৫. সাম্রাজ্যের অবক্ষয় (প্রায় ২০০ খ্রি. পূ. – ৩০০ খ্রি.)

সাম্রাজ্যের অবক্ষয় – আনুমানিক ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৩০০ খ্রিস্টাব্দ

মৌর্যযুগের অবসানের পর ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ কিছুটা অস্পষ্ট। অনেক রাজা, নানান যুগ, বহুপ্রকার মানুষ ও বিভিন্ন রাজবংশের জটিলতায় আচ্ছন্ন এই সময়। ঐতিহাসিক উপাদান খুঁজে বেড়াতে হয়েছে নানা জায়গা থেকে। এমনকি, সু-মা-চিয়েনের (Ssu-ma-chien) লেখা চীনের ইতিহাস থেকেও কিছু তথ্য সংগৃহীত হয়েছে। দক্ষিণ-ভারত ও উপকূল অঞ্চলের মানুষ যখন নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে তুলতে ব্যস্ত, উত্তর-ভারত তখন মধ্য- এশিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতার ঘূর্ণাবর্তে প্রবিষ্ট। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে এই উপমহাদেশ অনেকগুলো রাজনৈতিক অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে গেল এবং এক-একটি অঞ্চলের আকাঙ্ক্ষাও হলো এক-এক রকম। মনে হতে পারে, এই পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে কোনোরকম রাজনৈতিক যোগসূত্র অবশিষ্ট ছিল না। কিন্তু রাজনৈতিক ঘটনা যেমনই ঘটুক না কেন, একটা যোগসূত্র সত্যিই বজায় ছিল।

১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মৌর্যসাম্রাজ্যের ভগ্নাবশেষের উত্তরাধিকারী হলো সুঙ্গরা। এরা ছিল অজ্ঞাত এক ব্রাহ্মণবংশজাত। পশ্চিম-ভারতের উজ্জয়িনী অঞ্চল থেকে আগত শুঙ্গরা মৌর্যদের অধীনে কর্মচারী ছিল। শুঙ্গরাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা পুষ্যমিত্র শেষ মৌর্যরাজাকে হত্যা করে সিংহাসন অধিকার করলেন। বৌদ্ধ সূত্র থেকে জানা যায়, পুষ্যমিত্র বৌদ্ধদের ওপর অত্যাচার করেন তাদের উপাসনার স্থানগুলো, বিশেষত যেগুলো অশোকের তৈরি, ধ্বংস করে দেন। কিন্তু এ বর্ণনা অতিরঞ্জিত, কেননা এসময়ে বৌদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভগুলো নতুন করে নির্মিত হয়েছিল— তার প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য রয়েছে। অবশ্য পুষ্যমিত্র নিজে ব্রাহ্মণদের সমর্থক ছিলেন (এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই, কেননা তিনি নিজেও ছিলেন ব্রাহ্মণ)। তিনি দুবার অশ্বমেধ যজ্ঞও করেন।

শুঙ্গদের সর্বদাই যুদ্ধবিগ্রহে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। দাক্ষিণাত্যের উত্তরাংশের রাজ্যগুলোর সঙ্গেও যেমন লড়াই হয়েছে, তখন উত্তর-পশ্চিমে গ্রীক আক্রমণ আর দক্ষিণ-পূর্বে কলিঙ্গরাজ্যের সঙ্গেও যুদ্ধ চলেছে সমান তালে। প্রথমদিকে শুঙ্গদের অধীনে ছিল সমগ্র গাঙ্গেয় উপত্যকা ও উত্তর-ভারতের কিছু অংশ। কিন্তু ক্রমশ কয়েকটি অঞ্চলের ওপর থেকে প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ চলে গিয়ে কেবল রাজনৈতিক আনুগত্যের আশ্বাসই অবশিষ্ট রইল। ১০০ বছরের মধ্যেই শুঙ্গদের সাম্রাজ্য এসে ঠেকল কেবল মগধ অঞ্চলটুকুতে এবং এখানেও তাদের অস্তিত্ব শঙ্কাজনক হয়ে উঠল। শুঙ্গদের পর রাজত্ব পেল কাণ্বরা এবং তারা রাজত্ব করল ২৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। এদের রাজত্বেও ওই অনিশ্চিত অবস্থা চলতে লাগল প্রায় ৫০ বছর ধরে।

মগধের কাছে কলিঙ্গ সব সময়ই একটা উদ্বেগের কারণ ছিল। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর মধ্যভাগে রাজা খারবেলার নেতৃত্বে কলিঙ্গর উত্থান ঘটেছিল। উড়িষ্যার হাতিগুম্ফায় একটি দীর্ঘ শিলালিপি পাওয়া যায়। তার মধ্যে তাঁর জীনবৃত্তান্তও আছে। কিন্তু শিলালিপিটি এত ক্ষতবিক্ষত যে পড়তে গিয়ে নামের পাঠোদ্ধারে ভুল হতে পারে। খারবেলা ছিলেন জৈন। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাজ্যজয়ে তাঁর উৎসাহ ছিল এবং বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধজয়ও করেছিলেন। শোনা যায়, পশ্চিম দাক্ষিণাত্যের রাজাকে তিনি পরাজিত করেন, উত্তরের রাজগৃহ অধিকার করেন, মগধ জয় করেন ও উত্তর-পশ্চিমে গ্রীকদের আক্রমণ করেন। এছাড়া আরো দক্ষিণে পাণ্ড্যরাজ্যের কিছু কিছু অংশ দখল করে পাণ্ড্য রাজাদের প্রতি অসম্মান দেখানোর উদ্দেশ্যে গাধার সাহায্যে হলকর্ষণ করে আসেন। খারবেলা তাঁর শিলালিপিতে নন্দদের নির্মিত সেচ প্রণালীগুলোর কথা উল্লেখ করে এ বিষয়ে তাঁর নিজের কীর্তির জন্যে গর্বপ্রকাশ করেন। মৌর্যদের সম্পর্কে কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে শিলালিপির অস্পষ্ট অংশগুলোর মধ্যে হয়তো এ বিষয়ে কিছু লেখা ছিল। সম্ভবত অশোকের অভিযানের তিক্ত স্মৃতি তখনো কলিঙ্গবাসীদের মন থেকে মুছে যায়নি। এইসব যুদ্ধজয় ছাড়াও খারবেলা দাবি করেন, প্রজাদের উন্নতির জন্যে তিনি প্রচুর অর্থব্যয় করেছিলেন। শিলালিপির অলংকারবহুল ভাষা কিছুটা অতিরঞ্জন দোষে দুষ্ট বলে মনে হয়। আর রাজকীয় স্তুতিবাদ তো ছিলই। খারবেলার মৃত্যুর পর কলিঙ্গ আবার এক নিস্তরঙ্গ রাজ্যে পরিণত হলো।

উত্তর-পশ্চিম ভারতে আলেকজাণ্ডারের আক্রমণের পরেও গ্রীস ও ভারতবর্ষের মধ্যে তেমন কোনো যোগাযোগ হয়নি। বরং পরে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে ভারত-গ্রীক সম্পর্ক অনেক দৃঢ় হলো। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে যেসব গ্রীক রাজা সে সময়ে রাজত্ব করেছিলেন, তাঁদের বলা হতো ইন্দো-গ্রীক। ইরানে অ্যাকামেডিনদের রাজত্বে অবসান ૩ আলেকজাণ্ডারের মৃত্যুর পর ইরান ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোর রাজা হয়ে গেলেন আলেকজাণ্ডারের সেনাপতিরা। যখন সমগ্র অঞ্চলটি ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত হয়ে গেল, ব্যাকট্রিয়ার গ্রীক শাসকবৃন্দ ও পার্থিয়ার ইরানীয় শাসকরা সবচেয়ে বেশি সুবিধা আদায় করে নিলেন। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর মধ্যভাগে এঁরা সেলুসিড-নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে কার্যত স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনা শুরু করলেন।

প্রথমদিকে ব্যাকট্রিয়া ছিল বেশি শক্তিশালী। হিন্দুকুশ ও অকসাসের মধ্যবর্তী অঞ্চলে এক উর্বর ও প্রাকৃতিক সম্পদশালী অঞ্চলে অবস্থিত ছিল এই ব্যাকট্রিয়া রাজ্য। তাছাড়া, গান্ধার থেকে পারস্য যাবার রাস্তা ও সেখান থেকে কৃষ্ণসাগর ও গ্রীসে যাবার রাস্তায় যেতে হতো ব্যাকট্রিয়ার মধ্য দিয়েই। ব্যাকট্রিয়ার গ্রীক অধিবাসীরা এসেছিল অ্যাকামেডিনদের সময়ে (মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে)। তখন পারস্য সম্রাটরা গ্রীক দেশত্যাগীদের এখানে বসবাস করতে দিয়েছিলেন। ব্যাকট্রিয়ার মুদ্রাগুলো থেকে মনে হয়, এই রাজ্যের সঙ্গে গ্রীসের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল (যেমন, রাজা সোফাইটিসের মুদ্রাগুলো এথেন্সের ‘পেচক- মূর্তি’ সম্বলিত মুদ্রাগুলোর অনুকরণে তৈরি)। জমির উর্বরাশক্তি ও বাণিজ্যের সুবিধার জন্যে এখানে বড় বড় সম্পদশালী নগর গড়ে উঠল।

ব্যাকট্রিয়ার শাসনকর্তা ডায়োডোটাস সেলুসিড রাজা অ্যান্টিওকাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। অ্যান্টিওকাস আরো গুরুত্বপূর্ণ মধ্য-ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ব্যস্ত থাকায় এই বিদ্রোহ দমন করতে পারলেন না। সুতরাং ডায়োডোটাস স্বাধীন হয়ে গেলেন। সেলুসিড রাজারা ব্যাকট্রিয়াকে দমন করতে অসমর্থ হয়ে শেষপর্যন্ত এর স্বাধীন অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েছিলেন। আনুমানিক ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ডায়োডোটাসের প্রপৌত্রের সঙ্গে এক সেলুসিড রাজকুমারীর বিবাহ হয়। হিন্দুকুশ পর্বতমালা অতিক্রম করে এক নগণ্য ভারতীয় রাজ্য সুভগসেনকে পরাজিত করা ছাড়া সেলুসিড রাজা আর কোনো সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। তিনি সুভগসেনের কাছ থেকে অনেকগুলো হাতি ও অন্যান্য উপহার আদায় করেছিলেন।

২০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সুভগসেনের পরাজয়ের পর বোঝা গেল, উত্তর-পশ্চিম ভারত প্রায় অরক্ষিত। ইউথিডেমাসের (যিনি সেলুসিড রাজাকে হারিয়ে দেন) পুত্র ডিমেট্রিয়াস দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অভিযান শুরু করলেন। তিনি জয় করলেন আরাকোসিয়া ও পূর্ব গেড্রোসিয়া (বর্তমান দক্ষিণ-আফগানিস্তান ও মাকরান অঞ্চলগুলো)। দ্বিতীয় ডিমেট্রিয়াস আরো এগিয়ে এলেন। পাঞ্জাবে প্রবেশ করে সিন্ধু উপত্যকার মধ্য দিয়ে বদ্বীপ অঞ্চল ও তারপর কচ্ছ পর্যন্ত চলে এলেন। এইভাবে উত্তর-পশ্চিম ভারতে ইন্দো-গ্রীক রাজত্বের সূচনা হলো।

ইন্দো-গ্রীক রাজাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন মিনান্দার। তিনি বৌদ্ধগ্রন্থ ‘মিলিন্দ-পন্হো’ (রাজা মিলিন্দর প্রশ্ন) প্রসঙ্গেও বেশ পরিচিত। বইতে তাঁর নাম বলা হয়েছে— মিলিন্দ। বইটি হলো প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে বৌদ্ধধর্মের ওপর রাজা মিনান্দার ও বৌদ্ধ দার্শনিক নাগসেনের আলোচনার সংকলন। তারপরই মিনান্দার বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। মিনান্দার ইন্দো-গ্রীক শক্তিকে আরো দুর্ধর্ষ করে তুললেন। রাজ্যের সীমানাও বেড়ে চলল নানাদিকে। তার রাজত্বকাল ছিল ১৫৫-১৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। তাঁর অধিকারে ছিল সোয়াট উপত্যকার, হাজারা জেলা ও ইরাবতী (রাভি) নদী পর্যন্ত সমগ্র পাঞ্জাব। তাঁর মুদ্রা খুঁজে পাওয়া গেছে উত্তরে কাবুলে এবং দিল্লির কাছে মথুরায়। কিন্তু গাঙ্গেয় উপত্যকায় রাজ্যবিস্তারের চেষ্টা হয়েছিল। পাটলিপুত্রে না হলেও যমুনা অঞ্চলে, তিনি যে শুঙ্গদের আক্রমণ করেছিলেন, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়। মৃত্যুর পর তাঁর দেহ আগুনে পোড়ানো হয়। শোনা যায়, তাঁর জনপ্রিয়তা এত বেশি ছিল যে দেহাবশিষ্ট ভস্মের জন্যে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন শহরগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা লেগে যায়। অবশ্য সন্দেহ হয়, হয়তো গ্রীকরা এসব কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বুদ্ধদেবের মৃত্যুর কাহিনীর সঙ্গে মিনান্দারের মৃত্যুর কাহিনী মিশিয়ে ফেলেছেন।

ইন্দো-গ্রীকদের ইতিহাস রচনায় সাহায্য পাওয়া গেছে প্রধানত তাদের গ্রীক ও পরে ‘ব্রাহ্মী’ লিপিতে উৎকীর্ণ মুদ্রা থেকে। অনেক রাজার একই নাম ছিল এবং মুদ্রাগুলোর মধ্যেও তেমন পার্থক্য না থাকায় এই সাক্ষ্য অনেক সময়েই বিভ্রান্তিকর হয়ে পড়েছে। মিনান্দারের পর কোনো রাজার বদলে রাজপ্রতিনিধির শাসন চলল। তারপর এলো স্ট্র্যাটোর রাজত্বকাল। ওদিকে ইউক্রাটাইডিসের বংশের এক ধারা তখন ব্যাকট্রিয়ায় রাজত্ব করছিল। এই বংশের রাজারা গান্ধারের দিকে অগ্রসর হলেন। কাবুল পেরিয়ে তাঁরা তক্ষশিলা অধিকার করে ফেললেন। হিন্দুকুশ পেরিয়ে রাজ্যজয়ের ইচ্ছে ছিল পার্থিয়ার রাজাদেরও। কথিত আছে, রাজা প্রথম মিথ্রিয়েটিস (আনুমানিক ১৭১-১৩৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) নাকি তক্ষশিলা জয় করেন। কিন্তু তার তেমন বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না। সম্ভবত গ্রীকরাই তক্ষশিলার শাসক ছিল।

পশ্চিম-ভারতের বেসনগরে একটি স্তম্ভলিপি পাওয়া গেছে। এটির নির্মাতা ছিলেন বেসনগরের রাজার (সম্ভবত শুঙ্গবংশীয়) সভায় তক্ষশিলার রাজা অ্যান্টিয়ালকিডাস প্রেরিত দূত হেলিওডোরাস। ইনি বাসুদেবের (বিষ্ণুর আর এক নাম) ভক্ত ছিলেন। অর্থাৎ, গ্রীক হওয়া সত্ত্বেও ইনি হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তক্ষশিলা বেশিদিন ব্যাকট্রিয়ার রাজাদের হাতে রইল না।

উত্তর-পশ্চিমে গ্রীক রাজ্যগুলোর পতনের সময় আঘাত এলো ব্যাকট্রিয়া রাজ্যের ওপরই। মধ্য-এশিয়ার কয়েকটি যাযাবর উপজাতি এই রাজ্য আক্রমণ করল। এদের মধ্যে সিথিয়ান বা শকরাই ছিল প্রধান। এইসব উপজাতির পশ্চিমদিকে আগমনের কারণ ছিলেন চীনাসম্রাট শি হুয়াং তি। ইনিই হিউং-নু, উ- সুন ও ইয়েচি যাযাবর উপজাতিগুলোর আক্রমণ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর শেষার্ধে বিখ্যাত চীনের প্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন। এইসব যাযাবররা পশুচারণ করত এবং পশ্চিম-চীনের সমভূমিতে পশুর পাল নিয়ে আসত তৃণভূমির সন্ধানে। এক এক জায়গার পশুখাদ্য নিঃশেষিত হয়ে গেলে এরা আরো নতুন পশুচারণভূমির সন্ধান করত এবং তার সঙ্গে সঙ্গে অধিকতর সভ্য চীনাদের ধনসম্পত্তি লুটপাট করে আনত। কিন্তু চীনাপ্রাচীর নির্মাণের পর ওদের আর চীনে ঢোকবার উপায় রইল না। বিশেষত শি হুয়াং তি-র পর যে হান রাজবংশের শাসন শুরু হলো, সেই বংশের রাজারা প্রাচীরের প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা আরো সুদৃঢ় করে তুললেন। অতএব উপজাতিগুলো এবার দক্ষিণ ও পশ্চিমদিকে পা বাড়াল তিন প্রধান উপজাতির মধ্যে ইয়েং-চি-দের ভালো জমি ফেলে রেখে মহাদেশের অন্যপ্রান্তে পালিয়ে আসতে হলো। এরা দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। একদল— ছোট ইয়ে-চি-রা, উত্তর-তিব্বতে গিয়ে বসবাস শুরু করল। আর একদল— বড় ইয়ে-চি-রা, আরো পশ্চিমে আরাল সাগরের তীরে এসে ঘুরতে লাগল। এখানে তারা স্থানীয় অধিবাসীদের তাড়িয়ে দিল। এই অধিবাসীরাই হলো সিথিয়ান বা ভারতবর্ষে যাদের বলা হতো শক। এরপর শকরা, চলে এলো ব্যাকট্রিয়া ও পারথিয়ায়। একজন চীনা ভ্রমণকারী লিখেছেন, ১২৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আরাল সাগর অঞ্চলে শকদের বদলে ইয়ে-চি-রা বসবাস শুরু করে দিয়েছে। দ্বিতীয় মিথ্রিডেটিসের রাজত্বকালের স্বল্প সময়টুকুর পর পার্থিয়া আর শকদের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারল না। ৮৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর শকরা পার্থিয়া দখল করে নিল। তারপর কোয়েটার কাছে বোলান গিরিপথের মধ্য দিয়ে শকরা সিন্ধু উপত্যকায় হু হু করে এগিয়ে এসে একেবারে পশ্চিম-ভারতে এসে থামল। তাদের প্রভাব বিস্তৃত ছিল দিল্লির কাছে মথুরা থেকে উত্তরে গান্ধার পর্যন্ত।

ভারতের ইতিহাসে শকদের আগমনের পর থেকে বিভিন্ন চীনাসূত্রে মধ্য- এশিয়ার ঘটনাবলি যে উল্লেখ পাওয়া যায়, তা ভারতীয় ইতিহাসের পক্ষেও অর্থবহ হয়ে উঠেছে। তার সঙ্গে আছে শকদের তৈরি মুদ্রা ও লিপির সাক্ষ্য ও সাহিত্যকর্মের মধ্যে পাওয়া উল্লেখ। ভারতের প্রথম শকরাজা হলেন মোয়েস বা মোগা (আনুমানিক ৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)— ইনি গান্ধারে শক ক্ষমতা বিস্তার করলেন। পরবর্তী শক রাজা আজেস উত্তর-ভারতের শেষ গ্রীকরাজা হিপোস্ট্রেটসকে আক্রমণ করলেন। পরবর্তী আর এক রাজা গন্ডোভারনেসের নাম বিখ্যাত হয়ে আছে সেন্ট টমাসের সূত্রে। শোনা যায়, সেন্ট টমাস ইজরায়েল থেকে রাজা গন্ডোফারনেসের সভায় এসেছিলেন। সেক্ষেত্রে গন্ডোফারনেসের শাসনকাল দাঁড়াচ্ছে প্রথম শতাব্দীর প্রথমার্ধে। ইরানের সেলুসিড ও অ্যাকামেনিড শাসনব্যবস্থার সঙ্গে শক শাসন-ব্যবস্থার সাদৃশ্য আছে। রাজ্য কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। প্রদেশগুলোর সামরিক শাসনকর্তাদের বলা হতো ‘মহাক্ষাত্ৰপ’। এই প্রদেশগুলো আরো ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করা ছিল নিম্নপদস্থ শাসনকর্তাদের অধীনে। শাসনকর্তারা রীতিমতো স্বাধীনতা ভোগ করতেন— এঁরা শুধু যে নিজেদের ইচ্ছামতো সংবৎ-এ অনুশাসন খোদাই করতেন তাই নয়, নিজেদের নামে মুদ্রাও জারি করতেন। শকরাজারা গ্রীক ও অ্যাকিমেনিডদের অনুকরণে ‘মহারাজ’, ‘রাজাধিরাজ’ ইত্যাদি মহিমান্বিত উপাধি ব্যবহার করতেন। শকরা কিছুকাল আগেও ছিল যাযাবর। কাজেই সাম্রাজ্য গঠনের রাজসিক চেষ্টা হয়তো তাদের বিভ্রান্ত করেছিল।

ইয়ে-চি-রা আরো একবার এসে শকদের তাড়িয়ে দিয়েছিল। চীনা ঐতিহাসিক সু-মা-চিয়েন লিখেছেন, ইয়ে-চি-দের প্রধান কুজুল কদফিসেস একবার ইয়ে-চি-দের পাঁচটি উপদলকে সম্মিলিত করে উত্তরের পর্বতশ্রেণী অতিক্রম করে ভারতবর্ষে ঢুকে পড়লেন। হার্মেয়ুসকে হারিয়ে তিনি কাবুল ও কাশ্মীর করায়ত্ব করলেন। খ্রিস্ট্রীয় প্রথম শতাব্দীর মধ্যভাগের পরই ৮০ বছর বয়সে কুজুলের মৃত্যু হলো। তাঁর ছেলে বিম কদফিসের রাজা হলেন। এর স্বর্ণমুদ্রাগুলোতে যথেষ্ট ভারতীয় প্রভাব দেখা যায়। কিন্তু কুজুলের মুদ্রাগুলো রোমান ‘দীনারি’ মুদ্রার অনুকরণে তৈরি ছিল, কেননা রোমের সঙ্গে বাণিজ্য শুরু হবার ফলে ওই মুদ্রাগুলো মধ্য-এশিয়ায় তখন প্রচলিত হয়েছিল।

এই প্রথম দুই রাজার সঙ্গে পরবর্তী রাজা কণিষ্কর সম্পর্ক নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। মথুরার কাছে কুষাণ রাজাদের যেসব প্রতিমূর্তি পাওয়া গেছে, তার মধ্যে কণিষ্কের একটি মূর্তি দেখে বেশ বোঝা যায় যে, তাঁর পূর্বপুরুষরা মধ্য-এশিয়া থেকে এসেছিলেন। হয়তো প্রথম দুই রাজার সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ কোনো সম্পর্ক ছিল না। তাঁর সময়েরই কুষাণ রাজবংশের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল এবং উত্তর-ভারতের সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ইতিহাসে কুষাণ যুগে রীতিমতো উল্লেখযোগ্য। কণিষ্ক সিংহাসনে বসেছিলেন ৭৮ থেকে ১৪৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে। এই ৭৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে নতুন একটা বর্ষগণনা শুরু হয়, যার নাম শকাব্দ।* সম্ভবত শকরাই তা শুরু করেছিল। কুষাণাদের রাজ্য দক্ষিণে এসেছিল সাঁচী পর্যন্ত, পূর্বে বারাণসী আর মথুরাকে ধরা হতো প্রায় দ্বিতীয় রাজধানীরূপে। প্ৰকৃত রাজধানী পুরুষপুষ ছিল আধুনিক পেশোয়ারের কাছে।

[* বর্তমান ভারত সরকার গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডারের সঙ্গে শকাব্দকেও অনুসরণ করেন।]

কুষাণদের রাজত্বকালে উত্তর-ভারতের ইতিহাসের সঙ্গে মধ্য-এশিয়ার ইতিহাস ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। বৌদ্ধরা কণিষ্ককে তাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে গণ্য করত এবং তাঁর রাজত্বকালেই চতুর্থ বৌদ্ধ সম্মেলন হয়েছিল যাতে বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন তত্ত্ব ও নীতির আলোচনা হয়। এরপর বৌদ্ধদের কাজকর্মে নতুন একটা জোয়ার এলো এবং মধ্য-এশিয়া ও চীনে বৌদ্ধ প্রতিনিধিদল পাঠানো হলো। কণিষ্ক সম্ভবত মধ্য-এশিয়ার কোনো এক যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যান। চীনা বিবরণ থেকে জানা যায়, একজন কুষাণ রাজা হানবংশীয় এক রাজকুমারীকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। তাঁকে সেনাপতি পান চাও মধ্য-এশিয়া অভিযানের সময় প্রথম শতাব্দীর শেষভাগে যুদ্ধে পরাজিত করেন। কাহিনীটি যদি সত্যি হয় তাহলে উল্লিখিত রাজা ছিলেন বিম অথবা কণিষ্ক। কণিষ্কর উত্তরাধিকারীরা আরো ১৫০ বছর ধরে রাজত্ব করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের শক্তি হ্রাস হয়ে আসছিল ক্ৰমে ক্রমে। পারস্যের ঘটনাবলি আবার উত্তর-পশ্চিম ভারতের ওপর তার ছায়া ফেলল। ২২৬ খ্রিস্টাব্দে আর্দাশীর পার্থিয়ানদের উচ্ছেদ করে সাসানিয়ান রাজত্বের সূচনা করলেন। তাঁর উত্তরাধিকারী পেশোয়ার ও তক্ষশিলা জয় করলেন তৃতীয় শতাব্দীর মধ্যভাগে। কুষাণ রাজারা সাসানিয়ানদের সামন্তবর্গে পরিণত হলো।

কুষাণদের আগমনের ফলে শকরা আরো দক্ষিণে কচ্ছ অঞ্চল, কাথিওয়াড় ও মালবে সরে যেতে বাধ্য হয়েছিল। পশ্চিম-ভারতের এইসব অঞ্চলে তারা পঞ্চম শতাব্দীর গোড়ার দিক পর্যন্ত ছিল। দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যভাগে রুদ্রদামনের নেতৃত্বে একটি নাটকীয় উত্থান ছাড়া এরা বাকি সময়টা চুপচাপই ছিল। কণিষ্কের মৃত্যুর পর কুষাণদের দুর্বলতার সুযোগে শকরা আবার শক্তিশালী হয়ে উঠতে লাগল। রুদ্রদামন ছিলেন কচ্ছ অঞ্চলের অধিবাসী। জুনাগড়ে একটি দীর্ঘ শিলালিপি (সংস্কৃত ভাষায় এটিই সর্বপ্রাচীন গুরুত্বপূর্ণ শিলালিপি) থেকে তাঁর কীর্তিকলাপ সম্বন্ধে জানা যায়। ১৫০ খ্রিস্টাব্দের এই শিলালিপিতে মৌর্য বাঁধটির সংস্কারের কথা (বাঁধটি এখনো ব্যবহারযোগ্য অবস্থায় আছে) পাওয়া যায়। তাছাড়া নর্মদা উপত্যকার অভিযান, সাতবাহন রাজাদের (নর্মদার দক্ষিণে) বিরুদ্ধে অভিযান, রাজস্থানের যৌধের উপজাতিদের বিরুদ্ধে রুদ্রদামনের যুদ্ধজয়ের কথা শিলালিপিতে রাজার প্রতি প্রচুর স্তুতিবাদসহ লেখা আছে। রুদ্রদামনের বর্ণনাপ্রসঙ্গে লেখা আছে :

তিনি তাঁর হস্ত যথার্থভাবে উত্তোলন করে দৃঢ়ভাবে ধর্মকে সংশ্লিষ্ট করেছেন। তিনি ব্যাকরণ, সংগীত, তর্কবিদ্যা ও অন্যান্য বিজ্ঞানে প্রচুর অধ্যয়ন ও স্মৃতিশক্তির জন্য বিখ্যাত। অশ্ব, হস্তী ও রথচালনা এবং অসিযুদ্ধ ও মুষ্টিযুদ্ধে তিনি বিশেষ পারদর্শী।… তিনি যুদ্ধে কৌশলী ও দ্রুতগতি। তিনি নিয়মিত উপহার ও সম্মান প্রদান করেন ও অশোভন আচরণ পরিহার করেন। নজরানা, খাজনা ও অন্যান্য ধরনের ন্যায়সংগত অর্থ আগমনে তাঁর রাজকোষ সততই স্বর্ণ, রৌপ্য, মূল্যবান প্রস্তরখণ্ড ও ফিরোজা পাথর ও অন্যান্য মহার্ঘ সামগ্রীতে পরিপূর্ণ থাকে। তাঁর রচিত গদ্য ও কাব্য সহজ, মিষ্টি, সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর। তাঁর শব্দচয়ন ও অলংকার যথাযথ। তাঁর সুগঠিত দেহ বিভিন্ন লক্ষণে শোভিত। তাঁর উচ্চতা ও স্বাস্থ্য, কণ্ঠস্বর, বর্ণ, চলনরীতি, উদ্দীপনা ও শক্তি— সবই সুলক্ষণযুক্ত। তিনি ‘মহাক্ষাত্ৰপ’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। বহু স্বয়ংবর সভায় রাজকুমারীরা তাঁর গলায় বরমাল্য অর্পণ করেছেন। [১]

রুদ্রদামনের মৃত্যুর পর শকরা রাজনৈতিক গুরুত্ব হারাল এবং তাদের উত্থান হয় আবার চতুর্থ শতাব্দীর একেবারে শেষদিকে।

খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে সাতবাহন বংশের উত্থানের সঙ্গে ভারতবর্ষের ইতিহাসে উত্তর-দাক্ষিণাত্য পূর্ণভাবে ভূমিকা গ্রহণ শুরু করল। বর্তমান নাসিককে ঘিরে দাক্ষিণাত্যের উত্তর পশ্চিমাংশে এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠা ঘটে। এদের অস্ত্র রাজবংশও বলা হয়। সম্ভবত অন্ধ্র থেকেই এদের আগমন। পূর্ব উপকূলের কৃষ্ণা ও গোদাবরী নদী দুটির বদ্বীপ অঞ্চল থেকে এরা গোদাবরী নদীর তীর দিয়ে পশ্চিমদিকে চলে আসে। তারপর মৌর্য-সাম্রাজ্যের পতনের পরবর্তী বিশৃংখলার সুযোগে এরা নিজেদের আধিপত্য স্থাপন করে। আবার অন্যমতে, এই রাজপরিবার এসেছিল পশ্চিমদিক থেকেই। তারপর পূর্বদিকেও নিজেদের রাজ্যবিস্তারের পর নিজেদের নামানুসারে অঞ্চলটির নাম দেয় অন্ধ। মৌর্য আমলেও অন্ধ্রের কথা শোনা গেছে। অশোক তার শিলালিপিতে অন্ধ্রদের তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত এক উপজাতি বলে বর্ণনা করেছেন

সম্ভবত সাতবাহনরা মৌর্যদের শাসনকার্যে নিযুক্ত ছিল। পুরাণে আছে, দাক্ষিণাত্যে শুঙ্গদের যা শক্তি অবশিষ্ট ছিল, সাতবাহনরা তাও ধ্বংস করে দেয়।

বাণিজ্য পথ

কিন্তু পশ্চিম-দাক্ষিণাত্য বেশিদিন সাতবাহন রাজাদের দখলে রইল না। সাতকর্ণীয় মৃত্যুর পর সাতবাহনরা শোচনীয়ভাবে যুদ্ধে হেরে গেল। পশ্চিমদিক থেকে তাড়া খেয়ে তারা পালিয়ে এলো পূর্ব উপকূলে। কিন্তু এটা তাদের পক্ষে একরকম ভালোই হলো, কেননা তারা অন্ধ্র অঞ্চলে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছিল। এরপর যখন তারা আবার পশ্চিমাঞ্চল অধিকার করল, তখন দাক্ষিণাত্যের পূর্ব থেকে পশ্চিম উপকূল পর্যন্ত সবটাই তাদের দখলে। সাতকর্ণী যাদের সবচেয়ে ভয় করতেন, সেই শকরাই সাতবাহনদের কাছ থেকে পশ্চিমাঞ্চল অধিকার করে নিয়েছিল। শকরা নর্মদার উত্তরাঞ্চলে পশ্চিম-ভারতে অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। নাসিক অঞ্চলে শক রাজা নহপানার কয়েকটি মুদ্রা পাওয়া যাওয়ায় মনে হয়, প্রথম শতাব্দীতে শকরা এই অঞ্চল অধিকার করেছিল। কিন্তু বোধহয় এর অল্পদিন পরই সাতবাহনরা অঞ্চলটি আবার দখল করে নেয়। কেননা, নহপানার মুদ্রার ওপরই গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর ছাপ মারা আছে। এই রাজাই শকদের তাড়িয়ে দিয়ে এই অঞ্চলে সাতবাহনদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।

দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথমার্ধে গৌতমীপুত্র ও তাঁর ছেলে বাশিষ্ঠী পুত্রের রাজত্বকালে সাতবাহন রাজা বিশিষ্ট ক্ষমতারূপে গণ্য হয়েছিল। বাশিষ্ঠীপুত্রের আর একটি নাম ছিল শ্রীপুলুমবি। টলেমী ভারতের ভূগোল রচনার সময় বৈথানার (পৈথান) রাজা যে সিরোপলেমাইওসের উল্লেখ করেছেন, তিনি হয়তো পুলুমরি ছাড়া কেউ নন। উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে দাক্ষিণাত্য এখন সম্পর্কের সেতু হয়ে দাঁড়াল। এই যোগসূত্র কেবলমাত্র রাজনৈতিক নয়, বাণিজ্য ও নতুন চিন্তা বিনিময়েরও। বাশিষ্ঠীপুত্র লিখে গেছেন, গৌতমীপুত্র শকদের উচ্ছেদ করে ক্ষত্রিয়গর্ব খর্ব করেছিলেন। তিনি চারটি বর্ণের মধ্যে মিশ্রণও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তাঁর আমলে দ্বিজদের স্বার্থরক্ষার্থে নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। হিন্দু আইনবিদরা শকদের মিশ্রবর্ণ ও গ্রীকদের শ্রেণিচ্যুত ক্ষত্রিয় বলে বর্ণনা করেছেন। মিশ্রবর্ণ আখ্যা দেওয়াটা রীতিমতো মর্যাদা-হানিকর ছিল। গৌতমীপুত্রের মা একটি শিলালিপিতে লিখেছেন, গৌতমীপুত্র শক, যবন ও পল্লবদের বিতাড়িত করেছিলেন।* সম্ভবত এই শেষবারই গ্রীকদের সম্পর্কে কোনো গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ পাওয়া গেল।

[* ভারতীয় সূত্রে ‘যবন’ অথবা ‘যোন’ অর্থে গ্রীকদেরই বোঝানা হয়েছে। সেই সঙ্গে, পশ্চিম এশিয়া থেকে আগত অন্যান্য বিদেশিদেরও। শব্দটি এসেছে ‘আয়োনিয়া’ থেকে। ‘পল্লব’রা ছিল পার্থিয়ান।]

সাতবাহন ও শকদের বিরোধ মেটানোর উদ্দেশ্যে একটা বৈবাহিক সম্পর্কের ব্যবস্থা হয় ও সাতবাহন রাজার সঙ্গে রুদ্রদামনের কন্যার বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল।* কিন্তু তা সত্ত্বেও সম্পর্কের বোধহয় তেমন উন্নতি ঘটেনি। কারণ রুদ্রদামন বলেছেন, তিনি সাতবাহন রাজাকে দুবার যুদ্ধে পরাজিত করেন, কিন্তু নিকট সম্পর্কের জন্যে তাঁকে উচ্ছেদ করেন নি। রুদ্রদামনের মৃত্যুর পর সাতবাহনরা শকদের ওপর আবার আক্রমণ শুরু করল এবং তারা কিছুটা সাফল্যও লাভ করে। দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষভাগে সাতবাহনদের রাজ্য পশ্চিম উপকূলে কাথিওয়াড়, কৃষ্ণার বদ্বীপ অঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বে মাদ্রাজ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কিন্তু এই বিরাট রাজ্য বেশিদিন থাকেনি। পরবর্তী শতাব্দীতেই সাতবাহনের পতন শুরু হয় ও স্থানীয় শাসনকর্তারা উত্তরোত্তর অধিক শক্তি সঞ্চয় করে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে শুরু করে।

[* সাতবাহনরা নিজেরা চতুর্বর্ণের মধ্যে মিশ্রণ বন্ধ করা নিয়ে গর্ব করত, কিন্তু শক পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে তাদের আপত্তি হয়নি। বর্ণভেদের শাস্ত্রগত রীতি ও কার্যত প্রচলিত প্রথা— এই দুইয়ের মধ্যে কতটা প্রভেদ ছিল, এটি তার আর একটা উদাহরণ।]

ইন্দো-গ্রীক রাজারা ও কুষাণরা পারস্য ও চীনের রাজাদের অনুকরণে নিজেরা বড় বড় উপাধি গ্রহণ করে নিজেদের রাজাকে বৃহৎ সাম্রাজ্য বলে আখ্যা দিতে চাইতেন। উপাধিগুলোর মধ্যে ছিল ‘মহারাজাধিরাজ’ ও ‘দৈবপুত্র’। এছাড়া আগের রাজাদের দেবতার সম্মান দিয়ে তাঁদের নামে মন্দির প্রতিষ্ঠারও রীতি ছিল। সাত-বাহনরা অবশ্য এই ধরনের মহিমময় উপাধি গ্রহণ করেননি। এর কারণ বোধহয় এই যে, স্থানীয় শাসনকর্তা ও রাজাদের ওপর সাতবাহনদের আধিপত্য একেবারে সার্বভৌম ছিল না। সাতবাহনদের শাসন-ব্যবস্থার মধ্যেও এ ব্যাপারটা লক্ষ্য করা যায়। ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত না করে রাজকর্মচারীদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হয়েছিল। সাতবাহনদের রাজা কয়েকটি ছোট ছোট প্রদেশে বিভক্ত ছিল। ‘অমাত্য’ নামে একজন অসামরিক শাসনকর্তা ও ‘মহাসেনাপতি’ নামে একজন সামরিক শাসনকর্তার অধীনে ছিল একটি প্রদেশ। মহাসেনাপতিদের রাজপরিবারের বিবাহ করারও অনুমতি ছিল, সম্ভবত এই আশায় যে তার ফলে রাজবংশের প্রতি তাদের আনুগত্য বাড়বে। কাউকে কাউকে নিজস্ব মুদ্রা তৈরিরও অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। সাতবাহনদের পতনের পর শাসনকর্তারা স্বাধীনভাবে শাসন শুরু করল। রাজকর্মচারীদের তত্ত্বাবধানে স্থানীয় লোকরাই সাধারণত শাসনকার্য চালাত। উত্তরে এবং দাক্ষিণোত্যেও গ্রামই ছিল ক্ষুদ্রতম শাসনকেন্দ্র। যতদিন গ্রাম থেকেই বেশি রাজস্ব ও সৈন্য সংগ্রহ হতো, ততদিন এই ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়নি। রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাব পড়ত কেবল প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও তাদের কর্মচরীদের ওপর।

খ্রিস্টপূর্ব শেষ শতাব্দীর অবসানের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ ভারত প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ঐতিহাসিক যুগে প্রবেশ করেছিল। সমসাময়িক ঘটনালির পুঁথিগত বর্ণনাও পাওয়া যায়। অশোকের শিলালিপিতে দক্ষিণ-ভারতের রাজ্যগুলোর (অর্থাৎ আধুনিক অন্ধ্রপ্রদেশে, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক ও কেরালা) উল্লেখ আছে। যেমন চোল, পাণ্ড্য, সতিয়পুত্র ও কেরলপুত্র। প্রথম দুটি পূর্ব উপকূলে শক্তিশালী ছিল ও তামিল সংস্কৃতির উত্থানের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তামিলভাষা ছিল দ্রাবিড়গোষ্ঠীর প্রধান ভাষা। তামিল সংস্কৃতির কেন্দ্র ছিল মাদ্রাজ শহরের ঠিক দক্ষিণের অঞ্চল। এখনো তার নাম তামিলনাদ, অর্থাৎ তামিলদের দেশ। কলিঙ্গরাজ খারবেলা দাবি করেছেন তিনি তামিল মিত্রশক্তিকে পরাজিত করেন। এই মিত্রশক্তি অর্থে চোল, পাণ্ড্য, চের (বা কেরল) এবং তাদের সমস্ত রাজ্যগুলোকে বোঝানো হয়েছে। পাণ্ড্যরাজ্যের সঙ্গে খারবেলা বাণিজ্যিক সম্পর্কও স্থাপন করেছিলেন। মেগাস্থিনিস লিখেছেন, হেরাক্লিসের কন্যা পাণ্ড্যরাজ্য স্থাপন করেছিলেন। হয়তো তখনকার সময়ে দক্ষিণ ভারতে যে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ প্রচলিত ছিল এটি তারই উদাহরণ। এই সমাজব্যবস্থা পশ্চিম উপকূলের কেরলে আজ থেকে ৫০ বছর আগে পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। মেগাস্থিনিসের মতে, পাণ্ড্যদের রানীর ছিল ৫শত রণহস্তী ৪ হাজার অশ্বারোহী ও ১৩ হাজার পদাতিক।

এই সময়কার ঐতিহাসিক বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে ‘সঙ্গম’ সাহিত্যে- এগুলো এক ধরনের কাব্যসংকলন। বেদের সঙ্গে কিছু সাদৃশ্য থাকলেও এগুলোর উৎপত্তি সম্পূর্ণ ধর্মীয় ছিল না। কথিত আছে যে, শতাব্দী আগে তামিলনাদের রাজধানী মাদুরা শহরে পর পর তিনটি সমাবেশ (সঙ্গম) বসেছিল। দাক্ষিণাত্যের সমস্ত কবি ও চারণকবিরা এই সভায় যোগ দিয়েছিলেন এবং তাঁদের সমবেত প্রচেষ্টায় ‘সঙ্গম’ সাহিত্যের উদ্ভব হয়। প্রথম সমাবেশে নাকি দেবতারাও হাজির ছিলেন। তবে এই সমাবেশের রচিত কোনো কবিতা পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয় সমাবেশে প্রথম তামিল ব্যাকরণ ‘তোল কাপ্পিয়াম’ রচিত হয়েছিল বলে শোনা যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি রচিত হয়েছিল অনেক পরে। তৃতীয় সমাবেশে ২ হাজার কবিতার আটটি কাব্যগ্রন্থ সংকলিত হয়েছিল। এগুলো এখনো আছে।

চের, চোল ও পাণ্ড্যরা অবিরতভাবে পারস্পরিক যুদ্ধে ব্যাপৃত ছিল। তার ফলে কবিরা অনেক বীরত্বগাথা রচনার সুযোগ পেয়েছিলেন। এই তিনটি রাজ্য মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল বলা হয়। বেশ বোঝা যায়, এইকথা বলে রাজ্যগুলোর প্রাচীনত্ব প্রমাণের চেষ্টা হয়েছে। পরে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে তামিলরা নৌবাহিনী গঠন করে সিংহল আক্রমণ করে। তারা অল্পদিনের জন্যে উত্তর-সিংহল অধিকার করে রাখতেও কৃতকার্য হয়েছিল। তারপর ওই শতাব্দীর শেষার্ধে সিংহলরাজ ‘দুখগামিনী’ তামিলদের বিতাড়িত করেন। কয়েকজন চের রাজারও উল্লেখ পাওয়া যায়, কিন্তু তাঁদের সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। একজন রাজার অবশ্য বীর বলে খ্যাতি হয়েছিল, এঁর নাম ছিল নেডুজেরাল আদান। তবে তিনি হিমালয় পর্যন্ত সমস্ত ভূভাগ জয় করেছিলেন বলে যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা নিতান্তই কবিকল্পনা। তিনি রোমান নৌবাহিনীকেও নাকি পরাজিত করেছিলেন। এটি প্রকৃতপক্ষে বোধহয় রোমান বাণিজ্য জাহাজের ওপর আক্রমণের উল্লেখ।

প্রথমদিকে চোল রাজাদের (প্রথম থেকে চতুর্থ খ্রিস্টীয় শতাব্দ) কথাসাহিত্যে অনেক উল্লেখ আছে। করিকাল, যাঁকে বলা হয়েছে ‘দগ্ধপদ-বিশিষ্ট মানুষ’, বেন্নীতে একটি বিরাট যুদ্ধজয় করেছিলেন। তাঁর প্রতিপক্ষ ছিল পাণ্ড্য, চের ও আরো ১১ জন গৌণরাজার এক সম্মিলিত বাহিনী। ক্রমশ চোলরা অন্যদের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠার পর উপদ্বীপ অঞ্চলের দক্ষিণাংশের পূর্ব থেকে পশ্চিম উপকূলব্যাপী সমগ্র অঞ্চলে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো। দুই উপকূলেই বন্দর গড়ে ওঠায় স্থলপথের এ প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত বাণিজ্যপথ তৈরি হলো। রোমানদের সঙ্গেও ব্যবসা শুরু হলো। চোলদের আর এক বীর রাজা ছিলেন নলঙ্গিল্লী। তিনি অনেকবার বৈদিকমতে যজ্ঞ ও বলিদান করেছিলেন বলে খ্যাত। বৈদিক আচার-প্রক্রিয়া সম্পর্কে তামিলদের একটা অদ্ভূত আকর্ষণ ছিল! বিশেষত, কয়েকটি পূজাপদ্ধতির কথা উল্লেখ করা যায়। যুদ্ধ ও উর্বরতার দেবতা মুরুগণকে তারা ভাত ও রক্ত উৎসর্গ করত। তার সঙ্গে চলত পানোন্মত্ত উচ্ছৃঙ্খল নৃত্যানুষ্ঠান। নেতৃত্ব দিতেন প্রধান পুরোহিতরা। এছাড়া বীর যোদ্ধাদের কথা স্মরণ করে ‘বীর প্রস্ত’ স্থাপন করে সেগুলোও পূজা করা হতো সহজ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে।

তামিলদের পক্ষে এটা ছিল উপজাতীয় গোষ্ঠীতন্ত্রের যুগ থেকে রাজ্যগঠনে উপনীত হবার সময়। রাজা ছিলেন যুদ্ধনায়ক এবং তাঁর দায়িত্ব ছিল তাঁর রাজ্য বা উপজাতিকে সুরক্ষিত রাখা।* গ্রামীণ পরিষদ বা স্থানীয় সভার কথা উল্লিখিত থাকলেও সেগুলো সম্পর্কে ভালোভাবে কিছু জানা যায়নি। পরে তামিল সংস্কৃতিতে এগুলো ও মন্দিরগুলো একটা বড় শক্তিকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। প্রতিটি গ্রামে এগুলোই হয়ে উঠল গ্রামের সমস্ত কাজকর্মের কেন্দ্রস্থল।

[* রামায়ণে রামের সিংহল আক্রমণের সময় অনেক জন্তু-জানোয়ারের সাহায্য নেবার কথার উল্লেখ আছে। বানরদের সর্দার হনুমানও তার মধ্যে একজন। বলা যেতে পারে, এই উপদ্বীপ অঞ্চলের উপজাতিগুলোর বিভিন্ন ‘টোটেম’ প্রতীকের স্মৃতি হিসেবেই এসব জন্তু-জানোয়ারের কল্পনা এসে পড়েছে।]

কিন্তু তা সত্ত্বেও তামিলরা বেশিদিন পশুচারণ ও কৃষিযুগে পড়ে থাকেনি। তারা ক্রমশ একটি জটিলতর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে চলল। আর্য-সংস্কৃতির প্রভাবই এই পরিবর্তনের জন্যে দায়ী। বংশ পরম্পরায় রাজপরিবার, রাজস্ব আদায় ব্যবস্থার উদাহরণ এবং অন্যদিকে সারা উপমহাদেশে যে সামগ্রিক বাণিজ্যিক উন্নতি ঘটেছিল, দক্ষিণ-ভারতের পক্ষে তার প্রভাবমুক্ত থাকা সম্ভব ছিল না। সাতবাহনদের অভ্যুদয়ের পর উত্তর ও দক্ষিণাংশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলো ও বাণিজ্যও বেড়ে উঠল। দাক্ষিণাত্যের পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলে রোমানদের সঙ্গে বাণিজ্য শুরু হওয়ায় দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাইরের জগতের যোগাযোগের সূচনা হলো। রোমান নাগরিকদের তামিল নথিপত্রে ‘যবন’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এই একই শব্দ সংস্কৃত নথিপত্রে গ্রীকদের সম্পর্কে ব্যবহৃত হয়েছে।

সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে বহু বাণিজ্যপথ চালু হয়ে গেল। তার মধ্যে কয়েকটি চলে গেল সুদূর মধ্য-এশিয়া ও পশ্চিম-এশিয়াতেও। নদীর উপত্যকার মধ্য দিয়ে বড় বড় রাস্তা তৈরি হয়ে গেল। নদীর ওপর সেতু ছিল না, কিন্তু পারাপারের ব্যবস্থা ছিল। তবে কেবল গ্রীষ্ম ও শীতের শুকনো দিনগুলোতেই যাতায়াত সম্ভব ছিল। বর্ষার সময় বিশ্রাম। যাত্রীরা বড় বড় দলে যাতায়াত করত নিরাপত্তার খাতিরে। বলদ, অশ্বতর ও গর্দভের পিঠে মালপত্র যেত। মরুভূমিতে যেত কেবলই উট। উপকূল বাণিজ্যের প্রসার হয়েছিল আর স্থলপথের চেয়ে জলপথে যাতায়াত ছিল কম ব্যয়সাপেক্ষ। অর্থশাস্ত্রে জলপথে ও স্থলপথে ভ্রমণের সুবিধা নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা আছে। সমুদ্রভ্রমণের খরচ অল্প হলেও জলদস্যুর ভয় ও জাহাজ চুরির আশংকায় প্রকৃত ব্যয় হয়ত বেশিই পড়ত। উপকূলের কাছ দিয়ে যাতায়াত করলে মাঝ সমুদ্রের পথের চেয়ে তা অনেক নিরাপদ হতো। বাণিজ্যের সুযোগও বেশি থাকত। কৌটিল্য উপদেশ দিয়ে গেছেন, দক্ষিণাঞ্চলে যেসব পথ খনি অঞ্চল দিয়ে গেছে সেগুলোই ব্যবহার করা উচিত। কেননা, এগুলো জনবহুল জায়গার মধ্য দিয়ে গেছে বলে নিরাপদ। এ থেকে বোঝা যায়, এসময় খনির কাজ, বিশেষত মূল্যবান পাথর বা ধাতুর জন্যে খনি প্রচুর পরিমাণেই ছিল। বৌদ্ধসূত্রে অধিক ব্যবহৃত কয়েকটি পথের উল্লেখ আছে। যেমন, শ্রাবস্তী ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চল পর্যন্ত পথ, শ্রাবস্তী ও রাজগৃহের মধ্যে উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল পর্যন্ত পথ এবং পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমাঞ্চলে যাবার বিভিন্ন পথ। রাজস্থান মরুভূমি সচরাচর পরিহার করা হতো। পশ্চিম সমুদ্রে বাণিজ্যের জন্যে ভারুকচ্ছ বন্দর (বর্তমান ব্রোচ) ছিল প্রধান। আগের শতাব্দীগুলোতে বাভেরুর (ব্যাবিলন) সঙ্গেও এই বন্দরের যোগাযোগ ছিল।

পশ্চিম-এশিয়া ও গ্রীসের সঙ্গে স্থলবাণিজ্য হতো উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের শহরগুলোর মধ্য দিয়ে। যেমন, তক্ষশিলা। মৌর্যরা তক্ষশিলা থেকে পাটলিপুত্ৰ পর্যন্ত একটি রাজপথ নির্মাণ করেছিল। বিভিন্ন শতাব্দী ধরে এই পথটি বারবার পুনর্নির্মিত হয়েছে এবং এখন এটি গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড নামে পরিচিত। পাটলিপুত্রের সঙ্গে স্থলপথে যোগ ছিল তমলুক বন্দরের। এই বন্দর থেকে বর্মা, পূর্ব উপকূলের বিভিন্ন জায়গা ও সিংহল যাওয়া চলত। মৌর্যযুগের পর দক্ষিণ- ভারতের সঙ্গে স্থলপথগুলোর উন্নতি হলো প্রধানত ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনেই। নদী-উপকূল ও উপত্যকা অঞ্চল দিয়েই রাস্তাগুলো তৈরি হয়েছিল। কেননা, দাক্ষিণাত্যের পার্বত্য মালভূমির মধ্যদিয়ে পূর্ব-পশ্চিম পথ সহজ ছিল না। ব্যতিক্রম ছিল কেবল গোদাবরী ও কৃষ্ণানদীর উপকূলবর্তী পথগুলো। মালভূমি ছিল ঘন অরণ্যে আচ্ছন্ন। সুতরাং নদী-উপত্যকার জনবহুল ও পরিষ্কার অঞ্চলের তুলনায় বিপদসংকুল। পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে রাস্তাগুলো অবশ্য ব্যবহার হতো। যেমন, পশ্চিম-মালাবার উপকূল থেকে একটি রাস্তা কইম্বাটোরের কাছে ওরকম একটি গিরিখাতের মধ্য দিয়ে চলে গিয়েছিল কাবেরীর সমভূমি অঞ্চলে পেরিয়ে পণ্ডিতচেরীর কাছে পূর্ব-পশ্চিম বাণিজ্যকেন্দ্র আরিকামেডুতে।

পশ্চিমগামী সবচেয়ে প্রচলিত রাস্তাটি ছিল তক্ষশিলা ও কাবুলের মধ্যে। কাবুল থেকে বিভিন্ন দিকে কয়েকটি রাস্তা চলে গিয়েছিল। উত্তরদিকে রাস্তাটি গিয়েছিল ব্যাকট্রিয়া অক্সাস, কাপিয়ান সাগর ও ককেসাসের মধ্য দিয়ে কৃষ্ণসাগরের দিকে। দক্ষিণগামী আর একটি রাস্তা গিয়েছিল কান্দাহার ও হিটার থেকে একবাটানা (পরে হামাদান) পর্যন্ত, আর সেখান থেকে রাস্তা গিয়ে পৌঁছেছিল পূর্ব-ভূমধ্যসাগরীয় কয়েকটি বন্দরে। পার্সিপোলিস ও সুসা থেকে কান্দাহার পর্যন্ত আর একটি বড় রাস্তা ছিল। আরো দক্ষিণে পারস্য উপসাগর ও টাইগ্রিসের মধ্য দিয়ে সেলুসিয়া পর্যন্ত আর একটি রাস্তা ছিল। পশ্চিমদিকের বন্দরগামী জাহাজগুলো অনেক সময় পারস্য উপসাগরের উপকূলরেখা ধরে ব্যাবিলনে চলে আসত। অথবা, আরবসাগর অতিক্রম করে এডেন বা সোকোট্রা বন্দরে আসত। এখান থেকে আবার যাওয়া যেত লোহিত সাগর বর্তমান সুয়েজ বা তার কাছাকাছি একটি জায়গায় মালপত্র নামানো হতো। তারপর স্থলপথে সেগুলো পাঠানো হতো আলেকজান্দ্রিয়ায় এবং এটি ছিল ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোর পণ্য আমদানি-রপ্তানির জন্যে মাল রাখার কেন্দ্র। বেরেনিস (Berenice) ও মিওস হর্মাস (Myos Hormus, লোহিত সাগরের ওপর) থেকে এর চেয়ে বেশি ব্যবহৃত একটি স্থলপথ প্রচলিত ছিল নীলনদ পর্যন্ত এবং সেখান থেকে নদীপথে বেয়ে আলেকজান্দ্রিয়ায় পণ্যসামগ্রী নিয়ে আসা হতো।

ভারতবর্ষ থেকে পশ্চিম-এশিয়ায় যাবার পথ ছিল দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল। গ্রীষ্মকালে আরব সাগরের ওপর দিয়ে যে উত্তর-পূর্ব মৌসুমী হাওয়া বইত, আরবরাই প্রথম তার সদ্ব্যবহারের কথা চিন্তা করেছিলেন। উপকূলের কাছ দিয়ে জাহাজ চালানোর চেয়ে মাঝসমুদ্র দিয়ে মৌসুমী হাওয়ার সাহায্যে জাহাজ চালালে গতি দ্রুততর হতো। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোর অন্যান্য ব্যবসায়ীরাও মৌসুমী বায়ুর খবর জেনে যায়। আগে বলা হতো, জাহাজ চালানোর জন্যে অনুকূল বায়ুর ব্যবহার আবিষ্কার’ করেছিলেন হিপ্পালাস। কিন্তু আরবরা যখন ব্যাপারটা আগেই জেনে গিয়েছিল, নতুন করে আবিষ্কারের কথা আর ওঠে না। লোহিতসাগর থেকে যেসব জাহাজ ছাড়ত, তারা অনুকূল বায়ুর জন্যে অপেক্ষা করে তবেই যাত্রা শুরু করত। আবার, শীতকালে বিপরীতগামী বায়ুর সাহায্যে জাহাজগুলো ভারত থেকে ফিরে যেত।

ভারত ও পশ্চিম-এশিয়ার মধ্যে-ব্যবসা-বাণিজ্যের ফলে আফগানিস্তানের সঙ্গে যথেষ্ট সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান হয়েছিল। পূর্ব-আফগানিস্তানকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে উত্তর-পশ্চিম ভারতের অংশ বলেই মনে করা হতো। মধ্য-এশিয়ার বিভিন্ন উপত্যকা ও মরুদ্যানের মধ্য দিয়ে বহু রাস্তা তৈরি হয়ে যাওয়ায় এই অঞ্চলেও ব্যবসা শুরু হয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে একটি পরে ‘প্রাচীন রেশমপথ’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। কাশগড়, ইয়ারখন্দ, খোটান, মিরান, কুচি, কারাশার, তুরকান ইত্যাদি নতুন নতুন জায়গায় ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করতে লাগল। ক্রমে ক্রমে ব্যবসায়ীদের দেখাদেখি এখানে বৌদ্ধ প্রচারকদেরও আগমন ঘটল। মধ্যএশিয়ার এইসব কাজকর্মের ফলে চীনের সঙ্গে যোগাযোগের উন্নতি হলো। কুষাণ রাজারা ভারত ও চীনের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে গিয়েছিলেন। বৌদ্ধ প্রচাকরা এই সম্পর্ক নিকটতর করলেন। চীন থেকে রেশমের নানান জিনিসপত্র ভারতে আসা শুরু হওয়ায় বাণিজ্যিক সম্পর্কও স্থাপিত হয়ে গেল। রোমান অধিকৃত অঞ্চলগুলো থেকে ব্যবসায়ীরা গোবি মরুভূমি পর্যন্ত পণ্যসম্ভার নিয়ে আসত। চীন ও রোমের মধ্যে বিলাস,ব্যের বাণিজ্য ভারতীয় ব্যবসায়ীরা মধ্যস্থ হয়ে নিজেদের সুবিধামতো লাভ গুছিয়ে নিল। রোমের সঙ্গে বাণিজ্য করার পরই ভারতীয়রা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও ব্যবসা করতে আগ্রহী হয়ে উঠল। বর্মা ও আসামের মধ্য দিয়ে স্থলপথে যাতায়াতের চেষ্টা তেমন ফলপ্রসূ হয়নি। তারচেয়ে সমুদ্রপথই বেশি সুবিধাজনক বলে দেখা গেল। সুবর্ণদ্বীপের (জাভা, সুমাত্রা ও বালি দ্বীপপুঞ্জের ব্যবসায়ীদের অভিযানের যেসব কাহিনী পাওয়া যায় তা থেকে বোঝা যায়, এইসব যাতায়াত অত্যন্ত বিপদসংকুল ছিল। কিন্তু রোমানদের কাছে মশলা বিক্রি করে যা লাভ হতো তাতে এইসব ক্ষতি পুষিয়ে যেত। এই কারণেই পূর্বদিকে প্রথম বাণিজ্য শুরু করেছিল ভারতের পশ্চিম ও দক্ষিণ উপকূলের বণিক সম্প্রদায়।

***

১. রুদ্রদমনের জুনাগড় শিলালিপি। এপিগ্রাফিয়া ইণ্ডিকা, অষ্টম। পৃ. ৩৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *