১৪. দাক্ষিণাত্যের অনুক্রমণ (প্রায় ১৩০০–১৫২৬ খ্রি.)

দাক্ষিণাত্যের অনুক্রমণ – আনুমানিক ১৩০০-১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ

দিল্লির সুলতানরা সারা ভারতবর্ষব্যাপী সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে সমর্থ জানি বটে, কিন্তু দাক্ষিণাত্য অঞ্চলে সুলতানী আক্রমণের প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল সারা উপদ্বীপে। চতুর্দশ শতাব্দীতে দিল্লির সুলতানদের দক্ষিণ-ভারত জয় করার চেষ্টা ও ব্যর্থতা, উভয়ের যৌথ ফলস্বরূপ দক্ষিণ-ভারতের কতকগুলো রাজ্যের উত্থান হলো। উত্তর-ভারত ও দক্ষিণ-ভারতের বিভিন্ন ঘটনাবলির পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া এযুগে আগের চেয়ে অনেক বেশি লক্ষ্য করা যায়। এই প্রতিক্রিয়া যে কেবল রাজনৈতিক ঘটনাবলিতেই সীমাবদ্ধ ছিল, এমন নয়। দুই অঞ্চলেই সমাজের বিভিন্ন স্তরে একই ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে লাগল এবং তাদের মধ্যে কিছুটা অভিন্নতাও লক্ষ্য করা যায়।

দক্ষিণ-ভারতে আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে দিল্লির সুলতানরা ত্রয়োদশ শতাব্দীতে কয়েকটি সামরিক অভিযান করেছিলেন। এর ফলে দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলোর মধ্যে একটা অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়। অসংখ্য ছোট ছোট রাজ্য আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং প্রতিবারই তাদের আশঙ্কা হয় যে, তুর্কীরা তাদের গ্রাস করবে। কিন্তু চতুর্দশ শতাব্দীতে এই ভয়ের মনোভাব কেটে গেল। কেননা, ততদিনে সুলতানী শাসনের দুর্বলতা প্রকট হয়ে পড়েছে। এই সময় দাক্ষিণাত্যের তুর্কী প্রশাসক বিদ্রোহ ঘোষণা করে বাহমনী বংশের সূচনা করলেন। এই বংশ পরবর্তী ২০০ বছর ধরে দাক্ষিণাত্যের উত্তরাঞ্চল শাসন করেছিল। এর কয়েক বছর আগে আরো দক্ষিণে স্বাধীন বিজয়নগর রাজ্য স্থাপিত হয়েছিল। এই রাজ্যেই আগে হোয়সল বংশ রাজত্ব করেছিল। দাক্ষিণাত্যের উপদ্বীপ অঞ্চলে সুলতানী আক্রমণের ব্যর্থতা বিজয়নগর রাজ্য স্থাপনে পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছিল।

বাহমনী ও বিজয়নগর রাজ্যের মধ্যের সীমানা ছিল কৃষ্ণানদী, দাক্ষিণাত্যের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের রাজ্যগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ লেগেই থাকত। চতুৰ্দশ শতাব্দীতে আবার সংঘর্ষ শুরু হলো কৃষ্ণা ও তুঙ্গভদ্রা নদী দুটির মধ্যবর্তী উর্বরা রায়চুর দোয়াব অঞ্চল নিয়ে। এই অঞ্চলটি খনিজ সম্পদেও সমৃদ্ধ ছিল। এছাড়াও ছিল গোলকুণ্ডার হীরকখনি। দক্ষিণ-ভারতের ইতিহাসে চতুর্দশ, পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত দেখা যায় এই দ্বন্দ্ব; আর দেখা যায় যে সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলো ক্রমাগত আনুগত্য বদল করে গেছে।

এইসব শতাব্দীতেই ভারতে একটা নতুন ঘটনার সূত্রপাত হয়— বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ইউরোপীয়দের ভারত আক্রমণ। আরবরা পশ্চিম এশিয়ায় যেসব বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করেছিল, শুধু তার বাণিজ্যই তারা একচেটিয়া করে নেয়নি, তাদের বাণিজ্য প্রসারিত ছিল আরো পূর্ব দিকে, সেখানেও ছিল তাদের একচেটিয়া কর্তৃত্ব। আরবদের এই একচেটিয়া অধিকার ইউরোপীয় বণিকদের অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিভিন্ন ইউরোপীয় পর্যটক ও ব্যবসায়ী (যেমন, মার্কোপোলো, নিকলো কল্টি, অ্যাথানেসিয়াস, নিকিতিন ও ডুয়ার্তে বারনেসা) এশিয়া ভ্রমণ করে গিয়ে এখানকার নানা কাহিনী প্রচার করেছিলেন, সেসব কাহিনী ইউরোপীয় বণিকদের লোভ জাগিয়ে তুলেছিল। এরপর ইউরোপীয় বণিকরা বুঝল যে, আরব দালালদের বাদ দিয়ে যদি তারা সরাসরি এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য করতে পারে তাহলে তাদের লাভ হবে অনেক বেশি। এরপর এদের ব্যবসায়ী এবং প্রধানত রোমান-ক্যাথলিক ধর্মপ্রচারকরা ভারতে আসতে শুরু করল। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে পর্তুগাল এ ব্যাপারে সবচেয়ে অগ্রণী ছিল। ব্যবসা ও ধর্মান্তকরণ দুই ব্যাপারেই পর্তুগীজরা আগ্রহের সঙ্গে এগিয়ে গেল। পর্তুগীজ নাবিকরা এশিয়ায় পৌঁছানোর নতুন সমুদ্রপথ আবিষ্কার করে উত্তমাশা অন্তরীপ দিয়ে। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে পর্তুগীজরা মালাবার উপকূলে এসে পৌঁছল এবং এখানে যে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল তা পর্তুগীজরা শেষ পর্যন্ত বজায় রেখেছিল। এখানে আসবার কয়েক বছরের মধ্যেই পর্তুগীজরা এশিয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আরবদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠল।

এই যুগের প্রথম থেকেই দক্ষিণ-ভারত ইসলামের সঙ্গে সুপরিচিত ছিল। অষ্টম শতাব্দী থেকেই আরব ব্যবসায়ীরা পশ্চিম উপকূলে বসবাস শুরু করে এবং ক্রমশ ব্যবসার প্রয়োজনে দেশের অভ্যন্তরেও ঢুকে পড়েছিল। তবে তখনো উপকূল অঞ্চলে আরবদের ঘনবসতি ছিল এবং তাদের বলা হতো ‘মোপলা’ বা মালাবার মুসলিম। স্থানীয় অধিবাসীরা এদের বেশ পছন্দ ও সম্মান করত। ঘোড়া আমদানির ব্যাপারে আরবদের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল এবং তারা এই ব্যবসায়ে যথেষ্ট লাভও করত। একেকটি ঘোড়ার দাম ছিল ২২০ দীনার, এবং বছরে ১০ হাজার ঘোড়া আমদানি হবার ফলে এদের অবস্থা ছিল বেশ সমৃদ্ধ। ইবনে বতুতা চতুর্দশ শতাব্দীতে মালাবারে এসে সেখানকার উপকূল অঞ্চলে অসংখ্য মসজিদ ও এক সমৃদ্ধিশালী মুসলিম সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করে গেছেন। উত্তর-ভারতের তুলনায় দক্ষিণ-ভারতে মুসলিম সংস্কৃতির প্রসার হয়েছিল অনেক নিরুপদ্রবভাবে। কেননা, এখানকার আরবরা কেবল ব্যবসায় নিয়েই মাথা ঘামত, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলে তাদের আগ্রহ ছিল না। তাছাড়া নিজেদের স্বতন্ত্রতা বজায় রাখা নিয়েও তাদের কোনো উৎসাহ দেখা যায়নি।

মালিক কাফুরের নেতৃত্বে তুর্কী সেনাবাহিনী ১৩১১ খ্রিস্টাব্দে মাদুরা পর্যন্ত অগ্রসর হয়। এর ফলে দক্ষিণ-ভারতে একটা অনিশ্চিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কিন্তু মাদুরা থেকে সুলতানের সেনাবাহিনী চলে যাবার পর কুইলনের (মালাবার ) শাসক পূর্ব-উপকূল পর্যন্ত সেনাবাহিনী নিয়ে এগিয়ে এলেন এবং কাঞ্চীপুরম পর্যন্ত সমগ্র এলাকা জয় করে নিলেন। এর ফলে সুলতানী আক্রমণের বিরুদ্ধে দক্ষিণ- ভারতের পক্ষে আত্মরক্ষা করা সহজ হয়ে গেল। কিন্তু একথা ভাবলে ভুল হবে যে, দাক্ষিণাত্যের রাজাদের এই একতা মুসলমানদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্যেই জন্ম নিয়েছিল। কুইলনের শাসক আরব বাণিজ্যের ওপর এত নির্ভরশীল ছিলেন যে এধরনের সম্ভাবনার কথা চিন্তাও করা যায় না। বরং বলা যায়, দাক্ষিণাত্যের রাজাদের ঐক্য ছিল তুর্কী-বিরোধী। তুর্কীরা দক্ষিণ-ভারতে এসেছিল বিদেশি হিসেবে, এবং এই আশংকার সৃষ্টি হয়েছিল যে তারা উপকূল বাণিজ্যে বাধা সৃষ্টি করবে। সেক্ষেত্রে দক্ষিণ-ভারতের সবকটি উপকূলবর্তী রাজ্যই বিপদগ্রস্ত হতো। কাঞ্চীর উত্তরাঞ্চলে সুলতানী সেনাবাহিনীর প্রস্থানের পর নতুন রাজ্যগঠনের সুযোগ ছিল এবং বাহমনী ও বিজয়নগর রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতারা এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিলেন।

বাহমনী রাজ্যের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও পুরনো রীতিরও পুনরাবৃত্তি হলো। এখানেও প্রদেশ-শাসক বিদ্রোহী হয়ে সুলতানীর থেকে স্বাধীন হয়ে গেলেন। সুলতান দাক্ষিণাত্য শাসনের জন্যে জাফর খাঁকে দৌলাতাবাদে প্রাদেশিক শাসক নিযুক্ত করে গিয়েছিলেন। জাফর খাঁ কিছুদিন পরই স্বাধীনতা ঘোষণা করে ‘বাহমন শাহ’ উপাধি গ্রহণ করলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল রাজ্যের সীমানা দক্ষিণে মাদুরা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া। কিন্তু অন্ধ্রে বরঙ্গল রাজ্য ও তুঙ্গভদ্রার দক্ষিণ তীরে বিজয়নগর রাজ্য দুটির প্রতিষ্ঠা হওয়ায় ওই উচ্চাশা সফল হয়নি।

বরঙ্গলের বিরুদ্ধে বাহমনী সুলতান এক সামরিক অভিযান পাঠানোর পর বরঙ্গল রাজ্য বাৎসরিক কর দিতে সম্মত হয়। কিন্তু পরে এই কর আদায় নিয়ে ক্রমাগত সংঘর্ষের সৃষ্টি হলো। বরঙ্গল রাজ্য কর আদায় দিতে অসম্মত হলে বাহমনী সুলতান সৈন্য পাঠাতেন। এছাড়া বিজয়নগর রাজ্যকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করতে গিয়েও বাহমনী রাজারা যুদ্ধবিগ্রহে জড়িয়ে পড়তেন। এই যুদ্ধবিগ্রহে জড়িত হতো পাশাপাশি ছোট ছোট রাজ্যগুলোও, যারা নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী বড় রাজ্যগুলোর প্রতি আনুগত্য বদল করে চলত। সুলতানীর চেয়ে উপকূল অঞ্চলের রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাহমনী রাজ্যের সংঘর্ষ হয়েছিল বেশি।

বরঙ্গলে সামরিক অভিযান আগে পাঠানোর সময় সুলতানী সেনাবাহিনী দুই স্থানীয় রাজপুত্র হরিহর ও বুক্কাকে বন্দী করে নিয়ে যায়। দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে রাজপুত্রদের ইসলামে রূপান্তরিত করা হলো। তারপর তাদের দাক্ষিণাত্যে পাঠিয়ে দেওয়া হলো সুলতানের প্রতিনিধি হিসেবে সুলতানীর কর্তৃত্ব স্থাপন করার জন্যে। এ-কাজে রাজপুত্ররা সফল হলেও তাঁদের লোভ হলো নিজেদেরই স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করার। এরপর ১৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে হরিহর হস্তিনাবতী (আধুনিক হামপি) রাজ্যের রাজা হয়ে বসলেন। এই রাজ্য থেকেই বিজয়নগর রাজ্যের জন্ম হয়েছিল। এরপর দুই ভাই একটা উল্লেখযোগ্য কাজ করলেন। তা হলো, তাঁরা আবার হিন্দুধর্মে ফিরে এলেন। রাজ্য-জয়ের চেয়েও এ-কাজটা বেশি কঠিন ছিল। কেননা, ইসলামে ধর্মান্তরের পর তাঁরা জাতিচ্যুত হয়ে পড়েছিলেন। হিন্দুধর্মে নিয়মে এরপর আর হিন্দুধর্মের মধ্যে ফিরে আসার কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু ওই অঞ্চলের এক সর্বজনশ্রদ্ধেয় ধর্মীয় নেতা বিদ্যারণ্য দুই ভাইকে আবার হিন্দুধর্মে গ্রহণ করলেন। উপরন্তু তিনি একথাও বললেন যে, হরিহর স্থানীয় দেবতা বিরূপাক্ষের প্রতিনিধি। দৈবসম্মতির ওপর আর কোনো প্রশ্ন উঠতে পারে না। হরিহর কার্যত যে কোনো হিন্দু রাজার মতোই রাজত্ব করেন এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্যে তাঁর মর্যাদা নিয়ে কেউ কোনো কথা তুলতে সাহস পায়নি।

বিজয়নগরের রাজারা প্রথমদিকের এই ধর্মীয় সমস্যার কথা জানতেন এবং এই কারণেই হয়তো ধর্মপ্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করে এঁরা ধর্মীয় নেতাদের সন্তুষ্ট রাখতে চাইছিলেন। বলা হয়, বিজয়নগর রাজ্যের উত্থান হলো দাক্ষিণাত্যে হিন্দুদের পুনরুত্থান। কিন্তু রাজারা পুরনো মন্দিরের সংস্কার ও নতুন মন্দির নির্মাণ করলেও সাধারণভাবে কোনো মুসলমান বিরোধী মনোভাব প্রচার করেননি। হিন্দু রাজ্যগুলো মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে কোনো মৈত্রী চুক্তি করেনি এবং বিজয়নগরের রাজারা নিজেদের স্বার্থে আঘাত লাগলে হিন্দুরাজ্য আক্রমণ করতও কোনো দ্বিধা করেননি। ছোট ছোট হিন্দু রাজ্যগুলোর বিরুদ্ধে বিজয়নগর রাজ্য প্রায়ই যুদ্ধযাত্রা করেছে। যেমন, ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে হোয়সল রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরই বিজয়নগর দাক্ষিণাত্যের প্রধান রাজ্য হয়ে দাঁড়ায়।

হামপির কাছে হরিহর বিজয়নগর শহরটি পরিকল্পনা ও নির্মাণ করেন। ১৩৪৩ খ্রিস্টাব্দে বিজয়নগরই রাজ্যের রাজধানী হয়ে ওঠে এবং রাজ্যের নামও হয় রাজধানীর নামানুসারে। হরিহরের রাজ্য ছিল শত্রুবেষ্টিত: অন্ধ্ররাজাদের রাজ্য, উপকূলবর্তী রাজ্যগুলো এবং পরে উত্তরদিকের বাহমনী রাজ্য। উত্তরে বাহমনীদের সঙ্গে ক্রমাগত সংঘর্ষের ফলে স্থায়ী শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার সুব্যবস্থা প্রয়োজন হয়ে পড়ল। সেজন্য প্রচুর অর্থেরও দরকার ছিল। রাজস্ব আদায় বাড়াতে হলো। সেজন্যে জঙ্গল কেটে নতুন নতুন জায়গায় বসতি স্থাপন করতে হলো। এছাড়া ভূমিরাজস্ব আদায়ের পদ্ধতিরও অনেক উন্নতি করা হলো। সেচের জন্যে বড় বড় পুকুর ও নদীর ওপর বাঁধ তৈরি করা হলো। এ-কাজে যথেষ্ট কারিগরী জ্ঞানেরও প্রয়োজন ছিল। বাড়তি রাজস্ব ব্যয় করে সেনাবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করা হলো। বিদেশ থেকে ঘোড়া আমদানি করা হলো এবং পেশাদার তুর্কী সৈনিকদের বিজয়নগরের সেনাবাহিনীতে যোগদানে উৎসাহ দেওয়া হলো। রাজকীয় নিয়মিত সৈন্যের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হলো এবং ‘ফিউডাল’ ধরনের খাজনা আদায়ের ওপর তীক্ষ্ণতর নজর রাখা হলো।

বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের মধ্যে সংঘর্ষ ছিল অনিবার্য। ১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বিরোধের উপলক্ষ ছিল রায়চুর দোয়াব। প্রতিবারের যুদ্ধের ফলাফল অনুযায়ী রাজ্যের সীমানাও পরিবর্তিত হতে লাগল। বিজয়নগর ১৩৭০ খ্রিস্টাব্দে মাদুরা জয় করে রাজ্যের দক্ষিণ-সীমান্ত সুদৃঢ় করল। কিন্তু পূর্ব দিকের উড়িষ্যা ও বরঙ্গল রাজ্য দুটিকে নিয়ে সমস্যা দেখা দিল। গোয়া জয় করে সামরিক দিক থেকে বিজয়নগরের সুবিধা হলো এবং গোয়ার বাণিজ্যকেন্দ্র থেকে রাজস্ব আদায়ও বেড়ে গেল। বিজয়নগর পূর্ব উপকূল অঞ্চল জয় করতে পারলে রাজ্যের সীমানা দুইদিকে উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে যেত এবং কেবল উত্তরদিকের সীমানা রক্ষা করলেই প্রতিরক্ষা সমস্যা মিটে যেত। বাহমনীরাও আর দক্ষিণের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে উৎপাত করতে পারত না।

পঞ্চদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাহমনীরা রাজ্যের আভ্যন্তরীণ আন্তঃপ্রাদেশিক সম্পর্কের ব্যাপারে একটি নতুন নীতি স্থির করল। অনেকটা রাজ্যের মন্ত্রী মামুদ গবনের চেষ্টাতেই এটা সম্ভব হলো। এতদিন রাজ্যের উত্তরপ্রান্তে মালোয়া থেকে আক্রমণের যে আশঙ্কা ছিল, গুজরাটের সহায়তায় সেই আশঙ্কার নিরসন হলো। এর ঠিক পরেই গবন বিজয়নগরের হাত থেকে গোয়া কেড়ে নিলেন এবং সেখানকার বাণিজ্যের রাজস্বও বাহমনী রাজকোষে আসতে লাগল। পূর্ব-উপকূলে উড়িষ্যার সঙ্গে যুদ্ধেও বিজয়নগর সুবিধা করে উঠতে পারল না। কিছুকালের জন্যে উড়িষ্যা কাবেরী বদ্বীপ অঞ্চল পর্যন্ত রাজ্যের সীমানা বিস্তৃত করে ফেলেছিল। এরপর সিংহাসন দখল নিয়ে গণ্ডগোল বেধে গেল। শেষ পর্যন্ত ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে সালুব বংশ সিংহাসন অধিকার করল।

আভ্যন্তরীণ গোলযোগের জন্যে বাহমনী রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক বিশৃঙ্খলা চলছিল। গবন তা দূর করার চেষ্টা করতে গিয়ে নিজেই প্রাণ হারালেন এবং বাহমনী রাজ্যেরও পতন ঘনিয়ে এলো। বাহমনী রাজ্যের মুসলমান ওমরাহরা দুইদলে বিভক্ত ছিলেন। একদিকে ছিল ‘দক্ষিণী’ অর্থাৎ ধর্মান্তরিত মুসলিম ও স্থায়ীভাবে বসবাসকারী বিদেশিরা এবং অন্যদিকে ছিল ‘পরদেশি’ অর্থাৎ নবাগত বিদেশি ও অস্থায়ী চাকুরিরত বিদেশিরা। দ্বিতীয় দল অনেক বেশি করিৎকর্মা ছিল এবং নানাকাজে সাফল্য অর্জন করছিল। এর ফলে প্রথম দল দ্বিতীয় দলের ওপর অসন্তুষ্ট ছিল। এরপর প্রথম দলের লোকেরা দ্বিতীয় দলের লোকেদের অহেতুকভাবে হত্যা করতে শুরু করল। গবনকেও ‘পরদেশি’ মনে করা হতো এবং তাঁর ক্ষমতা খর্ব করার একমাত্র উপায় হিসেবে তাঁকেও হত্যা করা হলো। ১৪৮১ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে হত্যা করে প্রথম দল রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করল। পরের বছর সুলতানের মৃত্যু ঘটল এবং এক নাবালক সুলতানকে ক্ষমতায় বসিয়ে প্রথম দল রাজ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরো দৃঢ় করে ফেলল।

দক্ষিণী ও পরদেশি দলের এই ঝগড়া সামান্য গোষ্ঠীগত বিরোধ ছিল না, এরপর বাহমনী রাজ্যে যে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হলো, তার ফলে রাজ্যের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে উঠল। প্রাদেশিক শাসনকর্তারা ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠল এবং কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে গেল। বিজয়নগরের সেনাবাহিনীর বারংবার আক্রমণের ফলে বাহমনীদের অবস্থা আরো সঙ্গীন হয়ে উঠল। এরপর ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে বাহমনী রাজ্য ভেঙে পাঁচটি নতুন রাজ্য গঠিত হলো— বিজাপুর, গোলকোণ্ডা, আহমেদনগর, বিদর ও বেরার।

বাহমনী রাজ্যের সঙ্গে দিল্লির সুলতানীর নানা বিষয়ে সাদৃশ্য ছিল। দুই রাজ্যেরই প্রধান আয় ছিল ভূমিরাজস্ব। রাজস্বের হিসেব ও আদায় নিয়েই শাসনবিভাগ ব্যস্ত থাকত। রাজ্যটি চারটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। প্রাদেশিক শাসনকর্তারা রাজস্ব আদায় করতেন ও নির্দিষ্ট সংখ্যক সৈনিক রাজাকে সরবরাহ করতেন। শাসকর্তারা সামরিক ও অসামরিক পদে লোক নিয়োগ করার ও অধিকারী ছিলেন। এর ফলে শাসনকর্তারা প্রদেশগুলোকে প্রায় নিজস্ব এলাকা বলেই মনে করতেন। ক্রমাগত যুদ্ধের জন্যে সৈনিক সরবরাহের জন্যে রাজা এইসব শাসনকর্তার ওপর নির্ভর করতেন এবং প্রাদেশিক শাসন নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। যুদ্ধের সময় চাকুরির বদলী বা কেন্দ্রীয় পরিদর্শন ইত্যাদি বন্ধ থাকত। এইভাবেই বাহমনী রাজ্যের পতন ঘনিয়ে আসছিল।

মন্ত্রী গবনের মৃত্যুর পরই বাহমনী রাজ্যের পতন শুরু হলো। কিন্তু বিজয়নগরের পক্ষে ওই সময়ই ছিল সবচেয়ে গৌরবের কাল। বিজয়নগরে তখন রাজা ছিলেন কৃষ্ণদেব রায় (১৫০৯-১৫৩০)। রায়চুর দোয়াব দখলের জন্যে বাহমনীরা ১৫০৯ খ্রিস্টাব্দে শেষবার চেষ্টা করে। কিন্তু কৃষ্ণদেব রায় তাদের তাড়িয়ে নিয়ে একেবারে বাহমনী রাজ্যের কেন্দ্রস্থলে এসে উপস্থিত হলেন। এরপরই বাহমনী বংশের রাজত্বকাল শেষ হয়ে যাবার কথা কিন্তু কৃষ্ণদেব সুলতানকে আবার মসনদে বসিয়ে এলেন। তিনি বুঝেছিলেন যে, সুলতান থাকলে প্রাদেশিক শাসনকর্তারা সহজে স্বাধীনতা ঘোষণা করবে না। দুর্বল বাহমনী রাজ্যের চেয়ে চারটি ছোট ছোট স্বাধীন রাজ্যের সম্ভাবনা বিজয়নগরের পক্ষে মঙ্গলজনক ছিল না। বাহমনী সুলতানও বুঝলেন যে, তাঁর প্রধান খুঁটি কৃষ্ণদেব রায়। অতএব বিজয়নগর আক্রমণের আর প্রশ্নই ওঠে না। এইভাবে কৃষ্ণদেব রায়ের আমলে এই স্থিতাবস্থা বজায় রইল। কিন্তু পরবর্তীকালে এই নীতির পরিণাম ভালো হয়নি। বাহমনী রাজ্যের জায়গায় যে পাঁচটি নতুন রাজ্য গড়ে উঠেছিল, তারা বিজয়নগরের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।

উড়িষ্যার বিরুদ্ধে এক চমকপ্রদ সামরিক অভিযান করে কৃষ্ণদেব রায় পূর্বউপকূল জয় করে নেন, পশ্চিম-উপকূলে পারস্পরিক সহযোগিতার নীতি অনুযায়ী তিনি পর্তুগীজদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখেছিলেন। ঘোড়ার ব্যবসা পর্তুগীজদের হাতে এসে যাবার ফলে কৃষ্ণদেব রায় ঘোড়ার জন্যে পর্তুগীজ ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন; আবার বিজয়নগরের সমৃদ্ধির ওপরই দক্ষিণ-ভারতের পর্তুগীজ বাণিজ্য নির্ভরশীল ছিল। পর্তুগীজরা বারংবার গুজরাট ও বাহমনী রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কৃষ্ণদেব রায়কেও টেনে আনবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তিনি কিছুতেই এতে রাজী হননি। তাঁর কাছে পর্তুগীজরা ছিল ঘোড়ার জোগানদার। তিনি তাদের সঙ্গে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তে চাননি।

উত্তর-দাক্ষিণাত্যের পাঁচটি রাজ্য বিজয়নগর আক্রমণের সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। সুযোগ এলো ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে, তাদের সম্মিলিত আক্রমণে বিজয়নগর পরাজিত হলো। কিন্তু এই ঘটনা তাদের অজ্ঞাতসারে পরে তাদের নিজেদেরও সর্বনাশ ডেকে এনেছিল। যুদ্ধবিগ্রহে দক্ষিণ-ভারত তখন পরিশ্রান্ত। উত্তর-ভারতে নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটেছে। মোগল সম্রাটরা তখন দক্ষিণ-ভারত আক্রমণের উদ্যোগ করছেন।

এইসব রাজ্যের সীমান্ত অঞ্চলের রাজ্যগুলো নিজেদের অনিশ্চিত অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল। মালাবার উপকূলে হিন্দু ও মুসলমান শাসকদের অধীনে এরকম কয়েকটি রাজ্য ছিল। এরা বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এদের মধ্যে কালিকট রাজ্যের জামেরিন ছিলেন সবচেয়ে শক্তিশালী। তাঁরা নিজেদের কেরালার প্রাচীন পেরুমল বংশোদ্ভূত বলে দাবি করতেন। কালিকটে বাণিজ্যপণ্য এসে জমা হতো পূর্ব ও পশ্চিম এশিয়া থেকে। যেমন— ইয়েমেন, পারস্য, মালদ্বীপ, সিংহল, জাভা ও চীন। পর্তুগীজরা আসবার পর উপকূলবর্তী ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটল। বিপরীত উপকূলের পাণ্ড্যরাজ্য তখন একটা অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে চলছিল। অন্য রাজা বারবার পাণ্ড্যরাজ্য জয় করে নিত এবং আবার কিছুকাল পরে রাজ্যটি স্বাধীন হয়ে যেত। পুরনো পাণ্ড্যরাজ্যের মাদুরা অঞ্চলটির স্থানীয় শাসনকর্তা ১৩৩৪ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু ১৩৬৪ খ্রিস্টাব্দে মাদুরা বিজয়নগর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে।

উপকূলবর্তী রাজ্যগুলো প্রধানত বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। বৃহৎ রাজ্যগুলো নির্ভর করত ভূমিরাজস্বের ওপর। বিজয়নগরের অর্থনীতি চলত চোলদের ধাঁচে। বাণিজ্য ও কৃষি থেকে রাজস্ব আদায় হতো। শাসনব্যবস্থার স্ত রবিভাগ বেড়ে গিয়েছিল এবং চোলযুগ থেকেই অর্থনীতির সঙ্গে শাসনব্যবস্থার একটা নিকট সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এই নতুন পদ্ধতির সঙ্গে উত্তর-ভারতীয় পদ্ধতির সঙ্গে মিল ছিল। তবে বাণিজ্যের সুবিধার ফলে দক্ষিণ-ভারতে শহরের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। বিশেষত উপকূল অঞ্চলে। বিজয়নগরের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ফার্নাও নিজ লিখেছেন :

‘রাজা চিত্রা ও এর যে পদাতিক বাহিনী আছে, তার ব্যয়নির্বাহ করে অভিজাত ব্যক্তিরা। এদের ভরণপোষণ করতে ৬ লক্ষ সেনা, অর্থাৎ ৬ লক্ষ সৈন্য এবং ২৪ হাজার অশ্ব। অভিজাতদের এগুলো থাকা বাধ্যতামূলক। রাজার কাছ থেকে পাওয়া সব জমিতে এঁদের অধিকার ভাড়াটিয়ার মতো; সেনাবাহিনীর ভরণপোষণ ছাড়াও এঁদের জমির মূল্য দিতে হয়। রাজকীয় রাজস্ব হিসেবে রাজাকে দিতে হয় বছরে ৬০ লক্ষ টাকা। ভূমিরাজস্ব থেকে ১২০ লক্ষ টাকা আয় হয় ও ৬০ লক্ষ টাকা রাজাকে দিয়ে দিতে হয়। বাকি অর্থ দিয়ে সৈনিক ও হাতির খরচ চালাতে হয়।…বিভিন্ন উৎসব, ভোজ ও মন্দিরগুলোকে রাজার অর্থদান অনুষ্ঠানের সময় ভাড়াটিয়ার মতো এইসব অভিজাত ব্যক্তিকে সবসময় রাজসভায় উপস্থিত থাকতে হয়। সবসময় রাজার পাশাপাশি থাকেন এবং রাজার সঙ্গে রাজসভায় থাকেন এমন অভিজাতের সংখ্যা দু’শোরও বেশি। এঁদের সব সময় রাজার সঙ্গে থাকতে হয়। এঁরা যদি নির্দিষ্ট সংখ্যার চেয়ে কম সংখ্যক সৈনিক রাখেন, তাহলে তাঁদের কঠিন শাস্তি হয় ও জমি বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। এঁদের কখনো শহরে পাকাপাকিভাবে বাস করতে দেওয়া হয় না, কারণ তাহলে এঁদের রাজার হাতের বাইরে চলে যাবার সম্ভাবনা থাকে। এঁরা শুধু মাঝে মাঝে শহরাঞ্চলে যেতে পারেন। যেসব ছোট রাজা, রাজার অধীনস্থ— তাঁরা একটা সুবিধা পান। না ডেকে পাঠালে তাঁদের রাজসভায় হাজিরা দিতে হয় না, তাঁরা তাঁদের নিজেদের শহর থেকেই খাজনা বা ভেট পাঠাতে পারেন!… ভালো কাজ পেয়ে বা ভালো কাজের প্রত্যাশায় রাজা যদি কোনো সেনাধ্যক্ষ বা অন্য কোনো ব্যক্তিকে সন্তুষ্ট করতে চান, তাহলে তিনি কখনো কখনো তাদের নিজেদের ব্যবহারের জন্যে বিশেষ উত্তরীয় উপহার দেন। এটা বিশেষ সম্মানের। প্রতিবছর ভূমিরাজস্ব আদায়ের সময় রাজা এই উপহার দেন। সেপ্টেম্বর মাসে এই রাজস্ব আদায় হয়। তখন নয়দিন ধরে বিরাট ভোজসভা চলে। এবং কৃষকেরা উৎপন্ন ফসলের নয়-দশমাংশ রাজস্ব হিসেবে জমিদারকে দিত। রাজ্যের যত খাজনা এই নয় দিনের মধ্যেই রাজাকে দেওয়া হয়। আগেই বলা হয়েছে, সমস্ত জমির মালিক রাজা, তাঁর হাত থেকে পান সেনানায়করা। তাঁরা চাষের জন্য জমি দেন কৃষকদের, বিনিময়ে উৎপন্নের নয়-দশমাংশ পান। কৃষকদের নিজস্ব কোনো জমি নেই, কারণ সমগ্র রাজ্যটাই রাজার সম্পত্তি। জমির দায়িত্ব সেনানায়কদের দেওয়া হতো, কারণ সৈন্য জোগানোর ভার ছিল তাদের হাতে।…[১]

আরেকটি প্রথা ছিল নীলাম ডেকে জমির রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব বিলি করা। কেবল কৃষিজমিই নয়, বাণিজ্যিক দিক থেকে মূল্যবান জমি বিলির জন্যেও নীলাম ডাকা হতো। যেমন, বিজয়নগরের নগরদ্বারের কাছে একটি স্থানে ব্যবসায়ীরা এসে জমা হতো। এ সম্পর্কে নুমিজ লিখেছেন—

“…এই নগরদ্বার দিয়েই সমস্ত পণ্য দুটি শহরে প্রবেশ করে। কেননা, বিসনগর শহর (বিজয়নগর) প্রবেশের আর কোনো পথ নেই। সব পথ এখানে এসেই মিলেছে। এই নগরদ্বারটির বাৎসরিক ভাড়া ১২ হাজার ‘পারদাও’ এবং যারা ভাড়া নেয়, তাদের অর্থদান না করে কোনো স্থানীয় বা বিদেশি লোক নগরদ্বার দিয়ে ঢুকতে পারে না। শহর দুটির মধ্যে কোনো পণ্যদ্রব্যের উৎপাদন হয় না। সমস্ত পণ্যই ষাঁড়ের পিঠে চাপিয়ে বাইরে থেকে শহরে নিয়ে আসা হয়। ভারবাহী পশুর ব্যবহার এদেশে প্রচলিত। প্রতিদিন নগরদ্বার দিয়ে ২ হাজার ষাঁড় আসে, এবং প্রতিটি ষাঁড়ের জন্যে ৩ ‘ভিন্টি’ পরিমাণ অর্থ দিতে হয়। তবে কয়েকটি শৃঙ্গহীন ষাঁড় আছে, যাদের জন্যে সারা রাজ্যে কোথাও অর্থ দিতে হয় না।…”[২]

রাজ্যে নানা ধরনের কর ছিল, সব মিলিয়ে রাজ্যের রাজস্ব আদায় হতো। বাণিজ্যশুল্ক থাকা সত্ত্বেও ভূমিরাজস্বই আদায়ের প্রধান উৎস ছিল। রাজা কৃষ্ণদেবের সময় ভূমির একটি বিস্তারিত জমি জরিপ ও মূল্যায়ন করা হয়েছিল এবং রাজস্বের হার নির্ধারিত হয়েছিল এক-তৃতীয়াংশ থেকে এক-ষষ্ঠাংশ। জমির গুণাগুণ অনুসারে রাজস্ব নির্ধারিত হলো। বাণিজ্যিক রাজস্বের মধ্যে ছিল উৎপন্ন পণ্যের ওপর বিভিন্ন আদায়, শুল্ক ও কর। সব মিলিয়ে রাজস্বের পরিমাণ ছিল প্রচুর। এছাড়া সম্পত্তির ওপর কর থেকেও যথেষ্ট রাজস্ব আদায় হতো। কৃষি ছাড়া যাদের ভিন্ন বৃত্তি ছিল, তাদের বৃত্তিকর দিতে হতো। কারখানার মালিকদের জন্যে বিশেষ কর ছিল। এছাড়া বিবাহের সময় দেয় বিশেষ কর বা মন্দিরের প্রয়োজনে নির্ধারিত কর ছিল সামাজিক কর প্রকল্পের অন্তর্গত। দুর্গ ও সেনাবাহিনীর ব্যয়নির্বাহের জন্যে সময়ে সময়ে সামরিক কর দিতে হতো। রাষ্ট্রের আয়ের আর একটি উৎস ছিল বিচারে নির্ধারিত জরিমানা। এছাড়া সেচের পুষ্করিণী নির্মাণ বা ওই ধরনের বিশেষ কোনো প্রকল্পের জন্যে বিনা পারিশ্রমিকে শ্রমদান করতে হতো। গ্রামগুলো এই যুগেও অনেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ ও পরস্পর বিচ্ছিন্ন ছিল। স্থানীয় উৎপাদিত শস্য থেকে কিছু করতে হলে তা করতে হতো ওই অঞ্চলেই। যেমন কোনো গ্রামের উৎপন্ন আখ মাড়াই করার জন্যে কেবল ওই গ্রামের বা পার্শ্ববর্তী গ্রামের আখ মাড়াই কলেই যেতে হতো। দূরে কোথাও নিয়ে যাওয়া শুধু আইনবিরুদ্ধই ছিল না, সামাজিকভাবেও অসিদ্ধ ছিল। এই মনোভাবের ব্যতিক্রম ছিল গ্রাম্যমেলা। প্রায়ই মেলা বসতো, যেখানে শুধু উদ্বৃত্ত উৎপন্ন দ্রব্য বিক্রি ছাড়াও শহর গ্রামের লোকের মেলামেশার একটা কেন্দ্র ছিল।

তামিল অঞ্চলের গ্রামসভার ঐতিহ্য এই যুগেও ‘ব্রহ্মদেয়’ গ্রামগুলোতে বজায় ছিল। অন্যন্য গ্রামেও এই পরিষদগুলো ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল এবং ক্ষমতা হস্তান্তর হচ্ছিল জমির প্রাপকদের কাছে। উত্তর-ভারতের মতো এখানেও রাজনৈতিক আনুগত্যের চেয়ে বর্ণগত আনুগত্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এর মূলে ছিল কৃষকের চেয়ে জমিদারদের গুরুত্ব বৃদ্ধি। মন্দির, মঠ ও রাজার অনুগ্রহভাজন ব্যক্তিরা ছিল জমির মালিক। কৃষিমজুর ও প্রজাস্বত্বভোগী চাষীরা (tenants) জমিচাষ করত। কৃষিমজুররা চাষের মরশুমে মজুরী পেত। তারা নামে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যেতে পারত বটে, কিন্তু প্রতিটি গ্রামসমাজের কাঠামো সুসংবদ্ধ হওয়ায় কার্যত তা সম্ভব ছিল না। প্রজাস্বত্বভোগীরা নির্দিষ্ট হারে জমির মালিককে খাজনা দিত, তার পরিমাণ ছিল উৎপন্ন শস্যের অর্ধাংশ থেকে তিন- চতুর্থাংশ। তাদের গতিবিধিও ছিল সীমিত।

গ্রামের ঋণদান ব্যবস্থা প্রধানত মন্দির কর্তৃপক্ষের হাতে ছিল। তারা ব্যক্তিবিশেষকে এবং গ্রামকে ঋণ দিত। ঋণের ওপর সুদের হার ছিল ১২ থেকে ৩০ শতাংশ। ঋণের টাকা কেউ শোধ দিতে না পারলে মন্দির কর্তৃপক্ষ তার জমি বাজেয়াপ্ত করে নিত। গ্রামজীবনে মন্দিরের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। মন্দিরগুলো গ্রামের লোককে নানা ধরনের কাজও দিত। অনেক ক্ষেত্রে মন্দিরই গ্রামের অধিকাংশ জমির অধিকারী ছিল। কোনো পতিত জমি কিনে সেখানে কয়েকঘর তাঁতীকে বসিয়ে দেওয়া বা সেচের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া ইত্যাদি গ্রামোন্নয়নের কাজে মন্দির কর্তৃপক্ষ আগ্রহ দেখাত। এইভাবে মন্দিরেরও আয়বৃদ্ধি হতো। অর্থ ও ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার ফলে মন্দিরগুলো স্বাভাবিকভাবে একেকটি অঞ্চলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল! এইভাবে রাজা ও ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হচ্ছিল।

গ্রাম বা শহরের কারিগরদের মর্যাদা চোলযুগ থেকে এইযুগে মোটামুটি অপরিবর্তিত ছিল। ছুতোর, স্বর্ণকার ও কামারদের মর্যাদা বেশি ছিল। তাঁতী ও কুমার ইত্যাদি পেশার লোকেরা সমাজের পক্ষে অপরিহার্য হলেও অতটা মর্যাদার অধিকারী ছিল না। কারিগরদের নিজস্ব সমবায় সংঘ ছিল। কিন্তু সংঘগুলো ব্যবসায়ীদের সমবায় সংঘের জন্যেই কাজ করত। চোলযুগের মতো এই যুগেও ব্যবসায়ীদের সংঘগুলো কারিগরদের সংঘের চেয়ে অনেক বড় পরিধিতে কাজকর্ম করত। ব্যবসায়ীরা কারিগরদের অর্থসাহায্য করত এবং উৎপন্ন দ্রব্য বিক্রির ব্যবস্থা করে দিতে। এর ফলে কারিগরদের স্বাধীনতা সীমিত ছিল। দেশের মধ্যে বাণিজ্য ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছিল। আরব বণিকরা দেশের বিভিন্ন অংশে যাতায়াত করত। ভারতীয় ব্যবসায়ীরাও এই যুগের শেষদিকে দূরে দূরে ব্যবসা করতে শুরু করল। অবশ্য উপকূল অঞ্চলের ব্যবসায়ীরাই এতটা উদোগী ছিল।

অর্থনৈতিক সচ্ছলতার জন্যে ব্যবসায়ীদের সমবায় সংঘগুলো দেশে রাজনৈতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। রাজসভাতেও তাদের প্রভাব ছিল এবং করনীতি স্থির করার সময় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে রাজকর্মচারীরা পরামর্শ করত। ক্রমশ ব্যবসায়ীরাই জনমতের প্রতিনিধি হয়ে উঠল। রাজসভায় জমিদার ও রাজকর্মচারীদের এতদিন একচ্ছত্র প্রভাব ছিল। এবার ব্যবসায়ীরা আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠী হয়ে উঠল। মহীশূর, অন্ধ্র ও মাদ্রাজ অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের মধ্যে ‘চেট্টিরা’ ব্যবসায়ী হিসেবে সুপরিচিত। এদের কেউ কেউ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চলে গিয়ে পারিবারিক ব্যবসা চালিয়ে গিয়েছিল।

বৈদেশিক বাণিজ্য থেকে যে প্রচুর আয়ের সম্ভাবনা আছে সে বিষয়ে রাষ্ট্র ভালোভাবেই অবগত ছিল। কৃষ্ণদেব রায় তাঁর তেলুগু কবিতা ‘অমুক্তমাল্যদ’-তে এ সম্পর্ক লিখে গেছেন—

“রাজা রাজ্যের বন্দরগুলোর উন্নতিসাধন করবেন। তার ফলে ঘোড়া, হাতি, দামী পাথর, চন্দনকাঠ, মুক্তা ইত্যাদি মূল্যবান দ্রব্য তাঁর রাজ্যে অবাধে আমদানি হতে পারবে। ঝড়, অসুস্থতা বা শ্রান্তির জন্যে যেসব বিদেশি নাবিকরা রাজ্যের বন্দরে আশ্রয় নিতে আসে, তাদের প্রতি রাজ্যকে দৃষ্টি রাখতে হবে। নাবিকরা যেন নিজের দেশের মতোই যত্ন পায়।… যেসব বিদেশি বণিক বিদেশ থেকেও হাতি ও ঘোড়া আমদানি করে, তাদের রোজ দর্শন দিলে তারা খুশি থাকবে। তাদের উপহার দিতে হবে এবং ভালোরকম লাভ করারও সুযোগ দিতে হবে। তাহলে আর এইসব সামগ্রী কখনো শত্রুর রাজ্যে চলে যাবে না।…” [৩]

বাণিজ্য হাতছাড়া হয়ে শত্রুরাজ্যগুলোর হাতে চলে যাবার ভয় বিজয়নগর রাজ্যের ছিল। এই কারণেই তারা পর্তুগীজদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিল। বিদেশি বণিকদের নানারকম সুবিধা দেওয়া হতো এবং আমদানি করা সামগ্রীর ওপর শুল্কের হার চড়া ছিল না। দ্রব্যাদির বিক্রয়মূল্যের ওপর শতকরা আড়াই থেকে ৫ শতাংশ হারে শুল্ক দিতে হতো। বিদেশি কাপড় ও তেলের ওপর শুল্কের হার ছিল বেশি (১০ ও ১৫ শতাংশ), কেননা এই দুটি জিনিসের আমদানিতে রাজ্যের কিছুটা অনিচ্ছা ছিল। মালাবার উপকূলের ছোট ছোট রাজ্যগুলো বৈদেশিক বাণিজ্যের বেশকিছু অর্থ নিজেরাই ভোগ করত। কেননা, তাদের রাজ্যেই সামগ্রীগুলো প্রথম আসত এবং তারাই শুল্ক বসানোর সুযোগ পেত। যখন রাজ্যে সমৃদ্ধি ছিল, বিজয়নগরের পক্ষে এই ক্ষতি মেনে নিতে অসুবিধা ছিল না। কিন্তু অন্য সময়ে ছোট রাজ্যগুলো বিজয়নগরের বৈদেশিক বাণিজ্যের আয় অনেকটাই কমিয়ে দিত।

বিজয়নগরের আমদানি দ্রব্যের মধ্যে ছিল— স্বর্ণ ও রৌপ্যপিণ্ড, পেগু ও সিংহল থেকে হাতি (বাহমনীরা উত্তর-ভারত থেকে হাতি আমদানি করতে বাধা দিত) এবং ঘোড়া। আগে আরব বণিকরাই ঘোড়া সরবরাহ করত। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগীজরা আরব বন্দরগুলো দখল করে নিল। এই বন্দরগুলো থেকে ঘোড়া চালানো হতো। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে মশলা আসত। ভারি কাপড় যেমন মখমল, সাটিন ও বুটিদার কাপড় আসত জিডা, এডেন ও চীন থেকে। বিভিন্ন দ্রব্য রপ্তানি করা হতো প্রধানত পারস্য, আফ্রিকা, চীন ও সিংহলে। এই দ্রব্যগুলোর মধ্যে ছিল চাল, চিনি, নারকেল, জোয়ার, ভুট্টা, রং (হেনা, নীল, হিঙ্গুল, আমলকি) মরিচ, আদা, চন্দরকাঠ, সেগুনকাঠ, দারুচিনি, লবঙ্গ, সুতীবস্ত্র ও ছাপা কাপড়।

মাল বহনে ভারতীয় জাহাজের ব্যবহার কমে এলেও মালদ্বীপে তখনো দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার জন্যে কিছু বড় বড় জাহাজ তৈরি হতো। কল্টির মতে, ভারতীয় জাহাজ ইটালীর জাহাজের চেয়ে বড় ও চীনা জাহাজের চেয়ে ছোট ছিল। ভারতীয় বন্দরে যত দেশের জাহাজ আসত, তার মধ্যে চীনা জাহাজ ছিল শ্রেষ্ঠ। বিপদসংকুল সমুদ্রে দীর্ঘযাত্রার উপযোগী করে চীনা জাহাজগুলো নির্মিত ছিল। জাহাজভ্রমণ খুব আনন্দদায়ক ছিল না। জাহাজের গতি ছিল দিনে ৪০ মাইল। এবং উপকূলে অঞ্চলের বন্দরে ঘন ঘন আসতে হতো। কালিকট থেকে সিংহলে পৌঁছতে ১৫ দিন লেগে যেত। পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে আসা জাহাজগুলো কালিকট, এলি ও কুইলন বন্দরগুলোতেই বেশি যেত। বৈদেশিক বাণিজ্যে বিনিময় প্রথার পরিবর্তে মুদ্রার ব্যবহারই বেশি প্রয়োজন হতো। বিজয়নগর রাজ্যের প্রতিটি প্রাদেশিক রাজধানী টাকশাল ছিল। মুদ্রাগুলো যত্ন করে নির্মিত হতো এবং তার ওপর কানাড়া ও নাগরী লিপিতে লেখা থাকত। দেশি মুদ্ৰা ছাড়াও পর্তুগীজদের ‘ক্রুজাদো’, ফারসিদের ‘দীনার’ এবং ইটালীয়দের ‘ক্লোরিন’ ও ‘ডুকাট’ মুদ্রাও উপকূল অঞ্চলে প্রচলিত ছিল।

অভিজাত শ্রেণির আর্থিক সাচ্ছল্য সত্ত্বেও সাংস্কৃতিক জীবনে কোনো গতিশীলতা আসেনি। সাহিত্য ও শিল্পকলায় নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার নিদর্শন নেই, চিন্তাধারাতেও সজীবতার অভাব লক্ষিত হয়। শিল্পীরা রক্ষণশীলমনোভাবে পুরাতন রীতিকে আঁকড়ে ছিল— তার ফলে কল্পনার দৈন্য ও অপ্রয়োজনীয় খুঁটিনাটির দিকে অত্যধিক মনোযোগ, সে যুগের শিল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, যা স্থাপত্যে সহজেই নজরে পড়ে।

সমগ্র বিজয়নগর শহরটি এইযুগে নির্মিত হয়েছিল। সেখানে মন্দিরের প্রাচুর্য, কিন্তু তার যেটুকু এখনো অবশিষ্ট আছে তাতে বোঝা যায় যে, বাহ্যিক অলংকরণের বাহুল্যই ছিল প্রধান বৈশিষ্ট্য। পাথরের বদলে ইটের ব্যবহার বাড়ছিল। ইটের ওপর চূণ ও বালির প্রলেপ লাগানোর ফলে অলংকরণের সুবিধা হতো। প্রতিটি স্তম্ভ মূর্তি দিয়ে অলংকৃত হতো। মন্দিরে উপাসনার নানারকম আচার-অনুষ্ঠানের প্রয়োজনে মন্দিরের কাছাকাছি আরো কয়েকটি ছোট ছোট মন্দির নির্মাণ করতে হতো। মন্দিরের স্থাপত্যে ‘গোপুরম্’ বা মন্দির-তোরণের প্রাধান্য বৃদ্ধি পেল। বড় বড় মন্দিরগুলোর সংলগ্ন প্রশস্ত প্রাঙ্গণে দেব-দেবীদের বিবাহ উৎসব ধুমধাম করে পালন করা হতো। এই প্রাঙ্গণকে বলা হতো ‘কল্যাণমণ্ডপম্’। এই যুগেই এখান থেকে উত্তরে গোলকোণ্ডায় যে গোল গম্বুজটি নির্মিত হয়, সেটি বাস্তুবিদ্যার চূড়ান্ত নিদর্শন। অথচ এর কোনো প্রভাব বিজয়নগরের ওপর পড়েনি।

বলা হতো যে, বিজয়নগরের রাজারা এক শৈবদেবতা বিরুপাক্ষের প্রতিনিধিরূপে রাজ্যশাসন করেন। এইভাবে উপদ্বীপ অঞ্চলে শৈব মতবাদের জনপ্রিয়তা রাজকীয় সমর্থন লাভ করল। এতদিনে ভক্তি মতবাদ হিন্দুধর্মের অন্তর্গত হয়ে গিয়েছিল। তবে, ভক্তি-আন্দোলনের কেন্দ্র দক্ষিণ-ভারত থেকে মহীশূরে এবং আরো উত্তরে ও পশ্চিমে মহারাষ্ট্রে সরে গিয়েছিল। মারাঠী সাধুদের মধ্যে জ্ঞানদেবই প্রথম মারাঠীভাষায় গীতা আবৃত্তি করেছিলেন। এরপর চোদ্দশ শতকে এলেন নামদেব। তিনি মূর্তিপূজার ঘোরবিরোধী ছিলেন। অন্যান্য মারাঠী সাধুদের চেয়ে নামদেবের ভক্তদের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। তাঁর বাণী ছিল বেশি সংস্কারপন্থী এবং নানক ও কবীরের সঙ্গে তাঁর মতামতের মিল আছে। রাজা কৃষ্ণদেব যখন মহারাষ্ট্রের ভক্তিবাদী সাধকদের প্রিয়দেবতা বিধোবার পূজা করেন, তখন ভক্তিমতবাদের দক্ষিণ-ভারতে ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা আরো দৃঢ় হয়। ততদিনে তামিল, তেলেগু, কানাড়া এবং মারাঠী ইত্যাদি আঞ্চলিক ভাষাগুলো পূর্ণস্বীকৃত ও বেশ উন্নত হয়ে উঠেছিল। তামিল ভিন্ন অন্যান্য ভাষাগুলোতে অবশ্য প্রধান সাহিত্য ছিল সংস্কৃতের ভাবানুবাদ। বিশেষত মহাকাব্য ও পুরাণগুলোর অবলম্বনে লিখিত রচনা। ভক্তি-আন্দোলনের প্রভাবে আঞ্চলিক ভাষাগুলো সাংস্কৃতিক ভাববিনিময়ের মাধ্যম হয়ে উঠল। উত্তর-দাক্ষিণাত্যে বাহমনীরা ফারসি ও আরবিভাষা ব্যবহার করার ফলে ভাষাগতভাবে বাহমনী রাজ্যের সঙ্গে সুলতানীর সম্পর্ক নিকটতর ছিল। মালাবার অঞ্চলে মালয়ালম ভাষা বিশেষ মর্যাদা পেল। তামিলভাষা থেকেই মালয়ালম ভাষার জন্ম। কিন্তু তামিলনাদের সঙ্গে রাজনৈতিক দূরত্ব ও বিদেশিভাষার প্রভাবে মালয়ালম ভাষার ভিন্নমুখী বিকাশ হয়।

উত্তর-ভারতের মতো দক্ষিণ-ভারতেও সংস্কৃত ছিল সমাজের অল্প সংখ্যক লোকের জ্ঞানচর্চার ভাষা। সংস্কৃতে হোয়সল ও বিজয়নগরের রাজবংশের ইতিহাস ও রাজাদের জীবনচরিত লেখার জন্যে রাজসভা থেকে উৎসাহ দেওয়া হতো। বেদের ওপর সায়ণ যে ভাষ্য লিখেছিলেন, তার মতো ভাষ্য জ্ঞানীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করত। হেমাদ্রি ‘ধর্মশাস্ত্রের’ ওপর ভাষ্যরচনায় জীবনের অধিকাংশ ব্যয় করেছিলেন এবং তাঁর ব্যাখ্যার সঙ্গে উত্তর-ভারতীয় পণ্ডিতদের রচিত ভাষ্যের মিল আছে। অবশ্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নতিবিধানে এসব রচনার কোনো অবদান ছিল না।

সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে বিজয়নগর দক্ষিণ-ভারতে জড়ত্বের যুগ। দেশি ও বিদেশি বাণিজ্য থেকে প্রচুর অর্থাগম হয়েছে এবং সমাজের উচ্চ শ্রেণিগুলো বিলাসের না হলেও মোটামুটি সাচ্ছল্যের মধ্যেই দিন কাটিয়ে গেছে। ইসলামী প্রভাব অঙ্গীভূত হয়েছে নিঃশব্দে এবং তথাকথিত হিন্দু পুনরুত্থানের ফলে বুদ্ধিগত বা অন্য কোনো নাটকীয় সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়নি। এইযুগে সত্যিই কোনো সচেতন হিন্দু পুনরুত্থান ঘটছিল কিনা সেটা বিতর্কের বিষয়। বরং বলা যায় যে, ওইযুগে সমৃদ্ধ হিন্দুরাজ্য ছিল কেবল বিজয়নগর এবং তার ফলে ওই রাজ্যের হিন্দু মন্দির ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো রাজানুগ্রহ লাভ করেছিল। উত্তরে মেবার ও মাড়োয়ারের হিন্দু রাজপুত রাজ্য দুটিতেও এই ঘটনা ঘটেছিল কিছুটা ছোট আকারে। সতিই যদি কোনো হিন্দু পুনরুত্থান ঘটত, অন্তত ধর্মীয় ক্ষেত্রে, তার কিছু না কিছু পরিচয় পাওয়া যেত। কিন্তু বিজয়নগরের সংস্কৃতিতে তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।

উপদ্বীপ অঞ্চলের ইতিহাসে বিজয়নগরের গুরুত্ব এই যে, উত্তর-ভারতের কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিজয়নগরেও একটি কাঠামোর ক্রমবিকাশ ঘটেছিল। এ ঘটনা পুরো আকস্মিকও নয়, কিংবা ইচ্ছাকৃতও নয়। দুই অঞ্চলের ঘটনায় ক্রমবিকাশের এই যে সাদৃশ্য, তার কারণ হলো উত্তর ও দক্ষিণ-ভারতের রাজনীতিতে একই ধরনের সামন্ততান্ত্রিক বিন্যাস লক্ষিত হয়।

একই ধরনের প্রতিষ্ঠানের কাঠামোর মধ্যে স্থানীয় সংস্কৃতির বিকাশের ফলে স্থানীয় আনুগত্য গড়ে উঠল এবং সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে পারস্পরিক বিভেদের মনোভাব দেখা দিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে ঐক্যসূত্র নিশ্চিতভাবে লক্ষ্যণীয়। বাংলা ভাষাভাষীরা কানাড়া ভাষার কথা বুঝতে পারত না। কিন্তু যে ঘটনাপ্রবাহে আঞ্চলিক ভাষাগুলোর বিকাশ হয়েছিল, তা সব জাগয়াতেই এক ছিল। ভক্তি আন্দোলনের ফলস্বরূপ যেসব সামাজিক শক্তি উজ্জীবিত হয়েছিল তা উত্তর ও দক্ষিণ-ভারতে একইভাবে কাজ করে; যদিও সামাজিক প্রতিবাদ হিসেবে ভক্তি আন্দোলনের প্রভাব দক্ষিণ-ভারতে উত্তরের আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। শঙ্কর ও রামানুজের শিক্ষা ও বাণী একদিক দিয়ে দেখতে গেলে সমস্ত ভারতকে ঐক্যভূত করেছিল একই ধরনের বিশ্বাসকে সারাদেশে প্রসারিত করে। সারা ভারতের পুণ্যার্থী হিন্দুরা সাতটি পবিত্র তীর্থে ভ্রমণ করতে যেত। তীর্থগুলোর মধ্যে একদিকে ছিল হিমালয়ের বদ্রীনাথ এবং অন্যদিকে ছিল সুদূর দাক্ষিণাত্যের রামেশ্বরম। উপকূল বাণিজ্যের ফলে ব্যবসায়ীরা দেশের নানা অঞ্চলে যেতে পারত। গুজরাটের ব্যবসায়ীরা মালাবারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সমানভাবে ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতা চালিয়ে গেছে। আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য ও পার্থক্য সত্ত্বেও সমগ্র ভারতে এইসময় একটা সাম্য-সাদৃশ্য দেখা যায়। এ ছিল ভবিষ্যতে ভারতব্যাপী রাষ্ট্র গড়ে ওঠার পক্ষে অনুকূল পরিস্থিতি।

ষোড়শ শতাব্দীতে ভারতবর্ষের ইতিহাসে দুটি নতুন উপাদান সংযোজিত হয়েছিল। স্থলপথে এলো মুঘলরা। তারা উত্তর-ভারতে রাজ্য গড়ে তুলতে শুরু করল। সমুদ্রপথে এসেছিল পর্তুগীজরা এবং তারা দক্ষিণ ও পশ্চিম-ভারতে বসবাস শুরু করল। মুঘল ও পর্তুগীজরা দুইভাবে ভারতের ইতিহাসের গতি পরিবর্তন ঘটাল। পর্তুগীজরা ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যে নিজেদের একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছিল। অন্যদিকে মুঘলদের ছিল ভারতব্যাপী সাম্রাজ্য বিস্তারের পরিকল্পনা। পর্তুগীজরা সফল না হলেও মুঘলরা নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছতে সমর্থ হয়েছিল এবং পর্তুগীজ ও মুঘলদের এই ব্যর্থতা ও সাফল্যের নানান টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে ভারতে এক নতুন যুগের সূচনা হলো।

***

১. ফার্নাও নুনিজ। অনুবাদ : সীওয়েল, এ ফরগটন এম্‌পায়ার। পৃ- ৩৭৩-৭৪
২. ঐ
৩. অমুক্তমাল্যদ, ৪র্থ ও ৫ম পরিচ্ছেদ। পৃ. ২৪৫-৫৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *