২৭. তারকার হাসির পতন
লাল পাথরের দূর্গ পুরানা কেল্লায় নিজ কক্ষে বসে আছেন হুমায়ুন। দূর্গটি দিল্লির পূর্বাঞ্চলের একপ্রান্তে শাসনামলের প্রথম দিকে নির্মাণ কাজ শুরু করেন তিনি। তবে এর নির্মাণ কাজ শেষ করেন শেরশাহ ও তাঁর পূত্র ইসলাম শাহ। দূর্গটির চারপাশে পুরু দেয়াল। এতে প্রবেশের জন্য রয়েছে তিনটি চৌকিঘর ফটক। প্রায় এক মাইল বিস্তৃত এই দূর্গ সাপের মতো লম্বাটে। একইসঙ্গে এটি রাজকীয় কাজকর্মের কেন্দ্রস্থলও। হুমায়ূনের সামনের গালিচা বিছানো টেবিলে রাজ্যের খতিয়ান বই রাখা হয়েছে। বইতে শেরশাহ ও তাঁর পূত্রের শাসনামলের প্রশাসনিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বৃত্তান্তও অন্তর্ভূক্ত আছে। জওহর এই বইটি নিয়ে এখানে উপস্থিত রয়েছেন। তাকে কয়েক বছর নিঃস্বার্থভাবে সেবা দেয়ার জন্য ব্যবস্থাপক সভার কম্পট্রোলার করা হয়েছে।
দিল্লিতে প্রবেশের পর তাঁকে নিয়ে যে উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল তার রেশ এখন অনেকটা কেটে উঠছে। হুমায়ূন জানতেন যে তাঁকে নিয়ম-শৃঙ্খলায় উৎসাহিত হতে হবে এবং খবর রাখতে হবে কীভাবে তাঁর রাজত্ব চলছে এবং নতুন যেসব এলাকা জয় করা হয়েছে সেগুলো নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগে কর্মবিরত থাকলে চলবে না। তিনি তাঁর উপদেষ্টাদের বলেছিলেন, এখন আমাদের কাজ কেবল অর্ধেক শেষ হয়েছে। হিন্দুস্তানকে আবারও আক্রমণ করা হতে পারে যা খুব কঠিন কাজ নয়। আমাদেরকে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে আমরা হিন্দুস্তানের ক্ষমতা ধরে রাখব এবং সাম্রাজ্য বাড়াবো। দিল্লিতে থাকা শেরশাহ ও ইসলাম শাহের কর্মকর্তাদের তিনি ইতোমধ্যে জিজ্ঞেস করেছেন। তিনি তাঁর বিশ্বস্থ সেনাপতিদের বিভিন্ন রাজ্য শাসনের জন্য পাঠিয়েছেন। এদের মধ্যে আগ্রাতে পাঠানো হয়েছে আহমেদ খানকে।
কিছুটা ভ্রূ কুচকিয়ে তিনি (খতিয়ান বই) পড়তে শুরু করলেন। সবকিছুর পর জবরদখলকারীদের প্রাপ্তিও তাঁকে মুগ্ধ করছে। খতিয়ান খাতায় দেখা গেছে, সাংগঠনিক হিসেবে শেরশাহ ছিলেন দক্ষ, ধূর্ত ও প্রভাবশালী। কারণ তিনি ছিলেন ঠাণ্ডা মাথার এক হিসেবি যোদ্ধা। কোনো বিশেষ সরকারকে সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর না করতে রাজ্য সরকারের শাসন পদ্ধতিকে পুনর্গঠন করেছিলেন তিনি। তিনি রাজস্ব আদায়ের বিষয়টিও পুনর্গঠন করেছেন। অবশ্যই সাম্প্রতিক যুদ্ধকালে কর আদায় ছিল জটিল ও সমস্যার কাজ। তবে হুমায়ূনের কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে জানিয়েছেন যে শেরশাহ যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করে গেছেন সেগুলো এখনও বিদ্যমান আছে এবং সেগুলো আরও সক্রিয়ভাবে চালু করার দাবি রাখে। বিষয়টি হুমায়ুনের জন্য সুবিধার। তাঁর বাবা ডাইরিতে কী লিখে গেছেন? … অন্তত এই জায়গায় যথেষ্ট অর্থ আছে। হিন্দুস্তানের সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে হুমায়ূন জানতেন কীভাবে ক্ষমতা রক্ষা করতে হয় ও বিস্তার ঘটাতে হয়।
শেরশাহ রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করেছেন, বাড়িঘর সংস্কার করেছেন এবং প্রতি পাঁচ মাইল পর ভ্রমনকারীদের জন্য বিশ্রামকেন্দ্র নির্মাণ করেছেন। তবে এই বিশ্রামকেন্দ্রগুলোর মুল লক্ষ্য ছিল এগুলো খবরের দূত ও ঘোড়ার জন্য ডাক চৌকি। হিসেবে ব্যবহৃত হত। এতে দ্রুত রাজ্যের বিভিন্ন অংশে খবর সরবরাহ করা সম্ভব হত। রাজ্যের এক অংশের খবর আরেক অংশে দ্রুত পৌঁছে দেয়া সম্ভব হত।
বিদ্রোহ ঠেকাতে ও রাজ্যগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে শেরশাহ নতুন দূর্গ নির্মাণ করেন। তিনি নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন। হুমায়ূন একটি অনুচ্ছেদ পুনরায় পাঠ করেন যেখানে তার চোখ নিবদ্ধ হয়: তার অসীম প্রজ্ঞা ও ঈশ্বরপ্রদত্ত ভালোত্ব দিয়ে শেরশাহ প্রতি গ্রামে একজন সর্দার নিয়োগ করেন, যিনি তাঁর নিজ গ্রামকে চোর ও হত্যাকারীদের হাত থেকে রক্ষা করবেন। এছাড়া নিজ এলাকায় কোনো পর্যটক যদি হত্যার শিকার হয় সে জন্য দায়ি থাকবেন ওই সর্দার। এই সর্দার তার কাজকর্মের জন্য প্রশাসনের কাজে দায়বদ্ধ থাকার নির্দেন দেন শেরশাহ। যদি কোনো অপরাধের অপরাধী শনাক্ত করা সম্ভব না হয় তাহলে এর সাজা স্বয়ং ওই সর্দারকে ভোগ করতে হবে বলেও নিয়ম ছিল।
চামড়ার বাঁধাই করা ভারি খতিয়ান বইটি মার্বেল পাথরের টেবিলে রেখে ক্ষমতায় আসার সময়কার সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে হাসলেন হুমায়ূন। কিছু কিছু বিষয় ভেবে তিনি বেশ কিছুটা বিরক্তও হন। রাস্তা নির্মাণ, কিংবা রাজ্যগুলো পুনর্গঠন করা অথবা কর সংগ্রহের মধ্যে বিরত্বের কি আছে? তবে এখন তিনি জানেন ক্ষমতায় থাকার জন্য এগুলো করাটা কতোটা অপরিহার্য।
কোনটি শেরশাহ করেছেন আর কোনটি ইসলাম শাহ করেছেন, তা জেনে এখন কী আসে যায়। বরং ভালো বিষয়গুলোই রাখতে চান তিনি। এতে তিনি হিন্দুস্তানে তাঁর শাসনব্যবস্থাকে আরও জোরদার করতে পারবেন…। তবে একটি বিষয় তিনি পরিবর্তন করবেন। যদিও দিল্লি ছিল শেরশাহের রাজধানী এবং পুরানা কেল্লা সম্রাটের জন্য প্রাসাদদূর্গ ছিল। তিনি আগ্রাকে আবারও রাজধানী করার পক্ষপাতি। বাবর আগ্রাকে রাজধানী করেছিলেন। এটা করা মাত্রই তিনি তাঁর রাজপ্রাসাদ সেখানে স্থানান্তরিত করবেন। হামিদা কখনো আগ্রা দেখেননি। সেখানে তাঁকে নিয়ে তিনি সুন্দর একটি প্রসাদে থাকবেন। এমন এক সুন্দর প্রাসাদ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সভাকবিরা কবিতা লিখবেন। তবে দীর্ঘকাল ধরে বিভিন্ন রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বেশ ভালো স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে দিল্লি। এজন্য হিন্দুস্তানের মানুষের কথা বিবেচনা করে তিনি আরও কয়েকমাস দিল্লিতে রাজধানী রাখার কথা ভাবতে থাকেন। তারা (হিন্দুস্তানের মানুষ) বিভিন্ন যুদ্ধের কারণে অনেকটা বিপর্যস্ত। তিনি তাদের প্রকৃত সম্রাট– তিনি শক্তিশালী…
মহারাজ, মহারানী হামিদার কাফেলা শহর থেকে মাত্র পাঁচ মাইল দূরে রয়েছে। এক ঘোষণা হুমায়ূনের ভাবনাকে খণ্ডিত করে দিল। তখন তাঁর হৃদয় কেঁপে ওঠল। তিনি জানেন, তাঁর স্ত্রী বিভিন্ন রাজ্যে সফর করছেন। কিন্তু এতো দ্রুত তিনি এখানে ফিরে আসলেন, যা তাকে খানিকটা বিস্মিত করেছে। তিনি দাঁড়ালেন। তার হৃদয়টা আনন্দে ভরে গেল। কারণ প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। আমার রাজকীয় পোষাক এনে দাও। আমি আমার স্ত্রীর জন্য সবচেয়ে ভালো পোষাকে সাজতে চাই। যদিও পরে সে তার উজ্জল্যে আমাকে ছাড়িয়ে যাবে। প্রশাসনের প্রতি নির্দেশ দেন হুমায়ূন।
পুরানা কিল্লার পশ্চিম ফটকের ওপর থেকে হামিদার ধীরগতির কাফেলা দেখছিলেন হুমায়ূন। এই ফটকটি ছিল অন্যান্য ফটকের চেয়ে বেশ জাকজমকপূর্ণ। সাদা মারবেল পাথর দিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছে। দুই পাশে দুটি উঁচু চৌকিঘর। আর এই ফটক দিয়ে প্রবেশ করবেন হিন্দুস্তানের মোগল সম্রাজ্ঞি হামিদা। যে হাতির ওপরে করে তিনি আসছেন সেটাতে দামি কাপড়ের ওপর লাগানো আছে পাতলা স্বর্ণের আস্তরণ। এগুলো মাঝেমধ্যে ঝলকে উঠছে। যখনই এটি পশ্চিম ফটকের নিচে চলে আসল, চৌকিঘর থেকে সজোরে তূর্যধ্বনী উঠতে শুরু হল। উপস্থিত সবাই গুচ্ছগুচ্ছ গোলাপ ছুঁড়তে শুরু করলেন। হুমায়ূন দূর্গের ভেতরে একটি ফাঁকা স্থানে নেমে আসলেন। সেখানে একটি বড় সবুজ মখমলের তাবু তৈরি করা হয়েছে। সবুজ সিল্কের ফিতা দিয়ে এটি আচ্ছাদিত। এর একটি প্রবেশ পথ আছে যেখানে ঝুলে আছে সোনালি ফিতা। তাবুর ভেতরে রাখা হয়েছে বড় একটি মার্বেল পাথরের খণ্ড, যার উপরিভাগ সমান। গোপনীয়তার মধ্যে হামিদ নেমে আসার জন্য এই আয়োজন করা হয়।
হামিদার হাতি এখন প্রাসাদের উঠানে এসে হাজির হচ্ছে। মাহুত হাতির গলার মধ্যে বসে রয়েছেন এবং সতর্কভাবে তাবুর দিকে হাতিটিকে এগিয়ে নিয়ে আসছেন। তারপর প্রথমে তিনি হাতের ধাতু নির্মিত সরু লাটি দিয়ে হাতিটিকে প্রথমে ডান দিকে এবং পরে বামদিকে নির্দেশ করলেন। তারপর হাতিটি মার্বেলের বড় পাথরটিতে হাঁটু গেড়ে বসল। যেইমাত্র হাতিটি নিচু হল, মাহুত নেমে গিয়ে একপাশে বিনিত ভঙ্গিমায় দাঁড়ালেন। হুমায়ূন দেখলেন, তাঁর স্ত্রী পাথরের ওপর নরম পায়ে নামছেন। তাঁর জামাকাপড়ের স্বর্ণখণ্ডগুলো ঝলকে উঠছিল।
যেহেতু হুমায়ূনের দিকে চেয়ে তিনি হাসলেন, স্বর্ণ খচিত পোষাকে হামিদাকে আগের চেয়ে আরও আকর্ষণীয় মনে হচ্ছিল। তাঁর দীর্ঘ কালো সুগন্ধী চুল কাঁধের ওপর এসে পড়ছিল এবং এগুলো তার স্তনের ওপর ওঠানামা করছিল। তার গলায় মনি মুক্তার হার যা অনেক বিপদেও সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে।
মাউত (হাতির পরিচালক) ও অন্যান্য রাজকর্মচারীদের উদ্দেশ্যে হুমায়ূন বললেন, এখন যাও। যখনই তারা একাকী হয়ে গেলেন, তিনি হামিদাকে মার্বেলে সমতল পাথর থেকে নামিয়ে আনলেন এবং তাঁকে তাঁর সামনে দাঁড় করালেন। তিনি বললেন, আমার রানী, আমার সম্রাজ্ঞী।
হামিদাকে নিয়ে সে রাতে যমুনা নদীর তীরে গড়া প্রাসাদে কাটালেন হুমায়ুন। একসময় ইসলাম শাহের হেরেমের মতো গড়ে ছিলেন এক প্রাসাদ। সেখানে দেয়ালে কাঁচের ছোট ছোট টুকরো লাগানো রয়েছে। মোমের আলো এই কাঁচের টুকরোগুলোতে পড়ে চারিদিকে ছড়িয়ে যেতো। সোনার থালায় পুড়ানো সুগন্ধি চন্দনের ঘ্রাণ আসছে ঘরের প্রত্যেক কোনো থেকে। একইসঙ্গে মার্বেলের ঝর্ণা থেকে আসছে সুগন্ধী জলের ঘ্রাণ যেখানে গোলাপের পাপড়ি ফেলা হয়েছে।
শুধু গলার হার ছাড়া সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে পড়েন হামিদা। হুমায়ুন তার কোমল ঠোঁটে হাত বুলায়ে দেন। অন্তত আমি আপনাকে সেটা দিতে পারি যা দেয়ার প্রতিজ্ঞা আপনার কাছে আমি করেছি। রাজস্তানের মরুভূমিতে যুদ্ধ চলাকালে মাঝেমধ্যে রাতে যখন আমি ঘুমোতে পারতাম না, তাকিয়ে থাকতাম আকাশের তারার দিকে, তারাগুলো ঘুরে ফিরত, আমি তাতে সামান্য ব্যাথার প্রশমন পেতাম। কিন্তু আপনি আমার ব্যাথার সবচেয়ে বড় প্রশমন।
হামিদা হাসতেন, আমি এখনও মনে করতে পারছি কতোটা আশ্চর্য হয়েছে আমার বাবা যখন আমাকে জানালেন আপনি আমাকে বিয়ে করতে চাইছেন… আমি শুধু আপনাকে দূর থেকে দেখেছি… আপনাকে দেবতার মতো মনে হতো… আমাদের বাসর রাতেও আমি বিচলিত ছিলাম, কিন্তু যখন আপনি আমার কাছে আসলেন, আমি দেখলাম আমার জন্য আপনার জ্বলন্ত ভালোবাসা আর আমি জানতাম আপনি আমার অংশে পরিণত হবেন… আপনি আমার জীবন…
আর আপনি আমার… তবে আমাকে আবার প্রমাণ করতে দিন যে আমি আসলেই মানুষ, দেবতা নই। হুমায়ূন যখন হামিদাকে জড়িয়ে ধরলেন, তিনি দেখলেন তার দুটি চোখে সম্মতির মৃদু দিপ্তী।
*
মহারাজ, এক পত্রবাহক বৈরাম খানের কাছ থেকে খবর নিয়ে এসেছেন।
তাঁকে এক্ষুনি আমার কাছে নিয়ে আসো। নিজ কক্ষে পায়চারি করছিলেন হুমায়ুন। অবশেষে… কিন্তু কি খবর নিয়ে এসেছেন সেই ব্যক্তি? হুমায়ূনের শ্রেষ্ঠত্বের গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়ানো শক্তির বিরুদ্ধে গত কয়েক মাস আগে বৈরাম খান বিশ হাজার সেনার নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়েছেন। সর্বশেষ শিরহিন্দে যুদ্ধের পর সিকন্দর শাহ হিমালয়ের পাদদেশে পালিয়ে যান। তিনি আবারও পাঞ্জাবের সমতল ভূমিতে এসেছেন এবং সমর্থন কুড়ানোর চেষ্টা করছেন। বৈরাম খানের আগের রিপোর্ট ছিল বেশ সাহস যোগানোর মতো, এতে সিকন্দর শাহের বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে তাঁকে ঘায়েল করার কথা উল্লেখ রয়েছে। সিকন্দর শাহ আবারও পার্বত্যাঞ্চলে পালিয়ে যান। তারপর থেকে সবকিছু বেশ নীরব।
দিনের পর দিন হুমায়ূনের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ তাঁর পূত্র আকবর। পূত্রকে বৈরাম খানের সঙ্গে পাঠানোর জন্য চাওয়া হয়েছিল। তখন আগ্রহ না থাকার পরও হুমায়ুন রাজি হয়েছিলেন। নির্দেশ দিয়েছিলেন যে আকবরকে যুদ্ধ থেকে বিরত রাখতে হবে। আকবর তার দুধ-ভাই আদম খানের পিতা নাদিম খাওজার বিশেষ হেফাজতে থাকবেন। আকবরও বৈরাম খানের সঙ্গে যান। যদিও বিষয়টি তাঁর মনকে গর্বে ভরে দিয়েছে, তবে এটা তার জন্য দেখাটা কঠিন যে তাঁর একমাত্র ছেলে স্বতস্ফূর্তভাবে যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে। এটা হামিদার জন্য আরও কঠিন। যদিও তারা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা থেকে বিরত থাকছেন, হুমায়ুন জানেন, হামিদা কতগুলো রাত এ নিয়ে দুচিন্তা করে কাটিয়েছেন। তবে তাঁদের সৌভাগ্য যে
অপেক্ষার পালা এখন শেষ হতে যাচ্ছে।
হুমায়ুনের উপস্থিতির কথা ঘোষণা করা হল। বার্তাবাহকের ধূলোবালিপূর্ন জামা প্রমাণ করে যে তিনি বেশ কয়েক ঘন্টা ধরে পথে ছিলেন। হুমায়ূন আসার পর তাঁর দিকে সম্মানার্থে মাথা ঝুঁকালেন তিনি। তারপর চামড়ার থলে থেকে একটি পত্র বের করলেন। মহারাজ, আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে এই পত্রটি আপনাকে ছাড়া আর কারো কাছে না দেয়ার জন্য। হুমায়ুন আগ্রহের সঙ্গে পত্রটি হাতে নিলেন এবং হঠাই খানিকটা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তবে তার এই ভাবনাটা ছিল বোকামী। তিনি ধীরে ধীরে পত্রটি খুললেন এবং ফারসি হরফে বৈরাম খানের হাতের সুন্দর, পরিচ্ছন্ন লেখা দেখতে পেলেন।
মহারাজ, খুশির খবর। আপনার সৈন্য বাহিনী বিশ্বাসঘাতক সিকন্দর শাহকে পরাজিত করেছে। পরাজিত হয়ে নিজের সৈন্য বাহিনীকে তাঁদের ভাগ্যের কাছে ছেড়ে তিনি কাপুরুষের মতো পশ্চিমপ্রান্তে বাংলার দিকে পালিয়ে গেছেন। আমরা পাঁচ হাজার যুদ্ধবন্দিদের আটক করেছি এবং বেশ কিছু জিনিসপত্র হাতিয়ে নিয়েছি। একমাসের মধ্যে, স্রস্টার ইচ্ছা থাকলে, আমি আপনার সৈনাবাহিনী নিয়ে দিল্লিতে ফিরে আসতে পারব এবং আমাদের এই অভিযানের সম্পূর্ণ বৃত্তান্ত আপনাকে সরাসরি জানাতে পেরে অবশ্যই আনন্দ পাব। আপনার ছেলে ভালো আছেন এবং আপনাকে ও মহারানীকে তাঁর সালাম জানাতে বলেছেন।
কিছুক্ষণ নীরব আনন্দে মাথা নত করলেন হুমায়ুন। তারপর তিনি তার রক্ষীদের উদ্দেশ্যে জোরে বললেন, দূর্গের চৌকিঘর ও নগরীর দেয়ালের ওপর তুর্যধ্বনি শুরু করা হোক। আমরা একটা বড় বিজয় লাভ করেছি এবং সারা বিশ্বের বিষয়টি জানা উচিৎ।
*
যখন পশ্চিমের আকাশ খয়েরি রঙ ধারণ করেছে, হুমায়ূন শুনতে পেলেন তুর্যের উচ্চধ্বনী। ঘোষণা করা হয়েছে পশ্চিমের ফটক দিয়ে প্রবেশ করছেন বৈরাম খান। কিছুক্ষণ পর হুমায়ুনের ব্যক্তিগত রক্ষীদের একজন তাঁর কাছে আসলেন। তাঁর গায়ে গাঢ় সবুজের একটি ঢিলেঢালা জামা।
বৈরাম খানের পক্ষ থেকে আমার জন্য উপহার আছে বলে আশা করছি?
হ্যাঁ, মহারাজ।
তবে চলো আমরা এগিয়ে যাই। ছয় জন দেহরক্ষী সঙ্গে নিয়ে হুমায়ূন সভাকক্ষের দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁর সিংহাসনের ডানপাশের টেরাকোটা ফুল আঁকা দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেন। জওহরসহ তার সভাসদ, সেনাপতি ও রাজকর্মচারীরা ইতোমধ্যে সভাকক্ষে হাজির হয়ে সিংহাসনের সামনে গোলাকার হয়ে দাঁড়িয়েছেন। গাউনের উপরের হলুদ, লাল ও নীল লেবাস নিয়ে তাবরিজের উন্নত গারিচার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা তাদেরকে বেশ জমকালো মনে হচ্ছিল। তাদের পাগড়ি, গলা ও হাতের আঙ্গুল থেকে বিভিন্ন স্বর্ণালঙ্কার দ্যুতি ছড়াচ্ছিল। হুমায়ুনকে দেখামাত্র সকলেই অবনত হয়ে সম্মান প্রদর্শন করলেন।
তবে তার আগ্রহ এই সভাসদের প্রতি নয়, বরং বৈরাম খান ও আকবরের প্রতি। তিনি দুই দরজা পার হয়ে একটু দূরের একটি কক্ষে তাদের দেখতে পাচ্ছেন। তবে তিনি তার সভাসদদের ডেকেছেন বিজয়ী সেনাপতিদের কথা জানাতে এবং তাঁদের সঙ্গে এই বড় আনন্দ ভাগাভাগি করতে। সিংহাসনে বসে হুমায়ূন তার হাত তুলে বললেন, চলুন বৈরাম খানের সঙ্গে সাক্ষাত করি। এই ঘোষণার পর তার সেনাপতি সভাকক্ষে প্রবেশ করলেন। সিংহাসনের কাছে এসে তিনি শ্রদ্ধাবনত হলেন।
বৈরাম খান, আপনাকে স্বাগতম, বললেন হুমায়ুন। তারপর তিনি তাঁর কয়েকজন রাজকর্মচারির দিকে তাকালেন। এই রাজ কর্মচারীরা তার দিকে ফিরোজা রঙের রত্ন নিয়ে এগিয়ে আসলেন। রেশমি কাপড়ে রূপার তার নিয়ে মোড়ানো এই রত্ন বাম হাত দিয়ে গ্রহণ করলেন হুমায়ূন। তিনি এটি বৈরাম খানের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। বৈরাম খান দেখতে পেলেন এর ভেতরের রত্নের উজ্জ্বলতা।
বৈরাম খান, আপনি এমন এক যোদ্ধা যার জন্য এই সামান্য রত্ন খুবই তুচ্ছ। তবে আপনার জন্য আরও কিছু আমার দেয়ার আছে। আপনি হবেন খান ই খানান, সারা মোগল সৈন্য বাহিনীর প্রধান নির্দেশদাতা।
মহারাজ, আরও একবার মাথা ঝুঁকালেন বৈরাম খান। তবে এবার হুমায়ূনের সামনে নয়। তার কালো দুই চোখে বিস্ময় ঝলক দিয়ে উঠল। এটা সেনাপতিদের পুরস্কৃত করার বেশ ভালো পন্থা, যাঁরা তাঁদের পারস্য মাতৃভূমি তার জন্য ছেড়েছেন এবং এ ধরনের আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। জাহিদ বেগও সম্মাননা। প্রত্যাশা করেন এবং নিশ্চিত তিনি তা পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন। তবে সম্প্রতি তিনি তাঁর পূর্বপুরুষের ভূমি কাবুলে ফিরে যেতে চাওয়ার কথা জানিয়েছেন। তিনি বয়স্ক এবং তাঁর স্বাস্থ্যের অবস্থাও তেমন ভালো না। যোদ্ধা হিসেবে তার সময়টা প্রায় চলে গেছে, তবে হুমায়ূন যদি চান তাহলে তিনি আসবেন।
হুমায়ূন বৈরাম খানকে উপস্থিত সভাসদদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের সুযোগ করে দিলেন। পরবর্তী ভরা পুর্ণিমার রাতে আমরা পুরানা কিল্লায় অনেকগুলো প্রদীপ ও মোমবাতি দিয়ে আলো জ্বালব। এই আলোর তেজ পুর্ণিমার জ্যোৎস্নাকেও ম্লান করে দেবে। সে রাতে আমরা বিজয়কে উদযাপন করতে ভোজের আয়োজন করব। হুমায়ূন আবারও তার সভাসদদের দিকে ফিরে তাকালেন। আমার প্রিয় পূত্রকে এবার আমার সামনে নিয়ে আসো।
আকবর সামনে আসার পর হুমায়ূন তাঁর দিকে ভালোবাসা ও গর্ব নিয়ে তাকালেন। বেশ কয়েক মাস পর পূত্রের সঙ্গে পিতার সাক্ষাত। বেশ কিছুটা পরিবর্তন দেখা গেছে আকবরের মধ্যে। সবুজ কাপড়ের ওপর তাঁকে আগের চেয়ে লম্বা এবং তাঁর বৃহৎ বক্ষদেশ, দৃঢ় পেশিবহুল তরুণ হিসেবে দেখা যাচ্ছিল। হুমায়ূন লক্ষ্য করলেন তার মধ্যে এতোটা উৎফুল্লতা নেই। যখনই পুত্র আকবর কাছে আসলেন এবং সম্মানার্থে তাঁর ডানহাতটি নিয়ে বুকে লাগালেন হুমায়ূন, তিনি দেখলেন তার একটি হাতে ব্যান্ডেজ করা রয়েছে। হুমায়ূন প্রশ্ন করার আগেই বৈরাম খান এই আঘাত সম্পর্কে বলতে শুরু করলেন।
মহারাজ, আপনার পরামর্শ অনুযায়ি গুরুত্বপূর্ণ অভিযানগুলো চলাকালে রাজপূত্রকে রক্ষীরা বেশ ভালোভাবে খেয়াল রেখেছেন। একদিন সন্ধ্যার পর আমরা সিকন্দর শাহকে একদম ছন্নবিচ্ছন্ন করে দেই। আমার সহযোদ্ধারা জানায়, তারা পর্বতের পাশে একদল সৈন্যের বিচরণ লক্ষ্য করেছে। প্রায় ১ হাজার সেনা বাহিনীর একটি দল নিয়ে আমি সেই সৈন্য বাহিনীর মোকাবেলা করা সিদ্ধান্ত নেই। এরসঙ্গে বেশ কিছু অস্ত্রের মজুত নিয়ে আকবরকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই, যাতে তিনি যুদ্ধের অভিজ্ঞতা লাভ করেন। আমি ভেবেছিলাম ওই সৈন্য বাহিনী হয়তো সেখানে সামান্য প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে। আমরা একটি গিরিপথ ধরে যাই। সেখানে হঠাৎ পাথর ধ্বসের ঘটনা ঘটে। সে সময় পাথরের টুকরো পড়া শুরু হয়। তখন আমাদের তিন সৈনা নিহত হয়। রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়।
আমাদের অধিকাংশ সৈন্য দল সেই স্থান থেকে সামনে চলে যায়, তবে আমাদের শেষ একশ সৈন্য মূল্য বাহিনী থেকে আলাদা হয়ে পড়ে। তখন অন্ধকার নেমে আসছিল এবং আরও পাথর পতনের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছিল। যারা আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, আমি তাদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বললাম, তারা যে। পথে এসেছে সে পথে যেনো ফিরে যায়। আমি তখন এই গিরিখাতের সরু পথ থেকে সৈন্যদের নিয়ে বের হয়ে আসি। আমাদের বেশ কিছু শক্তিশালী সৈন্য গিরিপথ বন্ধ করে দেয়া পাথরের স্তূপ সরানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা জানতে পারি, ভোর হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা এই কাজ শেষ করতে পারব না… আমি রাজপূত্রের জন্য সবচেয়ে বেশি চিন্তিত হয়ে পড়ি, তিনি তাঁর দুদ্ধভাইয়ের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া সেই একশ সৈনের মধ্যে ছিলেন। তবে … বৈরাম খান থামলেন। রাজপূত্রকেই তাঁর গল্পটি বলার সূযোগ দেয়া উচিৎ…
আমি শুনতে পেলাম বৈরাম খান চিৎকার করে বললেন গিরিপথ থেকে বের হয়ে যেতে। আকবর আগ্রহের সঙ্গে বলতে শুরু করলেন। কিন্তু আমরা আমাদের রসদগুলো নিয়ে এতোদ্রুত ফেরার সুযোগ পাইনি, গিরিপথটি ছিল খুবই সংকীর্ণ হঠাৎ বেশ কিছু লোক আমাদের ওপর হামলা চালালো। তারা ছিল পাথরের ওপর। নিচ থেকে খুব কমই আমরা দেখতে পাই। আমরা দেখলাম সিকন্দর শাহের সৈন্যদের। তাদের কাছে তেমন অস্ত্রসস্ত্র নেই। কোনো মুখোশ ছিল না। শুধু তীর আর ধনুক। আমরা তাদেরকে প্রথমে পর্বতের উপজাতি গোষ্ঠি মনে করেছিলাম, যারা আমাদের এই পথে যাওয়াটা লক্ষ্য করছে এবং লুণ্ঠন করার চিন্তা করছে। তারা আমাদের ওপর পাথরও ছুঁড়ে মারতে পারে… তারা যারাই হোক, তাঁদের ধনুক আর বর্শা কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের চারপাশে বেশ ঘনভাবে পড়তে থাকল। আমাদের বেশ কয়েকজন এতে আঘাতপ্রাপ্ত হলেন।
.
আমি আমার সৈন্য দলকে বললাম ওয়াগনের পেছনে গিয়ে অবস্থান করতে। হামলাকারিদের ওপর আমাদের সঙ্গে থাকা কয়েকটি বন্দুকের গুলি ছুড়ারও নির্দেশ দিলাম আমি। তাদের চোখে নিরাশায় অস্তাচলের সূর্যের হলুদাভ আভা। তবে সেই বন্দুকের গুলি ছিল হামলাকারীদের ভয় দেখানো জন্য যথেষ্ট। কমপক্ষে তাদের একজনকে আমার পেলাম। তাঁর শরীর নিচে পড়ে গেল। আমরা দেখলাম তাঁর মাথায় একটি বন্দুকের গুলি। আমরা যদিও সারা রাত নিজেদের একটু সুরক্ষিত রাখতে আড়ালে অবস্থান করছিলাম, সে রাতে তারা আর ফিরে আসেনি। পরেরদিন সকালে পাথর সরানোর পর আমরা মুল সৈন্য বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেই।
আর আপনার হাত?
এটা আমার প্রথম যুদ্ধের আঘাত একটি তীরের আঘাত। আদম খান এটি আসতে দেখে আমাকে একপাশে সরিয়ে নেন। তা না হলে এটা আমার দেহে আঘাত হানতে পারত… আকবরের কাজল চোখে জল চলে এলো- অনেকটা হামিদার মতো, কারণ তিনি একটি সৈন্য দলকে রক্ষা করেছেন।
আপনি নিজেকে বীরত্বের সঙ্গে রক্ষা করেছেন বললেন হুমায়ূন। সিংহাসনের ডান দিকে গ্রীলের আড়াল থেকে হামিদা এসব দেখছিলেন ও শুনছিলেন। তবে মাতৃত্বের কারণে ভয় সৃষ্টির পরও তিনি আকবরকে নিয়ে গর্বিত হয়েছেন। সংকটের মুহূর্তে মাথা ঠান্ডা রেখে বেঁচে থাকার জন্য যে অপরিহার্য দক্ষতা তিনি দেখিয়েছেন
*
সেই রাতে হামিদা ও হুমায়ুনে সঙ্গে হেরেমে খাবার খেলেন আকবর। যখন হুমায়ূন তাঁর অপরূপ সুন্দরী স্ত্রী আর সুদর্শন, শক্তিশালী ও আত্মবিশ্বাসী ছেলেকে দেখলেন, তাঁর বুকটা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে গভীর আত্মতৃপ্তিতে ভরে উঠল। অবশেষে যেনো তাঁর জীবনের সকল গৌরব সেই স্থানটিতেই ছড়িয়ে পড়ল। স্রস্টা তাঁর অশেষ দয়ায় যে সাম্রাজ্য তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন, তা এখন নিরাপদ এবং এই সাম্রাজ্যে বিস্তৃতি ঘটাবেন তার পাশে থাকা পূত্র আকবর। একদিন আকবরই সাম্রাজ্য বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন যুদ্ধ সামনে থেকে পরিচালনা করবেন। মোগল সাম্রাজ্য সমুদ্রের পর সমুদ্র ছাড়িয়ে যাবে।
হামিদাকেও বেশ খুশি মনে হচ্ছিল। তার মুখে নতুন এক আলোর আভা দেখা যাচ্ছিল এবং তার রেশমের কাপড়ের ওপর দিয়ে শরীরের নম্র ভাঁজগুলোও ভেসে উঠছিল। কৈশোরের দিনগুলোর চেয়ে তার দেহে এখন অনেক বেশি ভোগবিলাসিতার ছাপ। আগের চেয়ে বেশি সুন্দরীও তিনি। আজ রাতে কালো চুলের মধ্যে নীলকান্ত মনির সঙ্গে হীরের টুকরো লাগিয়ে সেজেছেন তিনি। সেখানে হীরা থেকে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। অনাচ্ছাদিত নাভীতে একটি নীল কান্ত মনিও লাগিয়েছেন হামিদা। পরেছেন একটু ঢিলেঢালা পায়জামা। উপরে একটি জামা যা তাঁর শরীরের সঙ্গে লেগে আছে এবং স্ফিত স্তনদুটিকে অনেকটা স্পষ্ট করে তুলেছে।
নৈশভোজের পর আকবর চলে গেলে হামিদাকে জিজ্ঞেস করেন হুমায়ুন, হে আমার সম্রাজ্ঞী, আপনার কেমন লাগল?
আমি আপনাকে বহুবার বলেছি তিনি হাসলেন খুবই ভালো লেগেছে। শত শত রাজকর্মকর্তা কর্মচারি… আমার চিরায়ত অপেক্ষা… আমার জীবনে আমি কোনো কিছু কল্পনা করা বা আকাঙ্খা করতে পারি। কিন্তু সবকিছুর পর আমাকে যে বিষয়টি বেশি খুশি করে তা হলো আমাদের সন্তান নিরাপদভাবে ফিরে এসেছে। সে। আমাকে এই আনন্দে পুর্ণ করেছে। এটা ভাবা এখনও অদ্ভুত মনে হয় যে আমাদের কাছ থেকে নেয়ার পর যখন হিন্দাল তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিল- আকবরকে মন হচ্ছিল যেন সে আমাকে চেনে না। সে মাহাম আগাকে নিয়ে ঈর্ষাণিত ছিল, আমি দেখলাম সে তার হাত কীভাবে আগার দিকে এগিয়ে দিল এবং তার জন্য হাসল, আমার দিকে নয়। আমি তখন নিজের প্রতি খুব ক্ষুদ্ধ হয়েছিলাম, নিজের ঈর্ষার জন্যও ছিলাম চরম লজ্জিত। বীর মহাম আগার কাছ থেকে আমরা সবকিছুই প্রায় পেয়েছি… তবে এখন সবই অতীত। এখন আমি মনে করি আকবরের মাথায় যে ভাবনাই আসুক আমি তা উপলব্ধি করতে পারি। আমি তাঁর সকল উচ্চাকাঙ্খ ও অভিলাস বুঝতে পারি।
.
আমি স্মরণ করতে পারছি, বিবাহের প্রথম রাতের পর সকালে আপনি আমাকে বলেছিলেন- আপনি জানেন আপনি এক পূত্র সন্তানের জন্ম দেবেন। আর একদিন এবং সেই সন্তান হবে এক শ্রেষ্ঠ শাসক… আপনি ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে এখন কী দেখছেন?
আকবরের জন্মই ছিল শেষ বিষয় যা আমি আগেই স্পষ্টভাবে আগে থেকে বুঝতে পেরেছিলাম। যদিও আমার উত্তরসূরিদের কাছ থেকে নারী হিসেবে আমি আধ্যাত্বিক ক্ষমতা পেয়েছি, সেগুলো আমাকে এখন অনেকটাই ছেড়ে গেছে… তবে ওই ভবিষ্যৎ দর্শনটাই ছিল সবচেয়ে উত্তম। ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতা সবসময় সুখ নিয়ে আসতে নাও পারে… কখনো না দেখাটাও ভাল…