০৯. ভাইয়ে ভাইয়ে রেষারেষি
উষ্ণ, নিথর হয়ে থাকা বাতাস, ইতিমধ্যে আর্দ্রতায় ভারী হয়ে উঠেছে যা সপ্তাহখানেকের ভিতরেই আকাশ থেকে বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে ঝরে পড়বে, অসহনীয় হয়ে উঠেছে। তার পরনের ইস্পাতের শিকল দিয়ে তৈরী বর্ম আর মিহি সুতির কাপড় দিয়ে তৈরী জোব্বার নীচে, হুমায়ুনের পিঠ বেয়ে টপটপ করে ঘাম ঝরছে। তাঁর মুখাবয়বেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। অসহিষ্ণুভাবে সে একটা রুমাল দিয়ে মুখটা মুছতে গিয়ে টের পায়ে নোনতা বিন্দুগুলো প্রায় সাথে সাথে আবার পূর্বের আকৃতি লাভ করেছে। সে পুতবেগে যখন, সামনে দেহরক্ষী আর অশ্বারোহী যোদ্ধাদের একটা দল তাঁর অনুগত কমলা রঙের আলখাল্লা পরিহিত রাজপুতরা সেখানে রয়েছে তাঁর পেছনে পেছনে আসছে, আগ্রা অভিমুখে ফিরে চলেছে তাঁর তাম্রবর্ণের ঘোড়াটার খুরের ছন্দোবদ্ধ বোলে, মনে হয় যেন তিক্ত একটা বার্তা সবার কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। পরাজয় আর ব্যর্থতা। পরাজয় আর ব্যর্থতা। শব্দ দুটো তার মাথার ভিতরে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে কিন্তু তারপরেও যা ঘটে গিয়েছে সেই পুরো। বিষয়টা তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।
সে সৈন্যদের যে দলকে পুনরায় সমবেত করার আশা করেছিল তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ তাদের নিজ নিজ প্রদেশে ফিরে গিয়েছে কিন্তু বেশীরভাগই শেরশাহের অগ্রগামী বাহিনীর সামনে থেকে পালিয়ে গিয়েছে। তারা বিশ্বাস করে যে এক অন্ত্যজ ঘোড়ার কারবারীর ছেলে মোগলদের ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম… যে কোনো দৈহিক ক্ষতের চেয়েও এর বিশালতা অনেকবেশী যন্ত্রণাদায়ক, কিন্তু তারচেয়েও মারাত্মক এই ভাবনাটা যে যুদ্ধক্ষেত্রে সে অমিত সাহসের সাথে লড়াই করা সত্ত্বেও সে এমন একটা ব্যাপার মেনে নিয়েছে।
তার সৌভাগ্য এখন কোথায় গেল? পানিপথে, টসটসে পাকা একটা ডালিমের মতো হিন্দুস্তান মোগলদের হাতে এসে ধরা দিয়েছিল। বাহাদুর শাহ আর লোদি রাজ্যাভিযোগীকে হেলাফেলা করে মাত দেবার পরে তাঁর বুঝি ধারণা হয়েছিল মোগল সাম্রাজ্য অজেয়। সে সম্ভবত তাঁর নতুন সাম্রাজ্যের প্রকৃতি এখনও পুরোপুরি বুঝতে পারেনি- বিদ্রোহ এই অঞ্চলের সহজাত বৈশিষ্ট্য। সে যত অভ্যুত্থানই দমন করুক, যত বিদ্রোহীকেই কবন্ধ করুক, তারপরেও আবারও বিদ্রোহের সম্ভাবনা ঠিকই রয়ে যাবে। শেরশাহের সাফল্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, শক্ররা এখন দক্ষিণ আর পশ্চিমদিক থেকে আর সেই সাথে পূর্বদিক থেকেও হুমকি দিতে আরম্ভ করেছে।
হুমায়ুন নিজের হতাশায় বিমূঢ় হয়ে তার দস্তানা পরিহিত হাত দিয়ে এতোই জোরে তার ঘোড়ার পর্যানের সামনের দিকে উঁচু হয়ে থাকা বাঁকানো অংশে আঘাত করে যে, ঘোড়াটা ভড়কে গিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে আর চিহি শব্দ করে বেমক্কা একদিকে দৌড়াতে শুরু করে যে আরেকটু হলে সে নিজেই ঘোড়া থেকে পড়ে যেত। হাঁটু দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে সে জন্তুটাকে বশে আনে, তারপরে লাগামে ঢিল দিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে এবং জন্তুটার ঘামে ভেজা গলায় আলতো চাপড় দিয়ে তাঁকে আশ্বস্ত করে। সে মনে মনে ভাবে, যাই হোক, ভাগ্য সহায় থাকলে রাতের আগেই সে আর তার সাথের অগ্রবর্তী দলটা আগ্রা পৌঁছে যাবে। তাঁর অবশিষ্ট সৈন্যসামন্তের যদিও কামানবাহী শকট, মালবাহী গাড়ি, আর হাজারের উপরে ভারবাহী পশুর দল- আরো এক সপ্তাহ বা হয়তো আরো বেশী দিন লাগবে শহরে পৌঁছাতে, পরবর্তী পদক্ষেপ বিবেচনা করার জন্য তাঁর হাতে খুব একটা বেশী সময় নেই। তার গুপ্তদূতদের ভাষ্য অনুযায়ী, শেরশাহ তাঁর অগ্রযাত্রা স্থগিত রেখেছেন, অন্তত সাময়িকভাবে হলেও, কনৌজেই তিনি অবস্থান করছেন। তিনিও সম্ভবত রসদপত্রের মজুদ মিলিয়ে দেখছেন…
বস্ততপক্ষে মধ্যরাতের অনেক পরে, যমুনার পাড় বরাবর আগ্রার অন্ধকারাচ্ছন্ন সড়কের উপর দিয়ে হুমায়ুনের পরিশ্রান্ত ঘোড়াটা তাঁকে নিয়ে আগ্রা দূর্গের দিকে উঠে আসে। দূর্গের মূল তোরণদ্বারের উপরে রক্ষিত নাকাড়াগুলো রাতের আবহে গমগম করে উঠতে, দূর্গপ্রাকারের উপরে মশালদানিতে রাখা জ্বলন্ত মশালের দপদপ করতে থাকা কমলা আলোর মাঝে অশ্বারূঢ় হয়ে সে খাড়াভাবে দূর্গ অভিমুখে উঠে যাওয়া পথটা দিয়ে সোজা ভিতরের প্রাঙ্গণে এসে উপস্থিত হয়। হুমায়ুন পরিশ্রান্ত অবস্থায় ঘোড়ার পর্যান থেকে নীচে নেমে আসতে একজন সহিস দৌড়ে এসে তার হাত থেকে ঘোড়ার লাগামটা নিয়ে নেয়।
সুলতান। কালো আলখাল্লায় মোড়া একটা অবয়ব সামনের দিকে এগিয়ে আসে। অবয়বটা আরো কাছে আসতে, সে তার নানাজান বাইসানগারকে চিনতে পারে। স্বাভাবিকভাবে বেশ সবল, এমনকি বলিষ্ঠ, তাঁর চোখেমুখে দুশ্চিন্তার বলিরেখা দেখা যায়, তাঁর বাহাত্তর বছর বয়সে এই প্রথম সবাই তার এই চেহারা দেখছে এবং তাঁর দিকে এক পলক তাকিয়েই হুমায়ুন সাথে সতর্ক হয়ে উঠে যে অপরিজ্ঞেয় আর অনাকাঙ্খিত কিছু একটা ঘটে গেছে।
কি ব্যাপার? কি হয়েছে?
আপনার আম্মিজান অসুস্থ। গত ছয় সপ্তাহ ধরে তিনি তাঁর বুকে একটা ব্যাথা অনুভব করছিলেন, এতোটাই তীব্র তাঁর মাত্রা যে কেবলমাত্র আফিম দিয়েই তাঁর কষ্টের খানিকটা উপশম ঘটতো। হাকিমেরা আগেই জানিয়ে দিয়েছিল তার ব্যাপারে তাঁদের কিছুই করার নেই। আমি আপনার কাছে বার্তাবাহক প্রেরণ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু তিনিই আমাকে নিষেধ করেছেন সামরিক অভিযানের সময় আপনার মনোযোগ ভিন্নমুখী করা আমার উচিত হবে না…কিন্তু আমি এটাই জানতাম আপনাকে এক পলক দেখার জন্য তিনি ব্যাকুল হয়ে আছেন। এই একটা আকাঙ্খাই তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছিল…
আমি তাঁর সাথে দেখা করবো। বর্গাকার প্রস্তরফলকের মেঝের উপর দিয়ে দ্রুত পায়ে মায়ের আবাসন কক্ষের দিকে হেঁটে যাবার সময়, হুমায়ুনের চারপাশের লাল বেলেপাথরের দূর্গটা যেন শূন্যে মিলিয়ে যায়। সে আবারও কাবুলের একটা বালকে পরিণত হয়- তৃণভূমির উপর দিয়ে তাঁর টাটু ঘোড়াটা দুলকি চালে ছুটিয়ে, বাইসানগারের স্থাপিত খড়ের লক্ষ্যবস্তুর দিকে পর্যানে উপবিষ্ট অবস্থায় ক্রমাগত তীর নিক্ষেপ করছে এবং মাহামকে মুগ্ধ করার জন্য নিজের দক্ষতা আর সাহসিকতার অতিরঞ্জিত গল্পগুলো ইতিমধ্যে মনে মনে আউড়াতে শুরু করেছে।
সে যখন তার আম্মিজানের অসুস্থতার জন্য সংরক্ষিত কক্ষে প্রবেশ করতে, তাঁর নাসারন্ধ্র প্রশান্তিদায়ক সুগন্ধিতে ভরে যায়। গন্ধটা তাঁর আম্মিজানের খাটের চারপাশে স্থাপিত চারটা লম্বা ধূপাধার থেকে আসছে যেখানে রেজিনের সোনালী রঙের স্ফটিক ধিকিধিকি জ্বলছে। সবুজ শুজনির নীচে মাহামকে খুবই ছোট দেখায়, তাঁর মুখের ত্বক কাগজের মতো পাতলা কিন্তু তাঁর বিশাল কালো চোখ আজও তাদের সৌন্দর্য ধরে রেখেছে এবং চোখের তারায় নিজের ছেলেকে দেখতে পেয়ে সেখানে আন্তরিকতা, আবেগ এসে ভীড় করে। হুমায়ুন ঝুঁকে মায়ের কপালে চুমু খায়। আমাকে মার্জনা করবেন- আমি যাত্রাপথের ঘাম আর ধূলো নিয়েই আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি।
আমার সুদর্শন যোদ্ধা…তোমার আব্বাজান ভীষণ গর্ব করতেন তোমাকে নিয়ে…তিনি সবসময়েই বলতেন তার সব সন্তানের ভিতরে তুমিই সবচেয়ে যোগ্য, শাসক হবার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত…আমাকে তিনি শেষ যে কথাগুলো বলেছিলেন, মাহাম, আমার যদিও আরও সন্তান আছে, আমি তাদের কাউকে হুমায়ুনের মতো ভালোবাসি না। সে তার হৃদয়ের অভিলাস হাসিল করবে। তাঁর সমকক্ষ কেউ হবে না। তিনি তাঁর শুষ্ক হাত দিয়ে হুমায়ুনের গাল স্পর্শ করেন। আমার সম্রাট, আমার বাছা, তুমি কেমন আছো? আমাদের শত্রুকে তুমি কি পরাস্ত করেছে?
হুমায়ুন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবে, যাক তাঁর দুর্ভাগ্যের খবর তাহলে আম্মিজানকে কেউ জানায়নি। জ্বী আম্মিজান, সবকিছু ঠিক আছে। এখন আপনি ঘুমান। সকালে আমি আবার আসবো এবং তখন আমরা প্রাণ খুলে কথা বলবো। কিন্তু মাহাম ইতিমধ্যে চোখ বন্ধ করে ফেলেছেন এবং হুমায়ুন সন্দিহান যে তিনি তার কথা শুনতে পেয়েছেন।
খানজাদা পাশের উপকক্ষে তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাঁকে বিধ্বস্ত দেখায়- হুমায়ুন ধারণা করে মাহামের শয্যাপার্শ্বে অসংখ্য প্রহর তিনি নিন্দ্রাবিহীন কাটিয়েছেন কিন্তু হুমায়ুনকে দেখতে পেয়ে তার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। আগ্রায় নিরাপদে তোমার পৌঁছাবার সংবাদ জানতে পেরে আমি আল্লাহতালার কাছে শুকরিয়া প্রকাশ করেছি, তিনি তাঁর গালে চুমু দিতে দিতে কথাগুলো বলেন।
আমাকে হেকিমদের সাথে কথা বলতে হবে…
তাদের সাধ্যমতো তারা করেছে। আমরা এমনকি আব্দুল-মালিকের সাথে আলোচনা করার জন্যও তোক পাঠিয়েছিলাম, তোমার আব্বাজানকে যখন বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল তখন কিভাবে তার হাতযশ তাকে সুস্থ করে তুলেছিল সেটা সম্বন্ধে অবগত থাকায়। যদিও এখন তাঁর বয়স হয়েছে এবং চোখে ভালোমতো দেখতে পান না, কিন্তু তার মস্তিষ্ক এখনও পরিষ্কার কাজ করে। কিন্তু তাকে যখন রোগের উপসর্গগুলো বলা হয় তিনি সাফ জানিয়ে দেন মাহামের যন্ত্রণা উপশম করা ব্যাতীত আমাদের আর কিছুই করার নেই। খানজাদা চুপ করে থেকে কিছু একটা ভাবেন। মাহাম কেবল একটা বিষয়ের জন্য প্রতীক্ষা করেছিল- হুমায়ুন, তোমাকে আরেকবার চোখে দেখবে। এখন সে শান্তিতে মরতে পারবে…
হুমায়ুন চোখ নামিয়ে যুদ্ধের ক্ষতযুক্ত হাতে তৈমূরের অঙ্গুরীয়ের দিকে তাকায়। আমি এইমাত্র তাকে মিথ্যা কথা বলেছি…আমি তাকে বলে এসেছি আমাদের শত্রুদের আমি পরাস্ত করেছি। কিন্তু তিনি যখন বেহেশত থেকে আমাকে দেখবেন আমার জন্য তখন তিনি গর্ববোধ করবেন- আমি দিব্য করে বলছি… কিছু বুঝে উঠবার আগেই সে টের পায় তার গাল বেয়ে অশ্রু ঝরছে।
দুইদিন পরে, আরও তিনজন লোকের সাথে হুমায়ুনকে তাঁর মায়ের চন্দনকাঠের শবাধারে, কর্পূর পানিতে গোসল করিয়ে সাদা কাফনে জড়ান অবস্থায়, বহন করতে দেখা যায়, যমুনাতে অপেক্ষমান একটা নৌকা তাদের গন্তব্য। একটা দৃষ্টিনন্দন ফুলের বাগান- নদীর অপর পাড় থেকে বেশ খানিকটা ভেতরে তাঁর মরহুম আব্বাজান বাবরের তৈরী অনেকগুলো বাগানের একটা, যেখানে মাত্র ফুল ফুটতে আরম্ভ করেছে তার সমাধির জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। হুমায়ুন আড়চোখে একবার তার পাশে পাশে হাঁটতে থাকা বাইসানগারের দিকে তাকায়। তাঁর নিজেরই অনেক বয়স হওয়া সত্ত্বেও তিনি খানিকটা পীড়াপীড়ি করেই নিজের মেয়ের অন্তিমযাত্রায় অংশ নিয়েছেন। সামনের দিকে ঝুঁকে পড়া লোকটাকে এখন কি ভীষণ রোগা লাগছে- বাবরকে সমরকন্দ দখলে সাহায্য করতে গিয়ে নিজের জীবনকে বিপন্ন করে তোলা সেই যোদ্ধার ছায়া মাত্র এখন তাঁকে দেখে মনে হয়।
হুমায়ুনকে আরও গভীর এক বিষণ্ণতা আচ্ছন্ন করে তোলে- মাহামের মৃত্যুই কেবল না বরং যৌবনের অনেক নিশ্চয়তার নিরাপত্তা শেষ হয়ে আসছে এই বোধটা তাকে আরও বেশী ব্যাকুল করে। সারা জীবন সে ছিল অত্যধিক প্রশ্রয়ে বেড়ে উঠা এক যুবরাজ, পৃথিবীর বুকে নিজের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত, জীবনে যা কিছু পরম কাম্য সবকিছুতেই তার ন্যায্য অধিকার এমন একটা ধারণা নিয়ে সে বড় হয়েছে। অন্যদের কাজের কারণে বিড়ম্বনার শিকার হয়ে নিজেকে তার কখনও এতো নগন্য আর অরক্ষিত মনে হয়নি। তার আগে কখনও মনে হয়নি নিজের নিয়তি নিয়ন্ত্রণ করা এতো কঠিন।
হুমায়ুন বাকি সবার সাথে শবাধার বয়ে নিয়ে নদীর তীরে পৌঁছাবার পরে, সে মুখ তুলে আকাশের কালো মেঘের দিকে তাকায়। কোনো আগাম সতর্কতা না জানিয়েই হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়, প্রথমে বড়, ভারী ফোঁটা শীঘ্রই সেটা মুষলধারে নামতে শুরু করে হুমায়ুনের পরণের শোকের কালো আলখাল্লাটা ভিজিয়ে চুপচুপে করে তুলে। বৃষ্টিটা সম্ভবত একটা ইঙ্গিত, তাঁর মনে জমে উঠা সন্দেহ দূর করতে পাঠান হয়েছে, তাঁকে বলার জন্য যে যদিও কিছু বিষয়ের অবশ্যই সমাপ্তি ঘটবে, একজন নেতার জন্য সবসময়ে নতুন সূচনা অপেক্ষা করছে যে কখনও শোক কিংবা বিরুদ্ধতার মুখোমুখি হয়ে মুষড়ে পড়বে না বরং নিজের ক্ষমতা আর তার চূড়ান্ত বিজয়ের উপরে সে বিশ্বাস রাখবে।
*
হুমায়ুন তার চারপাশে উপস্থিত উপদেষ্টাদের দিকে তাকায়, সবার পরণে তার মতোই শোকের পোষাক, রীতি অনুযায়ী যা তাঁদের চল্লিশ দিন পরিধান করতে হবে। মাহামের মৃত্যুর পরে মাত্র চৌদ্দ দিন অতিবাহিত হয়েছে কিন্তু ভয়ঙ্কর বিপদাশঙ্কাপূর্ণ যে খবর সে পেয়েছে সেটা যদি সত্যি হয় তাহলে মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশের জন্য তাঁদের হাতে খুব অল্প সময়ই রয়েছে।
আহমেদ খান, আপনি নিশ্চিত…?
জ্বী, সুলতান, সারা দেহে সদ্য ভ্রমণ থেকে আসবার লক্ষণ স্পষ্ট ফুটে থাকা তার গুপ্তদূতদের প্রধান উত্তর দেয়। শেরশাহ প্রায় তিন লক্ষাধিক সৈন্যের একটা শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে। আমি নিজের চোখে এখান থেকে ঘোড়ায় মাত্র পাঁচ দিনের দূরত্বে তাদের অগ্রগামী বাহিনীকে দেখে আসছে।
সুলতান, তাঁর কথার সাথে আমরা যেসব খবর শুনেছি তার যথেষ্ট মিল আছে, কাশিম মন্তব্য করে। বৃষ্টি আরম্ভ হওয়া সত্ত্বেও শেরশাহ যথেষ্ট দ্রুতই এগিয়ে আসছে।
হুমায়ুন মনে মনে ভাবে, শেরশাহ অন্তত তাঁর পশ্চাদপসারনকারী বাহিনীর নাগাল পায়নি। এক সপ্তাহ আগে মূল বাহিনীটা নিরাপদে আগ্রা এসেছে যদিও আসবার পথে অনেকেই দলত্যাগ করেছে। তার মানে সে আগ্রা এসে আমাদের এখানেই আক্রমণ করতে চায়…আমাদের এই মুহূর্তে কত সৈন্য অবশিষ্ট রয়েছে? বাবা ইয়াসভালের স্থানে অশ্বারোহী বাহিনীর সর্বাধিনায়ক যাকে মনোনীত করেছে সেই হাল্কা পাতলা আর লম্বা আধিকারিক জাহিদ বেগের দিকে হুমায়ুন তাকায়।
সুলতান, কনৌজ থেকে যারা ফিরে এসেছে তাদের নিয়ে প্রায় আশি হাজার হবে, কিন্তু এই সংখ্যাটা প্রতিদিনই আশঙ্কাজনক হারে কমছে…
মাথা উঁচু করে হুমায়ুন তাঁর দরবার হলের অন্যপ্রান্তে অবস্থিত দূর্গচত্বরের দিকে তাকায়। বৃষ্টিপাত আপাতত বন্ধ রয়েছে এবং মেঘের ফাঁক দিয়ে নেমে আসা সূর্যরশ্মিতে লাল বেলেপাথর থেকে এক ধরনের আভা বিচ্ছুরিত হচ্ছে। তারা ঝড়ের বেগে হিন্দুস্তান অধিকার করার পরে এই দূর্গটা এখন পর্যন্ত মোগলদের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। গতরাতে হারেমের বিলাসিতা ঘুমাতে যাবার আগে প্রাকারবেষ্টিত দূর্গের ছাদে সে তাঁর ব্যক্তিগত জ্যোতিষী শারাফের সাথে দাঁড়িয়ে ছিল, অনেকদিন পরে তাঁরা দুজনে একসাথে রাতের আকাশ দেখেছে। কিন্তু শারাফ সেখানে কিংবা রাশিচক্রে বা গণনায়- নিয়তির কোনো বাণী খুঁজে পায়নি। নক্ষত্ররাজির এই মৌনতার মাধ্যমে কি আল্লাহতালা তাঁকে বলতে চায় যে তাঁকে নিজে এবং একাকী তাকেই নিজের রাজত্ব রক্ষার পথ খুঁজে বের করতে হবে…?
আমি যে ভয়টা করছিলাম আহমেদ খানের সংবাদ সেটাই কেবল নিশ্চিত করেছে। আমাদের সামনে আগ্রা পরিত্যাগ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই, হুমায়ুন অবশেষে বাক্যটা উচ্চারণ করে। সবাই চমকে গিয়ে সশব্দে শ্বাস টানে।
সুলতান, আগ্রা পরিত্যাগ করবো? কাশিমকে স্পষ্টতই বিহ্বল দেখায়।
হ্যাঁ। সেটাই একমাত্র পথ।
কিন্তু আমরা কোথায় যাব?
উত্তরপশ্চিম দিকে, লাহোরে। আমরা এরফলে কিছুটা সময় পাব আর আমি কাবুল থেকে আরো সৈন্য নিয়ে আসতে পারবো- সেখানের গোত্রগুলো লুটপাটের সুযোগকে খুশী মনে স্বাগত জানাবে…
অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলে না অবশেষে বাইসানগার কথা শুরু করেন। বহু বছর আগের কথা আমি তখনও একজন যুবক আর সম্রাট বাবরের সাথে সমরকন্দে অবস্থান করার সময়, আমরা এক শত্রুর মুখোমুখি হয়েছিলাম- সাইবানি খান আর তার অগণিত উজবেক সাথী, আমরা খুব ভালো করেই জানতাম যাদের পরাস্ত করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। আমাদের হাজার হাজার সহযোদ্ধাদের মৃত্যুই ছিল পশ্চাদপসারণের একমাত্র বিকল্প। বাবর, তাঁর সাহস আর দূরদৃষ্টি দিয়ে, যা তাকে একজন মহান শাসকে পরিণত করেছিল, বিষয়টা বুঝতে পেরেছিলেন। বর্বর উজবেকদের হাতে তৈমূরের শহর তুলে দিতে যদিও তার ভেতরের যোদ্ধার সত্ত্বা বিষাদ ভারাক্রান্ত হয়েছিল, তিনি জানতেন তাঁকে এটা করতেই হবে…ঠিক যেমন আমাদের আগা ছেড়ে যেতে হবে…
হুমায়ুন দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। বাইসানগার ঠিকই বলেছেন। কিন্তু তিনি যেটা উহ্য রেখেছেন সেটা হল এই যে সমঝোতার শর্ত হিসাবে সাইবানি খান নিজের স্ত্রী হিসাবে খানজাদাকে দাবী করেছিল আর বাবর বাধ্য হয়েছিলেন নিজের বোনকে শত্রুর হাতে তুলে দিতে। দশ বছর তৈমূরের বংশধরদের রক্তপিপাসু এক লোকের হারেমে খানজাদা জীবনযাপন করেছিলেন, যে খানজাদার মনোবল ভাঙতে খুশীমনে চেষ্টা করতো। তাঁর সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। সে, হুমায়ুন, যাই ঘটুক না কেন, খানজাদাকে এমন নির্মম নিয়তি আর বরণ করতে দেবে না।
আমরা পশ্চাদপসারণ করছি, পালিয়ে যাচ্ছি না। যদিও আগামীকাল ভোরের প্রথম প্রহরে আমরা যাত্রা শুরু করবো, সবকিছু যেন শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে করা হয়…কাশিম, রাজকীয় বাজার সরকার আর তার কর্মচারীদের সমবেত হতে বলেন এবং আমার আদেশ দ্রুত আর কোনো প্রশ্ন না করে তাঁরা যেন পালন করে সেটা আপনি নিশ্চিত করবেন। আগ্রায় রক্ষিত রাজকীয় কোষাগারে যা কিছু রয়েছে সবকিছু অবশ্যই সিন্দুকে স্থানান্তরিত করতে হবে। মূল্যবান বাকি অন্য জিনিষ আমাদের সাথে করে নিয়ে যাবার জন্য মোড়ক করতে আদেশ দেন- শেরশাহের কাজে লাগতে পারে এমন কিছুই রেখে যেতে চাই না আমি। জাহিদ বেগ, আমাদের সৈন্যদের যাত্রার জন্য প্রস্তুত হতে বলেন। তাঁদের বলবেন কাবুল থেকে আমাদের যে সৈন্যবাহিনী আসছে তাদের সাথে যোগ দেবার জন্য আমরা লাহোর যাচ্ছি। আর আমাদের সব গাদাবন্দুক আর বারুদ যেন নিরাপদে গোশকটে ভোলা হয় সেটা নিশ্চিত করবেন আর কামানগুলোকে যাত্রার জন্য প্রস্তুত করেন। এমনকিছু করবেন না বা বলবেন না যার ফলে কারো মনে পরাজয় বা পলায়ন বা আমরা শেরশাহের ভয়ে ভীত এমন ভাবনার জন্ম হয়।
হুমায়ুন কথা বন্ধ করে এবং চারপাশে তাকায়। আর আহমেদ খান আপনি, আমার সৎ-ভাইয়েরা নিজ নিজ প্রদেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ঠ পরিমাণ সৈন্য মোতায়েন করে, বাকি সৈন্য নিয়ে লাহোরে আমার সাথে তাদের যোগ দেবার আদেশ সম্বলিত চিঠি বয়ে নিয়ে যাবার জন্য আপনার সবচেয়ে দ্রুতগামী আর সেরা তরুণ অশ্বারোহীদের নির্বাচিত করেন। আমি নিজে চিঠিগুলো লিখব আর তাতে রাজকীয় মোহরের ছাপ দিয়ে দেব যাতে সম্রাট তাঁদের আদেশ দিয়েছেন- সে বিষয়ে আমার ভাইদের মনে কোনো ধরনের সন্দেহের অবকাশ না থাকে। এখন দ্রুত যা বললাম করেন, আমাদের হাতে সময় খুব অল্প…
সেই রাতে হুমায়ুন এক মুহূর্তের জন্য চোখের পাতা বন্ধ করে না বা হারেমো যায় না তাকে অনেককিছু নিয়ে মাথা ঘামাতে হচ্ছে। রাতের অন্ধকার ছিন্ন করে অবশ্য নিয়মিত বিরতিতে শেরশাহের অগ্রগামী সৈন্যের অগ্রসর হবার তাজা আর প্রতিবার আরো বেশী মাত্রায় উদ্বেগজনক হয়ে উঠা খবর নিয়ে গুপ্তদূতের আগমন অব্যাহত থাকে। হুমায়ুন হিসাব করে দেখে, শেরশাহ যদি তাঁর অগ্রসর হবার বর্তমান গতি বজায় রাখে তাহলে তার অগ্রবর্তী সৈন্যরা তিন কি চারদিনের ভিতরে আগ্রার উপকণ্ঠে এসে উপস্থিত হবে।
পূর্বাকাশে ভোরের আলো ফোঁটার অনেক আগেই, উষ্ণ বাতাসে পতপত করে উড়তে থাকা নিশান নিয়ে হুমায়ুনের সেনাবাহিনীর প্রথম দলটা সামনের রাস্তা নিরাপদ করার দায়িত্ব নিয়ে যাত্রা শুরু করে। সে আগ্রা ত্যাগ করছে এই খবরটা একবার চাউর হলে, জনগণ উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে আর ডাকাতের দল সেই সুযোগে হয়ত কোনো অপকর্ম ঘটাবে। হুমায়ুনের অগ্রবর্তী সেনাদলের দায়িত্ব হল ইস্পাতের চকচকে বর্ম আর রাজকীয় অশ্বশালা থেকে সরবরাহ করা তাজা ঘোড়ায় চেপে- শক্তির প্রদর্শন করে দুবৃত্তদের কোনো ধরনের অপকর্ম ঘটান থেকে বিরত রাখা। হুমায়ুন নিজের মনে বলে, আর সেই সাথে আমি এখনও শক্তিশালী। তার অধীনে এখনও আশি হাজার সৈন্যের একটা বাহিনী রয়েছে। পানিপথের সময় তাঁর আর তাঁর আব্বাজানের সাথে যা ছিল তার চেয়ে অনেক বেশী।
হুমায়ুন তাঁর আবাসন কক্ষের জানালা দিয়ে নীচের আঙ্গিনার দিকে তাকিয়ে দেখে, রাজঅন্তঃপুরের মহিলা এবং তাঁদের পরিচারিকার দল তাদের জন্য প্রস্তুত করা পালকি আর গোশকটে অবস্থান গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেনাসারির একেবারে মধ্যে তাঁরা ভ্রমণ করবেন, তাদের চারপাশে অবস্থানরত প্রহরীরা একটা নিরাপত্তা বেষ্টনী বজায় রাখবে, এবং সামনে আর পেছনে থাকবে আরও কয়েকসারি বিশেষভাবে তাদের নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত অশ্বারোহী বাহিনী। হুমায়ুন অবশ্য খানজাদা আর তার সৎ-বোন গুলবদনকে তাঁর কাছাকাছি আরেকটা রাজকীয় হাতিতে ভ্রমণের বন্দোবস্ত করতে আদেশ দিয়েছেন। সালিমা, এখনও তার প্রিয়তম উপপত্নী, পেছনে আরেকটা হাতিতে অবস্থান করবে।
মহিলাদের দলটার পেছনে থাকবে রাজকীয় শিবির স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি বহনকারী শকট- তাবু এবং ভ্রাম্যমান হাম্মামখানা, রান্নার উপকরণ এবং উত্তরপশ্চিমে চারশো মাইল যাত্রার জন্য দরকারী অন্যান্য সামগ্রী। এবং সেই সাথে অবশ্যই ভ্রমণের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত লোহার অতিকায় সিন্দুক যার জটিল তালা খুলতে চারটা আলাদা আলাদা রূপার চাবি- প্রতিটা চাবি আলাদা আলাদা আধিকারিকের কাছে রক্ষিত এবং একটা সোনার চাবি প্রয়োজন যা এই মুহূর্তে হুমায়ুনের গলায় ঝুলছে। হুমায়ুন নিজের ভিতরে শেরশাহের সাথে প্রথমবার মুখোমুখি হতে যাবার দিল্লীতে রক্ষিত ধনসম্পদ নিরাপত্তার খাতিরে আগ্রায় পাঠাবার আদেশ দেয়ার মতো দূরদৃষ্টি দেখিয়েছিল বলে নিজের কাছেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। তাঁর নিজের যা অর্থ আর রত্নপাথর রয়েছে আর সেই সাথে বাহাদুর শাহের কাছ থেকে সে যা দখল করেছে সেটা যোগ করলে, শেরশাহের সাথে টক্কর দেবার মতো একটা নতুন বাহিনী তৈরীর জন্য যথেষ্ট তহবিল তার কাছে রয়েছে।
বহরের একেবারে শেষে থাকবে অশ্বারোহী আর পদাতিক সৈন্যদের আরো কয়েকটা দল, যাদের ভিতরে তাঁর শ্রেষ্ঠ তীরন্দাজেরাও রয়েছে, তাঁরা মিনিটে চল্লিশটা তীর নিক্ষেপের মতো দক্ষ। আর পুরো সেনাসারির ভিতরে ছড়িয়ে থেকে এবং বেশীরভাগ সময় দৃশ্যপটের আড়ালে আহমেদ খানের গুপ্তদূতেরা অবস্থান করবে, যেকোনো ঝামেলার জন্য তারা সর্তক দৃষ্টি রাখবে।
দুই ঘন্টা পরে, পিঙ্গল বর্ণের লম্বা পায়ের অধিকারী পেষল স্ট্যালিয়নটায়, যা তাঁকে কনৌজের বিপর্যয়ের পরে খুব দ্রুত আগ্ৰায় ফিরিয়ে এনেছিল, উপবিষ্ট অবস্থায় আগ্রা দূর্গের মূল তোরণদ্বারের নীচে ঢালু পথের উপরে দিয়ে হুমায়ুনকে মন্থর গতিতে ঘোড়া চড়ে বের হয়ে আসতে দেখা যায়। মাথার রত্নখচিত শিরোস্ত্রাণের নীচে, তাঁর চোখের দৃষ্টি সোজা সামনের দিকে নিবদ্ধ। এটা পেছন দিকে শেষবারের মতো তাকিয়ে দেখা বা কোনো ধরনের স্মৃতি রোমন্থনের সময় না। এটা একটা সাময়িক বিপর্যয় আর শীঘ্রই খুব শীঘ্রই, যদি আল্লাহতালা সহায় থাকেন- নিজের ন্যায়সঙ্গত অধিকার বুঝে নেবার জন্য সে ফিরে আসবে। আপাতত বিদায় নেয়ার আগে সে শেষ একটা কাজ করতে চায়। ঘোড়ায় করে নদীর তীরে পৌঁছে সে সেখানে ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে তাঁকে যমুনার অপর তীরে মাহামের কবরের কাছে নিয়ে যাবে বলে যে ছোট নৌকাটা অপেক্ষা করছিল সেটায় আরোহন করে। সাদা মার্বেলের আয়তাকার চ্যাপ্টা খণ্ডটার কাছে পৌঁছে সে হাটু ভেঙে বসে এবং পাথরটায় চুমু খায়। শেরশাহ আমাদের ধর্মের অনুসারী লোক, সে ফিসফিস করে বলে। সে আপনার কবরের কোনো ক্ষতি করবে না এবং একদিন আমি আপনার কাছে ফিরে আসবো। আম্মিজান আমাকে মার্জনা করবেন যে আমি চল্লিশ দিনের শোক পালন করতে পারছি না, কারণ আমাদের রাজবংশের ভাগ্য অনিশ্চয়তার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে এবং আমাকে দেহের প্রতিটা স্নায়ু আর পেশীকে সহ্যের শেষ প্রান্তে নিয়ে গিয়ে একে রক্ষা করার জন্য আমাকে চেষ্টা…
*
তারা আগ্রা ছেড়ে আসবার পরে প্রতিদিনই নিয়মিত বৃষ্টিপাতের প্রকোপ মনে হয় যেন অনেকটা কমে এসেছে এবং হুমায়ুন ঠিক যেমনটা আশা করেছিল- শেরশাহ যদিও আগ্রা দখল করেছে কিন্তু সে তাকে আর অনুসরণ করেনি। হুমায়ুনের গুপ্তচরদের ভাষ্য অনুসারে শেরশাহকে হিন্দুস্তানের পাদিশাহ ঘোষণা করে আরো একবার তাঁর নামে আগ্রা দূর্গের মসজিদে খুতবা পাঠ করা হয়েছে এবং সে এখন নিয়মিত খিলানযুক্ত দর্শনার্থী হলে দরবার করছে। বেশ, ভুইফোড়টা তার গৌরবোজ্জ্বল মূহূর্ত উপভোগ করুক- যদিও সময়টা খুবই সংক্ষিপ্ত হবে।
হুমায়ুন মনে মনে ভাবে তাঁর সেনাসারি বেশ দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। প্রতিদিন সম্ভবত বারো কি তের মাইল, সম্ভবত আরো বেশী, যেহেতু তারা উত্তরপশ্চিম দিক অভিমুখে বৈচিত্রহীন ভূখণ্ডের উপর দিয়ে ভ্রমণ করছে। তারা যদি তাদের সামরিক বহরের এই গতি বজায় রাখতে পারে তাহলে আশা করা যায় একমাসের ভিতরে তারা লাহোরে পৌঁছে যাবে। এখনও পর্যন্ত কোনো ভয়াবহ আক্রমণের সম্মুখীন তাদের হতে হয়নি। মোগলদের সৈন্যসারি যখন কোনো গ্রামের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে তখন সেখানে বসবাসকারী লোকেরা মনে হয় যেন কাছে আসতে ভয় পায় তাঁরা বৃষ্টির পানি জমে থাকা ফসলের মাঠের নিরাপদ আশ্রয়ে কিংবা তাঁদের মাটির দেয়াল আর খড় দিয়ে ছাওয়া বাড়ি থেকে অগ্রসরমান সৈন্যদের কাতার আর মালবাহী শকটের দিকে তাকিয়ে থাকে। হাড়ের মাংসে চামড়া ঢুকে যাওয়া কুকুরের পাল আর হাড্ডিসার হলুদ পালকযুক্ত মুরগীর ঝাকই কেবল চারপাশে হেঁটে বেড়াতে দেখা যায়।
তাঁর সেনাসারির উপর এখন পর্যন্ত একবার মাত্র হামলা হয়েছে। ঝিরঝির বৃষ্টির পর্দায় চারপাশ জড়িয়ে নিয়ে একদিন সন্ধ্যাবেলা যখন দ্রুত আঁধার নামছিলো, কাদায় আটকে গিয়ে অতিরিক্ত তাবু আর রান্নার সরঞ্জামাদি বহনকারী একটা শকট মূলবহর থেকে আলাদা হয়ে গেলে, ডাকাতের দল সেটাকে আক্রমণ করে। বেশ কয়েক ঘন্টা পরে মালবাহী শকটটার অনুপস্থিতি সবার নজরে পড়ে এবং আহমেদ খান দ্রুত গুপ্তদূত পাঠায় ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে। তারা পিঠে তীরবিদ্ধ অবস্থায় মালবাহী শকটের চালকদের বৃষ্টিতে ভেজা মৃতদেহ খুঁজে পায় এবং আশেপাশে কোথায় মালবাহী শকট নেই। কিন্তু অন্ধকার হয়ে গেলেও চোর আর চুরি করা শকটটি খুঁজে বের করতে খুব একটা দেরী হয়না। রাতের প্রথম আগুন জ্বালাবার প্রায় সাথে সাথে, আহমেদ খানের প্রেরিত লোকেরা, বাজারে যেভাবে মুরগী বিক্রি করতে নিয়ে যাওয়া হয় ঠিক সেভাবে সেরাতের অস্থায়ী শিবিরে ডাকাতদের বেঁধে আনে। হুমায়ুন কালবিলম্ব না করে তাদের শিরোচ্ছেদের আদেশ দেয় এবং পাথরের একটা পিরামিডে ছিন্ন মুণ্ডুগুলো দেখা যায়, এমনভাবে গেঁথে দিতে বলে একটা হুশিয়ারি হিসাবে যে প্রজাদের ভিতরে আইন অমান্য করার কোনো ধরনের প্রবণতা সে বরদাশত করবে না।
সে এমনকি নিজের সৈন্যদের ভিতরেও এসব বরদাশত করতে রাজি না। রক্তের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও হিন্দুস্তানের এইসব লোকগুলো তাঁর আপন তাঁর প্রজা- এবং সে কখনও তার লোকদের বলেনি যে হিন্দুস্তানীদের উপরে তাঁরা ইচ্ছামতো লুটপাট চালাতে পারবে। সে কঠোরভাবে আদেশ দিয়ে রেখেছে যে কোনো ধরনের লুটপাট করা চলবে না এবং ইতিমধ্যে ছয়জন সৈন্যকে কাঠের কাঠামোতে হাতপা ছড়ান পক্ষবিস্তারকারী ঈগলের মতো আটকে তাদের সহযোদ্ধাদের সামনে তাদের ভালোকরে চাবকানো হয়েছে, একটা ভেড়া চুরি করার অপরাধে এবং সপ্তম আরেকজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে গ্রামের এক কিশোরী মেয়েকে ধর্ষণ করার দায়ে।
সে যাই হোক, গাদাফুল দিয়ে তারা যখন তাদের মন্দিরের সামনে খোদাই করা মোষের মূর্তির পাশ দিয়ে যায়, এবং তাদের উদ্ভটসব দেবতার মূর্তিসমূহ অনেকেরই একাধিক হাত রয়েছে, কেউ দেখতে অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক হাতির মতো- সে না ভেবে থাকতে পারে না যে রাজত্ব লাভের আকাঙ্খ আর নিয়তি মোগলদের যে স্থানে নিয়ে এসেছে সেখানের গতিপ্রকৃতি কি সে কখনও পুরোপুরি বুঝতে পারবে। তার আপন ঈশ্বর হলেন একটি নিঃসঙ্গ সত্ত্বা, অদৃশ্য এবং নিজে নিজে শেভ করার জন্য এবং সর্বময়ক্ষমতায় স্পর্ধিত হয়ে উঠে, তার আদলে কিছু একটা তৈরী করাটা ধর্মদ্রোহীতার সামিল। হিন্দুদের দেবতাদের দেখলে মনে হবে তারা কোনো বাহিনীর অংশ এবং তাঁদের ইন্দ্রিয়পরায়ন দেহ আর পেষল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখলে চিরন্তত পরিত্রাণের চেয়ে পার্থিব ভোগবিলাসের কথাই মনে পড়ে।
তাঁরা যখন হাতির পিঠে চেপে ভ্রমণ করে, হুমায়ুন তখন নিজের ভাবনাগুলো নিয়ে, তার সেরা হাতিগুলোর একটার পিঠে সোনার শেকল দিয়ে বাঁধা খানজাদা আর গুলবদনের দুলতে থাকা হাওদায়, তাদের সাথে ধুসর গোলাপী রেশমের কাপড়ের মাঝে দিয়ে যা তাদের পুরো হাওদা আবৃত করে রেখেছে, আলোচনা করে। প্রখর ব্যবহারিক জ্ঞানের অধিকারী খানজাদা তাঁর হিন্দু প্রজাদের ধর্মীয় আচরণের বিষয়ে তাঁর মতো আগ্রহ পোষন করেন না- পাথরের তৈরী যোনি আর লিঙ্গম- পুরুষ আর নারীর যৌনাঙ্গের প্রতীক- কেন তাদের কাছে এতো পবিত্র তাদের পুরোহিতেরা কেন কপালে ছাই লেপন করেন এবং কেন তাঁরা তাঁদের ডান কাঁধের উপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে দেহের সাথে একটা সুতির লম্বা সুতা ঝোলে।
গুলবদন অবশ্য অবিশ্বাসীদের এসব ধর্মাচরণ দ্বারা মনে হয় কেবল অভিভূতই না সে এসব বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান রাখে। হুমায়ুন অবশ্য নিজেকে এটাও স্মরণ করিয়ে দেয় যে কাবুল থেকে বাবরের রাজধানী আগ্রায় তাঁকে যখন নিয়ে আসা হয়েছিল তখন তার বয়স একেবারেই অল্প ছিল। সে হিন্দুস্তানেই বড় হয়েছে এবং খাইবার পাসের ওপাশে মোগলদের পাহাড়ী স্বদেশ সম্বন্ধে তাঁর স্মৃতি খুবই সামান্য প্রায় নেই বললেই চলে। তাঁকে লালনপালনের দায়িত্বে হিন্দুস্তানী মহিলারা ছিল তারা তাদের আয়া বলে- যারা নিশ্চয়ই তাদের ধর্মীয় কৃত্যানুষ্ঠানের আঙ্গিক তাঁকে ব্যাখ্যা করেছে। সময় যখন আবারও শান্ত হবে, সে তখন অবশ্যই গুলবদনের সাথে আরো বেশী সময় অতিবাহিত করবে, তার নতুন প্রজাদের আরো ভালো করে বুঝতে।
*
হুমায়ুনের সৈন্যসারি আপাতভাবে শান্ত ভূপ্রকৃতির উপর দিয়ে নিরূপদ্রবভাবে এগিয়ে যায়, যতক্ষণ না তাদের সামনে লাহোর ভেসে উঠে। শহরটার চারপাশে যদিও কোনো প্রতিরক্ষা বেষ্টনী নেই, শহরের কেন্দ্রস্থলে কয়েক শতাব্দি পূর্বে হিন্দু শাসকদের দ্বারা নির্মিত প্রাচীন রাজপ্রাসাদের সামনে হুমায়ুন যখন ঘোড়ার পিঠ থেকে নামে তখন লক্ষ্য করে যে প্রাসাদটার কাঠামো বেশ শক্তিশালী এবং মজবুত। এসবের চেয়েও ভালো খবর হল তার সৎ-ভাইয়েরা ইতিমধ্যে এসে উপস্থিত হয়েছে এবং প্রাসাদের অভ্যন্তরে তার জন্য অপেক্ষা করছে। সে কখনও কোনো অলুক্ষণে মুহূর্ত অনেকবারই ভেবেছে তাঁরা তাঁর আদেশ পালন করবে কি না কিন্তু তারা আদেশ পালন করেছে… এমনকি কামরানও।
তাঁদের সাথে মিলিত হবার জন্য নিজের ভেতরের ব্যাকুলতা দেখে সে বিস্মিত হয়। তারা এখন দেখতে কেমন হয়েছে? বাবরের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই যখন তারা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ের পরে সে আর তাঁদের দেখেনি। সে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশী কৃতজ্ঞ, তাদের অপরাধ সে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে বিবেচনা করেছিল- কারণ কেবল যে বাবর তাঁর মৃত্যুশয্যায় তাঁর কাছ থেকে কথা আদায় করেছিল তাদের সে সহানুভূতিপূর্ণ আচরন করবে আর তারচেয়েও বড় কথা এবং তাদেরও নিশ্চিতভাবেই তাকে প্রয়োজন রয়েছে। মোগল যুবরাজ হবার কারণে শেরশাহ তাঁদের সব ভাইদের জন্যই হুমকি স্বরূপ। বাবরের সন্তানেরা যদিও একত্রিত হতে পারে, তাহলে তারা বাংলার জলাজঙ্গল ভর্তি যে এলাকা থেকে শেরশাহ এসেছে, তাকে পুনরায় সেখানে পাঠিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা এই যে এই বিপর্যয়টা হয়তো তাদের সবকিছু নতুন করে শুরু করার একটা সুযোগ দেবে, কেবল রক্তের সম্পর্কই না ভ্রাতৃত্বের স্নেহশীল মনোভাব যা কখনও ছিন্ন হয়নি, সবকিছু পুনরায় মুসাকিদা করতে পারবে। তারাও অতীতের ক্ষত নিরাময় করতে আগ্রহী এমন আশা করাটা কি বোকামী হবে?
পরের দিন সকালের আলো ফোঁটার সাথে সাথে, হুমায়ুন তার সৎ-ভাইদের নিজেন আবাসন কক্ষে ডেকে পাঠায়। কাশিম, জাহিদ বেগ আর ক্লান্ত দেখতে বাইসানগারের উপস্থিতিতে কামরান, হিন্দাল আর আসকারি কক্ষে প্রবেশ করতে হুমায়ুন একে একে তাঁদের আলিঙ্গন করে, স্বতস্ফূর্ত আন্তরিকতায় প্রত্যেকের সম্বন্ধে মন্তব্য করে যা তাদের নিজেদের কৌতূহলের সাথে মিলে যায় যখন তারা অবাক দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রায় ছয় বছর আগে শেষবারের মতো সে যখন তাঁদের দেখেছিল, আসকারি আর হিন্দাল তখন সদ্য যৌবন প্রাপ্ত হয়েছে আর কামরান তার চেয়ে মাত্র পাঁচ মাসের ছোট, একটু পরিণত। এখন তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ।
কামরানের চোখ- যা ঠিক তাঁদের আব্বাজানের মতো উজ্জ্বল সবুজ- নাকের উপরে পিট পিট করে তাকিয়ে থাকে যা এখনও দেখতে বাজপাখির মতো, বস্তুত পক্ষে এখন সাদৃশ্য আরও বেশী মাত্রায় লক্ষণীয়। নাকটা ভাঙা পরিষ্কার বোঝা যায়- খুব সম্ভবত ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে বা সংক্ষিপ্ত কোনো লড়াইয়ের ফল- এবং হেকিমেরা ভাঙা জায়গাটা ঠিকমতো বসাতে পারেনি। সেটাই একমাত্র পরিবর্তন– কামরান বেশ লম্বা চওড়া হয়েছে। তার পরণের হলুদ জোব্বার নীচে কাঁধের পেশল মাংসপেশী আর বাহুর উধ্বভাগ ফুলে রয়েছে। আসকারির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। তাঁর যে চেহারা হুমায়ুনের মনে ছিল তার চেয়ে আসকারির মুখ অনেকবেশী সরু আর লম্বা দেখায় এবং তার মুখে এখন সুন্দর করে ছাটা দাড়ি শোভা পাচ্ছে, সে আগের মতোই হাল্কা পাতলা রয়ে গেছে। হুমায়ুন বা কামরানের চেয়ে সে লম্বায় কম করে একমাথা খাট। হুমায়ুন হিন্দালকে একেবারেই চিনতে পারেনা। দিলদারের ছেলে- গুলবদনের ভাই- চোখে পড়ার মতো লম্বা চওড়া হয়ে উঠেছে। তার যেকোনো ভাইয়ের চেয়ে কম করে হলেও চার ইঞ্চি লম্বা আর চওড়া পেশল দেহ, মাথাভর্তি ঝাকড়া লালচে চুলের নীচে ডান ভ্রুর উপরে একটা আড়াআড়ি কাটা দাগ এবং হুমায়ুনকে স্বাগত জানাবার সময় তাঁর মন্দ্র, গমগমে কণ্ঠস্বরের কারণে তাঁকে আঠার বছরের চেয়ে অনেক বড় মনে হয়।
পারস্পরিক কুশল বিনিময় শেষ হতে, হুমায়ুন কাশিম, বাইসানগার আর জাহিদ বেগের সাথে তাঁর সৎ-ভাইদেরও নিজের চারপাশে অর্ধ-বৃত্তাকারে উপবেশনের ইঙ্গিত করে এবং কোনো প্রকার ভণিতা না করে কাজের কথায় আসে। আমি তোমাদের এখানে দেখে খুব খুশী হয়েছি। বহুদিন পরে আমরা সবাই আবার একসাথে হলাম। তোমরা ভালো করেই জান- কেন আমি তোমাদের এখানে ডেকে পাঠিয়েছি। আমরা যুদ্ধের পরামর্শসভায় মিলিত হয়েছি এবং আমাদের প্রত্যেকের ভাগ্য- আমাদের পুরো রাজবংশের- আজকের সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে। অতীতে আমাদের নিজেদের ভিতরে অনেক মতানৈক্য ছিল কিন্তু আমরা চারজনই বাবরের সন্তান। আমাদের প্রত্যেকের ধমনীতে তৈমূরের রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে এবং চারপাশে ঘনিয়ে আসা বিপদের সম্মুখীন হয়ে আমাদের অবশ্যই একত্রিত হতে হবে। তোমরা অবহিত আহো যে শেরশাহ তিন লক্ষ সৈন্যের একটা বিশাল বাহিনী নিয়ে আমাদের সাম্রাজ্যের রাজধানী, আগ্রা দখল করে নিয়েছে…
এটা দুঃখজনক যে শেরশাহের বিরুদ্ধে আপনার অভিযান সফল হয়নি, কামরান মৃদু কণ্ঠে বলে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় অন্তত একবারের জন্য হলেও নক্ষত্ররাজির গণনা আপনাকে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করেছে।
হুমায়ুনের চোখমুখ লাল হয়ে উঠে, কামরান কথা বলার সাথে সাথে মৈত্রীর জন্য তার আকাঙ্খ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। শেরশাহের সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই করে আমার দেহ থেকে রক্তক্ষরণ হয়েছে এবং অনেক ভালো মানুষ- বাবা ইয়াসভালের মতো মানুষ- শহীদ হয়েছে। আমার অনুরোধে সাড়া দিয়ে তুমি যদি সাহায্য পাঠাতে, শেরশাহকে আমি পরাস্ত করতে পারতাম, এবং আমার চারপাশে যেসব বীর যোদ্ধারা শহীদ হয়েছে তারা হয়ত আজও বেঁচে থাকতো…
আমি আমার নিজের বাহিনীর প্রধান হিসাবে আসবার প্রস্তাব দিয়েছিলাম, আপনি সেটা মানতে অস্বীকার করেছেন…
কারণ আমি চাইনি তোমার নিজের প্রদেশ অরক্ষিত অবস্থায় থাকুক।
কিন্তু আমি আপনাকে এতো পূর্বদিকে গিয়ে শেরশাহকে মোকাবেলা করার ব্যাপারে হুশিয়ার করেছিলাম- আমি আপনাকে দিল্লী অথবা আগ্রায় দীর্ঘস্থায়ী অবরোধের জন্য প্রস্তুতি নেবার পরামর্শ দিয়েছিলাম। শহরের দেয়ালের ভিতরে সুরক্ষিত অবস্থায় এবং পর্যাপ্ত রসদের বন্দোবস্ত করে আপনি শেরশাহের বাহিনীকে উদ্যমহীন করতে পারতেন এবং আপনার অন্যান্য বাহিনী তাঁকে পেছন থেকে আক্রমণ করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতো। কিন্তু বরাবরের মতোই আপনি আমার পরামর্শের প্রতি কোনো গুরুত্বই দেননি… হুমায়ুনের মনে হয় কামরান নিজের চোখে মুখে হাল্কা বিদ্রুপের একটা হাসি ফুটিয়ে তুলে নিজের যুক্তির পক্ষে নাছোড়বান্দার মতো সাফাই দিচ্ছে।
এবং আমার প্রতি তোমার আনুগত্য বরাবরের মতোই সন্দেহজনক… বালিঘড়ির বালুর মতোই ইতিমধ্যে এর অবত শুরু হয়েছে…তোমার প্রতারক চোখের মণিতে আমি সেটা দেখতে পাচ্ছি… হুমায়ুন কথাটা বলে উঠে দাঁড়ায়। তাঁদের ছেলেবেলায় সে ছিল সবসময়ে সেরা যোদ্ধা আর কুস্তিগীর। সে কামরানকে বহুবার আড়ং ধোলাই করেছে এবং প্রয়োজন হলে আবার করবে… কামরানও মার্জারের দ্রুততায় উঠে দাঁড়ায়, তাঁর হাত কোমরের গাঢ় বেগুনী পরিকরে গোঁজা রত্নখচিত খঞ্জরের বাটের দিকে এগিয়ে যায়।
সুলতান আপনারা… বাইসানগারের শান্ত সমাহিত কণ্ঠস্বর তাঁদের দুজনের মাঝে সম্বিত ফিরিয়ে আনে। হুমায়ুন নিজেই লজ্জিত বোধ করে যে তাকে প্ররোচিত করতে সে কামরানকে সুযোগ দিয়েছে। তারা এখন আর কাবুলের সেই লড়াকু বালক নয় বরং মোগল যুবরাজ সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য মারাত্মক এক বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কামরানকে দেখেও মনে হয় সে নিজের আচরণের জন্য অনুতপ্ত। সে পরিকরের কাছ থেকে হাত সরিয়ে নেয় এবং চোখ নীচের দিকে নামিয়ে নিয়ে বিনা বাক্য ব্যয়ে পুনরায় আলোচনার উদ্দেশ্যে মাটিতে বসে। আসকারি আর হিন্দালও অধোমুখে তাকিয়ে রয়েছে, যেন তারা একটা বিষয় পরিষ্কার বুঝিয়ে দিতে চায় যে বাবরের বড় দুই ছেলের ঝগড়ার মাঝে তারা কোনো পক্ষ অবলম্বন করতে পারবে না।
বরাবরের মতোই বাইসানগার, তুমি হলে বিবেকের কণ্ঠস্বর। হুমায়ুন নিজেও এবার মাটিতে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে। অতীতের ঘটনা অতীতের গর্ভে বিলীন হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ হল ভবিষ্যতের খেয়াল রাখা। আমাদের মরহুম আব্বাজান তাঁর জীবনের প্রায় অর্ধেক সময়কাল যুদ্ধ করেই অতিবাহিত করেছেন- তাঁর যখন মাত্র বারো বছর বয়স তখন থেকেই একটা সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করতে। আল্লাহতালা তাকে আমাদের পৈতৃক জন্মভূমি থেকে অনেক দূরে নতুন দেশে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছেন, এবং এটা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব, যে জন্য তিনি লড়াই করেছিলেন সেটা যেন আমরা হারিয়ে না ফেলি। আমি এজন্যই তোমাদের এখানে ডেকে এনেছি- যাতে আমরা চারজন মিলে সিদ্ধান্ত নিতে পারি কিভাবে সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখা যায়… এবং আমাদের চূড়ান্ত শক্তি, আর পরম নিরাপত্তা আমাদের ঐক্যের ভিতরে লুকিয়ে রয়েছে।
তার সৎ-ভাইয়েরা একসাথে মাথা নাড়ে এবং সেটা দেখে হুমায়ুনেরও শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে আসে। জাহিদ বেগ আমাদের সামরিক পরিকল্পনার একটা রূপরেখা আমার ভাইদের সামনে উপস্থাপন করেন। আমি তাদের যেকোনো মতামতকে স্বাগত জানাব।
হুমায়ুন একটা রূপার কারুকাজ করা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসলে, তার অশ্বশালার প্রধান সিপাহসালার সামরিক কৌশলের সারাংশ ব্যাখ্যা করে, যা হুমায়ুন তার এবং বাইসানগারের সাহায্যে তৈরী করেছে।
মহামান্য যুবরাজবৃন্দ, জাহিদ বেগ বক্তব্য শুরু করে, তার প্রশস্ত মুখাবয়ব গম্ভীর, আমরা শেরশাহের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছুই জানি না কিন্তু বর্তমানে তার আচরণ দেখে মনে হচ্ছে সে নিজের অবস্থান সংহত করতে বেশী আগ্রহী- সে তার সেনাবাহিনীকে বাংলা থেকে পশ্চিমে অনেক দূরে নিয়ে এসেছে তাই তাঁর আরো রসদের আশ্বাস প্রয়োজন। সে সেইসাথে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের জলাভূমি অঞ্চলে বসবাসকারী বর্বর উপজাতিগুলি তার পেছনে বিদ্রোহ করে বসতে পারে সেই ঝুঁকির ভেতরেও রয়েছে। তাঁর তাই নিজেকে যথেষ্ট পরিমাণে নিরাপদ মনে না হওয়া পর্যন্ত সে আগ্রা থেকে আমাদের ধাওয়া করে এখানে আসবে না, তার মানে এই দাঁড়ায় যে আমাদের হাতে সামান্য হলেও খানিকটা সময় রয়েছে…যদি সত্যি সত্যি এটাই তার ইচ্ছা হয়ে থাকে এবং এটা নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল। এই সময়টায় আমাদের অবশ্যই নিজেদের বাহিনীর জন্য নতুন সৈন্য সংগ্রহ করতে হবে। আমরা ইতিমধ্যে কাবুলের প্রশাসকের কাছে বাড়তি লোকবল প্রেরণের জন্য দূত পাঠিয়েছি। তারা একবার পৌঁছে গেলে, আমাদের অবস্থান তখন অনেকবেশী শক্তিশালী হবে আর আমাদের তখন সিদ্ধান্ত গ্রহণের অনেক বেশী স্বাধীনতা থাকবে।
আমরা কি এইসব নতুন সৈন্যদের বেতন দিতে পারবো? আসকারি জিজ্ঞেস করে তার ছোট ছোট কালো চোখের মনিতে একাগ্রতা স্পষ্ট। নাকি আমরা আশা করি যে তাঁরা আমাদের পক্ষে লড়াই করবে কেবল লুটের মালের প্রতিশ্রুতির কারণে?
আমাদের কাছে যথেষ্ট তহবিল আছে- আগ্রা এবং সেই সাথে দিল্লীর রাজকোষ থেকে প্রাপ্ত, কাশিম উত্তর দেয়।
এবং তাঁরা এসে পৌঁছাবার আগে…? কামরান জানতে চায়।
আমরা সেই সময়ে লাহোরকে শক্তিশালী আর রসদের পর্যাপ্ত মজুদ নিশ্চিত করবো, হুমায়ুন বলে। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে শহরটায় কোনো প্রতিরক্ষা দেয়াল নেই কিন্তু উত্তরে রাভি নদী আমাদের নিরাপত্তা দেবে এবং আমরা পশ্চিম, দক্ষিণ আর পূর্বদিকে প্রতিরক্ষা পরিখা খনন করে সেখানে আমাদের কামান এবং তবকিদের মোতায়েন করতে পারি। রাজপ্রাসাদটা বেশ মজবুত করে নির্মাণ করা হয়েছে। নতুন সৈন্যের আগমনের জন্য অপেক্ষা করার সময়ে আমরা কিছু সময়ের জন্য শহরটাকে রক্ষা করতে পারবো।
কামরানের সবুজ চোখ পিট পিট করে কিন্তু সে কিছু বলা থেকে বিরত থাকে।
মহামান্য যুবরাজবৃন্দ, আপনারা প্রত্যেকে নিজেদের সাথে কতজন সৈন্যের বাহিনী নিয়ে এসেছেন? কাশিম তাঁর উঁত কাঠের প্রচ্ছদযুক্ত খেরো খাতাটা খুলে যেখানে হুমায়ুনের যতদূর মনে পড়ে তার উজির গুরুত্বপূর্ণ সব ব্যাপার লিখে রাখে। কাশিম নিজের গলায় একটা মালা থেকে ঝুলতে থাকা ছোট জেড পাথরের দোয়াতদানির মুখটা খুলে এবং সেটায় নিজের ব্যবহৃত লেখনী ডুবিয়ে নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।
আমার সাথে পাঁচ হাজার অশ্বারোহীর একটা বাহিনী আছে, যাদের ভিতরে এক হাজার হল অশ্বারোহী তীরন্দাজ, আসকারি বলে, এবং সেই সাথে অতিরিক্ত পাঁচশ ঘোড়ার পাল।
আমার বাহিনীতে তিন হাজার অশ্বারোহী আর পাঁচশ পদাতিক সৈন্য রয়েছে, হিন্দাল বলে। সবাই দক্ষ যোদ্ধা।
তারা সবাই কামরানের দিকে একসাথে তাকায়। আমার সাথে কেবল দুই হাজার অশ্বারোহীর একটা বাহিনী রয়েছে। আর তাছাড়া, তুমিইতো আমাকে কয়েক সপ্তাহ পূর্বে কখনও আক্রমণের সম্মুখীন হলে আমার প্রদেশকে প্রতিরক্ষাহীন অবস্থায় ফেরে রাখার বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলে… তার কণ্ঠস্বর সহ্য করাটাই হুমায়ুনের জন্য জুলুম হয়ে দাঁড়ায়-কামরানের প্রদেশ সবচেয়ে বড় আর সবার চেয়ে সমৃদ্ধ এবং শেরশাহের সেনাবাহিনীর কাছ থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থিত আর নিজের প্রদেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে না ফেলে সে অনায়াসে দুই হাজারের অনেক বেশী সৈন্য দিয়ে সাহায্য করতে পারতো, কিন্তু অনেক কষ্টে নিজের ক্রোধ দমন করেন। কিছুক্ষণের জন্য কেবল কাশিমের লেখনীর খসখস আওয়াজ শোনা যায়, তারপরে উজির লেখা শেষ করে মুখ তুলে তাকান। বেশ, মহামান্য যুবরাজবৃন্দ, এইসব অতিরিক্ত লোক এসে যোগ দেয়ায় আমাদের সেনাবাহিনীর সংখ্যা নব্বই হাজারে উন্নীত হয়েছে।
তাদের এখানে আটকে রাখার জন্য আমাদের সব রকমের চেষ্টা করতে হবে আমি চাই না তারা বাসায় যাবার জন্য গায়েব হতে শুরু করুক…হুমায়ুন বলে।
সেটা এড়াবার একমাত্র পথ হল তাঁদের শীঘ্রই যুদ্ধ আর লুটের মাল লাভের প্রশ্রুিতি দেয়া। লাহোরে রাজকোষ আর রাজঅন্তঃপুরের মহিলাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরে আমাদের এখন উচিত পুনরায় শেরশাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করা তাঁকে চমকে দিয়ে…কামরান উত্তর দেয়।
হ্যাঁ, আসকারিও ব্যথভাবে সায় দেয়। কামরান ঠিকই বলেছে। সেটাই কি শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত হবে না?
সেটা হবে একটা হঠকারী সিদ্ধান্ত, হুমায়ুন উত্তর দেয়। তোমরা ভুলে গেছো আমাদের বাহিনীর চেয়ে কত বিশাল তার সৈন্যসংখ্যা। চূড়ান্ত বিজয়ের সামান্যতম সম্ভাবনার জন্য আমাদের গোলন্দাজ বাহিনীর সাথে একটা যুগলবন্দি দরকার হবে। সেটা করতে গেলে আমাদের অগ্রসর হবার গতি হ্রাস পাবে আর সেই সাথে আমাদের অগ্রসর হবার খবর তার কাছে পৌঁছাবার জন্য সময়ের একটা ব্যাপার আছে। কামরান, আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। দিল্লী কিংবা আগ্রায় শেরশাহের হাতে নিজেকে অবরুদ্ধ হতে না দিয়ে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করায় তুমি আমার সমালোচনা করেছে কিন্তু এখন আমি যখন তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের জন্য লাহোরকে সুরক্ষিত করতে চাইছি, তুমি আমাকে অনুরোধ করছে তার বিরুদ্ধে পুনরায় যুদ্ধযাত্রা করতে…
পরিস্থিতিগুলো ভিন্ন। কিন্তু মোদ্দা কথা একটাই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি তোমার প্রয়োজন নেই। তুমি সেটা চাও না। তুমি কেবল তোমার নিজেরটা আমাদের বলতে চাও, কামরান নিজের চোখে মুখে একটা মনখারাপ করা অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে বলে। আমি আর বেশী কিছু বলতে চাই না।
হুমায়ুন তাঁর নানাজানের চোখে হুশিয়ারী দৃষ্টি খেয়াল করে, এই দফা সে কামরানের দ্বারা তাকে প্ররোচিত করার প্রলোভন বহুকষ্টে দমন করে। সে বরং হিন্দাল আর আসকারির দিকে ঘুরে তাকায়। কামরান ভুল করছে। আমি সত্যিই তোমাদের ভাবনা জানতে আগ্রহী। তাঁরা চুপ করে থাকে, তাদের বড়ভাইদের মধ্যে বিদ্যমান উত্তেজনা সম্ভবত তাঁদের সংযত করে তুলেছে। হুমায়ুনের ভিতরে হতাশার সাথে অনুশোচনার ক্ষরণ শুরু হয়। এই ধরনের কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হবার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। অতীতের সবকিছু ভুলে যাবার জন্য সে প্রস্তুত কিন্তু তার নিকট স্বজন, তার সৎ-ভাইয়েরা মনে হয় না সেরকম কিছু করতে ইচ্ছুক।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে অবশ্য হিন্দা কথা বলে। কাবুল থেকে বাড়তি লোকবল একবার এসে পৌঁছাবার পরে জাহিদ বেগ কি সব পছন্দের কথা বলছিলো। সেগুলো কি?
হুমায়ুন তার প্রশ্নের উত্তর দেয়। কম করে হলেও আমি পঞ্চাশ হাজার লোকের একটা বাহিনী প্রত্যাশা করছি। আমি তাঁদের কাছে আদেশ পাঠিয়েছি যে আমরা যদি ইতিমধ্যে এখানে অবরোধে সম্মুখীন হই তাহলে তারা অবরোধকারী বাহিনীকে পেছন থেকে এসে আক্রমণ করবে। আর তারা যদি শেরশাহ আগ্রা থেকে অগ্রসর হবার আগেই আমাদের সাথে এসে যোগ দেয়- আমি যেমন আশা করছি তখন শেরশাহের আগুয়ান বাহিনীর পার্শ্বদেশে আক্রমণের জন্য যথেষ্ট সংখ্যক লোক আমাদের সঙ্গে থাকবে। অধিক লোকবলের সুবিধা তাঁর থাকবে কিন্তু আমাদের পক্ষে থাকবে গতি আর ঘোড়সওয়ারীর কুশলতা যা আমাদের শত্রুর বিরুদ্ধে সবসময়ে আমাদের দারুণ সহায়তা করেছে। কামরান তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো, শেরশাহের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করার ঝুঁকি নিতে আমি প্রস্তুত- কেবল এই মুহূর্তে সেটা আমরা করতে পারছি না…।
কামরান কথা না বলে কেবল কাঁধ ঝাঁকায় এবং পুনরায় নিরবতা এসে বিরাজমান হয়। হুমায়ুন উঠে দাঁড়ায়। শেরশাহের অভিপ্রায় সম্বন্ধে আর কাবুল থেকে আমাদের অতিরিক্ত বাহিনীর অগ্রসর হবার সংবাদ যখন আমাদের কাছে আরও বিশদভাবে থাকবে তখন আবার আমরা আলোচনার জন্য মিলিত হতে পারি। কিন্তু তার আগে আজ রাতে একটা ভোজসভার আয়োজন করলে কেমন হয় বহুদিন পরে আমরা আবার সবাই একত্রিত হয়েছি। বর্তমান বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও বাবরের ছেলেরা একতাবদ্ধ রয়েছে এসো দুনিয়াকে সেটা আমরা দেখিয়ে দেই।
হুমায়ুন করিডোর দিয়ে দ্রুত পায়ে নিজের আবাসন কক্ষের দিকে হেঁটে যাবার সময় মহিলাদের কক্ষে যাবার দরজা সে পার হয়ে আসে। সেখানে ভেতরে কোথাও গুলরুখের থাকার কথা তাঁকে বলা হয়েছে কামরানের সাথে সে লাহোরে এসেছে। হুমায়ুন তাঁকে তাঁর দরবারে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার পরে সঙ্গত কারণেই তিনি তাঁর বড় ছেলে, উচ্চাকাঙ্খি কামরানের সাথে থাকাটাই বেছে নিয়েছেন। মহিলা কি কোনোভাবে তাঁর ছেলেদের প্রভাবিত করতে চেষ্টা করছে এবং সেটা যদি হয়ে থাকে, কিভাবে? এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। হুমায়ুন মুহূর্তের জন্য চিন্তা করে তার সৎ-ভাইদের পুনরায় একত্রিত করাটা তার ঠিক হয়েছে কিনা। তাঁদের চারজনের ভিতরে সত্যিকারের বিশ্বাস, সত্যিকারের একতাবোধ কখনও জন্ম নেবে এমন চিন্তা করাটা হয়ত বোকামী হবে- আকাঙ্খ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা সবসময়ে মাথা চাড়া দেবে। আর এজন্য কি সে তাঁদের দোষ দিতে পারে? তাঁদের অবস্থানে থাকলে যে ভাই উত্তরাধিকার সূত্রে সবকিছু পেয়েছে তাঁর প্রতি কি সে ক্ষোভ অনুভব করতো না? তাঁকে তাঁদের সবাইকে বিশেষ করে কামরানকে-চোখে চোখে রাখতে হবে এবং অবাধ্যতার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র তাকে ব্যবস্থা নিতে হবে। ঘরের বাইরে যখন শত্রু কড়া নাড়ছে তখন ঘরের ভেতরের শত্রুকে সে কোনমতেই বরদাশত করবে না।
হুমায়ুনের হঠাৎ সালিমার সাথে দেখা করতে ইচ্ছা হয়। তাঁর উষ্ণ, ঐকান্তিক আলিঙ্গনে দৈহিক সুখে উদ্বেলিত হয়ে সে অস্বস্তিকর ভাবনাগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখতে পাবে। তার মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠে এবং তাঁর হাটার গতি সহসা বেড়ে যায়।
*
সুলতান, শেরশাহের অগ্রবর্তী বাহিনী আগ্রা থেকে লাহোরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে। হুমায়ুনের বিশৃঙ্খল স্বপ্নের রেশ জওহরের কণ্ঠস্বরে ভেঙে যায়। সে কষ্ট করে ঘুমের রেশ কাটিয়ে সজাগ হবার মাঝে জওহরের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখটা তার ডানহাতে ধরা মোমের দপদপ করতে থাকা আলোক রশ্মির মাঝে উদ্ভাসিত দেখতে পায়। আহমেদ খান, এখনই আপনার সাথে দেখা করতে চায়। সে এমনকি ভোরের আলো ফোঁটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি হয়নি। তাঁর গুপ্তদূতদের একজন তার সাথেই রয়েছে। গত ছয় দিন লোকটা পথেই ছিল এবং এখনই ফিরে এসেছে।
হুমায়ুন উঠে বসে, তার বিছানার পাশে একটা কাঠের পাদানির উপরে রাখা পিতলের পাত্রে রক্ষিত পানি দিয়ে মুখে ঝাপটা দেয় এবং একটা সবুজ আলখাল্লা গায়ে জড়িয়ে নেয়। কয়েক মিনিট পরে, আহমেদ খান আর পথের ধকলের ফলে ক্লান্তিতে টলতে থাকা গুপ্তদূতকে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
তুমি নিশ্চিত শেরশাহ পুনরায় সামনের দিকে এগিয়ে আসছে?
জ্বি,সুলতান। আমার গুপ্তদূতের বক্তব্য আপনি নিজের কানেই শোনেন।
গুপ্তদূত কয়েক পা সামনের দিকে এগিয়ে আসে। আমি এর উপরে আমার জীবন বাজি রাখতে পারি। আমি নিজের চোখে যা দেখেছি আর নিজের কানে যা শুনেছি সে বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করেছি এবং কেবল তারপরেই আমি লাহোরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি, পথে ঘোড়া পরিবর্তন করার জন্য আমি কেবল দেরী হয়েছে।
কতজন সৈন্যের বাহিনী?
সেটা গণনা করাটা একটু কঠিন কিন্তু চলার পথে তারা যে পরিমাণ ধূলো উড়াচ্ছে, বেশ কয়েক হাজার অশ্বারোহী হবে, সুলতান।
আর শেরশাহর নিজের কি খবর?
আমি যা শুনেছি সে অনুযায়ী তিনি এখনও আগ্রায় অবস্থান করছেন। কিন্তু শীঘ্রই তিনি নিজেও যাত্রা করবেন, আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত। আমি রওয়ানা হবার ঠিক আগ মুহূর্তে, আগ্রা দূর্গের নীচে নদীর তীরে মালবাহী একটা বিরাট বহরকে সেখানে অবস্থান করতে দেখেছি- ভারবাহী খচ্চর, ষাড় আর উটের কোনো সীমা সংখ্যা নেই আর সেই সাথে রয়েছে কয়েকশ হাতি। মালবাহী শকটে বেগুনী রঙের আচ্ছাদনযুক্ত শেরশাহের নিজস্ব তাবু ভাঁজ করা অবস্থায় তুলতে দেখেছি। গুপ্তদূত নিজের দায়িত্ব সাফল্যের সাথে পালন করায় এখন তাঁর নোংরা, টানটান মুখটা দৃশ্যত স্বাভাবিক হয়ে উঠে।
সে বিদায় নেয়া মাত্র, হুমায়ুন তাঁর নীচু টেবিলের সামনে আসনপিড়ি হয়ে বসে। তার ভাইদের সাথে আরো আলোচনা করে কোনো লাভ হবে না। গত কয়েক দিন ধরে, আসকারি আর হিন্দাল তাদের বড় ভাইদের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় শুনতেই বেশী পছন্দ করেছে, নিজেরা গঠনমূলক কোনো পরামর্শ না দিয়ে। শেরশাহের সাথে যুদ্ধযাত্রার পক্ষে কামরান এখনও তর্ক চালিয়ে যাচ্ছে এবং হুমায়ুন দৃঢ়তার সাথে সেটা নাকচ করে বলছে যে আরো অনেক বেশী যোদ্ধা সমবেত করা ছাড়া এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য এবং সেই সাথে কামরানকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে সে নিজে ইতিমধ্যে দুবার শেরশাহের সাথে দুটো বিশাল যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে পরাজিত হয়েছে। তার শত্রু শেষবারের যুদ্ধের পর আরও অনেকবেশী শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। যখন সে নিজে আরও দুর্বল হয়েছে। আরেকটা সম্মুখ সমরের সুযোগ সন্ধান করার সময় এটা না।
গত কয়েকদিন ধরে এসব আলোচনার সময়ে, তার আব্বাজানের রোজনামচায় একবার পড়েছিল এমন একটা বিষয় হুমায়ুনের বারবার মনে হতে থাকে। অস্ত্রের বলে যদি তুমি তোমার শত্রুকে পরাজিত করতে না পার, হতাশ হয়ো না। অন্য কোনো উপায় খুঁজে বের কর। তেল দেয়া, ধারালো, দো-ধারি রণকুঠার নিঃসন্দেহে একটা দারুন অস্ত্র কিন্তু সেই সাথে বুদ্ধিদীপ্ত মস্তিষ্ক নিজেও একটা অস্ত্র যা বিজয়ের সুবেদী পথ খুঁজে বের করতে পারে…
কিছুক্ষণ চিন্তা করার পরে, হুমায়ুন লিখতে শুরু করে। শেরশাহ, তুমি হিন্দুস্তান আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে চাইছো যদিও তৈমূরের অধস্তন পুরুষের রক্ত নিজের ধমনীতে ধারণ করার কারণে এটা আমার সাম্রাজ্য। আমার সাথে একলা দ্বৈরথে অবতীর্ণ হও এবং এসো আমরা এই বিরোধ চিরতরে মীমাংসা করি। কিন্তু তুমি যদি আমার সাথে দ্বৈরথে রাজি না হও, তাহলে এসো আমরা অন্তত আরো রক্তপাত পরিহার করতে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়ে নিজেদের ভিতরের মতপার্থক্য সমাধানের জন্য ভিন্ন কোনো পথের সন্ধান করি।
গালার একটা কালচে লাল রঙের দণ্ড নিয়ে হুমায়ুন সেটা জ্বলন্ত মোমের শিখার উপরে ধরে এবং তাকিয়ে দেখে গালাটা নরম হয়, তারপরে রক্তের ফোঁটার মতো ফোঁটা ফোঁটা লালচে গালা ঝরতে শুরু করে। দণ্ডটা আগুন থেকে বের করে এনে সে চিঠির নীচে সেটা ধরে থাকে যতক্ষণ না সেখানে গালার একটা ক্ষুদ্র সঞ্চয় জমা হয়। তারপরে ডানহাত উল্টো করে সে তৈমূরের সোনার অঙ্গুরীয় শক্ত করে গালার উপরে চেপে ধরে গর্জনরত ক্রুদ্ধ ব্যাঘ্রের একটা নিখুঁত প্রতিকৃতি সেখানে সৃষ্টি করে।
এক ঘন্টা পরে, হুমায়ুন তাকিয়ে দেখে আহমেদ খানের দুজন লোক শেরশাহকে খুঁজে বের করে তাঁর চিঠিটা তাঁকে পৌঁছে দেবার জন্য লাহোর থেকে পুত বেগে ঘোড়া হাকিয়ে রওয়ানা হয়েছে। শেরশাহ কখনও ব্যক্তিগত দ্বৈরথে রাজি হবে না- কেবল আহাম্মকরাই এই ধরনের আহ্বানে সাড়া দিবে কিন্তু যুদ্ধবিরতির ধারণা তাঁকে হয়তো প্ররোচিত করতে পারে। ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের দ্বারা প্রচারিত কিছু গল্প সর্বজনস্বীকৃতভাবে যা গুজবের চেয়ে বেশী কিছু না- অনুসারে শেরশাহের কয়েকজন সেনাপতির ভিতরে বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে। এইসব গল্পে যদি সত্যের বিন্দুমাত্র ছিটেফোঁটা থেকে থাকে, শেরশাহ তাহলে হয়তো নিজের কর্তৃত্ব পুর্নপ্রতিষ্ঠায় নিজেকে সাহায্য করতে যুদ্ধবিরতির এই প্রস্তাব স্বাগত জানাবে। সেটা যদি হয়, তাহলে হুমায়ুনও কিছুটা সময় পাবে। কাবুল থেকে তাঁর ডেকে পাঠান সৈন্যের পৌঁছাবার এখনও কোনো লক্ষণ নেই এবং সম্ভবত আগামী কয়েক সপ্তাহের আগে তারা এসে পৌঁছাবে না। শেরশাহের যতদিন বিলম্ব হবে প্রতিটা দিন তাকে সাহায্য করবে…
সাতদিন পরে একটা অশুভ লক্ষণের ন্যায় শেরশাহ এখন লাহোরের কত নিকটে- হুমায়ুন তাঁর চিঠির উত্তর পায়। তার আবাসন কক্ষে সেটা কাশিম নিয়ে আসে। অবাক করার মতো ব্যাপার হল চিঠি দুটো একটা শেরশাহের মোটা অমার্জিত হাতে লেখা এবং তার মোহর অঙ্কিত আর অন্যটা চিঠিটা বাঁশের একটা চোঙ্গার ভেতরে মোড়ার অবস্থায় রাখা- কাশিমকে গুপ্তদূতেরা যা বলেছে সে অনুযায়ী চিঠিটা হুমায়ুনের কাছে অবশ্যই পৌঁছে দেবার জন্য শেরশাহ অনুরোধ করেছে।
হুমায়ুন শেরশাহের চিঠিটা প্রথমে পড়ে। আমি হিন্দুস্তান জয় করেছি। যা ইতিমধ্যে আমার নিজের তাঁর জন্য আমি কেন আপনার সাথে লড়াই করবো? আমি কাবুল আপনাকে ছেড়ে দিলাম। সেখানে চলে যান। কিন্তু চিঠিতে আরো কিছু লেখা আছে: একটা সাম্রাজ্য রক্ষার প্রত্যাশা আপনি কিভাবে করেন যখন আপনি আপনার নিজের পরিবারের আনুগত্য অর্জন করতে ব্যর্থ? আপনার সৎ-ভাই কামরান আপনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে ইচ্ছুক। কিন্তু আপনাদের মতো মোগলদের কাছ থেকে আমি কিছু চাই না কেবল তাঁদের ছিন্ন মস্তক যেখানে তাঁদের থাকার কথা সেই ধূলোতে গড়াগড়ি খাচ্ছে দেখা ছাড়া। আমি আপনার ভাইয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখান করে তাঁকে লিখে পাঠিয়েছি। ঠিক যেমন আমি আপনার প্রস্তাবও প্রত্যাখান করছি- এবং তাঁকে এটাও অভিহিত করেছি তাঁর প্রতারণার কথা আমি আপনাকে জানাব।
হুমায়ুন বাঁশের চোঙ্গাট নিয়ে ভেতর থেকে হলুদ পার্চমেন্টের টুকরো বের করে আনে। সেটাকে টেবিলের উপরে বিছানোর সাথে সাথে কামরানের সুচালো হাতের লেখা হুমায়ুন চিনতে পারে। এটা শেরশাহের কাছে তার লেখা চিঠি। আমার ভাই আমার জন্মগত অধিকার থেকে আমায় বঞ্চিত করেছে, ক্রোধে কাঁপতে থাকা কণ্ঠে সে উচ্চস্বরে চিঠিটা পড়ে। শেরশাহ, আপনি যদি পাঞ্জাব আর কাবুলসহ উত্তরের মোগল ভূখণ্ড শাসনের জন্য আমাকে ছেড়ে দেন, আমি হুমায়ুনকে আপনার হাতে তুলে দেব বা যদি আপনি চান- আমি শপথ করে বলছি, আমি নিজের হাতে তাকে হত্যা করবো।
কাশিম মাটি থেকে কামরানের চিঠিটা তুলে নেয় যেখানে হুমায়ুন সেটা ছুঁড়ে ফেলেছে এবং পুনরায় সেটা পড়ে, কামরানের উদ্ধত, রক্তলোলুপ শব্দগুলো পাঠ করার সময় সংক্ষোভে তার চোখ মুখ কুচকে যায়। হুমায়ুন নিজে দরজার কাছে হেঁটে যায় এবং এক ধাক্কায় পাল্লা খুলে চিৎকার করে, প্রহরী, আমার ভাই কামরানকে এখনই আমার কাছে নিয়ে এসো। সে যদি বাধা দেয়, শক্তির দ্বারা পরাভূত করবে এবং বেঁধে নিয়ে আসবে। সে সন্দেহ করেছিল তার ভাইয়েরা তার বিরুদ্ধে হয়ত চক্রান্ত করতে পারে কিন্তু তাঁদের একজন এতটাই বিবেচনাহীন হতে পারে যে রাজবংশের কাছে সে ঋণী তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে গিয়ে সেটাকেই একজন বহিরাগতের কাছে বলি দিতে চাইছে। হুমায়ুন উদ্বিগ্ন আর নিরব কাশিমের সামনে নিজের কক্ষে পায়চারি করতে থাকে, যতক্ষণ না প্রহরীদের একজন ফিরে আসে।
সুলতান, তাকে আমরা কোথাও খুঁজে পাইনি। আমরা প্রথমে তার আবাসন কক্ষে যাই কিন্তু তিনি সেখানে ছিলেন না। তারপরে আমরা পুরো দূর্গটা খুঁজে দেখি আমরা এমনকি জেনানা মহলে লোক পাঠিয়েছিলাম খুঁজে দেখতে, তাঁর আম্মিজান মহামান্য রাজমাতা গুলরুখের সাথে হয়তো তিনি আছেন, কিন্তু তার আম্মিজানও সেখানে ছিলেন না…
হুমায়ুন আর কাশিম পরস্পরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে। প্রধান তোরণদ্বারের পাহারার দায়িত্বে নিয়োজিত আধিকারিককে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও- দ্রুত, পা চালাও!
কয়েক মিনিটের ভিতরে হুমায়ুনের সামনে সন্ত্রস্ত দর্শন এক আধিকারিককে নিয়ে আসা হয়।
আজ সারাদিনে আমার কোনো ভাইকে তুমি দেখেছো?
জ্বী, সুলতান। আজ সকালে শাহজাদা কামরান আর শাহজাদা আসকারি ঘোড়ায় চড়ে বের হয়েছেন। তারা এখনও ফিরে আসেননি…
আর তাঁদের আম্মিজান গুলরুখ আর তাঁর পরিচারিক?
একটা পালকিতে করে তারাও প্রাসাদ ত্যাগ করেছে। বেগম সাহিবা বলেছেন তাঁর বোন, লাহোরের প্রধান কোষাধ্যক্ষের স্ত্রীর সাথে তিনি, শহরের উত্তরে তার হাভেলীতে দেখা করতে চান।
হুমায়ুন ক্রুদ্ধ কণ্ঠে গালিগালাজ করে উঠে। কোনো সন্দেহ নেই মহিলা এতোক্ষণে তার ছেলেরা এবং তাদের বাহিনীর সাথে মিলিত হয়েছে এবং এই মুহূর্তে তারা সবাই ঝড়ের বেগে এগিয়ে চলেছে তার নাগালের বাইরে যেতে। সে আরেকটু হলেই তাদের পিছু ধাওয়া করার আদেশ দিত কিন্তু মুশকিল হল শেরশাহও চায় সে ঠিক সেটাই করুক। তাঁর শত্রু দারুণ এক চাল দিয়েছে, একদিকে সে হুমায়ুনের হাতে তার ভাইয়ের শঠতার প্রমাণ তুলে দিয়েছে আর অন্যদিকে কামরানকেও পালাবার কারণ আর সময় দিয়েছে। কিন্তু সে শেরশাহের হুমকি অবহেলা করে তাঁর জন্য এত চতুরতার সাথে পাতা ফাঁদে পা দেবে না এবং এখনই কামরান আর আসকারির পিছু নিয়ে ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাইদের যুদ্ধের সূত্রপাত করবে না।
প্রতিশোধের সময় পরেও পাওয়া যাবে।