১৭. আবেগ আর অনুভূতি
পাহাড়ে শীতকালটা খুব দ্রুত জাকিয়ে বসে। তিন সপ্তাহ পূর্বেও, বাতাসের ঝাপটানিতে অস্থির তুষারকণা মাটিতে সামান্যই থিতু হতে পারতো কিন্তু এখন কাবুলের উত্তরপশ্চিমে বরফাবৃত পাহাড়ের মাঝে একটা সংকীর্ণ গিরিকন্দরের ভিতর দিয়ে হুমায়ুন যখন তার বাহিনী নিয়ে সামনে এগিয়ে চলেছে, বাতাস তখন প্রায় আনুভূমিকভাবে তুষারকণা তাঁদের দিকে পরিচালিত করছে। গিরিকন্দরের ভিতরে দিয়ে ভ্রমণের কষ্ট ক্রমশ খারাপ হতে থাকা পরিস্থিতির সাথে মিলিত হয়ে প্রবল হয়ে উঠেছে। হুমায়ুন তাঁর মূল মালবাহী বহর এসে পৌঁছান পর্যন্ত অপেক্ষা করাটাই শ্রেয় মনে করে। এরফলে যদিও কয়েকটা দিন নষ্ট হবে কিন্তু শীতের এই আবহাওয়ায় কামান আর অন্যান্য ভারী উপকরণ থেকে দীর্ঘ সময় বিচ্ছিন্ন থাকার ঝুঁকি নেয়াটা বিচক্ষণতার পরিচায়ক বলে মনে করে না সে।
সামনের আঁকাবাঁকা পথ জরিপ করার জন্য হুমায়ুন মাথা তুলে সামনের দিকে তাকাতে স্ফটিকাকার বরফের কণা তার মুখে হুল ফোঁটায়। এমনকি তুষারঝড়ের হাড়কাঁপান শীতলতার প্রকোপ থেকে বাঁচতে সিদ্ধান্ত নেয়া ভঙ্গিতে চোখ কুচকে সামনে তাকিয়ে সে প্রায় কিছুই দেখতে পায় না, বিশেষ করে বরফাবৃত উঁচুনীচু চূড়ার শীর্ষদেশ কিংবা গিরিকরটা যার অংশ এবং তাঁর ধারণা অনুযায়ী তাদের সামনে পৌনে এক মাইলের ভিতরে রয়েছে সেই গিরিপথের শীর্ষদেশ কিছুই গোচরীভূত হয় না।
আহমেদ খান শীঘ্রই ফিরে আসবে। সে কয়েকজন লোক দিয়ে তাঁকে সামনে পাঠিয়েছে, একটা বিষয় নিশ্চিত করতে যে এমন তীব্র আবহাওয়ায় তার বাহিনীর মতো একটা বাহিনীর পক্ষে গিরিকরটা অতিক্রম করা সম্ভব এবং সেই সাথে একটা স্থান নির্বাচন করে আসতে- সম্ভবত নিম্নগামী ঢালের কোনো অংশে যেখানে তারা বাতাসের আক্রমণ এড়িয়ে অস্থায়ী ছাউনি স্থাপন করতে পারবে।
সহসা, তুষারঝড়ের গর্জন এবং তাঁর মুখের নিম্নাংশ জড়িয়ে থাকা লাল পশমের কাপড়ের কারণে সৃষ্ট চাপা প্রভাব সত্ত্বেও, হুমায়ুনের মনে হয় সামনে কোথাও বরফের ভিতর থেকে সে একটা কান্নার শব্দ শুনতে পেয়েছে। সম্ভবত পুরোটাই বাতাসের একটা কারসাজি বা কোনো নেকড়ের কান্না, সে পুনরায় সামনের দিকে তাকিয়ে এবং শব্দটা ভালোমতো শোনার জন্য মুখের কাপড়টা সরিয়ে সেয়ার সময় সে ভাবে। সে যখন এসব সাতসতেরো ভাবছে, সে কাছেই আরেকটা চিৎকারের শব্দ শোনে এবং নিশ্চিতভাবেই মানুষের সামনে শত্রু রয়েছে!
সে ঠিক এরপরেই উড়ন্ত তুষারকণার মাঝে অস্পষ্ট এক অশ্বারোহীর অবয়ব দেখতে পায়, বরফাবৃত পথের উপর দিয়ে ঝড়ের বেগে তাঁর দিকে ছুটে আসছে, বরফ কিংবা তার নীচে চাপা পড়া পাথরে হোঁচট খাবার তোয়াক্কা না করে। ঘোড়সওয়াড় আরেকটু কাছে আসতে হুমায়ুন দেখে লোকটা আর কেউ না আহমেদ খান, পাগলের মতো নিজের ঘোড়ার পাঁজরে গুতো মারতে মারতে ক্রমাগত চিৎকার করে বলছে, হুশিয়ার, সামনে শত্রু! সামনে শত্ৰু, হুশিয়ার! তার গুপ্তদূতদের দুজন তার ঠিক পেছনেই রয়েছে। সহসা তাঁদের একজন তার ঘোড়র উপর দিয়ে সামনের দিকে ছিটকে পড়ে, সাদা বরফের উপরে গড়াবার সময় নিজের রক্ত দিয়ে এর উপরে লাল আল্পনা এঁকে দিয়ে যায়, তাঁর পিঠ থেকে দুটো তীরের শেষপ্রান্ত বের হয়ে রয়েছে। মুহূর্ত পরে, দ্বিতীয় গুপ্তদূতের খয়েরী রঙের ঘোড়াটা হোঁচট খায় এবং পেছনের পায়ে বেশ কয়েকটা তীরের আঘাত নিয়ে বরফের উপরে লুটিয়ে পড়ে। হতভাগ্য ঘোড়াটার সওয়ারী পর্যান থেকে পিছলে নেমে এসে হাটু পর্যন্ত গভীর বরফের ভিতর দিয়ে হোঁচট খেতে খেতে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করে, তবে দশ পা এগোবার আগেই সে নিজেও বরফে আছড়ে পড়ে, কালো পালকযুক্ত একটা তীর তাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।
হুমায়ুন এরপরেই বরফের ভিতর দিয়ে অচেনা অশ্বারোহীদের কালো অবয়ব আবির্ভূত হতে দেখে, তাঁর দিকে ধেয়ে আসছে, তাঁদের কেউ নিজেদের ঘোড়ার গলার উপর ঝুঁকে থেকে, তরবারি কিংবা বর্শা সামনের দিকে বাড়িয়ে রেখেছে এবং বাকিদের হাতে রয়েছে মৃত্যুবর্ষী ধনুক। বাতাসের গর্জন ছাপিয়ে হুমায়ুন বৈরাম খানের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠে। মালবাহী শকটগুলোকে তোমার পক্ষে যতটা সুচারুভাবে সম্ভব একটা নিরাপত্তা ব্যুহ তৈরী কর- যেসব শকটে মহিলারা রয়েছে তাঁদের ব্যুহের ভেতরে নিয়ে যাও। শকটগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তোমার সেরা যোদ্ধাদের পর্যাপ্ত সংখ্যায় মোতায়েন করে বাকিদের নিয়ে আমায় অনুসরণ কর।
হুমকির মুখোমুখি হতে হুমায়ুন তার ঘোড়ার পাজরে গুতো দেয় সামনে এগোবার জন্য এবং সেই সাথে তার ঠিক পেছনেই অবস্থানরত অশ্বারোহী তীরন্দাজদের একটা দলকে তাঁর পক্ষে যতটা জোরে চিৎকার করা সম্ভব, সে চিৎকার করে বলে, তীর ছুঁড়তে শুরু কর! তীরন্দাজেরা, যাঁরা ঠিক এমন অতর্কিত আক্রমণের কথা মাথায় রেখেই ধনুকের ছিলা টানটান করে বেঁধে রেখেছিল ইতিমধ্যেই পিঠ থেকে নিজেদের জোড়া ধনুক নামিয়ে এনে, ঘোড়ার রেকাবে দাঁড়িয়ে উঠে কামরানের লোকদের উদ্দেশ্যে উড়ন্ত তুষারকণার ভেতর দিয়ে এক পশলা তীর নিক্ষেপ করে। আগুয়ান বেশ কয়েকটা ঘোড়া টলমল করে উঠে হুমড়ি খেয়ে পড়ে এবং পিঠের সওয়ারীদের ছিটকে ফেলে দেয়। বরফের উপর আছড়ে পরার সময় একজন তার মাথার চূড়াকৃতি শিয়োস্ত্রাণ হারায় এবং তার কামান মাথা বরফের ভিতর বের হয়ে থাকা একটা পাথরের সাথে বেমক্কা ধাক্কা খেলে, তার খুলি ফেটে গিয়ে আশেপাশের মাটি রক্ত আর মগজে মাখামাখি হয়ে যায়।
অবশ্য, কামরানের অবশিষ্ট অশ্বারোহীরা ঠিকই ধেয়ে আসে, হানাদারের দল হুমায়ুনের অশ্বারোহীদের প্রথমসারির সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার আগে, গিরিকরের নিম্নমুখী ঢাল তাদের আক্রমণে বাড়তি গতি যোগ করে, হুমায়ুনের অশ্বারোহীরা তাদের চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলার আগে কেবল নিজেদের মধ্যবর্তী দূরত্ব বৃদ্ধি করে তাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়। ভেড়ার চামড়ার মোটা আলখাল্লা পরিহিত কামরানের এক যোদ্ধা, মাথার উপরে কাঁটাযুক্ত স্তনী ভীমবেগে ঘোরাতে ঘোরাতে হুমায়ুনের দিকে ধেয়ে আসে। সংঘর্ষের সম্ভাবনার কারণে তুঙ্গস্পর্শী উত্তেজনার মাঝে, হুমায়ুন তাঁর ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নেয়ার মাঝেই লক্ষ্য করে তার প্রতিপক্ষের ঘোড়ার কেশরে তুষারকণা কিভাবে আবৃত করে রেখেছে। হুমায়ুন তার শত্রুকে লক্ষ্য করে সামনে এগোতে লোকটার কস্তনীর শেষ প্রান্তে যুক্ত কাঁটাযুক্ত গোলকটা তাঁর পাশ নিয়ে নির্বীষভাবে অতিক্রম করে কিন্তু তাঁর তরবারির আঘাত ঠিকই লোকটার ভেড়ার চামড়ার পুরু আলখাল্লার এক জায়গা পুরু করে চিরে ফেলে।
উভয় যোদ্ধাই নিজ নিজ ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নেয় এবং পুনরায় পরস্পরের দিকে ধেয়ে আসে, শীতল বাতাসে তাদের ঘোড়ার উষ্ণ নিঃশ্বাস বাস্পের ন্যায় ছড়িয়ে যায়। দুজনেই পুনরায় পরস্পরকে লক্ষ্য করে আক্রমণ শানায় কিন্তু পুনরায় দুজনেই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। হুমায়ুনের প্রতিপক্ষ যখন প্রাণপনে লাগাম টেনে ধরে তৃতীয়বারের মতো হুমায়ুনকে আক্রমণের প্রয়াসে ব্যস্ত, বরফের উপরে তাঁর ঘোড়ার পা পিছলে যায়। লোকটা যখন প্রাণপনে চেষ্টা করছে পর্যানে কোনোমতে বসে থাকতে, হুমায়ুন তীক্ষ্ণ এক মোচড়ে তাঁর বাহনের মুখ ঘুরিয়ে নেয় এবং প্রতিপক্ষ তার হাতের কস্তনী দিয়ে আঘাত হানার মতো সুস্থির হবার আগেই তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
হুমায়ুন সপাটে তাঁর তরবারি চালনা করে এবং লোকটা যদিও একটা ঝাঁকি দিয়ে তার দেহের উপরের অংশ সরিয়ে নিতে সক্ষম হয় কিন্তু তরবারির ফলা তার আক্রমণকারীর উরুর নিম্নাংশে ঠিক হাটুর উপরে কামড় বসায়, মাংসপেশী কেটে গিয়ে একেবারে হাড়ে গিয়ে থামে। সহজাত প্রবৃত্তির বশে লোকটা হাতের কনী ফেলে দিয়ে ক্ষতস্থান চেপে ধরে। লোকটা ভুলের সুযোগ নিয়ে হুমায়ুন তাকে লক্ষ্য করে পুনরায় তরবারি চালায়, এবার লক্ষ্যস্থল কণ্ঠনালী। শীতল বাতাসে নিখুঁত ফোঁটায় রক্ত ছিটকে উঠে এবং লোকটা মাটিতে আছড়ে পড়ে।
হুমায়ুনের চারপাশে তার লোকেরা প্রতিপক্ষের সাথে প্রাণপনে লড়াই করছে, যাদের চেয়ে আপাতদৃষ্টিতে তারা সংখ্যায় বেশী। হুমায়ুন অবশ্য লক্ষ্য করে যে তিনজন শত্রুসেনা বৈরাম খানকে ঘিরে ফেলায় সে তার বাকি লোকদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। হুমায়ুন তার ঘোড়ার পাঁজরে গুতো দিয়ে তাঁদের দিয়ে এগিয়ে যায়। বৈরাম খান তাঁর মাথার শিরোম্রাণ হারিয়েছে এবং তুষার ঝড়ের কারণে তার মাথার লম্বা কালো চুল তার পেছনে নিশানের মতো উড়ছে। নিজের বিশালাকৃতি কালো ঘোড়াটাকে চক্রাকারে ঘুরিয়ে দক্ষতার সাথে তার আক্রমণকারীদের পর্যায়ক্রমে মোকাবেলা করে সে তার সাধ্যমতো চেষ্টা করছে নিজেকে রক্ষা করতে। সে অবশ্য তারপরেও চাপের ভিতরে রয়েছে এবং ইতিমধ্যে বাম কানের নীচে থেকে তার বুকের বর্মের উপরে যেখানে তাঁর গলা শেষ হয়েছে সেখান পর্যন্ত প্রসারিত একটা গভীর ক্ষতস্থান থেকে অঝোরে রক্ত ঝরছে।
বৈরাম খানের আক্রমণকারীদের একজন হুমায়ুনের তরবারির এক মোক্ষম আঘাতে পর্যান থেকে ছিটকে পড়ার পরেই কেবল তাঁরা হুমায়ুনের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন হয় এবং দ্বিতীয়জন যে বৈরাম খানের অরক্ষিত পার্শ্বদেশে তাঁর হাতের আয়ুধ প্রবিষ্ট করার পায়তারা করছিল, পরবর্তী এক কোপে তার তরবারি ধরা হাত কাঁধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তৃতীয়জন রণে ভঙ্গ দিয়ে পালাবার জন্য দাঁড়ায় কিন্তু সে পালাতে গেলে বৈরাম খান পেছন থেকে তাকে ধাওয়া করলে, সে নিজের প্রাণ নিয়ে পালাতে পারলেও পেছনে তুষারের উপরে রক্তের একটা ধারা তার পলায়নের সাক্ষী হয়ে থাকে। কামরানের বাকি সব যোদ্ধারা যারা নিজেদের লড়াই থেকে সরিয়ে নিতে সক্ষম হয় তাঁরা সবাই তাকে অনুসরণ করে। আক্রমণটা যেমন আচমকা শুরু হয়েছিল ঠিক তেমনই সহসা সমাপ্ত হয়। পুরো খণ্ডযুদ্ধটা আধঘন্টারও কম সময়ে মিটে যায়।
তাদের পিছু ধাওয়া কর, হুমায়ুন চিৎকার করে জাহিদ বেগকে আদেশ দেয়। তোমার পক্ষে যতজনকে হত্যা কিংবা আটক করা সম্ভব, কর কিন্তু সাবধান সামনে অন্যরা হয়ত অতর্কিত হামলার জন্য ওত পেতে রয়েছে। সে ঘোড়া থেকে নেমে বৈরাম খানের দিকে দৌড়ে যায়, যে নিজের পর্যানের উপরে উপুড় হয়ে রয়েছে। অকুতোভয় পার্সী যোদ্ধা ঘোড়ার উপর থেকে একপাশে টলে পড়ার আগেই সে তার পাশে পৌঁছে যায়। হুমায়ুন তাকে আলতো করে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে, নিজের মুখ ঢাকার লাল রুমালটা দিয়ে তার ক্ষতস্থানের রক্তপাত বন্ধ করতে চেষ্টা করে। সুলতান, আপনাকে ধন্যবাদ। আমার জীবন বাঁচাবার জন্য আমি আপনার কাছে ঋণী… আমি এর প্রতিদান আপনাকে দেব, ব্যাথায় চোখমুখ কুঁচকে বৈরাম খান বিড়বিড় করে কথাগুলো বলে।
জাহিদ বেগ আর তার লোকেরা পুনরায় যখন গিরিকন্দরে নেমে আসে ততক্ষণে তুষারপাত বন্ধ হয়ে গিয়েছে এবং শীতের ধুসর সূর্য যুদ্ধক্ষেত্রের বুকে লম্বা ছায়ার সৃষ্টি করে, পশ্চিমের চূড়াগুলোর আড়ালে অস্ত যেতে শুরু করেছে, যেখানে দাঁড়িয়ে হুমায়ুন বৈরাম খানের এবং অন্যান্য আহত যোদ্ধাদের শুশ্রূষার তদারকি করছে। হুমায়ুন খেয়াল করে দেখে আগুয়ান অশ্বারোহীদের মাঝে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বন্দি নিজেদের ঘোড়ার পর্যানে বেকায়দা ভঙ্গিতে লাফাচ্ছে, তাদের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা এবং প্রত্যেকের হাটুজোড়া তাদের ঘোড়র পেটের নিচ দিয়ে দড়ি দিয়ে বাঁধা।
জাহিদ বেগ, বন্দিদের কেউ কি কথা বলতে আগ্রহী? তারা কি বলতে চায়?
কেবল এটুকুই যে তারা আসলে ঝটিকা আক্রমণে এসেছিল- যাদের সংখ্যা কোনোমতেই দেড় হাজারের বেশী হবে না এবং অধিকাংশই স্থানীয় গোত্রের লোজন। তারা যদি সাফল্য লাভ করে তাহলে আপনার ভাই তাঁদের প্রচুর বখশিশ দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিশেষ করে তারা যদি আপনার কাটা মাথা তার কাছে নিয়ে যেতে পারে।
আমাদের আরও আক্রমণের বিষয়ে এখন থেকেই সতর্ক থাকতে হবে। আরো প্রহরী মোতায়েন কর। আমরা আসছি কামরান এখন জানতে পারবে এবং সেই সাথে কখন আর কোনদিক থেকে।
*
বাইশ বছর পূর্বে তাঁর আব্বাজানের সাথে হিন্দুস্তান অভিযানে রওয়ানা হবার পরে এই প্রথম হুমায়ুন তাঁর চোখের সামনে নিজের জন্মস্থান দেখতে পায়। কাবুল শহর রক্ষাকারী দেয়াল আর তোরণদ্বার, মাত্র আধ মাইল দূরে, বরফাবৃত অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেয়ালের উপর দিয়ে শহরের সরাইখানার উঁচু খিলানাকৃতি প্রবেশ পথের কেবল শীর্ষদেশ সে দেখতে পায় যা হাজার হাজার বণিকের দলকে, যাঁরা চিনি, কাপড়, ঘোড়া, মশলা আর রত্নপাথরের মতো তাদের বিভিন্ন পণ্য দ্রব্য নিয়ে শহর অতিক্রম করার সময়, আশ্রয় দেয়, কাবুলের জন্য যা সমৃদ্ধির বারতা বয়ে আনে।
দূর্গপ্রাসাদটা একটা পাথুরে উচ্চভূমিতে অবস্থিত যেখান থেকে শহরটা দেখা যায়। দূর্গপ্রাসাদটার সাথে যদিও তার অনেক সুখকর স্মৃতি রয়েছে, হুমায়ুন সেগুলো এই মুহূর্তে দূরে সরিয়ে রেখে, শহরের চওড়া মাটির দেয়ার আর পোক্ত গম্বুজগুলো আবেগহীন, হানাদারের চোখে জরিপ করে। তাঁর বাল্যের স্মৃতি বিজড়িত বাসস্থান এটা এখন আর না, যার দেয়ালের পাশে দিয়ে সে ঘোড়া দাবড়েছে এবং বাজপাখি নিয়ে শিকার ধরেছে বরং এটা এখন তাঁর শক্রর সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি এবং তার সন্তানের বন্দিশালা। কান্দাহারের মতো এখানেও সে একই বিড়ম্বনার সম্মুখীন হয়। তাঁর সন্তান আকবর ইতিমধ্যে যে ভয়ানক বিপদের মধ্যে রয়েছে, তাকে তার চেয়ে আরও বেশী বিপন্ন না করে কিভাবে উদ্ধার করবে এবং নিজের শত্রুদের পরাস্ত করবে? হুমায়ুনের গুপ্তদূতেরা যদিও অনেক সময় তাঁদের সৈন্যবহরকে অনুসরণরত অশ্বারোহীদের দেখেছে যারা কামরানের লোকই কেবল হতে পরে এবং তাঁদের ধাওয়া করে তাড়িয়েছে। কামরান আর কোনো আক্রমণ করার আগ্রহ দেখায়নি। সে নিশ্চয়ই মনে করছে যে কাবুলে পর্যাপ্ত পরিমাণ রসদ মজুদ রয়েছে এবং অবরোধ মোকাবেলায় প্রস্তুত।
হুমায়ুন সিদ্ধান্ত নেয় সে আরো একবার যুক্তি আর উপদেশ দিয়ে তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করবে, যদিও দুটোর প্রতিই কামরান নিজের সংবেদনশীলতা সামান্যই প্রকাশ করেছে। আজ রাতে কাবুলের বাইরে বরফাবৃত প্রান্তরের বুকে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে স্থাপিত তার অস্থায়ী শিবিরে বসে সে আরো একটা চিঠি লিখবে যা তার সৎ-বোন শত্রুশিবিরে বহন করে নিয়ে যাবে। এবং আরো একবার, খুবই সহজসরল হবে তাঁর প্রস্তাব। কামরান যদি আকবরকে মুক্তি দেয় এবং কাবুল তাঁর হাতে সমর্পন করে, সে আর তার লোকেরা নিরাপদ অতিক্রমনের প্রতিশ্রুতির সাথে শহর ত্যাগ করতে পারবে। হুমায়ুন বিবেচনা করে দেখে, কান্দাহারে আসকারির কাছে গুলবদন যখন যুদ্ধ অনিবার্য এই মর্মে লেখা তাঁর চরমপত্র পৌঁছে দিয়েছিল, অন্তত তার চেয়ে এখন তার অবস্থান অনেকবেশী শক্তিশালী। সে কাবুলের যত নিকটবর্তী হয়েছে, উপজাতিয় লোকজন আরও বেশী সংখ্যায় তাঁর সাথে যোগ দিয়েছে। তাঁর নিজের বাহিনী এখনও যদিও পার্সি যোদ্ধাদের সমকক্ষ হয়ে উঠেনি, তাঁদের সংখ্যা এখন প্রায় আট হাজার।
হুমায়ুন তাঁর দাস্তানাবৃত হাত দিয়ে উষ্ণতার জন্য নিজের দুপাশে চাপড় দিতে দিতে, তাঁর লাল নিয়ন্ত্রক তাবুর দিকে এগিয়ে যায় যেখানে তার জন্য তাঁর যুদ্ধকালীন পরিষদমণ্ডলী অপেক্ষা করছে। আমার ভগিনী বেশ সাহসী। সে আরো একবার আমার প্রতিনিধি হতে রাজি হয়েছে। কিন্তু কামরান যদি আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধপ্রাসাদ আক্রমণের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। আমাদের কামানের গর্জন এবার সে শুনতে পাবে।
সুলতান, শহরটার কি হবে? বৈরাম খান জানতে চায়। তার ক্ষতস্থানসমূহ খুব দ্রুত শুকিয়ে আসছে, যদিও সে এখনও তার ঘাড় নাড়াতে পারে না, যার চারপাশে এখনও মোটা পট্টি বাঁধা রয়েছে। আরেকটা পৌরুষদীপ্ত ক্ষতচিহ্ন লাভ করার ব্যাপারে সে মোটামুটি নিশ্চিত।
সুলতানের সৎ-ভাই, অবশ্যই, এর প্রহরায় রক্ষীসেনা মোতায়েন করেছে, জাহিদ বেগ মন্তব্য করে। দেয়ালের উপর থেকে শহর রক্ষায় নিয়োজিত সৈন্যরা আমাদের উদ্দেশ্যে গুলি বর্ষণ করতে পারে বলে আমাদের অবশ্যই তাদের নিশানা ভেদ করার দূরত্বের বাইরে অবস্থান করতে হবে এবং আমাদের নিজেদের শিবিরের চারপাশে নিরাপত্তা পরিখা খনন করে পাহারার ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
কিন্তু এই বাহিনীর মতো বিশাল একটা বাহিনীকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে শহরের রক্ষীসেনা অভিনিষ্ক্রমণের কথা বিবেচনা করলে বোকামীর পরিচয় দেবে, বৈরাম খান নিজের মতামত জানান।
হুমায়ুন এতোক্ষনে কথা বলে। সেইসাথে, শহরের অধিবাসীরাও হয়ত তাঁদের সমর্থন করে না। কাবুলের অধিবাসীরা ব্যবসা করেই তাদের সম্পদ অর্জন করেছে। তাঁরা যুদ্ধ নয়, শান্তি আর সমৃদ্ধি চায়। যদিও তারা হয়ত আমার প্রতি বিশেষ কোনো প্রকার আনুগত্য অনুভব করে না, তারা যদি মনে করে আমি- কামরান নয় শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হব, আমার অনুগ্রহ লাভের আশায় তারা হয়ত তার সৈন্যদলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, আমার আব্বাজানের জন্য তার শত্রুর বিরুদ্ধে তাঁরা আগেও যেমন করেছিল। পুরো শহরটা বৃত্তাকারে ঘিরে ফেলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন কর। কিন্তু দূর্গপ্রাসাদের বিষয়ে আমাদের কি করণীয়, আমাদের কামানগুলো আমরা কোথায় মোতায়েন করবো যার ফলে আমাদের প্রেরিত আত্মসমর্পণের প্রস্তাব আমার সৎ-ভাই যদি প্রত্যাখ্যান করে তাহলে তাৎক্ষণিক আক্রমণের জন্য সেগুলো প্রস্তুত থাকে?
জাহিদ বেগ সমাধান দেয়। দূর্গপ্রাসাদ অভিমুখী রাস্তা দিয়ে কামানগুলো উপরের দিকে নিয়ে গিয়ে আমরা সেগুলোর জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক অগ্রবর্তী স্থান খুঁজে বের করবো, যেখানে আমাদের গোলন্দাজেরা গোলাবর্ষণের সময় দূর্গপ্রাসাদের দেয়াল তাদের লক্ষ্য করে সরাসরি তীর কিংবা মাস্কেটের গুলি বর্ষণ করা অসম্ভব।
আমি একমত। হুমায়ুন মাথা নেড়ে বলে। আমার মনে হয়, দূর্গপ্রাসাদের প্রবেশদ্বারের আগে রাস্তাটা শেষবারের মতো যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানে ঐ পাথুরে শিলাস্তরটা একটা অবস্থান হিসাবে প্রতিপন্ন হতে পারে। সেইসাথে, আমাদের লোকেরা যদি সেখানে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে পারে, তাহলে আমাদের লোকদের উপরে গোলা বর্ষণের জন্য কামরানের নিজস্ব গোলন্দাজ বাহিনীর পক্ষে তাদের কামানগুলোর নল যথেষ্ট পরিমাণে নীচু করাটা একটা কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের নিশানা হবে প্রধান প্রবেশদ্বারগুলো। প্রবেশদ্বারগুলো ধাতব পাত দিয়ে বাধান এবং লোহার ভারী গরাদ দ্বারা সুরক্ষিত হলেও তাঁদের পক্ষে অবিরাম বোমাবর্ষণের ধাক্কা সামলান অসম্ভব। তাদের সরাসরি ডানের বৰ্হিদেয়ালকেও আমাদের নিশানা করতে হবে। আমার যতদূর মনে পড়ছে, ঐ দেয়ালটা বেশ পুরাতন এবং বাকী দেয়ালগুলোর মতো পুরু নয়।
আপনার প্রস্তাবিত অবস্থান থেকে জোরালভাবে গোলাবর্ষণ করা সম্ভব কিনা সেটাই হবে আমাদের প্রধান সমস্যা, জাহিদ বেগ মন্তব্য করে।
রুস্তম বেগ, আপনার কি মনে হয়? হুমায়ুন জানতে চায়। আপনার গোলন্দাজেরা ঐ দূরত্ব থেকে কাঙ্খিত ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাতে পারবে?
প্রবীণ পার্সি সেনাপতি উত্তরের জন্য তার সহযোগীর দিকে তাকান। সুলতান, আশা করি কোনো সমস্যা হবে না, বৈরাম খান জবাব দেয়, গাঢ় নীল চোখ চিন্তিত অভিব্যক্তি। আমাদের কামানগুলো ক্ষুদ্রাকৃতির এটাই একমাত্র আফসোসের বিষয়। কাঝভিন থেকে যদি আমরা বড় কামানগুলো নিয়ে আসতে পারতাম, প্রতিরক্ষা দেয়ালগুলো তাহলে আমরা অনায়াসে গুঁড়িয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু আমাদের কাছে অন্তত পর্যাপ্ত পরিমাণে বারুদ আর পাথরের গোলা রয়েছে।
চমৎকার। আমি জানি কামানগুলোর সময় লাগবে নিজেদের প্রভাব জানান দিতে, কিন্তু আমরা কার্যকর ফাটল সৃষ্টি করতে পেরেছি সেটা প্রত্যক্ষ করার সাথে সাথে, আমি আমাদের সৈন্যদের প্রস্তুত দেখতে চাই- দূর্গপ্রাসাদে প্রবেশ করার জন্য আমাদের তীরন্দাজ আর তবকিদের গুলিবর্ষণের ছত্রছায়ায় ঢালুপথ দিয়ে ঢেউয়ের মতো ধেয়ে গিয়ে আক্রমণ করছে। বৈরাম খান আর জাহিদ বেগ আমি আপনাদের উপরে আক্রমণের প্রশিক্ষণের জন্য সৈন্যবাহিনী আর তাঁদের নেতৃত্ব দেবার লোকদের নির্বাচনের দায়িত্ব ছেড়ে দিলাম। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, দূর্গপ্রাসাদ থেকে কেউ পালাবার চেষ্টা করলে তাদের পিছু ধাওয়া করার জন্য সবসময়ে যেন অশ্বারোহী বাহিনীর কয়েকটা দল প্রস্তুত অবস্থায় থাকে। আমার সৎ-ভাইকে কোনমতেই পালিয়ে যাবার বা আমার ছেলেকে আমার নাগালের বাইরে পাঠিয়ে দেবার অনুমতি দেয়া হবে না।
*
কামরান যদি গুলবদনের অনুরোধ সাথে সাথে নাকচ করে দিত, তাহলে এতোক্ষণে সে ফিরে আসতো, আসতো না? হামিদা জানতে চায়। কনকনে তীব্র শীত আর আকস্মিক তুষারপাত সত্ত্বেও, গুলবদন দুটো খচ্চর দ্বারা টেনে নেয়া পর্দাঘেরা একটা শকটে উঠে বসার পরে, এবং সন্ধির পতাকা হাতে উপস্থিত জওহরের সামনে অবস্থান করে ঢালু পথ দিয়ে দূর্গপ্রাসাদের দিকে রওয়ানা হবার পর থেকেই সে কাবুলের দূর্গপ্রাসাদের মূল তোরণদ্বারের দিকে মেয়েদের তাবুর সামনে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রয়েছে। পাঁচমিনিট পরেই একটা তোরণদ্বার খুলে যেতে সে ভেতরে ঢুকে হারিয়ে যায়।
সবসময়ে সেটা অপরিহার্য নয়। কামরান যদি আকবরকে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও থাকে, তাহলেও উত্তরের জন্য তাঁকে আর আমাদের অপেক্ষা করিয়ে রেখে মজা দেখার মতো বিদ্বেষপরায়ন কামরান, হুমায়ুন উত্তর দেয়।
ঠিকই বলেছেন। সে যদি নিজের উচ্চাকাঙ্খ চরিতার্থ করতে মায়ের কোল থেকে তার সন্তানকে ছিনিয়ে নেবার মতো বদমায়েসী করতে পারে, তাহলে তাকে দিয়ে যেকোনো খারাপ কাজ সংঘটিত হতে পারে।
কিন্তু এমনও হতে পারে তারা হয়ত আকবরের জিনিষপত্র একত্রিত করছে। হামিদাকে সান্ত্বনা দিতে হুমায়ুন একটা স্তোকবাক্য আউরায়- যা সে নিজেই বিশ্বাস করে না।
দেখেন, তোরণদ্বার পুনরায় খোলা হচ্ছে, মেঘের আড়াল ভেঙে সদ্য বের হওয়া সূর্যের আলো বরফের উপর পড়ে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে চোখ আড়াল করে রুদ্ধশ্বাসে হামিদা বলে। রৌদ্রজ্জ্বল পারিপার্শ্বিক হয়ত একটা শুভলক্ষণ।
সম্ভবত, হুমায়ুন উত্তর দেয়। তোরণদ্বারের ভেতর থেকে প্রথমে জওহর তার ধুসর ঘোড়াটা নিয়ে বাইরে বের হয়ে আসবার মিনিটখানেকের ভিতরে গুলবদনকে বহনকারী শকটটি বের হয়ে, ধীর গতিতে ঢালু পথ বেয়ে নীচের দিকে নামতে শুরু করে।
ঝালরগুলো এখনও বন্ধ করে রাখা। আকবর সম্ভবত ভেতরে রয়েছে, হামিদা বলে।
সম্ভবত, হুমায়ুন আবারও বলে। তাঁর কথার মাঝেই সূর্য আবার মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়।
দশমিনিট পরে ক্ষুদে কাফেলাটা মেয়েদের তাবুর সামনে এসে উপস্থিত হয়। খচ্চর টানা শকটটি পুরোপুরি থামার আগেই গুলবদন ঝালর সরিয়ে দিয়ে নীচে নামতে যায়। তাকে কোনো কথা বলতে হয় না। তার থমথমে মুখ আর সেখানে ফুটে থাকা কঠিন অভিব্যক্তি দেখে হুমায়ুন আর হামিদা বুঝে নেয় ভেতরে আকবর নেই এবং তার চেয়েও খারাপ খবর যে তাকে দ্রুত ফিরে পাবার যে আশা তারা মনের ভেতর লালন করছিল, কামরানের উত্তর সেটাও ব্যর্থ করে দিয়েছে। অঝোর ধারায় কাঁদতে শুরু করে হামিদা; ভেজা, শীতল তুষারের উপর হাটু মুড়ে বসে পড়ে। হুমায়ুন তাঁকে আলতো করে দাঁড় করিয়ে শক্ত করে তাঁকে ধরে রাখে।
আপনাদের অনুভূতি আমি বুঝতে পারছি।
না, তুমি মোটেই বুঝতে পারছে না, হামিদা ফুঁপিয়ে উঠে। একজন মা কেবল সেটা বুঝতে পারবে। এক মোচড়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে জেনানাদের বরফাবৃত তাবু লক্ষ্য করে সে ছুটে যায়। ক্রোধ আর হতাশায় কাঁপতে কাঁপতে, হুমায়ুন তাঁর ছুটে যাওয়াটা তাকিয়ে দেখে তারপরে, সে গুলবদনের দিকে এগিয়ে গিয়ে তাঁকে নিজের তাবুতে নিয়ে আসে। তাবুর ভেতরে প্রবেশ করে সে তাঁদের সমস্ত পরিচারক আর পরিচারিকাদের ইশারায় বাইরে যেতে বলে। সে ঠিক কি বলেছে? সবাই বের হয়ে যাবার পরে তাবুর ভেতরে যখন কেবল তাঁরা দুজনে রয়েছে সে জিজ্ঞেস করে।
সামান্যই। দীর্ঘ সময় কামরান আমাকে অপেক্ষা করিয়ে রেখেছিল… সে একাই ছিল শেষ পর্যন্ত সে যখন আমাকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেয়, আমাদের আব্বাজানের গিল্টি করা সিংহাসনে উপবিষ্ট- কাবুলের রাজসিংহাসন। সে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে স্বাগত জানাবার কোনো চেষ্টাই করেনি। আপনার চিঠিটা আমি তাঁর হাতে তুলে দিতে, সে চিঠিটার দিকে একপলক তাকিয়ে থাকে। তারপরে, আপন মনে হাসতে হাসতে সে এটা লিখেছে। গুলবদন হুমায়ুনের দিকে ভাঁজ করা একটা কাগজ এগিয়ে দেয়। সে চিঠিটা আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে কেবল এটুকুই বলে, তাকে গিয়ে এটা দেবে এবং তাকে বিদায় হতে বলবে। আমি তার কাছে মিনতি করি, নাছোড়বান্দার মতো তাকে বলি, আপনার জন্য না হোক তার মা আর আমার খাতিরে হলেও, আকবরকে মুক্তি দিতে। সে কেবল এটাই বলে, আমাকে কি তোমার আহাম্মক মনে হয়? তোমার যদি আর কিছু বলার না থাকে, তাহলে তুমি এবার বিদায় নিতে পার। আমি আর একটা কথাও না বলে ঘুরে দাঁড়াই এবং কক্ষ থেকে বের হয়ে আসি। আরও মিনতি কিংবা কান্নাকাটি করে নিজেকে তাঁর সামনে আরও অপদস্থ করার সম্ভষ্টি আমি তাকে পেতে দেব না।
তুমি ঠিক কাজই করেছো, গুলবদনকে জড়িয়ে ধরে হামিদা কথাগুলো বলতে সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। আমি আর কাঁদব না এবং আপনিও না। হুমায়ুন, কামরান চিঠিতে কি লিখেছে? আমাদের নিশ্চিত হতে হবে সে আবার নতুন কোনো ধূর্ততার আশ্রয় নেয়নি।
হুমায়ুন চিঠির ভাঁজ খুলে এবং অসহিষ্ণু আঁকাবাঁকা হাতে লেখা যা তাঁদের ছেলেবেলা থেকেই হুমায়ুনের পরিচিত, চিঠিটা জোরে জোরে পড়ে।
আপনি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এই এলাকা ত্যাগ করে পারস্য যাবেন কিন্তু আপনি ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন এবং ভিনদেশী একদল সৈন্য নিয়ে আমাকে হুমকি দেবার জন্য ফিরে এসেছেন। আমার নিজের বাহুবলে গড়া রাজ্য থেকে আমাকেই নিরাপদ সঞ্চারণের প্রস্তাব দেবার ধৃষ্টতা দেখান- আপনি, যে নিজে ব্যর্থ হয়েছে খাইবার গিরিপথের ওপাশে আমাদের আব্বাজানের বিজিত ভূখণ্ড নিজের দখলে রাখতে, আপনি, যে আমাদের আব্বাজানের সৃষ্ট সবকিছু হারিয়েছে। তার সিংহাসনে এখন আমার অধিকার। আপনিই এখানে পরাধিকারপ্রবেশক, আমি নই। ফিরতি পথে পারস্যে এবং নির্বাসনে নিজের যাত্রার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করেন।
হামিদাই প্রথম নিরবতা ভঙ্গ করে। মেয়েদের বিনীত নিবেদনে বা আপনার যৌক্তিক আর ক্ষমাপূর্ণ প্রস্তাবে সে কর্ণপাত করবে না। নিজের ঔদাসীন্য আর নিষ্ঠুরতার মূল্য তাকে রক্ত দিয়ে শোধ করতে বাধ্য করুন।
আমি এবার সেটাই করবো, হুমায়ুন প্রতিজ্ঞা করে এবং তাবুর প্রবেশ পথের দিকে হেঁটে যায়। প্রবেশ পথে ঝুলে থাকা পর্দার একটা তুলে সে পা যুক্ত ঝুড়িতে রাখা জ্বলন্ত কয়লার কাছে ওম পোহাতে থাকা জওহরকে ডাকে। জওহর আমার ভাইয়ের কাছ থেকে আমরা আমাদের জবাব পেয়ে গেছি। যুদ্ধ এড়াবার আর কোনো পথ নেই। আমার পরামর্শদাতাদের ডেকে পাঠাও। আগামী কাল সকালেই আমরা আক্রমণ শুরু করবো।
*
গতকাল দিনে আর রাতের বেলার বেশীর ভাগ সময়ে যে তুষারপাত হয়েছিল এবং হুমায়ুনের পার্সী গোলন্দাজেরা যখন তাঁদের কামানগুলোকে নিজ নিজ অবস্থানে মোতায়েন করার সময়ে তাঁদের জন্য একটা আড়াল তৈরী করেছিল গোলন্দাজের দল তাদের গোলাবর্ষণ শুরু করতেই বরফ গলতে শুরু করে। গোলন্দাজদের থেকে পঞ্চাশ গজ পেছনে আরেকটা পাথুরে শিলাস্তরের আড়ালে হুমায়ুন তার নিয়ন্ত্রক অবস্থান থেকে দলবদ্ধ লোকগুলো তাদের কাজ শুরু করতে সেদিকে তাকিয়ে। থাকে। প্রতিটা কামানের জন্য পাঁচজন- প্রত্যেকের পরণে রয়েছে চামড়ার তৈরী আঁটসাট জামা, পাতলুন এবং মাথায় সূচালো অগ্রভাগযুক্ত শিরোস্ত্রাণ, বারুদ ভর্তি সুতির তৈরী থলেগুলো তোলার সময় একটা ঘোঁতঘোঁত শব্দ হয় এবং তারপরে ব্রোঞ্জের নলের ভেতরে পাথরের গোলাগুলো প্রবিষ্ট করিয়ে সেগুলোকে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে নীচের দিকে ঠেলে দেয়। তারা তারপরে তাঁদের সঙ্গের বেধনিকার ধারাল ধাতব কীলক বারুদের থলে ফুটো করতে সংবেদনশীল-গর্তের ভেতরে প্রবেশ করায় এবং গর্তের মুখের চারপাশে সাবধানে সামান্য পরিমাণে আরেকটু বারুদ ছিটিয়ে দেয়। অবশেষে, দলের সবাই বেশ খানিকটা পেছনে সরে এসে দাঁড়াতে, প্রতিটা দল থেকে একজন নিজ নিজ কামানের দিকে এগিয়ে যায়। তাঁর হাতে একটা লম্বা আকর্ষিযুক্ত দণ্ডের একপ্রান্তে তেলে ভিজানো সরু দড়ি লাগানো যার অগ্রভাগে আগুন জ্বালানো রয়েছে এবং ধিকিধিকি করতে থাকা লালচে-কমলাভ অগ্রভাগ দিয়ে সে সংবেদনশীল গর্তের মুখে অগ্নি সংযোগ করেই দ্রুত লাফিয়ে পেছনে নিরাপদ দূরত্বে সরে আসে।
পুরো প্রক্রিয়াটা যদিও দৈহিকভাবে পরিশ্রমসাধ্য- হুমায়ুন দূর থেকে শীতল বাতাসে তাঁদের দেহের ঘাম বাস্পের মতো মিশে যেতে দেখে লোকগুলোর দক্ষতার কারণে পুরো প্রক্রিয়াটা, বিস্ফোরক মাত্রার বারুদে অগ্নি সংযোগ হতে উজ্জ্বল আলোর ঝলকানির সাথে বারুদ আর গোলার যুগলবন্দি থেকে সৃষ্ট মন্দ্র গর্জনের কারণে, সাবলীল আর দ্রুত দেখায়। হুমায়ুনের চোখের সামনে তারা একের পর এক গোলা বর্ষণ করতে থাকে। প্রথম কয়েকটা গোলা লক্ষ্যবস্তু থেকে খানিকটা পশ্চিমে এবং দূরে গিয়ে আছড়ে পড়ে কিন্তু বৈরাম খানের লোকেরা দ্রুত কামানবাহী শকটের সামনের চাকার নীচে কাঠের গোঁজ খুঁজে- কামানের নলের নতির প্রয়োজনীয় সংশোধন সাধন করে আর বারুদের পরিমাণ হ্রাস বৃদ্ধি করে বিচ্যুতি শুধরে নেয়। অচিরেই অধিকাংশ গোলা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে শুরু করে তোরণদ্বার আর মাটির দেয়ালে আছড়ে পড়তে শুরু করলে, সেখান থেকে অবিরামভাবে লালচে-খয়েরী রঙের ধূলার মেঘ সৃষ্টি হতে শুরু করে।
দূর্গপ্রাসাদের প্রাকার থেকে কামরানের কয়েকজন গাঁদাবন্দুকধারী তবকিকে গোলন্দাজদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে দেখা যায়, কিন্তু কামানগুলোকে রক্ষাকারী পাথরের দেয়ালে আঘাত করা থেকে বিরত থাকতে তাঁদের প্রাকারের উপর অনেকখানি ঝুঁকে এসে গুলি করতে হয় এবং নিজেদের অস্তিত্ব পুরোপুরি প্রকাশ করতে হয়। প্রথমদিকে যদিও তারা হুমায়ুনের বেশ কয়েকজন গোলন্দাজকে আঘাত করতে সক্ষম হয়, তার নিজের তবকিরা ইতিমধ্যে অগ্রবর্তী অবস্থানে পৌঁছে যেতে সেখান থেকে তারা এবার প্রাকারের উপরে কামরানের লোকেরা গুলি করার পায়তারা করলেই পাল্টা গুলি করা আরম্ভ করে। তারা শত্রুপক্ষের দুজনকে গুলিবিদ্ধ করতে সক্ষম হয়, যাঁরা তাঁদের অস্ত্র ফেলে দিয়ে প্রাকারের উপর থেকে উল্টে পড়ে বাতাসে খাবি খেতে খেতে নীচের পাথুরে ভূমিতে এসে আছড়ে পড়ে। বাকি যোদ্ধারা এরপরে আড়ালে থাকাই শ্রেয় মনে করে এবং তারা গুলিবর্ষণ অব্যাহত রাখলেও সেগুলো তড়িঘড়ি করে ছোঁড়া যা লক্ষ্যবস্তুর অনেক দূর দিয়ে চলে যায়।
হুমায়ুন একটা চওড়া ছাতিঅলা সাদা ঘোড়ায় চড়ে জাহিদ বেগকে আস্কন্দিত বেগে উপরের দিকে উঠে আসতে দেখে। সুলতান, শহরের পরিস্থিতি শান্ত বলেই মনে হচ্ছে, গাঁদাবন্দুকের গমগম করতে থাকা আওয়াজ ছাপিয়ে সে চিৎকার করে বলে। সৈন্যরা শহর প্রতিরক্ষা দেয়ালের কাছ থেকে দূর্গপ্রাসাদ লক্ষ্য করে আমাদের গোলাবর্ষণ প্রত্যক্ষ করছে কিন্তু কেউ শহর অবরোধ করে অবস্থানরত আমাদের সৈন্যদের লক্ষ্য করে গুলি করেনি বা শহর থেকে বের হয়ে এসে পেছনদিক থেকে আমাদের আক্রমণ করার কোনো চেষ্টা করেনি। আপনি যেমন ধারণা করেছিলেন আদতে তাই হয়েছে- এহেন প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো সাহস তাঁদের নেই। কিন্তু তারা যেখানে লুকিয়ে রয়েছে সেই শহর প্রতিরক্ষা দেয়াল বিশেষ করে দূর্গপ্রাসাদের প্রতিরক্ষা দেয়ালগুলো খুবই মজবুত। তাদের পরাস্ত করতে আমাদের সময় লাগবে আর নিরবিচ্ছিন্নভাবে আক্রমণ চালিয়ে যেতে হবে।
*
সুলতান, গোলন্দাজেরা দূর্গপ্রাসাদের প্রাকারে একটা ফাটল সৃষ্টি করেছে। হামিদার পাশে শুয়ে থাকা অবস্থায় জয়নব ঝাঁকি দিয়ে হুমায়ুনকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে। বৈরাম খান বাইরে অপেক্ষা করছেন। আপ্রাণ চেষ্টা করে ঘুমের রেশ কাটিয়ে উঠার মাঝেই হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো খুশীর একটা আমেজ হুমায়ুনকে আপুত করে। কাবুলে এবার নিশ্চিতভাবেই তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং আকবরকে উদ্ধার করা সম্ভব হবে। সে দ্রুত এবং অমনোযোগী ভঙ্গিতে নিজেকে পোষাক সজ্জিত করে এবং রাতের কনকনে শীতের ভিতরে টলতে টলতে তাবু থেকে বের হয়ে আসে। বৈরাম খান, প্রতিরক্ষা প্রাচীরের কোথায় ফাটল সৃষ্টি হয়েছে?
প্রধান তোরণদ্বারের ডানপাশে আপনার মতামত অনুযায়ী যেখানে প্রতিরক্ষা প্রাচীর সবচেয়ে দূর্বল হবার কথা।
কত বড় ফাটল?
বেশী বড় না কিন্তু আমার মনে হয়, আমরা যদি এখনই সক্রিয় হই, আমাদের উদ্দেশ্য সাধিত হবে। আমি ইতিমধ্যে আমাদের তবকি এবং তীরন্দাজদের সাথে সাথে গোলন্দাজদেরও ব্যাপকভাবে গোলাবর্ষণ করতে বলেছি যাতে প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত কেউ প্রাচীরের ফাটল মেরামত করার আগ্রহ না দেখায়। আর দেড় ঘন্টার ভিতরেই সকালের আলো ফুটবে এবং আপনি যদি আদেশ দেন তাহলে এই সময়ের ভিতরে আমি একদল সৈন্যকে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত করতে পারবো।
প্রস্তুত করেন।
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করার সময়টায় শীতের সূর্য নীচুতে ভেসে থাকা কালো মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকে আর কনকনে শীতল বাতাস বইতে থাকে আর যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হুমায়ুনকে দূর্গপ্রাসাদ অভিমুখে উঠে যাওয়া ঢালু পথটার পাদদেশে আক্রমণকারী যোদ্ধাদের মাঝে দাঁড়িয়ে উজ্জীবিত ভঙ্গিতে কথা বলতে দেখা যায়।
এখানে যারা উপস্থিত রয়েছে তাঁদের সবার সাহসীকতা আর আনুগত্য সম্বন্ধে অবগত আছি এবং তোমাদের পাশে নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করছি বলে আমি গর্বিত। নিজের রক্তসম্পর্কিত আত্মীয়ের সাথে যুদ্ধ করার চেয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা আর হয় না কিন্তু আমার কুচক্রী সৎ-ভাই কামরান অন্যায়ভাবে আমার সিংহাসন দখল করেই ক্ষান্ত হয়নি, আমার নির্দোষ সন্তানকে চুরি করে রক্তের সম্পর্ক আর সম্মানের প্রচলিত সব রীতি লঙ্ঘন করেছে। সে এসব করে মোগল অহমিকা কলঙ্কিত করেছে। কিন্তু আমরা সবাই একসাথে এই অপমানের প্রতিকার করতে এবং জবরদখলকারীকে শাস্তি দিতে পারি। কোনো কথা নয় আর এবার যুদ্ধ!
বৈরাম খানকে পাশে নিয়ে হুমায়ুন তার লোকদের একেবারে সামনের সারিতে অবস্থান করে আক্রমণের উদ্দেশ্যে ঘোড়া হাকায়। দূর্গপ্রাসাদের তোরণদ্বার লক্ষ্য করে ছোঁড়া কামানের গোলার সাদা ধোয়ার মাঝে বরফ জমে থাকা ঢালু পথের উপর দিয়ে ঘোড়া দুটো তাদের সাধ্যমতো দ্রুতগতিতে অগ্রসর হতে থাকে, দুটো প্রাণীর পাজর হাপরের মতো উঠানামা করতে থাকে, মাঝে মাঝে যদিও তারা বরফের উপরে পা হড়কায়। তার নিজের সৈন্যদের গাদাবন্দুক আর কামানের শব্দে তার কানে প্রায় তালা লেগে যায় কিন্তু বোয়ার ভিতরে একটা ফাঁকা স্থান দিয়ে সে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে, তোরণদ্বারের ডানপাশের দেয়ালে আসলেই একটা আঁকাবাঁকা ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। তার আত্মা প্রফুল্ল হয়ে উঠে। পর মুহূর্তেই সে বিস্মিত হয়ে অনুধাবন করে যে দূর্গপ্রাকারের প্রাচীরের কাছ থেকে পাল্টা গুলি খুব সামান্যই ছোঁড়া হচ্ছে।
সে বিমূঢ় ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকার মাঝেই সহসা কুণ্ডলীকৃত ধোয়ার মাঝের আরেকটা ফাঁকাস্থান দিয়ে তোরণদ্বারের ঠিক উপরের প্রাকারে একটা কর্মচাঞ্চল্য লক্ষ্য করে। কামরান কি আত্মসমর্পনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিষয়টা তার বিশ্বাস করতে কষ্টই হয়। সে তার গোলন্দাজ আর তকিদের চিৎকার করে গুলিবর্ষণ বন্ধ করতে বলে, তারপরে বিষয়টা ভালো করে পর্যবেক্ষন করতে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। বারুদের তীব্র, ঝাঁঝালো গন্ধযুক্ত ধোঁয়া ধীরে ধীরে সরে যেতে শুরু করতে সে দেখে যে দূর্গ প্রকারের উপরে কামরানের সৈন্যরা কাঠের তৈরী সূচালো দণ্ডের মতো কিছু একটা স্থাপণ করছে। তারপরে দীর্ঘকায় একটা অবয়বকে নিজেদের সামনে ঠেলতে ঠেলতে, সেখানে আরও সৈন্য এসে উপস্থিত হয়ে, সকালের ধুসর আকাশের প্রেক্ষাপটে যার মাথার লম্বা খোলা চুল আবছাভাবে দেখা যায়। হুমায়ুন সামনের দিকে দৌড়াতে আরম্ভ করে যতক্ষণ না সে দেখতে পায় যে অবয়বটা একজন মহিলার এবং তার হাতে কিছু একটা ধরা রয়েছে। এমন একটা কিছু যা ছটফট করছে আর মোড় খাচ্ছে- একটা শিশু।
হুমায়ুনের দেহের রক্ত যেন নিমেষে জমাট বরফে পরিণত হয়। সৈন্যরা যখন মেয়েটাকে কাঠের খুঁটির সাথে বাধছে তখন সে স্বপ্নবিষ্ট মানুষের মতো তাকিয়ে থাকে, তারা মেয়েটার সারা শরীর দড়ি বা শেকলের মতো দেখতে কিছু একটা দিয়ে পেঁচিয়ে বাধে কেবল তার হাতের প্রাণবন্ত বোঝাটা ধরে রাখার জন্য হাত দুটো খোলা রাখে। ঐ ক্ষুদে পুটলিটা, হুমায়ুনের মনে সন্দেহের সামান্যতম কোনো অবকাশ থাকে না, তার সন্তান তারই দুধ-মা মাহাম আগা তাকে দুহাতে জড়িয়ে রয়েছে।
একটা অসহায় কান্না তার গলা চিরে বের হয়ে আসে। না! জাহিদ বেগ আর বৈরাম খান ইতিমধ্যে তার পাশে এসে উপস্থিত হয়েছে, রক্ত মাংসের জীবন্ত লক্ষ্যবস্তু হিসাবে প্রাচীরের উপরে প্রদর্শিত মহিলা আর শিশুটির অপার্থিব দৃশ্যপটের দিকে হুমায়ুনের মতো তারা নির্বাক ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে। অবশেষে ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা থেকে বহুকষ্টে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে হুমায়ুন দুহাতে নিজের মুখ চেপে ধরে। নিজের সৎ-ভাইয়ের কুটিলতাকে সে আরো একবার ছোট করে দেখেছে। কামরানের এই প্রত্যুত্তরের অর্থ প্রাঞ্জল আর দ্ব্যর্থহীন- আক্রমণ অব্যাহত রাখলে নিজের সন্তানের ঘাতক তুমি নিজেই হবে।
বৈরাম খান, অবিলম্বে গোলাবর্ষণ বন্ধ করতে বলেন। আমি আমার ছেলের জীবন নিয়ে কোনো ঝুঁকি নিতে চাই না…জাহিদ বেগ, দূর্গপ্রাসাদ আর শহরের চারপাশে অবরোধ বজায় রাখতে পর্যাপ্ত সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন করেন কিন্তু আক্রমণকারী বাহিনীকে এই মুহূতে শিবিরে ফিরে যেতে বলেন।
তূর্যধ্বনি আর দামামার শব্দে তার সৈন্যরা তুষারাবৃত সমভূমির উপর দিয়ে নিজেদের তাবুর দিকে ফিরে যেতে আরম্ভ করতে, হুমায়ুন ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নেয় এবং কারো সাথে আর কোনো কথা না বলে নিজের দেহরক্ষী কিংবা সেনাপতি কারো সাথে কোনো কথা না বলে- সে মন্থর গতিতে তাবুর দিকে ফিরে যেতে থাকে। সূর্য এখন যদিও মেঘের আড়াল থেকে বের হয়ে এসেছে, সরু ধুসর আলোরশ্মি আকাশ আলোকিত করতে শুরু করেছে, তার নিজের পৃথিবী এমন অন্ধকারের ভিতরে হারিয়ে গিয়েছে বলে তার আগে কখনও মনে হয়নি। সে সফলভাবে কিভাবে এই অভিযানের পরিসমাপ্তি টানবে। সে ফিরে গিয়ে হামিদাকে কি বলবে?