২৪. উষ্ণ রুটি
সুলতান, ইসলাম শাহ মৃত। হিন্দুস্তানের সিংহাসন শূন্য।
অঙ্গসংবাহক যখন তার পিঠের উপরের অংশে সুগন্ধি নারিকেলের তেল ঘষে দলাইমলাই করে, হুমায়ুন- ছয় সপ্তাহ পূর্বে- যখন উত্তেজিত আহমেদ খানের কাছ থেকে সে শব্দগুলো শুনেছিল, তখনকার কথা স্মরণ করে হাসে। পরবর্তী দিনগুলোতে, হিন্দুস্তান থেকে খাইবার গিরিপথ অতিক্রম করে আগত ভ্রমণকারীদের বয়ে আনা গুজব আরো জোরাল হতে থাকে। তাদের কেউ বলে যে ইসলাম খান কয়েক মাস পূর্বে আকষ্মিকভাবে মারা গিয়েছে এবং তার সমর্থকেরা যখন একজন উত্তরাধিকারীর ব্যাপারে মতৈক্যে পৌঁছাতে চেষ্টা করছে তখন কিছু সময়ের জন্য হলেও সাফল্যের সাথে বিষয়টা তারা গোপন করতে পেরেছে। প্রতিটা দিন এবং প্রতিটা সংবাদ সম্পর্কে অতিবাহিত হবার সাথে সাথে, হুমায়ুনের ভিতরে নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি হতে থাকে। সে অনুভব করে তার সিংহাসন পুনরুদ্ধারের বিশাল একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে। সে যদি কাবুল ত্যাগ করে তাহলে তার সৎ-ভাইদের কাছ থেকে কাবুলের জন্য কোনোরকম হুমকির উৎকণ্ঠা থেকে মুক্ত হয়ে, সে এই সুযোগটা গ্রহণ করতে পারে এবং তাঁর হতাশা আর নির্বাসনের লম্বা বছরগুলোর একটা সমাপ্তি ঘটাতে পারে।
সে অতিসত্ত্বর অভিযানের জন্য নিজের বাহিনী প্রস্তুত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে শুরু করে। এই মুহূর্তে, দূর্গপ্রাসাদের প্রাচীরের বাইরে, তাঁর আধিকারিকেরা তার তবকিদের গুলিবর্ষণের গতি বৃদ্ধি করতে এবং শৃঙ্খলার সাথে অস্ত্রে বারুদ, আর গুলি ভর্তি করতে এবং নিশানা লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা রপ্ত করাতে কসরত করছে। তার রাজ্যের প্রত্যন্ত উপত্যকায় আর রাজ্যের বাইরে তার লোকেরা অতিরিক্ত সৈন্য সগ্রহের উদ্দেশ্যে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছে। অঙ্গসংবাহক এখন হুমায়ুনের উরু আর নিতম্বে উপযুপরি মুষ্ঠাঘাত করছে যা তাঁর শারীরিক আর মানসিক প্রস্তুতির অংশ। নিজের অভিযান পরিকল্পনায় দিক নির্দেশনা লাভ করতে সে তাঁর আব্বাজানের হিন্দুস্তান আক্রমণের স্মৃতিকথা আবার পড়তে শুরু করেছে এবং তাঁর নিজের অভিযানের স্মৃতির সাথে সেগুলো তুলনা করছে।
শেরশাহের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযানে সে কোথায় ভুল করেছিল এবং অন্যত্র যেমন গুজরাতে সে কেন সাফল্য লাভ করেছিল সেটার বোঝার জন্য সে তার সেনাপতিদের সাথে, বিশেষ করে আহমেদ খানের সাথে দীর্ঘসময় আলোচনা করেছে। নিজের কক্ষে একাকী বসে থাকার সময় একদিন সন্ধ্যা নামার বেশ কিছুক্ষণ পরে সে নিজের জন্য পুরো ব্যাপারটার একটা সংক্ষিপ্তসার প্রস্তুত করে। ভালোমতো প্রস্তুতি গ্রহণ কর, দ্রুত আর নিশ্চায়করূপে চিন্তা আর কাজ কর। তোমার মোকাবেলা করতে তোমার প্রতিপক্ষকে বাধ্য কর এবং কখনও যেন এর বিপরীত অবস্থার সৃষ্টি না হয়।
বিগত বছরগুলোতে সে আবারও নিজেকে গজনীর সুরা উপভোগ করার অনুমতি দিয়েছে এবং কাবুল দখল করার পর থেকে সে মাঝে মাঝে কেবল আফিমের উদ্বেগ-হরণকারী স্বস্তির পরিচর্যা গ্রহণ করে। যুদ্ধের কঠোরতার জন্য নিজের দেহকে শক্ত আর মনকে শাণিত করতে এখন নিজের ভিতরে একটা ব্যাপক টানাপোড়েনের পড়ে আর ইচ্ছাশক্তির বিপুল প্রয়োগ ঘটিয়ে সে আফিম আর সুরা দুটো গ্রহণ করা থেকে নিজেকে বিরত করেছে। সে আবারও মল্লযুদ্ধ শুরু করেছে এবং অঙ্গসংবাহক তাঁকে তাঁর প্রতিদিনের কসরতের জন্য প্রস্তুত করছে। দ্রুত একটা ইশারা করে লোকটাকে তার কাজ বন্ধ করতে বলে, হুমায়ুন গড়িয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে তারপরে উঠে দাঁড়ায়। সে সুতির লম্বা একটা পাজামা কোমড়ে গলিয়ে নেয়, লড়াইয়ের সময় তাঁর পরণে কেবল এটাই থাকে, এবং মসৃণ হলুদ মসলিনের পর্দার ভিতর দিয়ে পাশের কামরার দিকে এগিয়ে যায়। সেখানে লম্বা, পেষল দেহের অধিকারী এক বাদখশানি, তাঁর প্রতিপক্ষ, একইরকম পোষাক পরিহিত অবস্থায় এবং তেল মালিশ করে তার জন্য অপেক্ষা করছে।
বায়েজিদ খান, একদম ইতস্তত করবে না। হুমায়ুন মৃদু হাসে। তুমি আমাকে দারুণ শিখিয়েছে। আমাকে যদি দশ মিনিটের ভিতরে পরাস্ত করতে পার তাহলে তোমার জন্য মোহর ভর্তি একটা থলি অপেক্ষা করছে। এখন চলো বিষয়টা নিষ্পত্তি করা যাক।
দুইজন লোক বৃত্তাকারে পরস্পরের চারপাশে ঘুরতে থাকে, কে প্রথম আক্রমণ করে সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করে। হুমায়ুনই প্রথম দ্রুত সামনে এগিয়ে এসে বায়েজিদ খানের বাহু আকড়ে ধরে তাকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলতে চেষ্টা করে। বায়েজিদ খান অবশ্য একটা মোচড় দিয়ে হুমায়ুনের পাঞ্জা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় এবং হুমায়ুনের কাঁধ আকড়ে ধরে ধাক্কা দিয়ে তাঁকে ভারসাম্যহীন করতে চেষ্টা করে। হুমায়ুন ধাক্কাটা সামলে নেয় এবং দুজনে একে অপরের কাঁধ আকড়ে ধরে, ধ্বস্তাধ্বস্তি করে, নিজেদের শক্তি পরখ করে। তারপরে বায়েজিদ খান হুমায়ুনের হাঁটুর পেছনে চকিতে একটা লাথি মারলে হুমায়ুন হোঁচট খায়। হুমায়ুন মাটিতে পড়ে যায় এবং বায়েজিদ খান মাটির উপরে পাতা গালিচায় তার বাহু চেপে ধরে প্রতিযোগিতার সমাপ্তি ঘটাতে হুমায়ুনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
কিন্তু হুমায়ুন দারুণ ক্ষিপ্র আর সে গড়িয়ে নীচ থেকে সরে যায়। বায়েজিদ খান গালিচার উপরে আছড়ে পড়তে হুমায়ুন তাঁর পিঠের উপর লাফিয়ে পড়ে এবং নিজের হাঁটু তার পিঠে চেপে ধরে বায়েজিদের দুই হাত পেছন দিকে টেনে ধরে। বায়েজিদ খান যতই ধ্বস্তাধ্বস্তি করুক, সে নিজেকে হুমায়ুনের হাত থেকে মুক্ত করতে পারে না। সুলতান, অনেক হয়েছে। আপনি দ্বিতীয়বারের মতো আমাকে পরাস্ত করেছেন।
আমার মনে হয়, প্রথমবারের মতো। আমার তীব্র সন্দেহ আছে যে আগেরবার তুমি আমাকে জিতিয়ে দিয়েছিলে কিন্তু এবার আমিই জিতেছি।
সুলতানের সন্দেহ হয়ত অমূলক না।
ফাঠেহুমায়ুন তাঁর মালিশ কক্ষে ফিরে আসে এবং মল্লযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাঁর পরিচারকেরা উষ্ণ, কর্পূর-সুবাসিত পানি দিয়ে তামার যে আয়তাকার বিশাল স্নানের পাত্র ভরে রেখেছে সেটায় নিজের ঘাম আর তেলে চকচক করতে থাকা দেহ ধুয়ে নিজেকে পরিষ্কার করে। সে সুতির একটা মোটা তোয়ালে দিয়ে নিজেকে শুষ্ক করে চন্দন-সুবাসিত চক পাউডার দেহে ছিটিয়ে দেয়ার ফাঁকে, সে সামনের বার্নিশ করা আয়নায় নিজের নগ্ন দেহের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তাঁর পেশীসমূহ একমাস আগের তুলনায় এখন অনেক বেশী স্পষ্ট আর সুগঠিত। সে ভাবে তাকে দেখে মনেই হয় না সে ছেচল্লিশ বছরের একজন বৃদ্ধ, এবং তার মুখে সন্তুষ্টির হাসি ফুটে উঠে। শারীরিক কসরতটা বোধহয় তাঁকে সাহায্য করছে তার মনকে কেন্দ্রীভূত করতে এবং পরিষ্কার করে চিন্তা করতে। একারণেই সে আরও ঘনঘন রতিক্রিয়ায় মিলিত হতে পারছে।
হুমায়ুন তাঁর পরিচারকদের সহায়তায় দ্রুত পোষাক পরিধান করে তাঁর পরামর্শদাতাদের সাথে বৈঠকে মিলিত হবার জন্য প্রস্তুত হয়। কয়েক মিনিট পরে, সোনার বকলেশ দেয়া গাঢ় নীল রঙের টিউনিক আর সম্মুখভাগে ময়ূরের লম্বা পালক শোভিত দুধ সাদা রঙের পাগড়ি পরিধান করে সে মন্ত্রণা কক্ষে প্রবেশ করে।
আহমেদ খান, হিন্দুস্তানের সর্বশেষ খবরাখবর কি? আজ সকালে কি আরেকটা কাফেলা আসেনি?
জ্বী, সুলতান। কাফেলাটা আমাদের জন্য যা সুসংবাদ সেটাই এসে নিশ্চিত করেছে। ইসমাইল শাহের মৃত্যু নিয়ে সন্দেহের আর কোনো অবকাশ নেই। তারচেয়েও বড় কথা, আজকের কাফেলার সাথে আগত ধনাঢ্য এক ব্যবসায়ী বলেছে যে দিল্লীর আশেপাশে সিংহাসনের তিন দাবীদারের ভিতরে লড়াই শুরু হয়েছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অভাবে ডাকাতেরা অবাধে ডাকাতি করছে, রাতের বেলা ধনবান ব্যক্তিদের বাড়িতে হামলা করে খুন, ধর্ষণ আর ডাকাতি করছে। আমাদের এই বণিক তাঁর সম্পদের কিছুটা লুকিয়ে রেখে, বাকি সম্পদ আর পরিবার সাথে নিয়ে কষ্টসাধ্য পথ পাড়ি দিয়ে উত্তরে আপনার রাজ্যে নিরাপত্তার আশায় এসেছে, যতক্ষণ না হিন্দুস্তানে কি ঘটছে তিনি বুঝতে পারেন। কাফেলার অন্য সদস্যরা তার কথার সপক্ষে গোলযোগের নানা প্রাসঙ্গিক বর্ণনা দিয়েছে। একজন বলেছে যে ডাকাতেরা গেঁটেবাতে আক্রান্ত এক ধনী বৃদ্ধার আঙ্গুল থেকে মূল্যবান আংটি খুলতে না পেরে, তার আঙ্গুলটাই কেটে ফেলেছে এবং রক্তক্ষরণের ফলে মারা যাবার জন্য তাঁকে ফেলে রেখে গিয়েছে।
সিংহাসন পুনরুদ্ধারের জন্য আমরা যে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম, লড়াই আর অরাজকতার ফলে আমরা সেই কাঙ্খিত সুযোগ লাভ করবো এবং আমাদের ন্যায়সঙ্গত রাজ্যের অধিবাসীদের ন্যায়বিচার আর আইনের শাসন ফিরিয়ে দিতে পিরবো। এই তিন দাবীদার সম্বন্ধে আমরা কি জানি?
একজন আদিল শাহু, ইসমাইল শাহের প্রিয়তমা স্ত্রীর ভাই- তার পাঁচ বছর বয়সী একমাত্র সন্তানের জননী। আদিল শাহ্ ক্ষমতার লোভে এতোটাই উন্মত্ত হয়ে উঠেছে যে সে রক্তের সম্পর্কের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে হারেমে প্রবেশ করে এবং মাংসের জন্য কসাই যেভাবে পশু জবাই করে সেভাবে সে নিজের বোনের সামনে তাঁর সন্তানের গলা কেটে তাঁকে হত্যা করে। সে তারপরে নিজেকে সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করে।
হুমায়ুন বিরক্তিতে মুখ কুচকায়। কামরানের পক্ষেও এতটা নীচে নামা অসম্ভব ছিল। আর বাকি দুজন?
ইসমাইল শাহের আত্মীয় সম্পর্কিত এক ভাই এদের ভিতরে সবচেয়ে শক্তিশালী, যে সিকান্দার শাহ্ হিসাবে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেছে। সে আদিল শাহকে ইতিমধ্যে যুদ্ধে একবার পরাজিত করেছে কিন্তু নিজের বিজয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে ব্যর্থ হয়েছে তৃতীয় দাবীদার, তার্তার খান, আমরা যাদের পরাস্ত করেছিলাম সেই পুরাতন লোদী বংশের বর্তমান প্রধান এবং গুজরাতের সুলতানের সাথে মিলিত হয়ে যে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল, তার কর্মকাণ্ডের কারণে।
এদের প্রত্যেকের সম্বন্ধে আমাদের পক্ষে যতটা সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করতে হবে- কারা তাঁদের শত্রু আর মিত্র, তাঁদের ব্যক্তিগত শক্তি আর দূর্বলতা, তাঁদের সৈন্যসংখ্যা, কত টাকা আছে, সবকিছু আমাদের জানতে হবে।
আমরা সম্প্রতি আগত পর্যটকদের আরও জিজ্ঞাসাবাদ করবো। এবং সেই সাথে অবশ্যই আরো বেশী সংখ্যায় গুপ্তদূত আর গুপ্তচর প্রেরণ করবো।
আমাদের অভিযান পরিকল্পনা বিস্তারিত আলোচনার উদ্দেশ্যে আমরা আগামীকাল আবার আলোচনা শুরু করবো। হুমায়ুন মন্ত্রণাকক্ষ ত্যাগ করার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়। সে ঘুরে দাঁড়াবার মাঝেই অবশ্য আহমেদ খান তাঁর কাছে এগিয়ে গিয়ে একটা ছোট চারকোণাকৃতি কাগজ হুমায়ুনের হাতে গুঁজে দেয়।
ভ্রমণকারীদের একজন এই সীলমোহর করা বার্তাটা নিয়ে এসেছে, সে আমাদের প্রহরীদের কাছে বলেছে কেবল আপনার দেখার জন্য এই বার্তাটা। সে বলেছে তার পরিবারের একজন সদস্য- একজন নাবিক যে সম্প্রতি আরব থেকে ফিরে এসেছে এবং সে কাবুল যাচ্ছে শুনে তাঁকে অনুরোধ করেছে চিঠিটা আপনাকে পৌঁছে দিতে। সুলতান, বিষয়টা হয়ত কিছুই না কিন্তু আমার মনে হয়েছে। আপনার এটা খোলা উচিত।
আহমেদ খান, আপনাকে ধন্যবাদ। আমি কক্ষে ফিরে গিয়েই বার্তাটা পাঠ করবো।
সোয়া ঘন্টা পরে, হুমায়ুন জেনানাদের আবাসন এলাকায় প্রবেশ করে এবং সরাসরি হামিদার কক্ষের দিকে এগিয়ে যায়। হামিদা মুখ তুলে তাকিয়ে বলে, আমি শুনলাম হিন্দুস্তান থেকে ভালো খবর এসেছে…।
হুমায়ুন স্মিত হাসে, কিন্তু তার হাসি আর চোখের দৃষ্টিতে বিষণ্ণতার মেঘ ভীড় করে থাকে। হিন্দুস্তানের সংবাদ আসলেই ভালো কিন্তু আমি আজ আরেকটা মনখারাপ করা সংবাদ পেয়েছি। খবরটা আসকারি সংক্রান্ত। তুমি নিশ্চয়ই জানো, আঠার মাস আগে পবিত্র ভূমি মক্কায় যাবার জন্য কাম্বে থেকে জাহাজে আরোহন করার পরে, আমি তার আর কোনো সংবাদ না পেয়ে অনেকদিন থেকে থেকেই। আশঙ্কা করছিলাম যে সে হয়তো কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। আমি আজ তার ভাগ্যের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছি…
আহমেদ খান তাঁকে যে কাগজটা দিয়েছিল হুমায়ুন সেটা তাঁর আলখাল্লার পকেট থেকে বের করে আনে। কাগজটায় অসংখ্য ভাঁজ আর সেটা কুঁচকে গিয়েছে। বার্তাটার প্রেরক মোহাম্মদ আজহারুদ্দিন- আমার ভাইয়ের দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধান হিসাবে আমি যাকে পাঠিয়েছিলাম। বার্তাটায় সংক্ষেপে বলা হয়েছে কিভাবে কাম্বে থেকে যাত্রা শুরু করার পরে অনুকূল বাতাসের বরাভয়ে তারা কেমন দ্রুতগতিতে মক্কার উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলেছিল, তারা আরব উপকূলে অবস্থিত সালালা বন্দর থেকে যখন মাত্র বিশ মাইল দূরে অবস্থান করছে, এমন সময় জলদস্যুদের তিনটি দ্রুতগতিসম্পন্ন জাহাজের একটা বহর তাঁদের ধাওয়া করে ধরে ফেলে। জলদস্যুরা জাহাজে উঠতে চেষ্টা করলে আসকারি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয় কিন্তু প্রতিপক্ষের সংখ্যার কাছে সে পরাজিত হয় এবং তরবারি হাতে মৃত্যুবরণ করে। তাঁর সাথে আরো অনেকেই মৃত্যুবরণ করে। মোহাম্মদ আজহারুদ্দিন মারাত্মকভাবে আহত হন এবং অবশিষ্ট দেহরক্ষী আর তাদের সাথে থাকা টাকাপয়সাসহ বন্দি হন। তিনি সুস্থ হলে মাস্কাটের বিশাল ক্রীতদাসের বাজারে শহরের বাইরে অবস্থিত খনিতে কাজ করার জন্য তাঁকে বিক্রি করে দেয়া হয়। ছয়মাস পূর্বে তিনি বন্দিদশা থেকে পলায়ন করেন এবং দেশে ফিরে আসবার পূর্বে তিনি প্রথমেই এই বার্তাটা আমার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন।
আল্লাহতালা নিশ্চয়ই আসকারিকে তার কৃতকর্মের জন্য মার্জনা করে এবং তার আত্মাকে বেহেশত নসীব করবেন, হামিদা বলে। সে কিছুক্ষণ পরে আবার বলে, সে যাই হোক, তাঁর মৃত্যুসংবাদ নিশ্চিতভাবে পাবার পরে আপনি একটা দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেলেন যে নির্বাসিত অবস্থায় আপনার বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র করার জন্য সে আত্মগোপন করেনি।
কথা সত্যি, কিন্তু সে কখনও কামরানের মতো জাত প্রতিপক্ষ ছিল না এবং আমার প্রায়ই মনে হয় নিজের ভাই আর মায়ের প্রতি আনুগত্য থেকেই সে আমার বিরুদ্ধাচারণ করেছে। হজ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়ার পূর্বে সে বলেছিল বিদ্রোহের সব ভাবনা সে ত্যাগ করেছে। আমি তখন তার কথা বিশ্বাস করেছিলাম। তাঁর মৃত্যু আমাকে আরও সচেতন করে তুলেছে যে আমার আব্বাজান তার পরিবারের জন্য যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সেটা পূরণ করার জন্য এখন কেবল আমি একাই বেঁচে রয়েছি।
আপনি অনেকদিন ধরেই তাঁর স্মৃতির প্রতি বিশ্বস্ত তার একমাত্র সন্তান।
কিন্তু আমি তার গড়ে তোলা সাম্রাজ্যের বিশাল অংশ হারিয়েছি এবং সেটা পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়েছি, তাঁর রাজত্ব বৃদ্ধি করার কথা না হয় বাদই দিলাম। আমি তোমার এবং আমার নিজের, আর সেই সাথে আমার আব্বাজানের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছি। আমার নিয়ত পবিত্র ছিল কিন্তু আমি একাগ্রচিত্তে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে যথেষ্ট প্রয়াস নেইনি।
পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে। হজ্জের উদ্দেশ্যে আসকারি আর কামরান রওয়ানা হবার পর থেকে আমি আপনার ভিতরে সত্যিকারের দৃঢ়সংকল্প লক্ষ্য করছি। আপনি এখন আর নিছক আমোদ কিংবা অলস কল্পনায় নিজের মনকে বিভ্রান্ত হতে দেন না। আপনি সবসময় চেয়েছেন যা আপনার নিজের সেটা উদ্ধার করতে, কিন্তু সময় আর একাগ্রতা নিয়ে আপনি এখন সেটা অর্জনের জন্য চেষ্টা করছেন।
আমিও সেটাই আশা করি। আমি কিভাবে আমার সিংহাসন হারিয়েছি, আকবরকে যখন আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছিল তখন আমাদের সবচেয়ে হতাশ সময়ে তোমার মুখ, বরফে জমে আর অর্ধভুক্ত অবস্থায় শাহের শরণার্থী হিসাবে আমরা পারস্য গমন করেছিলাম, এইসব তিক্ত স্মৃতিগুলো অঙ্কুশের মতো ব্যবহার করে আমি হিন্দুস্তান পুনরুদ্ধারে আমার সমস্ত শক্তি নিবদ্ধ করেছি।
আপনি সাফল্য লাভ করছেন। আমি জানি আপনি কেবল এক কদম অগ্রসর হবার কথাই চিন্তা করেন না, বরং পুরো যাত্রাপথের পরিকল্পনা আপনার মাথায় রয়েছে।
আমি প্রার্থনা করি এটা যেন আমাকে আমার সিংহাসনের কাছে পৌঁছে দেয়।
আমাদের সন্তানের খাতিরে যেন তাই হয় সেটা নিশ্চিত করবেন।
হামিদার চোখে মুখে এমন দৃঢ় সংকল্পের অভিব্যক্তি হুমায়ুন আগে কখনও লক্ষ্য করেনি। সে তাকে আর হতাশ করবে না।
*
১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাস, হুমায়ুনের সদ্য নিযুক্ত সেনাবাহিনী তার সামনে দিয়ে কুচকাওয়াজ করে অতিক্রম করার সময়ে, শরতের শীতের হাত থেকে বাঁচতে ফারের আস্তরণযুক্ত একটা আলখাল্লায় নিজেকে শক্ত করে জড়িয়ে, সে কাবুলের দূর্গপ্রাসাদের ছাদে আকবরকে পাশে নিয়ে পিঠ সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকে।
আমাদের প্রতিনিধিরা দারুণ কাজ করেছে। আমাদের নিজস্ব ভূখণ্ডের সব এলাকা থেকে তাঁরা লোক সংগ্রহ করে এনেছে। ধুসর-ত্বকের অধিকারী ঐ লোকগুলো গজনী থেকে এসেছে। কালো পাগড়ি আর মুখের উপরে কাপড় দেয়া লোকগুলো কান্দাহারের উত্তরের পাহাড়ী এলাকা থেকে এসেছে। বাদখশান আর তাজিখ এলাকায় আমাদের অনুগত জায়গীরদারেরা সৈন্য পাঠিয়েছে। তাঁদের সবসময়ে সাহসী আর শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং সেইসাথে সুসজ্জিতও বটে। লক্ষ্য করে দেখো তাঁদের ঘোড়াগুলো কেমন তাগড়া।
কিন্তু আব্বাজান ওখানে ঐ হলুদ নিশানের নিচে কারা দাঁড়িয়ে রয়েছে?
তারা ফারগানা- তোমার দাদাজানের জন্মস্থান থেকে এসেছে। ইসলাম শাহের মৃত্যুর গুজব শুনেই অনাহূতের ন্যায় তারা কাবুলের পথে রওয়ানা হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা আমার অধীনে নিয়োজিত করার অভিপ্রায়ে, জানে যে আমি নিশ্চিতভাবেই হিন্দুস্তান আক্রমণ করবো… হুমায়ুন বাক্যের এই পর্যায়ে কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে থাকে, আবেগে তাঁর কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এসেছে, এবং তারপরে আবেগ সামলে নিয়ে সে আবার শুরু করে, তোমার দাদাজানের ন্যায় আমিও তাদের নেতৃত্ব দিয়ে বিজয়ের পথে ধাবিত করবো। কিন্তু অশ্বারোহী তিরন্দাজদের ঐ দলটাকে লক্ষ্য করেছো? তারা বোখারা আর সমরকন্দের আশেপাশের এলাকা থেকে এসেছে এবং আমাদের মহান পূর্বপুরুষ তৈমূরের নিশানের অনুকরণে তাঁরা নিজেদের সজ্জিত করেছে- তাকিয়ে দেখো কমলা রঙের বাঘ সম্বলিত নিশানটা কেমন পতপত করে উড়ছে…
আমাদের সৈন্য সংখ্যা কত?
বারো হাজার।
আমার দাদাজান যখন হিন্দুস্তান অভিযানে রওয়ানা হয়েছিলেন তখন তার সাথে অনেকবেশী সৈন্য ছিল।
সত্যি কথা, কিন্তু আমাদের সাথে তখনকার তুলনায় অনেক বেশী কামান, আর বন্দুক রয়েছে এবং প্রতিদিনই আমাদের সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের কাছে সংবাদ আছে যে ইসলাম শাহের অনেক জায়গীরদার হিন্দুস্তানে তাঁদের সীমান্তের নিকটবর্তী হওয়া মাত্র আমাদের সাথে যোগ দেবে।
কিভাবে আপনি এতো নিশ্চিত এই ব্যাপারে?
হুমায়ুনের ঠোঁটের কোণে একটা বাঁকা হাসি ফুটে উঠে। বহু বছর পূর্বে তাঁদের পিতার ঠিক যেমন আমাকে পরিত্যাগ করেছিল, তাঁদের বিশ্বাস তারা জানে কে শেষপর্যন্ত বিজয়ী হবে?
তার মানে আমাদের সাফল্যের ব্যাপারে তাদের বিশ্বাসই আমাদের বিজয়ী করবে?
হ্যাঁ- তোমার চারপাশের লোকেরা তোমার সাফল্যের ব্যাপারে আস্থাশীল হলে বিজয়ের পথে তুমি অনেকদূর এগিয়ে যাবে। এই আস্থা একবার নষ্ট হয়ে গেলে সেটা পুনরুদ্ধার করা ভীষণ কঠিন। এই একটা শিক্ষা আমি বহু মূল্যে শিখেছি। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে এইবার যেন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়। আমাদের অর্জিত প্রতিটা বিজয়ে আস্থার জোয়ার ফুলে ফেঁপে উঠে আমাদের প্রতিপক্ষের অবশিষ্ট শক্তিটুকুও ধুয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন করে দেবে।
আব্বাজান, আমি বুঝতে পেরেছি।
হুমায়ুন তাঁর সন্তানের দিকে তাকিয়ে অনুধাবন করে যে আকবর হয়তো আসলেও বুঝতে পেরেছে। গত এক বছরে তার ভিতরে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তার দৈহিক গড়ন আর আকৃতির কারণেই কেবল না, তাঁর বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আর অন্যদের বিচার করার ব্যাপারে তাঁর ক্রমশ বাড়তে থাকা বিচক্ষণতাবোধের কারণে বয়সের তুলনায় তাকে অনেক পরিণত মনে হয়। হুমায়ুন গত রাতে হামিদার সাথে তাঁর আলোচনার কথা স্মরণ করে যখন, সে তাঁকে জানায় যে কয়েকদিনের ভিতরে সে যখন হিন্দুস্তান অভিযানে রওয়ানা দিবে তখন তার ইচ্ছা সে আকবরকে সাথে করে নিয়ে যাবে। সে হামিদাকে মনে করিয়ে দেয় যে বাবর আকবরের বয়সীই ছিল যখন সে রাজা হয়েছিল। সে তাকে বলে যে আকবরকে তার সাথে নিয়ে গেলে রাজবংশের ভবিষ্যতের ব্যাপারে আস্থা জোরদার হবে। যুদ্ধক্ষেত্রে ইসলাম শাহের মতো তাঁর পতন ঘটলে সবাই দেখবে যে তার একজন যোগ্য উত্তরাধিকারী রয়েছে।
হুমায়ুন আশা করেছিল, যুদ্ধক্ষেত্রে আকবরকে যেসব বিপদের সম্মুখীন হতে হবে সেসবের কথা চিন্তা করে, হামিদা প্রতিবাদ করবে কিন্তু যদিও তার চোখ প্রথমে ঠিকই অশ্রুসজল হয়ে উঠে কিন্তু সে প্রাণপন চেষ্টায় নিজেকে সামলে নেয়। আমি জানি সে আপনার সাথে গেলে সেটাই হবে সঠিক সিদ্ধান্ত। একজন মায়ের পক্ষে নিজের ছেলেকে যুদ্ধযাত্রা করতে দেখাটা ভীষণ কঠিন একটা ব্যাপার কিন্তু সে অচিরেই প্রাপ্তবয়স্ক যুবকে পরিণত হবে। আমার উচিত নিজেকে স্মরণ করিয়ে দেয়া যে আমার বয়স মাত্র দুই বেশী ছিল যখন আমি আমার পরিবার পরিজন ত্যাগ করেছিলাম- আপনার জীবন আর এর সাথে সংশ্লিষ্ট নানা বিপদ বরণ করে নিতে বিষয়টা নিয়ে আমি কখনও অনুতপ্ত হইনি।
হামিদার কথা বলার মাঝে, হুমায়ুন অনুধাবন করে কেন আরো অনেক মেয়েকে চেনার পরেও হামিদাই কেন তাঁর জীবনের সত্যিকারের ভালোবাসা। হুমায়ুন তাঁকে অধীর আবেগে আলিঙ্গন করে এবং তাঁর একত্রে দীর্ঘ সময়ব্যাপী নাজুক এক রতিক্রিয়ায় বিভোর হয়ে উঠে।
হুমায়ুন জোর করে নিজেকে বর্তমানে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। তার সিদ্ধান্তের কথা ছেলেকে জানাবার সময় হয়েছে। আকবর, আমি আমাদের উত্তরাধিকার প্রাপ্তি উদ্ধার করতে যাচ্ছি, তুমি কি আমার সাথে যেতে আগ্রহী?
আকবর ক্ষণিকের তরে ইতস্তত না করে সহজসরল ভঙ্গিতে উত্তর দেয়, হ্যাঁ, আব্বাজান।
তোমার কি একটুও ভয় করছে না?
ভয় একটু করছে, কিন্তু আমি মনে মনে জানি যে এটাই যুক্তিসঙ্গত। এটাই আমার নিয়তি… তাছাড়া, এবং তাঁর চোখে মুখে বালকসুলভ একটা হাসি ফুটে উঠে, দারুণ একটা অভিযানের অভিজ্ঞতা হবে এবং সব অভিযানেই বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে যা আমি ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছি। আপনাকে এবং আমার আম্মিজানকে আমার জন্য গর্ববোধ করতে আমি বাধ্য করবো।
তুমি সেটা করবে, আমি জানি।
ইত্যবসরে, তবকিরা নীচে দিয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধ ভঙ্গিতে সারিবদ্ধভাবে নীচে দিয়ে কুচকাওয়াজ করে এগিয়ে যায়, তাঁদের কেউ কেউ ঘোড়ার পিঠে উপবিষ্ট অবস্থায় রয়েছে আর তাঁদের লম্বা আয়ুধ ঘোড়ার পর্যানের সাথে বাঁধা আর অন্যরা বন্দুক কাঁধে নিয়ে হেঁটে চলেছে।
আব্বাজান, পদাতিক সৈন্যরা কিভাবে মূল বাহিনীর সাথে তাল মিলিয়ে চলে?
কামানবাহী ষাড়ের গাড়ির মতো দ্রুত গতিতে তারা হাঁটতে পারদর্শী। তাছাড়া, অগ্রসর হবার সাথে সাথে আমরা আরো ঘোড়া সংগ্রহ করবো। আমরা কাবুলের মতো নদীগুলোতে ভেলা ব্যবহার করে আমাদের যাত্রার গতি বৃদ্ধি করবো আর কামান এবং ভারী মালপত্র বহন করবো। যারা পায়ে হেঁটে চলেছে, ভেলাগুলোতে তারা আরোহন করতে পারবে। কাবুল নদীর জন্য আমি ইতিমধ্যে ভেলা নির্মাণের আদেশ দিয়েছি, যেগুলোতে দাঁড় টানার জন্য বিশেষ ব্যবস্থার সাথে দিক নির্দেশনার জন্য হাল থাকবে।
দুই রাত পরের কথা, হুমায়ুন হামিদার নিরাভরণ মসৃণ দেহের উপর আড়াআড়িভাবে হাত রেখে শুয়ে রয়েছে। তারা কিছুক্ষণ আগেই ভালোবাসার আর্তি মিটিয়েছে এবং হুমায়ুন অনুভব করে যে সঙ্গমের আবেশে আগে কখনও তাঁদের নিজেদের সত্যিকারের একক সত্ত্বা বলে মনে হয়নি। এর পেছনে সম্ভবত একটাই কারণ রয়েছে যে তারা দুজনেই জানে যে আগামীকাল সকালবেলা হুমায়ুন আর আকবর তাঁদের হিন্দুস্তান অভিযানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবে।
হামিদা এক কনুইয়ের উপরে ভর দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় হুমায়ুনের কালো চোখের দিকে পরম ভালোবাসায় সিক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আপনি নিজেকে এবং আমাদের সন্তানকে রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন, তাই না? আপনি যতটা অনুধাবন করেন প্রাসাদে অপেক্ষমান আর পরবর্তী অশ্বারোহী ডাকের জন্য উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা একজন মেয়েমানুষ হওয়াটা তারচেয়েও কঠিন একটা কাজ, বিশেষ করে ডাক বহন করে আনা লোকটার মুখ পর্যবেক্ষণ করে যদি মনে হয় তাঁর মুখাবয়ব আলাদা মনে হচ্ছে, তখনই কল্পনার সূতো জট পাকাতে শুরু করে যাত্রার ধকলের কারণে তাঁকে এমন দেখাচ্ছে, নাকি কোনো খারাপ খবর আছে। আপনি মাঝে মাঝে বিছানায় শুয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করার সময় দূরে কোথাও কি ঘটছে আন্দাজ করার চেষ্টা করেন, যদিও ভালো করেই জানেন ভালো মন্দ যে খবরই আসুক সেটা কয়েক সপ্তাহের পুরান এবং আপনি যে প্রিয়জনের কথা চিন্তা করছেন সে হয়ত ইতিমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে এবং নিজের অজান্তেই আপনি একজন বিধবা।
হুমায়ুন তাঁর তর্জনী দিয়ে আলতো করে হামিদার ঠোঁট স্পর্শ করে এবং তারপরে সেখানে সজোরে দীর্ঘ একটা চুম্বন এঁকে দেয়। আমি জানি আকবর আর আমি বেঁচে থাকবো- তারচেয়েও বড় কথা- যে আমরা বিজয়ী হব এবং আগ্রার রাজপ্রাসাদে তুমি হবে আমার সম্রাজ্ঞী। আমি আমার অন্তরের গভীরে এটা অনুভব করি। আমার অতীত ব্যর্থতার গ্লানি মোচনের আর আমার আব্বাজানের সিংহাসন পুনরুদ্ধার করে আকবরের জন্য সেটাকে নিরাপদ করার এটাই মোক্ষম সুযোগ, এবং আমি এই সুযোগটা গ্রহণ করবো।
হামিদা মৃদু হাসে এবং হুমায়ুন তাঁকে আবারও কাছে টেনে নিয়ে আবার তারা ভালোবাসার আদিম খেলায় মেতে উঠে, প্রথমে মৃদু মন্থর ভঙ্গিমায় ধীরে ধীরে আবেগের মূচ্ছনায় সর্বগ্রাসী জোয়ারের সুর জেগে উঠে।
*
সিন্ধু নদীর দক্ষিণ তীরে হুমায়ুন তাঁর বিশাল কালো ঘোড়ার পিঠে বসে রয়েছে। উত্তরের হিমালয় থেকে ভেসে আসা শীতল বাতাসের ঝাপটায় তার মাথার চুল এলোমেলো হয়ে যায়। সে উত্তরের তীরের দিকে তাকিয়ে থাকে অসংখ্য মানুষ। আর ঘোড়া চলাচলের ফলে যা ইতিমধ্যে আঠাল কাদায় পরিণত হয়েছে তাঁর বিশাল ব্রোঞ্জের কামানের একটা টানার জন্য নিয়োজিত ষাড়ের দলের গলার কাঠের সংযোজক ধরে তার গোলন্দাজ বাহিনীর বিশজনের মতো সৈন্য টেনে তুলতে চেষ্টা করছে। লোকগুলো তাদের হাতের চাবুক আর সেইসাথে বাহবা ধ্বনি দিয়ে অনিচ্ছুক জন্তুগুলোকে হুমায়ুন আর তার লোকেরা নদীতে দুলতে থাকা ভেলা আর নৌকার যে সেতু তৈরী করেছে তার উপরে পা রাখতে প্ররোচিত করতে চেষ্টা করছে, সেতুটা এই স্থানে প্রায় দুইশ ফিট প্রশস্ত।
হুমায়ুন তাঁর আব্বাজানের অভিজ্ঞতা দেখে শিখেছে এবং ভাটির দিকে এমন একটা স্থান নির্বাচিত করেছে- যেখানে নদীটা ডান দিকে একটা প্রায় সমকোণী বাঁক নিয়েছে বলে তার স্রোতের বেগ এখানে অনেক শ্লথ। সে কাবুল ত্যাগ করার পরে গত ছয় সপ্তাহ যাবৎ, তার আগে থেকে তৈরী করে রাখা দাঁড় টানা ভেলার কারণে সে তার বাহিনী নিয়ে ধুসর, বন্ধ্যা পাহাড়ের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত কাবুল নদীর উপর দিয়ে সে যেমনটা আশা করেছিল তার চেয়েও দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। ভেলাগুলো বস্তুত পক্ষে এতোই কার্যকরী যে সিন্ধু নদীর বিশাল জলধারার প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করার সময় পর্যাপ্ত সংখ্যক নৌকা সংগ্রহ করতে গিয়ে তাঁর আব্বাজানকে কেমন বেগ পেতে হয়েছিল সেটা স্মরণ করে এবং সবসময়ে একটা বিষয়ে সচেতন থেকে যে তাঁকে দ্রুত অগ্রসর হতে হবে যদি সে তাঁর সুযোগ নষ্ট করতে না চায়, হুমায়ুন তাই অর্ধেক ভেলা খুলে সেগুলো হিন্দুস্তান অভিমুখী যাত্রার সময় ভারবাহী পশুর পিঠে চাপিয়ে দেয় যাতে করে সে সিন্ধু নদী অতিক্রম করার সময় সেগুলো পুনরায় ব্যবহার করতে পারে। সে সিদ্ধান্তটা নিয়েছিল বলে নিজের প্রতি কৃতজ্ঞবোধ করে যেহেতু সে সামান্য কিছু নৌকা সংগ্রহ করতে সমর্থ হলেও, তার প্রায় অর্ধেক অস্থায়ী সেতু সাথে করে বয়ে আনা ভেলা বা ভেলার উপকরণ থেকে নির্মিত। সে নদীর তীরে পৌঁছাবার পর থেকে গত তিনদিন যাবৎ তাঁর প্রকৌশলীরা নিজেদের উদ্ভাবনকুশলতার দ্বারা ভেলার টুকরোগুলো একত্রে বাঁধছে। হুমায়ুন তাদের সাথে যোগ দিয়ে, কোমর পর্যন্ত বরফ শীতল পানিতে দাঁড়িয়ে, তাঁর লোকদের উৎসাহ দেয়, নিজেও আঙ্গুল দিয়ে চামড়ার ফালিতে গিঁট দিতে থাকে আঙ্গুলগুলো অচিরেই ঠাণ্ডায় জমে নীল আর অসার হয়ে পড়ে।
সে এখন স্বস্তির সাথে তাকিয়ে দেখে যে ধুসর রঙের ষাড়ের প্রথম জোড়াটা সেতুর উপর দিয়ে এগিয়ে চলেছে এবং পুরো দলটা তাঁদের অনুসরণ করছে। তার গোলন্দাজ বাহিনীর আরো লোকজন এসে কামানবাহী শকটের চারটা বিশালাকৃতি চাকা ধাক্কা দিতে আর টানতে থাকে, কাদার ভিতর দিয়ে সেতুর দিকে এগিয়ে যেতে ষাড়গুলোকে সাহায্য করে। তারা যখন ধাক্কা দিতে ব্যস্ত তখন ওজনের কারণে সেতুর পাটাতন পানির ভেতরে বেশ খানিকটা ডুবে যায়। মিনিটখানেকের ভিতরে, অবশ্য, কামান, মানুষ আর পশুর পাল নিরাপদে সেতু অতিক্রম করে এবং তারপরে ষাড়ের পরবর্তী দলটাকে নদীর উত্তর তীরে উৎসাহিত করার ভিতর দিয়ে পুরো প্রক্রিয়াটা আবার আরম্ভ হয়।
হুমায়ুন সহসা নদীর দক্ষিণ তীরের সীমান্তবর্তী নীচু টিলার উপরে সে বৃত্তাকারে যে প্রহরীদের মোতায়েন করেছে যাতে নদী অতিক্রম করার সময় অজ্ঞাত কেউ কাছে এলে সর্তক করে দেয়, তাদের অবস্থান থেকে তূর্যধ্বনি শুনতে পায়। প্রথমে একবার তারপরে দ্বিতীয় এবং তারপরে তৃতীয় ধ্বনি ভেসে আসে মানুষের বিশাল বহর তাদের অবস্থানের দিকে এগিয়ে আসলে সে আর আহমেদ খান যে হুশিয়ারি সংকেত নির্ধারণ করেছিল।
আমরা যখন অনুসন্ধান করবো, পাহারার দায়িত্বে নিয়োজিত লোকেরা কি দেখেছে তখন যেন সেতুর উপর দিয়ে কামার পার করা না হয়। অশ্বারোহীদের আরো দূরে ছড়িয়ে দাও এবং আমাদের তবকিরা যেন বন্দুকে বারুদ আর গুলি ভরে নিজেদের অস্ত্র প্রস্তুত রাখে।
হুমায়ুন তাঁর দেহরক্ষীদের অনুসরণ করা ইঙ্গিত করে, সে তার বিশাল কালো ঘোড়ার পাঁজরে গুতো দিয়ে তাঁকে দুলকি চালে ছোটাতে শুরু করে এবং নীচু যে টিলার উপর থেকে তূর্যবাদকেরা হুশিয়ারি সংকেত ধ্বনিত করেছে সে শীঘ্রই সেখানে পৌঁছে যায়। হুমায়ুন সাথে সাথে দেখতে পায় কেন লোকটা হুশিয়ারি সংকেত ধ্বনিত করেছে। প্রায় পৌনে এক মাইল দূরে, দক্ষিণ দিক থেকে হিন্দুস্তানের দিক থেকে- ঘোড়ায় চেপে বিশাল একটা দল এগিয়ে আসছে। হুমায়ুন এমনকি এই দূরত্ব থেকেও সূর্যালোকে তাঁদের বর্শার ফলার অগ্রভাগ ঝলসাতে দেখে এবং অশ্বারোহী দলটা অগ্রসর হবার সাথে সাথে তাদের নিশান বাতাসে পতপত করে উড়ে। অশ্বারোহী লোকগুলো, যাদের সংখ্যা খুব সম্ভবত একশর কাছাকাছি হবে, মনে হয় আস্কন্দিত বেগের বদলে অর্ধবল্পিত বেগে এগিয়ে আসছে তাঁদের যদি আক্রমণের অভিপ্রায় থাকতো তারা এভাবে আসতো না। হুমায়ুন অবশ্য কোনো ধরনের সুযোগ দিতে রাজি নয়।
আমাদের তবকি আর তীরন্দাজদের দ্রুত আক্রমণাত্মক অবস্থান গ্রহণ করার বিষয়টা নিশ্চিত কর, সে চিৎকার করে তার এক আধিকারিককে আদেশ দেয়। অশ্বারোহী দলটা আরো কাছে আসলে হুমায়ুন লক্ষ্য করে যে তাঁদের কারো মাথায় শিরোম্রাণ নেই আর তাদের অস্ত্রও কোষবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। তারা তিনশ গজ দূরে অবস্থান করার সময় ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে এবং এক কি দুই মিনিট পরে তাদের ভেতর থেকে একজন নিজের ধুসর ঘোড়া নিয়ে একাকী ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে আসে। সে স্পষ্টতই একজন ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি বা কোনো ধরনের মুখপাত্র এবং হুমায়ুন তাঁর দুইজন দেহরক্ষীকে আদেশ দেয় লোকটাকে তাঁর কাছে নিয়ে আসবার জন্য ঘোড়া নিয়ে তাঁর প্রতিরক্ষা ব্যুহ থেকে সামনে এগিয়ে যেতে।
পাঁচ মিনিটের ভিতরে সেই অশ্বারোহীকে দুধসাদা রঙের আলখাল্লা পরিহিত লম্বা ছিপছিপে এক তরুণ এবং তার গলায় বেশ মোটা একটা সোনার মালা ঝুলছে হুমায়ুনের সামনে হাজির করা হয়। পায়ের নীচের ময়লা আর পাথর সম্পর্কে আপাতদৃষ্টিতে উদাসীন লোকটা হুমায়ুনের সামনে, মুখ নীচের দিকে রেখে, দুহাত প্রসারিত করে নিজেকে প্রণত করে, সে তখনও নিজের বিশাল কালো ঘোড়ায় উপবিষ্ট জন্তুটা অস্থির ভঙ্গিতে সামনের পায়ের খুর দিয়ে পাথুরে জমিতে ক্রমাগত বোল তুলছে।
কে আপনি? কি চান?
আমি মুরাদ বেগ, মুলতানের সুলতান উজাদ বেগের জ্যেষ্ঠ পুত্র। আমার আব্বাজানের পক্ষ থেকে আমি এসেছি যিনি নিজের দেহরক্ষীদের সাথে ওইদিকে অপেক্ষা করছেন। তিনি এখানে এসে আপনাকে নিজের জায়গীর আর অভিবাদন নিবেদন করার অনুমতি প্রার্থনা করেছেন। তার ইচ্ছা আপনার ন্যায়সঙ্গত হিন্দুস্তানের সিংহাসন পুনরুদ্ধার অভিযানে সহযোগিতা করার জন্য তার সৈন্যবাহিনীকে আপনার অধীনে অর্পণ করা।
হুমায়ুন উজাদ বেগের নাম শুনে মুচকি হাসে। কাবুল নদী আর খাইবার গিরিপথ ধরে সে নীচের সমভূমির দিকে নেমে আসবার সময় অনেক গোত্রপ্রধান এসেছে, তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে। তাঁদের অনেকেই পুরাতন রীতি অনুসরণ করে নিজেদের মুখে ঘাস নিয়ে তাঁর আর আকবরের সামনে উপস্থিত হয়েছে এটা দেখাতে যে তাঁরা হুমায়ুনের অনুগত ভারবাহী পশু, তাঁর ষাড়ের পাল, সে নিজের অভিপ্রায় অনুসারে তাঁদের সাথে আচরণ করতে পারে। হুমায়ুন প্রতিবারই তাঁদের স্বাগত জানিয়েছে এবং তাঁদের লোকজন তার সেনাবাহিনীতে কার্যকর সংযোজন বলে বিবেচিত হয়েছে।
উজাদ বেগের বিষয়টা অবশ্য আলাদা। সে কোনো মামুলি গোত্র প্রধান নয় বরং একজন পরিশীলিত আর ধূর্ত নৃপতি। পনের বছর পূর্বে, চসার যুদ্ধের পরে, শেরশাহের অগ্রগতি বন্ধে সাহায্য করতে হুমায়ুন সৈন্যের জন্য তাঁর কাছে নিজের প্রতিনিধি প্রেরণ করেছিল, কিন্তু উজাদ বেগ তার দেখা অন্যতম সেরা নিষ্ঠাবান সত্যের অপলাপকারী। তাঁর বিচিত্র সব অজুহাতের গৰ্তাধা ফিরিস্তির ভিতরে ব্যক্তিগত অসুস্থতা থেকে শুরু করে বিদ্রোহ দমনের প্রয়োজনীয়তা ছাড়াও ছিল তার দূর্গপ্রাসাদে সংঘটিত ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের গল্প। হুমায়ুন পরবর্তীতে জানতে পারে শেরশাহকে নিজের অধিরাজ হিসাবে প্রথমে যারা স্বীকৃতি দিয়েছিল সে তাদের ভিতরে অন্যতম। সেই লোক এখন আরো একবার হুমায়ুনের প্রতি নিজের আনুগত্য প্রদর্শন করতে ছুটে আসায় ব্যাপারটা সত্যিকারের ইঙ্গিতবহনকারী যে তারই বিজয়। প্রত্যাশা করা হচ্ছে এবং সে অচিরেই রাজকীয় সিংহাসনে পুনরায় অধিষ্ঠিত হবে। হুমায়ুন অনুধাবন করে যে এখন পুরাতন বিবাদের বোঝাঁপড়া করার সময় না বরং তাঁর অনুগত প্রাক্তন জায়গীরদার আর তাঁদের প্রজাদের সমর্থণ অর্জনের বিষয়টা নিশ্চিত করা যেন দিল্লী আর আগ্রা অভিমুখে অগ্রসর হবার সময় তার পশ্চাতে শান্তি বজায় থাকে। তাছাড়া তার যতদূর মনে পড়ছে, উজাদ বেগের লোকেরা সাহসী, সুসজ্জিত যোদ্ধা যখন তাদের শাসককে প্ররোচিত করা সম্ভব যুদ্ধের ফলাফল পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ না হয়ে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে। হুমায়ুন ভাবে, সে যাই হোক, উজাদ বেগের খানিকটা ঘাম ঝরাতে দোষ কি…
তোমার আব্বাজানকে আমার ভালোমতোই মনে আছে। আমি খুশী হয়েছি যে তাঁর স্বাস্থ্য, যা তিনি আমাকে প্রায়শই লিখে জানাতেন যে তাকে ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে, বিগত বছরগুলোয় এতোটাই উন্নত হয়েছে যে তিনি ব্যক্তিগতভাবে আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন। তুমি তাকে জানাতে পার যে সূর্য অস্ত যাবার ঠিক আগে আগে এক ঘন্টার ভিতরে, যখন আমার অস্থায়ী ছাউনি তাঁর মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ সামন্তরাজকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য যথাযথভাবে প্রস্তুত হবে, তাকে স্বাগত জানাতে পারলে আমি খুশীই হব।
সুলতান, আমি গিয়ে তাঁকে সেটাই বলবো।
একঘণ্টার সামান্য কিছুক্ষণ পরে, হুমায়ুনকে, একজন সম্রাটের পক্ষে মানানসই পোষাক পরিহিত অবস্থায়, তার নিয়ন্ত্রক তাবুর লাল চাঁদোয়ার নীচে একটা গিল্টি করা সিংহাসনে উপবিষ্ট অবস্থায় দেখা যায় আকবর তাঁর পাশে একটা নীচু টুলে বসে রয়েছে। হুমায়ুনের সেনাপতিরা তাঁর সিংহাসনের দুপাশে সারিবদ্ধ অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, সিংহাসনের পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সবুজ পাগড়ি আর বুকে ইস্পাতের ঝকঝকে বক্ষনিরোধক বর্ম পরিহিত দুজন দেহরক্ষী। আকাশে গোলাপী আর বেগুনী রঙের আবীর ছড়িয়ে দিয়ে সূর্য যখন অস্ত যাচ্ছে, তখন উজাদ বেগ হুমায়ুনের রক্ষীবাহিনী পরিবেষ্টিত অবস্থায় এবং নিজের ছেলেকে সাথে নিয়ে হুমায়ুনের দিকে এগিয়ে যায়। দলটা তার সামনে উপস্থিত হওয়া মাত্র উজাদ বেগ আর তার ছেলে নিজেদের সাষ্টাঙ্গপ্রণত করে। সে তাঁদের অধধামুখে শীতল স্যাঁতসেঁতে মাটিতে সে মনে মনে ভাবে তারা যেমনটা প্রত্যাশা করেছিল তারচেয়ে কিছুটা বেশী সময় শুইয়ে রাখে। তারপরে সে লক্ষ্য করে কথা বলে।
তোমরা দুজনেই এখন উঠে দাঁড়াতে পার।
উজিদ বেগ উঠে দাঁড়াবার সময় হুমায়ুন লক্ষ্য করে যে তাঁর অনুগত সামন্তরাজের চুল আর দাড়ি এখন অনেক বেশী সাদা এবং তার কাঁধ সামান্য ঝুঁকে রয়েছে, এবং তার পরণের রেশমের সবুজ টিউনিক একটা নাদুসনুদুস ভূড়ির চাপে টানটান হয়ে রয়েছে। হুমায়ুন প্রায় নিজের অজান্তে তার ইতিমধ্যে অনেকটা সমতল হয়ে আসা পেটের পেশী ভেতরের দিকে টেনে নিয়ে কথা শুরু করে।
এতো বছর পরে আবার আপনার সাথে দেখা হওয়ায় আমি খুব খুশী হয়েছি। আমার সাথে আপনি হঠাৎ কি মনে করে দেখা করতে এসেছেন?
আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই যে তিনি আমাদের মহামান্য সুলতানকে সহিসালামত রেখেছেন এবং আমিও নিজের মূল্যহীন জীবন বাঁচিয়ে রেখেছি হয়ত আপনার ন্যায়সঙ্গত সিংহাসন পুনরুদ্ধারে আপনার অভিযানের জন্য আপনাকে শুভেচ্ছা জানাতে। আমার অধিরাজ, আমি আপনার কাছে এসেছি আমার নিজের এবং সেই সাথে আমার প্রজাদের বিনীত আনুগত্য নিবেদন করতে। উজিদ বেগ শ্বাস নেয়ার জন্য একটু থামে এবং নিজের পরিচারকদের একজনের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে যে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে তাকে অনুসরণ করছে। সুলতান, আমি বিনীত অনুরোধ করছি, এই লোকটাকে সামনে অগ্রসর হবার অনুমতি দেন।
হুমায়ুন মাথা নেড়ে নিজের সম্মতি জানায় এবং পরিচারকটা সোনালী রঙের তাকিয়ার উপরে রাখা হাতির দাঁতের তৈরী একটা বিশাল সিন্দুক নিয়ে উজিদ বেগের দিকে এগিয়ে আসে। উজিদ বেগ সিন্দুকের ভিতর থেকে রুবি বসান একটা সোনার পানপাত্র বের করে সেটা বিম্র ভঙ্গিতে হুমায়ুনের সামনে তুলে ধরে।
সুলতান, আমি আমার আনুগত্যের একটা ক্ষুদ্র স্মারক হিসাবে এই উপহারটা আপনার জন্য নিয়ে এসেছি।
আপনাকে আমি ধন্যবাদ জানাই। আমি খুবই প্রীত হয়েছি যে আরো একবার আপনার অধিরাজ হিসাবে আমাকে স্বীকৃতি দিতে আপনি নিজে এসেছেন। আমার আহ্বানে সাড়া দিতে আপনি সচরাচর এতটা উদগ্রীব থাকেন না।
উজিদ বেগের চোখমুখ লাল হয়ে যায়। সুলতান, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কারণেই কেবল সাময়িকভাবে আমাকে বিরত থাকতে হয়েছিল, এবং এর কিছুদিন পরেই আপনি হিন্দুস্তান ত্যাগ করেছিলেন।
নির্বাসিত অবস্থায় আপনি ইচ্ছা করলেই আমাকে অনুসরণ করতে পারতেন।
আমাকে আমার সিংহাসন আর পরিবারের নিরাপত্তার বিষয়টা লক্ষ্য রাখতে হয়েছিল, উজিদ বেগ কোনমতে তোতলাতে তোতলাতে বলে।
হুমায়ুন সিদ্ধান্ত নেয় বেচারাকে অনেক অপদস্থ করা হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি আমাদের সবার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। অতীতে কথা ভুলে যাওয়াই আমাদের জন্য মঙ্গল। আপনি আরো একবার আপনার আনুগত্য আমার প্রতি নিবেদন করেছেন বলে আমি খুশী হয়েছি এবং এই আনুগত্য যে আন্তরিকতার সাথে নিবেদন করা হয়েছে আমিও ঠিক সেই আন্তরিকতার সাথেই এটা গ্রহণ করছি। আপনি আমার সৈন্যবাহিনীতে কতজন সৈন্য দিয়ে সাহায্য করতে পারবেন?
আপনি দক্ষিণ অভিমুখে যাত্রা শুরু করার কয়েক দিনের ভিতরেই আটশ অশ্বারোহীর একটা সুসজ্জিত বাহিনী আপনার বাহিনীর সাথে যোগ দিতে পারবে।
আমি খুব খুশী হবো যদি এখানে উপস্থিত আপনার এই ছেলে অশ্বারোহী বাহিনীর সেনাপতি হিসাবে আমার সাথে যোগ দেয়, হুমায়ুন বলে, তাঁর মুখের একটা পেশীও টান খায় না, সে খুব ভালো করেই জানে যে তার বাহিনীর সাথে মুরাদ বেগের উপস্থিতি তার আব্বাজানের সুবোধ আচরনের কার্যকর নিশ্চয়তা দান করবে।
সুলতান, আমি নিজেই এটা প্রস্তাব করতে যাচ্ছিলাম।
*
এপ্রিলের প্রথমদিকে সূর্য মাত্র তিনঘন্টা আগে আকাশে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছে, যখন হুমায়ুন পাঞ্জাবে অবস্থিত একসারি শৈলচূড়ার শেষটার শিখরে আকবর আর বৈরাম খানকে পাশে নিয়ে উঠে আসে এবং সামনের দিকে তাকিয়ে বেলেপাথরের তৈরী অতিকায় রোহতাস দূর্গের কাঠামো দেখতে পায়। নীচের সমভূমিতে একটা নিচু কিন্তু দৃশ্যমান শিলাস্তরের উপরে দূর্গটা নির্মাণ করা হয়েছে, যেখান থেকে উত্তর আর পূর্ব দিক থেকে দক্ষিণ অভিমুখী রাস্তার সংযোগস্থলের দিকে লক্ষ্য রাখা যায়। হুমায়ুন হিন্দুস্তানের অভ্যন্তরে ক্রমাগতভাবে প্রবেশ করার পরেও তাকে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের লক্ষণীয় বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। উজাদ বেগের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বরং ইসলাম খানের অনুগত জায়গীরদারের স্বপক্ষ ত্যাগ করতে শুরু করে। নিজেদের প্রাক্তন অধিরাজকে তারা এতো উদগ্র ভঙ্গিতে অভিযুক্ত করে এবং নিজেরা আনুগত্য আর সমর্থনের শপথ নেয় যে হুমায়ুন সাথে সাথেই বালক আকবরকে পরামর্শ দেয় এসব দৃঢ়োক্তি সে যেন কখনও অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস না করে। সর্বোপরি, এদের অনেকেই আগে হুমায়ুনকে ত্যাগ করে শেরশাহের প্রতি নিজেদের আনুগত্য জ্ঞাপন করেছিল এবং আকবর লক্ষ্য করে দেখে তাঁর আব্বাজান সম্পর্কে তাদের এই বর্তমান প্রশস্তি আর আনুগত্যের উৎকীর্তন এসবই মূলত অভ্যঞ্জনেরই নামান্তর। হুমায়ুনের সেনাবাহিনী কাবুল থেকে রওয়ানা দেবার পরে যখন সিন্ধু নদী অতিক্রম করছে ততদিনে এর লোকবল বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণ হয়ে বাইশ হাজার হয়েছে। এই সংখ্যা বেড়ে এখন প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার হয়েছে এবং প্রতিদিনই আরো বেশী সংখ্যায় নতুন লোক এসে উপস্থিত হচ্ছে।
আব্বাজান, দূর্গের প্রধান তোরণদ্বার বন্ধ। দূর্গপ্রাকারের উপরে সশস্ত্র লোক অবস্থান করছে এবং আমি রান্নার জন্য প্রজ্জ্বলিত আগুন থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখছি। আমাদের কি দূৰ্গটা দখল করা একান্ত জরুরী নাকি এটা পাশ কাটিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে পারি? আকবর জিজ্ঞেস করে।
হিন্দুস্তানের উত্তরাঞ্চল নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য এই দূর্গটা অন্যতম একটা চাবিকাঠি। আমরা এটাকে শত্রুর হাতে রেখে এগিয়ে যেতে পারি না যারা যেকোনো সময়ে আকস্মিকভাবে পেছন থেকে আমাদের আক্রমণ করে বসতে পারে, আমাদের তাই অবশ্যই দূর্গটা নিজেদের দখলে নিতে হবে। অবশ্য গুজবে শোনা যায় যে দূর্গের প্রতিরক্ষায় খুবই সামান্য সংখ্যক সৈন্য নিয়োজিত রয়েছে। তাদের সামনে সাহায্যকারী কোনো বাহিনী এসে পৌঁছাবার কোনো সম্ভাবনা নেই এবং নৈরাশ্যজনক কারণে মৃত্যুবরণ করতে তারা খুব একটা উৎসাহী হবে না। আমি দেখতে চাই প্রাথমিকভাবে শক্তি প্রদর্শন কি ফলাফল বয়ে আনে। বৈরাম খান শত্রুপক্ষের গাদাবন্দুকের লক্ষ্যভেদের নাগালের বাইরে দূর্গের ঠিক সামনে আমাদের কয়েকটা কামান এমনভাবে মোতায়েন করেন, যেন দূর্গের প্রধান তোরণদ্বার আর প্রতিরক্ষা প্রাচীরের নিম্নাংশে সেখান থেকেই তারা কিছুটা ক্ষতিসাধন করতে পারবে। আমাদের অশ্বারোহীদের আদেশ দেন তারা যেন ভূপৃষ্ঠের উপরে দৃশ্যমান শিলাস্তরের চারপাশে ব্যুহ রচনা করে অবস্থান করে এবং আমাদের তবকি আর তীরন্দাজেরা কামানের পিছনে যেন এমনভাবে সমবেত হয় যে দূর্গের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত সৈন্যরা তাদের সংখ্যা সম্বন্ধে অবহিত হতে পারে।
দুই ঘন্টারও কম সময়ের ভিতরে, জোড়ায় জোড়ায় যূথবদ্ধ ষাড়ের দল মোগল তোপ নির্ধারিত স্থানে টেনে নিয়ে আসে এবং হুমায়ুনের অশ্বারোহী সৈন্যরা রোহতাসের চারপাশে ব্যুহ বিন্যাস সমাপ্ত করে, বসন্তের বাতাসে পতপত করে তাঁদের লম্বা, সরু সবুজ নিশান উড়তে শুরু করে। পুরোটা সময় ধরে, যদিও দূর্গপ্রাচীরের উপরে ব্যাপক কর্মচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা গেলেও, দূর্গ প্রতিরক্ষাকারী সৈন্যরা তাদের অবরোধকারীদের কার্যকলাপে ছন্দপতন ঘটাতে কোনো ধরনের আক্রমণের প্রয়াস নেয়া থেকে বিরত থাকে। সবকিছু জায়গামতো মোতায়েন করা হয়েছে দেখে নেবার পরে হুমায়ুন বৈরাম খানকে আদেশ দেয়, দূর্গপ্রাসাদের তোরণদ্বার লক্ষ্য করে কামানগুলোকে গোলাবর্ষণের আদেশ দেন। পর্যাপ্ত পরিমাণ ধোঁয়া কুণ্ডলীকৃত অবস্থায় যখন চারপাশ ঢেকে ফেলে। তোরণদ্বারের চারপাশে উত্তাল তরঙ্গের ন্যায় ধোয়া পর্যাপ্ত পরিমাণে জমা হলে, আমাদের তবকিদের ভিতর থেকে বাছাই করা ছেলেদের ধোঁয়ার আড়াল ব্যবহার করে সামনে শত্রুর নাগালের ভিতরে এগিয়ে যেতে বলেন এবং কামানের গোলা নিক্ষেপের জন্য দূর্গ প্রকারের পিছনে অবস্থিত ছাদ থেকে যারা নিজেদের দেহকাঠামো পর্যবেক্ষণ করে তারপরে, তাদের কেউ আর সেখান থেকে পরে শ্রেণীকক্ষে ফিরে যায়নি। ইত্যবসরে আমাদের বার্তাবাহকেরা দূর্গের প্রতিরক্ষাকারীদের নিরাপদে প্রস্থানের সুযোগ করে দিয়ে। আমাদের পক্ষে কি তা করা সম্ভব, দলিল লেখকেরা কি এখন দলিলও ছেড়ে যেতে শুরু করেছে এবং তারা যখন ঘন্টাখানেকের ভিতরে নিজেদের প্রস্তত করতে আদেশ দেয় তাহলে স্পেন প্রতিরোধকারীদের নিরাপদে প্রস্থান করতে দেবে এটা একটা বার্তা আকারে লিখতে বলে। আমরা কতখানি অনর্থ ঘটাতে পারি সেটার একটা নমুনা প্রদর্শনের পরে আমাদের শ্রেষ্ঠ তীরন্দাজেরা আত্মসমর্পণের বার্তা সম্বলিত তীর শহর লক্ষ্য করে ছুড়বে।
সমভূমির উপর দিয়ে প্রায় সাথে সাথেই একটা বিকট বুম শব্দ ভেসে আসে, হুমায়ুনের আদেশ অনুসারে তোপচিরা ব্রোঞ্জের তোপের আগ্নেয় গহ্বরে তাদের হাতের জ্বলন্ত নোম লাগান সুতা প্রবিষ্ট করেছে। তোপের প্রথম কয়েকটা গোলা লক্ষ্যবস্তু থেকে বেশ দূরে, শৈলস্তরের একেবারে নীচের ঢালে আঘাত করে এবং তোরণদ্বার আর দূর্গপ্রাকারের ক্ষতি করার বদলে বাতাসে মাটি আর পাথরের টুকরো বৃষ্টির মতো নিক্ষেপ করে। দিন বাড়ার সাথে সাথে উষ্ণতা বৃদ্ধি পেতে থাকলে কোমর পর্যন্ত নিরাভরণ ঘর্মাক্ত দেহে তোপচিরা বড় কামানবাহী শকটের চাকার নীচে পাথর দিয়ে আর ছোট কামানগুলোকে হাতে তুলে উঁচু মাটির ঢিবির উপরে নিয়ে গিয়ে কামানের নতি পরিবর্তনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তারা যখন এই কাজে ব্যস্ত তখন উঁচু দূর্গপ্রাকার থেকে কয়েকটা গাদাবন্দুকের শব্দ ভেসে আসে কিন্তু হুমায়ুনের পরিকল্পনা অনুযায়ী লক্ষ্যভেদের জন্য দূরত্বটা একটা বিশাল বাঁধা হিসাবে প্রতিয়মান হয়।
দূর্গের নিরাপত্তায় নিয়োজিত প্রহরীদের নিক্ষিপ্ত কয়েকটা তীর, অবশ্য, কামানের অবস্থানের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয় নিক্ষিপের সময় তারা ধনুকের মুখ উপরের দিকে রাখায় তীরগুলো বেশী দূরত্ব অতিক্রম করে। নির্মেঘ আকাশের বুক থেকে মৃত্যু মুখে নিয়ে তাঁরা নীচে নেমে আসে, অধিকাংশই নিরীহ ভঙ্গিতে মাটিতে গেঁথে তিরতির করে কাঁপতে থাকে কিন্তু বেশ কয়েকটা তীর দাঁড়িয়ে থাকা ষাড়ের গায়ে বিদ্ধ হলে, তাঁদের পিঙ্গল বর্ণের চামড়া রক্তে কালচে দেখায়, এবং হুমায়ুন দেখে তাঁর একজন তোপচিকে সবাই ধরাধরি করে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তার পিঠে কালো শরযষ্টি যুক্ত দুটো তীর বিদ্ধ হয়েছে একটা কামানকে জায়গামতো নিয়ে যাবার জন্য প্রাণপনে সেটাকে ধাক্কা দেবার সময় বেচারা পিঠে তীরবিদ্ধ হয়েছে। কামানগুলো সাময়িক বিরতির পরে শীঘ্রই আবার গোলা বর্ষণ শুরু করে এবং এবার নিয়মিতভাবে কামানের গোলা তোরণদ্বার আর এর দুপাশের পাথুরে দেয়ালে লক্ষ্যভেদ করতে থাকে। কাবুলের পার্শ্ববর্তী উপত্যকায় যেমন দেখা যায় অনেকটা সেরকম প্রথম সকালের কুয়াশার মতো সাদা ধোয়ার একটা আচ্ছাদন কামানগুলোর উপরে ভেসে থাকে।
হুমায়ুন তাকিয়ে দেখতে থাকে তার একদল তবকি তাদের গাদাবন্দুক আর গুলি করার সময় বন্দুক রাখার তেপায়া নিয়ে সামনে দৌড়ে গিয়ে ধোয়ার ভিতরে হারিয়ে যায়। তাঁর বেশ কয়েকজন তীরন্দাজ পিঠে তীর ভর্তি তূণীর আর হাতে দুই মাথাযুক্ত ধনুক নিয়ে তবকিদের অনুসরণ করে। এক কি দুই মিনিট পরেই দূর্গপ্রাকারের সমতল ছাদ থেকে একটা দেহ শূন্যে দুহাত ছুঁড়তে ছুঁড়তে নীচের পাথরে আছড়ে পড়ে। আরেকটা দেহ বাতাসে কিছু একটা আকড়ে ধরার চেষ্টা করতে করতে প্রথমজনকে অনুসরণ করে, এবার হুমায়ুন স্পষ্ট দেখতে পায় হতভাগ্য লোকটার গলা একটা তীর এফোড়ওফোড় করে দিয়েছে। দূর্গ প্রাকারে অবস্থানরত দূর্গরক্ষীদের বন্দুক থেকে আর কোনো সাদা ধোয়ার মেঘ বাতাসে ভাসতে দেখা যায় না এবং আকাশ থেকে নেমে আসা তীরের সংখ্যাও লক্ষণীয়ভাবে হ্রাস পায় অবশ্য রোহতাস দূর্গের তোরণদ্বারগুলো তখনও দৃঢ়ভাবে ভেতর থেকে বন্ধ করা রয়েছে।
আমরা যেমন ধারণা করেছিলাম, লড়াই করার জন্য স্পষ্টতই দূর্গরক্ষীরা খুব একটা আগ্রহী না। তীরন্দাজদের এবার তাঁদের তীরে আত্মসমর্পনের আহ্বান সম্বলিত বার্তাগুলোকে সংযুক্ত করতে বলেন এবং সামনে এগিয়ে গিয়ে শহর লক্ষ্য করে তীরগুলো ছুঁড়তে বলেন, হুমায়ুন আদেশ দেয়। কয়েক মিনিটের ভিতরে, সে দেখে বার্তাযুক্ত তীরগুলো আকাশে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, বেশীরভাগ তীরই দূর্গের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের উপর দিয়ে উড়ে যায় এবং দূর্গের ভিতরে অবতরণ করে।
আত্মসমর্পণের বার্তাযুক্ত তীর নিক্ষেপের প্রায় ঘন্টা দুয়েক পরে, আকবরকে পাশে নিয়ে, হুমায়ুন ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায় রোহতাসের উঁচু, লোহার গজালযুক্ত প্রধান তোরণদ্বারের নীচে দিয়ে দূর্গের অভ্যন্তরের জনশূন্য, নিরব প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে, পরিত্যক্ত অস্ত্র আর ভারী যুদ্ধ উপকরণে পুরো জায়গাটা গিজগিজ করছে। হুমায়ুনের সৈন্যবাহিনীর শক্তি দেখে, দূর্গের প্রতিরক্ষায় যারা ছিল তারা আত্মসমর্পণের প্রস্তাবের উদারতায় সাথে সাথে সমঝদারের মতো সম্মতি দিয়েছে। কয়েক মিনিটের ভিতরে দূর্গের প্রধান তোরণদ্বারের পুরু কাঠের পাল্লা খুলে যায় এবং সেনাছাউনির লোকেরা দুই পাল্লার মাঝের ফাঁকা স্থান দিয়ে, কেউ খালি পায়ে কেউ ঘোড়ায় চড়ে তাঁদের পক্ষে বহন করা সম্ভব এমন মূল্যবান সব কিছু নিয়ে, স্রোতের মতো বাইরে বের হয়ে আসতে শুরু করে এবং সবাই দক্ষিণ দিকে রওয়ানা দিয়ে, হুমায়ুনকে হিন্দুস্তানে প্রবেশপথে অবস্থিত এই ঘাঁটিটার মালিক হিসাবে স্বীকার করে ছেড়ে দিয়ে যায়।
হুমায়ুন তাঁর দেহরক্ষীদের কয়েকজন আধিকারিককে আদেশ দেয় দূর্গের সেনাছাউনি থেকে আসলেই সবাই বিদায় নিয়েছে কিনা তল্লাশি করে দেখতে এবং নিশ্চিত করতে যে অতর্কিত হামলা করার জন্য সেখানে কেউ ওঁত পেতে নেই। তাঁদের কাছ থেকে দ্রুত নিশ্চয়তাজ্ঞাপক সংবাদ লাভ করার পরে, হুমায়ুন দূর্গের দরবার কক্ষের খোলা দরজার দিকে পায়ে হেঁটে এগিয়ে যায়। হুমায়ুন হাঁটবার গতি না কমিয়ে ডানদিকে তাকিয়ে দেখে মাটির কয়েকটা তন্দুরের নীচে তখনও কয়লার আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে। সে একটা তন্দুরের ভিতরে উঁকি দিয়ে সেখানে বেশ কয়েকটা গরম আর আফোলা রুটি দেখতে পায়। সে একটা রুটি তুলে নিয়ে সেখান থেকে ছোট একটা টুকরো ছিঁড়ে নিয়ে, টুকরোটা আকবরের দিকে এগিয়ে দেয়।
রুটিটা উপভোগ করো। রুটির এই টুকরোয় বিজয়ের স্বাদ রয়েছে।