০৪. অনিশ্চিত ভারসাম্য
বর্ষায় মুষলধারে বৃষ্টি হতে আগ্রা দূর্গের ভিতরের আঙ্গিনা পানিতে থৈ থৈ করছে। বৃষ্টির ভারী ফোঁটা পাথরের আস্তরণে ঠিকরে যাচ্ছে এবং পানির প্রস্রবনগুলো যা থেকে জলের বুদ্বুদ বের হবার কথা সেগুলো জলমগ্ন করে তুলেছে। স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ার জন্য কাপড়ে ক্ষয়কারী ছত্রাক জন্মাতে শুরু করেছে এবং রাজকীয় পাঠাগারে উদ্বিগ্ন পণ্ডিতেরা হিন্দুস্তানে যেসব পাণ্ডুলিপি নিয়ে এসেছিলেন বাবর সেগুলোকে আর্দ্র আবহাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে তাদের বাৎসরিক প্রয়াসে ব্যস্ত। পাণ্ডুলিপিগুলোর ভিতরে বাবরের রোজনামচাও রয়েছে, যেগুলোকে আর্দ্র আবহাওয়া আর কীটপতঙ্গের ঝাঁকের হাত থেকে বাঁচাতে ভিতরের দিকে সীসার আস্তরণযুক্ত বিশেষভাবে তৈরী ধাতব বাক্সে সংরক্ষণের জন্য তাঁর গ্রন্থাগারিকদের আদেশ দিয়েছে হুমায়ুন। বাক্সটা যে কক্ষে রাখা হয়েছে সেখানের বাতাস শুষ্ক করতে বর্ষা মৌসুমে অবিরত কর্পূর কাঠ জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে।
গতকাল গভীর রাতে, মুষলধারে হতে থাকা বৃষ্টি সম্পর্কে উদাসীন হুমায়ুন তাঁর গুজরাত অভিযান শেষে বিজয়ীর বেশে আগ্রায় ফিরে এসেছে। তার লোকদের পুরস্কৃত করার পরেও সোনা, রূপা আর মূল্যবান রত্নপাথরের বেঁচে যাওয়া অবশিষ্টাংশ ইতিমধ্যে রাজকীয় কোষাগারে স্তূপীকৃত করা হয়েছে। কয়েকটা স্মারক ব্যাতীত- মুক্তাখচিত রূপার একটা পরিকর সালিমার নমনীয় কটিদেশে যা দারুণ মানাবে, তার মা মাহামের জন্য একটা সবুজ জেড পাথরের তৈরী পানপাত্র এবং খানজাদার জন্য রুবী আর আকাটা পান্না খচিত সোনার তৈরী একটা দুই-লহর বিশিষ্ট হার যা বংশ পরম্পরায় গুজরাতের রাজবংশের মহিলাদের কণ্ঠে সুনামের সাথে শোভা পেয়েছে। একটা কলাই করা সিন্দুক খুলে সে হারটা বের করে, গাঢ় সবুজ পান্নার সাথে আগ্নেয় প্রভায় বিন্যস্ত রুবীর দিকে আরও একবার মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
হুমায়ুন যখন তাঁর ফুপুজানের বাসস্থানের দিকে হেঁটে চলে, তখনও হারটা তাঁর হাতে ধরা। হুমায়ুন জানে অভিযানের খুঁটিনাটি বর্ণনা তাঁকে আগ্রহী করে তুলবে কিন্তু সেই সাথে ফুপুজানের পরামর্শও তার প্রয়োজন। ফুপুজানের কক্ষে প্রবেশ করতে, সে দেখে যে খানজাদা কিছু একটা পাঠ করছে এবং তাঁর পাশে বইয়ের ভিতরে মাথা গুঁজে বসে রয়েছে তার এগার বছর বয়সী সৎ-বোন গুলবদন। মেয়েটা তার মা দিলদার এবং ভাই হিন্দালের মতো গাঢ় তামাটে বর্ণের উজ্জ্বল আর কৌতূহলী চোখ তুলে তাঁর দিকে তাকায়।
খানজাদা সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায় এবং তাঁর দুই কাঁধ চেপে ধরে তাঁর দুগালে পরম মমতায় চুম্বন করে। হুমায়ুন, তোমাকে স্বাগতম। তুমি বিজয়ী হয়েছে যেমনটা আমি জানতাম তুমি হবে…তোমার অগ্রগতির প্রতিটা বিবরণী আমাকে গর্বিত করেছে।
আমি আপনার জন্য একটা উপহার নিয়ে এসেছি, হুমায়ুন তার হাতের মুঠি খুলে এবং তার আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে রুবী আর পান্নার হারটার সৌন্দৰ্য ক্ষরিত হতে দেয়। ভালো করে দেখার জন্য গুলবদন সামনে এগিয়ে আসে, কিন্তু রত্নখচিত হারটা গ্রহণ করে সেটাকে আলোতে ধরার আগে খানজাদা সম্ভবত একটু ইতস্তত করেন। দারুণ সুন্দর কিন্তু আমার জন্য বোধহয় একটু বেশীই মনোরম… এটা। এখন আর আমায় মানাবে না। তুমি যখন বিয়ে করবে তখন তোমার বৌকে আমার হয়ে এটা দিয়ো। হুমায়ুন কিছু বলার আগেই খানজাদা হারটা হুমায়ুনের তালুতে রেখে তার আঙ্গুলগুলো বন্ধ করে সেটাকে তালুবন্দি করে দেয় এবং ইঙ্গিতে তাঁকে পাশে বসতে বলে। গুলবদন- এখন তুমি যাও। আগামীকাল তুমি অবশ্যই আসবে- একটা ফার্সী কবিতা আছে যা আমি তোমাকে দেখাতে চাই।
মেয়েটা বই বন্ধ করে ধীর পায়ে হেঁটে যেতে খানজাদা পেছন থেকে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। গতবছর তাঁর মায়ের মৃত্যুর পর থেকেই আমার ভেতরে মেয়েটার প্রতি একটা মমতুবোধ জন্ম নিয়েছে দারুণ বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে এবং চারপাশে কি ঘটছে সবকিছু লক্ষ্য করে।
তার বয়সে আপনি যেমন ছিলেন? আমার আব্বাজান আমাকে প্রায়ই বলতেন কিছুই আপনার দৃষ্টি এড়ায় না।
সে আমার তোষামদ করতো।
আমার সেটা মনে হয় না, এবং সেই কারণেই আমি আরো একবার আপনার কাছে পরামর্শের জন্য এসেছি। বাহাদুর শাহের বিরুদ্ধে অভিযানের সময় আমি অনেক কিছু শিখেছি। আমার বিজয় প্রমাণ করেছে যে যুদ্ধক্ষেত্রে আমাকে অনুসরণ করার জন্য মানুষদের অনুপ্রাণিত করতে পারি এবং নিশ্চিত হয়েছি যে আমি একজন ভালো যোদ্ধা।…আমাকে জীবনে আরও অনেক যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে এবং আমি সেজন্য ভীত নই- বস্তুতপক্ষে আমি তাঁদের মুখোমুখি হবার জন্য মুখিয়ে আছি যদি তারা আমার সাম্রাজ্য আরও নিরাপদ করতে আমাকে সাহায্য করে…
তুমি ঠিকই বলেছে। প্রমাণ করেছে যে তুমি একজন জাত নেতা। সেই সাথে নির্ভীক। তাহলে তোমার এই উদ্বেগ কিসের জন্য?
আমি যখন অভিযান শেষে আগ্রায় ফিরে আসছিলাম, যুদ্ধের উদ্বেগ আর উত্তেজনা থিতিয়ে আসতে প্রায়ই নিজের মনেই চিন্তা করেছি, এবার কি? আমি জানি কিভাবে যোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয় কিন্তু আমি কি সত্যিই জানি কিভাবে একটা সাম্রাজ্য শাসন করতে হয় এবং টিকিয়ে রাখতে হয়? সোনার কারুকাজ করা সিংহাসনে যখন উপবেশন করি, আমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে থাকে উপদেষ্টা, মোসাহেব আর শরণার্থীর দল, সবাই নিজ নিজ সমস্যা বা অনুরোধের প্রতি আমার মনোযোগ আকর্ষনে ব্যস্ত, তখন আমার কেমন আচরণ করা উচিত? মাঝে মাঝে আমার মনে হয় এদের সবাইকে বিতাড়িত করি এবং সালিমা বা আমার অন্য কোনো রক্ষিতার সাথে সময় কাটাই কিংবা শিকারে বেড়িয়ে পড়ি।
একজন প্রাণবন্ত যুবকের জন্য সেটাই স্বাভাবিক কিন্তু তোমাকে এমন প্রলোভন দমন করতে হবে। একজন শাসককে তাঁর চারপাশে কি ঘটছে সে বিষয়ে অবশ্যই সজাগ থাকবে এবং অসন্তোষ ঘনিয়ে উঠে বিদ্রোহের রূপ নেবার আগেই সেটা আঁচ করার মতো সংবেদনশীল হতে হবে। তোমার আব্বাজান যেমন শিখেছিলেন তুমিও তেমনি শিখে নিবে। তার জন্য বিষয়টা মোটেই সহজ ছিল না। আল্লাহতালা যখন তাকে সিংহাসনের অধিকারী করেছিল তখন তোমার চেয়েও তার বয়স অল্প ছিল কিন্তু তিনি একজন মহান শাসকে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর রোজনামচাগুলো পড়–তুমি যা সন্ধান করছে সেখানের পাতায় তুমি তা খুঁজে পাবে, কঠিন অভিজ্ঞতা আর রক্ত থেকে সৃষ্ট… খানজাদা দম নেবার জন্য থামেন, তারপরে খানিকটা বিষণ্ণ ভঙ্গিতে হেসে উঠেন। বাবর যদি এখন এই মুহূর্তে আমাদের মাঝে উপস্থিত থাকতেন, দরবারে তুমি যাদের তোমার নিকটে অবস্থান করতে দাও তাঁদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে তিনি হয়ত তোমায় বলতেন… যাকে তুমি ক্ষমতা প্রদান করছে তার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখবে, সবাইকে বিশ্বাস করবে না। সবসময়ে নিজেকে প্রশ্ন করবে কেন- কেন এই লোকটা আমাকে এই পরামর্শ দিচ্ছে? আমি যদি সম্মতি দেই তাহলে তার কি লাভ? আমি যদি সম্মতি না দেই তাহলে তার কি ক্ষতি? তাকে যা দেয়া হয়েছে সেজন্য কি সে কৃতজ্ঞ থাকবে নাকি সে চিন্তা করবে অধিকার বলেই এটা তাঁর প্রাপ্য?
আমার মনে হয় এসব অনেকটাই এখন বুঝতে পারি। ব্যাপারটা অনেকটা এমন যেন সন্দেহপরায়নতাই একজন শাসকের মূলমন্ত্র হওয়া উচিত। সঙ্গত কারণেই বিষয়টা আমাকে পীড়িত করে, আমার সৎ-ভাইদের বিদ্রোহ মানুষের উপরে কম আস্থা আরোপ এবং বেশী মাত্রায় সতর্ক হবার শিক্ষা আমাকে দিয়েছে, এমনকি পরিবারের সেইসব ঘনিষ্ঠ সদস্যদের ক্ষেত্রেও যাদের আমি অকৃত্রিম মিত্র হিসাবে বিবেচনা করতাম। কিন্তু সাধারণ মানুষ, আমার প্রজারা, যাদের কেবল আমার শরণার্থী হিসাবে দেখি কিংবা রাষ্ট্রীয় ভ্রমণের সময়ে যাদের আনুগত্য আমার প্রয়োজন তাঁদের ক্ষেত্রে আমি কি করবো?
তাদের কাছে তুমি সবসময়ে অন্তরঙ্গতাবর্জিত একজন হিসাবে অবস্থান করবে। তুমি কেমন তারচেয়ে তারা তোমাকে কিভাবে প্রত্যক্ষ করে সেটাই বিবেচ্য বিষয়। তোমার পক্ষে যখনই সম্ভব হবে তুমি তাদের সামনে উপস্থিত হবে এবং যখন দর্শন দেবে তাঁদের কাছে সেটা যেন সূর্যের মতো মনে হয়, দৃষ্টি আরোপের ক্ষেত্রে বড় বেশী দীপ্রময়। তাঁদের সুরক্ষিত রাখতে তোমার ক্ষমতার প্রতি যেন তারা বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে…এবং কেউ তোমার বিরুদ্ধাচারণ করলে তোমার শাস্তি দেয়ার ক্ষমতায়। আমাদের পূর্বপুরুষ তৈমূর তার প্রজাদের কেবল নিজের বিজয় না, সেই সাথে তাঁর ব্যক্তিত্বের ঝলকে কিভাবে বিমোহিত করতেন সেটা স্মরণ কর। সমরকন্দে যেসব প্রাসাদ আর মসজিদ তিনি নির্মাণ করেছিলেন, তিনি যে অভাবিত সম্পদ প্রদর্শন আর দান করেছেন, সেসব তার প্রতিটা বিজয়ের মতোই গুরুত্বপূর্ণ, পৃথিবীর বুকে তাঁর পদচিহ্ন চিরস্থায়ী করতে।
হুমায়ুন উঠে দাঁড়ায় এবং ধীরে জানালার দিকে হেঁটে যায়। বৃষ্টি থেমে এসেছে। এবং বিপ্ন আকাশের ধুসর বুক চিরে সূর্যালোকের কয়েকটা ম্লান রশ্মি নীচে নেমে আসে। তার ফুপুজান ঠিকই বলেছে- দরবারের রাজনীতি অনুধাবনে যে প্রয়াস আর সময় সে ব্যয় করেছে সেজন্য অসন্তষ্ট হওয়া তার উচিত হবে না। কেবল বিজয় না, সে তার লোকদের জন্য জাঁকজমকপূর্ণ প্রদর্শনী আর বিনোদনের ব্যবস্থা করবে…একজন নশ্বর মানুষ হিসাবে না তাঁরা তাঁকে ক্ষমতা আর উত্তর্ষের প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করবে।
হুমায়ুন- এটা একবার দেখো…
ঘুরে তাকিয়ে সে দেখে খানজাদা একটা ঢাউস বইয়ের হাতির দাঁতের তৈরী মলাটের সাথে যুক্ত দুটো রূপার ক্ষুদ্রাকৃতি কজা খুলছে যা তার এক পরিচারিকা তার কাছে নিয়ে এসেছে। বইটা চন্দন কাঠের তৈরী একটা রেহেলের উপরে রেখে সে পাতা উল্টাতে আরম্ভ করে, লাইনের পর লাইন চোখ বুলিয়ে যাবার সময় তাঁর ভ্র কুচকে থাকে, সে যা খুঁজছিলো সেটা পাবার পরেই কেবল সন্তুষ্টির সাথে সে মাথা নাড়ে।
তুমি যখন এখানে ছিলে না, আমি সুলতান ইব্রাহিমের ঘরোয়া নথীপত্র আমাদের ভাষায় অনুবাদের আদেশ দিয়েছিলাম। হিন্দুস্তানের শাসকদের দরবারের রীতিনীতি আমাদের দৃষ্টিতে কেমন অদ্ভুত মনে হয় খানিকটা উদ্ভটও- সেগুলো যত্নের সাথে বিবেচনা করা প্রয়োজন। যেমন ধরো, এখানে লেখা রয়েছে যে প্রতিবছর তাঁর সিংহাসনে আরোহণের দিনটিতে একটা সর্বজনীন উৎসবের আয়োজন করে সুলতান ইব্রাহিমের ওজন নেয়া হত এবং ওজনের সমপরিমাণ রূপা, খাদ্যবস্তু আর উৎকৃষ্ট কাপড় তাঁর অমাত্য আর প্রজাদের মাঝে তাদের যোগ্যতা আর পদমর্যাদা অনুযায়ী বিলিয়ে দেয়া হত। তুমিও এমন কিছু একটা করতে পার? প্রজাদের কাছে নিজের ক্ষমতা আর সম্পদ-এবং তোমার উদারতা প্রদর্শন করে তুমি তোমার ধনী আর দরিদ্র প্রজাদের আনুগত্যের বন্ধনে আবদ্ধ করতে পার। দেখ- অনুষ্ঠানটার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা এখানে দেয়া হয়েছে…।
খানজাদার কাছে এসে হুমায়ুন তাঁর কাঁধের উপর দিয়ে লেখাটা পড়ে। প্রথমে, ওজন নেবার অনুষ্ঠানে পালনীয় আচারের বিশদ বর্ণনা পড়ে তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে। বিস্মিত হবার কোনো কারণ নেই মোগলরা পানিপথে সুলতান ইব্রাহিমের বাহিনীকে সহজেই পরাস্ত করেছিল যদি সুলতান এসব বিষয় প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। কঠিন যুদ্ধ আর রক্তক্ষয়ের বিনিময়ে যে সম্পদ অর্জিত হয়নি সেটা অপুরুষোচিত, দুর্বলচিত্তের পরিচায়ক। সে তুলনায় বিজয়ের অব্যবহিত পরেই তাঁর যোদ্ধাদের ঢালে লুষ্ঠিত সম্পদ স্তূপীকৃত করাটা বরং অনেক উত্তম…
সে অবজ্ঞায় ঠোঁট বাঁকায়। হিন্দুস্তানের অতীতের নৃপতিরা যেভাবে শাসন করেছে সেভাবে শাসন করার জন্য মোগলরা হিন্দুস্তানের উপরে প্রভুত্ব স্থাপন করেনি। কিন্তু খানজাদা আগ্রহী চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকলে সে নিজের ভাবনার রাশ সংযত করে এবং সে যখন সংযত হয় তার নিশ্চয়তায় ফাটল ধরে। তাঁর প্রতিক্রিয়া এখনও সম্ভবত মধ্য এশিয়ার বিশুষ্ক তৃণপ্রধান প্রান্তর থেকে আগত সেইসব যাযাবর যোদ্ধাদের মতোই রয়েছে…কিন্তু সে এখন হিন্দুস্তানে রয়েছে এবং অবশ্যই পরিবর্তিত হওয়া শিখতে হবে। খানজাদা সম্ভবত ঠিকই বলেছেন। একজন নৃপতির যুদ্ধের ময়দানে জয়লাভের সাথে সাথে তার পুরস্কৃত করার এবং সম্ভ্রম উদ্রেকের সামর্থ্যের দ্বারাই ক্ষমতার অধিকারী হয়। এইসব পুরাতন আনুষ্ঠানিকতার মাঝে নিশ্চয়ই কিছু একটা রয়েছে। সুলতান ইব্রাহিমের কিছু কিছু রীতি বোধহয় তার গ্রহণ করা উচিত কিন্তু সেগুলোকে নতুন জৌলুসে… জাঁকজমকপূর্ণ প্রদর্শনী হিসাবে গড়ে তুলতে হবে…
হুমায়ুন খানজাদার কাঁধে হাত রাখে। আরও একবার আমার কর্তব্য করণীয় সম্পর্কে আপনি আমাকে পথ দেখালেন…
*
জওহরের ধরে থাকা ঘষা-মাজা করা আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে হুমায়ুন তাকিয়ে থাকে। তার পরনে ধুসর নীল বুটিদার রেশমের উপরে সোনার কারুকাজ করা আলখাল্লা এবং তাঁর আঙ্গুলে আর গলার চারপাশে মূল্যবান সব পাথর ঝলমল করছে। নিজের আঁকালো পোষাক আর অলঙ্কারে মুগ্ধ, নিজের উপস্থাপিত অবয়ব দেখে প্রীত হয়ে হাসে সে। বস্তুত পক্ষে, তাঁর কাছে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ যে অলঙ্কারটা সেটা হল কোহ-ঈ-নূর হীরক খণ্ড, তাঁর আলোর পর্বত, যা স্বর্ণখচিত অবস্থায় তার বুকে শোভা পাচ্ছে, এবং– এমনকি এর চেয়েও বেশী। ডান হাতের মধ্যমায় পরিহিত তৈমুরের স্বর্ণ অঙ্গুরীয়। আংটিটা হুমায়ুনের সৌভাগ্যে কবচ- এর পৌরুষত্ব, বস্তুগত দৃঢ়তা তাঁর কাছে সবার প্রত্যাশার মাত্রা অবিরত তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেয়, তাকে এখনও কত কিছু অর্জন করতে হবে…
হুমায়ুন ইশারায় জানায় যে আগ্রা দূর্গের বিশাল দর্শনার্থী কক্ষের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হবার জন্য সে প্রস্তুত। ব্রোঞ্জের তৈরী দুটো লম্বা সূর্যের তূর্যনাদ আর পাদিশাহ্ সালামাত, সম্রাটের জয় হোক, সে বহু-স্তম্ভ বিশিষ্ট দরবার হলে প্রবেশ করে যেখানে তার নেতৃস্থানীয় প্রজাবৃন্দ- তাঁর রাষ্ট্রীয় আধিকারিকেরা, তাঁর সেনাপতিরা, তাঁর অমাত্যবৃন্দ এবং তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে নেয়া হিন্দুস্তানী রাজারা অপেক্ষা করছে। তারা অধোমুখে প্রণত হতে, তাঁদের কপাল মাটি স্পর্শ করে, উজ্জ্বল আলখাল্লা পরিহিত অবস্থায় তাদের তীব্র বাতাসের ঝাপটায় নুয়ে পড়া ফুলের বাগিচার মতো দেখায়।
আপনারা উঠে দাঁড়াতে পারেন।
দরবার হলের দূরবর্তী প্রান্তে পদ্মপাতার আকৃতির একটা মার্বেলের জলাধারের মাঝে সারিযুক্ত ফোয়ারায় জলপ্রপাতের মতো প্রবাহিত গোলাপজলের সুগন্ধ, চারটা সুরু পদযুক্ত সারসের মতো দেখতে, যাদের চোখের বদলে রুবী বসান রয়েছে, লম্বা সোনালী দাহকে পুড়তে থাকা ধূপের ঝাঁঝালো গন্ধের সাথে এসে মিশে। হুমায়ুনের পায়ের নীচে পাথরের মেঝের উপরে বিছান লাল এবং নীল রঙের কার্পেট, সে যখন ধীরে ধীরে সোনালী ঝালর দেয়া সবুজ মখমলের শামিয়ানার নীচে স্থাপিত উঁচু বেদীর দিকে এগিয়ে যায়, নরম লাগে এবং পা ডুবে যায়, বেদীর উপরে সোনালী রঙের একটা অতিকায় দাড়িপাল্লা দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা শক্ত কাঠের আড়া থেকে সোনার শেকলের সাহায্যে দুটো অতিকায় তশতরি ঝুলান হয়েছে, তাঁদের প্রান্তের ধুসর গোলাপী বর্ণের খনিজ পাথরের হীরকাকার খণ্ডের কিনারা মুক্তাখচিত।
দাড়িপাল্লার ঠিক বিপরীত দিকে সাজান রয়েছে দান সামগ্রী যা তার বিপরীতে ওজন করা হবে- কারুকার্যখচিত হাতির দাঁতের বাক্স ভর্তি আকাটা রত্নপাথর, স্বর্ণ আর রৌপ্য মুদ্রা ভর্তি সোনার গিল্টি করা কাঠের গুঁড়ি যার প্রতিটা কক্ষে বয়ে আনতে আটজন করে লোকের দরকার হয়েছে, পশমিনা ছাগলের পশমী কাপড়ের গাঁট যা এতটাই নমনীয় আর কোমল যে একটা ছোট আংটির ভিতর দিয়ে ছয় ফিট চওড়া কাপড়ের বিস্তার অনায়াসে পার হয়ে যেতে পারে, রংধনু রঙের বেলনাকারে পাকানো রেশম কাপড় এবং পিতলের ট্রে যার উপরে মশলা স্তূপ করে রাখা।
বেদীর সামনে এবং দুপাশে দলবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শণার্থীদের হুমায়ুন জরিপ করে, যাদের ভিতরে তাঁর নানাজান বাইসানগার এবং তাঁর শুভ্র শুশ্রুমণ্ডিত উজির কাশেমও রয়েছে। দুই প্রবীণ ব্যক্তি সমর্থনের দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে রয়েছে এবং এক মুহূর্তের জন্য হুমায়ুন বাবরের কথা ভাবে যার শাসনামলের শুরুর দিকে তাঁরাই তাঁকে পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেছিল…কিন্তু এটা শোক বা আক্ষেপের মুহূর্ত না বরং আড়ম্বর আর আনুষ্ঠানিকতার সময়। সে আজ একটা রাজকীয় বিবৃতি দেবে।
নয় বছর পূর্বে পানিপথের যুদ্ধে আমি আমার বাবার পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করেছিলাম। আল্লাহতালা আমাদের একটা মহান বিজয় এবং একটা নতুন রাজ্য দান করেছিলেন। এটাও আল্লাহ্তালার ইচ্ছা যে আমার আব্বাজান তিনি যা জয় করেছিলেন সেটা উপভোগের জন্য বেশীদিন জীবিত থাকেননি। হিন্দুস্তানের মোগল সম্রাট হিসাবে আমাকে ঘোষণা করে খুতবা পাঠের আজ তৃতীয় বার্ষিকী। আমার সাম্রাজ্য এখনও নবীন কিন্তু এর আয়তন বৃদ্ধি পাবে…বস্তুতপক্ষে অটোমান সুলতান বা পারস্যের শাহদের স্নান করে দিয়ে এই সাম্রাজ্য ক্ষমতাধর হয়ে উঠবে। মধ্যাহ্নের সূর্যের ন্যায় মোগলদের জৌলুস দ্যুতি ছড়াবে, যারাই এর চোখের দিকে তাকাবার সাহস দেখাবে অন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের সীমান্তে যারা হুমকির কারণ হয়ে উঠেছিল আমি ইতিমধ্যে তাদের পরাজিত করে আমার ক্ষমতা প্রমাণ করেছি। বাহাদুর শাহ এবং লোদি রাজ্যাভিযোগী তার্তার খান অসৎ উদ্দেশ্যে পাহাড়ে লুকিয়ে রয়েছে এবং তাঁদের একদা যে বিপুল ধনসম্পদ ছিল এখন আমার কোষাগারে গচ্ছিত রয়েছে। কিন্তু তোমরা যারা আমার এবং আমার বংশের প্রতি বিশ্বস্ত তাঁরা আজ থেকে শুরু হওয়া গৌরব আর প্রাচুর্যের অংশীদার হবে।
তারা ঠিক যেমন যত্নের সাথে পূর্বে মহড়া দিয়েছিল, কাশেম তূর্যবাদকদের ইশারা করতে তারা আরেকদফা দীর্ঘ তূর্যনাদ অনুকীর্তন করে, যা কক্ষের চারপাশে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। হুমায়ুন দাঁড়িপাল্লার দিকে এগিয়ে যায়। সোনালী তশতরীর একটাতে উঠে দাঁড়াতে সে টের পায়, তার ওজনে সেটা মাটির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। কাশেম হাততালি দিতে, পরিচারকের দল বাক্সের পর বাক্স মূল্যবান পাথর অপর তশতরীতে স্তূপীকৃত করতে শুরু করে যতক্ষণ না, ঢাকের সুললিত ধ্বনির সাথে হুমায়ুন ধীরে ধীরে জমিন থেকে উপরে উঠে আসতে থাকে। অবশেষে, পাল্লা যখন ভারসাম্যে আসে তখন আরেকবার তূর্যধ্বনি শোনা যায়।
লাল চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা একটা বই খুলে কাশিম পাঠ আরম্ভ করে। মহামান্য সুলতান, হুমায়ুন, তাঁর অসীম উদারতার বশবর্তী হয়ে ঘোষণা করছেন যে এইসব মূল্যবান রত্নপাথর তাঁর অমাত্য এবং অনুগত প্ৰজাসকল যাদের নাম এখানে রয়েছে তাদের ভিতরে ভাগ করে দেয়া হবে। সে ধীরে কিন্তু সুললিত কণ্ঠে সুর করে একের পর এক নাম পড়তে থাকে। হুমায়ুনের হাসিতে কৃতজ্ঞতা ফুটতে দেখে- এমনকি লোভও।
এবং এভাবেই ব্যাপারটা চলতে থাকে। হুমায়ুনকে এরপরে থলে ভর্তি সোনা আর রূপার বিপরীতে ওজন করা হয় যা তাঁর সেনাপতিদের ভিতরে বাড়তি পুরষ্কার হিসাবে বিতড়িত হবে এবং এরপরে রেশমের থান, মশলা আর কিংখাবের বিপরীতে তাঁকে ওজন করা হয় যা অন্যান্য শহর আর প্রদেশের শীর্ষ আধিকারিক আর প্রজাদের জন্য পাঠান হয়। অবশেষে সে দরিদ্রদের মাঝে খাদ্যশস্য আর রুটি বিতরণের আদেশ দেয় স্মরণ করিয়ে দিতে যে সম্রাট কেবল তাঁর ধনী এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রজাদের কথাই না বরং সবার কথাই ভাবেন।
সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে এবং শুকরিয়া আর সমর্থনের চিৎকারের রেশ মিলিয়ে আসতে হুমায়ুনের মাথা ব্যাথা আরম্ভ হয়। দরবারের আনুষ্ঠানিকতা- সেখান থেকে প্রচারিত বক্তব্য- রাজবংশের জন্য গুরুতুবহ। সে এখন সেটা বোঝে এবং নিজের প্রজাদের মাঝে সম্ভ্রম জাগ্রত করতে তাকে অবশ্যই আরো উপায় খুঁজে বের করতে হবে কিন্তু এই মুহূর্তে নিজের কক্ষে ফিরে আসতে পেরে সে স্বস্তি পায় এবং পরণের ভারী আলখাল্লাটা ছুঁড়ে ফেলে। তাঁর ব্যক্তিগত পরিচারকেরা তাঁকে যখন আরামদায়ক চোগা আর আচকানে সজ্জিত করে তখন জওহর তার অলঙ্কারগুলো নিয়ে সিন্দুকে তুলে রাখে, সে বুঝতে পারে তার একটু একা থাকা প্রয়োজন, চিন্তা করার জন্য সময় দরকার। যমুনার তীর থেকে সে ঘোড়া নিয়ে ঘুরে আসতে পারে যেখানের বাতাস এখানের এই দূর্গের দমবন্ধ করা পরিবেশের চেয়ে নিশ্চয়ই শীতল হবে। সেখান থেকে ফিরে এসে সে সম্ভবত মিষ্টি-গন্ধযুক্ত হারেম এবং সেখানে বসবাসরত তার কোনো এক সুন্দরী তরুণী রক্ষিতাকে দর্শন দিতে পারে।
সুলতান, মহামান্য গুলরুখ আপনার সাথে কথা বলার অনুমতি প্রার্থনা করছেন। একটা কোমল, অদ্ভুত বাচনভঙ্গি বিশিষ্ট কণ্ঠস্বর তার ভাবনায় বিঘ্ন ঘটায়। ঘুরে দাঁড়িয়ে, হুমায়ুন কালো চোখের এক যুবককে দেখে যার মাথা ভর্তি কালো ঝাকড়া চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে। হুমায়ুন তাঁকে আগে কখনও দেখেছে বলে মনে করতে পারে না। নমনীয় এবং পেলব দেহসৌষ্ঠবের অধিকারী ছেলেটাকে দেখে কোনো মতেই বিশ বছরের বেশী বয়সী বলে মনে হয় না। তাঁর বাহুদ্বয় পরণের লাল কারুকার্যখচিত আস্তিনহীন পোষাকের কারণে নগ্ন সাবলীলভাবে পেশীবহুল।
তোমার নাম কি?
মেহমুদ, সুলতান।
এবং তুমি আমার সৎ মায়ের খিদমত কর।
মেহমুদের চোখের মণি ঝিলিক দিয়ে উঠে। হ্যাঁ, সুলতান।
তোমার দেশ কোথায়?
ইস্তাম্বুলের অটোম্যান দরবার। আমি আমার মশলা ব্যবসায়ী প্রভুর সাথে আগ্রা এসেছিলাম কিন্তু তিনি যখন দেশে ফিরে যান ভাগ্যান্বেষণের জন্য এখানেই থেকে যাই। আমি ভাগ্যবান রাজমহিষীর কৃপা দৃষ্টি আমি লাভ করেছি।
গুলরুখ কি চায়? সে কদাচিৎ তাঁকে বিব্রত করে। বস্তুতপক্ষে তাঁর আব্বাজানের ইন্তেকাল এবং তার সৎ ভাইদের চক্রান্তের পরে গুলরুখের সাথে তার কদাচিৎ দেখা হয়েছে। তিনি আগে কখনও তাঁর সাথে দেখা করতে চাননি। গুলরুখের অনুরোধ তাঁকে দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভিতরে ফেলে দেয়। অনিচ্ছাসত্তেও হুমায়ুন তার বেড়াতে যাবার সিদ্ধান্ত বাতিল করে। তাঁর সাথে এখন দেখা করতে গেলে সেটা ভদ্রতার পরিচায়ক হবে এবং সে যত তাড়াতাড়ি যাবে তত তাড়াতাড়ি জানতে পারবে পুরো বিষয়টা কি নিয়ে। বেশ, আমাকে তোমার গৃহকত্রীর কাছে নিয়ে চল।
হুমায়ুন মেহমুদকে অনুসরণ করে নিজের কক্ষ থেকে বের হয়ে এসে, ভিতরের প্রাঙ্গণ অতিক্রম করে এবং সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসে, যা নীচের ফুলের বাগান দেখা যায় এমন কতগুলো কক্ষের দিকে চলে গিয়েছে যেখানে রাজপরিবারের বয়স্ক মহিলাদের খানজাদা ব্যতীত, যিনি দূর্গের অন্য অংশে থাকতেই পছন্দ করেন- কক্ষ রয়েছে। বাবরের দ্বিতীয় স্ত্রী এবং তাঁর দুই সন্তান, আসকারি এবং কামরানের মা হিসাবে গুলরুখের মর্যাদার সাথে তাঁর বাসস্থান সামঞ্জস্যপূর্ণ। রূপার কারুকার্যখচিত উঁত কাঠের তৈরী দরজার দরজার সামনে তারা যখন পৌঁছায়, পরিচারকের দল দরজার পাল্লা খুলে দিতে হুমায়ুন কক্ষের ভিতরে প্রবেশ করে।
তুমি হৃদয়বান তাই এতো দ্রুত এসেছো, গুলরুখ তাঁর উষ্ণ, ভারী কণ্ঠে বলে- যা অনায়াসে তাঁর সবচেয়ে আকর্ষণীয় গুণ- তাঁর দিকে এগিয়ে আসে। এতোটা সম্মান আমি আশা করিনি।
তার আপন মায়ের চেয়ে দুই বছরের বড়, গুলরুখের বয়স চল্লিশের দশকের শুরুর দিকে, কিন্তু মসৃণ, ঢলঢলে দেহসৌষ্ঠবের কারণে তাকে অনেক অল্পবয়সী মনে হয়। কামরান- পাহাড়ী মার্জারের মতো প্রাণশক্তির অধিকারী যার চোখগুলো সরু আর সবুজ- হুমায়ুন ভাবে, দেখতে বাবরের মতো হয়েছে, মায়ের চেহারা পায়নি। কিন্তু গুলরুখের খুদে কালো চোখ- আগ্রহের সাথে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে- একেবারে আসকারির মতো।
তুমি কি অনুগ্রহ করে একটু বসবে না? সে লাল রেশমের একটা তাকিয়ার দিকে ইঙ্গিত করতে হুমায়ুন সেটায় হেলান দিয়ে বসে।
আমি বিষয়টা নিয়ে কখনও তোমার সাথে আলাপ করিনি কারণ আমি লজ্জিত, কিন্তু আমার ছেলেরা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছে সেটা আমার যথেষ্ট মর্মপীড়ার কারণ হয়েছে। তোমার আব্বাজান আল্লাহ্তালা তাঁর আত্মাকে বেহেশত নসীব করুন- তোমাকে তার উত্তরাধিকার নির্বাচিত করেছেন এবং এর বিরুদ্ধাচারণ করা কারও উচিত নয়। আমাকে বিশ্বাস কর আমি তাদের হঠকারী আর ছেলেমানুষী পরিকল্পনার বিষয়ে কিছুই জানতাম না। তারা কি করেছে আমি যখন শুনতে পেয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম তুমি তাদের প্রাণদণ্ডের আদেশ দেবে। যখন তাদের প্রাণভিক্ষা চাইতে তোমার কাছে আসব বলে ঠিক করেছি তখনই আমি তোমার উদারতার কথা শুনতে পাই কিভাবে তুমি তাদের বুকে টেনে নিয়েছে এবং তাদের মার্জনা করেছে আর সমৃদ্ধ প্রদেশের শাসক হিসাবে তাঁদের মনোনীত করেছো…আমার বহুদিনের ইচ্ছা এই বিষয়ে তোমার সাথে আলাপ করি কারণ একজন মা হিসাবে আমি তোমাকে ধন্যবাদ দিতে চাই। আমি আজকের দিনটা বেছে নিয়েছি কারণ আজ তোমার রাজত্ব আরম্ভ হবার তৃতীয় বার্ষিকী। আমি বিষয়টাকে মাঙ্গলিক হিসাবে বিবেচনা করছি আর আমি তোমাকে অভিনন্দনও জানাতে চাই। তুমি খুব বেশী দিন হয়নি যে সম্রাট হয়েছে কিন্তু এরই ভিতরে তোমার অর্জন প্রচুর।
আমি বিশ্বাস করি আমার ভাইয়েরা তাদের কৃতকর্মের শিক্ষা পেয়েছে এবং তাঁরা এখন জীবনের পূর্ণতা খুঁজে পাবে… তাকিয়ার উপরে হুমায়ুন অস্বস্তি নিয়ে নড়েচড়ে উঠে, বিব্রতবোধ করে এবং চলে যাবার জন্য রীতিমতো উৎকণ্ঠায় ভুগতে আরম্ভ করে। কিন্তু, তাঁর সন্দেহ হয়, গুলরুখের আরও কিছু বলবার আছে। গুলরুখ তাঁর মেহেদী রঞ্জিত আঙ্গুল বুকের উপরে চেপে ধরে আরও কাছে। এগিয়ে আসে।
আমি তোমার কাছে একটা অনুগ্রহ আশা করি যদিও আমার ঠিক সাহস হয় না…
কামরান আর আসকারিকে দরবারে ডেকে পাঠাবার অনুরোধ কি গুলরুখ করতে চাইছে? তার কথা শেষ করার জন্য অপেক্ষা করতে করতে হুমায়ুন নিজের ভিতরে বিরক্তির একটা ঝলক অনুভব করে।
তুমি যদি আমার ইচ্ছাটা রাখো তাহলে সেটা আমাকে ভীষণ প্রীত করবে। হুমায়ুনের নিরবতা আপাতভাবে গুলরুখকে স্পর্শ করে না। তোমার গুজরাত বিজয় উদযাপন করতে, আমি তোমার সম্মানে একটা ভোজসভার আয়োজন করতে চাই। তোমার আম্মিজান আর ফুপু এবং রাজপরিবারের অন্যান্য মহিলারাও আমার অতিথি হবে। তোমার খাতিরে আমাকে এটুকু অন্তত করতে দাও, আমি তাহলে জানব যে তুমি সত্যিই আমার ছেলেদের ক্ষমা করেছে এবং বাবরের পরিবারে সম্প্রীতি ফিরে এসেছে।
হুমায়ুন নিজের ভিতরে স্বস্তির একটা আমেজ অনুভব করে। সে তাহলে এটা চায়- এটা তার ছেলেদের আগ্রায় ফিরিয়ে আনবার জন্য কোনো অশ্রুসিক্ত আবেদন নয়… কেবলই তার বিজয় উদযাপন। গুলরুখের অনুরোধের প্রতি নিজের সম্মতি প্রকাশ করতে সে তার মাথা নাড়ে, এবং শেষবারের মতো মাধুর্যপূর্ণ সৌজন্যতা প্রকাশ করে সে তার কাছ থেকে বিদায় নেয়।
ঘোড়সওয়াড়ীর ধারণা বাদ দিয়ে, সে এর বদলে মায়ের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেয়। মাহামের বাসকক্ষের দিকে অগ্রসর হবার সময়ে সে দিলদারের কক্ষের পাশ দিয়ে যায়। খুব অল্প বয়সে- দশ কি বারো দিন হবে- যখন বাবর হিন্দালকে মাহামের হাতে তুলে দিয়েছিল। তাঁর কেবল মনে আছে তার মা তাঁকে ডেকে এনে নিজের কোলের শিশুটিকে তাঁকে দেখিয়েছিল। দেখো, তোমার একজন নতুন ভাই এসেছে, মা বলেছিলেন। বিভ্রান্ত হুমায়ুন জোরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকা শিশুটির দিকে তাকায় সে ভালো করেই জানে তার মা নয় অন্য মহিলার…
সেই মুহূর্তে ভাবনাটাকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলে সে। কাবুলে বড় হয়ে উঠার দিনগুলোতে তরবারি নিয়ে যুদ্ধের কৌশল আয়ত্ত্ব করা, মিনিটে ত্রিশটা তীর নিক্ষেপে পারদর্শিতা অর্জন আর পোলো খেলাটা ছিল অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। অনেক পরে সে বুঝতে পেরেছিল মাহামের হাতে হিন্দালকে তুলে দেয়াটা ছিল আব্বাজানের জীবনে দুর্বলতার পরিচায়ক নগণ্য কয়েকটা কাজের অন্যতম- যদিও নিখাদ ভালোবাসা থেকে তিনি কাজটা করেছিলেন।
বিষয়টা থেকে কার মঙ্গল হয়েছে? মাহামের শোকের প্রকোপ হয়ত এরফলে প্রশমিত হয়েছে কিন্তু এর ফলে পরিবারের ভিতরে মতানৈক্য পুষ্ট হয়েছে। প্রথম দিকের বছরগুলোতে সে হিন্দালকে দিলদারের কাছ থেকে আলাদা রাখতে সবসময়ে পাহারা দিত। কিন্তু হিন্দালের বয়স হলে এবং তার আসল মা কে সেটা সে জানতে পারলে, সঙ্গত কারণেই মাহামের কাছ থেকে সে দূরে সরে যায়। সম্ভবত এটাই কারণ, সবচেয়ে ছোট হওয়া সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে কামরান আর আসকারির চক্রান্তে হিন্দাল যোগ দিয়েছিল। সম্ভবত সেদিনের জন্য এটা ছিল তাঁর প্রতিশোধ যেদিন দিলদারের কোল থেকে তাঁকে পৃথক করা হয়েছিল।
দিলদারের নিজের কি অবস্থা? এতোগুলো বছর তাঁর মনে কি ভাবনা খেলা করেছে? সে নিদেনপক্ষে গুলবদনকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা লাভ করতে পেরেছে…কিন্তু সে যখন ভূমিষ্ঠ হয়েছিল, দিলদার কি শঙ্কিত হয়েছিল যে মাহাম মেয়েটাকেও তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নিতে চেষ্টা করবে? হুমায়ুন আপনমনে মাথা নাড়ে। সে কখনও সেটা জানতে পারবে না। দিলদার এখন মৃত। মাহাম এসব বিষয়ে কখনও কথা বলে না এবং খানজাদাকেও এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে তাঁর দারুণ অনীহা। মেয়েদের জগতটা সম্ভবত অনেক জটিল আর অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা জায়গা। পুরুষদের পৃথিবীর যত যুদ্ধ আর সংঘাতের সাথে তুলনা করলে মনে হয়, যেখানে সব বিরোধের মীমাংসা মুষ্ঠাঘাত বা তরবারির এক আঘাতে নিস্পন্ন হতে পারে, সেটা অনেক বেশী পরিচ্ছন্ন আর সহজ।
*
একদম প্রায় সোনালী চাঁদের নীচে, দূর্গপ্রাঙ্গণ যা গুলরুখ তাঁর আয়োজিত উৎসবের জন্য মনোনীত করেছে স্থানটা তামার গোলাকার পাত্র বা দিয়ার মাঝে সঞ্চিত সুগন্ধি তেলের ভিতরে জ্বলতে থাকা অসংখ্য সলতের মৃদু আভায় আলোকিত। দূর্গপ্রাঙ্গণের একটা দেয়ালের সাথে একটা বিশাল তাবু দেখা যায়- মোগলদের মাতৃভূমিতে যেমনটা দেখা যায় অনেকটা তেমনি চোঙাকৃতি। কিন্তু শীতকালের তীব্র বাতাসের ঝাপটা সহ্য করার জন্য মজবুত লাঠি একত্রে আটকে এবং পুরু পশমে আবৃত করে তৈরী করার বদলে, হুমায়ুন দেখতে পায় যে কাঠামোটা সরু রৌপ্য দণ্ড দিয়ে নির্মিত যা ফুলের নক্সা শাভিত রেশমী কাপড় দ্বারা আবৃত। রেশমের কাপড়টাকে দুপাশ থেকে পেছনে টেনে বাঁধা হয়েছে মুক্তাখচিত ফিতা দিয়ে যাতে করে প্রবেশপথ রাতের উষ্ণ বাতাসে অর্ধেক উন্মুক্ত থাকে।
গুলরুখের দুজন পরিচারিকা তাঁকে পথ দেখিয়ে তাবুর ভিতরে নিয়ে যায় যেখানে সে অপেক্ষা করছে, পরণে গাঢ় বেগুনী রঙের আলখাল্লা এবং একই রঙের শাল সেটাতে আবার রূপার জরি দিয়ে কারুকাজ করা যা তার মাথা আর কাঁধ ঢেকে রেখেছে। কিন্তু গুলরুখের তরুণী পরিচারিকার দল অর্ধ-স্বচ্ছ মসলিনের পোষাক পরিহিত। দপদপ করতে থাকা আলোর মাঝ দিয়ে তারা এগিয়ে যাবার সময়, হুমায়ুনের দৃষ্টি তাঁদের নমনীয় কোমড়ের বাঁক, সুগঠিত স্তন আর ইন্দ্রিয়সুখাবহ গোলাকৃতি উরু আর নিতম্ব আটকে যায়। তাঁদের নাভিমূলে মূল্যবান পাথর ঝলসে উঠে এবং তাঁদের ঘন কালো চুল হিন্দুস্তানী রীতিতে সাদা জুই ফুল দিয়ে বেণী বাঁধা।
অনুগ্রহ করে… গুলরুখ একটা নীচু, মখমল মোড়া আসনের দিকে ইঙ্গিত করে। হুমায়ুন সেখানে আসন গ্রহণ করলে, তাঁর পরিচারিকাদের একজন চন্দন-সুবাসিত, শীতল পানি পূর্ণ কলাই করা সোনালী জগ হাতে তাঁর সামনে নতজানু হয় যখন আরেকজন সুতির একটা কাপড় নিয়ে আসে। হুমায়ুন তার হাত বাড়িয়ে দেয় এবং প্রথম পরিচারিকা তাদের উপরে পানির ধারা বইয়ে দেয়। ধীরে, প্রণয়পূর্ণ ভঙ্গিতে অপরজন সেটা মুছে দেয়।
বিভ্রান্ত হুমায়ুন তার মা আর খানজাদা আর অন্যান্য রাজ মহিষীদের খোঁজে চারপাশে ইতিউতি তাকায়, কিন্তু গুলরুখ আর তার পরিচারিকাদের ছাড়া তারা সম্ভবত সেখানে একা।
আমি ভেবেছিলাম, স্বল্প পরিসরে, আনুষ্ঠানিকতাবর্জিত উৎসব আয়োজন হয়ত তোমার পছন্দ হবে, গুলরুখ বলে। আজ আমি তোমার একমাত্র আতিথ্যকত্রী কিন্তু আশা করি তুমি আমার অসম্পূর্ণতা মার্জনা করবে।
হুমায়ুন এবার তার আসনে একটু সোজা হয়ে বসে, চোখে সতর্ক দৃষ্টি। গুলরুখ কি করতে চায়? নিশ্চয়ই জানে তাঁর আমন্ত্রণ সে সৌজন্যের খাতিরে গ্রহণ করেছিল- তাঁর বেশী কিছু না-কিন্তু সে বোধহয় আয়োজনটাকে অন্তরঙ্গ কিছু একটায় পরিণত করতে চায়। এক মুহূর্তের জন্য সে ভয় পায় যে গুলরুখ বোধহয়। তাঁকে প্রলুব্ধ করতে চেষ্টা করবে, হয় সে নিজে বা তাঁর পরিচারিকাদের মাধ্যমে।
আমি তোমার জন্য একটা চমকের বন্দোবস্ত করেছি।
হুমায়ুন চারপাশে তাকায়, মনে ক্ষীণ আশা সে ঘন্টা আর মন্দিরার আওয়াজ শুনতে পাবে এবং সারিবদ্ধভাবে নাচিয়ে মেয়েদের এগিয়ে আসতে দেখবে নিদেনপক্ষে টলমল করে এগিয়ে আসা বাজিকর, দড়াবাজ এবং আগুন-খেকোদের দল যা দরবারের মনোরঞ্জনের বাধা উপকরণ। কিন্তু এর বদলে তার ডান পাশের ছায়ার ভিতর থেকে নমনীয় একটা অবয়ব আবির্ভূত হয়। অবয়বটা সরাসরি তার দিকে এগিয়ে আসলে, হুমায়ুন মেহমেদের ধুসর মুখাবয়ব চিনতে পারে। তুর্কী লোকটা তার সামনে নতজানু হয় এবং একটা পানপাত্র তার দিকে এগিয়ে দেয় যেটা লাল সুরার মতো দেখতে একটা পানীয় দ্বারা ভর্তি।
এটা কি? মেহমেদকে উপেক্ষা করে হুমায়ুন এবার সরাসরি গুলরুখের দিকে তাকায়।
কাবুলের দক্ষিণ থেকে সংগৃহীত উচচণ্ড আফিমের একটা বিশেষ মিশ্রণ এবং গজনীর লাল সুরা, আমি নিজের হাতে মিশ্রিত করেছি আমাদের পরিবারের ভিতরে সীমাবদ্ধ একটা প্রস্তুতপ্রণালী অনুসারে। মাঝে মাঝে তোমার আব্বাজান যখন ক্লান্ত হয়ে পড়তেন-আমি এটা তার জন্য প্রস্তুত করতাম। তিনি বলতেন পানীয়টা তাকে আত্মহারা করে তুলে…
হুমায়ুন গাঢ়, প্রায় বেগুনী তরলটার দিকে যখন তাকিয়ে থাকে, তাঁর মানসপটে বাবরের একটা ধারাবাহিক প্রতিচ্ছবি ঝলসে উঠে, যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয় লাভের পরে আনন্দে অধীর হয়ে আফিম নিয়ে আসতে বলে নিজেকে আরও তুঙ্গস্পর্শী উচ্চতায় নিয়ে যাবার জন্য…সে তার আব্বাজানের মুখাবয়বে পরমানন্দের অনুভূতি লক্ষ্য করেছে, তার আনন্দদায়ক অনুভূতির চাপা গুঞ্জন শুনেছে। তাঁর নিজের কাছেও অবশ্য আফিম অপরিচিত কিছু না। তার আব্বাজানের মৃত্যুর পরে এটা তার শোককে প্রশমিত করতে সাহায্য করেছে। পরবর্তীতে সে ইন্দ্রিয়পরবশ অবসন্নতা আবিষ্কার করেছে যা গোলাপজলে দ্রবীভূত কয়েকটা বড়ি উৎপন্ন করতে পারে এবং যা রমণের উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু বাবরকে যেমন আত্মহারা দেখাত সে কদাচিৎ সেরকম পুরোপুরি আত্মহারা হতে পেরেছে।
তুমি কি প্রথমে তোমার ব্যক্তিগত খাদ্য আস্বাদকারীকে ডেকে পাঠাতে চাও?গুলরুখ জানতে চায়। কিন্তু হুমায়ুন কোনো উত্তর দেবার আগেই সে সামনে এগিয়ে এসে মেহমেদের হাত থেকে পানপাত্রটা তুলে নেয় এবং সেটাকে নিজের নিখুঁত ঠোঁটের কাছে তুলে আনে। সে ঢোক গেলাতে তাঁর ভরাট গলা কেঁপে উঠে এবং হুমায়ুন দেখে গুলরুখ নিজের হাত উঁচু করে চিবুক বেয়ে গড়িয়ে নেমে আসা। তরলের কয়েকটা ফোঁটা ধরে এবং তারপরে কমনীয় ভঙ্গিতে চেটে নিজের আঙ্গুল পরিষ্কার করে।
সুলতান, পান করুন। আপনার জন্য এটা আমার উপহার… হুমায়ুন সামান্য ইতস্তত করে তারপরে পানপাত্রটা হাতে নেয়, তখনও সেটা তিন-চতুর্থাংশ পূর্ণ, এবং সেটাকে নিজের ঠোঁটের কাছে তুলে এনে একটা চুমুক দেয়। সুরাটার স্বাদ কেমন একটু অগ্নিগর্ভ মনে হয়- গুলরুখ নিশ্চিতভাবেই আফিমের হাল্কা তিতা স্বাদ ঢাকতে মশলা ব্যবহার করেছে। হুমায়ুন আবারও পান করে, এইবার আরও জোরালভাবে এবং অনুভব করে তার দেহের ভিতরে এক ধরনের কোমল উষ্ণত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে- গলা দিয়ে সেটা প্রথমে নামে, তারপরে তাঁর পাকস্থলীর গর্ভে গিয়ে থিতু হয়। কয়েক মুহূর্ত পরে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো ভারী হয়ে উঠতে থাকে। একটা আনন্দদায়ক, দুর্নিবার একটা নিশ্চেষ্টতা তাঁকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে থাকে এবং হুমায়ুন পরিশ্রান্ত একজন মানুষের মতো যিনি একটা নরম বিছানা তাঁর জন্য প্রস্তুত দেখতে পেয়ে সেটাতে শোয়ার জন্য অপেক্ষা করতে অপারগ এমনভাবে নিজেকে এই আলস্যের হাতে সঁপে দেয়।
পানপাত্রে থেকে যাওয়া বাকি পানীয়টুকুও গিলে নেয় সে। তার চোখ ইতিমধ্যে অর্ধেক বন্ধ হয়ে গিয়েছে সে অনুভব করে তাঁর কাছ থেকে একটা কোমল হাত পানপাত্রটা নিয়ে নেয় এবং চেয়ার থেকে তাকে তুলে নিয়ে এবং তাকে পথ দেখিয়ে একটা নরম গদির কাছে নিয়ে আসে যেখানে তাঁরা তাঁকে শুইয়ে দেয়। কেউ একজন তার মাথার নীচে একটা বালিশ রাখে এবং সুগন্ধিযুক্ত পানি দিয়ে আলতো করে তার মুখটা মুছিয়ে দেয়। ব্যাপারটা বেশ ভালো লাগে এবং হুমায়ুন বিলাসপ্রিয় ভঙ্গিতে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে। শীঘ্রই তাঁর দেহে এমন একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে যেন একটা শূন্যতার মাঝে দেহটা দ্রবীভূত হচ্ছে। সে নিজের দেহের কোনো অংশই অনুভব করতে পারে না কিন্তু এতে কিবা এসে যায়? তাঁর আত্মা- সে যা তাঁর মূল নির্যাস, পৃথিবীর গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ, হেঁটমুখ করে থাকা একটা জমতো না সে একদা যেমন ছিল- যেন তারকা-শোভিত স্বর্গের দিকে ধাবিত হচ্ছে যা সহসা তাঁর সামনে অবারিত হয়েছে।
নিজের দেহ থেকে মুক্তি পেয়ে, হুমায়ুন ধূমকেতুর মতো ভাসমান অবস্থায় নিজেকে অনুভব করে। সে নীচে যমুনার বুক চিরে বয়ে যাওয়া পানির গাঢ় স্রোত চিনতে পারে যেমন চিনতে পারে আগ্রা দূর্গের প্রকারবেষ্টিত সমতল ছাদে গুলরুখের সুরা ভর্তি পাত্রটা। সবদিক ছাপিয়ে হিন্দুস্তানের আপাত সীমাহীন সমভূমি প্রসারিত, উষ্ণ তমিস্র বিদীর্ণ হয়, কখনও এখানে, কখনও সেখানে, তাঁর নতুন প্রজাদের গ্রামের জ্বলন্ত ঘুঁটের আগুনের দ্বারা জোনাকির মতো। তাদের মাটির তৈরী বাড়ির বাইরে বটবৃক্ষ আর বাবলা গাছের নীচে নিজেদের মামুলি বিছানায় তারা টানটান হয়ে শুয়ে আছে, তাঁরা সেইসব মানুষদের স্বপ্নে দেখছে যাদের জীবন ঋতুর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, কখন বীজ বপন করতে হবে আর কখন শস্য কাটতে হবে এবং যাঁদের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা নিজেদের ষাড়ের স্বাস্থ্যসম্পর্কিত এবং তাদের দিয়ে কিভাবে জমি চাষ করবে।
তাঁর আত্মা উড়ে যখন সামনের দিকে এগিয়ে যায়, হুমায়ুন সূর্যোদয় প্রত্যক্ষ করে। কমলা রঙের একটা আলোর কুণ্ডু পৃথিবীর কিনারার উপর দিয়ে ক্ষরিত হয়ে উষ্ণতা আর নবায়ন বয়ে আনছে। এবং এখন ধুসর কমলা আভায় তার নীচে সে কি দেখতে পাচ্ছে?–মহান দিল্লী শহরের প্রাসাদসারি, মিনারসমূহ, এবং অতিকায় সব রাজকীয় সমাধিসৌধ, একদা যা লোদি সুলতানদের রাজধানী ছিল কিন্তু মোগলদের দ্বারা অবজ্ঞাত। হুমায়ুনের অবারিত আত্মা এখনও, হিন্দুস্তানের গরম আর ধূলো পেছনে ফেলে, ভেসে চলে। সে নীচে এখন সিন্ধুর নদের শীতল পানি দেখতে পায়। ওপারে হাড়ের মতো শক্ত আর রঙ জ্বলে যাওয়া সব পাহাড়ের সারি আর কাবুলের দিকে এগিয়ে যাওয়া আঁকাবাঁকা গিরিপথ এবং সেটা এরপরে হিন্দু কুশের শক্ত, হীরক উজ্জ্বল চূড়ার দিকে এগিয়ে গিয়েছে, মোগলদের পিতৃপুরুষের স্বদেশ মধ্য এশিয়ার সমভূমির প্রবেশদ্বার। তারা কতদূর ভ্রমণ করে এসেছে। কি গৌরব তারা লাভ করেছে। এবং এখনও কি বিস্ময় তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে…এই সমস্ত অন্তদৃষ্টির সাহায্যে নতুন কি উচ্চতায় তারা আরোহন করতে পারে? শূন্যে হুমায়ুনের তখনও ভাসমান আত্মার উপরে আকাশ তরল সোনার মতো দীপ্তি ছড়িয়ে সমগ্র পৃথিবীকে আলিঙ্গন করে।