তৃতীয় পর্ব – কোহ–ই-নূর বিসর্জন
১৫. শাহ তামাস্প
সেদিন সকালবেলা, বরফের ভিতরে হুমায়ুন তার লোকদের নিজের চারপাশে জড়ো করে, কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসে তাঁদের নিঃশ্বাস কুণ্ডলী পাকিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। তার লোকদের কেউই মারাত্মকভাবে আহত হয়নি। তারা হামলার সম্মুখীন হয়েছে এটা বোঝার আগেই চামড়ার ফিতে দিয়ে তাদের হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু হুমায়ুনের মতোই তাঁদের সবার মেজাজই বিগড়ে রয়েছে এবং সে বুঝতে পারে কেন- তাদের যোদ্ধার সংহিতা লঙ্ঘিত হয়েছে। প্রত্যেক মানুষই, নিজের অন্তরের অন্তস্থলে লড়াইয়ের একটা সুযোগ প্রত্যাশা করে। তরবারির ফলায় আহত হবার চেয়ে শত্রুর হাতে বেকায়দায় ধরা পড়ার লজ্জা অনেক বেশী যন্ত্রণাদায়ক। ক্ষতচিহ্ন নিদেনপক্ষে সম্মানের একটা স্মারকচিহ্ন বটে। তাবুর ভিতরে ঘুমন্ত অবস্থায় ধরা পড়ার মাঝে গৌরব কোথায়?
গতরাতে যা ঘটেছে তার জন্য তোমাদের কেউ দায়ী নয়। প্রহরী মোতায়েন না করার সিদ্ধান্ত আমিই নিয়েছিলাম।
আমরা কি ঘোড়া নিয়ে তাঁদের পিছু নেব? জাহিদ বেগ জানতে চায়।
না।
কিন্তু, সুলতান কেন? আমাদের চেয়ে বড়জোর এক কি দুই ঘন্টার পথ তারা এগিয়ে আছে…
জাহিদ বেগ, আমি কথা দিয়েছি, এবং কামরানের কথার দাম না থাকতে পারে কিন্তু আমার কথার মূল্য আছে। তাছাড়া, সে আমার সন্তানকে বন্দি করেছে। সে হুমকি দিয়ে গিয়েছে আকবরকে আমার চোখের সামনে হত্যা করবে এবং আমি বিশ্বাস করি সে সেটা করতে পারবে।
কিন্তু তৈমূর বংশীয় নবজাত যুবরাজদের জীবন পবিত্র বলে গন্য করা হয়। আমরা সবসময়ে সেটা মেনে এসেছি…।
কিন্তু আমার সৎ-ভাইয়ের কাছে এসবের কোনো মূল্য নেই। উচ্চাশা তাকে অন্ধ করে ফেলেছে এবং তা গৌরবময় স্বপ্ন সত্য করার পথে সে কোনো ধরনের বাধা বরদাস্ত করবে না। আমার সন্তানকে সে খুশী মনে হত্যা করবে যদি আমি তাকে সামান্যতম কোনো অজুহাতের সুযোগ দেই।
হুমায়ুন দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে থাকে। গুলবদনকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে থাকা হামিদাকে কি কিছুক্ষণ আগেই সে একই কথা বলেনি, যাকে সে অন্য মেয়েদের সাথে মুখে কাপড় গোজা আর হাত-পা বাঁধা অবস্থায় খুঁজে পেয়েছে? গুলবদন যদিও ভীষণ ভয় পেয়েছিল, সে দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়েছে কিন্তু হামিদাকে প্রশমিত করাতো সম্ভব হয়নি বরং মাঝে মাঝেই উন্মত্ত হয়ে উঠছে। আমাদের ছেলেকে উদ্ধার করে নিয়ে এসো! হুমায়ুনকে উদ্দেশ্য করে সে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করছে। তোমার ধমনীতে যদি মানুষের রক্ত বলে কিছু থাকে তাহলে অন্য কিছু করার কথা তুমি কিভাবে ভাবতে পারছো?
কিন্তু তাঁদের বিয়ের পর এই প্রথম হুমায়ুন হামিদাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে। তার সৎ-ভাইয়ের সত্ত্বার ভেতরে অশুভ কিছু একটা ওত পেতে রয়েছে। আকবরের নিষ্পাপ মাথার উপর দিয়ে তারা দুই ভাই যখন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ছিল তখন সেটা সে ভালো করেই দেখতে পেয়েছে। কামরান যা চায় সেটা পাবার জন্য সে যে কোনোকিছু করতে প্রস্তুত… সেজন্যই হামিদাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হুমায়ুন তাকে বলে কামরানকে অনুসরণ করার কথা চিন্তা করাও তাদের উচিত হবে না। সে আলতো করে হামিদার চুলে বিলি কাঁতে কাঁতে তাকে বলেছে, মাহাম আগা অন্তত আকবরের সাথে রয়েছে এবং এই মুহূর্তে তার উপরে ভরসা করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই। ধীরে ধীরে প্রতিয়মান হয় যে যোগ্য ব্যক্তির উপরেই আস্থা রাখা হয়েছে। হামিদা ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই তাকে বলে যে বিদায়ের আগ মুহূর্তে মাহাম ফিসফিস করে তার কানে কি বলেছিল যে তার কাছে একটা খঞ্জর রয়েছে যার ফলায় বিষ মাখান রয়েছে। আকবরের কেউ ক্ষতি করতে চাইলে তাকে সেজন্য মৃত্যুবরণ করতে হবে।
নিজেকে বর্তমানে ফিরিয়ে এনে, হুমায়ুন তার লোকদের উদ্দেশ্যে কথা বলতে থাকে। আমার প্রিয় সাথীরা, আমার অবশ্যই তোমাদের আরো কিছু সম্বন্ধে অবহিত করা উচিত। আমি আমার সৎ-ভাইকে আরো প্রতিশ্রুতি দিয়েছি যে এই অঞ্চল ত্যাগ করে পারস্যে গমন করবো। আমার মনে হয় না সেখানে রাজত্বকারী শাহ। তামা আমাকে নিরাপত্তা দিতে অস্বীকার করবেন কিন্তু সেখানের উদ্দেশ্যে যাত্রাটা অনেক কষ্টসাধ্য হবে, রুক্ষ আর বরফাবৃত প্রান্তরের উপর দিয়ে কয়েকশ মাইল পথ আমাদের পাড়ি দিতে হবে। যাত্রা শেষ হবার আগে আমাদের হয়ত এমন বিপদ আর বঞ্চনার মুখোমুখি হতে হবে যার কথা আমাদের কল্পনাতেও নেই। আমার অনুগামী হবার জন্য আমি তোমাদের আদেশ করছি না… তোমরা যদি দেশে ফিরে যেতে চাও, তাহলে সসম্মানে যেতে পারো…কিন্তু তোমরা যদি আমার সঙ্গী হও, আমি আমার মরহুম আব্বাজান বাবর আর আমার পূর্বপুরুষ তৈমূরের নামে শপথ করে বলছি যে, পারস্য গমনের প্রতিশ্রুতি আমি রক্ষা করার পরে আমাদের সেখানে অবস্থানকাল খুবই সংক্ষিপ্ত হবে। অন্যায়ভাবে জবরদখল করা আমার প্রতি ইঞ্চি ভূমি আমি পুনরায় দখল করবো এবং আমার অনুগামী যারা হবে তারা আমার ইচকিরা- সেইসব গৌরবময় অভিযানের অংশীদার হবে যা নিয়ে একশ বছর পরেও তাঁদের বংশধরেরা গর্বের সাথে আলোচনা করবে।
হুমায়ুন কথা থামিয়ে চারপাশে তাকায়। তার লোকদের চোখ মুখের অভিব্যক্তি তাকে বলে দেয় যে তার কথাগুলো আর তার পেছনে লুকিয়ে থাকা ইস্পাত দৃঢ় সংকল্প- বিফলে যায়নি। যাই হোক এখনই তাঁকে ফেলে রেখে কেউ যাচ্ছে না। তাঁকে যে কোনো মূল্যেই তাঁদের এই বিশ্বাসের যোগ্য হয়ে উঠতে হবে।
*
চারপাশের পাহাড়ের হীরক-উজ্জ্বল শৃঙ্গসমূহ- রূপকথার গল্প থেকে উঠে আসা তুষার স্তম্ভের ন্যায়- দীপ্র প্রভায়, প্রায় মোহিনী সৌন্দর্যে ঝলমল করছে। একমাস পরে, একটা সংকীর্ণ গিরিপথের ভিতর দিয়ে, যেটা ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠে গিয়েছে, হুমায়ুন তার সৈন্যসারির পুরোভাগে অবস্থান করে অগ্রসর হবার সময়ে চারপাশের দৃশ্যপট তাকে একেবারেই মোহিত করে না। বালুচ পথ প্রদর্শকদের, যারা পারস্যের সীমান্ত পর্যন্ত তাঁদের পৌঁছে দিতে রাজি হয়েছে, পরামর্শ অনুসারে হুমায়ুন তার লোকদের যত কম সম্ভব আওয়াজ করার আদেশ দিয়েছে। তারপরেও, হাত দিয়ে চোখের উপরে একটা আড়াল তৈরী করে উপরের চিকচিক করতে থাকা তুষার আর বরফাবৃত প্রান্তরের দিকে সে যখন তাকায়, সে জানে- যেমন তারা প্রত্যেকেই জানে যে জানান না দিয়ে যেকোনো সময় তুষারধ্বস শুরু হয়ে তাঁদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে।
বিপদ চারপাশে ওঁত পেতে রয়েছে। গতকালেরই কথা- সদ্য শেষ হওয়া তুষারপাতের কারণে ঢাকা পড়া হিমবাহের উপরিভাগের ফাটলে পড়ে আরেকটু হলেই তার একজন লোক মারা যেত। লোকটা যে খচ্চরটাকে টেনে নিয়ে আসছিলো সেটা তুষার শূন্যতায় উল্টে পড়ে কিন্তু নিয়তির এক অসাধারণ লীলাখেলার কারণে সে দশফিট নীচে একটা পাথুরে তাক আকড়ে ধরে কোনোমতে প্রাণ বাঁচায়। আহমেদ খানের দুই গুপ্তদূত দড়ির সাহায্যে পড়ে তাকে উপরে টেনে তুলে।
তাদের বেঁচে থাকার পথে প্রকৃতিই কেবল একমাত্র অন্তরায় নয়। এই বিরান, জনবসতিহীন অঞ্চলের ভিতর দিয়ে নিতান্ত প্রয়োজন না হলে কেউ অতিক্রম করে না। দস্যুর দল- বালুচ পথ প্রদর্শকেরা যাদের নিষ্ফলা প্রান্তরের পিশাচ বলে, মাটিতে চরম বিতৃষ্ণায় থুতু ফেলে- এইসব উঁচু অঞ্চলেই বিচরণ করে থাকে। কেউ কেউ এমনও গল্প করে যে তারা নাকি মানুষের মাংস খেতেও দ্বিধা করে না। হুমায়ুনের অনেকবারই মনে হয়েছে উপরের তুষারাবৃত গিরিকরের মাঝে সে মানুষের আনাগোনা দেখতে পেয়েছে কিন্তু তারপরে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালে আর কিছুই তার নজরে পড়েনি। সে যাই হোক, আড়াল থেকে কেউ তাদের উপর নজর রাখছে এই অনুভূতিটা তাঁর যায়নি এবং সে জানে যে আহমেদ খানও একই ধরনের অস্বস্তিবোধ করছে। কামরানের মতো শঠ আর ধূর্ত লোকের পক্ষে- হুমায়ুনের সম্ভাব্য যাত্রাপথ এবং তার সাথে মাত্র দুইশজন লোক রয়েছে জানার পরে খুবই স্বাভাবিক তাকে আক্রমণ করার জন্য ডাকাতদের ঘুষ দেয়া। হুমায়ুনের মৃত্যু, যদি দেখান যায় যে অন্যদের হাতে হয়েছে, কামরানের জন্য সেটা অনেকবেশী সুবিধাজনক হবে। আবহাওয়ার পরিস্থিতি যাই থাকুক না কেন, প্রতিরাতে হুমায়ুন। প্রহরী মোতায়েন করে।
কিন্তু সে এটাও জানে যে তাঁদের ক্রমশ বেঁকে বসতে থাকা শারীরিক দূর্বলতা এই মুহূর্তে তাদের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে কারণ দূর্বলতার পেছন পেছন আসে অসাবধানতা। তাঁদের রসদ- শস্যদানা, শুকনো ফল- সব প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। গত তিন রাত খাবার বলতে একটা ছোট আগুনের উপরে শিরোস্রাণে ফোঁটান আঁশালে ঘোড়ার মাংস। অচিরেই তারা আর কোনো কিছু রান্না করতেও পারবে না। তাদের সাথে যা কাঠ আর কয়লা ছিল সব প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছে।
হুমায়ুন ঠাণ্ডায় কেঁপে উঠলে তার প্রতিটা হাড়ে যেন ব্যাথার একটা ঢেউ বয়ে যায়- সে তাঁর আব্বাজান বাবরের হিন্দু কুশ অতিক্রমের গল্প স্মরণ করে, কিভাবে উপর থেকে সহসা আছড়ে পড়া বরফ তার লোকদের ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে, কিভাবে গভীর হিমবাহের মুখোমুখি হয়ে সে তার লোকেরা পর্যায়ক্রমে বরফ বিদীর্ণকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সেটাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে তার ভিতর দিয়ে পথ করে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছে। বাবর কেবল দৃঢ়সংকল্প হয়ে সব বাধা অতিক্রম করেছে এবং তাকেও ঠিক তাই করতে হবে।
সেদিন অপরাহ্নে, আপাতদৃষ্টিতে তুষারধ্বস হবার সম্ভাবনা নেই এমন এক টুকরো জমিতে তারা যখন সেদিনের মতো অস্থায়ী শিবির স্থাপন করেছে, তীব্র শীতের ভেতরে বেঁচে থাকা সম্বন্ধে বাবরের গল্পগুলো হুমায়ুন অন্য আরেকটা কারণে স্মরণ করে। ভেড়ার চামড়ার পুরু আলখাল্লায় আবৃত, আহমেদ খান, কিনারাবিহীন পশমী বালুচ টুপি একেবারে চোখের উপর পর্যন্ত টেনে নামান এবং তাঁর পুরো মুখটা একটা গরম কাপড় দিয়ে এমনভাবে আড়াল করা রয়েছে যে কেবল তার হলুদাভ-খয়েরী চোখজোড়া দৃশ্যমান, হোঁচট খেতে খেতে এগিয়ে আসে, বরফের উপরে তাঁর পায়ের চামড়ার জুতোজোড়া কেবলই পিছলে যেতে চায়।
সুলতান, গত কয়েকরাত এতো তীব্র শীত পড়েছিল যে পাহারা দেবার দায়িত্ব পালন করার সময় আমার দুজন লোকের পায়ে মারাত্মক হিম-দংশ হয়েছে। আমাদের হেকিমসাহেব এই মুহূর্তে তাদের সাথে রয়েছে…
তিনি কি বলেছেন?
তিনি বলেছেন যে তাঁকে ব্যবচ্ছেদের সহায়তা নিতে হবে। একজনের কপাল ভালোই বলতে হবে তার তিনটা আঙ্গুল কেটে বাদ দিলেই হবে কিন্তু অন্যজনের পুরো পা কেটে ফেলতে হবে…
আমি দেখতে যাবো।
একটা ছোট তাবুর অভ্যন্তরে হেকিমসাহেব এবং দুই হতভাগ্য সৈন্য অবস্থান করছে যেখানে একটা ধাতব পাত্রে মিটমিট করে আগুন জ্বলছে। হুমায়ুন তাকিয়ে দেখে ছেঁড়া পাতলুন আর নগ্ন পা বের করে শুয়ে থাকা দুজনের একজন দারয়া। প্রাণবন্ত ছেলেটাকে ভীষণ ফ্যাকাশে দেখায়, সে অপলক চোখে তাকিয়ে থেকে হেকিমসাহেবকে আগুনের দুর্বল শিখায় তাঁর ছুরির ফলাটাকে জীবাণুমুক্ত করা দেখছে। আরেকটা চওড়া ফলা আগুনের ভেতরে ঠেসে রাখা হয়েছে- বোঝাই যায় ক্ষতস্থানে সংক্রমণ রোধ করতে জায়গাটা পুড়িয়ে দেবার জন্য সেটাকে গরম করে গনগনে-লাল করা হবে। হুমায়ুন দারয়ার পাশে আসনপিড়ি হয়ে বসে তার ডান পায়ের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। পা ফুলে কালো হয়ে রয়েছে এবং ফোলাটা গোড়ালীর অনেক উপরে ছড়িয়ে গিয়েছে আর অল্প যে কয়েকটা আঙ্গুলের নখ অবশিষ্ট রয়েছে তাঁর নীচ থেকে অশুভ-দুর্গন্ধযুক্ত সবুজাভ পুজ নির্গত হচ্ছে। হেকিমসাহেব কি তোমায় বলেছেন এই অবস্থায় তার কি করা উচিত? দারয়া মাথা নাড়ে কিন্তু হুমায়ুন তাঁর চোখে আতঙ্কের ছায়া স্পষ্ট দেখতে পায়। হিম্মত রাখো। হেকিমসাহেব খুবই দক্ষ। আল্লাহ সহায় থাকলে, এটা তোমার জীবন বাঁচিয়ে দেবে।
হিম-দংশে আক্রান্ত অপর সৈন্য- এক বাদশানি- তাঁকে দেখে দারয়ার চেয়েও অল্পবয়সী মনে হয়। তাঁর পায়ের তিনটি আঙ্গুল ফুলে উঠে বিবর্ণ হয়ে রয়েছে আর তাঁকে দেখে মনে হয় বেচারা হেকিমের ছুরির ফলা থেকে দৃষ্টি সরাতে পারছে না, যা কিছুক্ষণ পরেই তাঁর মাংস আর হাড়ের ভেতর কেটে বসে যাবে।
হেকিমসাহেব, আমি আর আহমেদ খান আপনাকে সাহায্য করবো, হুমায়ুন বলে। প্রথমে কার পালা?
হেকিমসাহেব বাদশানি সৈন্যর দিকে ইঙ্গিত করে। আহমেদ খান যখন তরুণ সৈন্যের কাঁধ শক্ত করে ধরে তাঁকে মাটিতে শুইয়ে রাখতে তখন হুমায়ুন হাটু মুড়ে তাঁর পায়ের কাছে বসে হাঁটুর ঠিক উপরে দুই হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে। হেকিমসাহেব যখন তার কাজ করছে তখন পা স্থির রাখতে গিয়ে হুমায়ুনকে তাঁর পুরো শক্তি প্রয়োগ করতে হয় এবং বাদশানি ছেলেটা পিঠের ভরে ধনুকেরমতো বেঁকে যায়, আপ্রাণ চেষ্টা করে চিৎকার না করতে। কিন্তু হেকিমসাহেব খুব দ্রুত কাজ করে। তিনটা নিখুঁত পোচে তিনি কালো হয়ে যাওয়া পায়ের আঙ্গুল তিনটি আলাদা করে ফেলেন, তারপরে রক্ত ঝরতে থাকা ক্ষতস্থানের সংক্রমণ রোধে জায়গাটা পুড়িয়ে দিয়ে সেখানে শক্ত করে পটি বেঁধে দেন।
এবার দারয়ার পালা। আরো একবার ছুরির ফলাটা আগুনের মাঝে আন্দোলিত করার সময় হেকিমসাহেবের চোখমুখ থমথম করতে থাকে। সুলতান, এবার কিন্তু অনেকবেশী সময় লাগবে। যন্ত্রণার অনুভূতি নিঃসাড় করতে আমি যদি তাকে একটু আফিম দিতে পারতাম… আমি ওর চেয়ে অনেক শক্তিশালী যোদ্ধাদের দেখেছি, ব্যবচ্ছেদের সময় স্নায়বিক অভ্যাঘাতেই মৃত্যুবরণ করেছে।
হুমায়ুন কাঁধের উপর দিয়ে তাকিয়ে দেখে যেখানে দারিয়া নিথর হয়ে শুয়ে রয়েছে, ফ্যাকাশে মুখটা ঘামের কারণে চকচক করছে।
সে যদি অচেতন থাকে, তাহলে কি কষ্ট কম হবে?
হাকিমসাহেব মাথা নেড়ে সম্মতি জানান।
হুমায়ুন দারয়ার দিকে এগিয়ে যায়। সব ঠিক হয়ে যাবে, ছেলেটার পাশে হাঁটু মুড়ে বসে সে বলে। কষ্ট করে একটু উঠে বসতে পারবে, তোমাকে একটা কথা আমায় বলতেই হবে… চোখে বিভ্রান্তি নিয়ে দারয়া কুনুইয়ের উপর ভর দিয়ে নিজেকে উঁচু করে, হুমায়ুন কোনো হুশিয়ারী ছাড়াই মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে তাঁকে গায়ের সবশক্তি দিয়ে ঘুষি মারে, ঘুষিটা বোমারমতো তার থুতনির শীর্ষভাগে বিস্ফোরিত হয়। তরুণ ছেলেটা বিনা প্রতিবাদে আবার শুয়ে পড়ে। হুমায়ুন তার চোখের পাতা টেনে দেখে- যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর সাথে আর অনেক সময় বন্ধুদের সাথে সে বহুবার এমন করেছে- বেচারী কিছু বোঝার আগেই জ্ঞান হারিয়েছে। তার নিশানা ভেদ ভালোই আছে…
হাকিমসাহেব, আপনার যা করণীয় এবার করতে পারেন। হুমায়ুন তাবুর ভিতর থেকে একটু ঝুঁকে বাইরের কনকনে শীতল বাতাসে বের হয়ে আসে, আহমেদ খানকে রেখে আসে চিকিৎসককে সাহায্য করার জন্য, বাইরে থেকে সে ঘাস ঘাস শব্দে ধাতব ফলার হাড় কাটার আওয়াজ শুনতে পায় এবং তাঁর মনটা আরও বিষণ্ণ হয়ে উঠে। তার লোকদের আস্থা আর তাদের আত্মত্যাগের যথাযথ প্রতিদান কিভাবে দেবে? অন্ধকার ঘনিয়ে আসা আকাশের দিকে সে মুখ তুলে তাকায় এবং ক্ষণিকের জন্য তাঁর যত দায়িত্ব আর দুশ্চিন্তা তাঁকে বিব্রত করছে সবকিছু ভুলে থাকতে এবং পরমানন্দে ভেসে যাবার জন্য গুলরুখের আফিম-মিশ্রিত সুরার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। তারপরেই আকাশের নক্ষত্ররাজির মাঝে যেন খানজাদার মুখ ভেসে উঠে, নিরবে তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে উদ্বেগহীন জীবনযাপনের নিয়তি নিয়ে সে জন্মগ্রহণ করেনি এবং এর সাথে অনেক বাধ্যবাধকতা আর তার সাথে সংশ্লিষ্ট চাপ জড়িয়ে রয়েছে। সে তার পরণের আলখাল্লাটায় নিজেকে আরও ভালো করে জড়িয়ে নেয় এবং সিদ্ধান্ত নেয় যে পাহারার কাজে যারা নিয়োজিত রয়েছে, সেখানে গিয়ে সে হিম-দংশের আক্রমণের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাঁদের হুশিয়ার করে দিয়ে নড়াচড়া করতে বলবে, আর ঘনঘন তাদের পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করার ব্যাপারে সতর্ক করে দেবে।
কিন্তু তিনদিন পরে আপাতদৃষ্টিতে এটা প্রতিয়মান হয় যে, তাঁরা বোধহয় সবচেয়ে জঘন্য পরিস্থিতি অতিক্রম করে এসেছে। একটা সর্পিলাকার সংকীর্ণ পথ দিয়ে তারা যখন সাপের মতো একেবেঁকে নীচের দিকে নামছে, সহসা বাতাসের তীব্র কনকনে ভাবটা তিরোহিত হয় এবং চারপাশে তূলোর মতো ভাসতে থাকা মেঘের ভিতর দিয়ে হুমায়ুন নীচে তাকিয়ে বৃত্তাকারে অবস্থিত তুষারাবৃত বাড়ি ঘর দেখতে পায় এবং তাঁদের চিমনি থেকে বোয়া উঠতে দেখে সে অনুমান করে সেটা কোনো একটা সরাইখানা হবে। সরাইখানার আঙ্গিনায় ভারী আলখাল্লা পরিহিত অবয়বদের জটলা করতে দেখা যায় এবং সে গৃহপালিত পশুদের ইতস্তত বিচরণ করতে দেখে। তুমি যে বসতির কথা বলছিলে এটাই কি সেটা? বালুচ পথ প্রদর্শকদের একজনকে ডেকে এনে সে জিজ্ঞেস করে।
হা, সুলতান। আমরা যাকে গামসির বলি- পাহাড়ের মধ্যবর্তী পশুচারণভূমি যেখানে পশুপালক আর কৃষকেরা তাঁদের শীতকালীন আবাসস্থল হিসাবে ব্যবহার করে- আমরা এখন পাহাড়ের উচ্চতা থেকে সেদিকে অবতরণ করছি। আমরা সেখান থেকে জ্বালানী আর রসদ সংগ্রহ করতে পারবো… এবং পুনরায় যাত্রা শুরম্ন করার আগে ইচ্ছা করলে আমরা সেখানে কয়েকদিন বিশ্রামও নিতে পারি।
রসদ প্রাপ্তির সম্ভাবনায় হুমায়ুন উৎফুল্ল হয়ে উঠে কিন্তু সেখানে সে প্রয়োজনের চেয়ে এক মুহূর্তও বেশী সময় নষ্ট করার পক্ষপাতি নয়। আকবর বহু মাইল দূরে কোনো অজানায় কামরানের হাতে বন্দি রয়েছে, এই ভাবনায় জারিত হয়ে হামিদার দিকে প্রতিবার তাকাবার সময় তাঁর চোখে জমাট কষ্টের সাথে তাঁর নিজের অক্ষমতাবোধ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তাঁরা যত শীঘ্র পারস্যে পৌঁছাবে, তত দ্রুত সে আবার পরিকল্পনার ছক বিন্যাস শুরু করতে পারবে।
সীমান্ত এখান থেকে কতদূরে?
সুলতান, এখান থেকে প্রায় আশি মাইল দূরে হেলমান্দ নদীর ঠিক অপর তীরেই পারস্যের সিয়েস্তান প্রদেশ অবস্থিত।
সেখানে পৌঁছাবার পূর্বে আমরা কি ধরনের ভূ-প্রকৃতির মোকাবেলা করবো?
এখন থেকে বেশীর ভাগ সময়েই আমরা নীচের দিকে নামতে থাকবো। আমরা হেলমান্দের কাছাকাছি পৌঁছালে ভূ-প্রকৃতি সমতল হয়ে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে।
নদীর কাছে পৌঁছাতে আমাদের আর কতদিন লাগবে?
নদীর যে অগভীর অংশটা আমি চিনি সেখানে পৌঁছাতে দশ কি বার দিনের বেশী সময় লাগবে না।
সেইদিন রাতের বেলার কথা, নীচের সেই বসতিটায় পৌঁছে বহুদিন পরে তাঁরা সবাই প্রথমবারের মতো উদরপূর্তি করে, হুমায়ুন তার তাবুতে হামিদার সাথে এসে যোগ দেয়। আমরা এখন যখন শাহের রাজ্যের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি, আমাদের স্বাগত জানাবার অনুরোধ জানিয়ে শাহ্ তামাকে আমার অবশ্যই একটা চিঠি লেখা উচিত। নিজেদের অভিপ্রায় না জানিয়ে আমরা যদি তার ভূখণ্ডের দিকে। এগিয়ে যাই, সীমান্তে মোতায়েন করা পারস্যের সীমান্তরক্ষীরা ভাবতেই পারে আমাদের কোনো বৈরী উদ্দেশ্য রয়েছে। জওহরকে আমার বিশেষ বার্তাবাহক করে আমি তাকে দিয়ে চিঠিটা পাঠাতে চাই। হেলমান্দ নদী পার হয়ে সে চিঠিটা নিয়ে যাবে এবং সেখানে প্রাদেশিক শাসক বা সমান পদমর্যাদার অন্যকোন আধিকারিককে খুঁজে বের করে আমাদের আগমনের উদ্দেশ্য তার কাছে ব্যাখ্যা করবে এবং তাকে অনুরোধ করবে অনতিবিলম্বে শাহের কাছে আমার চিঠিটা যেন। পৌঁছে দেয়া হয়।
হুমায়ুন কথা বলার মাঝেই, একটা নীচু টেবিলের সামনে আসন পিঁড়ি হয়ে বসে যেখানে একটা মাত্র তেলের প্রদীপের মৃদু আলোয়, সে চিঠি লেখার জন্য কালি প্রস্তুত করতে শুরু করে। সে খুব ভালো করেই জানে তাঁর শব্দ চয়নের উপর সবকিছু কতখানি নির্ভর করছে। সে পথে আসবার সময়ে তার কি লেখা উচিত সে বিষয়ে অনেক ভাবনাচিন্তা করার অবকাশ পেয়েছে এবং এখন কোনো ধরনের ইতস্ত ত না করে সে সাবলীল ভঙ্গিতে লিখতে শুরু করে, চিঠির বক্তব্য জোরে জোরে হামিদার উদ্দেশ্যে বলতে থাকে। ভাগ্য ভালোই বলতে হবে যে মোগলদের কাছে পার্সী একটা পরিচিতি ভাষা সেজন্য তার কোনো দোভাষিকের প্রয়োজন হয় না।
প্রথম অনুচ্ছেদে সৌজন্যমূলক শিষ্টাচার, যেখানে বারবার শাহের দীর্ঘ নিরোগ জীবন আর তাঁর শাসনাকালের সাফল্য কামনা করা হয়। হুমায়ুন তারপরে তাসাম্পকে বিনয়ের সাথে স্মরণ করিয়ে দেয় যে বহুবছর আগে শাহের বাবা শাহ ইসমাঈল, হুমায়ুনের আব্বাজান বাবরকে তার শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে কেবল সাহায্যই করেননি, একইসাথে মোগলদের কৃপাহীন শত্ৰু উজবেক গোত্রপতি সাইবানি খানের হেরেম থেকে বাবরের বোন খানজাদাকেও উদ্ধার করেছিলেন। হুমায়ুন অবশ্য উল্লেখ করে না যে- যা সম্পর্কে শাহ্ তামাম্প খুব ভালোভাবেই অবহিত আছে ইসমাঈল আর বাবরের মধ্যকার মৈত্রী খুব বেশী দিন স্থায়ী হয়নি। সে এর পরিবর্তে বিষয়টা প্রগলভ প্রশংসার সুরে এভাবে লেখে যে, এই দুই মহান নৃপতি একদা তাদের দুজনেরই শত্রু, এমন একজনকে ধ্বংস করতে তাদের শক্তি একত্রিত করেছিলেন।
হুমায়ুন পরের অনুচ্ছেদে সরাসরি একটা অনুরোধ জানাবার সিদ্ধান্ত নেয়: আমাকে অনেক প্রতিকুলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। বাংলা থেকে আগত এক উঁইফোঁড়, শেরশাহ, আমার পরিবর্তে এখন হিন্দুস্তান শাসন করছে যখন আমার সৎ-ভাইয়েরা কাবুল আর কান্দাহার আমার কাছ থেকে চুরি করে নিয়েছে এবং আমার নবজাত সন্তানকে বন্দি করে রেখেছে। আপনি নিজে একজন সম্রাট মহান একজন সম্রাট- এবং আমি নিশ্চিত, আপনি নিশ্চয়ই আমার দুর্দশার কথা অনুধাবন করতে পারবেন এবং সহানুভূতিশীল হবেন। পারস্যে আমাকে, আমার পরিবারকে আর আমার সাথের ক্ষুদ্রবাহিনীকে স্বাগত জানিয়ে রাজোচিত ঔদার্য প্রকাশের জন্য আমি আপনাকে অনুরোধ করছি।
তোমার কি মনে হয়? শেষে কিছু রীতিমাফিক আনুষ্ঠানিক সৌজন্য প্রকাশ করে চিঠিটা শেষ করে, কলম দোয়াতদানিতে নামিয়ে রেখে, হুমায়ুন হামিদাকে জিজ্ঞেস করে।
হামিদা কিছুক্ষণ চিন্তা করে। চিঠিটার বাক্য বিন্যাস সুচারু আর সেইসাথে অকপট আর খোলামেলা। শাহকে প্রভাবিত করা উচিত, চিঠিটার কিন্তু আদৌ সেটা হবে কিনা কে বলতে পারে। আমরা প্রায়শই আশা আর প্রতীক্ষায় অধীর হয়ে উঠি, কেবলই আশাহতের বেদনা সহ্য করবো বলে।
*
সুলতান, নদীর অগভীর অংশে আমরা পৌঁছে গেছি।
হাত দিয়ে চোখের উপরে একটা আচ্ছাদন তৈরী করে, হুমায়ুন পথ প্রদর্শকের আঙ্গুলিনির্দেশের দিকে তাকায় এবং সামনের ধুসর, সমতল ভূমির উপর পানির একটা স্রোতকে ঝিকিয়ে উঠতে দেখে- হেলমান্দ নদী। নদীর অপর পাড়ে অবস্থিত একটা অনুচ্চ দালানের ছাদে পতপত করে একটা লম্বা নিশান উড়ছে- খুব সম্ভবত নদী পারাপারের উপর নজর রাখছে এমন একটা পার্সী সেনাছাউনি। এই পথ দিয়েই নিশ্চিতভাবেই তিন কি চারদিন পূর্বে জওহর অতিক্রম করেছে, ধরে নেয়া যায় সেনাছাউনির আধিকারিক হুমায়ুনের আগমন প্রত্যাশা করছেন। অবশ্য একই সাথে, সতর্কতা বজায় রাখাটাও বাঞ্ছনীয়।
আহমেদ খান, সেনাছাউনির নিকটে গিয়ে সেখানকার পরিস্থিতি দেখে আসবার জন্য আপনার কয়েকজন গুপ্তদূতদের পাঠান ততক্ষণ আমরা বাকিরা এখানেই অপেক্ষা করি।
সুলতান, আমি নিজেই যাচ্ছি। আহমেদ খান তার দুজন অভিজ্ঞ লোককে ডেকে নিয়ে ধুসর মিহি ধূলোর একটা মেঘ মাথার উপর তৈরী করে দুলকি চালে ঘোড়া ছোটায়।
ঘোড়ায় টানা ছাউনি দেয়া এক্কা গাড়ির শেষ বসতিটা ছেড়ে আসবার সময় সে বেশ কয়েকটা এমন গাড়ি কিনেছে, অসুস্থ আর মেয়েদের পরিবহনের সুবিধার্থে- দিকে হুমায়ুন খুব ধীরে ধীরে ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে যায়, সেটাতে হামিদা আর গুলবদন ভ্রমণ করছে। কাঠের তৈরী ঝালর সরিয়ে ভিতরে উঁকি দিয়ে, সে দেখে হামিদা গভীর ঘুমে অচেতন আর গুলবদন কিছু একটা লিখছে নিঃসন্দেহে সেটা তাঁর রোজনামচা। তাঁদের দুজনকেই কৃশকায় আর ফ্যাকাশে দেখায়।
আমরা নদীর কাছে পৌঁছে গিয়েছি, হামিদার ঘুমে যাতে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্য কথাটা সে খুব আস্তে বলে। আহমেদ খান এসে যদি বলে যে সবকিছু ঠিকঠাক রয়েছে এবং পার্সীরা কোনো আপত্তি না জানালে আমরা নদী অতিক্রম করবো এবং সেখানে রাতেরমতো অস্থায়ী শিবির স্থাপন করবো। হামিদা কেমন আছে?
সে এখনও খুব কম কথা বলে…সে এমনকি আমার সাথেও কদাচিৎ নিজের অনুভূতি বা ভাবনার কথা আলোচনা করে।
আমি যেমন বুঝিয়েছি, তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা কর যে আমাদের সন্তানকে পুনরায় আমাদের কাছে ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত আমি বিশ্রাম নেব না। আমি যা কিছু করছি…অনাগত দিনগুলোতে যা করবো…আকবরকে ফিরে পাবার জন্যই আমি সেসব কিছু করবো।
তিনি খুব ভালো করেই জানেন যে, আপনার জন্যই তার শক্ত হওয়া উচিত কিন্তু শাহ আমাদের উপস্থিতি কিভাবে দেখবেন- সেটা নিয়ে তিনি খুব দুশ্চিন্তা করছেন…আর সেইসাথে কামরান আকবরের সাথে কেমন আচরণ করছে সেটাতো রয়েইছে।
হামিদা ঘুমের ভিতর নড়েচড়ে উঠলে, ঝালরের ভিতর থেকে হুমায়ুন মুখ বের করে আনে এবং তাঁর সৈন্যসারির সম্মুখভাগে পুনরায় ফিরে আসে। সংবাদের জন্য তাকে খুব বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। আহমেদ খান তার লোকজন নিয়ে রেকি করতে যাবার ঘন্টাখানেকের ভিতরে, হুমায়ুন তাঁদের সদলবলে ফিরে আসতে দেখে। তাঁদের ঠিক পিছনেই আরো দুজন অশ্বারোহীকে অনুসরণ করতে দেখা যায়। পুরো দলটা একটু কাছে আসতে হুমায়ুন দেখে যে একজন অশ্বারোহী যদিও অপরিচিত, অন্যজন দীর্ঘদেহী অবয়বের অধিকারী জওহর। শাহের সাথে দেখা করার জন্য সে এখনও কেন রওয়ানা হয়নি? শাহ্ কি পারস্যে তাঁদের প্রবেশের ব্যাপারে অসম্মতি জানিয়েছেন? কামরান কি আগে কোনোভাবে তার প্রশ্রয় লাভ করেছে? দুশ্চিন্তায় অধীর হয়ে উঠে, সে তাদের সাথে দেখা করার জন্য ঘোড়ার পাঁজরে খোঁচা দেয়।
সুলতান। আহমেদ খান মিটিমিটি হাসছে। খবর সব ভালো, সে আগন্তুকের দিকে ইঙ্গিত করে, ইনি আব্বাস বেগ, সিস্তান প্রদেশের প্রশাসক, আপনার সাথে পারস্যের অভ্যন্তরে প্রতিরক্ষা-সহচর হিসাবে যাবার জন্য তিনি এসেছেন।
আব্বাস বেগ, গাঢ় বেগুনী রঙের মখমলের চমৎকার পোষাক পরিহিত কালো শুশ্রুমণ্ডিত বছর চল্লিশেকের দীর্ঘদেহী এক লোক এবং তার মাথার উঁচু করে বাঁধা উষ্ণীষে সাদা সারসের একটা লম্বা পালক অলঙ্কৃত বন্ধনী দিয়ে আঁটকানো, ঘোড়া থেকে নেমে এসে হুমায়ুনের সামনে নতজানু হয়ে কুর্নিশ করে। সুলতান, আপনার বার্তা আমি শাহের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমাদের দ্রুতগামী বার্তাবাহকেরা দিনে আশি মাইল পথ অতিক্রম করতে সক্ষম। আমাকে পরামর্শ দিতে কিভাবে যথাযথ মর্যাদায় আপনাকে স্বাগত জানানো যায় আমি আপনার প্রতিনিধিকে এখানে অবস্থান করতে অনুরোধ করেছি। সবকিছু প্রস্তুত রয়েছে। আপনাকে কেবল নদীর অগভীর অংশ দিয়ে ওপারে যেতে হবে।
হুমায়ুনের বুকের উপর থেকে একটা বিশাল বোঝা যেন নিমেষে নেমে যায়। গত কয়েক মাসের ভিতরে এই প্রথম তার পরিবার আর তাঁর অনুগামী লোকেরা রাতে কোথায় ঘুমাবে, খাবারের জোগান আছে কিনা, তাঁর লোকেরা আক্রমণের হাত থেকে নিরাপদ কিনা, এসব বিষয়ে তাকে আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না। সে এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে এবং কৃতজ্ঞতায় সে মাথা নত করে তারপরেই স্বমূর্তি ধারণ করে বলে, আব্বাস বেগ আমার ধন্যবাদ গ্রহণ করবেন। আপনার কথাগুলো দারুণ প্রীতিকর।
বেশ তাহলে, পৃথিবীর অধিশ্বর, শাহ্ তামাস্পের নামে, আমি আপনাকে পারস্যে স্বাগত জানাচ্ছি।
*
একশ পরিচারকের দল সামনের রাস্তা ঝাড় দেয় এবং ধূলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে গোলাপজল ছিটায়। হুমায়ুন আর তার সঙ্গীসাথীদের সামনে চমৎকার বস্ত্রাদিশোভিত এক হাজার অশ্বারোহীর একটা দল দুলকি চালে এগিয়ে যায়, যাদের শাহ্ পাঠিয়েছেন এখান থেকে সাতশ মাইল উত্তরপশ্চিমে, তার রাজধানী, কাঝভিনে, তাদের প্রতিরক্ষা সহচর হিসাবে অনুগামী হতে। পার্সী ঘোড়ার পিঠে হুমায়ুনের নিজের লোকেরাও সমান জাক-জমকপূর্ণ ভঙ্গিমায় আসীন- হুমায়ুনের জন্য রয়েছে কালো স্যাবলের চামড়ার উপরে সোনার কারুকাজ করা লাগামসহ ঘোড়ার মাথার সাজ এবং পর্যান। হামিদা আর গুলবদন মখমলের আস্তরন দেয়া, গিল্টি করা গরুর গাড়িতে অবস্থান করছে যেগুলো টানছে সাদা ষাড়ের দল, যাদের শিঙে মোগলদের সবুজ রঙের ফিতে জড়ান রয়েছে।
হুমায়ুন সীমান্ত অতিক্রম করে পারস্যে প্রবেশের তিন সপ্তাহ পরে শাহ্ তামাস্পের কাছ থেকে তার প্রেরিত চিঠির উত্তর এসে পৌঁছে। তিন পৃষ্ঠাব্যাপী মাত্রাছাড়া সৌজন্যসূচক কথা শেষ হয়েছে এই শব্দগুলো দিয়ে আপনি আমার ভাই, সার্বভৌম ক্ষমতার এক মূল্যবান রত্ন, পৃথিবীকে আলোকিত করা সূর্য- যার দীপ্র প্রভার কাছে ম্লান হয়ে যায়। কাঝভিনে আমার দরবারে আপনাকে স্বাগত জানাবার সুখকর অভিজ্ঞতা আমি লাভ না করা পর্যন্ত আমার দিনগুলো অসার মনে হবে।
হুমায়ুন তার যাত্রাপথে যেসব শহর আর প্রদেশে যাত্রাবিরতি করবে তার প্রতিটার শাসকের কাছে হুমায়ুনের স্বাচ্ছন্দ্য আর আনন্দের জন্য পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ প্রদান করে, লিখিত আদেশ, ফরমান, শাহ্ আগেই প্রেরণ করেছেন। হুমায়ুন এসব জানে কারণ প্রতিটা ফরমানের অনুলিপি শাহ্ তাকেও পাঠিয়েছেন- চারপাশে সোনার প্রান্তযুক্ত মোটা কাগজের উপরে লেখা- যেটা রয়েছে হাতির দাঁতের বাক্সে যাতে আমার ভাই জানতে পারে যে তাঁকে স্বাগত জানাবার কোনো প্রয়াসই আমি বাদ দেইনি।
প্রতি রাতে রাজকীয় কাফেলা ঠিক কোথায় যাত্রা বিরতি করবে শাহ্ সেটাও আদেশ দিয়েছেন, যাতে করে, সারা দিনের যাত্রা শেষে বিশ্রামের সময় মখমল আর রেশমের চাঁদোয়াযুক্ত সুক্ষ কারুকাজ করা সাদা কাপড়ের তাবু ইতিমধ্যে টাঙানো আর অপেক্ষমান অবস্থায় দেখতে পায় তারা। প্রতিটা রাতই রসনা তৃপ্তিকর ভোজনের নতুন অভিজ্ঞতা বহন করে আনে- দুধ আর মাখন সহযোগে উনুনে ঝলসানো মিষ্টি সাদা রুটি ভর্তি সোনালী বারকোশ এবং রুটির উপরে আফিম আর সুগন্ধিযুক্ত হলুদ পুষ্পবিশিষ্ট সজির বীজ ছড়ান রয়েছে, সাথে পাঁচশ ভিন্ন ভিন্ন স্বাদযুক্ত পদ- আখরোটের সসে ফোঁটান হাঁসের মাংস, শুকনো লেবু আর নাশপাতির আচারে রান্না করা কচি ভেড়া- সোনালী আর রূপালি তবক দেয়া সব ধরনের বাদাম, ভেতরে মধু আর কুচো করা বাদামের পুর দেয়া শুকনো খুবানি এবং গোলাপজল ছিটানো স্তূপীকৃত মিষ্টান্ন এবং উপরে মোতির মতো দেখতে ডালিমের দানা ছিটানো রয়েছে।
প্রতিটা দিনই নতুন উপঢৌকনের আগমন ঘটতে দেখা যায়- হুমায়ুনের জন্য সোনার কারুকাজ করা বুটিদার রেশমি কাপড় দিয়ে তৈরী পোষাক এবং রত্নখচিত খঞ্জর এবং হামিদা আর গুলবদনের জন্য শাহের ভগিনী শাহজাদা সুলতানাম পাঠান হলুদাভ বাদামি পাথর অ্যাম্বার আর উৎকৃষ্ট সুগন্ধি। উপঢৌকনের বদান্যতা থেকে হুমায়ুনের অবশিষ্ট ভ্রমণসঙ্গীরাও বাদ যায় না। তার লোকদের জন্য শাহ্ তামাস্প অস্ত্রের শ্রেষ্ঠ কারিগরদের দ্বারা তৈরী খঞ্জর আর তরবারি পাঠিয়ে দেন। প্রত্যেকের জন্য নতুন কাপড় আসে। পরিশ্রান্ত, ছেঁড়া কাপড় পরিহিত যে দলটা হেলমান্দ নদী অতিক্রম করেছিল রাতারাতি তাদের পরিস্থিতি বদলে যায়।
কিন্তু সপ্তাহ অতিক্রান্ত হবার সাথে সাথে খুবানি আর জামের বেষ্টনীযুক্ত বাগানের ভিতর দিয়ে এবং নদীর তীরের ঝুঁকে আসা উইলোর সারি বরাবর এগিয়ে গিয়ে তাঁরা যতই কাঝভিনের নিকটবর্তী হতে থাকে, হুমায়ুন তখনও তাঁকে বিব্রত করতে থাকা প্রশ্নটার কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। শাহ্ তামাস্প এহেন বাড়াবাড়ি ধরনের আতিথ্য প্রদর্শন করছেন কেন? এর কারণ কি কেবলই হুমায়ুনকে অভিভূত করা? মোগল সম্রাট তাঁর কাছে শরণ নেয়া ব্যাপারটা তাঁর অহংবোধকে আপুত করেছে, নাকি এর পেছনে আরও গূঢ় কোনো রহস্য রয়েছে?
কাশিম আর জাহিদ বেগের সাথে হুমায়ুন তার এই অস্বস্তির বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করলেও সে খুব ভালো করেই জানে হামিদার সাথে এই বিষয় নিয়ে সে কোনো রকমের আলোচনা করতে পারবে না। শাহের বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবের প্রতিটা উপলক্ষ্য যেন হামিদাকে তার হারিয়ে যাওয়া প্রাণশক্তি ফিরিয়ে দেয়- আশার বাণী হয়ে যা তার চোখের পাতায় স্পষ্ট উচ্চারিত হয়, যে সৎ-ভাইদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এবং আকবরকে পুনরায় নিজেদের কাছে ফিরে পেতে শাহ তামাস্প নিশ্চয়ই হুমায়ুনকে সহায়তা করবেন। হামিদার ধারণা অবশ্য একদিক দিয়ে দেখতে গেলে ঠিকই আছে। শাহের সত্যিকারের অভিসন্ধি যাই হোক এবং পুরোটাই হয়তো যথাযথভাবে হিতসংকল্প- তার সাথে তাকে অবশ্যই মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে…
অবশেষে এক গ্রীষ্মের সকালে, সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হয় হুমায়ুন একাগ্রচিত্তে যার প্রতিক্ষা করেছিল। কাঝভিনের নিকটবর্তী এক উজ্জ্বল পুষ্পশোভিত প্রান্তরে, শাহ্ তামাস্প, দশ হাজার অশ্বারোহীবাহিনী পরিবেষ্টিত অবস্থায় মোগল সম্রাটকে স্বাগত জানাবার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। শাহের কাছ থেকে কি প্রত্যাশা করা উচিত হুমায়ুন এতোদিনে সে সম্বন্ধে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, এবারও প্রতিটা বিষয়ের খুঁটিনাটি সম্বন্ধে আগে থেকেই ভেবে রাখা হয়েছে- হুমায়ুন যেখানে ঘোড়া থেকে নামবে, তাঁর লোকেরা যেখানে অপেক্ষা করবে, প্রতিটা স্থান আগে থেকেই নির্ধারিত, গাঢ় লাল রঙের পুরু গালিচা বিছান একটা পথ যার উপরে শুকনো গোলাপের কুড়ি ছড়ান রয়েছে প্রান্তরের একেবারে কেন্দ্রস্থলের দিকে এগিয়ে গিয়েছে, যেখানে সোনালী রঙের একটা বিশাল বৃত্তাকার গালিচা বিছান রয়েছে সূর্যের আলোয় এর রেশমের কারুকাজ দীপ্তি ছড়াচ্ছে।
শাহ্ গালিচার ঠিক কেন্দ্রে একাকী দাঁড়িয়ে রয়েছেন, তাঁর সৈন্যেরা প্রায় পঞ্চাশ গজ পেছনে সুবিন্যস্ত ভঙ্গিতে দণ্ডায়মান, আজ তাঁর পরনে টকটকে লাল মখমলের পোষাক আর মাথায় টকটকে লাল রেশমের উপর সোনার জরি দিয়ে কারুকাজ করা লম্বা, সূচালো অগ্রভাগযুক্ত রত্নখচিত উষ্ণীষ। হুমায়ুন ভালো করেই জানে শাহের মাথার ঐ উষ্ণীষ কিসের লক্ষণ। এটা হল তাজ- ইসলামের শিয়া ধর্মাবলম্বীদের প্রতীক। হুমায়ুন গালিচার প্রান্তদেশের দিকে এগিয়ে যেতে তামাস্প তাঁর দিকে এগিয়ে আসে এবং তার কাঁধ জড়িয়ে ধরে হাসিমুখে তাকে আলিঙ্গন করে। সে তারপরে হুমায়ুনকে একটা বিশাল তাকিয়ার দিকে নিয়ে যায় এবং নিজের ডানপাশে হুমায়ুনকে বসতে দিয়ে নিজে তার পাশে উপবেশন করে।
আমার ভাই, আপনাকে স্বাগত জানাই। হুমায়ুন এবার ভালো করে তাকিয়ে দেখে তামাস্প তার সমবয়সীই হবে, কাটা কাটা মুখাবয়ব, ফ্যাকাশে ত্বক আর ঘন ভ্রর নীচে জ্বলজ্বল করতে থাকা কালো চোখের অধিকারী এক ব্যক্তি।
আপনার আতিথিয়তার জন্য আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ। পারস্যের গৌরবগাঁথার কথা আমি শুনেছি এবং এখন আমি স্বচক্ষে সেটা প্রত্যক্ষ করলাম।
তামাস্প মৃদু হাসেন। আপনার যাত্রাকালীন সময়ে এমন কিই আর আমি আপনার জন্য করতে পেরেছি, আমি মোগলদের যে জৌলুসের কথা শুনেছি তাঁর সাথে তুলনা করতে গেলে আমি নিশ্চিত এসব কিছু ধোপেই টিকবে না।
হুমায়ুন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাঁর আতিথ্যকর্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তামাস্প খুব ভালো করেই জানে পারস্যে তাঁর পালিয়ে আসার মাঝে জৌলুসপূর্ন কিছুই নেই। তার এসব খোসামুদি শব্দের আড়ালে কি কোনো মর্মভেদী খোঁচা রয়েছে? সহস্রাধিক উৎসুক দৃষ্টির ব্যাপারে সচেতন দৃষ্টি যারা দেখতে পাবে সে কি করতে চলেছে হুমায়ুন সহসা একটা সিদ্ধান্ত নেই। সে নিশ্চয়ই তাদের দেখিয়ে দেবে যে সে মোটেই একজন ভিক্ষুকের ন্যায় পারস্যে আসেনি। সে এমন জাঁকালো সদিচ্ছাজ্ঞাপক একটা পদক্ষেপ নেবে, এমনকি অসম্ভব সমৃদ্ধশালী পারস্যেও যেটা নিয়ে পুরুষানুক্রমে আলোচনা হবে- এমন একটা সদিচ্ছাজ্ঞাপক পদক্ষেপ যা পারস্যের শাসকেও তাঁর কাছে ঋণী করে তুলবে।
শাহ তামাস্প আমি হিন্দুস্তান থেকে আপনার জন্য একটা উপহার নিয়ে এসেছি। হুমায়ুন তার আলখাল্লার গলার ভেতরে হাত দিয়ে ফুলের ছোপঅলা রেশমের একটা বটুয়া বের করে আনে যার ভেতরে, কঠিন আর বিপদসঙ্কুল পুরোটা সময় ধরে সে তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ নিজের হৃদয়ের কাছে সংরক্ষণ করেছে। ইচ্ছাকৃত আলস্যে হুমায়ুন বটুয়ার ভেতর থেকে কোহ-ই-নূর বের করে এনে সেটাকে শূন্যে তুলে ধরে যাতে সূর্যের আলো এসে পড়ে। নক্ষত্রের দীপ্তিতে পাথরটা ঝলসে উঠে এবং হুমায়ুন শাহ তামাস্পকে সশব্দে শ্বাসরোধ করতে শোনে।
আমাকে যদি এতটা দিন পথে কাটাতে না হত, আপনার জন্য আমি নিশ্চয় আরও মূল্যবান কিছু খুঁজে পেতাম। কিন্তু এই উজ্জ্বল ঝকমকে পাথরটা আমার বিশ্বাস আপনাকে প্রীত করবে। এই পাথরটাকে কোহ-ই-নূর, আলোর পর্বত, বলা হয়। আশা করি আমাদের চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব এবং সেই সাথে শাহ্ তামাস্প আপনাকেও এর আলো উদ্ভাসিত করবে।