নীলদর্পণ বইখানি নিয়ে ইংরেজ সরকার এক মজার মুশকিলে পড়ে গেল।
সরকারের গোচরে আনা পাদ্ৰী লঙের কর্তব্য। লঙ সাহেব সেই অনুযায়ী নীলদর্পণের সারমর্ম জানালেন বাংলার লেফটেনান্ট গভর্নরের সেক্রেটারি সীটন-কার সাহেবকে। এবং লঙ যেহেতু দেশীয় লোকদের অবস্থা উন্নয়নে আগ্রহী, সেই কারণে তাঁর কণ্ঠস্বরে খানিকটা আবেগও ফুটেছিল।
সীটন-কার-এর বয়েস কম, একটু আদর্শবাদী ধরনের, ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে সজাগ। তা ছাড়া, বড়লাট লর্ড ক্যানিং এবং ছোটলাট জন পিটার গ্রান্ট দুজনেই যদিও কলকাতায় অধিষ্ঠিত, তবু বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি শাসনের সব ঝক্কিঝামেলা সেক্রেটারি সীটন-কারকেই পোহাতে হয়। সিপাহী যুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি এখনো সকলের মনে জাগরকে। নিরীহ প্রজাদের ওপর বেশী অত্যাচার চালালে আবার না একটা অগ্ন্যুৎপাত ঘটে যায়। সুতরাং সীটন-কার এই বিষয়টি তাঁর ওপরওয়ালা জন পিটার গ্রান্টকে অবহিত করালেন অবিলম্বে।
গ্রান্ট এদেশে চাকরি করছেন অনেকদিন। পদোন্নতি হতে হতে বাংলার লেফটেনাণ্ট গভর্নর হয়েছেন। এদেশের গ্রাম গঞ্জের অবস্থা সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট অবহিত। এত বড় একটা দায়িত্বপূর্ণ পদ পাবার পর তিনি প্রথম কিছুদিন পূর্ণ উদ্যমে কাজ শুরু করেছিলেন, ইদানীং সেই উৎসাহে ভাঁটা পড়েছে। বয়েসও হয়েছে যথেষ্ট, তিনি জানেন, আর তাঁর পদোন্নতির আশা নেই, ছোট লাট থেকে বড় লাট হওয়া তাঁর পক্ষে আর সম্ভব হবে না, তার আগেই অবসর নিতে হবে। এই অবস্থায় উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা খানিকটা আলস্যে গা ভাসিয়ে দেয়।
প্রবল গ্রীষ্মের সন্ধ্যা। গ্রান্ট তাঁর চৌরঙ্গি সম্মুখবর্তী আলয়ের দ্বিতলের বারান্দায় হালকা কুর্তা গায়ে বসেছিলেন। বিকেলের শেষাশেষি বঙ্গোপসাগরের দিক থেকে কিছুক্ষণ প্রবল বাতাস ছুটে আসে কলকাতার দিকে, সেইটুকুই যা আরামের। বাঁ হাতে ছোটা পেগ, ডান হাতে আলবোলার নল, দেশীয় প্রথায় ধূমপানের অভ্যেস হয়েছে তাঁর কিছুদিন। এই সময় জরুরি কাজে সীটন-কার দেখা করতে এলেন।
নীলদর্পণ বইটির বিষয়বস্তু শুনে ভ্ৰ কুঞ্চিত করলেন গ্রান্ট। অলস হলেও তিনি বিচক্ষণ ব্যক্তি। নাটকটিতে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র গ্রামের চাষী একযোগে প্রতিরোধ করতে নেমেছে, এ ঘটনা যদি সত্যি হয়, তা হলে সত্যিই আশঙ্কার কথা। গ্রামের নিরীহ গরিব চাষী আবহমানকাল ধরেই নিপীড়িত হয়ে আসছে। কিন্তু ধনবান বা শিক্ষিত শ্রেণী কখনো চাষীদের পাশে দাঁড়ায় না, তাঁরা চেষ্টা করে সরকারের পক্ষে থাকতে। নবীনামাধব এবং তোরাপের স্বাৰ্থ আলাদা, নবীনামাধবদের পরিবার তো ইচ্ছে করলেই কিছু অর্থ ব্যয় করে সব মিটমাট করে নিতে পারতো, তবু তারা কেন তোরাপ ক্ষেত্রমাণিদের হয়ে লড়াই করতে গেল? এর মধ্যে বিপদের বীজ আছে। এইভাবেই বিদ্রোহ শুরু হয়।
বিষয়টি নিয়ে গ্রান্ট কিছুক্ষণ আলোচনা করলেন সীটন-কার-এর সঙ্গে। সীটন-কারেরও বক্তব্য এই যে শুধু গ্রামের মধ্যবিত্ত নয়, এমনকি শহরের কিছু কিছু বুদ্ধিজীবী, যাদের সঙ্গে জমিজমার কোনো সম্পর্কও নেই, তারাও চাষীদের পক্ষ নিয়ে কথা বলছে। ইণ্ডিগো কমিশানে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে আগুন ছোটাচ্ছে হরিশ মুখুজ্যে। এই হরিশ মুখুজ্যের কী সম্পর্ক গ্রামের চাষীদের সঙ্গে? যার নিজের কোনো জমি-জমা নেই। এটা একটা নতুন ঝোঁক।
গ্রান্ট জিজ্ঞেস করলেন, এই নাটকের একটি ইংরাজী অনুবাদ করানো সম্ভব কী? তাহা হইলে রাজকর্মচারীরা ইহা পাঠ করিয়া বর্তমান অবস্থার চিত্রটি সম্যক অনুধাবন করিতে পারিত!
সীটন-কার বললেন, ইহার অনুবাদ করা শক্ত কিছু নহে। লঙের সহিত বহু শিক্ষিত নেটিভের যোগাযোগ রহিয়াছে, সে অনায়াসেই সত্বর অনুবাদের ব্যবস্থা করিতে পারে।
গ্রান্ট বললেন, তাহা হইলে অনুবাদ সংগ্ৰহ করিয়া। আপনি আমাদের ব্যয়ে তাহা মুদ্রণের ব্যবস্থা করুন। যাহাদের যাহাদের আপনি উপযুক্ত মনে করিবেন, তাহাদের নামে এক কপি বই প্রেরণ করুন। আমাদিগের সকলের ইহা জানা দরকার।
এই নির্দেশ দিয়ে গ্ৰাণ্ট কয়েকদিন পরেই চলে গেলেন মফঃস্বল পরিদর্শনে।
অনুবাদ তো লঙের কাছে প্ৰস্তুত। কালক্ষেপ না করে তা মুদ্রণের ব্যবস্থা হলো। সরকারি খরচে সীটন-কার পাঁচশো কপি ইংরেজি নীলদর্পণ ছাপিয়ে তার এক এক কপি সরকারি লেফাফয় ভরে শুধু এদেশের নয়, ইংলণ্ডেরও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে প্রেরণ করতে লাগলেন। এর পর বারুদে অগ্নি সংযোগ হলো।
ইংরেজি কেতাবখানির সন্ধান পেয়ে ক্রুদ্ধ নিশ্বাস ছাড়তে লাগলো নীলকর সাহেবরা। ইংলিশম্যান নামে সংবাদপত্র হৈ হৈ রৈরৈ তুললো। ইংরেজ ব্যবসায়ীদের শক্তিশালী সংস্থা ল্যাণ্ড হোন্ডার্স অ্যাণ্ড কমার্শিয়াল অ্যাসোসিয়েশন কড়া ভাষায় বাংলা সরকারের কাছে এক পত্র লিখে জানতে চাইলো, সরকারি উদ্যোগেই এ গ্রন্থ প্রকাশিত ও বিতরিত হয়েছে কি না। যে গ্রন্থে ইংরেজ জাতিকে এত হেয় করে দেখানো হয়েছে, ইংরেজ সরকারই সে রচনার পৃষ্ঠপোষক! সমস্ত নীলকরদের চিত্রিত করা হয়েছে অমানুষ হিসেবে, খুন ও ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছে ইংরেজের নামে, নীলকর পত্নীর সঙ্গে জেলা ম্যাজিসট্রেটের প্রণয়ের ইঙ্গিত করে ইংরেজ ললনাদের সতীত্বে কুৎসা আরোপিত হয়েছে, এমনই একটি কদৰ্য, বিদ্বেষমূলক অপকৃষ্ট পুস্তকের জন্য ব্যয়িত হয়েছে সরকারি অর্থ?
চিঠি পেয়ে সরকার একেবারে অপ্ৰস্তুতের একশেষ। ব্যাপারটা তো এদিক থেকে ভালো করে খুঁটিয়ে দেখা হয়নি। সরকারি স্বীকৃতি মানেই গ্রন্থটির সব অভিযোগ স্বীকার করে নেওয়া। ব্যবসায়ীদের চটিয়ে কখনো সরকার চালানো যায়? নীলকরদের খানিকটা সংযত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন বটে সরকার, তা বলে তাদের একেবারে বিরুদ্ধবাদী করে তোলা যায় কি? নেটিভদের এতখানি প্রশ্ৰয়ই বা দেওয়া চলে কী করে? স্বয়ং বড় লাট লর্ড ক্যানিং পর্যন্ত এই গ্ৰন্থ প্রকাশের ব্যাপারে বিব্রত ও ক্রুদ্ধ হলেন।
বেগতিক দেখে নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে গেলেন গ্রান্ট। তিনি জানালেন যে সে সময় তিনি মফঃস্বল পরিদর্শনে ব্যস্ত ছিলেন, সব ব্যাপারটা তিনি জানেন না। সরকারি খরচে মুদ্রণের নির্দেশও কি তিনি দেননি? গ্ৰন্ট জানালেন যে তিনি বলেছিলেন বটে যে আমাদের খরচে, স্পষ্টাক্ষরে সরকারি ব্যয়ের কথা তো বলেন নি?
তাহলে সব দায়িত্ব সীটন কার-কেই নিতে হয়। কিন্তু বাংলা সরকারের সেক্রেটারি প্রকৃতপক্ষে সরকারের মুখপাত্র, তাঁর অবমাননায় সরকারেরই অবমাননা। সুতরাং সরকারের পক্ষ থেকে ঐ চিঠির উত্তরে জানানো হলো যে, নীলদর্পণ প্রকাশের ব্যাপারটা সরকারের পক্ষে একটা অনিচ্ছাকৃত ভুল হয়ে গেছে, সেজন্য সরকার অনুতপ্ত।
কিন্তু ল্যাণ্ড-হোল্ডার্স অ্যাণ্ড কমার্শিয়াল অ্যাসোসিয়েশনের সভ্যুরা ওতে শান্ত হলো না, তারা হাইকোর্টে ঐ গ্রন্থের লেখক, প্রকাশক এবং অনুবাদকের নামে মামলা দায়ের করলো।
বাংলা বইটিতে যেমন, তেমন ইংরেজি অনুবাদ গ্রন্থটিতেও লেখক, অনুবাদক, প্রকাশকের কোনো নাম নেই। দীনবন্ধু মিত্র ও মধুসূদন দত্তের নাম সযত্নে গোপন রাখা হয়েছে। ইংরেজি অনুবাদে শুধু মুদ্রাকর হিসেবে ছাপাখানার মালিক ম্যানুয়েল নামে এক সাহেবের নাম রয়েছে। সে বেচারিকেই শমন পাঠালো আদালত। যেহেতু ইংরেজি গ্রন্থ নিয়েই মামলা, তাই প্রকাশক হিসেবে বাংলা সরকারের দুই প্রতিনিধি গ্রান্ট এবং সীটন-কারেরই এগিয়ে আসা উচিত, কিন্তু তাঁরা ঢোঁক গিলে বসে রইলেন এবং খুঁজতে লাগলেন একজন বলির পাঠা।
খোঁজার প্রয়োজন অবশ্য অবিলম্বেই ফুরিয়ে গেল, নির্দোষ ম্যানুয়েল সাহেবের সাজা হবে ভেবে এগিয়ে এলেন পাদ্ৰী লঙ, তিনি জানালেন, এই গ্রন্থের সব কিছুর জন্য তিনি এক দায়ী। আদালতের সামনে তিনি ধীর শান্ত গলায় বললেন, যতদিন আমি জীবিত আছি, যতদিন আমার মস্তিষ্কে চিন্তাশক্তি থাকিবে ততদিন আমি দরিদ্র জনসাধারণের উন্নতির চেষ্টা করিয়া যাইব। আমি খৃষ্টান এবং ইহাই খৃষ্টানের প্রকৃত ধর্ম।
শুরু হয়ে গেল নীলদর্পণের মামলা।
নবীনকুমার তখন একদিকে মহাভারত অন্যদিকে হুতোমের নকশা রচনায় ব্যাপৃত। এই সময় হরিশ মুখুজ্যে তাকে একটি চিঠি পাঠালেন। কিছুটা শ্লেষ ও পরিহাসের সঙ্গে হরিশ লিখেছেন,
বেরাদর, বেশ কিছুকাল তোমার দর্শন পাই না, তবে তোমার অগ্ৰজ মারফৎ তোমার সুকীর্তির কিছু সংবাদ পাই। আমোদ-প্ৰমোদ সব বাদ দিয়া একেবারে কর্মবীর হইয়া উঠিলে। সমগ্ৰ মহাভারতের অনুবাদ করিতেছ। অহো কী মহীয়সী কীর্তি! ভবিষ্যৎ বংশধরেরা তোমায় ধন্য ধন্য করিবে, অবশ্য যদি ভবিষ্যতে এ দেশের মানুষ টিকিয়া থাকে! শত সহস্ৰ মানুষ অনাহারের সম্মুখীন, নীলকরের অত্যাচারে গ্রামের পর গ্রামে আগুন জ্বলিতেছে, দেশ ছারখার হইয়া গেল, এই সময় মহাভারতের মতন পুণ্য গ্ৰন্থ রচনাই যোগ্য কাজ বটে।
আরও শুনিয়াছি, তুমি কবিবর মাইকেল দত্ত এস্কোয়ারকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপনের জন্য এক মহতী সভার আহ্বান করিয়াছিলে। তিনি প্ৰকাণ্ড কবি, আমি যদিও এক অক্ষরও পাঠ করি নাই, তবু লোক মারফৎ শুনিলাম দত্ত কবি মেঘনাদ বধ কাব্য রচনার নামে রামায়ণকেই বধ করিয়া ছাড়িয়াছেন! তাঁহাকে মানপত্র দেওয়ায় নববাবু সমাজের যোগ্য কাজই হইয়াছে বলিতে হইবে। বুলবুলির লড়াই ও বাঈ নৃত্য দর্শন ছাড়িয়া এক্ষণে কাব্যকলা লইয়া মত্ত হইবারই উপযুক্ত সময় বটে। তোমাকে দেখিয়া ভাবিয়ছিলাম তুমি কিঞ্চিৎ বেতর পথে চলিবে, পিতৃসঞ্চিত অর্থ সমুচিত কার্যে ব্যয় করিবে।
এত তোমার পুস্তক প্রীতি, নীলদর্পণ নামে একটি কেতাব বাহির হইয়াছে, তাহার সংবাদ রাখো কি? গ্ৰন্থকার কে তাহা জানি বটে, কিন্তু নাম বলিব না। তবে নীলকরদিগের অত্যাচারের বড়ই সত্য, বড়ই মৰ্মদ্ভদ চিত্র অঙ্কিত তিনি করিয়াছেন। সে গ্ৰন্থ প্রচারেরও বুঝি উপায় রহিল না, বাঘা বাঘা সাহেবরা ভুকু মামলায় ফাঁসাইয়াছে পাদ্ৰী লঙ সপ্তরিখীর বিরুদ্ধে অভিমন্যুর মতন একাকী আর কতদিন লড়িবে!
আমারও বোধ করি নিষ্কৃতি নাই। আমি ইণ্ডিগো কমিশানে সাক্ষ্য দিয়া সকল প্রকৃত তথ্য উদঘাটন করিতেছি বলিয়া কুপিত ইংরাজগণ আমারও নামে মোকদ্দমা আনিয়া আমাকে সর্বস্বান্ত করিবার উদ্যোগ করিতেছে। তবে আমার জন্য চিন্তা করিয়ো না, আমার শরীরে অসুরের শক্তি, ইংরেজ বেটাদের অপেক্ষা আমার মেধাও বেশী। আমি আরও কিছু না হউক পঞ্চাশ বৎসর বাঁচিব এবং ও বেটাদের সহিত লাঠালাঠি করিয়া যাইব। তুমি শরীফ মেজাজে রহিয়ে, এই মনস্কামনা জানাই।
পত্রটি পেয়ে রীতিমতন ক্ষুব্ধ হলো নবীনকুমার। সে চাটকারদের পছন্দ করে না বলেই এক সময় হরিশ মুখুজ্যের সাগরেদী করতে গিয়েছিল। কিন্তু হরিশ এবার তাকে অন্যায্য কটাক্ষ করেছে। তৎক্ষণাৎ সে কাগজ কলম নিয়ে উত্তর রচনা করতে বসলো।
বন্ধু,
ক্ষুধার্ত মানুষের কাচে সৌন্দর্যের কোনো মূল্য নেইকো, তা বলে সব সুন্দর জিনিস মুচে ফেলতে হবে? যে লোক না খেয়ে রয়েচে, বসরাই গোলাপের কোনো কদর নেই তার কাচে, কারণ গোলাপ-টগর-চাঁপা এগুলো তার খাদ্য নয়, খেলে পেটও ভরে না। সেইজন্য তুমি পৃথিবী থেকে সব ফুলগাচ উপড়ে ফেলতে চাও? গ্রাম দেশে রায়তরা কষ্ট পাচ্চে, তাদের কষ্ট দূর কত্তে তো হবে বটেই, যেমন তুমি চেষ্টা কচ্চো, তা বলে লোকে মহাভারত পড়বে না? কবিরা মাতৃভাষার সাধনা কর্বে না? কতায় বলে, অক্ষরে পণ্ডিত তুষ্ট, ফুলে তুষ্ট ভোমরা,/ক্ষুধা ভোজনে তুষ্ট, কিলে তুষ্ট বর্বরা—। যার যা কাজ তার তা সাজে, নইলে সব যজ্ঞিই নষ্ট। চাষীদের দুর্দশা ঘুচোবার জন্য শুধু সেদিকেই সবাই মন দেবে, আর ইদিকে নব্য শিক্ষিত ছোঁড়াগুলো বাংলা ভাষার অনাদর করে শুদু ইংরিজি ফড়ফড়াবে, কিংবা দলে দলে কেরেস্তান হয়ে যাবে, এটাই বা কেমন কতা! মধুসূদন দত্ত সাহেবমন্য ও ইংরেজিতে কৃতবিদ্য ব্যক্তি, তিনি যে বাংলার জন্য লেখনী ধারণ কচ্চেন এবং এমন অত্যুৎকৃষ্ট কাব্য উপহার দিয়েচেন সেজন্য অমরা ধন্য ও কৃতজ্ঞ। তাঁর গুণের সমাদর না কল্লে আমাদের এই কুঁদুলে বাঙালী জাতির উপযুক্ত কাজই হয় বটে! নীলদর্পণ আমি পড়িচি, লেকাটি তেমন সরেশ নয়, একটাও সাহেব মল্লে না, আর দিশি ক্যারেকটারগুলো পটাপট মরে গ্যালো, এ কেমন? অবশ্য সোসিয়াল রিফর্মেশানের জন্য এই প্রকার নাটকের মূল্য খুবই আচে। তোমার শরীরে এখুনো অসুরের মতন শক্তি জেনে বড় প্রীত হলেম। এত বল কোতায় পাও! এত ব্যস্ততার মধ্যেও যে মাদৃশ সামান্য ব্যক্তিকে স্মরণে রেকেচো তাতে যার-পর-নাই সুখী হয়িচি।…
এই পত্র লেখা সত্ত্বেও অবশ্য নবীনকুমার নীলদর্পণ মামলার প্রতি আকৃষ্ট হলো। গঙ্গানারায়ণের কাছ থেকে এর আগেই সে নীলদর্পণ গ্ৰন্থ সংক্রান্ত সমস্ত ঘটনা শুনেছে। মধুসূদনের জন্য তাঁর বন্ধুরা চিন্তিত, কোনোক্রমে অনুবাদক হিসেবে তাঁর নাম ফাঁস হয়ে গেলে তাঁকে বিপদে পড়তে হবে। চাকুরিও হারাতে হতে পারে। সেইজন্য সব প্ৰমাণপত্র বিলোপ করা হয়ে গেছে। পাদ্ৰী লঙ অবশ্য আদালতে অবিচল, তিনি আর কারুকে জড়াতে চান না।
বিচারের সময় প্রতিদিন আদালত লোকে লোকরণ্য। ব্যবসায়ী ইংরেজরা তো আসছেই, তাছাড়া দেশীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যেও অনেককে দেখা যায়। এমন বিচার-প্রহসন বহুদিন দেখা যায়নি। সাহেবের আদালতে সাহেবের বিচার, যদিও উপলক্ষ সাধারণ নিপীড়িত প্ৰজাবৃন্দ। সকলেই জানে যে পাদ্ৰী লঙ এ নাটক রচনাও করেননি, প্রচারের দায়িত্বও তাঁর নয়। তবু সেই লঙকেই শাস্তি পেতে হবে। শাস্তি যে হবেই, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিচার চলছে মডান্ট ওয়েলসের এজলাশে, এই মডান্ট ওয়েলসই কিছুদিন আগে এক বিচারের সময় মন্তব্য করেছিলেন যে ভারতীয়রা সকলেই জুয়াচোর এবং বদমাশ।
বরানগরে মহাভারত অনুবাদ কার্যালয়ে না গিয়ে নবীনকুমার এখন হাইকোর্টে চলে আসে প্রত্যহ। যদুপতি গাঙ্গুলীকেও এখানে সে দেখতে পায়। আদালতে দর্শকদের গ্যালারিতে স্থান সঙ্কুলান হয় না, যদুপতি আগেভাগে এসে দুজনের জন্য আসন সংরক্ষণ করে রাখে। সওয়াল জবাব শুনতে শুনতে নবীনকুমারের গ্লানি বোধ হয়। সে যদুপতিকে ফিসফাস করে বলে, আমাদের প্রজাদের নিয়ে মামলা, অথচ আমাদের দেশী লোক একজনও কাঠগড়ায় দাঁড়ালো না? এ বড় লজ্জার কতা নয়?
যদুপতি বলে, ভাই, তবু এ একরকম ভালো! দিশী লোক কখুনো সাহেবদের সাথে মামলায় জিততে পারে? তার ওপর এ হলো গে মানহানির মামলা। এ মামলায় হারলে প্ল্যাণ্টার সাহেবগুলোর মুখে একেবারে চুনকালি পড়ে যাবে!
—এ মামলায় জয় হবে, তুমি আশা করো?
—দ্যাকোই না। কী হয়! হাজার হোক লঙ একজন পাদ্রী এবং ভালোমানুষ বলে সব্বাই জানে। এমন মানুষকে সাজা দিলে অনেক ইংরেজও ক্ষেপে যাবে। বিলেতেও এর প্রতিক্রিয়া হবে!
—নীলকরদের সঙ্গে ইংরেজি কাগচওয়ালারাও যোগ দিয়েচে, ওদের কামড় একেবারে কচ্ছপের কামড়।
—কাগচওয়ালাদের ক্ষেপাবার তো কারণ রয়েচেই! হরকরা আর ইংলিশম্যান তো ক্ষেপে একেবারে লাল! নীলদর্পণ-এর ভূমিকায় কী লেকা আচে দ্যাকোনি? রসিক নাট্যকার লিকেচেন যে চাঁদির কত গুণ! জুডাস যেমন মাত্র তিরিশটি টাকার বিনিময়ে প্ৰভু যীশুকে পণ্টিয়াস পাইলেটের হাতে ধরিয়ে দিইচিলেন, সেই রকমই এই দুই কাগচওয়ালা নীলকরদের কাচ ঠেঙে মাত্র হাজার টাকা ঘুষ খেয়েই গরীব চাষীদের বিপক্ষে লেখনী ধারণ করে অত্যাচারী ব্যবসায়ীদের গুণ গাইচে। বেড়ে লিকেচেন, যাই বলো!
এক এক সময় আসামী পক্ষের উকিলদের সওয়াল শুনে নবনীকুমার বিরক্ত হয়ে উঠে চলে যায়। তার শরীর নিশপিশ করে। এই বুঝি উকিল? নীলকরদের দ্বারা নিয়োজিত দুদে উকিলদের বিরুদ্ধে লঙের পক্ষের একজন উকিল মিনমিন করে কতা বলে, কী যে বলে তা ভালো করে শোনাই যায় না! আর একজন উকিল সকালের দিকটায় জিভ ছুঁচোলো করে কিছু চোকা চোকা বাক্য বলে বটে, কিন্তু বেলা বারোটা বাজতে বাজতেই তার জিভ এলিয়ে যায়, পাটিলতে থাকে, কথার কোনো সঙ্গতি থাকে না। বিচারকও তেমনি চতুর, নিউমার্চ নামে এই মদ্যপ উকিলটি সওয়াল করতে এলেই কোনো ছুতোনাতায় অ্যাডজোর্ন করে দেয়। অপরাহ্ন আবার আদালত বসলে নিউমার্চ তখন শুধু হাসির খোরাক জোগায়।
নবীনকুমারের মনে হয়, এখানে এসে শুধু সময়ের অপব্যয় হচ্ছে। মহাভারতের কাজ দেখাশুনো স্থগিত রয়েচে, তাছাড়া কুসুমকুমারীর বিবাহের চিন্তাও সে পরিত্যাগ করেনি,প্রায়ই মনে পড়ে, কিন্তু সে ব্যাপারে সে সময় দিতে পারছে না। মধ্যপথে সে চলে যাচ্ছে দেখে যদুপতি গাঙ্গুলী তাকে বাধা দেয়। তার মতে এর চেয়ে বড় ঘটনা এখন আর দেশে কিছু ঘটছে না।
সে বলে, বুঝতে পারচো না, ভাই—
নবীনকুমার তাকে বাধা দিয়ে বলে, অত ভাই ভাই করো না তো! আমি কি বেম্ম হয়িছি? ও তোমার বোম্ম সতীর্থদের যত খুশী ভাই ভাই করো গে।
ঈষৎ অপ্ৰস্তুত হয়ে যদুপতি বলে, ব্ৰাহ্মদের প্রতি তোমার এমন বিতৃষ্ণা আচে জানতুম না তো! তুমি তো দেবেন্দ্ৰবাবুর বাড়িতে নিয়মিত যাও দেকিচি!
নবীনকুমার বললো, সে আলাদা কতা। ব্ৰাহ্ম তো হইনি, কোনোদিন হবোও না। দেবেন্দ্ৰবাবুকে শ্রদ্ধা করি বটে, কিন্তু ধম্মো নিয়ে মাতামাতিতে আমার মন নেই।
যদুপতি বললো, সে যাই হোক! শোনো একটা কতা বলি, এই নীলদর্পণের মামলায় জয় হলেও আমাদের জিৎ, হারলেও আমাদের জিৎ!
—কী রকম?
–জয় হলে তো কতাই নেই। আর হার হলে, নিরপরাধ পাদ্ৰী লঙ সাজা পেলে দেকো সারা দেশে। কত শোরগোল পড়ে যাবে। বিলাতেও এ নিয়ে আন্দোলন হবে। কোনো পাদ্রীকে জেলে ভরার কতা আগে কখনো শুনোচো?
—কিন্তু পাদ্ৰী লঙ আইরিশ, সে কত ভুলে যেও না! আইরীশদের সম্পর্কে ইংরেজদের খানিকটা বিরাগ ভাব আচে না?
—তা হোক, তবু বিলোতে আইরীশদেরও মুরুব্বি রয়েচে অনেক।
যথাসময়ে জুরিদের পরামর্শ নিয়ে বিচারক মডান্ট ওয়েলস রায় দিলেন। জুরিমণ্ডলীও গঠিত হয়েছে অপূর্বভাবে, বারোজন ইংরেজ, একজন পর্তুগীজ, একজন আর্মেনিয়ান আর একজন পার্শী। বাংলার চাষীদের ব্যাপার, বাঙালী মুখপাত্র একজনও নেই। জুরিরা একবাক্যে লঙকে দোষী সাব্যস্ত করলো। শেষ মুহূর্তেও লঙকে বাঁচাবার জন্য তাঁর পক্ষের উকিলরা পুনর্বিচার দাবি তুললো জোরালো ভাবে। তখন চীফ জাসটিস বার্নস পীকক বিচারের ভার নিলেন। তাতে হেরফের কিছু হলো না। এমনকি একটু সৌজন্যও তিনি দেখালেন না। লঙের বক্তব্যের মাঝপথে অকস্মাৎ বাধা দিয়ে তিনি রায় দিলেন, লঙের এক মাস কারাদণ্ড এবং এক সহস্ৰ মুদ্রা জরিমানা!
দণ্ড শুনে সাহেবরা হর্ষধ্বনি করে উঠলো। দেশীয় ব্যক্তিরা স্তম্ভিত। তারপর কয়েকজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি উঠে দাঁড়াতেই নবীনকুমার হাত তুলে নিরস্ত করলেন সকলকে। অন্য কেউ পা বাড়াবার আগেই নবীনকুমার ধীর গভীর পদক্ষেপে এগিয়ে গেল ধর্মাধিকরণের দিকে। হাকিমের পার্শ্বে বসা পেশকারের সামনে একটি টাকার তোড়া নামিয়ে দিয়ে সে বিনীত ভাবে বললো, লঙ মহোদয়ের জরিমানার অর্থ আমার তরফ হইতে গ্ৰহণ করিতে আজ্ঞা হয়!
উত্তরের প্রতীক্ষ্ণ না করেই নবীনকুমার আবার পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করলো। দ্বারের কাছাকাছি এসেই সে দৌড় দিল, পাছে কেউ কেউ তাকে অভিনন্দন জানাতে আসে! বাইরে বেরিয়েই সে শুনতে পেল আদালত কক্ষের মধ্যে তার উদ্দেশে করতালি ধ্বনি, সে দুই হাতে চাপা দিল কান।। যদুপতি গাঙ্গুলী তাকে এসে ধরবার আগেই সে হাঁকিয়ে দিয়েছে জুড়িগাড়ি।
পরদিন দল বেঁধে অনেকেই এলো তার গৃহে। যদুপতির উৎসাহই সবচেয়ে বেশী। তারা নবীনকুমারকে সম্বর্ধনা জানাতে চায়। নবীনকুমার লজ্জায় আরক্ত হয়ে বার বার থামিয়ে দিতে গোল তাদের। সামান্য এক সহস্র মুদ্রা সে দিয়েচে, এ নিয়ে বেশী কথা বলার কী আছে! সে তো লঙের হয়ে কারাদণ্ড ভোগ করতে পারেনি!
সকলে এই বিষয়ে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলতে চায়, কিন্তু নবীনকুমার উঠে পড়লো। বিশেষ কারণে তাকে এখন বার হতে হবে। উত্তম সাজসজ্জা করতে গেল নবীনকুমার। আজ দেবেন্দ্রবাবুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ। কয়েকমাস আগে দেবেন্দ্ৰবাবুর আর একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেছে। আজ তার নামকরণ উপলক্ষে উৎসব।
নাম অবশ্য আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠিক আগের পুত্রটির নাম সোম, সেইজন্য এই নবজাতকের নাম রাখা হবে রবি।