1 of 2

৩০. সরোজিনীর ভগিনীর বিবাহ উপলক্ষে

সরোজিনীর ভগিনীর বিবাহ উপলক্ষে নবীনকুমারকে যেতে হয়েছে বর্ধমানে। কিছুকাল আগে সরোজিনীর পিতৃবিয়োগ হওয়ায় জ্যেষ্ঠ জামাতা হিসেবে নবীনকুমারই কন্যাকর্তা। পাত্রের বাড়ি ঠিক সদর বর্ধমানেও নয়, ঐ জেলার অন্তঃপাতী এক প্ৰাচীন গ্রামে। পাত্রের পিতা একজন ধনাঢ্য জমিদার, কলকাতায় তাঁদের একাধিক অট্টালিকা আছে, কিন্তু গ্রামের বসতবাড়ির কুলদেবতার সামনে বিবাহ যজ্ঞ সম্পন্ন করাই তাঁদের পারিবারিক প্রথা। কুলদেবতাকে কলকাতায় আনয়ন করা সম্ভব নয়, সেইজন্য কন্যাপক্ষকে সদলবলে যেতে হয়েছে সেই সুদূর গ্রামে। অবশ্য বন্দোবস্তের কোনো ত্রুটি নেই, মোট একচল্লিশটি পাল্কি সারবদ্ধভাবে রওনা হয়েছে কলকাতা থেকে। নবীনকুমার এখন বন্ধুবান্ধবদের সাহচর্য ছাড়া থাকতে পারে না, তাই কয়েকজন বন্ধুকেও সে সঙ্গে নিয়েছে। যদুপতি আর উমানাথ তো আছেই, তা ছাড়া হরিশ মুখুজ্যেকেও সে জোর করে নিয়ে গেছে।

সরোজিনী বেশ কিছুদিন ধরেই পিত্ৰালয়ে। তাদের বাড়িতে এক একটি বিবাহের উদযোগপর্ব শুরু হয়। অন্তত এক মাস আগে এবং পরে তার জের চলে আরও এক মাস। নবীনকুমার এবং সরোজিনীর সঙ্গে তাদের নিজস্ব দাসদাসীরাও চলে গেছে, তাই জোড়াসাঁকোয় সিংহ বাড়ির অন্দরমহলের দ্বিতল প্রায় শূন্য।

মধ্যরাত্রে বিম্ববতীর হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়, তাঁর মনে হয়, তিনি যেন নির্জন নিশুতি কোনো প্রাস্তরে শুয়ে আছেন। সে সময়ে তিনি তাঁর বুকের কাছে অনেকখানি শূন্যতা অনুভব করেন। এক সময় তাঁর বুকের পাশটিতে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকতো তাঁর খোকা, তখন মনে হতো। এই বিশ্বসংসারে তাঁর আর কিছুই চাইবার নেই। কিন্তু সে তো অনেকদিন আগেকার কথা। আট নয়। বৎসর বয়েস থেকেই নবীনকুমার বড় বেশী স্বাতন্ত্র্যবাদী, তখন থেকেই সে আর তার মায়ের পাশে শোয় না, তার শয্যা স্থাপিত হয়েছিল পৃথক কক্ষে। এখন নবীনকুমার তার পিতা রামকমল সিংহের বিরাট কক্ষটিতে অধিষ্ঠিত হয়েছে। বিম্ববতী তাঁর স্বামীকে যেমন কখনো সেরকম আপন করে পাননি, তাঁর সন্তানও তেমনই যেন দূরে সরে যাচ্ছে।

নবীনকুমার বাড়িতে নেই বলেই যেন এই চিন্তা কয়েকদিন ধরে বিম্ববতীকে বেশী পীড়া দিতে শুরু করেছে। অন্য সময় ছেলে একই বাড়িতে কাছাকাছি কোথাও আছে, এই অনুভব অনেকখানি শান্তি দেয়। সন্তান কামনায় এক সময় বিম্ববতী প্ৰায় উন্মাদিনী হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু সেই সন্তান পেয়েও তাকে নিয়ে তাঁর নিজের জীবন তো পূৰ্ণ হয়ে উঠলো না।

অথচ সন্তান সম্পর্কে অভিযোগ করারও কিছু নেই। এমন হীরের টুকরো ছেলে কজনে পায়? এই বয়েসে ছেলেদের গৃহের বন্ধনে আটকে রাখা যে কতখানি দুষ্কর তা বিম্ববতী ভালোই জানেন। কর্তাদের ধরনই এই সাবালক হবার আগে থেকেই পাখা গজায়, তখন আর তারা কিছুতেই বাড়িতে রাত কাটাতে চায় না। কিন্তু নবীনকুমার সে ধরনেরই হয়নি। ইয়ার মোসাহেবদের নিয়ে সে ফুর্তি করে না, একটি দিনও সে বাড়ির বাইরে থাকে না। সে বিদ্বান-সজনদের সঙ্গে মেলামেশা করে, জ্ঞানের চৰ্চায় সময় কাটায়। সে বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলনে সাহায্য করার জন্য মেতে উঠেছিল। বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে বেহ্মজ্ঞানী হয়ে পিতৃপিতামহদের ধর্মে কালি দেয়নি। শুধু তার জেদ বা গোঁ বড় বেশী, এই যা। এই বয়েসেই তাঁর ছেলের যে কতখানি সুনাম রটেছে, সে কথা বিম্ববতীরও কানে এসেছে। শুধু দিনে একবার দুবার ছেলে যদি তাঁর কাছে এসে পাশটিতে বসে মা বলে ডাকতো, দুটো মনের কথা কইতো! গত কয়েক বৎসর ধরে নবীনকুমার মায়ের কাছে এসেছে শুধু টাকা পয়সা চাইবার জন্য। সম্প্রতি সাবালক হয়ে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়ার পর থেকে সে আর একবারও আসে না।

জা হেমাঙ্গিনী ছিলেন বিম্ববতীর অনেকখানি সঙ্গিনী, গত বৎসর তিনিও ধরাধাম পরিত্যাগ করেছেন। এখন আর বিম্ববতীর সময়ই কাটে না। প্ৰাতঃকালে গঙ্গামান আর ঠাকুরঘরে ধ্যান করে আর কত সময় কাটানো যায়! যদি একটি নাতিও থাকতো! কতদিন এ গৃহে কোনো শিশুর কলহাস্য শোনা যায়নি। নাতির চিন্তা করলেই বিম্ববতীর দীর্ঘশ্বাস পড়ে, চক্ষে জল আসে। মনে পড়ে আর একজনের কথা। নবীনকুমারের এখনো কিছুই বয়েস নয়, কিন্তু গঙ্গানারায়ণ বেঁচে থাকলে এতদিনে নিশ্চয়ই তিনি নাতি-নাতনীর মুখ দেখতেন। তাদের বুকে জড়িয়ে তিনি আবার জীবন ধারণের সার্থকতা উপলব্ধি করতে পারতেন।

 

দুজন ভৃত্য ঝাড়পোঁছ করার জন্য নবীনকুমারের কক্ষের তালা খুলেছে, সে সময় বিম্ববতী এসে দাঁড়ালেন সেখানে। ভৃত্যদের কাজ শেষ হয়ে গেলে তিনি বললেন, তোরা যা, আমি বন্দো করে দেবোখন।

বিম্ববতী ঢুকলেন সেই কক্ষে। কয়েক যুগ আগে নববধূর সাজে। এই কক্ষে প্রথম প্রবেশ করেছিলেন বিম্ববতী, এখানেই তাঁর ফুলশয্যা হয়েছিল। তখন বিম্ববতী নিতান্তই অবোধ বালিকা, পিতামাতার আশ্রয় ছেড়ে সেই প্রথম দিন এক অচেনা বাড়িতে রাত্রি যাপন। ভয় পেয়ে বিম্ববতী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলেন আর তাঁর স্বামী পরম স্নেহে তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন, সেই স্মৃতি এখনো বিম্ববতীর মনে স্পষ্টভাবে জাগরূক।

রামকমল সিংহ পত্নীর জন্য পৃথক কক্ষ নির্দিষ্ট করেছিলেন দম্পত্যজীবনের শুরু থেকেই। সেই সময়েই তিনি বিম্ববতীর চেয়ে বয়েসে অনেক বড় এবং অভিজ্ঞও ছিলেন, বিবাহের অভিজ্ঞতা তাঁর আগেই হয়ে গিয়েছিল। প্রথম প্রথম মাসে কয়েকদিন, শেষের দিকে বৎসরে দু-একদিন রাত্রিকালে বিম্ববতীকে তিনি আহ্বান জানাতেন তাঁর শয্যার অংশভাগিনী হবার জন্য। তাও সারা রাত্রির জন্য নয়। রামকমল সিংহের নাসিকাগর্জন ছিল সুবিখ্যাত, সেই গর্জনে এক এক সময় তাঁর নিজেরই ঘুম ভেঙে যেত, তিনি কে রে? কে রে? বলে চিৎকার করে উঠতেন। অধিকাংশ নাসিকা গর্জনকারীরাই নিজেদের এই গুণাপনাটি বিষয়ে অবহিত নন। কিন্তু রামকমল সিংহ জানতেন বলেই তিনি পছন্দ করতেন একাকী শয়ন। অবশ্য, যে-কটি দিন তিনি স্বগৃহে রাত্রি যাপন করার সময় পেতেন। নবীনকুমার অবশ্য পিতার স্বভাব পায়নি, সে পত্নীর সঙ্গে এক পালঙ্কেই ঘুমোয়।

শিয়রের কাছে দেয়ালের অভ্যন্তরে একটি বড় লোহার সিন্দুক। এর চাবি থাকতো কর্তার কাছে, মধ্যে এতগুলি বছর ছিল বিধুশেখরের জিন্মায়, এখন নবীনকুমারের কাছে। বিম্ববতী ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন, নবীনকুমার কক্ষটির অনেক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। রামকমলের আমলে ছিল দরজার ঠিক ওপরেই এক বিলাতী শিল্পীর আঁকা জলকেলিরত তিন নগ্ন রমণীর চিত্র। রামকমল বিম্ববতীকে বুঝিয়েছিলেন যে ঐ রমণী তিনটি অপ্সরা, সেইজন্য তাদের পোশাক পরিধান করতে নেই। নবীনকুমার সে ছবি সরিয়ে ফেলেছে, সেখানে কালিঘাটের পটুয়াদের আঁকা কয়েকটি পট সারিবদ্ধ ভাবে সাজানো। পালঙ্কের দক্ষিণ পাশেই ছিল কতার আলবোলা, তার রূপা বাঁধানো নলটি খুবই সুদৃশ্য। নবীনকুমার ধূমপানের অভ্যেস করেনি। সে আলবোলাটি আর স্বস্থানে নেই, সেইজন্যই ঘরে ঢুকে কেমন যেন ফাঁকা লাগছিল বিম্ববতীর। আলবোলাটির স্থানে এখন একটি মেহগনি কাঠের এবং কাচের ছোট্ট আলমারি, তার মধ্যে কয়েকটি বই রাখা। রামকমল সিংহ, বইপত্রের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই রাখতেন না। নবীনকুমারের আরও একটি শখ আছে, যা তার পিতার ছিল না। দুটি বড় ফুলদানিতে তার কক্ষে প্রতিদিন টাটকা ফুল সাজানো থাকে। বিম্ববতী আগেও শুনেছেন যে নবীনকুমার প্রতিদিন সকালে উদ্যানের মালিকে ডেকে ফুল বাছাই করে। পূজা অৰ্চনার জন্য ছাড়া কেউ প্রতিদিন নিজের শয়ন কক্ষ ফুল দিয়ে সাজায়, তা বিম্ববতী আগে কখনো জানতেনই না। তাঁর পুত্র কোথা থেকে এসব শিখলো?

ফুলদানি দুটি নতুন, খাগড়াই কাসার। আগে ছিল দুটি পোর্সিলিনের। সেই যে এক রাত্রে নবীনকুমার অত্যন্ত রাগারগি করে অনেক জিনিসপত্র ভাঙচুর করেছিল, সেদিন ঐ ফুলদানি দুটিও গেছে। বিম্ববতী কাছে এগিয়ে এসে দেখলেন, ফুলদানিতে কয়েকদিনের বাসী ফুলের স্তবক শুকিয়ে আছে। ঘরের মালিক নেই, তাই কেউ ফুল বদল করেনি। বাসী ফুলগুলি তুলে নিয়ে কেন জানি বিম্ববতীর অকস্মাৎ কান্না পেয়ে গেল। অশ্রু মোচন করতে করতে তিনি নিজেই বিস্মিত হতে লাগলেন। কেন কাঁদছেন, তা তিনি জানেন না।

দ্বারের কাছে একটি শব্দ শুনে চমকিত হয়ে ফিরে তাকালেন বিম্ববতী। তিনি দেখলেন, কখন বিধুশেখর এসে দাঁড়িয়েছেন সেখানে। আঁচল দিয়ে চোখ মুখ মুছে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কখুন এয়েচেন?

উত্তর না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন বিধুশেখর। তাঁর ওষ্ঠে মৃদু হাস্য। পার্বতীর মতন ন যযৌ। ন তন্থেী হয়ে রইলেন বিম্ববতী। বিধুশেখরকে এই কক্ষে প্রবেশ করে আসন গ্ৰহণ করতে বলবেন, না তিনি নিজেই এখান থেকে বেরিয়ে যাবেন, তা বুঝতে পারলেন না।

লাঠি ঠকঠকিয়ে বিধুশেখর এগিয়ে এলেন কয়েক পা। জরিপ করার ভঙ্গিতে চতুর্দিকে মাথা ঘুরিয়ে কক্ষটি দেখলেন কয়েকবার। তারপর অস্ফুট স্বরে বললেন, এগারো বচর, প্রায় এক যুগ আগে এ ঘরে আমি শেষ এয়েচিলুম। সেবার রামকমলের সান্নিপাতিক হলো, তোমার মনে আচে, বিম্ব?

বিম্ববতী নিঃশব্দে ঘাড় হেলালেন।

বিধুশেখর আবার বললেন, ছোট্‌কু বিদ্ধেমানে গ্যাচে শুনিচি, কবে ফিরবে? আজকাল লোকমুখে আমায় এসব খপর পেতে হয়।

বিম্ববতীও জানেন না যে নবীনকুমার ঠিক কবে প্রত্যাগমন করবে। তাই তিনি নিরুত্তর রইলেন।

বিধুশেখরের কণ্ঠে সামান্য অভিযোগের সুর এসেছিল, এবার সেটি মুছে ফেলে তিনি আবার হাসলেন। তারপর বললেন, বিম্ব, তোমার সঙ্গে এ ঘরে আমার কখনো দেকা হয়নি কো।

সে কথা ঠিক। মধ্যে মধ্যে রামকমল সিংহের সুদীর্ঘ প্রবাস কালে বিধুশেখর আসতেন বিম্ববতীর খোঁজ খবর নিতে। তখন বিম্ববতীর নিজস্ব কক্ষেই দেখা হতো।

সম্পূর্ণ অকারণেই প্রায়, বিম্ববতী গলায় আঁচল জড়িয়ে বিধুশেখরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে প্ৰণাম করলেন। বিধুশেখর বিস্মিত হলেন না। তিনি ডান হাত তুলে আশীর্বাদ করে কুসুম, চির-আয়ুৰ্ৱতী হও, সৌভাগ্যশালিনী হও! তুমি একা একা এ ঘরে ডাঁড়িয়ে কাঁদছেলে কেন,

বিম্ববতী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কী জানি।

বিধুশেখর এগিয়ে গিয়ে পালঙ্কের ওপর বসে পড়ে বললেন, তুমি আমায় কখনো কাঁদতে দেকেচো? আমি পুরুষকারে বিশ্বাসী, কান্নায় বিশ্বাসী নই। কিন্তু এদানি আমার কী হয়েছে কে জানে, আমারও চোকে জল আসে, যকন তোকন। আমি ভাবি, এ আবার কী জ্বালা? বোধ হয় বুড়ো বয়সে আমার ভীমরতি ধরলো!

বিম্ববতী জিজ্ঞেস করলেন, আপনার শরীর ভালো আচে?

বিধুশেখর বললেন, হ্যাঁ, ভালো, বেশ ভালো, হটাৎ যেন বেশী ভালো হয়ে গ্যাচে! পিন্দিমের সলতে নেববার আগে একবার বেশী করে জ্বলে ওঠে না? এ বোধ হয় সেই দশা! তুমি ভালো আচো বিম্ব?

-হ্যাঁ।

—আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী। যতদিন বাঁচবো, তোমায় দেকে যাবো। তুমি তো জানো বিম্ব, আমি ইচ্ছে করলে এ বাড়ির মালিক হতে পাতুম! এইসব বিষয় সম্পত্তি আঁমার হতে পাত্তো! এই ঘরে, এই ছাপরাখাটে আমার জন্য বিছনা পাতা হতো—

মধ্যপথে কথা থামিয়ে বিধুশেখর হাসতে লাগলেন। রীতিমতন খুশীর, উপভোগের উপহাস্য।

বিম্ববতী আকুল নয়নে চেয়ে রইলেন বিধুশেখরের মুখের দিকে।

এক সময় হাসি থামিয়ে বিধুশেখর বললেন, দ্যাকো, এই আমার এক নতুন উপসর্গ। আগে কখনো আমায় অকারণে হাসতে দেকোচো? কান্নার মতন হাসিও, আমার এক নতুন ব্যাধি।

বিম্ববতীর মনে হলো, এই বিধুশেখর তাঁর অচেনা। ইনি একজন নতুন মানুষ। ডাকসাঁইটে পুরুষ বিধুশেখর মুখুজ্যের পক্ষে হঠাৎ হাসি বা কান্না অন্যদের কাছে অকল্পনীয়।

-এবার মনে পড়েচে, বিম্ব, কেন হাসলুম। পরে বলচি। তোমার সঙ্গে কটা কতা আচে, সেইজন্যই এয়েচি। ছোট্‌কু যে বড় ভাবিয়ে তুললে! এ ছেলেকে সামাল না দিলে যে সব যাবে!

বিম্ববতী আতঙ্কিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, কী করেচে ছোট্‌কু?

–কলুটোলায় তোমাদের যে সাত বিঘে জমি ছেল, তা বেচে দিয়েচে! এমন গোখুরির কাজ কেউ করে? নগরের একেবারে মন্দ্যিখানে, ও তো জমি নয়, সোনা, দিন দিন দাম বাড়চে! মেডিকেল হাসপাতালের একেবারে গায়ে। আমায় ঘুনাক্ষরে কিচু জানায়নি। কেন এমন কাণ্ড করলো, জানো?

–কেন?

–আমার ওপর টক্কর দেবার সাধ। সবাইকে দেকালে যে আমার সঙ্গে পরামর্শ না করেও সে তার বিষয় সম্পত্তি নিয়ে যা খুশী করতে পারে। এই যদি যা খুশীর নমুনা হয়, তা হলে দুদিনেই তো সব ফুকে দেবে!

—ছোট্‌কু আমাকেও কিচু বলেনি।

—বিম্ব, গঙ্গাকে আমি সহ্য করতে পাত্তুম না, তুমি সেজন্য মনে ব্যথা পেতে, আমি জানি। কিন্তু গঙ্গা বড় অসমীচীন কাজ করেছেল, আমার বিধবা মেয়ে বিন্দু, সে তার ভগ্নীর মতন, তার প্রতি সে কু-নজর দিয়েছেল। ছিঃ! সেজন্য আমি তাকে ক্ষমা করতে পারিনি। কিন্তু ছোট্‌কু, সে তো আমার বুকের ধন, তার কোনো আবদারে আমি বাধা দিই না, সে আনন্দ ফুর্তি করতে চাইলেও…

—ছোট্‌কুর কোনো বদ অভ্যেস নেই।

কিন্তু আমার সঙ্গে সে কেন আকচা-আকচি করতে চায়? আমি তার দিকে দু হাত বাড়িয়ে দিলেও সে দূরে সরে যায়। আমি কি তার প্রতিপক্ষ হতে পারি? তাকে আমি দু চক্ষের মণি করে রাকতে চাই, আর সে আমার চোকে ধুলো দিতে চায় কেন? আমার বড় কষ্ট হয়—

—ছোট্‌কু এখনো ছেলেমানুষ!

—কিন্তু তার ধরন ধারণ যে পাকা! সে তবিলের চাবি চাইলে, আমি এক কতায় দিয়ে দিলুম। সে টাকা চাইলে, যত লাখ টাকা চাক, আমি এক কতায় দিতে পারি। তবু তাকে জমি বেচতে হবে, আমায় নুকিয়ে? আমার এ দুঃখু আমি তোমায় ছাড়া আর কাকে জানাবো?

বিধুশেখর তাঁর একটু আগেকার উক্তির সত্য প্রমাণিত করার জন্য নিরত হলেন এবং তাঁর চক্ষু থেকে জল করতে লাগলো।

বাঁ হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চক্ষু মুছে তিনি বললেন, কেন হাসচিলুম জানো? এই দ্যাকো—

বিধুশেখর দলিলের মতন একটি লম্বা তুলেটি কাগজ বাড়িয়ে দিলেন বিম্ববতীর দিকে। সে কাগজ দেখে আর বিম্ববতী কি বুঝবেন, তিনি উৎসুকভাবে বিধুশেখরের কাছ থেকে আরও কিছু শোনার জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগলেন।

—কলুটোলার সেই জমি আমিই কিনে নিইচি। বলচিলুম না। তোমাদের এই সব বিষয়-সম্পত্তি আমিই কিনে নিতে পাতুম! এবার বুঝি তাই-ই হলো, ছোট্‌কু যা বেচবে, তা আমাকেই কিনে নিতে হবে! হো-হো-হো-হে! হাসির ব্যাপার নয়!

–আপনি না দোকলে ও যে একেবারেই ভেসে যাবে!

–দেকবো! ওকে দেকার জন্যই আমায় আরও বেঁচে থাকতে হবে! কিন্তু আমি আর আগের মতন নির্লোভ নই। তোমার ছেলের ভালোমন্দ আমি দেকবো, কিন্তু তার বিনিময়ে তোমার কাচ থেকে প্রতিদান চাই। প্রদীপের সলতে নেববার আগে দপ করে জ্বলে উঠেচে, আমার কামনা বাসনা বেড়ে গ্যাচে, পাপ-পুণ্যের চিন্তে ঘুচে গ্যাচে! লোভী, আমি আবার বিম্ব লোভী হয়েচি, আমি আবার তোমাকে চাই।

বিম্ববতীর মুখখানি রক্তশূন্য, বিবৰ্ণ হয়ে গেল। তিনি আর্তের মতন একবার দ্বারের দিকে চাইলেন।

বিধুশেখর ওষ্ঠে হাসি অঙ্কিত রেখে বললেন, বার্ধক্যে মানুষ দ্বিতীয়বার শিশু হয়, আমারও সেই দশা। উদ্ভট সব শক হয় আজকাল। যেমন, আমার ইচ্ছে হয়েচে, আমার বন্ধু রামকমলের এই পালঙ্কে আমি শয়ন করবো, আর তুমি এসে আমার সেবা করবে!

–না!

–বিম্ব–

—দয়া করুন, আমায় ক্ষমা করুন, আপনি কতা দিয়েচিলেন—

—সে সব কতা ভেসে গ্যাচে! এ যুগে কেউ কতা রাকে না। এ এক হতচ্ছাড়াদের যুগ এয়েচে, তাদের সঙ্গে সঙ্গে আমিও হতচ্ছাড়া হবো। এসো বিম্ব, আমার বুকে এসো—

-না, আমায় ক্ষমা করুন। সে বিম্ব নেই, সে মরে গ্যাচে—

বিধুশেখর এবার মুখের রেখা কঠোর করলেন, তারপর নিজের পাশটা চাপড়ে গম্ভীরভাবে বললেন, এসো, এখেনে এসে বসো। তার আগে দোরটা দিয়ে এসো, যাও—

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *