বাহির বাড়ির একটি অংশকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে সজ্জিত করে একটি কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। বিশিষ্ট পণ্ডিতদের এনে রাখা হয়েছে সেখানে, তাঁদের সেবার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে কয়েকজন ভৃত্য। ব্ৰাহ্মণ পাঁচক নানাপ্রকার উৎকৃষ্ট ব্যঞ্জন রন্ধন করে তাঁদের পরিবেশন করে, যেসব পণ্ডিত স্বপাকে আহার করতে চান, তারও ব্যবস্থা আছে। সংস্কৃত মহাভারতের অনেকগুলি পুঁথি, ছাপা বই, এমনকি পুণা থেকেও আনানো হয়েছে নির্ভরযোগ্য সংস্করণ। নীলকণ্ঠের টীকা সমন্বিত একটি ভাষ্যের পুঁথি নবীনকুমার ক্রয় করেছে বহু টাকা দিয়ে। কৈব্য বা অবসাদ একেবারে দূরীভূত হয়ে গেছে, নবীনকুমার আবার এক অতি চঞ্চল যুবা। সে যেন ঝড়ের আরোহী, অষ্টাদশ পর্ব মহাভারতের বাংলা রূপান্তরের মতন বৃহৎ কাজ সে অনতিবিলম্বে শেষ করতে চায়। তার নিজস্ব ছাপাখানাটি পরিবর্ধিত হয়েছে, কাগজ কেনা হয়েছে রাশি রাশি, সিংহ এস্টেটের সকল কর্মচারী এখন এই কর্মে ব্যস্ত। টাকা-পয়সা যত লাগে লাগুক, তার জন্য কোনো চিন্তা নেই।
একদিন বিদ্যাসাগর মহাশয় এসে সবকিছু পরিদর্শন করে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে গেছেন।
বাড়ির অন্দর মহলের সঙ্গে প্রায় সম্পর্ক ঘুচে গেছে নবীনকুমারের। সে সর্বক্ষণ এখানেই পড়ে থাকে। যদুপতি গাঙ্গুলী এবং বিদ্যোৎসাহিনী সভার আরও কয়েকজন বন্ধু নবীনকুমারের এই নতুন উদ্যমে খুব খুশী হয়েছে, তারা প্রায়ই আসে। অনেকদিন সাক্ষাৎ হয়নি বলে হরিশ মুখুজ্যে একদিন ডেকে পাঠিয়েছিল, নবীনকুমার যায়নি।
কয়েকজন পণ্ডিত মূল সংস্কৃত শ্লোকগুলির আক্ষরিক বাংলা তৰ্জমা করে দেন, কয়েকজন সেগুলিকে সাজিয়ে দেন বাংলা গদ্যে, তারপর নবীনকুমার সেই ভাষার ওপর ঘষামাজা করে। মূলের গাম্ভীর্য রক্ষা করেও সুবোধ্য এবং সাবলীল ভাষা সৃষ্টির যেন জাদু আছে তার হাতে। দুটি-একটি শব্দের বিকল্প এবং কোথাও কোথাও ক্রিয়াপদের স্থান পরিবর্তন করলেও যেন নতুন রূপ এসে যায়।
এক অপরাহ্নে নবীনকুমার এই কাজে গম্ভীরভাবে নিমগ্ন, এমন সময় তার ডাক এলো অন্দর মহল থেকে। ডেকে পাঠিয়েছেন বিম্ববতী। ঈষৎ বিরক্ত হলেও নবীনকুমার জননীর আহ্বান প্রত্যাখ্যান করতে পারলো না। কলম নামিয়ে রেখে উঠে পড়লো। স্ত্রী সরোজিনী কিছুদিন হলো পিত্ৰালয়ে গেছে। বলে নবীনকুমার রাত্রে নিজকক্ষে শুতেও আসে না ইদানীং। অধিক রাত্রি পর্যন্ত পণ্ডিতদের সঙ্গে সংস্কৃত ব্যাকরণের নিগৃঢ় তত্ত্ব আলোচনা করার পর সেখানকারই একটি কক্ষে শুয়ে পড়ে। এখন মহাভারতই তার ধ্যান জ্ঞান।
নতুন থান বস্ত্ৰ পরে একটি হরিণের চামড়ার আসনে বসে আছেন বিম্ববতী। তাঁকে দেখে সবিশেষ বিস্মিত হলো নবীনকুমার। স্বতই তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, একি, মা?
স্বামীর মৃত্যুর পর কেশচ্ছেদন করেছিলেন বিম্ববতী। তারপর তাঁর পিঠছাওয়া গুচ্ছ গুচ্ছ চুল আবার ফিরে এসেছিল অনেকদিন আগেই। আজ নবীনকুমার দেখলো, বিম্ববতী আবার মস্তক মুণ্ডন করেছেন, গলায় মোটা রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে চন্দনের তিলক, সম্পূৰ্ণ বৈরাগিণীর বেশ। তাঁর চক্ষু দিয়ে দর দর ধারে অণু গড়িয়ে পড়ছে।
অন্তত আট নয় দিন এক পলকের জন্যও বিম্ববতীর সঙ্গে দেখা হয়নি নবীনকুমারের। মায়ের এই পরিবর্তনের ব্যাপার সে কিছুই জানে না। যতই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হোক, তবু এখনো প্রতি বৎসর দুর্গোৎসবের সময় দুর্গা প্রতিমার মুখের সঙ্গে সে তার মায়ের মুখের মিল খুঁজে পায়। তার মায়ের মতন রূপসী সে আর একজনও দেখেনি এ পর্যন্ত।
মায়ের এই বেশ এবং চক্ষে জল দেখে তার হৃদয় উদ্বেলিত হয়ে উঠলো। সে ছুটে এলো মায়ের পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়বার জন্য।
সঙ্গে সঙ্গে বিম্ববতী তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে উঠলেন, ছুঁসনি! ছুঁসনি! ওরে ছুঁসনি আমাকে!
নবীনকুমার স্থাণুবৎ হয়ে গেল। তার মা তাকে স্পর্শ করতে নিষেধ করছেন? এই সেদিনও কাছাকাছি এলেই মা তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছেন, ছোট্কু, তোকে বুকে ধরলে আমি যা শান্তি পাই, তেমুন শান্তি ভগমন আর কিচুতে দেননি। আমায়।
বিহ্বল কণ্ঠে নবীনকুমার জিজ্ঞেস করলো, মা, তুমি আমায় ছুঁতে বারণ করচো? আমি পাপ করিচি বলে?
বিম্ববতী বললেন, ওমা, তুই পাপ কবি কেন? বালাই ষাট। চতুর্দিকে এঁটো কাঁটা, সকড়ি, কেউ খুঁয়ে দিলে আমায় আবার চ্যান কত্তে হবে। তুই একটু দূরে বোস, তোর সঙ্গে আমার কতা আচে।
—তুমি কাঁদচিলে কেন মা? আমি তোমার মনে নতুন কোনো দুঃখ দিয়িচি?
—নারে, তুই কেন দুঃখ দিবি? তুই আমার মানিক, আমার সোনা, আমার সাত রাজার ধন-আমি কানচিলুম মনের সুখে-ভগমান আমায় ডেকেচেন তাঁর ছিপাদপদ্মে আমার ঠাঁই হবে।
—ভগবান তোমায় ডেকেচোন? ভগবানের কোন সাধ্য আচে মা, যে এক্ষুনি তোমায় ডেকে নেবেন? আমি আচি না? ডাকলেই হলো!
—শোনো ছেলেমানুষের কতা। আমি কি মরার কতা বলচি। ছোট্কু, আমি কাল হরিদ্ধারে রওনা হবো।
—কাল?-হরিদ্ধারে? তুমি কী বলচো, মা? কোন হরিদ্বার?
—তুই বাবু একটু ভালো করে বোস দিনি। অমন ঘোড়ায় জিন দিয়ে থাকলে কত হয়? আমি মনস্থির করে ফেলিচি, ছোট্কু। জগদগুরু একনাথজীর কাচে আমি দীক্ষা নিইচি, গুরু কৃপা করে তেনার ছিচরণে আমায় স্থান দেবেন বলেচেন। গুরু বলেচেন, আমায় সোংসার ধম্মো এবার ত্যাগ কত্তে। চতুর্দিকে এত নোংরা, কলকেতা শহরটা বড় অশুচি, কেউ এখন আর পাইখানা যাবার পর চ্যান করে না, দাসী মাগীগুলো বাসী কাপড়ে বাসুন মাজে, সেই বাসুনে আমরা খাই, ঠাকুর পুজো হয়, এঃ, ঘেন্না, ঘেন্না! ম্যাগোঃ! এত অশুচি!
সত্যিকারের ঘৃণায় কেঁপে উঠলো বিম্ববতীর সর্বাঙ্গ। নবীনকুমার বিস্ফারিত নেত্ৰে দেখতে লাগলো জননীকে। মাত্র এই কয়েকটি দিনে এত পরিবর্তন? এরই মধ্যে অনেক শীণা হয়ে গেছেন তিনি, চোখ দুটি অস্বাভাবিক।
বিম্ববতী বললেন, এখেনে আমার শরীল। এমন অশুচি হয়ে গ্যাচে যে ঘষে ঘষে ছাল চামড়া তুলে ফেললেও দোষ কাটবে না। আমি হরিদ্ধারে চলে যাবো। কালই।
—হরিদ্ধার কতদূরে, তুমি জানো, মা? বেশ তো, সেখেনে যেতে চাও, ব্যবস্থা করা যাবে। কালই কেন?
—তোকে আর কোনো ব্যবস্থা কত্তে হবে না। সব ব্যবস্থা আমি নিজেই করে ফেলিচি, পোটলা পুঁটলি বাঁদা হয়ে গ্যাচে। গুরুদেব কাল রওনা হচ্চেন। আমি তাঁর সঙ্গে যাবো। তোর যদি ইচ্ছে হয় আমায় দশ বিশ ট্যাকা মাসোহারা পাটাস, আর না পাটালেও আমার চলে যাবে। ঈশ্বর যা জোটাবেন তাই খেয়ে থাকবো।
—তুমি কার ওপরে রাগ করেচো বলো তো মা? আমি অনেক দোষ করিচি জানি।
—ওমা, ফের ঐ কতা। তুই কেন দোষ কবি, ছোট্কু। তুই পণ্ডিতদের দিয়ে মহাভারত লোকচ্চিাস, এ তো কত বড় পুণ্যের কাজ। তার জন্যে এ বাড়ি ধন্য হলো। এই বংশ ধন্য হলো। স্বাগ্যো থেকে তোর বাবা তোকে আশীর্বাদ কৰ্বেন। কিন্তু আমায় চলে যেতেই হবে যে, ছোট্কু।
—তুমি আমাদের ফেলে চলে যাবে?
—তোকে কোতায় ফেলে যাবো? তুই আমার বুকের ধন, বুকের মধ্যে থাকবি। ভগমনের পর গুরুদেব, তারপর তুই। একনাথজী বলেচেন, মায়ার বাঁদন না কাটালে প্রকৃত ভালোবাসা হয় না। দূরে চলে গেলে তুই সবসময় আমার নয়নে নয়নে থাকবি।
—তোমার যাওয়া হবে না। এই একনাথজী সাধুটি আবার কে? কবে সে এ বাড়িতে এলো? তেনার সঙ্গে আমি দেকা করতে চাই।
-দেকা কবি, নিশ্চয়ই কবি। বাবা তোকে আশীর্বাদ কবেন। কিন্তু আমাকে যেতেই হবে। হরিদ্ধারে নির্মল গঙ্গাজলে চ্যান কবে, আমার শরীর মন পবিত্র হয়ে যাবে, আর ভগমনের কাচে প্রার্থনা কবে, যাতে তোরা সুখে থাকিস, ভালো থাকিস।
–মা, আমি যদি তোমায় জোর করে ধরে রাকি? যদি কান্নাকাটি করি, না খেয়ে থাকি, তাও তুমি যেতে পারবে?
-ছিঃ, আমন কতা বলতে নেই, ছোট্কু ভগমান যাকে ডেকেচোন, তাঁকে কি আটকাতে আচে?
অনেক পীড়াপীড়ি অনুনয় বিনয়েও নিবৃত্ত করা গেল না বিম্ববতীকে। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, তিনি যাত্রার পাকাপাকি ব্যবস্থা আগে থেকেই করে তারপর খবর দিয়েছেন নবীনকুমারকে। এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া কিংবা নিজের উদ্যোগে এতখানি ব্যবস্থা জীবনে আগে কখনো করেননি বিম্ববতী। তাঁর সিদ্ধান্তে তিনি অনড়।
যাবেনই যখন তখন আর কয়েকটি দিন সময় চাইলো নবীনকুমার বিম্ববতীর কাছে। কিন্তু তাও সম্ভব নয়। আগামী কাল যাত্রার পক্ষে অতি শুভ দিন। তখনই নবীনকুমার মহাব্যস্ত হয়ে বন্দোবস্তের জন্য লেগে গেল। সাতজন দাসদাসী যাবে বিম্ববতীর সঙ্গে। একজন গোমস্তার হাতে টাকা দিয়ে দেওয়া হলো, যেন পৌঁছেই সে বিম্ববতীর জন্য হরিদ্বারের শ্রেষ্ঠ বাড়িটি ক্রয় করে ফেলে। তেমন বাড়ি না পাওয়া গেলে একনাথজীর আশ্রমেই যেন একটি পাকা বাড়ি তৈরি করে ফেলা হয়। সারা বাড়িতে একটা হুলুস্থুলু পড়ে গেল।
এর পর বিধুশেখরের কাছ থেকে বিদায় নেবার পালা। তাঁকে কেউ ডেকে পাঠায়নি। কিন্তু সেই বৃদ্ধের কানে সব খবরই যথাসময়ে পৌঁছোয়। তিনি এলেন বেশ গভীর রাত্রে।
তখন নবীনকুমার মায়ের ঘরে উপস্থিত। বিধুশেখরকে সে সব বৃত্তান্ত খুলে বললো। যথারীতি বিধুশেখর এক কথায় প্রস্তাবটি উড়িয়ে দিলেন প্ৰথমে। আবার বাদ-প্রতিবাদ চললো। কিন্তু যে বিম্ববতী ভয়ে বিধুশেখরের সামনে এতদিন কথা বলতেই পারেননি, আজ তাঁর মুখে ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই। মাথায় আজ আর ঘোমটা দেননি। তিনি, সব কথার উত্তরে তাঁর এক কথা, তাঁকে যেতেই হবে।
বিধুশেখর এক সময় নবীনকুমারকে বললেন, তুই একবার ঘরের বাইরে যা তো, তোর মাকে আমি একটু বুঝিয়ে বলি।
বিম্ববতী সঙ্গে সঙ্গে বললেন, না, ছোট্কু থাক। তারপরেই উচ্ছ্বসিত কান্না এসে গেল বিম্ববতীর চক্ষে। তিনি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ধরা গলায় বললেন, আপনি-আপনি ছোট্কুকে স্নেহের চোকে দেকবেন…তার যাতে মঙ্গল হয়…সে কতা দিয়েচে কখুনো আপনার অবাধ্য হবে না, আপনার সঙ্গে তার অসৈরণ হবে না।
ধীর, শান্ত কণ্ঠে বিধুশেখর বললেন, এ কী কথা বলচো, বিম্ব। ছোট্কু আমার প্রাণাধিক, তার সঙ্গে আমার বিবাদ হবে কেন? বিষয় সম্পত্তির ব্যাপারে মতভেদ হয়, কিন্তু ছোট্কু যে আমাদের সকলের বড় আদরের, তার কোনো ইচ্ছেতে আমি বাধা দি? কি রে ছোট্কু বল?
নবীনকুমার সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লো। বিধুশেখর নবীনকুমারের কাঁধে হাত রেখে নরমভাবে বললেন, তোর মায়ের সঙ্গে আমি একটু একলা কতা বলবো, একবার শেষ চেষ্টা করে দেকি, বোঝাতে পারি কিনা। তীর্থ করতে হয় নবদ্বীপ যাক না, কিংবা বৈদ্যনাথধাম ঘুরে আসুক, ভালো রাস্তা। কী, ঠিক বলিচি কিনা? তুই একটু বাইরে যা। দেকিস, ইদিকে যেন কেউ না আসে।
নবীনকুমার এই সন্ধ্যার ঘটনায় বড় দিশাহারা হয়ে পড়েছে। সে বাইরে বেরিয়ে গেল। বিধুশেখর খোঁড়াতে খোঁড়াতে গিয়ে বিম্ববতীর বিছানায় ভর দিয়ে দাঁড়ালেন। চোখ থেকে চশমা খুলে ঝুলিয়ে রাখলেন গলার কাছে।
বিম্ববতী অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রইলেন। তৎক্ষণাৎ তিনি ঠিক করে ফেলেছেন যে বিধুশেখরের স্পর্শ করা পালঙ্কে তিনি আর ঘুমোবেন না। আজ রাতটা তিনি ভূমিশয্যায় কাটাবেন।
হাতের ছড়িটা মেঝেতে কয়েকবার ঠুকে বিধুশেখর বিম্ববতীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলেন। তিনি এমনভাবে বিম্ববতীর দিকে চেয়ে আছেন যেন বনের ব্যাঘ্ৰ দেখছে তার পলায়মান শিকারকে।
কড়া গলায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছো? তোমার ছেলেকে, না আমাকে?
বিম্ববতী অন্যদিকে মুখ রেখেই বললেন, ভগমন আমায় ডেকেচোন, তাই আমায় যেতে হবে।
বিধুশেখর শুকনোভাবে হাসলেন। তারপর ছড়িটা আবার ঠকাতে ঠুকতে বললেন, অদ্ভুত কতা। ভগবান কখনো কোনো স্ত্রীলোককে ঘর ছাড়াবার জন্য ডাকেন না। স্ত্রীলোকদের ঠাঁই শুধু সংসারে।
—তিনি মীরাবাঈকে ডেকেচিলেন!
—হুঁ। মুখে বুলি ফুটেচে দেকচি। এসব বুলি ঐ একনাথজীর শেকানো। ও ব্যাটা বোষ্টম। ও বোষ্টম হয়ে শাক্ত বাড়ির বৌকে দীক্ষে দেয় কোন সাহসে? আর তুমিই বা আমার মতামত না নিয়ে ওর কাচে গ্যালে কেন?
এবার বিম্ববতী মুখ ফেরালেন। এখনো তাঁর দুই নেত্ৰে অবারিত জলোচ্ছ্বাস। এত কান্নাও বিম্ববতীর বুকে জমা ছিল!
তিনি হাত জোড় করে বললেন, আপনি দয়া করুন। যাবার সময় আপনি ভালো মনে আমায় বিদায় দিন। আমায় আশীর্বাদ করুন। আমি ঠাকুরের কাচে আপনার নামে…
বিধুশেখর বিছানার ওপর চাপড় মেরে বললেন, ইদিকে এসো। আমার পাশে এসো। আমার বুকের ওপরে মাতা দিয়ে কাঁদো। আমার বুক খালি করে তোমার জন্যে সব ন্যায় নীতি বিসর্জন দিয়িচি।
বিম্ববতী দুপা পিছিয়ে গিয়ে বললেন, না। না। অশুচি। আমায় আর কেউ ছোবে না।
—বিম্ব, কেন আমায় দুঃখ দিচ্চো? তোমায় ছেড়ে আমি যে আর থাকতে পারবো না, তা বুঝতে পারো না? কেন খেলচো আমায় নিয়ে? তুমি চলে গিয়ে আমায় মেরে ফেলতে চাও? এই শেষ বয়েসে, তোমার জন্যে সব ন্যায় নীতি বিসর্জন দিয়িচি আমি। বহুদিন চেপে রাখা কামনার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলচে। শুধু সামাজিকতা আর বিষয় সম্পত্তির কতা চিন্তা করে নিজেকে বঞ্চিত করিচি আমি। এ শরীরের আর কিচু নেই। এ চোখে দেখি না। বাঁ পায়ে জোর নেই, তবু এ শরীর তোমাকে চায়। বিম্ব, এসো, আমার বুকে মাতা রেকে একটু কাঁদো। আমিও কাঁদবো তোমার সঙ্গে।
বিম্ববতী স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। বৃদ্ধ বয়েসে বিধুশেখরের লালসার চরম রূপ দেখেছেন তিনি। কোনো রকম খবর না দিয়ে যখন তখন বিধুশেখর চলে আসেন বিম্ববতীর কক্ষে। বিনা দ্বিধায় দ্বার বন্ধ করে দেন। চতুর্দিকে দাসদাসী গিস গিস করছে, তারা কি দেখে না? নবীনকুমার এদিকে বিশেষ আসে না, কিন্তু পুত্রবধুর চোখে তো পড়তে পারে। বাধা দেবার সাধ্য নেই বিম্ববতীর, ভয়ে এবং লোকলজ্জায় তিনি চিৎকার করে উঠতে পারেননি। বিম্ববতীর শরীরে আর যৌবন নেই, রূপ নষ্ট করার জন্য তিনি চুল কেটে ফেলেছেন, তবু তাঁর প্রতি বিধুশেখরের অসম্ভব লোভ। ভোগ করার শক্তিও নেই বিধুশেখরের, যেন তাঁর উদরাময় রোগীর মতন ক্ষুধা। সব সময় আলিঙ্গনের জন্য হাহাকার করেন। বিম্ববতীকে নীরব দেখে বিধুশেখর বললেন, তোমার জন্য তোমার সন্তানের শত দোষ ক্ষমা করিচি। আমি চাইলে অ্যাতদিন তোমাদের পথের ভিকিরি করে দিতে পাতুম। সেজন্য একটু কৃতজ্ঞতা নেই তোমার? শোনো, আমার উইলে আমার সম্পত্তির অর্ধেক লিকে দিইচি ছোট্কুর নামে। আমি মলে সে আমার মুখাগ্নি করবে, আমায় পুন্নাম নরক থেকে বাঁচাবে। যতই সে উড়িয়ে পুড়িয়ে খর্চা করুক, এত সম্পত্তি পেলে সে রাজসুখ ভোগ করে যাবে। তার বিনিময়ে তুমি আমায় কিচু দাও, বিম্ব। আমি ভিকিরি হয়ে তোমার কাচে হাত জোড় করে চাইচি, তুমি আমায় ছেড়ে যেও না। তুমি আমায় দয়া করে। আর যে কটা দিন বেঁচে আচি তোমার ঐ নরম হাতের সেবা থেকে আমায় বঞ্চিত করো না।
বিম্ববতী তার কোনো উত্তর দিলেন না। বিধুশেখর আরও অনেক কাকুতি মিনতি করতে লাগলেন। কিন্তু বিম্ববতী প্রস্তর মূর্তি। অকস্মাৎ আবার রূপ বদলে গেল বিধুশেখরের।
—ইদিকে আয়, হারামজাদী!
বিম্ববতী মুখ থেকে সমস্ত ভয় মুছে ফেললেন। তারপর শান্ত কণ্ঠে বললেন, না। আর আমি পাপ কর্বো না।
—তোকে আমি ছেকল দিয়ে বেঁদে রাকবো। তুই কোতায় যাবি ভেবিচিস? চতুর্দিকে তোর কেলেঙ্কারির কতা রাষ্ট্র করে দেবো। ছেলে পাবার লোভে তুই একদিন স্বেচ্ছায় আমার সঙ্গে ব্যভিচার করিসনি? এখুন সতীপনা দেকানো হচ্চে? পাছায় কাপড় নেই, মাতায় ঘোমটা? আমার হাত ছাড়িয়ে পালাবি! দেকি তোর কেমন সাধ্য?
অকম্পিত কণ্ঠে বিম্ববতী বললেন, হ্যাঁ, আমি চলে যাবো, আমায় কেউ আর আটকাতে পার্বে না।
বিছানা ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন বিধুশেখর। লাঠি ভর দিয়ে এক পা এক পা এগুতে এগুতে বললেন, আজ হেস্তনেস্ত হয়ে যাক। বাইরে তোর ছেলে রয়েচে, সবাই রয়েচে, তাদের সবার সামনে বলে যাবো, তুই আসলে বিধু মুকুজ্যের রাঁড়ি। ভালো চাস তো এখুনো আমার বুকে আয়।
বিম্ববতী দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালেন। বিধুশেখর খুব কাছাকাছি এসে পড়তে তিনি বললেন, ছোবেন না, আমায় ছেবেন না, নোংরা, নোংরা, সব নোংরা–
বাঁ হাতটি উঁচু করে মধ্যমার একটি আঙটি দেখিয়ে বিম্ববতী বললেন এর মধ্যে বিষ আচে, কদিন হলো জোগাড় করে রেকিচি, আর একবার অশুচি হলেই আমি বিষ খাবো।
চেপে বিধুশেখর বললেন, তবে তাই থা। বিষ খেয়ে ছটপটিয়ে মর আমার সামনে, আমি তাই দেকি।
বিম্ববতী আঙটির ঢাকনাটা খুলে ফেললেন। তারপর কপালে হাত ঠেকিয়ে ইষ্টদেবের উদ্দেশে প্ৰণাম জানিয়ে আঙটিটিা ওষ্ঠে ঠেকাতে গেলেন।
ডান হাতের ছড়িটা তুলে বিধুশেখর খুব জোরে মারলেন বিম্ববতীর বিষময় আঙটি সমন্বিত হাতটিতে।
তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে আস্তে আস্তে বললেন, ন জাতু কামঃ কামনাম উপভোগেন শাম্যাতি। আমি জানি। কামের দ্বারা কামের উপশম হয় না। বলপ্রয়োগে নারীকে ভোগ করা পশুর প্রবৃত্তি। সবই জানি। শুধু এটাই জানতুম না, মানুষের মন সব সময় যুক্তি মানে না। এক এক সময় ন্যায়-নীতি-ধর্ম সবই তুচ্ছ হয়ে যায়। বিম্ব, যদি হরিদ্ধারে গিয়ে শান্তি পাও, তবে তাই যাও। আমি এখেনেই জ্বলে পুড়ে মর্বো, সেই আমার নিয়তি। আমা দ্বারা তোমার ছেলের কোনো ক্ষতি কখুনো হবে না। তুমি সেই কতটাই শুনতে চাও তো? কতা দিলুম।
বিম্ববতী এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার সাতদিনের মধ্যে পরপর দুজন বাহকের হাতে দুটি পত্র এসে পৌঁছেলো। একটি লিখেছে। বিরাহিমপুর কুষ্ঠীর নায়েব ভুজঙ্গ ভট্টাচাৰ্য আর একটি লিখেছে পুলিশের এক দারোগা। দুটি চিঠিতেই গঙ্গানারায়ণের সংবাদ আছে, কিন্তু দুজনের সংবাদ দুরকম।