কুসুমকুমারীর পিত্ৰালয়ে প্রায়ই নানা উপলক্ষে খুব ধুমধাম হয়। এ গৃহে সুখ ও সমৃদ্ধি যেন পরস্পরের হাত ধরে আছে।
কুসুমকুমারীর পিতারা পাঁচ ভাই, তাঁরা সকলেই একান্নবর্তী। তাঁদের পুত্র কন্যার সংখ্যাও বর্তমানে সব মিলিয়ে সাতাশ, কুসুমকুমারীর নিজের সহোদর সহোদরার সংখ্যাই নয়। সুতরাং এতবড় পরিবারের একেবারে এক কোণে বিধবা কুসুমকুমারীর হারিয়ে যাবার কথা ছিল। কিন্তু তা হলো না। বিধবা বলেই কুসুমকুমারীকে ঠেলে দেওয়া হলো না ঠাকুরঘরে। তার পিতা-মাতা ভালো করে খোঁজ খবর না নিয়েই যে এক উন্মাদের সঙ্গে তার বিবাহ দিয়েছিলেন, সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য তাঁরা কুসুমকুমারীর প্রতি আদরের বন্যা বইয়ে দিলেন। তার জন্য নির্ধারিত হলো এ গৃহের একটি সুসজ্জিত কক্ষ, দুটি দাসী নিযুক্ত করা হলো তার সেবার জন্য।
কুসুমকুমারীর পিতা কৃষ্ণনাথ রায়ের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের কিছু ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে। কিছুদিনের মধ্যেই কৃষ্ণনাথকে কার্যোপলক্ষে ত্রিপুরায় যেতে হলো, তিনি কুসুমকুমারীকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। সম্ভ্রান্ত পরিবারের যুবতী বিধবার পক্ষে দেশ ভ্ৰমণ প্রায় অকল্পনীয় ব্যাপার, কিন্তু কৃষ্ণনাথ নিছক আচারবদ্ধ মানুষ নন, তিনি তেজস্বী পুরুষ, নিজের বিচার বুদ্ধি অনুযায়ী কাজ করেন, পাঁচজনের কথা অগ্রাহ্য করার সাহস রাখেন। বদ্ধ জীবন ছেড়ে কিছুদিন বাইরে ঘুরে শোকসন্তপ্তা কন্যাটির যে যথেষ্ট উপকার হবে, সে কথা ভেবেই তিনি কুসুমকুমারীকে নিয়ে গেলেন ত্রিপুরায়।
কুসুমকুমারীর অবশ্য সন্তাপ ছিল, কিন্তু শোক ছিল না। যে-স্বামীর সঙ্গে তার কোনো দিন একটিও স্বাভাবিক বাক্য বিনিময় হলো না, হৃদয় বিনিময় তো দূরের কথা, যাকে দেখে সে শুধু ভয়ই পেয়েছে, তার মৃত্যুতে আবার শোক কী? শুধু বুকের ওপর সর্বক্ষণ যেন পাষাণভার চেপে থাকে।
ত্রিপুরার পথে পাহাড় ও অরণ্যানীর মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে আস্তে আস্তে তার হৃদয় উন্মোচিত হয়। প্রকৃতি দর্শনে মুগ্ধ হবার মতন চক্ষু তার আছে। প্রতিটি দৃশ্যই তার কাছে নতুন মনে হয়। নদীবক্ষে শত শত কাঠের গুঁড়ি ভেসে যেতে দেখলে একই সঙ্গে সে বিস্মিত ও উল্লসিত হয়ে ওঠে। এই ভাবে এক দেশ থেকে অন্য দেশে কাঠ চালান যায়, বাঃ ভারি বুদ্ধির ব্যাপার তো! মধ্যে মধ্যে চোখে পড়ে শিশুর মতন দুষ্টুমিভরা দৃষ্টি নিয়ে ছুটে যাওয়া ধূসর রঙের বন-খরগোশ। কুসুমকুমারীর ইচ্ছে হয় ছুটে গিয়ে ওদের ধরতে।
যাত্রীদলটির সঙ্গে প্রহরা দিয়ে চলেছে ত্রিপুরা রাজবাহিনীর কয়েকজন সৈনিক। সুতরাং বিপদের কোনো ভয় নেই। কৃষ্ণনাথ বাইরে এসে কন্যার আবুর ব্যাপারেও বিশেষ কড়াকড়ি করেন নি, জনপদের বাইরে দিয়ে যাবার সময় কুসুমকুমারীর পাল্কির দু পাশ খোলা থাকে। কখনো ইচ্ছে হলে সে তার পরিচারিকাকে সঙ্গে নিয়ে বনের মধ্যে হেঁটেও আসতে পারে।
ত্রিপুরায় ধর্মনগর নামে এক স্থানে এক রাত্ৰিবেলা ওদের তাঁবু পড়েছে। কাছেই একটি জলাশয়ের ওপারে খানিকটা জঙ্গল। পূর্ণিমার রাত, আকাশ ধুয়ে যাচ্ছে জ্যোৎস্নায়। কুসুমকুমারী সেই জলাশয়ের ধারে এসে বসেছে। এক একবার সে জল দেখছে, এক একবার দেখছে আকাশ। আজ চন্দ্ৰকিরণের এত জোর যে পাতলা মেঘ ভেদ করেও দেখা যায় পূর্ণ চাঁদ। মেঘগুলি শন শন করে ছুটছে, অথবা এক এক সময় কুসুমকুমারীর ভ্রম হয় মেঘগুলিই বুঝি থেমে আছে, আর চাঁদ ছুটছে অমন করে।
হঠাৎ অদূরে চক চক শব্দ হতেই কুসুমকুমারী চমকে তাকালো। তার পর সে যেন নিজের চক্ষুকেই বিশ্বাস করতে পারলো না। সেই সরোবরে জলপান করতে এসেছে দুটি চিত্রল হরিণ। কুসুমকুমারী এর আগে কখনো জীবন্ত হরিণ দেখে নি। সমস্ত হৃদয়টাকে দু চক্ষে এনে সে দেখতে লাগলো হরিণ দুটিকে এবং তাকে সাহায্য করার জন্যই যেন সেই সময় মেঘ সরে গিয়ে বেশী করে আলো পড়লো। সেখানে। হরিণ দুটি এত কাছাকাছি মানুষের উপস্থিতি টের পায় নি আগে, একটু পরে সজাগ হতেই তারা এক সঙ্গে লাফিয়ে উঠলো। তাদের সেই ছন্দময় লম্ফ এবং সমস্ত শরীরে ঢেউ খেলিয়ে ছুটে যাওয়ার দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কুসুমকুমারী, তার সর্বশরীরে রোমাঞ্চ হলো। পৃথিবীটা এত সুন্দর!
সেইখানে আচ্ছন্নের মতই বসে ছিল কুসুমকুমারী, একটু পরেই একসঙ্গে অনেক মানুষের চিৎকারে সজাগ হলো সে। রক্ষীর দল হরিণ দুটিকে দেখতে পেয়েছে, ওদের বধ করার জন্য তারা পিছু ধাওয়া করেছে। কুসুমকুমারী তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালো। তার পিতাকে বলে সে ওদের নিবৃত্ত করবে। এমন স্নিগ্ধ, সুষমাময় রাত্রেও কি মানুষের হিংসার কথা মনে আসে! কুসুমকুমারীর মনে পড়ে গেল শকুন্তলার গল্পের কথা। এই স্থানটি যেন তপোবন, এখানে জীব হত্যা নিষেধ। তারপর তার মনে হলো, এমন জ্যোৎস্নাময় রাত্রে, সমস্ত পৃথিবীটাই তপোবন, কোথাও কারুর মনে এখন হিংসা থাকা উচিত নয়।
কুসুমকুমারী এগিয়ে যেতে লাগলো তাঁবুর দিকে। লোকগুলি হরিণ দুটিকে শেষ পর্যন্ত খুঁজে পায়নি শুনে সে নিশ্চিন্ত হলো। আবার ফিরে এলো সেই জলাশয়ের কাছে। জলের ওপর ভাসছে। চাঁদ, আকাশেও চাঁদ, এই দুই চাঁদ দেখতে দেখতে মগ্ন হয়ে রইলো সে, যেন তার শরীরের প্রতিটি রন্ধে সুখানুভূতি হচ্ছে। তার সতেরো বছরের জীবনে এমন আনন্দ সে যেন আর কখনো পায় নি। তবু, চতুর্দিকে এত সুন্দরের মধ্যে বসে থেকেও কুসুমকুমারীর এক সময় মনে হলো, চিত্রল হরিণ দুটি কেন সে দেখলো? শকুন্তলার গল্পটা না মনে পড়লেই ভালো হতো। এ সময়। সে কিছুতেই দমন করতে পারলো না একটা দীর্ঘশ্বাস। শকুন্তলা তার মতন বিধবা ছিল না!
ত্রিপুরা থেকে প্রায় তিন মাস পরে কুসুমকুমারী আবার ফিরে এলো কলকাতায়। তখন তাদের বাড়ির ছেলেরা মিলে একটি নাটক অভিনয়ের ব্যাপারে মেতে উঠেছে।
এই পরিবারের পুরুষরা কেউ প্রকাশ্যে মদ-মেয়েমানুষের চাচা করে না। গোপনে কার কোন দিকে যাতায়াত আছে, তা কে জানে, কিন্তু বাড়িতে ও সবের কোনো স্থান নেই। কুসুমকুমারীর পিতা কৃষ্ণনাথ অবশ্য প্রকৃতই সচ্চরিত্র পুরুষ, তাঁর ঝোঁক আছে ধ্রুপদী সঙ্গীতের প্রতি। এ গৃহের বালকদের স্কুল-কলেজে পড়া বাধ্যতামূলক। যুবকরা পায়রা ও ঘুড়ি ওড়ানোর মতন নির্দোষ আনন্দে মত্ত থাকে। দোল-দুর্গোৎসবে যাত্রা ও পালাগান হয়। এবার তারা নিজেরাই নাটক করবে। নির্দেশক, অভিনেতা, গায়ক-বাদক প্রায় সকলেই এ বাড়ির ছেলে। বাড়ির মেয়েদের অংশ গ্ৰহণ করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না, তবে নাটমহলে মহড়ার সময় মেয়েদের উপস্থিত থাকায় কোনো দোষ নেই। নাটকের নাম বিক্রমোর্বশী। জোড়াসাঁকোর সিংহবাড়িতে নবীনকুমার সিংহের এই নাটকের অভিনয় দেখে বাগবাজারের ছেলেরা মুগ্ধ হয়েছিল, তাই তারা সেই নাটকই মঞ্চস্থ করতে চেয়েছে। কুসুমকুমারী আগাগোড়া বসে বসে মহড়া দেখে, এক একবার সে তার মেজদা, ছোড়দা, ফুলদাদের কিছু কিছু নির্দেশও দেয়।
একদিন দুর্গামণি একটি পত্র পাঠালো তাকে।
আমার পরম মেহের ধনকুসুম সোনা, আজ ছয় মাস হইল তোরে দর্শন করি নাই। দিবারাত্র বার ২ মনে পড়ে তব ফুল্ল কুসুমিত মুখখানি। ঐ নীল নয়নমণি দুইটি কী কহিব সর্বদা আমার সঙ্গে ২ ফেরে। তুই এই পাপের গৃহে আর কোনোদিন পদম্পর্শ করবি না জানি, কেনই বা করিবি, তোর উদ্ধার হইয়া গিয়াছে। আমি হতভাগিনী আর কোথায় যাইব এই পাপ পুরীতেই পচিয়া মরা বৈ আর কোনো গতি নাই। শ্ৰীমান সত্যপ্ৰসাদ মধ্যে ২ তোমার কথা বলে। বেচারি বড় মুষড়াইয়া পড়িয়াছে, উহার বোধহয় এস্থান হইতে বাস উঠিল। উহার মাতা বিবাহের জন্য পীড়াপীড়ি করিতেছেন সে পাশ না দিয়া বিবাহ করিতে চাহে না। আর খেলা জমে না।
ওরে কুসোম, তুই বড় বাঁচা বাঁচিয়া গিয়াছিস। রাক্ষস পাগোল স্বামীর সহিত সারা জীবন জ্বলিয়া পুড়িয়া মরার চাহিতে স্বাধীন বৈধব্য শতগুণ ভালো। স্বাধীন বৈধব্য এমন কথা সত্যপ্ৰসাদ একবার তোর সম্পর্কে বলিয়াছিল, আমার বড় মনে ধরিয়াছে। আহা আমি যদি এমত স্বাধীন বৈধব্য পাইতাম! তুই বিধবা থাকিবি কেন আমার মতন তোর বয়স তো তিনকাল গিয়া এককালে ঠেকে নাই— ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর অবলাদিগের সুরাহা করিয়াছেন। তোর কাঁচা বয়স, তোর পুনরায় বিবাহ হইবে, হইবেই হইবে, এমন যার রূপ সেই যে বৃন্দাবন গোস্বামী ঠাকুর একবার গান শুনাইয়াছিলেন ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণি তুই যেন সেই। বলিব কি কুসোম, আমি যদি পুরুষ মানুষ হইতাম তবে বলপূর্বক তোরে হরণ করিয়া লইয়া যাইতাম কোনো দূর দেশে। আমার এই জীবনটা বৃথাই গেল, তুমি ভাগ্যবতী হও, কোনো রূপবান গুণবান পুরুষ তোমারে গ্রহণ করিয়া ধন্য হউন। সত্যপ্ৰসাদ এই পত্র পাঠ করিবার জন্য আকুতি করিতেছে তাহাকে দেখাইব না। সুতরাং আর লিখিব না। আর অধিক কী। ইতি আং
তোমার খুড়ী ঠাকুরানী দুর্গামণি।
পত্রখানি অন্তত দশবার পাঠ করলো কুসুমকুমারী। পড়তে পড়তে সে হাসলো, কাঁদলো, তার পর সেখানি কুটিকুটি করে ছিঁড়ে সে উড়িয়ে দিল বাতাসে। এই পত্র অন্য কেউ দেখে ফেললে কতখানি লজ্জার ব্যাপার হবে। দুর্গামণির মুখের কোনো বাঁধন নেই। আবার বিবাহ? ছিঃ!
কুসুমকুমারী অবশ্য জানে না যে তার পুনর্বিবাহ নিয়ে ইতিমধ্যেই খানিকটা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে। কুসুমকুমারীর জ্যেষ্ঠভ্রাতা নৃপেন্দ্রনাথের দুটি শিশুপুত্রের গৃহশিক্ষক যদুপতি গাঙ্গুলী, তার সঙ্গে নৃপেন্দ্রনাথের মাঝে মধ্যে দেশ ও সমাজ রিষয়ে আলোচনা হয়। যদুপতি গাঙ্গুলী বিদ্যোৎসাহিনী সভার সদস্য এবং বিদ্যাসাগরের চ্যালা। নৃপেন্দ্রনাথ ঐ যদুপতির প্ররোচনায় কয়েকটি দুঃস্থ বিধবার বিবাহের সময় কিছু আর্থিক সাহায্য করেছিলেন। কুসুমকুমারী এ বাড়িতে বিধবা হয়ে ফিরে আসার কিছুদিন পর যদুপতি একদিন নৃপেন্দ্রনাথকে বললেন, আপনি বিধবা বিবাহের সমর্থক, আপনি আপনার এই ভগিনীর আবার বিবাহ দিন না কেন! প্রস্তাব শুনে নৃপেন্দ্রনাথ আমতা আমতা করতে লাগলেন। তৎক্ষণাৎ সায় দিতেও পারেন না। আবার গৃহশিক্ষকের কাছে প্রাচীনপন্থী সাজতেও চান না। তিনি বললেন, আমার অমত না থাকলেও আমার বাবা এ পরিবারের কতা, তাঁর সম্মতি বিনা তো কিছু হতে পারে না। যদুপতি তখন বললেন, আপনার বাবার কাছে এ প্রস্তাব পেশ করুন। তবে। শুনেছি আপনার বাবা রামতনু লাহিড়ী মশায়ের একজন সুহৃদ। আপনি জানেন নিশ্চয় যে রামতনু লাহিড়ী, রামগোপাল ঘোষ প্রমুখ বিধবা বিবাহ কার্যে মহোৎসাহী?
আচ্ছা দেখি, বলে নৃপেন্দ্রনাথ তখনকার মতন এড়িয়ে যান। রাশভারী কৃষ্ণনাথের কাছে এরকম কথা বলতে নৃপেন্দ্রনাথের সাহস হয় না। কৃষ্ণনাথ যদি রাজি হন তো তখুনি এমন সুপরামর্শের জন্য পাত্রকে স্নেহ-সম্ভাষণ করবেন, আর যদি রাজি না হন তো অমনি একেবারে ক্ৰোধে অগ্নিশর্মা!
নাছোড়বান্দা যদুপতি কিছুদিন অন্তর অন্তরই বিষয়টা মনে করিয়ে দেয় নৃপেন্দ্রনাথকে। নৃপেন্দ্রনাথ এখন গৃহশিক্ষকটিকে দূর থেকে দেখলেই সোজা একেবারে শয়ন ঘরে ঢুকে দ্বার রুদ্ধ করে বসে থাকেন। তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ দুই ভাইকে একটু বাজিয়ে দেখেছেন নৃপেন্দ্রনাথ। সেই ভাই দুটির কোনো আপত্তি নেই কুসুমকুমারীর পুনর্বিবাহে, কিন্তু তারাও কেউ কৃষ্ণনাথের কাছে গিয়ে এই প্রসঙ্গ তোলার সাহস পায় না।
এক ভাই একটি কার্যকর বুদ্ধি দিল। কৃষ্ণনাথের মনোভাব যাচাই করার সাহস যখন তাদের নেই, তখন অন্য একটা পন্থা গ্ৰহণ করা যেতে পারে। রামতনু লাহিড়ী মহাশয়ের কাছে গিয়ে যদি অনুরোধ করা যায়, তিনি কৃষ্ণনাথকে কুসুমকুমারীর পুনর্বিবাহের কথা বলুন। কৃষ্ণনাথ রাজি না হলেও রামতনু লাহিড়ীর মতন মান্য বন্ধুর ওপর তো রাগ করতে পারবেন না! সেই অনুযায়ী রামতনু লাহিড়ীর খোঁজ নেওয়া হলো। কিন্তু দুঃখের বিষয় লাহিড়ী মহাশয় এখন কৃষ্ণনগরে। তাঁর কলকাতায় আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই।
কুসুমকুমারীর ফুলদাদা হেমেন্দ্ৰনাথ সাজছে উর্বশী। সে বেচারির দুপা হাঁটলেই শাড়ি খুলে যায়। তা দেখে নাটমঞ্চের সিঁড়িতে বসা বাড়ির মেয়েরা একেবারে হেসে গড়িয়ে পড়ে। সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ হেমেন্দ্র রাগ করে বলে, দিদিরা থাকলে আমি পাট বলবো না! মহড়ার সময় ওদের থাকা চলবে না!
তখন মেয়েরা কলকল করে ওঠে। কুসুমকুমারীর সেজদিদি বলেন, ওরে হেমু, আসল থ্যাটারের দিনে অ্যাক্টো করার সময় তোর যদি শাড়ি খুলে যায়, তখন ভালো হবে?
কুসুমকুমারী বলে, অ সেজদি, হেমু বলেচে, উর্বশী মালকোঁচা মেরে শাড়ি পরবো!
এক হাতে তলোয়ার ধরা পুরুষরা পর্যন্ত হেসে ওঠে!
নাট্য নির্দেশক পিসতুতো দাদা নগেন্দ্রনাথ গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলে, অ্যাই, কী হচ্চে! এটা ছ্যাবলামোর জায়গা? ইন্দু, শশী, কুসী, ক্ষেমী তোরা এবার ভাগ এখেন থেকে!
সেজদিদি ইন্দুমতি বলেন, তোরা থ্যাটারের সময় লোক হাসালে আমাদের বাড়ির নাম খারাপ হবে না? মেয়েদের পাট আমরা করে দেখিয়ে দিচ্ছি, তোরা শিখে নে।
যাও, যাও, তোমাদের আর ধিঙ্গিাপনা কর্তে হবে না! এখুনি ইদিকে বড়োদাদা এসে পড়লে দেকাবে মজা।
-ওমা, ওমা, নস্তু ওর শাড়িতে বেল্ট বেঁধেচে দ্যাক। অনন্তু, সখীরা বেল্ট বেঁধে এস্টেজে নামবে নাকি রে? হি-হি-হি!
মেয়েদের রঙ্গরস অবশ্য অকস্মাৎ থেমে গেল। এই সময় সেখানে এসে পড়লো স্বয়ং নাট্যকার নবীনকুমার সিংহ। ঠিক পাশের গৃহেই তার শ্বশুরালয়। এ বাড়ির যুবকরা তাকে অনুরোধ জানিয়েছিল একবার এসে মহড়া দেখে যেতে এবং কিছু পরামর্শ দিতে।
সরোজিনীদের সঙ্গে এ বাড়ির কিছুটা আত্মীয়তা আছে, সেই হিসেবে নবীনকুমার এ বাড়ির কুটুম্বের মতন। তাকে দেখে মহিলারা ঘোমটা দিয়ে মুখ ফেরালো, কেউ কেউ আড়ালে সরে গেল, কয়েকজন একই জায়গায় বসে রইলো, তাদের সঙ্গে নবীনকুমারের রসিকতার সম্পর্ক।
কোঁচানো ধুতি ও নীল মখমলের বেনিয়ান পরা নবীনকুমার চত্বরের মাঝখানে গম্ভীর মুখে দাঁড়ালো, তার হাতে একটি রূপো বাঁধানো ছড়ি। তার চেয়েও বেশী বয়েসী যুবকদের উদ্দেশ করে ভারিক্কী গলায় সে বললো, তা কেমন হচ্চে-টচ্চে শুনি! সুরেন্দ্রবাবু বুঝি পুরুরবা সেজেছেন?
কুসুমকুমারী সিঁড়ির আসন ছেড়ে উঠে অবনতমুখে চলে গেল অন্দর মহলে। যাবার সময় নবীনকুমারের সামনে দিয়ে আসতে হলো তাকে। সে মুখ তুললো না একবারও। এই নবীনকুমারের ব্যাধির সময় সে একবার দেখতে গিয়েছিল, তখন নবীনকুমার একটিও কথা বলেনি তার সঙ্গে। সে কথা তার মনে আছে। নবীনকুমার এবারেও অবশ্য থান কাপড় পরা এই তরুণীটির দিকে চেয়েও দেখলো না।
পরদিন সরোজিনী এলো এ বাড়িতে। সকলের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎসেরে একেবারে শেষ কালে সে এলো কুসুমকুমারীর কাছে। সরোজিনী এর আগেও কুসুমকুমারীর সঙ্গে দেখা করে গেছে কয়েকবার। যখনই সে পিত্ৰালয়ে আসে, এ বাড়িতেও একবার ঘুরে যায়। আজ এসে সরোজিনী কুসুমকুমারীর হাত জড়িয়ে ধরে বললো,অ কুসুম দিদি, তুমি একবার আমাদের বাড়িতে চলো! এখুনি চলো।
কুসুমকুমারী বললো, কেন রে, তোদের বাড়িতে যাবো কেন?
সরোজিনী তাকে টেনে তোলার চেষ্টা করে বললো, চলো না! একবারটি চলো! আমার আজ্জপুত্র তোমার সঙ্গে কতা কইতে চেয়েচেন!
—কী বললি! কী পুত্র!
—আজ্জপুত্র! আমি সব সময় অন্যদের কাচে আমার বর, আমার বর বলি তো, তাই উনি বলেচেন, বর বর বলো কেন? বর তো শুধু বিয়ের দিন হয়। তোমাকে কি এখুন আমি আমার কনে, আমার কনে বলবো? তুমি আমায় আজ্জপুত্র বলবে।
কুসুমকুমারী হেসে বললো, ও, আৰ্যপুত্র! বরের বদলে আৰ্যপুত্র! এ যে কেমন যাত্রা যাত্রা শোনায়!
-কী করি বলো দিদি। ওনার যে খেয়াল! কত রকম খেয়াল যে ওঁর হয়!
—তা তোর বরের সঙ্গে আমি কী কতা কইবো!
—একবার চলোই না! তুমি যে বেধবা হয়েচো, সে কতা তো উনি জানতেনই না, আমি কাল রাতের বেলায় বল্লুম! তা শুনে উনি বললেন, আহা, কোন মেয়েটি গো? সেই যার সঙ্গে আমাদের পুতুলের বে হয়েছেল? তাকে একবার ডাকো না?
—সরো, তুই যেমন পাগল, তোর বরও তেমনি পাগল! সেই পুতুল খেলা, সে সব কবেকার কতা! বিধবা মেয়েকে কি পরের বাড়ি যেতে আচে!
-আমরা তোমার পর? আমাদের বাড়ি তোমার হলো গে পরের বাড়ি?
সরোজিনীর স্বভাবটি এখনো ছেলেমানুষীতে ভরা। কুসুমকুমারীর চেয়ে সে বয়েসেও কিছুটা ছোট। একটু অমনোমত কথা শুনলেই সে অভিমানে ওষ্ঠ ফোলায়। তা সরোজিনীর অভিমানের কারণ আছে। দুই পরিবারের প্রাসাদ একেবারেই সংলগ্ন বলা যায়, এ ছাদে ও ছাদে কথা হয়, অন্দর মহলের পিছন দিকে দুই বাড়িরই বাগান এবং ঝিল। এ বাড়ি ও বাড়ির মেয়েরা সব সময়ই যাতায়াত করে।
তবু কুসুমকুমারীর যেতে লজ্জা করে। সরোজিনীও কিছুতেই ছাড়বে না। শেষ পর্যন্ত কুসুমকুমারী গেল তার মায়ের কাছে অনুমতি চাইতে। তার মা পুণ্যপ্ৰভা বললেন, ওমা, তুই বোসেন্দের বাড়ি যাবি, তাতে আবার কতা কী! তিনি সরোজিনীর চিবুক ষ্টুয়ে অনেক আদর করলেন।
নবীনকুমার পালঙ্কে শুয়ে একখানি বই পড়ছিল, সরোজিনী ঘরে ঢুকে বললো, এই যে, কাকে এনিচি দেকুন!
নবীনকুমার দেখলো, একগলা ঘোমটা টানা এক থান পরা মূর্তি ঈষৎ পাশ ফিরে দাঁড়ানো। মুখখানা দেখবার কোনো উপায় নেই।
নবনীকুমার বললো, এই যে মিতেনী, আমায় চিনতে পারো?
কুসুমকুমারী কোনো উত্তর দিল না।
নবীনকুমার বললো, সরোজ, তোমার মিতেনী কি আমন উল্টে দিকে ফিরে থাকবে?
সরোজিনী বললো, আপনি ভুলে গ্যাচেন, ও আমার মিতেনী কেন হবে। কুসোমদিদি তো ছেল আমার দিদির মিতেনী!
নবনীকুমার বললো, তা না হয় হলো। উনি কি আমার সঙ্গে কতা বলবেন না?
সরোজিনী বললো, ও কুসোমদিদি, তুমি অ্যাত লজ্জা পাচ্চো কেন গো? তুমি তো আগে আমার বরের…অ্যাই! থুড়ি…আজ্জপুত্রের সঙ্গে কতা কইতে।
কুসুমকুমারী ফিসফিস করে কী যেন বললো তাকে।
সরোজিনী বললো, তুমি ওরকম করো না তো! বিধবা হলে বুঝি কতা কইতেও নেই। শান্তি মাসী কি চন্দনগরের পিসেমশাইয়ের সঙ্গে কতা বলেন না?
নবীনকুমার হাত জোড় করে ছদ্মকৌতুকে বললো, হে দেবী, একবার আমায় দর্শন দান করে ধন্য করুন। আপনি কি জানেন না, বিধবা কুন্তী তাঁর দেবর বিদুরের সঙ্গে কতা কইতেন।
সরোজিনী জোর করে সরিয়ে দিল কুসুমকুমারীর মুখের ঘোমটা। তবু সে এদিকে তাকাবে না। আবার মুখখানা জোর করে স্বামীর দিকে ফিরিয়ে দিল সরোজিনী। কুসুমকুমারীর চক্ষু দুটি বোঁজা। তার ওষ্ঠ্যদ্বয় কম্পিত হচ্ছে লজ্জায়।
কুসুমকুমারীকে দেখে চমকে উঠলো নবীনকুমার। ইতিমধ্যে অনেক ঘটনা পার হয়ে এসেছে বলে এই মেয়েটির মুখখানি সে ভুলেই গিয়েছিল। এখন মনে পড়লো। অস্ফুট কণ্ঠে সে বললো, তুমি-তুমি সেই বনজ্যোৎস্না!
এবার নীল রঙের চক্ষু দুটি মেলে কুসুমকুমারী তাকালো নবীনকুমারের দিকে।