1 of 2

২৮. ইংলণ্ডের রানী ভিক্টোরিয়া

ইংলণ্ডের রানী ভিক্টোরিয়া যেদিন হিন্দুস্তানের সম্রাজ্ঞী হলেন, সেদিন নবীনকুমারের জীবনেও এক বিরাট পরিবর্তন সূচিত হলো।

সিপাহীদের দমনকার্য এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষিপ্তভাবে খণ্ডযুদ্ধ চলেছে, এর মধ্যেই অকস্মাৎ ইংলণ্ডেশ্বরীর ঘোষণা এসে পৌঁছালো এ দেশে। কোম্পানির আমল শেষ। এখন থেকে ভারতবর্ষীয় নাগরিকেরা সকলেই সরাসরি ব্রিটিশ রাজবংশের প্রজা। রানী ভিক্টোরিয়া আশ্বাস দিলেন যে, যে-সব দেশীয় নৃপতিদের অধীনে ছোট ছোট রাজ্য আছে সেইসব রাজ্য আর গ্রাস করা হবে না এবং ভারতীয় সীমানার মধ্যেকার অধিবাসীরা আমাদের অন্যান্য সমস্ত প্রজাদের মতন সমানভাবে গণ্য হইবে এবং তাহাদের প্রতি আমাদের সমান দায়িত্ব থাকিবে, আমরা ইহাতে দায়বদ্ধ রহিলাম।

এই উপলক্ষে বিরাট উৎসব হলো লাট প্রাসাদে। মিষ্টান্ন বিতরিত হলো সমস্ত স্কুলের বালকদের মধ্যে। পথে পথে মহা ধুমধাম। রানীর ঘোষণার বয়নের বঙ্গানুবাদ এবং অন্যান্য দেশীয় ভাষায় অনুবাদ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ পাঠ করে শোনালেন জেলা শহরগুলির জনসাধারণের কাছে। এর ফলে ভারতবর্ষীয়দের অবস্থার কতখানি উন্নতি হলো তা এখনই সঠিক বোঝা না গেলেও অনেকেরই মনে হল, একটা যেন বিরাট কিছু পরিবর্তন ঘটে গেল। রাজা-বাদশার অধীনে থাকাই এ দেশীয় মানুষের বহুকালের অভ্যেস, প্ৰায় শতবর্ষ যাবৎ এ দেশে সঠিক কোনো সম্রাট ছিল না, ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি রাজ্য চালালেও তাদের গায়ে খানদানী রাজবংশের গন্ধ নেই, ব্যবহারেও বেনিয়া সুলভ ভাব-ভঙ্গী প্রকট। এতদিন পর সত্যিকারের একজন মহারানীকে পেয়ে সকলেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। স্থূলকায়া কুরূপা রমণী শ্ৰীমতী ভিক্টোরিয়া অনেকের চক্ষে পরিত্রাতা দেবী হিসেবে প্রতিভাত হলেন।

শহর কলকাতার অনেক বিশিষ্ট পরিবারেও আনন্দ উৎসব হলো এইদিন। প্রবেশদ্বার সজিত হলো ফুলমালায়, ছাদে উড়িয়ে দেওয়া হলো ইউনিয়ন জ্যাক এবং অনেক রাত্রি পর্যন্ত আত্মীয়-বান্ধবদের সঙ্গে খানাপিনা। জোড়াসাঁকোর সিংহসদনে অবশ্য এর ব্যত্যয় হলো। নবীনকুমার কোনো উৎসবের ব্যবস্থা করেনি। মল্লিক, ঠাকুর, দত্ত এবং বসুদের বাড়িতে তার নিমন্ত্রণ ছিল, শারীরিক অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে কোথাও যায়নি সে। দুদিন আগে একটি ঘটনায় বড় অপমানিত বোধ করেছে নবীনকুমার। নবীনকুমার অর্থের কথা কখনো চিন্তা করে না। তার জননীর ঢালাও অনুমতি দেওয়া আছে, সে যখন যা চাইবে, সব পাবে।

নবীনকুমার অর্থের মূল্য বোঝে না। সে দু হাতে অকাতরে অর্থ ব্যয় করে। বিদ্যোৎসাহিনী সভার কাজকর্মের জন্য সে কত যে ব্যয় করেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ইদানীং নাটকের মহলার জন্য আরও বেশী ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু গত পরশুদিন তার ইচ্ছায় প্রথম বাধা পোড়েছে।

নাটকের কুশীলবদের জন্য পোশাক নির্মিত হবে সেইজন্য সভার এক সদস্য কিছু সিল্ক বস্ত্রের নমুনা সংগ্রহ করে এনেছে। তার মধ্যে এক প্রকার ইতালীয় সিল্ক সকলেরই খুব পছন্দ হলো। সে সিল্ক বস্ত্ৰ অবশ্য খুবই মহাৰ্য, কিন্তু নবীনকু্মার মূল্যের জন্য আবার কবে রেয়াৎ করেছে। তখনই দিবাকরকে ডেকে সে হুকুম দিল এক সহস্র মুদ্রা নিয়ে আসবার জন্য।

দিবাকর ঘাড়-মাথা চুলকে, শঙ্কায়-লজ্জায়-বিনয়ে একেবারে সঙ্কুচিত হয়ে জানালো যে এখন টাকা দেওয়ার কোনো উপায় নেই। স্বয়ং বিধুশেখর সব হিসাবপত্র পরীক্ষা করছেন, এখন কয়েকদিন তহবিল থেকে টাকা তোলা বন্ধ।

নবীনকুমার প্রথম কথাটা বিশ্বাসই করতে পারেনি। চাওয়া মাত্র সে টাকা পাবে না, এমন অভিজ্ঞতা তার কখনো হয়নি।

সে কড়া স্বরে বললো, বাবুকে বলো, আমি নিইচি, এখন টাকা নিয়ে এসো। যাও।

দিবাকর বললো, আজ্ঞে তার উপায় নেইকো, তবিল বাক্সের চাবি বড়বাবু নিজের কাচে রেকেচেন।

নবীনকুমার তখন বললো, তা হলে যাও মায়ের কাঁচ থেকে আমার নাম করে নিয়ে এসো গো!

বিম্ববতীর কাছ থেকে ঘুরে এসে দিবাকর জানালো যে বিম্ববতীর হাতও একেবারে খালি। যা ছিল তা নবীনকুমারকেই দিয়েছেন। তহবিল থেকে না তুলে তিনিও কিছু দিতে পারবেন না।

বন্ধুবান্ধবদের সামনে বড় অপদস্থ হতে হলো নবীনকুমারকে।

পরের দুদিন সে আর শয্যা ছেড়ে উঠলো না, কারুর সঙ্গে কথাবার্তাও বললো না বিশেষ।

মহারানী ভিক্টেরিয়ার ভারত গ্ৰহণ ঘোষণার দিনেও নবীনকুমার শয্যা ত্যাগ করেনি। সন্ধ্যার পর শোনা যেতে লাগলো। পটকা ফাটার শব্দ, মাঝে মাঝে আকাশে ঝলসে ওঠে বাজির রোশনাই, পথে পথে মানুষের ফুর্তির হল্লা। রাত্ৰি নটার তোপ দাগার পর যখন নবীনকুমারকে আহার গ্রহণ করার জন্য ডাকতে এলো তার পত্নী, সেই সময় সে পালঙ্ক থেকে নামলো। কিন্তু আহার গ্রহণ করতে গেল না। পত্নীর সঙ্গে একটি কথাও না বলে সে চলে এলো তার জননীর কক্ষের দিকে।

অতি প্ৰাতঃকালেই বিম্ববতী ইদানীং প্রত্যহ গঙ্গাস্নান যান। সেইজন্য শুয়ে পড়েন সন্ধ্যা রাত্রেই। তাঁর কক্ষের বন্ধ দ্বারের বাইরে দাঁড়িয়ে নবীনকুমার গম্ভীর কণ্ঠে ডাকলো, মা, মা!

বিম্ববতীর সঙ্গে এখন আর প্রত্যহ তাঁর পুত্রের দেখা হয় না। সে তার বন্ধুবর্গের সঙ্গেই আলাপে বেশী ব্যাপৃত থাকে। পারিবারিক আদিখ্যেতা সে বিশেষ পছন্দও করে না। বিম্ববতী লোক মারফত প্রতিদিন খবরাখবর নেন। আধো ঘুম আধো তন্দ্রার মধ্যেও বিম্ববতী ধড়মড় করে উঠে বসলেন। প্রিয়জন সম্পর্কে প্রথমেই কোনো বিপদের কথা মনে আসে। তিনি দ্রুত এসে দরজা খুলে উৎকণ্ঠিতভাবে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে?

নবীনকুমার বললো, মা, আমার কত সালে জন্ম, তোমার মনে আচে?

প্রগাঢ় বিস্ময়মাখা দৃষ্টি ফেলে বিম্ববতী জিজ্ঞেস করলেন, কেন? এত রাত্রে সে কতা কেন?

—রাত বেশী হয়নি, মা। তোমার মনে আচে কি না বলো?

—সেই যেবার আমাদের ইব্রাহিমপুরের তালুকটা কেনা হলো, সেটা কত সন, ছেচল্লিশ না সাতচল্লিশ?

—আমার মনে আচে মা, আমি হিসেব কষে দেকিচি, এই পরশুদিন আমার আঠারো বছর পূর্ণ হয়েচে।

—ওমা তাই নাকি! আমি খেয়ালই করিনি, তোর জ্যাঠাবাবুও কিচু বলেননি তো?

—কেন তোমরা খেয়াল করোনি? এখুন থেকে এই বিষয় সম্পত্তির মালিক কে? আমি না জ্যাঠাবাবু?

—ওমা, তুই-ই তো সব কিচুর মালিক!

—আমি মালিক, আর তবিল বাক্সের চাবি থাকবে জ্যাঠাবাবুর কাচে?

নবীনকুমার হুংকার দিয়ে ডাকলো, দুলাল? যা তো দুলাল, জ্যাঠাবাবুকে ডেকে নিয়ে আয়।

দুলাল প্ৰায় অষ্টপ্রহরই নবীনকুমারের কাছাকাছি থাকে। বারান্দায় এক কোণে সে বসেছিল, ডাক শুনে কাছে এগিয়ে এলো।

বিম্ববতী বললেন, এ কি কতা বলচিস ছোটকু? এত রাতে তোর জ্যাঠাবাবুকে ডাকতে যাবে?

নবীনকুমার উত্তর দিল, বললুম না। রাত বেশী হয়নি। রাস্তায় কত মানুষজন।

—উনি যে সন্ধের পরই শুয়ে পড়েন!

—শোবার পরও দরকার পড়লে মানুষ ওঠে।

—এখন কী দরকার পড়লো, ছোটকু?

—তবিল বাক্সের চাবি আমার এক্ষুনি চাই। আমি আর কচি খোকাটি নই। আমি টাকা চাইলে দিবাকর আমার মুখের ওপর না বলে। এবার দেকাচ্চি!

—ওরকম করিসনি, ছোটকু। তুই বরং কাল সকালে গিয়ে ওনার সঙ্গে দেকা করিস। উনি তোকে কত ভালোবাসেন।

—আমি দেকা করতে যাবো? কেন? ওঁকেই আসতে হবে। আজই, এক্ষুনি। এই দুলাল, হাঁ করে ডাঁড়িয়ে দেকচিস কী? যা—

—তুই কি পাগল হলি? এই রাত্তিরেই তোর চাবি চাই?

—হাঁ। চাই। আর তুমি ভেবো না মা, আমি কখনো জ্যাঠা বাবুর বাড়িতে চাবি চাইতে যাবো। তাঁকে নিজে এসে দিতে হবে।

 

বিম্ববতী অনেকভাবে বোঝাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু নবীনকুমারের ক্ৰোধ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগলো। দুলালকে এক প্রকার জোর করে পাঠিয়ে ছাড়লো সে। ইতিমধ্যে তার স্ত্রী সরোজিনী তাকে আহার সেরে নেবার জন্য অনুরোধ জানালো। কিন্তু চাবি হাতে না পাওয়া পর্যন্ত নবীনকুমার অন্ন গ্ৰহণ করবে না। বিম্ববতী তার গায় মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সে ঝটুকা মেরে সরে যেতে লাগলো। সে এমনই ছটফট করছে যেন তাকে কেউ তপ্ত কটাহে বসিয়ে দিয়েছে।

দুলাল ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে ফিরে এসে জানালো যে বিধুশেখর অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। এখন তাঁকে জাগানো কোনোক্রমেই সম্ভব নয়।

ঠিক উন্মাদেরই মতন চক্ষু দুটি বিস্ফারিত হয়ে গেল নবীনকুমারের, তারকা দুটি যেন ঘূর্ণিত হতে লাগলো। প্রচণ্ড জোরে দুলালকে এক চপেটাঘাত করে সে হিংস্র কণ্ঠে বললো, সম্ভব নয়? তাঁর বাড়িতে আগুন লাগলেও তিনি ঘুম থেকে উঠবেন না? এই সময় যদি আমি মরে যাই, তবুও তাঁকে ডাকা সম্ভব নয়? উল্লুক কোথাকার!

বিম্ববতী দুলাল আর নবীনকুমারের মাঝখানে এসে পড়ে বিপন্ন, করুণ কণ্ঠে বললেন, কেন এমন করচিস, ছোট্‌কু! আমার কতা শোন, কাল সকালে…

নবীনকুমার বললো, মা, জমিদার কে, আমি না জ্যাঠাবাবু? জমিদারের রক্ত আচে আমার শরীরে। উনি তো শুদু উকিল, আমাদের সম্পত্তির অছি, যখন ডাকবো, তখুনি ওঁকে আসতে হবে।

বিম্ববতী নিথর হয়ে গেলেন, অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়লো তাঁর দুচোখ দিয়ে। বাষ্পজড়িত স্বরে তিনি ধীরে ধীরে বললেন, আমার দিব্যি রইলো, আজকের রাতটার মতন ক্ষ্যামা দে, কাল সকালেই—

নবীনকুমার চিৎকার করে উঠলো, আমার চাই না। কাল সকালেই আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। বিষয় সম্পত্তি সব তোমাদের রইলো।

একটা চীনে মাটির সুদৃশ্য ভাস তুলে মাটিতে আছড়ে চুরমার করে সে বললো, চাই না! আমার কিচু চাই না! সব জ্যাঠাবাবু নিক।

বারান্দায় সার দেওয়া খাঁচাগুলি থেকে ডেকে উঠলো। কয়েকটি পাখি। বিম্ববতী এবং সরোজিনী দুজনে মিলে ধরে রাখবার চেষ্টা করলো নবীনকুমারকে। কিন্তু সে সবলে নিজেকে ছাড়িয়ে আরও কিছু জিনিস ভাঙার জন্য ইতস্তত দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লাগলো। কিছু না পেয়ে সে ছুটে নিজের ঘরে ঢুকে বন্ধ করে দিল অগল। ভিতরে শোনা যেতে লাগলো দুম দাম শব্দ। সে অনেক কিছু ভাঙছে।

বিম্ববতী এবং সরোজিনী দুজনেই কাঁদতে কাঁদতে দরজায় ধাক্কা দিয়ে বারবার তাকে অনুরোধ করতে লাগলো খোলার জন্য। কিন্তু নবীনকুমার ক্ৰোধে জ্ঞানশূন্য। খেয়ালী পুত্রটির জেদের পরিচয় বিম্ববতী এর আগেও পেয়েছেন। কিন্তু এতখানি বাড়াবাড়ি কখনো দেখেননি। তিনি খুবই আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন।

 

বহু কাতর সনির্বন্ধ অনুরোধেও নবীনকুমার কর্ণপাত না করায় বিম্ববতী দুলালকে বললেন, বাবা দুলাল, তুই আর একবার যা। দিবাকরকে সঙ্গে নিয়ে যা। যেমন করে হোক ও বাড়ির বড়বাবুকে জাগিয়ে তোল। আমার নাম করে বলবি, বড় বিপদে পড়ে আমি তাঁকে ডেকিচি। সব বুঝিয়ে বলিস, যা দৌড়ে যা–

বিধুশেখর এলেন আধঘণ্টা পরে।

বারান্দায় একটি কেদারায় বিম্ববতী নিঝুম হয়ে বসেছিলেন, আর সরোজিনী তাঁর পায়ের কাছে। লাঠিতে ভর দিয়ে একটা পা টেনে টেনে বিধুশেখর এগিয়ে এলেন সেদিকে। বিধুশেখরকে দেখে সরোজিনী মাথায় ঘোমটা টেনে ছুটে চলে গেল আড়ালে।

বিধুশেখর একেবারে বিম্ববতীর সামনে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েচে, বিম্ব?

বিম্ববতীর মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে। তাঁর শরীরের সেই অপরূপ রূপলাবণ্যরাশিতে যেন মেঘের ছায়া পড়েছে। ইদানীং, নাকের ওপর একটু একটু মেছেতার দাগ, চিবুকের নিচে ভাঁজ। বিধুশেখরকে দেখে মাথায় অবগুণ্ঠন টানার কথাও তাঁর মনে এলো না। তিনি বিধুশেখরের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলেন না। প্ৰাণপণে উদগত অশ্রু রোধ করার চেষ্টা করতে লাগলেন।

বিধুশেখর বললেন, ঐ দুলালটা একটা বেল্লিক। আগেরবার গিয়ে আমায় ডাকতে পারেনি? ওপরে উঠে গেলেই তো পারতো। এমন কিচু রাত হয়নিকো, ছোটকু কোতায়?

বিম্ববতী হাত তুলে বন্ধ ঘর দেখিয়ে দিলেন।

বিধুশেখর সেখানে গিয়ে ডাকলেন, ছোটকু, ছোটকু!

কক্ষের মধ্যে আপাতত কোনো শব্দ নেই। বিধুশেখরের ডাকের পর আবার কিছু একটা ভাঙার শব্দ হলো। বিধুশেখর গলা চড়িয়ে বললেন, ছোটকু খোল, আমি চাবি এনিচি!

তৎক্ষণাৎ সশব্দে দরজা খুলে গেল। নবীনকুমার হাত বার করে বললো, কই দিন।

 

সারা ঘরের মধ্যে লণ্ডভণ্ড অবস্থা, বিছানা বালিশও পড়ে আছে মেঝেতে। বিধুশেখর একটুক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন নবীনকুমাবের দিকে। তারপর সহাস্য মুখে প্রশ্ন করলেন, এত রাতে চাবি নিয়ে কী করবি? কাল সকাল পর্যন্ত তাঁর সইছেল না?

নবীনকুমার জেদী বালকের মতন বললো, চাবি এখুন থেকে আমার হেপাজতে থাকবে। পরশু। থেকে আমিই সব কিচুর মালিক।

বিধুশেখর বললেন, তা তো বটেই। শুধু তোর বাপের সম্পত্তি কেন, আমার যা কিচু আচে, সে সবও তো বলতে গেলে তোরই। আমার তো থাকবার মধ্যে আচে ঐ নাতি, আমি চোক বোজবার আগে তার ভার তো তোর হাতেই দিয়ে যাবো।

—আমি পর্শু থেকে সাবালক হয়িচি, তবু দিবাকর আমার মুখের ওপর না বলে কেন? আপনি ওকে বলে দেননি কেন?

—ঠিক, আমাদের অন্যায় হয়েচে, বুজলে বিম্ব, আমাদের অন্যায় হয়েচে সত্যি, আমি পাঁচ কাজে ব্যস্ত রইচিলুম, সেইজন্য দিনক্ষণের হিসেব করিনিকো। তবে আমি ভেবে রেকিচিলুম, তোর কোনো সন্তানাদি হলে তারপর সব বিষয়-আশয় তোর হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্দি হবো। সন্তান না হলে সংসারে মন বসে না। তা যাই হোক, তুই বড় হইচিস, জমিদারির কাজকৰ্ম্ম শিকে নে, নিয়ম করে রোজ হৌসে বেরো। আমিও এবার সব দায়িত্ব থেকে মুক্তি চাই—

বিধুশেখর চাবির গুচ্ছ নবীনকুমারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, কিন্তু এত রাতে টাকা নিয়ে তুই কী করবি, বললি না? তোর এখুনি টাকার দরকার?

নবীনকুমার বললো, হাঁ। আমার এখুনি টাকা চাই। আমার টাকার তোড়া নিয়ে লোপালুপি খেলার ইচ্ছে হয়েচে।

বিধুশেখর হা হা করে হেসে উঠলেন। সহজে হাসেন না তিনি। তাঁর অসময়ের হাসি শুনে অনেকে ভয় পেয়ে যায়। কিন্তু তিনি যেন আজ নবীনকুমারের গোঁয়ার্তুমি বেশ উপভোগ করছেন। হাসতে হাসতেই বললেন, আর যাই করিস বাপু টাকা নিয়ে কখনো লোপালুপি খেলতে যাস না। বড় পিছলে যায়। একবার হাত পিছলে গেলে আর ধরা যায় না।

বিম্ববতীর দিকে ফিরে তিনি আবার বললেন, আমাদের ছোটকুর কতকগুলোন দোসর জুটেচে, তারা বিজ্ঞের মতন খুব গেরেমভারি কতা বলে বটে, কিন্তু সবগুলোনেরই মতলোব ছোটকুর মাতায় ক্যাটাল ভাঙা। আমি সবই টের পাই। সব কিচুরই খপর রাকি। আমি যে এখুনো মরিনি, সেটা তারা জানে না।

তারপর লাঠিটি বাগিয়ে ধরে তিনি বললেন, চলিগো, বিম্ব, আমার মাতা থেকে একটা গুরুভার নেমে গেল। আজ থেকে আমি নিশ্চিন্দি। রামকমলের জিনিস তার ছেলের হাতে তুলে দিইচি।

বিম্ববতী বললেন, ছোটকু, তোর জ্যাঠাবাবুকে পেন্নাম করলিনি?

বিধুশেখর বললেন, থাক থাক, রাত্তিরের দিকে আর পেন্নামের দরকার নেই। এই সামান্য কারণে রাগ করে ছোটকু খাওয়া-দাওয়া করেনি শুনলাম। যা এখুন খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়গে যা।

 

নবীনকুমার অবশ্য মায়ের এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলো না। বিধুশেখর যে এই রাতেই নিজে এসে এত সহজে তার হাতে চাবি তুলে দেবেন, এজন্য সে ঠিক প্রস্তুত ছিল না। সে এগিয়ে গিয়ে নিচু হয়ে বিধুশেখরের পায়ে হাত ছোঁয়ালো।

বিধুশেখর নবীনকুমারের চিবুক স্পর্শ করে হাতটি নিজের ওষ্ঠে ছোঁয়ালেন। তারপর বললেন, বাবা ছোটকু, একটা কতা আমি বলে যাই। তবিলের চাবি শুধু নিজের কাচে রাকলেই হয় না। তবিল ভরাবার কৌশলটাও শিকতে হয়।

নবীনকুমারের বুকটা কেঁপে উঠলো। তা হলে কি তহবিল একেবারে শূন্য? চাবির গুচ্ছ হাতে নিয়ে সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, বিধুশেখর লাঠি ঠুকে ঠুকে পা টেনে টেনে চলতে লাগলেন, সিঁড়ি পর্যন্ত শোনা গেল তাঁর চলে যাওয়ার শব্দ।

সেই রাত্রেই নবীনকুমার দিবাকরকে ডেকে তহবিল খোলালো। না। বিধুশেখর মিথ্যেই ভয় দেখিয়েছেন, তহবিল যথেষ্টই পূর্ণ।

পরদিন থেকে সে খোলামকুচির মতন অর্থ ছড়াতে লাগলো। বিক্রমোর্কশী নাটকের অভিনয়ের জন্য যত অর্থব্যয়ের প্রয়োজন ছিল, সে ব্যয় করলো তার প্রায় চতুর্গুণ। এমন সুসজ্জিত মঞ্চ এ শহরে কেউ কখনো দেখেনি। পোশাকের চাকচিক্যে চক্ষু ঝলসে যায়। নিমন্ত্রণ করা হলো সমস্ত মান্যগণ্য মানুষদের, তাঁদের প্রত্যেকের জন্য বহুমূল্য গালিচামোড়া আসন এবং নানা বর্ণের পুষ্পস্তবক। বেশ কয়েকজন সাহেব সুবোকেও নিমন্ত্রণ করা হলো, তাঁদের মধ্যে অনেকেই এলেন না, কয়েকজন এলেন। মঞ্চের ওপর সাদা রঙের অশ্বের পৃষ্ঠে পুরোপুরি রাজ্যোচিত পোশাকে ভূষিত নবীনকুমারকে পুরুরবার ভূমিকায় দেখে মুগ্ধ হতেই হয়। যেমন সুন্দর তার মুখশ্ৰী, তেমনই মধুর তার কণ্ঠ। দর্শকদের মধ্যে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। পরদিন সংবাদপত্রগুলিতেও এই নাট্য অনুষ্ঠানের ভূয়সী প্রশংসা প্রকাশিত হলো।

শুধু সামান্য একটু ত্রুটি হয়েছিল এই অনুষ্ঠানের। কুশীলবদের কারুর যখন গান গাওয়ার কথা, তখন প্রসেনিয়ামের পাশ থেকে আগেই জড়িত গলায় গান ধরছিল একজন। এরকম একবার নয়, দুবার। তাতে খানিকটা হাস্যের সঞ্চার হয়েছিল। যাই হোক, মঞ্চ ব্যবস্থাপকরা ঠেলাঠেলি করে রাইমোহনকে একেবারে পথে বার করে দিয়ে আসে।

পরদিন বিদ্যোৎসাহিনী সভার সদস্যরা আবার সমবেত হয়ে যখন তাদের সার্থকতার জন্য উল্লাস করছে, কোন বিখ্যাত ব্যক্তি কোন ভূমিকা সম্পর্কে কী মন্তব্য করেছেন সেই আলোচনা চলছে, সেই সময়ে আবার এসে উপস্থিত হলো রাইমোহন। একেবারে চুরচুর মাতালের দশা। পোশাকে লেগে আছে ধুলো কাদা, বোধহয় রাস্তায়ও কয়েকবার গড়াগড়ি দিয়েছে। ঢুকে জড়িত গলায় সে গান ধরলো, লোকে যা বলে বলুক, আমি তো নিজেরে জানি-হ্যাঁ, হাঁ বাবা-

রাইমোহনকে দেখেই নবীনকুমার একেবারে অগ্নিমূর্তি ধারণ করলো। কাল রাইমোহনের ব্যবহারে সে বড়ই মনে আঘাত পেয়েছিল। তার নিজের সভার সদস্যের এই ব্যবহার! মনে মনে নবীনকুমার এবং আরও অনেকের ভয় ছিল, পাইকপাড়ার সিংহ কিংবা প্যাথুরেঘাটার ঠাকুররা বোধহয় ভাড়াটে লোক পাঠিয়ে বিঘ্ন ঘটিয়ে নাটক পণ্ড করার চেষ্টা করবে। সে সব কিছুই হয়নি, আর রাইমোহনের এত সাহস!

নবীনকুমার লাফিয়ে এসে রাইমোহনের টুটি চেপে ধরলো। চিৎকার করে বললো, উল্লুক, তুমি আবার এসোচো! বেরোও! বেরোও!

রাইমোহন বললো, মাচ্চো কেন বাবা? কাল রাজা আর আজ জল্লাদ! অ্যাঁ? বড় খাসা হয়েছেল

নবীনকুমার তাকে মারতে উদ্যত হলে হরিশ মুখুজ্যে এসে বাধা দিয়ে সরিয়ে নিল তাকে। সে বললো, আহা আজি আনন্দের দিনে বেচারিকে মারধোর করো না। ও আনন্দের চোটে একটু বেশী খেয়ে ফেলেচে। মাতালকে মারতে দোকলে আমার বড় কষ্ট হয়।

রাইমোহন হরিশ মুখুজ্যের দিকে ঢুলু ঢুলু চোখে চেয়ে ফিক করে হেসে ফেললো। তারপর বললো, শুদু ফুকো দয়ার কতা কেন বাওয়া! কিচু দাও। এখুন দু ঢোক না পেলে-গলাটা বড় শুক্যে গ্যাচে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *