1 of 2

৪৩. দীনবন্ধু মিত্র

বড় মুখ করে আত্মপরিচয় দেবার মতন কিছুই নেই দীনবন্ধুর। দরিদ্রের সন্তান, কলকাতার বিদ্বজনমণ্ডলীতে কিংবা অভিজাত সমাজে প্রবেশ করার কোনো সুযোগপায়নি। নদীয়ার এক গ্রামের পাঠশালায় বাংলা লেখাপড়া শিখেছিল, তারপরই তার পিতা তাকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন এক জমিদারি সেরেস্তায় খাতা লেখার কাজে। কিশোর দীনবন্ধুর সে কাজে মন টেকেনি, পিতা ঠাকুরের নির্দেশ অমান্য করে গোপনে পালিয়ে এসেছিল কলকাতায়। এক বৃহত্তর জগৎ তাকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছিল।

কিন্তু এক সহায়-সম্বলহীন কিশোরের পক্ষে কলকাতা শহর বড় কঠোর স্থান। বাহির সিমুলিয়াতে এক পিতৃব্যের বাড়ি খুঁজে খুঁজে বার করল অনেক চেষ্টায়, সেখানে শুধু আশ্রয় মিললো, আর কিছু না। আশ্রয়ের বিনিময়ে খুড়তুতো ভাইয়েরা তার ওপর রান্নার ভার চাপিয়ে দিল। কিন্তু গ্রামের জমিদারি সেরেস্তায় খাতা লেখার চেয়ে কলকাতায় আত্মীয় বাড়িতে রাঁধুনিগিরি করার মধ্যে কী আর এমন পদোন্নতি ঘটলো। সর্বক্ষণ মনখারাপ হয়ে থাকে দীনবন্ধুর। একটু সময় পেলেই কলকাতার পথে পথে ঘুরে বেড়ায় আর স্কুল-কলেজগুলির সামনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

পাদ্ৰী লঙ সাহেব একটি অবৈতনিক স্কুল চালান। একদিন ভরসা করে সেখানে ঢুকে পড়লো দীনবন্ধু। ইংরেজি শিক্ষার উপযোগিতা বুঝতে পেরে এখন দলে দলে ছেলে আসে স্কুলে পড়তে, সকলকে নেওয়া সম্ভব হয় না। লঙ সাহেব কিশোরটিকে দু-চার কথায় পরীক্ষা করে বললেন, দেখো হে, তোমার কিছুদিনের জন্য সুযোগ দিব। যদি পাঠাভ্যাসে উৎকৃষ্ট মতি দেখাইতে পারো, তবেই তোমার স্থান হইবে এখানে, নচেৎ নহে।

লঙ সাহেবের কথার মান রেখেছিল সে। প্রত্যেকটি পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়েছে। বৃত্তি না পেলে বই-খাতা কেনার টাকাই বা আসবে কোথা থেকে। দীনবন্ধুর পিতৃদত্ত নাম গন্ধৰ্বনারায়ণ, সবাই গন্ধা গন্ধা বলে ডাকে, মোটেই তার পছন্দ হয় না। স্কুলে পড়ার সময়ই সে নিজের নামটা বদলে নিয়েছে।

লঙ সাহেবের স্কুল ছেড়ে কলুটোলা ব্র্যাঞ্চ স্কুল, তারপর হিন্দু স্কুল। লঙ সাহেব লক্ষ রেখেছিলেন এই ছেলেটির ওপর, দীনবন্ধু পরীক্ষায় ভালো ফল করলে তিনি তাকে বইপত্র কিনে দেন। কিন্তু হিন্দু স্কুলে বেশীকাল পড়া হলো না দীনবন্ধুরী, তার সহপাঠীদের তুলনায় তার বয়েস অনেক বেশী। যে-বিয়েসে অন্যরা চাকুরিতে ঢুকে যায়, সেই বয়েসে সে স্কুলের ছাত্র। তাই শেষ পরীক্ষা দেবার আগেই সে ডাক বিভাগের চাকুরি গ্রহণ করলো।

কিছুদিন পাটনায় পোস্ট-মাস্টারী করার পর বদলি হলো উড়িষ্যায়। সেখান থেকে আবার নদীয়ায়, বর্তমানে ঢাকায়। ইতিমধ্যে বিবাহাদি করে সে সংসারী হয়েছে।

নদীয়ায় থাকার সময় তার পরিচয় হলো এক প্রতিভাবান যুবকের সঙ্গে। যুবকটি পাশের জেলা যশোহরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর। এর নাম বঙ্কিম চাটুজ্যে। ছাত্র বয়েসে দীনবন্ধু গুপ্ত কবির সংবাদ প্রভাকর কাগজে পদ্য লিখেছে মাঝে মাঝে, সে পত্রিকার পৃষ্ঠায় সে এই বঙ্কিমের পদ্যও দেখেছে। তারপর এ-ও শুনেছিল যে কলকাতায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পর প্রথম বি এ পরীক্ষায় এই বঙ্কিমও প্রথম দুই গ্র্যাজুয়েটের মধ্যে একজন। চাক্ষুষ হলো এই প্রথম। যুবকটি বয়েসে তার চেয়ে বেশ ছোট হলেও স্বভাবে অতি গভীর, অন্যান্য লোকজনের সঙ্গে কথাই বলতে চায় না। দীনবন্ধুই উদ্যোগী হয়ে নারকোলের খোলা ভেঙে যুবকটির অন্তরের নরম শাঁস স্পর্শ করলো। বন্ধুত্ব হয়ে গেল দুজনের।

বিবাহের পরই বঙ্কিমের পত্নী বিয়োগ হয়েছে। সে আবার বিবাহ করতে চায়। দীনবন্ধু বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে নানান জায়গায় পাত্রী দেখে বেড়ায়। এবার ঢাকা থেকে ছুটি নিয়ে কলকাতায় এসেছে, বঙ্কিমের বিবাহের সম্বন্ধ একেবারে পাকা করে যাবে। তারই মধ্যে একদিন অবসর করে সে দেখা করতে এলো বঙ্গীয় সাহিত্যাকাশে উল্কার মতন প্রবেশকারী কবিবর মাইকেল মধুসূদনের সঙ্গে। দীনবন্ধু বঙ্কিমকেও সঙ্গে করে আনতে চেয়েছিল, কিন্তু সে আসেনি। অপরিচিতদের সঙ্গে উপযাচক হয়ে কথা বলা সে তো পছন্দ করে না বটেই, তা ছাড়া বাংলা সাহিত্য বিষয়েও তেমন কোনো আগ্রহ নেই বঙ্কিমের। ছাত্রাবস্থায় সে বাংলা পদ্য লিখেছে বটে কিন্তু এখন তার লেখনী দিয়ে ইংরেজী বাক্য ছাড়া আর কিছু বেরোয় না।

প্রাথমিক সম্ভাষণাদি এবং মধুসূদনের রচনাগুলির উচ্চ প্রশংসা করার পর দীনবঙ্কু বললো, যদি অনুমতি দেন, তবে আপনার সমীপে আগমনের যে অন্য আর একটি উদ্দেশ্য আছে, সেটি ব্যক্ত করি।

মধুসূদন বললেন, নিবেদন? অব কোর্স আপনি তা ব্যক্ত কর্তে পারেন, যদি ব্ৰিফলি হয়, আমি আমার এই বন্ধুর মুখ থেকে কিছু গল্প শুনচিলাম–

দীনবঙ্কু বললো, হ্যাঁ, সংক্ষেপেই বলবো। দেখুন। মিঃ ডাটু, আপনার কবিতা পড়ে আমি মুগ্ধ হয়চি নিশ্চয়ই, আপনার শৰ্মিষ্ঠা নাটকও বড় মনোরম, কিন্তু আপনার প্রহসন দুটি এক কথায় অনবদ্য। এমন জীবন্ত ডায়ালগ বাংলায় আর কেউ লেখেননি। আমার মুখস্ত আচে, শুনবেন? তা এই যে আমার মনোমোহিনী এসেছেন! (স্বগত) আহা, যবনী হোলো তার বয়ে গেল কি? ছুড়ী রূপে যেন সাক্ষাৎ লক্ষ্মী! এ যে আস্তাকুড়ে সোনার চাঙড়! (প্রকাশ্যে গদার প্রতি) গদা, তুই একটু এগিয়ে দাঁড়া তো যেন এদিকে কেউ না এসে পড়ে। গদা বললো, যে আজ্ঞে! ভক্ত বললো, ও পুঁটি, এটি তো বড় লাজুক দেখচি রে, আমার দিকে একবার চাইতেও নাকি নাই?

মধুসূদন বললেন, ব্যাস, ব্যাস, আর শোনাবার দরকার নেই।

গৌরদাস বললেন, তাজ্জব! আপনি অ্যাক্টর নন, তবু নাটকের ভাষা এমন মুখস্ত করেচেন? দীনবঙ্কু বললো, আরো গড়গড়িয়ে বলে যেতে পারি। এটা বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ। এবার একেই কি বলে সভ্যতা থেকে শুনবেন?

মধুসূদন বললেন, দ্যাটস এনাফ। কিন্তু আপনার নিবেদনটি কী। তা এখনো বুঝলাম না!

দীনবঙ্কু বললো, এমন যাঁর ভাষা, তাঁর কাছে আমাদের অনেক কিছু চাইবার আচে। আপনি ইংরেজ মান্য লোক হলেও এমন দিশী কথা জানলেন কী করে? সেটাই অবাক লাগে।

মধুসূদন বললেন, আমি যশোরের গ্রামে বাল্যকালে কতবার গেচি। সে সব ভাষা আমার মেমরিতে ঘুমিয়ে ছেল, আবার ফিরে এসেচে।

দীনবঙ্কু বললো, সেই জন্যই বলচি, আপনি মদ্যপানের কুপ্ৰথা, গ্ৰাম্য জমিদারদের ব্যভিচার নিয়ে স্যাটায়ার লিখে সমাজের অনেক উপকার করেচেন। এবার রায়তদের নিয়ে একটি লিখুন।

—কাদের নিয়ে?

—গ্রামের রায়তদের নিয়ে। আমি কর্মোপলক্ষে নদীয়া-যশোরে ঘুরে দেখিচি, নীল চাষীদের ওপর কী দুঃসহ অত্যাচার হচ্চে। আপনার প্রহসন দুটি পড়বার পর থেকেই আমার মনে হচ্ছে, এই সব হতভাগ্য চাষীদের দুরবস্থার কথা নিয়ে আপনি যদি একটি নাটক রচনা করেন, তবে দেশের মানুষ সবাই জানবে।

—ষ্ট্রেঞ্জ কয়েনসিডেন্স! আমরা আমাদের এই বন্ধুটির কাঁচ থেকে ইণ্ডিগো প্ল্যান্টারসদের কীর্তি-কাহিনীই শুনচিলুম এতক্ষণ। তার মাঝখানে আপনি এসে পড়লেন। আমাদের এই স্কুল-ফ্রেন্ডটি নিজে জমিন্দার, কিন্তু গ্ৰাম্য প্লাউমেনদের সঙ্গে মিশে রিবেলিয়ান অর্গানাইজ করেচে। গঙ্গা, তোমার বাকি কাহিনীটা বলো না।

ধুতি ও চাদর পরিহিত গঙ্গানারায়ণ এতক্ষণ নীরবে নবাগত ব্যক্তিটির কথা শুনছিল। এবার সে বললো, আমার আর বিশেষ কিচু বলবার নেই। চাষীদের অবস্থা তো মোটামুটি জেনেচো, তারপর দু-এক জায়গায় সংঘর্ষ হলো আর কি।

গৌরদাস বললো, না না, বলে আমার শুনতে বড় আগ্রহ হচ্চে।

দীনবঙ্কু বললো, আমি বাইরের লোক, তবু যদি আমায় আপনাদের বৈঠকে একটু স্থান দেন, তা হলে আমিও শুনতে পারি।

মধুসূদন বললেন, বিলক্ষণ! বিলক্ষণ! প্লীজ!

গৌরদাস বললো, তারপর সেই তোরাপ নামে লোকটি কী করলো?

গঙ্গানারায়ণ ধীর স্বরে বললো, তোরাপ আর অন্যান্য গ্রামবাসীরা একেবারে মরীয়া হয়ে একটা কিচু করতে চায়। বিশেষত একটি দুটি নারী-হরণের পর তারা টগবগ করে ফুটচে। তখন একরাতে জঙ্গলের ডেরা ছেড়ে আমরা বেরিয়ে পড়লুম। আমার হাতে বন্দুক দেখে ওরা ভরোসা পেয়েচে, আমার অবশ্য বন্দুক দাগতে হয়নি। একটা নীলকুঠি সহজেই দখল করা গেল।

রাজনারায়ণ বললেন, অমন ছাড়া ছাড়া করে বলচিস কেন, গঙ্গা, সব ব্যাপারটা ডিটেইলসে বল! তুই এমন ভাব কচ্চিস যেন একটা নীলকুঠি দখল করা চাট্টিখানি মুখের কথা? এ যে সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার–।

এরপর গঙ্গানারায়ণকে তার অভিজ্ঞতার আদ্যোপান্ত বৰ্ণনা দিতেই হলো।

শেষ হবার পর দীনবঙ্কু বললো, আপনিই তা হলে গঙ্গানারায়ণ সিংহ? নদীয়ায় গিয়ে বহুবার আপনার নাম শুনিচি। গরিবগুর্বো লোকেরা আপনাকে দেবতার মতন মানে।

গঙ্গানারায়ণ লাজুক মুখে বললো, না, সে রকম কিছু নয়।

দীনবঙ্কু বললো, আপনাকে নিয়ে অনেক গল্প-কথা আছে ওদিকে। আপনিই সেই সব গল্পের নায়ক। আপনাকে চোখে দেখাও ভাগ্যের কতা!

মধুসূদন সহাস্যে বললেন, ইট্‌ সিমস, গঙ্গা, ইউ আর মোর ফেমাস দ্যান মি!

দীনবন্ধু মধুসূদনের দিকে ফিরে বললো, দত্তজা, আপনার ফ্ৰেণ্ডের মুখে শুনলেন তো সব কথা? আমিও এ সব কথাই বলতে এসেছিলুম। আপনার দুর্দান্ত লেখনীতে এই সব চিত্র ফুটিয়ে তুলুন। আপনি ছাড়া আর কেউ পারবে না।

মধুসূদন বললেন, প্রোজ! আমি আর প্রোজ লিকতে চাই না। পোয়েট্রি, শুধু পোয়েট্রিই আমার আলোবাতাস। এখন আমি একটা গ্রেট পোয়েট্রি লেখার কত ভাবচি। হয় তো কালই শুরু কর্বো।

দীনবঙ্কু বললো, আপনি নিশ্চয়ই পোয়েট্রি লিকবেন। কিন্তু এখন প্রয়োজন নাটকের। প্ৰহসন দুটি লিকে আপনি যে-রূপ কশাঘাত করেচেন, এবার নীলচাষীদের দুঃখ নিয়ে এমন কিছু লিকুন, যা পড়ে সবাই কাঁদবে। আপনারা জানেন বোধ হয়, নীলচাষের প্রকৃত অবস্থা জানবার জন্য সরকার থেকে এক কমিশন বসানো হয়েচে। সীটনকার সাহেব তার সভাপতি। শোনা যাচ্চে, এই সীটনকার চাষীদের প্রতি সহানুভূতিশীল। লেফটেনাণ্ট গভর্নর গ্র্যান্ট সাহেব গোড়ার দিকে চাষীদের দিক একটু টেনেছিলেন বটে, কিন্তু এখন আবার বেঁকে গ্যাচেন। এই গঙ্গানারায়ণ সিংহের মতন কেউ যদি চাষীদের সাহায্য কত্তে যায়, তবে তাদের ফাটকে পোরবার জন্য ১১ আইন চালু হয়েচে। আমাদের উচিত ইণ্ডিগো কমিশনারের সামনে প্রকৃত তথ্যগুলি তুলে ধরা, যদি ঐ আইন পাল্টানো যায়–

মধুসূদন বললেন, এ সব বেশ ভালো কতা। কিন্তু এর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী?

—ঐ যে বললুম, আপনি নীল চাষীদের নিয়ে একটি নাটক রচনা করুন। আপনি ছাড়া আর কেউ পারবে না। আপনি স্বয়ং বীণাপাণির আশীর্বাদপুষ্ট।

-আমার এখুন আর গদ্য রচনায় মন নেই। আমার মন শুধু কাব্যের দিকে ঝুঁকে আচে। আমি রামায়ণের মেঘনাদকে নিয়ে একটা কাব্য শুরু কচি। রাম আর তার দলবল যেমন অসভ্যোর মতন অন্যায় যুদ্ধে মেঘনাদকে মেরেচে, আমি আমার কাব্যে তার শোধ তুলবো।

–আপনি আর নাটক লিকবেন না!

রাজনারায়ণ বসু দীনবন্ধুকে বললেন, আপনি-আপনি তো ভারি অদ্ভুত লোক মশায়। মধু লিকবে না শুনে অমনি আপনার মুখখানা একেবারে শুকিয়ে গেল। আপনি নিজেই লিকুন না। আপনার যখন নীলচাষীদের ব্যাপারে অভিজ্ঞতা আচে।

দীনবঙ্কু বললো, হায়, আমি লিখবো! আমার কি সে ক্ষমতা আচে। বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ, একেই কি বলে সভ্যতা যিনি লিখেচোন তিনিই যদি না লেখেন-কয়েক লাইন পদ্য ছাড়া আমার হাত দিয়ে আজ পর্যন্ত কিচুই বেরোয় নি।

গঙ্গানারায়ণের দিকে ফিরে দীনবন্ধু জিজ্ঞেস করলো, আপনি লিকতে পারেন না? গঙ্গানারায়ণ হেসে বললো, কোনোক্রমে আমি দু-একবার বন্দুক চালিয়েচি বটে, কিন্তু লেখনী আমার হাতে একেবারেই চলে না।

মধুসূদন উঠে এসে দীনবন্ধুর কাঁধে হাত রেখে বললেন, মাই ফ্রেণ্ড, ইউ বেটার ট্রাই ইয়োর হ্যাণ্ড-নীলচাষীদের অবস্থা দেকে আপনার মনে হয়েচে এই বিষয় নাটক লেখার যোগ্য-এই মনে হওয়াকেই বলে ইনসপিরেশান। বড় বড় লেখকরা এই ইনসপিরেশান দ্বারাই চালিত হন, সুতরাং আপনি আর দ্বিধা কর্বেন না। কাগজ-কলম নিয়ে বসে পড়ুন গে।

মধুসূদনের স্পর্শে রোমাঞ্চিত বোধ করলো দীনবন্ধু। সে আর কোনো কথা না বলে নীরব হয়ে রইলো। এবং সেদিন ঐ আসর থেকে বিদায় নেবার পর মধুসূদনের শেষ কথাগুলিই অনবরত ঘুরতে লাগলো তার মস্তিষ্কে।

হালিশহরে বন্ধু বঙ্কিমের বিবাহে নিমন্ত্রণ খেয়েই দীনবন্ধু আবার চলে গেল তার কর্মস্থল ঢাকায়। সরকারি নিরস কাজকর্মের মধ্যে মধ্যে বিদ্যুৎ ঝলকের মতন এক একটি কাল্পনিক চরিত্রের সংলাপ তার মাথায় আসে। কবি মধুসূদন একেই কি বলেছেন ইনসপিরেশান? নইলে হঠাৎ এই সব কথা মাথায় আসে কেন? তা হলে তো লিখতে হয়। বেশী দেরী করে ফেললেও লাভ নেই, ইণ্ডিগো কমিশন চলাকালীন বার করতে পারলেই এর উপযোগিতা।

কর্মোপলক্ষে দীনবন্ধুকে নৌকাযোগে প্রায়ই ঢাকা থেকে নানা স্থলে যেতে হয়, দু দিন তিনদিন, কখনো এক সপ্তাহও নৌকোয় কাটাতে হয়। নিরিবিলিতে লেখার সেই প্রকৃষ্ট সময়। লিখতে লিখতে এক এক সময় গঙ্গানারায়ণ সিংহের বর্ণনার কথা মনে পড়ে। কিন্তু গঙ্গানারায়ণ সিংহের নামে আদালতে মামলা ঝুলছে। তার নাম নাটকে উল্লেখ করা সমীচীন হবে না বলে দীনবন্ধু এড়িয়ে যায়।

তিন সপ্তাহের মধ্যে নাটক লেখা সম্পূর্ণ হয়ে গেল। নাম আগে থেকেই ঠিক করা ছিল, নীলদর্পণ। সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপিখানি হাতে নিয়ে দীনবন্ধু উঠে এলো নৌকোর ছাদে। যে-কোনো একটি সৃষ্টিকার্য সম্পূর্ণ করার আনন্দ তো আছেই, কিন্তু এখন বক্ষের মধ্যে ভয়ের দুম দুম শব্দও হচ্ছে। এই নাটক প্রকাশিত হলে রাজদ্রোষে পড়ার ভয় আছে। চাকরি হারানোও অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু এখন আর পিছিয়ে আসার উপায় নেই।

একটু বাদেই প্রবল ঝড় উঠলো। দীনবন্ধুর নৌকো তখন মেঘনার বুকে। ভদ্রের মেঘনা ঝড়ের সময় অতি ভয়ঙ্করী, কালো রঙের ঢেউগুলি যেন অকস্মাৎ অতি জীবন্ত হয়ে ওঠে। অনেক চেষ্টা করেও মাঝিরা হাল ধরে রাখতে পারলো না। তারা হায় হায় করে উঠলো। আর বুঝি নৌকে রক্ষা পায় না।

দীনবন্ধুর সারা শরীর কম্পিত হতে লাগলো। মানুষ মাত্রেরই মৃত্যুভয় থাকে, দীনবন্ধু ভাবলো, সে সামান্য মানুষ, তার জীবনের আর এমন মূল্য কী, কিন্তু নীলদর্পণের পাণ্ডুলিপিও সলিলসমাধি লাভ করবে? তবে কি জগদীশ্বরের ইচ্ছে নয় যে এই নাটক প্রকাশিত হোক? কিছুক্ষণের জন্য দীনবন্ধুর মন ভালো-মন্দ চিন্তার অতীত হয়ে গেল, ক্রুদ্ধ ঝড়ের দাপাদাপি চললো বাইরে।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য নৌকে নিমজ্জিত হলো না। দীনবন্ধু নিরাপদেই এসে পৌঁছেলো ঢাকায়। নাটকটির গুণাগুণ বিচারের আর সময় নেই, অতি দ্রুত ছাপিয়ে ফেলা দরকার। ঢাকায় দীনবন্ধুর দু-একজন গুণগ্ৰাহী জুটেছে। তাদেরই মধ্যে রাম ভৌমিক নামে এক ব্যক্তি যত্ন করে সেখানে নীলদর্পণ ছাপিয়ে দিল। নাট্যকারের কোনো নাম রইলো না। কশ্চিৎ পথিকস্য এই নামে একটি ভূমিকা জুড়ে দিল দীনবন্ধু। তারপর মুদ্রিত নাটকের কয়েক কপি নিয়ে চলে এলো কলকাতায়।

বন্ধু বঙ্কিমকে পড়বার সুযোগ নেই। কারণ সে ইতিমধ্যে মেদিনীপুরের নেগুয়ায় বদলি হয়ে গেছে। দীনবন্ধুর প্রথমেই মনে পড়লো তার কৈশোর পৃষ্ঠপোষক লঙ সাহেবের কথা। লঙ তাকে সব সময় উৎসাহ দিয়েছেন নানা ব্যাপারে, তাঁকে একবার পড়ানো দরকার।

পাদ্ৰী লঙ পেশায় সরকারী অনুবাদক। দেশীয় ভাষায় রচনার সারমর্ম তিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করে সরকারের গোচরে আনেন। আসলে লঙকে দিয়ে সরকার গোয়েন্দার কাজ করিয়ে নেয়। দেশী ভাষায় রাজদ্রোহমূলক কিছু লেখা হচ্ছে কিনা সেটা জানাই সরকারের উদ্দেশ্য। সরলমনা পাদ্ৰী লঙ অত বোঝেন না। তিনি এ দেশের ভাষা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে এ দেশের মানুষকে ভালোবেসে ফেলেছেন। এ দেশের চাষীদের দুরবস্থা সম্পর্কে ব্যক্তিগত উদ্যোগে তদন্ত করেছেন। লঙকে নাটকটি পড়ে শোনালেন দীনবন্ধু। শুনতে শুনতে লঙ উত্তেজিত, ক্রুদ্ধ ও কাতর হয়ে পড়লেন। বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, তুমি সত্য লিখেছে? গ্ৰাম দেশে এমন অত্যাচার হয়! এ সব তুমি নিজের চোখে দেখেছে?

দীনবঙ্কু বললো, কিছু আমার নিজের চোখে দেখা। কিছু কোনো বিশ্বস্ত ব্যক্তির মুখে শোনা।

লঙ বললেন, তুমি অবিলম্বে এ বইখানি ইংরেজিতে অনুবাদিত করাও। এমন চলতি গ্ৰাম্যভাষা তো আমি ইংরেজি করতে পারবো না। তুমি কোনো যোগ্য ব্যক্তির হাতে সত্বর এ-ভার দেও। সে পুস্তক ছাপাবার ব্যবস্থা আমিই করবো। তারপর সেই ইংরেজি ভাষ্য ইণ্ডিগো কমিশনে পেশ করা হবে।

নীলদর্পণের ইংরেজি অনুবাদ কে করবে? দীনবন্ধুর প্রথমেই মনে পড়লো মধুসূদন দত্তের কথা। তিনি এ নাটক লিখতে সম্মত হননি। কিন্তু ইংরেজি অনুবাদও কি করে দেবেন না? ইংরেজি তিনি অতি উত্তম জানেন তো বটেই, তা ছাড়া তিনি এ রকম ভাষায় স্বয়ং নাটক লিখেছেন। শৰ্মিষ্ঠা, পদ্মাবতীর ইংরেজি করেছেন। সুতরাং নাটক অনুবাদের অভিজ্ঞতা তাঁর আছে।

দীনবন্ধু আবার গিয়ে ধরলেন মধুসূদনকে। সেদিনও সেখানে তাঁর বন্ধুরা উপস্থিত। সকলের অনুরোধ তিনি ঠেলতে পারলেন না। ঠিক হলো, তিনি অনুবাদ করে দেবেন বটে কিন্তু তাঁর নাম যেন ঘুনাক্ষরেও প্রকাশ না পায়। তাঁরও তো সরকারি আদালতে চাকুরি।

লঙ সাহেবই পরামর্শ দিয়েছিলেন দীনবন্ধুকে এই সময় কলকাতা ত্যাগ করতে। তাই দীনবন্ধু ঢাকায় ফিরে গিয়ে নিরীহভাবে চাকুরি করতে লাগলেন। ঝামাপুকুরে এক বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো মধুসূদনকে। তিনি বললেন, এক রাত্রেই তিনি অনুবাদ শেষ করে দেবেন। তবে তাঁর দুটি শর্ত আছে। অন্তত বারো বোতল বীয়ার চাই তাঁর। আর গঙ্গানারায়ণকে তাঁর সঙ্গে থেকে প্রতিটি লাইন পড়ে শুনিয়ে সঠিক অর্থ বুঝিয়ে দিতে হবে। মাঝে মাঝে সংলাপে মুসলমানী ভাষা আছে। গঙ্গানারায়ণ ওদের মধ্যে ছিল। সে-ই ও সব কথার ঠিক মানে বুঝতে পারবে।

সন্ধে থেকে শুরু হলো কাজ। মধুসূদনের একহাতে বীয়ারের বোতল, অন্য হাতে লেখনী। গঙ্গানারায়ণ সংলাপগুলো পড়ে পড়ে তার সাধারণ অর্থ বুঝিয়ে দেয়। মধ্যপথেই মধুসূদন হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ঠিক আচে, ঠিক আচে, বুঝিচি, বুঝিচি। তার পর তিনি গড়গড়িয়ে লিখে যান।

অনুবাদ চলতে লাগলো দ্রুত তালে। মধ্যরাত্রি পেরিয়ে যাবার পর মধুসূদনের নেশাও প্রায় চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছোয়। মাঝে মাঝে তাঁর চক্ষু ঢুলে আসে, হাত থেকে খসে পড়ে কলম। গঙ্গানারায়ণ তখন বলে, তা হলে আজ আর থাক, মধু! বাকিটা কাল হবে।

আবার কলম তুলে নিয়ে এবং গলায় এক ঢোক বীয়ার ঢেলে মধুসূদন বলেন, নো-ও-ও। আই মাস্ট ফিনিস দিস ড্যাম থিং টু নাইট। যাই বলিস, গঙ্গা, এই পোস্টমাস্টারবাবুটি কিন্তু নাটকটি লিকেচে বেড়ে। সুমুন্দি দেঁড়িয়ে যেন কাটের পুতুল, গোড়ার বাক্যি হয়ে গিয়েচে! ড্যাম গুড! ভেরি রিয়েলিস্টিক। তারপর বল, নবীনমাধব কী বললে? নবীনমাধব ক্যারেকটারটা যেন তোর আদলে গড়েচে।

গঙ্গানারায়ণ বললো, মধু, তুই আর বীয়ার পান করিস নি! যথেষ্ট তো হলো।

মধুসূদন ধমকে বললেন, সাট্‌-আপ, মাইডিয়ার বয়। তোর কাজ তুই করে যা, আমার কাজ আমি করবো।

পঞ্চম অঙ্কে এসে মধুসূদন বললেন, এ কি রে বাপু, সব্বাইকে মেরে ফেলচে যে! এ যে বাবা হ্যামলেটকেও ছাড়িয়ে গেল! পোস্টমাস্টারবাবুটি প্রথম নাটক লিকেই শেক্সপীয়ার। হা-হা-হা-হা! তারপর বল গঙ্গা, আদুরী কী বললে? ফাইন ক্যারেকটার, দিস আদুরী, আই লাইক দিস গার্লি-ওরে বাপরে, এই বিন্দুমাধব আবার খুব সংস্কৃত ঝাড়ে যে।

নাটকের শেষ বাক্যটি লেখামাত্র মধুসূদন নেশায় জ্ঞান হারিয়ে সেই টেবিলের ওপরেই শুয়ে পড়লেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *