1 of 2

৩৯. মহাভারতের বাংলা অনুবাদ

বিধবা বিবাহের প্রচলন করবার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রী-শিক্ষা বিস্তারের জন্যও আপ্ৰাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন বিদ্যাসাগর। অকস্মাৎ তাতে বাধা পড়লো।

সরকারী কর্মচারীরা তাঁর কাজকর্মের তারিফ করেন, বিলাতের সংবাদপত্রে তাঁর প্রশস্তি ছাপা হয়, সেইজন্য বিদ্যাসাগর ধরেই নিয়েছিলেন যে তাঁর সব প্রগতিমূলক কাজে তিনি সরকারের সমর্থন পাবেন। গ্রামে গ্রামে স্কুল খোলার দায়িত্ব দিয়ে সরকার তাঁকে স্পেশাল ইন্সপেক্টর অব স্কুলস পদে নিযুক্ত করেছেন, সেইজন্য অতিরিক্ত পরিশ্রম করে বিদ্যাসাগর স্কুল খুলে চলেছেন। শুধু ছেলেদের জন্য নয়, বালিকাদের জন্যও। বেথুনের নামে কলকাতার স্কুলটি চলছে নানান বাধা বিপত্তি এড়িয়ে, বিদ্যাসাগর সেই স্কুল কমিটির সম্পাদক, কিন্তু তিনি বুঝেছিলেন, গ্রামের অবলাদেরও মুখে ভাষা না জোগাতে পারলে দেশের নারী সমাজের অন্ধকার কিছুতেই দূর হবে না।

স্কুল খোলা খুব কষ্টসাধ্য কিংবা ব্যয়সাধ্য নয়। যে গ্রামের লোকেরা স্কুলের জন্য জমি দিতে চায় এবং গ্রামবাসীরাই চাঁদা তুলে একটি স্কুল ঘর নির্মাণ করে দিতে প্ৰস্তুত, সেখানেই বিদ্যাসাগর নিজে গিয়ে একটি স্কুলের পত্তন করে আসেন। সেই স্কুলের শিক্ষকের মাস মাহিনা দেবে সরকার। এক একটি স্কুলের জন্য মাসে পনেরো-কুড়ি টাকা, বড়জোর চল্লিশ-পয়তাল্লিশ টাকা খরচ। হুগলি, বর্ধমান, মেদিনীপুর, নদীয়ায় ঘুরে ঘুরে বিদ্যাসাগর একটার পর একটা বালিকা বিদ্যালয় খুলে যেতে লাগলেন। এই রকম ভাবে পঁয়তাল্লিশটা স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পর সরকারের টনক নড়লো।

সরকারের শিক্ষা বিভাগ থেকে বিদ্যাসাগরকে ডেকে বলা হলো, এত স্কুল খুলে যাচ্ছে, এর খরচ দেবে কে?

বিদ্যাসাগর আকাশ থেকে পড়লেন। এই অশিক্ষিত মূখদের দেশে জ্ঞানের আলো বিতরণ করার, জন্য ইংরেজরা কত বাণী দিয়েছে, এখন খরচের নামে তারা পিছিয়ে যাবে? আর কতই বা খরচ, এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত পঁয়তাল্লিশটি স্কুলের জন্য মাসিক মোট ব্যয় আট শো পঁয়তাল্লিশ টাকা। রাজকোষে এই সামান্য টাকার অকুলান?

কিন্তু ইংরেজ সরকার এ দেশে শিক্ষার প্রসার চায় কিছু কেরাণী বা নিম্নশ্রেণীর কর্মচারী সৃষ্টির জন্য। স্ত্রীলোকদের শিক্ষিত করে সরকারের কোনো লাভ নেই, কারণ স্ত্রীলোকেরা তো চাকরি করতে আসবে না। এমন অকাজে অর্থব্যয়ের ইচ্ছে সরকারের থাকবে কেন? বিদ্যাসাগর লম্বা লম্বা চিঠিতে অনেক যুক্তি প্ৰদৰ্শন করলেন, তবু সরকার অটল। এদিকে মাসের পর মাস চিঠি চালাচালির ফলে ঐ পঁয়তিরিশটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন বন্ধ হয়ে আছে। বিদ্যাসাগর নিজে ঐসব শিক্ষকদের নিযুক্ত করেছেন, সরকার বেতন না দিলে তাঁকেই দিতে হবে।

আর একটি ব্যাপারও বিদ্যাসাগর লক্ষ্য করলেন। দক্ষিণ বাংলার ইন্সপেক্টর অব স্কুলস পদটি খালি হওয়ার পর সকলেই ধরে নিয়েছিলেন যে এবার ঐ পদটি বিদ্যাসাগরকেই দেওয়া হবে। গ্রাম বাংলার বিদ্যালয়গুলি সম্পর্কে তাঁর চেয়ে বেশি অভিজ্ঞতা আর কারুর নেই। কোনো সাহেবের তো থাকতেই পারে না। তবু ঐ পদটি দেওয়া হলো আর একজন সাহেবকে। চাকুরির ক্ষেত্রে একটা সীমারেখা। আছে, তার ঊর্ধ্বে কোনো নেটিভকে বসানো হবে না।

বীরসিংহ গ্ৰাম থেকে আগত এই জেদী পুরুষটির আর একবার ঘাড় বেঁকা হলো। বিদ্যাসাগর পাঁচশো টাকা মাইনের সরকারী চাকরি থেকে পদত্যাগ করলেন।

এখন অবস্থা এমন নয় যে চাকরি ছাড়লে বিদ্যাসাগরকে দারিদ্র্য বরণ করতে হবে। গ্ৰন্থ রচনা করে তাঁর নিজস্ব আয় যথেষ্ট। কিন্তু তাঁর মন ভেঙে গেল। শুধু এই ঘটনায় নয়, পর পর আরও কয়েকটিতে।

কয়েক বৎসর আগে বিদ্যাসাগর তাঁর বন্ধু প্যারীচরণ সরকারের বাড়িতে একদিন গিয়েছিলেন রসালাপ করতে। প্যারীচরণ বারাসতের স্কুলে পড়াচ্ছিলেন, সেখান থেকে তখন হিন্দু স্কুলের হেড মাস্টার হয়ে এসেছেন। প্যারীচরণ ইংরেজিতে যথেষ্ট পন্ডিত। বারাসতে থাকার সময় একেবারে শিশুদের ইংরেজি শিক্ষার জন্য একটি বই লিখেছিলেন, তার নাম ফাস্ট বুক-হিন্দু স্কুলে এসে সেই বইটির একটি নতুন সংস্করণ প্রকাশের জন্য ঘষামাজ করছেন তখন। কথায় কথায় তিনি বিদ্যাসাগরকে বলেছিলেন, ঈশ্বর, তুমিও একটা শিশুশিক্ষার জন্য বাংলা বই লেখো না কেন! বিদ্যাসাগর প্রথমে কোনো উত্তর দেননি। প্যারীচরণ আবার বলেছিলেন, তুমি কি ভাবছো, তোমার মতন এতবড় পন্ডিত অ-আ-ক-খাঁর বই লিখলে তোমার মান যাবে? কিন্তু শিশুকালে যদি শিক্ষার ভিত্তি পোক্ত না হয়, তাহলে বড় হয়ে পণ্ডিতী বই পড়বেই বা কজনা? এসো, তুমি আর আমি মিলে শিশুদের বাংলা ও ইংরেজি বর্ণ পরিচয়ের ভার লই।

কথাটা বিদ্যাসাগরের মনে লেগেছিল। এর পর একদিন পাল্কীতে যেতে যেতে তিনি অতি সরল কয়েকটি বাংলা বাক্য লিখলেন। পাখী উড়িতেছে। পাতা নড়িতেছে। গরু চরিতেছে। জল পড়িতেছে। ফুল বুলিতেছে।–গোপাল বড় সুবোধ, গোপাল আপনার ছোট ভাই ভগিনীগুলিকে বড় ভালো বাসে– লিখতে লিখতে নিজেই অবাক হয়ে গেলেন বিদ্যাসাগর। বাংলা এমন সহজভাবেও লেখা যায়? যুক্তাক্ষর ব্যতিরেকেও বাক্য হয়? সংস্কৃতের অভিভাবকত্ব ছাড়াও বাংলাভাষা নিজের পায়ে ভর দিয়ে চলতে পারে!

কিছুদিন পরে তিনি প্রকাশ করলেন বর্ণ পরিচয়, প্রথম ভাগ। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে অভূতপূর্ব সাড়া পড়ে গেল। ঠিক এই রকমই একটা গ্রন্থের যে অভাব ছিল, সেটা বোঝা গেল যখন বিদ্যাসাগর এই রকম একটি বই লিখলেন। বিক্রয় হতে লাগলো। হাজারে হাজারে। বিদ্যাসাগর নিজেই প্ৰকাশক, সুতরাং অথগিম হতে লাগলো প্রচুর। তারপর রচনা করলেন বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগ। পরপর আরও কয়েকটি পাঠ্য পুস্তক লিখে ফেলার পরে তাঁর নিয়মিত অথাগম হতে লাগলো। তিনি রীতিমত ধনী ব্যক্তি।

চাকরি ছাড়ার পরও তিনি ধনী, কিন্তু অর্থশূন্য এবং ঋণগ্রস্ত। আয়ের চেয়ে তাঁর ব্যয় বেশী। বিধবা বিবাহের জন্য তাঁকে ঋণ করতে হয়েছে প্রচুর। বিধবাদের বিবাহের জন্য তিনি শুধু আইনের প্রবর্তন করিয়েই নিরস্ত হননি। সামাজিক ভাবে এই বিবাহ চালু করার জন্য তিনি নিজে একের পর এক বিবাহের ব্যবস্থা করে যাচ্ছিলেন। ক্ৰমে দেখা গেল, এটি যেন তাঁরই একার দায়। খরচ বহন করতে হয় তাঁকেই। এমনও রটে গেল যে কলকাতায় গিয়ে কোনো বিধবা কন্যাকে বিবাহ করলে বিদ্যাসাগরই নববধূর গয়না-গাঁটি ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিজে কিনে দেন। বিধবা বিবাহের নামে কেউ কেউ তাঁকে তঞ্চকতা করতেও ছাড়লো না।

যেসব মান্যগণ্য ব্যক্তি এ কাজে তাঁকে সাহায্য করার আন্তরিক আশ্বাস দিয়েছিলেন, তাঁরাও একে একে পিছিয়ে গেছেন প্রায় সকলেই। অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েও ভুলে গেছেন। এমনকি তাঁর সুহৃদরাও অনেকেই উদাসীন এখন এ-ব্যাপারে।

চাকরি ছাড়ার পর বিদ্যাসাগর ঠিক করলেন, যে-কয়েকটি বালিকা বিদ্যালয় ইতিমধ্যেই স্থাপিত হয়েছে সেগুলিকে কিছুতেই বন্ধ হতে দেওয়া হবে না। তাঁর একার পক্ষে এতগুলি স্কুলের ব্যয় বহন করা দুঃসাধ্য। তিনি জনসাধারণের কাছ থেকে চাঁদা তুলে চালাবেন। কিন্তু তেমন সাড়া পাওয়া গেল না। তিনি সবিস্ময়ে টের পেলেন যাঁরা মুখে সর্বদা বলেন যে, স্ত্রী-শিক্ষা আমাদের দেশের পক্ষে বিশেষ প্রয়োজনীয়, তাঁরাও কার্যক্ষেত্রে কোনো সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন না। এ-দেশের মানুষের মুখের কথার সঙ্গে কাজের মিল নেই।

আঘাত শুধু এরকমই নয়, আঘাত আসে অতি কাছের মানুষের কাছ থেকেও। যাদের তিনি সাহায্য করেন, তারাই আড়ালে গিয়ে তাঁর নামে অপবাদ ছড়ায়। অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু মদনমোহন সামান্য টাকা পয়সার প্রশ্ন তুলে ঝগড়া করলেন কিছুদিন আগে। অথচ, প্রথম যৌবনে এই মদনমোহনকেই তিনি ডেকে এনে সংস্কৃত কলেজে তাঁর থেকে উঁচু পদে চাকরির ব্যবস্থা করেছিলেন।

কিছুদিন অবসন্ন, নিরুদ্যম হয়ে রইলেন বিদ্যাসাগর। মনের সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যও ভগ্ন হলো। চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকেন এবং গ্রন্থ পাঠ করেন।

কিন্তু এরকম অবস্থা বেশী দিন চলতে পারে না। এক সময় তিনি ভাবলেন, আমি কি মানুষের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছি? মানুষের কথা ভেবে, মানুষের জন্য তিনি ঈশ্বরের প্রতিও মনোযোগ দেননি। এখন মানুষের ওপর থেকেও যদি বিশ্বাস চলে যায়, তাহলে তিনি কী অবলম্বন করে বাঁচবেন? আবার জোর করে ঝেড়ে ফেললেন মানসিক বিষাদ। ঠিক করলেন যে একটা কিছু কঠিন কাজের মধ্যে আত্মনিয়োগ করলে জড়তা কেটে যাবে। কিছুদিনের জন্য লেখার কাজ নিয়ে থাকবেন তিনি। এ পর্যন্ত টুকিটাকি ছোটখাটো বই লিখেছেন কতকগুলি কিন্তু বড় কিছু লেখার সময় পাননি। তিনি মহাভারতের অনুবাদ শুরু করলেন, এটি শেষ না করা পর্যন্ত থামবেন না।

মহাভারতের কিছু কিছু অনুবাদ করে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশের জন্য পাঠাচ্ছেন এই সময় একদিন এক যুবক এলো তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। যুবকটি তাঁর পূর্ব পরিচিত, কিন্তু তাকে দেখে তিনি চিনতে পারলেন না। মুখখানি কালি বৰ্ণ, চক্ষু দুটি কোটরগ্ৰস্ত, এর ধুতি ও কুর্তা যথেষ্ট মূল্যবান হলেও পা দুটি খালি।

বিদ্যাসাগর জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কে হে, বাপু?

যুবকটি বললো, গুরুদেব, আমায় বিস্মৃত হয়েচেন? আমি নবীনকুমার সিংহ।

বিদ্যাসাগর নাম শুনে ভ্রূকুঞ্চিত করে রইলেন। তাঁর ক্রোধের সঞ্চার হলো। এই সব অস্থিরমতি ধনীর দুলালদের সঙ্গে তিনি কোনো সংশ্ৰব রাখতে চান না। এই নবীনকুমার সিংহ অত্যুৎসাহ নিয়ে এক সময় তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। প্রথম প্রথম প্রতিটি বিধবা বিবাহের অনুষ্ঠানে সে নিজে উপস্থিত থাকতো। প্রতিটি বিবাহে সে এক সহস্র টাকা সাহায্য করবে, এমন ঘোষণা করেছিল সংবাদপত্রে। তারপর হঠাৎ ভোঁ ভাঁ। আর তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি, এক সহস্র টাকা দূরে থাক, এক পাই পয়সা দিয়েও আর সাহায্য করে না। অন্যান্য বনিয়াদী ঘরের ছোঁকরাদের মতন এরও যে পাখা গজিয়েছে এবং উড়তে শিখেছে, সে সংবাদ একটু একটু কানে এসেছে তাঁর। যতই মুখে আদর্শের বুলি আওড়াক, রক্তের দোষ যাবে কোথায়, সূরা আর বারনারী ছাড়া এরা বাঁচতে পারে না।

অপ্ৰসন্ন মুখে তিনি বললেন, চেহারা দেখে চিনবার উপায় নেই, তবে নাম শুনে চিনেছি। তবে আমি তোমার গুরু হলাম কিসে? তোমার মতন দু-চারটে চ্যালা দেখলেই লোকে টের পেয়ে যাবে আমি কী দরের গুরু।

নবীনকুমার বললো, আমি আপনার অতি অযোগ্য শিষ্য। আমি কি আপনার চরণারবিন্দ একবার সম্পর্শ করতে পারি?

বিদ্যাসাগর বললেন, যদি ব্ৰাহ্মণকে প্ৰণামের মতি থাকে, তবে করতে পারো।

উপবিষ্ট অবস্থায় প্ৰণাম গ্ৰহণ করতে নেই বলে বিদ্যাসাগর উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই নবীনকুমার একেবারে তাঁর পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বললো, আমি পাপী, আমি অপবিত্র…।

হু-হু করে কাঁদতে লাগলো সে।

বিদ্যাসাগর এরকম কান্নাকাটি খুবই অপছন্দ করেন। অপরকে অশ্রু বিসর্জন করতে দেখলেই তাঁর চক্ষু সজল হয়ে আসে, এই তাঁর এক মহা দুর্বলতা। এই বিলাসী, উচ্ছৃঙ্খল যুবকটিকে তিনি অপছন্দ করেন, তবে এর কান্না দেখে তাঁকে কাঁদতে হবে, এ এক জ্বালা!

তিনি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, ওঠে, উঠে বসে যা বলতে চাও বলে। আমি কোনো মানুষকেই অপবিত্র মনে করি না। তবে তোমার মতন ধনী ব্যক্তিদের আবার কখনো পাপ হয় নাকি? পাপ তো শুধু গরিব-হা-ভাতেদের জন্য।

নবীনকুমার তবু কান্না সামলাতে পারছে না। তার মতন তেজস্বী অহংকারী যুবক এরকম দুর্বলতা আগে কখনো দেখায়নি। কিন্তু তার মানসিক ভারসাম্যই যেন টলে গেছে। কমলাসুন্দরীর বাড়িতে রাত্রিযাপন করার পর তার যখন চৈতন্য হয়, তখনই সে কেঁদে উঠেছিল। নিজের কাছে নিজের এমন নিদারুণ পরাজয় সে সহ্য করতে পারেনি। সেদিন বাড়ি ফেরার পথেই সে সংকল্প নিয়েছিল সে আত্মহত্যা করবে।

প্ৰায় দশদিন সে নিজেকে বন্দী করে রেখেছিল নিজের শয়নকক্ষে। বাইরের কারুর সঙ্গে দেখা করেনি। জননী কিংবা পত্নীর অনুরোধে সামান্য কিছু আহার মুখে তোলার ভান করেছে মাত্র। সে আত্মনিগ্রহের চরম দেখতে চেয়েছিল। ক্রমশই বেড়ে উঠছিল তার জেদ, সে ভেবেছিল আত্মহত্যাই তার একমাত্র পরিণতি হতে পারে। নির্জন দুপুরে সে চুপি চুপি বেরিয়ে গিয়ে ঝাঁপ দিয়েছিল তাদের গৃহের পিছনের দিকে পুকুরে। সস্তরণ জানে না সে, জলের গভীরে তলিয়ে যেতে যেতে বুক ফাঁটা যন্ত্রণার সঙ্গে সঙ্গে সে তৃপ্তিতেও বলতে চেয়েছিল, আঃ! আমার শাস্তি শুধু আমি নিজেই দিচ্ছি। আর কেউ না! অবশ্য পরম বিশ্বস্ত এবং সদা অনুগামী দুলালচন্দ্র তাকে ঠিক সময় দেখতে পেয়ে জলে লাফিয়ে পড়ে এবং উদ্ধার করে আনে। নবীনকুমার দুলালচন্দ্রকে পাঁচবার চপেটাঘত করে বলেছিল, আমার হুকুম ছাড়া তুই কেন আমাকে তুলিচিস, হারামজাদা!

এর পর সে একদিন দুপুরে বাবার আমলের পুরোনো কেলভিন কোম্পানির একটি পিস্তলে গুলি ভরে তার নলটি নিজের গলায় ঠেকিয়ে ট্রিগার টেনে দেয়। বহুকাল অব্যবহৃত পিস্তলটি নিজেই ফেটে যায় বিকট শব্দ করে, নবীনকুমারের দুটি আঙুল কিছু জখম হয় মাত্র। দুবার প্রাণে বেঁচে যাওয়ায় নবীনকুমার প্রাণ হাননের চেষ্টা থেকে বিরত হয় বটে কিন্তু বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সামাজিক জীবন থেকে। মুলুকচাঁদের আখড়ায় সে আর কখনো পদার্পণ করেনি। তার বন্ধুরা তাকে কতবার এসে ডেকে ডেকে ফিরে গেছে, কিন্তু সে দেখা করেনি। কারুর সঙ্গে।

কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলেই তার চক্ষে সেই দৃশ্যটি ভেসে ওঠে। স্থূলকায়া কমলাসুন্দরী অতিশয় কাতরভাবে আকুলি বিকুলি করে বলছে, ওগো, আমায় ছুঁয়োনি, আমায় ছুঁতে নেই। আমি যে তোমার মায়ের মতন…আর নেশার ঝোঁকে দিকবিদিক জ্ঞানশূণ্য নবীনকুমার তাকে আলিঙ্গন করে জড়িত স্বরে বলছে, নাচ দেকাবে না, নাচ? শুয়ে শুয়ে নাচ? প্রতিবার দৃশ্যটি মনে পড়লে ঘৃণায় তার শরীরে একটা ঝাঁকুনি লাগে। এক বিগতযৌবনা বারবনিতার দূষিত শয্যায় রাত্রি যাপন করতে হয়েছে তাকে। লোকপরম্পরায় সে জেনেছে যে ঐ স্ত্রীলোকটিই ছিল তার পিতার রক্ষিতা। সহ্য হয় না, কিছুতেই সহ্য হয় না! এজন্য সে কারুকে দোষ দিতে পারে না নিজেকে ছাড়া। হরিশকে সে দায়ী করতে পারে না কিছুতেই, কারণ হরিশ কোনো দিন নিজে থেকে তাকে ডাকেনি, তাছাড়া নিজের কাজের সময় ঠিক সে উঠে যেতে পারে, তার মতন গা ভাসিয়ে দেয়নি।

চার পাঁচ মাস এই অবস্থায় কাটিয়ে দিয়েছে নবীনকুমার। গ্রন্থপাঠ করে সে মন ভোলাতে চেয়েছে। তারপর শুরু হলো একাকিত্বের যাতনা। তার পাপের কথা সে কারুকে জানাতে চায়। কিন্তু কাকে? ক্যাথলিকরা যেমন গীর্জায় গিয়ে সব কথা উজাড় করে দিতে পারে, সেইরকম ভাবে। বারবার একটি নামই মনে পড়ছিল তার, কিন্তু তাঁর কাছে আসতে ভয় পাচ্ছিল সে। শেষ পর্যন্ত বুঝলো যে, ওঁর কাছে যাওয়া ছাড়া গতি নেই।

এতদিন পর বাড়ির বাইরে এসে নবীনকুমার অনুভব করলে যে মানসিক বৈকল্যের প্রভাব তার শরীরের ওপরেও পড়েছে। চলতে গেলে তার পা কাঁপে, মস্তিষ্কের মধ্যে ঝিম ঝিম শব্দ। কয়েক বৎসর আগে সে গুরুতরভাবে পীড়িত হয়ে পড়েছিল, তখন তার বাঁচার জন্য ব্যাকুলতা ছিল প্রবল। এবারে সে স্বেচ্ছায় মৃত্যুকবলিত হতে গিয়েছিল। এখনো সে জীবন সম্পর্কে বীতরাগ। জুড়ি গাড়িতে ওঠার অনেক পরে দেখলো যে তার দু পায়ে দু রকম পাটির জুতো।

বিদ্যাসাগর তার হাত ধরে টেনে তুলে বললেন, তোমার শরীরের এ অবস্থা হয়েছে কেন? বেশ দিব্যাকান্তি ফুটফুটেটি ছিলে! কী পাপ করেছে তুমি শুনি?

অশ্রু সংবরণ করে নবীনকুমার স্থির হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করলো। তখনো তার শরীর কাঁপছে। বিদ্যাসাগর বললেন, বসো। শান্ত হও! নবীনকুমার তারপরও কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। চক্ষু শুষ্ক হবার পর ধীর স্বরে সে বললো, আমাকে শাসন করার কেউ নেই। আমি স্বেচ্ছাচারীর মতন চলতে পারি, আমি কুপথে যাই না সুপথে যাই, সে ব্যাপারে। আমি সম্পূর্ণ স্বাধীন। কিন্তু আমি আমার মনকে নিজের বশে রাকতে পারিনি, এই আমার পাপ।

এই নবীন যুবকটির কথা শুনে বিদ্যাসাগর খানিকটা সকৌতুক বিস্ময় অনুভব করলেন। এই রকম কাঁচা বয়েসের অধিকাংশ যুবকই তো নিজের মনকে সবশে রাখতে পারে না, এ আর নতুন কথা কী! সদ্য সাবালকত্ব প্রাপ্ত হয়ে বিপুল সম্পত্তির অধিকারী হয়েছে, এদের পিছনে অজস্র ইয়ার-বক্সী-মোসাহেব জুটে যায়, তারপর মুণ্ডটি চিবিয়ে খায়।

তিনি বললেন, পুরুষকার থাকলেই মনকে নিজের বশে রাখা যায়। এ ব্যাপারে আমি তোমাকে কী প্রকারে সাহায্য করতে পারি, বলে তো বাপু?

-আমার মতন ব্যক্তির কি জীবন ধারণের প্রয়োজন আছে? আমি মরতেও রাজি আচি, যদি আপনি বলেন।

—আমি বললেই মরবে, এ যে বড় বিষম কথা! কেন, মরবো কেন? কী এমন গৰ্হিত, কাজ করেছে? তোমার মতন যুবকের কোনো দিকেই কোনো অভাব নেই, তবু মৃত্যু-চিন্তা, এ তো ভারি আশ্চর্যের!

—আমায় কেউ সুরাপান কত্তে নিষেধ করেনি, আমি ঐ নেশা ধল্লে সবাই ভাবতো স্বাভাবিক, তবু আমি বাল্যকাল থেকে সুরাপানকে ঘৃণার চক্ষে দেখিচি। অথচ কখন এক সময়ে আমি সুরাপায়ী হয়ে গেলুম। কুপল্লীতে নষ্ট মেয়েমানুষদের অঙ্গ আমি কখনো কামনা করিনি, অথচ এক রাত্রি অবসানে আমি দেকলুম, আমি সেখেনে শুয়ে আচি। কেন আমার এরূপ বিপরীত মতি? যে কাজে আমার অনুশোচনা হয়, সে কাজ আমি নিজেই করি কেন? আপনি আমায় আত্মস্থ করে দিন।

—তুমি কি আমায় গুরুঠাকুর ঠাওরেছে নাকি? আমি কোনো মন্ত্রতন্ত্র দিয়ে তোমায় সারাতে পারবো না। যদি সুপথে থাকতে চাও, নিজেকে শোধরাতে চাও, নিজের মনকে শক্ত করো!

—মন যার নিজের বশে থাকে না সে কোন উপায়ে মন শক্ত করবে?

—শোনো, যারা নিজের বিচার বুদ্ধি দিয়ে ন্যায়-অন্যায় বুঝতে শেখে, তারা কখনো পরের কথায় নাচে না। তোমার এখনো বুদ্ধি পাকেনি বোঝা যাচ্ছে। বয়সোচিত দুর্বলতায় যদি কিছু কুকর্ম করে থাকে, এখনো ফেরো। সময় বয়ে যায়নি। তোমার অর্থ আছে, দেশের কথা ভাবো, লোকহিতের জন্য কিছু করো। মদ টেনে বয়াটেগরি করা অতি সহজ, গণ্ডায় গণ্ডায় বড় মানুষের ছেলেরা তো তাই করছে। তুমি যদি প্রকৃত মানুষ হতে চাও, তবে নিজের বিচার বুদ্ধিকে জাগ্রত করো।

—আপনি বলচেন, আমার জীবন ধারণের সার্থকতা আচে?

—কোনো সৎ কাজ করতে পারলেই জীবন ধারণ সার্থক হয়। তুমি তো দু-একখানা বই লিখেছিলে, সেদিকেই অবার মন দাও!

–সামান্য গ্ৰন্থ রচনায় আমার আর আগ্রহ হয় না। গত পরশ্ব থেকে আমি অন্য একটা কতা ভাবচি। আমি যদি সম্পূর্ণ মহাভারত বাঙ্গালাতে অনুবাদিত করি, তাতে কি আমার পাপস্খালন হতে পারে? মুসলমানরা পুণ্য অর্জনের জন্য কোরান নকল করে, আমিও যদি সেই মতন—

বিদ্যাসাগর নবীনকুমারকে আপাদমস্তক দেখলেন একবার। তাঁর ওষ্ঠে হাস্য ফুটে উঠলো। সদ্য গুণফরেখা দেখা দিয়েছে এই যুবকের, এ সমগ্ৰ মহাভারত অনুবাদ করবে? বলে কী?

—কী বললে? তুমি মহাভারত হাতে লিখে নকল করবে, না বাঙ্গালায় রূপান্তরিত করবে?

–বাঙ্গালা গদ্যে সমগ্ৰ মহাভারত রচনা করবো।

—তুমি সমগ্ৰ মহাভারত পড়েছে? জানো সে গ্ৰন্থখানি কত বিশাল?

—আজ্ঞে, বাল্যকাল থেকেই মহাভারত গ্ৰন্থ আমার বড় প্রিয়, কাশীদাস নয়, মহাত্মা ব্যাসদেব বিরচিত যেটি। সম্প্রতি গত কয়েক মাসে গৃহবন্দী থাকাকালীন আমি আবার আদ্যোপান্ত ঐ গ্রন্থ পাঠ করিচি। এ কাজ বিপুল পরিশ্রমসাধ্য আমি জানি, কিন্তু এই শ্ৰম আমার প্রাপ্য।

বিদ্যাসাগর উচ্চহাস্য করে উঠলেন। কয়েক মাস ধরে তিনি নিজেও মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন, তা কাটিয়ে ওঠার জন্যই তিনি মহাভারত অনুবাদে প্ৰবৃত্ত হয়েছিলেন। এই যুবকও সম্পূর্ণ অন্য কারণে কিছুদিন যাবৎ মনোযোগী, সেই অবস্থা থেকে উদ্ধার পাবার জন্য এ-ও মহাভারত অনুবাদের কথা চিন্তা করেছে। এই অকস্মিক মিলটি কৌতুকজনকই বটে।

আরও কিছুক্ষণ নবীনকুমারের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বললেন বিদ্যাসাগর। তারপর তাকে বললেন, সপ্তাহখানেকের মধ্যে সে যেন কয়েক পৃষ্ঠা অনুবাদ করে এনে দেখায়। সেই লেখা দেখে তিনি নবীনকুমারের আন্তরিকতা বিচার করতে পারবেন।

এক সপ্তাহ লাগলো না, দুদিন পরেই নবীনকুমার সঙ্গে নিয়ে এলো স্বরচিত তিন পৃষ্ঠা বাংলা মহাভারত। বিদ্যাসাগর মনোযোগ সহকারে পৃষ্ঠা তিনটি পড়লেন কয়েকবার। তারপর বললেন, তুমি তো সত্যি বড় বিস্ময়কর ছোঁকরা দেখছি! তোমার রচনায় কয়কটি ভ্ৰম আছে, তিন জায়গায় তুমি শ্লোকের ঠিক মতন অর্থ অনুধাবন করতে পারোনি, স্পষ্টই বোঝা যায়, তোমার সংস্কৃত জ্ঞান তেমন নেই। কিন্তু তোমার বাঙ্গালা গদ্যভাষাটি তো বড় চমৎকার। যেমন সাবলীল, তেমনই ঝংকারময়। অপরাপর লেখকদের রচনা আমি পড়ে দেখেছি, এমন গদ্যভাষা সহসা চোখে পড়ে না। এরকম প্রাঞ্জল অনুবাদ লোকে আগ্রহের সঙ্গে পাঠ করবে। তুমি সত্য বলছে, তুমি সম্পূর্ণ মহাভারত অনুবাদ করবে?

নবীনকুমার বললো, আপনার পা ছুঁয়ে শপথ কর্তে পারি।

বিদ্যাসাগর বললেন, উত্তম কথা। তুমি এ কাজ এক কিছুতেই পারবে না। সংস্কৃত উত্তমরূপে না জানলে তোমার সারা জীবনের পরিশ্রমেও কোনো কাজ হবে না। তোমার অর্থ আছে, কিছু পণ্ডিত নিযুক্ত করো। আমিই সেরকম কিছু পণ্ডিত ঠিক করে দিতে পারি। তাঁদের দিয়ে সংস্কৃত শ্লোকগুলির সঠিক অর্থ নিৰ্ণয় করিয়ে নেবে, কিন্তু ওঁদের ঐ অং বং ওয়ালা বাঙ্গালা গদ্য চলবে না, তোমার এই সুন্দর ভাষায় সেই রূপ দাও।

নবীনকুমার বললো, আপনি যেরকম বলচেন, সেরকমই হবে।

বিদ্যাসাগর বললেন, দেরি না করে কাজে লেগে যাও অবিলম্বে। লঘু আমোদ ছেড়ে তুমি এই কঠিন কর্মে নিযুক্ত হলে তোমার উপকার হবে, এবং তা আমারও আহ্লাদের বিষয় হবে। সেইজন্য, আমি নিজে মহাভারতের যে অনুবাদ শুরু করেছিলুম, তা বন্ধ করে দিলুম। তোমার মহাভারতই দেশে প্রচারিত হোক।

নবীনকুমার বললো, আপনি-আপনি মহাভারতের রূপান্তর শুরু করেছিলেন? আমি জানতুম না, তবে তো আমার…

বিদ্যাসাগর বললেন, আমি অল্পই করেছি, সেখানেই ক্ষান্ত হবো। ভালোই হলো, আমি অন্য কাজে মন দিতে পারবো। তোমার ভয় নেই, আমি মধ্যে মধ্যে তদারক করে আসবো তোমাদের অগ্ৰগতি। আমার যেটুকু সাধ্য, তা দিয়ে তোমায় সাহায্য করতে বিরত হবো না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *