যুদ্ধের কারণ (سَبَبُ الْغَزْوَةِ):
মক্কা বিজয়ের যুদ্ধ ছিল সত্য মিথ্যা এবং ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্যকারী যুদ্ধ। এ যুদ্ধের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর রিসালাত সম্পর্কে আরববাসীগণের মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কিংবা সন্দেহের আর কোন অবকাশই রইল না। এ কারণে, পরিস্থিতির মোড় সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে গেল। এবং মানুষ আল্লাহর দ্বীনে দলে দলে প্রবিষ্ট হতে থাকল। এ সম্পর্কিত বিস্তারিত বিবরণ ‘প্রতিনিধি প্রেরণ’ অধ্যায়ে উপস্থাপিত হবে এবং ‘বিদায় হজ্জ’ সম্পর্কিত আলোচনায়ও এ সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করা সম্ভব হবে। যাহোক, আলোচ্য সময়ে অভ্যন্তরীণ সমস্যা বলতে আর তেমন কিছুই ছিল না। ফলে মুসলিমগণ শরীয়তের শিক্ষা বিস্তার এবং ইসলামের প্রচার প্রসারে একনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ লাভ করেন।
ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এমনি এক পর্যায়ে মদীনার উপর এমন এক শক্তির দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল যা কোন কারণ ব্যতিরেকেই মুসলিমগণকে এখানে সেখানে ত্যক্ত বিরক্ত করে চলছিল। ইতিহাসে এরা রোমক বা রোমীয় নামে পরিচিত। তদানীন্তন পৃথিবীতে এরা ছিল সর্বাধিক সৈন্য সম্পদে সমৃদ্ধ। ইতোপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে যে, এ বিরক্তিকর কাজ আরম্ভ করে শোরাহবীল বিন ‘আমর গাসসানী নাবী কারীম (ﷺ)-এর দূত হারিস বিন উমাইর আযদীকে (রাঃ) হত্যা করার মাধ্যমে। তাছাড়া এ হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যায়দ বিন হারিসাহ (রাঃ)-এর অধিনায়কত্বে যে সৈন্যদল প্রেরণ করেছিলেন এবং যাঁরা মুতাহ নামক স্থানে রোমক বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলেন সে কথাও ইতোপূর্বে আলোচিত হয়েছে। কিন্তু এ সৈন্যদল সে আত্মগর্বী অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণে সক্ষম হন নি। অবশ্য এর ফলে দূরের ও নিকটের আরব অধিবাসীদের উপর মুসলিমগণের প্রভাব প্রতিপত্তির একটি অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি হয়ে যায়।
বস্তুত আরব গোত্রসমূহের উপর মুসলিমগণের প্রভাব প্রতিফলিত হওয়ার কারণে তাদের মধ্যে সৃষ্ট সচেতনতা এবং রোমকদের নাগপাশ থেকে নিজেদের মুক্ত করার জন্য সৃষ্ট সংকল্পের ব্যাপারটিকে উপেক্ষা করা তাদের পক্ষে কোনক্রমেই সম্ভব ছিল না। এ ব্যাপারে রোমকদলে যে ভয় ছিল তা ক্রমে ক্রমে সীমান্তের দিকে সম্প্রসারিত হচ্ছিল। বিশেষ করে আরব ভূখন্ডের সীমান্তবর্তী শাম রাজ্যের জন্য তারা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে শক্তি সঞ্চয়ের পূর্বেই ইসলামী শক্তিকে সম্পূর্ণরূপে পিষ্ট করে দেয়ার প্রয়োজন অনুভব করলেন রোমক সম্রাট যাতে রোম সাম্রাজ্যের সংলগ্ন আরব এলাকা থেকে ভবিষ্যতে কোন ফেতনা কিংবা হাঙ্গামার সম্ভাবনা না থাকে।
উপরোক্ত কারণসমূহের প্রেক্ষাপটে মুতাহ যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পর একটি বছর পূর্ণ হতে না হতেই রোম সম্রাট রোম সাম্রাজ্যের অধিবাসীদের মধ্য থেকে এবং অধীনস্থ আরব গোত্রসমূহ অর্থাৎ গাসসান পরিবার ও অন্যান্য বিভিন্ন গোত্র থেকে সৈন্য সংগ্রহের কাজ শুরু করে দিল এবং এক রক্তক্ষয়ী ও চূড়ান্ত ফয়সালাকারী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকল।
রোমক এবং গাসসানীদের প্রস্তুতির সাধারণ সংবাদ (الْأَخْبَارُ الْعَامَّةُ عَنْ اِسْتِعْدَادِ الْرُّوْمَانِ وَغَسَّان):
এদিকে মদীনায় ক্রমে ক্রমে খবর আসতে থাকে যে, মুসলিমগণের বিরুদ্ধে এক চূড়ান্ত ও মীমাংসাকারী যুদ্ধের জন্য রোমক সম্রাট অত্যন্ত ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করে চলেছেন। রোমক সম্রাটের এহেন সমর প্রস্তুতির সংবাদে স্বাভাবিকভাবেই মুসলিমগণের মনে কিছু অস্বস্তির ভাব সৃষ্টি হয়েছিল এবং কোন অস্বাভাবিক শব্দ শোনা মাত্র তাদের কান খাড়া হয়ে যাচ্ছিল। তাঁদের মনে এ রকম একটি ধারণারও সৃষ্টি হয়েছিল যে, না জানি কখন রোমক বাহিনীর স্রোত এসে আঘাত হানে। ৯ম হিজরীর ঠিক এমনি সময়েই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজ বিবিগণের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে এক মাসের ইলা[1] করেন এবং তাঁদের সঙ্গ পরিহার করে একটি ভিন্ন কক্ষে নির্জনতা অবলম্বন করেন।
প্রাথমিক অবস্থায় সাহাবায়ে কেরাম প্রকৃত সমস্যা অনুধাবন করতে সক্ষম হননি। তাঁরা ধারণা করেছিলেন যে, নাবী কারীম (ﷺ) তাঁর পত্নীদের তালাক দিয়েছেন এবং এ কারণে তাঁদের অন্তরে দারুণ দুঃখ বেদনার সৃষ্টি হয়েছিল। উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) এ ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন যে, ‘আমার একজন আনসারী বন্ধু ছিল, আমি যখন খিদমতে নাবাবীতে উপস্থিত না থাকতাম, তখন তিনি আমার নিকট সংবাদাদি পৌঁছে দিতেন এবং তিনি যখন উপস্থিত না থাকতেন তখন আমি তাঁর নিকট তা পৌঁছে দিতাম।’ তাঁরা উভয়েই মদীনার উপকণ্ঠে বাস করতেন। তাঁরা পরস্পর পরস্পরের প্রতিবেশী ছিলেন এবং পালাক্রমে খিদমতে নাবাবীতে উপস্থিত থাকতেন ঐ সময়ে আমরা গাসসানী সম্রাটকে ভয় করতাম। কারণ, আমাদের বলা হয়েছিল যে, তারা আমাদের আক্রমণ করবে এবং এ ভয়ে আমরা সব সময় ভীত থাকতাম।’
একদিন আমার এ আনসারী বন্ধু আকস্মিক দরজায় করাঘাত করতে করতে বলতে থাকলেন, ‘খুলুন, খুলুন’ আমি বললাম, ‘গাসসানীরা কি এসে গেল?’ তিনি বললেন, ‘না’ বরং এর চাইতেও কঠিন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর স্ত্রীদের থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছেন।[2]
ভিন্ন এক সূত্র থেকে বিষয়টি এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, উমার (রাঃ) বললেন, ‘আমাদের মাঝে সাধারণভাবে এ কথা প্রচারিত হয়েছিল যে, গাসসান গোত্রের লোকজনেরা আমাদের আক্রমণ করার জন্য ঘোড়ার পায়ে নাল লাগাচ্ছে। একদিন আমার বন্ধু তাঁর পালাক্রমে খিদমতে নাবাবীতে হাজির হন। অতঃপর বাদ এশা তিনি বাড়ি ফিরে এসে দরজায় জোরে জোরে আঘাত করতে করতে বলতে থাকেন, ‘এরা কি শুয়ে পড়েছেন? ’ আতঙ্কিত অবস্থায় আমি যখন ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম তখন তিনি বললেন যে, একটি বড় ঘটনা ঘটেছে। আমি বললাম, ‘গাসসানীরা কি এসে গেছে?’ তিনি বললেন, ‘না’ বরং এর চাইতেও কঠিন সমস্যা হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর বিবিদেরকে তালাক।’ শেষ পর্যন্ত[3]
উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) বর্ণিত ঘটনা থেকে সহজেই অনুমান ও অনুধাবন করা যায় যে, রোমকগণের যুদ্ধ প্রস্তুতি মুসলিমগণকে কতটা চিন্তিত এবং বিচলিত করে তুলেছিল। মদীনায় মুনাফিক্বদের শঠতা ও চক্রান্ত সমস্যাটিকে আরও প্রকট করে তুলেছিল। অথচ মুনাফিক্বরা এ কথাটি ভালভাবেই অবগত ছিল যে, উদ্ভূত সমস্যার প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিজয়ী হয়েছেন এবং পৃথিবীর কোন শক্তিকেই তিনি কখনো ভয় করেন না। অধিকন্তু, এ কথাটিও তারা ভালভাবেই অবগত ছিল যে, যারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিরুদ্ধাচরণ করেছে তারা সকলেই পর্যুদস্ত এবং ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। তবুও অন্তরে অন্তরে তারা একটি ক্ষীণ আশা পোষণ করে আসছিল যে, যুগের আবর্তনের গতিধারায় মুসলিমগণের বিরুদ্ধে তাদের লালিত প্রতিহিংসার অগ্নি একদিন না একদিন প্রজ্জ্বলিত হবেই এবং খুব সম্ভব এটাই হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত সময়। তাদের সেই কল্পিত সুযোগের প্রেক্ষাপটে তারা একটি মসজিদের আকার আকৃতিতে (যা মাসজিদে ‘যেরার’ ‘ক্ষতিকর নামে প্রসিদ্ধ ছিল) ষড়যন্ত্রের আড্ডাখানা তৈরি করল। এর উদ্দেশ্য ছিল মুসলিমগণের মধ্যে দলাদলি সৃষ্টি এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর কুফরী করা ও মুসলিমগণের সঙ্গে লড়াইয়ের উদ্দেশে গোপনে তথ্য সরবরাহের কেন্দ্র হিসেবে তা ব্যবহার করা। তাদের এ অসদুদ্দেশ্যকে ঢেকে রাখার কৌশলস্বরূপ সেখানে সালাত আদায়ের জন্য তারা নাবী কারীম (ﷺ)-কে অনুরোধ জানায়।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে সেখানে সালাত পড়ানোর অনুরোধ জানানোর পিছনে উদ্দেশ্য ছিল যে, মুসলিমগণ কোনক্রমেই যেন চিন্তাভাবনা করার সুযোগ না পায় যে, সেখানে তাঁদের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। তাছাড়া এ মসজিদে যাতায়াতকারীদের ব্যাপারে ঘুণাক্ষরেও যেন কোন সন্দেহের সৃষ্টি না হয় এটাও ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য। এমনিভাবে এ মসজিদটি মুনাফিক্ব ও তাদের দোসরদের নিরাপদ আড্ডা ও গোপন কার্যকলাপের কেন্দ্রে পরিণত হয়।
কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ মসজিদে সালাত আদায় করার ব্যাপারটি যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত বিলম্বিত করেন। কারণ, যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য তাঁকে অতিমাত্রায় ব্যস্ত থাকতে হচ্ছিল। এর ফলে তাদের দুরভিসন্ধির ব্যাপারে মুনাফিক্বগণ কৃতকার্য হতে সক্ষম হল না। অধিকন্তু, যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তনের পূর্বেই আল্লাহ তাদের অসদুদ্দেশ্যের যবনিকা উন্মোচন করে দিলেন। কাজেই, যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তনের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ মসজিদে সালাত আদায় না করে তা বিধ্বস্ত করে দেন।
[1] ইলা বলা হয় স্ত্রী নিকট গমন না করার শপথ করাকে। যদি এ শপথ ৪ মাস কিংবা এর কম সময়ের জন্য হয় তাহলে এর উপর শরীয়তের কোন হুকুম প্রযোজ্য হয় না। কিন্তু এ ভাবে ৪ মাসের অধিক সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে শরীয়তের বিচার প্রযোজ্য হয়ে যায়। এতে স্বামী স্ত্রীকে স্ত্রী হিসেবে রাখতে পারে কিংবা তালাক দিতে পারে। কোন কোন সাহাবীর উক্তি অনুযায়ী ৪ মাস অতিক্রান্ত হলেই তালাক পড়ে যায়।
[2] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৭৩০ পৃঃ।
[3] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৩৩৪ পৃঃ।
রুমী ও গাসসানীদের যুদ্ধ প্রস্তুতির বিশেষ খবর (الْأَخْبَارُ الْخَاصَّةُ عَنْ اِسْتِعْدَادِ الرُّوْمَانِ وَغَسَّان):
মুসলিমগণ যখন ক্রমাগতভাবে উপর্যুক্ত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েই চলেছিলেন এমন সময় শাম রাজ্য হতে আগমণকারী তৈল বাহক [1] দলের মাধ্যমে আকস্মিকভাবে জানা গেল যে, হিরাকল ৪০ হাজার সৈন্যের সমন্বয়ে এক যুদ্ধ প্রিয় বাহিনী গঠন করেছে এবং রোমের একজন প্রখ্যাত কমান্ডারের অধিনায়কত্বে এ বাহিনীকে ন্যস্ত করেছে। তাছাড়া, নিজ পতাকার আওতায় খ্রিষ্টান গোত্রসমূহের মধ্যে লাখম জোযাম ও অন্যান্য গোত্রগুলোও একত্রিত করেছে এবং তাদের বাহিনীর অগ্রবর্তী দলটি বালকা’ নামক স্থানে পৌঁছে গেছে। এমনিভাবে এক ভয়াবহ বিপদ মূর্তরূপে মুসলিমগণের সামনে আত্মপ্রকাশ করেছে।
[1] নাবিত্ব বিন ইসমাঈলের বংশ উত্তর হেজাযে এক কালে যাদের অত্যন্ত সমাদর ও উচ্চ মর্যাদা ছিল। কিন্তু কালক্রমে তারা ধীরে ধীরে সাধারণ কৃৃষক এবং ব্যবসায়ীদের পর্যায়ে চলে যায়।
বিপদাপন্ন পরিস্থিতির বিবৃদ্ধি (زِيَادَةُ خُطُوْرَةِ الْمَوْقِفِ):
এমনি এক নাজুক পরিস্থিতির মুখে আরও বিভিন্নমুখী সমস্যার ফলে অবস্থা অত্যন্ত জটিল এবং সঙ্গীন হয়ে উঠল। সময়টা ছিল অত্যন্ত গরম। মানুষ ছিল অসচ্ছলতা এবং দুর্ভিক্ষের কবলে। যান বাহনের সংখ্যাও ছিল খুব সীমিত। বাগ-বাগিচার ফলমূলে পরিপক্কতা এসে গিয়েছিল। ফলমূল সংগ্রহ এবং ছায়ার জন্য বাগ-বাগিচায় অবস্থান করাটা মানুষের অধিকতর পছন্দনীয় ছিল। এ সব কারণে তাৎক্ষণিক যুদ্ধ যাত্রার জন্য তারা মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। তদুপরি, পথের দূরত্ব এবং সফরের ক্লেশকিষ্টতা তাদের মনকে দারুনভাবে প্রভাবিত করছিল।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পক্ষ হতে যুদ্ধ যাত্রার জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশ (الرَّسُوْلُ ﷺ يُقَرِّرُ الْقِيَامَ بِإِقْداَم حَاسِم):
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) গভীর মনোনিবেশ সহকারে সমস্যা সংকুল পরিস্থিতির এবং বিভিন্নমুখী প্রতিকূলতা পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিলেন। তিনি এটা পরিস্কার ভাবে উপলব্ধি করছিলেন যে এ চরম সংকটময় মুহূর্তে যদি রুমীগণের সঙ্গে মোকাবেলা করার ব্যাপারে শৈথিল্য কিংবা গড়িমসি করা হয়, কিংবা আরও অগ্রসর হয়ে তারা যদি মদীনার দ্বার প্রান্তে এসে উপস্থিত হয় তাহলে ইসলামী দাওয়াত ও মুসলিমগণের জন্য তা হবে অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং অমবমাননাকর। এতে মুসলিমগণের সামরিক মর্যাদা দারুণভাবে ক্ষুণ্ণ হবে এবং যে অজ্ঞতার কারণে হুনাইন যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী প্রচন্ডভাবে আঘাত প্রাপ্ত হয়েছিল তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। অধিকন্তু, যুগের আবর্তন-বিবর্তনের ধারায় মুনাফিক্বগণ যে সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে এবং ফাসেক আবূ ‘আমির ফাসেকের মাধ্যমে রোম সম্রাটের সংগে ঐক্যবন্ধন সৃষ্টি করেছে তা পিছন দিক থেকে পেটে খঞ্জর ঢুকিয়ে দেয়ার শামিল। আর সামনের দিক থেকে রুমীদের সৈনিক প্লাবন রক্ষক্ষয়ী আঘাত হানবে তাদের উপর। এমনিভাবে অর্থহীন হয়ে যাবে সে সকল অসাধারণ প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর সাহাবাবৃন্দ ব্যয় করেছিলেন আল্লাহর দ্বীনের প্রচার ও প্রসার কার্যে, অকৃতকার্যতায় পর্যবসিত হয়ে যাবে সে সময় দুর্লভ সাফল্য যা অর্জন করা হয়েছিল অসামান্য ত্যাগ তিতিক্ষা, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে।
ইসলাম ও মুসলিমগণের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত নিয়ে সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ আলোচনা পর্যালোচনা পর বিভিন্নমুখী সমস্যা সত্ত্বেও নাবী কারীম (ﷺ) সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন যে, মুসলিম অধ্যূষিত অঞ্চলে রুমীদের প্রবেশের সুযোগ না দিয়ে বরং তাদের আঞ্চলিক সীমানার মধ্যেই তাদের সঙ্গে এক চূড়ান্ত ফয়সালাকারী সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া বিশেষ প্রয়োজন।
রোমকদের সঙ্গে যুদ্ধ প্রস্তুতির ঘোষণা (الْإِعْلَانُ بِالتَّهِيْؤُ لِقِتَالِ الرُّوْمَانِ):
রোমকদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উত্তম যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য সাহাবীগণকে নির্দেশ প্রদান করেন। তাছাড়া, মক্কার বিভিন্ন গোত্র এবং অধিবাসীদের নিকট সংবাদ প্রেরণ করেন যুদ্ধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার জন্য। এ সব ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর একটা নীতি ছিল তিনি যখনই কোন যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন তখন যুদ্ধের ব্যাপারে গোপনীয়তা অবলম্বন করতেন। কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতি এবং প্রকট অভাব অনটনের কারণে এবার তিনি সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করে দিলেন যে, রুমীগণের যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এর পিছনে উদ্দেশ্য ছিল যোদ্ধাগণ যেন উত্তম প্রস্তুতি সহকারে যুদ্ধ যাত্রা করেন। যুদ্ধের জন্য তিনি সাহাবীগণকে প্রবলভাবে উৎসাহিত করতে থাকেন। এ সময়েই যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করার ব্যাপারেই সূরাহ তাওবার একটি অংশ অবতীর্ণ হয়। সঙ্গে সঙ্গে সাদকা খয়রাত করার ফযীলত বর্ণনা করা হয় এবং আল্লাহর পথে আপন আপন উত্তম সম্পদ ব্যয় করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়।
যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য মুসলিমগণের দৌড় ঝাঁপ (الْمُسْلِمُوْنَ يِتَسَابَقُوْنَ إِلَى التَّجَهُّزِ لِلْغَزْوِ):
সাহাবীগণ (রাঃ) যখনই অবগত হলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রুমীগণের বিরুদ্ধে উত্তম যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন, তখনই তাঁরা পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন গোত্র এবং মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজনেরা মদীনায় সমবেত হতে আরম্ভ করে দিলেন। যাদের অন্তরে কপটতা ছিল তারা ব্যতীত কোন মুসলিমই এ যুদ্ধের ব্যাপারে নির্লিপ্ত থাকার কথাটা ঘুণাক্ষরেও মনে ঠাঁই দেন নি। তবে তিন জন মুসলিম এ নির্দেশের বাইরে ছিলেন। নিষ্ঠাবান ঈমানদার হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন নি।
পক্ষান্তরে অবস্থা এই ছিল যে, গরীব ও অসহায় ব্যক্তিবর্গ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করতেন যে, তাঁদের জন্য সওয়ারীর ব্যবস্থা করা হলে তাঁরাও যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে পারেন। নাবী কারীম (ﷺ) যখন তাঁদের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতেন যে,
(لاَ أَجِدُ مَا أَحْمِلُكُمْ عَلَيْهِ تَوَلَّواْ وَّأَعْيُنُهُمْ تَفِيْضُ مِنَ الدَّمْعِ حَزَنًا أَلاَّ يَجِدُوْا مَا يُنفِقُوْنَ) [التوبة:92]
‘তাদের বিরুদ্ধেও কোন অভিযোগ নেই যারা তোমার কাছে যখন বাহন চাওয়ার জন্য এসেছিল তখন তুমি বলেছিলে, ‘আমি তো তোমাদের জন্য কোন বাহন পাচ্ছি না’। তখন তারা ফিরে গেল, আর সে সময় তাদের চোখ থেকে অশ্রু ঝরে পড়ছিল- এ দুঃখে যে, ব্যয় বহন করার মত কোন কিছু তাদের ছিল না।’ [আত্-তাওবাহ (৯) : ৯২]
যুদ্ধ প্রস্তুতির প্রয়োজনের প্রেক্ষাপটে মুসলিমগণের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। পরস্পর পরস্পরের তুলনায় সাদকা এবং দান-খয়রাত করতে পারে কে কত বেশী আল্লাহর রাহে। সেই সময় উসমান বিন আফফান শাম রাজ্যের উদ্দেশ্যে এমন একটি বাণিজ্য কাফেলা প্রস্তুত করছিলেন যার মধ্যে ছিল পালান ও গদিসহ দু’শ উট এবং দু’শ উকিয়া রৌপ্য (যার ওজন ছিল প্রায় ঊনত্রিশ কেজি)। এর সব কিছুই তিনি সাদকা করে দেন যুদ্ধের জন্য। এর পর তিনি হাওদাসহ আরও একশ উট দান করেন। এর পরও পুনরায় তিনি এক হাজার (আনুমানিক সাড়ে পাঁচ কেজি ওজনের) স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে এসে নাবী কারীম (ﷺ)-এর কোলের উপর ঢেলে দেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বর্ণমুদ্রাগুলো উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, ‘আজকের পর উসমান যা কিছু করবে তাতে তার কোনই ক্ষতি হবে না। এর পরও উসমান আবার দান করেন এবং আরও সাদকা করেন। এমন কি তাঁর দানকৃত জিনিসের পরিমাণ নগদ অর্থ বাদে নয়শ উট এবং একশ ঘোড়া পর্যন্ত পৌছেছিল।[1]
অন্যদিকে আব্দুর রহমান বিন আওফ (রাঃ) দু’শ উকিয়া রৌপ্য (যার ওজন ছিল প্রায় সাড়ে ঊনত্রিশ কেজি) নিয়ে এলেন এবং আবূ বাকর (রাঃ) তাঁর সমস্ত সম্পদ নাবী কারীম (ﷺ)-এর খিদমতে এনে সমর্পণ করলেন। আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল (ﷺ) ছাড়া তাঁর পরিবারবর্গের জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। তাঁর দানের পরিমাণ ছিল চার হাজার দিরহাম এবং নাবী কারীম (ﷺ) সমীপে দান সামগ্রী আনার জন্য তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি। উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) দান করেন তাঁর অর্ধেক সম্পদ। আব্বাস (রাঃ) অনেক সম্পদ নিয়ে আসেন। ত্বালহাহ (রাঃ), সা‘দ বিন অবী ওয়াক্কাস (রাঃ) এবং মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ যথেষ্ট অর্থ নিয়ে আসেন। ‘আসিম বিন আদী নব্বই অসাক (অর্থাৎ সাড়ে তের হাজার কেজি) খেজুর নিয়ে হাজির হন। অন্যান্য সাহাবীগণও কম বেশী দান খয়রাতের বিভিন্ন দ্রব্য নিয়ে আসেন। এমনকি কেউ কেউ এক মুঠ দু’ মুঠ যার নিকট যা ছিল তাই দান করেন। কারণ, এর বেশী দান করার ক্ষমতা তাঁদের ছিল না। মহিলাগণ গলার মালা, হাতের চুড়ি, পায়ের অলংকার, কানের রিং, আংটি ইত্যাদি যার যা ছিল তা নাবী কারীম (ﷺ)-এর খিদমতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে কেউ কৃপণতা করেন নি এবং এমন কোন হাত ছিল না যে হাত কিছুই দান করে নি। শুধু মুনাফিক্বগণ দান খয়রাতে অংশ গ্রহণ করে নি। শুধু তাই নয়, যে সকল মুসলিম দান খয়রাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, কথাবার্তায় তাঁদের খোঁচা দিতে তারা ছাড়েনি। যাঁদের শ্রম ছাড়া অন্য কিছুই দেবার মতো ছিল না, তাঁদের ঠাট্টা বিদ্রূপ করে বলল, ‘একটা দু’টা খেজুর দিয়েই এরা রোমক সাম্রাজ্য জয়ের স্বপ্ন দেখছে। (৯ : ৭৯)।
(الَّذِيْنَ يَلْمِزُوْنَ الْمُطَّوِّعِيْنَ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ فِيْ الصَّدَقَاتِ وَالَّذِيْنَ لاَ يَجِدُوْنَ إِلاَّ جُهْدَهُمْ فَيَسْخَرُوْنَ مِنْهُمْ)[التوبة: 79]
‘মু’মিনদের মধ্যে যারা মুক্ত হস্তে দান করে, তাদেরকে যারা দোষারোপ করে আর সীমাহীন কষ্টে দানকারীদেরকে যারা বিদ্রূপ করে, আল্লাহ তাদেরকে বিদ্রূপ করেন আর তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ শাস্তি।’ আত্-তাওবাহ (৯) : ৭৯]
[1] জামে তিরমীযি, উসমান বিন আফফান (রাঃ)-এর কৃতিত্ব অধ্যায়।
তাবুকের পথে ইসলামী সৈন্য (الْجَيْشُ الْإِسْلَامِيْ إِلٰى تَبُوْكَ):
উল্লেখিত তৎপরতা, উৎসাহ-উদ্দীপনা দৌড় ঝাঁপের মধ্য দিয়ে মুসলিম বাহিনীর প্রস্তুতি সম্পন্ন হল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুহাম্মাদ বিন মাসলামাকে (মতান্তরে সেবা বিন আরফাতকে) মদীনার গভর্ণর নিযু্ক্ত করেন এবং নিজ পরিবারের লোকজনদের দেখাশোনা করার জন্য আলী ইবনু আবি ত্বালিবকে নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু মুনাফিক্বগণ তাঁর প্রতি কটাক্ষ করে কিছু কথাবার্তা বলায় মদীনা হতে বাহির হয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট চলে যান। কিন্তু নাবী কারীম (ﷺ) পুনরায় তাঁকে মদীনায় ফিরে যাওয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করলেন এবং বললেন :
(ألَا تَرْضٰى أَنْ تَكُوْنَ مِنِّيْ بِمَنْزِلَةِ هَارُوْنَ مِنْ مُوْسٰي، إِلَّا أَنَّهُ لَا نَبِيَ بَعْدِيْ).
‘তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, আমার সঙ্গে তোমার সে রূপই সম্পর্ক রয়েছে যেমনটি ছিল হারুন (আঃ)-এর সঙ্গে মুসা (আঃ)-এর তবে এটা জেনে রাখ যে আমার পরে কোন নাবী আসবে না।’
যাহোক, এ ব্যবস্থাদির পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উত্তর দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন। (নাসায়ীর বর্ণনা মোতাবেক দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার)। গন্তব্যস্থল ছিল তাবুক ও সৈন্য সংখ্যা ছিল ত্রিশ হাজার। এর পূর্বে মুসলিমগণ আর কখনই এত বড় সেনাবাহিনীর সমাবেশ ঘটাতে সক্ষম হন নি। বিশাল এক বাহিনী এবং সাধ্যমতো অর্থসম্পদ ব্যয় করা সত্ত্বেও সৈন্যদের পুরোপুরি প্রস্তুত করে নেয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। খাদ্য সম্ভার এবং যান বাহনের যথেষ্ট অভাব ছিল। আঠার জনের প্রতিটি দলের জন্য ছিল মাত্র একটি করে উট যার উপর তাঁরা আরোহণ করতেন পালাক্রমে। অনুরূপভাবে খাওয়ার জন্য প্রায়ই গাছের পাতা ব্যবহার করতে হতো যার ফলে ওষ্ঠাধরে স্ফীতি সৃষ্টি হয়েছিল। অধিকন্তু, উটের অভাব থাকা সত্ত্বেও উট যবেহ করতে হতো যাতে পাকস্থলী এবং নাড়িভূড়ির মধ্যে সঞ্চিত পানি এবং তরল পদার্থ পান করা যেতে পারে। এ কারণে এ বাহিনীর নাম রাখা হয়েছিল ‘জায়শে উসরাত’ (অভাব অনটনের বাহিনী)।
তাবুকের পথে মুসলিম বাহিনীর গমনাগমন চলল হিজর অর্থাৎ সামুদ সম্প্রদায়ের অঞ্চলের মধ্য দিয়ে। সামুদ ছিল সেই সম্প্রদায় যারা ওয়াদিউল কোরা নামক উপত্যকায় পাথর কেটে কেটে ঘরবাড়ি তৈরি করেছিল। সাহাবীগণ (রাঃ) সেখানকার কূপসমূহ হতে পানি সংগ্রহ করার পর যখন যাত্রা করলেন তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,
(لَا تَشْرَبُوْا مِنْ مَائِهَا وَلَا تَتَوَضَّأُوْا مِنْهُ لِلصَّلَاةِ، وَمَا كَانَ مِنْ عَجِيْنٍ عَجَنْتُمُوْهُ فَاعْلِفُوْهُ الْإِبِلَ، وَلَا تَأْكُلُوْا مِنْهُ شَيْئاً)
‘তোমরা এখানকার পানি পান করনা, এ পানি দ্বারা অযু করোনা এবং এ পানির দ্বারা আটার যে তাল তৈরি করেছ তা পশুদের খাইয়ে দাও, নিজে খেও না।’
তিনি এ নির্দেশও প্রদান করেন যে, ‘সালেহ (আঃ)-এর উট যে কূপ থেকে পানি পান করেছিল তোমরা সে কূপ থেকে পানি সংগ্রহ করবে।’
বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীসে ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নাবী কারীম (ﷺ) যখন হিজর (সামুদ সম্প্রদায়ের অঞ্চল) দিয়ে গমন করছিলেন তখন বলেন,
(لَا تَدْخُلُوْا مَسَاكِنِ الَّذِيْنَ ظَلَمُوْا أَنْفُسَهُمْ أَنْ يُّصِيْبَكُمْ مَا أَصَابَهُمْ إِلَّا أَنْ تَكُوْنُوْا بَاكِيْنَ)
‘সেই অত্যাচারী সামুদের আবাসভূমিতে প্রবেশ করো না যাতে তোমাদের উপর যেন সে মুসিবত নাযিল হয়ে না যায়, যা তাদের উপর নাযিল হয়েছিল। হ্যাঁ, তবে কাঁদতে কাঁদতে অতিক্রম করতে হবে। অতঃপর তিনি তাঁর মস্তক আবৃত করে নিয়ে দ্রুত গতিতে সেই উপত্যকা অতিক্রম করে গেলেন।[1]
পথের মধ্যে সৈন্যদের পানির তীব্র প্রয়োজন দেখা দিল। এমন কি লোকজনেরা পিপাসার কষ্ট সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট অভিযোগ পেশ করল। তিনি পানির জন্য দু‘আ করলে আল্লাহ তা‘আলা মেঘ সৃষ্টি করলেন এবং বৃষ্টিও হয়ে গেল। লোকেরা পূর্ণ পরিতৃপ্তির সঙ্গে পানি পান করলেন এবং প্রয়োজন মতো তা সংগ্রহ করে নিলেন।
অতঃপর যখন তাবুকের নিকট গিয়ে পৌঁছেন তখন নাবী কারীম (ﷺ) বললেন,
(إِنَّكُمْ سَتَأْتُوْنَ غَداً إِنْ شَاءَ اللهُ تَعَالٰى عَيْنَ تَبُوْكَ، وَإِنَّكُمْ لَنْ تَأْتُوْهَا حَتّٰى يَضْحَي النَّهَارَ، فَمَنْ جَاءَهَا فَلَا يَمُسُّ مِنْ مَائِهَا شَيْئاً حَتّٰى آتِيْ)
‘ইনশাআল্লাহ, আগামী কাল আমরা তাবুকের ঝর্ণার নিকট গিয়ে পৌঁছব। কিন্তু সূর্যোদয় ও দুপুরের মধ্যবর্তী সময়ের পূর্বে পৌঁছানো যাবে না। কিন্তু আমার পৌঁছানোর পূর্বে কেউ যদি সেখানে পৌঁছে তাহলে আমি যতক্ষণ সেখানে গিয়ে না পৌঁছি ততক্ষণ যেন তাঁরা সেখানকার পানিতে হাত না লাগায়।
মু‘আয (রাঃ) বলেছেন, ‘আমরা যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছলাম, দেখলাম তার পূর্বেই দু’জন সেখানে গিয়ে পৌঁছেছেন। ঝর্ণা দিয়ে অল্প অল্প পানি আসছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জিজ্ঞেস করলেন, (هَلْ مَسَسْتُمَا مِنْ مَائِهَا شَيْئاً؟) ‘তোমরা কি এর পানিতে কেউ হাত লাগিয়েছ? তাঁরা উত্তর দিলেন, হ্যাঁ। নাবী কারীম (ﷺ) সে দু’ ব্যক্তিকে আল্লাহ যা ইচ্ছা করলেন তাই বললেন।
অতঃপর অঞ্জলির সাহায্যে ঝর্ণা থেকে অল্প অল্প পানি বের করলেন এবং এভাবে কিছুটা পানি সংগৃহীত হল। এ পানির দ্বারা তিনি মুখমণ্ডল ও হাত ধৌত করলেন এবং ঝর্ণার মধ্যে হাত ডুবালেন। এর পর ঝর্ণায় ভাল পানির প্রবাহ সৃষ্টি হল। সাহাবা কেরাম (রাঃ) পূর্ণ পরিতৃপ্তির সঙ্গে পানি পান করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,
(يُوْشِكُ يَا مُعَاذُ، إِنْ طَالَتْ بَكَ حَيَاةٌ أَنْ تَرٰي مَاهَاهُنَا قَدْ مُلِّئَ جَنَاناً)
‘হে মু’আয! যদি তোমার জীবন দীর্ঘ হয় তাহলে এ স্থান তুমি বাগানে পরিপূর্ণ ও শ্যামল দেখবে।[2]
পথের মধ্যে কিংবা তাঁবুকে পৌঁছার পর বর্ণনায় কিছুটা পার্থক্য রয়েছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,
(تَهِبُ عَلَيْكُمْ اللَّيْلَةَ رِيْحٌ شَدِيْدَةٌ، فَلَا يَقُمْ أَحَدٌ مِنْكُمْ، فَمَنْ كَانْ لَهُ بِعَيْرٍ فَلْيِشُدُّ عِقَالَهُ)
‘আজ রাতে তোমাদের উপর দিয়ে প্রবল ঘূর্ণি ধূলি ঝড় বয়ে যেতে পারে। কাজেই, কেউই উঠবে না। অধিকন্তু, যার নিকট উট আছে সে তাকে মজবুত রশি দ্বারা শক্তভাবে বেঁধে রাখবে।’ হলও ঠিক তাই, চলতে থাকল প্রবল থেকে প্রবলতর ধূলো বালি যুক্ত ঘূর্ণি বায়ু। এ সময় এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে ছিল। ঘূর্ণি ঝড় তাকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে তাই গোত্রের দু’ পর্বতের নিকট নিক্ষেপ করল।[3]
পথ চলা কালে নাবী কারীম (ﷺ)-এর এটা ব্যবস্থা ছিল যে, তিনি যুহর ও আসর এবং মাগরিব ও এশার সালাত একত্রে আদায় করতেন। তাছাড়া, তিনি জমা তাকদীমও করতেন এবং জমা তাখীরও করতেন (জমা তাকদীমের অর্থ হচ্ছে যুহর ও আসর এ দু’ সালাতকে যুহরের সময় এবং মাগরিব ও এশা এ দু’ সালাতকে মাগরিবের সময় আদায় করা এবং জমা তাখিরের অর্থ হচ্ছে যুহর ও আসর এ দু’ সালাত আসরের সময় এবং মাগরিব ও এশা এ দু’ সালাতকে এশার সময়ে আদায় করা)।
[1] সহীহুল বুখারী রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হিজরে অবতরণ অধ্যায় ২য় খন্ড ৬৩৭ পৃঃ।
[2] মুসলিম শরীফ মু’আয বিন জাবাল হতে বর্ণিত ২য় খন্ড পৃ: ২৪৬
[3] প্রাগুক্ত ।
ইসলামী সৈন্য তাবুকে (الْجَيْشُ الْإِسْلَامِيْ بِتَبُوْكَ):
ইসলামী সৈন্য তাবুকে অবতরণ করে শিবির স্থাপন করলেন। রোমকগণের সঙ্গে দুই দুই হাত করার জন্য তাঁরা প্রস্তুত ছিলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সৈন্যদের উদ্দেশ্য করে জাওয়ামেউল কালাম দ্বারা (এক সারগর্ভ) ভাষণ প্রদান করেন। এ ভাষণে তিনি তাৎপর্যপূর্ণ নির্দেশাবলী প্রদান করেন, দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের প্রতি উৎসাহিত করেন, আল্লাহর শাস্তির ভয় প্রদর্শন এবং তাঁর রহমতের শুভ সংবাদ প্রদান করেন। নাবী কারীম (ﷺ)-এর এ ভাষণ সৈন্যদের মনোবল বৃদ্ধি করে। তাঁদের খাদ্য সম্ভার ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ঘাটতি জনিত যে অসুবিধা ছিল এ ভাবে মনস্তাত্মিক স্বস্তিবোধ সৃষ্টির মাধ্যমে বহুলাংশে তা পূরণ করা সম্ভব হল।
অন্য দিকে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও মুসলিম বাহিনীর আগমনের সংবাদ অবগত হয়ে রুমী এবং তাদের মিত্র গোত্রসমূহের মধ্যে এমন ভয় ভীতির সঞ্চার করে যে, সামনে অগ্রসর হয়ে তাঁদের মোকাবেলা করার সাহস তারা হারিয়ে ফেলল এবং বিক্ষিপ্ত হয়ে দেশের অভ্যন্তরভাগে বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ল। রুমীদের এ ভয় ভীতিজনক নিষ্ক্রিয়তা আরব উপদ্বীপের ভিতরে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করল এবং মুসলিম বাহিনীর জন্য তা এমন সব রাজনৈতিক সুযোগ সুবিধা লাভের ক্ষেত্র তৈরি করে দিল যুদ্ধের মাধ্যমে যা অর্জন করা মোটেই সহজ সাধ্য ছিল না। এ সবের বিস্তারিত বিবরণ হচ্ছে যথাক্রমে নিম্নরূপ :
আয়লার প্রশাসক ইয়াহনাহ্ বিন রুবা নাবী কারীম (ﷺ)-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে কর দানের স্বীকৃতি জ্ঞাপন করে সন্ধি চুক্তি সম্পাদন করল। জারবা এবং আজরুহর অধিবাসীগণও খিদমতে নাবাবীতে হাজির হয়ে কর দানের প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের লিখিত প্রমাণ প্রত্র প্রদান করেন যা তাদের নিকট সংরক্ষিত ছিল। তিনি আয়লার প্রশাসকের নিকটও লিখিত একটি প্রমাণ পত্র প্রেরণ করেন যার বিষয়বস্তু হচ্ছে নিম্নরূপ:
(بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ، هٰذِهِ أَمَنَةٌ مِّنْ اللهِ وَمُحَمَّدِ النَّبِيِّ رَسُوْلِ اللهِ لِيَحْنَةَ بْنِ رُؤْبَةَ وَأَهْلِ أَيْلَةِ، سفنِهِمْ وَسِيَارَاتِهِمْ فيِ الْبَرِّ وَالْبَحْرِ لَهُمْ ذِمَّةُ اللهِ وَذِمَّةُ مُحَمَّدِ النَّبِيِّ، وَمَنْ كَانَ مَعَهُ مِنْ أَهْلِ الشَّامِ وَأَهْلِ الْبَحْرِ، فَمَنْ أَحْدَثَ مِنْهُمْ حَدَثاً، فَإِنَّهُ لَا يَحُوْلُ مَالهُ دُوْنَ نَفْسِهِ، وَإِنَّهُ طِيْبٌ لِمَنْ أَخَذَهُ مِنْ النَّاسِ، وَأَنَّهُ لَا يَحِلُّ أَنْ يَّمْنَعُوْا مَاءً يُرَدُّوْنَهُ، وَلَا طَرِيْقاً يُرِيْدُوْنَهُ مِنْ بَرٍّ أَوْ بَحْرٍ)
‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম : এ হচ্ছে শান্তির আদেশ পত্র আল্লাহর এবং নাবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর পক্ষ হতে ইয়াহনাহ বিন রুবা এবং আয়লার অধিবাসীদের জন্য স্থল এবং সমুদ্র পথে তাদের নৌকা এবং ব্যবসায়ী দলের জিম্মা আল্লাহর এবং নাবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উপর রইল। তাছাড়া, এ দায়িত্ব সিরিয়া এবং ঐ সকল সমুদ্র তীরবর্তী অধিবাসীদের জন্য রইল যারা ইয়াহনার সঙ্গে থাকে। হ্যাঁ, যদি তাদের কোন ব্যক্তি কোন প্রকার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তবে তার অর্থ তার জীবন রক্ষা করবে না এবং যে ব্যক্তি তার অর্থ নিয়ে নেবে তার জন্য তা বৈধ হবে। তাদেরকে কোন ঝর্ণার নিকট অবতরণ করতে এবং স্থল কিংবা জলভাগের কোন পথ অতিক্রম করতে বাধা দেয়া যাবে না।
এছাড়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চারশ’ বিশ জন সৈন্যের সমন্বয়ে গঠিত এক বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ)-কে দুমাতুল জান্দালের শাসক উকায়দেরের নিকট প্রেরণ করেন। যাত্রাকালে তিনি তাঁকে বলেন, (إِنَّكَ سَتَجِدُهُ يَصِيْدُ الْبَقَرَ) ‘তোমরা তাকে নীল গাভী শিকার করার সময় দেখতে পাবে।’
রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশ মোতাবেক খালিদ (রাঃ) তথায় গমন করলেন। মুসলিম বাহিনী যখন এতটুকু দূরত্বে অবস্থান করছিলেন যে দূর্গটি পরিস্কার চোখে পড়ছিল তখন হঠাৎ একটি নীল গাভী বেরিয়ে এসে দূর্গের দরজার উপর শিং দ্বারা গুঁতো দিতে থাকল। উকায়দের তাকে শিকার করার জন্য বাহির হলে খালিদ (রাঃ) এবং তাঁর ঘোড়সওয়ার দল তাকে বন্দী করে ফেললেন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে প্রেরণ করলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে ক্ষমা করলেন এবং দুই হাজার উট, আটশ’ দাস, যুদ্ধের চারশ’ লৌহ বর্ম এবং চারশ’ বর্শা দেয়ার শর্ত সাপেক্ষে একটি সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করেন। এ সন্ধি চুক্তিতে কর প্রদানের শর্তও সংযোজিত হল। সুতরাং তিনি তার সাথে ইয়াহনাহ্সহ দুমাহ, তাবুক, আয়লাহ এবং তাইমার শর্তানুযায়ী চুক্তিতে আবদ্ধ হলেন।
যে সকল গোত্র তখনো রোমকগণের পক্ষে কাজ করছিল, পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে যখন তারা অনুধাবন করল যে, পুরাতন ব্যবস্থাধীনে থাকার দিন শেষ হয়েছে তখন তারা নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে মুসলিমগণের সঙ্গে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেল। এভাবে ইসলামী সাম্রাজ্যের সীমা বিস্তৃতি লাভ করে রোমক সাম্রাজ্যের প্রান্ত সীমা পর্যন্ত পৌঁছে গেল। ফলে যে সকল গোত্র রোমকদের শক্তি জোগাত তারা একদম নিঃশেষ হয়ে গেল।
মদীনায় প্রত্যাবর্তন (الرُّجُوْعُ إِلْى الْمَدِيْنَةِ):
সংঘর্ষ এবং রক্তক্ষয় ছাড়াই মুসলিম বাহিনী বিজয়ী বেশে মদীনা প্রত্যাবর্তন করলেন। যুদ্ধের ব্যাপারে মু’মিনদের আল্লাহই যথেষ্ট হলেন। তবে পথের মধ্যে এক জায়গায় একটি গিরিপথের নিকট ১২ জন মুনাফেক নাবী কারীম (ﷺ)-কে হত্যার এক ঘৃণ্য প্রচেষ্টা চালায়। সে সময় নাবী সে গিরিপথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন শুধু আম্মার (রাঃ) যিনি উটের লাগাম ধরে ছিলেন এবং হুযায়ফা (রাঃ) ইয়ামান যিনি উটকে খেদিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। অন্যান্য সাহাবীগণ (রাঃ) দূরবর্তী উপত্যকার নিম্নভূমির মধ্য দিয়ে পথ চলছিলেন। এ কারণে মুনাফিক্বগণ তাদের এ ঘৃণ্য চক্রান্তের জন্য এটিকে একটি মোক্ষম সুযোগ মনে করে নাবী কারীম (ﷺ)-এর দিকে অগ্রসর হতে থাকল।
এদিকে সঙ্গীদ্বয়সহ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যথারীতি সম্মুখ পানে অগ্রসর হচ্ছিলেন এমন সময় পশ্চাত দিকে থেকে অগ্রসরমান মুনাফিক্বদের পায়ের শব্দ তিনি শুনতে পান। এরা সকলেই মুখোশ পরিহিত ছিল। তাদের আক্রমণের উপক্রমমুখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হুযায়ফাকে তাদের দিকে প্রেরণ করলেন। তিনি তাঁর ঢালের সাহায্যে মুনাফিক্বদের বাহনগুলোর মুখের উপর প্রবল ভাবে আঘাত করতে থাকলেন। এর ফলে আল্লাহর ইচ্ছায় তারা ভীত সন্ত্রস্ত্র অবস্থায় পলায়ন করতে করতে গিয়ে লোকদের সঙ্গে মিলিত হয়ে গেল। এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের নাম বলে দেন এবং তাদের অসদুদ্দেশ্য সম্পর্কে সকলকে অবহিত করেন। এ জন্য হুযায়ফা (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ‘রাযদান’ রহস্যবিদ বলা হয়। এ ঘটনা উপলক্ষে আল্লাহর এ ইরশাদ অবতীর্ণ হয়
(وَهَمُّوْا بِمَا لَمْ يَنَالُوْا) [التوبة:74]
‘তারা ঐ কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করেছিল যা তারা পায় নি।’ [আত্-তাওবাহ (৯) : ৭৪]
সফর শেষে নাবী কারীম (ﷺ) যখন দূর হতে মদীনার দৃশ্য দেখতে পেলেন তখন তিনি বললেন, (তাবা) এবং (উহুদ), এগুলো হচ্ছে সেই পর্বত যা আমাদেরকে ভালবাসে এবং আমরাও যাকে ভালবাসি। এদিকে যখন মদীনায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আগমন সংবাদ পৌঁছে গেল তখন মহিলা ও কিশোরেরা ঘর থেকে বের হয়ে এসে তাঁকে এবং তাঁর সাহাবীগণকে (রাঃ) খোশ আমদেদ জানিয়ে এ সঙ্গীতে গুঞ্জণধ্বনি উচ্চারণ করল।[1]
طلع البـدر علينا ** من ثنيات الوداع
وجب الشكر علينا ** ما دعا لله داع
অর্থ : সান্নায়াতুল ওয়াদা’ নামকস্থান হতে আমাদের উপর চৌদ্দ তারিখের চন্দ্র উদিত হল। আহবানকারীগণ যতক্ষণ আল্লাহকে আহবান করতে থাকবে ততক্ষণ আমাদের কর্তব্য হবে শোকর করা।’
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রজব মাসে তাবুকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন এবং প্রত্যার্তন করেছিলেন রমযান মাসে। এ সফরে পূর্ণ পঞ্চাশ দিন অতিবাহিত হয়েছিল। বিশ দিন তাবুকে এবং ত্রিশ দিন পথে যাতায়াতে। তাবুকে অভিযান ছিল তাঁর জীবনের শেষ যুদ্ধাভিযান যাতে স্বশরীরে তিনি অংশ গ্রহণ করেছিলেন।
[1] এ হচ্ছে ইবনুল কাইয়্যেমের বিবরণ। ইতোপূর্বে এ সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে।
যারা যুদ্ধ হতে পিছনে রয়ে গিয়েছিলেন (المُخَلَّفُوْنَ):
তাবুক যুদ্ধ ছিল আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে এমন এক কঠিন পরীক্ষা যা দ্বারা ঈমানদার ও অন্যান্যদের মধ্যে প্রভেদের একটি সুস্পষ্ট সীমারেখা তৈরি হয়েছিল। এ ধরণের অবসরে আল্লাহর বিধি-বিধানও এরূপ :
(مَّا كَانَ اللهُ لِيَذَرَ الْمُؤْمِنِيْنَ عَلٰى مَآ أَنتُمْ عَلَيْهِ حَتّٰى يَمِيْزَ الْخَبِيْثَ مِنَ الطَّيِّبِ)[ آل عمران:179].
‘আল্লাহ মু’মিনদেরকে সে অবস্থায় পরিত্যাগ করতে পারেন না। যার উপর তোমরা আছ, ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না অপবিত্রকে পবিত্র থেকে পৃথক করে দেন।’ (আলু ‘ইমরান (৩): ১৭৯]
কাজেই, এ যুদ্ধে মু’মিন ও সত্যবাদিগণ শরীক হন। যুদ্ধ হতে অনুপস্থিতি কপটতার লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত হয়। সুতরাং তখন ঠিক এ রকম এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল যে, যদি কেউ পিছনে পড়ে থাকত কিংবা পিছুটান হয়ে থাকত তার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সামনে আলোচনা করা হলে তিনি বলতেন,
(دَعَوْهُ، فَإِنْ يَكُنْ فِيْهِ خَيْرٌ فَسَيَلْحَقُهُ اللهُ بِكُمْ، وَإِنْ يَكُنْ غَيْرَ ذٰلِكَ فَقَدْ أَرَاحَكُمْ مِنْهُ)
‘তাকে ছেড়ে যাও। যদি তার মধ্যে মঙ্গল নিহিত থাকে তাহলে আল্লাহ শীঘ্রই তাকে তোমাদের নিকট পৌঁছে দিবেন। আর যদি তা না হয় তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে তার অনুপস্থিতির মাধ্যমে শান্তি প্রদান করবেন।’ প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এ যুদ্ধ হতে সেই সকল লোক অনুপস্থিত ছিল, যারা ছিল অপারগ, অথবা ছিল মুনাফিক্ব। মুনাফিক্বগণ আল্লাহ এবং তদীয় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর ঈমানের মিথ্যা দাবী করত এবং এ দাবীর ভিত্তিতেই তারা যুদ্ধে শরীক হয়েছিল, কিন্তু যুদ্ধের ব্যাপারে তারা ছিল সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়। মিথ্যা অযুহাতে তারা যুদ্ধরত সৈন্যদের পিছনে বসে থাকত। হ্যাঁ, তিন ব্যক্তি এমন ছিল যারা প্রকৃতই মু’মিন ছিল এবং কোন কারণ ছাড়াই যুদ্ধে শরিক হওয়া থেকে বিরত ছিল। আল্লাহ তাদেরকে পরীক্ষার মধ্যে নিপতিত করেন এবং পুনরায় তাদের তওবা কবুল করেন।
এর বিবরণ হচ্ছে, তাবুক হতে প্রত্যাবর্তন করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনায় প্রবেশের পর সর্ব প্রথম মাসজিদে নাবাবীতে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং সেখানে দু’ রাকাত সালাত আদায় করেন। অতঃপর লোকজনদের জন্য সেখানে বসে পড়েন। এ সময় আশি জনেরও অধিক মুনাফিক্বের একটি দল সেখানে উপস্থিত হয়ে নানা ওযর আপত্তি আরম্ভ করে দেয়[1] এবং শপথ করতে থাকে। নাবী (ﷺ) বাহ্যিকভাবে তাদের ওযর গ্রহণ করে আজ্ঞানুবর্তী হওয়ার শপথ গ্রহণ করেন এবং ক্ষমা প্রদান করেন। অতঃপর প্রশ্নটি আল্লাহর সমীপে সমর্পণ করে দেন।
অবশিষ্ট তিন জন মু’মিন অর্থাৎ কা‘ব বিন মালিক, মুরারাহ বিন রাবী’ এবং হেলাল বিন উমাইয়া সত্যবাদিতা অবলম্বন ক’রে স্বীকার করে যে, কোন রকম অসুবিধা ছাড়াই তারা যুদ্ধে শরীক হওয়া থেকে বিরত ছিল। এ প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এদের সঙ্গে কথাবার্তা না বলার জন্য সাহাবীগণ (রাঃ)-কে নির্দেশ প্রদান করেন।
সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে কঠিন বয়কট বা বর্জন ব্যবস্থা কার্যকর হয়ে গেল। মানুষের মধ্যে পরিবর্তন এসে গেল, পৃথিবী ভয়ানক আকার ধারণ করল এবং প্রশস্ততা থাকা সত্ত্বেও সংকীর্ণ হয়ে গেল। তাদের জীবনের জন্য বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে গেল।
এমনি এক বিপদের সৃষ্টি হয়ে গেল যে, ৪০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর তাদেরকে আপন আপন স্ত্রী এবং পরিবার পরিজন থেকে পৃথক থাকার নির্দেশ দেয়া হল। যখন বয়কটের ৫০ দিন পূর্ণ হল তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদের তাওবা কবুল করার সুসংবাদ প্রদান করে আয়াত নাযিল করলেন,
(وَعَلَى الثَّلاَثَةِ الَّذِيْنَ خُلِّفُوْا حَتّٰى إِذَا ضَاقَتْ عَلَيْهِمُ الأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ وَضَاقَتْ عَلَيْهِمْ أَنفُسُهُمْ وَظَنُّوْا أَن لاَّ مَلْجَأَ مِنَ اللهِ إِلاَّ إِلَيْهِ ثُمَّ تَابَ عَلَيْهِمْ لِيَتُوْبُوْا إِنَّ اللهَ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيْمُ) [التوبة:118].
‘আর (তিনি অনুগ্রহ করলেন) ঐ তিনজনের প্রতিও যারা পিছনে থেকে গিয়েছিল [কা‘ব ইবনে মালিক, মুরারা ইবনে রাবী‘আ ও হিলাল ইবনে উমায়্যা (রাযি।) তাঁরা অনুশোচনার আগুনে এমনি দগ্ধীভূত হয়েছিলেন যে] শেষ পর্যন্ত পৃথিবী তার পূর্ণ বিস্তৃতি নিয়েও তাদের প্রতি সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল আর তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠল আর তারা বুঝতে পারল যে, আল্লাহ ছাড়া তাদের কোন আশ্রয়স্থল নেই তাঁর পথে ফিরে যাওয়া ব্যতীত। অতঃপর তিনি তাদের প্রতি অনুগ্রহ করলেন যাতে তারা অনুশোচনায় তাঁর দিকে ফিরে আসে। আল্লাহ অতিশয় তাওবাহ কবূলকারী, বড়ই দয়ালু।’ [আত্-তাওবাহ (৯) : ১১৮]
মীমাংসা সম্পর্কিত এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ায় সাধারণ মুসলিমগণ এবং ঐ তিন জন সাহাবা অত্যন্ত আনন্দিত হন। লোকেরা দৌড় দিয়ে গিয়ে এ শুভ সংবাদ প্রচার করতে থাকে। আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে সকলের মুখমণ্ডলে উজ্জ্বলতা প্রকাশ পায় এবং সকলে দান খয়রাত করতে থাকে। প্রকৃতই এ দিনটি ছিল তাদের জন্য চরম ও পরম সৌভাগ্যের দিন।
যারা অপারগতার কারণে যুদ্ধে শরিক হতে পারেন নি অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা তাদের জন্যও বলেন,
(لَّيْسَ عَلٰى الضُّعَفَاء وَلاَ عَلٰى الْمَرْضٰى وَلاَ عَلٰى الَّذِيْنَ لاَ يَجِدُوْنَ مَا يُنفِقُوْنَ حَرَجٌ إِذَا نَصَحُوْا لِلهِ وَرَسُوْلِهِ) [التوبة: 91]
তাঁদের সম্পর্কে নাবী কারীমও (ﷺ) মদীনায় পৌঁছার পর বলেছেন, (إِنَّ بِالْمَدِيْنَةِ رِجَالاً مَا سِرْتُمْ مَسِيْراً، وَلَا قَطَعْتُمْ وَادِياً إِلَّا كَانُوْا مَعَكُمْ، حَبَسَهُمْ الْعُذْرُ) ‘মদীনায় এমন কতগুলো লোক আছে তা তোমরা যেখানেই সফর করেছ এবং যে উপত্যাকা অতিক্রম করেছ তারা তোমাদের সঙ্গেই রয়েছে। তাদের অপারগতা তাদেরকে রেখেছিল।’
লোকেরা বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! তারা মদীনায় অবস্থান করেও আমাদের সঙ্গে ছিল? নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, (وَهُمْ بِالْمَدِيْنَةِ) ‘হ্যাঁ’ মদীনায় অবস্থান করেও তারা সঙ্গেই ছিল।’
[1] ইমাম ওয়াক্বিদী উল্লেখ করেছেন যে, এ সংখ্যা ছিল মুনাফিক্ব আনসারদের। এদের ছাড়া বনু গেফার এবং অন্যন্যদের মধ্যে বাহানাকারীদের সংখ্যাও ছিল। অতঃপর আব্দুল্লাহ বিন উবাই এবং তার অনুসারীগণ ছিল ওই সংখ্যার বাইরে এবং এদের সংখ্যাও ছিল বেশ বড়। দ্র: ফাতহুল বারী ৮ম খন্ড ১১৯ পৃঃ।
এ যুদ্ধের প্রভাব (أَثَرُ الْغَزْوَةِ):
আরব উপদ্বীপের উপর মুসলিমগণের প্রভাব বিস্তার এবং তাঁদের অবস্থানকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে এ যুদ্ধ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ফলোৎপাদক ঘটনা। এ যুদ্ধের পর থেকে মানুষের নিকট এটা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, আরব উপদ্বীপের মধ্যে ইসলামী শক্তিই হচ্ছে একমাত্র প্রতিষ্ঠিত শক্তি। অন্য কোন শক্তিরই আর তেমন কোন কার্যকারিতা নেই। এর ফলে অর্বাচীন ও মুনাফিক্বগণের সেই সকল অবাঞ্ছিত কামনা বাসনা যা মুসলিমগণের বিরুদ্ধে যুগের বিবর্তনের গতিধারায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশায় আশান্বিত ছিল তা একদম নিঃশেষ হয়ে গেল। কারণ, তাদের সকল আশা ভরসার কেন্দ্রবিন্দু ছিল যে, রোমক শক্তি তা যখন ইসলামী শক্তির মোকাবেলায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল, তখন তাদের লালিত আকঙ্ক্ষা পূরণের আর কোন পথই রইল না। তখন তাদের কাছে এটাও সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, ইসলামী শক্তির নিটক আত্মসমর্পণ করা ছাড়া নিস্কৃতি লাভের আর কোন পথই অবশিষ্ট রইল না।
কাজেই পরিবর্তিত এ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে তখন এ রকম কোন প্রয়োজন ছিল না যে, মুসলিমগণ মুনাফিক্বদের সঙ্গে নম্র ও অযাচিত ভাবে ভদ্র ব্যবহার করবেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে মুসলিমগণ নির্দেশিত হলেন তাদের সঙ্গে শক্ত, সাহসিকতাপূর্ণ ও শঙ্কাহীন আচরণ করতে। এমনকি তাদের সদকা গ্রহণ, তাদের সালাতে জানাযায় অংশ গ্রহণ, তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা এবং তাদের কবরের পাশে যাওয়ার ব্যাপারেও মুসলিমগণকে নিষেধ করে দেয়া হল। অধিকন্তু, ষড়যন্ত্র ও দূরভিসন্ধির বশবর্তী হয়ে মসজিদ নামের যে ক্ষুদ্র কুটিরটি তৈরি করেছিল তা ধ্বংস করে দেয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হল। এ সময় তাদের সম্পর্কে এমন এমন সব আয়াত অবতীর্ণ হতে থাকল যার মাধ্যমে তাদের কার্যকলাপ উলঙ্গ ভাবে জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়ে পড়ল। তাদের শঠতা ও দুরভিসন্ধির ব্যাপারে সন্দেহের আর কোন অবকাশই রইল না। এ যেন মদীনাবাসীদের জন্য উল্লেখিত আযাতসমূহ ছিল ঐ মুনাফিক্বদের চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে অঙ্গুলি সংকেত।
এ যুদ্ধের ইতিবাচক প্রভাবসমূহের মধ্যে এ কথাটা সুস্পষ্টভাবে বলা যায় যে, মক্কা বিজয়ের পরে এমন কি পূর্বে যদিও আরবের প্রতিনিধিগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে আসতে আরম্ভ করেছিল কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাবুক যুদ্ধের পরই যথোচিতভাবে শুরু হয়েছিল।[1]
[1] উল্লেখিত যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ নিম্নোক্ত উৎস হতে সংঘৃহীত হয়েছে, ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৫১৫-৫৩৭ পৃঃ, যাদুল মা’আদ ৩য় খন্ড, ২-১৩ পৃঃ, সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৬৩৩-৬৩৭ ও ১ম খন্ড ২৫২-৪১৪ পৃ: অন্যান্য সহীহুল মুসলিম নাবাবী সহ ২য় খন্ড ২৪৬ পৃঃ, ফাতহুল বারী ৮ম খন্ড ১১০-১২৬ পৃঃ, শাইখ আব্দুল্লাহ রচিত মুখতাসারুস সীরাহ ৩৯১-৪০৭ পৃঃ।
এ যুদ্ধ সম্পর্কে কোরবানের আয়াত নাযিল (نُزُوْلُ الْقُرْآنِ حَوْلَ مَوْضُوْعِ الْغَزْوَةِ):
উল্লেখিত যুদ্ধের পরিস্থিতি সম্পর্কে সূরাহ ‘তাওবায়’ অনেক আয়াত অবতীর্ণ হয়, কিছু যাত্রার পূর্বে, কিছু যাত্রার পরে, কিছু কিছু ভ্রমণ কালে এবং কিছু মদীনা প্রত্যাবর্তনের পর। উল্লেখিত আয়াতসমূহে মুনাফিক্বদের চক্রান্তের যবনিকা উন্মোচন, যুদ্ধের অবস্থা ও মুখলেস মুজাহিদদের মর্যাদা সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। তাছাড়া, সিদ্দীকীন মু’মিনদের মধ্যে যাঁরা যুদ্ধে শরীক হয়েছিলেন এবং যাঁরা হন নি তাদের তওবা কবুল ইত্যাদি ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে।
এ সনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী (بَعْضُ الْوَقَائِعِ الْمُهِمَّةِ فِيْ هٰذِهِ السَّنَةِ):
এ সনে (৯ম হিজরী) যে সকল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয় তা হচ্ছে যথাক্রমে নিম্নরূপ:
১. তাবুক হতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রত্যাবর্তনের পর উওয়াইমের আজলানী ও তার স্ত্রীর মধ্যে লি’আন হয়। (স্বামী যদি স্ত্রীর প্রতি ব্যভিচারের অপবাদ দেয় আর তার সাক্ষী না থাকে তাহলে যে পদ্ধতির মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানো হয় তাকে লি’আন বলা হয়।)
২. গামিদিয়া মহিলা যে নাবী কারীম (ﷺ)-এর খিদমতে হাজির হয়ে ব্যভিচারের স্বীকৃতি দিয়েছিল তাকে প্রস্তরাঘাত করে মেরে ফেলা হয়েছিল। এ মহিলার সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর যখন শিশুটি দুগ্ধ পান থেকে বিরত হয়েছিল তখন তাকে প্রস্তরাঘাত করা হয়েছিল।
৩. সম্রাট আসাহামা নাজ্জাশী মৃত্যুবরণ করেন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর গায়েবানা জানাযা আদায় করেন।
৪. নাবী কারীম (ﷺ)-এর কন্যা উম্মু কুলসুম মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে নাবী কারীম (ﷺ) গভীরভাবে শোকাভিভূত হন। তিনি উসমানকে বলেন যে, (لَوْ كَانَتْ عِنْدِيْ ثَالِثْةً لَزَوَّجْتُكَهَا) ‘আমার তৃতীয় কন্যা থাকলে তার বিবাহও তোমার সঙ্গে দিতাম’।
৫. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর তাবূক হতে প্রত্যাবর্তনের পর মুনাফিক্ব নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই মৃত্যুবরণ করে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং উমার (রাঃ)-এর বাধা দান সত্ত্বেও তার সালাতে জানাযা আদায় করেন। পরে কুরআন শরীফের আয়াত অবতীর্ণ হয়ে তাতে উমার (রাঃ)-এর মত সমর্থন করে মুনাফিক্বদের জানাযা আদায় করতে নিষেধ করা হয়।
আবূ বাকর (রাঃ)-এর হজ্জ পালন (حَجُّ أَبِيْ بَكْرٍ ):
নবম হিজরীর হজ্জ (আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর নেতৃত্বে) এ সালের (৯ম হিজরী) যুল ক্বাদাহ কিংবা যুল হিজ্জাহ মাসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মানাসিকে হজ্জ (হজ্জের বিধি বিধান) কায়েম করার উদ্দেশ্যে আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ)-কে আমিরুল হজ্জ (হজ্জযাত্রী দলের নেতা) হিসেবে প্রেরণ করেন। এরপর সূরাহ বারাআতের (তাওবার) প্রথমাংশ অবতীর্ণ হয় যাতে মুশরিকদের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিনামা সমতার ভিত্তিতে শেষ করে দেয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়। এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর তাঁর পক্ষ থেকে এ সম্পর্কে ঘোষণা প্রদানের জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আলী (রাঃ)-কে প্রেরণ করেন। যেহেতু রক্ত এবং সম্পদ সংশ্লিষ্ট অঙ্গীকার বা চুক্তিনামার প্রশ্নে এটাই ছিল আরবের নিয়ম, সেহেতু এমনটি করতে হয় (সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নিজেই ঘোষণা করবে কিংবা পরিবারের কোন সদস্যের মাধ্যমে তা করানো হবে। পরিবার বহির্ভূত কোন ব্যক্তির মাধ্যমে প্রদত্ত ঘোষণা স্বীকৃত হতো না।) আবূ বাকর (রাঃ)-এর সঙ্গে আলী (রাঃ)-এর সাক্ষাত হয় আরয অথবা জাজনান নামক উপত্যকায়। আবূ বাকর জিজ্ঞেস করলেন নির্দেশদাতা, না নির্দেশ প্রাপ্ত? আলী (রাঃ) বললেন, না, বরং নির্দেশ প্রাপ্ত।
অতঃপর দু’ জনই সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। আবূ বাকর (রাঃ) সকল লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে হজ্জ পালন করেন। ১০ই যুল হিজ্জাহ কুরবানী দিবসে আলী বিন আবূ ত্বালিব (রাঃ) জামরার (কংকর নিক্ষেপের স্থান) নিকট দাঁড়িয়ে সমবেত জনতার মাঝে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশিত বিষয়ে ঘোষণা প্রদান করেন, অর্থাৎ অঙ্গীকারকারীগণের সকল অঙ্গীকারের বিলুপ্তি ঘোষণা প্রদান করেন এবং এ সকল বিষয় চূড়ান্ত করার জন্য চার মাস মেয়াদের কথা বলা হয়। যাদের সঙ্গে কোন চুক্তি ছিল না তাদেরকেও চার মাসের সময় দেয়া হয়। তবে যে মুশরিকগণ মুসলিমগণের সঙ্গে অঙ্গীকার পালনে কোন প্রকার ত্রুটি করে নি, কিংবা মুসলিমগণের বিরুদ্ধে অন্য কাউকেই সাহায্য প্রদান করে নি, তাদের অঙ্গীকার নামা নির্ধারিত সময় পর্যন্ত বলবত রাখা হয়।
আবূ বাকর (রাঃ) একদল সাহাবায়ে কেরামের মাধ্যমে ঘোষণা প্রদান করেন যে, আগামীতে কোন মুশরিক খানায়ে কা‘বাহর হজ্জ করতে পারবে না এবং কোন উলঙ্গ ব্যক্তি কা‘বাহ ঘর তাওয়াফ করতে পারবে না।
এ ঘোষণা ছিল মূর্তিপূজার জন্য শেষ অশনি সংকেত অর্থাৎ এর পর থেকে মূর্তি পূজার আর কোন সুযোগই রইল না।[1]
[1] এ হজ্জের বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্রষ্টব্য: সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ২২০ ও ৪৫১ পৃঃ, ২য় খন্ড ৬২৬ ও ৬৭১ পৃঃ. যাদুল মা‘আদ ৩য় খন্ড ২৫ ও ২৬ পৃঃ, ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৫৪৩-৫৪৬ পৃঃ, এবং সূরাহ বারাআতের প্রথমাংশের তফসীর।
যুদ্ধ পরিক্রমা (نَظْرَةٌ عَلَى الْغَزَوَاتِ):
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরিচালনায় সংঘটিত বিভিন্ন যুদ্ধ, যুদ্ধাভিযান ও সৈনিক মহোদ্যম সম্পর্কে সঠিকভাবে অবহিত হওয়ার পর যুদ্ধের পটভূমি, পরিবেশ, পরিচালনা, নিকট ও সুদূর-প্রসারী প্রভাব প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল সম্পর্কে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে যিনি বিচার বিশ্লেষণ করবেন তাঁকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে নাবী কারীম (ﷺ) ছিলেন সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সমর বিশারদ এবং সমর নায়ক। শুধু তাই নয়, তাঁর সমরাদর্শও ছিল সকল যুগের সকল সমর নায়কের অনুসরণ ও অনুকরণযোগ্য সর্বোত্তম আদর্শ। তাঁর যুদ্ধ সম্পর্কিত উপলব্ধি ও অনুধাবন ছিল সঠিক ও সময়োপযোগী, অর্ন্তদৃষ্টি ছিল অত্যন্ত গভীর এবং সিদ্ধান্ত ছিল সুতীক্ষ্ণ প্রজ্ঞাপ্রসূত। রিসালাত ও নবুওয়াতের বৈশিষ্ট্যে তিনি ছিলেন রাসূলগণের সরদার (সাইয়্যিদুল মুরসালীন) এবং ছিলেন নাবীকুল শিরোমণি (আ’যামুল আমবিয়া)। সৈন্য পরিচালনের ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অতুলনীয় এক ব্যক্তিত্ব এবং একক গুণের অধিকারী। যখনই কোন যুদ্ধের জন্য তিনি প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন তখই দেখা গেছে যে, যুদ্ধের স্থান নির্বাচন, সেনাবাহিনীর বিন্যাস ব্যবস্থা, সমর কৌশল, সমরাস্ত্রের ব্যবহার বিধি , আক্রমণ, পশ্চাদপসরণ ইত্যাদি সর্ব ব্যাপারে তিনি সাহসিকতা, সতর্কতা ও দূরদর্শিতার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন। তাঁর সমর পরিকল্পনায় কোন ত্রুটি হয় নি এবং এ কারণেই মুসলিম বাহিনীকে কখনই কোন যুদ্ধে পরাজয় বরণ করতে হয় নি।
অবশ্য উহুদ এবং হুনাইন যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীকে সাময়িকভাবে কিছুটা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্তু সমর পরিকল্পনা কিংবা সমর কৌশলের ত্রুটি কিংবা ঘাটতির কারণে এ বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয় নি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’র নির্দেশিত কৌশল নিষ্ঠার সঙ্গে অবলম্বন করলে এ বিপর্যয়ের কোন প্রশ্নই আসত না। এ বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছিল কিছু সংখ্যক সৈন্যের ভুল ধারণা এবং দুর্বল মানসিকতা থেকে। উহুদ যুদ্ধে যে ইউনিটকে গিরিপথে পাহারার দায়িত্বে নিযুক্ত রাখা হয়েছিল তাঁদের ভুল বুঝাবুঝির কারণেই সেদিন কিছুটা বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছিল। হুনাইন যুদ্ধের দিন কিছুক্ষণের জন্য বিপর্যয়ে সৃষ্টি হয়েছিল কিছু সংখ্যক সৈন্যের কিছুটা মানসিক দুর্বলতা এবং শত্রুপক্ষের আকস্মিক আক্রমণে হতচকিত হয়ে পড়ার কারণে।
উল্লেখিত দুই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর বিপর্যয়ের মুখে নাবী কারীম (ﷺ) যে অতুলনীয় সাহসিকতা ও কর্মদক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন মানব জাতির যুদ্ধের ইতিহাসে একমাত্র তিনিই ছিলেন তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। যুদ্ধের ভয়াবহ বিভীষিকার মুখেও পর্বতের ন্যায় অটল অচল থাকার কারণেই বিপর্যস্ত প্রায় মুসলিম বাহিনী ছিনিয়ে এনেছিলেন বিজয়ের গৌরব।
ইতোপূর্বে যে আলোচনা করা হল তা ছিল যুদ্ধ সম্পর্কিত। কাজেই, যুদ্ধের দৃষ্টিকোণ থেকে সে সব বিষয় আলোচিত হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ ছাড়াও এমন কতগুলো সমস্যা যেগুলো ছিল সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। নিরলস প্রচেষ্টার দ্বারা সে সকল সমস্যার সমাধান করে নাবী কারীম (ﷺ) তৎকালীন আরব সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করেন, অশান্তি ও অনিষ্টতার অগ্নি নির্বাপিত করেন, মূর্তিপূজার মূলোৎপাটনের মাধ্যমে একটি পরিচ্ছন্ন ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করেন এবং আপোষ ও সন্ধিচুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে মুশরিকদের বৈরিতার অবসান ঘটান। তাছাড়া সে সকল সংগ্রামের মাধ্যমে তিনি প্রকৃত মুসলিম ও মুনাফিক্বদের সম্পর্কে অবহিত হন এবং তাদের ষড়যস্ত্র এবং ক্ষতিকর কার্যকলাপ থেকে মুসলিমগণকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হন।
অধিকন্তু, বিভিন্ন যুদ্ধে শত্রুদের সঙ্গে মুখোমুখী মোকাবেলায় লিপ্ত হয়ে বাস্তব দৃষ্টান্ত সৃষ্টির মাধ্যমে এত যুদ্ধাভিজ্ঞ ও শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে মুসলিম বাহিনীকে তিনি তৈরি করে দিয়েছিলেন যে, পরবর্তী কালে এ বাহিনী ইরাক ও সিরিয়ার ময়দানে বিশাল বিশাল পারস্য ও রোমক বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে তাদের শোচনীয় ভাবে পরাস্ত করার পর তাদের বাড়িঘর, সহায় সম্পদ, বাগ-বাগিচা, ঝর্ণা ও ক্ষেতখামার থেকে বিতাড়িত করেন এবং নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেন।
অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সে সকল যুদ্ধের মাধ্যমে হিজরতের কারণে ছিন্নমূল মুসলিমগণের আবাসভূমি, চাষাবাদযোগ্য ভূমি ও কৃষি ব্যবস্থা এবং অন্যান্য বৃত্তিমূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে আয় উপার্জনহীন শরণার্থীদের জন্য উত্তম পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। তাছাড়া যুদ্ধাস্ত্র এবং যুদ্ধের উপযোগী সরঞ্জামামি, ঘোড়া এবং যুদ্ধের ন্যায় নির্বাহের জন্য অর্থ সম্পদ ইত্যাদিও সংগ্রহ করে দেন, অথচ এ সব করতে গিয়ে কখনই তিনি বিধিবহির্ভূত কোন ব্যবস্থা, অন্যায় কিংবা উৎপীড়নের পথ অবলম্বন করেন নি।
যুদ্ধের লক্ষ্য উদ্দেশ্য এবং নীতির ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এক যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধন করেন। জাহলিয়াত যুগে যুদ্ধের রূপ ছিল লুটতরাজ, নির্বিচার হত্যা, অত্যাচার ও উৎপীড়ন, ধর্ষণ, নির্যাতন, কায়ক্লেশ ও কঠোরতা অবলম্বন এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি। কিন্তু ইসলাম জাহেলী যুগের সে যুদ্ধ নামের দানাবীয় কান্ডকারখানাকে পরিবর্তন ও সংস্কার সাধনের মাধ্যমে পবিত্র জিহাদে রূপান্তরিত করেন। জিহাদ হচ্ছে অন্যায় ও অসত্যের মূলোৎপাটন করে ন্যায় সঙ্গত ও যুক্তিসঙ্গত উপায়ে সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম। জিহাদ বা সত্য প্রতিষ্ঠার এ সংগ্রামে অযৌক্তিক বাড়াবাড়ি, অন্যায় উৎপীড়ন, ধ্বংস, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অপহরণ, অহেতুক হত্যা ইত্যাদি কোন কিছুরই সামান্যতম অবকাশও ছিল না। ইসলামে যুদ্ধ সংক্রান্ত যে কোন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোরভাবে আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-বিধান অনুসরণ করা হত।
শত্রু পক্ষের উপর আক্রমণ পরিচালনা, সাক্ষাত সমরে যুদ্ধ পরিচালনা, যুদ্ধ বন্দী, যুদ্ধোত্তর ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিভিন্ন ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে নিয়ম নীতি অনুসরণ করেছিলেন সর্বযুগের সমর বিশারদগণ তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ইসলামে যুদ্ধের উদ্দেশ্য ভূমি কিংবা সম্পদ দখল, সাম্রাজ্য বিস্তার কিংবা আধিপত্যের সম্পসারণ নয়, নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অবহেলিত মানুষকে সত্যের পথে আনয়ন, ন্যায় ও কল্যাণ ভিত্তিক সমাজের সদস্য হিসেবে সম্মানজনক জীবন যাপন, সকল প্রকার ভূয়া আভিজাত্যের বিলোপ সাধনের মাধ্যমে অভিন্ন এক মানবত্ববোধের উন্মেষ ও লালন। অশান্তি, অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার স্থলে মানবত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন এবং নিরাপদ ও শান্তি স্বস্তিপূর্ণ জীবন যাপনের উদ্দেশ্যে আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠাই ছিল রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুদ্ধ বিগ্রহের প্রধান উদ্দেশ্য।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(وَالْمُسْتَضْعَفِيْنَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاء وَالْوِلْدَانِ الَّذِيْنَ يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْ هٰذِهِ الْقَرْيَةِ الظَّالِمِ أَهْلُهَا وَاجْعَل لَّنَا مِن لَّدُنكَ وَلِيًّا وَاجْعَل لَّنَا مِن لَّدُنكَ نَصِيْرًا) [النساء:75]
‘এবং অসহায় নারী-পুরুষ আর শিশুদের জন্য, যারা দু‘আ করছে- ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এ যালিম অধ্যূষিত জনপথ হতে মুক্তি দাও, তোমার পক্ষ হতে কাউকেও আমাদের বন্ধু বানিয়ে দাও এবং তোমার পক্ষ হতে কাউকেও আমাদের সাহায্যকারী করে দাও।’ [আন-নিসা (৪) : ৭৫]
যুদ্ধ বিগ্রহের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে সকল মানবোচিত আইন কানুন প্রণয়ন ও প্রবর্তন করেছিলেন সেনাবাহিনী প্রধান কিংবা সাধারণ সৈনিকগণ যাতে কোনক্রমেই তার অপপ্রয়োগ না করেন কিংবা এড়িয়ে না যান তার প্রতি তিনি সর্বদাই সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন।
সোলায়মান বিন বোরাইদাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন কোন ব্যক্তিকে কোন মুসলিম সেনাবাহিনীর অধিনায়ক কিংবা অভিযাত্রী দলের নেতা নির্বাচিত করতেন তখন গন্তব্যস্থলে যাত্রার প্রাক্কালে তাঁকে তাঁর নিজের ব্যাপারে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করতে এবং তাঁর সঙ্গী সাথীদের ভাল মন্দের ব্যাপারে বিশেষভাবে উপদেশ প্রদান করতেন। অতঃপর বলতেন,
(اُغْزُوْا بِسْمِ اللهِ، فِيْ سَبِيْلِ اللهِ، قَاتِلُوْا مَنْ كَفَرَ بِاللهِ، اُغْزُوْا، فَلَا تَغُلُّوْا، وَلَاتَغْدِرُوْا، وَلَا تَمْثِلُوْا، وَلَا تَقْتُلُوْا وَلِيْداً...)
‘আল্লাহর নির্দেশিত পথে আল্লাহর নামে যুদ্ধ করবে, যারা আল্লাহর কুফরী করেছে তাদের সঙ্গে যু্দ্ধ করবে। ন্যায় সঙ্গতভাবে যুদ্ধ করবে, বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, অঙ্গীকার ভঙ্গ করবে না, শত্রুপক্ষের কোন ব্যক্তির নাক, কান ইত্যাদি কর্তন করবে না, বাড়াবাড়ি করবে না, কোন শিশুকে হত্যা করবে না।’ – শেষপর্যন্ত।
অনুরূপভাবে নাবী কারীম (ﷺ) সহজভাবে কাজকর্ম সম্পাদন করার জন্য নির্দেশ প্রদান করতেন এবং বলতেন, (يَسِّرُوْا وَلَا تُعَسِّرُوْا، وَسَكِّنُوْا وَلَا تُنَفِّرُوْا) ‘সহজভাবে কাজ করো, কঠোরতা অবলম্বন করো না। মানুষকে শান্তি দাও, ঘৃণা করো না[1]
যখন তিনি আক্রমণের উদ্দেশ্যে কোন বস্তির নিকট রাত্রে গমন করতেন তখন সকাল হওয়ার পূর্বে কখনই তিনি আক্রমণ করতেন না। কোন শত্রুকে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করার ব্যাপারে তিনি কঠোরভাবে নিষেধ করতেন। কোন ব্যক্তিকে হাত, পা বাঁধা অবস্থায় হত্যা করতে এবং মহিলাদের মারধর এবং হত্যা করতেও নিষেধ করতেন। লুণ্ঠন কার্যকে তিনি কঠোর ভাবে নিরুৎসাহিত করে বলতেন, (إِنَّ النُّهْبٰى لَيْسَتْ بِأَحَلٍّ مِنْ الْمَيْتَةِ) ‘লুণ্ঠন-লব্ধ মাল মুর্দার চাইতে অধিক পবিত্র নয়।’ তাছাড়া ক্ষেতখামার নষ্ট করা, পশু হত্যা এবং অহেতুক গাছপালা কেটে ফেলতে তিনি নিষেধ করতেন। অবশ্য যুদ্ধের বিশেষ প্রয়োজনে গাছপালা কেটে ফেলার অনুমতি যে তিনি দিতেন না তা নয়, কিন্তু প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটিও না।
মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালেও নাবী কারীম (ﷺ) নির্দেশ প্রদান করেছিলেন,(لَا تُجَهِّزَنَّ عَلٰى جَرِيْحٍ، وَلَا تَتَّبِعَنَّ مُدْبِراً، وَلَا تَقْتُلَنَّ أَسِيْراً) আহত ব্যক্তিদের আক্রমণ করবে না, কোন পলাতকের পিছু ধাওয়া করবে না, এবং কোন বন্দীকে হত্যা করবে না, কোন কওম কিংবা রাষ্ট্রের দূতকে হত্যা করবে না।’
অঙ্গীকারাবদ্ধ অমুসলিম দেশের নাগরিকদেরও হত্যা করতে তিনি কঠোরভাবে নিষেধ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, (مَنْ قَتَلَ مُعَاهِداً لَمْ يُرِحْ رَائِحَةَ الْجَنَّةِ، وَإِنَّ رِيْحَهَا لَتُوْجَدُ مِنْ مَسِيْرَةِ أَرْبَعِيْنَ عَاماً) ‘কোন অঙ্গীকারাবদ্ধ ব্যক্তিকে যে হত্যা করবে সে জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না। অথচ তার সুগন্ধ চল্লিশ বছরেরও অধিক পথের দূরত্বে পাওয়া যাবে।’
উল্লেখিত বিষয়াদির বাইরে আরও অনেক উন্নত মানের নিয়ম-কানুন তিনি প্রণয়ন ও প্রবর্তন করেছিলেন যার ফলে তাঁর সমর কার্যক্রম জাহেলিয়াত যুগের পৈশাচিকতা ও অপবিত্রতার কলুষতা থেকে মুক্ত হয়ে পবিত্র জিহাদের রূপ লাভ করে।
[1] সহীহুল মুসলিম ২য় খন্ড ৮২-৮৩ পৃৃঃ।
আল্লাহর দ্বীনে দলে দলে প্রবেশ (النَّاسُ يَدْخُلُوْنَ فِيْ دِيْنِ اللهِ أَفْوَاجاً):
ইতোপূর্বে যেমনটি আলোচিত হয়েছে যে, মক্কা বিজয়ের যুদ্ধ ছিল এমন একটি যুগান্তকারী ঘটনা যা মূর্তিপূজার মূলকে সম্পূর্ণরূপে উৎপাটিত করে এবং আরবে মিথ্যাকে অপসৃত করে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে। ইসলামের বিজয় গৌরবে আরববাসীগণের মনের সর্বপ্রকার দ্বিধা-দ্বনদ্ধ ও সন্দেহ দূরীভূত হয়ে যায় এবং তারা দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে থাকে। ‘আমর বিন সালামাহহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, ‘আমরা এক ঝর্ণার ধারে বসবাস করতে ছিলাম। সে স্থানটি ছিল বাণিজ্য কাফেলার গমনাগমনের পথ। বাণিজ্য কাফেলা যখন সে পথ দিয়ে গমনাগমন করত তখন লোকজনদের জিজ্ঞেস করতাম, ‘লোকজনেরা সব কেমন আছ? ঐ লোক, অর্থাৎ নাবী কারীম (ﷺ)-এর অবস্থা কেমন? তারা বলত, ‘তিনি মনে করেন যে, আল্লাহ তাঁকে নাবী করেছেন এবং আল্লাহর তরফ থেকে তাঁর নিকট ওহী আসে। আল্লাহ তাঁর নিকট এ এ বিষয়ে ওহী অবতীর্ণ করেছেন। আমি তাদের কথা এমনভাবে স্মরণ করে রাখতাম যে সেগুলোকে যেন আমার সীনা চিমটে ধরে রাখত।’
ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় লাভের জন্য সমগ্র আরব জাহান মক্কা বিজয়ের অপেক্ষায় ছিল। তারা বলত ‘তাঁকে এবং তাঁর দলকে ক্ষমতা পরীক্ষার জন্য ছেড়ে দাও। যদি তিনি কুরাইশ এবং তাদের মিত্রদের উপর বিজয়ী হন তাহলে বুঝতে হবে যে, তিনি প্রকৃতই নাবী। কাজেই, যখন মক্কা বিজয়ের ঘটনা সংঘটিত হল তখন বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা ইসলাম গ্রহণের উন্মুখতা নিয়ে মদীনা অভিমুখে অগ্রসর হল। ‘আমর গোত্রের লোকজনদের ইসলাম গ্রহণের জন্য আমার পিতাও গমণ করলেন। অতঃপর যখন তিনি খিদমতে নাবাবী থেকে ফেরত আসলেন তখন বললেন, ‘আল্লাহর শপথ! একজন সত্য নাবীর নিকট থেকে আমি তোমাদের নিকট আসছি। নাবী (ﷺ) বললেন, ‘অমুক সময় সালাত আদায় কর। যখন সালাতের সময় হবে তোমাদের মধ্য হতে একজন আযান দেবে এবং কোনআন শরীফ যার ভাল জানা আছে সে সালাতে ইমামত করবে।[1]
এ হাদীস দ্বারা স্পষ্টত প্রমাণিত হয় যে, মক্কা বিজয়ের ঘটনা, ঘটনা প্রবাহের মোড় পরিবর্তনের ক্ষেত্রে, ইসলামকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে, আরব অধিবাসীদের নীতি-নির্ধারণের ব্যাপারে এবং তাদের বহুত্ববাদের ধারণাকে মন মস্তিষ্ক থেকে অপসারণ করে ইসলামের নিকট আত্মসমর্পণ করার ব্যাপারে কত ব্যাপক ও গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। বিশেষ করে তাবুক অভিযানের পর অত্যন্ত দ্রুত গতিতে এ অবস্থার বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। এর প্রমাণ হিসেবেই এটা প্রত্যক্ষ করা যায় যে, ৯ম ও ১০ম হিজরীতে ইসলাম গ্রহণেচ্ছু বিভিন্ন দলের মদীনা আগমণ একের পর এক অব্যাহত থাকে এবং তারা দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে থাকে।
এ সময় আরববাসীগণ যে অত্যন্ত অধিক সংখ্যক হারে ইসলামে দীক্ষিত হতে থাকেন তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ হচ্ছে সেনাবাহিনী। মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে যেক্ষেত্রে সেনাবাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা ছিল মাত্র দশ হাজার, সেক্ষেত্রে একটি বছর অতিবাহিত না হতেই মুসলিম বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা উন্নীত হয় ত্রিশ হাজারে। এর অল্প কাল পরেই বিদায় হজ্জের সময় এ বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা উন্নীত হয় এক লক্ষ চবিবশ হাজার অথবা এক লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজারে। শ্রাবণ প্লাবনের ন্যায় উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে ইসলামের সৈন্যসংখ্যা। বিদায় হজ্জের সময় এ বিশাল বাহিনী নাবী কারীম (ﷺ)-এর চার পাশে এমনভাবে লাববায়িক, তাকবীর, হামদ ও তসবীহ ধ্বনি উচ্চারণ করতে থাকেন যে, আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে এবং আল্লাহর একত্ববাদের ঐকতানে সমগ্র উপত্যকা মুখরিত হয়ে ওঠে।
[1] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৬১৫-৬১৬ পৃঃ।
প্রতিনিধিদল সমূহ (الـوُفُـــوْد):
ধর্ম যুদ্ধ সম্পর্কে তথ্যাভিজ্ঞ ব্যক্তিগণ যে সকল প্রতিনিধি দলের কথা উল্লেখ করেছেন তার সংখ্যা ছিল সত্তরের অধিক। কিন্তু এখানে সে সবের পুরো বিবরণ প্রমাণের অবকাশ নেই এবং তার কোন প্রয়োনও সেই। এ প্রেক্ষিতে আমরা শুধু সে সকল প্রতিনিধিদলের কথা আলোচনা করব যে গুলো ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে আরও যে বিষয়টির প্রতি পাঠকবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ প্রয়োজন তা হচ্ছে যদিও সাধারণ গোত্র সমূহের প্রতিনিধি দলগুলো মক্কা বিজয়ের পর খিদমতে নাবাবীতে উপস্থিত হতে আরম্ভ করেছিল,কিন্তু কোন কোন গোত্র এমন যে তাদের প্রতিনিধিদলগুলো মক্কা বিজয়ের পূর্বেই মদীনাতে আগমন করেছিল। এখানে আমরা তাদের কথাও উল্লেখ করছি।
১. আব্দুল কাইসের প্রতিনিধিদল(وَفْدُ عَبْدِ الْقَيْسِ) : এ গোত্রের প্রতিনিধিদল দু’বার খিদমতে নাবাবীতে উপস্থিত হয়েছিল। প্রথম বার ৫ম হিজরীতে কিংবা তারও কিছু পূর্বে এবং দ্বিতীয় বার ৯ম হিজরীতে। প্রথমবার তাদের আগমণের কারণ ছিল ঐ গোত্রের মুনকেজ বিন হেববান নামক এক ব্যক্তি বাণিজ্য পণ্যাদি নিয়ে মদীনায় যাতায়াত করত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হিজরতের পর প্রথমবার যখন সে মদীনায় আগমন করল তখন ইসলাম সম্পর্কে অবহিত হয়ে মুসলিম হয়ে গেল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর একটি পত্রসহ নিজ গোত্রে প্রত্যাবর্তন করল। ইসলামের বিষয়াদি অবগত হয়ে সেই গোত্রের লোকজনেরাও ইসলাম গ্রহণ করল। ১৩ কিংবা ১৪ জনের সমন্বয়ে গঠিত একটি প্রতিনিধিদল হারাম মাসগুলোর মধ্যে খিদমতে নাবাবীতে গিয়ে হাজির হল। সে সময় ঐ প্রতিনিধিদল নাবী কারীম (ﷺ)-এর নিকট ঈমান এবং পানীয় দ্রব্যাদি সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। এ দলের নেতা ছিল আল আশাজ্জ আল আসরী।[1] যাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছিলেন যে,
(إِنَّ فِيْكَ خَصْلَتَيْنِ يَحِبُّهُمَا اللهُ : الحِلْمُ وَالْأَنَاةُ)
‘তোমাদের মধ্যে এমন দুটি স্বভাব রয়েছে যা আল্লাহ পছন্দ করেন এবং তা হচ্ছে (১) ধৈর্য্য ও (২) দূরদর্শিতা।’
ইতোপূর্বে যেমনটি উল্লেখিত হয়েছে, এ গোত্রের দ্বিতীয় দলটি আগমন করে ছিল ৯ম হিজরীতে। ঐ সময় দলের সদস্য সংখ্যা ছিল চল্লিশ। তাদের অন্যতম ছিল জারুদ বিন ‘আলা- আবদী নামক একজন খ্রিষ্টান। কিন্তু সে ইসলাম গ্রহণ করেছিল এবং তার ইসলামই ছিল উত্তম।[2]
২. দাউস গোত্রের প্রতিনিধি দল (وَفْدُ دَوْسٍ) : ৭ম হিজরীর প্রথম ভাগে এ প্রতিনিধিদল মদীনায় আগমন করে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সে সময় খায়বারে অবস্থান করছিলেন। ইতোপূর্বে এটা উল্লেখিত হয়েছে যে, এ গোত্রের নেতা তুফাইল বিন ‘আমর দাউসী (রাঃ) ঐ সময় ইসলামের আওতাভুক্ত হয়েছিলেন, যখন নাবী কারীম (ﷺ) মক্কায় ছিলেন। অতঃপর তিনি নিজ সম্প্রদায়ের নিকট প্রত্যাবর্তন এবং দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে মনোনিবেশ করে অবিরামভাবে কাজ করে যেতে থাকেন। কিন্তু তাঁর সম্প্রাদায়ের লোকেরা নানা প্রকার ছলনার আশ্রয় নিয়ে বিলম্ব করতে থাকে। এভাবে অযথা সময় অতিবাহিত হওয়ার কারণে তুফাইল তাদের ব্যাপারে নিরাশ হয়ে পড়েন এবং খিদমতে নাবাবীতে হাজির হয়ে দাউস গোত্রের লোকজনদের জন্য বদ দু‘আ করার আরজি পেশ করেন। কিন্তু বদ দু‘আর পরিবর্তে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ বলে দু‘আ করলেন, ‘হে আল্লাহ! দাউস গোত্রের লোকজনদের হিদায়াত করুন।’
নাবী (ﷺ)-এর দু‘আর বরকতে দাউস গোত্রের লোকেরা মুসলিম হয়ে যায়। তুফাইল দাউসী নিজ সম্প্রদায়ের ৭০ কিংবা ৮০টি পরিবারের একটি দল সহ ৭ম হিজরীর প্রথমভাগে মদীনায় আগমন করেন। ঐ সময় নাবী কারীম (ﷺ) খায়বার গিয়েছিলেন এ কারণে তুফাইল সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে খায়বারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গে মিলিত হন।
৩. ফারওয়াহ বিন ‘আমর জুযামীর সংবাদ বহন (رَسُوْلُ فَرْوَةَ بْنِ عَمْرِو الْجُذَامِيْ) : ফারওয়াহ ছিলেন রোমক সেনাবাহিনীতে একজন আরবীয় সেনাপতি। রুমীগণ তাঁকে রোমক সাম্রাজ্যের সীমান্তে আরব অঞ্চলসমূহের গভর্ণর নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর কেন্দ্র ছিল মা’আন (দক্ষিণ উরদুন) এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এর কার্যকারিতা ছিল। মুতাহ যুদ্ধে (৮ম হিজরী) তিনি মুসলিমগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। এ যুদ্ধে তিনি মুসলিমগণের বীরত্ব এবং সমর দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর একজন সংবাদ বাহকের মাধ্যমে তাঁর মুসলিম হওয়ার সংবাদ তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট প্রেরণ করেন। উপঢৌকনের মধ্যে একটি সাদা খচ্চরও তিনি প্রেরণ করেন। রুমীগণ তাঁর মুসলিম হওয়ার সংবাদে তাঁকে বন্দী করে কয়েদখানায় নিক্ষেপ করে। অতঃপর ইসলাম পরিত্যাগ করে পুনরায় পূর্ব ধর্মে প্রবেশ করা নতুবা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তাঁকে বলা হয়। তিনি ইসলাম পরিত্যাগ করার চাইতে মৃত্যুবরণ করাকেই প্রাধান্য দেন। কাজেই, ফিলিস্ত্বীনের আফরা’ নামক এক ঝর্ণার উপর সুলীকাষ্ঠে ঝুঁলিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়।[3]
৪. সুদা’ প্রতিনিধি দল (وَفْدُ صَدَاء) : নাবী কারীম (ﷺ)-এর জি’রানা হতে প্রত্যাবর্তনের পর ৮ম হিজরীতে এ প্রতিনিধিদল খিদমতে নাবাবীতে উপস্থিত হয়। এর কারণ ছিল রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ৪০০ (চারশ) মুজাহিদীন সমন্বয়ে এক বাহিনী সংগঠন করে ইয়ামানের সুদা’ গোত্রে আবাসিক অঞ্চলে আক্রমণ পরিচালনার নির্দেশ প্রদান করেন। এ বাহিনী যখন কানাত উপত্যকায় স্থাপিত শিবিরে অবস্থান করছিল তখন যিয়াদ বিন হারিস সুদায়ী এ ব্যাপারটি অবগত হয়ে তৎক্ষণাত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে হাজির হন এবং আরয করেন যে, আমার পরে যারা আছেন তাদের প্রতিনিধি হিসেবে আমি আমার সম্প্রদায়ের জন্য জামিন হচ্ছি। নাবী কারীম (ﷺ) কাল বিলম্ব না করে উপত্যকা থেকে মুসলিম বাহিনীকে ফিরিয়ে আনেন। এরপর নিজ গোত্রে ফিরে গিয়ে যিয়াদ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দরবারে উপস্থিত হওয়ার জন্য নিজ সম্প্রদায়ের লোকজনদের উৎসাহিত করতে থাকেন। এর ফলে ১৫ জনের একটি দল খিদমতে নাবাবীতে উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণে আজ্ঞানুবর্তী হওয়ার শপথ গ্রহণ করে। অতঃপর নিজ সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে এসে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে রত হয়। এর ফলে এ সম্প্রদায়ের মধ্যে ইসলাম প্রসার লাভ করে। বিদায় হজ্জের সময় এ সম্প্রদায়ের একশ ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে উপস্থিত হওয়ার সম্মান অর্জন করেন।
[1] মওলানা ওবায়দুল্লাহ (রহঃ) প্রণীত মিরআতুল মাফাতীহ ১ম খন্ড ৭১পৃঃ।
[2] আল্লামা নাবাবী রচিত মুসলিম শরীফের শারাহ ১ম খন্ড ৩৩ পৃঃ, এবং ফতুহুল বারী ৮ম খন্ড
[3] যাদুল মা‘আদ ৩য় খন্ড ৪৫ পৃঃ।
কা‘ব বিন যুহাইর বিন আবী সালমার আগমন (قُدُوْمُ كَعْبُ بْنُ زُهَيْرِ بْنِ أَبِيْ سَلْمٰى):
তিনি ছিলেন আরবের এক অভিজাত বংশদ্ভূত একজন প্রখ্যাত কবি। তিনি কাফির ছিলেন এবং নাবী কারীম (ﷺ)-এ নামে কুৎসা রটনা করতেন। এদিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন ত্বায়িফ যুদ্ধ হতে ফিরে আসেন (৮ম হিজরী) তখন কা‘বের নিকট তার ভাই বুজাইর বিন যুহাইর এ মর্মে পত্র লিখেন যে, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মক্কার এমন কয়েক ব্যক্তিকে হত্যা করেছেন যারা তাঁর নামে কুৎসা রটনা করত এবং তাঁকে কষ্ট দিত। কুরাইশদের ছোটখাটো কবিগণের মধ্যে যার যে দিকে সুযোগ সুবিধা হয়েছে সে সেদিকে পলায়ন করেছে। অতএব, যদি তুমি প্রাণে রক্ষা পেতে চাও তাহলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে গিয়ে হাজির হয়ে যাও। কারণ, নাবী কারীম (ﷺ)-এর দরবারে গিয়ে কেউ তওবার সঙ্গে ক্ষমা প্রার্থনা করলে তিনি তাকে ক্ষমা করে দেন। তাকে হত্যা করেন না। যদি এ কথার উপর তুমি আস্থাশীল না হও তাহলে যেখানে খুশী গিয়ে প্রাণ রক্ষার চেষ্টা করতে পার।’’
এরপর দু’ ভাইয়ের মধ্যে পত্রালাপ চলতে থাকে এবং ক্রমে ক্রমে কা’বের নিকট পৃথিবীর পরিসর সংকীর্ণ মনে হতে থাকে। এমনকি তার নিকট নিজের জীবনের ফুল নিক্ষিপ্ত হতে দেখা গেল- এ কারণে অবশেষে সে মদীনায় আগমন করল এবং জুহাইনা গোত্রের এক ব্যক্তির মেহমান হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করল। অতঃপর তার সঙ্গে ফজরের সালাত আদায় করল। ফজরের সালাত হতে ফারেগ হওয়া মাত্রই জুহাইনা গোত্রের লোকটি তাঁকে ইঙ্গিত করলে তিনি উঠে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট উপবিষ্ট হলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে চিনতেন না। তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! কা‘ব বিন জুহাইর তওবা করে মুসলিম হয়েছেন এবং আপনার নিকট ক্ষমা ও আশ্রয় প্রার্থনা করছেন। আমি যদি তাঁকে আপনার খিদমতে হাজির করি তাহলে আপনি কি তাঁকে আশ্রয় প্রদান করবেন?
নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, ‘হ্যাঁ’
অতঃপর তিনিই বললেন, ‘আমি হচ্ছি কা‘ব বিন জুহাইর’। এ কথা শুনে একজন আনসারী সাহাবী তাকে হত্যা করার জন্য লাফ দিয়ে ওঠেন এবং তাঁর গ্রীবা কর্তন করার জন্য অনুমতি চান। নাবী কারীম (ﷺ) বললেন,
(دَعْهُ عَنْكَ، فَإِنَّهُ قَدْ جَاءَ تَائِباً نَازِعاً عَمَّا كَانَ عَلَيْهِ)
‘ক্ষান্ত হও, এ ব্যক্তি তাওবা করেছে, এবং তাওবা করার কারণে সমস্ত দোষত্রুটি থেকে সে মুক্তি লাভ করেছে।’
এ সময়েই কা‘ব বিন জুহাইর তাঁর একটি প্রসিদ্ধ কবিতা পাঠ করে নাবী কারীম (ﷺ)-কে শোনাল যার প্রথম পংক্তিটি এখানে লিপিবদ্ধ করা হল,
بانت سعاد فقلبي اليوم مَتْبُول ** مُتَيَّمٌ إثْرَهَا، لم يُفْدَ، مَكْبُول
অর্থ : ‘সু’আদ চলে গেছে, বিরহ ব্যথায় আমার অন্তর বিদীর্ণ, আমি বন্দী শৃঙ্খলাবদ্ধ আমার মুক্তিপণ দেয়া হয়নি।
এ কবিতাতেই কা‘ব রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রশংসাসহ তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে নিম্নোক্ত লাইনগুলো আবৃত্তি করেন,
نبئت أن رسول الله أوعدني ** والعفو عند رسول الله مأمول
مهلا هداك الذي أعطاك نافلة الـ ** قرآن فيها مواعيظ وتفصيل
لا تأخذن بأقوال الوشاة ولم ** أذنب، ولو كثرت فيَّ الأقاويل
لقد أقوم مقاما ما لو يقوم به ** أرى وأسمع ما لو يسمع الفيل
لظل يرعد إلا أن يكون له ** من الرسول بإذن الله تنويل
حتى وضعت يميني ما أنازعه ** في كف ذي نقمات قيله القيل
فلهو أخوف عندي إذ أكلمه ** وقيل: إنك منسوب ومسئول
من ضيغم بضراء الأرض مخدرة ** في بطن عثر غيل دونه غيل
إن الرسول لنور يستضاء به ** مهند من سيوف الله مسلول
অর্থ : আমি সংবাদ পেয়েছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে ধমক দিয়েছেন, কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট ক্ষমার আশা করা হয়। আপনি অপেক্ষা করুন। যে আল্লাহ আপনাকে হিদায়াতপূর্ণ কুরআন দিয়েছেন, তিনি আপনাকে হিদায়াতের কাজে সাফল্য দান করুন। (নিন্দুকদের কথায়, কান দিবেন না) যদিও আমার সম্পর্কে অনেক কথাই বলা হয়েছে, কিন্তু আমি কোন অপরাধ করিনি। আমি এমন এক জায়গায় দন্ডায়মান আছি, আমি সেই কথাই শুনেছি এবং দেখেছি যে হাতীও যদি সেখানে দাঁড়ায় এবং সেই কথাগুলো শুনে তাহলে কম্পিত হবে। এ অবস্থা ব্যতীত যে তার উপর আল্লাহর অনুমতিতে রাসূল (ﷺ)-এর মেহেরবানী হয়। এমন কি আমি নিজ হাত কোন দ্বিধা ছাড়াই এমন এক সম্মানিত ব্যক্তির হাতে রেখেছি যাঁর প্রতিশোধ নেয়ার পূর্ণ ক্ষমতা রয়েছে এবং যার কথাই আসল কথা যখন আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলছি। এমতাবস্থায় আমাকে বলা যে, ‘তুমি এ কথা বলেছ এবং তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। তা তো আমার নিকট সে সিংহের চাইতেও ভয়ানক যার থাকার স্থান এমন এক উপত্যকায় অবস্থিত যা অত্যন্ত কঠিন এবং ধ্বংসাত্মক যার পূর্বেও ধ্বংস হয়ে থাকে। নিশ্চয়ই রাসূল আলোকস্বরূপ, তাঁর দ্বারা অন্ধকার দূর হয়। কোষমুক্ত হিন্দুস্থানী ধারালো তলোয়ার।
এরপর কা‘ব বিন জুহাইর কুরাইশ মুহাজিরগণের প্রশংসা করেন। কারণ, কা’বের আগমনে তাদের কোন ব্যক্তি ভাল উক্তি ছাড়া কোন মন্তব্য করে নি এবং কোন গতিভঙ্গীও পরিলক্ষিত হয়নি। কিন্তু তাদের প্রশংসা কালে আনসারদের প্রতি তিনি কটাক্ষ করেন। কারণ তাঁদের একজন তার গ্রীবা কর্তনের অনুমতি চেয়েছিল। কাজেই তিনি বললেন,
يمشون مَشْي الجمال الزُّهْرِ يعصمهم ** ضَرْبٌ إذا عَرَّد السُّودُ التَّنَابِيل
অর্থ : ওরা (কুরাইশগণ) সুশ্রী উটের ন্যায় হেলে দুলে চলেন। অসিযুদ্ধ তাদের রক্ষা করে যখন কদাকার কুৎসিত লোকেরা রাস্তা ছেড়ে পলায়ন করে।
কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর যখন তাঁর ঈমান দৃঢ় হয় তখন আনসারদের প্রশংসাসূচক একটি কবিতা আবৃত্তি করেন এবং তাঁদের ব্যাপারে তাঁর যে ত্রুটি হয়েছিল তার তিনি সংস্কার করে নেন। এ কবিতাটি নিম্নে লিপিবদ্ধ করা হল :
من سره كَرَمُ الحــياة فلا يَزَلْ ** في مِقْنَبٍ من صالحي الأنصار
ورثوا المكارم كابراً عن كـابر ** إن الخـيار هـم بنـو الأخيار
অর্থ : ভদ্রোচিত জীবন যাপন যার পছন্দনীয় হয় তিনি সর্বদাই সৎ সাহায্যকারীদের দলভুক্ত হয়ে থাকেন। তার ভাল স্বভাবগুলো পিতা এবং পূর্বের পিতৃপুরুষগণের নিকট হতে প্রাপ্ত হয়েছে। প্রকৃতই ভাল লোক ভাল লোকেরই সন্তান হয়।
৬. উযরাহ প্রতিনিধি দল (وَفْدُ عُذْرَة):
এ প্রতিনিধি দল ৯ম হিজরীতে মদীনায় আগমন করেন। এ দলের সদস্য সংখ্যা ছিল বার জন। এদের মধ্যে হামযাহ বিন নু’মানও ছিলেন। তাঁদের উৎস সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হলে দলনেতা বলেন যে, তাঁরা বনু উযরাহর অন্তর্ভুক্ত কুসাই গোত্রের বৈমাত্রেয় ভাই। আমরাই কুসাই’র সমর্থন দান করে বনু বাকর এবং বনু খুযা’আহ গোত্রকে মক্কা হতে বহিস্কার করেছিলাম। এদের সঙ্গে আমাদের আত্মীয়তা সম্পর্ক আছে। এ প্রেক্ষিতে নাবী কারীম (ﷺ) তাঁদের স্বাগত জানালেন এবং শাম দেশ বিজয় করার সুসংবাদ দিলেন। তিনি গণক মহিলাদেরকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার ব্যাপারে তাঁদের নিষেধ করলেন এবং তাঁদেরকে সে সব যবেহ থেকে নিষেধ করলেন যা তাঁরা (মুশরিক থাকা কালীন) যবেহ করতেন। এ দলটি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং কয়েকদিন অবস্থান করার পর নিজ গোত্রের নিকট ফিরে যান।
৭. বালী প্রতিনিধি দল (وَفْدُ بَلِي):
৯ম হিজরীর রবিউল আওয়াল মাসে এ দলটি মদীনায় আগমন করেন এবং ইসলাম গ্রহণের পর ৩ দিন সেখানে অবস্থান করেন। মদীনায় অবস্থান কালে দলের নেতা আবূ যবীর জিজ্ঞেস করেন যে, নিমন্ত্রণ করাতে কিরূপ সওয়াব আছে? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,
(نَعَمْ، وَكُلُّ مَعْرُوِفٍ صَنَعَتْهُ إِلٰى غَنِيٍّ أَوْ فَقِيْرٍ فَهُوَ صَدَقَةٌ)،
‘ধনাঢ্য কিংবা মুখাপেক্ষীদের যে কোন ভাল আচরণই করবে সেটাই সাদকা হিসেবে পরিগণিত হবে।’
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘নিমন্ত্রণের সময় সীমা কত?
নাবী কারীম (ﷺ) উত্তর দিলেন, ‘তিন দিন’।
তিনি আরও জিজ্ঞেস করলেন, ‘মালিক বিহীন হারানো ভেড়া কিংবা বকরী পেলে তার হুকুম কী? নাবী কারীম বললেন, (هِيْ لَكَ أَوْ لِأَخِيْكَ أَوْ لِلذِّئْبِ) ‘তা তোমার কিংবা তোমার ভাইয়ের জন্য হবে অথবা বাঘের খোরাক হবে।’ এরপর তিনি হারানো উট সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, (مَالَكَ وَلَهُ؟ دَعْهُ حَتّٰى يَجِدَهُ صَاحِبُهُ)‘এর সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক? তার মালিক প্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত ওকে ছেড়ে দিতে হবে।’
৮. সাক্বীফ প্রতিনিধি দল (وَفْدُ ثَقِيْفٍ):
তাবুক হতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রত্যাবর্তনের পর ৯ম হিজরীর রমাযান মাসে এ দলটি খিদমতে নাবাবীতে উপস্থিত হন। এ গোত্রের ইসলাম গ্রহণের পূর্বের ঘটনার গতি প্রকৃতি ছিল ৮ম হিজরীর যুল ক্বাদাহ মাসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন ত্বায়িফ যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তনের করেন তখন তাঁর মদীনায় পৌঁছার পূর্বেই এ গোত্রের সর্দার উরওয়াহ বিন মাসউদ সাক্বাফী মদীনায় আগমন করে ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর নিজ কওমের নিকট ফিরে গিয়ে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। যেহেতু তিনি তাঁর সম্প্রদায়ের নেতা ছিলেন এবং শুধু এটাই নয় যে, কওমের লোকেরা তাকে মান্য করে চলত বরং তাঁকে তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের মেয়েদের এবং মহিলাদের চাইতেও বেশী প্রিয় ভাবত। এ কারণেই তাঁর ধারণা ছিল যে, লোকেরা অবশ্যই তাঁকে অনুসরণ করে চলবে। কিন্তু যখন তিনি ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকলেন তখন সম্পূর্ণ উল্টো ফল ফলল। লোকেরা তীরের আঘাতে আঘাতে তাঁকে হত্যা করে ফেলল।
তাঁকে হত্যার পর একই অবস্থার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত হতে থাকে। কয়েক মাস অতিবাহিত হওয়ার পর এটা তাদের নিকট সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পার্শববর্তী অঞ্চলসমূহের যারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন তাঁদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকার ক্ষমতা তাদের নেই। সুতরাং অবস্থার প্রেক্ষিতে আলাপ আলোচনা ও সলাপরামর্শের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে একজন লোক পাঠানোর সিদ্ধান্ত তারা গ্রহণ করল এবং এ কাজের জন্য আবদে ইয়ালিল বিন ‘আমরকে মনোনীত করল কিন্তু এ কাজের জন্য সে প্রথমাবস্থায় রাজি হল না। তার আশঙ্কা ছিল যে, তার সঙ্গেও সে আচরণ করা হতে পারে যা উরওয়া বিন মাসউদ সাকাফীর সঙ্গে করা হয়েছিল। এ কারণে তিনি বললেন, ‘আমার সঙ্গে আরও কিছু সংখ্যক লোক না পাঠালে আমার পক্ষে একাজ করা সম্ভব নয়।’
লোকেরা তাঁর এ দাবী মেনে নিয়ে তাঁর সঙ্গে সাহায্যকারীদের মধ্য হতে দু’জনকে এবং বনু মালিক গোত্রের মধ্য হতে তিনজনকে তাঁর সঙ্গে দিল। কাজেই, তাঁকে সহ মোট ছয় জনের সমন্বয়ে দলটি গঠিত হল। এ দলে উসমান বিন আবিল আস সাক্বাফীও ছিলেন যিনি ছিলেন বয়সে সর্বকনিষ্ঠ।
যখন তাঁরা খিদমতে নাবাবীতে গিয়ে উপস্থিত হলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁদের জন্য মসজিদের এক কোণে একটি তাঁবু খাটিয়ে দিলেন। যাতে তাঁরা কুরআন শ্রবণ করতে এবং সাহাবীগণ (রাঃ)-কে সালাতরত অবস্থায় দেখতে পারেন। অতঃপর তাঁরা নাবী কারীম (ﷺ)-এর নিকট যাতায়াত করতে থাকেন এবং তিনি তাঁদেরকে ইসলামের প্রতি আহবান জানাতে থাকেন। অবশেষে তাঁদের নেতা প্রস্তাব করলেন যে, নাবী কারীম (ﷺ) তাঁর নিজের এবং সাক্বীফ গোত্রের মধ্যে এমন একটি সন্ধি চুক্তি সম্পাদন করে দেবেন যার মধ্যে ব্যভিচার, মদ্যপান এবং সুদ খাওয়ার অনুমতি থাকবে। অধিকন্তু, তাদের উপাস্য লাত বিদ্যমান থাকবে, তাদের জন্য সালাত মাফ করে দিতে হবে এবং তাদের মূর্তিগুলোকে বিনষ্ট করা হবে না। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁদের অযৌক্তিক দাবীসমূহের কোনটিকেই মেনে নিতে পারলেন না। অতএব তাঁরা নির্জনে নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করতে থাকলেন, কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আত্মসমর্পণ করা ছাড়া তাঁরা কোন উপায় স্থির করতে পারলেন না। অবশেষে তাঁরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আত্মসমর্পণ করে ইসলাম গ্রহণ করলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে তাঁরা একটি শর্ত আরোপ করলেন এবং তা হচ্ছে তাঁদের মূর্তি লাতকে বিনষ্ট করার ব্যাপারে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। সাক্বীফ গোত্রের লোকেরা কখনই নিজ হাতে তা ধ্বংস করবে না। উসমান বিন আবিল আস সাকাফীকে তাঁদের দলের নেতা মনোনীত করে দিলেন। কারণ, ইসলাম সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ এবং দ্বীন ও কুরআনের শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপারে তিনি ছিলেন সব চাইতে উৎসাহী এবং অগ্রণী। এর কারণ ছিল দলের সদস্যগণ প্রত্যহ সকালে যখন খিদমতে নাবাবীতে উপস্থিত হতেন তখন উসমান বিন আবিল আস শিবিরে থাকতেন। অতঃপর দলের লোকেরা যখন দুপুর বেলা শিবিরে ফিরে এসে বিশ্রাম গ্রহণ করতেন তখন উসমান বিন আবিল আস রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে কুরআন পাঠ করতেন এবং দ্বীনের কথাবার্তা জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। তিনি যখন নাবী কারীম (ﷺ)-কে বিশ্রামের অবস্থায় পেতেন তখন আবূ বকরের খিদমতে গিয়ে হাজির হতেন। উসমান বিন আবিল আসের নেতৃত্ব অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মৃত্যুবরণ করার সময়ের পর আবূ বাকর (রাঃ)-এর খিলাফতকালে যখন নব্য মুসলিমগণের মধ্যে ধর্মত্যাগের হিড়িক পড়ে যায় তখন সাক্বীফ গোত্রের লোকেরা ধর্মত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তখন উসমান বিন আবিল ‘আস (রাঃ) সকলকে সম্বোধন করে বলল,
(يَا مَعْشَرَ ثَقِيْفٍ، كُنْتُمْ آخِرُ النَّاسِ إِسْلَاماً، فَلَا تَكُوْنُوْا أَوَّلُ النَّاسِ رِدَّةً، فَامْتَنِعُوْا عَنْ الرِّدَّةِ، وَثَبِّتُوْا عَلَى الْإِسْلَامِ)
‘হে সাক্বীফ গোত্রের লোকজনেরা! তোমরা সকলের শেষে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছ। এখন স্বধর্ম ত্যাগ করলে সকলের পূর্বেই তোমরা স্বধর্ম ত্যাগী, তোমরা এভাবে স্বধর্ম ত্যাগ করো না।’ এ কথা শ্রবণের পর ধর্মত্যাগের চিন্তা পরিহার করে তাঁরা ইসলামের উপর সুদৃঢ় থাকেন।
যাহোক, দলের লোকেরা নিজ গোত্রীয় লোকজনদের নিকট ফিরে আসার পর তাঁদের প্রকৃত অবস্থা গোপন রেখে ভবিষ্যত লড়াইয়ের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে চিন্তান্বিত ও দুঃখিত হয়ে বলল যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘তোমরা ইসলাম গ্রহণ এবং ব্যভিচার, মদ ও সুদ পরিত্যাগ কর, অন্যথায় তোমাদের বিরুদ্ধে ভীষণ যুদ্ধ আরম্ভ করা হবে।’ এ কথা শ্রবণের পর প্রথমাবস্থায় সাক্বীফ গোত্রের লোকদের মধ্যে জাহেলিয়াত যুগের অহমিকা প্রাবল্য লাভ করে এবং দু’ তিন দিন যাবত তাঁরা যুদ্ধের কথাই চিন্তাভাবনা করতে থাকেন। কিন্তু এর পর আল্লাহ তাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করে দেন, যার ফলে পুনরায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট লোক পাঠিয়ে তাঁর সমস্ত শর্ত মেনে নেয়ার চিন্তা ভাবনা করতে থাকেন। পরিস্থিতি অনুকূল হওয়ায় প্রতিনিধিদল প্রকৃত বিষয় প্রকাশ করে এবং যে সকল কথার পর উপর সন্ধি হয়েছিল তা সুস্পষ্টভাবে বলে। সব কিছু অবগত হওয়ার পর সাক্বীফ গোত্রের লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করেন।
এদিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) লাত মূর্তিটি ভেঙ্গে ফেলার উদ্দেশ্যে খালিদ বিন ওয়ালীদের নেতৃত্বে কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবীর সমন্বয়ে গঠিত একটি দলকে প্রেরণ করেন। মুগীরা বিন শু‘বা দাঁড়িয়ে লৌহ নির্মিত গদা বিশেষ উত্তোলন করলেন এবং তাঁর সঙ্গীদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘আল্লাহর শপথ! আমি আপনাদের জন্য সাক্বীফদের সম্পর্কে একটু হাসির ব্যবস্থা করব।
অতঃপর লাতের উপর গুর্জ দ্বারা আঘাত করলেন এবং নিজেই মাটির উপর লুটিয়ে পড়লেন এবং পায়ের গোড়ালি দ্বারা মাটিতে আঘাত করতে থাকলেন। এ উদ্ভট দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে ত্বায়িফবাসীদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার হল। তারা বলতে লাগল ‘আল্লাহ মুগীরাকে ধ্বংস করুক’। লাত দেবী তাকে হত্যা করেছে’। এমন সময় মুগীরা লাফ দিয়ে উঠে বললেন, ‘আল্লাহ তোমাদের মন্দ করুন। এ তো হচ্ছে মাটি এবং পাথরের তৈরি একটি মূর্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। অতঃপর তিনি দরজার উপর আঘাত করেন এবং তা ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলেন। এর পর সব চাইতে উঁচু দেয়ালের উপর ওঠেন, তাঁর সঙ্গে আরও কয়েক সাহাবীও ওঠেন। অতঃপর তা ভেঙ্গে মাটির সমতল করে ফেলেন। এমনকি ভিত পর্যন্ত উঠিয়ে ফেলেন এবং অলঙ্কার ও পোশাকাদি বাহির করে ফেলেন। সাক্বীফ গোত্রের লোকেরা শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় এ সব কাজকর্ম প্রত্যক্ষ করেন। খালিদ (রাঃ) অলংকার ও পোশাকাদিসহ নিজ দলের সঙ্গে মদীনায় ফিরে আসেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) লাতের মন্দির থেকে আনীত দ্রব্যাদি বন্টন করে দেন এবং নাবী (ﷺ)-এর সাহায্য এবং দ্বীনের সম্মানের জন্য আল্লাহর প্রশংসা করেন।[1]
[1] যাদুল মা‘আদ ৩য় খন্ড ২৬-২৮ পৃঃ। ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৫৩৭-৫৪২ পৃঃ।
৯. ইয়ামান সম্রাটের পত্র (رِسَالَةُ مُلُوْكِ الْيَمَنِ) :
তাবুক হতে নাবী কারীম (ﷺ)-এর প্রত্যাবর্তনের পর হিমইয়ার সম্রাট অর্থাৎ হারিস বিন আবদে কুলাল, না’ঈম বিন আবদে কুলাল, নু’মান এবং যূ রু’ঈন, হামদান ও মু’আফিরের অধিনায়কের পত্র আসে। পত্রবাহক ছিলেন মালিক বিন মুররাহ রাহাভী। ঐ সম্রাটগণ ইসলাম গ্রহণ এবং শিরক্ ও শিরককারী হতে বিচ্ছিন্নতা অবলম্বনের সংবাদাদিসহ পত্র প্রেরণ করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁদের পত্রের উত্তরে পত্র লিখে ঈমানদারদের প্রাপ্য এবং দায়িত্ব সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন। এ পত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অঙ্গীকারাবদ্ধদের জন্য শর্ত সাপেক্ষে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর অঙ্গীকারাবদ্ধদের জন্য শর্ত সাপেক্ষ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর দায়িত্বের কথা উল্লেখ করেন। এতে শর্ত ছিল তাঁরা যথারীতি কর পরিশোধ করবেন। অধিকন্তু, নাবী কারীম (ﷺ) কতিপয় সাহাবা (রাঃ)-কে ইয়ামানে প্রেরণ করেন। মু’আয বিন জাবালকে এ দলের আমীর নিযুক্ত করেন।
তাঁকে ‘আদন’ এর দিকে ‘সাকূন ও সাকাসিক’ এর নামক উঁচু অঞ্চলের দায়িত্ব প্রদান করেন। তিনি ‘হূরূব’এর ক্বাযী ও বিচারক এবং যাকাত ও যিযিয়াহ উসূলকারী ছিলেন। তিনি তাদের সাথে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করতেন। আর আবূ মূসা আশয়ারী (রাঃ) কে ‘যুবায়দ’, ‘মারিব’, ‘যামাআ’, ‘সাহিল’ নামক নিম্নাঞ্চলের দায়িত্বে প্রেরণ করে বললেন, (يسرا ولا تعسرا, وبشرا ولا تنفرا, وتطاوعا ولا تختلفا) ‘‘সহজ করবে, কঠিন করবেনা; সুসংবাদ দিবে, ভয় দেখাবে না; আনুগত্য করবে, মতবিরোধ করবেনা।’’ মু’আয (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মৃত্যু অবধি ইয়ামানে অবস্থান করেন আর আবূ মূসা আশয়ারী বিদায় হজ্জে রাসূল (ﷺ)-এর নিকট আগমন করেন।
১০. হামদান প্রতিনিধি দল (وَفْدُ هَمْدَانَ):
তাবুক যুদ্ধ হতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রত্যাবর্তনের পর ৯ম হিজরীতে এ প্রতিনিধিদল খিদমতে নাবাবীতে উপস্থিত হন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট কিছু তথ্য জানতে চাওয়ার প্রেক্ষিতে তিনি তাঁদের একটি পত্র দেন এবং মালিক বিন নামাত্বকে (রাঃ) তাঁদের নেতা এবং তাঁদের সম্প্রদায়ের যারা মুসলিম হয়েছিলেন তাঁদের গভর্ণর নিযুক্ত করেন। অবশিষ্ট অন্যান্যদের নিকট ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্য খালিদ (রাঃ)-কে প্রেরণ করেন। তিনি সেখানে ছয় মাস অবস্থান করেন এবং দাওয়াত দিতে থাকেন। কিন্তু লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করে নি। অতঃপর নাবী কারীম (ﷺ) আলী বিন আবূ ত্বালিব (রাঃ)-কে সেখানে প্রেরণ করেন এবং খালিদকে মদীনায় ফেরত পাঠানোর পরামর্শ প্রদান করেন।
আলী (রাঃ) হামদান গোত্রের লোকজনদের নিকট রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পত্র পাঠ করে শোনান এবং ইসলামের দাওয়াত প্রদান করেন। এর ফলে তাঁরা সকলেই ইসলাম গ্রহণ করেন। আলী (রাঃ)-এর নিকট থেকে তাঁদের ইসলাম গ্রহণের সংবাদ প্রাপ্ত হয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সিজদায় পতিত হন। অতঃপর মাথা উঠিয়ে বলেন,
(السَّلَامُ عَلٰى هَمْدَانَ، السَّلَامُ عَلٰى هَمْدَانَ)
‘হামদানের উপর শান্তি বর্ষিত হোক , হামদানের উপর শান্তি বর্ষিত হোক।’
১১. বনু ফাযারাহর প্রতিনিধি দল (وَفْدُ بَنِيْ فَزَارَة):
তাবুক হতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রত্যাবর্তনের পর এ প্রতিনিধিদল ৯ম হিজরীতে মদীনায় আগমন করেন। এ দলের সদস্য সংখ্যা ছিল দশ জনের অধিক। এরা সকলেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা তাঁদের অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের কথা বলায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মিম্বরের উপর পদার্পণ করলেন এবং দু’ হাত তুলে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করলেন। তিনি আল্লাহর সমীপে আরয করলেন,
(اللهم اَسْقِ بِلَادَكَ وَبَهَائِمِكَ، وَانْشُرْ رَحْمَتَكَ، وَأَحْيِ بَلَدَكَ الْمَيِّتِ، اللهم اَسْقِنَا غَيْثاً مُغِيْثاً، مَرِيْئًا مَرِيْعاً، طَبَقاً وَاسِعاً، عَاجِلاً غَيْرَ آجِلٍ، نَافِعاً غَيْرَ ضَارٍّ، اللّٰهُمَّ سُقْيًا رَحْمَةٌ، لَا سُقْيًا عَذَابٌ، وَلَاهَدْمَ وَلَا غَرَقَ وَلَا مَحْقَ، اللّٰهُمَّ اَسْقِنَا الْغَيْثَ، وَانْصُرْنَا عَلَى الْأَعْدَاءِ)
‘হে আল্লাহ! তোমার রহমত ধারা বর্ষণ ও বিস্তৃত করে তোমার সৃষ্টিরাজিকে পরিতৃপ্তি করো এবং মৃতপ্রায় জনপদকে সঞ্জীবিত কর। হে আল্লাহ! আমাদের উপর এমন বৃষ্টি বর্ষণ কর যা আমাদের জন্য আনন্দদায়ক কল্যাণকর ও আরামদায়ক হয় এবং বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে হয়, তা যেন বিলম্বে না হয়ে শীঘ্র হয়। হে আল্লাহ! এ বৃষ্টি যেন তোমার রহমতের বৃষ্টি হয়, শাস্তিমূলক কিংবা ধ্বংসাত্মক না হয়, তা যেন আমাদের ভাসিয়ে না দেয় এবং নিশ্চিহ্ন করে না ফেলে। হে আল্লাহ! বৃষ্টিদ্বারা আমাদের পরিতৃপ্ত কর এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য কর।[1]
[1] যাদুল মা‘আদ ৩য় খন্ড ৪৮ পৃঃ।
১২. নাজরানের প্রতিনিধি দল (وَفْدُ نَجْرَانَ):
মক্কা হতে ইয়ামানের দিকে যেতে সাত দিনের দূরত্বে একটি বড় অঞ্চল ছিল, ঐ অঞ্চলটি ছিল ৭৩ পল্লী বিশিষ্ট। কোন দ্রুতগামী বাহন একদিনে পুরো অঞ্চল ভ্রমণ করতে সক্ষম হতো না। এ অঞ্চলে এক লক্ষ যোদ্ধা পুরুষ ছিল। এরা ছিল সকলেই খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারী।
নাজরানের প্রতিনিধি দল মদীনায় আগমন করেন ৯ম হিজরী সনে। এর সদস্য সংখ্যা ছিল ষাট। ২৪ জন ছিলেন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ। যার মধ্যে ৩ জন ছিলেন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। এর মধ্যে একজনের নাম ছিল আব্দুল মাসীহ। তিনি ছিলেন আক্বিব। তাঁর দায়িত্ব ছিল অধিনায়কত্ব ও রাষ্ট্র পরিচালনা। দ্বিতীয় জনের নাম ছিল আইহাম অথবা শুরাহবিল। তিনি রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিষয়াদি দেখাশোনা করতেন, উপাধি ছিল সাইয়্যিদ। তৃতীয় জন হলেন আসক্বাফ’। তার নাম ছিল আবূ হারিসাহ বিন আলক্বামাহ। তিনি ছিলেন ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক নেতা (লাট পাদরী) উপকুফ।
মদীনায় পৌঁছার পর এ দলটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। অতঃপর নাবী কারীম (ﷺ) এবং এ প্রতিনিধি দলের মধ্যে উভয় পক্ষের কিছু প্রশ্ন নিয়ে কথাবার্তা হয়। এরপর নাবী কারীম (ﷺ) তাঁদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন এবং কুরআনের কিছু অংশ পাঠ করে শোনান। কিন্তু তাঁরা ইসলাম গ্রহণ না করে পাল্টা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন- ‘আপনি মাসীহ (আঃ) সম্পর্কে কী বলছেন? তাঁদের জবাবে কিছু না বলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিরুত্তর রইলেন। অতঃপর নিম্নোক্ত আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হল:
(إِنَّ مَثَلَ عِيْسَى عِندَ اللهِ كَمَثَلِ آدَمَ خَلَقَهُ مِن تُرَابٍ ثِمَّ قَالَ لَهُ كُن فَيَكُوْنُ – الْحَقُّ مِن رَّبِّكَ فَلاَ تَكُن مِّن الْمُمْتَرِيْنَ – فَمَنْ حَآجَّكَ فِيْهِ مِن بَعْدِ مَا جَاءكَ مِنَ الْعِلْمِ فَقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ أَبْنَاءنَا وَأَبْنَاءكُمْ وَنِسَاءنَا وَنِسَاءكُمْ وَأَنفُسَنَا وأَنفُسَكُمْ ثُمَّ نَبْتَهِلْ فَنَجْعَل لَّعْنَةُ اللهِ عَلَى الْكَاذِبِيْنَ) [آل عمران:59-61]
‘আল্লাহর নিকট ঈসার অবস্থা আদামের অবস্থার মত, মাটি দ্বারা তাকে গঠন করে তাকে হুকুম করলেন, হয়ে যাও, ফলে সে হয়ে গেল। এ বাস্তব ঘটনা তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হতেই, সুতরাং তুমি সংশয়কারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। তোমার নিকট জ্ঞান আসার পর যে ব্যক্তি তোমার সাথে (ঈসার সম্বন্ধে) বিতর্ক করবে তাকে বল, ‘আসো, আমাদের পুত্রদেরকে এবং তোমাদের পুত্রদেরকে আর আমাদের নারীদেরকে এবং তোমাদের নারীদেরকে এবং আমাদের নিজেদেরকে এবং তোমাদের নিজেদেরকে আহবান করি, অতঃপর আমরা মুবাহালা করি আর মিথ্যুকদের প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষণ করি।’ [আল ‘ইমরান (৩) : ৫৯-৬১]
সকাল হলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ আয়াত সমূহের আলোকে ঈসা (আঃ) সম্পর্কে তাঁদের প্রশ্নের জবাব দেন এবং এর পর সারা দিন যাবত এ ব্যাপারে তাদের চিন্তা ভাবনা করার অবকাশ দেন। কিন্তু তাঁরা ঈসা (আঃ) সম্পর্কিত নাবী কারীম (ﷺ)-এর কথাবার্তা মেনে নিতে অস্বীকার করলেন। অতঃপর পরবর্তী দিবস সকালের কথা যেহেতু দলের সদস্য ঈসা (আঃ) সম্পর্কিত নাবী কারীম (ﷺ)-এর কথাবার্তা মেনে নিতে এবং ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন সেহেতু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁদেরকে মুবাহালার জন্য দাওয়াত দিলেন। হাসান ও হোসাইন (রাঃ) একই চাদর পরিবেষ্টিত অবস্থায় আগমন করলেন। পিছনে পিছনে যাচ্ছিলেন ফাত্বিমাহ (রাঃ)।
প্রতিনিধি দল যখন লক্ষ্য করলেন যে, প্রকৃতই নাবী (ﷺ) সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছেন তখন নির্জনে গিয়ে তাঁরা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করলেন। আকেব এবং সাইয়্যিদ একজন অপরজনকে বললেন, ‘দেখ মুবাহালা করো না। আল্লাহর কসম! তিনি যদি সত্যিই নাবী হন এবং আমরা তাঁর সঙ্গে মুলা‘আনত করি তাহলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কখনই কৃতকার্য হবে না। পৃথিবীর উপরিভাগে আমাদের একটি লোম এবং নখও ধ্বংস হতে রক্ষা পাবে না। অবশেষে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে এ ব্যাপারে বিচারক নির্ধারণ করা হোক ।
কাজেই তাঁরা নাবী কারীম (ﷺ)-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করলেন যে, ‘আপনি যে দাবী করবেন আমরা তার মানার জন্য প্রস্তুত থাকব।’ এ প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁদের নিকট থেকে কর গ্রহণের স্বীকৃতি প্রদান করেন এবং তাঁদের দুই হাজার জোড়া কাপড় প্রদানের স্বীকৃতি সাপেক্ষে সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত হয়। তাঁরা এ কাপড় প্রদান করবেন এক হাজার জোড়া রজব মাসে, এক হাজার জোড়া সফর মাসে। অধিকন্তু, এটাও স্বীকৃত হল যে, প্রতি জোড়া কাপড়ের সঙ্গে এক উকিয়া রৌপ্য (একশ বায়ান্ন গ্রাম) প্রদান করবে। এর বিনিময়ে নাবী কারীম (ﷺ) আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর জামানত প্রদান করলেন এবং দ্বীনের ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করলেন। পক্ষান্তরে তাঁরা এ আরজি পেশ করলেন যে, তাঁদের নিকট হতে কর আদায়ের জন্য নাবী কারীম (ﷺ) যেন একজন আমানতদার প্রেরণ করেন। চুক্তি মোতাবেক এ কাজের জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উম্মতের আমানতদার আবূ উবাইদাহ বিন জাররাহকে প্রেরণ করেন।
এরপর তাদের মধ্যে ইসলাম বিস্তৃতি লাভ করে। চরিত বিশারদগণের বর্ণনানুযায়ী সৈয়দ এবং আকেব নাজরানে প্রত্যাবর্তনের পর ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর নাবী কারীম (ﷺ) তাঁদের সাদকা ও কর আদায়ের জন্য আলী (রাঃ)-কে প্রেরণ করেন। এটি একটি বিদিত বিষয় যে, মুসলিমগণের নিকট থেকেই সাদকা গৃহীত হয়ে থাকে।[1]
[1] ফাতহুল বারী ৮ম খন্ড ৯৪-৯৫ পৃঃ, যাদুল মা‘আদ ৩য় খন্ড ৩৮-৪১ পৃঃ। নাজরান প্রতিনিধিদলের বিস্তারিত বিবরণে কিছু বিরোধ আছে এবং সেই কারণেই কোন কোন মুহাক্কেকীন বলেছেন যে, নাজরানের প্রতিনিধিদল মদীনায় দু’বার এসেছিলেন। কিন্তু আমরা উপরে যা বর্ণনা করেছি সেটাই অমাদের নিকট গ্রহণযোগ্য।
১৩. বনু হানীফার প্রতিনিধি দল (وَفْدُ بَنِيْ حَنِيْفَةَ):
এ প্রতিনিধিদল মদীনায় আগমন করেছিলেন ৯ম হিজরী সনে। মুসায়লামা কাযযাবসহ এ দলের সদস্য সংখ্যা ছিল ১৭ জন।[1]
মুসায়লামার বংশ পরিচয় : মুসায়লামা বিন সুমামাহ বিন কাবীর হাবীব বিন হারিস।
এ দলটি একজন আনসারী সাহাবীর বাড়িতে আশ্রিত হন। অতঃপর খিদমতে নাবাবীতে উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। তবে মুসায়লামা কাযযাব সম্পর্কে ভিন্নমুখী বর্ণনা রয়েছে। সকল বর্ণনার সারসংক্ষেপ সূত্রে বুঝা যায় যে, অধিনায়কত্বের বাসনা ও উৎকট অহংবোধের কারণে সে নাবী কারীম (ﷺ)-এর খিদমতে হাজির হয় নি। নাবী কারীম (ﷺ) প্রথমাবস্থায় অত্যন্ত নম্র ও ভদ্রোচিত আচরণের মাধ্যমে তাঁর মনোতুষ্টির চেষ্টা করেন। কিন্তু যখন তিনি অনুধাবন করেন যে ভদ্রোচিত আচরণ ফলোৎপাদক হবে না, তখন তিনি উপলব্ধি করতে সক্ষম হন যে, এর মধ্যে অনিষ্টতার সম্ভাবনা রয়েছে।
এর পূর্বে নাবী কারীম (ﷺ) স্বপ্ন দেখেছিলেন যে, পৃথিবীর ধনভান্ডার তাঁর নিকট এনে রাখা হয়েছে তার মধ্যে দুটি সোনার তৈরি বালা এসে তাঁর হাতে পড়েছে। এ দেখে নাবী কারীম (ﷺ) অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়লেন। কাজেই, ওহীর মাধ্যমে তাঁকে ঐ দু’টিতে ফুঁক দেয়ার কথা বলা হল। তিনি সে মোতাবেক তাতে ফুঁক দিলেন এবং তৎক্ষনাত তা উড়ে গেল। নাবী কারীম এভাবে এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা করলেন যে, তাঁর পরে দুই মিথ্যুকের (নিম্ন শ্রেণীর মিথ্যুক) আবির্ভাব ঘটবে। কাজেই মুসায়লামা যখন আত্মম্ভরিতার সঙ্গে বললেন যে, ‘মুহাম্মাদ যদি তাঁর পরে আমার উপর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব হাওয়ালা করে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তাহলে আমি তাঁর অনুসরণ করব।’
এ কথা শ্রবণের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর নিকট গেলেন। তখন তাঁর হাতে ছিল একটি খেজুরের শাখা এবং তাঁর মুখপাত্র হিসেবে সঙ্গী ছিলেন সাবিত বিন ক্বায়স বিন শাম্মাস (রাঃ)। মুসায়লামাহ নিজ সঙ্গীগণের মধ্যে অবস্থান করছিলেন। নাবী (ﷺ) তাঁর মাথার উপর গিয়ে দাঁড়ালেন এবং কথা বললেন।
মুসায়লামা বললেন, ‘আপনি যদি চান তাহলে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে আপনাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে ছেড়ে দিব। কিন্তু আপনার পরবর্তী অবস্থায় আমাদের জন্য আপনাকে নেতৃত্বে দানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। নাবী কারীম (খেজুরের শাখাটির প্রতি ইঙ্গিত করে)বললেন,
(لَوْ سَأَلْتَنِيْ هٰذِهِ الْقِطْعَةَ مَا أَعْطَيْتُكَهَا، وَلَنْ تَعْدُوْ أَمْرَ اللهِ فِيْكَ، وَلَئِنْ أَدْبَرْتَ لَيَعْقِرَنَّكَ اللهُ، وَاللهِ إِنِّيْ لَأَرَاكَ الَّذِيْ أُرِيْتُ فِيْهِ مَا رَأَيْتُ، وَهٰذَا ثَابِتٌ يُجِيْبُكَ عَنِّيْ)،
‘যদি তুমি আমার নিকট হতে এর অংশটুকুও চাও তবুও আমি তোমাকে তা দেব না। অথচ তুমি নিজের ব্যাপারে আল্লাহর নির্ধারিত অংশের একটুও ব্যতিক্রম করতে পারবে না। যদি তুমি পশ্চাদমুখী হও তবুও আল্লাহ তোমাকে ধ্বংস করে ছাড়বেন। আল্লাহর কসম! আমি তোমাকে সে ব্যক্তিই মনে করছি যার ব্যাপারে আমাকে স্বপ্ন দেখানো হয়েছে। আমাকে স্বপ্নে যা দেখানো হয়েছে আমার পক্ষ থেকে সাবিত বিন ক্বায়স তার বিবরণ দেবেন।’
অতঃপর তিনি সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করলেন।[2]
তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা অনুধাবন করেছিলেন ঠিক তাই হল। মুসায়লামা কাযযাব ইয়ামামা ফিরে গিয়ে প্রথমে নিজ সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করতে থাকেন। অতঃপর দাবী করেন যে, তাঁকে নাবী কারীম (ﷺ)-এর সঙ্গে নবুওয়াতের কাজে শরীক করা হয়েছে। কাজেই, সে নবুওয়াতের দাবী করতে থাকে এবং অমিল ছন্দের কবিতা রচনা করতে থাকে। নিজ সম্প্রদায়ের জন্য ব্যভিচার এবং মদ্যপান বৈধ করে দেয় এবং এসব কিছুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করে এ সাক্ষ্যও দিতে থাকে যে, নাবী মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর নাবী। এ ব্যক্তির প্রচারণার কারণে তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা তাঁকে অনুসরণ করতে থাকে। তাঁর সম্প্রদায়ের লোকজনদের মধ্যে তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তি ও মর্যাদা এত বেশী বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে থাকে যে, তাকে ইয়ামামাহর রহমান বলা হতে থাকে।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট তিনি এ মর্মে একটি পত্র লিখেন যে, ‘আপনি যে কাজে রত আছেন আমাকে সে কাজে আপনার শরীক করা হয়েছে, রাষ্ট্রের অর্ধেক আমাদের জন্য এবং অর্ধেক কুরাইশদের জন্য।’ উত্তরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, (إِنَّ الْأَرْضَ لِلهِ يُوَرِّثُهَا مَنْ يَّشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ، وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِيْنَ) ‘পৃথিবী আল্লাহর! নিজ বান্দাগণের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তিনি তার তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করেন এবং এর শেষ ফলাফল সমীহকারীদের জন্যই।[3]
ইবনু মাসউদ হতে বর্ণিত আছে যে, ইবনু নাওওয়াহাহ এবং ইবনু উসাল মুসায়লামাহর পত্র বাহক হিসেবে নাবী কারীম (ﷺ)-এর নিকট আগমন করে। নাবী কারীম (ﷺ) জিজ্ঞেস করলেন, (أَتَشْهَدَانِ أَنِّيْ رَسُوْلُ اللهِ؟) ‘তোমরা কি সাক্ষ্য দিচ্ছ যে, আমি আল্লাহর রাসূল?’ তারা বলল, ‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুসায়লামা আল্লাহর রাসূল’। নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, (آمَنْتُ بِاللهِ وَرَسُوْلِهِ، لَوْ كَنْتُ قَاتِلاً رَسُوْلاً لَقَتَلْتُكُمَا) ‘আমি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলাম। যদি কোন পত্র বাহককে হত্যা করা আমার নীতি হতো তাহলে তোমাদের দু’জনকে হত্যা করতাম।’[4]
মুসায়লামাহ কাযযাব ১০ম হিজরীতে নুবওয়াতের দাবী করেন। আবূ বাকর (রাঃ)-এর খিলাফত আমলে ইয়ামামাহ যুদ্ধে দ্বাদশ হিজরী রবিউল আওয়ালে তাকে হত্যা করা হয়। তার হত্যাকারী ছিল ওয়াহশী যে হামযাহ (রাঃ)-কে হত্যা করেছিল। নুবওয়াতের দাবীদার মুসায়লামা কাযযাবে পরিণতি হয়েছিল এই ।
নবুওয়াতের দ্বিতীয় দাবীদার ছিল আসওয়াদ ‘আনসী যে ইয়ামানে বিবাদ সৃষ্টি করে রেখেছিল। রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর ওফাত প্রাপ্তির মাত্র ২৪ ঘন্টা পূর্বে ফাইরুয (রাঃ) তাকে হত্যা করেন। অতঃপর তার সম্পর্কে নাবী কারীম (ﷺ)-এর নিকট ওহী নাজিল হয় এবং তিনি সাহাবীগণ (রাঃ)-কে তা অবহিত করেন। এরপর ইয়ামান হতে আবূ বাকর (রাঃ)-এর নিকট নিয়মিত সংবাদ আসতে থাকে।[5]
[1] ফাতহুল বারী ৮ম খন্ড ৮৭ পৃঃ।
[2] সহীহুল বুখারী বনু হানীফা এবং আসওয়াদ আনাসীর অধ্যায় ২য় খন্ড ৬২৭-৬২৮ পৃঃ, এবং ফতুহুল বারী ৮ম খন্ড ৮৭-৯৩ পৃঃ।
[3] যাদুল মা‘আদ ৩য় খন্ড ৩১-৩২ পৃঃ।
[4] মুসনাদে আহমাদ, মিশকাত ২য় খন্ড ৩৪৭ পৃঃ।
[5] ফাতহুল বারী ৮ম খন্ড ৯৩ পৃঃ।
১৪. বনু ‘আমির বিন সা’সার প্রতিনিধি দল (وَفْدُ بَنِيْ عَامِرِ بْنِ صَعْصَعَة):
এ প্রতিনিধি দলে আল্লাহর শত্রু ‘আমির বিন তুফাইল, লাবীদের বৈমাত্রেয় ভাই আরবাদ বিন কায়স, খালিদ বিন জা’ফার এবং জাব্বার বিন আসলাম অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরা ছিল নিজ কওমের নেতা এবং শয়তান গোছের লোক। ‘আমির বিন তুফাইল ছিল সে ব্যক্তি যে, ‘বীরে মাউনাহ’তে সত্তর জন্য সাহাবীগণকে (রাঃ) শহীদ করিয়েছিল। এরা যখন মদীনায় আসার ইচ্ছা করল তখন ‘আমির এবং আরবাদ দু’ জনে মিলে ষড়যন্ত্র করল যে, প্রতারণার মাধ্যমে তারা নাবী কারীম (ﷺ)-কে হত্যা করবে। কাজেই, যখন তারা দলবদ্ধভাবে মদীনায় পৌঁছল তখন ‘আমির নাবী কারীম (ﷺ)-এর কথোপকথন আরম্ভ করল এবং আরবাদ পাশ কাটিয়ে নাবী কারীম (ﷺ)-এর পিছন দিকে গিয়ে দাঁড়াল। অতঃপর সে তার তলোয়ার খানা কোষমুক্ত করার চেষ্টা করল। কিন্তু কোষ হতে তলোয়ার খানা একটু বাহির হওয়ার পর আর বের হল না। এভাবে আল্লাহ তাঁর নাবী (ﷺ)-কে হেফাযত করলেন।
নাবী কারীম (ﷺ) তাদের বিরুদ্ধে বদ দু’আ করলেন। যার ফলে তাদের প্রত্যাবর্তনের প্রাক্কালে আল্লাহ তা’আলা আরবাদ এবং তার উটের উপর বিজলী নিক্ষেপ করেন যাতে আরবাদ দগ্ধ হয়ে মৃত্যু বরণ করে। এদিকে ‘আমির এক সালুলিয়া মহিলার নিকট অবতরণ করল। সে সময় তার গ্রীবাদেশে একটি ফোঁড়া ওঠে এবং তার ফলে তার অবস্থার দারুন অবনতি ঘটায়। সে মৃত্যুবরণ করে। মৃত্যুর সময় সে বলতে থাকে ‘আপসোস! উটের ফোঁড়ার ন্যায় ফোঁড়া এবং একজন সালুলিয়া মহিলার ঘরে মৃত্যু?’
সহীহুল বুখারীতে বর্ণিত আছে যে, নাবী কারীম (ﷺ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে ‘আমির বলল, ‘আমি আপনাকে তিনটি কথার অধিকার দিচ্ছি,
আপনার জন্য থাকবে উপত্যকার লোকজন আর আমার জন্য থাকবে জনবসতি।
অথবা আপনার পরে আমি হব খলীফা।
অন্যথায় আমি গাত্বাফানদের দ্বারা এক হাজার ঘোটক এবং এক হাজার ঘোটকী সহ আপনার উপর আক্রমণ চালাব।
১৫. তুজাইব প্রতিনিধি দল (وَفْدُ تُجِيْب):
এ প্রতিনিধি দলটি নিজ কওমের সাদকার অর্থ যা ফকীরদের দেওয়ার পর অতিরিক্ত ছিল তা নিয়ে মদীনায় আগমন করেছিল। এ দলে ১৩ জন লোক ছিল, যারা কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করত এবং শিক্ষা গ্রহণ করত। তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে কতগুলো কথা জিজ্ঞেস করে। তখন তিনি তাদেরকে সেগুলো লিখে দেন। মদীনায় স্বল্পকাল অবস্থান করে। যখন নাবী কারীম (ﷺ) তাদেরকে উপঢৌকন দ্বারা পুরস্কৃত করেন তখন তারা নিজেদের এক যুবককেও প্রেরণ করে। এ যুবককে তারা শিবিরে রেখে এসেছিল। যুবক খিদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করল, ‘হে রাসূলুল্লাহ! আল্লাহর কসম! আমাকে আমার অঞ্চল থেকে এছাড়া অন্য কোন বস্তু টেনে আনেনি যে, আপনি আমার জন্য আল্লাহ তা‘আলার সমীপে প্রার্থনা করবেন যেন আল্লাহ নিজ অনুগ্রহ ও রহমতের সঙ্গে আমার সম্পদ আমার অন্তরে নিহিত করে দেন। নাবী কারীম (ﷺ) তার জন্য দু‘আ করলেন। এর ফল হল এ ব্যক্তি সব চাইতে অল্পে তুষ্ট হল। যখন অন্যদের উপর ধর্ম ত্যাগের ঢেউ বয়ে যেতে থাকল তখন শুধু এ ব্যক্তিই ইসলামের উপর সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত রইল এবং নিজ কওমের লোকজনদের নসীহত করতে থাকল এর ফলে তারাও ইসলামে প্রতিষ্ঠা লাভ করল। অতঃপর এ দলভুক্ত লোকজনেরা ১০ম হিজরী বিদায় হজ্জের সময় দ্বিতীয়বার রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গে সাক্ষাত করে।
১৬. ‘ত্বাই’ প্রতিনিধি দল (وَفْدُ طيِّـئ):
এ দলের সঙ্গে আরবের প্রসিদ্ধ ঘোড়সওয়ার যায়দুল খাইলও ছিলেন। তাঁরা নাবী কারীম (ﷺ)-এর সঙ্গে কথাবার্তা বলেন এবং তাঁদের সামনে ইসলাম উপস্থাপন করেন। তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেন এবং অনেক ভাল মুসলিম হয়ে যান। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যায়দ (রাঃ)-এর প্রশংসা করে বলেন,
(مَا ذُكِرَ لِيْ رَجُلٌ مِّنْ الْعَرَبِ بِفَضْلٍ، ثُمَّ جَاءَنِيْ إِلَّا رَأَيْتُه دُوْنَ مَا يُقَالُ فِيْهِ ، إِلَّا زَيْدُ الْخَيْلِ، فَإِنَّهُ لَمْ يَبْلُغْ كُلَّ مَا فِيْهِ)
‘আমাকে আরবের যে কোন লোকের প্রশংসা শুনানো হয়েছে এবং সে আমার নিকট এসেছে তখন আমি তাকে তার প্রচারকৃত প্রশংসা থেকে কম পেয়েছি। কিন্তু তার বিপরীত হচ্ছে যায়েদুল খাইল। কারণ, তাঁর খ্যাতি তাঁর প্রকৃত গুণের নিকটেই পৌঁছে নি।’
অতঃপর নাবী কারীম (ﷺ) তাঁর নাম রাখেন ‘যায়দুল খাইর’।
এমনি ভাবে ৯ম ও ১০ম হিজরীতে বিভিন্ন প্রতিনিধিদল মদীনায় আগমন করতে থাকেন। চরিতকারগণ ইয়ামান, আযদ, কুযা’আহর বনু সা‘দ, হুযাইম, বুন ‘আমির বিন ক্বায়স, বনু আসাদ, বাহরা, খাওলান, মুহারিব, বনু হারিস বিন কা‘ব, গামিদ, বনু মুনতাফিক্ব ও সালামান, বনু আবস, মুযাইনা, মুরাদ, যুবাইদ, কিন্দাহ, যূ মুররাহ, গাসসান, বুন ‘ঈশ এবং নাখ’ এর প্রতিনিধি দল সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ‘নাখ’ এর দলই ছিল শেষ দল যা ১১শ হিজরী মুহাররম মাসের মধ্যে এসেছিল। ঐ দলের সদস্য সংখ্যা ছিল দুই শত। অবিশষ্ট অন্যান্য দলগুলো আগমন করে ৯ম ও ১০ম হিজরীতে। অল্প কিছু সংখ্যক পরে একাদশ হিজরীতে আগমন করেছিল।
ওই সকল প্রতিনিধি দলের আগমন ধারা থেকেই বুঝা যায় যে, সে সময় ইমলামী দাওয়াত কতটা বিস্তার লাভ করেছিল এবং বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলামের কতটা স্বীকৃতি অর্জিত হয়েছিল। অধিকন্তু, এটাও আঁচ অনুমান করা সম্ভব যে, আরববাসীগণ মদীনাকে কী পরিমাণ সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছিল। এমন কি মদীনার নিকট মাথা নত করা ছাড়া তাদের গত্যন্তর ছিল না। প্রকৃতই মদীনা সমগ্র আরব উপদ্বীপের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। এবং মদীনাকে এড়িয়ে চলা কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না। অবশ্য সকল আরববাসীর অন্তর ইসলামের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল এমনটি বলা হয়ত সঙ্গত হবে না। কারণ, তাদের মধ্যে তখনো এমন কিছু সংখ্যক বেদুঈন ছিল যারা শুধুমাত্র তাদের নেতাদের অনুসরণে মুসলিম হয়েছিল। মুসলিম হিসেবে পরিচিতি প্রদান করলেও তাদের মধ্যে হত্যা এবং লুটতরাজের মনোভাব পূর্বের মতোই ছিল। ইসলামী আদর্শের প্রভাবে তারা ততটা প্রভাবিত হয় নি। এ প্রেক্ষিতে কুরআন কারীমের সূরাহ তাওবায় তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে,
(الأَعْرَابُ أَشَدُّ كُفْرًا وَنِفَاقًا وَأَجْدَرُ أَلاَّ يَعْلَمُوْا حُدُوْدَ مَا أَنزَلَ اللهُ عَلٰى رَسُوْلِهِ وَاللهُ عَلِيْمٌ حَكِيْمٌ وَمِنَ الأَعْرَابِ مَن يَتَّخِذُ مَا يُنفِقُ مَغْرَمًا وَيَتَرَبَّصُ بِكُمُ الدَّوَائِرَ عَلَيْهِمْ دَآئِرَةُ السَّوْءِ وَاللهُ سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ) [التوبة:97، 98]
‘বেদুঈন আরবরা কুফুরী আর মুনাফিকীতে সবচেয়ে কঠোর, আর আল্লাহ তাঁর রসূলের প্রতি যা অবতীর্ণ করেছেন তার সীমারেখার ব্যাপারে অজ্ঞ থাকার তারা অধিক উপযুক্ত, আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, মহা প্রজ্ঞাবান। কতক বেদুঈন যা তারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে তাকে জরিমানা ব’লে গণ্য করে আর তোমাদের দুঃখ মুসিবতের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে, মন্দের চক্র তাদেরকেই ঘিরে ধরুক। আর আল্লাহ তো সব কিছুই শুনেন, সব কিছু জানেন।’ [আত্-তাওবাহ (৯) : ৯৭-৯৮]
আবার কিছু লোকের সুনামও করা হয়েছে। তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে,
(وَمِنَ الأَعْرَابِ مَن يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَيَتَّخِذُ مَا يُنفِقُ قُرُبَاتٍ عِندَ اللهِ وَصَلَوَاتِ الرَّسُوْلِ أَلا إِنَّهَا قُرْبَةٌ لَّهُمْ سَيُدْخِلُهُمُ اللهُ فِيْ رَحْمَتِهِ إِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ) [ التوبة:99].
‘কতক বেদুঈন আল্লাহতে ও শেষ দিবসে বিশ্বাস করে আর তারা যা আল্লাহর পথে ব্যয় করে তাকে তারা আল্লাহর নৈকট্য ও রসূলের দু‘আ লাভের মাধ্যম মনে করে, সত্যিই তা তাদের (আল্লাহর) নৈকট্য লাভের মাধ্যম, অচিরেই আল্লাহ তাদেরকে তাঁর রহমাতের মধ্যে প্রবিষ্ট করবেন, অবশ্যই আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু।’ [আত্-তাওবাহ (৯) : ৯৯]
যতদূর পর্যন্ত মক্কা, মদীনা, সাকাফ, ইয়ামান ও বাহরায়েন অধিকাংশ শহরের অধিবাসীদের সম্পর্ক বিস্তৃত ছিল তাঁদের মধ্যে ইসলাম পূর্ণরূপে পরিপক্কতা লাভ করেছিল এবং তাঁদের মধ্য হতেই প্রখ্যাত সাহাবীগণ (রাঃ) এবং নেতৃস্থানীয় মুসলিমগণের আবির্ভাব ঘটেছিল।[1]
[1] এ কথা বলেছেন খুযরী মোহাযারাতে, ১ম খন্ড ১৪৪ পৃঃ, এবং যে সকল প্রতিনিধি দলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে অথবা যার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্রষ্টব্য বুখারী ১ম খন্ড ১৩ পৃঃ, ২য় খন্ড ৬২৬-৬৩০ পৃঃ, ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৫০১-৫০৩ পৃঃ, ৫১০-৫১৪ পৃঃ, ৫৩৭-৫৪২ পৃ: ৫৬০-৬০১ পৃঃ, যাদুল মা‘আদ ৩য় খন্ড ২৬-৬০ পৃঃ, ফাতহুল বারী ৮ম হিজরী ৮৩-১০৩ পৃঃ, রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ১৮৪-২১৭ পৃঃ।