বনু মুসত্বালাক্ব যুদ্ধের পূর্বে মুনাফিক্বদের রীতিনীতি
ইতোপূর্বে একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, মদীনায় সাধারণভাবে মুসলিমগণের এবং বিশেষ করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আগমনের ব্যাপারটি আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের যথেষ্ট মনোবেদনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কেননা, আউস এবং খাযরাজ এ দু’ গোত্রের নেতৃত্বের পদে তাঁকে বরণ করে নেয়ার জন্য যখন মুকুট তৈরি হচ্ছিল এমন এক ক্রান্তি লগ্নে তখন মদীনায় ইসলামের আলোক পৌঁছায় জনগণের মনোযোগ আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের পরিবর্তে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দিকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট হল। এ কারণে এ ধারণাটি তার মনে বদ্ধমূল হয়ে গেল যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-ই তাকে তার এ মান-সম্মান থেকে বঞ্চিত করেছেন।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি তার এ বিদ্বেষমূলক মনোভাব এবং মনোকষ্ট হিজরতের প্রথম অবস্থাতেই সূচিত হয় এবং বেশ কিছুকাল যাবৎ তা অব্যাহত থাকে। কারণ, তখনো সে ইসলাম গ্রহণ করে নি। তার ইসলাম গ্রহণের পূর্বেকার একটি ঘটনা থেকে এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়ে যায়। সা‘দ বিন উবাদার অসুস্থতার খবর পেয়ে তাঁকে দেখার জন্য একদা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) গাধার পিঠে আরোহিত অবস্থায় পথ চলছিলেন, এমনি সময়ে আব্দুল্লাহ বিন উবাইসহ কতগুলো লোক পথের ধারে আলাপ আলোচনায় রত ছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে পথ চলতে দেখে সে তার নাকে কাপড় চাপা দিয়ে বলল, ‘আমাদের উপর ধূলোবালি উড়িয়ো না।’
অতঃপর রাসূলে কারীম (ﷺ) যখন উপস্থিত লোকজনদের নিকট কুরআন শরীফ থেকে তিলাওয়াত করলেন তখন সে বলল, ‘আপনি আপন ঘরে বসেই এ সব করুন। এ সবের মধ্যে আমাদের জড়াবেন না।’[1]
কিন্তু বদর যুদ্ধে মুসলিমগণের অসামান্য সাফল্য প্রত্যক্ষ করার পর যখন ব্যাপারটি তার নিকট পরিস্কার হয়ে গেল যে মুসলিমগণের বিরুদ্ধাচরণ করা খুবই বিপদজনক হবে তখন সে ইসলাম গ্রহণ করল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এবং মুসলিমগণের শত্রুই রয়ে গেল। ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটি ছিল তার একটি বাহ্যিক প্রকাশ মাত্র। গোপনে গোপনে সে ইসলামী সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং ইসলামের দাওয়াতী ব্যবস্থাকে দুর্বল করার জন্য অব্যাহতভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। শুধু তাই নয়, ইসলামের শত্রুদের সঙ্গেও সে ঘনিষ্ট সহযোগিতা ও আঁতাত গড়ে তুলতে থাকে। এক্ষেত্রে বনু ক্বায়নুক্বার ঘটনাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বনু ক্বায়নুক্বার ব্যাপারে সে অত্যন্ত বিবেকহীনতার পরিচয় দিয়েছিল (ইতোপূর্বে বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। একইভাবে সে উহুদের যুদ্ধেও শঠতা, অঙ্গীকার ভঙ্গ, মুসলিমগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি, তাদের কাতারে অশান্তি, বিশৃঙ্খলা ও ব্যাকুলতা সৃষ্টির প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিল (এ বিষয়টিও পূর্বে আলোচিত হয়েছে)।
এ মুনাফিক্ব (কপট) ব্যক্তিটি নানা ছল-চাতুরী-প্রতারণা ও ধূর্ততার মাধ্যমে রাসূলুলাহ (ﷺ)-এর বিরুদ্ধাচরণ করতেই থাকত। প্রত্যেক জুমআর দিনে খুৎবা দানের উদ্দেশ্যে তিনি যখন আগমন করতেন তখন সে অযাচিতভাবে দাঁড়িয়ে গিয়ে জনতাকে লক্ষ্য করে বলত, ‘হে লোক সকল! তোমাদের মাঝে এ ব্যক্তি হচ্ছেন আল্লাহর রাসূল (ﷺ)। এর মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদেরকে মান সম্মান ও ইজ্জত দান করেছেন। অতএব, তোমরা তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে। তোমরা তাঁর হাতকে শক্তিশালী করবে এবং তাঁর কথা মেনে চলবে।’ -এ সকল অযাচিত ও অর্থহীন কথাবার্তার পর সে বসে পড়ত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর পর উঠে দাঁড়িয়ে খুৎবা দান করতেন।
এভাবে তার ঔদ্ধত্য, অন্যায় আচরণ এবং নির্লজ্জতা চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছল উহুদ যুদ্ধের পর যখন জুমু‘আর দিন উপস্থিত হল। কেননা, এ যুদ্ধের সময় অনন্ত শঠতা, কপটতা এবং প্রতারণামূলক ভূমিকা পালনের পরেও খুৎবার পূর্বে সে দাঁড়িয়ে সে সব কথার পুনরাবৃত্তি করতে থাকল যা ইতোপূর্বে সে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলেছিল। কিন্তু এবার উপস্থিত মুসলিম জনতা নির্বিবাদে তার এ সব কথা মেনে নিতে পারল না। চতুর্দিক থেকে তারা তার কাপড় টেনে ধরে বলল, ‘ওহে আল্লাহর শত্রু, বসে পড়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তুমি যে ভূমিকা পালন করেছ তারপর তুমি এর যোগ্য নও।’
বিক্ষুব্ধ লোকজনদের প্রতিবাদে সে বকবক করতে করতে মসজিদ পরিত্যাগ করল। মসজিদ পরিত্যাগকালে তার কণ্ঠ-নিঃসৃত এ প্রলাপ বাক্যগুলো সকলের শ্রুতিগোচর হল, ‘আমি যেন এখানে কোন অপরাধী এসেছি। আমিতো তাঁরই সমর্থনে বলার জন্যই দাঁড়িয়েছিলাম।’
ভাগ্যক্রমে দরজায় একজন আনসারীর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। তিনি বললেন, ‘তোমার ধ্বংস হোক ! ফিরে চল! রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তোমার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করে দিবেন। সে বলল, ‘আল্লাহর শপথ! আমি চাই না যে, তিনি আমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন।’
এছাড়াও, ইবনু উবাই বনু নাযীর গোত্রের সঙ্গেও গোপনে অাঁতাতের মাধ্যমে মুসলিমগণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আসছিল।
আল-কুরআনের ভাষায় তাদেরকে বলা হয়েছিল :
(لَئِنْ أُخْرِجْتُمْ لَنَخْرُجَنَّ مَعَكُمْ وَلَا نُطِيْعُ فِيْكُمْ أَحَدًا أَبَدًا وَإِن قُوْتِلْتُمْ لَنَنصُرَنَّكُمْ) [ الحشر: 11]
‘তোমরা যদি বহিস্কৃত হও, তাহলে অবশ্য অবশ্যই আমরাও তোমাদের সাথে বেরিয়ে যাব, আর তোমাদের ব্যাপারে আমরা কক্ষনো কারো কথা মেনে নেব না। আর যদি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়, তাহলে আমরা অবশ্য অবশ্যই তোমাদেরকে সাহায্য করব।’ [আল-হাশর (৫৯) : ১১]
অনুরূপভাবে খন্দকের যুদ্ধেও সে মুসলিমগণের মধ্যে বিশৃঙ্খলা, চাঞ্চল্য ও ভীতি সঞ্চারের জন্য নানা কূট কৌশল প্রয়োগ করেছিল। আল্লাহ তা‘আলা সূরাহ আহযাবের নিম্ন বর্ণিত আয়াত সমূহে সে সম্পর্কে আলোচনা করেছেন :
(وَإِذْ يَقُوْلُ الْمُنَافِقُوْنَ وَالَّذِيْنَ فِيْ قُلُوْبِهِمْ مَرَضٌ مَا وَعَدَنَا اللهُ وَرَسُوْلُهُ إِلَّا غُرُوْراً – وَإِذْ قَالَتْ طَائِفَةٌ مِنْهُمْ يَا أَهْلَ يَثْرِبَ لَا مُقَامَ لَكُمْ فَارْجِعُوْا وَيَسْتَأْذِنُ فَرِيْقٌ مِنْهُمُ النَّبِيَّ يَقُوْلُوْنَ إِنَّ بُيُوْتَنَا عَوْرَةٌ وَمَا هِيَ بِعَوْرَةٍ إِنْ يُرِيْدُوْنَ إِلَّا فِرَاراً – وَلَوْ دُخِلَتْ عَلَيْهِمْ مِنْ أَقْطَارِهَا ثُمَّ سُئِلُوْا الْفِتْنَةَ لَآتَوْهَا وَمَا تَلَبَّثُوْا بِهَا إِلَّا يَسِيْراً – وَلَقَدْ كَانُوْا عَاهَدُوْا اللهَ مِنْ قَبْلُ لَا يُوَلُّوْنَ الْأَدْبَارَ وَكَانَ عَهْدُ اللهِ مَسْؤُوْلاً – قُلْ لَنْ يَنْفَعَكُمُ الْفِرَارُ إِنْ فَرَرْتُمْ مِنَ الْمَوْتِ أَوِ الْقَتْلِ وَإِذاً لَا تُمَتَّعُوْنَ إِلَّا قَلِيْلاً – قُلْ مَنْ ذَا الَّذِيْ يَعْصِمُكُمْ مِنَ اللهِ إِنْ أَرَادَ بِكُمْ سُوْءاً أَوْ أَرَادَ بِكُمْ رَحْمَةً وَلَا يَجِدُوْنَ لَهُمْ مِنْ دُوْنِ اللهِ وَلِيّاً وَلَا نَصِيْراً – قَدْ يَعْلَمُ اللهُ الْمُعَوِّقِيْنَ مِنْكُمْ وَالْقَائِلِيْنَ لِإِخْوَانِهِمْ هَلُمَّ إِلَيْنَا وَلَا يَأْتُوْنَ الْبَأْسَ إِلَّا قَلِيْلاً – أَشِحَّةً عَلَيْكُمْ فَإِذَا جَاءَ الْخَوْفُ رَأَيْتَهُمْ يَنْظُرُوْنَ إِلَيْكَ تَدُوْرُ أَعْيُنُهُمْ كَالَّذِيْ يُغْشَى عَلَيْهِ مِنَ الْمَوْتِ فَإِذَا ذَهَبَ الْخَوْفُ سَلَقُوْكُمْ بِأَلْسِنَةٍ حِدَادٍ أَشِحَّةً عَلٰى الْخَيْرِ أُوْلَئِكَ لَمْ يُؤْمِنُوْا فَأَحْبَطَ اللهُ أَعْمَالَهُمْ وَكَانَ ذٰلِكَ عَلٰى اللهِ يَسِيْراً – يَحْسَبُوْنَ الْأَحْزَابَ لَمْ يَذْهَبُوْا وَإِنْ يَأْتِ الْأَحْزَابُ يَوَدُّوْا لَوْ أَنَّهُمْ بَادُوْنَ فِيْ الْأَعْرَابِ يَسْأَلونَ عَنْ أَنْبَائِكُمْ وَلَوْ كَانُوْا فِيْكُمْ مَا قَاتَلُوْا إِلَّا قَلِيْلاً-) [الأحزاب: 12-20]
‘আর স্মরণ কর, যখন মুনাফিক্বরা এবং যাদের অন্তরে রোগ আছে তারা বলছিল- আল্লাহ ও তাঁর রসূল আমাদেরকে যে ওয়া‘দা দিয়েছেন তা ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই নয়। স্মরণ কর, যখন তাদের একদল বলেছিল- হে ইয়াসরিববাসী! তোমরা (শত্রুর আক্রমণের বিরুদ্ধে) দাঁড়াতে পারবে না, কাজেই তোমরা ফিরে যাও। আর তাদের একদল এই বলে নাবীর কাছে অব্যাহতি চাচ্ছিল যে, আমাদের বাড়ীঘর অরক্ষিত, অথচ ওগুলো অরক্ষিত ছিল না, আসলে পালিয়ে যাওয়াই তাদের ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য। যদি শত্রুপক্ষ (মাদীনাহ নগরীর) চারদিক থেকে তাদের উপর আক্রমণ করতো, অতঃপর তাদেরকে কুফুরীর আহবান করা হত, তবে তারা তাই করে বসত। তাতে তারা মোটেও বিলম্ব করত না। অথচ তারা ইতোপূর্বে আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার করেছিল যে, তারা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে না। আল্লাহর সঙ্গে কৃত ওয়া‘দা সম্পর্কে অবশ্যই জিজ্ঞেস করা হবে। বল, পলায়নে তোমাদের কোনই লাভ হবে না, যদি তোমরা মৃত্যু অথবা হত্যা থেকে পলায়ন কর তাহলে তোমাদেরকে সামান্যই ভোগ করতে দেয়া হবে। বল, তোমাদেরকে আল্লাহ (’র শাস্তি) হতে কে রক্ষে করবে তিনি যদি তোমাদের অকল্যাণ করতে চান অথবা তোমাদেরকে অনুগ্রহ করতে চান? তারা আল্লাহকে ছাড়া তাদের জন্য না পাবে কোন অভিভাবক, আর না কোন সাহায্যকারী। আল্লাহ তোমাদের মধ্যে তাদেরকে নিশ্চিতই জানেন কারা বাধা সৃষ্টিকারী আর কারা নিজেদের ভাইদেরকে বলে- আমাদের কাছে এসো। যুদ্ধ তারা সামান্যই করে তোমাদের প্রতি কৃপণতার বশবর্তী হয়ে। যখন বিপদ আসে তখন তুমি দেখবে মৃত্যু ভয়ে অচেতন ব্যক্তির ন্যায় চোখ উল্টিয়ে তারা তোমার দিকে তাকাচ্ছে। অতঃপর বিপদ যখন কেটে যায় তখন ধনের লালসায় তারা তোমাদেরকে তীক্ষ্ম বাক্য-বাণে বিদ্ধ করে। এরা ঈমান আনেনি। এজন্য আল্লাহ তাদের কার্যাবলী নিস্ফল করে দিয়েছেন, আর তা আল্লাহর জন্য সহজ। তারা মনে করে সম্মিলিত বাহিনী চলে যায়নি। সম্মিলিত বাহিনী যদি আবার এসে যায়, তাহলে তারা কামনা করবে যে, যদি মরুচারীদের মধ্যে থেকে তারা তোমাদের সংবাদ নিতে পারত! তারা তোমাদের মধ্যে অবস্থান করলেও তারা যুদ্ধ সামান্যই করত।’ [আল-আহযাব (৩৩) : ১২-২০]
উল্লেখিত আয়াতসমূহে অবস্থা বিশেষে মুনাফিক্বদের চিন্তা ও ভাবধারা, কার্যকলাপ, অহংকার ও আত্মম্ভরিতা এবং সুযোগ সন্ধান ও সুবিধা সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র অংকন করা হয়েছে।
এত সব কিছু বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও ইহুদী, মুনাফিক্ব, মুশরিকগণ এক কথায় ইসলামের শত্রুগণ এটা ভালভাবেই ওয়াকেফহাল ছিল যে, মুসলিমগণের বিজয়ের কারণ প্রাকৃতিক প্রাধান্য অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত সৈন্যবাহিনী কিংবা বাহিনীর লোকজনদের সংখ্যাধিক্য নয় বরং এর প্রকৃত কারণ ছিল আল্লাহর দাসত্বকরণ এবং একনিষ্ঠ চারিত্রিক গুণাবলী অর্জন যার দ্বারা পূর্ণ ইসলামী সমাজ সংগঠন সম্ভব হয়েছিল এবং এর ফলে দ্বীন ইসলামের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি ব্যক্তি ছিলেন পরিতৃপ্ত ও নিবেদিত। তাঁরা নিজেদের ভাগ্যবানও মনে করতেন একমাত্র দ্বীনের কারণে। ইসলামের শত্রুগণ এটাও ভালভাবেই জানতে যে মুসলিমগণের অনুপ্রেরণার মূল উৎস ছিল, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সত্তা মুবারক যা মুসলিমগণের চরিত্র সম্পদ ও চরিত্র মাধূর্যের অলৌকিকত্বের চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছার ব্যাপারে ছিল সব চাইতে বড় আদর্শ।
অধিকন্তু, ইসলাম ও মুসলিমগণের শত্রুরা চার পাঁচ বছর যাবৎ শত্রুতা, হিংসা ও বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে সাধ্যমতো সব কিছু করেও যখন তারা এটা উপলব্ধি করল যে, এ দ্বীন এবং অনুসারীগণকে অস্ত্রের দ্বারা নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব নয়, তখন তারা ভিন্ন পন্থা অবলম্বনের চিন্তা-ভাবনা করতে থাকল। তাদের এ বিকল্প কৌশল হিসেবে তারা মুসলিমগণের শক্তি এবং শৌর্যবীর্যের প্রধান, চরিত্র-সম্পদের উপর আঘাত হানার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। তাদের হীন চক্রান্তের প্রথম লক্ষ্যস্থল নির্বাচন করল আল্লাহর নাবী (ﷺ)-কে। কারণ, মুনাফিক্বরা মুসলিমগণের শ্রেণীতে ছিল পঞ্চম বাহিনী। মদীনায় বসবাস করার ফলে মুসলিমগণের সঙ্গে মেলামেশার যথেষ্ট সুযোগ তাদের ছিল। এ কারণে কূট কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের অনুভূতিতে নাড়া দিয়ে সহজভাবে প্রলুব্ধ করার সুযোগও তাদের ছিল। তাদের এ জঘন্য উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার লক্ষ্যে তারা শুরু করল ব্যাপক অপপ্রচার। মুনাফিক্বগণ তাদের এ প্রচার ভিযানের দায়িত্ব নিজেই নিয়েছিল অথবা তাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আর এর নেতৃত্বের ভার স্বয়ং আব্দুল্লাহ বিন উবাই বহন করছিল।
যখন যায়দ বিন হারিসাহ (রাঃ) যায়নাবকে তালাক প্রদান করেন এবং নাবী কারীম (ﷺ) তাঁর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তখন মুনাফিক্বগণ রাসূলুল্লাহর চরিত্র সম্পর্কে কটাক্ষ করা ও অপ্রপ্রচারের একটি মোক্ষম সুযোগ পেয়ে যায়। কারণ, তৎকালীন আরবের প্রচলিত প্রথায় পোষ্য পুত্রকে প্রকৃত সন্তানের মর্যাদা ও স্থান দেয়া হতো এবং পোষ্য পুত্রের স্ত্রীকে প্রকৃত পুত্রের স্ত্রীর ন্যায় অবৈধ গণ্য করা হত। এ কারণে, নাবী কারীম (ﷺ) যখন যায়নাবকে বিবাহ করলেন তখন তারা নাবীর (ﷺ) বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা শুরু করে দিল।
যায়নাব (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিবাহ করার ব্যাপারে মুনাফিক্বগণ তাদের অপ-প্রচারের আরও যে সূত্রটি আবিষ্কার ও ব্যবহার করল তা হচ্ছে-
১. যায়নাব (রাঃ) তাঁর পঞ্চম পত্নী। তাদের প্রশ্ন ছিল, কুরআনুল কারীমে যেখানে চারটির অধিক বিবাহ করার অনুমতি দেয়া হয় নি। সেক্ষেত্রে এ বিবাহ কিভাবে বৈধ হতে পারে?
২. তাদের দ্বিতীয় প্রশ্ন, যায়নাব হচ্ছে নাবী কারীম (ﷺ)-এর ছেলের (পোষ্য পুত্রের স্ত্রী)। তৎকালীন আরবের প্রচলিত প্রথানুযায়ী এ বিবাহ ছিল অবৈধ এবং কঠিন পাপের কাজ।
এ বিবাহকে কেন্দ্র করে তারা নানা অলীক ও ভিত্তিহীন কাহিনী রচনা করে এবং জোর গুজব ছড়াতে থাকে। লোকে এমনটিও বলতে থাকে যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) জয়নবকে দেখা মাত্র তাঁর সৌন্দর্য্যে এমনভাবে আকৃষ্ট হল যে, সঙ্গে সঙ্গে উভয়ের মন দেয়া নেয়া হয়ে গেল। যায়দ এ খবর জানতে পারল তখন সে যায়নাবকে তালাক দিল।
মুনাফিক্বগণ এত জোরালোভাবে এ ঘৃণ্য কল্প কাহিনী প্রচার করতে থাকল যে, এর জের হাদীস এবং তফসীর কিতাবে এখন পর্যন্ত চলে আসছে। ঐ সময় এ সমস্ত অপ-প্রচার দুর্বল চিত্ত এবং সরলমন মুসলিমগণের অন্তরকে এমনভাবে প্রভাবিত করেছিল যে, অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা এ প্রসঙ্গে আয়াত নাযিল করেন। যার মধ্যে সন্দেহ ব্যাধিতে আক্রান্ত অন্তরসমূহের জন্য সুচিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল। প্রাসঙ্গিক আয়াতে কারীমা থেকে এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে, এ প্রচারের ব্যাপকতা কতটা বিস্তৃতি লাভ করেছিল। সূরাহ আহযাবের সূচনাই হয়েছিল এ আয়াতে কারীমা দ্বারা :
(يا أَيُّهَا النَّبِيُّ اتَّقِ اللهَ وَلَا تُطِعِ الْكَافِرِيْنَ وَالْمُنَافِقِيْنَ إِنَّ اللهَ كَانَ عَلِيْمًا حَكِيْمًاَ) [الأحزاب : 1]
‘হে নাবী! আল্লাহকে ভয় কর, আর কাফির ও মুনাফিক্বদের আনুগত্য কর না, নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞাতা, মহাপ্রজ্ঞাময়।’ [আল-আহযাব : ১]
এ আয়াতে কারীমা ছিল মুনাফিক্বদের কার্যকলাপ ও কর্মকান্ডের প্রতি একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত এবং তাদের চক্রান্তের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র। নাবী কারীম (ﷺ) তাঁর স্বভাবজাত উদারতা এবং ধৈর্যের সঙ্গে মুনাফিক্বদের এ সকল অন্যায় আচরণ সহ্য করে আসছিলেন। সাধারণ মুসলিমগণও তাদের প্রতিহিংসা পরায়নতা থেকে নিজেদের রক্ষা করার ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ করে চলছিলেন। কারণ, তাঁদের নিকট বহুবার এটা প্রমাণিত হয়েছিল যে, মুনাফিক্বগণ আল্লাহর তরফ থেকেই মাঝে মাঝে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়ে আসছে। যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল মাজীদে ইরশাদ করেছেন:
(أَوَلاَ يَرَوْنَ أَنَّهُمْ يُفْتَنُوْنَ فِيْ كُلِّ عَامٍ مَّرَّةً أَوْ مَرَّتَيْنِ ثُمَّ لاَ يَتُوْبُوْنَ وَلاَ هُمْ يَذَّكَّرُوْنَ) [التوبة :126]
‘তারা কি দেখে না যে, প্রতি বছরই তাদেরকে একবার বা দু’বার পরীক্ষায় ফেলা হয় (তাদের ঈমান আনার দাবী সত্য না মিথ্যা তা দেখার জন্য) তারপরেও তারা তাওবাও করে না, আর শিক্ষাও গ্রহণ করে না।’ [আত-তাওবাহ (৯) : ১২৬]
[1] ইবনু হিশম, ১ম খন্ড, ৫৮৪ ও ৫৮৭ পৃ: সহীহুল বুখারী ৯২৪ পৃ: সহীহুল মুসলিম ২য় খন্ড ১০৯ পৃঃ।
বনু মুসত্বালাক্ব গাযওয়ায় মুনাফিক্বদের কার্যকলাপ (دَوْرُ الْمُنَافِقِيْنَ فِيْ غَزْوَةِ بَنِيْ الْمُصْطَلِقِ):
যখন বনু মুসত্বালাক্ব যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং মুনাফিক্বগণও এতে অংশ গ্রহণ করে তখন তারা ঠিক তাই করেছিল নিম্নোক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা যা বলেছেন,
(لَوْ خَرَجُوْا فِيْكُم مَّا زَادُوْكُمْ إِلاَّ خَبَالاً ولأَوْضَعُوْا خِلاَلَكُمْ يَبْغُوْنَكُمُ الْفِتْنَةَ) [التوبة : 47]
‘তারা যদি তোমাদের সঙ্গে বের হত তাহলে বিশৃংখলা ছাড়া আর কিছুই বাড়াত না আর তোমাদের মাঝে ফিতনা সৃষ্টির উদ্দেশে তোমাদের মাঝে ছুটাছুটি করত।’ [আত্-তাওবাহ (৯) : ৪৭]
অতএব, এ যুদ্ধে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার দুটি সুযোগ তাদের হাতে আসে। তার ফলশ্রুতিতে তারা মুসলিমগণের মধ্যে বিভিন্ন রকম চঞ্চলতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিরুদ্ধে নিকৃষ্টতম অপ-প্রচার চালাতে থাকে। তাদের প্রাপ্ত সুযোগ দুটির বিবরণ হচ্ছে যথাক্রমে নিম্নরূপ:
১. মদীনা হতে নিকৃষ্ট ব্যক্তিদের বহিস্কার প্রসঙ্গ
বনু মুসত্বালাক্ব গাযওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তখনো মুরাইসী’ ঝর্ণার নিকট অবস্থান করছিলেন, এমন সময় কতগুলো লোক পানি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সেখানে আগমণ করে। আগমণকারীদের মধ্যে উমার (রাঃ)-এর একজন শ্রমিকও ছিল। তাঁর নাম ছিল জাহজাহ গিফারী। ঝর্ণার নিকট আরও একজন ছিল যার নাম ছিল সিনান বিন অবর জুহানী। কোন কারণে এ দুজনের মধ্যে বাক বিতন্ডা হতে হতে শেষ পর্যায়ে ধস্তাধস্তি ও মল্লযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এক পর্যায়ে জুহানী চিৎকার শুরু করে দেয়, ‘হে আনসারদের দল! (আনসারী লোকজন) সাহায্যের জন্য দ্রুত এগিয়ে এস। অপরপক্ষে জাহজাহ আহবান করতে থাকে, ‘ওগো মুহাজিরিনের দল! (মুহাজিরগণ) আমাকে সাহায্য করার জন্য তোমরা শীঘ্র এগিয়ে এস।’
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ সংবাদ পেয়ে তৎক্ষণাৎ তথায় গমন করলেন এবং বললেন,
(أَبِدَعْوَي الْجَاهِلِيَّةِ وَأَنَا بَيْنَ أَظْهُرِكُمْ؟ دَعَوْهَا فَإِنَّهَا مُنْتِنَةٌ)
‘আমি তোমাদের মধ্যে বর্তমান আছি অথচ তোমরা জাহেলী যুগের মত আচরণ করছ। তোমরা এ সব পরিহার করে চল, এ সব হচ্ছে দুর্গন্ধযুক্ত।’
আব্দুল্লাহ বিন উবাই এ ঘটনা অবগত হয়ে ক্রোধে একদম ফেটে পড়ল এবং বলল, ‘এর মধ্যেই এরা এ রকম কার্যকলাপ শুরু করেছে? আমাদের অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করে তারা আমাদের সঙ্গেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করেছে এবং আমাদের সমকক্ষ হতে চাচ্ছে? আল্লাহর কসম! আমাদের এবং তাদের উপর সে উদাহরণ প্রযোজ্য হতে যাচ্ছে যেমনটি পূর্ব যুগের লোকেরা বলেছেন যে, ‘নিজের কুকুরকে লালন-পালন করিয়া হৃষ্টপুষ্ট কর যেন সে তোমাকে ফাড়িয়ে খাইতে পারে।’ শোন, আল্লাহর কসম! যদি আমি ফিরে যেতে পারি তাহলে দেখবে যে আমাদের সম্মানিত ব্যক্তিগণই নিকৃষ্ট ব্যক্তিদের মদীনা থেকে বহিস্কার করেছে।’
অতঃপর উপস্থিত লোকজনদের লক্ষ্য সে বলল, ‘এ বিপদ তোমরা নিজেরাই ক্রয় করেছ। তোমরা তাকে নিজ শহরে অবতরণ করেছ এবং আপন সম্পদ বন্টন করে দিয়েছ। দেখ! তোমাদের হাতে যা কিছু আছে তা দেয়া যদ্ধি বন্ধ করে দাও তবে সে তোমাদের শহর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে।’
ঐ সময় এ বৈঠকে যায়দ বিন আরক্বাম নামক এক যুবক সাহাবী উপস্থিত ছিলেন। তিনি ফিরে এসে তাঁর চাচাকে ঐ সমস্ত কথা বলে দেন। তাঁর চাচা তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে সব কিছু অবহিত করেন। ঐ সময় সেখানে উমার (রাঃ) উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, ‘হুজুর (ﷺ) আববাদ বিন বিশরকে নির্দেশ দিন, সে ওকে হত্যা করুক।’
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,
(فَكَيْفَ يَا عُمَرُ إِذَا تَحَدَّثَ النَّاسُ أَنَّ مُحَمَّداً يَقْتُلُ أَصْحَابَهُ؟ لَا وَلٰكِنْ أَذِّنْ بِالرَّحِيْلِ)
‘উমার! এটা কী করে সম্ভব? লোকে বলবে যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) নিজের সঙ্গী সাথীদের হত্যা করছে। না, তা হতে পারে না তবে তোমরা যাত্রার কথা ঘোষণা করে দাও।’
সময় ও অবস্থাটা তখন এমন ছিল, যে সময়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কোন কথা বলতেন না। লোকজনেরা যাত্রা শুরু করেছে। এমনি সময়ে ওসাইদ বিন হোযাইর (রাঃ) নাবী কারীম (ﷺ)-এর খিদমতে উপস্থিত হলেন। তিনি তাঁকে সালাম জানানোর পর আরজ করলেন, ‘অদ্য এমন অসময়ে যাত্রা আরম্ভ করা হল।’ নাবী (ﷺ) বললেন,(أَوْ مَا بَلَغَكَ مَا قَالَ صَاحِبُكُمْ؟) ‘তোমাদের সাথী (অর্থাৎ ইবনু উবাই) যা বলেছে, তার সংবাদ কি তুমি পাওনি? জিজ্ঞেস করলেন, ‘সে কী বলেছে?’ নাবী (ﷺ) বললেন, (زَعَمَ أَنَّهُ إِنْ رَّجَعَ إِلٰى الْمَدِيْنَةِ لَيُخْرِجَنَّ الْأَعَزُّ مِنْهَا الْأَذَلَّ) ‘তার ধারণা হচ্ছে, সে যদি মদীনায় ফিরে আসে তাহলে সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ নিকৃষ্ট ব্যক্তিবর্গকে মদীনা থেকে বহিস্কার করে দেবে।’
তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আপনি যদি চান তাহলে তাকে মদীনা থেকেম বের করে দেয়া হবে। আল্লাহর শপথ! সে নিকৃষ্ট এবং আপনি পরম সম্মানিত।
অতঃপর সে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! তার সঙ্গে সহনশীলতা প্রদর্শন করুন। কারণ আল্লাহই ভাল জানেন। তিনি আপনাকে আমাদের মাঝে এমন এক সময় নিয়ে আসেন, যখন তার গোত্রীয় লোকেরা তাকে মুকুট পরানোর জন্য মণিমুক্তা সমূহের মুকুট তৈরি করছিল। এ কারণে এখন সে মনে করছে যে আপনি তার নিকট থেকে তার রাজত্ব কেড়ে নিয়েছেন।
অতঃপর তিনি সন্ধ্যা পর্যন্ত পূর্ণ দিবস এবং সকাল পর্যন্ত পূর্ণ রাত্রি পথ চলতে থাকেন এবং এমন কি পরবর্তী দিবস পূর্বাহ্নে ঐ সময় পর্যন্ত ভ্রমণ অব্যাহত রাখেন যখন রৌদ্রের প্রখরতা বেশ কষ্টদায়ক অনুভূত হচ্ছিল। এর পর অবতরণ করে শিবির স্থাপন করা হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সফরসঙ্গীগণ এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, ভূমিতে দেহ রাখতে না রাখতেই সকলে ঘুমে অচেতন হয়ে পড়লেন। এ একটানা দীর্ঘ ভ্রমণের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উদ্দেশ্য ছিল, লোকজনেরা যেন আরামে বসে গল্প গুজব করার সুযোগ না পায়।
এদিকে আব্দুল্লাহ বিন উবাই যখন জানতে পারল যে যায়দ বিন আরক্বাম তার সমস্ত কথাবার্তা প্রকাশ করে দিয়েছে তখন সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে উপস্থিত হল এবং বলল যে, আল্লাহর শপথ! যায়দ আপনাকে যে সকল কথা বলেছে আমি তা কখনই বলি নি এবং এমন কি মুখেও আনি নি।
ঐ সময় আনসার গোত্রের যারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন তারাও বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! এখন ও নাবালক ছেলেই আছে এবং হয়তো তারই ভুল হয়েছে। সে ব্যক্তি যা বলেছিল হয়তো সে ঠিক ঠিক ভাবে তা স্মরণ রাখতে পারে নি।
এ কারণে নাবী (ﷺ) ইবনু উবাইয়ের কথা সত্য বলে মেনে নিলেন। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যায়দ (রাঃ) বলেছেন, ‘এর পর এ ব্যাপারে আমি এতই দুঃখিত হয়ে পড়েছিলাম যে ইতোপূর্বে আর কখনই কোন ব্যাপারে আমি এতটা দুঃখিত হই নি। সে চিন্তাজনিত দুঃখে আমি বাড়িতেই বসে রইলাম।
শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা সূরাহ মুনাফিক্ব নামে একটি সূরাহ অবতীর্ণ করলেন যার মধ্যে উভয় প্রসঙ্গেরই উল্লেখ রয়েছে:
(إِذَا جَاءَكَ الْمُنَافِقُوْنَ قَالُوْا نَشْهَدُ إِنَّكَ لَرَسُوْلُ اللهِ وَاللهُ يَعْلَمُ إِنَّكَ لَرَسُوْلُهُ وَاللهُ يَشْهَدُ إِنَّ الْمُنَافِقِيْنَ لَكَاذِبُوْنَ – اتَّخَذُوْا أَيْمَانَهُمْ جُنَّةً فَصَدُّوْا عَنْ سَبِيْلِ اللهِ إِنَّهُمْ سَاءَ مَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ – ذٰلِكَ بِأَنَّهُمْ آمَنُوْا ثُمَّ كَفَرُوْا فَطُبِعَ عَلٰى قُلُوْبِهِمْ فَهُمْ لَا يَفْقَهُوْنَ – وَإِذَا رَأَيْتَهُمْ تُعْجِبُكَ أَجْسَامُهُمْ وَإِنْ يَقُوْلُوا تَسْمَعْ لِقَوْلِهِمْ كَأَنَّهُمْ خُشُبٌ مُسَنَّدَةٌ يَحْسَبُوْنَ كُلَّ صَيْحَةٍ عَلَيْهِمْ هُمُ الْعَدُوُّ فَاحْذَرْهُمْ قَاتَلَهُمُ اللهُ أَنَّى يُؤْفَكُوْنَ – وَإِذَا قِيْلَ لَهُمْ تَعَالَوْا يَسْتَغْفِرْ لَكُمْ رَسُوْلُ اللهِ لَوَّوْا رُؤُوْسَهُمْ وَرَأَيْتَهُمْ يَصُدُّوْنَ وَهُمْ مُسْتَكْبِرُوْنَ – سَوَاءٌ عَلَيْهِمْ أَسْتَغْفَرْتَ لَهُمْ أَمْ لَمْ تَسْتَغْفِرْ لَهُمْ لَنْ يَغْفِرَ اللهُ لَهُمْ إِنَّ اللهَ لَا يَهْدِيْ الْقَوْمَ الْفَاسِقِيْنَ – هُمُ الَّذِيْنَ يَقُوْلُوْنَ لَا تُنْفِقُوْا عَلٰى مَنْ عِنْدَ رَسُوْلِ اللهِ حَتّٰى يَنْفَضُّوْا وَلِلهِ خَزَائِنُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلَكِنَّ الْمُنَافِقِيْنَ لَا يَفْقَهُوْنَ – يَقُوْلُوْنَ لَئِنْ رَجَعْنَا إِلَى الْمَدِيْنَةِ لَيُخْرِجَنَّ الْأَعَزُّ مِنْهَا الْأَذَلَّ وَلِلهِ الْعِزَّةُ وَلِرَسُوْلِهِ وَلِلْمُؤْمِنِيْنَ وَلَكِنَّ الْمُنَافِقِيْنَ لَا يَعْلَمُوْنَ)
‘১. মুনাফিক্বরা যখন তোমার কাছে আসে তখন তারা বলে- ‘আমরা সাক্ষ্য দিচিছ যে, আপনি অবশ্যই আল্লাহর রসূল।’ আল্লাহ জানেন, অবশ্যই তুমি তাঁর রসূল আর আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিক্বরা অবশ্যই মিথ্যেবাদী। ২. তারা তাদের শপথগুলোকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আর এ উপায়ে তারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে নিবৃত্ত করে। তারা যা করে তা কতই না মন্দ! ৩. তার কারণ এই যে, তারা ঈমান আনে, অতঃপর কুফুরী করে। এজন্য তাদের অন্তরে মোহর লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। যার ফলে তারা কিছুই বুঝে না ৪. তুমি যখন তাদের দিকে তাকাও তখন তাদের শারীরিক গঠন তোমাকে চমৎকৃত করে। আর যখন তারা কথা বলে তখন তুমি তাদের কথা আগ্রহ ভরে শুন, অথচ তারা দেয়ালে ঠেস দেয়া কাঠের মত (দেখন- সুরত, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে কিছুই না)। কোন শোরগোল হলেই তারা সেটাকে নিজেদের বিরুদ্ধে মনে করে (কারণ তাদের অপরাধী মন সব সময়ে শঙ্কিত থাকে- এই বুঝি তাদের কুকীর্তি ফাঁস হয়ে গেল)। এরাই শত্রু, কাজেই তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাক। এদের উপর আছে আল্লাহর গযব, তাদেরকে কিভাবে (সত্য পথ থেকে) ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে! ৫. তাদেরকে যখন বলা হয়, ‘এসো, আল্লাহর রসূল তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন, তখন তারা মাথা নেড়ে অস্বীকৃতি জানায়, তখন তুমি দেখতে পাও তারা সদম্ভে তাদের মুখ ফিরিয়ে নেয়। ৬. তুমি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর আর না কর, উভয়ই তাদের জন্য সমান। আল্লাহ তাদেরকে কক্ষনো ক্ষমা করবেন না। আল্লাহ পাপাচারী জাতিকে কক্ষনো সঠিক পথে পরিচালিত করেন না। ৭. তারা বলে- ‘রসূলের সঙ্গী সাথীদের জন্য অর্থ ব্যয় করো না, শেষে তারা এমনিতেই সরে পড়বে।’ আসমান ও যমীনের ধন ভান্ডার তো আল্লাহরই, কিন্তু মুনাফিক্বরা তা বুঝে না। ৮. তারা বলে- ‘আমরা যদি মাদীনায় প্রত্যাবর্তন করি, তাহলে সম্মানীরা অবশ্য অবশ্যই হীনদেরকে সেখানে থেকে বহিষ্কার করবে।’ কিন্তু সমস্ত মান মর্যাদা তো আল্লাহর, তাঁর রসূলের এবং মু’মিনদের; কিন্তু মুনাফিক্বরা তা জানে না।’ [আল-মুনাফিকূন (৬৩) : ১-৮]
যায়দ বলেছেন, ‘এর পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং এ আয়াতগুলো পাঠ করে শোনালেন। অতঃপর বললেন,(إِنَّ اللهَ قَدْ صَدَقَكَ) ‘আল্লাহ তা‘আলা তোমার কথার সত্যতা প্রমাণিত করেছেন।’[1]
উল্লেখিত মুনাফিক্বের সন্তানের নামও ছিল আবদুল্লাহ। সন্তান ছিলেন পিতার সম্পূর্ণ বিপরীত, অত্যন্ত সৎ স্বভাবের মানুষ এবং উত্তম সাহাবাদের অন্তর্ভুক্ত। তিনি পিতার নিকট থেকে পৃথক হয়ে গিয়ে উন্মুক্ত তরবারী হস্তে দন্ডায়মান হলেন মদীনার দরজায়। যখন তার পিতা সেখানে গিয়ে পৌঁছেন তখন তিনি বললেন, ‘আল্লাহর শপথ! আপনি এখান থেকে আর অগ্রসর হতে পারবেন না যতক্ষণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অনুমতি না দিবেন। কারণ নাবী (ﷺ) প্রিয়, পবিত্র ও সম্মানিত এবং আপনি নিকৃষ্ট।’ এরপর নাবী কারীম (ﷺ) যখন সেখানে উপস্থিত হয়ে তাকে মদীনায় প্রবেশের অনুমতি প্রদান করলেন তখন পুত্র পিতার পথ ছেড়ে দিলেন। আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের ঐ ছেলেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এ বলে আরজ করলেন, ‘আপনি তাকে হত্যা করার ইচ্ছা পোষণ করলে আমাকে নির্দেশ প্রদান করুন। আল্লাহর কসম! আমি তার মস্তক দ্বিখন্ডিত করে আপনার খিদমতে এনে হাজির করব।’[2]
[1] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড, ৪৯৯ পৃঃ, ২য় খন্ড ২২৭-২২৯ পৃঃ, ইকনু হিশমা ২য় খন্ড ২৯০-২৯২ পৃঃ।
[2] ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ২৯০-২৯২ পৃঃ, শাইখ আব্দুল্লাহ রচিত মুখতাসারুস সীরাহ ২৭৭ পৃঃ।
২. মিথ্যা অপবাদের ঘটনা (حَدِيْثُ الْإِفْكِ):
উল্লেখিত যুদ্ধের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল মিথ্যা অপবাদের ব্যাপারটি। এ ঘটনার সার সংক্ষেপ হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিয়ম ছিল সফরে যাওয়ার প্রাক্কালে তিনি তাঁর পবিত্র পত্নীগণের মধ্যে লটারী করে নিতেন। লটারীতে যাঁর নাম উঠত তাঁকে তিনি সফরে নিয়ে যেতেন। এ অভিযান কালে লটারীতে ‘আয়িশাহ (রাঃ)-এর নাম বাহির হয়। সেহেতু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে সঙ্গে নিয়ে সফরে যান।
অভিযান শেষে মদীনা প্রত্যাবর্তনের পথে এক জায়গায় শিবির স্থাপন করা হয়। শিবিরে থাকা অবস্থায় ‘আয়িশাহ (রাঃ) নিজ প্রয়োজনে শিবিরের বাহিরে গমন করেন। সফরের উদ্দেশ্যে যে স্বর্ণাহারটি তাঁর বোনের নিকট থেকে নিয়ে এসেছিলেন এ সময় তা হারিয়ে যায়। হারানোর সময় হারের কথাটি তাঁর স্মরণেই ছিল না। বাহির থেকে শিবির ফিরে আসার পর হারানো হারের কথাটি স্মরণ হওয়া মাত্রই তার খোঁজে তিনি পুনরায় পূর্বস্থানে গমন করেন। এ সময়ের মধ্যেই যাঁদের উপর নাবী পত্নির (রাঃ) হাওদা উটের পিঠে উঠিয়ে দেয়ার দায়িত্ব অর্পিত ছিল তাঁরা হাওদা উঠিয়ে দিলেন। তাদের ধারণা যে, উম্মুল মু’মিনীন হাওদার মধ্যেই রয়েছেন। যেহেতু তাঁর শরীর খুব হালকা ছিল সেহেতু হাওদা হালকা থাকার ব্যাপারটি তাদের মনে কোন প্রতিক্রিয়া করে নি। তাছাড়া, হাওদাটি দু’ জনে উঠালে হয়তো তাদের পক্ষে অনুমান করা সহজ হতো এবং সহজেই ভুল ধরা পড়ত। কিন্তু যেহেতু কয়েক জন মিলে মিশে ধরাধরি করে হাওদাটি উঠিয়ে ছিলেন ব্যাপারটি অনুমান করার ব্যাপারে তাঁরা কোন ভ্রুক্ষেপই করেন নি।
যাহোক, হারানো হারটি প্রাপ্তির পর মা ‘আয়িশাহ (রাঃ) আশ্রয়স্থলে ফিরে এসে দেখলেন যে পুরো বাহিনী ইতোমধ্যে সে স্থান পরিত্যাগ করে এগিয়ে গিয়েছেন। প্রান্তরটি ছিল সম্পূর্ণ জনশূন্য। সেখানে না ছিল কোন আহবানকারী, না ছিল কোন উত্তরদাতা। তিনি এ ধারণায় সেখানে বসে পড়লেন যে, লোকেরা তাঁকে যখন দেখতে না পাবেন তখন তাঁর খোঁজ করতে করতে এখানেই এসে যাবেন। কিন্তু সর্বজ্ঞ ও সর্বত্র বিরাজিত প্রজ্ঞাময় প্রভূ আল্লাহ তা‘আলা আপন কাজে সদা তৎপর ও প্রভাবশালী। তিনি যে ভাবে যা পরিচালনা করার ইচ্ছা করেন সে ভাবেই তা বাস্তবায়িত হয়। অতএব, আল্লাহ তা‘আলাভ ‘আয়িশাহর (রাঃ) চক্ষুদ্বয়কে ঘুমে জড়িয়ে দেয়ায় তিনি সেখানে ঘুমিয়ে পড়লেন। অতঃপর সফওয়ান বিন মু’আত্তাল এর কণ্ঠস্বর শুনে তিনি জাগ্রত হলেন। তিনি বলছিলেন, ‘ইন্না লিল্লাহ ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন, রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর স্ত্রী?’
সফওয়ান (রাঃ) সেনাদলের শেষ অংশে ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন। তাঁর অভ্যাস ছিল একটু বেশী ঘুমানো। ‘আয়িশাহ (রাঃ)-কে এ অবস্থায় দেখা মাত্রই তিনি চিনতে পারলেন। কারণ, পর্দার হুকুম অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে তিনি তাঁকে দেখেছিলেন। অতঃপর ‘ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পাঠরত অবস্থায় তিনি আপন সওয়ারীকে নাবী পত্নীর (রাঃ) নিকট বসিয়ে দিলেন। ‘আয়িশাহ (রাঃ) সওয়ারীর উপর আরোহণ করার পর তিনি তার লাগাম ধরে টানতে টানতে হাঁটতে থাকলেন এবং সর্বক্ষণ মুখে উচ্চারণ করতে থাকলেন ইন্না লিল্লাহি………..।
সফওয়ান ইন্নালিল্লাহ… ছাড়া অন্য কোন বাক্য উচ্চারণ করেননি। সাফওয়ান (রাঃ) ‘আয়িশাহ (রাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে যখন সৈন্যদলে মিলিত হলেন, তখন ছিল ঠিক খরতপ্ত দুপুর। সৈন্যদল শিবির স্থাপন করে বিশ্রামরত ছিলেন। ‘আয়িশাহ (রাঃ)-কে এ অবস্থায় আসতে দেখে লোকেরা আপন আপন প্রকৃতি ও প্রবৃত্তির নিরিখে ব্যাপারটি আলোচনা পর্যালোচনা করতে থাকলেন। সৎ প্রকৃতির লোকেরা এটাকে সহজ ভাবেই গ্রহণ করল। কিন্তু অসৎ প্রকৃতি ও প্রবৃত্তির লোকেরা এটাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে চিন্তা করতে থাকল নানা ভাবে। বিশেষ করে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর দুশমন অপবিত্র খবিশ আব্দুল্লাহ বিন উবাই এটিকে পেয়ে বসল তার অপপ্রচারের একটি মোক্ষম সুযোগ হিসেবে। সে তার অন্তরে কপটতা, হিংসা বিদ্বেষের যে অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত রেখেছিল এ ঘটনা তাতে ঘৃতাহুতির ন্যায় অধিকতর প্রভাবিত ও প্রজ্জ্বলিত করে তুলল। সে এ সামান্য ঘটনাটিকে তার স্বকপোলকল্পিত নানা আকার প্রচার ও রঙচঙে চিত্রিত ও রঞ্জিত করে ব্যাপকভাবে অপপ্রচার শুরু করে দিল।
পুণ্যের তুলনায় পাপের প্রভাবে মানুষ যে সহজেই প্রভাবিত হয়ে পড়ে এ সত্যটি আবারও অত্যন্ত নিষ্করুণভাবে প্রমাণিত হয়ে গেল। আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের এ অপপ্রচারে অনেকেই প্রভাবিত হয়ে পড়ল এবং তারাও অপপ্রচার শুরু করল। এমনি দ্বিধান্দ্ব ও ভারাক্রান্ত মানসিকতাসম্পন্ন বাহিনীসহ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনা প্রত্যাবর্তন করলেন। মুনাফিক্বেরা মদীনা প্রত্যাবর্তনের পথে আরও জোটবদ্ধ হয়ে অপপ্রচার শুরু করে দিল।
এ অপবাদ ও অপপ্রচারের মুখোমুখী হয়ে রাসূলে কারীম (ﷺ) ওহীর মাধ্যমে এর সমাধানের আশায় নীরবতা অবলম্বন করলেন।
কিন্তু দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করা সত্ত্বেও ওহী নাযিল না হওয়ায় ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে পৃথক থাকার ব্যাপারে তিনি তাঁর সাহাবাবর্গের সঙ্গে পরামর্শের ব্যবস্থা করলেন। আলী (রাঃ) আভাষ ইঙ্গিতে তাঁকে পরামর্শ দিলেন তাঁর থেকে পৃথক হয়ে গিয়ে অন্য কোন মহিলাকে বিবাহ করার জন্য। কিন্তু উসামা ও অন্যান্য সাহাবীগণ (রাযি.) শত্রুদের কথায় কান না দিয়ে ‘আয়িশাহ (রাঃ)-কে তাঁর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত রাখার পরামর্শ দিলেন।
এরপর আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের কপটতাজনিত কষ্ট হতে অব্যাহতি লাভের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মিম্বরে উঠে এক ভাষণের মাধ্যমে জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। এ প্রেক্ষিতে সা‘দ বিন মোয়ায তাকে হত্যা করার অভিমত ব্যক্ত করেন। কিন্তু সা‘দ বিন উবাদা (যিনি আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের খাযরাজ গোত্রের নেতা ছিলেন) গোত্রীয় প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে খুব শক্তভাবে এর বিরোধিতা করায় উভয়ের মধ্যে বাকযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যার ফলে উভয় গোত্রের লোকেরাই উত্তেজিত হয়ে ওঠে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অনেক চেষ্টা করে উভয় গোত্রের লোকজনদের উত্তেজনা প্রশমিত করেন এবং নিজেও নীরবতা অবলম্বন করেন।
এদিকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রত্যাবর্তনের পর ‘আয়িশাহ (রাঃ) অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এক নাগাড়ে এক মাস যাবৎ অসুস্থতায় ভুগতে থাকেন। এ অপবাদ সম্পর্কে অবশ্য তিনি কিছুই জানতেন না। কিন্তু তাঁর অসুস্থ অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’র কাছ থেকে যে আদর যত্ন ও সেবা শুশ্রূষা পাওয়ায় কথা তা না পাওয়ার তাঁর মনে কিছুটা অস্বস্তি ও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়ে যায়।
বেশ কিছু দিন যাবত রোগ ভোগের পর ধীরে ধীরে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। সুস্থতা লাভের পর পায়খানা প্রস্রাবের জন্য এক রাত্রি তিনি উম্মু মিসত্বাহর সঙ্গে সন্নিকটস্থ মাঠে গমন করেন। হাঁটতে গিয়ে এক সময় উম্মু মিসত্বাহ স্বীয় চাদরের সঙ্গে জড়ানো অবস্থায় পা পিছলিয়ে মাটিতে পড়ে যায়। এ অবস্থায় সে নিজের ছেলেকে গালমন্দ দিতে থাকে। ‘আয়িশাহ (রাঃ) তাঁর ছেলেকে গালমন্দ দেয়া থেকে বিরত থাকার কথা বলায় সে বলে, আমার ছেলেও সে অপবাদ সম্পর্কিত অপপ্রচারে জড়িত আছে, বলে অপবাদের কথা ‘আয়িশাহ (রাঃ)-কে শোনান। ‘আয়িশাহ (রাঃ) সে অপবাদ ও অপপ্রচার সম্পর্কে জানতে চাইলে উম্মু মিসত্বাহ তাঁকে সকল কথা খুলে বলেন। এভাবে তিনি অপবাদের কথা জানতে পারেন। এ খবরের সত্যতা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর পিতা-মাতার নিকট যাওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট অনুমতি চাইলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে অনুমতি প্রদান করলে তিনি পিতা-মাতার নিকট গমন করলেন এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিতরূপ অবগত হয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। নিরবচ্ছিন্ন কান্নার মধ্যে তাঁর দু’ রাত ও এক দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। ঐ সময়ের মধ্যে ক্ষণিকের জন্যও তাঁর অশ্রুর ধারা বন্ধ হয় নি কিংবা ঘুমও আসেনি। তাঁর এ রকম একটা উপলব্ধি হচ্ছিল যে, কান্নার চোটে তাঁর কলিজা ফেটে যাবে। ঐ অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সেখানে তাশরীফ আনয়ন করলেন এবং কালিমা শাহাদাত সমন্বয়ে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ প্রদান করলেন। অতঃপর ইরশাদ করলেন,
(أَمَّا بَعْدُ يَا عَائِشَةَ، فَإِنَّهُ قَدْ بَلَغَنِيْ عَنْكَ كَذَا وَكَذَا، فَإِنْ كَنْتِ بِرَيْئَةٍ فَسَيُبْرِئُكَ اللهُ، وَإِنْ كُنْتِ أَلْمَمْتِ بِذَنْبٍ فَاسْتَغْفِرِيْ اللهَ وَتُوْبِيْ إِلَيْهِ، فَإِنَّ الْعَبْدَ إَِذَا اعْتَرَفَ بِذََنْبِهِ، ثُمَّ تَابَ إِلٰى اللهِ تَابَ اللهُ عَلَيْهِ).
‘হে ‘আয়িশাহ তোমার সম্পর্কে কিছু জঘন্য কথাবার্তা আমার কানে এসেছে। যদি তুমি এ কাজ থেকে পবিত্র থাক তাহলে আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ করে এর সত্যতা প্রকাশ করে দেবেন। আর আল্লাহ না করুন, তোমার দ্বারা যদি কোন পাপ কাজ হয়ে থাকে তাহলে তুমি আল্লাহ তা‘আলার সমীপে ক্ষমাপ্রার্থী হও এবং তওবা কর। কারণ, পাপ কাজের পর কোন বান্দা যখন অনুতপ্ত হয়ে খালেস অন্তরে আল্লাহ তা‘আলার সমীপে তওবা করে তিনি তা কবুল করেন।’
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বক্তব্য শোনার পর ‘আয়িশাহ (রাঃ)-এর অশ্রুধারা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেল। তাঁর চোখে তখন এক ফোঁটা পানিও যেন অবশিষ্ট ছিল না। তিনি তাঁর পিতা-মাতাকে বললেন যে, তাঁদেরকে নাবী (ﷺ)-এর এ প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। কিন্তু জবাব দেয়ার মতো কোন ভাষাই যেন তাঁরা খুঁুজে পেলেন না। পিতা-মাতাকে অত্যন্ত অসহায় ও নির্বাক দেখে ‘আয়িশাহ (রাঃ) নিজেই বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আপনারা যে কথা শুনেছেন তা আপনাদের অন্তরকে প্রভাবিত করেছে এবং আপনারা তাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছেন। এ কারণে, আমি যদি বলি যে, আমি সম্পূর্ণ পাক পবিত্র আছি এবং আল্লাহ অবশ্যই অবগত আছেন যে, আমি পবিত্র আছি, তবুও আপনারা আমার কথাকে সত্য বলে মেনে নেবেন না। আর যদি আমি ঐ জঘন্য অপবাদকে সত্য বলে স্বীকার করে নেই। অথচ আল্লাহ তা‘আলা অবগত আছেন যে, আমি তা থেকে পবিত্র আছি- তবে আপনারা আমার কথাকে সত্য বলে মেনে নেবেন। এমতাবস্থায় আল্লাহর কসম! আমার ও আপনাদের জন্য ঐ উদাহরণটাই প্রযোজ্য হবে যা ইউসূফ (আঃ)-এর পিতা বলেছিলেন :
(فَصَبْرٌ جَمِيْلٌ وَاللهُ الْمُسْتَعَانُ عَلٰى مَا تَصِفُوْنَ) [يوسف: 18]
‘ধৈর্য ধারণই উত্তম পথ এবং তোমরা যা বলছ তার জন্য আল্লাহর সাহায্য কামনা করছি।’ [ইউসুফ (১২) : ১৮]
এরপর ‘আয়িশাহ (রাঃ) অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়লেন এবং ঐ সময়ই রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর উপর ওহী নাযিল আরম্ভ হয়ে গেল। অতঃপর যখন নাবী কারীম (ﷺ)-এর উপর ওহী নাযিলে কঠিন অবস্থা অতিক্রান্ত হল তখন তিনি মৃদু মৃদু হাসছিলেন। এ সময় তিনি প্রথম যে কথাটি বলেছিলেন তা হচ্ছে, (يَا عَائِشَةُ، أَمَا اللهُ فَقَدْ بَرِأَكِ) ‘হে ‘আয়িশাহ! আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে অপবাদ থেকে মুক্তি দিয়েছেন। এতে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর আম্মা বললেন, ‘(‘আয়িশাহ!) উঠে দাঁড়াও (হুজুরের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর)। ‘আয়িশাহ (রাঃ) স্বীয় সতীত্ব ও রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর ভালবাসার উপর ভরসা করে গর্বের সঙ্গে বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি তো তাঁর সামনে দাঁড়াব না, শুধুমাত্র আল্লাহর প্রশংসা করব।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মিথ্যা অপবাদ সম্পর্কিত যে আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হয় তা ছিল সূরাহ নূরের দশটি আয়াত।
(إِنَّ الَّذِيْنَ جَاءُوْا بِالْأِفْكِ عُصْبَةٌ مِنْكُمْ لَا تَحْسَبُوْهُ شَرّاً لَكُمْ بَلْ هُوَ خَيْرٌ لَكُمْ لِكُلِّ امْرِئٍ مِنْهُمْ مَا اكْتَسَبَ مِنَ الْأِثْمِ وَالَّذِيْ تَوَلَّى كِبْرَهُ مِنْهُمْ لَهُ عَذَابٌ عَظِيْمٌ – لَوْلَا إِذْ سَمِعْتُمُوْهُ ظَنَّ الْمُؤْمِنُوْنَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بِأَنْفُسِهِمْ خَيْراً وَقَالُوْا هٰذَا إِفْكٌ مُبِيْنٌ – لَوْلَا جَاءُوْا عَلَيْهِ بِأَرْبَعَةِ شُهَدَاءَ فَإِذْ لَمْ يَأْتُوْا بِالشُّهَدَاءِ فَأُوْلَئِكَ عِنْدَ اللهِ هُمُ الْكَاذِبُوْنَ – وَلَوْلَا فَضْلُ اللهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ فِيْ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ لَمَسَّكُمْ فِيْ مَا أَفَضْتُمْ فِيْهِ عَذَابٌ عَظِيْمٌ – إِذْ تَلَقَّوْنَهُ بِأَلْسِنَتِكُمْ وَتَقُوْلُوْنَ بِأَفْوَاهِكُمْ مَا لَيْسَ لَكُمْ بِهِ عِلْمٌ وَتَحْسَبُوْنَهُ هَيِّناً وَهُوَ عِنْدَ اللهِ عَظِيْمٌ – وَلَوْلَا إِذْ سَمِعْتُمُوْهُ قُلْتُمْ مَا يَكُوْنُ لَنَا أَنْ نَتَكَلَّمَ بِهٰذَا سُبْحَانَكَ هٰذَا بُهْتَانٌ عَظِيْمٌ – يَعِظُكُمُ اللهُ أَنْ تَعُوْدُوْا لِمِثْلِهِ أَبَداً إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِيْنَ – وَيُبَيِّنُ اللهُ لَكُمُ الْآياتِ وَاللهُ عَلِيْمٌ حَكِيْمٌ – إِنَّ الَّذِيْنَ يُحِبُّوْنَ أَنْ تَشِيْعَ الْفَاحِشَةُ فِيْ الَّذِيْنَ آمَنُوْا لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ فِيْ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَاللهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُوْنَ – وَلَوْلَا فَضْلُ اللهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ وَأَنَّ اللهَ رَؤُوْفٌ رَحِيْمٌ)
‘১১. যারা এ অপবাদ উত্থাপন করেছে তারা তোমাদেরই একটি দল, এটাকে তোমাদের জন্য ক্ষতিকর মনে কর না, বরং তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তাদের প্রত্যেকের জন্য আছে প্রতিফল যতটুকু পাপ সে করেছে। আর এ ব্যাপারে যে নেতৃত্ব দিয়েছে তার জন্য আছে মহা শাস্তি। তোমরা যখন এটা শুনতে পেলে তখন কেন মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন স্ত্রীরা তাদের নিজেদের লোক সম্পর্কে ভাল ধারণা করল না আর বলল না, ‘এটা তো খোলাখুলি অপবাদ।’ তারা চারজন সাক্ষী হাযির করল না কেন? যেহেতু তারা সাক্ষী হাযির করেনি সেহেতু আল্লাহর নিকট তারাই মিথ্যেবাদী। দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাদের উপর যদি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকত, তবে তোমরা যাতে তড়িঘড়ি লিপ্ত হয়ে পড়েছিলে তার জন্য মহা শাস্তি তোমাদেরকে পাকড়াও করত। যখন এটা তোমরা মুখে মুখে ছড়াচ্ছিলে আর তোমাদের মুখ দিয়ে এমন কথা বলছিলে যে বিষয়ে তোমাদের কোন জ্ঞান ছিল না, আর তোমরা এটাকে নগণ্য ব্যাপার মনে করেছিলে, কিন্তু আল্লাহর নিকট তা ছিল গুরুতর ব্যাপার। তোমরা যখন এটা শুনলে তখন তোমরা কেন বললে না যে, এ ব্যাপারে আমাদের কথা বলা ঠিক নয়। আল্লাহ পবিত্র ও মহান, এটা তো এক গুরুতর অপবাদ! আল্লাহ তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন তোমরা আর কখনো এর (অর্থাৎ এ আচরণের) পুনরাবৃত্তি করো না যদি তোমরা মু’মিন হয়ে থাক। আল্লাহ তোমাদের জন্য স্পষ্টভাবে আয়াত বর্ণনা করছেন, কারণ তিনি হলেন সর্ববিষয়ে জ্ঞানের অধিকারী, বড়ই হিকমাতওয়ালা। যারা পছন্দ করে যে, মু’মিনদের মধ্যে অশ্লীলতার বিস্তৃতি ঘটুক তাদের জন্য আছে ভয়াবহ শাস্তি দুনিয়া ও আখিরাতে। আল্লাহ জানেন আর তোমরা জান না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে (তোমরা ধ্বংস হয়ে যেতে), আল্লাহ দয়ার্দ্র, বড়ই দয়াবান।’ [আন্-নূর (২৪) ১১-২০]
এরপর মিথ্যা অপবাদের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের অপরাধের দায়ে মিসত্বাহ বিন আসাস, হাসসান বিন সাবেত এবং হামনাহ বিনতে জাহশকে আশি (৮০) দোররা কার্যকর করা হল।[1] তবে খবিস আব্দুল্লাহ বিন উবাই এ শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে গেল। অথচ অপবাদ রটানোর কাজে জড়িত জঘন্য ব্যক্তিদের মধ্যে সে ছিল প্রথমে এবং এ ব্যাপারে সব চাইতে অগ্রগামী ভূমিকা ছিল তারই। তাকে শাস্তি না দেয়ার কারণ হয়তো এটাই ছিল যে, আল্লাহ তা‘আলা পরকালে তাকে শাস্তি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাকে এখন শাস্তি প্রদান করা হলে তার পরকালের শাস্তি হালকা হয়ে যাবে এ ধারণায় শাস্তির ব্যবস্থা করা হয় নি। কিন্তু অন্যান্য যাদের জন্য শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা করা হয় তাদের পরকালীন পাপ ভার হালকা এবং পাপসমূহের কাফফারা হিসেবেই তা করা হয়। অথবা এমন কোন ব্যাপার এর মধ্যে নিহিত ছিল যে কারণে তাকে হত্যা করা হয় নি।[2]
এভাবে এক মাস অতিবাহিত হওয়ার পর সন্দেহ, আশঙ্কা, অশান্তি, অশুভ ও ব্যাকুলতার বিষবাষ্প থেকে মদীনার আকাশ বাতাস পরিস্কার হয়ে উঠল। এর ফলশ্রুতিতে আব্দুল্লাহ ইবনু্ উবাই এতই অপমানিত ও লাঞ্ছিত হল যে, সে আর দ্বিতীয়বার মস্তক উত্তোলন করতে সক্ষম হল না। ইবনু ইসহাক্ব বলেছেন যে, এর পর যখনই সে কোন গন্ডগোল পাকাতে উদ্যত হয় তখনই তার লোকজনেরা তাকে ভৎর্সনা ও তিরস্কার করতে থাকত এবং বলপ্রয়োগ করে বসিয়ে দিত। এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উমার (রাঃ)-কে বললেন,
(كَيْفَ تَرٰى يَا عُمَرُ؟ أَمَا وَاللهِ لَوْقَتَلْتَهُ يَوْمَ قُلْتَ لِيْ : اُقْتُلْهُ، لَأَرْعَدَتْ لَهُ آنِفٌ، وَلَوْ أَمَرْتُهَا الْيَوْمَ بِقَتْلِهِ لَقَتَلَتْهُ)
হে উমার! এ ব্যাপারে তোমার ধারণা কী? দেখ আল্লাহর শপথ! যে দিন তুমি আমার নিকট অনুমতি চেয়েছিলে সে দিন যদি আমি অনুমতি দিতাম আর যদি তুমি তাকে হত্যা করতে তাহলে এ জন্য অনেকেই বিরূপ মনোভাব পোষণ করত। কিন্তু আজকে যদি সেই সব লোকদের আদেশ দেয়া হয় তাহলে তারাই তাকে হত্যা করবে।
উমার (রাঃ) বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি ভাল ভাবেই হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হয়েছি যে, রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর কাজ আমার কাজের তুলনায় অনেক বেশী বরকতপূর্ণ।[3]
[1] ইসলামী শরীয়তে এরূপ বিধান আছে যে কোন ব্যক্তি যদি অন্য কোন ব্যক্তিকে ব্যভিচারের অপবাদ দেয় অথচ প্রমাণ পেশ করতে সক্ষম না হয় তাহলে তাকে আশি কোড়া মারতে হবে।
[2] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৩৬৪ পৃঃ, ২য় খন্ড ৬৯৬-৬৯৮ পৃঃ, যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ১১৩-১১৫ পৃঃ. ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ২৯৭-৩০০ পৃঃ।
[3] ইকসু হিশাম ২য় খন্ড ২৯৩ পৃঃ।