যুদ্ধের কারণ (سَبَبُ الْمَعْرِكَةِ):
মুতাহ হচ্ছে উরদুন অঞ্চলে ‘বালক্বা’ নামক স্থানের নিকটবর্তী একটি জনপদের নাম। সেখান হতে বায়তুল মুক্বাদ্দাস দু’ মনজিল ভ্রমণ পথের দূরত্বে অবস্থিত। আলোচ্য যুদ্ধ এ স্থানে সংঘটিত হয়েছিল।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবদ্দশায় মুসলিমগণের সামনে এটাই ছিল সব চাইতে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এবং এ যুদ্ধ ছিল পরবর্তী পর্যায়ের খ্রিষ্টান দেশসমূহ বিজয়ের পূর্ব সূত্র। এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ৮ম হিজরীর জুমাদাল উলা মোতাবেক ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট কিংবা সেপ্টেম্বর মাসে।
এ যুদ্ধের কারণ ছিল, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) হারিস বিন উমায়ের আযদী (রাঃ)-কে একটি পত্রসহ বুসরার শাসকের নিকট প্রেরণ করেন এবং তদানীন্তন রোম সম্রাটের গর্ভণর শোরাহবিল বিন ‘আমর গাসসানী যিনি ‘বালক্বা’ নামক স্থানে নিযুক্ত ছিলেন তিনি হারিস (রাঃ)-কে বন্দী করার পর শক্ত করে বেঁধে হত্যা করে।
প্রকাশ থাকে যে, রাষ্ট্রীয় দূত এবং সংবাদ বাহকদের হত্যা করার ব্যাপারটি সব চাইতে নিকৃষ্ট কাজ এবং জঘন্যতম অপরাধ। এ ধরণের কাজ ছিল যুদ্ধ ঘোষণার শামিল, বরং বলা যায় যে, তার চাইতেও ভয়ংকর। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন এ সংবাদ অবগত হলেন তখন তাঁর সামনে অনভিপ্রেত এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে গেল। মুসলিমগণের পক্ষে যুদ্ধ করা ছাড়া আর কোন পথ খোলা রইল না। এ উদ্দেশ্যে ৩০০০ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী তিনি প্রস্তুত করে নিলেন।[1] এবং এটাই ছিল সব চাইতে বড় ইসলামী যোদ্ধা বাহিনী। এর পূর্বে আহযাব যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোন যুদ্ধে মুসলিমগণের এত বড় বাহিনী সংগঠিত হয় নি।
[1] যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ১৫৫ পৃঃ, ফাতহুলবারী ৭ম খন্ড ৫১১ পৃঃ।
সৈন্য পরিচালকগণ এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর অসিয়ত (أُمَرَاءُ الْجَيْشِ وَوَصِيَّةُ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ إِلَيْهِمْ):
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জায়েদ বিন হারিসাহকে এ সৈন্যদলের সেনাপতি নিযুক্ত করেন। এবং অসিয়ত করেন যে, যায়দকে যদি শহীদ করা হয় তবে জা’ফার এবং জা’ফারকে শহীদ করা হলে আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা সেনাপতি হবেন।[1] সৈন্যদলের জন্য সাদা পতাকা বেঁধে তা যায়েদের হাতে দিলেন।[2] অতঃপর সৈন্যদলের উদ্দেশ্যে নিম্নবর্ণিত উপদেশাবলী প্রদান করলেন।
যে জায়গায় হারিস বিন উমায়েরকে শহীদ করা হয়েছে তথায় উপস্থিত হয়ে তথাকার অধিবাসীগণের নিকট প্রথমে ইসলামের দাওয়াত পেশ করবে। যদি তারা ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে সেটা হবে উত্তম। অন্যথায় আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনার পর যুদ্ধে লিপ্ত হবে। তিনি আরও বললেন,
(اُغْزُوْا بِسْمِ اللهِ، فِيْ سَبِيْلِ اللهِ، مَنْ كَفَرَ بِاللهِ، لَا تَغْدِرُوْا، وَلَا تَغْلُوْا، وَلَا تَقْتُلُوْا وَلِيْدًا وَلَا اِمْرَأَةً، وَلَا كَبِيْراً فَانِياً، وَلَا مُنْعَزِلاً بِصوْمَعَةٍ، وَلَا تَقْطَعُوْا نَخَلاً وَلَا شَجَرَةً، وَلَا تَهْدِمُوْا بِنَاءً).
আল্লাহর নামে আল্লাহর পথে, আল্লাহর সঙ্গে কুফরকারীদের সঙ্গে যুদ্ধ কর। সাবধান! অঙ্গীকার ভঙ্গ কর না, আমানতের খিয়ানত কর না, শিশু মহিলা, বৃদ্ধ এবং গীর্জায় অবস্থানরত পুরোহিতদের হত্যা কর না,খেজুর কিংবা অন্য কোন বৃক্ষ কর্তন কর না এবং বাড়ি ঘর ও দালানকোঠা বিনষ্ট কর না।[3]
[1] সহীহুল বুখারী শাম রাজ্যে মুতাহ যু্দ্ধ সম্পর্কিত অধ্যায় ২য় খন্ড ৬১১ পৃঃ।
[2] শাইখ আব্দুল্লাহ রচিত মুকতাসারুস সীরাহ ৩২৭ পৃঃ।
[3] পূর্বোক্ত এবং রহমাতুল্লিল আলামীন ২য় খন্ড ২৭১ পৃঃ।
ইসলামী সৈন্যদলের যাত্রা এবং আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহার ক্রন্দন (تَوْدِيْعُ الْجَيْشِ الْإِسْلاَمِيْ وَبُكاَءُ عَبْدِ اللهِ بْنِ رَوَاحَةَ):
ইসলামী সৈন্যদল যখন যাত্রার জন্য প্রস্তুত হল তখন লোকেরা এসে রাসূলে কারীম (ﷺ) কর্তৃক নিযুক্ত সেনাপতিদেরকে বিদায়ী সালাম জানালেন। ঐ সময় অন্যতম সেনাপতি রাওয়াহা ক্রন্দন করতে লাগলেন। জনগণ বললেন, ‘আপনি কেন ক্রন্দন করছেন?’
উত্তরে তিনি বললেন, ‘দেখ, আল্লাহর শপথ! (এর কারণ পৃথিবীর মায়া মহববত কিংবা তোমাদের সঙ্গে আমার মধুর সম্পর্ক এ জন্য নয়, বরং আমি রাসূলে কারীম (ﷺ)-কে আল্লাহর কিতাবের একটি আয়াত পড়তে শুনেছি যাতে জাহান্নামের উল্লেখ আছে। আয়াতটি হচ্ছে :
:(وَإِن مِّنكُمْ إِلَّا وَارِدُهَا كَانَ عَلٰى رَبِّكَ حَتْمًا مَّقْضِيًّا) [مريم:71]،
‘তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যাকে জাহান্নাম অতিক্রম করতে হবে না, এটা তোমার প্রতিপালকের অনিবার্য ফায়সালা।’ [মারইয়াম (১৯) : ৭১]
আমি জানি না যে, জাহান্নামের নিকট আগমনের পর কেমন করে ফিরে আসতে পারব?
অন্যেরা বললেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা আপনার সঙ্গী হয়ে, নিরাপত্তা দান করবেন, আপনার পক্ষ হতে শত্রুদের প্রতিহত করবেন, আপনাকে সওয়াব দ্বারা পুরস্কৃত করবেন এবং ফিরে এসে গণীমত দান করবেন। আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা আবৃত্তি করলেন :
لكنني أسأل الرحمن مغفــرة ** وضربة ذات فرع تقذف الزبدا
أو طعنة بيدي حران مجـهزة ** بحربة تنفذ الأحشـاء والكبدا
حتى يقال إذا مروا عَلٰى جدثي ** أرشده الله من غاز وقد رشدا
অর্থ : ‘কিন্তু আমি দয়ালু আল্লাহর নিকট ক্ষমা এবং হাড় কোকড়ান, মস্তিষ্ক বিচ্ছুরণকারী তরবারীর কর্তন অথবা কোন বর্শা পরিচালনাকারীর হাতগুলো, নাড়িভূঁড়িসমূহ এবং কলিজার উপর অতিক্রমকারী বর্শার আঘাতের প্রার্থনা করছি। যাতে লোকজনেরা যখন আমার কবরের পাশ দিয়ে যাত্রা করবে তখন যেন তারা বলে কি আশ্চর্য এ সেই গাজী যাকে আল্লাহ তা‘আলা হিদায়াত দিয়েছিলেন এবং যিনি হিদায়াতপ্রাপ্ত হয়েছিল।
এরপর সৈন্যদল যাত্রা শুরু করলেন। রাসূলে কারীম (ﷺ) এঁদের অনুসরণ করে সান্নায়াতুল অদা’ নামক স্থান পর্যন্ত গমন করেন এবং সেখান হতে তাদের আলবিদা (বিদায়) বলেন।[1]
[1] ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৩৭৩-৩৭৪ পৃঃ, যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ১৫৬ পৃঃ, শাইখ আব্দুল্লাহ মুখতাসারুস সীরাহ ৩২৭ পৃঃ।
ইসলামী সৈন্যদলের পূর্ব গমন এবং হঠাৎ ভয়ানক অবস্থার সম্মুখীন (تَحَرَّكُ الْجَيْشِ الْإِسْلاَمِيْ،وَمُبَاغَتَته حَالَة رَهِيْبَة):
ইসলামী সৈন্যদল উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে মা‘আন নামক স্থানে পৌঁছেন। এ স্থানটি উত্তর হিজাযের সন্নিকটে শামী (উরদুনী) অঞ্চলে অবস্থিত। মুসলিম বাহিনী এখানে শিবির স্থাপন করেন। মুসলিম বাহিনীর গোয়েন্দাগণ সংবাদ পরিবেশন করেন যে, রোমান সম্রাট হিরাক্বল বালক্বা’ নামক অঞ্চলের মাআব নামক স্থানে এক লক্ষ রোমান সৈন্যসহ অবস্থান করেছেন এবং লাখম ও জুযাম বালক্বাইন ও বাহরা এবং বালী (আরবের বিভিন্ন গোত্র) গোত্রের অতিরিক্ত এক লক্ষাধিক সৈন্য তাদের পতাকা তলে সমবেত হয়েছে।
মা’আন নামক স্থানে পরামর্শ বৈঠক (الْمَجْلِسُ الْاِسْتِشَارِيْ بِمَعَانٍ):
মুসলিমগণের ধারণায় এ চিন্তা মোটেই ছিল না যে, যুদ্ধপ্রিয় এরূপ এক বিশাল বাহিনীর সম্মুখীন তাঁদের হতে হবে। এ দীর্ঘ ও দুর্গম পথ অতিক্রম করার পরে হঠাৎ এ সমস্যার মুখোমুখী হয়ে তাঁরা চিন্তায় একদম জর্জরিত হয়ে পড়লেন। তাঁদের সামনে এখন যে প্রশ্নটি সব চাইতে বড় হয়ে দেখা দিল তা হচ্ছে, দু’ লক্ষ সৈন্যের সমুদ্র সমতুল্য এ বিশাল বাহিনীর সঙ্গে মাত্র তিন হাজার সৈন্য নিয়ে তাঁরা মোকাবেলা করবেন কিনা। চিন্তায় চিন্তায় তাঁরা যেন অস্থির ও দিশেহারা হয়ে পড়লেন এবং দারুন দুশ্চিন্তা ও আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে দু’ রাত্রি সেখানে অতিবাহিত করলেন। কিছু সংখ্যক মুজাহিদ এ রকম একটি চিন্তাভাবনা করছিলেন যে, একটি পত্র লিখে শত্রু সৈন্যের সংখ্যা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে অবহিত করা হোক। এর ফলে তাঁর নিকট থেকে সঠিক নির্দেশনা লাভ কিংবা অধিক সাহায্য লাভের সম্ভাবনা থাকবে।
কিন্তু আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রাঃ) এ মতের বিরোধিতা করে বললেন, ‘হে ভ্রাতৃবৃন্দ! আল্লাহর কসম! যে ব্যাপারটিকে আপনারা ভয় করছেন সেটি হচ্ছে সেই শাহাদাত যার খোঁজে আপনারা বের হয়েছেন। এটা অবশ্যই স্মরণ রাখবেন যে, শত্রুর সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হবে সৈন্য সংখ্যা, শক্তি কিংবা সমরাস্ত্রের আধিক্যের ভিত্তিতে নয়, বরং তাদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হবে শুধুমাত্র আল্লাহর দ্বীনের খাতিরে, যার দ্বারা আল্লাহ আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন। কাজেই, চলুন আমরা অগ্রসর হই। আল্লাহর দ্বীনের খাতিরে যুদ্ধ করতে গিয়ে আমাদের জন্য রয়েছে দুটি কল্যাণ এবং এর যে কোন একটি আমরা পাবই। আমরা বিজয়ী হলে বিজয়ের সম্মান লাভ করব, আর যদি শহীদ হয়ে যাই তাহলে শাহাদতের মর্যাদা লাভ করব।’ অবশেষে আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহাহর প্রস্তাবকৃত কথার উপর সিদ্ধান্ত হয়ে গেল।
শত্রুদের উপর ইসলামী সৈন্যদলের আক্রমণ (الجَيْشُ الْإِسْلَامِيْ يَتَحَرَّكُ نَحْوَ الْعَدُوِّ):
মূল কথা, ইসলামী সৈন্যদল মায়ান নামক স্থানে দু’ রাত্রি অতিবাহিত করার পর শত্রুদের আক্রমণ করেন এবং ‘বালক্বা’ নামক জায়গায় একটি বস্তিতে, যার নাম ছিল ‘শারিফ’, হিরাক্কলের সৈন্যদের সম্মুখীন হন। এরপর শত্রু সৈন্য আরও নিকটবর্তী হলে মুসলিম সৈন্যগণ মুতাহ নামক স্থানের দিকে অগ্রসর হয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। অতঃপর সৈন্যদের শৃঙ্খলা বিন্যাস করা হয়। ডান বাহুতে কুতবাহ বিন কাতাদা উযরী (রাঃ)-কে এবং বাম বাহুতে উবাদাহ বিন মালিক আনসারী (রাঃ)-কে নিযুক্ত করা হয়।
যুদ্ধারম্ভ এবং সেনাপতিগণের পর পর শাহাদত বরণ (بِدَايَةُ الْقِتَالِ، وَتَنَاوُبُ الْقَوَادِ):
এরপর মুতাহয় দু’ দলের মধ্যে মুখোমুখী সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেল। এক পক্ষে অত্যন্ত সাধারণ অস্ত্র সম্ভার সজ্জিত মাত্র তিন হাজার মুসলিম সৈন্য, অন্যপক্ষে উন্নত সমর সাজে সজ্জিত দু’ লক্ষ সৈন্য। এ যুদ্ধ ছিল সৈন্য সংখ্যা এবং সাজ-সরঞ্জামের দিক থেকে এক অকল্পনীয় অসম যুদ্ধ। সমগ্র পৃথিবী বিস্ময়াভিভূত হয়ে লক্ষ্য করছিল এর গতি প্রকৃতি। কিন্তু যখন ঈমানের বসন্তকালীন হাওয়া প্রবাহিত হয় তখন ঠিক সে রকম বিস্ময়কর ঘটনাবলী প্রকাশ হয়ে যায়।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরম প্রিয় যায়দ বিন হারিসাহ (রাঃ) সর্ব প্রথম পতাকা গ্রহণ করেন এবং এমন উদ্দীপনা ও সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন যে, ইসলামী বাজপক্ষীদের ছাড়া অন্য কোথাও আর এর নজীর পাওয়া যায় না। অমিত বিক্রমে তিনি যুদ্ধ করতে থাকেন এবং যুদ্ধ করতে থাকেন। কিন্তু তাঁর যুদ্ধোন্মাদনার এক পর্যায়ে শত্রুপক্ষের বর্শা বিদ্ধ হয়ে শাহাদতের পেয়ালায় অমৃত পান করে ভূমিতে লুটিয়ে পড়লেন।
এরপর পালা ছিল জা’ফার (রাঃ)-এর। অনতিবিলম্বে তিনি পতাকা উঠিয়ে নিলেন এবং পূর্ণ উদ্যমে যুদ্ধ আরম্ভ করে দিলেন। যুদ্ধ যখন পূর্ণ মাত্রায় পৌঁছল তখন তিনি তাঁর লাল-কালো ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফ দিয়ে নীচে নেমে পড়লেন। ঘোড়ার পাসমূহ কর্তন করে দিলেন এবং আঘাতের পর আঘাত হেনে বাধা দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে শত্রুর আঘাতে তাঁর দক্ষিণ হাতটি কর্তিত হয়ে পড়ল। এরপর বাম হাত দ্বারা পতাকা ধারণ পূর্বক তাকে উর্ধ্বে উত্তোলিত অবস্থায় রাখার জন্য অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলেন। এক পর্যায়ে তাঁর বাম হাতও কর্তিত হল। অতঃপর তিনি তাঁর উভয় হাতের অবশিষ্টাংশ দ্বারা বুকের সঙ্গে পতাকা জড়িয়ে ধরে যতক্ষণ না শাহাদতের পেয়ালা পান করলেন ততক্ষণ পতাকা সমুন্নত রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে গেলেন।
বলা হয়েছে যে, একজন রোমীয় তাঁকে এমন ভাবে তরবারী দ্বারা আঘাত করেছিল যে, তাতে তাঁর দেহ দ্বিখন্ডিত হয়ে গিয়েছিল। আল্লাহ তা‘আলা তাঁই দু’ হাতের বিনিময়ে জান্নাতে দু’টি হাত প্রদান করেছেন যার ফলে তিনি যেখানে খুশী সেখানে উড়ে বেড়াতে পারছেন। এ জন্য তাঁকে জা’ফার ত্বাইয়ার এবং ‘যুল জানাহাইন’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। অর্থাৎ তাঁর উপাধিসহ নাম হয়েছে জা’ফার তাইয়ার যুল জানাহাইন বা দু’ পাখা বিশিষ্ট উড়ন্ত জা’ফার (ত্বাইয়ার অর্থ উড়ন্ত এবং যুল জানাহাইন অর্থ দু’ বাহু বিশিষ্ট)।
ইমাম বুখারী (রঃ) নাফি‘র বরাতে ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, মুতাহ যুদ্ধের দিন জা’ফার (রাঃ)-এর শাহাদতের পর তাঁর শরীরে বর্শা ও তরবারীর ৫০টি আঘাত গণনা করেছিলাম। এসবের মধ্যে একটি আঘাতও পিছন দিক থেকে লাগেনি।[1]
অন্য এক সূত্রের ভিত্তিতে ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘আমি সে যুদ্ধে মুসলিমগণের সঙ্গে ছিলাম। জা’ফার বিন আবূ ত্বালীবের খোঁজ করতে গিয়ে আমরা তাঁকে শাহাদতপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণের মধ্যে পেলাম। আমরা তাঁর দেহে বর্শা এবং তীরের নব্বইটিরও অধিক আঘাতের চিহ্ন প্রত্যক্ষ করলাম।[2]
নাফে‘ হতে ইবনে উমার (রাঃ)-এর বর্ণনায় আরও অতিরিক্ত এ কথাগুলো আছে যে, ‘এই আঘাতের চিহ্নগুলো আমরা তাঁর শরীরের সামনের দিকে পেলাম।’’[3]
এভাবে অসাধারণ বীরত্ব ও সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করার পর জা’ফার (রাঃ) শাহাদত বরণ করেন। অতঃপর আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রাঃ) পতাকা ধারণ করে নিজের ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে সম্মুখ পানে অগ্রসর হতে থাকলেন এবং তাঁর সঙ্গে মোকাবেলা করার জন্য আহবান জানিয়ে নীচের কবিতার চরণগুলো আবৃত্তি করতে থাকলেন,
أقسمت يا نفس لتنزلنه كارهة أو لتطـاوعنه
إن أجلب الناس وشدوا الرنه مالي أراك تكرهين الجنه
অর্থ : ‘হে আত্মা! আমি শপথ করছি যে, তুমি অবশ্যই প্রতিদ্বন্দ্বীতায় অবতরণ করবে, ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় হোক যদি লোকেরা যুদ্ধরত থাকে এবং বর্শা পরিচালনা করতে থাকে তাহলে আমি তোমাকে জান্নাত হতে কেন পশ্চাদপসরণ করতে দেখছি।
এরপর তিনি প্রতিদ্বন্দ্বীতায় অবতরণ করেন। এমতাবস্থায় তাঁর চাচাত ভাই মাংস যুক্ত একটি হাড় নিয়ে আসেন এবং বলেন, এ দ্বারা আপন পৃষ্ঠদেশ শক্ত করে নাও। কারণ এ দিবসে তোমাকে কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে। তিনি হাড়টি নিয়ে একবার কামড়ালেন তারপর তা ফেলে দিয়ে তরবারী ধরলেন এবং সম্মুখে অগ্রসর হয়ে যুদ্ধ করতে করতে শাহাদত বরণ করলেন।
[1] সহীহুল বুখারী শাম রাজ্যে মুতাহ যুদ্ধ সম্পর্কিত অধ্যায় ২য় খন্ড ৬১১ পৃঃ।
[2] ঐ অধ্যায় ২য় খন্ড ৬১১ পৃঃ।
[3] ফাতহুল বারী ৭ম খন্ড ৫১২ পৃঃ। বাহ্যত দুই হাদীসে সংখ্যার পার্থক্য পরিদৃষ্ট হচ্ছে, সামঞ্জস্য বিধান হেতু বলা হয়েছে যে, তীরের আঘাত হিসেবে ধরার কারণে সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে দ্র: ফাতহুল বারী)।
ঝান্ডা, আল্লাহর তলোয়ারসমূহের মধ্য হতে এক তলোয়ার হাতে (الْرَّايَةُ إِلٰى سِيْفٍ مِّنْ سُيُوْفِ اللهِ):
ওই সময় বনু আজলান গোত্রের সাবেত বিন আকরাম নামক এক সাহাবী লাফ দিয়ে ঝান্ডা উঁচিয়ে ধরে বললেন, ‘হে মুসলিম ভ্রাতাগণ! আমাদের মধ্য হতে কোন এক জনকে সেনাপতি নির্বাচিত করে নাও।’ সাহাবীগণ (রাঃ) বললেন, ‘আপনি এ দায়িত্ব পালন করুন।’
এ কথা শুনে তিনি বললেন, ‘এ দায়িত্ব পালন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ এ প্রেক্ষিতে সাহাবীগণ (রাঃ) খালিদ বিন ওয়ালীদকে সেনাপতি মনোনীত করেন। সেনাপতির দায়িত্ব ভার গ্রহণের পর ঝান্ডা হাতে নিয়ে তিনি অত্যন্ত উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকেন। সহীহুল বুখারীতে খালিদ বিন ওয়ালীদ নিজেই বর্ণনা করেছেন যে, ‘মুতাহ যুদ্ধের দিন আমার হাতে ৯টি তলোয়ার ভেঙ্গেছিল এবং ইয়ামানের তৈরি মাত্র একটি ছোট তলোয়ার হাতে অবশিষ্ট ছিল।[1] অন্য এক বর্ণনায় তাঁর বিবরণটি এভাবে রয়েছে যে, ‘মুতাহ যুদ্ধের দিন আমার হাতে ৯ খানা তরবারী ভেঙ্গে যায় এবং মাত্র এক খানা ইয়েমেনী তরবারী অবশিষ্ট থাকে।[2]
এদিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যুদ্ধের ময়দান থেকে কোন খবর না পেয়ে অত্যন্ত চিন্তাযুক্ত ছিলেন। এমন সময় ওহীর মাধ্যমে তাঁকে খবর দেওয়া হয় যে,
(أَخَذَ الرَّايَةَ زَيْدٌ فَأُصِيْبَ، ثُمَّ أَخَذَ جَعْفَرُ فَأُصِيْبَ، ثُمَّ أَخَذَ ابْنُ رَوَاحَةَ فَأُصِيْبَ – حَتّٰى أَخَذَ الرَّايَةَ سَيْفٌ مِّنْ سُيُوْفِ اللهِ، حَتّٰى فَتَحَ اللهُ عَلَيْهِمْ).
পতাকা হাতে যুদ্ধ করতে গিয়ে যায়দ (রাঃ) শহীদ হয়েছেন। অতঃপর জা’ফার (রাঃ) পতাকা হাতে নিয়ে যুদ্ধ করতে থাকেন এবং তিনিও শহীদ হয়ে যান। তাঁর শাহাদত বরণের পর আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহ পতাকা হাতে নিয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ হয়ে যান।
এ সংবাদ অবগত হয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চক্ষুযুগল অশ্রুসজল হয়ে ওঠে।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলার তলোয়ারসমূহের মধ্য হতে এক তলোয়ার পতাকা হাতে নিয়ে অমিত বিক্রমে এমন ভাবে যুদ্ধ করতে থাকেন যে, আল্লাহ মুসলিমগণকে বিজয়ী করেন।[3]
[1] সহীহুল বুখারী শাম রাজ্যে মুতাহ যুদ্ধ সম্পর্কিত অধ্যায় ২য় খন্ড ৬১১ পৃঃ।
[2] সহীহুল বুখারী শাম রাজ্যে মুতাহ যুদ্ধ সম্পর্কিত অধ্যায় ২য় খন্ড ৬১১ পৃঃ।
[3] সহীহুল বুখারী শাম রাজ্যে মুতাহ যুদ্ধ সম্পর্কিত অধ্যায় ২য় খন্ড ৬১১ পৃঃ।
যুদ্ধের পরিসমাপ্তি (نِهَايَةُ الْمَعْرِكَةِ):
জীবন বাজী রেখে যতই বীরত্ব এবং সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করুক না কেন এটা অতীব আশ্চর্যের বিষয় ছিল যে, অত্যন্ত রণ পিপাসু ও রণ কুশলী বিশাল রোমীয় বাহিনীর মোকাবেলায় মুসলিমগণের ছোট্ট একটি বাহিনী পর্বতের ন্যায় অটল থাকবে এবং তার চাইতেও আশ্চর্যের ব্যাপার ছিল খালিদ বিন ওয়ালীদের রণ প্রজ্ঞা ও রণ নৈপুণ্য। মুতাহর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীকে যুদ্ধের ভয়াবহ বিভীষিকা থেকে সম্মানের সঙ্গে বের করে আনার ব্যাপারে তিনি যে রণ কৌশল অবলম্বন করেছিলেন ইসলামের ইতিহাসে চিরদিনের জন্য তা স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে এবং প্রত্যেক মুসলিমগণের জন্য তা গর্ব ও প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
এ যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্যাদির ক্ষেত্রে যথেষ্ট মত পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি পর্যালোচনা করলে জানা যায় যে, যুদ্ধের প্রথম দিন খালিদ বিন ওয়ালিদ রোমীয়দের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সর্বক্ষণই অটল থাকেন। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে তিনি এমন এক রণ কৌশল অবলম্বন করেন যা রোমীয়গণের মনে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব এবং ভীতির সঞ্চার করে এবং অত্যন্ত দক্ষতা ও নিরাপত্তার সঙ্গে মুসলিম বাহিনীকে পশ্চাদপসরণ করে নিতে সক্ষম হন। তাঁর এ রণ কৌশলের কারণেই রোমীয় বাহিনী পশ্চাদ্ধাবন করার সাহস পায়নি। সৈন্য সংখ্যার ব্যাপারে এ যুদ্ধ ছিল দারুণ অসম দু’ পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ। কাজেই, মুসলিমগণের সসম্মানে পশ্চাদপসরণ ছিল অনিবার্য। কিন্তু পশ্চাদপসরণের ক্ষেত্রে শত্রু পক্ষের পশ্চাদ্ধাবনের ভয়ও ছিল যথেষ্ট। কিন্তু খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) শত্রুদেরকে পশ্চাদ্ধাবনের প্রলুব্ধতা থেকে শুধু যে বিরত রেখেছিলেন তাই নয় বরং তারা কিছুটা ভীত সন্ত্রস্ত্রও হয়ে পড়েছিল।
তাঁর পরিবর্তিত রণ কৌশলের প্রেক্ষাপটে দ্বিতীয় দিবসে প্রভাতে তিনি নতুন এক ধারায় তাঁর বাহিনীকে বিন্যস্ত করে নেন। এ বিন্যাস সাধন করতে গিয়ে তিনি সম্মুখ ভাগের দলকে পশ্চাদ ভাগে এবং পশ্চাদ ভাগের দলকে সম্মুখ ভাগে, ডান পাশের দলকে বাম পাশে এবং বাম পাশের দলকে ডান পাশে স্থানান্তরিত করেন। পরিবর্তিত বিন্যাস ধারা প্রত্যক্ষ করে শত্রু চমকিত হয়ে ভাবল যে তাঁরা নতুন ভাবে সাহায্য প্রাপ্ত হয়েছে। এর ফলে তাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার হয়ে গেল। এরপর উভয় পক্ষের সৈন্যগণ যখন সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তখন খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) সুশৃঙ্খল ভাবে বিন্যস্ত মুসলিম বাহিনীকে ধীরে ধীরে পিছনের দিকে সরিয়ে নিতে শুরু করেন। কিন্তু রোমীয়গণ এই ভেবে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল না যে, মুসলিমগণ হয় তো এমন এক কৌশল অবলম্বন করেছেন যার মাধ্যমে তাদেরকে মরু প্রান্তরে নিক্ষিপ্ত হতে পারে এবং তেমনি যদি হয়ে যায় তাহলে তাদেরকে দারুণ দূর্বিপাকে নিপতিত হতে হবে। এর ফলে রোমীয়গণ মুসলিমগণকে পশ্চাদ্ধাবন করার পরিবর্তে নিজ অঞ্চলে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারটিকেই প্রাধান্য দিয়ে স্বস্থানে প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশ্যে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রস্থান করল। এ দিকে মুসলিমগণ নিরাপদে পশ্চাদপসরণ ক’রে মদীনা প্রত্যাবর্তন করল।[1]
[1] ফতহুলী বারী ৫১৩-৫১৪ পৃঃ। যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ১৫৬ পৃঃ। যুদ্ধের বিস্তৃত বিবরণ পূর্বোল্লিখিত কিতাবসহ এ দু’ কিতাব হতে গৃহীত হয়েছে।
উভয় পক্ষের নিহত সৈন্য সংখ্যা (قَتْلَى الْفَرِيْقَيْنِ):
এ যুদ্ধে ১২ জন মর্দে মু’মিন শাহাদতবরণ করেন। কিন্তু কত জন রোমীয় সৈন্য নিহত হয়েছিল তা সঠিক জানা যায় নি। তবে যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ সূত্রে জানা যায় যে, তাদের বহু সৈন্য নিহত হয়েছিল। অনুমান করা যেতে পারে যে, খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) একা যখন নিজ হাতে নয় খানা তলোয়ার ভেঙ্গেছেন তখন নিহত এবং আহতের সংখ্যা কতই না অধিক হতে পারে।
এই যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া (أَثَرُ الْمَعْرِكَةِ):
যে প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে এ যুদ্ধের বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মধ্যে নিজেদের নিপতিত করা হয়েছিল যদিও সে প্রতিশোধ গ্রহণ সম্ভব হয় নি, তবুও মুসলিমগণের জন্য তার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। মুসলিমগণ যে একটি অকুতোভয় জাতি এবং কোন পার্থিব শক্তি তা যত বিশালই হোক না কেন তার কাছে যে তাঁরা মাথা নোয়াতে পারেন না, তা আরও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, মুসলিমগণের শৌর্যবীর্যের কথাও বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ল এবং এর ফলশ্রুতিতে সমগ্র আরব জাহান স্তম্ভিত ও হতচকিত হয়ে পড়ল। কারণ, তদানীন্তন রোমক শক্তি ছিল পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎশক্তি। শত্রুভাবাপন্ন আরব জাহান মনে করে ছিল রোমক বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারটি হবে মুসলিমগণের জন্য আত্মহত্যার শামিল। কিন্তু মাত্র তিন হাজার সৈন্যর একটি বাহিনী অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত ও সুদক্ষ দুই লক্ষ সৈন্যের সঙ্গে মোকাবেলা করে উল্লেখযোগ্য কোন ক্ষতি ছাড়াই নিরাপদ পশ্চাদপসরণে সক্ষম হওয়ার ব্যাপারটি ছিল একটি অচিন্তণীয় ব্যাপার। অধিকন্তু, আরব জাহানের নিকট এ সত্যটিও উদঘাটিত হয়ে গেল যে, আরব ভূখন্ডে যে ধরণের লোকজন সম্পর্কে তাদের পরিচিতি ছিল, মুসলিমগণ সে সব হতে ভিন্নতর অনন্যসাধারণ একটি গোষ্ঠি। এরা হচ্ছেন আল্লাহর তরফ থেকে সাহায্য ও সহানুভূতি প্রাপ্ত এবং তাঁদের পরিচালক প্রকৃতই আল্লাহর রাসূল (ﷺ)।
এমনি এক অবস্থার প্রেক্ষাপটে আমরা দেখতে পাই যে, আরবের যে সকল গোত্র মুসলিমগণের প্রতি বৈরিতা পোষণ করত এবং কারণে অকারণে যখন তখন তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতো মুতাহ’ যুদ্ধের পর তারাও ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হল। এদের মধ্যে বনু সুলাইম, আশজা’, গাত্বাফান, যুবইয়ান এবং ফাযারাহ ও অন্যান্য কতগুলো গোত্র ইসলাম গ্রহণ করল। এ যুদ্ধের মধ্য দিয়েই রোমকদের সঙ্গে মুসলিমগণের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ আরম্ভ হয়ে যায়, যার ফলে পরবর্তী সময়ে রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন দেশ বিজয় এবং দূর দূরান্তের বিভিন্ন অঞ্চলের উপর মুসলিমগণের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
যাতুস সালাসিল অভিযান (سَرِيَّةُ ذَاتِ السَّلَاسِلِ):
মুতাহ যুদ্ধের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন শাম রাজ্যে বসবাসকারী আরব গোত্রসমূহের মনোভাব বুঝতে পারলেন যে মুসলিমগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তারা রোমকদের পতাকাতলে সমবেত হয়েছিল, তখন তিনি এমন এক কৌশল অবলম্বনের প্রয়োজন অনুভব করলেন যার মাধ্যমে এক দিকে গোত্রসমূহ ও রোমকদের ঐক্যবোধের ক্ষেত্রে ফাটল সৃষ্টি করা যায় এবং অন্যদিকে মুসলিমগণের নিকটে নিজেদেরকে তাদের বন্ধু হিসেবে পরিচয় প্রদানের মাধ্যমে তাদের মনে বিশ্বাস ও আস্থার মজবুত ভিত্তি গড়ে তোলা সম্ভব হয়। এ রকম এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে ভবিষ্যতে তারা আর মুসলিমগণের বিরুদ্ধে যু্দ্ধ করার জন্য রোমকদের সঙ্গে জোট বাঁধার প্রয়োজন বোধ করবে না।
আলোচ্য উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি অবলম্বনের জন নাবী কারীম (ﷺ) ‘আমর বিন ‘আসকে (ﷺ)-কে মনোনীত করেন। কারণ, উপত্যকার বালা গোত্রের সঙ্গে তিনি সম্পর্কিত ছিলেন। তাই মুতাহ যুদ্ধের পর পরই অর্থাৎ ৮ম হিজরীর জুমাদাল আখেরাতে সে সকল গোত্রের লোকদেররে সান্তনা দানের উদ্দেশ্যে রাসূলে কারীম (ﷺ) ‘আমর বিন ‘আস (রাঃ)-কে তাদের নিকট প্রেরণ করেন। বলা হয়েছে যে, গোয়েন্দাগণ এ খবরও দিয়েছিল যে বনু কুযা’আহ গোত্র মদীনার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের উপর আক্রমণ পরিচালনার উদ্দেশ্যে একটি সৈন্যদল সংগ্রহ করে রেখেছে। সম্ভবত এ দুইটি উদ্দেশ্যেকে সামনে রেখেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ‘আমর বিন আস (রাঃ)-কে তাদের নিকট প্রেরণ করেন।
যাহোক, ‘আমর বিন আস (রাঃ)-এর হাতে একটি সাদা ও একটি কালো পতাকা দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর অধীনে মুহাজিরীন ও আনসারদের সমন্বয়ে গঠিত তিনশ সৈন্যর একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। এ বাহিনীর সঙ্গে ত্রিশটি ঘোড়াও ছিল। বিদায় কালে বাহিনী প্রধানের নিকট তিনি এ নির্দেশ প্রদান করলেন যে, বালা, উযরা এবং বিলকীন গোত্রের নিকট দিয়ে যাবার সময় যে সকল লোকের সঙ্গে সাক্ষাত হবে তাদের সাহায্য কামনা করবে। মুসলিম বাহিনী রাতের অন্ধকারে ভ্রমণ করতেন এবং দিবাভাগে আত্মগোপন করে থাকতেন। এভাবে চলতে চলতে তাঁরা যখন শত্রু পক্ষের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছলেন তখন জানতে পারলেন যে, তাদের বাহিনীতে বহুগুণে বেশী সৈন্য রয়েছে। তাই ‘আমর বিন ‘আস (রাঃ) সাহায্য পাঠানোর আরজিসহ রাফি বিন মুক্বায়স জুহানী (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে প্রেরণ করলেন।
এ প্রেক্ষিতে তিনি আবূ উবাইদাহ বিন জাররাহ (রাঃ)-এর হস্তে পতাকা প্রদান করে তাঁর নেতৃত্বাধীনে দু’শ সৈন্যর একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। এ বাহিনীতে মুহাজিরীনদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ যেমন, আবূ বাকর সিদ্দীক এবং উমার ইবনু খাত্তাব (রাঃ) এবং আনসার প্রধানগণও ছিলেন। আবূ উবাইদাহকে এ নির্দেশ প্রদান করা হয় যে, তিনি যেন ‘আমর বিন আসের সঙ্গে মিলিত হয়ে উভয়ে একত্রে মিলে মিশে কাজ-কর্ম সম্পন্ন করেন, কোন ব্যাপারে যেন মতবিরোধের সৃষ্টি না হয়, ‘আমর বিন ‘আস (রাঃ)-এর সঙ্গে মিলিত হয়ে আবূ উবাইদাহ (রাঃ) ইমামত করতে চাইলে ‘আমর বিন ‘আস (রাঃ) বললেন, ‘আপনি তো এসেছেন আমার সাহায্যকারী হিসেবে আর আমি এসেছি বাহিনীর পরিচালক হিসেবে।’ আবূ উবাইদাহ (রাঃ) সে কথা মেনে নিলেন। ‘আমর বিন আস (রাঃ) সালাতে ইমামত করতে থাকলেন।
সাহায্য আসার পর মুসলিম বাহিনী অগ্রসর হয়ে কুযা’আহর অঞ্চলে প্রবেশ করলেন এবং এ অঞ্চলকে পদানত করার পর দূর দূরান্তের সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে গেলেন। অগ্রগমনের এক পর্যায়ে এক দল সৈন্যের সঙ্গে তাঁদের যুদ্ধ বেধে যায়। কিন্তু মুসলিমগণ যখন তাদের আক্রমণ করল তখন তারা বিক্ষিপ্ত হয়ে এদিক সেদিক পলায়ন করল।
এরপর আউফ বিন মালিক আশজা’ঈ (রাঃ)-কে সংবাদ বাহক হিসেবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে প্রেরণ করা হয়। তিনি মুসলিম বাহিনীর নিরাপদ প্রত্যাবর্তন এবং যুদ্ধের অন্যান্য খবরাদি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে পেশ করেন। যাতুস সালাসেল (সুলাসিল উভয়ই পড়া যেতে পারে, সে দেশের একটি মাঠের নাম) ওয়াদিউল কুরা হতে কিছু দূর অগ্রসর হয়। এখান হতে মদীনার দূরত্ব দশ দিনের পথ। ইতিহাসবিদ ইবনু ইসহাক্বের বর্ণনার সূত্রে জানা যায় যে, মুসলিমগণ জুযাম গোত্রের দেশে ‘সালসাল’ নামক স্থানে একটি ঝরণার নিকটে অবতরণ করেছিলেন। এ কারণেই এ যুদ্ধের নাম ‘যাতুস সালাসিল’ হয়েছিল।[1]
[1]ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৬২৩-৬২৬ পৃঃ, যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ১৫৭পৃঃ।
খাযিরাহ অভিযান (سَرِيَّةُ أَبِيْ قَتَادَةَ إِلٰى خَضِرَةَ):
(৮ম হিজরী শা‘বান মাস) এ অভিযানের কারণ ছিল, নাজদের অন্তর্ভুক্ত মুহারিব গোত্রের অঞ্চলে খাযেরা নামক জায়গায় বনু গাত্বাফান সৈন্য একত্রিত করছিল। এ প্রেক্ষিতে তাদের সমুচিত শিক্ষা দানের উদ্দেশ্যে পনের জন মুজাহিদসহ আবূ ক্বাতাদাহ (রাঃ)-কে প্রেরণ করা হয়। তিনি শত্রুদের একাধিক ব্যক্তিকে হত্যা এবং বন্দী করেন। কিছু গণীমতও হস্তগত হয়। এ অভিযানে তাঁরা পনের দিন বাইরে অবস্থান করেন।[1]
[1] রহমাতুল্লিল আলামীন ২য় খন্ড ২৩৩ পৃঃ, তালকীহুল ফহুম ৩৩ পৃঃ।