১০. পূর্ণাঙ্গ বয়কট
অত্যাচার উৎপীড়নের অঙ্গীকার
মুশরিকদের সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা যখন ব্যর্থ হলো এবং তারা দেখতে পেল যে, বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিবের মুসলিম ও কাফির সকলের সম্মিলিতভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে সাহায্যদানের অঙ্গীকার করেছে। এ সব কারণে মুশরিকদের হতবুদ্ধিতা আরো বেড়ে গেল।
পূর্বোলিখিত সিদ্ধান্ত মোতাবেক মুশরিকগণ ‘মুহাসসাব’ নামক উপত্যকায় খাইফে বনী কিনানাহর ভিতরে একত্রিত হয়ে সর্বসম্মতভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ হল যে, বনু হাশিম এবং বনু মুত্তালিবের সাথে ক্রয় বিক্রয়, সামাজিক কার্যকলাপ, অর্থনৈতিক আদান-প্রদান, কুশল বিনিময় ইত্যাদি সবকিছুই বন্ধ রাখা হবে। কেউ তাদের কন্যা গ্রহণ করতে কিংবা তাদের কন্যা দান করতে পারবে না। তাদের সঙ্গে উঠাবসা, কথোপকথন মেলামেশা, বাড়িতে যাতায়াত ইত্যাদি কোনকিছুই করা চলবে না। হত্যার জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে যতদিন তাদের হাতে সমর্পণ না করা হবে ততদিন পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে।
মুশরিকগণ এ বর্জন বা বয়কটের দলিলস্বরূপ একটি অঙ্গীকারনামা সম্পাদন করে যাতে অঙ্গীকার করা হয়েছিল যে, তারা কখনো বনু হাশিমের পক্ষ হতে কোন সন্ধিচুক্তির প্রস্তাব গ্রহণ করবে না এবং তাদের প্রতি কোন প্রকার ভদ্রতা বা শিষ্টাচার প্রদর্শন করবে না, যে পর্যন্ত তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে হত্যার জন্য মুশরিকগণের হাতে সমর্পন না করবে সে পর্যন্ত এ অঙ্গীকার নামা বলবৎ থাকবে।
ইবনে কাইয়ূমের বর্ণনা সূত্রে বলা হয়েছে যে, এ অঙ্গীকারপত্রখানা লিখেছিলেন মানসুর বিন ইকরামা বিন ‘আমির বিন হাশিম। কেউ কেউ উল্লেখ করেছেনে যে, এ অঙ্গীকার নামা লিখেছিলেন নাযর বিন হারিস। কিন্তু সঠিক কথা হচ্ছে এ অঙ্গীকার নামার সঠিক লেখক ছিলেন বোগায়েয বিন ‘আমির বিন হাশিম। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার প্রতি বদ দোওয়া করেছিলেন যার ফলে তার হাত পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিল।[1]
যাহোক এ অঙ্গীকার স্থিরীকৃত হল এবং অঙ্গীকারনামাটি ক্বাবা’হর দেয়ালে ঝুলিয়ে দেয়া হল। যার ফলে আবূ লাহাব ব্যতীত বনু হাশিম এবং বনু মুত্তালিবের কী কাফের, কী মুসলিম সকলেই আতঙ্কিত হয়ে ‘শেয়াবে আবূ ত্বালিব’ গিরি সংকটে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল নবুওয়ত সপ্তম বর্ষের মুহারম মাসের প্রারম্ভে চাঁদ রাত্রিতে। তবে এ ঘটনা সংঘটনের সময়ের ব্যাপারে আরো মতামত রয়েছে।
[1] যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৪৬ পৃঃ।
তিন বৎসর, ‘শিয়াবে আবূ ত্বালিব’ গিরিসংকটে অন্তরীণাবস্থা
এ বয়কটের ফলে বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিবের লোকজনদের অবস্থা অত্যন্ত কঠিন ও সঙ্গীন হয়ে পড়ল। খাদ্য-শস্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব-সামগ্রী আমদানী ও পানীয় সরবরাহ বন্ধ হয়েছিল। কারণ, খাদ্য-শস্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী যা মক্কায় আসত মুশরিকগণ তা তাড়াহুড়া করে ক্রয় করে নিত। এ কারণে গিরি সংকটে অবরুদ্ধদের অবস্থা অত্যন্ত করুণ হয়ে পড়ল। খাদ্যাভাবে তারা গাছের পাতা, চামড়া ইত্যাদি খেতে বাধ্য হল। কোন কোন সময় তাঁদের উপবাসেও থাকতে হতো। উপবাসের অবস্থা এরূপ হয়ে যখন মর্মবিদারক কণ্ঠে ক্রন্দন করতে থাকত তখন গিরি সংকটে তাঁদের নিকট জিনিসপত্র পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব পড়েছিল, যা পৌঁছত তাও অতি সঙ্গোপনে। হারাম মাসগুলো ছাড়া অন্য কোন সময়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁরা বাহিরে যেতে পারতেন না। অবশ্য যে সকল কাফেলা মক্কার বাহির থেকে আগমন করত তাদের নিকট থেকে তাঁরা জিনিসপত্র ক্রয় করতে পারতেন। কিন্তু মক্কার ব্যবসায়ীগণ এবং লোকজনেরা সে সব জিনিসের দাম এতই বৃদ্ধি করে দিত যে, গিরিসংকটবাসীগণের ধরা ছোঁয়ার বাইরেই তা থেকে যেত।
খাদীজাহ (রাঃ)-এর ভ্রাতুষ্পুত্র হাকীম বিন হিযাম কখনো কখনো তাঁর ফুফুর জন্য গম পাঠিয়ে দিতেন। এক দিবস আবূ জাহলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে গেলে সে খাদ্যশস্য নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বাধা দিতে উদ্যত হল, কিন্তু আবুল বোখতারী এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করল এবং তার ফুফুর নিকট খাদ্য প্রেরণে সাহায্য করল।
এ দিকে আবূ ত্বালিব রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সম্পর্কিত সর্বক্ষণ চিন্তিত থাকতেন। তাঁর নিরাপত্তা বিধানের কারণে লোকেরা যখন নিজ নিজ শয্যায় শয়ন করত তখন তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে নিজ শয্যায় শয়ন করার জন্য পরামর্শ দিতেন। উদ্দেশ্য এই ছিল যে, কেউ যদি তাঁকে হত্যা করতে ইচ্ছুক থাকে তাহলে সে দেখে নিক যে, তিনি কোথায় শয়ন করেন। তারপর যখন লোকজনেরা ঘুমিয়ে পড়ত তিনি তাঁর শয্যাস্থল পরিবর্তন করে দিতেন। নিজ পুত্র, ভাই কিংবা ভ্রাতুষ্পুত্রদের মধ্যথেকে এক জনকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শয্যায় শয়ন করার জন্য পরামর্শ দিতেন এবং তার পরিত্যাজ্য শয্যায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শয়নের ব্যবস্থা করতেন।
এ অবরুদ্ধ অবস্থা সত্ত্বেও হজ্বের সময় নাবী কারীম (ﷺ) এবং অন্যান্য মুসলিমগণ গিরি সংকট থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতেন এবং হজ্বব্রত পালনে আগত ব্যক্তিগণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করতেন। সে সময় আবূ লাহাবের কার্যকলাপ যা ছিল সে সম্পর্কে ইতোপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
অঙ্গীকারনামা বিনষ্ট
এরূপ অবর্ণনীয় সংকটময় অবস্থায় দীর্ঘ দু’ বা তিন বছর অতিক্রান্ত হল। এরপর নবুওয়াত ১০ম বর্ষের মুহাররম মাসে[1] লিখিত অঙ্গীকারনামাটি ছিন্ন করে ফেলা হয় এবং অত্যাচার উৎপীড়নের পরিসমাপ্তিত ঘটানোর প্রচেষ্টা চালানো হয়। কারণ, প্রথম থেকেই কিছু সংখ্যক ছিল এর বিপক্ষে। যারা এর বিপক্ষে ছিল তারা সব সময় সুযোগের সন্ধানে থাকত একে বাতিল কিংবা বিনষ্ট করার জন্য। অনেক ত্যাগ ও তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে বছর দুয়েক অতিক্রান্ত হওয়ার পর আল্লাহর রহমতে সেই একরারনামা বিনষ্ট করার মোক্ষম এক সুযোগ এসে যায় অবলীলাক্রমে।
এর প্রকৃত উদ্যোক্তা ছিলেন বনু ‘আমির বিন লুঈ গোত্রের হিশাম বিন ‘আমর নামক এক ব্যক্তি। রাতের অন্ধকারে এ ব্যক্তি গোপনে গোপনে ‘শেয়াবে আবূ ত্বালিব’ গিরি সংকটের ভিতরে খাদ্য শস্যাদি প্রেরণ করে বনু হাশিমের লোকজনদের সাহায্য সহানুভূতি করতেন। এ ব্যক্তি এক দিন যুহাইর বিন আবূ উমাইয়া মাখযুমীর নিকট গিয়ে পৌঁছলেন। যুহায়েরের মাতা আতেকা হলেন আব্দুল মুত্তালিবের কন্যা এবং আবূ ত্বালীবের ভগ্নী। তিনি যুহাইরকে সম্বোধণ করে বললেন, যুহাইর! ‘তুমি এটা কিভাবে বরদাস্ত করছ যে, আমরা উদর পূর্ণ করে তৃপ্তি সহকারে আহার করছি, উত্তম বস্ত্রাদি পরিধান করছি আর বনু হাশিম খাদ্যাভাবে, বস্ত্রাভাবে, অর্থাভাবে জীবন্মৃত অবস্থায় দিন যাপন করছে। বর্তমানে তোমার মামা বংশের যে অবস্থা চলছে তা তুমি ভালভাবেই জানো।’ বনু হালীমাহর কথা শুনে ব্যথা-বিজড়িত কণ্ঠে যুহাইর বললেন, ‘সব কথাই তো ঠিক, কিন্তু এ ব্যাপারে একা আমি কী করতে পারি? তবে হ্যাঁ, আমার সঙ্গে যদি কেউ থাকত তাহলে অবশ্যই আমি এ একরারনামা ছিঁড়ে ফেলার ব্যাপারে যথাসাধ্য চেষ্টা করতাম’’। হিশাম বলল, ‘বেশতো, এ ব্যাপারে আমি আছি তোমার সঙ্গে।’ যুহাইর বলল, বেশ, তাহলে এখন তৃতীয় ব্যক্তির অনুসন্ধান করো।’
এ প্রেক্ষিতে হিশাম, মুত্ব’ঈম বিন আদীর নিকটে গেলেন। মুত্ব’ঈম বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিবের সম্পর্ক সূত্রে আবদে মানাফের সন্তানদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। হিশাম তাঁদের বংশীয় সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে তাঁকে ভৎর্সনা করার পর ‘বনু হাশিম এবং বনু মুত্তালিবের দারুণ দুঃখ-দুর্দশার কথা উল্লেখ করে বললেন, ‘বংশীয় ব্যক্তিদের এত দুঃখ, কষ্টের কথা অবগত হওয়া সত্ত্বও তুমি কিভাবে কুরাইশদের সমর্থন করতে পার?’ মুত্ব’ঈম বললেন, ‘সবই তো ঠিক আছে, কিন্তু আমি একা কী করতে পারি? ‘হিশাম বললেন, ‘আরও একজন রয়েছে।’ মুত্ব’ঈম জিজ্ঞাসা করলেন সে কে? হিশাম বললেন, ‘আমি’’। মুত্ব’ঈম বললেন, ‘আচ্ছা তবে তৃতীয় ব্যক্তির অনুসন্ধান করো’। হিশাম বললেন, ‘এটাও করেছি।’ বললেন, সে কে? উত্তরে বললেন, ‘যুহাইর বিন আবি উমাইয়া।’
মুত্ব’ঈম বললেন, ‘আচ্ছা তবে এখন চতুর্থ ব্যক্তির অনুসন্ধান করো’’। এ প্রেক্ষিতে হিশাম বিন ‘আমর আবুল বুখতারী বিন হিশামের নিকট গেলেন এবং মুতয়েমের সঙ্গে যেভাবে কথাবার্তা হয়েছিল তার সঙ্গেও ঠিক একইভাবে কথাবার্তা হল।
তিনি বললেন, ‘আচ্ছা এর সমর্থক কেউ আছে কি?’ হিশাম বললেন হ্যাঁ। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন কে? হিশাম বললেন, ‘যুহাইর বিন আবি উমাইয়া, মুত্ব’ঈম বিন আদী এবং আমি।’
তিনি বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। তবে এখন ৫ম ব্যক্তির খোঁজ করো। এবাবে হিশাম যামআ বিন আসওয়াদ বিন মুত্তালিব বিন আসাদের নিকট গেলেন এবং তার সঙ্গে কথাবার্তা বলেন বনু হাশিমের আত্মীয়তা এবং তাদের প্রাপ্যসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন।
তিনি বললেন, ‘আচ্ছা যে কাজের জন্য আমাকে ডাক দিচ্ছ, সে ব্যাপারে আরও কি কারো সমর্থন আছে?
হিশাম ‘হ্যাঁ’ সূচক উত্তর করে সকলের নাম বললেন। তারপর তাঁরা সকলে হাজূনের নিকট একত্রিত হয়ে এ মর্মে অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেন যে, কুরাইশগণের অঙ্গীকারপত্রখানা অবশ্যই ছিঁড়ে ফেলতে হবে। যুহাইর বললেন, ‘এ ব্যাপারে আমিই সর্ব প্রথম মুখ খুলব।’
পূর্বের কথা মতো পর দিন প্রাতে সকলে মজলিসে উপস্থিত হলেন। যুহাইর শরীরে একজোড়া কাপড় ভালভাবে লাগিয়ে উপস্থিত হলেন। প্রথমে তিনি সাতবার বায়তুল্লাহ প্রদক্ষিণ করে নিলেন। তারপর সমবেত জনগণকে সম্বোধন করে বললেন, ওহে মক্কাবাসীগণ! আমরা তৃপ্তি সহকারে উদর পূর্ণ করে খাওয়া-দাওয়া করব, উত্তম পোষাক পরিচ্ছদ পরিধান করব। আর বনু হাশিম ধ্বংস হয়ে যাবে। তাদের সঙ্গে ক্রয়-বিক্রয় এবং আদান-প্রদান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহর শপথ! আমি ততক্ষণ পর্যন্ত বসে থাকতে পারি না, যতক্ষণ ঐ অন্যায় ও উৎপীড়নমূলক অঙ্গীকারপত্রখানা ছিঁড়ে ফেলা না হচ্ছে।
আবূ জাহল মাসজিদুল হারামের নিকটেই ছিল- সে বললো, তুমি ভুল বলছ। আল্লাহর শপথ! তা ছিঁড়ে ফেলা হবে না।
প্রত্যুত্তরে যাময়া বিন আসওয়াদ বলে উঠল, ‘আল্লাহর কসম! তুমি অধিক ভুল বলছ। কিসের অঙ্গীকারপত্র! ওটা লিখার ব্যাপারে আমাদের কোন সম্মতি ছিল না। আমরা ওতে সন্তুষ্টও ছিলাম না।’’
অন্য দিক থেকে আবুল বুখতারী সহযোগী হয়ে বলে উঠল,
‘‘যাময়া ঠিকই বলেছো। ঐ অঙ্গীকারপত্রে যা লেখা হয়েছিল তাতে আমাদের সম্মতি ছিল না এবং এখনো তা মান্য করতে আমরা বাধ্য নই।’
এর পর মুত্ব’ঈম বিন আদী বললেন, ‘তোমরা উভয়েই ন্যায্য কথা বলেছো। এর বিপরীত কথাবার্তা যারা বলেছো তারাই ভুল বলেছো। আমরা এ প্রতিজ্ঞাপত্র এবং ওতে যা কিছু লেখা রয়েছে তা হতে আল্লাহর সমীপে অসন্তোষ প্রকাশ করছি।
ওদের সমর্থনে হিশাম বিন ‘আমরও অনুরূপ কথাবার্তা বললেন।
এদের আলাপ ও কথাবার্তা শুনে আবূ জাহল বলল, ‘বুঝেছি, বুঝেছি, এ সব কথা আলাপ-আলোচনা করে বিগত রাত্রিতে স্থির করা হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত পরামর্শ এ স্থান বাদ দিয়ে অন্যত্র কোথাও করা হয়েছে।’
ঐ সময় আবূ ত্বালিবও পবিত্র হারামের এক প্রান্তে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর আগমনের কারণ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে এ অঙ্গীকারপত্র সম্পর্কে এ সংবাদ দিয়েছিলেন যে, তার জন্য আল্লাহ তা‘আলা এক প্রকার কীট প্রেরণ করেছেন যা অন্যায় ও উৎপীড়নমূলক এবং আত্মীয়তা বিনষ্টকারী অঙ্গীকার পত্রটির সমস্ত কথা বিনষ্ট করে দিয়েছে। শুধুমাত্র আল্লাহর নাম অবশিষ্ট রয়েছে। নাবী কারীম (ﷺ) তাঁর চাচা আবূ ত্বালিবকে এ কথা বলেছিলেন এবং তিনিও কুরাইশগণকে এ কথা বলার জন্য মসজিদুল হারামে আগমন করেছিলেন।
আবূ ত্বালিব কুরাইশগণকে লক্ষ্য করে বললেন, আল্লাহর তরফ থেকে আমার ভ্রাতুষ্পুত্রের নিকট সংবাদ এসেছে যে, আপনাদের অঙ্গীকারপত্রটির সমস্ত লেখা আল্লাহ প্রেরিত কীটেরা নষ্ট করে ফেলেছে। শুধু আল্লাহর নামটি বর্তমান আছে। এ সংবাদটি আপনাদের নিকট পৌঁছানোর জন্য আমার ভ্রাতুষ্পুত্র আমাকে প্রেরণ করেছেন। যদি তাঁর কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয় তাহলে তাঁর ও আপনাদের মধ্য থেকে আমি সরে দাঁড়াব। তখন আপনাদের যা ইচ্ছে হয় করবেন। কিন্তু তাঁর কথা যদি সত্য প্রমাণিত হয় তাহলে বয়কটদের মাধ্যমে আপনারা আমাদের প্রতি যে অন্যায় অত্যাচার করে আসছেন তা থেকে বিরত হতে হবে। এ কথায় কুরাইশগণ বললেন, ‘আপনি ইনসাফের কথাই বলছেন।’
এ দিকে আবূ জাহল এবং লোকজনদের মধ্যে বাকযুদ্ধ ও বচসা শেষ হলে মুত্ব’ঈম বিন আদী অঙ্গীকার পত্রখানা ছিঁড়ে ফেলার জন্য উঠে দাঁড়াল। তারপর সেটা হাতে নিয়ে সত্যি সত্যিই দেখা গেল যে, এক প্রকার কীট লেখাগুলোকে সম্পূর্ণরূপে নষ্ট করে দিয়েছে। শুধু মাত্র ‘বিসমিকা আল্লাহুম্মা’ কথাটি অবশিষ্ট রয়েছে এবং যেখানে যেখানে আল্লাহর নাম লেখা ছিল শুধু সেই লেখা গুলোই অবশিষ্ট রয়েছে। কীটে সেগুলো খায়নি।
তারপর অঙ্গীকার পত্রখানা ছিঁড়ে ফেলা হল এবং এর ফলে বয়কটেরও অবসান ঘটল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং অন্যান্য সকলে শেয়াবে আবূ ত্বালিব থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন। মুশরিকগণ নাবী (ﷺ)-এর নবুওয়তের এক বিশেষ নিদর্শন প্রত্যক্ষ করে চমৎকৃত হল, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের আচরণের ক্ষেত্রে কোনই পরিবর্তন সূচিত হল না। যার উল্লেখ এ আয়াতে কারীমায় রয়েছে,
(وَإِن يَرَوْا آيَةً يُعْرِضُوْا وَيَقُوْلُوْا سِحْرٌ مُّسْتَمِرٌّ) [القمر:2]
‘‘কিন্তু তারা যখন কোন নিদর্শন দেখে তখন মুখ ফিরিয়ে নেয় আর বলে- ‘এটা তো সেই আগের থেকে চলে আসা যাদু’।’ (আল-ক্বামার ৫৪ : ২)
তাই মুশরিকগণ বিমুখ হলে গেল এবং স্বীয় কুফরে তারা আরও কয়েক ধাপ অগ্রসর হয়ে গেল।[2]
[1] এর প্রমাণ হচ্ছে যে অঙ্গকার নামা ছিঁড়ে ফেলার ছয় মাস পর আবূ তালিবের মৃত্যু হয় এবং সঠিক কথা এটাই যে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল রজম মাসে। যাঁরা একথা বলেন যে, তাঁর মৃত্যু হয়েছিল রমাযান মাসে তাঁরা একথাও বলেন যে, তাঁর মৃত্যু হয়েছিল অঙ্গীকার নাম ছিন্ন করা ছয় মাস পরে নয় বরং আট মাস অথবা আরও কয়েক দিন পরে। উভয় প্রকার হিসেবেই অঙ্গীকারানাম ছিন্ন করার মাস হচ্ছে মুহারম।
[2] বয়কটের এ বিস্তৃত বিবরণাদি নিম্নে বর্ণিত উৎস হতে চয়ন ও প্রণয়ন করা হয়েছে। সহীহুল বুখারী মক্কায় নাবাবী অবতরণ অধ্যায় ১ম খন্ড ২৬১ পৃঃ। বাবু তাকাসোমিল মুশরিকীন আলান্নাবীয়ে (সাঃ) ১ম খন্ড ৫৪৮ পৃঃ যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৪৬ পৃঃ। ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৩৫০-৩৫১ পৃঃ ও ৩৭৪-৩৭৭ পৃঃ। রাহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৬৯-৭০ পৃঃ শাইখ আবদুল্লাহ রচিত ‘মুখতাসারুস সীরাহ ১০৬-১১০ পৃঃ। এবং শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব রচিত ‘মুখতাসারুস সীরাহ ৬৮-৭৩ পৃঃ। এ উৎসসমূহে কিছু কিছু মতবিরোধ রয়েছে। প্রমাণাদির প্রেক্ষিতে আমি অগ্রাধিকার যোগ্য দিকটিই উল্লেখ করেছি।