হুদায়বিয়াহর উমরাহ-এর কারণ (سَبَبُ عُمْرَةِ الْحُدِيْبِيَةِ):
আরব উপদ্বীপের অবস্থা যখন বহুলাংশে মুসলিমগণের অনুকূলে এসে গেল তখন ইসলামী দাওয়াতের কার্যকারিতা ও বৃহত্তম বিজয়ের বিভিন্ন নিদর্শন ধীরে ধীরে প্রকাশ লাভ করতে থাকল। মুশরিকগণ ছয় বছর যাবত মসজিদুল হারামে মুসলমানদের প্রবেশ বন্ধ করে রেখেছিল সেখানে মুসলিমগণের ইবাদত বন্দেগীর ইতিবাচক দাবীর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল।
মদীনায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে স্বপ্নযোগে দেখানো হল যে, তিনি এবং তাঁর সাহাবীগণ মসজিদুল হারামে প্রবেশ লাভ করছেন। তিনি কা‘বা গৃহের চাবি গ্রহণ করে সাহাবীগণসহ আল্লাহর ঘর তাওয়াফ এবং উমরাহ পালন করছেন। অতঃপর কিছু সংখ্যক লোক মস্তক মুন্ডন করেছেন এবং কিছু সংখ্যক লোক চুল কর্তন করাকেই যথেষ্ট মনে করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবীগণকে এ স্বপ্ন সম্পর্কে অবহিত করলে তাঁরা বড়ই আনন্দিত হন। এর ফলে তাঁরা এটাও ধারণা করতে থাকেন যে, আল্লাহর রহমতে শীঘ্রই তাঁরা মক্কায় প্রবেশাধিকার লাভ করবেন। রাসূলে কারীম (ﷺ) সাহাবীগণকে এ কথাও বললেন যে, তিনি উমরাহ পালনের মনস্থ করেছেন। এ প্রেক্ষিতে সাহাবীগণ সফরের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকলেন।
মুসলিমগণের (মক্কা) গমনের ঘোষণা (اِسْتِنْفَارُ الْمُسْلِمِيْنَ):
তাঁর সঙ্গে মক্কা গমনের জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনা এবং পার্শ্ববর্তী জনবহুল বিভিন্ন অঞ্চলে ঘোষণা দিলেন। কিন্তু অধিকাংশ আরবীগণ যাত্রা শুরু করার ব্যাপারে কিছুটা বিলম্ব করে ফেললেন। এদিকে রাসূলে কারীম (ﷺ) স্বীয় পোশাক পরিচ্ছদ পরিস্কার করে নিলেন। অতঃপর মদীনায় ইবনু উম্মু মাকতুম কিংবা নামীলা লাইসীকে স্বীয় স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করলেন এবং কাসওয়া নামক নিজ উটের উপর আরোহণ করে ৬ষ্ঠ হিজরীর ১লা যুল ক্বা’দাহ মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন উম্মুল মু’মিনীন উম্মু সালামাহ (রাঃ), সঙ্গ নিলেন চৌদ্দশত (মতান্তরে পনের শত) সাহাবী। সফররত অবস্থায় অস্ত্র গ্রহণের নিয়মে কোষাবদ্ধ তলোয়ার ছাড়া পৃথক কোন খোলা অস্ত্রশস্ত্র সঙ্গে নেননি।
মক্কা অভিমুখে মুসলিমগণের অগ্রযাত্রা (الْمُسْلِمُوْنَ يَتَحَرَّكُوْنَ إِلٰى مَكَّةَ):
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং সাহাবীগণ (রাঃ) মক্কা অভিমুখে ছিলেন অগ্রসরমান। যখন তাঁরা যুল হোলায়ফায় গিয়ে পৌঁছলেন তখন কুরবানীর পশুকে হার পরিয়ে দিলেন।[1] উটের পিঠের উঁচু জায়গা কেটে চিহ্নিত করলেন এবং উমরাহর জন্য ইহরাম বাঁধলেন। এর প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্য ছিল, লোকজনেরা যেন নিশ্চিন্ত থাকে যে যুদ্ধ করবেন না। কুরাইশদের খবরাখবর সংগ্রহের উদ্দেশ্যে খুযা’আহ সম্প্রদায়ের এক গোয়েন্দাকে প্রেরণ করা হল অগ্রভাগে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দলবলসহ উসফান নামক স্থানে যখন পৌঁছলেন তখন এ গোয়েন্দা ফিরে এসে তাঁকে অবহিত করলেন যে, মুসলিমগণের সঙ্গে মুখোমুখী যুদ্ধ করার জন্য কা‘ব বিন লুওয়ায় সাহায্যকারী আহাবীশ (মিত্র) গোত্রকে সংঘবদ্ধ করছে এবং আরও সৈন্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করছে। সে আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করার এবং আল্লাহর ঘর থেকে আপনাকে বিরত রাখার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে।
এ সংবাদ অবগত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর সাহাবীগণের সঙ্গে এক পরামর্শ বৈঠকে মিলিত হলেন এবং ইরশাদ করলেন,
(أَتَرَوْنَ نَمِيْل إِلٰى ذَرَارِيْ هٰؤُلَاءِ الَّذِيْنَ أَعَانُوْهُمْ فَنَصِيْبَهُمْ؟ فَإِنْ قَعَدُوْا قَعَدُوْا مُوْتُوْرِيْنَ مَحْزُوْنِيْنَ، وَإِنْ نَجَوْا يَكُنْ عُنُقٌ قَطَعَهَا اللهُ، أَمْ تُرِيْدُوْنَ أَنْ نَؤمَ هٰذَا الْبَيْتِ فَمَنْ صَدَّنَا عَنْهُ قَاتَلْنَاهُ؟)
‘আপনাদের অভিমত কি এটা যে, যে সকল লোক আমাদের বিরুদ্ধে কুরাইশদের সাহায্য করার প্রস্তুতি নিচ্ছে আমরা তাদের পরিবারবর্গের উপর আক্রমণ চালিয়ে সে সব দখল করে নেই। এর পর যদি তারা চুপচাপ বসে পড়ে তাহলে সেটা হবে মঙ্গলজনক। এতে আমরা ধারণা করব যে, যুদ্ধের ক্ষয় ক্ষতি, চিন্তা ভাবনা এবং দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেই তারা বসে পড়েছে। আর যদি তারা পলায়ন করে তাতেও তাদের এমন এক অবস্থার মধ্যে দেখব যে আল্লাহ তাদের গর্দান কেটে দিয়েছেন অথবা আপনারা এ অভিমত পোষণ করছেন যে আমরা কা‘বা গৃহ অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকি। আমাদের যাত্রাপথে কেউ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে আমরা তার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হব।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথার পরিপ্রেক্ষিতে আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ) আরয করলেন যে, ‘কী করতে হবে তা আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল (ﷺ) ভাল জানেন, তবে আমরা এসেছি উমরাহ পালন করতে, যুদ্ধ করতে নয়। অবশ্য কেউ যদি আমাদের এবং আল্লাহর ঘরের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তাহলে আমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে বাধ্য হব।’
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘ভাল কথা, চল তোমরা সামনের দিকে অসগ্রসর হতে থাক।’ কাজেই সকলে যাত্রা শুরু করলেন।
[1] হাদী ঐ পশুকে বলা হয় যা হজ্জ এবং উমরাহ পালনকারীগণ মক্কা অথবা মদীনায় যবহ করেন। জাহেলিয়াত যুগে আববের প্রচলিত নিয়ম ছিল যে হাদীর পশু ভেড়া কিংবা বকরী হলে তার গলায় হার দেযা হত। পক্ষান্তরে তা উট হলে তার পিঠের উঁচু অংশ চিরে কিছুটা রক্ত বের করে দেয়া হত। এ পশুকে কোন ব্যক্তি বাধা দিতে না। শরীয়তে এ বিধান বহাল রয়েছে।
আল্লাহর ঘর হতে মুসলিমগণকে বিরত রাখার প্রচেষ্টা (مُحَاوَلَةُ قُرَيْشٍ صَدِّ الْمُسْلِمِيْنَ عَنْ الْبَيْتِ):
এদিকে কুরাইশগণ যখন মুসলিমগণের আগমন সম্পর্কে অবহিত হল তখন তারা একটি পরামর্শ বৈঠকে মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, যে প্রকারেই হোক আল্লাহর ঘর হতে মুসলিমগণকে নিবৃত্ত করতেই হবে। এমনি এক অবস্থার প্রেক্ষাপটে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কুরাইশগণের সাহায্যকারী লোকজন অধ্যূষিত জনপদের পার্শ্ববর্তী পথ দিয়ে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখলেন। এ সময় বনু কা‘ব গোত্রের এক লোক এসে নাবী কারীম (ﷺ)-কে অবহিত করল যে, কুরাইশগণ যী’তাওয় নামক স্থানে শিবির স্থাপন করেছে এবং খালিদ বিন ওয়ালিদ দু’ শত ঘোড়সওয়ার সৈন্য দল নিয়ে কোরাউলগামীমে প্রস্তুত রয়েছে। (কুরাউল গামীম মক্কা যাওয়ার পথে মধ্যস্থলে এবং যাতায়াতের মহা সড়কের উপর অবস্থিত।) খালিদ মুসলিমগণকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করল।
খালিদ এমন এক স্থানে ঘোড়সওয়ারদের মোতায়েন করল যেখান থেকে উভয় দলই পরস্পর পরস্পরকে দেখতে পাচ্ছিল। যুহর সালাতের সময় খালিদ প্রত্যক্ষ করল যে, মুসলিমগণ সালাতের মধ্যে রুকু সিজদাহহ করছে। এতে তার ধারণা হল যে, সালাতের মধ্যে যখন তারা বহির্জগত সম্পর্কে গাফেল অবস্থায় থাকে তখন আক্রমণ চালালে সহজেই তাদের পরাভূত করা সম্ভব হতে পারে। তার এ ধারণার প্রেক্ষিতে সে স্থির করল যে, আসর সালাতের সময় তার বাহিনী নিয়ে সে আকস্মিকভাবে তাদের উপর আক্রমণ চালাবে। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা ঠিক সেই সময়েই খাওফের সালাতের (যুদ্ধাস্থার বিশেষ সালাত) আয়াত নাযিল করলেন। ফলে খালিদের সে সুযোগ লাভ সম্ভব হল না।
রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এড়ানোর প্রচেষ্টায় পথ পরিবর্তন (تَبْدِيْلُ الطَّرِيْقِ وَمُحَاوَلَةِ اِجْتِنَابَ اللِّقَاءِ الدَّامِيْ):
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কুরাউল গামীমের প্রধান পথ পরিহার করে আঁকাবাঁকা অন্য এক পথ ধরে অগ্রসর হতে থাকলেন। এ পথটি ছিল একটি পাহাড়ী পথ, প্রধান সড়কটি বাম পাশে রেখে ডান দিকে ঘুরে হিমসের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে এমন পথ ধরলেন, যে পথ সানিয়াতুল মারারের উপর দিয়ে চলে গেছে। সানিয়াতুল মারার হতে হুদায়বিয়াহতে নেমেছে। হুদায়বিয়াহ মক্কার নিম্ন অঞ্চলে অবস্থিত। পরিবর্তিত পথ ধরে অগ্রসর হওয়ার সুবিধা হল, কোরাউল গামীমের সে প্রধান সড়ক যা তানঈম হতে হারাম শরীফ পর্যন্ত গিয়েছে এবং যেখানে খালিদ বিন ওয়ালিদের সৈন্য বাহিনী মোতায়েন ছিল তাকে বাম দিকে রেখে এগিয়ে যাওয়ার ফলে সংঘর্ষের ঝুঁকিটা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। মুসলিমগণের পথ চলার ফলে বাতাসে যে ধূলোবালির আভাষ প্রকাশ যাচ্ছিল তা প্রত্যক্ষ করে খালিদ এটা অনুধাবন করতে সক্ষম হল যে, তারা পথ পরিবর্তন করেছে। তখন সে পরিবর্তিত পরিস্থিতি সম্পর্কে কুরাইশগণকে অবহিত করার জন্য তার ঘোড়াকে যতটুকু সম্ভব উত্তেজিত করল এবং অত্যন্ত ক্ষিপ্র গতিতে মক্কা অভিমুখে ছুটে চলল।
এদিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যথারীতি সফর অব্যাহত রাখলেন এবং যখন সানিয়াতুল মারারে এসে পৌঁছলেন তখন উট বসে পড়ল। লোকজনেরা বললেন, ‘বসলে কেন চল।’ কিন্তু সে বসেই রইল। লোকেরা বললেন, ‘ক্বাসওয়া (হুজুরের (ﷺ) উটের নাম) বেঁকে বসেছে।’
নাবী কারীম (ﷺ) বললেন,(مَا خَلَأَتِ الْقَصْوَاءُ، وَمَا ذَاكَ لَهَا بِخُلُقٍ، وَلٰكِنْ حَبَسَهَا حَابِسُ الْفِيْلِ) ‘ক্বাসওয়া থামেনি এবং এটা তার স্বভাব কিংবা অভ্যাসও নয়। কিন্তু একে সেই সত্তাই বিরত রেখেছেন যে সত্তা হাতীকে বাধা দিয়ে রেখেছিলেন।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করলেন,وَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ لاَ يَسْأَلُوْنِيْ خُطَّةً يُعَظِّمُوْنَ فِيْهَا حُرُمَاتِ اللهِ إِلاَّ أَعْطِيْتُهُمْ إِيَّاهَا ‘ঐ সত্তার কসম! যাঁর হাতে রয়েছে আমার আত্মা, এরা এমন কোন বিষয়ের দাবী করলে যার মধ্যে আল্লাহর নিষিদ্ধবস্তুর সম্মান প্রদর্শিত হয় আমি অবশ্যই তা স্বীকার করে নিব।
এরপর নাবী (ﷺ) উটকে ধমক দিলেন। তখন সে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। রাসূলে কারীম (ﷺ) পথের সামান্য পরিবর্তন করে অগ্রসর হলেন এবং হুদায়বিয়াহর শেষ প্রান্তে একটি ঝর্ণার নিকট অবতরণ করলেন। সেখানে সামান্য পরিমাণ পানি ছিল এবং লোকেরা অল্প করে তা নিচ্ছিলেন। কাজেই, কিছুক্ষণের মধ্যেই পানি নিঃশেষ হয়ে গেল।
পিপাসার্ত লোকজন যখন রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর খেদমতে পানির জন্য আরয করলেন তখন তিনি শরাধার থেকে একটি শর বা তীর বাহির করে দিয়ে তা তাদের হাতে দিলেন এবং সেটিকে ঝর্ণায় নিক্ষেপ করার পরামর্শ দান করলেন। ঝর্ণায় তীর নিক্ষেপ করার সঙ্গে সঙ্গে ঝর্ণায় এত পরিমাণ পানি প্রবাহিত হল যে সকলেই পূর্ণ পরিতৃপ্তির সঙ্গে পানি পান করে প্রত্যাবর্তন করলেন।
বুদাইল বিন ওরক্বার মধ্যস্থতা (بُدَيْلٌ يَتَوَسَّطُ بَيْنَ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ وَقُرَيْشٍ):
রাসূলে কারীম (ﷺ) যখন একটু স্বস্তি বোধ করলেন তখন বুদাইল বিন ওয়ারাক্বা (রাঃ) খুযায়ী আপন খুযা’আহ গোত্রের কয়েক জন লোক সহ তাঁর খেদমতে উপস্থিত হলেন। তুহামার অধিবাসীগণের মধ্যে এ গোত্রই (খুযা’আহ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’র মঙ্গলকাঙ্ক্ষী ছিল। বুদাইল বলল, ‘আমি কা‘ব বিন লুওয়ায়কে দেখে আসছি যে, সে হুদায়বিয়াহর পর্যাপ্ত পানির আশ্রয়ের উপর শিবির স্থাপন করেছে। তাদের সঙ্গে শিশু এবং মহিলাগণও রয়েছে। আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করা এবং আল্লাহর ঘর হতে আপনাদের নিবৃত্ত রাখার ব্যাপারে তারা বদ্ধ-পরিকর।’
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,
(إِنَّا لَمْ نَجِئ لِقِتَالِ أَحَدٍ، وَلٰكِنَّا جِئْنَا مُعْتَمِرِيْنَ، وَإِنَّ قُرَيْشاً قَدْ نَهَكَتْهُمْ الْحَرْبُ وَأَضَرَّتْ بِهِمْ، فَإِنْ شَاءُوْا مَادَدْتُّهُمْ، وَيَخْلُوْا بَيْنِيْ وَبَيْنَ النَّاسِ، وَإِنْ شَاءُوْا أَنْ يَّدْخُلُوْا فِيْمَا دَخَلَ فِيْهِ النَّاسُ فَعَلُوْا، وِإِلَّا فَقَدْ جَمُّوْا ، وَإِنْ هُمْ أَبَوْا إِلَّا الْقِتَالَ فَوَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ لَأُقَاتِلَنَّهُمْ عَلٰى أَمْرِيْ هٰذَا حَتّٰى تَنْفَرِدُ سَالفتي، أَوْ لَيَنْفِذَنَّ اللهُ أَمْرَهُ)
‘কারো সঙ্গে যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে আমরা এখানে আগমন করি নি। অতীতের যুদ্ধসমূহ কুরাইশগণকে সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত ও তছ্নছ্ করে ফেলেছে। এতে তাদের ক্ষতিও হয়েছে অসামান্য। তাই যদি তারা চায় তাহলে আমি তাদের সঙ্গে একটি সময় নির্ধারণ করব যে সময় তারা আমার ও বিপক্ষীয় লোকজনের পথ থেকে সরে দাঁড়াবে। এতে বড় আকারের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হবে। অন্যথায় যদি তারা যুদ্ধ চায় তাহলে তাদের ঔদ্ধত্য জনিত কৃতকার্যের শাস্তি অবশ্যই ভোগ করতে হবে।
আর যুদ্ধই যদি তাদের একমাত্র কাম্য হয়ে থাকে, তবে সেই সত্তার কসম! যাঁর হাতে রয়েছে আমার জীবন আমি আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে তাদের সঙ্গে ঐ সময় পর্যন্ত যুদ্ধ করে যাব যতক্ষণ পর্যন্ত আমার শরীরে আত্মা থাকে, কিংবা যতক্ষণ আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় দ্বীনের ব্যাপারে একটা চূড়ান্ত ফয়সালা করে না দেন।
বুদাইল বলল, ‘আপনি যা বললেন আমি তা কুরাইশগণকে অবহিত করব।’
অতঃপর সে কুরাইশগণের নিকট গিয়ে বলল, ‘আমি মদীনার ঐ নাবী সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাত করে এসেছি। আমি তাঁর নিকট একটা কথা শুনেছি, যদি তোমরা চাও তাহলে আমি তোমাদের নিকট তা উপস্থাপন করব।’
এ কথার প্রেক্ষিতে নির্বোধ এবং স্বল্পবুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরা বলল, ‘আমাদের এমন কোন প্রয়োজন নেই যে, তুমি কোন কথা আমাদের নিকট বর্ণনা কর।’
কিন্তু যারা বুদ্ধিমান ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন ছিল তারা বলল, ‘তুমি তাঁর কাছ থেকে কী শুনেছ তা আমাদের শুনতে দাও।’
বুদাইলের নিকট রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে সকল কথা বলেছিলেন সে তাদের নিকট তা বর্ণনা করল। এ প্রেক্ষিতে কুরাইশরা মিকরায বিন হাফসকে তাঁর নিকট প্রেরণ করল। তাকে দেখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘এ ব্যক্তি অঙ্গীকার ভঙ্গকারী।’
কিন্তু যখন সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট অগ্রসর হয়ে আলাপ আলোচনা করল তখন তিনি তাকে সেই সব কথাই বললেন যা বুদাইল এবং তাঁর সঙ্গীসাথীদের নিকট বলেছিলেন। অতঃপর সে মক্কা ফিরে এসে কুরাইশগণকে তার আলাপ আলোচনার বিষয়াদি অবহিত করল।
কুরাইশগণের দূত (رُسُلُ قُرَيْشٍ):
আলাপ আলোচনার বিষয়াদি অবহিত হয়ে বনু কিনানাহ গোত্রের হুলাইস বিন আলকামা বলল, ‘আমাকে তাঁর নিকট যেতে দাও।’ লোকজনেরা বলল, ‘বেশ তবে যাও।’
যখন সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দরবারে উপস্থিত হল তখন নাবী কারীম (ﷺ) সাহাবীগণ (রাঃ)-কে লক্ষ্য করে বললেন, (هٰذَا فُلاَنٌ، وَهُوَ مِنْ قَوْمٍ يُعَظِّمُوْنَ الْبُدْنَ، فَابْعَثُوْهَا) ‘এ ব্যক্তি এমন এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত যারা হাদ্য়ীর পশুকে অনেক সম্মান করে। অতএব পশুগুলোকে দাঁড় করে দাও।’
সাহাবীগণ (রাযি.) পশুগুলোকে দাঁড় করে দিলেন এবং নিজেরাও লাববায়েক বলে তাকে খুশ আহমেদ জানালেন। এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে সে ব্যক্তি আনন্দে বিভোর হয়ে বলে উঠল, ‘সুবহানাল্লাহ! এ সকল লোককে আল্লাহর ঘর হতে বিরত রাখা কোন মতেই সমীচীন হবে না।’ এ কথা বলেই সে তার সঙ্গীদের নিকট ফিরে গেল।
ফিরে গিয়ে সে কুরাইশগণের নিকট বলল, ‘আমি হাদয়ীর পশু দেখে এলাম যাদের গলায় হার দেওয়া আছে এবং পৃষ্ঠদেশ চিরে দেওয়া হয়েছে। এ জন্য আল্লাহর ঘর থেকে তাদের নিবৃত্ত রাখা আমি সমীচীন মনে করছি না।’ তার এ সকল কথার প্রেক্ষাপটে কুরাইশ লোকজন ও তার মধ্যে এমন কিছু বাক্য বিনিময় হয়ে গেল যার ফলে সে খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়ল।
এমন সময় উরওয়া বিন মাসউদ সাক্বাফী হস্তক্ষেপ করল এবং বলল, ‘ঐ ব্যক্তি (মুহাম্মাদ (ﷺ)) তোমাদের নিকট একটি ভাল প্রস্তাব দিয়েছে। তোমরা তাঁর প্রস্তাব গ্রহণ করে নাও এবং আমাকে তাঁর নিকট যেতে দাও।’’
লোকজনেরা তাকে যাওয়ার অনুমতি দিলে সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে কথোপকথন আরম্ভ করল। আলোচনায় নাবী কারীম (ﷺ) তাকে সে সব কথাই বললেন, যা তিনি বুদাইলকে বলেছিলেন। প্রত্যুত্তরে উরওয়া বলল, ‘হে মুহাম্মাদ (ﷺ)! যদি আপনি নিজ জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেন তবে কি আপনার পূর্বের কোন আরব সম্পর্কে শুনেছেন যে, সে নিজ জাতিকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে? আর যদি দ্বিতীয় অবস্থা ঘটে যায় তবে আল্লাহর কসম! আমি এমন কতগুলো মূর্খ ও লম্পট দেখছি যারা আপনাকে ছেড়ে পলায়ন করবে।’
এ কথা শুনে আবূ বাকর (রাঃ) বললেন, ‘লাতের লজ্জাস্থানের ঝুলন্ত চর্ম চুষতে থাক, আমরা নাবী (ﷺ)-কে ছেড়ে পলায়ন করব?
উরওয়া বলল, ‘এ লোকটি কে?’
লোকজনেরা বলল, ‘তিনি আবূ বাকর।’
সে আবূ বাকরকে সম্বোধন করে বলল, ‘দেখ, সেই সত্তার কসম! যাঁর হাতে রয়েছে আমার জীবন যদি এমন ব্যাপার না হতো যে, তুমি আমার একটি উপকার করেছিলে এবং আমি তার প্রতিদান দিতে পারি নি, তবে অবশ্যই এর জবাব আমি দিয়ে দিতাম।’
এরপর উরওয়া পুনরায় নাবী কারীম (ﷺ)-এর সঙ্গে কথোপকথন শুরু করল এবং আলাপ-আলোচনা চলা অবস্থায় বার বার নাবী কারীম (ﷺ)-এর দাড়ি মুবারক ধরে নিচ্ছিল। মুগীরা বিন শো‘বা নাবী কারীম (ﷺ)-এর মাথার পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর হাতে ছিল একটি তরবারী। আলোচনার সময় উরওয়া যখন নাবী কারীম (ﷺ)-এর দাড়ি মুবারকের দিকে হাত বাড়াত তখন তিনি তরবারীর হাতল দ্বারা তার হাতে আঘাত করতেন এবং বলতেন, নাবী কারীম (ﷺ)-এর দাড়ি মুবারক হতে হাত দূরে রাখ।’
অবশেষে উরওয়া নিজ মস্তক উত্তোলন করে বলল, ‘এ লোকটি কে?’
লোকেরা বলল, মুগীরাহ বিন শো‘বা। তাতে সে বলল, ‘অঙ্গীকার ভঙ্গকারী! আমি কি তোমার অঙ্গীকার ভঙ্গের ব্যাপারে দৌঁড় ঝাঁপ করছিনা?’’
প্রকৃত ঘটনাটি হচ্ছে জাহেলীয়াত যুগে মুগীরা (রাঃ) কিছু সংখ্যক লোকের সঙ্গে ছিলেন। কোন এক অবস্থায় তিনি সঙ্গী সাথীদের হত্যা করেন এবং তাদের ধন সম্পদ নিয়ে পলায়ন করেন। অতঃপর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নাবী কারীম (ﷺ) বলেছিলেন,أَمَّا الْإِسْلاَمُ فَأَقْبَلُ، وَأَمَّا الْمَالُ فَلَسْتَ مِنْـُهُ فِـْي شَيْءٍ وَكَانَ الْمُغِيْرَةُ اِبْنُ أَخِيْ عُرْوَةَ ‘তুমি তো ইসলাম গ্রহণ করছ কিন্তু তোমার ধন সম্পদের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক থাকবে না। এ ব্যাপারে উরওয়ার দৌঁড় ঝাঁপ করার কারণ ছিল, মুগীরাহ (রাঃ) ছিলেন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র।
এরপর উরওয়া নাবী কারীম (ﷺ)-এর সঙ্গে সাহাবায়ে কেরামের সম্পর্ক সৌকর্যের ক্ষেত্রে আন্তরিকতার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে থাকল। অতঃপর সে স্বগোত্রীয় লোকজনদের নিকট ফিরে এসে বলল, ‘হে গোত্রীয় ভ্রাতৃবর্গ! আল্লাহর কসম! আমি কায়সার ও কিসরা এবং নাজ্জাসীদের সম্রাটের দরবারে গিয়েছি, আল্লাহর কসম! আমি কোন সম্রাটকে দেখি নি যে, তাঁর অনুসারী বা সঙ্গীসাথীগণ তাঁর এতটুকু সম্মান করছে মুহাম্মাদ (ﷺ)- কে তাঁর সাহাবাবর্গ যত বেশী সম্মান করছে। আল্লাহর কসম! তিনি যখন থু-থু ফেলছেন তখন যে কেউ তা হাতে নিয়ে আপন মুখমণ্ডলে কিংবা শরীরে তা মেখে নিচ্ছেন। যখন তিনি কোন কাজের নির্দেশ প্রদান করছেন তখন তা বাস্তবায়নের জন্য সকলের মধ্যেই তৎপরতা শুরু হয়ে যাচ্ছে। যখন তিনি অযু করছেন তখন মনে হচ্ছে যেন তাঁর ব্যবহৃত পানির জন্য লোকেরা যুদ্ধ শুরু করে দেবে। যখন তিনি কোন কথা বলছেন তখন সকলের কণ্ঠস্বর নীচু হয়ে যাচ্ছে। তাঁর সম্মানের খাতিরে সাহাবীগণ কখনই তাঁর প্রতি পূর্ণভাবে দৃষ্টিপাত করেন না। নিশ্চয়ই তাঁর মধ্যে এমন গুণাবলীর সমাবেশ ঘটেছে যার ফলে সাহাবীগণ তাঁকে এতটা শ্রদ্ধা করছেন। তিনি তোমাদের জন্য একটি উত্তম প্রস্তাব দিয়েছেন। তোমাদের উচিত তা গ্রহণ করে নেয়া।’
তিনিই সেই সত্তা যিনি তাদের হাত তোমাদের হতে নিবৃত্ত করলেন (هُوَ الَّذِيْ كَفَّ أَيْدِيَهُمْ عَنْكُمْ):
যখন কুরাইশগণের যুদ্ধবাজ ও যুদ্ধোন্মাদ যুবকগণ দেখল যে তাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ সন্ধির পক্ষপাতি, তখন তারা নেতৃস্থানীয়দের এড়িয়ে স্বতন্ত্রভাবে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যে, রাত্রিরে অন্ধকার এখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে তারা মুসলিমগণের শিবিরে প্রবেশ করবে এবং এমন ভাবে গন্ডগোল পাকিয়ে তুলবে যাতে আপনা থেকেই যুদ্ধের আগুন জ্বলে ওঠে।
অতঃপর তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ সম্পাদনের লক্ষ্যে রাতের আঁধারে সত্তর কিংবা আশি জন যুবক তানঈম পর্বতে অবতরণ করে মুসলিমগণের শিবিরে প্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু মুসলিম শিবির প্রহরীদের পরিচালক মুহাম্মাদ বিন মাসলামা তাদের সকলকে বন্দী করেন। কিন্তু সন্ধিচুক্তির খাতিরে নাবী কারীম (ﷺ) সকলকে ক্ষমা প্রদর্শন ক’রে মুক্ত করে দেন। সে সম্পর্কেই আল্লাহর তরফ থেকে তখন আয়াত নাযিল হয়: (وَهُوَ الَّذِيْ كَفَّ أَيْدِيَهُمْ عَنْكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ عَنْهُم بِبَطْنِ مَكَّةَ مِن بَعْدِ أَنْ
أَظْفَرَكُمْ عَلَيْهِمْ) [الفتح: 24]
‘তিনি সেই সত্তা যিনি তোমাদের উপর হতে তাদের হাতকে নিবৃত্ত করলেন মক্কা প্রান্তরে এবং তোমাদের হাতকে তাদের হতে। এর পূর্বেই তিনি তাদেরকে তোমাদের আয়ত্বে এনে দিয়েছিলেন।’ [আল-ফাতহ (৪৮) : ২৪]
উসমানের দৌতকার্য (عُثْمَانُ بْنُ عَفَّانٍ سَفِيْراً إِلٰى قُرَيْشٍ):
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চিন্তা করলেন যে, এ সময় কুরাইশদের নিকট এমন একজন দূত প্রেরণ করা প্রয়োজন যিনি বর্তমান ভ্রমণের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য সম্পর্কে জোরালোভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করতে সক্ষম হবেন। রাসূল্লাহ (ﷺ) প্রথম উমার (রাঃ)-কে এ কাজের জন্য আহবান জানালে তিনি এ বলে ক্ষমাপ্রার্থী হলেন যে, ‘হে আল্লাহর রাসূল! সেখানে যদি আমাকে কষ্ট দেয়া হয় তাহলে মক্কায় বনু কা‘ব গোত্রের এমন একজন লোকও নেই যে আমার সাহায্যের জন্য উদ্বু্দ্ধ হবে। আপনি বরং উসমান বিন আফফান (রাঃ)-কে এ উদ্দেশ্যে প্রেরণ করুন। তাঁর আত্মীয় এবং গোত্রীয় লোকজনদের অনেকেই এখনো মক্কায় রয়েছেন। তিনি আপনার বার্তা খুব ভালভাবেই পৌঁছে দিতে সক্ষম হবেন।
অতঃপর রাসূলে কারীম (ﷺ) উসমান (রাঃ)-কে আহবান জানিয়ে কুরাইশগণের নিকট গমনের নির্দেশ দিলেন এবং বললেন, ‘তুমি গিয়ে তাদেরকে বলে দাও যে যুদ্ধ করার জন্য আমরা আসি নি। আমরা এসেছি উমরাহ পালনের জন্য। তাছাড়া তাদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ কর।’
অধিকন্তু, তিনি উসমান (রাঃ)-কে এ নির্দেশ দিলেন যে, ‘তুমি মক্কায় ঈমানদার পুরুষ ও মহিলাগণের নিকট গিয়ে অদূর ভবিষ্যতে মুসলিমগণের মক্কা বিজয়ের শুভ সংবাদ শুনিয়ে দেবে এবং এ কথাও বলে দেবে যে আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় দ্বীনকে শীঘ্রই মক্কায় প্রকাশিত ও প্রতিষ্ঠিত করবেন। কাজেই, আল্লাহর দ্বীনে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য কাউকেও আত্মগোপন করে থাকার প্রয়োজন হবে না।’
উসমান (রাঃ) নাবী কারীম (ﷺ)-এর বার্তা নিয়ে মক্কা গমন করলেন। বালদাহ নামক স্থানে কুরাইশগণের নিকট দিয়ে যখন তিনি পথ চলছিলেন তখন তারা জিজ্ঞেস করল, কী উদ্দেশ্যে কোথায় এ যাত্রা? তিনি বললেন, ‘একটি বার্তাসহ আল্লাহর নাবী মুহাম্মাদ (ﷺ) আমাকে এ স্থানে প্রেরণ করেছেন।’
তারা বলল, ‘আমরা মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর কথা শুনেছি, আপনি নিজ কাজে চলে যান।’
অন্য দিকে সাঈদ বিন আস উঠে এসে ‘মারহাবা’ বলে তাঁকে খুশ আমদেদ জানালেন। অতঃপর তিনি নিজ ঘোড়ার উপর জিন চাপিয়ে তাতে আরোহণ করলেন এবং উসমান (রাঃ)-কে সঙ্গে বসিয়ে নিয়ে মক্কায় নিজ বাসস্থানে নিয়ে গেলেন। সেখানে গিয়ে উসমান (রাঃ) নেতৃস্থানীয় কুরাইশগণের নিকট রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বার্তা শোনালেন। বার্তা পৌঁছানোর মাধ্যমে যখন তিনি আরোপিত দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভ করলেন তখন কুরইশগণ প্রস্তাব করল যে, তিনি যেন আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করেন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর তাওয়াফের পূর্বে তাওয়াফ করা সমীচীন মনে না করায় তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
উসমানের শাহাদাতের গুজব এবং রিযওয়ান প্রতিজ্ঞা (إِشَاعَةُ مَقْتَلِ عُثْمَانٍ وَبَيْعَةُ الرِّضْوَانِ):
উসমান (রাঃ) তাঁর উপর আরোপিত দৌত-মহোদ্যম সম্পূর্ণ করলেন কিন্তু কুরাইশগণ তাঁকে আটকাবস্থায় রাখলেন। সম্ভবত উদ্ভূত পরিস্থিতির ব্যাপারে সঠিক কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পারার কারণেই এবং কিছুটা বিলম্বে হলেও তাঁর মাধ্যমে তারা তাদের সিদ্ধান্ত সঠিক রেখেছিল। যেহেতু ব্যাপারটি ছিল তাদের জন্য অত্যন্ত বিতর্কমূলক এবং এ ব্যাপারে তাদের আরও সলা-পরামর্শের প্রয়োজন ছিল সেহেতু তারা উসমান (রাঃ)-এর প্রত্যাবর্তন বিলম্বিত করতে চেয়েছিল।
কিন্তু উসমান (রাঃ)-এর পত্যাবর্তনে অস্বাভাবিক বিলম্ব হওয়ার কারণে মুসলিমগণের মধ্যে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে, উসমান (রাঃ)-কে হত্যা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন এ সংবাদ অবগত হলেন, তখন ঘোষণা দিলেন যে,(لاَ نَبْرَحُ حَتّٰى نُنَاجِزَ الْقَوْمَ) যুদ্ধের মাধ্যমে যতক্ষণ একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হচ্ছে ততক্ষণ আমরা এ জায়গা পরিত্যাগ করব না। অতঃপর নাবী কারীম (ﷺ) সাহাবীগণকে অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়ার আহবান জানালেন। সাহাবা কেরামের একটি দলকে কিছুটা ভেঙ্গে পড়ার মতো মনে হল। অবশ্য, তাঁরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেন যে, তারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করবেন না। অন্য এক দল মৃত্যুবরণ করার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেন, অর্থাৎ মৃত্যুবরণ করতে হলেও তাঁরা যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করবে না। সর্ব প্রথম অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেন আবূ সেনান আসাদী। সালাম বিন আকওয়া তিন দফা অঙ্গীকারে করলেন। প্রথমে, মধ্যে ও শেষে। রাসূলে কারীম (ﷺ) স্বয়ং নিজ হাত ধরে বললেন,(هٰذِهِ يَدُ عُثْمَانَ) ‘এ হচ্ছে উসমানের হাত।’ ইতোমধ্যে যখন অঙ্গীকার গ্রহণ পর্ব সম্পন্ন হয়ে গেল তখন উসমান (রাঃ) প্রত্যাবর্তন করলেন এবং তিনিও অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেন। এ অঙ্গীকার পর্বে মাত্র একজন অংশ গ্রহণ করে নি। সে ছিল মুনাফিক্ব। তার নাম ছিল জুদ বিন ক্বায়স।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন একটি বৃক্ষের তলদেশে। উমার (রাঃ) পবিত্র হাতকে উত্তোলিত অবস্থায় রেখেছিলেন এবং মাকাল বিন ইয়াসার (রাঃ) বৃক্ষের কতগুলো শাখা ধরে রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর উপর থেকে সরিয়ে রেখেছিলেন। এ অঙ্গীকারের নাম হচ্ছে বাইয়াত রিযওয়ান। এ বাইয়াত সম্পর্কে কুরআনে ইরশাদ হয়েছে :
(لَقَدْ رَضِيَ اللهُ عَنِ الْمُؤْمِنِيْنَ إِذْ يُبَايِعُوْنَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ)الآية [الفتح: 18]
‘মু’মিনদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট হলেন যখন তারা (হুদাইবিয়ায়) গাছের তলে তোমার কাছে বায়‘আত নিল।’ [আল-ফাতহ (৪৮) : ১৮]
সন্ধিচুক্তি এবং চুক্তির দফাসমূহ (إِبْرَامُ الصُّلْحِ وَبُنُوْدُهُ):
যাহোক, কুরাইশগণ পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করল এবং অনতিবিলম্বে সোহাইল বিন ‘আমরকে সন্ধিচুক্তির ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দরবারে প্রেরণ করল। তাকে প্রেরণের সময় এ পরামর্শ দিল যে, সন্ধিচুক্তিতে অবশ্যই এ চুক্তিটি উল্লেখিত হবে যে, এ বছর ওমরাহ্ পালন না করেই তাঁর সঙ্গী সাথীদের নিয়ে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করবেন যাতে মক্কার লোকেরা এমন চিন্তার অবকাশ না পায় যে, নাবী কারীম (ﷺ) জোর জবরদস্তি করে আমাদের শহরে প্রবেশ করেছেন। কুরাইশগণের নিকট হতে এ সকল নির্দেশ সহকারে সোহাইল বিন ‘আমর নাবী কারীম (ﷺ)-এর নিকট উপস্থিত হল। তাকে আসতে দেখে নাবী কারীম (ﷺ) সাহাবীগণ (রাঃ)-কে বললেন, (قَدْ سَهَّلَ لَكُمْ أَمْرَكُمْ) ‘তোমাদের জন্য তোমাদের কাজ সহজ করে দেয়া হয়েছে। এ ব্যক্তিকে পাঠানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে, কুরাইশগণ সন্ধি চাচ্ছে।’ সোহাইল নাবী কারীম (ﷺ)-এর নিকট আগমনের পর বহুক্ষণ পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করল এবং অবশেষে উভয় পক্ষের মধ্যে চুক্তির দফাসমূহ স্থিরীকৃত হল। চুক্তির দফাগুলো হচ্ছে যথাক্রমে নিম্নরূপ : ১. রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ বছর মক্কায় প্রবেশ না করেই সঙ্গী সাথীগণসহ মদীনায় ফিরে যাবেন। মুসলিমগণ আগামী বছর মক্কায় আগমন করবেন এবং সেখানে তিন দিন অবস্থান করবেন। তাঁদের সঙ্গে সফরের প্রয়োজনীয় অস্ত্র থাকবে এবং তরবারী কোষবদ্ধ থাকবে। তাঁদের আগমনে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হবে না।
২. দশ বছর পর্যন্ত দু’ পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ থাকবে। এ সময় লোকজন নিরাপদ থাকবে, কেউ কারো উপর হাত উত্তোলন করবে না।
৩. যে সকল গোত্র কিংবা জনগোষ্ঠি মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর অঙ্গীকারাঙ্গনে প্রবেশ লাভ করতে চাইবে, প্রবেশ লাভ করতে পারবে। যে গোত্র যে দলে অংশ গ্রহণ করবে তাকে এ দলের অংশ গণ্য করা হবে। এরূপ ক্ষেত্রে কোন গোত্রের উপর অন্যায় অত্যাচার করা হলে সংশ্লিষ্ট দলের উপর অন্যায় করা হয়েছে বলে ধরে নেয়া হবে।
৪. কুরাইশদের কোন লোক অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া অর্থাৎ পলায়ন করে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর দলে যোগদান করলে তাকে ফেরত পাঠাতে হবে। কিন্তু মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর দলভুক্ত কোন লোক আশ্রয় লাভের উদ্দেশ্যে পলায়ন করে কুরাইশদের নিকট গেলে কুরাইশগণ তাকে ফেরত দেবে না।
এরপর নাবী কারীম (ﷺ) আলী (রাঃ)-কে সন্ধির দফাগুলো লিপিবদ্ধ করার জন্য নির্দেশ দিলেন। তিনি বললেন লিখ, বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম।
এর প্রেক্ষিতে সুহাইল বলল, ‘রহমান’ বলতে যে কী বুঝায় আমরা তা জানি না। আপনি এভাবে লিখুন, ‘বিসমিকা আল্লাহুম্মা’ (হে আল্লাহ তোমার নামে)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আলী (রাঃ)-কে সে ভাবেই লিখতে নির্দেশ দিলেন এবং তিনি সে ভাবেই তা লিখলেন।
অতঃপর নাবী কারীম (ﷺ)-এর নির্দেশে আলী (রাঃ) লিখলেন, (هٰذَا مَا صَالَحَ عَلَيْهِ مُحَمَّدٌ رَّسُوْلُ اللهِ) ‘এগুলো হচ্ছে সে সব কথা যার উপর ভিত্তি করে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) সন্ধি করলেন।’’
এ কথার প্রেক্ষিতে সুহাইল বলল, ‘আমরা যদি জানতাম যে, আপনি আল্লাহর রাসূল তাহলে আপনাকে আল্লাহর ঘর হতে বিরত রাখতাম না এবং আপনার সঙ্গে যুদ্ধও করতাম না। কাজেই, আপনি লিখুন, ‘মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ।’
নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, (إِنِّيْ رَسُوْلُ اللهِ وَإِنْ كَذَبْتُمُوْنِيْ) ‘তোমরা মিথ্যা প্রতিপন্ন করলেও এটা এক মহা সত্য যে, আমি আল্লাহর রাসূল (ﷺ)।’
অতঃপর ‘রাসূলুল্লাহ’ কথাটি মুছে ফেলে তার পরিবর্তে ‘মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ’ লিখার জন্য তিনি আলী (রাঃ)-কে নির্দেশ দিলেন।
কিন্তু আলী (রাঃ) ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’ কথাটি মুছে ফেলার ব্যাপারটিকে কিছুতেই যেন মেনে নিতে পারছিলেন না। আলী (রাঃ)’র মানসিক অবস্থা অনুধাবন করে নাবী কারীম (ﷺ) স্বীয় মুবারক হাত দ্বারাই কথাটি মুছে ফেললেন। তার পর পুরো চুক্তিটি লিপিবদ্ধ করা হয়ে গেল।
যখন সন্ধি চুক্তি সম্পন্ন হয়ে গেল তখন বনু খুযা’আহ গোত্র রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর অঙ্গীকারাঙ্গনে প্রবেশ করল। এরা প্রকৃতপক্ষে আব্দুল মুত্তালিবের সময় হতেই বনু হাশিমের হালীফ ছিল। যেমনটি পুস্তকের প্রারম্ভে উল্লেখিত হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অঙ্গীকারাঙ্গনে বনু খুযা’আহর প্রবেশের ব্যাপারটি ছিল পূর্বতন প্রতিজ্ঞারই ফলশ্রুতি বা পরিপক্ক অবস্থা। অন্যদিকে কুরাইশদের অঙ্গীকারাঙ্গনে প্রবেশ করল বনু বাকর গোত্র।
আবূ জান্দালের প্রত্যাবর্তন (رَدُّ أَبْيِ جَنْدَلٍ):
সন্ধিপত্র লেখার কাজ তখন চলছিল এমন সময় সুহাইলের পুত্র আবূ জান্দাল লৌহ শিকল পরিহিত অবস্থায় হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে এসে সেখানে উপস্থিত হল। সে মক্কার নিম্নাঞ্চল হতে বের হয়ে এসেছিল। সে এখানে পৌঁছে নিজে নিজেই মুসলিমগণের দলের মধ্যে শামিল হল। তার এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে সোহাইল বলল, ‘এ আবূ জান্দালই হচ্ছে প্রথম ব্যক্তি যার সম্পর্কে আপনার সঙ্গে মত বিনিময় করেছি যে, আপনি তাকে ফেরত দেবেন।’
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,(إِنَّا لَمْ نَقَضَ الْكِتَابُ بَعْدُ) ‘এখন তো আমাদের সন্ধিপত্র সম্পন্নই হয় নি।’
সে বলল, ‘তাহলে আমি সন্ধির ব্যাপারে আপনার সঙ্গে আর কোন আলাপ-আলোচনা করতে রাজি নই।’
নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, ‘আচ্ছা তাহলে আমার খাতিরে তুমি তাকে ছেড়ে দাও।’
সে বলল, ‘আমি আপনার খাতিরেও তাকে ছাড়ব না।’
নাবী কারীম বললেন, ‘না, না, অন্তত পক্ষে এতটুকু তোমাকে করতেই হবে।’
সে বলল, ‘না, আমি তা করতে পারি না।’
অতঃপর সোহাইল আবূ জান্দালের মুখের উপর চপেটাঘাত করল এবং মুশরিকদের নিকট প্রত্যাবর্তনের জন্য তাঁর গলবস্ত্র ধারণ করে হেঁচড়িয়ে টানতে টানতে নিয়ে গেল।
আবূ জান্দাল তখন জোরে জোরে চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘হে মুসলিম ভ্রাতৃবৃন্দ! আমি কি মুশরিকদের কাছে ফিরে যাব এবং তারা আমাকে দ্বীনের ব্যাপারে ফেৎনায় নিক্ষেপ করবে?’
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,
(يَا أَبَا جَنْدَلٍ، اِصْبِرْ وَاحْتَسِبْ، فَإِنَّ اللهَ جَاعِلٌ لَّكَ وَلِمَنْ مَّعَكَ مِنْ الْمُسْتَضْعَفِيْنَ فَرَجاً وَمَخْرَجًا، إِنَّا قَدْ عَقَدْنَا بَيْنَنَا وَبَيْنَ الْقَوْمَ صُلْحاً، وَأَعْطَيْنَاهُمْ عَلٰى ذٰلِكَ، وَأَعْطُوْنَا عَهْدَ اللهِ فَلَا نَغْدِرُ بِهِمْ)
‘আবূ জান্দাল! ধৈর্য্য ধারণ কর এবং একে সওয়াব লাভের উপায় মনে করে নাও। আল্লাহ তা‘আলা তোমার এবং তোমার মতো দুর্বল ও নির্যাতিত মুসলিমগণের জন্য প্রশস্ত আশ্রয় স্থান তৈরি করে রেখেছেন। আমরা কুরাইশগণের সঙ্গে সন্ধি করেছি এবং আমরা পরস্পরের নিকট অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছি। এ কারণে আমরা অঙ্গীকার ভঙ্গ করতে পারব না।’
এরপর উমার (রাঃ) বাহির হয়ে অত্যন্ত ক্ষিপ্র গতিতে আবূ জান্দালের নিকট গিয়ে পৌঁছে গেলেন এবং তাঁর পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলছিলেন, ‘আবূ জান্দাল! ধৈর্য্য ধারণ কর। এরা মুশরিক, এদের রক্ত তো কুকুরের রক্ত।’ সঙ্গে সঙ্গে তলোয়ারের হাতলও তিনি তাঁর সামনে তুলে ধরলেন। উমার (রাঃ)-এর বর্ণনা রয়েছে যে, ‘আমার আশা ছিল যে, আবূ জান্দাল তলোয়ার হাতে নিয়ে তাঁর পিতাকে নিঃশেষ করে ফেলবেন, কিন্তু তিনি তাঁর পিতার ব্যাপারে কৃপণতা অবলম্বন করলেন এবং সন্ধিচুক্তি কার্যকর হয়ে গেল।’
উমরাহ হতে হালাল হওয়ার জন্য কুরবানী এবং মাথার চুল কর্তন (النَّحْرُ وَالْحَلْقُ لِلْحِلِّ عَنْ الْعُمْرَةِ):
সন্ধি চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে নিস্কৃতি লাভের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজ নিজ পশু কুরবানী করার জন্য সাহাবীগণকে পরামর্শ দিলেন। কিন্তু আল্লাহর শপথ! কেউই আপন স্থান ত্যাগ করলেন না। মনে হল যেন এ কথা তাঁদের কানেই যায় নি।
নাবী কারীম (ﷺ) তিন বার তাঁর উক্তির পুনরাবৃত্তি করলেন। কিন্তু কেউই স্থান ত্যাগ করলেন না। তখন তিনি উম্মু সালামাহ (রাঃ)-এর নিকট গেলেন এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করলেন। উম্মুল মু’মিনীন বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি যদি চান যে, সকলে নিজ নিজ পশু কুরবানী করে মস্তক মুন্ডন করুক তাহলে আর কাউকেও কিছু না বলে নিজ পশু যবহ করুন এবং হাজ্জামকে (নাপিতকে) ডাকিয়ে নিয়ে নিজ মস্তক মুন্ডন করে নিন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উম্মুল মু’মিনীনের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করলেন, অর্থাৎ নিজ হাদয়ের পশু যবেহ করলেন এবং হাজ্জামকে ডাকিয়ে নিয়ে নিজ মস্তক মুন্ডন করিয়ে নিলেন।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে কুরবানী ও মস্তক মুন্ডন করতে দেখে অন্যেরা সকলেই নিজ নিজ পশু যবেহ করলেন এবং একে অন্যের সাহায্য নিয়ে মস্তক মুন্ডন করে নিলেন। সমগ্র পরিবেশটা তখন গাম্ভীর্যপূর্ণ এবং সকলেই এতই চিন্তাযুক্ত ছিলেন যে, মনে হচ্ছিল অত্যধিক চিন্তিত থাকার কারণে পরস্পর পরস্পরকে হত্যা করে ফেলবে। সে সময় সাত সাত জনের জন্য একটি গরু এবং একটি উট যবেহ করা হয়।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবূ জাহলের একটি উট যবেহ করেন যার নাকে রূপোর তৈরি একটি নোলক বালি বা বৃত্ত ছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল, এর ফলে কুরাইশ মুশরিকগণ যেন মানসিক যন্ত্রণায় ভোগে। অতঃপর রাসূলে কারীম (ﷺ) মস্তক মুন্ডনকারীদের জন্য তিনবার ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং কাঁচি দ্বারা চুল কর্তনকারীদের জন্য একবার দু‘আ করেন। এ সফরে আল্লাহ তা‘আলা কা‘ব বিন উজরাহ সম্পর্কে এ হুকুম নাযিল করেন যে, যে ব্যক্তি কষ্টের কারণে নিজ মস্তক মুন্ডন করবে (ইহরামের অবস্থায়) সে যেন রোযা পালন করে, অথবা সদকা করে কিংবা কোন পশু যবেহ করে তা উৎসর্গ করে।
হিজরতকারিণী মহিলাগণকে ফেরত প্রদানে অস্বীকৃতি (الْإِبَاءُ عَنْ رَدِّ الْمُهَاجِرَاتِ):
এরপর কিছু সংখ্যক মহিলা মুহাজির আগমন করলেন। তাদের অভিভাবকগণ দাবী করল যে, হুদায়াবিয়ার যে সন্ধিচুক্তি সম্পন্ন হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে এদের ফেরত প্রদান করা হোক । কিন্তু তাদের এ দাবী রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রমাণের ভিত্তিতে প্রত্যাখ্যান করে দিলেন যে, এ চুক্তির শর্ত সম্পর্কে সন্ধিপত্র যে কথা লিখা হয়েছিল তা ছিল-
(وَعَلٰى أَنَّهُ لَا يَأْتِيْكَ مِنَّا رَجُلٌ، وَإِنْ كَانَ عَلٰى دِيْنِكَ إِلَّا رَدَدْتُّهُ عَلَيْنَا)
‘এ শর্ত সাপেক্ষে এ সন্ধি করা হচ্ছে যে, আমাদের যে ব্যক্তি আপনার নিকট চলে যাবে আপনি অবশ্যই তাকে ফেরত পাঠাবেন যদিও সে আপনার দ্বীনের অনুসারী হয়।[1]
অতএব, এ মহিলাগণ সন্ধিচুক্তির শর্তাবলীর আওতাভুক্ত ছিলেন না। অন্য দিকে আবার এ মহিলাগণ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতে কারীমও নাযিল করেন,
(يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِذَا جَاءكُمُ الْمُؤْمِنَاتُ مُهَاجِرَاتٍ فَامْتَحِنُوْهُنَّ)، حَتّٰى بَلَغَ (بِعِصَمِ الْكَوَافِرِ) [الممتحنة : 10]
‘হে মু’মিনগণ! ঈমানদার নারীরা যখন তোমাদের কাছে হিজরাত করে আসে তখন তাদেরকে পরখ করে দেখ (তারা সত্যিই ঈমান এনেছে কি না)। তাদের ঈমান সম্বন্ধে আল্লাহ খুব ভালভাবেই জানেন। অতঃপর তোমরা যদি জানতে পার যে, তারা মু’মিনা, তাহলে তাদেরকে কাফিরদের কাছে ফেরত পাঠিও না। মু’মিনা নারীরা কাফিরদের জন্য হালাল নয়, আর কাফিররাও মু’মিনা নারীদের জন্য হালাল নয়। কাফির স্বামীরা (মাহর স্বরূপ) যা তাদের জন্য খরচ করেছিল তা কাফিরদেরকে ফেরত দিয়ে দাও। অতঃপর তোমরা তাদেরকে মাহর প্রদান করতঃ বিয়ে করলে তাতে তোমাদের কোন অপরাধ হবে না। তোমরা কাফির নারীদেরকে (বিবাহের) বন্ধনে আটকে রেখ না।’ [আল-মুমতাহিনাহ (৬০ : ১০]
উল্লেখিত আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর যখনই কোন মহিলা হিজরত করে আসতেন তখন রাসূলে কারীম (ﷺ) আল্লাহর এ নির্দেশের আলোকে তাঁর পরীক্ষা গ্রহণ করতেন,
(يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِذَا جَاءَكَ الْمُؤْمِنَاتُ يُبَايِعْنَكَ عَلٰى أَنْ لَا يُشْرِكْنَ بِاللهِ شَيْئاً وَلَا يَسْرِقْنَ وَلَا يَزْنِيْنَ وَلَا يَقْتُلْنَ أَوْلَادَهُنَّ وَلَا يَأْتِيْنَ بِبُهْتَانٍ يَفْتَرِيْنَهُ بَيْنَ أَيْدِيْهِنَّ وَأَرُجُلِهِنَّ وَلَا يَعْصِيْنَكَ فِيْ مَعْرُوْفٍ فَبَايِعْهُنَّ وَاسْتَغْفِرْ لَهُنَّ اللهَ إِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَحِيْمٌ) [الممتحنة : 12]
‘হে নাবী! যখন মু’মিনা নারীরা তোমার কাছে এসে বাই‘আত করে যে, তারা আল্লাহর সঙ্গে কোন কিছুকে শারীক করবে না, চুরি করবে না, যিনা করবে না, নিজেদের সন্তান হত্যা করবে না, জেনে শুনে কোন অপবাদ রচনা ক’রে রটাবে না এবং কোন ভাল কাজে তোমার অবাধ্যতা করবে না- তাহলে তুমি তাদের বাই‘আত (অর্থাৎ তোমার প্রতি আনুগত্যের শপথ) গ্রহণ কর এবং তাদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর; আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, বড়ই দয়ালু।’ [আল-মুমতাহিনাহ (৬০ : ১২]
এ প্রেক্ষিতে মহিলাগণ এ আয়াতে বর্ণিত শর্তাবলী অনুসরণ করবে বলে যখন অঙ্গীকার করত, নাবী কারীম (ﷺ) তখন তাদের অঙ্গীকার গ্রহণ করতেন। অতঃপর তাদরকে আর ফেরত দেয়া হতো না।
এ নির্দেশাবলী পালনার্থে মুসলিমগণ নিজ নিজ কাফেরা মুশরিকা স্ত্রীগণকে তালাক প্রদান করেন। ঐ সময় উমারের দাম্পত্যে দুই অংশীবাদী মহিলা ছিল। তিনি তাদের দু’ জনকে তালাক প্রদান করেন। এদের একজনকে বিবাহ করেন মুওয়াবিয়া এবং অন্য জনকে বিবাহ করেন সফওয়ান বিন উমাইয়া।
[1] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৩৮০ পৃঃ।
এ সন্ধির দফাসমূহের সারসংক্ষেপ (مَاذَا يَتَمَخَّضُ عَنْ بُنُوْدِ الْمُعَاهَدَةِ):
ইসলামের ইতিহাসে দিকে পরিবর্তনকারী এবং সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ সন্ধি হচ্ছে হুদায়বিয়াহর সন্ধি। যে ব্যক্তি এ সন্ধির দফাগুলো এবং পরবর্তী দৃশ্যপট সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করবেন এটা তাঁর নিকট স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হবে যে, এ সন্ধি ছিল মুসলিমগণের জন্য একটি বিরাট বিজয় স্বরূপ। কারণ এর পূর্ব পর্যন্ত কুরাইশগণ ইসলামী সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের কোন অস্তিত্বই স্বীকার করত না। এমন কি একে নিশ্চিহ্ন করার জন্য এরা ছিল বদ্ধপরিকর। তারা এ অপেক্ষায় ছিল যে, এক দিন না একদিন এদের শক্তি বিনষ্ট হয়ে যাবে। অধিকন্তু, কুরাইশগণ আরব উপদ্বীপে ধর্মীয় নেতৃত্ব এবং পার্থিব প্রধানের দায়িত্বে সমাসীন থাকার কারণে ইসলামী দাওয়াত এবং সাধারণ মানুষের মাঝে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে প্রতিবন্ধক ছিল।
এর পরবর্তী দৃশ্যপট বিশ্লেষণ করলে এটা পরিস্কার হয়ে যায় যে, এ সন্ধিতে আপাত: দৃষ্টিতে মুসলিমগণের কিছুটা নতি স্বীকার করার কথা মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এতে ছিল মুসলিমগণের শক্তির স্বীকারোক্তি এবং এ সত্যের স্বীকৃতি যে ইসলামী শক্তিকে পিষ্ট কিংবা নিশ্চিহ্ন করার ক্ষমতা কুরাইশদের নেই।
তৃতীয় দফার ক্ষেত্রে এটা প্রতীয়মান হচ্ছিল যে, কুরাইশগণের নিকট পরিবর্তিত পরিস্থিতির ব্যাপারটি তাদের অতীতের অবস্থা এবং অবস্থান সম্পর্কে তেমন কোন সচেতনতা যেন ছিল না। ধর্মীয় ব্যাপারে তাদের ভূমিকা যে ছিল শীর্ষস্থানে এ কথাটি তারা প্রায় ভুলতেই বসেছিল। অধিকন্তু, আরব উপদ্বীপের সাধারণ মানুষের কথাটাও যেন তাদের চিন্তা ও চেতনার বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। আরব উপদ্বীপের সকল সাধারণ মানুষ যদি ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে তাতেও যেন তাদের মাথা ব্যথার আর তেমন কিছুই ছিল না এবং এ ব্যাপারে তারা আর কোন প্রতিবন্ধকও হবে না। কুরাইশগণের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং সংকল্পের প্রেক্ষাপটে এটা কি তাদের জন্য প্রকাশ্য পরাজয় ছিল না? পক্ষান্তরে, মুসলিমগণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রেক্ষাপটে এটা কি তাদের জন্য সুস্পষ্ট বিজয় ছিল না?
অবশেষে মুসলিম ও ইসলামের শত্রুদের মধ্যে যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ সংঘটিত হয়েছিল এর লক্ষ্য এর উদ্দেশ্য এছাড়া আর কী ছিল যে, বিশ্বাস বা দ্বীনের ব্যাপারে জনসাধারণ সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করবে এবং ক্ষমতার অধিকারী হবে? অর্থাৎ স্বাধীন ইচ্ছানুযায়ী যে ব্যক্তি যা ইচ্ছা করবে তাই অবলম্বন করতে পারবে? মুসলিম হতে চাইলে মুসলিম হবে, আর কাফের থাকতে চাইলে কাফের থাকবে। তাদের ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষার সামনে কোন শক্তি বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। মুসলিমগণের এ ইচ্ছা তো কখনই ছিল না যে শত্রুদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হোক , তাদেরকে মৃত্যু ঘাটে অবতরণ করা হোক এবং জোরজবরদস্তি করে মুসলিম করা হোক। অর্থাৎ মুসলিমগণের উদ্দেশ্য এটা ছিল যা আল-কুরআন বর্ণনা করছে,
فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُرْ
‘কাজেই যার ইচ্ছে ঈমান আনুক আর যার ইচ্ছে সত্যকে অস্বীকার করুক’। (সূরাহ আল-কাহফ ১৮ : ২৯)
লোকেরা যা করতে চায় এ ব্যাপারে কোন শক্তিই যেন বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে। এটা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, এ সন্ধির মাধ্যমে মুসলিমগণের উল্লেখিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য সুবিধাদি অর্জিত হয়ে গেল এবং সে সব এভাবে অর্জিত হল যে, অধিকাংশ সময় যুদ্ধে প্রকাশ্য বিজয় লাভ করেও তা সম্ভব হয় নি। সন্ধির মাধ্যমে প্রচার কাজের ঝুঁকি এবং বিপদাপদের সম্ভাবনা থেকে মুক্ত হওয়ায় ইসলামের দাওয়াত ও প্রচারের ময়দানে মুসলিমগণ অভূতপূর্ব কৃতকার্যতা অর্জন করতে থাকেন। সন্ধির পূর্বে যে ক্ষেত্রে মুসলিমগণের সৈন্য সংখ্যা কখনই তিন হাজারের অধিক হয় নি, সে ক্ষেত্রে সন্ধির পর মাত্র দু’ বছরের ব্যবধানে মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে তা দশ হাজারে পৌঁছে গেল।
দ্বিতীয় দফাও প্রকৃতপক্ষে এ প্রকাশ্য বিজয়েরই অংশ ছিল। কারণ, সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করে মুশরিকগণই যুদ্ধ আরম্ভ করেছিল। এ প্রসঙ্গে কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,
(وَهُم بَدَؤُوْكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ) [التوبة: 13]
‘প্রথমে তারাই তোমাদেরকে আক্রমণ করেছিল।’ [আত্-তাওবাহ (৯) : ১৩]
যে অঞ্চল পর্যন্ত মুসলিম প্রহরী চক্র বা টহলদারী সৈন্য দলের কার্যক্রম বিস্তৃত ছিল মুসলিমগণের এটা উদ্দেশ্য এবং আশা ছিল যে, কুরাইশগণ তাদের নির্বুদ্ধিতা প্রসূত অহংকার পরিহার করে আল্লাহর দ্বীনের পথে বাধা সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকবে এবং সাম্য ও মৈত্রীর ভিত্তিতে কার্যাদি সম্পন্ন করবে। অর্থাৎ প্রত্যেক পক্ষই আপন আপন লক্ষ্যে কার্যাদি নিষ্পন্ন করার ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকবে। এখন চিন্তা করে দেখলে ব্যাপারটি পরিস্কার হয়ে যাবে যে, দশ বছরের জন্য যুদ্ধ বিরতির সন্ধি ছিল তাদের অর্থহীন অহংকার এবং আল্লাহর পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি থেকে বিরত থাকার অঙ্গীকার। অধিকন্তু, এটা এ কথা প্রমাণ করে যে, যারা যুদ্ধ আরম্ভ করেছিল তারা দুর্বল এবং পর্যুদস্ত হওয়ার ফলে স্বীয় উদ্দেশ্য হাসিল করতে গিয়ে তারা সম্পূর্ণ অকৃতকার্য হয়ে গেল।
প্রথম দফার প্রসঙ্গটি বিশ্লেষণ করলেও এটা সহজেই অনুধাবন করা যায় যে, আপাত দৃষ্টিতে মুসলিমগণের জন্য অবমাননাকর মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা ছিল তাঁদের সাফল্যেরই প্রতীক। কারণ, এ শর্তের মাধ্যমে মুসলিমগণ মসজিদুল হারামে প্রবেশাধিকার লাভ করেছিলেন যেখানে তাঁদের প্রবেশের ব্যাপারে কুরাইশরা ইতোপূর্বে নিষেধাজ্ঞা জারী করেছিল। তবে এ শর্তের মধ্যে কুরাইশদের পরিতৃপ্ত হওয়ার যে বিষয়টি ছিল তা হচ্ছে, তারা ঐ বছরের জন্য মুসলিমগণকে মক্কায় প্রবেশ থেকে বিরত রাখার ব্যাপারে সফলকাম হয়েছিল। কিন্তু তা ছিল নিতান্ত গুরুত্বহীন একটি সাময়িক ব্যাপার।
এ সন্ধির ব্যাপারে বিশেষভাবে চিন্তা-ভাবনার আরও একটি বিষয় হচ্ছে, কুরাইশগণ মুসলিমগণকে তিনটি বিষয়ে সুযোগদানের বিনিময়ে তারা মাত্র একটি সুযোগ গ্রহণ করেছিল যা ৪র্থ দফায় উল্লেখিত হয়েছে। কিন্তু এ সুযোগ ছিল খুবই সাধারণ এবং গুরুত্বহীন। এতে মুসলিমগণের কোন ক্ষতি হয় নি। কারণ, এটা একটা বিদিত বিষয় ছিল যে, যতক্ষণ কোন মুসলিম ইসলামের বন্ধনের মধ্যে থাকবে সে ততক্ষণ আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এবং মদীনাতুল ইসলাম হতে পলায়ন করতে পারবে না। মাত্র একটি কারণেই সে পলায়ন করতে পারে এবং তা হচ্ছে স্বধর্ম ত্যাগ। প্রকাশ্যে হোক কিংবা গোপনে হোক কোন মুসলিম যখন স্বধর্ম ত্যাগ করবে তখন তো মুসলিম সমাজে তার কোন প্রয়োজন থাকবে না। বরং মুসলিম সমাজে তার উপস্থিতির থেকে তার পৃথক হয়ে যাওয়াই হবে বহু গুণে উত্তম। এ মোক্ষম ব্যাপারটির প্রতি ইঙ্গিত করে রাসূলে কারীম (ﷺ) ইরশাদ করেছেন
(إِنَّهُ مَنْ ذَهَبَ مِنَّا إَلَيْهِمْ فَأَبْعَدَهُ اللهُ)
অর্থ: যে আমাদের ছেড়ে মুশরিকদের নিকট পলায়ন করল আল্লাহ তাকে দূর করে দিলেন এবং ধ্বংস করে দিলেন।[1]
এরপর অবশিষ্ট থাকে মক্কার সেই সব অধিবাসীর কথা যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল কিংবা ইসলাম গ্রহণের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান ছিল। অবশ্য এ চুক্তির ফলে যদিও তাদের জন্য একটি সান্তনার বিষয় এ ছিল যে, ‘আল্লাহর জমিন প্রশস্ত।’ ইসলামের প্রথম পর্যায়ে মক্কার মুসলিমগণের অত্যন্ত সংকটময় মুহূর্তে কি হাবাশাকে মুসলিমগণের জন্য তার বাহুবন্ধন উন্মুক্ত করে দেয় নি যখন মদীনার অধিবাসীগণ ইসলামের নাম পর্যন্ত শোনেনি? অনুরূপভাবে আজও পৃথিবীর যে কোন অংশ মুসলিমগণের জন্য স্বীয় বাহু বন্ধন উন্মুক্ত করতে পারে।
এ বিষয়টির প্রতিই ইঙ্গিত করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, (وَمَنْ جَاءَنَا مِنْهُمْ سَيَجْعَلَ اللهُ لَهُ فَرَجاً وَمَخْرَجاً) অর্থ: তাদের মধ্য হতে কোন ব্যক্তি আমাদের কাছে আসলে আল্লাহ তার জন্য যে কোন সুরাহা এবং প্রশস্ততা বের করে দেবেন।[2]
অতঃপর এ ধরণের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যদিও বাহ্যিকভাবে কুরাইশগণের সাময়িক মান-মর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছিল, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের জন্য তা ছিল ব্যক্তিগত ব্যাকুলতা, চিন্তাভাবনা, গোত্রীয় চাপ এবং বিপর্যয়ের নিদর্শন। অধিকন্তু, এ থেকে এমনটিও বোধগম্য হচ্ছিল যে, তারা তাদের মূর্তি পূজক সমাজ সম্পর্কে খুবই ভীতসন্ত্রস্ত ছিল। তাছাড়া তারা এটাও উপলব্ধি করছিল যে, শিশুদের খেলা ঘরের ন্যায় ঠুনকো ও অর্থহীন সমাজ-ব্যবস্থা এমন একটি ফাঁকা অন্তসারশূন্য এবং অভ্যন্তর ভাগ হতে খননকৃত পরিখার পাশে অবস্থিত যা যে কোন মুহূর্তে ধ্বসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। অতএব এর হেফাজতের জন্য ঐ জাতীয় রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা অবলম্বনের প্রয়োজন ছিল।
অন্যপক্ষে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে উদার অন্তঃকরণের সঙ্গে এ শর্তগুলোর স্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছিলেন যে, কুরাইশগণের নিকট আশ্রিত কোন মুসলিমকে ফেরত চাইবেন না, তা দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণিত করে যে, প্রস্তর প্রতিম সুদৃঢ় ও সুসংঘঠিত ইসলামী সমাজের উপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ পুরোমাত্রায় কার্যকর ছিল। এ প্রকার শর্তে সম্মতি জ্ঞাপনের ব্যাপারে তাঁর মনে দ্বিধা, দ্বন্দ্ব কিংবা আশংকার কোনই কারণ ছিল না।
[1] সহীহুল মুসলিম ২য় খন্ড ১০৫ পৃঃ, হুদায়বিয়াহর সন্ধি অধ্যায়।
[2] ক সহীহুল মুসলিম ২য় খন্ড ১০৫ পৃঃ, হুদায়বিয়াহর সন্ধি অধ্যায়।
মুসলিমগণের বিষণ্ণতা এবং উমার (রাঃ)-এর বিতর্ক (حُزْنُ الْمُسْلِمِيْنَ وَمُنَاقَشَةُ عُمَرُ النَّبِيَّ ﷺ):
হুদায়বিয়াহ সন্ধি চুক্তির শর্তাদি এবং তার সমীক্ষাসূচক আলোচনা ইতোপূর্বে উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু এ শর্ত সমূহের মধ্যে দুটি শর্ত স্পষ্টতঃ এ প্রকারের ছিল যা মুসলিমগণের মনে দারুন দুঃখ, বেদনা, হতাশা ও বিষণ্ণতার ভাব সৃষ্টি করেছিল। সেগুলো হচ্ছে (১) বিষয়টি ছিল, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছিলেন যে, তিনি আল্লাহর ঘরের নিকট গমন করবেন এবং তাওয়াফ করবেন, কিন্তু পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে তাওয়াফ না করেই মদীনা ফিরে যাওয়ার শর্তে তিনি সম্মতি জ্ঞাপন করেন। (২) দুঃখ-বেদনার দ্বিতীয় বিষয়টি ছিল, তিনি আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এবং সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ তা‘আলাভ তাঁর দ্বীনকে জয়যুক্ত করবেন বলে তিনি ঘোষণাও দিয়েছিলেন, অথচ কুরাইশগণের চাপে পড়ে কী কারণে তিনি সন্ধির এ অবমাননাকর শর্তে সম্মতি জ্ঞাপন করলেন তা কিছুতেই মুসলিমগণের বোধগম্য হচ্ছিল না। এ দুটি বিষয় মুসলিমগণের মনে দারুণ সংশয় সন্দেহ এবং শঙ্কার সৃষ্টি করেছিল। এ দুটি বিষয়ে মুসলিমগণের অনুভূতি এতই আঘাতপ্রাপ্ত ও আহত হয়েছিল যে বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করে এর সুদূর প্রসারী ফলাফল সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করার মতো মানসিক ধৈর্য তাঁদের ছিল না। ভাবানুভূতির ক্ষেত্রে তাঁরা সকলেই প্রায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন এবং সম্ভবত উমার (রাঃ) আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন সব চাইতে বেশী।
তিনি নাবী কারীম (ﷺ)-এর দরবারে উপস্থিতত হয়ে আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আমরা কি সত্যের উপর দন্ডায়মান নই এবং কাফিরেরা বাতিলের উপর?
নাবী কারীম (ﷺ) উত্তর দিলেন, ‘অবশ্যই।’
তিনি পুনরায় আরয করলেন, ‘আমাদের শহীদগণ জান্নাতে এবং তাদের নিহতগণ কি জাহান্নামে নয়? ‘তিনি বললেন, ‘কেন নয়।’
উমার বললেন, ‘তবে কেন আমরা আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে মুশরিকদের চাপে পড়ব এবং এমন অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করব যে, এখনও আল্লাহ তা‘আলা আমাদের ও তাদের মধ্যে কোনই ফয়সালা করেন নি?’
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, (يَا ابْنَ الْخَطَّابِ، إِنِّيْ رَسُوْلُ اللهِ وَلَسْتُ أَعْصِيَهُ، وَهُوَ نَاصِرِيْ وَلَنْ يُضَيِّعَنِيْ أَبَداً)
‘ওহে খাত্তাবের সন্তান! আমি আল্লাহর রাসূল এবং কখনই তাঁর অবাধ্য হতে পারব না। আমি বিশ্বাস করি যে সকল প্রয়োজনে তিনিই সাহায্য করবেন এবং কখনই আমাকে ধ্বংস হতে দেবেন না।’
উমার (রাঃ) বললেন, ‘আপনি কি আমাদের বলেন নি যে, আপনি আল্লাহর ঘরের নিকট গমন করবেন এবং তাওয়াফ করবেন?’
নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, (بَلٰى، فَأُخْبِرْتُكَ أِنَّا نَأْتِيَهُ الْعَامَ؟) ‘অবশ্যই, কিন্তু আমি কি এ কথা বলেছিলাম যে, আমরা এ বছরই আসব।’
তিনি উত্তর করলেন, ‘না’
নাবী (ﷺ) বললেন, (فإنك آتيه ومطوف به) ‘যাহোক ইনশাআল্লাহ্ তোমরা আল্লাহর ঘরের নিকট আসবে এবং তাওয়াফ করবে।
এরপর উমার (রাঃ) ক্রোধে ও অভিমানে অগ্নিশর্মা হয়ে আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর নিকট গিয়ে উপস্থিত হলেন এবং তাকেও সে সব কথা বললেন যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলেছিলেন। প্রত্যুত্তরে আবূ বাকরও (রাঃ) সে সব কথাই বললেন যা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছিলেন এবং পরিশেষে এটুকুও বললেন যে, ধৈর্য সহকারে নাবী (ﷺ) পথের উপর দন্ডায়মান থাক যতক্ষণ পর্যন্ত সত্য সমাগত না হয়। কেননা আল্লাহর শপথ তিনি সত্যের উপরেই প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন।’
এরপর(إِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحًا مُّبِيْنًا) ‘আমি তোমাকে দিয়েছি স্পষ্ট বিজয়।’ [আল-ফাতহ (৪৮) : ১] আয়াত অবতীর্ণ হয়। যার মধ্যে এ সন্ধিকে সুস্পষ্ট বিজয় প্রমাণ করা হয়েছে। এ আয়াতে কারীমা অবতীর্ণ হলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উমার (রাঃ)-কে আহবান করলেন এবং আয়াতটি পড়ে শোনালেন। তিনি তখন বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি একে বিজয় বলতে পারি?
নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, ‘হ্যাঁ’’।
এতে তিনি সাত্ত্বনা লাভ করলেন এবং সেখান থেকে চলে গেলেন।
পরে উমার (রাঃ) যখন নিজের ভুল বুঝতে পারলেন তখন অত্যন্ত লজ্জিত হলেন। এ ব্যাপারে তাঁর নিজের বর্ণনা হচ্ছে, ‘আমি সে দিন যে ভুল করেছিলাম এবং যে কথা বলেছিলাম তাতে ভীত হয়ে আমি অনেক আমল করেছি, প্রচুর দান খয়রাত করে আসছি, রোযা রেখে আসছি এবং দাস মুক্ত করে আসছি। এত শত করার পর এখন আমার মঙ্গলের আশা করছি।[1]
[1] হুদায়বিয়াহ সন্ধির চু্ক্তির বিস্তারিত বিবরণের উৎসগুলো হচ্ছে যথাক্রমে ফাতহুল বারী ৭ম খন্ড ৪৩-৪৫৮৮, সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৩৭৮-৩৮১পৃ, ২য় খন্ড, ৫৯৮-৬০০ ও ৭১৭ পৃঃ, সহীহুল মুসলিম ২য় খন্ড ১০৪-১০৬ পৃঃ। ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৩০৮-৩২২ পৃঃ। যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ১২২-১২৭ পৃঃ, মুখতাসারুস সীরাহ (শাইখ আব্দুল্লাহ রচিত) ২০৭-৩৫০ পৃঃ, ইবনু জাওযী লিখিত তারীখে উমার বিন খাত্তাব ৩৯-৪০ পৃঃ।
দুর্বল মুসলিমগণের সমস্যা সমাধান প্রসঙ্গ (اِنْحَلَتْ أزْمَةُ الْمُسْتَضْعَفِيْنَ):
মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করতে থাকলেন। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই অন্য এক সমস্যার সৃষ্টি হয়ে গেল। একজন মুসলিম- মক্কায় যার উপর নির্যাতন চালানো হচ্ছিল- কোন ভাবে মুক্ত হয়ে মদীনায় এসে উপস্থিত হল। তাঁর নাম ছিল আবূ বাসীর। তিনি সাক্বীফ গোত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং কুরাইশদের সঙ্গে সহযোগিতা চুক্তিতে আবদ্ধ ছিলেন। তাঁকে ফেরত নেয়ার জন্য কুরাইশগণ দু’ ব্যক্তিকে মদীনায় প্রেরণ করে। তাঁরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলল, ‘আমাদের ও আপনার মধ্যে যে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে তা কার্যকর করে আবূ বাসীরকে ফেরত দিন।’
তাদের এ কথার প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবূ বাসীরকে তাদের হস্তে সমর্পণ করে দিলেন। তারা দুজন তাঁকে সঙ্গে নিয়ে মক্কা অভিমুখে যাত্রা করল। পথ চলার এক পর্যায়ে তারা যুল হোলাইফা নামক স্থানে অবতরণ করে খেজুর খেতে লাগল। খাওয়া দাওয়া চলাকালীন অন্তরঙ্গ পরিবেশে আবূ বাসীর একজনকে বলল, ‘ওগো ভাই! আল্লাহর শপথ! তোমার তরবারীখানা আমার নিকট খুবই উকৃষ্ট মনে হচ্ছে। সে ব্যক্তি কোষ থেকে তরবারী খানা বের করে নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আল্লাহর শপথ! এ হচ্ছে অত্যন্ত উৎকৃষ্ট তরবারী। আমি একে বার বার পরীক্ষা করে দেখেছি।’
আবূ বাসীর বলল, ‘তরবারীখানা আমার হাতে একবার দাও ভাই, আমিও দেখি।’
সে তার কথা মতো তরবারীখানা তার হাতে দিল। এদিকে তরবারী হাতে পাওয়া মাত্রই আবূ বাসীর তাকে আক্রমণ করে স্ত্তপে পরিণত করে দিল।
দ্বিতীয় ব্যক্তি প্রাণভয়ে পলায়ন করে মদীনায় এসে উপস্থিত হল এবং দৌঁড় দিয়ে মসজিদে নাবাবীতে প্রবেশ করল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে দেখে বললেন, (لَقَدْ رَأَى هٰذَا ذعْراً) ‘কী হয়েছে একে এত ভীত দেখাচ্ছে কেন?’
লোকটি নাবী (ﷺ)-এর নিকট অগ্রসর হয়ে বলল, ‘আল্লাহর শপথ! আমার সঙ্গীকে হত্যা করা হয়েছে এবং আমাকেও হত্যা করা হবে।’ এ সময় আবূ বাসির সেখানে এসে উপস্থিত হল এবং বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আল্লাহ আপনার অঙ্গীকার পূরণ করে দিয়েছেন। আপনি আমাকে তাদের হস্তে সমর্পণ করে দিয়েছেন। অতঃপর আল্লাহ আমাকে তাঁদের নির্যাতন থেকে পরিত্রাণ দিয়েছেন।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,(وَيْلُ أَمِّهِ، مِسْعَرْ حَرْبٍ لَوْ كَانَ لَهُ أَحَدٌ) ‘তার মাতা ধ্বংস হোক , এ কোন সঙ্গী পেলে যুদ্ধের অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করবে।’
নাবী কারীম (ﷺ)-এর এ কথা শুনে আবূ বাসীর বুঝে নিলেন যে, পুনরায় তাকে কাফিরদের হস্তেই সমর্পণ করা হবে। কাজেই , কালবিলম্ব না করে তিনি মদীনা থেকে বের হয়ে সমুদ্রোপকূল অভিমুখে অগ্রসর হলেন।
এদিকে আবূ জান্দাল বিন সোহাইলও কোন ভাবে মুক্ত হয়ে মক্কা হতে পলায়ন করেন এবং আবূ বাসীরের সঙ্গে মিলিত হন। এরপর থেকে কুরাইশদের কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে মক্কা থেকে পলায়ন করে গিয়ে আবূ বাসীরের সঙ্গে গিয়ে মিলিত হতেন। এভাবে একত্রিত হয়ে তারা একটি সুসংগঠিত দলে পরিণত হয়ে যান।
এরপর থেকে শাম দেশে গমনাগমনকারী কোন কুরাইশ বাণিজ্য কাফেলার খোঁজ খবর পেলেই তাঁরা তাদের উপর চড়াও হয়ে লোকজনদের মারধোর করতেন এবং ধনমাল যা পেতেন তা লুটপাট করে নিয়ে যেতেন। বার বার প্রহৃত এবং লুণ্ঠিত হওয়ার ফলে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে অবশেষে কুরাইশগণ নাবী কারীম (ﷺ)-এর নিকট এসে আল্লাহ এবং আত্মীয়তার মধ্যস্থতার বরাত দিয়ে এ প্রস্তাব পেশ করেন যে তিনি যেন তাঁদেরকে তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীনে নিয়ে আসেন। এ প্রেক্ষিতে নাবী কারীম (ﷺ) তাঁদেরকে মদীনায় আগমনের জন্য আহবান জানালে তাঁরা মদীনায় চলে আসেন। কুরাইশরা আরও প্রস্তাব করে যে, যে সকল মুসলিম মক্কা থেকে মদীনা চলে যাবে তাদের আর ফেরত চাওয়া হবে না।’’[1]
[1] পূর্ব উৎস দ্রষ্টব্য।
কুরাইশ ভ্রাতৃবৃন্দের ইসলাম গ্রহণ (إِسْلاَمُ أَبْطَالٍ مِّنْ قُرَيْشٍ):
হুদায়বিয়াহর সন্ধিচুক্তির পর সপ্তম হিজরী সালের প্রথম ভাগে ‘আমর বিন আস, খালিদ বিন ওয়ালিদ এবং উসমান বিন ত্বালহাহ (রাঃ) ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এরা যখন মসজিদে নাবাবীতে উপস্থিত হলেন তখন নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, (إِنَّ مَكَّـةَ قَدْ أَلْقَتْ إِلَيْنَا أَفْلاَذَ كَبِدِهَا) ‘মক্কা তার কলিজার টুকরোদের (প্রিয়জনদেরকে) আমাদের নিকট সমর্পণ করে দিয়েছে।[1]
[1] এ সাহাবাগণ কোন বছর ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন সে ব্যাপারে যথেষ্ট মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়েছে। ব্যক্তি বৃত্তান্ত সংক্রান্ত পুস্তকসমূহে একে অষ্টম হিজরীর ঘটনা বলা হয়েছে। কিন্তু নাজ্জাশীর নিকট আমর বিন আসের ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি প্রসিদ্ধ ছিল যা সপ্তম হিজরীতে ঘটেছিল। অধিকন্তু, এটাও বিদিত বিষয় যে, খালিদ বিন ওয়ালিদ এবং উসমান বিন ত্বালহাহ ঐ সময় মুসলিম হয়েছিলেন। কারণ তিনি হাবশ হতে ফিরে এসে মদীনায় আসার ইচ্ছা করেন তখন পথিমধ্যে ঐ দু’ জনের সাথে সাক্ষাত হয় এবং তিন জনেই এক সঙ্গে খিদমতে নাবাবীতে উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। এর অর্থ দাঁড়ায়, এরা সকলেই সপ্তম হিজরীর প্রথম দিকে মুসলিম হয়েছিলেন। আল্লাহ ভাল জানেন।