নতুন সমাজ ব্যবস্থার রূপায়ণ (بِنَاءُ مُجْتَمِعٍ جَدِيْدٍ ):
ইতোপূর্বে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনায় আগমন করে প্রথম হিজরী রবিউল আওয়াল মাসের ১২ই তারীখে জুমআর দিন মোতাবেক ২৭শে সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে বনী নাজ্জার গোত্রের আবূ আইউব আনসারীর বাড়ির সম্মুখে অবরতণ করেছিলেন এবং বলেছিলেন ‘ইন-শা-আল্লাহ এটাই হবে আমার অবস্থান।’ তারপর তিনি আবূ আইউব আনসারীর বাড়িতে স্থানান্তর হয়ে যান।
মসজিদে নাবাবীর নির্মাণ (بِنَاءُ الْمَسْجِدِ النَّبَوِيْ ):
এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রথম কাজ হল মসজিদে নাবাবীর নির্মাণ। আর এজন্য ঐ স্থানটিই নির্ধারিত হল যেখানে সর্ব প্রথম তাঁর উটটি বসে পড়েছিল। এ স্থানটির মালিক ছিল দু’জন অনাথ বালক। তিনি ঐ স্থানটি ন্যায্য মূল্যে ক্রয় করলেন এবং স্বশরীরে মসজিদের নির্মাণ কাজে অংশগ্রহণ করলেন। তিনি ইট ও পাথর বহন করছিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বলছিলেন,
[اَللَّهُمَّ لاَ عَيْشَ إِلاَّ عَيْشُ الآخرة ** فاغْفِرْ للأنصار والمُهَاجِرَة]
অর্থঃ ‘হে আল্লাহ! জীবন তো কেবল পরকালেরই জীবন। অতএব আনসার ও মহাজিরদেরকে ক্ষমা করুন।’
অধিকন্তু এ কথাও বলছিলেন,
[هذا الحِمَالُ لا حِمَال خَيْبَر ** هــذا أبـَــرُّ رَبَّنَا وأطْـهَر]
অর্থঃ ‘এটা খায়বারের বোঝা নয়, এ আমার প্রভূর পক্ষ হতে অধিক পুণ্যময় ও পবিত্র।’
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কর্মধারা সাহাবীগণ (রাঃ)-কে উৎসাহিত, উদ্দীপিত ও উজ্জীবিত করছিল। কাজে তারাও বলছিলেন,
لئن قَعَــدْنا والنبي يَعْمَل ** لـذاك مِــنَّا العَمَــلُ المُضَلَّل
অর্থঃ ‘যদি আমরা বসে থাকি এবং নাবী (ﷺ) কাজ করেন, তাবে আমাদের এ কাজ হবে পথভ্রষ্টতার’’।
এ জমিতে মুশরিকদের কিছু সংখ্যক কবর ছিল। কিছু অংশ পতিত ছিল। তাছাড়া খেজুর ও গারকাদের কয়েকটি গাছ ছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুশরিকদের কবরগুলো পরিষ্কার করিয়ে নিলেন, অসমতল জায়গাটা সমতল করলেন এবং খেজুর ও অন্য গাছগুলো কাটিয়ে ক্বিবলাহর দিকে খাড়া করে দিলেন। সে সময় ক্বিবলাহ বায়তুল মুক্বাদ্দাস। দরজার দু’বাহুর স্তম্ভগুলো পাথর দ্বারা এবং দেওয়াল নির্মিত হল কাঁচা ইট দিয়ে। ছাদের উপর খেজুরের ডালপালা চাপিয়ে আবরণ তৈরি করা হল আর খেজুর গাছের গুড়ি দিয়ে থাম তৈরি করা হল। মেঝেতে বিছানো হল বালি ও ছোট ছোট কাঁকর। ঘরের তিন দরজা লাগানো হয়েছিল। ক্বিবলাহর দেওয়াল হতে পিছনের দেওয়াল পর্যন্ত দৈর্ঘ ছিল ১০০ (একশত) হাত আর প্রস্থও ছিল ঐ পরিমাণ অথবা কিছু কম। ভিতরে গভীরতা ছিল তিন হাত।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মসজিদের পাশে কয়েকটি ঘর তৈরি করিয়ে নিলেন যার দেয়াল ছিল কাঁচা ইটের এবং ছাদ ছিল খেজুরের গুঁড়ির বর্গা দিয়ে। ছাউনি দেয়া হয়েছিল খেজুরের শাখা ও পাতা দিয়ে তৈরি। এগুলো ছিল উম্মাহাতুল মু’মিনীন নাবী পত্নীগণের (রাঃ) আবাস কক্ষ। এ কক্ষগুলোর কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবূ আইউব আনসারী (রাঃ)-এর বাসা থেকে এ আবাসস্থানে স্থানান্তর হয়ে গিয়েছিলেন।[1]
মসজিদে নাবাবী শুধুমাত্র সালাত আদায়ের কেন্দ্রবিন্দুই ছিল না, বরং তা ছিল তৎকালীন মুসলিম রাষ্ট্রের বিভিন্নমুখী কর্মকান্ডের উৎসস্থল। এ মসজিদেই ছিল মুসলিম সামাজের আদিশিক্ষা কেন্দ্র যেখানে বসে মুসলিমগণ ইসলামের যাবতীয় শিক্ষাদিক্ষা এবং হেদায়াতের পাঠ গ্রহণ করতেন, এ মসজিদেই ছিল এমন একটি মিলনকেন্দ্র যেখানে জাহেলিয়াত জীবনের দীর্ঘ কালের বিবাদ বিসম্বাদ ও যুদ্ধ-বিগ্রহের অবসান ঘটিয়ে আরব গোত্রগুলোর মধ্যে সৌহার্দ ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে তোলা হয়েছিল, এ মসজিদেই বসত রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম পরিচালনার পরামর্শ সভা। রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণ, সৈন্য পরিচালনা, সন্ধি স্থাপন, চুক্তি সম্পাদন ইত্যাদি যাবতীয় কাজকর্মের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এ মসজিদে নাবাবী। অধিকন্তু, এ মসজিদেই ছিল অনেক নিবেদিত সাহাবী (রাঃ)-এর আবাসস্থল, যাঁদের বাড়িঘর, ধন-সম্পদ এবং আত্মীয়-স্বজন বলতে কিছুই ছিল না।
হিজরতের প্রথম দিকেই আযান প্রথা প্রচলিত হয়। এটা এমন এক সুরেলা স্বর্গীয় সঙ্গীত এবং সালাত কায়েমের উদ্দেশ্যে মসজিদে আগমনের জন্য এমন মনোজ্ঞ আহবান যা প্রত্যহ পাঁচবার প্রচারিত হয় মসজিদের মিনার থেকে। মসজিদে নাবাবীতে যখন আযান দেয়া হতো এবং আযানের গুরু গম্ভীর আওয়াজ যখন আকাশের দিকে দিকে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকত, তখন একদিকে আল্লাহ প্রেমিক মুসলিমদের অন্তর ভালবাসায়, ভক্তিতে, আবেগে উদ্বেলিত হয়ে উঠত, অন্যদিকে কাফির মুশরিকদের অন্তর ভয়-ভীতিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠত। এ সম্পর্কে আব্দুল্লাহ বিন যায়দ বিন আবদে রাব্বিহীর (রাঃ) স্বপ্নের ঘটনাটি সুপ্রসিদ্ধ রয়েছে (বিস্তারিত অবগতির জন্য জামে তিরমিযী, সুনানে আবূ দাউদ, মুসনাদে আহমাদ ও সহীহুল ইবনে খুযায়মাহ’য় দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে।)
[1] সহীহুল বুখারী শরীফ ১ম খন্ড ৭১, ৫৫৫ ও ৫৬০ পৃঃ। যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৫৬ পৃঃ।
মুসলিমগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন স্থাপন (المُؤَاخَاةُ بَيْنَ الْمُسْلِمِيْنَ):
মসজিদে নাবাবীর নির্মাণ কাজে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং মুসলিমগণ যেভাবে পারস্পরিক বোঝাপড়া, সাহায্য সহযোগিতা এবং উৎসাহ-উদ্দীপনার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তেমনভাবে মুসলিমগণের মধ্যে এমন অপূর্ব এক ভ্রাতৃত্ব বন্ধন প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছিলেন যার তুলনা মানব জাতির ইতিহাসে কোথাও মিলে না। মুসলিমগণের এ ভ্রাতৃত্ব বন্ধনকে ‘মুহাজির ও আনসারগণের ভ্রাতৃত্ব বন্ধন’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। ইবনুল কাইয়্যেম লিখেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আনাস বিন মালেকের গৃহে মুহাজির ও আনসারগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন স্থাপন করিয়েছিলেন। এ সভায় সর্বশেষ নব্বই জন মুসলিম উপস্থিত ছিলেন, অর্ধেক সংখ্যক ছিলেন মুহাজির এবং অর্ধেক সংখ্যক আনাসার। ‘মুহাজির আনসার ভ্রাতৃত্বের’ মূলনীতি গুলো ছিল, ‘একে অন্যের দুঃখে দুঃখিত হবেন এবং মৃত্যুর পর নিজ আত্মীয়ের মতো একে অন্যের ওয়ারেস বা উত্তরাধিকারী হবেন। ওয়ারাসাত বা উত্তরাধিকারের এ ব্যবস্থা বদর যুদ্ধ পর্যন্ত চালু ছিল। তারপর যখন এ আয়াতে শরীফা,
(وَأُوْلُوْا الأَرْحَامِ بَعْضُهُمْ أَوْلَى بِبَعْضٍ) [الأنفال: 75]
‘‘কিন্তু আল্লাহর বিধানে রক্ত সম্পর্কীয়গণ পরস্পর পরস্পরের নিকট অগ্রগণ্য।’ (আল-আনফাল ৮ : ৭৫)
বলা হয়ে থাকে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কেবলমাত্র মুহাজিরীনদের মধ্যে আরও এক ভ্রাতৃত্ব বন্ধন গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু প্রথম মতটিই অধিক প্রামণ্য ও গ্রহণযোগ্য। কেননা, মুহাজিরীনগণ এমনিতেই পরস্পর ইসলামী ভ্রাতৃত্বে, দেশীয় ও গোত্রীয় ভ্রাতৃত্বে এবং আত্মীয়তার বন্ধনের কারণেই তাঁদের মধ্যে নতুন করে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু আনসারদের ব্যাপারটি ছিল ভিন্ন।[1]
এ ভ্রাতৃত্বের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মুহাম্মাদ গাযালী লিখেছেন যে, ‘এ ছিল মূর্খতার যুগের বংশীয় সম্পর্ক ছিন্নকারী। আত্মীয়তা বা অনাত্মীয়তার সম্পর্ক যা কিছু হবে তা হবে ইসলামের জন্য। এরপর থেকে মানুষে মানুষে বংশ, বর্ণ ও দেশের সম্পর্ক মুছে যাবে। উঁচু, নীচু ও মানবত্বের মাপকাঠি হবে কেবলমাত্র তাকওয়ার ভিত্তিতে, অন্য কোন কিছুর ভিত্তিতে নয়।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে শুধুমাত্র ফাঁকা বুলির পোষাক পরে ক্ষান্ত হন নি, বরং এ ছিল এমন এক কার্যকর অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি যা রক্ত ও ধন-সম্পদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। এটা শুধু ফাঁকা বুলি এবং গতানুগতিক সালাম ও মুবারকবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এ ভ্রাতৃত্বের মধ্যে ছিল সমবেদনা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। আর এ কারণেই তাঁর পরিকল্পিত ও প্রতিষ্ঠিত এ নবতর জীবনধারা মানব জাতির ইতিহাসে এমন এক অধ্যায় রচনা করেছিল কোন কালেই যার কোন তুলনা মিলে না।[2]
সহীহুল বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে যে, মুহাজিরগণ যখন মদীনায় আগমন করলেন তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আব্দুর রহমান বিন আউফ (রাঃ) এবং সা’দ বিন রাবীর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন স্থাপনে করিয়ে দিয়েছিলেন। এর পর সা’দ (রাঃ) আব্দুর রহমানকে (রাঃ) বললেন, ‘আনসারদের আমি সর্বাপেক্ষা ধনী ব্যক্তি। আপনি আমার সম্পদ দু’ভাগে ভাগ করে অর্ধেক গ্রহণ করুন। তাছাড়া, আমার দুজন স্ত্রী রয়েছে। দুজনের মধ্যে যাকে আপনার পছন্দ হয় আমাকে বলুন, আমি তাকে তালাক দিব। ইদ্দত পালনের পর তাকে বিবাহ করবেন।’
আব্দুর রহমান (রাঃ) বললেন, ‘আল্লাহ আপনার ধনজন ও মালমাত্তায় বরকত দিন। আপনাদের বাজার কোথায়?’ তাঁকে বনু ক্বাইনুক্কা’র বাজার দেখিয়ে দেয়া হল। তিনি যখন বাজার থেকে ফিরে এলেন তখন তাঁর নিকট অতিরিক্ত কিছু পনির ও ঘি ছিল। এরপর তিনি প্রত্যহ বাজারে যেতে থাকলেন। তারপর একদিন যখন তিনি বাজার থেকে ফিরে এলেন তখন তাঁর শরীরে হলুদ রঙের চিহ্ন ছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কী?’ তিনি বললেন, ‘আমি বিবাহ করেছি।’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘স্ত্রীকে মোহর দিয়েছ তো?’ তিনি বললেন, ‘একটি খেজুরের বিচী পরিমাণ স্বর্ণ (অর্থাৎ সোয়া ভরি) দিয়েছি।[3]
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে এরূপ একটি বর্ণনা এসেছে যে, আনাসারগণ রাসূলুল্লাহ (রাঃ)-এর নিকট এ বলে আবেদন পেশ করলেন যে, ‘আপনি আমাদের এবং মুহাজিরীন ভাইদের মধ্যে আমাদের খেজুর বাগানগুলো ভাগ বন্টন করে দিন’’। তিনি বললেন, ‘না’’।
আনসারগণ বললেন, ‘তবে আপনারা অর্থাৎ মুহাজিরগণ আমাদের কাজ করে দেবেন এবং তাদেরকে আমরা ফলের অংশ দিব।
তারা বললেন, ‘ঠিক আছে, আমরা কথা শ্রবণ করলাম ও মান্য করলাম।[4]
এ থেকে সহজে অনুমান করা যায় যে, আনাসারগণ কিভাবে আন্তরিকতা ও আগ্রহের সঙ্গে আগু বেড়ে মুহাজির ভাইদের জন্য সহমর্মিতা প্রকাশ ও সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করেছিলেন এবং কতটুকু মহববত, খলুসিয়াত ও আত্মত্যাগের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। অধিকন্তু, মুহাজিরগণও তাঁদের আনসার ভাইদের প্রতি কতটুকু শ্রদ্ধাশীল, সহমর্মী ও আত্মসচেতন ছিলেন তা এ ঘটনা থেকেই প্রমাণিত হয়ে যায়। আনসারগণের আত্মত্যাগের সুযোগ তাঁরা গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু সুযোগের অপব্যবহার কখনই করেন নি। তাঁদের ভেঙ্গে যাওয়া জীবনধারাকে ন্যূনতম প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে সচল করে তোলার জন্য যতটুকু গ্রহণ করার প্রয়োজন ছিল তাঁরা ঠিক ততটুকুই গ্রহণ করেছিলেন।
এ প্রসঙ্গটি সম্পর্কে সত্য কথা এবং এর গৃঢ় রহস্য সম্পর্কে বলতে গেলে কথা অবশ্যই বলতে হয় যে, এ ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের ভিত্তি ছিল অভাবিত ও অপূর্ব। আল্লাহ দর্শন এবং বিজ্ঞানের উর্বর পলল ভূমিতে উপ্ত হয়েছিল ইসলামী রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালার বীজ যার ফলে মুসলিমগণের সম্মুখে সৃষ্ট সকল সমস্যার সমাধান হয়েছিল সর্বোত্তম পন্থায়।
[1] যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৫৬ পৃঃ।
[2] ফিকহুস সীরাহ ১৪০ ও ১৪১ পৃঃ।
[3] সহীহুল বুখারী বাবু এখাউন নাবী (সাঃ) বায়নাল মুহাজিরীনা অল আনসার, ১ম খন্ড ৩৫৫ পৃঃ।
[4] প্রাগুক্ত বাবু ইয়াকলা আকফেনী মোউনাতান নাখলে ১ম খন্ড ৩১২ পৃঃ।
পরস্পরে ইসলামী সাহায্যের অঙ্গীকার (مِيْثَاقُ التَّحَالُفِ الْإِسْلَامِيْ):
উপরি উল্লেখিত ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের মতই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুসলিমগণের মধ্যে আরও একটি অঙ্গীকারপত্র সম্পাদন করেছিলেন যদ্দ্বারা জাহেলিয়াত যুগের সকল গোত্রীয় গন্ডগোলের মূলোৎপাটন এবং যাবতীয় কুসংস্কার ও রসম-রেওয়াজের বিলোপ সাধন ঘটে। এ অঙ্গীকারনামার দফাগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে লিপিবদ্ধ করা হল যার রূপ ছিল এ ধরণেরঃ
এটা লিখিত হচ্ছে নাবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর পক্ষ থেকে কুরাইশ, ইয়াসরেবী এবং তাঁদের অনুসারী ও তাঁদের সঙ্গে মিলিত হয়ে জিহাদে অংশগ্রহণকারী মুসলিমগণের জন্যঃ
১. এরা নিজেদের ছাড়া অন্য সকল মানব থেকে ভিন্ন একটি গোষ্ঠি।
২. কুরাইশ মুহাজিরগণ নিজেদের পূর্বেকার অবস্থা মোতাবেক নিজেদের মধ্যে দিয়াত (হত্যার বিনিময়) দেবেন এবং মু’মিনদের মধ্যে ইনসাফের সঙ্গে বন্দীদের মুক্তিপণ প্রদান করবেন। আনসারদের সকল গোত্র নিজেদের পূর্বেকার অবস্থা মোতাবেক নিজেদের মধ্যে দিয়াত প্রদান করবেন এবং তাঁদের সকল দল ঈমানদারদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গত পন্থায় আপন বন্দীদের জন্য মুক্তিপণ প্রদান করবেন।
৩. ঈমানদারগণ কোন সহায় সম্পদহীন (অনাথ) কে মুক্তিপণ ও দিয়াত প্রদানের ব্যাপারে উত্তম পন্থা মোতাবেক প্রদান এবং সম্মান করা থেকে বিমুখ করবেন না।
৪. সকল ধর্মপ্রাণ মু’মিন ঐ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধাচরণ করবেন যারা তাঁদের প্রতি অন্যায় আচরণ করবে অথবা ঈমানদারদের বিরুদ্ধে অন্যায়, অত্যাচার, পাপ ও গন্ডগোলের পথ বেছে নেবে।
৫. মু’মিনগণ তাদের বিরুদ্ধে কাজ করবেন যদিও তাদের মধ্যে কেউ আপন পুত্রও হয়।
৬. কোন কাফিরের বদলে কোন মু’মিন কোন মু’মিনকে হত্যা করবেন না।
৭. কোন মু’মিন কোন মু’মিনের বিরুদ্ধে কোন কাফিরকে সাহায্য করবেন না।
৮. আল্লাহর যিম্মা (অঙ্গীকার) একই হবে। একজন সাধারণ মানুষের প্রদানকৃত যিম্মা সকল মুসলমানের জন্য সমানভাবে পালনযোগ্য হবে।
৯. যে সকল ইহুদী মুসলিমগণের অনুগামী হবে তাদের প্রয়োজনে সাহায্য করতে হবে এবং তারা অন্য মুসলিমগণের মতো হয়ে যাবে। তাদের প্রতি কোন অন্যায় করা যাবে না। কিংবা তাদের বিরুদ্ধে অন্যকে সাহায্যও করা যাবে না।
১০. মুসলিমগণের সম্পাদিত সন্ধি হবে একই। কোন মুসলিম কোন মুসলিমকে বাদ দিয়ে আল্লাহর পথে যুদ্ধের ব্যাপারে কোন সন্ধি করবেন না, বরং সকলে সমতা ও ন্যায়ের ভিত্তিতেই তা করবেন।
১১. মুসলিমগণ ঐ রক্তপাতের ব্যাপারে সমান অধিকার রক্ষা করবেন যা আল্লাহর পথে প্রবাহিত হবে।
১২. কোন কুরাইশ মুশরিককে আশ্রয় দেবে না, তাদের ধন-সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে সাহায্য করবে না, আর কোন মু’মিনের হেফাজতের ব্যাপারে মুশরিকদেরকে প্রতিবন্ধক হিসেবে দাঁড় করাবে না।
১৩. যে ব্যক্তি কোন মুসলমানকে হত্যা করবে এবং তা যদি প্রমাণিত হয় তাহলে তার নিকট থেকে হত্যার বদলা গ্রহণ করা হবে যদি নিহতের অভিভাবক রাজী থাকেন।
১৪. যে সকল মু’মিন এর বিরুদ্ধাচরণ করবে তাদের জন্য এছাড়া আর কিছু হালাল হবে না যে, তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করবেন, তাঁরা বিরুদ্ধাচারীর বিরুদ্ধাচরণ করবেন।
১৫. কোন মু’মিনের জন্য এটা সঙ্গত হবে না যে, যারা গুন্ডগোল সৃষ্টি করে (বিদ’আতী) তাদের কার্যকলাপে সাহায্য করে অথবা তাকে আশ্রয় দেয়, কিংবা যে তাকে সাহায্য করে তাকে আশ্রয় দেয়। যে এরূপ করবে কিয়ামতের দিন সে অভিশাপ এবং গযবে নিপতিত হবে এবং তার ফরজ ও নফল কোন ইবাদতই কবুল হবে না।
১৬. তোমাদের মধ্যে যখনই যে কোন মতভেদ পরিলক্ষিত হবে তখনই তা আল্লাহ এবং তার রাসূল (ﷺ)-এর বিধি-বিধান মতো ফয়সালার ব্যবস্থা করবে।[1]
[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৫০২-৫০৩ পৃঃ।
জীবনধারায় বৈপ্লবিক ধ্যান-ধারণার প্রবর্তন (أَثَرُ الْمَعْنَوِيَاتِ فِي الْمُجْتَمِعِ):
ইসলামী রাষ্ট্র ও মহা বিজ্ঞানময় মুসলিম সমাজের এ ক্রান্তি লগ্নে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এক নতুন জীবনধারার ভিত্তি স্থাপন করেন। এ জীবনধারার বাহ্যিকতা প্রকৃতপক্ষে ঐ আভ্যন্তরীণ পরিপূর্ণতারই প্রতিবিম্ব (রশ্মি) ছিল যাকে নাবী (ﷺ)-এর সঙ্গ ও সাহচর্যের বদৌলতে অভাবনীয় এক সম্মানের আসনে সমাসীন করা সম্ভব হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর শিষ্যদের দীক্ষা, আত্মশুদ্ধি ও উত্তম চরিত্র গঠনে উৎসাহিত করতেন এবং অবিরামভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতেন।
তিনি তাঁর শিষ্যগণকে সদা-সর্বদা ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসা, সম্মান, সম্ভ্রম এবং উপাসনা, আনুগত্য ও আদবক্বায়দার তালীম দিতেন এবং নিষ্ঠার সঙ্গে তা মেনে চলার জন্য প্রেরণা ও পরামর্শ দান করতেন।
একজন সাহাবী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করলেন,
أَيُّ الْإِسْلَامِ خَيْرٌ
‘কোন্ ইসলাম উত্তম? অর্থাৎ ইসলামের কোন্ আচার-আচরণটি উৎকৃষ্ট?’ তিনি বললেন,
[تُطْعِمُ الطَّعَامَ، وَتُقْرِئُ السَّلَامَ عَلٰى مَنْ عَرَفْتَ وَمَنْ لَمْ تَعْرِفْ]
‘তুমি খাদ্য খাওয়াও এবং চেনা-অচেনা (লোককে) সালাম দাও’’।[1]
আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ)-এর বর্ণনা রয়েছে যে, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন মদীনায় আগমন করলেন, তখন আমি তাঁর দরবারে হাজির হয়ে তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডল প্রত্যক্ষ করেই স্পষ্টতঃ উপলব্ধি করলাম যে, এ কমনীয়, রমণীয়, সুষমাস্নিগ্ধ ও উজ্জ্বলতামন্ডিত মুখমণ্ডলটি কোন মিথ্যুক মানুষের হতেই পারে না (এবং তার মুখ নিঃসৃত যে প্রথম বাণীটি শ্রবণ করেছিলাম তা ছিল,
[يَا أَيُّهَا النَّاسُ، أَفْشُوْا السَّلَامَ، وَأَطْعِمُوْا الطَّعَامَ، وَصِلُوْا الْأَرْحَامَ، وَصَلُّوْا بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ نِيَامٌ، تَدْخُلُوْا الْجَنَّةَ بِسَلَامٍ]
‘হে লোক সকল! তোমরা পরস্পর পরস্পরকে সালাম দেয়ার রেওয়াজ প্রবর্তন কর, খাদ্য খাওয়াও, আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ় কর এবং রাত্রি বেলা মানুষ যখন নিদ্রাসুখে মগ্ন থাকবে তখন আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাক। (তবে) নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করবে।[2]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলতেন,
[لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ لَا يَأْمَنْ جَارُهُ بَوَائِقَهُ]
‘‘ঐ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যার প্রতিবেশী তার অন্যায়-অত্যাচার থেকে নিরাপদে না থাকে।[3] তিনি আরও বলেছেন,
[الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُوْنَ مِنْ لِّسَانِهِ وَيَدِهِ]
‘‘(প্রকৃত) মুসলিম ঐ ব্যক্তি যার হাত ও জিহবা থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদে থাকে।[4]
তিনি আরও বলেছেন,
[لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتّٰى يُحِبُّ لِأَخِيْهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ]
‘তোমাদের মধ্যে কেউই (প্রকৃত) মুসলিম হতে পারবে না যতক্ষণ না সে অপর ভাইয়ের জন্য ঐ সকল জিনিস পছন্দ করবে যা নিজের জন্য পছন্দ করে।’[5]
তিনি আরও বলেছেন,
[المُؤْمِنُوْنَ كَرَجُلٍ وَّاحِدٍ، إِنْ اشْتَكٰى عَيْنُهُ اِشْتَكٰى كَلُّهُ، وَإِنْ اشْتَكٰى رَأْسُهُ اِشْتَكٰى كُلُّهُ]
‘‘সকল মু’মিন একটি মানব দেহের মত, যদি তার চোখে ব্যথা হয় তাহলে সমগ্র দেহেই ব্যথা অনুভূত হবে, আর যদি মাথায় ব্যথা হয় তাহলে তার সমগ্র শরীরেই ব্যথা অনুভূত হবে।[6]
তিনি আরও বলেছেন,
[المُؤْمِنُ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضاً]
‘‘মু’মিন মু’মিনের জন্য একটি দালান ঘরের মতো, একাংশ অপর অংশকে শক্তি দান করে। [7]
তিনি আরও বলেছেন,
[لَا تَبَاغَضُوْا، وَلَا تَحَاسَدُوْا، وَلَا تَدَابَرُوْا، وَكُوْنُوْا عِبَادَ اللهِ إِخْوَاناً، وَلَا يَحِلُّ لِمُسْلِمٍ أَنْ يَهْجُرَ أَخَاهُ فَوْقَ ثَلَاثَةَ أَيَّامٍ]
‘‘নিজেদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ রাখবে না, রাগ করবে না, একে অপর থেকে মুখ ফিরাবে না, আল্লাহর বান্দা ও আপোষের মধ্যে ভাই ভাই হয়ে থাকবে। কোন মুসলমানের জন্য হালাল নয় যে, সে তিন দিনের বেশী তার ভাইয়ের সাথে ক্রোধবশত কথা বার্তা বলবে না।[8]
তিনি আরও বলেছেন,
[الْمُسْلِمُ أَخُوْ الْمُسْلِمِ لَا يَظْلِمُهُ وَلَا يَسْلِمُهُ، وَمَنْ كاَنَ فِيْ حَاجَةِ أَخِيْهِ كَانَ اللهُ فِيْ حَاجَتِهِ، وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً فَرَّجَ اللهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرَبَاتِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِماً سَتَرَهُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ]
‘মুসলিম মুসলমানের ভাই, না তার প্রতি অন্যায় করবে আর তাকে শত্রুর হাতে অর্পণ করবে। আর যে ব্যক্তি আপন (মুসলিম) ভাইয়ের প্রয়োজন মেটাতে সচেষ্ট হবে আল্লাহ তার প্রয়োজন মিটাতে থাকবেন। কোন মুসলিম যদি তার মুসলিম ভাইয়ের দুঃখ-কষ্ট দূরীভূত করে তবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দুঃখ-কষ্ট দূর করবেন। আর কেননা মুসলিম যদি তার মুসলিম ভাইয়ের দোষত্রুটি গোপন করে তবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষত্রুটি গোপন রাখবেন।’[9]
আরও বলেছেন,
[اِرْحَمُوْا مَنْ فِي الْأَرْضِ يَرْحَمُكُمْ مَنْ فِي السَّمَاءَ]
‘তোমরা পৃথিবীবাসীদের প্রতি সদয় হও, আকাশবাসী (আল্লাহ) তোমাদের প্রতি সদয় হবেন।’[10]
তিনি আরও বলেছেন,
[لَيْسَ الْمُؤْمِنُ بِالَّذِيْ يَشْبَعُ وَجَارُهُ جَائِعٌ إِلٰى جَانِبِهِ]
‘ঐ ব্যক্তি মুসলিম নহে, যে পেট পুরে খায় অথচ তার পাশেই প্রতিবেশী অনাহারে কালাতিপাত করে।’[11]
আরও বলেছেন,
[سِبَابُ الْمُؤْمِنِ فُسُوْقٌ، وَقِتَالُهُ كُفْرٌ]
‘মুসলিমগণকে গালি দেয়া ফিসক (পাপ) তাদের হত্যা করা কুফুরী কাজ (অবিশ্বাসের কর্ম)।’[12]
এভাবে তিনি রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু দূরীভূত করাকে সদকা বলে গণ্য করতেন এবং এটাকে ঈমানের শাখাসমূহের মধ্যে একটি শাখা বলে গণ্য করতেন।[13]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দান-খয়রাতের ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন এবং এ সবের এমন এমন ফযীলত বর্ণনা করতেন যেদিকে মন এমনিতেই আকৃষ্ট হতো। তিনি বলতেন যে, সদকা এবং দান-খয়রাত পাপকে এমনভাবে মুছে ফেলে যে, যেমন পানি আগুনকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে ফেলে।[14]
তিনি আরো বলেছেন,
[أَيُّمَا مُسْلِمٍ كَسَا مُسْلِماً ثَوْباً عَلٰى عُرى كَسَاهُ اللهُ مِنْ خُضَرِ الْجَنَّةِ، وَأَيُّمَا مُسْلِمٍ أَطْعَمَ مُسْلِماً عَلٰى جُوْعٍ أَطْعَمَهُ اللهُ مِنْ ثِمَارِ الْجَنَّةِ، وَأَيُّمَا مُسْلِمٍ سَقٰى مُسْلِماً عَلٰى ظَمَأٍ سَقَاهُ اللهُ مِنْ الرَّحِيْقِ الْمَخْتُوْمِ]
‘‘কোন মুসলিম যদি কোন নগ্ন মুসলিমকে কাপড় পরিয়ে দেয় তা হলে আল্লাহ তাকে জান্নাতের সবুজ পোষাক পরিয়ে দিবেন এবং কোন মুসলিম যদি ক্ষুধার্ত মুসলিমকে খাদ্য খাওয়ায় তাহলে আল্লাহ তাকে জান্নাতে ফল খাওয়াবেন এবং কোন মুসলিম যদি কোন তৃষ্ণার্ত মুসলিমকে পানি পান করায় তাহলে আল্লাহ তাকে জান্নাতে মোহরকৃত পবিত্র শরাব পান করাবেন।[15] তিনি বলেছেন,
[اِتَّقُوْا النَّارَ وَلَوْ بِشَقِّ تَمَرَةٍ، فَإِنْ لَمْ تَجِدْ فَبِكَلِمَةٍ طَيِّبَةٍ]
‘‘আগুন থেকে বাঁচার চেষ্টা করো যদিও খেজুরের অর্ধাংশ দিয়েও হয়, তাও যদি না পাও তা হলে কমপক্ষে ভাল কথার দ্বারা ভিখারীকে তুষ্ট করো।[16]
অথচ ভিক্ষা বৃত্তি হতে বিরত থাকার জন্য চরমভাবে নিষেধ করেছেন, ধৈর্যধারণ এবং অল্পতে সন্তুষ্ট হওয়ার ফযীলত শুনাতেন, ভিক্ষুকগণের ভিক্ষাবৃত্তিকে তাদের মুখমণ্ডলে অাঁচড়, পাচড়ও ক্ষত আখ্যায়িত করেছেন।[17] অবশ্য সীমাতিরিক্ত নিরুপায় হয়ে যারা ভিক্ষা করে তাদেরকে এর বাইরে রেখেছেন।
কোন ইবাদতের কী ফযীলত এবং আল্লাহর নিকট তার কী সওয়াব ও পুরষ্কার রয়েছে সে সবও তিনি আলোচনা করতেন। উপরন্তু, তাঁর নিকট যে সকল আয়াত অবতীর্ণ হতো মুসলিমগণকে তার সঙ্গে শক্তভাবে জড়িয়ে রাখতেন। সেই সকল আয়াত তিনি মুসলিমগণকে পড়ে শোনাতেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে তাঁদের তা পড়ে শোনাতে বলতেন। উদ্দেশ্য ছিল এ কাজের মাধ্যমে তাঁদের মধ্যে বুঝ-সমঝ ও চিন্তাভাবনার উদ্রেক এবং দাওয়াতের যোগ্যতা, পয়গম্বরত্বের অনুভূতি ও সচেতনতার সৃষ্টি করা।
এভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুসলিমগণের সুপ্ত সম্ভাবনা সমূহের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের মাধ্যমে মানবত্বের সর্বোচ্চ স্তরে তাঁদের উন্নীত করেন এবং জাগতিক ও পারত্রিক ভাবধারার সুষ্ঠু সমন্বয় ঘটিয়ে আল্লাহর চেতনা ও ন্যায়-নীতির প্রতি নিবেদিত ও সমর্পিত এমন এক মানবগোষ্ঠির গোড়াপত্তন করেছিলেন ইতিহাসে যার কোন নজির নেই। এ মানবগোষ্ঠির মধ্যে তার সাক্ষাৎ শিষ্যদের বলা হতো সাহাবী (রাঃ)। মান-মর্যাদা এবং মানবত্বের উৎকর্ষতার ক্ষেত্রে সাহাবীগণের স্থান ছিল নাবী রাসূলগণের পরেই। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) বলেন, ‘যার অনুসরণের প্রয়োজন রয়েছে সে অতীত মানবগোষ্ঠির অনুসরণ করুক কেন না, জীবিতদের ব্যাপারে ফিৎনার ভয় রয়েছে।’
‘অতীত মানবগোষ্ঠি’ বলতে তিনি সাহাবীগণের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তাঁরা নাবী (ﷺ)-এর সঙ্গী ছিলেন। নাবী (ﷺ)-এর এই উম্মত-গোষ্ঠি ছিলেন সর্বোৎকৃষ্ট মানব, সব চাইতে পুণ্যবান, সর্বাধিক জ্ঞানী এবং সব চাইতে নিবেদিত। আল্লাহ তা‘আলা তাঁদেরকে নিজ নাবী (ﷺ)-এর বন্ধুত্ব এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার মহান-ব্রতে শরীক হওয়ার দুর্লভ সুযোগ দানে ধন্য ও সম্মানিত করেছেন। তাঁদের পদাংক অনুসরণ করে তাঁদের চরিত্রে চরিত্রবান হওয়া প্রত্যেক মুসলমানের একান্ত কর্তব্য। কারণ, তাঁরা ছিলেন হিদায়াত প্রাপ্তির উজ্জ্বলতার দৃষ্টান্ত।[18]
অন্যদিকে আবার, আমাদের পয়গম্বর রহাবারে আযম (ﷺ) সেরা পথপ্রদর্শক নিজেও এরূপ মানবিক ও আধ্যাত্মিক গুণাবলি, আল্লাহ প্রদত্ত পয়গম্বরত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ, মান-মর্যাদা মহানচরিত্র এবং সুন্দর সুন্দর কাজ-কর্মের অধিকারী ছিলেন যে, তার সংস্পর্শে এলে মন এমনিতেই তাঁর প্রতি ঝুঁকে পড়ত। ফলে তাঁর মুখ থেকে যখনই কোন কথা বের হতো তখনই সাহাবীগণ (রাঃ) তা বাস্তবায়নের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তেন। হিদায়াতের যে সকল কথা তিনি বলতেন জীবন-মরণ পণ করে সাহাবীগণ (রাঃ) তা সর্বাগ্রে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে যেতেন।
আধ্যাত্মিকতার অলৌকিক চেতনায় উজ্জীবিত প্রেরণাবোধ এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে নাবী কারীম (ﷺ) মদীনার সমাজ জীবনে এমন এক জীবনধারা প্রবর্তন করতে সক্ষম হয়েছিলেন অখন্ড মানব জাতির ইতিহাসে যা ছিল সর্বোচ্চ মানের এবং সর্বাধিক পূর্ণত্বপ্রাপ্ত। এ জীবনধারায় তিনি এমন সব নিয়মনীতি এবং আচার-আচরণ প্রবর্তন করলেন যা যুগ-যুগান্তর ধরে অব্যাহত থাকা শোষণ, শাসন ও নিষ্পেষণের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত মানব জীবনকে শান্তি, স্বস্তি ও মুক্তির আস্বাদে ভরপুর করে তুলে এ জীবনধারার উপাদানগুলোকে এমন উঁচু মানের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পূর্ণতা দান করা হয়েছিল যে, যুদ্ধ এবং শান্তি সকল অবস্থার সঙ্গেই সর্বাধিক যোগ্যতার সঙ্গে মোকাবেলা করে যে কোন পরিস্থিতির মোড় নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসার মতো যোগ্যতা মুসলিমগণ অর্জন করেছিলেন। মুসলিমগণের এহেন পরিবর্তিত জীবনধারা কিছুটা যেন আকস্মিকভাবেই ইতিহাসের মোড় পরিবর্তন করে দেয়।
[1] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৬ ও ৯ পৃঃ।
[2] তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, দারেমি, মিশকাত ১ম খন্ড ১৬৮ পৃঃ।
[3] সহীহুল মুসলিম, মিশকাত ২য় খন্ড ৪২২ পৃঃ।
[4] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৬ পৃঃ।
[5] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৬ পৃঃ।
[6] সহীহুল মুসলিম, মিশকাত ২য় খন্ড ৪২২ পৃঃ।
[7] মুত্তাফাকুন আলাইহি মিশকাত ২য় খন্ড ৪২২ পৃঃ, সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৮৯০ পৃঃ।
[8] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৮৯৬ পৃঃ।
[9] মুত্তাফাকুন আলাইহি, মিশকাত ২য় খন্ড ৪২২ পৃঃ।
[10] সুনানে আবূ দাউদ ২য় খন্ড ৩৩৫ পৃঃ, জামে তিরমিযী ২য় খন্ড ১৪ পৃঃ।
[11] বাইহাকী, শোআবুল ঈমান, মিশকাত ২য় খন্ড ৪২৪ পৃঃ।
[12] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৮৯৩ পৃঃ।
[13] মুত্তাফাকুন আলাইহি, মিশকাত ১ম খন্ড ১২ ও ১৬৭ পৃঃ।
[14] আহমাদ তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মিশকাত ১ম খন্ড ১৪ পৃঃ।
[15] সুনানে আবূ দাউদ, জামে তিরমিযী, মিশকাত ১ম খন্ড ১৬৯ পৃঃ।
[16] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ১৯০ পৃঃ ২য় খন্ড ৮৯০ পৃঃ।
[17] দ্রষ্টব্য, আবূ দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, দারেমী, মিশকাত ১ম খন্ড ১৬৩ পৃঃ।
[18] রাযীন, মিশকাত ১ম খন্ড ৩২ পৃঃ।