২.০৭ বিপুলা এ পৃথিবীর যতটুকু জানি

বিপুলা এ পৃথিবীর যতটুকু জানি
[বিনোদ বর্মণ হত্যা
সুশান্ত ধর, সহ নগরপাল, গোয়েন্দাবিভাগ। ২০০৪ সালে পেয়েছেন ভারত সরকারের ‘ইন্ডিয়ান পুলিশ মেডেল’। ২০১১ সালে সম্মানিত হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ‘প্রশংসা পদক’-এ।]

—বাবা!

নিস্তব্ধতা ভেঙে একটা আর্তচিৎকার। তারপর হাঁটু মুড়ে মাটিতেই বসে পড়ে অঝোর কান্না। পোড়খাওয়া পুলিশ অফিসাররাও থামাতে পারছিলেন না তিরিশ বছরের যুবককে। যাঁর বাবার দেহ ততক্ষণে বাইরে আনা হয়েছে মাটি খুঁড়ে। যুবক কেঁদে চলেছেন জন্মদাতার দেহ আঁকড়ে ধরে।

‘দেহ’ মানে যতটুক অবশিষ্ট রয়েছে আর। পচন ধরেছে। কাদামাটির প্রলেপ সর্বাঙ্গে। বালতি বালতি জল দিয়ে ধুয়েমুছে কিছুটা পরিষ্কার হল অবয়ব। দেখে যতটা আন্দাজ করা যায়, মৃতের বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে। হাফ প্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে। মাথার বাঁ দিকে দুটো গভীর ক্ষত। মুখ বাঁধা একটুকরো কাপড় দিয়ে। গলায় ফাঁসের দাগ স্পষ্ট। ডান হাতে উল্কিতে আঁকা ত্রিশূল। বাঁ হাতের উল্কিতে লেখা, ‘বিনোদ’।

কালীঘাট থানার বড়বাবু মোবাইল বার করেন পকেট থেকে। ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টকে এখনই জানানো দরকার। ফোনে ধরেন ওসি হোমিসাইডকে।

—স্যার, বডি রিকভার্ড হয়েছে একটা। সেমি-ডিকম্পোজ়ড। ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে। মাটির নীচে পোঁতা ছিল। গলায় ‘লিগেচার মার্ক’ আছে। হেড ইনজুরি ভিজিবল। মার্ডার।

ফোন রেখে দুটো কাজ করেন ওসি হোমিসাইড। এক, ডিডি-র ফটোগ্রাফি সেকশনে নির্দেশ, ফটোগ্রাফার যাতে যত দ্রুত পৌঁছে যায় স্পটে। দুই, ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির ডিরেক্টরকে ফোন করে ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে অনুরোধ, ‘স্যার, একটা টিম যদি তাড়াতাড়ি পাঠানো যায়, দেখুন প্লিজ়।’

পরের কাজ বলতে গোয়েন্দাপ্রধানকে খবরটা জানানো এবং দু’-তিনজন সহকর্মীকে নিয়ে তড়িঘড়ি গাড়িতে উঠে বসা। ড্রাইভার গৌতম গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে হাতঘড়ির দিকে তাকান। বিকেল চারটে। মানে,আজ বাড়ি ফিরতে ফিরতে হয়তো মাঝরাত হয়ে যাবে।

বহু বছর হয়ে গেল হোমিসাইড বিভাগের গাড়ি চালাচ্ছেন। ওসি যখন এত হন্তদন্ত হয়ে গাড়িতে উঠে বসছেন, নির্ঘাত খুন হয়েছে কোথাও। এবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে তদন্ত চলবে। লালবাজারের কর্তারা আসবেন একে একে। সন্ধে পেরিয়ে রাত গড়িয়ে যাবে। সারারাত বাড়ি ফেরা হয়নি, গাড়ি নিয়ে ছুটতে হয়েছে টালা থেকে টালিগঞ্জ, এমন যে কত হয়েছে এতদিনের চাকরিতে। কে জানে আজ কপালে কী আছে?

লালবাজারের গেট পেরিয়ে ডানদিকে টার্ন নিতে নিতে জিজ্ঞেস করেন গৌতম।

—কোথায় স্যার?

—কালীঘাট। হরিশ মুখার্জি রোড ধরো, তাড়াতাড়ি হবে। থানার কাছেই।

থানার কাছে বলেই চাঞ্চল্য আরও বেশি। গাড়ি ঢুকতেই পারল না ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে। আটকে গেল। সরু রাস্তায় জমাট ভিড় স্থানীয় মানুষের। ঠেলেঠুলে ওসি হোমিসাইডকে রাস্তা করে দিলেন কালীঘাট থানার এক কনস্টেবল, যাঁর মুখে রুমাল চাপা দেওয়া, ‘আসুন স্যার, বড়বাবু আর বাকিরা বাড়ির ভিতরে। যা দুর্গন্ধ, টেকা যাচ্ছে না।’

টেকা যে মুশকিল, গলিতে ঢুকতে ঢুকতেই টের পেয়েছিলেন ওসি হোমিসাইড। অবাক হননি। ফোনে তো জেনেইছেন, বডি সেমি-ডিকম্পোজ়ড। পচতে থাকা মনুষ্যদেহের গন্ধে অন্নপ্রাশনের ভাত মুখে উঠে আসারই কথা। বাড়ির ভিতরে ঢুকে যখন ‘বডি’-র উপর চোখ রাখলেন প্রথম, তখনও মৃতদেহের পাশে বসে আছাড়িপিছাড়ি কেঁদে চলেছেন যুবক। ফটোগ্রাফার এসে গেছেন। দেহের ছবি উঠছে বিভিন্ন দিক থেকে। শাটার টেপার ‘ক্লিক ক্লিক’ আওয়াজ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে সদ্য পিতৃহারার বিলাপে।

.

বিনোদ বর্মণ হত্যা মামলা। কালীঘাট থানা। কেস নম্বর ১৫৬, তারিখ ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০০৫। ধারা, ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ এবং ২০১। খুন এবং প্রমাণ লোপাট।

২০/৩/সি ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটের একটি তালাবন্ধ বাড়ি থেকে দুর্গন্ধ বেরচ্ছে, ফোনে খবর এসেছিল কালীঘাট থানায়। থানার খুব কাছেই ওই রাস্তা। দূরত্ব খুব বেশি হলে আড়াইশো মিটার। ওসি পৌঁছলেন দ্রুত।

একটা ছোট একতলা পাকা বাড়ি। ঢোকার মুখে লোহার গ্রিল। যাতে তিনটে তালা ঝুলছে। ঘরের মধ্যে ঢোকার দরজা গ্রিলের পিছনে। সেই দরজাতেও তালা ঝুলছে একটা। কৌতূহলী জনতা ভিড় জমিয়েছে বাড়ির সামনে।

কার বাড়ি? স্থানীয় মানুষের থেকে জানা গেল, বাড়ির মালিকের নাম বিনোদ বর্মণ। এই বাড়িটা কিনেছেন বছরের শুরুর দিকে। তবে এখানে থাকেন না। কোথায় থাকেন? কালীঘাট শ্মশানের কাছে হিউম রোডে। এক অফিসার সঙ্গে সঙ্গেই গেলেন হিউম রোডে। এবং মিনিট কুড়ির মধ্যে ফিরলেন বছর তিরিশের এক যুবককে নিয়ে। কে ইনি? রাজেশ বর্মণ, এই বাড়ির মালিক বিনোদের একমাত্র ছেলে। পেশায় অটোচালক। বাড়ির সামনে ওই ভিড়ভাট্টা আর ভিতর থেকে দুর্গন্ধের বহর দেখে দৃশ্যতই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন রাজেশ। হাত চেপে ধরেন ওসি-র।

—স্যার, বাবা গত ২৫ তারিখ বেলা ১১টা নাগাদ আমাদের হিউম রোডের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেনি। বাবা রোজ সকালে ঘণ্টাখানেকের জন্য এখানে আসত দেখভাল করতে। তারপর ব্যবসার কাজ সেরে রাতে ফিরত। সে-রাতে ফেরেনি দেখে এখানে এসেছিলাম খোঁজ করতে। তালা বন্ধ ছিল। আমরা ভাবছিলাম, হয়তো ব্যবসার জরুরি কোনও কাজে কলকাতার বাইরে গেছে। মাঝেমাঝেই যেতে হত। কিন্তু পরের দিনও যখন ফিরল না, তখন মিসিং ডায়েরি করেছি আপনাদের থানায়। রাতের দিকে। খুব ভয় করছে স্যার।

—তালাগুলোর ডুপ্লিকেট চাবি আছে আপনাদের বাড়িতে?

—না স্যার, চাবি এক সেটই ছিল। বাবা নিজের কাছে রাখত।

ওসি তাকান সঙ্গী সাব-ইনস্পেকটরের দিকে। যিনি বোঝেন, এখন কী করণীয়। তালাটা ভাঙতে হবে।

ভাঙা হল গ্রিলে লাগানো তিনটে তালা। ভিতরের দরজার তালাও। পুলিশ ঢুকল ভিতরে। দু’কামরার বাড়ি। একটা বাথরুম। আসবাবপত্র বিশেষ নেই। চেয়ার-টেবিল একটা করে, খাট একটা। যাতে সাদামাটা বেডশিট আর একটা বালিশ শুধু। বেশ বোঝা যায়, বাড়ি ফাঁকাই পড়ে থাকত। নিয়মিত বসবাস করত না কেউ। ব্যবহৃত হত না খাট-বিছানা।

গন্ধের উৎসের হদিশ ঘরে মিলল না। মিলল বাড়ির পিছন দিকে। বাউন্ডারি ওয়াল আর ঘরের গাঁথনির মাঝে একফালি লম্বা জায়গায়। যার একটা অংশে মাটি আলগা হয়ে আছে। উপরে থিকথিক করছে পোকা।

খোঁড়ার ব্যবস্থা করতে আধঘণ্টার মতো লাগল। মাটি কাটার লোক ডাকা হল। জোগাড় হল কোদাল-শাবল-ঝুড়ি। মাটি একটু খুঁড়তেই বেরল এক পুরুষের মৃতদেহ। কাদামাটি মাখা সারা শরীরে। পলকের দেখাতেই চিনলেন রাজেশ। দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়লেন মাটিতে।

—বাবা!

ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা এলেন। খুঁটিয়ে দেখলেন সব। জানালেন, যা বোঝা যাচ্ছিল সাদা চোখেও। খুনি বা খুনিরা গর্ত যেটা খুঁড়েছিল, সেটা গন্ধ ঢাকা দেওয়ার মতো গভীর ছিল না। আড়াই ফুট বাই ছয়-সাত ফুটের মতো খুঁড়ে মৃতদেহ শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপর মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিল আলগা ভাবে, তাড়াহুড়োয়। প্রমাণ লোপাটের কাজটা মোটেই পরিপাটি হয়নি। গর্তটা যদি আরও বেশ কিছুটা গভীরে খোঁড়া হত লম্বায়-চওড়ায়, সময় নিয়ে উপরে পর্যাপ্ত মাটি চাপা দেওয়া হত, পচনশীল দেহের গন্ধ এভাবে ছিটকে আসত না বাইরে। পচেগলে মাটির সঙ্গে মিশে গিয়ে একটা সময়ের পর পড়ে থাকত হাড়গোড়।

অপরাধের ঘটনাস্থল আদ্যোপান্ত খুঁটিয়ে দেখাটা তদন্তের গোড়ার কথা। সবাই জানে। তবে ওই গোড়ার রুটিনমাফিক কাজটায় এতটুকু ঢিলে দেওয়ার বিলাসিতা দেখানো যায় না। দেখালে ভুগতে হয় চার্জশিট দেওয়ার সময়। অপরাধের কিনারা করে ফেলেও হিমশিম খেতে হয় প্রমাণ জোগাড়ে। যে প্রমাণ হয়তো নাগালের মধ্যেই থাকত, ‘প্লেস অফ অকারেন্স’-এর তল্লাশিতে আরও বেশি মনোযোগী হলে।

মনোযোগে খামতি রাখল না পুলিশ। সন্ধে হয়ে গেছে। ড্রাগন লাইট নিয়ে ওসি হোমিসাইড আঁতিপাঁতি তল্লাশি শুরু করলেন বাড়ির। ‘কষ্ট করলে কেষ্ট’ বলতে মিলল একটা প্লাস্টিকের বোতাম। গর্ত যেখানে খোঁড়া হয়েছিল, তার ফুট দশেক দূরে। মৃতের শার্ট ছিঁড়ে গিয়ে ছিটকে পড়েছিল? খুনি বা খুনিদের সঙ্গে ধস্তাধস্তির সময়? বোতাম ছাড়াও সংগ্রহ করা হল ঘরের দেওয়ালে ছোপ ছোপ বাদামি দাগের স্যাম্পল। নিশ্চয়ই শুকিয়ে যাওয়া রক্ত?

সময় লাগল তল্লাশি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হতে। বিনোদ বর্মণের দেহ যখন বেরল মোমিনপুরের কাঁটাপুকুর মর্গের উদ্দেশে, রাত গড়িয়ে প্রায় সাড়ে এগারোটা। ইতিমধ্যে গোয়েন্দাপ্রধান এবং ডিসি সাউথ ঘুরে গেছেন অকুস্থল। ফোনে সব জানানো হয়েছে নগরপালকে। যিনি পত্রপাঠ কেসের তদন্তের ভার দিয়েছেন গোয়েন্দা বিভাগকে। রহস্যভেদের দায়িত্ব পেয়েছেন হোমিসাইড বিভাগের তৎকালীন সাব-ইনস্পেকটর সুশান্ত ধর (বর্তমানে গোয়েন্দা বিভাগেরই অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার হিসাবে কর্মরত), যিনি লালবাজার থেকে কালীঘাট আসার পথে সঙ্গী হয়েছিলেন ওসি হোমিসাইডের।

ময়নাতদন্ত হতে হতে পরের দিন দুপুর গড়িয়ে গেল। এই জাতীয় খুনের মামলায় অনেক ক্ষেত্রেই পোস্টমর্টেমের সময় তদন্তকারী অফিসার নিজেই উপস্থিত থাকেন। সুশান্তও ছিলেন। ময়নাতদন্ত জানাল, মাথায় কোনও ভারী জিনিসের আঘাতে খুন, ‘ante-mortem and homicidal’। এটুকু অনুমেয়ই ছিল। বাড়তি যেটা ডাক্তারবাবু বললেন, সেটাও মৃতদেহ আবিষ্কারের সময়ই আন্দাজ করা গিয়েছিল। এই খুনে ‘খুনি’ নয়, ‘খুনিরা’ যুক্ত। মৃত বিনোদের শারীরিক গঠন ছিল যথেষ্ট মজবুত। তাঁকে কাবু করে, নিশ্বাস বন্ধ করে মারার পর গর্ত খুঁড়ে পুঁতে দেওয়া, একার পক্ষে প্রায় অসম্ভবই।

কখন হয়েছিল খুনটা? দ্বিধাহীন জানালেন ডাক্তারবাবু, ২৫ তারিখ সকাল সাড়ে দশটা থেকে দুপুর দুটোর মধ্যে। দেহ উদ্ধার হয়েছিল ২৯ তারিখ বিকেলে। বিনোদকে খুন করা হয়েছিল তার প্রায় ৯৬ ঘণ্টা আগে!

খুনিদের সন্ধান শুরু করলেন সুশান্ত। বিকেল থেকে প্রায় মাঝরাত, কালীঘাট থানা এলাকায় ঘাঁটি গেড়ে পড়ে থাকলেন। বিনোদের পরিবারের লোকজন, স্থানীয় মানুষ এবং ওই অঞ্চলের পরিচিত সোর্সদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে যা তথ্য সংগ্রহ করলেন, সংক্ষেপে এরকম।

বর্মণ পরিবার আদতে বিহারের। কিন্তু প্রায় চার পুরুষ ধরে বসবাস কলকাতায়। কালীঘাটের ২, হিউম রোডের বাড়িতে। সোনারুপোর গয়নার পারিবারিক ব্যবসা ছিল বর্মণদের। বিনোদ বর্মণরা ছিলেন ছ’ভাই। বিনোদ সবার বড়। ব্যবসার দেখাশোনার পাশাপাশি কাজ করতেন ব্রিটানিয়া কোম্পানিতে। ২০০৩ সালে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর পুরোপুরি মনোনিবেশ করেছিলেন ব্যবসায়।

মেজোভাই দিলীপ মারা গেছেন। সেজো ঘনশ্যাম তিরিশ বছর আগে বিবাগী হয়ে নিরুদ্দেশ। চতুর্থ ভাই অশোকের ব্যবসায়িক বুদ্ধির কিছু অভাব ছিল। স্বতন্ত্র দায়িত্ব নিতে গিয়ে প্রচুর টাকা লোকসান করেছিলেন। বিনোদকে সাহায্য করতেন ব্যবসার টুকিটাকি কাজে। কিন্তু ইদানীং সেটুকুও করতে পারতেন না ঘনঘন অসুস্থ হয়ে পড়ায়। পঞ্চম ভাইয়ের নাম প্রদীপ। ব্যবসার কাজে যে শ্রম এবং মনোযোগ প্রয়োজন, দুটোর কোনওটাই আয়ত্ত করে উঠতে পারেননি প্রদীপ। হাল ছেড়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত দিন গুজরান বাস্তুহারা বাজারে মাছ কেটে। ছোটভাই স্বপন জন্ম থেকেই বিকলাঙ্গ।

অসুস্থ বৃদ্ধা মা গোদাবরী দেবী মারা গিয়েছিলেন এই মাসের শুরুতেই। মা এবং বিকলাঙ্গ ছোটভাই স্বপনের চিকিৎসার সমস্ত খরচ বহন করতেন বিনোদই। ভাইদের মধ্যে আর্থিক সচ্ছলতা শুধু তাঁরই ছিল। প্রদীপ-অশোকের সংসারেও টানাটানি হত যখন, বড়দা বিনোদই ছিলেন সহায়।

বিনোদের স্ত্রী বেশ কয়েক বছর যাবৎ মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত। চিকিৎসা চললেও উন্নতি হয়নি বিশেষ। একমাত্র পুত্র রাজেশ ব্যবসার হাল ধরুন, আপ্রাণ চেয়েছিলেন বিনোদ। সে চাওয়া পূর্ণ হয়নি। ব্যবসার কাজে নিয়মিত সময় দেওয়ায় তীব্র অনীহা ছিল রাজেশের। বরং প্রবল উৎসাহ ছিল ব্যবসার টাকা মদ-মাংস-মোচ্ছবে উৎসর্গ করায়। শেষমেশ সমস্ত ব্যবসায়িক দায়দায়িত্ব থেকে বাধ্য হয়েই রাজেশকে অব্যাহতি দেন বিনোদ। মাসে মাসে রাজেশের জন্য নামমাত্র হাতখরচ বরাদ্দ করেছিলেন। অগত্যা রাজেশ শুরু করেন অটো চালানো। বিয়ে করেছেন বছরদুয়েক আগে। এখনও নিঃসন্তান।

বিনোদের বন্ধুমহলে কারা ছিলেন? দুটো নাম পেলেন সুশান্ত, যাদের সঙ্গে বিনোদের বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল। মন্টু দাস এবং প্রবাল দস্তিদার। দু’জনেই বিনোদের সমবয়সি, বয়স ষাট ছুঁইছুঁই। দু’জনেই কালীঘাটে বিনোদের পাড়ারই বাসিন্দা বহু বছর ধরে।

মন্টুবাবু পটুয়াপাড়ায় মূর্তি গড়ার কাজ করেন। কালীঘাটে মায়ের মন্দিরে প্রায় নিত্য যাতায়াত। প্রবালের কালীঘাট মার্কেটে একটা জামাকাপড়ের দোকান আছে ছোট।

মন্টু-প্রবালের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে একটা তথ্য পাওয়া গেল। বিনোদের নারীবিষয়ে স্বাভাবিকের বেশিই দুর্বলতা ছিল। স্ত্রী মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে যে দুর্বলতা বেড়েছিল উত্তরোত্তর। নিষিদ্ধ পল্লিতে যাতায়াত ছিল নিয়মিত। দুই আবাল্য বন্ধুর কাছে কিছুই অজানা ছিল না।

ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে যে বাড়িটা বিনোদ বছরের শুরুতে কিনেছিলেন, তার লাগোয়া বাড়িতে বাস রীতা নস্কর নামের এক বছর চল্লিশের মহিলার। যাঁর স্বামী মারা গেছেন বছর পাঁচেক হল। এক ছেলে, হস্টেলে থেকে পড়াশুনো করে, ক্লাস নাইনে। এই রীতার সঙ্গে বিনোদের সম্পর্ক নিয়ে পাড়ায় নাকি কানাঘুষো হচ্ছিল ইদানীং। বিনোদ-রীতাকে নাকি একসঙ্গে স্থানীয় সিনেমাহলে দেখা গিয়েছিল বেশ কয়েকবার, এমন কথাও রটেছিল পাড়ায়।

রীতাকে সেদিন জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারলেন না সুশান্ত। ছেলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন হস্টেলে। পরের দিন সকালের ট্রেনে কলকাতায় ফেরার কথা।

.

১ অক্টোবর, সকাল এগারোটা। লালবাজার।

অফিসে এসেই সোজা ওসি হোমিসাইডের ঘরে ঢোকেন সুশান্ত। তদন্তে এখনও পর্যন্ত যা যা তথ্য এসেছে হাতে, জানাবেন। আলোচনাও প্রয়োজন, কী কী ভাবে এগোনো যায়, সে নিয়ে।

—স্যার, পরিচিত লোকজন হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। বিনোদ যে রোজ সকালে ওই সময় ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটের বাড়িতে যেতেন, জানত খুনিরা।

—হুঁ, অ্যাপারেন্টলি তাই মনে হচ্ছে। একেবারে অচেনা-অজানা কেউ দিনের বেলায় এসে ঘরে ঢুকে মেরে পুঁতে দিয়ে যাবে, এটা হাইলি আনলাইকলি। আচ্ছা, ও রাস্তায় তো মোটামুটি মানুষজনের ভিড় লেগেই থাকে। কেউ কিছু দেখেনি? আই মিন, কাউকে ঢুকতে ও-বাড়িতে?

—দেখার তো কথা। তবে খোঁজখবর করার সময়ও তো বিশেষ পাইনি। গতকাল বিকেল থেকে রাত তো বেসিক ইনফর্মেশন নিতেই কেটে গেল।

—সোর্স?

—লাগিয়েছি স্যার। কাল-পরশুর মধ্যে কিছু না কিছু খবর আসবেই।

—আচ্ছা, ধরেই নেওয়া যাক, পরিচিতরা মেরেছে। কারা হতে পারে, ভেবেছ কিছু? মানে, প্রিলিমিনারি আইডিয়া কোনও?

—দেখুন স্যার, একদিনে তো সবটা জানা হয়ে ওঠেনি। পরিচিতির বৃত্তে কারা কারা ছিলেন, ব্যবসায়িক শত্রুতা কিছু ছিল কিনা, সেসব ডিটেলে জানতে আরও দিনদুয়েক তো লাগবেই। তবে যাঁদের কথা এখন পর্যন্ত জানা গেছে, তাঁরা কেউই সন্দেহের বাইরে নয়। মোটিভ সকলেরই ছিল অল্পবিস্তর।

—যেমন?

—ধরুন স্যার, রাজেশ। ব্যবসা থেকে একরকম তাড়িয়েই দিয়েছিল বাবা। অটো চালিয়ে আর ক’পয়সা হয়? নেশার ঠেকে প্রায়ই দেখা যায়, সোর্স ইনফর্মেশন। টাকার দরকার ছিল। মোটিভ? বাবাকে মেরে ব্যবসার দখল নেওয়া। মিসিং ডায়েরিটা স্রেফ আমাদের মিসলিড করতে। আর ওই আকুলিবিকুলি কান্নাটা স্রেফ নাটক।

—হুঁ…

—আবার একই কারণে দুই ভাই অশোক আর প্রদীপকেও সন্দেহের তালিকার বাইরে রাখা যায় না। ওদের আর্থিক অবস্থাও ভাল ছিল না। তার উপর দাদার এই রমরমা।

—হ্যাঁ, কিন্তু যদি উইল-টুইল বিনোদ না করে গিয়ে থাকেন, লেখাপড়া যদি কিছু না থাকে, বিনোদের মৃত্যুর পর তো ব্যবসার দখল নিয়ে রাজেশ আর ওর কাকাদের মধ্যে ঝামেলা লাগবে।

—আমি এই পয়েন্টেই আসছিলাম স্যার। এমন হওয়াও অস্বাভাবিক নয় যে রাজেশ আর তার দুই কাকা মিলেই বিনোদকে মেরেছে। আফটার অল, কাজটা কারও একার নয়। খুনটা যে একাধিক লোক মিলে করেছে, সেটা তো পরিষ্কার।

—হুঁ, অসম্ভব নয়। আর রীতা? বা বন্ধু যে দু’জনের কথা বললে, মন্টু, আর কী যেন নাম অন্যজনের?

—প্রবাল। দুই বন্ধু মিলেও করতেই পারে। কিন্তু মোটিভ তো কিছু দেখছি না। ছোটবেলার বন্ধুকে মারতে যাবে কেন হঠাৎ? আর রীতা নস্করের সঙ্গে তো এখনও কথাই বলা গেল না। আজ বলব।

—হ্যাঁ, শুধু রীতা নন, সকলের সঙ্গেই আর একবার ডিটেলে কথা বলো আজ, সময় নিয়ে। থানাতেই ডেকে নাও বিকেলের দিকে।

—রাইট স্যার।

—আর হ্যাঁ, রাজেশ এবং অন্য যাঁদের কথা বললে, মোবাইল রেকর্ডস পেয়েছ? ভিক্টিমেরটা?

—রিকুইজিশন কাল সন্ধেবেলায়ই পাঠিয়ে দিয়েছি। শেষ তিন মাসের চেয়েছি। আজ সন্ধের মধ্যে ডেফিনিটলি পেয়ে যাব।

—হ্যাঁ, ওটা থেকে ‘লিড’ কিছু একটা পাওয়া উচিত। আর না পেলেও কয়েকজনকে ‘এলিমিনেট’ অন্তত করতে পারবে সাসপেক্টদের লিস্ট থেকে।

.

১ অক্টোবর, কালীঘাট থানা। বিকেল সাড়ে চারটে।

থানায় উপস্থিত বর্মণ পরিবারের তিন সদস্য রাজেশ-অশোক-প্রদীপ, দুই বাল্যবন্ধু মন্টু দাস-প্রবাল দস্তিদার, এবং প্রতিবেশিনী রীতা নস্কর। সুশান্ত থানায় চলে এসেছেন সোয়া চারটেয়। এঁদের প্রত্যেকের ব্যাকগ্রাউন্ডের ব্যাপারে আরও অনেক খোঁজখবর নেওয়ার আছে। প্রত্যেকের গতিবিধির উপর নজর রাখাও প্রয়োজন। সেসব করাই যাবে। মোবাইল রেকর্ডস এসে যাবে সন্ধের মধ্যে। কোনও অসংগতি পেলে চেপে ধরতে আর কতক্ষণ? এক রীতা ছাড়া প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ এঁদের সবারই হয়ে গেছে। তবু আরও একবার বাজিয়ে নেওয়া দরকার সবাইকে। এবং এই ‘বাজিয়ে নেওয়া’-র কাজটা একটু অন্যভাবে করবেন, ঠিক করলেন সুশান্ত। শুরু হল দ্বিতীয় দফার জেরা।

জেরা নিয়ে কিছু কথা প্রাসঙ্গিক এখানে। বাস্তবের তদন্তের অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে, তাঁদের যে কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন, জেরা বা জিজ্ঞাসাবাদ হল পৃথিবীর নীরসতম কাজগুলোর একটা। অন্তত তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে তো বটেই। শুরুর দিকে সন্দেহের পরিধি থাকে বিস্তৃত। নাম কী, বাবার নাম কী, বাড়ি কোথায়, কে কে আছে বাড়িতে, কী করেন, আগে কী করতেন… এমন গুচ্ছের কেজো প্রশ্নের মাধ্যমে সংগ্রহ তৈরি করতে হয় তথ্যভাণ্ডার। নীরস, কিন্তু জরুরি। ওটাই ভিত, ওটাই বুনিয়াদ। যার উপর বাড়ি উঠবে।

জেরার পদ্ধতি বা ‘Interrogation techniques’ নিয়ে প্রচুর তত্ত্ব আছে অপরাধবিজ্ঞানে। ১৯৭৪ সালে John E. Reid প্রবর্তিত ‘Reid Technique’ একসময় প্রবল সমাদৃত ছিল তদন্তকারীদের কাছে। বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। Reid-এর তত্ত্বের নির্যাস হল, জেরায় যত বেশি সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করো। তারপর অপরাধের ধরন এবং সন্দেহভাজনদের সঙ্গে সেই তথ্যের যোগসূত্র স্থাপন করো জিজ্ঞাসাবাদে।

কীভাবে? প্রত্যেক সন্দেহভাজনের জীবনধারা এবং চরিত্রবৈশিষ্ট্যের একটা ছবি এঁকে ফেলো মনে মনে। অমুকের আর্থ-সামাজিক অবস্থা কেমন, পারিবারিক জীবনই বা কেমন, কর্মজীবনে কতটা অস্থিরতা, প্রাথমিক প্রশ্নোত্তরে শরীরী ভাষায় কোনও উদ্বেগ ধরা পড়েছে কিনা, চিন্তিত হয়ে পড়লে কোনও মুদ্রাদোষ চোখে পড়ে কিনা, সব মগজে ‘স্টোর’ করে রাখো। সামগ্রিক ভাবে একটা নির্দিষ্ট ধারণা তৈরি করো, যাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, তার ব্যাপারে। সেই ধারণার ভিত্তিতে পরের পর্যায়ে প্রশ্নমালার গতিপথ নির্ধারণ করো। সে প্রশ্ন কখনও হোক আন্তরিক এবং তথ্যমূলক, কখনও ব্যক্তিবিশেষে হোক প্ররোচনামূলক। প্রতিক্রিয়া লক্ষ করো গভীর মনোযোগে এবং অপেক্ষায় থাকো উত্তরের অসংগতির। পরিভাষায়, ‘factual analysis’ আর ‘behaviour analysis’।

Reid-এর তত্ত্ব নিয়ে বিতর্কও আছে। পালটা তত্ত্ব আছে। অনেকে মনে করেন, এ ভাবে অপরাধীর থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের পদ্ধতি ‘থিয়োরি’ হিসাবে শুনতে ভাল। তবে বাস্তবে কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ আছে। সংশয় আছে ব্যবহারের বা শরীরী ভাষার তারতম্যের ভিত্তিতে ধারণা তৈরির বিষয়ে। পুলিশের প্রশ্নের মুখে পড়ে সম্পূর্ণ নিরপরাধ মানুষও নার্ভাস হয়ে যেতেই পারেন। হাতের তালু ঘেমে উঠতে পারে। পাল্‌স রেট বেড়ে যেতে পারে। অস্বাভাবিক কিছু নয়। আকছার হয়ে থাকে, দেখেছি আমরা। জেরার সময় ব্যবহারের পরিবর্তনের উপর মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপের পক্ষপাতী নন Reid Technique-এর বিরোধীরা। Reid-এর পদ্ধতিতে তত্ত্বের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য নিয়ে বরাবর আপত্তি জানিয়ে এসেছেন অপরাধবিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশ।

আপত্তিটা কিন্তু উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে, জিজ্ঞাসাবাদকে তত্ত্বের ঘেরাটোপে বন্দি করে ফেললে ফল মেলে না অনেক ক্ষেত্রেই। কোন ক্ষেত্রে কোন স্ট্র্যাটেজি কাজ করবে, বলা মুশকিল। জেরা করতে করতেই অনেক ক্ষেত্রে তদন্তকারীকে পদ্ধতি বদলে ফেলতে হয় পরিস্থিতির বিচারে। ব্যাকরণসিদ্ধ প্রথার পরোয়া করলে চলে না তখন।

যেমন ধরুন, বহুপ্রচলিত ‘Good cop, Bad cop’ টেকনিক। সন্দেহভাজনকে যদি কিছুটা আবেগপ্রবণ মনে হয়, এই পদ্ধতিতে কাজ হয় বেশি। ‘Bad cop’ অর্থাৎ ‘খারাপ পুলিশ’ ইচ্ছাকৃত ভাবে রূঢ় ভাষায় জেরা করে সন্দেহভাজনকে মানসিক ভাবে দুমড়ে দিলেন। আর কিছুক্ষণের বিরতির পর ‘Good cop’ অর্থাৎ ‘ভাল পুলিশ’ এসে পিঠে সহানুভূতির হাত রাখলেন, ‘আগের জনের কথায় কিছু মনে করবেন না প্লিজ়। নিন, জল খান। আপনি কী অসহনীয় পরিস্থিতিতে ক্রাইমটা করতে বাধ্য হয়েছেন, আমি বুঝি। আপনার জায়গায় থাকলে আমিও একই জিনিস করতাম। কিছু বলতে হবে না এখন আপনাকে। যখন ইচ্ছে হয়, বলবেন। না ইচ্ছে হলে বলবেন না।’

এই পন্থায় অভাবিত কাজ দেয় কখনও কখনও। বাবা খুব বকাবকি করার পর মা পিঠে হাত রেখে আদর করে দিলে, বা উলটোটা হলে, বাচ্চারা যেমন হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে কাঙ্ক্ষিত সহানুভূতির ছোঁয়ায়, এ অনেকটা তেমন। ‘Good cop’-এর কাছে স্বতঃস্ফূর্ত স্বীকারোক্তি আসে অপরাধের।

উদাহরণ আরও অনেক দেওয়া যায়। মোদ্দা কথা হল, তত্ত্বসর্বস্বতায় আটকে থাকতে নেই তদন্তকারীকে। টেকনিকের জন্য খেলা নয়। খেলার জন্যই টেকনিক। যে টেকনিকে যখন যেভাবে রান আসতে পারে, সেটাই তখন সেখানে ব্যাটসম্যানের সেরা টেকনিক। সে ব্যাটিং-ম্যানুয়াল যা-ই বলুক না কেন।

সুশান্ত জেরা শুরু করলেন ব্যাকরণের তোয়াক্কা না করেই। প্রথম থেকেই চালু করে দিলেন ‘শক থেরাপি’। মনস্তাত্ত্বিক ‘শক’, আচমকা ঝটকা। কথা নেই বার্তা নেই, শুরুতেই সবাইকে সরাসরি কাঠগড়ায় তোলা হতভম্ব-হতচকিত করে দিয়ে। এবং যাচাই করে নেওয়া বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের প্রতিক্রিয়া।

বাড়ি ফেরার কিছুটা তাড়াও ছিল সুশান্তর। সন্ধে হয়ে যাবে একটু পরেই। বৃষ্টি শুরু হয়েছে আকাশ ভেঙে। থামার ন্যূনতম লক্ষণ নেই। রাত্রে যাদবপুরে এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের ছেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠান। একবার না গেলেই নয়। বুড়ি ছুঁয়ে আসাই, তবু একবার মুখ দেখাতেই হবে, সে যত রাতই হোক। এমনিতেই পুলিশ মহলে একটা রসিকতা চালু আছে, ‘পুলিশের শনিবার নেই, রবিবার নেই, পরিবার নেই।’ আজকের নেমন্তন্নটায় না গেলে সত্যিই ‘পরিবার’ থাকার সম্ভাবনা কম। বাড়িতে সবাই অপেক্ষা করে আছে, সুশান্ত ফিরলে একসঙ্গে যাওয়া হবে। কিন্তু এ যা বৃষ্টি শুরু হয়েছে, সময়মতো বেরতে পারলে হয়। বিরক্ত লাগে সুশান্তর, দ্রুত শুরু করেন রাজেশকে দিয়ে।

—ভাই, আপনি কিন্তু আগাগোড়া একটা কথা মিথ্যে বলেছেন।

হকচকিয়ে যান রাজেশ।

—আমি? কী স্যার?

—একটা ম্যাটাডোর কেনার টাকা চেয়েছিলেন বাবার কাছে। বিনোদবাবু দেননি। বলেছিলেন, ‘তোকে টাকা দেওয়া মানে জলে দেওয়া। মদ খেয়ে উড়িয়ে দিবি দু’দিনে।’ চেতলার জুয়ার ঠেকে এ নিয়ে তো পরদিন বাবাকে প্রচুর গালমন্দ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘দেখে নেব বুড়োকে!’

—ভুল খবর স্যার, ডাহা মিথ্যে!

—মোটেই মিথ্যে নয়! আপনি যান না চেতলা লক গেটের পাশের ঠেকে প্রতি রাত্রে?

রাজেশ আমতা আমতা করতে থাকেন এবার।

—যাই স্যার। অনেকেই যায়। কিন্তু বিশ্বাস করুন, বাবার কাছে টাকাও চাইনি আর ওসব বলিওনি ঠেকে। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখুন স্যার।

—খোঁজ না নিয়ে কী আর বলছি? বাবাকে মেরে বাড়িটা হাতানোর মতলব করেছিলেন কিছু গুন্ডা-বদমাইশদের নিয়ে। ভুল বলছি?

রাজেশ রেগে যান হঠাৎ।

—হ্যাঁ স্যার, ভুল বলছেন। একশোবার ভুল বলছেন। হাজারবার ভুল বলছেন। আমি মরে গেলেও নিজের বাবাকে খুন করার কথা ভাবতেই পারব না। কী প্রমাণ আছে আপনাদের কাছে? যা খুশি বলে যাবেন, আর মেনে নিতে হবে?

সুশান্ত শোনেন চুপচাপ। সত্যিই, প্রমাণ তো কিছু নেই। এ তো স্রেফ আন্দাজে ঢিল ছোড়া চলছে। লাগলে তুক, না লাগলে তাক। মুখে অবশ্য বুঝতে দেন না রাজেশকে।

—কী প্রমাণ আছে, ঠিক সময়ে বলব। আমরা তো আর ঘাসে মুখ দিয়ে চলি না। কাল দুপুরের দিকে খবর পাঠাব। লালবাজারে চলে আসবেন।

রাজেশের চোখে আতঙ্কের ছায়া পড়ে।

—লালবাজারে কেন স্যার?

সুশান্ত থেমে থেমে উত্তরটা দেন, সময় নিয়ে।

—আসলে কী জানেন, থানায় বসে ঠিক হয় না। দেখছেন তো, কত লোক কত সমস্যা নিয়ে আসছে যাচ্ছে। এখানে ঠিক হয় না ব্যাপারটা। লালবাজারে আলাদা ঘর আছে জেরা করার। কাল আসুন, বুঝতে পারবেন। নিশ্চিন্ত থাকুন, যত্নআত্তির কোনও ত্রুটি হবে না।

রাজেশের আতঙ্ক দৃশ্যতই আরও গাঢ় হয়। লালবাজারে যত্নআত্তি মানে? পাশে বসে থাকা মন্টুবাবুর হাত চেপে ধরেন রাজেশ।

—মন্টুকাকু, স্যাররা ভাবছেন আমি বাবাকে মেরেছি। আমি কেন নিজের বাবাকে মারতে যাব? তুমি তো আমাকে ছোট থেকে দেখেছ। তোমার মনে হয়, আমি বাবাকে মারতে পারি? তুমি বলো স্যারকে …

মন্টু সত্যিই রাজেশকে জন্মাতে দেখেছেন, বিনোদের সঙ্গে প্রায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছরের অভিন্নহৃদয় বন্ধুত্ব। পিঠে হাত রাখেন পুত্রসম রাজেশের, তাকান সুশান্তর দিকে।

—স্যার, জানি না কী প্রমাণ পেয়েছেন আপনারা। তবে এটুকু বলতে পারি, আর যাই করুক, খুন করার ছেলে রাজেশ নয়। বিশ্বাস করুন।

সুশান্ত সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেন মন্টুকে। তাকান রীতার দিকে।

—কিছু মনে করবেন না রীতাদেবী, আপনার সঙ্গে বিনোদবাবুর সম্পর্ক ঠিক কেমন ছিল?

মহিলা এ প্রশ্ন আশা করেননি। অবাক দৃষ্টিতে তাকান।

—কেমন সম্পর্ক মানে?

—মানে আর নতুন করে কী বোঝাব? আপনিও বুঝছেন, কী বলতে চাইছি। বিনোদবাবুর সঙ্গে আপনার অবৈধ সম্পর্কের কথা বলছি। বাধ্য হয়েই বলছি।

—এসব কী বলছেন স্যার!

—আপনার অজানা কিছু বলছি কি? আর না জেনে এ ধরনের কথা বলবই বা কেন? বিনোদ যখন ঈশ্বর গাঙ্গুলির বাড়িতে যেতেন রোজ, মাঝেমাঝে আপনি যেতেন না দুপুরের দিকে? কেন যেতেন? ওঁর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বাড়িটা নিজের নামে লিখিয়ে নিতে জোর করতেন না? একটা শব্দও মিথ্যে এর?

রীতা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন সুশান্তর দিকে। তারপর কেঁদেই ফেলেন প্রায়।

—এ আপনি কী বলছেন স্যার? বিনোদদার সঙ্গে দাদা-বোনের সম্পর্ক ছিল। ওঁর বাড়িতে যাইই নি কোনওদিন। উনিই বরং গত ভাইফোঁটায় আমার বাড়িতে এসে ফোঁটা নিয়ে গেছেন। রাস্তাঘাটে দেখা হলে দু’-একটা কথা হত। আলাপ ছিল। এইটুকুই। খোঁজ নিয়ে দেখুন না পাড়ায়, সেলাই করে সংসার চালাই। মিথ্যে স্যার, আপনাকে যে এসব খবর দিয়েছে, মিথ্যে বলেছে। ডাকুন না একবার আমার সামনে…

—সময় হলেই ডাকব। যাক গে, বৃষ্টি থামলে বাড়ি যেতে পারেন। আরও কিছু জিজ্ঞেস করার আছে। কাল বিকেলের দিকে আপনাকেও একবার লালবাজার আসতে হতে পারে। থানা জানিয়ে দেবে, কখন।

রীতার মুখ থেকে কথা বেরয় না। চেয়ারেই বসে থাকেন। যেন নড়াচড়ারও ক্ষমতা হারিয়েছেন।

সুশান্ত দেখেও দেখেন না। ঘড়িতে চোখ বুলোন। পৌনে ছ’টা। দেরি হয়ে যাচ্ছে। মন্টু-প্রবাল-অশোক-প্রদীপ এখনও বাকি। তাড়াতাড়ি সেরে বেরতে হবে এবার। বৃষ্টিটা ধরে এসেছে একটু। থামেনি, তবে আগের মতো মুষলধার চোখরাঙানি নেই।

—মন্টুবাবু, কী কী কারণে আপনি বাল্যবন্ধু বিনোদকে খুন করতে পারেন বলবেন একটু…

কথা জোগায় না স্তম্ভিত প্রৌঢ়র মুখে। সুশান্ত আবার জিজ্ঞেস করেন।

—বলুন মন্টুবাবু… কেন মারলেন বিনোদবাবুকে? ছোটবেলার বন্ধুকে এভাবে মারতে হাত কাঁপল না? আপনার তো নরকে ঠাঁই হওয়াও মুশকিল …

মন্টুকে আক্ষরিক অর্থেই বাক্‌রুদ্ধ দেখায়।

—স্যার, আমি ছাপোষা মানুষ। কালীঘাট মন্দিরে পাঁঠাবলি দিই, পটুয়াপাড়ায় মূর্তি বানাই। গায়ক অমৃক সিং অরোরার নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন স্যার? ওঁর বাড়ির কালীপুজোয় আমিই মূর্তি বানাই বহু বছর হল। জিজ্ঞেস করে দেখবেন আমার ব্যাপারে। আমি খুন করব বিনোদকে?

—সে না হয় জিজ্ঞেস করব। আর আপনি যদি না-ও মেরে থাকেন, আর কে মারতে পারে আপনার বন্ধুকে? কী মনে হয়?

বিহ্বল মন্টু হাতজোড় করে ফেলেন এবার। চশমা খুলে চোখ মোছেন।

—কী বলব স্যার? বিনোদের তো কোনও শত্রু ছিল না। নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ ছিল।

সুশান্তর হঠাৎই চোখ চলে যায় করজোড় মন্টুর বাঁ হাতের দিকে। লাল ছোপ একটা বুড়ো আঙুলে।

ইনস্টিংক্ট। ইংরেজি শব্দ। কী বাংলা হয়? সহজাত প্রবৃত্তি? আগাথা ক্রিস্টির ‘The Mysterious Affair at Styles’ উপন্যাসে অদ্বিতীয় Hercule Poirot এক জায়গায় বলছেন, ‘Instinct is a marvellous thing. It can neither be explained, nor can be ignored.’ সহজাত প্রবৃত্তি এক আশ্চর্য বস্তু। ব্যাখ্যাও করা যায় না, উপেক্ষাও না।

জিজ্ঞাসাবাদের সময় সন্দেহভাজনের শরীরের প্রতিটি নড়াচড়া শ্যেনদৃষ্টিতে লক্ষ করা যে-কোনও বুদ্ধিমান তদন্তকারীর সহজাত প্রবৃত্তি, স্বাভাবিক ইনস্টিংক্ট। যেটা অভাবিত ভাবে কাজে লেগে গেল সুশান্তর।

—ওটা কীসের দাগ মন্টুবাবু? লাল দাগটা?

মন্টুকে সামান্য অপ্রস্তুত দেখায়, সামলে নেন পরমুহূর্তেই।

—মূর্তি গড়ি তো, রং লেগে যায়, লেগে গেছে অসাবধানে।

সুশান্ত উঠলেন চেয়ার ছেড়ে। মন্টুবাবুর বাঁ হাতটা ধরে লাল ছোপটা দেখলেন মিনিটখানেক। স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন চোখাচোখি।

—মিথ্যে বলছেন কেন? এটা মূর্তির রং নয়। এটা তো লাল ওষুধ, মারকিউরোক্রোম।

মন্টুবাবু ফ্যালফ্যাল করে তাকান সুশান্তর দিকে। তোতলাতে থাকেন হঠাৎ।

—পাঁঠা কাটি তো… রক্ত ছিটকে বোধহয়…

সুশান্ত শোনেন, এবং আগ্রাসী আক্রমণে যান নিমেষে। লোভনীয় ফ্লাইটেড ডেলিভারিতে ঠিক যেভাবে স্টেপ আউট করে ব্যাটসম্যান।

—একবার বলছেন মূর্তির রং, একবার বলছেন বলির রক্ত। আমাকে দেখে যদি নির্বোধ বলে মনে হয় আপনার, তা হলে ভুল মনে হয়। কোথায় কেটে গেছে আপনার? লাল ওষুধের দরকার পড়ল কেন?

মন্টু বসে থাকেন বজ্রাহতের মতো। টেনে দাঁড় করান সুশান্ত।

—জামাটা খুলুন।

জামা খোলার পর দেখা গেল, মন্টুর ডান কনুইয়ের কাছে ছড়ে যাওয়ার চিহ্ন। দেখেই বোঝা যায়, ক্ষত খুব পুরনো নয়। সবে মামড়ি পড়তে শুরু করেছে। ফরেনসিক সায়েন্সের ভাষায়, ‘brush abrasion’, রাফ সারফেসের সঙ্গে শরীরের কোনও অংশের ঘর্ষণজনিত ক্ষতচিহ্ন।

—এটা কবে হল? কী ভাবে হল?

মন্টু নিরুত্তর। কাঁপছেন। সুশান্ত বলতে থাকেন।

—আমি বলি? আমি বলি, কীভাবে হয়েছিল? বিনোদকে খুন করে যখন বডিটা টেনেহেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন পোঁতার জন্য, দেওয়ালে ঘষা লেগেছিল। ঠিক বলছি?

স্রেফ আন্দাজেই বলা, এবং লক্ষ্যভেদ! মন্টু দাস কাঁপতে কাঁপতে চেয়ার ছেড়ে মাটিতে বসে পড়েন। পা জড়িয়ে ধরেন সুশান্তর। কাঁদতে শুরু করেন অঝোরে।

—সব বলছি স্যার। আমি একা মারিনি। অশোক আর প্রদীপও ছিল।

অশোক বর্মণ আর প্রদীপ বর্মণ, মৃত বিনোদের দুই সহোদরের দিকে তাকান সুশান্ত। দু’জনে যেন সহসাই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট। বেঞ্চে চুপচাপ বসে থাকা রাজেশ শুনছিলেন সব। আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন অশোকের উপর, ঝাঁকাতে থাকেন কাকার শার্টের কলার, ‘তোমরা মেরেছ বাবাকে? তোমরা?’

দু’জন কনস্টেবল সরিয়ে নিয়ে যান রাজেশকে। মোবাইল কল রেকর্ডের আর দরকার পড়বে না আপাতত, বোঝেন সুশান্ত। বোঝেন, ওসি হোমিসাইডকে ফোন করা দরকার এখনই। বোঝেন, নেমন্তন্ন রক্ষা লাটে উঠল। বাড়ি যাওয়ার কোনও গল্পই নেই আর। ‘পরিবার’ থাকবে কিনা, ভাবার সময় নেই এখন।

মন্টু বলতে শুরু করলেন। মুখ খুললেন অশোক আর প্রদীপও। পরদা উঠল হত্যারহস্যের।

বিনোদদের মা গোদাবরী দেবী সেপ্টেম্বরের শুরুতে মারা যাওয়ার পরই মায়ের ঘরের দখলদারি নিয়ে অশোক-প্রদীপের সঙ্গে ঝামেলা শুরু হয় বিনোদের। মায়ের ঘরের সম্পূর্ণ দখল নিতে চেয়েছিলেন বিনোদ, একরকম জোর করেই। বাধা দেন অশোক-প্রদীপ। মায়ের শ্রাদ্ধের দিনও তীব্র বাদানুবাদ হয় এ নিয়ে। বিনোদ বলেন, ‘মায়ের চিকিৎসার সব খরচ যখন আমি দিতাম, ঘরের উপর আমারই দাবি সবার আগে।’ এ যুক্তি মানতে চাননি ভাইরা। যাঁরা নিজেদের দিন-আনি-দিন-খাই জীবনযাত্রার সঙ্গে বড়দার রাজা-মারি-বাদশা-মারি চালচলনের তুলনা করে দীর্ঘদিন যাবৎ ভুগতেন হীনম্মন্যতায়, ঈর্ষায়। যে ঈর্ষায় প্রবল ঘৃতাহুতি দিয়েছিল বিনোদের ঘর দখলের চেষ্টা।

মন্টু দাস এ পরিবারের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ। অশোক-প্রদীপদের বড় হতে দেখেছেন। মন্টুদা-র শরণাপন্ন হলেন দুই ভাই, ‘তুমি বড়দাকে বোঝাও। ওর টাকার জোর আছে। ঠিক কোনওভাবে ঘরটা দখল করে নেবে। জোরজার করলে কিন্তু আমরাও ছাড়ব না। টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করে বলে উঠতে-বসতে গালিগালাজ করে। কথা শোনায় রোজ। অনেক সহ্য করেছি। আর নয়। তা ছাড়া ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটের বাড়িটাও তো আছে। ওটা বেচে দিলে তো অনেক টাকা পাবে। মায়ের ঘরটাও দরকার? বাড়াবাড়ি করলে খুনোখুনি হয়ে যাবে। মেরেই ফেলব।’

অশোক আর প্রদীপ জানতেন না, বিনোদের ব্যাপারে ঈর্ষা শুধু তাঁরাই নন, আপাতদৃষ্টিতে অভিন্নহৃদয়ের বন্ধু মন্টুও পোষণ করতেন।

—স্যার, একসঙ্গে বড় হয়েছি বিনোদের সঙ্গে। হাফপ্যান্টের বয়সের বন্ধু। গত এক-দেড় বছরে ব্যবসার যত রমরমা বাড়ছিল, বিনোদ যেন ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করেছিল। আচার-আচরণই পালটে গেছিল। একসঙ্গে আড্ডা দিতাম বা তাস খেলতাম ঠিকই। কিন্তু ও মাঝেমাঝেই কথাবার্তায় বুঝিয়ে দিত, যে ও বড়লোক আর আমরা ছাপোষা। ও পেরেছে, আমরা পারিনি।

—বলে যান, শুনছি।

—আমারও স্যার টানাটানির সংসার। কোনওভাবে দিন চলে। পুজোর মরশুমেই যা মূর্তি গড়ে টাকা আসে কিছু। বাকি বছরটা চালাতে প্রাণ বেরিয়ে যায়।

—টানাটানির সংসার বলে ছোটবেলার বন্ধুকে মেরে ফেললেন? মেরে পুঁতে রাখলেন?

—বিশ্বাস করুন, বিনোদকে মারার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি কোনওদিন। গত মাসে ওর থেকে কিছু টাকা ধার চেয়েছিলাম বাড়িটা সারানোর জন্য। বেশি নয়, হাজার পাঁচেক। শুনে হাসতে হাসতে বলল, ‘দিতে পারি, কিন্তু শোধ দিবি, তার গ্যারান্টি কী? ফস করে কোনদিন মরে যাবি, আমার টাকা জলে যাবে।’ ওই অপমানটা প্রচণ্ড গায়ে লেগেছিল আমার। নিজেকে খুব ছোট মনে হয়েছিল। মুখে শুধু বলেছিলাম, ‘দিতে হবে না টাকা।’ বিনোদ তারপরেও দিতে চেয়েছিল টাকা। নিইনি। সম্মানে লেগেছিল। রাগ হয়েছিল খুব। দয়া দেখাচ্ছে?

—তারপর?

—অশোক-প্রদীপরা যখন এসে বলল, বিনোদ মায়ের ঘরের দখল নিতে চাইছে, যখন বলল, জবরদস্তি করলে ওরা মেরেই ফেলবে ‘বড়দা’-কে, আমার মাথায় একটা প্ল্যান এল। নিজের ভাইদের সঙ্গে যে কুকুর-ছাগলের মতো ব্যবহার করে, টাকার গরমে ছোটবেলার বন্ধুকে অপমান করতে যার বাধে না, তার চরম শাস্তিই পাওয়া উচিত।

—প্ল্যানটা কী করলেন?

—ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটের বাড়িটা ভাল করে সারিয়ে-সুরিয়ে বেচে দেওয়ার কথা ভাবছিল বিনোদ। আমাকে বলেছিল, ‘দ্যাখ না একটা ভাল কোনও খদ্দের।’ আমি অশোক-প্রদীপকে বললাম, ‘তোদের বড়দা এই বাড়িটা বেচে দিয়ে মোটা টাকা পাবে আর সেই দিয়ে ব্যবসা আরও ফুলেফেঁপে উঠবে। মামলা করে তোদের মায়ের ঘরটাও দখল নেবে। একটা উপায় আছে আমাদের তিনজনেরই বড়লোক হওয়ার। শুনতে চাস তো বলব।’

অশোক এবার থামিয়ে দেন মন্টুকে।

—আমি বলছি স্যার। মন্টুদা বলল, ‘বিনোদের কাছ থেকে বাড়ির দলিলটা কোনওভাবে বাগিয়ে তারপর পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে। দলিলটা জাল করে বাড়িটা বিক্রি করে যা টাকা পাব, সেটা তিনজন ভাগ করে নেব।’

প্রদীপ বলতে শুরু করেন অশোকের কথা শেষ হতে না হতেই।

—আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম মন্টুদাকে, ‘যদি পুলিশ ধরে ফেলে?’ মন্টুদা বলেছিল, ‘আরে, বডি পেলে তো ধরবে। পুঁতে দেব মাটির নীচে। খুঁজেই তো পাবে না কেউ। লোকে কিছুদিন পরে ভাববে, মেন্টাল পেশেন্ট বউ-কে ফেলে রেখে বাড়ি বেচে অন্য কোনও মহিলার সঙ্গে চলে গেছে অন্য কোথাও। দ্যাখ ভেবে, তোরা রাজি আছিস কিনা?’

বক্তা এবার অশোক।

—বাড়ি ফেরার পথে আমরা দু’জন আলোচনা করে ঠিক করলাম, রোজকার অর্থকষ্ট আর বড়দার অপমানের থেকে বাঁচতে এটাই সেরা রাস্তা।

সুশান্ত ইশারায় থামতে বলেন দুই ভাইকে। তাকান মন্টুর দিকে। শক্ত সবল চেহারার প্রৌঢ় মাথা নিচু করে বসে আছেন নিশ্চুপ।

—মন্টুবাবু, বাকিটা আপনার মুখ থেকেই শুনি। ধরা তো পড়েই গেছেন, চুপ করে থেকে আর লাভ নেই।

উনষাট বছরের মন্টু মুখ তোলেন, বলতে থাকেন ধীরে ধীরে, বন্ধুহত্যার বৃত্তান্ত।

—২৪ তারিখ সন্ধেবেলা বিনোদকে ফোন করলাম। বললাম, ‘একজন ভাল খদ্দের পেয়েছি। বাড়িটা দেখতে চাইছে। দলিলটা নিয়ে কাল সাড়ে এগারোটায় আসতে পারবি?’ জানতাম, ওই সময়টায় রোজ ও এমনিতেই আসে। বিনোদ বলল, ‘ঠিক আছে, আসব।’

—আসার পর?

—রাতেই জানিয়ে দিয়েছিলাম অশোক-প্রদীপকে। কথা ছিল, ওরা কাছেপিঠে থাকবে। বিনোদ এলে আমি ঢুকব। ঢোকার আগে একটা মিসড কল দেব অশোককে। ওরাও চলে আসবে পাঁচ মিনিটের মধ্যে।

—বেশ …

—বিনোদ এল দলিল নিয়ে। আমি টুকটাক কথাবার্তা চালালাম কয়েক মিনিট। বিনোদ জানতে চাইল, ‘খদ্দের কখন আসবে রে?’ আমি বললাম, ‘এখুনি এসে পড়বে।’ বলতে বলতেই অশোক আর প্রদীপ ঢুকল। বিনোদ চমকে উঠে বলল, ‘আরে, তোরা?’

প্ল্যানমাফিক একটা বড় ব্যাগে শাবল আর কয়েক টুকরো কাপড় নিয়ে এসেছিল ওরা। বিনোদ কিছু বোঝার আগেই ব্যাগ থেকে শাবলটা বার করলাম আমি। ওরা দু’জন বিনোদের হাত চেপে ধরল, আর আমি সজোরে শাবল চালালাম কপালে। পরপর দু’বার। বিনোদ কাটা গাছের মতো পড়ে গেল।

—তারপর গলায় কাপড়ের ফাঁস দিলেন, মুখে কাপড় গুঁজলেন, আর বাড়ির পিছনে বিনোদকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়ে পুঁতে দিলেন, এই তো?

—হ্যাঁ স্যার, তার আগে বিনোদের প্যান্ট-জামা খুলে নিয়েছিলাম। প্যান্ট থেকে চাবির গোছাটা নিলাম। মেঝের রক্তের দাগ জল দিয়ে ভাল করে ধুয়ে ঘর তালাবন্ধ করে দলিলটা নিয়ে বেরিয়ে এলাম। বিনোদের শার্ট-প্যান্ট ব্যাগে ভরে নিয়ে।

.

প্রমাণ একত্রিত করার কাজটা খুব দুঃসাধ্য ছিল না চার্জশিট তৈরির সময়।

এক, রক্তের দাগ-লাগা শাবল উদ্ধার হয়েছিল অশোকের ঘর থেকে। রক্তের দাগের নমুনা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় মিলে গিয়েছিল ঘরের দেওয়াল থেকে সংগৃহীত রক্তের নমুনার সঙ্গে।

দুই, বিনোদের রক্তমাখা শার্টপ্যান্ট মন্টু দাসের বাড়ির তল্লাশিতে পাওয়া গেছিল। এক্ষেত্রেও পোশাকের রক্তের নমুনা আর অকুস্থল থেকে সংগৃহীত রক্তের নমুনা মিলে গিয়েছিল পরীক্ষায়। উদ্ধার হওয়া শার্টে একটা বোতাম ছিল অমিল। ঘটনাস্থল থেকে বাজেয়াপ্ত হওয়া প্লাস্টিকের বোতামই যে সেই বোতাম, একই শার্টের, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের রিপোর্টে নিখুঁত প্রমাণিত হয়েছিল।

তিন, প্রদীপের কাছে ছিল বিনোদের সেই বাড়ির দলিল। উদ্ধার হয়েছিল হিউম রোডের বাড়িতে প্রদীপের ঘরের ট্রাঙ্ক থেকে।

চার, কফিনে শেষ পেরেক ঠুকেছিল বিনোদ এবং আততায়ী-ত্রয়ীর কল রেকর্ড। খুনের আগের সন্ধেয় বিনোদকে ফোন মন্টুর, খুনের দিন সকালে মন্টুর মিসড কল অশোককে, চারজনের ফোনের টাওয়ার লোকেশন খুনের সময় একই বিন্দুতে মিলে যাওয়া, পারিপার্শ্বিক প্রমাণও ছিল অকাট্য।

পাঁচ বছরের বিচারপর্বের শেষে মন্টু-অশোক-প্রদীপকে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা শুনিয়েছিলেন বিচারক। কারাদণ্ড যাবজ্জীবন। যে সাজা ওঁরা এখনও ভোগ করছেন।

স্বামী-স্ত্রীকে খুন করছে সন্দেহের বশে। স্ত্রী ষড়যন্ত্রে শরিক হচ্ছে প্রেমিকের সঙ্গে, স্বামীকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে। ছেলে সম্পত্তির লোভে ছক কষছে বাবার ভবলীলা সাঙ্গ করার। বাবার হাত কাঁপছে না সন্তান-নিধনে। ছোটবেলার বন্ধু অর্থলিপ্সায় পথের কাঁটা ভাবছে বন্ধুকে, বন্ধুর ভাইদের সঙ্গে সজ্ঞানে প্ল্যান করছে খুন করে মাটিতে পুঁতে দেওয়ার!

কল্পনার গল্প-উপন্যাসে এসব পড়া এক। বাস্তবের এমন ব্যতিক্রমী ঘটনা কাগজে পড়া এক। কিন্তু ঘটনায় জড়িত রক্তমাংসের চরিত্রগুলোর সঙ্গে তদন্ত চলাকালীন নিয়মিত ভাবের আদানপ্রদান আরেক। তদন্ত যাঁরা করেন এ ধরনের বিরল মামলায়, তাঁদের কিছুটা সুযোগ ঘটে অপরাধীর মনোজগৎকে সত্তর মিলিমিটার স্ক্রিনে দেখার।

দেখেও যে খুব বেশি শেখা যায়, এমন দাবিই বা করি কী করে? সম্পর্কের যোগ-ভাগ-গুণ-বিয়োগ মেলে না অপরাধের দুনিয়ায়। এ এক অন্য পৃথিবী।

বিপুলা যে পৃথিবী। যার কতটুকুই বা জানি!

পুনশ্চ: রীতা নস্কর নামটি পরিবর্তিত। মহিলার সামাজিক বিড়ম্বনা অভিপ্রেত নয়। তাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *