এ কাহিনির শিরোনাম হয় না
[বীরেশ পোদ্দার মামলা
পৃথ্বীরাজ ভট্টাচার্য, ইনস্পেকটর, গোয়েন্দাবিভাগ।]
ঠিক যেন ‘শোলে’! স্থান-কাল-পাত্রে দূরতম মিলও নেই। মিল নেই পটভূমিতেও। তবু মনে পড়ে যেতে বাধ্য রমেশ সিপ্পির কালজয়ী ব্লকবাস্টারের সেই দৃশ্য।
পাশাপাশি শোয়ানো পাঁচটি মৃতদেহ। সাদা কাপড়ে মোড়া। দীর্ঘদিন পর পাওয়া ছুটিতে দেশের বাড়ি ফিরছেন জাঁদরেল পুলিশ অফিসার সঞ্জীবকুমার, রামগড়ে নিজের গ্রামে যিনি সর্বজনমান্য ঠাকুরসাব। যিনি সদ্য গ্রেফতার করে জেলে পুরেছেন দুর্ধর্ষ ডাকাত গব্বর সিং-কে। স্টেশনে বাড়ির লোকজন নেই কেউ, দেখে অবাকই হয়েছেন। কেউ এল না? আশ্চর্য!
বাড়ি পৌঁছনোর পর বিস্ময় বদলে গেছে স্তব্ধতায়। পাতা পড়ছে না চোখের। পাশাপাশি পাঁচটি দেহ শুয়ে নিথর। দুই ছেলে, একমাত্র মেয়ে, পুত্রবধূ। এবং আট বছরের নাতি। জেল পালিয়ে যাদের খুন করে গেছে গব্বর, ভয়ংকরতম বদলা নিয়েছে গ্রেফতারির। পরিবার নিশ্চিহ্ন। অক্ষত শুধু ছোটছেলের স্ত্রী, আর বহু বছরের গৃহভৃত্য। যাঁরা গব্বরের হত্যালীলার সময় পুজো দিতে গিয়েছিলেন মন্দিরে।
গৃহভৃত্য কাঁদছেন মনিবের পা জড়িয়ে ধরে। ছোটবউ বাড়ির দালানে বসে আছেন শোকস্তব্ধ। এতদিন পরে বাড়ি আসছেন, পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জন্য ঠাকুরসাব কিছু-না-কিছু কিনে এনেছিলেন। দু”হাত থেকে খসে পড়তে থাকে সেই উপহারগুচ্ছ। একটার পর একটা।
দমকা হাওয়া আসে। উড়িয়ে নিয়ে যায় চারটি দেহের উপর থেকে সাদা কাপড়। তিন সন্তান এবং পুত্রবধূর গুলিবিদ্ধ দেহে একে একে চোখ রাখেন বাক্রুদ্ধ ঠাকুরসাব। পঞ্চম দেহের উপরের কাপড় তখনও উড়ে যায়নি হাওয়ায়। নাতির দেহের উপর থেকে নিজেই কাপড় সরান ধীরে। শোক ততক্ষণে বদলে গেছে উন্মত্ত ক্রোধে।
.
মুরারিপুকুরের দশ বাই বারোর একচিলতে ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে ‘শোলে’ মনে পড়ে যায় ওসি মানিকতলার। বাহ্যত মিল নেই কোনও, তবু। ওটা সিনেমার পরদা, এটা ঘোর বাস্তব। ওটা ঘটেছিল খোলা আকাশের নীচে, এটা ঘটেছে চার দেওয়ালের মধ্যে। ওটায় ঘাতক ছিল বন্দুকের গুলি, এটায় গলার ফাঁস। রামগড়ে নিহতের সংখ্যা ছিল পাঁচ। এখানে মেঝেতে একটা, আর খাটের উপর পাশাপাশি পড়ে আছে পাঁচটা দেহ। ওটায় লাশগুলোর মুখ ঢাকা ছিল কাপড়ে। এখানে নেই।
মেঝেতে প্রাণহীন দেহ এক মহিলার। গলায় উলের চাদরের প্যাঁচ। বয়স তিরিশের নীচেই হবে। খাটে ফুলের মতো পাঁচটি বাচ্চা মেয়ে। যেন ঘুমোচ্ছে নিশ্চিন্তে। কারও গলায় ওড়নার ফাঁস, কারও গলায় মাফলারের। বয়স? সবচেয়ে বড় যে, সে কিছুতেই বারোর বেশি নয়। সবচেয়ে ছোট দু’জনকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে যমজ। বয়স খুব বেশি হলে পাঁচ-ছয়।
পুলিশের চাকরিতে কম দিন হল না মানিকতলা থানার বড়বাবু দ্বিজেন চ্যাটার্জির। অসংখ্য মৃতদেহ দেখেছেন। দুর্ঘটনায় ধড় থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া শরীর দেখেছেন অনেক। দুমড়ে-মুচড়ে দলা পাকিয়ে যাওয়া বডি দেখেছেন একাধিক। তদন্তের স্বার্থে বহুবার ডাক্তারবাবুর পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছেন ময়নাতদন্তের কাটাছেঁড়া। দেহ, সে যতই বিকৃত হোক, স্নায়ু বিন্দুমাত্রও চঞ্চলতা দেখায়নি কখনও।
সঙ্গী সাব-ইনস্পেকটর তাই অবাকই হন একটু। দ্বিজেন ঠায় তাকিয়ে আছেন পড়ে থাকা হাফডজন দেহের দিকে। একটু এগিয়ে যান যমজ মেয়েদুটির গলার ফাঁস পরীক্ষা করতে। মুখের উপর ঝুঁকে কয়েক সেকেন্ড দেখার পরই পিছিয়ে আসেন। ফ্যাকাশে হয়ে আসে চোখমুখ। অস্ফুটে অধস্তন সহকর্মীকে বলেন, ‘ডিসি ডিডি-কে ধরো।’ মোবাইল এগিয়ে দেন নিজের।
—স্যার, রিং হচ্ছে। ধরুন, ডিসি ডিডি সাহেব…
ফোন হাতে নিয়ে কোনওমতে ‘নমস্কার স্যার, এত রাতে ডিস্টার্ব করার জন্য সরি স্যার’ বলার পরই বিদ্রোহ করে বহুপরীক্ষিত স্নায়ু। হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেন ডাকসাইটে ওসি। জড়ানো গলায় শুধু বলতে পারেন, ‘একবার আসুন স্যার, শুধু দেখে যান, বাচ্চা মেয়েগুলোকে এভাবে… এতদিনের চাকরিতে এমন কখনও দেখিনি স্যার…।’
ঘড়ি দেখেন গোয়েন্দাপ্রধান। পৌনে চারটে। পোড়খাওয়া ওসি কীসে এতটা বিচলিত হয়ে পড়লেন, যে পুরো বাক্যটা শেষ করতে না পেরে কেঁদেই ফেললেন? এখনই যাওয়া দরকার স্পটে। বিছানা ছেড়ে উঠতে না উঠতেই মোবাইল বেজে উঠল আবার। এবার লালবাজার কন্ট্রোল রুম, ‘স্যার, মুরারিপুকুরে মাল্টিপল মার্ডার। ওসি স্পটে আছেন। ডিসি যাচ্ছেন। প্রবলেম হচ্ছে একটু। লোক জমে গেছে। বডি বার করতে সমস্যা হতে পারে। ডিসি হেডকোয়ার্টার স্পটে RAF পাঠাতে বলেছেন। ফোর্স যাচ্ছে স্যার।’
সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে ফোন কেটে দেন গোয়েন্দাপ্রধান, ‘হ্যাঁ, শুনেছি, ওসি-র সঙ্গে কথা হয়েছে। আমি যাচ্ছি। ওসি হোমিসাইডকেও যেতে বলুন। আর, পারলে সিপি সাহেবকে জানিয়ে রাখুন ইনসিডেন্টটা।’
গোয়েন্দাপ্রধানের গাড়ি যখন ঢুকছে মুরারিপুকুরে, ঘড়িতে ভোর সাড়ে চারটে। নাকি লেখা উচিত, রাত সাড়ে চারটে? সময়টাই এমন, যখন রাত আর ভোর সহবাস করে দৈনন্দিন।
.
রহস্যপিপাসুর সনাতন চাহিদা এ কাহিনি মেটাবে না, স্বীকার্য শুরুতেই। একটা অপরাধ ঘটবে, থাকবে একাধিক সন্দেহভাজন, প্রত্যেকেরই থাকবে অপরাধী হওয়ার সম্ভাব্যতা, পাঠক আগাগোড়া থাকবেন দ্বিধাদীর্ণ, আর গোয়েন্দা শেষ পৃষ্ঠায় যবনিকা উত্তোলন করবেন রহস্যের, এ কাহিনি এই পরিচিত ছকের অনুসারী নয়। বরং উলটো। শুরুতেই জানা হয়ে যাচ্ছে, কে খুনি। ‘কে করেছিল’ নয়, কেন করেছিল, এবং কীভাবে করেছিল, সেটাই উপজীব্য এ মামলার। যা আজও হিমশীতল নৃশংসতার বিরলতম দিকচিহ্ন হয়ে আছে কলকাতা পুলিশের ইতিহাসে।
মানিকতলা থানা, কেস নম্বর ৩৮২। তারিখ, ১৭ ডিসেম্বর, ২০০০। ধারা, ৩০২/৩০৭। খুন এবং খুনের চেষ্টা।
.
প্রণম্য শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘চিড়িয়াখানা’ উপন্যাসে এক জায়গায় লিখেছিলেন, ‘টেলিফোনের সহিত যাঁহারা ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত তাঁহারা জানেন, টেলিফোনের কিড়িং কিড়িং শব্দ কখনও কখনও ভয়ংকর ভবিতব্যতার আভাস বহন করিয়া আনে। যেন তারের অপর প্রান্তে যে-ব্যক্তি টেলিফোন ধরিয়াছে, তাহার অব্যক্ত হৃদয়াবেগ বিদ্যুতের মাধ্যমে সংক্রামিত হয়।’
মানিকতলা থানায় যে ফোনটা এসেছিল রাত সোয়া তিনটে নাগাদ, তাতেও যেন আভাস ছিল ভয়ংকর ভবিতব্যের। ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে এক হিন্দিভাষী ভদ্রলোক উত্তেজিত কণ্ঠে জানিয়েছিলেন ডিউটি অফিসারকে, ‘সার, জলদি ফোর্স ভেজিয়ে ইঁয়াহা। 16/J/Q মুরারিপুকুর রোড মে, ইয়াহাঁ পাঁচ লেড়কি অউর এক অউরত কা খুন হো গয়া।’ ভদ্রলোক যেখান থেকে ফোনটা করছেন, সেখানে যে পরিস্থিতি খুব একটা শান্ত নেই, কথোপকথনের মাঝেই ভেসে আসা চিৎকার-চেঁচামেচিতে দিব্যি বুঝতে পেরেছিলেন অফিসার।
থানার লাগোয়া কোয়ার্টারেই থাকেন ওসি। ঘণ্টাদেড়েক হল থানা ছেড়ে বাড়ি গেছেন। ডিউটি অফিসার ঘুম ভাঙালেন ফোনে, জানালেন খবরটা। ‘পাঁচ লড়কি অউর এক অউরত?’ অনেক উড়ো ফোন আসে থানায় রাতের দিকে। কিন্তু ছ’টা খুন? খবরটা ঠিক হোক, ভুল হোক, দেরি করার মানে হয় না। তৈরি হয়ে নিতে যতটুকু সময়, ওসি-র গাড়ি ছুটল মুরারিপুকুরের দিকে। এবং নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছেই দ্বিজেন বুঝলেন, খবরে ভুল নেই।
তিনতলা বাড়ি। তৃতীয় তলাটা অসম্পূর্ণ। ওই গভীর রাতেও অন্তত শ’তিনেক লোকের জমাট ভিড় বাড়ির গেটের সামনে। পুলিশের গাড়ি দেখেই যে ভিড়টা আরও উত্তেজিত হওয়ার অক্সিজেন পেয়ে গেল নিমেষে। কী হয়েছে, সেটা জানতে গেলে তো ঢুকতে হবে বাড়িতে। সেই ঢোকাটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়াল ভিড়ভাট্টা-হইহল্লার মধ্যে। বিস্তর ঠেলেঠুলে কোনওমতে বাড়িটায় ঢুকতে ঢুকতেই দ্বিজেন মোবাইল ফোনে ধরলেন লালবাজার কন্ট্রোল রুম। ‘সিচুয়েশন গ্রেভ অ্যাট মুরারিপুকুর। রিইনফোর্সমেন্ট নিডেড আর্জেন্টলি। প্লিজ় ইনফর্ম সিনিয়র অফিসার্স।’
একতলায় এগারোটা ঘর, দু’পাশে সার দিয়ে। জনাবিশেক লোকের ভিড় উত্তর দিকের শেষ ঘরের সামনে। ঘরের দরজা খোলা। সঙ্গী অফিসারকে নিয়ে দ্বিজেন ঢুকলেন। এবং ঢুকে যা দেখলেন, লিখেছি শুরুতেই। মেঝেতে এক মহিলার দেহ প্রাণহীণ, খাটে পঞ্চকন্যার। বিহ্বল ওসি কেঁদে ফেললেন দৃশ্যের অভিঘাতে, ‘বাচ্চা মেয়েগুলোকে এভাবে… এতদিনের চাকরিতে এমন কখনও দেখিনি স্যার…!’
ডিসি ইএসডি (ইস্টার্ন সাবার্বান ডিভিশন) এবং ডিসি ডিডি যখন এসে পৌঁছলেন, ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছেন দ্বিজেন। খুঁটিয়ে দেখে নিয়েছেন দশ বাই বারোর ঘরটা। সহজেই চোখে পড়েছে জানালার পাশে রাখা একটা কাগজের টুকরো। আঁকাবাঁকা হাতের লেখায় যা ছিল সেই কাগজে, তুলে দিলাম নীচে।
‘হাম বীরেশ পোদ্দার আপনি ইচ্ছা সে পুরে পরিবার কো মার ডালা। ইস মে বাকি লোগো কা কোই কসুর নেহি হ্যায়। কৃপয়া সাজা দে, মারনে কা কারণ দিগ্বিজয় শর্মা কা মেরি পরিবার ইয়ানি মেরি বিবি সে গলত সম্পর্ক।’
(‘আমি বীরেশ পোদ্দার নিজের ইচ্ছেয় আমার পুরো পরিবারকে মেরে ফেলেছি। এতে অন্য কারও কোনও দোষ নেই। আমাকে শাস্তি দেওয়া হোক। মারার কারণ হল দিগ্বিজয় শর্মার সঙ্গে আমার স্ত্রী-র অবৈধ সম্পর্ক।’)
কাগজের নীচে ইংরেজিতে সই, ‘Biresh Poddar’। তা এই বীরেশ কই? বউ-বাচ্চাদের মেরে স্বীকারোক্তি লিখে পালিয়েছেন? যাঁরা ভিড় জমিয়েছিলেন ঘরের সামনে, তাঁরা সমস্বরে হইহই করে উঠলেন, ‘দিগ্বিজয় কো মারকে ভাগ গয়া!’
ঘটনাপ্রবাহ যা জানা গেল, এরকম। একতলায় এগারোটা ঘরের মধ্যে দশটায় ভাড়া থাকতেন সব মিলিয়ে সাতটি পরিবার। একটা ঘর খালি ছিল। উত্তর দিকের দুটো মুখোমুখি ঘরে ভাড়া থাকতেন বীরেশ পোদ্দার এবং দিগ্বিজয় শর্মা। বছর চল্লিশের বীরেশ আদতে বিহারের বাসিন্দা। বড়ভাই নরেশের সঙ্গে জীবিকার সন্ধানে কলকাতায় চলে আসেন বছর পনেরো আগে। দুই ভাই মিলে ক্যানাল ওয়েস্ট রোডে একটা ছোট ঘর ভাড়া নিয়ে কাঠের কাজকর্মের কারবার শুরু করেন।
নরেশ সপরিবারে থাকেন উলটোডাঙার কাছে। আর বীরেশ মুরারিপুকুরের এই বাড়ির ভাড়াটিয়া কলকাতায় আসার পর থেকেই। স্ত্রী রীতা এবং পাঁচ কন্যাকে নিয়ে বসবাস। রিমা-প্রীতি-স্মৃতি-ভাবনা-শ্বেতা। রিমা বড়, এগারো বছর। প্রীতি আর স্মৃতি মেজো আর সেজো, যথাক্রমে দশ আর আট বছরের। ভাবনা আর শ্বেতা যমজ, চার পেরিয়ে সবে পাঁচ ছুঁয়েছে।
প্রতিবেশী দিগ্বিজয় শর্মা মধ্যচল্লিশ। বড়বাজারের এক বেসরকারি সংস্থায় ছোটখাটো চাকুরে। বিবাহিত, একমাত্র ছেলে কৌশলের বয়স আঠারো। কলেজে পড়ে, বাবার সঙ্গেই থাকে। স্ত্রী থাকেন দেশের বাড়িতে, বিহারে।
একতলাতেই অন্য ঘরগুলোয় যাঁরা ভাড়া থাকতেন, তাঁদের মধ্যে দু’জন, সত্যদেও পাণ্ডে এবং রামচল জয়সওয়াল, জানালেন, রাত আড়াইটে নাগাদ বাইরে থেকে প্রবল চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় ওঁদের। প্যাসেজে সারারাতই আলো জ্বলত এ বাড়িতে। গেট বন্ধ হয়ে যেত সাড়ে এগারোটা নাগাদ। তালার কমন চাবি থাকত সব আবাসিকের কাছেই। কারও রাতে বেরনোর প্রয়োজন হলে তালা খুলে বেরতেন। ফিরে এসে গেট আবার তালাবন্ধ করে দিতেন।
দরজা খুলে বাইরে এসে সত্যদেও আর রামচল দেখেন, দিগ্বিজয় এক হাতে নিজের পেট চেপে ধরেছেন। রক্তে ভেসে যাচ্ছে শার্ট। আর অন্য হাতে কলার চেপে ধরে আছেন বীরেশের। দিগ্বিজয়ের ছেলে কৌশল তারস্বরে চেঁচাচ্ছে, ‘পিতাজি কো মার ডালা!’ দিগ্বিজয়ের হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে ঝটিতি মূল গেট দিয়ে বেরিয়ে যান বীরেশ। গেট খোলা ছিল। নিশ্চয়ই বীরেশই খুলে রেখেছিলেন ঘটনা ঘটানোর আগে। যাতে দ্রুত পালাতে সুবিধে হয়।
দিগ্বিজয় কোথায়? সত্যদেও-রামচলের হইহইয়ে অন্য ভাড়াটেরাও বেরিয়ে এসেছিলেন। দু’তলায় থাকতেন বাড়ির মালিক শ্যামল সাহা, নেমে এসেছিলেন। দু’-তিনজন একটা ট্যাক্সি জোগাড় করে রক্তাক্ত দিগ্বিজয়কে নিয়ে ছুটেছিলেন আর জি কর হাসপাতালে। সেখানেই এখন আইসিইউ-তে চিকিৎসাধীন সে।
বীরেশের ঘরে বাইরে থেকে শিকল তোলা ছিল। শিকল খুলে ভিতরের ওই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে এক প্রতিবেশী ফোন করেছিলেন মানিকতলা থানায়।
অকুস্থল থেকে পুলিশের বাজেয়াপ্ত করা জিনিসের তালিকায় রইল হিন্দিতে লেখা বীরেশের স্বীকারোক্তি-চিরকুট, ঘরগুলির মধ্যবর্তী প্যাসেজে বইতে থাকা রক্তস্রোতের ‘স্যাম্পল’, দিগ্বিজয়কে আক্রমণে ব্যবহৃত ছুরি, এবং কিছু রুটিন টুকিটাকি।
দেহগুলো ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো দরকার। কিন্তু পারলে তো? সকাল হয়ে গেছে। লোকের ভিড় বেড়েছে আরও। পাঁচ-সাতশো এলাকাবাসীর বিক্ষুব্ধ জমায়েত বাড়ির সামনে। দাবি, এভাবে ছ’জনকে খুন করে পালিয়ে গেছেন বীরেশ, তাকে গ্রেফতার না করা পর্যন্ত একটাও দেহ বাড়ির বাইরে বেরবে না। আগে গ্রেফতার, তারপর অন্য কিছু।
সিনিয়র অফিসাররা জনতাকে আপ্রাণ বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। ডিসি হেডকোয়ার্টার, যিনি শহরের আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকেন, ততক্ষণে চলে এসেছেন লালবাজারে। মুরারিপুকুরে পৌঁছে গিয়েছে RAF। পরিস্থিতি ক্রমশ ঘোরালো হচ্ছে দেখে সামান্য বলপ্রয়োগ করতেই হল পুলিশকে। জনতাকে হঠিয়ে দিয়ে বার করা হল দেহগুলি। মৃতা মায়ের সঙ্গে পুলিশ ভ্যানে করে মর্গের উদ্দেশে রওনা দিল পাঁচ বোন। রিমা-প্রীতি-স্মৃতি-ভাবনা-শ্বেতা। ঘুমের মধ্যেই যারা কয়েক ঘণ্টা আগে পাকাপাকিভাবে পাড়ি দিয়েছে ঘুমের দেশে।
পোস্টমর্টেম রিপোর্ট জানাল, যা জানাই ছিল। ‘Death was caused due to effects of strangulation, ante-mortem and homicidal in nature.’
ঘটনা এতটাই চাঞ্চল্যকর, প্রাথমিক তদন্ত থানা শুরু করলেও গোয়েন্দাবিভাগের উপর দায়িত্ব পড়াটা অনিবার্যই ছিল। তদন্তকারী অফিসার নিযুক্ত হলেন গোয়েন্দাবিভাগের হোমিসাইড শাখার তৎকালীন সাব-ইনস্পেকটর পৃথ্বীরাজ ভট্টাচার্য, যিনি বর্তমানে গোয়েন্দাবিভাগেই কর্মরত ইনস্পেকটর হিসাবে।
প্রতিবেশীদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেল, বীরেশ-রীতার দাম্পত্য সম্পর্ক মসৃণ ছিল না। ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকত। রীতার পরিবারের লোকজন থাকতেন কাঁকুড়গাছি এলাকায়। রীতার দাদা চন্দ্রশেখর জানালেন, বীরেশ প্রায়ই মারধর করতেন রীতাকে। সন্দেহ করতেন, দিগ্বিজয়ের সঙ্গে বোধহয় স্ত্রীর অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। সন্দেহই, প্রমাণ ছিল না কিছু। মাঝেমাঝে রীতা রাগারাগি করে বাচ্চাদের নিয়ে চলে আসতেন দাদার বাড়িতে। কান্নাকাটি করতেন দাদা-বউদির কাছে।
কয়েকদিন পরে বীরেশই এসে ফিরিয়ে নিয়ে যেতেন স্ত্রীকে। রীতাও ফিরে আসতেন মুরারিপুকুরে। কী-ই বা উপায় ছিল ফিরে আসা ছাড়া? যখন কিশোরী ছিলেন, বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। পড়াশুনোর সুযোগ হয়নি। সম্পূর্ণভাবে স্বামীর উপর নির্ভরশীল ছিলেন। আর রীতার দাদা চন্দ্রশেখরও যে আর্থিকভাবে খুব সচ্ছল ছিলেন, এমনও নয়। পাঁচটা বাচ্চাকে নিয়ে কতদিনই বা থাকা যায় দাদা-বউদির সংসারে?
ফিরে আসতেন, কিছুদিন সব ঠিকঠাক চলত। তারপর ফের সন্দেহ, ফের অশান্তি, ফের মারধর। যথাপূর্বং তথাপরম।
নিশ্চিত জানা হয়ে গিয়েছিল, অপরাধী কে। বাকি ছিল গ্রেফতারি। বীরেশ সহজে ধরা দিলেন না। ভোগালেন সপ্তাহদুয়েক। ঘটনা ২০০০ সালের। মোবাইল ব্যবহার করার মতো ট্যাঁকের জোর ছিল না বীরেশের। তাই প্রযুক্তির সাহায্যে পলাতকের অবস্থান জানার প্রশ্ন ছিল না। বীরেশের ভাই নরেশের কাছে জানতে চাওয়া হল বিহারে যাবতীয় আত্মীয়স্বজনের নাম-ঠিকানা ইত্যাদি। জেনে নেওয়া হল, কোথায় কোথায় আশ্রয় নিতে পারেন পালিয়ে।
তিনটে টিম করা হল। যাঁরা ১৭ তারিখ দুপুরেই বেরিয়ে পড়লেন বিহারে। সম্ভাব্য সমস্ত আস্তানায় রেইড করা হল দিনের পর দিন। আজ সমস্তিপুর, কাল গয়া, পরশু জামুই, তরশু ঘাটশিলা। আত্মীয়বন্ধুদের বাড়িতে এক-দু’-দিন করে থাকছিলেন বীরেশ। পুলিশ পৌঁছনোর আগেই ডেরা বদলে ফেলছিলেন। প্রায় দশ-বারো দিন ধরে বিহারের পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ চষে ফেলেও নাগাল পাওয়া গেল না বীরেশের। ফিরে এলেন হতোদ্যম অফিসাররা।
বীরেশের মোবাইল না থাকলেও দাদা নরেশের ছিল। যে ফোনের উপর নজরদারি চালু হয়ে গিয়েছিল ঘটনার পরের দিন বিকেল থেকেই। অফিসাররা যেদিন ফিরে এলেন বিহার থেকে, তার পরের দিনই ফোন-নজরদারিতে ইঙ্গিত মিলল, টাকা ফুরিয়ে গেছে বীরেশের। দু’-এক দিনের মধ্যেই কলকাতায় আসার সম্ভাবনা। দেখা করতে পারেন দাদার সঙ্গে। জাল পাতা হল শহরের স্টেশনে-বাস টার্মিনাসে-ফেরিঘাটে। ৩১ ডিসেম্বর বর্ষশেষের সন্ধেয় বাবুঘাটে গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়লেন স্ত্রী এবং পাঁচ কন্যাকে খুন করে ফেরার হয়ে যাওয়া বীরেশ।
জেরাপর্বে বীরেশ কোনও রাখঢাকের রাস্তায় গেলেন না। কয়েক লাইনে লিখে গিয়েছিলেন যে স্বীকারোক্তি, সেটাই বললেন বিস্তারে। যখনই রীতাকে কোনও কারণে কথা বলতে দেখতেন দিগ্বিজয়ের সঙ্গে, তীব্র অশান্তি হত সংসারে। ছোটখাটো ঘটনা নিয়েও স্বামী-স্ত্রীর খিটিমিটি লেগেই থাকত। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবধারিত ভাবে বীরেশ টেনে আনতেন দিগ্বিজয়ের সঙ্গে সম্পর্ককে। ঘটনার মাসখানেক আগে যেমন। সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে বীরেশ দেখলেন, একটা মাঝারি মাপের সুটকেস এক কোণে রাখা।
—দিগ্বিজয় ভাইয়ার। ওর ঘরে কিছু মেরামতির কাজ চলছে। জায়গার অভাব। তাই বিকেলে ভাইয়া এসে বলল, দু’-তিন দিনের জন্য যদি এটা..
—ভাইয়া! ভাইয়া, না সাঁইয়া? সব জানা আছে আমার, এ সুটকেস এখানে থাকবে না। রাস্তায় রাখুক সুটকেস, আমার বাড়ি ছাড়া আর জায়গা পেল না?
সঙ্গে সঙ্গেই উলটোদিকের ঘরে গিয়ে সুটকেস রেখে এসেছিলেন বীরেশ, তপ্ত বাদানুবাদ হয়েছিল স্বামী-স্ত্রীর।
মনে সন্দেহের বীজ দাম্পত্য জীবনের শুরু থেকেই লালন করে এসেছিলেন বীরেশ। বিয়ের তিন মাসের মধ্যেই গর্ভবতী হন রীতা এবং বীরেশের ধারণা হয়, এ সন্তান তাঁর ঔরসজাত নয়। ভুল ভাঙানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন রীতা।
এরপর একে একে আরও চার কন্যাসন্তানের জন্ম। তাদের একটু একটু করে বড় হয়ে ওঠা। যত বছর গড়িয়েছে, সন্দেহের তীব্রতা প্রশমিত হওয়া দূরে থাক, কোনও কার্যকারণ ছাড়াই বীরেশের ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে, সন্তানরা তাঁর নয়। রীতার অবৈধ সম্পর্কের ফসল। এই ধারণায় ঘৃতাহুতি দিয়েছিল গত কয়েক বছরে রীতা-দিগ্বিজয়ের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠা। দিগ্বিজয় ডাকতেন ‘রীতা ভাবি’ বলে। রীতা ডাকতেন ‘ভাইয়া’। বীরেশ মনে করতেন, ওসব লোকদেখানো। আসলে অন্য সম্পর্ক আছে।
—আমি বারবার ওকে বারণ করতাম দিগ্বিজয়ের সঙ্গে কথা বলতে। রীতা শুনত না। তর্ক করত। বলত, ‘বিনা কারণে কথা বন্ধ করব কেন?’ শুনে খুন চেপে যেত মাথায়।
প্রতি সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে মেয়েদের কাউকে না কাউকে আড়ালে ডেকে জিজ্ঞেস করতেন বীরেশ, ‘আজ দিগ্গিচাচা ঘরে এসেছিল? মা ওঘরে গিয়েছিল? গল্প করতে দেখেছিস?’
সন্দেহ ক্রমে জিঘাংসায় পরিণত হওয়া যদি খুনের প্রথম কারণ হয়, দ্বিতীয় ছিল উপর্যুপরি পাঁচ কন্যাসন্তানের জন্ম। দুর্ভাগা দেশ আমাদের, ছেলে কেন হচ্ছে না, সন্তান প্রসবের পর প্রতিবারই এ নিয়ে বীরেশ কাঠগড়ায় তুলতেন রীতাকে। চতুর্থবার যখন যমজ কন্যাসন্তান ভূমিষ্ঠ হল, বীরেশের ধৈর্য বিদ্রোহ করল।
—স্যার, ঘুম আসত না রাতের পর রাত। সামান্য ব্যবসা করি, কীভাবে বিয়ে দেব
পাঁচ-পাঁচটা মেয়ের? আর রাগ হত রীতার উপর। পাঁচটাই মেয়ে, একটা ছেলে হতে পারত না?
পালটা কী-ই বা বলা যেত প্রস্তরযুগীয় মানসিকতায় আচ্ছন্ন এই অল্পশিক্ষিত যুবককে? পৃথ্বীরাজ পরের প্রশ্নে গিয়েছিলেন।
—স্ত্রীকে মারলেন কেন, বুঝলাম। কিন্তু নিজের বাচ্চা মেয়েগুলোকে ওভাবে …
কথা শেষ করতে দেন না বীরেশ।
—আমি আর পারছিলাম না বউ আর পাঁচ-পাঁচটা মেয়ের বোঝা টানতে। আর, নিজের বাচ্চা কে বলল স্যার? নিজের কিনা সেটা নিয়েই ধন্দে থাকতাম সবসময়।
পৃথ্বীরাজ বোঝেন, এই লোকের সঙ্গে তর্ক বৃথা। কথায় কথাই বাড়বে শুধু। তার চেয়ে বরং জিজ্ঞেস করা যাক সে-রাতের ঘটনাক্রম।
—আমি ঠিক করে ফেলেছিলাম স্যার, বউ-বাচ্চাদের তো মারবই, দিগ্বিজয়কেও বাঁচতে দেব না। কাঠের কাজ করি। নানা ধরনের ছুরি ব্যবহার করতে হয়। একটা ধারালো ছুরি বাড়িতে এনেছিলাম সেদিন। আর কিনে এনেছিলাম একপাতা ঘুমের বড়ি।
—কী বড়ি?
—ভ্যালিয়াম-৫ স্যার। ঘুমের ওষুধ তো প্রেসক্রিপশন ছাড়া ডাক্তাররা দিতে চাইবে না, জানতাম। এক বন্ধুর কাকা ডাক্তার ছিলেন। উলটোডাঙার কাছে চেম্বার। বন্ধুকে ধরলাম। ওর সঙ্গে গেলাম ডাক্তারবাবুর কাছে। বললাম, গত দু’সপ্তাহ ধরে রাতে ঘুম হচ্ছে না। অস্থির লাগছে সারাদিন। একটা উপায় করুন রাতে ঘুমোনোর। ডাক্তারবাবু প্রেশার দেখলেন। ঘুমের ওষুধ দিতে চাইছিলেন না। আমি খুব কাকুতিমিনতি করায় রাজি হলেন। ওষুধ কিনে বাড়ি ফিরলাম।
—তারপর?
—আমরা সকলেই রাতে দুধ খেয়ে শুতাম। রীতা যখন বাচ্চাদের জন্য বিছানা করছে, আমি ওর গ্লাসে দুটো ঘুমের বড়ি ফেলে দিলাম। বাচ্চাদের হাতে এক একটা করে বড়ি দিয়ে বললাম, এগুলো ভিটামিন ট্যাবলেট। ওরা চুপচাপ খেয়ে নিল। আমরা সাড়ে দশটা-পৌনে এগারোটা নাগাদ শুয়ে পড়লাম। আমি আর রীতা মেঝেতে শুতাম। মেয়েরা খাটে। আমি জেগে থাকলাম, কখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, তার অপেক্ষায়।
—বলতে থাকুন।
বীরেশ বলতে থাকলেন নির্বিকার। বর্ণনা থাকুক তাঁরই বয়ানে, একটানা।
—ওরা সবাই ঘুমিয়ে পড়ল কিছুক্ষণ পরেই। আমি উঠলাম। সব ঠিক করে রেখেছিলাম আগে থেকেই। প্রথমে রীতাকে মারলাম। উলের চাদর ছিল একটা ওর। আলনায় রাখা ছিল। সেটা দিয়ে ফাঁস দিলাম গলায়। নাকের কাছে হাত নিয়ে গিয়ে দেখলাম, নিশ্বাস পড়ছে না।
খাটে উঠলাম এবার। আমাদের খাটটা ঘরের ডানদিকের দেওয়ালে লাগানো ছিল। একদম বাঁদিকে রিমা শুত। বড়মেয়ে। ওকে মারলাম ওরই ওড়নার ফাঁস দিয়ে।
তারপর প্রীতি, মেজো। কয়েকদিন হল একটু ঠান্ডা লেগেছিল ওর। গলায় মাফলার ছিল। ওটাই চেপে ধরলাম গলায়।
প্রীতির পাশে ছিল স্মৃতি। পাশ ফিরে শুয়েছিল। ঘুমে কাদা, সোজা করে দিলাম। আলনায় রাখা মাফলার দিয়ে গলাটা চেপে ধরলাম।
দেওয়ালের দিকে পাশাপাশি শুত শ্বেতা আর ভাবনা। যমজ ওরা। বড়মেয়ে রিমার ওড়নাগুলোর কয়েকটা রাখা থাকত আলনায়, কয়েকটা ঝুলত দরজার হুকে। দুটো ওড়না নিলাম। তাই দিয়ে প্রথমে শ্বেতা। তারপর ভাবনা। তারপর ছুরিটা নিয়ে দিগ্বিজয়ের ঘরে নক করলাম।…
এবার বীরেশকে থামিয়ে দেন পৃথ্বীরাজ। স্ত্রী-সন্তানদের হত্যার এই নিস্পৃহ ধারাবিবরণী একটানা শোনা দুঃসাধ্য হয়ে উঠছিল। কেস ডায়েরি লেখার প্রয়োজনে প্রায়ই দেখতে হয় বাচ্চাগুলোর মৃতদেহের ছবি। যতবার দেখেন, কান্না জমে গলার কাছে। আর এ বাবা হয়ে কী অনায়াসে বলে যাচ্ছে!
কেসের কিনারা হয়ে গেছে। অপরাধী ধরা পড়ে গেছে। তবু যে প্রশ্নের উত্তর না পেলেই নয়, সেটা করেই ফেলেন পৃথ্বীরাজ। পারা যাচ্ছিল না আর।
—সন্দেহ করতেন স্ত্রীকে, বুঝলাম। কিন্তু বাচ্চাগুলো তো কোনও দোষ করেনি। ওদের এভাবে মেরে ফেললেন ঘুমের মধ্যে? একটুও কষ্ট হল না? আর মারলেনই যদি, স্বীকারোক্তি লিখে গেলেন কেন? আজ নয় কাল, আমরা তো ধরতামই আপনাকে।
আবেগের ন্যূনতম বহিঃপ্রকাশ ছিল না বীরেশের উত্তরে।
—স্বীকারোক্তিটা ঝোঁকের মাথায় লিখেছি। ওটা উচিত হয়নি। আর মেয়েগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেই বা কী লাভ হত স্যার? আমি তো ভেবেছিলাম, বিহারে পাকাপাকিভাবে পালিয়ে যাব। ব্যবসা করব কিছু। কী লাভ হত ওদের বাঁচিয়ে রেখে? কে দেখত ওদের? দাদার নিজের সংসার ছিল, সম্ভব হত না পাঁচটা মেয়ের ভার নেওয়া। বেঁচে থাকলে ওদের অসুবিধেই হত। উপায় ছিল না এ ছাড়া। তা ছাড়া ওই যে বললাম, আমারই যে মেয়ে সেটাই তো…
আর সহ্য করতে পারেন না পৃথ্বীরাজ, ফের থামিয়ে দেন বীরেশকে। বোঝেন, এই লোক বাহ্যত সুস্থ, আসলে গভীর মনোবিকারগ্রস্ত। পরকীয়াজনিত সন্দেহে স্বামী খুন করেছে স্ত্রীকে, এমন ঘটনা অনেকই ঘটে। কিন্তু স্ত্রী এবং পাঁচটা নিষ্পাপ মেয়েকে এভাবে প্ল্যান করে মারার পরও কীভাবে কেউ সেই নিধনবৃত্তান্ত শোনাতে পারে নির্বিকার? কথাবার্তায় না আছে লেশমাত্র অনুতাপ, না আছে শোকের সামান্যতম চিহ্ন।
চার্জশিট পেশ করলেন পৃথ্বীরাজ। দিগ্বিজয়কে ছুরি মারার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন দু’জন। দিগ্বিজয় স্বয়ং, আর তাঁর ছেলে কৌশল। দিগ্বিজয় ভয়ংকর জখম হয়েও প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন দ্রুত চিকিৎসা শুরু হওয়ায়। বীরেশের পালানোর সাক্ষী ছিলেন দুই প্রতিবেশী, সত্যদেও আর রামচল। বীরেশের হাতের লেখার নমুনার সঙ্গে মিলে গিয়েছিল স্বীকারোক্তির চিরকুটের হস্তাক্ষর। প্যাসেজে পড়ে থাকা রক্তমাখা ছুরিতে পাওয়া গিয়েছিল বীরেশের আঙুলের ছাপ। বাড়ির পিছনের উঠোন থেকে উদ্ধার হয়েছিল ভ্যালিয়াম ৫-এর খালি স্ট্রিপ। যে ওষুধের দোকান থেকে বীরেশ কিনেছিলেন ওষুধ, সেই ‘Popular Drug House’-এর দোকানদার চিহ্নিত করেছিলেন অভিযুক্তকে।
জাল কেটে বেরনোর রাস্তা ছিল না। বীরেশ তবু আদালতে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছিলেন পুলিশকে দেওয়া বয়ান। জোরগলায় দাবি করেছিলেন আগাগোড়া, ‘আমি নির্দোষ।’ সমস্ত প্রমাণ বিপক্ষে, তবু একচুলও নড়েননি সে দাবি থেকে।
বিচারসিদ্ধান্তের আনুগত্য থাকে শুধু প্রমাণের প্রতি। অভিযুক্তের সারবত্তাহীন দাবির প্রতি নয়। ধোপে টেকেনি বীরেশের দাবি, দায়রা আদালত দীর্ঘ বিচারপর্বের পর ২০০৬ সালে বীরেশকে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন। যাবজ্জীবন কারাবাস, না ফাঁসি, জল্পনা তুঙ্গে উঠেছিল সেসময়।
বিচারক সরাসরি প্রশ্ন করেছিলেন বীরেশকে, ‘যা অপরাধ করেছেন, কী সাজা হওয়া উচিত বলে মনে হয় আপনার?’ বীরেশ বলেছিলেন ‘আমার বয়স এখন ৪৬। আমার কোনওরকম অপরাধের কোনও অতীত রেকর্ড নেই। আপনি যদি মনে করেন ফাঁসি দেবেন, দিন। আমি বারবার বলে এসেছি, আমি নির্দোষ। এখনও তাই বলছি।’
ফাঁসি হয়নি। সাজা হয়েছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের। হাইকোর্টে সাজা রদের আবেদন করেছিলেন বীরেশ। লাভ হয়নি। শাস্তি বহাল থেকেছিল।
অপরাধ-মনস্তত্ত্ব নিয়ে বিশ্বজুড়ে কত যে গবেষণা হয়ে এসেছে কয়েক শতক ধরে, কত যে নতুন চিন্তাপ্রবাহ প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করে চলেছে অপরাধবিজ্ঞানকে, হিসেব রাখা কঠিন। আমার-আপনার থেকে কোথায় কতটা আলাদা ভয়ংকর অপরাধীদের মস্তিষ্কের গঠন, ব্রেনের আকৃতির তারতম্য কীভাবে আলাদা করে দেয় সামান্য ছিঁচকে চোরের সঙ্গে সিরিয়াল কিলারের মনোজগতের, সে নিয়ে বিদগ্ধ অধ্যয়ন জারি রয়েছে দেশে-বিদেশে।
তবে কিনা, বিষয়টা তো দিনের শেষে মন। কে আর কবে মনের পাসওয়ার্ড সম্পূর্ণ ভেদ করতে পেরেছে গবেষণায়-আলোচনায়-পরীক্ষানিরীক্ষায়? আর এ তো বিরল অপরাধীর মন, যেখানে সন্দেহের বীজ সযত্ন পরিচর্যায় ক্রমশ আক্রোশের মহীরুহে পরিণত হয়। এবং ঘটে যায় এমন অপরাধ, যা লজ্জায় ফেলবে সুদূরতম কল্পনাকেও। কী উপাদানে তৈরি হয় বীরেশ পোদ্দারদের মনোজগৎ? যা প্ররোচিত করে ঠান্ডা মাথার পরিকল্পনায় অচিন্তনীয় অপরাধে, বাধ্য করে অপরাধের স্বীকারোক্তি-লিখনে, এবং আইনের কাছে পরাভূত হওয়ার প্রাক্কালে সেই স্বীকারোক্তিকেই নির্দ্বিধায় খণ্ডনে?
এই লেখা লিখতে গিয়ে মনে হয়েছে বারবার, হয়তো পড়তে পড়তে আপনাদেরও, কিছু অপরাধ তোয়াক্কা করে না ব্যাখ্যার। কিছু অপরাধী হেলায় অগ্রাহ্য করে বিশ্লেষণকে, স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধিকে।
সে আপনি যতই গভীরে যান। এই বুঝি তল পাবেন, ফের হারাবেন।