২.০১ ডক্টর জেকিল, না মিস্টার হাইড?

ডক্টর জেকিল, না মিস্টার হাইড?
[রোশনলাল মামলা
একাধিক অফিসার যুক্ত ছিলেন। প্রাপ্ত নথি থেকে নিশ্চিতভাবে যাঁদের নাম জানা যায় না।]

—‘কেয়া ফেকতা হ্যায় বাবু? কেয়া ফেকতা হ্যায়?’

দৃশ্যটা দেখে সহসা থমকে গিয়েছিলেন ত্রিলোচন। কম দিন তো হল না এ তল্লাটে। এই জায়গাটা বরাবরই নির্জন। আজ যেন একটু বেশিই শুনশান, হাঁটতে হাঁটতেই মনে হয়েছিল ত্রিলোচনের। গত রাতের তুলকালাম বৃষ্টির জন্য? লোক একটু কম যেন? অন্তত অন্যদিনের তুলনায়?

দক্ষিণ কলকাতার বহুপরিচিত সরোবর-প্রাঙ্গণ। সাধারণের কথ্যভাষায়, লেক। যেখানে দৈনিক প্রাতঃভ্রমণে আসেন নগরবাসীরা। যাঁদের স্বাস্থ্যরক্ষার তাগিদের সাক্ষী থাকাটা একরকম অভ্যাসেই পরিণত হয়েছে ত্রিলোচনের।

আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে লেক এলাকার নিরাপত্তারক্ষীর চাকরিটা পেয়েছিলেন। সেই থেকে একই রুটিন দৈনন্দিন। সূর্য আড়মোড়া ভাঙতে না ভাঙতেই বেরিয়ে পড়া, লেকের বিস্তীর্ণ এলাকায় পাক দেওয়া পদব্রজে। দিনের পর দিন একই কাজ একই রাস্তায় বছরের পর বছর করে গেলে যা হয়, চোখ বেঁধে দিলেও এই রোজকার টহলদারি মোটেই কষ্টসাধ্য হবে না, জানেন ত্রিলোচন।

যেখানে থমকে গেলেন ত্রিলোচন, সেই জায়গাটা লেকের এক প্রান্তে। এই সীমা পর্যন্ত খুব স্বল্পসংখ্যক হাতেগোনা মানুষই আসেন। বস্তুত, সচরাচর কেউ আসেনই না এতদূর। সংগত কারণ ছিল ত্রিলোচনের অবাক হওয়ার। উনি কে? ওই ভদ্রলোক? বেঞ্চে বসেছিলেন এক মহিলার পাশে। হঠাৎ উঠে এদিক-ওদিক তাকালেন, হাতে একটা বড় চটের ব্যাগ নিয়ে দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেলেন লেকের ধারে। ফের সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন চারপাশে।

ব্যাগটা ফেলতে যাচ্ছেন জলে? ভদ্রলোক ওভাবে চারদিক দেখছেন কেন? উদ্বেগ কেন এত চোখেমুখে? কী ফেলতে যাচ্ছেন? কী আছে ব্যাগে? ত্রিলোচন থমকান দেখে। সন্দেহ হয়। হাঁক দেন বাজখাঁই গলায়, ‘কেয়া ফেকতা হ্যায় বাবু, কেয়া ফেকতা হ্যায়?’

‘ওরে বাবা দেখ চেয়ে, কত সেনা চলেছে সমরে!’

এ দৃশ্য আগে দেখেছে কলকাতা? স্রেফ একটা মামলার জন্য এহেন যুদ্ধং দেহি সাজ? টগবগ টগবগ ধ্বনি আলিপুর আদালতের সামনের রাস্তা জাজেস কোর্ট রোডে। ঘোড়াপুলিশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রাজপথে। সন্ত্রস্ত পথচারীরা দেখছে নিরাপদ দূরত্ব থেকে। পুলিশের গাড়ি এসে থামছে একে একে। আদালত প্রাঙ্গণে ‘পজিশন’ নিচ্ছেন উর্দিধারীরা। আজ রায় ঘোষণা হবে। ‘জাজমেন্ট ডে’।

‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই’ অবস্থা এজলাসে। বাইরের রাস্তাও জনাকীর্ণ। আরও অনেকে ঢুকতে চান, দেখতে চান, শুনতে চান। কোর্ট চত্বরের মূল প্রবেশপথ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে পুলিশ। লালবাজারের তরফে পূর্ণাঙ্গ পুলিশি বন্দোবস্ত করা হয়েছে শ’য়ে শ’য়ে উৎসাহী জনতাকে দূরবর্তী রাখতে। দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে নেহাতই স্বল্পপরিসরের ওই এজলাস, অবাধ প্রবেশের অনুমতি দেওয়া মানে অনর্থকেই আমন্ত্রণ।

তর সইছে না জনতার। সত্যি কথা বলতে, পুলিশেরও। আর কত দেরি? যখন বিচারক পড়তে শুরু করলেন দীর্ঘ রায়, অনন্ত অপেক্ষার পর যখন পৌঁছলেন শাস্তিদানের অনুচ্ছেদে, এজলাসের দখল নিয়েছে পিনপতন নীরবতা। বেলা তখন প্রায় দ্বিপ্রহর।

‘Taking into account the facts and circumstances of the case…’

এ কাহিনি প্রায় সত্তর বছর আগের। সন ১৯৪৮, স্বাধীনতার সঙ্গে তখনও আলাপ-পরিচয়ের পর্ব চলছে দেশের।

রহস্যভেদের রোমান্স-রোমাঞ্চ অমিল এ আখ্যানে। তবু আলোচ্য মামলার মতো চাঞ্চল্যকর এবং বহুচর্চিত কেস এদেশের অপরাধ-ইতিহাসে খুব বেশি নেই।

পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে যাঁরা অশীতিপর, তাঁদের স্মরণে থাকলেও থাকতে পারে এই মামলা। স্মরণে থাকতে পারে ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে সমসাময়িক জল্পনা-কল্পনা-চৰ্চার তীব্রতা। শুধু সমসময়ই বা লিখি কেন, দেশের বিভিন্ন পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আজও যখনই আলোচিত হয় স্বাধীনোত্তর যুগের সাড়া-জাগানো মামলাগুলির ইতিবৃত্ত, অবধারিত উল্লেখিত হয় সাত দশক আগের এই ঘটনা।

সমস্যা হল, মামলার বিস্তারিত নথিপত্রের অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে সময়ের প্রকোপে। একাধিক অফিসার বিভিন্ন পর্যায়ে তদন্তের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। যাঁদের কয়েকজনের নাম নির্দিষ্ট ভাবে জানা যায় না। যতটুকু জানা যায় এই মামলা নিয়ে পত্র-পত্রিকায় পদস্থ অফিসারদের লেখালেখি থেকে, যতটুকু উদ্ধার করা যায় শতচ্ছিন্ন কেস ডায়েরির হলুদ হয়ে-আসা পাতাগুলির পাঠযোগ্য অংশ থেকে, পেশ করলাম।

কৃষ্ণহরি শর্মা। বয়স যখন কুড়ি, দার্জিলিং জেলার আর্মড পুলিশে যোগ দিয়েছিলেন। বিয়ে করেছিলেন তারও বছর তিনেক পরে। যশোদাদেবীকে। এই দম্পতির তিন সন্তান। দুই মেয়ে, এক ছেলে। বড়মেয়ের নাম মণি। ছোটমেয়ে বেলা। সবার ছোট হল অমল।

দীর্ঘ কর্মজীবনের মধ্যভাগে কৃষ্ণহরিকে গ্রাস করল বিবিধ রোগব্যাধি। ১৯৪১-এ যখন মারা গেলেন, বড়মেয়ে মণি তখন একুশ বছরের সুন্দরী যুবতী। দার্জিলিংয়ে কলেজের পাট চোকার পর নার্সিং কোর্সে ভরতি হয়েছেন সদ্য। ছোটমেয়ে বেলা তখন উনিশ। অমলের সবে ষোলো পেরিয়েছে।

স্বামীর মৃত্যুর পর সপরিবারে কলকাতায় চলে এলেন যশোদা। কলকাতায় যশোদার এক বোন থাকতেন। নাম ডলি। যাঁর বিয়ে হয়েছিল কিরণ দে নামের এক বঙ্গসন্তানের সঙ্গে। সম্ভ্রান্তবংশীয় কিরণ পদস্থ চাকুরে ছিলেন। সানন্দে আশ্রয় দিয়েছিলেন যশোদা এবং তাঁর তিন সন্তানকে। অমল এবং বেলা কলকাতার কলেজে ভরতি হল। মণির নার্সিং-এর পড়াশুনো চালু হল নতুন উদ্যমে। বঙ্গীয় জীবনধারার সঙ্গে দ্রুত অভ্যস্ত হয়ে উঠলেন যশোদা। মণি-বেলা-অমলও।

নিরুদ্বেগ জীবন কাটল কয়েক বছর। উদ্বেগের সূত্রপাত হল ১৯৪৬ সালে, যখন অমলের ফুসফুসে ধরা পড়ল যক্ষ্মা রোগের সংক্রমণ। যাদবপুর হাসপাতালে চিকিৎসায় অমলের কিছুটা স্বাস্থ্যোদ্ধার হওয়ায় যশোদা কিঞ্চিৎ স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন বটে, কিন্তু সে স্বস্তি স্থায়ী হল স্বল্পকালই। ’৪৬-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বেঘোরে প্রাণ হারালেন কলেজপড়ুয়া অমল। একমাত্র পুত্রের অকালমৃত্যুতে যশোদা সাময়িক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। মণি এবং বেলা আপ্রাণ শুশ্রূষায় ক্রমে স্বাভাবিকতায় ফেরালেন মা-কে।

যশোদার বোন ডলি এর কিছুদিন পরেই মারা গেলেন মাত্র সপ্তাহখানেকের জ্বরে। মানসিকভাবে আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন যশোদা। ডলির স্বামী কিরণ আদ্যন্ত ভদ্রলোক ছিলেন। মুখে কখনও কিছু বলেননি, তবে ডলির মৃত্যুর পর আশ্রিতা হয়ে সপরিবারে তাঁর বাড়িতে বসবাস করার অস্বস্তি ক্রমে গ্রাস করল যশোদাকে। কিন্তু গেলেও যাবেনই বা কোথায়? কে জায়গা দেবে সপরিবারে দুই মেয়েকে নিয়ে থাকার? বাড়ি ভাড়া করে থাকার মতো আর্থিক সংগতি নেই। নিরুপায় আশ্রিতার দিনগত পাপক্ষয়কেই ভবিতব্য মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কী আর?

’৪৬ সালেরই শেষ দিকে আলিপুর মিলিটারি হাসপাতালে নার্সের চাকরি পেলেন মণি। বেতন ভদ্রস্থ। যশোদা ভাবলেন, মানসিক কষ্ট কমাটা দুষ্কর, অন্তত অর্থকষ্টটা এবার কিছুটা কমবে।

মিলিটারি হাসপাতালে ইএনটি বিভাগে নার্স হিসাবে নিযুক্ত হলেন মণি। ওই বিভাগের দায়িত্বে তখন মেজর রোশনলাল সিং। মণি প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়লেন আপাদমস্তক, রোশনলালের চোখে দেখলেন নিজের সর্বনাশ।

দোষ দেওয়া যায় না মণিকে। একটা অমোঘ আবেদন ছিল রোশনলালের ব্যক্তিত্বে, যার চৌম্বকীয় আকর্ষণ উপেক্ষা করা কঠিন হত মেয়েদের পক্ষে। কাহিনি আরও অগ্রসর হওয়ার আগে, আসুন, আলাপ করিয়ে দিই রোশনলালের সঙ্গে।

রাজা রোশনলাল সিং সুয়েজভান— পুরো নাম। কাশ্মীরের মহারাজা সুয়েজভান সিং-এর বংশজাত। বরাবরই প্রখর মেধাবী। সসম্মানে ডাক্তারি পাশ করার পর যুবক রোশনলাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যোগ দিয়েছিলেন Indian Army Medical Corps-এ। অসামান্য কর্মদক্ষতা পথ সুগম করেছিল দ্রুত পদোন্নতির। ডাক্তার রোশনলাল মেজর পদে উন্নীত হয়েছিলেন ১৯৪৬ সালে। কলকাতার আলিপুরে সেনাবাহিনীর হাসপাতালে E. N. T. বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছিলেন।

রোশনলালের চরিত্রের কাটাছেঁড়ায় মনে পড়তে বাধ্য ১৮৮৬ সালে রচিত রবার্ট লুইস স্টিভেনসনের সেই কালজয়ী উপন্যাস, ‘Strange Case of Dr. Jekyll and Mr. Hyde’।

Dr. Henry Jekyll, শান্ত, ধীরস্থির, হৃদয়বান এক চিকিৎসক। যিনি দিনের বেলায় সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, কিন্তু এক রাসায়নিক তরলের প্রভাবে রাত্রিবেলা জেগে ওঠে যাঁর অন্য সত্তা। Dr. Jekyll হয়ে ওঠেন Mr. Edward Hyde, যিনি স্বভাবে-আচারে-আচরণে Dr. Jekyll-এর সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে। নৃশংস-বিবেকবর্জিত-দয়ামায়াহীন এক খুনি। একই মানুষ, দ্বৈত সত্তা।

রোশনলালও ছিলেন তা-ই। এক গবেষণাযোগ্য চরিত্র। একই অঙ্গে দ্বৈত রূপ। দীর্ঘদেহী সুঠাম চেহারার তরুণ ডাক্তার। সুদর্শন। চশমার পিছনে বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চোখ। চলনে-বলনে-পোশাকে-আশাকে দৃশ্যমান, রাজরক্ত বইছে এই লোকটির শরীরে।

এক একজন থাকেন, যে-কোনও সামাজিক সমাবেশে হাজির হলেই সব আলো কেড়ে নেন অবলীলায়। রোশনলাল ছিলেন সেই গোত্রের। সাহিত্য বলুন বা বিজ্ঞান, দর্শন বলুন বা নৃতত্ত্ব, যে-কোনও বিষয়ে পাণ্ডিত্য ছিল প্রশ্নাতীত। যখন কথা বলতেন মার্জিত বাচনভঙ্গিতে, লোকে শুনত মন্ত্রমুগ্ধ। যখন রোগীর চিকিৎসায় নাওয়া-খাওয়া ভুলে হাসপাতালে কাটিয়ে দিতেন রাতের পর রাত, সহকর্মীদের শ্রদ্ধা-সম্ভ্রম কুড়িয়ে নিতেন অনায়াসে।

নিজের লেটারহেডে ছাপিয়ে রেখেছিলেন, ‘Worship God by servicing the ailing humanity’। দুঃস্থ মানুষকে দানধ্যান করতেন নিয়মিত। মদ-সিগারেটের সঙ্গে কোনওরকম সংস্রব ছিল না নিত্যদিন পূজাপাঠ করা রোশনলালের। হুবহু ড. জেকিল। যাঁর প্রেমে না পড়ে উপায় ছিল না মণির। জানতেন না প্রেমিকপুরুষের দ্বৈতসত্তার কথা। যখন জেনেছিলেন, দেরি হয়ে গিয়েছিল বিস্তর।

মণির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ল রোশনলালের। মানসিক এবং শারীরিক। ’৪৬-এর ডিসেম্বরে মণি সন্তানসম্ভবা হলেন। এবং রোশনলালকে বললেন, ‘এবার বিয়েটা করে নেওয়া দরকার।’ যখন বলেছিলেন, জানতেন না রোশনলালের গোপন করে যাওয়া দুটি তথ্য। এক, রোশনলাল বিবাহিত। স্ত্রী-র নাম কৌশল্যা। দুই, ওঁদের একটি পুত্রসন্তানও বর্তমান। নাম, সুদর্শন কুমার।

মণির বিবাহ-প্রস্তাবে রোশনলাল রাজি হলেন এক কথায়। নির্দিষ্ট দিনে এক বন্ধুর বাড়িতে উপস্থিত হলেন মণিকে নিয়ে। এক পুরোহিত বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ করলেন, সাক্ষী রইল অগ্নিকুণ্ড। মণি যারপরনাই অবাক হলেন বৈবাহিক ক্রিয়াকর্মের রীতিনীতিতে। আত্মীয়স্বজনের বিয়েতে আশৈশব দেখে এসেছেন হিন্দু ধর্মমতে বিয়ের পরিচিত আচারবিধি। এ তো আলাদা সম্পূর্ণ!

রোশনলাল স্মিতহাস্যে জানালেন, হিন্দুমতে বিবাহের আয়োজন যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ। ব্যয়বহুলও। তার চেয়ে আপাতত এই ভাল। আর্যসমাজ মতে এভাবেই হয় বৈবাহিক প্রক্রিয়া। মণি তখন মোহাচ্ছন্ন রোশনলালের প্রেমে। প্রিয়তম পুরুষের প্রতি সন্দেহের ন্যূনতম অবকাশই নেই।

মণি যখন প্রশ্ন করলেন বিয়ের আইনসিদ্ধ রেজিস্ট্রি নিয়ে, রোশনলাল ফের সহাস্যে বললেন, ‘ওটা তো যে-কোনওদিন করে নেওয়া যাবে। সত্যি বলো তো, তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো না?’ আবেগবিহ্বল মণি আনন্দাশ্রু ব্যয় করলেন কিছু। সমর্পণ সম্পূর্ণ হল।

পরের বছর, ’৪৭-এ জন্ম হল রোশনলাল-মণি-র শিশুপুত্রের। নাম রাখা হল মুন্না। ’৪৮-এ ফের গর্ভবতী হলেন মণি। এবার কন্যাসন্তান। মুন্নি। ’৪৭-এর মাঝামাঝি রোশনলাল ফ্ল্যাট ভাড়া করলেন ৪/ডি মতিলাল

নেহরু রোডে একটি বাড়ির চারতলায়। যশোদা-মণি-বেলা উঠে এলেন দেশপ্রিয় পার্কের থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বের

সেই ফ্ল্যাটে। পরাশ্রিত থাকার থেকে মেয়ে-জামাইয়ের সংসারে দিনাতিপাতই শ্রেয়তর মনে করলেন যশোদা।

রোশন-মণির সম্পর্কে চিড় ধরা শুরু দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের কিছুকাল পর থেকে। মণির সঙ্গে রোশনলাল ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন স্রেফ শরীরী আকর্ষণে। মন ছিল বহু আলোকবর্ষ দূরে। আর্যসমাজ মতে বিয়ের ছদ্মচিত্রনাট্য সাজিয়েছিলেন মণি সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ায়।

মানসিক সংযোগ না থাকলে ‘আদিম রিপু’-র তাড়না একটা সময় স্তিমিত হয়ে আসেই। শরীরী মোহ কাটিয়ে ওঠার পরই নিজমূর্তি ধরলেন রোশনলাল। বদলির নির্দেশ এল রাঁচির নামকুম হাসপাতালে। মণি এবং দুই সন্তানকে নিয়ে পাড়ি দিলেন রাঁচি। যেখানে অন্য রোশনলালকে চিনতে শুরু করলেন মণি। যিনি আর ডক্টর জেকিল নন। সর্বার্থেই মিস্টার হাইড।

প্রতি পদে রোশনলাল বুঝিয়ে দিতে লাগলেন, মাঝে মাঝে শরীরী চাহিদা মেটানোর ভোগ্যবস্তুর বেশি মর্যাদা তিনি মণিকে দিতে নারাজ। মণি যখনই বিয়ের রেজিস্ট্রির কথা তুলতেন, নির্বিচার গালিগালাজ করতেন রোশনলাল। সমাজের চোখে সুভদ্র হিসাবে পরিচিত ডাক্তারবাবুর মুখ থেকে অকথা-কুকথার বন্যা বয়ে যেত। কথায় কথায় মণির গায়ে হাত তোলা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল রোশনলালের। একটা পর্যায়ের পর মণি বুঝে গিয়েছিলেন, বিবাহিতা স্ত্রী-র স্বীকৃতি পাবেন না কোনওদিনই। কানাঘুষোয় শুনতেন অন্য একাধিক নারীর সঙ্গে স্বামীর ঘনিষ্ঠতার কথা। এমনও হত, রাতের পর রাত বাড়িই ফিরতেন না রোশনলাল। প্রশ্ন করলে বরাদ্দ থাকত উপেক্ষা এবং ঔদাসীন্য।

বিনিদ্র রাতে মণি চোখের জল ফেলতেন আর ভাবতেন, কী পরিচয়ে তা হলে দিন কাটাচ্ছেন রোশনলালের সঙ্গে? সোজা বাংলায়, রক্ষিতাই তো! জীবন কি এ ভাবেই কাটবে, অবহেলা-অনাদর-অত্যাচারের গ্লানি মুখ বুজে সহ্য করে? ছেলেমেয়ে এখনও দুধের শিশু। তাদের পরিচর্যার দায়িত্ব সামলে নার্সের চাকরির চেষ্টা করাটাও অসম্ভবের পর্যায়েই। আরও অসম্ভব, কারণ, এরই মধ্যে ফের সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়েছেন।

পরিস্থিতির চাপে দিশেহারা মণি দাঁতে দাঁত চেপে তবু মেনে নেওয়ার এবং মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেই যাচ্ছিলেন। এবং হয়তো করেই যেতেন, যদি না এক সন্ধেয় হঠাৎই দেখে ফেলতেন ওঁদের দু’জনকে।

বেশ কয়েক মাস ধরে পাওলিন নামের এক অতীব সুন্দরী মহিলার গলার সংক্রমণের চিকিৎসা করছিলেন রোশনলাল। রাঁচির টেলিফোন এক্সচেঞ্জে অপারেটরের কাজ করতেন তেইশ বছরের পাওলিন। মাঝেমধ্যে রোশন-মণির ফ্ল্যাটেও আসতেন। মুন্না-মুন্নির জন্য উপহার আনতেন। রান্না করেও আনতেন ভালমন্দ।

এমনই এক সন্ধেয় এসেছেন পাওলিন। ঘণ্টাদুয়েক গল্পগুজবের পর বেরলেন। রোশনলাল কিছুটা এগিয়ে দিতে গেলেন পাওলিনকে। বেশ কিছুক্ষণ পরও যখন ফিরলেন না, কৌতূহলবশত মণি বাইরের ঘরের জানালায় চোখ রাখলেন। এবং আধো অন্ধকারেও স্পষ্ট বুঝলেন, কোয়ার্টারের গেটের কাছে রোশনলাল আর পাওলিন পরস্পরের আলিঙ্গনবদ্ধ। দু’জনের ঠোঁটের মধ্যে ব্যবধান অন্তর্হিত।

সে-রাতে বাদানুবাদ হল রোশন-মণির। একটা সময় রোশনলাল নিরুত্তাপ গলায় বললেন, ‘পাওলিন আমার বোনের মতো। ভাই-বোনে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়ায় দোষের কিছু নেই। নিজের মান্ধাতার আমলের চিন্তাভাবনা বদলাও।’

স্বামীর এহেন ব্যাখ্যায় বাক্‌রুদ্ধ হয়ে গেলেন মণি। পরনারীতে রোশনলালের আসক্তির ব্যাপারে আন্দাজ করতেন মণি, সন্দেহও। কিন্তু নিজের ফ্ল্যাটের চৌহদ্দির মধ্যেই যখন চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন ঘটল, মণি মনস্থির করে ফেললেন।

পরের দিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে রওনা দিলেন কলকাতায়। উঠলেন মতিলাল নেহরু রোডের সেই ভাড়ার ফ্ল্যাটে, যেখানে যশোদাদেবী বসবাস করতেন ছোটমেয়ে বেলার সঙ্গে। মণির মুখে সব শুনলেন যশোদা। অদৃষ্টকে দোষারোপ আর অশ্রুপাত ছাড়া কী-ই বা করার ছিল প্রৌঢ়ার?

কূটবুদ্ধির অভাব আছে, রোশনলালের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ তাঁর চরম শত্রুর পক্ষেও করা অসম্ভব ছিল। মণি কলকাতায় ফিরে যাওয়ার পর ছক কষলেন বরফশীতল মস্তিষ্কে। অসম্ভব ইমেজ-সচেতন মানুষ ছিলেন রোশনলাল। জানতেন, মণি যদি তাঁর কীর্তিকলাপের ব্যাপারে আলোচনা করেন পরিচিত মহলে, সামাজিক প্রতিপত্তিতে আঁচড় পড়তে পারে। তাই মণির আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখাটাই আপাতত প্রধান কর্তব্য বলে স্থির করলেন। দুটো চিঠি লিখলেন মণিকে। পাঁচ দিনের ব্যবধানে। অগস্টের ১৪ এবং ১৯ তারিখে। যা লিখলেন, তুলে দিচ্ছি অংশবিশেষ।

১৪.০৮.৪৮

‘প্রিয়তমা মণি,

… তুমিই আমার জীবন, আমার সব কিছু। তুমি আমাকে চিঠি লিখছ না কেন? তোমার চিঠি না পেলে আমার নিজেকে শূন্য মনে হয়। ডার্লিং প্লিজ়, এবারের মতো আমায় মাফ করে দাও। দেখবে, আমি অনেক বদলে গেছি। ভুল বুঝো না আমায়। তোমার কোনওরকম ক্ষতি হয় এমন কাজ আমি কখনও করব না। মন থেকে প্লিজ় সমস্ত সন্দেহ দূর করে দাও… দেখবে আমরা আগের মতো সুখী জীবন কাটাতে পারব। আমাদের তৃতীয় সন্তান কিছুদিন পরেই পৃথিবীতে আসতে চলেছে। অন্তত তার কথা ভেবে সমস্ত ভুল বোঝাবুঝিকে চলো মুছে ফেলি আমরা…

তোমার রোশন’

১৯.০৮.৪৮

‘ডার্লিং,

…তোমাকে আমি আর কতবার বলব যে আমি তোমাকে মিথ্যে বলার কথা ভাবতেও পারি না। আমি তোমাকে কখনও ঠকাব না। আমি তোমাকে ভালবাসি… এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভালবাসব।

আচ্ছা, তোমার কি মনে হয় যে বিয়েতে রেজিস্ট্রিটাই সব? বিয়ের আসল জিনিস তো ভালবাসা। রেজিস্ট্রি বিয়েতে স্বামী-স্ত্রী একে অন্যকে ছেড়ে চলে যেতে পারে, ডিভোর্স করতে পারে। কিন্তু প্রকৃত ভালবাসার যে বিয়ে, তাতে কখনও ছাড়াছাড়ি হয় না। আমার কথাগুলো মন দিয়ে ভেবে দেখো।

তোমারই রোশন’

এই কুম্ভীরাশ্রুতে যে বিশেষ বরফ গলছে না, বুঝতে পারছিলেন রোশনলাল। একটি চিঠিরও উত্তর দিচ্ছিলেন না মণি। এবং উদ্বেগ বাড়ছিল রোশনলালের। সিদ্ধান্ত নিলেন কলকাতায় আসার। রাঁচির সেনা হাসপাতালের চাকরিটা ছাড়লেন। কলকাতায় এসে যোগ দিলেন লেক মিলিটারি হাসপাতালে। উঠলেন হাসপাতালের নির্দিষ্ট কোয়ার্টারেই। কলকাতায় পৌঁছনোর সন্ধেতেই গেলেন মতিলাল নেহরু রোডের ফ্ল্যাটে মণির সঙ্গে দেখা করতে। এবং বুঝলেন, যা আশঙ্কা করছিলেন, সত্যিই। এ মণি আর সেই মণি নয়, যিনি স্বামীর মিষ্টি কথার জাদুতে আগের মতো মোহাবিষ্ট হয়ে পড়বেন।

রোশনলালের প্রতি মণির ভালবাসা ছিল নিখাদ। স্বামীর বিশ্বাসভঙ্গে চিন্তাতীত আঘাত পেয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু সে আঘাত মণির মানসিক কাঠিন্যের বুনিয়াদ অনেকটাই পোক্ত করে দিয়েছিল। রোশনলালকে বললেন, প্রায় তিন বছর স্বামী-স্ত্রী হিসাবে একত্রে বসবাসের পর, দুই সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর এবং তৃতীয়বার সন্তানসম্ভবা হওয়ার পরও যদি বিয়েকে আইনি বৈধতা দেওয়া নিয়ে এতটা দ্বিধাগ্রস্ত থাকেন রোশনলাল, তা হলে তো এই সম্পর্কের কোনও মানেই দাঁড়ায় না। পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে এই অনাচারের বিচার চাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না আর। নিজের মানসম্মানের দায়িত্ব তখন রোশনলালকে নিজেকেই নিতে হবে।

রোশনলাল সব শুনলেন চুপ করে। এই প্রথম স্বামীর শরীরী ভাষায় অনুতাপের চিহ্ন দেখলেন মণি। দেখলেন, চোখ আর্দ্র হয়ে এসেছে রোশনলালের। মণিকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, ‘বেশ, তুমি যা চাইছ, তা-ই হোক। এতে যদি তুমি শান্তি পাও, তবে তা-ই হোক। আমি রেজিস্ট্রেশনের দিনক্ষণ ঠিক করছি। কাশ্মীরের বাড়িতে আজই টেলিগ্রাম করব। আমাদের রাজবাড়িতেই রেজিস্ট্রেশন হবে বিয়ের। তারপর ধুমধাম করে অনুষ্ঠান। তুমি শুধু আমাকে আগের মতোই ভালবেসো।’ শোনামাত্র মণি কেঁদে ফেললেন স্বামীর বুকে মাথা রেখে। প্রেম বড় বিষম বস্তু।

রোশনলাল ভক্তিনিষ্ঠ প্রণাম করলেন শাশুড়িকে। চোখের জল বাধা মানল না যশোদারও। দিদির মানসিক কষ্টের অবসানের সম্ভাবনায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন বেলাও।

দিনক্ষণ স্থির হল কাশ্মীর যাওয়ার। মণি যখন মা-কে প্রণাম করে বেরচ্ছেন রোশনলালের সঙ্গে, যশোদাদেবী ঘোরতর দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি, মেয়ের সঙ্গে এই তাঁর শেষ দেখা।

হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে রোশনলাল মণিকে বললেন, ‘চলো দু’-একদিনের জন্য পুরী ঘুরে আসি। সেখান থেকে কাশ্মীর যাব।’ হঠাৎ এই প্ল্যান পরিবর্তন? জানতে চাইলেন মণি। রোশন হাসলেন, ‘তুমি কি এখনও আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না? আমরা কোথাও কখনও একসঙ্গে বেড়াতে যাইনি। তাই ভাবলাম, দু’দিন সমুদ্রের ধারে একটু সময় কাটাই দু’জনে। আমি তোমাকে সারপ্রাইজ় দিতে চেয়েছিলাম। তুমি রাজি হবে না জানলে টিকিট কাটতাম না।’

মণি রাজি হলেন রোশনের কথায়। সন্দেহ হয়েছিল কি কিছু? হয়তো হয়েছিল। তবু রাজি হয়েছিলেন, বহুকাঙ্ক্ষিত রেজিস্ট্রেশনের ব্যাপারে পাছে মত বদলান রোশন, সেই আশঙ্কাতেই সম্ভবত। ট্রেনে উঠে বসলেন দু’জনে।

পুরী। আজকের পুরীর সঙ্গে সে-কালের পুরীর তফাত ছিল আকাশপাতাল। শহরের যত্রতত্র হোটেল গজিয়ে ওঠেনি গায়ে গা লাগিয়ে। হরেক পশরা সাজিয়ে তট বরাবর মাথা তোলেনি অসংখ্য দোকানপাট। পর্যটকদের ভিড়ে তখন অষ্টপ্রহর থইথই করত না সমুদ্রতট। নির্জনতাই নিরঙ্কুশ।

সমুদ্রের ধারেই একটি সাদামাটা ছিরিছাঁদহীন হোটেলে ঘর ভাড়া নিলেন রোশনলাল। হোটেলের রেজিস্টারে মিথ্যে নাম-ঠিকানা লিখলেন নিজের আর মণির।

সমুদ্রতীরে পাশাপাশি বসে সন্ধেটা দিব্যি কাটল দু’জনের। হোটেলে ফেরার আগে রোশন প্রস্তাব দিলেন, ‘চলো, একটু হেঁটে আসি।’

মণি তখন আট মাসের গর্ভবতী। বালিপথ ধরে হাঁটাহাঁটির ইচ্ছে ছিল না বিশেষ। তবু রোশনকে বিমুখ করতে মন চাইল না। স্বামীর হাত ধরে ধীরপায়ে হাঁটা দিলেন। যখন ফিরে আসছেন, পেটে ব্যথা শুরু হয়েছে তীব্র। রোশন যন্ত্রণাকাতর স্ত্রী-কে ভরসা দিলেন, ‘এ সময় এমন হয়। এই অবস্থায় এতটা না হাঁটলেই বোধহয় ভাল হত। আমারই দোষ। যাক গে, চিন্তা কোরো না। স্বামী যখন ডাক্তার, চিন্তা কীসের? হোটেলে ফিরেই ব্যথা কমার ওষুধ দিচ্ছি।’

ওষুধ দিলেন রোশনলাল। ডাক্তারি ব্যাগ থেকে বার করলেন ইনজেকশন। বিছানায় শুয়ে তখন যন্ত্রণায় ছটফট করছেন মণি, ‘কই, ওষুধটা দাও, খুব কষ্ট হচ্ছে!’ মণির হাতে সূচ ফোটালেন রোশনলাল। সূচ বেয়ে তরল প্রবেশ করল মণির শরীরে। ছড়িয়ে গেল শিরা-উপশিরায়। মরফিয়া!

রোশনলাল মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন মণির, ‘ওষুধ পড়েছে, দেখো এবার, যন্ত্রণা কমবে। ঘুম এসে যাবে।’

ঘুম এল মণির। গভীর ঘুম। রোশনলাল নিজের গলার স্কার্ফটা খুললেন। পেঁচিয়ে ধরলেন ঘুমন্ত মণির গলায়। সর্বশক্তি দিয়ে। শ্বাসরোধ করে খুন। একটা নয়, দুটো। মণির গর্ভস্থ সন্তানের দিনের আলো দেখার সময় তো হয়েই এসেছিল প্রায়।

রাত বাড়তে মণির দেহ একটা বেডশিটে মুড়ে বেরলেন ঘর থেকে। নিরাপত্তারক্ষীর বালাই থাকে না এসব সস্তার হোটেলে। অর্ধেক ঘরও খালি পড়ে থাকে। কেউ কারও খোঁজ রাখে না। নিরাপদে বেরিয়ে গেলেন গেট দিয়ে, দেহ পুঁতে দিলেন সমুদ্রতটে বালির স্তূপের নীচে। যেটা চিহ্নিত করে রেখেছিলেন বিকেলেই। মণির স্লিপার, চুড়ি, মুক্তোর নেকলেস এবং ইনজেকশনের সিরিঞ্জ ফেলে দিলেন হোটেল-সংলগ্ন একটা মজে যাওয়া কুয়োয়।

ফিরে এলেন ঘরে, এবং নিজের জিনিসপত্র নিয়ে সন্তর্পণে বেরিয়ে গেলেন হোটেল থেকে। রাত তখন সোয়া তিনটে। কোনও সাক্ষী থাকল না গভীর রাতের অন্তর্ধানের। সমুদ্র ছাড়া কে-ই বা জেগে থাকে ওই নিশুত রাতে?

রোশনলাল ফিরে এলেন কলকাতায়। মতিলাল নেহরু রোডের ফ্ল্যাটে গেলেন তারও সপ্তাহখানেক পরে। জামাইয়ের সঙ্গে মেয়েকে না দেখে যশোদা অবাক, ‘ভালয় ভালয় সব মিটে গেছে তো? মণি কই?’

—ওকে কাশ্মীরেই রেখে এলাম কিছুদিনের জন্য।

—কেন?

রোশনলাল বোঝানোর চেষ্টা করলেন যশোদাকে, যত শীঘ্র সম্ভব কলকাতায় ফিরিয়ে আনবেন মণিকে। বললেন, বিয়ের পর নববধূর মুখই দেখেননি তাঁর মা। তা ছাড়া মায়ের শরীরটা একেবারেই ভাল যাচ্ছে না। গিয়েই চলে এলে বড় বিসদৃশ দেখায়। শত হোক, রাজকুলবধূ, সামাজিকতারও দায় থাকে একটা। দায় থাকে আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে ন্যূনতম পরিচিতির।

দিনের পরে দিন যায়। সপ্তাহ যায়। আশঙ্কা আর অস্বস্তি ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠছিল যশোদার। একদিন রোশনলালকে চেপে ধরলেন, ‘মণিকে নিয়ে এসো এবার। আমার কিচ্ছু ভাল লাগছে না।’

—আর সপ্তাহখানেক পরে কাজের চাপ কমলেই নিয়ে আসব। আপনি অযথা চিন্তা করছেন। আমাদের বাড়িতে আপনার মেয়ের কোনও অযত্ন হবে না, নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

নিশ্চিন্ত থাকতে বললেই কি আর থাকা যায়? যশোদা পালটা প্রশ্ন করলেন, ‘বেশ তো, কিন্তু চিঠি লিখছে না কেন? এতদিন হয়ে গেল, একটা চিঠিও লিখবে না মেয়ে? সেই মেয়ে, যে মা-অন্ত প্রাণ একরত্তি বয়স থেকে?’

এ প্রশ্নের উত্থাপন একটা সময় অবধারিতই, বিলক্ষণ জানতেন রোশনলাল। প্রস্তুত রেখেছিলেন উত্তর।

—আসলে কী হয়েছে জানেন মা, কাশ্মীরের নিয়ম বাকি দেশের মতো নয়। ওখান থেকে ইংরেজি বা হিন্দিতে চিঠি পাঠানো যায় না। একমাত্র উর্দুতেই ও রাজ্য থেকে চিঠি পাঠানো যায়। মণির উর্দু শেখার ব্যবস্থা আমি করেই এসেছি এবার। ওখানের এক উর্দুর অধ্যাপক আমার বহুদিনের পরিচিত। উনি এক সপ্তাহ হল মণিকে উর্দু শেখানো শুরু করেছেন। চিঠি এল বলে।

যশোদা শুনলেন। এবং বিশ্বাস করার কণামাত্র কারণও খুঁজে পেলেন না। জামাতার বহুরূপী চরিত্র সম্পর্কে সম্যক ধারণা হয়ে গিয়েছে ততদিনে। সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরের থেকে যে ঘোর দূরবর্তী রোশনলালের অবস্থান, সেটা বুঝে গিয়েছিলেন। মুখের উপর মিথ্যেবাদী বলতে বাধে। যশোদা তাই বাক্যব্যয় করলেন না বিশেষ। রাত্রি গভীর হলে চিঠি লিখতে বসলেন ছোটভাই ভীমপ্রসাদকে। যাঁর জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল।

ভাইকে লেখা দিদির চিঠির অংশবিশেষ রইল।

স্নেহের ভীম,

আমার আশীর্বাদ নিয়ো। মণি দুই সপ্তাহ আগে রোশনলালের সঙ্গে কাশ্মীর গিয়েছিল। রোশন ন’দিন পরে ফিরে এসেছে মণিকে কাশ্মীরেই রেখে। মণি খুব অসুস্থ ছিল যাওয়ার সময়। আট মাস হয়ে গেছে গর্ভবতী। এখনও একটাও চিঠি লেখেনি। রোশন বলছে, উর্দু ভাষা ছাড়া ওখান থেকে চিঠি লেখা যায় না। আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। তুমি একটু গণনা করে তাড়াতাড়ি জানিয়ো, মণি কী অবস্থায় আছে, কেমন আছে? ও ভাল আছে তো? আমি খুব কষ্টে আছি। দিনরাত শুধু কাঁদি। খাওয়াদাওয়া ত্যাগ করেছি। তুমি তাড়াতাড়ি জানিয়ো গণনা করে, মণি কেমন আছে। খুবই দুশ্চিন্তায় সময় কাটছে। তোমার উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।

আশীর্বাদিকা দিদি

শাক দিয়ে মাছ ঢাকারও একটা সময়সীমা থাকে। সপ্তাহে দিনদুয়েক মনোহরপুকুর রোডের ফ্ল্যাটে এসে যথাসম্ভব স্বাভাবিক আচরণ করতেন রোশনলাল। এবং যখনই আসতেন, উদ্বিগ্ন যশোদা আকুল উৎকণ্ঠায় চেপে ধরতেন জামাতাকে, ‘মণিকে নিয়ে এসো এবার? বাচ্চার জন্মের সময় তো হয়ে এল।’ সন্দিগ্ধ বেলা প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করে দিতেন জামাইবাবুকে, ‘দিদি চিঠি লিখছে না কেন? দিদি ভাল আছে তো?’

রোশনলালের দুঃসহ ঠেকছিল এই অতলান্ত চাপ। যা থেকে পরিত্রাণের একটাই উপায় ছিল। সেটাই কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নিলেন রোশনলাল।

১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৯। বিকেল পাঁচটা নাগাদ মতিলাল নেহরু রোডের চারতলার ফ্ল্যাটে গেলেন রোশনলাল। বেলা অফিসে। সদ্য চাকরি পেয়েছেন বেঙ্গল টেলিফোনস-এ। ফিরবেন ছ’টার পরে। ফ্ল্যাটে যশোদা এবং রোশনলাল-মণির দুই সন্তান, মুন্না এবং মুন্নি। খেয়ালখুশিতে খেলছে দু’জন। যেমন খেলে রোজ।

যশোদা চা করে আনলেন রোশনলালের জন্য। ফের মণি-প্রসঙ্গ পাড়তে যাবেন, এমন সময় রোশনলাল ঝাঁপিয়ে পড়লেন শাশুড়ির উপর। গলা টিপে ধরলেন। সবলদেহী রোশনলালের বিরুদ্ধে ক্ষণস্থায়ী হল মধ্যপঞ্চাশের যশোদার যৎসামান্য প্রতিরোধ। প্রাণবায়ু নিঃশেষিত হল। মুন্না এবং মুন্নি আতঙ্কে বাক্‌রুদ্ধ হয়ে রইল। যশোদার দেহ ছাদে নিয়ে গেলেন রোশনলাল। মাদুরচাপা দিয়ে রাখলেন এক কোণায়। মুন্না-মুন্নিকে চকোলেট আর খেলনা দিয়ে খানিক শান্ত করে অন্য একটা ঘরে ঢুকিয়ে দিলেন। এবং অপেক্ষায় থাকলেন বেলার ফেরার। যশোদার ছোটমেয়েকে বাঁচিয়ে রাখার ঝুঁকি নেওয়া চলে না।

বেলা অফিস থেকে ফিরলেন সাড়ে ছ’টা নাগাদ। অপেক্ষায় ছিলেন রোশনলাল। ঘরে ঢুকতেই ভারী হাতুড়ি দিয়ে পিছন থেকে মারলেন মাথায়। আকস্মিক আঘাতের তীব্রতায় জ্ঞান হারালেন বেলা। এরপর সংজ্ঞাহীন বেলার গলা টিপে খুন করা তো কয়েক মিনিটের ব্যাপার মাত্র। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে উপর্যুপরি দুটো খুনের পর রোশনলাল শুরু করলেন অধীত চিকিৎসাবিদ্যার নিখুঁত প্রয়োগ।

প্রস্তুতিতে কোনও ফাঁক রাখেননি রোশনলাল। নিয়ে এসেছিলেন চপার, দা, তার, দড়ি, রেশনের ঢাউস ব্যাগ, ডাক্তারির ছুরি-কাঁচি। ভেবেই রেখেছিলেন, ছাদের উপর পড়ে থাকা কাঠের পাটাতনটা ব্যবহার করবেন যথাসময়ে। করলেনও। পাটাতন নিয়ে এলেন ছাদ থেকে। রাখলেন বিছানার উপর। বেলার মৃতদেহ শুইয়ে দিলেন কাঠের উপর। ‘অপারেশন থিয়েটার’ সম্পূর্ণ।

অপারেশন থিয়েটার, না কসাইখানা? দৃশ্যপট বলবে, দ্বিতীয়টাই। কেসের কিনারা হওয়ার পরে ওই ঘরের ফরেনসিক পরীক্ষা চলাকালীন উপস্থিত ছিলেন, এমন এক পদস্থ অফিসারের ভাষায়, ‘The room bore a horrid look. It had the impression of a butcher’s shop kept uncleaned with blood and fat and pieces of flesh sticking to the floor and wall, stinking with putrid smell.’

রোশনলাল চপার দিয়ে গুঁড়োগুঁড়ো করে দিলেন বেলার হাড়। হাতে উঠে এল surgical knife। টুকরো টুকরো করে কাটলেন বেলার দেহ। দেহাংশ মুড়ে রাখলেন রেশনের ব্যাগে। তার দিয়ে বাঁধলেন ব্যাগের মুখটা। জল দিয়ে ধুয়ে ফেলার চেষ্টা করলেন মেঝেতে বইতে থাকা রক্তস্রোত, যতটা সম্ভব। টুকরো হাড়, অস্থি-মজ্জা-চর্বি, মৃতার শরীর থেকে নির্গত বর্জ্য তরল.. সব মিলিয়ে ওই ঘর তখন চূড়ান্ত বিবমিষা উদ্রেককারী। কসাইখানাই!

বেলার দেহাংশ ব্যাগে ভরে মুন্না-মুন্নিকে নিয়ে রোশনলাল ঘর তালাবন্ধ করে বেরিয়ে এলেন রাত্রি দশটা নাগাদ। যশোদার লাশ পড়ে রইল ছাদে। রোশনলাল ভেবেছিলেন, আগে তো বেলার গতি করা যাক, যশোদার কাটাছেঁড়া কাল করা যাবে। তারপর ধোয়ামোছা সাফসুতরো করবেন ঘর। তালাবন্ধই থাকছে। কেউ ঢোকার নেই।

ফিরলেন কোয়ার্টারে। হাসপাতালেরই এক ইলেকট্রিক মেকানিকের জিম্মায় রাখলেন দুই শিশুকে। বললেন, ‘কিছু সমস্যা হয়েছে। ওদের মা হাসপাতালে। দিনদুয়েকের জন্য তোমার কাছে থাক।’

পাওলিনকে টেলিগ্রাম করে দিয়েছিলেন রোশনলাল ১৩ তারিখ দুপুরেই, ‘Come quickly’। পাওলিন রাঁচি থেকে এসে পৌছলেন ১৫ তারিখের কাকভোরে। রোশনলাল স্টেশনে গেলেন আনতে। সঙ্গে রেশনের ব্যাগ। যাতে বেলার দেহাংশ। পাওলিনকে নিয়েই সরাসরি পৌঁছলেন দক্ষিণ কলকাতার লেকে।

আজকের লেকের যে সুসজ্জিত পরিপাটি রূপ দেখে আমি-আপনি অভ্যস্ত, সূর্যের আলো ফুটতে না ফুটতেই মর্নিং ওয়াকে আসা নারীপুরুষের যে জনস্রোত দেখে চোখ সয়ে গেছে, তেমনটা ছিল না তখন। শহরবাসী আসতেন প্রাত্যহিক, তবে কাতারে কাতারে নয়। স্বল্পসংখ্যায়। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে কাঠের বেঞ্চ যা ছিল, তার সংখ্যাও খুব বেশি নয়। শান্ত সরোবর ঘিরে গাছগাছালির অবশ্য তেমন অভাব ছিল না। কোলাহলশূন্য পরিবেশ। প্রকৃতি অবকাশই পেত না পরিশ্রান্ত হওয়ার।

নির্জন জায়গা দেখে সবে ব্যাগটা ফেলতে যাবেন জলে, ত্রিলোচন নামের এক নিরাপত্তাকর্মীর নজরে পড়ে গেলেন রোশনলাল, ‘কেয়া ফেকতা হ্যায় বাবু, কেয়া ফেকতা হ্যায়?’

বিপদ বুঝে রোশনলাল দৌড়লেন ব্যাগ ফেলে। ধাওয়া করে ধরে ফেললেন নিরাপত্তাকর্মী। ব্যাগ থেকে আবিষ্কৃত হল দেহাংশ। খবর গেল টালিগঞ্জ থানায়। পুলিশ এল। রোশনলাল-পাওলিনকে নিয়ে যাওয়া হল থানায়। তারপর লালবাজারে।

একঝাঁক গোয়েন্দাদের জেরার মুখোমুখি হয়েও রোশনলাল প্রাথমিক ভাবে না ভাঙলেন, না মচকালেন। আজগুবি গপ্পো ফাঁদলেন একের পর এক। ‘খুন আমি করিনি। করেছেন পি কে কাপুর বলে এক ব্যবসায়ী, যাঁর সঙ্গে বেলার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ঘনিষ্ঠতার ফলে বেলা গর্ভবতী হয়ে পড়েন। কাপুর নামের ভদ্রলোক বেলাকে বিয়ে করায় নারাজ ছিলেন। তিনিই খুনটা করেছেন। কাপুর আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত। ওঁর কথায় ব্যাগটা লেকের জলে ফেলতে এসেছিলাম। খুনটা আমি করিনি।’ উন্মাদেও বিশ্বাস করবে না এই গাঁজাখুরি গল্প, তবু একচুলও নড়ছিলেন না মেজর রোশনলাল।

মতিলাল নেহরু রোডের ফ্ল্যাটের ছাদ থেকে যশোদার দেহ উদ্ধারের পরেও রোশনলাল ছিলেন অবিচলিত।

—মণি কোথায়? আপনার স্ত্রী?

—আমি কী করে বলব? আমাকে বলে তো যায়নি। আমার ওর চরিত্রের ব্যাপারে বরাবরই সন্দেহ হত। অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে পালিয়ে গেলে অবাক হব না।

ফ্ল্যাটে পাওয়া গিয়েছিল বিভিন্ন সময়ে দিদি যশোদাকে লেখা ভীমপ্রসাদের চিঠি। পুলিশ টেলিগ্রাম করে ডেকে পাঠাল ভীমপ্রসাদকে। যিনি কলকাতায় এলেন সাম্প্রতিক অতীতে দিদির লেখা চিঠিগুলি নিয়ে। যার মধ্যে একটা ..‘মণি দুই সপ্তাহ আগে রোশনলালের সঙ্গে কাশ্মীর গিয়েছিল ..’

সেই চিঠির ব্যাখ্যা যখন চাওয়া হল, রোশনলাল দেখলেন, মিথ্যাচারে লাভ নেই আর। অস্বস্তির হাসি হেসে বললেন ‘Ok gentlemen, enough of it. No more waste of time. I have murdered Moni and left her buried under the sand at Puri.’ যখন স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন, কৃতকর্মের জন্য লেশমাত্র অনুতাপের আভাসও খুঁজে পাননি গোয়েন্দারা। সাধে কী লিখেছি আগে, গবেষণাযোগ্য চরিত্র!

রোশনলালকে সঙ্গে নিয়ে গোয়েন্দারা পাড়ি দিলেন পুরী। বয়ান অনুযায়ী হোটেলের পাশের সেই কুয়ো থেকে উদ্ধার হল মণির স্লিপার-চুড়ি-নেকলেস, যা চিহ্নিত করলেন ভীমপ্রসাদ। বালির স্তূপের ভিতর থেকে উদ্ধার হল মণির দেহাবশেষ। হাড়গোড়ই মূলত। মণিকে নিয়ে যে ওই হোটেলে উঠেছিলেন রোশনলাল, তার সাক্ষী তো ছিলেনই হোটেলকর্মীরা। পারিপার্শ্বিক প্রমাণের আর বাকি ছিল না কিছু।

চার্জশিট জমা পড়ার পর যথানিয়মে শুরু হল বিচার। আদালতকক্ষে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে সাক্ষ্যদান এবং সওয়াল-জবাবের প্রক্রিয়ায় উত্তেজনার উপাদান থাকে না সিংহভাগ ক্ষেত্রে। রোশনলালের মামলার বিচারপর্ব অবশ্য দেখা দিল ব্যতিক্রমী চেহারায়। যেমনটা আদালতে অদৃষ্টপূর্ব।

যেন নাম-কা-ওয়াস্তে নিযুক্ত হয়েছেন অভিযুক্তের তরফের আইনজীবী। যাঁর ভূমিকা বস্তুত ক্রীড়নকের। যিনি কখন কী বলবেন, কোন যুক্তির প্রতিরোধে তুলবেন কোন তর্ক, কোন সওয়ালের প্রত্যুত্তরে আশ্রয় নেবেন কোন জবাবের, সব তো ঠিক করে দিচ্ছেন অভিযুক্ত নিজেই। রোশনলাল স্বয়ং। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েই হোক বা বা কোর্ট লক-আপে বন্দি অবস্থায়। অত্যুৎসাহে কখনও কখনও আইনজীবীকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই প্রতিপক্ষের সঙ্গে তর্ক জুড়ছেন। থামাতে হচ্ছে বিচারককে। কখনও দু’ পক্ষের যুক্তিজাল শুনতে শুনতে ভ্রুকুঞ্চিত। কখনও আবার ফেটে পড়া অট্টহাস্যে। মামলার চড়াই-উতরাইয়ে অশেষ আগ্রহী কখনও, কখনও নিরাসক্ত নিস্পৃহ। এক উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিককে আদালতে দাঁড়িয়েই কথায় কথায় বলেছিলেন, দিব্যি উপভোগ করছেন ‘… fun of a trial.’

সমাজের সর্বস্তরে প্রবল কৌতূহল উৎপন্ন হয়েছিল এই মামলার গতিপ্রকৃতি বিষয়ে। বিচার চলাকালীন রোশনলালের আচরণে সেই ঔৎসুক্য তীব্রতর হয়েছিল। বিচারের দিনগুলিতে আলিপুরের দায়রা আদালতের স্বল্পপরিসর বিচারকক্ষে পা রাখার জায়গা হত না। এজলাসে ঠাসা ভিড় থাকত আমজনতার। যাঁদের যত না কৌতূহল ছিল বাদী-বিবাদীর প্রশ্নোত্তরে, তার ঢের বেশি ঔৎসুক্য ছিল রোশনলালকে একবার চোখের দেখা দেখায়। সেই লোকটিকে দেখায়, যে অচিন্তনীয় নৃশংসতায় হত্যা করেছে স্ত্রী-শাশুড়ি-শ্যালিকাকে। এবং অন্তত বহিরঙ্গে যাঁর বিন্দুমাত্র বহিঃপ্রকাশ নেই অনুতাপ-অনুশোচনার। বরং মরিয়া প্রয়াস রয়েছে নিজেকে নির্দোষ প্রতিপন্ন করার।

নিধননাট্যের খুঁটিনাটি কাটাছেঁড়ার পর রায় যেদিন ঘোষিত হল, আলিপুর কোর্টের ভিড় সেদিন কল্পনাতীত মাত্রাছাড়া। পরিস্থিতি আঁচ করে আগেভাগেই মোতায়েন বাড়তি পুলিশ। কৌতূহলী জনজোয়ার নিয়ন্ত্রণে নজিরবিহীনভাবে আদালতের বাইরের রাস্তায় ঘোড়সওয়ার পুলিশের দাপাদাপি। যানবাহনের গতি বাধ্যতই শ্লথ, সংলগ্ন রাস্তাগুলিতেও।

জুরিদের মতামতের সঙ্গে সহমত হয়ে বিচারপতি কে এন ভট্টাচার্য যখন ঘোষণা করতে চলেছেন চূড়ান্ত রায়, উত্তেজনার পারদ তখন বেহিসেবি রকমের ঊর্ধ্বমুখী। ‘Taking into consideration the facts and circumstances of the case…’ বিচারসিদ্ধান্ত পাঠ যখন শুরু হল, এজলাসে নীরবতা নিশ্ছিদ্রতম।

‘As the accused deliberately and in cold blood murdered Jashoda Sharma, Moni Sharma and Bela Sharma and as there are no extenuating circumstances, the only sentence that can be awarded to the accused in this case is death. I, therefore, sentence the accused Roshanlal to death and direct that he be hanged by the neck till he is dead…’

ফাঁসির হুকুম শোনার পর যখন জনতার সহর্ষ উল্লাস এজলাসকক্ষে, মুহূর্তের জন্য বিচলিত দেখিয়েছিল রোশনলালকে। কিন্তু ওই মুহূর্তের জন্যই। সামলে উঠে ক্ষণিক পরেই দৃপ্ত নির্দেশ দিয়েছিলেন আইনজীবীকে, ‘Let’s appeal to higher courts.’ পাওলিন দোষী সাব্যস্ত হননি। আদালতের বিচারে বেকসুর খালাস।

উচ্চতর আদালতে রোশনলাল আবেদন করেছিলেন শাস্তি হ্রাসের। কলকাতা হাইকোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি স্যার ট্রেভর হ্যারিস পত্রপাঠ খারিজ করে দিয়েছিলেন সে আর্জি। বড়লাটের শরণাপন্ন হয়েছিলেন রোশনলাল। ক্ষমাভিক্ষা করেছিলেন এবং প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। ‘ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা’, সেখানে নিষ্ঠুর হতে পেরেছিলেন বড়লাট। অপরিবর্তিত থেকেছিল মৃত্যুদণ্ডাদেশ। যা কার্যকর হয়েছিল ১৯৫১ সালের ২০ অক্টোবরের উষাকালে।

হাতে গোনা কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী কারাকর্মীর বয়ান অনুযায়ী, ফাঁসিকাঠের পাটাতনে পা রাখার ঘণ্টাখানেক আগেও রোশনলাল ছিলেন শান্ত-স্থিতধী। বলেছিলেন, ‘যা করেছি, তাতে ফাঁসিই উপযুক্ত শাস্তি।’

ডক্টর জেকিল।

কিন্তু মৃত্যুমুহূর্ত যখন উপস্থিত হয়েছিল, সহসা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন, ‘আমি হিন্দু। আমি পুনর্জন্মে বিশ্বাস করি। আমার মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী, তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য আমি হাজারবার জন্ম নেব।’

মিস্টার হাইড।

কী হয়েছিল মুন্না-মুন্নির? রোশন-মণির দুই সন্তানের? ‘Society for the Protection of Children in India’ নামের এক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল দুই শিশুর পরিচর্যার। মুন্না এবং মুন্নি প্রত্যক্ষদর্শী ছিল দিদা যশোদাদেবীর খুনের। শক-এর তীব্রতায় বাক্‌শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল মুন্না। কেউ কাছে এলেই পরিত্রাহি চিৎকার করে কাঁদত শুধু। কিছু খেতে চাইত না। ১৯৫০ সালে মারা গিয়েছিল ক্যাম্পবেল হাসপাতালে। বাঁচেনি মুন্নিও। রোগজীর্ণ অবস্থায় দাদার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিল এক বছর পর।

আরও লেখাই যায়। লিপিবদ্ধ তো রয়েইছে দুই শিশুর তিলেতিলে মৃত্যুযাপনের রোজনামচা। লেখাই যায়, কীভাবে আক্ষরিক অর্থেই জীবন্মৃত হয়ে গিয়েছিল অভিভাবকহীন দুই শিশু। লেখাই যায় আরও।

থাক। মৃত্যু-রোমন্থন থাক।

‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *