২.০৪ শরীর, শুধু শরীর?

শরীর, শুধু শরীর?
[লীনা সেন হত্যা
বৈদ্যনাথ সাহা, উপনগরপাল, ষষ্ঠ সশস্ত্র বাহিনী। ২০১৩ সালে ভারত সরকারের ‘ইন্ডিয়ান পুলিশ মেডেল’-এ সম্মানিত।]

প্রদীপকুমার সেন। ভিজিটর্স স্লিপে নামটা দেখে সামান্য ভুরু কুঁচকে যায় নগরপালের। চেনেন দর্শনপ্রার্থীকে। সামাজিক জমায়েতে দেখা হয়েছে একাধিকবার। সখ্য নেই তেমন। হঠাৎ দেখায় ‘হাই-হ্যালো’ আছে। হতে পারে কোনও ব্যক্তিগত দরকারে এসেছেন বা কোনও অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ জানাতে। কিন্তু স্লিপে ‘Purpose of visit’-এর জায়গায় ‘Most urgent and confidential’ লেখা কেন? হঠাৎ লালবাজারে, সকাল দশটা বাজতে না বাজতেই? স্লিপটা হাতে রেখেই বেল বাজান পুলিশ কমিশনার।

—কল হিম ইন।

বিধ্বস্ত চেহারাটা যখন ঘরে ঢুকছে, একটু অবাকই হন নগরপাল। দেখলে বোঝা যায়, কাঁচাপাকা চুলের প্রৌঢ় ষাটের চৌকাঠ পেরিয়ে গেছেন। সুঠাম চেহারা হয়তো নয়, কিন্তু স্বাস্থ্যবান। লম্বায় নিশ্চিতভাবে ছ’ফুটের উপর। টাক পড়েছে সামান্য। চেহারায় একটা জেল্লা আছে। তবে আজ চলনেবলনে ছিটেফোঁটাও নেই চাকচিক্যের। যেন এক ধাক্কায় ভদ্রলোকের বয়স বেড়ে গেছে বছর দশেক। চোখ লাল। ঘুম সঙ্গ ত্যাগ করলে যেমন হয়, তেমন।

—কী ব্যাপার মি. সেন, হোয়াট ব্রিংস ইউ হিয়ার? অল ওয়েল?

নগরপালের প্রশ্নের উত্তরে বিন্দুমাত্র ভূমিকা করেন না প্রৌঢ়। সোজাসুজি পয়েন্টে আসেন, গলায় ঝরে পড়ে অসহায় আর্তি।

—স্যার, প্লিজ় হেল্‌প মি। মাই ওয়াইফ ইজ় মিসিং…

—মানে?

—ইয়েস স্যার, আমার স্ত্রীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না দু’দিন হল। বাড়ি থেকে পরশু বেরিয়েছিল। আর ফেরেনি।

—দাঁড়ান দাঁড়ান, ফেরেননি মানে? আপনারা থাকেন কোথায়? মিসিং ডায়েরি করেছেন?

—হ্যাঁ, যাদবপুর থানায়। আমরা প্রিন্স গোলাম মহম্মদ শা রোডে থাকি। স্যার, লীনা মিসিং ফর দ্য লাস্ট টু ডেজ়… হাতে মুখ ঢেকে প্রায় কেঁদেই ফেলেন প্রৌঢ়। ফের বেল বাজানোর প্রয়োজন পড়ে নগরপালের। জল আনতে বলেন আরদালিকে।

—মি. সেন, যাদবপুর তো রাজ্য পুলিশের এলাকায়। আপনি চিন্তা করবেন না, আমি দেখছি। কোনও অ্যাক্সিডেন্ট হল কিনা সেটা আগে খোঁজ নেওয়া দরকার। প্লিজ় স্যার, থানা বলছে, মিসিং ডায়েরির এনকোয়ারি চলছে। আমি এখন কী করব, মাথা কাজ করছে না।

—মোবাইল নম্বরটা… মানে আপনার মিসেসের?

—ছিল না। আমরা কেউই মোবাইল ব্যবহার করি না।

চিন্তিত দেখায় নগরপালকে। লালবাজার পিবিএক্স-কে ধরেন ইন্টারকমে।

—ডিসি ডিডি প্লিজ়…

.

কড়েয়া থানার গাড়ি যখন ব্রেক কষল অভিজাত বহুতলের সামনে, ফুটপাথে ছোটখাটো জটলা কৌতূহলী জনতার। নেমে চারপাশে একঝলক তাকান ওসি। জটলাকে ভিড়ে পরিণত হতে দিলে সে ভিড় খুব তাড়াতাড়ি রাস্তায় নেমে আসবে। ট্র্যাফিকের ঘোর সমস্যা হবে। এমনিতেই ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা। অফিসফেরত গাড়ির ঢল নামল বলে। ওয়ারলেসে থানায় নির্দেশ পাঠান বড়বাবু, বাড়তি ফোর্স দরকার এখানে। ক্রাউডকে সরিয়ে দিতে বলুন। কুইকলি!

‘মৈনাক অ্যাপার্টমেন্টস’। পি-১৭ বি, আশুতোষ চৌধুরী অ্যাভিনিউ। বালিগঞ্জ ফাঁড়ি থেকে পার্ক সার্কাসের দিকে কিছুটা হাঁটলেই ডানদিকে চোখে পড়তে বাধ্য এগারো তলার বাড়িটা। ঢোকার মুখেই বড় গেট। এ ধরনের আবাসনে যেমন থাকে। ঢুকেই ছোট একটা ড্রাইভওয়ে। যার শেষে কুড়ি-পঁচিশটা গাড়ি রাখার মতো পার্কিং স্পেস।

‘সিকিউরিটি এনক্লোজার’ রয়েছে একটা। কেয়ারটেকারের বসার ব্যবস্থা সেখানেই। কাচ দিয়ে ঘেরা। ভিতর থেকে স্বচ্ছন্দে দেখা যায় বাইরেটা। কে ঢুকছে, কে বেরচ্ছে, সব। দুটো সিঁড়ি। একটা ব্যবহার হয়ই না প্রায়। তালা বন্ধ থাকে। ওই সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে আবাসিকদের বাড়ির কাজের লোকদের ঘর। মূল সিঁড়ির পাশেই দুটো লিফট। লিফটম্যান আছে, তবে চাইলে নিজেরাও অপারেট করতে পারেন আবাসিকরা। ওসি-কে দেখতে পেয়েই শশব্যস্ত লিফটম্যান এগিয়ে আসে, গলায় উত্তেজনার আঁচ, ‘আসুন স্যার, দশতলায়।’

ফ্ল্যাট নম্বর ৯০৬। যার বাইরে অন্তত পনেরো-কুড়ি জনের জটলা-গুঞ্জন-ফিসফাস। লিফট থেকে বেরিয়েই পকেটে হাত চলে যায় ওসি-র। রুমাল বের করতে বাধ্য হন। প্রবল দুর্গন্ধ গ্রাস করেছে চারদিক। এবং গন্ধের উৎসমুখ যে ওই ফ্ল্যাটই, সন্দেহের বিশেষ অবকাশ নেই। ওই গন্ধ পেয়েই ফোন গিয়েছিল থানায়।

গোদরেজের ইয়া বড় তালা ঝুলছে ফ্ল্যাটের দরজায়। ওসি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সামনে উপস্থিত কেয়ারটেকার জানিয়ে দিলেন, ডুপ্লিকেট চাবি নেই। চাবি থাকত ‘দিদিমণির’ কাছেই। তালা ভেঙে ঢোকার পর আবিষ্কৃত হল দিদিমণি-র মৃতদেহ। বহু ডেডবডি দেখার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বড়বাবুও মুহূর্তের জন্য হতবাক হয়ে পড়লেন দৃশ্যের বীভৎসতায়।

আঁতকে না ওঠাই আশ্চর্য, গা গুলিয়ে না ওঠাই অস্বাভাবিক। দশ আর এগারো তলা মিলিয়ে ডুপ্লে ফ্ল্যাট। একটা দরজা দশ থেকে এগারোয় যাওয়ার। তালা বন্ধ। দশতলার ফ্ল্যাটটা বেশি বড় নয়, কিন্তু ছিমছাম। বাহুল্য না থাক, পারিপাট্য আছে। একটা শোওয়ার ঘর, ছোট। বসার ঘরে কার্পেট-সেন্টার টেবিল-সোফাসেট, যেমন থাকার। বারান্দা রয়েছে একফালি। রয়েছে বসার ঘরের লাগোয়া বাথরুম এবং রান্নাঘর। অসহনীয় দুর্গন্ধের উৎপত্তি যে ওই রান্নাঘর থেকেই, আবিষ্কৃত হল নিমেষেই। রান্নাঘরের দরজা বাইরে থেকে ভেজানো। ঠেলে খুললেন ওসি, এবং পিছনে দাঁড়ানো এক প্রতিবেশী আবাসিকের মুখ থেকে ছিটকে বেরল আতঙ্কিত আর্তনাদ, ও মাই গড!

এক মহিলা নিস্পন্দ বসে আছেন পা ছড়িয়ে। সম্পূর্ণ বিবস্ত্রা। দেখে মনে হয়, বয়স চল্লিশের কোঠায়। মাথাটা দেওয়ালে ঠেস দেওয়া। হাত দুটো বাঁধা নারকেল দড়ি দিয়ে। মুখে একটা কাপড় গোঁজা। তীব্র পচন ধরেছে দেহে। পোকার থিকথিক-ভনভন সর্বাঙ্গে। চোখ ঠেলে বেরিয়ে এসেছে কোটর থেকে। দেহ ফুলে গিয়ে সে এক বীভৎস আকার নিয়েছে। শরীর থেকে বেরিয়ে এসেছে বর্জ্য তরল। রক্তের ধারা জমাট বেঁধেছে মেঝে জুড়ে। দমবন্ধ হয়ে আসার জোগাড়, এতই দাপট দুর্গন্ধের।

প্রতিবেশীদের জিজ্ঞাসা করেন বড়বাবু, কে ইনি? ইনিই থাকতেন এ ফ্ল্যাটে? ঝটিতি উত্তর দেন কেয়ারটেকার, ‘দিদিমণি। লীনা দিদিমণি।’

.

লীনা সেন হত্যা মামলা। কড়েয়া থানা, কেস নম্বর ১৩৬/ তারিখ ০৩.০৭.১৯৯৯। ধারা, ৩০২/২০১ আইপিসি। খুন এবং প্রমাণ লোপাট। বালিগঞ্জের অভিজাত বহুতলে মধ্যবয়সি মহিলার নৃশংস হত্যা এবং পচন-ধরা বিবস্ত্র দেহ উদ্ধার। চাঞ্চল্য উৎপন্ন হওয়ারই কথা। হয়েওছিল। ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মিডিয়া, শহরে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘মৈনাক অ্যাপার্টমেন্ট’।

হুলুস্থুল ফেলে দেওয়া খুন। তদন্তের ভার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের হাতে তুলে দিতে সময় নিলেন না নগরপাল। রহস্যভেদের দায়িত্ব পড়ল গোয়েন্দাবিভাগের তৎকালীন সাব-ইনস্পেকটর (বর্তমানে ষষ্ঠ সশস্ত্র ব্যাটালিয়নের ডেপুটি কমিশনার) বৈদ্যনাথ সাহার উপর।

দ্রুত খবর পাঠানো হল FSL (ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি)-এ। তলব করা হল ডগ স্কোয়াডকে। পুলিশ ট্রেনিং স্কুল থেকে ঘটনাস্থলের উদ্দেশে রওনা দিল পুলিশ কুকুর। ডিসি ডিডি স্বয়ং খবর পেয়েই ছুটলেন হোমিসাইড বিভাগের অফিসারদের সঙ্গে নিয়ে। তাঁর আগেই পৌঁছে গিয়েছেন ডিসি সাউথ। শুরু হয়ে গিয়েছে প্রাথমিক তথ্যতালাশ। মৃতার দেহ যখন নীচে নামিয়ে এনে পুলিশ ভ্যানে তোলা হচ্ছে ময়নাতদন্তে পাঠানোর জন্য, রাস্তায় ভিড় জমে গিয়েছে অন্তত শ’দুইয়ের। কড়েয়া থানার ফোর্স হিমশিম খাচ্ছে সামলাতে। বাড়তি ফোর্স রওনা দিয়েছে লালবাজার থেকে।

ঘটনার ঘনঘটায় ঢোকার আগে জরুরি তথ্য কিছু। এক, এগারো তলাতেও যাওয়া হল তালা ভেঙে। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা দুটো তলাই তন্নতন্ন করে পরীক্ষা করে জানিয়ে দিলেন, ‘no external interference into the flat’। বাইরে থেকে ঢুকে কোনরকম জোরজবরদস্তির চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। সংগ্রহযোগ্য এক বা একাধিক হাত বা পায়ের ছাপ পাওয়া যাচ্ছে না ঘরের আসবাবপত্র-বাসনকোসনে। একটা আলমারি ছিল ঘরে। সেটাও অক্ষত, ভাঙার কোনও চেষ্টা হয়নি। খুব মূল্যবান কিছু ছিল না ঘরে আপাতদৃষ্টিতে। আর থাকলেও তা যে আততায়ী বা আততায়ীদের অভীষ্ট ছিল না, স্পষ্ট। ডাকাতি জাতীয় কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কম। কার্পেটে খয়েরি তরলের যে ছোপ দেখা যাচ্ছে দু’-এক জায়গায়, ওটা শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ। তবে ‘স্যাম্পল’ সংগ্রহ করলেও ওটা যে রক্তই, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় একশো শতাংশ নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল হবে। পুলিশ কুকুর এল, দেখল এবং ফিরে গেল। ঘ্রাণযোগ্য তেমন কিছু সূত্র অমিল।

দুই, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অজয়কুমার গুপ্তের তত্ত্বাবধানে হওয়া ময়নাতদন্তের রিপোর্ট জানাল, শ্বাসরোধ হয়েই মৃত্যু। মুখ এবং নাক চেপে ধরার চেষ্টা হয়েছিল বলপূর্বক। ড. গুপ্ত লিখলেন, ‘The death in my opinion was due to the effect of asphyxia as a result of gagging ante-mortem and homicidal in nature, there was also attempt of closing mouth and nostrils forcibly.’ যেমনটা ভাবা হয়েছিল।

খুনের আগে যৌন অত্যাচার? হয়নি। স্পষ্ট হয়ে গেল সংগৃহীত ‘vaginal swab’-এর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায়। খুনটা হয়েছিল কখন? বিশেষজ্ঞরা জানালেন, ২৯ জুন দুপুর থেকে সন্ধের মধ্যে। মনে করিয়ে দিই মামলা রুজু হওয়ার তারিখটা, ৩ জুলাই। যেদিন সন্ধে ছুঁইছুঁই বিকেলে লীনার মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছিল।

তিন, P.O. (Place of Occurrence) থেকে বাজেয়াপ্ত হওয়া জিনিসের মধ্যে থাকল মৃতার হাত বাঁধার জন্য ব্যবহৃত নারকেল দড়ি, মুখে গোঁজা কাপড়, রান্নাঘরের মেঝে এবং কার্পেটে জমাট বাঁধা খয়েরি দাগের নমুনা, যে তালা ভেঙে ফ্ল্যাটে ঢোকা হয়েছিল, সেটা, আরও কিছু টুকিটাকি। এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, একটি ছোট ডায়েরি। লীনা সেনের।

ডায়েরির বিষয়বস্তুতে পরে আসছি। তার আগে প্রাথমিক পরিচয় করিয়ে দেওয়া দরকার মামলার কেন্দ্রে থাকা চরিত্রদের সঙ্গে।

লীনা সেনের জন্ম পাঁচের দশকের গোড়ায়। খুন হওয়ার সময় বয়স হয়েছিল সাতচল্লিশ। জন্ম লীনা মুখার্জি হিসাবে। সাত বছরের ছোট ভাই বর্তমান। নাম অমিত। লীনা কিশোরীবেলা থেকেই ছিলেন বহির্মুখী প্রকৃতির। অত্যন্ত সপ্রতিভ, সুন্দরী। কনভেন্ট-শিক্ষিতা, অনার্স গ্র্যাজুয়েট। প্রেম করে বিয়ে করলেন দক্ষিণ ভারতীয় যুবক বব শেষাদ্রিকে, বয়স যখন চব্বিশ। বিয়ের বছর দুয়েক আগে থেকেই লীনা চাকরি করতে শুরু করেছিলেন নামকরা বেসরকারি বাণিজ্যিক সংস্থায়। কর্মস্থল বদলেছিলেন ঘনঘন। কোথাও স্টেনোগ্রাফার, কোথাও রিসেপশনিস্ট, কোথাও বা জনসংযোগ আধিকারিক। মৈনাক অ্যাপার্টমেন্ট-এর ডুপ্লে ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছিলেন বিয়ের কয়েক মাস আগে। বিয়ের পর ওই ফ্ল্যাটেই দাম্পত্য জীবন শুরু হয়েছিল বব-লীনার।

বিবাহজীবন সুখের হয়নি। এক বছরের মধ্যেই ডিভোর্স। দ্বিতীয় বিয়ে প্রায় কুড়ি বছর পরে। ’৯৫-এর অগস্টে। যাঁর সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়ে, তিনিও বিবাহবিচ্ছিন্ন। প্রদীপকুমার সেন, পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। নামকরা বাণিজ্যিক সংস্থার ডাকসাইটে বড়কর্তা। লীনা ছিলেন প্রদীপের পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট। কর্মসূত্রেই গাঢ় হয় ঘনিষ্ঠতা, পরিণতি বিয়েতে। প্রদীপবাবুর ফ্ল্যাট ছিল যাদবপুর থানা এলাকার প্রিন্স গোলাম মহম্মদ শা রোডে, ‘নয়নতারা অ্যাপার্টমেন্ট’-এ। বিয়ের পর সেখানে গিয়ে উঠলেও লীনা ছাড়েননি বালিগঞ্জের ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটটা।

দেহ আবিষ্কৃত হওয়ার পর খবর দেওয়া হল প্রদীপবাবুকে। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর ক্যামাক স্ট্রিটে নিজের ফার্ম খুলেছেন। ছুটে এলেন অফিস থেকে এবং মৃতা লীনাকে দেখে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। ফ্ল্যাট থেকে যখন সবাইকে বার করে দেওয়া হচ্ছে ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য, তখনও সোফা ছেড়ে উঠতে পারছেন না বাক্‌রুদ্ধ প্রদীপ। দুই পুলিশকর্মী ধরে ধরে নিয়ে গেলেন লিফট পর্যন্ত। ডিসি ডিডি ভদ্রলোককে দেখেই চিনলেন। ইনিই তিনি, যাঁকে পুলিশ কমিশনারের ঘরে দেখেছিলেন দিন দুয়েক আগে। যিনি পয়লা জুলাই লালবাজারে নগরপালের কাছে জানিয়েছিলেন আর্জি, ‘আমার স্ত্রী-কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, হেল্‌প মি প্লিজ়।’

বৈদ্যনাথ শুরু করলেন তথ্যসংগ্রহের কাজ। দিব্যি বুঝতে পারছিলেন, দ্রুত কিনারা করার চাপ এই মামলায় অবশ্যম্ভাবী। প্রাথমিক জেরায় যে যতটা বললেন, ফিরে দেখা যাক। যতটা বললেন, তার বাইরেও যা যা জানা যাচ্ছিল পুলিশি তদন্তে, সেটাও থাকুক। সামগ্রিক ছবিটা স্পষ্ট হবে।

প্রদীপকুমার সেনের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর যেভাবে এগোল, সারাংশ তুলে দিচ্ছি।

—মি. সেন, যদি কিছু না মনে করেন, এটা তো দ্বিতীয় বিয়ে ছিল। প্রথমটা ভেঙে গেল কেন?

—মনে করার কী আছে? ফার্স্ট ওয়াইফ ছিল সুনন্দা। আমাদের এক ছেলে, এক মেয়ে। দু’জনেই বাইরে চাকরি করে। সুনন্দার সঙ্গে ডিভোর্স হয়েছে বছরচারেক আগে। বনিবনা হচ্ছিল না আমাদের। মিউচুয়াল কনসেন্টে ডিভোর্স।

—লীনা তো আপনার পিএ ছিলেন বিয়ের আগে, না?

—হ্যাঁ। বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল। আমিই জোর করেছিলাম। ভাড়াবাড়িটাও ছেড়ে দিতে বলেছিলাম। রাজি হয়নি।

—সম্পর্ক কেমন ছিল আপনাদের?

—টাকাপয়সা নিয়ে মাঝে মাঝে অশান্তি হত। লীনা হাইপ্রোফাইল লাইফ পছন্দ করত। আমি মাসে মাসে হাতখরচের জন্য যথেষ্ট টাকা দিতাম। কিন্তু লীনার তাতে কুলোত না। এই নিয়ে মাঝে মাঝে ঝগড়া হত কখনও কখনও। মিটেও যেত। উই ওয়্যার ইন লাভ উইথ ইচ আদার। ইন ফ্যাক্ট, গত মাসের শুরুর দিকে সপ্তাহখানেকের জন্য সিঙ্গাপুর বেড়াতে গিয়েছিলাম আমরা। দারুণ কেটেছিল ছুটিটা।

—কাউকে সন্দেহ হয়? কে মারতে পারে মিসেস সেনকে?

—নো ক্লু। অ্যাবসোলিউটলি নো ক্লু। আমি জাস্ট ভাবতেই পারছি না…

—২৯ জুন, মানে মার্ডারের দিন, স্ত্রী-র সঙ্গে শেষ কখন দেখা হয়েছিল? আর ওইদিন আপনার মুভমেন্টটা একটু ডিটেলে জানা দরকার।

—সার্টেনলি। সেদিন আমাদের একসঙ্গে লাঞ্চ করার কথা ছিল তাজ বেঙ্গলে। আড়াইটে নাগাদ টেবিল বুক করেছিলাম।

—হুঁ…

—আমি রোজকার মতো সাড়ে ন’টা নাগাদ অফিস বেরলাম। কথা ছিল, লীনা ট্যাক্সি নিয়ে অফিসে চলে আসবে দেড়টা নাগাদ। সেখান থেকে তাজে যাব। লীনা যখন পৌনে দুটো পর্যন্ত এল না, বাড়িতে ফোন করলাম। কাজের লোক বলল, মেমসায়েব দশটার একটু পরে বেরিয়ে গেছেন।

—তারপর?

—হপ্তায় দু’-একদিন লীনা মৈনাক-এ যেত ইদানীং। ফ্ল্যাটের রিনোভেশন হচ্ছিল। মিস্ত্রিদের যাওয়া-আসা ছিল। নতুন করে সাজাচ্ছিল ফ্ল্যাটটা। আমি ভাবলাম ওখানেই গেছে হয়তো। আসতে দেরি হচ্ছে কোনও কারণে।

—আচ্ছা…

—গাড়ি নিয়ে নিজেই মৈনাক-এ গেলাম। এই দুটো-সোয়া দুটো হবে তখন। খুব বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন। লীনা ফ্ল্যাটেই ছিল। বলল, রিপেয়ার ওয়ার্ক সব ঠিকঠাক হয়েছে কিনা, আরও কিছু খুঁটিনাটি কাজ আছে কিনা, দেখতে এসেছিল। বৃষ্টি হচ্ছিল বলে বেরতে পারেনি।

—সেদিনই শেষ দেখা ওঁর সঙ্গে?

—হ্যাঁ। এত বৃষ্টি হচ্ছিল যে বলার নয়! আমরা লাঞ্চ ক্যানসেল করলাম। লীনা থেকে গেল ঘরটা গোছগাছ করবে বলে। আমার অফিসে কাজ ছিল। ফিরে এলাম আধঘণ্টা পর। সেই শেষ দেখা ওর সঙ্গে।

—লীনা আর বাড়ি ফেরেননি?

—না। বলেছি তো আগে। আমার বাড়ি ফিরতে প্রায় রাত দশটা হয়েছিল। এসে দেখলাম, লীনা ফেরেনি। সারা রাত ফিরল না।

—পুলিশে জানালেন না? মৈনাক-এ গেলেন না কেন রাতেই?

—পুলিশে তো পরদিন দুপুরেই জানালাম। যাদবপুর থানায় মিসিং ডায়েরি করলাম। তেমন গুরুত্ব দিল না থানা। অফিসার বললেন, এনকোয়ারি হবে। একটা ফোটো শুধু নিয়ে রাখলেন।

—বুঝলাম, কিন্তু সে-রাতেই তো মৈনাক-এ যেতে পারতেন?

—ভাবলাম, রাতটা দেখি। লীনার মা থাকেন সুন্দরীমোহন অ্যাভিনিউতে। ভাবলাম, হয়তো ওঁর শরীর হঠাৎ খারাপ হয়েছে। খবর পেয়ে গেছে ওখানে। হয়তো শাশুড়ি জোর করেছেন থেকে যেতে রাতটা। শাশুড়ির শরীরটা ইদানীং ভাল যাচ্ছিল না। প্রতি সপ্তাহেই এক-দু’বার যেত লীনা ওবাড়িতে। ভাবলাম…

—আপনার শাশুড়ির বাড়িতে ফোন নেই? এত কিছু ভেবে না নিয়ে ফোন তো করতে পারতেন একটা।

—করেছিলাম। কানেক্ট করতে পারিনি। জল জমলে শহরের ফোনের কী দশা হয় সে তো জানেনই। আমার অফিসের ফোনও সেদিন দুপুর থেকে ডেড।

—বেশ, তারপর?

—সেই রাতে একফোঁটা ঘুমোতে পারিনি দুশ্চিন্তায়। পরদিন সকালে, এই দশটা নাগাদ আবার গেলাম মৈনাক-এ। দেখলাম, তালা বন্ধ। লীনার কাছেই একমাত্র চাবি থাকত ফ্ল্যাটের। অফিস ফিরে ড্রাইভারকে পাঠালাম সুন্দরীমোহন অ্যাভিনিউয়ে লীনার মায়ের বাড়ি। ওখানেও নেই। আসেইনি। সোজা যাদবপুর থানায় গিয়ে ডায়েরি করলাম। সেদিনও ফিরল না লীনা। পরদিন মাথা কাজ করছিল না আমার। আর কোনও উপায় না দেখে সকাল-সকাল সোজা সিপি সাহেবের কাছেই ছুটলাম। তারপর তো সবটাই জানেন…

দৃশ্যতই ক্লান্ত দেখায় প্রদীপকে। আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার ভদ্রলোককে, ভাবেন বৈদ্যনাথ। আরও তথ্য আসুক হাতে, তারপর দেখা যাবে।

তথ্য এলও পরের কয়েকদিন দৌড়ঝাঁপের পর। যা প্রদীপ বলেননি প্রাথমিক জেরার সময়। প্রথম, লীনার মা জানালেন, মেয়ের সঙ্গে জামাইয়ের সম্পর্ক গত কয়েক মাসে তলানিতে এসে ঠেকেছিল। চাকরি যখন ছেড়েছিলেন, লীনা মাইনে পেতেন মাসিক পনেরো হাজার। আজ থেকে প্রায় বাইশ-তেইশ বছর আগে মাসে হাজার পনেরো মানে অনেক। বিলাসবৈভবের পক্ষে যথেষ্ট। বিয়ের পর চাকরি ছাড়তে বাধ্য হওয়ায় স্বামীর উপর আর্থিকভাবে নির্ভর হয়ে পড়েছিলেন সম্পূর্ণ। প্রদীপ মাস গেলে তিন হাজার দিতেন লীনাকে। সেই নিয়েই সূত্রপাত অশান্তির। দুর্ব্যবহার তো ছিলই। গায়েও হাত তুলতেন মাঝেমাঝেই, মায়ের কাছে অনুযোগ করতেন লীনা।

দ্বিতীয়, নিজের কিছু গয়নাগাটি মেয়ের কাছে রেখেছিলেন লীনার মা। বিয়ের পর সেগুলো ফেরত দিতে চাননি প্রদীপ। লীনা এবং তাঁর মায়ের শত অনুরোধেও। এ নিয়েও অশান্তি হত প্রায়ই।

তৃতীয়, লীনার চরিত্রের দিকে নিয়মিত আঙুল তুলতেন প্রদীপ। যিনি সম্প্রতি ক্যালকাটা ক্লাবের প্রেসিডেন্ট পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। এবং গো-হারান হেরেছিলেন। লীনার সঙ্গে সামাজিক স্ট্যাটাসের এতটাই তফাত তাঁর, এবং লীনার বেহিসাবি জীবনযাপন এতটাই প্রচারিত, সেজন্যই ভোট পাননি সংখ্যাগরিষ্ঠের, এমনই বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল প্রদীপের।

লীনার যে ডায়েরি পুলিশ পেয়েছিল ফ্ল্যাট থেকে, তাতেও ধরা ছিল অসুখী দাম্পত্যের রোজনামচা। কখনও ইংরেজিতে লিখতেন, কখনও কখনও বাংলায়। লেখার সিংহভাগ জুড়ে প্রদীপের বিরুদ্ধে ক্ষোভ, চাকরি ছেড়ে দেওয়ার আক্ষেপ এবং টাকাপয়সার টানাটানির বৃত্তান্ত। ভাড়া বাড়ানোর জন্য বাড়িওয়ালার তাগিদ ক্রমে অসহনীয় হয়ে ওঠার উল্লেখও রয়েছে ডায়েরির পাতায়।

বাড়িওয়ালার পরিচয় প্রয়োজন এখানে। ডাক্তার স্বয়ম্ভু মুখার্জি। থাকেন মৈনাক থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বে, ওল্ড বালিগঞ্জ রোডে। ফ্ল্যাট থেকে দুর্গন্ধ বেরচ্ছে দেখে আবাসিকরা ৩ জুলাই বিকেলে ডা. মুখার্জিকে ফোন করেছিলেন। তিনিই ফোনে যোগাযোগ করেন কড়েয়া থানার সঙ্গে।

ডা. মুখার্জি জানালেন, হ্যাঁ, অনেকদিন বাড়ির ভাড়া বাড়াননি লীনা। বারবার বললেও কর্ণপাত করতেন না। কয়েক বছর আগে উচ্ছেদের মামলাও করেছিলেন। কিন্তু বাড়িওয়ালা-ভাড়াটের মামলা যেমন চলতে থাকে অনন্তকাল, এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। ভাড়া নিয়ে লীনার সঙ্গে কয়েক বছর আগে বাদানুবাদ হয়েছিল, কিন্তু ওই পর্যন্তই।

শুধু ‘ওই পর্যন্তই’ যে নয়, শীঘ্রই জানতে পারলেন বৈদ্যনাথ। স্রেফ বাদানুবাদ নয়, বাড়িওয়ালা-ভাড়াটের সম্পর্ক চূড়ান্ত তিক্ততায় পৌঁছেছিল বছর সাতেক আগে। মৈনাক-এর আবাসিকদের মিটিংয়ে স্বয়ম্ভু চোটপাট করেছিলেন লীনার বেপরোয়া জীবনযাপন নিয়ে। ফ্ল্যাটে যখন-তখন একাধিক পুরুষের যাতায়াত নিয়ে গলা চড়িয়েছিলেন, ‘আমার ফ্ল্যাটে এসব নোংরামো চলবে না!’ তুমুল তর্কাতর্কি হয়েছিল। লীনা পালটা বলেছিলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আপনি বলার কে? ফ্ল্যাটের ভাড়ার টাকা গুনে দিচ্ছি, ব্যস! আমার জীবন আমি যেমন খুশি কাটাব। আপনি কে নাক গলানোর?’

এই অশান্তির কিছুদিন পরই লীনার বাড়িতে পুলিশ এসেছিল এক রাতে। ফ্ল্যাটে মধুচক্র চলছে, এই অভিযোগের তদন্তে। লীনাকে নিয়েও যাওয়া হয়েছিল থানায়, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। কাগজেও বেরিয়েছিল ঘটনার খবর। লীনার দৃঢ় ধারণা ছিল, পুলিশে অভিযোগটা স্বয়ম্ভুরই মস্তিষ্কপ্রসূত। এ নিয়েও ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিল বিস্তর।

উচ্ছেদের মামলার কাগজপত্র ঘেঁটে বৈদ্যনাথ দেখলেন, লীনা যে দুশ্চরিত্রা এবং বাড়িতে দেহব্যবসা চালাচ্ছেন, সোজাসাপটা এমন অভিযোগ করেছিলেন স্বয়ম্ভু। পিটিশনের সঙ্গে ছিল ফ্ল্যাটে পুলিশি অভিযানের খবরের পেপারকাটিং।

স্বয়ম্ভু প্রথমে এসব কিছুই বলেননি। বরং জানিয়েছিলেন, উৎসাহ হারিয়েছিলেন মামলা নিয়ে। খবরই রাখেন না আর। জানতে চেয়েছিলেন বৈদ্যনাথ, ‘ঝামেলা যে কথা-কাটাকাটির থেকে অনেকটা বেশিই গড়িয়েছিল, বলেননি কেন আগে?’ সামান্য অসহিষ্ণু উত্তর এসেছিল, ‘অনেকদিন আগের কথা, মনেও ছিল না। আর এসব এই কেসে প্রাসঙ্গিক কি? বাড়িওয়ালা-ভাড়াটেতে এসব ঝামেলা তো হয়েই থাকে। আপনি কি বাই এনি চান্স আমাকে সন্দেহ করছেন? খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন, ২৯ তারিখ সারাদিন বাড়িতেই ছিলাম।’

খোঁজ নেওয়ার বাকি ছিল অনেক। দিনের মধ্যে নিয়ম করে চার-পাঁচ ঘণ্টা মৈনাক-এ কাটাচ্ছিলেন বৈদ্যনাথ। কাজ কি একটা? আবাসনে মোট চুয়ান্নটা ফ্ল্যাট। প্রত্যেকটা ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের নাম-ঠিকানা-পেশা ইত্যাদির তালিকা তৈরি করা। খুনের দিন কে কোথায় ছিলেন, কী করছিলেন, তার ‘ইনফর্মেশন শিট’ বানানো ঘণ্টার পর ঘণ্টার প্রশ্নোত্তরে। লীনার ফ্ল্যাটের মেরামতিতে যে মিস্ত্রিরা আসত-যেত, তাদের খোঁজ করে জেরা। এবং অপরাধের কোনও পূর্ব-ইতিহাস কারও আছে কিনা, যাচাই করে নেওয়া। ক্লাব-পার্টি-নাচাগানা-হইহই ছিল লীনার স্বভাবজাত। বন্ধুবৃত্তে কে কে ছিলেন তাঁর, কে কতটা ঘনিষ্ঠ ছিলেন তাঁদের মধ্যে, সে ব্যাপারে খবর জোগাড় করা বিনিদ্র দৌড়ঝাঁপে।

তদন্তের সনাতনী ব্যাকরণ মেনেই এগোচ্ছিলেন বৈদ্যনাথ। যে ব্যাকরণ বলে, তথ্যই শক্তি। কোনও তথ্যই তুচ্ছ নয়, এই ভেবে এগোও। যথাসাধ্য তথ্য মজুত করো। এবং তারপর কোন কোনটা জরুরি বা প্রাসঙ্গিক নয় একেবারেই, সেগুলো চিহ্নিত করো। সরিয়ে ফেলো চিন্তাস্রোত থেকে। ছবিটা আপনিই পরিষ্কার হয়ে আসবে। ছোট হয়ে আসবে তদন্তের বৃত্তটা, ভাবনা হবে স্বচ্ছতর।

বৃত্ত ছোট হওয়া দূরে থাক, রহস্য জটিলতর হল আবাসনের কর্মীদের জেরাপর্বে। মৈনাক-এর নিরাপত্তাব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত বিবরণ শুরুতে দিয়েছি। দুটো জিনিস যোগ করার। এক, আবাসনে কোনও সিসি টিভি ছিল না। ঢোকা-বেরনোর কোন প্রযুক্তি-প্রমাণ পাওয়ার প্রশ্ন নেই। দুই, যাঁরা আবাসনের বাসিন্দা, তাঁদের ‘ভিজিটর্স রেজিস্টার’-এ নাম না লেখালেও চলত। কিন্তু বহিরাগত হলে কোন ফ্ল্যাটে কার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন, রেজিস্টারে লেখা বাধ্যতামূলক। আবাসিকের সঙ্গে কোনও বহিরাগত এলে? নিয়মনাস্তি।

কেয়ারটেকার এবং অন্য নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে বৈদ্যনাথ বুঝলেন, ব্যবস্থা নিশ্ছিদ্র তো নয়ই। বরং ঢিলেঢালা, দায়সারা। ব্যাট-প্যাডের মধ্যে দিয়ে বল গলে যাওয়ার মতো ফাঁক যথেষ্ট।

কেয়ারটেকারের নাম দিলীপ চ্যাটার্জি। একজন সহকারী আছেন, জয়প্রকাশ শর্মা। লিফটম্যান একজনই। নাম, বরুণ রায়। দিলীপ-জয়প্রকাশকে সাহায্য করার জন্য রয়েছেন একজন কর্মী, শংকর পণ্ডিত। নিরাপত্তারক্ষী মাত্র তিনজন। ভানু ব্যানার্জি, শম্ভু বড়ুয়া এবং অসিত পণ্ডিত। তিন শিফটে আট ঘণ্টা করে ডিউটি। সকাল ছ’টা থেকে দুপুর দুটো। দুটো থেকে রাত দশটা। দশটা থেকে সকাল ছ’টা পর্যন্ত নাইট শিফট। একজন লিফটম্যানের পক্ষে চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটি করা অসম্ভব। বরুণ মৈনাক-এ থাকেন দুপুর দুটো থেকে রাত দশটা পর্যন্ত। বাকি সময় পালা করে লিফটম্যানের ভূমিকায় থাকেন জয়প্রকাশ-শংকর।

মোদ্দা কথা, লোক যেহেতু কম, পরিস্থিতি অনুযায়ী সবার কাজটাই সবাই কমবেশি করে থাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। ২৯ এবং ৩০ তারিখ যাঁরা ডিউটিতে ছিলেন, সবার সঙ্গে কথা বলা হল বিস্তারিত। বাড়তি তথ্য বলতে, ২৯ তারিখ যখন এসেছিলেন মি. সেনের হাতে একটা মাঝারি সাইজের ফোলিও ব্যাগ ছিল। বেরনোর সময়ও ব্যাগটা সঙ্গে ছিল। আবাসিকদের ছাড়া অন্য কারও গাড়ি ভিতরে পার্ক করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল মৈনাক-এ। ২৯ তারিখ প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল বলে প্রদীপ কেয়ারটেকার অফিসে এসে অনুরোধ করেন গাড়ি ভিতরে রাখতে দেওয়ার জন্য। ড্রাইভার ইসমাইল ভিতরেই পার্ক করেছিল প্রদীপের ছাইরঙা মারুতি এস্টিম।

লিফটে বরুণ দশতলায় পৌঁছে দিয়েছিলেন প্রদীপকে। নামিয়েও এনেছিলেন আধঘণ্টা পর। পরের দিন, ৩০ তারিখ সকালে প্রদীপ যখন এসেছিলেন, লিফটের দায়িত্বে ছিলেন শংকর। বরুণ-শংকর দু’জনের বিবরণের সঙ্গে প্রদীপের বয়ান মিলে গেল হুবহু। সেনসাহেবের আচরণে কোনও অস্বাভাবিকতা চোখে পড়েছিল? ‘না তো!’ দু’জনেই বললেন একবাক্যে। লীনা ২৯ তারিখ সেই যে সকাল দশটায় এসেছিলেন, তারপর দুপুর-বিকেলের মধ্যে আর বেরিয়েছিলেন? সেই একবাক্যেই উত্তর, ‘না, দিদিমণি তো আর বেরননি। বেরলে তো দেখতেই পেতাম।’

কী দেখতে পেতেন ওঁরা আর কী না পেতেন, সে অবশ্য বৈদ্যনাথ বুঝে গিয়েছিলেন খুনের দিনদুয়েকের মধ্যেই। মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছিল ৩ তারিখ। সাদা পোশাকে বৈদ্যনাথ ৫ তারিখ রাতে কাউকে কিছু না বলে একাই ঢুঁ মেরেছিলেন মৈনাক-এ। দেখেছিলেন, কেয়ারটেকার অফিসের সামনে নাইট শিফটের নিরাপত্তারক্ষী খুব মন দিয়ে চেয়ারে বসে ঢুলছেন। যে কেউ ঢুকে আবার বেরিয়ে যেতে পারে, চোখেও পড়বে না ঢুলুনিতে আচ্ছন্ন রক্ষীর। শুধু মূল গেটটা টপকাতে হবে। যেটা কোনও ব্যাপারই নয় মোটামুটি শারীরিক সক্ষম যে কারও পক্ষে।

এই যখন অবস্থা, কী করে পুরোপুরি ভরসা করা যায় এদের কথায়? কী করে একশো শতাংশ নিশ্চিত হওয়া যায়, ২৯ তারিখ অন্য কোনও বহিরাগত যাননি লীনার ফ্ল্যাটে, মিস্টার সেন ছাড়া? এরা কিছু বললেই ‘ভিজিটর্স রেজিস্টার’ দেখাচ্ছে। সব ওতে নোট করা থাকে।

কী নোট করা থাকে, খুঁটিয়ে দেখতে গিয়েই ঘোরতর খটকা। এটা কী হল? ২৯ তারিখ দুপুর সোয়া দুটোয় মিস্টার সেন এসেছিলেন, এন্ট্রি আছে। কিন্তু চারটে থেকে সাড়ে ছ’টার মধ্যে দুটো এন্ট্রি পড়া যাচ্ছে না। জলে ধুয়েমুছে গেছে, হাজার চেষ্টাতেও উদ্ধার করা যাচ্ছে না নাম দুটো। আগে-পরের দিনগুলো নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। শুধু খুনের দিন এবং সম্ভাব্য সময়ের এন্ট্রিতেই জল পড়ে গেল? কী করে?

বৈদ্যনাথের একেবারেই মনঃপূত হল না কেয়ারটেকার দিলীপবাবুর ব্যাখ্যা, ‘সেদিন সারাদিন ধরে বৃষ্টি হয়েছিল। ভিজিটর্স রেজিস্টার বেশিরভাগ সময় তো বাইরেই থাকে। বৃষ্টির জল অসাবধানে পড়েই হয়তো এন্ট্রিগুলো…।’ শুধু ওই দিনের, ওই সময়েই বৃষ্টিজল? বৈদ্যনাথ রেজিস্টার নিয়ে গেলেন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের কাছে। ওঁরাও পারলেন না মুছে যাওয়া নামগুলো পড়তে।

বেশ, নাম না হয় পড়া যাচ্ছে না। মাত্র তো দিনকয়েক আগের কথা, মনে করে দেখুন না, মিস্টার সেনের পর আর কে কে এসেছিলেন বাইরে থেকে? ২৯ তারিখ দুপুর চারটে থেকে সন্ধে সাড়ে ছ’টার মধ্যে? লিফটম্যান বরুণ অনেক ভেবে জানালেন, দু’জন এসেছিলেন। একজন দাড়িওলা ভদ্রলোক, মাঝবয়সি। আরেকজন প্রৌঢ়া। কেউই লীনার ফ্ল্যাটে যাননি। প্রথমজন সাততলায় নেমেছিলেন, দ্বিতীয়জন পাঁচে। সঙ্গে বরুণ যোগ করলেন ‘যদ্দূর মনে পড়ছে।’

বরুণের ‘মনে পড়া’য় আস্থা রাখার কোনও কারণ পাচ্ছিলেন না বৈদ্যনাথ। যদি আস্থা রাখেনও তর্কের খাতিরে, বহিরাগত কেউ তো অন্য ফ্ল্যাটের নম্বর এন্ট্রি করে, অন্য তলায় নেমে আরামসে যেতেই পারে লীনার ফ্ল্যাটে। কে দেখতে যাচ্ছে? লিফটে কে কোন তলায় নেমেছিলেন, কী প্রমাণ হয় তাতে?

.

তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে খুনের পর। প্রমাণ বা সূত্র মেলেনি কিছু খুনিকে চিহ্নিত করার মতো। এদিকে প্রায়ই সিপি খোঁজ নিচ্ছেন, কিছু হল কিনা? অবসন্ন লাগে বৈদ্যনাথের। সন্ধেবেলায় গেলেন ডিসি ডিডি-র ঘরে। গুরুত্বপূর্ণ মামলায় তদন্তকারী অফিসারকে দৈনন্দিন হালহকিকত জানাতে হয় গোয়েন্দাপ্রধানকে। নিয়ম।

শ্রান্ত চেহারাটা দেখেই গোয়েন্দাপ্রধান বোঝেন, নির্ণায়ক সূত্র এখনও অধরা থাকায় হতাশা ক্রমশ ঘিরে ধরছে বৈদ্যনাথকে। পিঠে হাত রাখেন, ‘লেগে থাকাটাই আসল। দরকারে শূন্য থেকে শুরু করো। দেখবে, হঠাৎ লিড পেয়ে যাবে। ছেড়ো না। লেগে থাকো।’

ঠিকই। লেগে থাকতে হয়। গাভাসকার একবার বলেছিলেন, যে-কোনও পেশায় সফল হতে গেলে তিনটে ‘ডি’ প্রয়োজন। ডিসিপ্লিন, ডেডিকেশন, ডিটারমিনেশন। শৃঙ্খলা, নিষ্ঠা, সংকল্প। সফল তদন্তকারীর অবশ্য সবার আগে দরকার তিনটে ‘পি’। পেশেন্স, পেশেন্স এবং পেশেন্স। অনন্ত ধৈর্য সর্বাগ্রে। মেধা-পরিশ্রম-একাগ্রতা, এসব আসবে অনেক পরে। ধৈর্যই তদন্তকারীর আসল চাঁদমারি। কিছুতেই যখন কিছু হচ্ছে না, নিজেকেই বারবার গুনগুনিয়ে ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু’ শুনিয়ে যাওয়া চেতনে-অবচেতনে।

পরের দিন অফিসে এসে শূন্য থেকেই ফের শুরু করেন বৈদ্যনাথ। সন্দেহের বৃত্ত খুব বড় নয়। সন্দেহভাজনের তালিকায় শীর্ষবাছাই নিঃসন্দেহে প্রদীপকুমার সেন। সম্ভাব্য মোটিভ? দাম্পত্য অশান্তির সহ্যসীমা অতিক্রম করা। সম্পর্ক যে তিক্ত থেকে তিক্ততর হয়েছিল, উল্লেখ আছে লীনার ডায়েরিতে। টাকাপয়সা নিয়ে অশান্তি কি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল? লীনার বন্ধুমহল থেকে জানা যাচ্ছে, শহরের প্রথম সারির বিউটি পার্লারগুলোয় নিয়মিত যাতায়াত ছিল। দিনে তিন-চার প্যাকেট ক্ল্যাসিক সিগারেট খেতেন। অভ্যস্ত ছিলেন মদ্যপানে। চাকরি করতেন না, স্বামীর দেওয়া মাসিক তিন হাজারে চলত কী করে এতসব? অন্য উপার্জন ছিল? থাকলে, কী তার উৎস? কে টাকা দিত, এবং কেন? অন্য পুরুষসঙ্গ, এক বা একাধিক? প্রদীপ জেনে গিয়েছিলেন? যৌন-ঈর্ষা?

অন্যদিকে, খুনের দিনের গতিবিধি সম্পর্কে প্রদীপের বয়ান মিলে যাচ্ছে লিফটম্যান-কেয়ারটেকারের বিবরণের সঙ্গে। আনুমানিক যে সময়ে খুন বলে চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, প্রদীপ সেই সময়সীমার মধ্যে লীনার ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন। সর্বসমক্ষেই গিয়েছিলেন। তাজ বেঙ্গলে খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে, সত্যিই সেদিন লাঞ্চ বুকিং ছিল সেনদম্পতির। এবং সে-রাতে সত্যিই ফোন ডেড হয়ে গিয়েছিল লীনার মায়ের বাড়িতে। নিজে মহিলার সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন বৈদ্যনাথ। ফোলিও ব্যাগে কী ছিল? উত্তরে বলেছেন, অফিসের কাগজপত্র। হতেই পারে। অবিশ্বাসের কোনও কারণ নেই। সর্বোপরি নিজেই লালবাজারে এসে খোদ নগরপালের সঙ্গে দেখা করে তদন্তপ্রক্রিয়া চালু করেছেন প্রদীপ। না হলে তো স্রেফ ‘মিসিং ডায়েরি’-র অনুসন্ধানেই সময় চলে যেত রুটিনমাফিক। কিছুই তো সেভাবে লুকোনোর চেষ্টা করেননি, বৈবাহিক অশান্তির তীব্রতাটা বাদ দিয়ে।

অবশ্য সম্ভাব্য অপরাধীর এই ‘কিছুই তো লুকোচ্ছি না’-র প্রবণতা নতুন কিছু নয়। অনেকই হয়। পুলিশকে বিপথে চালিত করতে সব তাস আগেভাগেই দেখিয়ে দেওয়ার চালাকি, যাতে সন্দেহের সূচিমুখ একটা সময়ের পর ধাবিত হয় অন্য দিকে। আর এ তো কল্পনার গোয়েন্দাকাহিনি বা সিনেমা নয়, যে পুলিশ যাকে প্রাথমিক তদন্তে অপরাধী মনে করছে, শেষ বিচারে তার দোষী হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য। এ তো ‘ফিকশন’ নয়, যে কোনও মহাপ্রতিভাধর গোয়েন্দা মধ্যপথে আবির্ভূত হবেন এবং শেষে পুলিশি ধারণাকে দুরমুশ করে ছাড়বেন। এবং দেখা যাবে, পুলিশ যা ভেবেছিল, সবই স্থূলবুদ্ধির প্রতিফলন মাত্র। সুতরাং প্রদীপ সেনকে ক্লিন চিট দেওয়াটা আহাম্মকি হবে। কিন্তু যদি প্রদীপ খুনটা করে থাকেন, প্রমাণ কই? সন্দেহের বশে তো আর খুনের মামলায় কাউকে আদালতে চালান করা যায় না, যখন ন্যূনতম প্রমাণটুকুও নেই হাতে। আর যদি প্রদীপ খুনি না হন, তা হলে কে? অন্য কেউ? না, অন্য কারা?

‘অন্য কেউ’ বলতে ডাক্তার স্বয়ম্ভু মুখার্জির নাম মাথায় আসতে বাধ্য। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, সন্দেহের আওতার বাইরে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? হ্যাঁ, ‘অ্যালিবাই’ যথেষ্ট মজবুত। খুনের দিনে, খুনের সম্ভাব্য সময়ে বাড়িতেই ছিলেন, যাচাই করে জানা গিয়েছে নিঃসংশয়। কিন্তু এমনও তো হতে পারে, খুনটা নিজে করেননি। করিয়েছেন। মোটিভ তো ছিলই। ফ্ল্যাটের দখল ফিরে পাওয়া এবং নতুন করে ভাড়া দেওয়া বা বেচে দেওয়া। অমন জায়গায় ফ্ল্যাট অনায়াসে বিক্রি হবে বিশাল অঙ্কের টাকায়। ভাড়া দিলেও পাবেন, লীনা যা দিতেন, তার অন্তত তিনগুণ।

ফ্ল্যাটের প্রসঙ্গেই কিছু খটকা। লীনার জীবনযাপন নিয়ে যে তাঁর সঙ্গে এত বিশ্রী কাদা ছোড়াছুড়ি হয়েছিল, এটা প্রাথমিক কথাবার্তায় চেপে গেলেন কেন? মামলা নিয়ে কোনও আপসরফা হয়েছিল লীনার সঙ্গে? হলে কেমন রফা? কী সেই রফাসূত্র?

সম্পর্কের উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও খুনটা যদি স্বয়ম্ভুই লোক লাগিয়ে করিয়ে থাকেন, ধরে নিতে হয়, ফ্ল্যাটের মালিকানা প্রাপ্তি কারণ হিসাবে নেহাতই গৌণ। গভীরতর উদ্দেশ্য ছিল কিছু। কী হতে পারে? ‘সম্পর্কের উন্নতি’ মানে কী? কেমন সম্পর্ক? সেই সূত্রেই ব্ল্যাকমেল? বা আরও গুরুতর কিছু? হাজার প্রশ্ন মাথায় ঘুরতে থাকে বৈদ্যনাথের।

খুনটা করানোই যদি হয়ে থাকে, তা হলে কাদের দিয়ে? আবাসনের কর্মীদের এক বা একাধিককে দিয়ে করানোটাই সবচেয়ে সহজ। ফ্ল্যাটের অ-আ-ক-খ থেকে অনুস্বার-চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত নখদর্পণে ওদের। টাকার লোভ বড় সাংঘাতিক জিনিস। হতেই পারে, টাকার বিনিময়ে নিরাপত্তাকর্মীদের কয়েকজনকে, বা হয়তো একজনকেই, হাত করে খুনটা করিয়েছেন স্বয়ম্ভু।

সম্ভাবনা নম্বর তিন, খুনটা স্রেফ ব্যক্তিগত আক্রোশের বশে হয়েছে। এবং করেছেন আবাসনের এক বা একাধিক কর্মী। লীনা মিষ্টভাষী ছিলেন, এমন অভিযোগ জেরার সময় আবাসনের কেউ করেননি। অত্যন্ত রগচটা ছিলেন। মুখে কোনও লাগাম থাকত না রেগে গেলে। বৈদ্যনাথ বিশ্বস্ত সোর্স লাগিয়েছিলেন একাধিক। যারা নানা কাজকর্মের ছুতোয় ভাব জমানোর চেষ্টা করেছে মৈনাক-এর কর্মীদের সঙ্গে। এবং সোর্স মারফত পাওয়া খবর অনুযায়ী, ঘটনার দিনদশেক আগে লিফটম্যান বরুণের সঙ্গে তীব্র বাদানুবাদ হয়েছিল লীনার। লিফট খুলতে দেরি হয়েছিল। যাচ্ছেতাই ভাষায় গালাগালি করেছিলেন লীনা। সে নিয়ে কেয়ারটেকার অফিসে নাকি চর্চাও হয়েছিল বিস্তর।

লীনা নাকি মানুষ বলেই গণ্য করতেন না কর্মীদের, এতটাই নাকউঁচু ছিলেন। কর্মীরাও অত্যন্ত অপছন্দ করতেন বদমেজাজি লীনাকে। পুষে রাখা রাগ জমতে জমতে কি কোনওভাবে এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল, যে একক বা যৌথ ষড়যন্ত্রে একেবারে মেরে ফেলারই সিদ্ধান্ত? ভাবতে একটু কষ্টকল্পিত লাগলেও একেবারেই অসম্ভব কি? আর সবচেয়ে বড় কথা, বৃষ্টির জলে শুধু সেদিনের ওই সময়ের এন্ট্রি দুটোই মুছে গেল? একটু বেশিই কাকতালীয় না?

একটাই দূরতম সম্ভাবনা পড়ে আছে আর। বব শেষাদ্রি। লীনার প্রথম স্বামী। যাঁর কোনও খোঁজই পাওয়া গেল না এদিক-ওদিক অনেক খবর নিয়েও। কেউ কিছু বলতে পারলেন না। এই বব কি কোনওভাবে ফের উদয় হয়েছিলেন লীনার জীবনে? হলেই বা কী, সন্ধান তো পেতে হবে আগে।

আর এমনই কপাল, না লীনা-প্রদীপ, না স্বয়ম্ভু, কেউই ব্যবহার করতেন না মোবাইল। চার বছর আগে, ’৯৫-এ, ভারতে এসে গিয়েছে মোবাইল ফোন। রাস্তাঘাটে সবারই হাতে হাতে ফোনের অভ্যেস চালু হতে তখনও ঢের দেরি। তবু, সামাজিক অবস্থানের বিচারে ওঁদের তিনজনের কাছে থাকতেই পারত মোবাইল। থাকলে তদন্তে সুবিধে হত অনেক। যাক, ছিল না যখন, কী আর করা?

ঘটনার পরের দুই সপ্তাহে প্রদীপ-স্বয়ম্ভু তো বটেই, আবাসনের কর্মীদের সবাইকে লালবাজারে ডেকে দফায় দফায় জেরা করেছেন বৈদ্যনাথ। অন্তত চারবার তো বটেই। তবু সিদ্ধান্ত নিলেন সবাইকে আর একবার তলব করার। পঞ্চমবার রুটিনমাফিক ডেকে পাঠানোর সময় জানতেন না, রহস্যভেদ দ্রুত হতে চলেছে অভাবিত ঘটনাপ্রবাহে।

২৯ জুলাই। লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের দোতলা। ঘড়িতে সাড়ে এগারোটা। সকাল দ্রুত পা চালাচ্ছে দুপুরের দিকে। নিজের ঘরে আছেন বৈদ্যনাথ। সঙ্গে এক সহকারী অফিসার। পাশের একটা ঘরে অপেক্ষায় প্রদীপকুমার সেন, ডা. স্বয়ম্ভু মুখার্জি, মৈনাক-এর কেয়ারটেকার দিলীপ আর লিফটম্যান বরুণ। দিলীপ-বরুণ ফিরে গেলে বাকিদের আসার কথা পালা করে।

প্রথমে প্রদীপ। বৈদ্যনাথ ইচ্ছে করেই সবাইকে বসিয়ে রেখেছেন ঘণ্টাখানেক। মিস্টার সেনের ডাক পড়ল প্রায় পৌনে একটায়। এত দেরি হওয়ায় বেশ ধৈর্যচ্যুত দেখাচ্ছে ভদ্রলোককে। বিরক্তি গোপনের চেষ্টাও করলেন না বিশেষ। চেয়ার টেনে বৈদ্যনাথের মুখোমুখি বসতে বসতেই বললেন, ‘মিস্টার সাহা, এই নিয়ে পাঁচবার হল। একই কথা আর কতবার জানতে চাইবেন আপনারা? এক মাসও হয়নি আমার স্ত্রী মারা গেছেন। মেন্টালি ভীষণ ডিস্টার্বড আছি। অফিসের কাজও শিকেয় উঠেছে। তার মধ্যে বারবার লালবাজারে এভাবে আসতে হলে…।’

বৈদ্যনাথ স্ট্র্যাটেজি ঠিক করেই রেখেছিলেন। শুরু থেকেই চালিয়ে খেলবেন আজ। একদম কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্তের স্টাইলে।

—সরি মিস্টার সেন। আমারই কি ভাল লাগছে বারবার এভাবে ডাকতে? আপনারা কেউই পুরো সত্যিটা বলছেন না বলেই ডাকতে হচ্ছে। উপায় কী?

প্রদীপও ঝাঁঝিয়ে উত্তর দেন।

—কোন সত্যিটা বলিনি? কোনটা?

বৈদ্যনাথকে এবার উত্তেজিত দেখায় সামান্য।

—আমাকে বলে দিতে হবে, কোনটা? ডায়েরির মাত্র কয়েকটা পাতা নিয়ে আপনাকে প্রশ্ন করেছি এতদিন। বাকিগুলোর কথা তুলিইনি। এই ভেবে, যে আপনি নিজেই বলবেন হয়তো।

টেবিলে রাখা লীনার ডায়েরিটা হাতে তুলে নিয়ে বলে চলেন বৈদ্যনাথ।

—খুন হওয়ার দিনতিনেক আগে আপনার মিসেস কী লিখেছিলেন ডায়েরিতে, শুনবেন?

‘এভাবে আর পারছি না আমি। সিঙ্গাপুরে গিয়ে আমাকে হোটেলের রুমের মেঝেতে শুতে বাধ্য করল প্রদীপ। আমার সঙ্গে বেড শেয়ার করতে নাকি ওর ঘেন্না করে। আমি নাকি রাস্তার মেয়ে। একটা সামান্য পারফিউম কিনতে চেয়েছিলাম গতকাল। মুখের উপর বলল, একটা পয়সাও খরচ করবে না আমার জন্য। বিদেশে বেড়াতে এনেছে, এই ঢের।’

একটু থামেন বৈদ্যনাথ, শান্ত ভাবে চোখে চোখ রাখেন প্রদীপ সেনের।

—কী সেনসাহেব, আরও শুনবেন? আমি আরও বলতে পারি। কিন্তু শুনতে আপনার ভাল লাগবে না…

প্রদীপ সেনের চোখমুখ এতক্ষণে রাগে থমথমে। থামিয়ে দেন প্রশ্নকারীকে।

—না, ভাল লাগছেও না। আর শুনতেও চাই না আমি। কারণ, লীনা চিরকালই মিথ্যেবাদী ছিল, ড্যাম লায়ার! শুনুন মিস্টার সাহা, পুরোটাই মিথ্যে ছিল ওর…

—কোনটা মিথ্যে? এই ডায়েরির লেখাগুলো মিথ্যে? টাকাপয়সা দিতেন না, জামাকাপড় দিতেন না, প্রতি মুহূর্তে অপমান করতেন, এগুলো মিথ্যে? সিঙ্গাপুরে একটা পারফিউম কিনতে চেয়েছিলেন বলে পাঁচটা কথা শুনিয়েছিলেন, মিথ্যে?

—দিতাম না, বেশ করতাম। আমার কাছে সাদা হাতি পোষার মতো হয়ে গিয়েছিল লীনা। টাকা, টাকা আর ওনলি টাকা। আমি তো তবু ওর শখ মেটাতে এতগুলো টাকা খরচ করে সিঙ্গাপুর নিয়ে গিয়েছিলাম। অন্য কেউ হলে করত না। আর পারফিউম, জামাকাপড়? ওর সবকিছু, এমনকী মৈনাক-এ যে আন্ডারগার্মেন্টস পরে গিয়েছিল সেদিন, সেগুলোও সিঙ্গাপুরের lingerie shop থেকে কেনা।

শেষ বাক্যটা বলেই আচমকা থেমে যান প্রদীপ। দৃশ্যতই অপ্রস্তুত। বৈদ্যনাথ নিমেষে বোঝেন, অপরাধীর যুক্তি-তক্কো-গপ্পোর বাসরঘরে এই সেই কাঙ্ক্ষিত ছিদ্র, যা নজরে আসা মাত্রই কালসর্প হয়ে ঢুকে পড়তে হয় তদন্তকারীকে, বিন্দুমাত্র কালবিলম্ব না করে।

—তাই? কী করে জানলেন ওই আন্ডারগার্মেন্টস পরেই সেদিন নিজের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন লীনা? আধঘণ্টা থেকে কথাবার্তা বলেই তো চলে এসেছিলেন। ওটাই আপনার সঙ্গে শেষ দেখা, শেষ কথা। ওই সময়ের মধ্যে শারীরিক মিলন না হয়ে থাকলে নিশ্চিত হচ্ছেন কী করে অন্তর্বাসের ব্যাপারে? হয়েছিল?

স্রেফ ঢিল ছুড়েছিলেন বৈদ্যনাথ, একরকম মরিয়া হয়েই। যেটা পড়ে শুনিয়েছিলেন ডায়েরি থেকে, সেটা বানানো। সিঙ্গাপুরের ব্যাপারে কোনও এন্ট্রিই ছিল না ডায়েরিতে। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে আত্মঘাতী মন্তব্য করে বসবেন প্রদীপ, তিন সপ্তাহের দুর্ভেদ্য রক্ষণকে ভঙ্গুর দেখাবে রাতারাতি, ভাবতে পারেননি বৈদ্যনাথ। ক্রমশ অসহায় দেখাতে থাকে প্রদীপকে, আমতা-আমতা করে কিছু বলতে চেষ্টা করেন।

—না মানে…

—মানে একটাই হয় মিস্টার সেন। আপনি উকিল-টুকিলকে ফোন করতে পারেন। কোনও অসুবিধে নেই। আপনাকে অ্যারেস্ট করা হচ্ছে। সারা দিন সারা রাত পড়ে আছে। তবে যত তাড়াতাড়ি সত্যিটা স্বীকার করবেন, ততই ভাল। পুলিশি আদরযত্নের প্রয়োজন হবে না, আই অ্যাম শিয়োর। তা ছাড়া আপনার বয়স হয়েছে…

বৈদ্যনাথের গলার স্বর আমূল পালটে গিয়েছে এখন। এ স্বর প্রতিপত্তিশালী কর্পোরেট কর্তাকে সৌজন্যমিশ্রিত পুলিশি প্রশ্নের নয়। জালে জড়িয়ে যাওয়া অপরাধীকে উদ্দেশ করে এ স্বর এখন আত্মবিশ্বাসী আইনরক্ষকের। সব খুলে বলা ছাড়া উপায় ছিল না প্রদীপের।

পুরোটাই ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা। সিঙ্গাপুরে বেড়াতে যাওয়ার আগেই। দুটো কারণ ছিল। এক, লীনার টাকাপয়সার বায়নাক্কা সামলাতে সামলাতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন প্রদীপ। মুক্তির পথ খুঁজছিলেন। দুই, বিয়ের বছরদুয়েক পর থেকেই লীনার ‘কুছ পরোয়া নেহি’ জীবনযাপন। কখন কোন ক্লাবে কোন পুরুষের ঘনিষ্ঠ হচ্ছেন, কোন পার্টি থেকে কখন বেরিয়ে পুরুষসঙ্গীকে নিয়ে চলে যাচ্ছেন মৈনাক-এর ফ্ল্যাটে, খবর ঠিকই পেয়ে যেতেন প্রদীপ। সামাজিক পরিচিতির পরিধিটা নেহাত ছোট ছিল না তাঁর। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া ছিল প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক। লীনা বদলাননি নিজেকে, প্রদীপও আর্থিক দিক থেকে স্ত্রীকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করেছেন ক্রমশ। এবং একটা সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন স্ত্রী-কে পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দেওয়ার।

সিঙ্গাপুরে বেড়াতে যাওয়াটা লোক-দেখানো। সপ্তাহদুয়েক আগেই যিনি স্ত্রী-র সঙ্গে বিদেশ ঘুরে এলেন, তিনি হঠাৎ খুন করতে যাবেন কেন সহধর্মিণীকে, এই ধারণা তৈরি করতে। তাজ বেঙ্গল-এ লাঞ্চের বুকিং-ও একই কারণে। স্ত্রী-র সঙ্গে যাঁর লাঞ্চে যাওয়ার কথা হয়ে আছে, তিনি সেদিনই খুন করবেন অক্লেশে, বিশ্বাসযোগ্য?

প্রদীপ প্রাথমিক জেরায় বলেছিলেন, কথা ছিল, লীনা বাড়ি থেকে ট্যাক্সিতে ক্যামাক স্ট্রিটের অফিসে আসবেন। মিথ্যে বলেছিলেন। কথা বরং ছিল, ফ্ল্যাটের তদারকিতে লীনা মৈনাক-এর ফ্ল্যাটে যাবেন। সেখানে পৌনে দুটো-দুটো নাগাদ প্রদীপ চলে আসবেন অফিস থেকে। লীনাকে তুলে লাঞ্চ করতে যাবেন একসঙ্গে।

প্রদীপ এসেছিলেন কথামতো, সময়মতো। হাতে ছিল ফোলিও ব্যাগ। যার ভিতরে ছিল কাপড়ের টুকরো, প্লাস্টিকের ছোট প্যাকেট একটা আর নারকেল দড়ি। লীনার ফ্ল্যাটে গিয়ে টুকটাক কিছু কথাবার্তার পর আচমকাই আক্রমণ করেছিলেন স্ত্রী-কে। প্রদীপ, আগে লিখেছি, যথেষ্ট স্বাস্থ্যবান ছিলেন। হতচকিত লীনার সাময়িক প্রতিরোধকে আয়ত্তে আনতে বেশি সময় লাগেনি। শ্বাসরোধ করে মেরেছিলেন স্ত্রী-কে। তারপর বিবস্ত্র করে দিয়েছিলেন লীনাকে। এটা কেন? প্রদীপের মুখেই শুনুন— ‘রাগে। ওকে সবার সামনে লিটারালি বেআব্রু করে দিতে চেয়েছিলাম। অনেকে তো জানতই ওর চরিত্রের স্বরূপ। এবার দেখুক। সবাই দেখুক।’

রান্নাঘরে লীনার দেহ ঢুকিয়ে রেখে বেরিয়ে এসেছিলেন প্রদীপ। মুখে কাপড় গুঁজে, হাত নারকেল দড়ি দিয়ে বেঁধে। ফোলিও ব্যাগে ভরে নিয়েছিলেন লীনার পোশাকআশাক আর হ্যান্ডব্যাগ। হ্যান্ডব্যাগ থেকে ফ্ল্যাটের চাবিটা নিয়ে বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে লিফট ডেকেছিলেন নির্বিকার। আবাসন থেকে বেরিয়ে অফিস ফেরার পথে ড্রাইভার ইসমাইলকে বলেছিলেন আউট্রাম রোড হয়ে যেতে। গাড়িটা দাঁড় করিয়েছিলেন নেচার পার্ক-এর সামনে। ইসমাইল অপেক্ষা করছিল গাড়িতে, আর প্রদীপ ব্যাগ হাতে ঢুকে গিয়েছিলেন পার্কে। চাবিটা একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে মুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন ঝোপঝাড়ের মধ্যে। লীনার জামাকাপড় ব্যাগসুদ্ধ ফেলেছিলেন আর-এক প্রান্তে। তারপর সোজা অফিস। পরের দিন থানায় ডায়েরি, আর তারও পরের দিন সশরীরে লালবাজারে এসে কুম্ভীরাশ্রু। পচাগলা মৃতদেহ কয়েকদিনের মধ্যে আবিষ্কৃত হবেই, জানতেন প্রদীপ। প্রশ্নের জবাব দেওয়া তখন মুশকিল হবে, জানতেন। তাই এগিয়েছিলেন আটঘাট বেঁধেই।

স্বীকারোক্তি অনুযায়ী যাওয়া হল নেচার পার্ক-এ। কাগজের মোড়কে চাবিটা পাওয়া গিয়েছিল নির্দিষ্ট জায়গাতেই। কিন্তু পাওয়া যায়নি লীনার পোশাক আর হ্যান্ডব্যাগ। কত লোকেরই তো যাতায়াত ওই পার্কে নিত্যদিন। কেউ হয়তো নিয়ে গিয়েছিল দেখতে পেয়ে।

চার্জশিটের প্রস্তুতি যখন তুঙ্গে, তখনও বৈদ্যনাথ পাননি একটা প্রশ্নের উত্তর। খুনের দিন ‘ভিজিটর্স রেজিস্টার’-এ জলের দাগে দুটো এন্ট্রি মুছে যাওয়াটা। কী ব্যাখ্যা? উত্তর মেলেনি। এমন ব্যাখ্যাতীত সমাপতন বোধহয় কালেভদ্রেই সম্ভব, যা হাজির হয় তদন্তকে বিপথগামী করার সম্ভাব্য উপাদানসমেত।

এ মামলার পরিণতি অনেকাংশেই ছিল পারিপার্শ্বিক প্রমাণ (circumstantial evidence) নির্ভর। খুনের কোনও প্রত্যক্ষদর্শী নেই। শ্বাসরোধ করে হত্যা, খুনে ব্যবহৃত অস্ত্রের প্রশ্ন নেই। অকুস্থলের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় আঙুলের বা পায়ের ছাপ মেলেনি অভিযুক্তের। অপরাধী কে, সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে গেলেও তদন্তকারীকে অসম্ভব যত্নবান হতে হয় এ ধরনের মামলায়, যেখানে প্রমাণ-পরম্পরায় (chain of evidence) সামান্যতম ফাঁকফোকর থাকলেও ভরাডুবি অনিবার্য। এবং এ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ছিলেন অর্থবান। প্রদীপকুমার সেন যে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে অর্থব্যয় করবেন যথেচ্ছ, জানাই ছিল।

কী ঘটেছিল, কীভাবে এবং কেন, চার্জশিটে উঠে এসেছিল ছবির মতো। বিচারপর্বে অভিযুক্তের আইনজীবীর প্রধান যুক্তি ছিল, ষাট বছরের এক প্রৌঢ়র পক্ষে একা ওইভাবে প্রায় পনেরো বছর কম বয়সের মহিলাকে খুন করা অসম্ভব। এ যুক্তি ধোপে টেকার ছিল না। টেকেওনি। লীনাকে কাবু করার মতো স্বাস্থ্য যে অভিযুক্তের ছিল, রায়ে উল্লিখিত হয়েছিল।

পারিপার্শ্বিক প্রমাণ হিসাবে প্রত্যাশিতভাবেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছিল পার্ক থেকে উদ্ধার হওয়া চাবির গোছা। লীনার তালাবন্ধ ফ্ল্যাটের চাবি কী করে প্রদীপের কাছে এল, আর কেনই বা সেটা লুকিয়েচুরিয়ে ফেলে এলেন পার্কে, জবাব ছিল না এ প্রশ্নের। ড্রাইভার ইসমাইল তাঁর বয়ানে স্বীকার করেছিল পার্কে যাওয়ার কথা। পার্কের নিরাপত্তারক্ষীদের বয়ান নেওয়া হয়েছিল। একজন মনে করতে পেরেছিলেন সেদিনের কথা। গাড়ি এসে থেমেছিল, একজন ব্যাগ নিয়ে নেমেছিলেন, ফিরে এসেছিলেন কিছুক্ষণের মধ্যে খালি হাতে। এজলাসে প্রদীপকে চিহ্নিত করেছিলেন ওই রক্ষী।

কী পড়ে থাকে আর? লীনার ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ থাকা অসুখী দাম্পত্যের বিবরণ বিবেচিত হয়েছিল খুনের ‘মোটিভ’ হিসাবে। ডায়েরির হাতের লেখা যে লীনারই, চিহ্নিত করেছিলেন ভাই অমিত। সর্বোপরি, জীবিত অবস্থায় লীনাকে শেষ দেখা গিয়েছিল প্রদীপের সঙ্গে। দেখেছিলেন লিফটম্যান বরুণ, যখন প্রদীপ ফ্ল্যাটের বেল বাজিয়েছিলেন ২৯ তারিখ দুপুরে, লীনা খুলেছিলেন দরজা এবং প্রদীপ ঢুকে গিয়েছিলেন ফ্ল্যাটে। সাক্ষ্যপ্রমাণের ভাষায় একে বলে হয় ‘last seen alive together’, যা এই ধরনের মামলায় (যেখানে কোনও প্রত্যক্ষদর্শী নেই অপরাধের) প্রমাণ হিসাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আদালতের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন প্রদীপকুমার সেন। দণ্ডিত হয়েছিলেন যাবজ্জীবন কারাবাসে। এখন পরলোকগত।

সম্পর্কের রসায়ন ভারী বিচিত্র। বিনিয়োগের রসায়ন। কোথাও পুঁজি স্রেফ বিশ্বাস, কোথাও-বা নির্ভরতা। কোথাও হয়তো ভালবাসা, কোথাও অন্য কোনও অনুভূতি। ঈর্ষা-ক্ষোভ-দ্বেষ, বা অন্য কিছু।

প্রদীপ-লীনার সম্পর্কেও বিনিয়োগ ছিল উভয়ত। অব্যক্ত হিসেব ছিল পারস্পরিক। নারীবিষয়ে প্রদীপের দুরারোগ্য দুর্বলতা লীনা বিলক্ষণ বুঝেছিলেন। এবং প্রৌঢ়ত্বের স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রদীপকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলেন একটাই কারণে। নিজে গভীর আসক্ত ছিলেন জেটগতির দিনযাপনে। সেই জীবনযাত্রায় অর্থবান এবং সামাজিক প্রতিপত্তিশালী স্বামী দীর্ঘস্থায়ী অনুঘটক হয়ে দেখা দেবেন, এই নিশ্চিন্ততায়।

আর প্রদীপ? রিপুর তাড়না চরিতার্থ করাই ছিল পাখির চোখ। ‘শরীর শুধু শরীর, তোমার মন নাই লীনা’ বলার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি কখনও। বলবেন, এমন প্রত্যাশাও লীনার ছিল না।

প্রেম ছিল না ওঁদের। চাওয়া-পাওয়ার হিসেব ছিল। যা দু’জনেই ভালবাসার আব্রু দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করেছিলেন বিয়ের পরের কয়েক মাস। কিন্তু যে সম্পর্কের ইট-বালি-চুন-সুরকিতে শুধুই দেওয়া-নেওয়া, তাতে ফাটল ধরা ছিল অবধারিতই। ‘কী পাইনি তার হিসাব মিলাতে’-ই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন উভয়েই।

পরিণতি? পড়লেন তো!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *