২.০৬ ফেলুদাং শরণং গচ্ছামি

ফেলুদাং শরণং গচ্ছামি
[ললিতা গোয়েঙ্কা হত্যা
আশিক আমেদ, ওসি, মেটিয়াবুরুজ।]

— মা-কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না… তুমি শিগগির বাড়ি এসো…

অনিল গোয়েঙ্কার মোবাইলটা যখন বেজে উঠল, সকাল তখন কত? এই পৌনে আটটা। ব্যাট-প্যাড পরে মাঠে নামতে যখন রোদের দেরি থাকে কিছু। আবার ভোরের আধো-অন্ধকারও যখন প্যাভিলিয়নের পথে। মাঝামাঝি একটা সময়। ভোর আর সকালের প্রাত্যহিক চুক্তিতে যখন সব ‘শান্তিকল্যাণ’ হয়ে আছে।

মঙ্গল-বৃহস্পতি-রবি, সপ্তাহে তিনদিন টালিগঞ্জ ক্লাবে ভোরবেলা গল্‌ফ খেলতে আসা অনিলের বহুদিনের অভ্যেস। আজ, বিষ্যুদবারে, যেমন এসেছেন। দু’রাউন্ড খেলার পর সবে একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন যখন, গলা ভিজিয়ে নিচ্ছেন ফ্রেশ ফ্রুট জুসে, স্ত্রী জয়শ্রীর ফোন। মা-কে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! অনিলের উত্তরে ঠিকরে বেরয় অস্থিরতা-উদ্বেগ-আশঙ্কা।

—কী বলছ কী? খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানে? বাথরুমে দেখেছ?

—দেখেছি। নেই। বিছানায় রক্তের দাগ আছে। সব ওলটপালট। মেঝেতেও রক্ত আছে… আমার হাত-পা কাঁপছে… এসো শিগগির…

গল্‌ফ মাথায় উঠল। দ্রুত গাড়িতে উঠে বসলেন অনিল। ড্রাইভারের প্রতি সামান্য উত্তেজিত নির্দেশ এল।

—ঘর চলো… জলদি!

‘ঘর’, অর্থাৎ ‘শ্রীনিকেত অ্যাপার্টমেন্টস’। ১১, অশোকা রোড, আলিপুর।

অনিল যখন পড়িমরি করে বাড়ি পৌঁছে পা রাখলেন বাড়ির দরজায়, ভিড় জমে গেছে প্রতিবেশীদের। থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ছোটভাই সুনীল। দাদাকে দেখেই বললেন, ‘ভাইয়া… কুছ গড়বড় হ্যায়… পুলিশ কো বুলানা চাহিয়ে।’

‘গড়বড়’ যে আছেই, সেটা বুঝতে অবশ্য তেমন বুদ্ধি খরচের দরকার পড়ে না। ফ্ল্যাটে এক চক্কর দিলেই মালুম হয় অনায়াসে।

আসলে দুটো ফ্ল্যাট একসঙ্গে। এগারো তলায়, 10D আর 10E। আয়তনের বিচারে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে মাঝারি সাইজ়ের ফুটবল মাঠের সঙ্গে। সব মিলিয়ে আটটা ঘর। প্রতিটাই পেল্লায় সাইজ়ের। অপর্যাপ্ত বৈভবের চিহ্ন ছড়িয়ে ফ্ল্যাটের এ-মাথা থেকে ও-মাথা। বিরাট হলঘরে সেগুনকাঠের রকমারি আসবাবপত্র। দুর্মূল্য তৈলচিত্র। বাহারি সোফাসেট। সিলিং থেকে ঝুলতে থাকা কারুকাজের ঝাড়লন্ঠন। প্রশস্ত ড্রয়িংরুম পেরিয়ে আরও প্রশস্ত বারান্দা। যার পাশে বিস্তৃত খোলা জায়গা একটা, ‘ওপেন টেরেস’। যেখানে দাঁড়িয়ে চোখ তুলে চাইলে আকাশকে খুব দূরের মনে হয় না।

আটটার মধ্যে সাতটা ঘর যেমন থাকার তেমন। একটা শোওয়ার ঘরের চেহারা শুধু বিধ্বস্ত। বিছানা ওলটপালট। দুটো বালিশ ঝুলছে খাটের এক কোণে। বেডসাইড টেবিল থেকে একটা জলের গ্লাস উলটে পড়েছে মেঝেতে। প্রায় দু’ফুট লম্বা একটা জিআই পাইপ পড়ে আছে খাটের নীচে। বিছানার উপর অন্তত চারটে জায়গায় লাল ছোপছোপ। রক্ত, বোঝা যায় সাদা চোখেই।

যিনি এই বিছানায় শুতেন, শুয়েছিলেন গত রাতেও, সেই ললিতাদেবী গোয়েঙ্কা কোথায়? সত্তর বছরের বৃদ্ধা কোত্থাও নেই। অন্য ঘরগুলোয় নেই। রান্নাঘরে নেই। শোওয়ার ঘরের লাগোয়া বাথরুমে নেই। হলঘরের এক কোনায় আর একটা বাথরুম। যেটা কখনও ব্যবহার হয় না। খুলে দেখা হল। নেই।

ছাদে-বারান্দায়-টেরেসে-ঠাকুরঘরে? নেই। একটা জায়গাই দেখার পড়ে আছে। স্টোররুম। তালা ঝুলছে দরজায়। যেমন ঝোলে রোজ। শোওয়ার ঘরের ড্রেসিং টেবলের ড্রয়ারে চাবি থাকে। ‘থাকে’ নয়, থাকত। দ্রুত আবিষ্কৃত হল, স্টোররুমের চাবি ড্রয়ারে নেই।

অনিল গোয়েঙ্কার মুখ রক্তশূন্য হয়ে যায় এবার। চাবিটা কোথায় গেল স্টোররুমের? মা কোথায়? তা হলে কি…? মোবাইলে আলিপুর থানার নম্বর যখন ডায়াল করছেন, হাত কাঁপতে শুরু করেছে।

—একবার আপনাদের আসতে হবে বড়বাবু। মা-কে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। স্টোররুমের চাবি মিসিং। বেডরুমটা ডিস্টার্বড। ব্লাড স্টেইনস আছে বেডে। একবার যদি আসেন এখনই… প্লিজ়…

পুলিশ পৌঁছল, স্টোররুমের তালা ভাঙা হল এবং ভিতরের দৃশ্য দেখে মুহূর্তে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লেন ললিতা গোয়েঙ্কার পুত্রবধূ জয়শ্রী। অনিল দাঁড়িয়ে রইলেন স্তব্ধ হয়ে। মুখে হাত ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠলেন সুনীল।

মেঝে রক্তে থইথই। বৃদ্ধা পড়ে আছেন নিষ্প্রাণ। মুখে কাপড় গোঁজা। কপালে গভীর ক্ষতচিহ্ন। গলার নলিটা কাটা। যা দিয়ে কাটা হয়েছে সম্ভবত, সেই ছুরিটা পড়ে আছে পেটের উপর। যে ফুল-ফুল খয়েরি-সাদা ম্যাক্সিটা মহিলার শরীরে, সেটার রং প্রায় পুরো বদলে গিয়ে লালে লাল। রক্তপাত হয়েছে প্রচুর। দুটো সাদা বেডশিট পড়ে আছে দুমড়ানো-মুচড়ানো। রক্তের দাগ যাতে যত্রতত্র।

স্টোররুমে দুটো বড় আলমারি। দুটোই লন্ডভন্ড। হাতড়ানো হয়েছে বেপরোয়া। কী থাকত আলমারিগুলোয়? অনিল জানালেন, মায়ের জমানো টাকাপয়সা থাকত ছোট ছোট কাপড়ের পুঁটলিতে। যার একটাও আলমারিতে নেই এখন। মৃতদেহের পাশে একটা একশো টাকার নোটের বান্ডিল পড়ে আছে হেলাফেলায়। যে বা যারা খুনটা করল, পালানোর সময় তাড়াহুড়োয় নিতে ভুলে গেছে?

প্রায় সাত হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটের প্রতিটি ইঞ্চি-সেন্টিমিটারের তন্নতন্ন তল্লাশিতে ঘণ্টা দুয়েক লেগে গেল আলিপুর থানার পুলিশের। যাদের সঙ্গে যোগ দিলেন গোয়েন্দাবিভাগের হোমিসাইড শাখার অফিসাররা। দ্রুত চলে এলেন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা। খোঁজাখুঁজিতে উল্লেখ করার মতো জিনিস বলতে পাওয়া গেল দুটো কালো রংয়ের প্লাস্টিকের বোতাম। পড়ে ছিল খাটের নীচে এক কোনায়। খুনি বা খুনিদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়েছিল মহিলার? সাধ্যমতো প্রতিরোধ করেছিলেন, এবং আততায়ী বা আততায়ীদের কারও শার্ট থেকে বোতাম দুটো ছিঁড়ে গিয়েছিল টানাটানিতে?

জিআই পাইপটা খাটের নীচে এল কোথা থেকে? বারান্দার একধারে চারটে পাইপ পড়েছিল বেশ কিছুদিন যাবৎ। তারই একটা নিয়ে জোরালো আঘাত করা হয়েছিল মৃতার কপালে।

‘Seizure list’-এর তালিকায় ওই লোহার পাইপের সঙ্গে যোগ হল রক্তের দাগ লাগা বালিশ, স্টোররুমে পড়ে থাকা রক্তমাখা এক জোড়া বেডশিট, মৃতার পেটের উপর পড়ে থাকা ছুরি, একশো টাকার নোটের বান্ডিল। আলমারিতে আঙুলের ছাপ? বা খাট-বিছানায়? পাওয়া গেল আবছা, ‘ডেভেলপ’ করার যোগ্য নয়।

অভিজাত আবাসনে সম্পন্ন ব্যবসায়ী পরিবারে সত্তর বছরের বৃদ্ধার নৃশংস খুন। গলাকাটা অবস্থায় দেহ উদ্ধার ফ্ল্যাটের স্টোররুম থেকে। মিডিয়ায় হইচই হবে, স্বাভাবিকই ছিল। যেমন স্বাভাবিক ছিল দেহ উদ্ধারের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তদন্তভার নেওয়া হোমিসাইড বিভাগের। সাব-ইনস্পেকটর আশিক আমেদ (বর্তমানে মেটিয়াবুরুজ থানার ওসি) দায়িত্ব পেলেন রহস্যভেদের।

ললিতাদেবী গোয়েঙ্কা হত্যারহস্য। আলিপুর থানা, কেস নম্বর ১১৭, তারিখ ১২/৮/২০০৪। খুন, লুঠ এবং প্রমাণ লোপাট। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২/৩৯৪/২০১ ধারায়।

.

শ্রীনিকেত অ্যাপার্টমেন্টস। ছিমছাম কোলাহলহীন রাস্তার উপর ভিতরে-বাইরে গাছগাছালির সবুজ আবাসন। দুটো আলাদা ব্লক। ‘এ’ আর ‘বি’। দুটোই এগারো তলা। ব্লক এ-র দশ আর এগারো তলায় দুটো করে ফ্ল্যাট। বাকি প্রতিটা ফ্লোরে চারটে করে ফ্ল্যাট। একতলায় পার্কিং স্পেস রয়েছে পর্যাপ্ত, যেমন থাকে এ ধরনের আবাসনে।

নিরাপত্তায় যথেষ্ট বিনিয়োগ করেছিলেন আবাসিকরা। প্রায় পনেরো ফুটের কাছাকাছি উচ্চতার পাঁচিল। যার উপর তার দেওয়া, ‘barbed wire fencing’।

ঢোকার-বেরনোর একটাই গেট। যেটা পেরিয়ে ঢুকলেই পশ্চিম দিকে ‘security box’। বেসরকারি সংস্থা ‘Royal Securities Pvt Ltd.’-র কর্মীরা থাকেন নিরাপত্তার দায়িত্বে। ব্লক এ-র একতলায় আবাসনের অফিস, ‘শ্রীনিকেত হাউসিং এস্টেট সোসাইটি’।

সিকিউরিটি বক্সে ইন্টারকম আছে। বাইরে থেকে কেউ এসে কোনও ফ্ল্যাটে যেতে চাইলে নিরাপত্তাকর্মী ফোন করে ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের জানিয়ে দেয়, তমুক এসেছেন। সবুজ সংকেত পেলে তবেই প্রবেশাধিকার মেলে বহিরাগত অতিথির। ভিজিটর্স রেজিস্টারে নাম-ঠিকানা লিখে সই করার পর। রোজকার আংশিক সময়ের গৃহকর্মীদের, যাদের মুখ চেনা, ঢোকার ব্যাপারে বাধা নেই।

যাঁরা বিভিন্ন ফ্ল্যাটে স্থায়ী কাজের লোক, তাঁরা যখন ছুটিতে যান, ‘গেট পাস’ নিয়ে বেরতে হয়। বেরনোর সময় সঙ্গে যা যা থাকে ব্যাগ বা সুটকেসে, দেখাতে হয় নিরাপত্তাকর্মীদের। তারপর ছাড়পত্র মেলে বাইরে যাওয়ার। কে কখন বেরল আর ফিরল কবে কখন, সব নোট করা থাকে রেজিস্টারে।

প্রতি ব্লকে দুটো করে লিফট। দু’জন করে লিফটম্যান ব্লকপিছু। যাঁরা দুটো শিফটে কাজ করেন। সকাল ছ’টা থেকে দুপুর দুটো। দুপুর দুটো থেকে রাত দশটা। চারজন স্থায়ী সাফাইকর্মী রয়েছেন। রয়েছেন একজন ইলেকট্রিশিয়ান এবং একজন প্লাম্বার। হাউসিং-এর অফিসে আছেন একজন কেয়ারটেকার আর তাঁর একজন সহযোগী।

নিরাপত্তারক্ষীরা শিফটে কাজ করেন রাতদিন সাতদিন। দু’জন করে থাকেন সকাল ন’টা থেকে রাত ন’টা। পরের শিফট রাত থেকে সকাল, বারো ঘণ্টা টানা। দিনের শিফটে একজন সুপারভাইজ়ারও থাকেন।

এই আবাসন তৈরি করেছিলেন ভগবতীপ্রসাদ গোয়েঙ্কা। ব্লক এ-তে দশ আর এগারো তলাটা নিজের পরিবারের জন্য রেখে বাকি ফ্ল্যাটগুলো বেচে দিয়েছিলেন। এগারো তলায় থাকতেন সস্ত্রীক। দশতলার দুটো ফ্ল্যাট লিখে দিয়েছিলেন দুই ছেলের নামে। বড় অনিল, ছোট সুনীল। আগেই লিখেছি, ব্লক দুটোর বাকি ফ্লোরগুলোর প্রতিটায় ছিল চারটে করে ফ্ল্যাট। গোয়েঙ্কাদের বাদ দিলে মোট ফ্ল্যাটের সংখ্যা আশি।

পি. ও। প্লেস অফ অকারেন্স। ঘটনা যেখানে ঘটেছে। যে-কোনও তদন্তে ঘটনাস্থল তদন্তকারীর কাছে মন্দির-মসজিদ-চার্চের মতো। তীর্থস্থানস্বরূপ। সাধকের ধৈর্য নিয়ে দেখতে হয়। পূর্ণাঙ্গ খানাতল্লাশির পর ফ্ল্যাটটা ভাল করে ঘুরে দেখছিলেন আশিক।

এগারো তলার যে ফ্ল্যাটে ললিতাদেবী থাকতেন, বলেছি আগে, তার নম্বর 10D & 10E। পাশাপাশি দুটো ফ্ল্যাটের পুরোটা নিয়েই বসবাস করতেন মহিলা। দুটো ফ্ল্যাট মিলিয়ে আটটা বড় ঘর, দুটো বড় হল, ডাইনিং রুম, একটা রান্নাঘর। প্রশস্ত বারান্দা যেখানে শুরু হচ্ছে, তার পাশেই বড় স্টোররুম। যেখানে আবিষ্কৃত হয়েছিল বৃদ্ধার দেহ।

দশতলায় দুটো ফ্ল্যাট। 9E এবং 9F। অনিল থাকেন 9E-তে। সুনীল 9F-এ।

অনিলের ফ্ল্যাটের ভিতর থেকে এগারো তলায় মায়ের ফ্ল্যাটে উঠে যাওয়ার একটা সিঁড়ি আছে। অনিল সপরিবারে উপরে মায়ের সঙ্গেই খাওয়াদাওয়া করতেন। রান্নাবান্নার সরঞ্জাম এগারো তলাতেই থাকত।

ছাদে ‘সার্ভেন্টস কোয়ার্টার’। যে ছাদের মালিকানা সম্পূর্ণত ছিল গোয়েঙ্কাদের। বাড়ির কাজের লোকদের জন্য ছাদ থেকে নেমে এগারো তলার রান্নাঘরে ঢোকার একটা দরজা ছিল। সেই দরজা খোলা থাকত দিনভর। রান্নাঘরের ওই দরজা দিয়েই ফ্ল্যাটে ঢুকত স্থায়ী কাজের লোকেরা। রাতের খাওয়ার পাট সাধারণত সাড়ে ন’টার মধ্যে চুকে যেত গোয়েঙ্কা পরিবারের। তারপর জয়শ্রী রান্নাঘরের দরজায় ভিতর থেকে ছিটকিনি দিয়ে দিতেন।

ললিতার নিত্যনৈমিত্তিক রুটিন? ভোর পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে উঠে ঠাকুরঘরে চলে যেতেন। তার আগে দরজা খুলে দিতেন রান্নাঘরের। গৃহকর্মীরা নির্দিষ্ট সময়মতো এসে দশ এবং এগারো তলার কাজ শুরু করত। দুপুর দুটো থেকে বিকেল পাঁচটা অবধি ছিল কাজের লোকদের বিশ্রামের সময়।

ললিতার দেহ উদ্ধার হল ১২ অগস্ট সকালে। তার আগের রাতে মহিলা কিছু খাননি। একাদশী ছিল। রাত ন’টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। উপরের ফ্ল্যাটে রোজকার মতো সকাল সাড়ে সাতটা-পৌনে আটটা নাগাদ উঠে এসেছিলেন জয়শ্রী। জলখাবারের তদারকি করতে। এসে দেখেছিলেন, শাশুড়ি ফ্ল্যাটে নেই। ওলটপালট বিছানায় রক্তের দাগ। তারপর আতঙ্কিত ফোন অনিলকে, ‘মা-কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শিগগির বাড়ি এসো।’

.

ময়নাতদন্ত হতে হতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। প্রত্যাশিত রিপোর্ট, গলায় ছুরির আঘাত এবং মাথায় গভীর ক্ষত থেকে অবিরাম রক্তক্ষরণ মৃত্যু ঘটিয়েছে, ante-mortem and homicidal। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা মৃতদেহ দেখে যা অনুমান করেছিলেন, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট সহমত হল তাতে। খুনটা ঘটেছে রাত তিনটে থেকে চারটের মধ্যে। ললিতা ভারী চেহারার ছিলেন, খুনি একাধিক হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

‘একাধিক’ যে হতেই পারে, বোঝাই যাচ্ছিল। দেহ বেডশিটে মুড়ে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল স্টোররুমে। একের পক্ষে অসম্ভব নয়। কিন্তু কঠিন। ‘এক’ না ‘একাধিক’, ভাবার আগে প্রাথমিক তথ্যসংগ্রহের প্রয়োজন। রাত দশটা অবধি আবাসনে কাটালেন আশিক। যা যা জানলেন, যা যা শুনলেন, যা যা বুঝলেন জিজ্ঞাসাবাদে এবং কানাঘুষোয়, বাড়ি ফেরার পথে সাজিয়ে নিচ্ছিলেন মাথায়।

ললিতাদেবীর দুই ছেলের পারস্পরিক সম্পর্ক ভ্রাতৃসুলভ ছিল না। না থাকার কারণ? ভগবতীপ্রসাদ গোয়েঙ্কা বড়ছেলেকে বেশি দায়িত্ববান মনে করতেন বলেই সম্ভবত যাবতীয় সম্পত্তি ‘প্রোবেট’ করে গিয়েছিলেন অনিলের নামে। অগাধ সম্পত্তির মালিকানা পেয়েছিলেন অনিল। ছোটছেলে সুনীলকে ব্যবসার যৎসামান্য অংশীদারিত্ব নিয়েই খুশি থাকতে হয়েছিল।

অর্থের সড়কপথেই অনর্থের প্রবেশ ঘটে থাকে সচরাচর। অনর্থ বলতে যা বোঝায়, এক্ষেত্রে তেমন কিছু হয়নি অবশ্য। তবে ভায়ে-ভায়ের সম্পর্কে যে ফাটল ধরেছিল, সেটা অজানা ছিল না কারও। পরলোকগত স্বামীর সিদ্ধান্তে ললিতার নীরব সমর্থন ছিল। বড়ছেলের সংসারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। অনিলের দুই স্কুলপড়ুয়া পুত্র-কন্যা ঠাকুমার অনিঃশেষ স্নেহের ভাগিদার হয়েছিল। উৎসব-অনুষ্ঠান ছাড়া দুই ভাইয়ের পরিবারের মধ্যে যোগাযোগ ছিল না বললেই চলে। সুনীল থাকতেন নিজের মতো, সপরিবার।

দশ এবং এগারো তলা মিলিয়ে সবসময়ের কাজের লোক আটজন। শিবু মাহাতো। রান্না করেন। এ বাড়িতে আছেন তা সাত-আট বছর হল। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনায়।

আশিস-অমলেশ। দুই ভাই। মূলত বাড়ির রোজকার বাজারহাটের দায়িত্বে। ওঁরাও বেশ কয়েক বছর ধরে আছেন গোয়েঙ্কা পরিবারে। হুগলিতে বাড়ি।

ত্রিলোকি সিং। বাড়ির সবচেয়ে পুরনো গৃহকর্মী। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। আদতে উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা। নির্দিষ্ট কোনও দায়িত্ব নেই সেভাবে। বাকি গৃহকর্মীদের কাজের তদারকিই মূল কাজ। ব্যাংকের কাজ, চেক জমা দেওয়া, টাকা তুলে আনা, ইলেকট্রিক বিল জমা দেওয়া, এসবে ত্রিলোকির উপরই ভরসা করেন অনিল।

খগেন এবং রাজেশ। ললিতাদেবীর দেখাশুনোর দায়িত্ব ছিল এঁদের উপর। খগেনের বয়স বছর তিরিশ, বাড়ি ক্যানিং লাইনে। রাজেশের বয়স বাইশ-তেইশ। বাড়ি ওড়িশায়। দু’জনে প্রায় একসঙ্গেই কাজে ঢুকেছিলেন। বছর চারেক আগে।

সীতা এবং লক্ষ্মী। দুই মহিলা গৃহকর্মী। কাজের মধ্যে, ঘরদোর পরিষ্কার করা, কাপড় কাচা, বাসন মাজা, টুকটাক ফাইফরমাশ খাটা ইত্যাদি। সীতার বয়স কুড়ির কোঠায়, বাড়ি হাওড়ায়। অবিবাহিতা। লক্ষ্মী মাঝবয়সি, বিবাহিতা। লক্ষ্মীকান্তপুরের বাসিন্দা। সীতা-লক্ষ্মী রাত্রে শুতেন দশতলায়, অনিলের ফ্ল্যাটের বারান্দার লাগোয়া একটা ঘরে।

ঘটনার রাতে, ১১/১২ অগস্ট, আটজন কাজের লোকের মধ্যে ছ’জন উপস্থিত ছিলেন। অমলেশের স্ত্রী-র একটি অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন ছিল। দেড় মাসের ছুটি নিয়েছিলেন। জুলাই মাসের ৮ তারিখ থেকে। ফের কাজে যোগ দেওয়ার কথা অগস্টের একুশ-বাইশ নাগাদ।

রাজেশের বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল সপ্তাহখানেক আগে। বাবা অসুস্থ। এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে বাড়ি গিয়েছিল ৮ অগস্ট। চলে আসার কথা পনেরো-ষোলো তারিখের মধ্যে।

অনিল-জয়শ্রী এবং কাজের লোকদের সঙ্গে দফায় দফায় প্রশ্নোত্তরে জানা গেল, ললিতাদেবীর সবচেয়ে বিশ্বাসভাজন ছিলেন তিনজন। কে কে?

লক্ষ্মী, দীর্ঘদিন আছেন বাড়িতে। যাঁকে খুবই ভালবাসতেন ললিতা। প্রতি পুজোয় হাজার খানেক টাকা বরাদ্দ রাখতেন। এটা-ওটা কিনে দিতেন প্রায়ই।

ত্রিলোকি, যাকে অনেক ছোট বয়স থেকে দেখেছিলেন ললিতা। পরিবারের সদস্যের মতোই স্নেহ করতেন। খোঁজখবর রাখতেন ত্রিলোকির বাড়ির লোকজনের। যে-কোনও আর্থিক সমস্যায় সাহায্য করতেন দরাজহস্ত।

রাজেশ, যাকে প্রায় পুত্রবৎ ভালবাসতেন বৃদ্ধা। মাঝেমাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন ললিতা। তখন খাইয়ে দিত এই রাজেশই। বছরখানেক আগে উজ্জয়িনীতে তীর্থে গিয়েছিলেন ললিতা, সঙ্গে গিয়েছিল রাজেশই। অনিল জানালেন, ‘কাজের লোকদের মধ্যে শুধু ত্রিলোকি, লক্ষ্মী আর রাজেশের সঙ্গেই মা খোলামনে কথাবার্তা বলতেন।’

লক্ষ্মী এবং ত্রিলোকির সঙ্গে আলাদা করে অনেকক্ষণ কথা বললেন আশিক। আশাব্যঞ্জক কিছু পাওয়া গেল না। রইল বাকি রাজেশ। ফোন করে খবর পাঠানো হল ওড়িশার বাড়িতে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, ফিরে আসতে বলা হল। ফিরে আসতে বলা হল অমলেশকেও, আরেকজন গৃহকর্মী, যিনি ছুটিতে ছিলেন।

‘সূত্র’ পাওয়ার লক্ষ্যে আবাসনের অন্যান্য স্থায়ী-অস্থায়ী কর্মীদেরও বিশদে জেরা করলেন আশিক। কাউকে বাদ দিলেন না। চার লিফটম্যান, লক্ষ্মণ-হিমাংশু-ইন্দ্রপাল-কৃষ্ণ। চার সুইপার, নিমাই-হিরামন-রামপ্রসাদ-লাল্টু। কেয়ারটেকার অচ্ছেবর সিং এবং তাঁর সহযোগী পল্টু ব্যানার্জি। জেরার ফল? বলার মতো কিছু? ভাবার মতো কিছু? না।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেরা করা হল গেটের নিরাপত্তারক্ষীদের। আদ্যন্ত খুঁটিয়ে দেখা হল ভিজিটর্স রেজিস্টার, পুরনো গেটপাস। রাত্রে তো নয়ই, কোনও বহিরাগত অতিথি ১১ অগস্টের পুরো দিনটাতেই ব্লক এ-র দশ তলা বা এগারো তলায় আসেননি। অন্যান্য ফ্ল্যাটগুলোর গৃহকর্মীদের আসা-যাওয়ার খতিয়ানেও কোনও অসংগতি নেই গেটপাসে, নেই সন্দেহ উদ্রেক করার মতো কিছু। রাতের শিফটের দুই নিরাপত্তাকর্মী সুনির্মল আর দীপক জোর গলায় দাবি করলেন, কেউ ঢোকেনি রাত্রে। প্রশ্নই নেই।

প্রশ্ন আছে কি নেই, ভাবতেই হত না সিসি টিভি থাকলে। এত সম্পন্ন একটা আবাসনে সিসি টিভি নেই, আশ্চর্য লাগে আশিকের। ‘শ্রীনিকেত অ্যাপার্টমেন্টস’ থেকে ১২ অগস্টের রাত্রে বেরনোর সময় ক্লান্ত আশিক ভাবতে থাকেন, কী কী কাজ বাকি আছে আর।

এক, প্রতিবেশীদের জিজ্ঞাসাবাদ। আজ সময়ই পাওয়া গেল না সেভাবে। গোয়েঙ্কা পরিবারের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে, বিশেষ করে অনিল-সুনীলের পারস্পরিক সমীকরণের বিষয়ে বিস্তারিত জানা দরকার।

দুই, প্রতিটি গৃহকর্মীর ‘ব্যাকগ্রাউন্ড চেক’ প্রয়োজন। প্রত্যেকের বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর করা জরুরি। আবাসনের অন্য কর্মীদের ব্যাপারেও আরও খোঁজ নেওয়ার আছে।

তিন, যে দু’জন ছুটিতে ছিল, তারা কাল বা পরশু বিকেলের মধ্যে এসে পড়বে। বাড়তি তথ্য পাওয়া যেতেই পারে কিছু। যদি পাওয়া যায়, দেখতে হবে।

চার, ওই ফ্ল্যাটেরই শুধু নয়, আবাসনের কর্মীদের যাঁদের যাঁদের মোবাইল ফোন আছে তাঁদের কল রেকর্ডস আনাতে হবে। অন্তত গত সাতদিনের। এবং খুঁটিয়ে দেখতে হবে, দিশা পাওয়া যায় কিনা। আশিটা ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের ঠিকুজিকুষ্ঠি জানতে হবে। সবার মোবাইল নম্বর জোগাড় করে পাঠাতে হবে সার্ভিস প্রোভাইডারের কাছে। CDR (Call Details Records) নিতে হবে।

পাঁচ, কাল সকালেই একবার বসতে হবে ওসি হোমিসাইডের সঙ্গে। আলোচনা প্রয়োজন। ডিসি ডিডি তো নিজেই স্পটে এসেছিলেন, ছিলেন অনেকক্ষণ। ফোন করেছেন সন্ধে থেকে অন্তত তিনবার। সিপি-ও খোঁজ নিয়েছেন ওসি হোমিসাইডের কাছে। সবে তো প্রথম দিন। যত দিন যাবে, দ্রুত ‘ডিটেকশন’ করার চাপ উত্তরোত্তর বাড়বে, বুঝতে অসুবিধে হয় না আশিকের।

.

—অনেকগুলো খটকা স্যার… মেলানো মুশকিল…

আশিককে একটু চিন্তিত লাগে ওসি হোমিসাইডের।

—হুঁ… শুনছি, তার আগে বলো মোটিভটা কী মনে হচ্ছে?

—অ্যাপারেন্টলি তো মার্ডার ফর গেইন। স্টোররুমের আলমারি থেকে টাকাপয়সা নিয়ে গেছে।

—কত গেছে?

—এগজ়্যাক্ট অ্যামাউন্টটা বলা মুশকিল। অনিল প্রতি মাসে মা-কে কুড়ি হাজার হাতখরচা দিতেন। মহিলার মাসিক খরচ খুব বেশি ছিল না। নাতি-নাতনিকে এটা-ওটা কিনে দেওয়া, ঠাকুরঘরের টুকিটাকি জিনিস কেনা, বাড়ির কাজের লোকের মধ্যে ত্রিলোকি-রাজেশ-লক্ষ্মীর খুচরো সাধ-আহ্লাদ মেটানো। বাকিটা ছোট ছোট কাপড়ের পুঁটলিতে জমাতেন। অনিল বলছিলেন, লাখখানেক লাখ দেড়েকের মতো তো গেছেই।

—মিসলিড করার পসিবিলিটিটা মাথায় রেখেছ তো? কারণ হয়তো অন্য কিছু, তদন্তটা গুলিয়ে দেওয়ার জন্য লুঠপাট…

—হ্যাঁ, স্যার, সেটা তো মাথায় আছে… অন্য অঙ্ক থাকতেই পারে… আজ সকালেই এক পরিচিত অ্যাডভোকেটের ফোন এসেছিল… কাগজে খুনের খবরটা পড়ে কল করেছিলেন…

—কী বললেন?

—বললেন, পারিবারিক সম্পত্তির সিংহভাগ যে বড়ছেলের নামে ‘প্রোবেট’ করে গিয়েছেন ভগবতীপ্রসাদ গোয়েঙ্কা, সেটা নিয়ে বিস্তর ক্ষোভ আছে ছোটছেলে সুনীলের…

—স্বাভাবিক…

—হ্যাঁ… সম্পত্তির ভাগ চেয়ে নাকি মামলা করার কথা ভাবছিলেন…

—বুঝলাম, কিন্তু ললিতাদেবীর মৃত্যুতে কি মামলায় কোনও সুবিধে হত সুনীলের?

—এমনিতে হওয়ার কথা নয়, তবু একটু কথা বলা দরকার ওই অ্যাডভোকেটের সঙ্গে… উনি আজ কলকাতার বাইরে আছেন… কাল সন্ধেবেলা যাব…

—হ্যাঁ… আর ওই খটকার কথা কী বলছিলে…

—রান্নাঘরের দরজাটা স্যার…

—মানে?

—বলছি স্যার। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে, খুনটা হয়েছে রাত তিনটে থেকে চারটের মধ্যে।

—তো?

—রোজ ভোর পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটায় উঠে ললিতা রান্নাঘরের দরজা খুলে ঠাকুরঘরে যেতেন। মানে, ১২ অগস্টের ভোরে রান্নাঘরের দরজা খোলার স্কোপই ছিল না। তার আগেই মৃত্যু।

—হুঁ…

—অথচ জয়শ্রী সকালে সাড়ে সাতটা-আটটা নাগাদ উপরে গিয়ে দেখেছিলেন, রান্নাঘরের দরজা খোলা। ভিতর থেকে কেউ খুলে দিয়েছিল, এবং সেটা রাত তিনটের আগে। কে খুলল? কারা খুলল? যে বা যারা খুলল, তারা ভিতরে ঢুকল কী করে?

—বলে যাও…

—এটা পরিষ্কার, খুনি বা খুনিরা ওই রান্নাঘরের দরজা দিয়ে ঢুকেছিল। এ ছাড়া রাস্তা নেই ঘরে ঢোকার।

—যদি না মূল দরজায় কেউ বেল বাজায়, এবং মধ্যরাতে উঠে ললিতাদেবী দরজা খুলে দিয়ে থাকেন…

—সে সম্ভাবনা প্রায় শূন্য স্যার। ললিতা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন রোজকার মতো রাত সাড়ে ন’টায়। উপোস ছিল, খাননি। অনিল বলছেন, অচেনা লোক হলে রাতে দরজা খুলতেনই না। আর রাতে কেউ আসতও না।

—অচেনা লোক হলে খুলতেন না, কিন্তু যদি চেনা লোক হয়?

—চেনা লোক বলতে তো অনিলের পরিবার আর সুনীলের পরিবার…

—অনিলের পরিবারের কেউ হলে তা বাইরে থেকে ঢোকার দরকার পড়বে না, দশ থেকে এগারো তলায় ওঠার সিঁড়ি তো আছে ভিতর থেকেই।

—এগজ়্যাক্টলি মাই পয়েন্ট স্যার .. তা হলে পড়ে থাকছেন সুনীল…

—দেখতে গেলে তা-ই, কিন্তু কেন মারবেন মা-কে?

—মেরেছেন তো বলছি না… নিজের মা-কে ওইভাবে ছুরি দিয়ে… টাকাপয়সা নিয়ে… হাইলি আনলাইকলি…

—কিন্তু ধরো যদি উনি বেল বাজালেন, ললিতা ছোটছেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুললেন, আর সুনীলের লাগানো ভাড়াটে গুন্ডারা, যারা অপেক্ষায় ছিল বাইরে, কাজটা করল…

—তাতেও ওই মোটিভের ব্যাপারটা অস্পষ্টই থাকছে।

—হুঁ!

—বাড়ির কাজের লোকদের কারও বা কয়েকজন মিলে খুনটা করার সম্ভাবনা সবথেকে বেশি। সবাই নিম্নবিত্ত পরিবারের। মোটিভ? টাকা।

—আরও ডিটেলে খোঁজ নাও সবার ব্যাপারে।

—নেব স্যার, প্রত্যেকের বাড়ির আর্থিক অবস্থা, শখ-আহ্লাদ-নেশা, সব আজ-কালের মধ্যে পেয়ে যাব আশা করছি। লোক লাগানো হয়ে গেছে।

—বেশ…

—স্যার, ওসব ইনফর্মেশন না হয় জোগাড় হয়েই যাবে, কিন্তু রান্নাঘরের দরজার খোলা থাকাটা কিছুতেই মেলাতে পারছি না। কে খুলল, কীভাবে খুলল, কখন খুলল? কে ঢুকল, কীভাবে ঢুকল, কখন ঢুকল? কার বা কাদের সাহায্যে ঢুকল? আর খুনটা করার পর অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরল কীভাবে…

—গেটে রাতের সিকিউরিটি গার্ডরা তো বলছে, কাউকে বেরতে দেখেনি…

—হ্যাঁ .. বেরতে গেলেও গেট পাস লাগত… খুনটা করার পর পালাতে তো হবে, পালাল কীভাবে…

—সার্ভেন্টস কোয়ার্টার সার্চ করেও তো কিছু পাওয়া যায়নি বলছ?

—না স্যার। মিলছে না, কিছুতেই মিলছে না ফ্ল্যাটে খুনি বা খুনিদের ঢোকা-বেরনোর অঙ্কটা… মিলছে না… কিছু একটা মিস করছি নির্ঘাত।

আশিকের চিন্তিত চেহারাটা দেখে একটু খারাপই লাগে ওসি হোমিসাইডের। এই ঠান্ডা মাথার স্থিতধী অফিসারটিকে তিনি বিশেষ স্নেহের চোখে দেখেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে পিঠে আশ্বাসের হাত রাখেন।

—মিলবে, ঠিক মিলবে। সবে তো একটা দিন হয়েছে। আকাশ থেকে উড়ে এসে তো কেউ রান্নাঘরের দরজা খোলেনি। আততায়ী বা আততায়ীরাই খুলেছে। এখন প্রশ্ন হল, কীভাবে খুলেছে? আর কীভাবে ঢুকেছে?

—স্যার…

—একটা কথা বলি শোনো তোমায়। আমরা যখন ব্যারাকপুরের পুলিশ ট্রেনিং কলেজে প্রবেশনার ছিলাম, একজন আইপিএস অফিসার গেস্ট লেকচারার হিসেবে ইনভেস্টিগেশনের উপর একটা ক্লাস নিয়েছিলেন। শার্লক হোমসের রেফারেন্স দিয়েছিলেন একটা। নোট করে নিয়েছিলাম। মনে গেঁথে আছে এখনও।

—কী স্যার?…

—আর্থার কোনান ডয়েলের একটা উপন্যাস আছে, পড়েছ কিনা জানি না, ‘The Sign of the Four’। যেখানে হোমস এক জায়গায় বলছেন, ‘When you have eliminated the impossible, whatever remains, however improbable, must be the truth.’

—স্যার….

—যা যা অসম্ভব, যা যা হতেই পারে না, সেগুলো একটা একটা করে বাদ দাও। যা পড়ে থাকবে, সেটা যতই কল্পনাতীত মনে হোক, সত্যি হতে বাধ্য। এক্ষেত্রেও যা যা অসম্ভব, বাদ দাও একটা একটা করে। এই এলিমিনেশনটা করতে সময় লাগবে, কিন্তু ধৈর্য হারিয়ো না। একটা সময় দেখবে, যেটা ভাবোইনি কখনও, সেটাই আসলে ঘটেছে। সেটাই সত্যি!

আশিক শোনেন চুপচাপ। মাথা নেড়ে বেরিয়ে আসেন। ফের গন্তব্য আলিপুর। যেতে যেতে ভাবেন, আবাসনের পুরো কম্পাউন্ডটা আঁতিপাঁতি করে তল্লাশি করা হয়েছিল ঘটনার দিন। কিছুই পাওয়া যায়নি। গল্পের গোয়েন্দা হলে নির্ঘাত খুঁজে পেতেন আধপোড়া সিগারেটের টুকরো, কাদায় পায়ের ছাপ কিংবা নিদেনপক্ষে কোনও হুমকি-চিরকুট! কল্পনার শার্লক হোমসের তত্ত্বকথা শুনতে ভাল। বাস্তব অনেক রুক্ষ জমির।

জিজ্ঞাসাবাদ আজও সারাদিন ধরে চালিয়ে যাওয়াই যায়। চালাতে হবেও। কিন্তু ‘লিড’ তো দরকার একটা এগোনোর। কাউকে চেপে ধরতে গেলে, সে বাড়ির লোকই হোক বা কাজের লোক, একটা সূত্র তো দরকার। সেটা কোথায়?

সূত্র অমিলই থাকল। তথ্যসংগ্রহের কাজ যা যা বাকি ছিল, করলেন আশিক। আবাসনের বাসিন্দাদের অনেকের সঙ্গে কথা বললেন দীর্ঘক্ষণ। অজানা কোনও তথ্য আর উঠে এল কই?

১৩ তারিখ রাত্রে আবাসন থেকে বেরনোর সময় ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জনাকয়েক সাংবাদিক ছুটে এসে ‘বুম’ ধরলেন আশিকের মুখের সামনে। পাশ কাটিয়ে গাড়িতে ওঠার সময় আশিক শুনতে পেলেন, ‘আপনারা দেখলেন দিনভর তদন্তের পর ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের অফিসাররা বেরিয়ে এলেন অ্যাপার্টমেন্ট থেকে। আমাদের প্রশ্নের উত্তরে মুখে কুলুপ এঁটেছে পুলিশ। খুনের পর প্রায় আটচল্লিশ ঘণ্টা হতে চলল, অথচ …’

পরের দিন, ১৪ অগস্টের দুপুরে যখন শ্রীনিকেত-এ পৌঁছলেন আশিক, ততক্ষণে আটচল্লিশ ঘণ্টা সত্যিই পেরিয়ে গিয়েছে ললিতা-হত্যার পর। ছুটিতে থাকা দুই কাজের লোক ফিরে এসেছেন। অমলেশ দুপুরে। রাজেশ বিকেলের দিকে। যাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে নতুন কিছু পাওয়া গেল না। অন্যরা যা বলেছিলেন, ওঁরাও তাই বললেন… ললিতার ব্যবহার মাঝেমাঝে রুক্ষ হলেও আদতে সহৃদয় প্রকৃতির মহিলা ছিলেন।

অমলেশের গলা বুজে এল ললিতার কথা বলতে গিয়ে।

—আমার স্ত্রী-র অপারেশনের জন্য ছুটিতে গিয়েছিলাম। হাজার তিরিশেক টাকার মতো খরচ হত। দিদা বলে ডাকতাম ওঁকে। ধার চেয়েছিলাম কিছু। পাঁচ হাজার এক কথায় দিয়ে দিয়েছিলেন।

—কোথায় অপারেশন হল স্ত্রী-র? কী অসুখ?

—মধ্যমগ্রামের নার্সিংহোমে স্যার। গলব্লাডারে স্টোন। পেটে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিল। এখন ঠিক আছে।

রাজেশও কেঁদে ফেললেন ‘মা-জি’-র কথা বলতে গিয়ে।

—মা-জি আমাকে ছেলের মতো ভালবাসত। বকাঝকা করলে পরে গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিত। কলকাতার বাইরে তীর্থে গেলে আমি সঙ্গে যেতাম। আমাকে ছাড়া যেতই না। হিন্দি সিনেমা দেখতে আমি খুব ভালবাসি। নতুন ছবি রিলিজ় হলে নিজে টাকা দিত টিকিটের। বসুশ্রীতে অজয় দেবগনের ‘Yuva’ দেখার টাকা দিয়েছিল এই তো গত মাসে।

দ্বিতীয় দফার জেরায় ত্রিলোকি তথ্য দিলেন আর একটা। গৃহকর্মী সীতার সঙ্গে নাকি লিফটম্যান লক্ষ্মণের বিশেষ ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল ইদানীং। প্রায়ই লক্ষ্মণ এই ফ্ল্যাটে আসত। যেটা ললিতা বিন্দুমাত্র পছন্দ করতেন না। সীতাকে নাকি সপ্তাহখানেক আগে এ নিয়ে বকাঝকাও করেছিলেন। লক্ষ্মণকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছিলেন চেঁচিয়ে। এই ব্যাপারটার আরও গভীরে যাবেন, ঠিক করলেন আশিক। প্রেমে বাধা বড় বিপজ্জনক জিনিস। প্রণয়ী-প্রণয়িনীর হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায় অনেক সময়। তেমন কিছু ঘটেছিল?

সন্ধে হয়ে গেল প্রশ্নোত্তর-পর্ব মিটতে মিটতে। আলিপুর কোর্টের অ্যাডভোকেটের সঙ্গে ওঁর ভবানীপুরের বাড়িতে দেখা করতে আশিক বেরলেন সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। তার আগে সুনীল গোয়েঙ্কাকে এক প্রস্থ জিজ্ঞাসাবাদ হয়ে গেছে। সুনীলের কথাবার্তায়, আচার-আচরণে কণামাত্র অস্বাভাবিকতা খুঁজে পাননি আশিক। মায়ের এহেন মৃত্যুতে পুত্রের যেমন শোকগ্রস্ত হওয়ার কথা, তেমনই। আশিকও তোলেননি ‘প্রোবেট’-এর কথা। আগে দেখা যাক ওই উকিলের সঙ্গে কথা বলে, সম্পত্তি নিয়ে মামলা-মোকদ্দমার ব্যাপারটা কতটা এগিয়েছে, আদৌ এগিয়েছে কি না।

হাজরা মোড়ের সিগন্যালে গাড়ি থামল। দু’ মিনিট গেল, চার মিনিট গেল, থেমেই আছে। কী ব্যাপার? গাড়ি থেকে নেমে একটু এগিয়ে গিয়ে দেখে এল ড্রাইভার।

একটা বড় মিছিল যাচ্ছে স্যার। ট্র্যাফিক সার্জেন্ট বললেন, গাড়ি ছাড়তে কম করে হলেও আরও মিনিট দশ।

অপেক্ষা ছাড়া কী আর করার? আশিক আনমনা তাকিয়ে থাকেন গাড়ির বাইরে। বসুশ্রীর ইভনিং শো শুরু হওয়ার মুখে। লোক ঢুকছে। সিনেমার পোস্টারের দিকে তাকান আশিক। ‘Yuva’.. starring Ajay Devgan, Abhishek Bachchan..।

এই ছবিটার কথাই বলছিল রাজেশ ছেলেটা। অজয় দেবগনের ফ্যান, কোনও ছবিই নাকি মিস করে না। নিজের ওই বয়সটার কথা মনে পড়ে আশিকের। অমিতাভ বচ্চনের একটা ছবিও মিস করতেন না তখন। এখনও করেন না। বিগ বি-র কত ছবি যে এই বসুশ্রীতেই দেখেছেন। তবে এই হলে দেখা যে ছবিটা মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছিল, তার প্রতিটা দৃশ্য এখনও মুখস্থ বলতে পারবেন। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’।

মিছিল হাজরা মোড় পেরিয়ে গেছে। সিগন্যাল গাঢ় সবুজ। গাড়িঘোড়া চলতে শুরু করেছে ফের। যখন গাড়ি যদুবাবুর বাজার পেরোচ্ছে, হঠাৎই আশিক তরঙ্গস্রোত টের পান মস্তিষ্কের ধূসর কোষগুলোয়। যাকে Hercule Poirot বলতেন, ‘the little grey cells’।

—এই, গাড়ি ঘোরাও!

ড্রাইভার অবাক দৃষ্টিতে তাকান পিছন ফিরে। অধৈর্য আশিক ফের নির্দেশ দেন।

—বলছি তো গাড়ি ঘোরাও!

গাড়ি ফের দক্ষিণমুখী। থেমেছে গিয়ে সেই হাজরা মোড়েই। আশিক সোজা গিয়ে ঢুকেছেন বসুশ্রীতে, ম্যানেজারের ঘরে। পুলিশ দেখে ম্যানেজার সামান্য হতচকিত। উঠে পড়েছেন চেয়ার ছেড়ে।

—কী ব্যাপার স্যার?

—তেমন কিছু না, একটা ব্যাপার জানার ছিল।

—বলুন না স্যার… আপনার জন্য চা-কফি কিছু…

—না না, দরকার নেই… সামান্য ব্যাপার… আচ্ছা, এই ‘Yuva’ বলে সিনেমাটা কতদিন ধরে চলছে এখানে?

—এই তো গত সপ্তাহ থেকে স্যার, মানে গত শুক্রবার ৬ তারিখ থেকে। রিলিজ় হয়েছে মাসদুয়েক আগে। অন্য একটা ছবি ভাল চলছিল। ‘Yuva’ লেগেছে গত সপ্তাহ থেকে।

আশিকের হৃদ্‌স্পন্দন বেড়ে যায় হঠাৎ। তা হলে কি যা ভাবছেন, তা-ই? আজ শনিবার, ১৪ তারিখ। ছবি রিলিজ় করেছে ৬ তারিখ। মানে বসুশ্রীতে ছবিটা দেখতে গেলে ৬ থেকে ১৩-র মধ্যে দেখতে হবে রাজেশকে। রাজেশ ছুটিতে ওড়িশা গিয়েছিল ৮ তারিখ। ফিরেছে আজ বিকেলে। তা হলে ছবিটা দেখল কবে? যদি ছয় বা সাত তারিখে দেখে না থাকে, তা হলে ৮ থেকে ১৩-র মধ্যে দেখেছে। কিন্তু বলল তো গত মাসে বসুশ্রীতে দেখেছে! কী করে সম্ভব? ছুটিতে ওড়িশায় যাওয়ার গল্পটা তা হলে ডাহা মিথ্যে? ওই সময়টার মধ্যে কোনও একদিন অন্তত কলকাতায় ছিল? বাবার অসুখের নাম করে ছুটি নিয়ে কেন ছিল শহরে? মিথ্যে বলল কেন? যার একটা মিথ্যে ধরা পড়ে গেছে, তাকে আর বিশ্বাস করা চলে না।

যতটা না সমাপতন, তার থেকে ঢের বেশি কাজ করেছিল তদন্তকারীর সহজাত অনুসন্ধিৎসু প্রবৃত্তি। গাড়িতে ফিরতে ফিরতে বসুশ্রীতে দেখা ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ স্মৃতিতে ফিরে এসেছিল আশিকের, প্রিয় সেই দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল হঠাৎ, মনে পড়েছিল সংলাপটা। এবং মনে পড়তেই যদুবাবুর বাজারের কাছে গাড়ি থামিয়ে দিয়েছিলেন আশিক, ড্রাইভারকে বলেছিলেন গাড়ি ঘোরাতে।

ছবিটা যখন দেখেছিলেন, তখন বোধহয় ক্লাস নাইন বা টেন। শেষ দৃশ্যে মছলিবাবার বেশধারী ফেলুদা নয়, মগনলালের ডেরায় লালমোহনবাবুর দিকে তাক করে সেই ‘knife throwing’-এর দমবন্ধ করা সিনটাও নয়, কিশোর আশিকের সবচেয়ে ভাল লেগেছিল ছবির অন্য একটা জায়গা। যেখানে ঘোষালবাড়ির কর্মী বিকাশের মিথ্যে ধরে ফেলেছিল ফেলুদা। একটা নির্দিষ্ট সময়ে কোথায় ছিলেন, জানতে চাওয়ায় বিকাশ বলেছিলেন, গান শুনছিলেন রেডিয়োতে। আখতারি।

ফেলুদার সন্দেহ হওয়াতে যাচাই করেছিল আকাশবাণীর প্রোগ্রাম তালিকা থেকে। ওইসময় আখতারি হচ্ছিলই না। আশিকের দারুণ লেগেছিল মিষ্টির দোকানে ফেলুদার চেপে ধরা বিকাশকে, কোমরে আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে নিয়ে যাওয়া যন্তরমন্তরের ছাদে, সেই সংলাপ সহ, ‘যার একটা মিথ্যে ধরা পড়ে গেছে, তাকে আর বিশ্বাস করা চলে না।’

রাজেশেরও একটা মিথ্যে ধরা পড়ে গেছে, তাকেও আর বিশ্বাস করা চলে না। উকিলের বাড়ি আর যাওয়া হল না আশিকের। গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা ‘শ্রীনিকেত অ্যাপার্টমেন্টস’। রাজেশ ছিল ছাদের সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে। আশিক এগারো তলায় নামিয়ে আনলেন। কোন ভণিতা না করে চোখে চোখ রাখলেন রাজেশের।

—Yuva সিনেমাটা কেমন লেগেছিল?

হঠাৎ এ প্রশ্নে কিছুটা থতমত খেয়ে যায় রাজেশ।

—মানে?

—বলছি, কেমন লেগেছিল?

—ভাল স্যার…

—কবে দেখলি?

—এই তো গত মাসে স্যার। আপনাকে বললাম তো বিকেলে, বসুশ্রীতে।

আর কিছু জিজ্ঞাসা করার ছিল না আশিকের। কলার চেপে ধরে হিড়হিড় করে ফ্ল্যাটের বাইরে লিফটে। নীচে নেমে গাড়িতে তুলে সোজা লালবাজার। গাড়িতে একটা শব্দও ব্যয় করলেন না আশিক। বেশ বুঝতে পারছিলেন, ঘামতে শুরু করেছে পাশে বসা রাজেশ। মুখচোখ থেকে ব্লটিং পেপার দিয়ে যেন রক্ত শুষে নিয়েছে কেউ।

কতশত ধুরন্ধর অপরাধীর লালবাজারের ইন্টারোগেশন রুমে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যেতে দেখেছেন আশিক, ইয়ত্তা নেই। তুলনায় এ ছোকরা তো নেহাতই চুনোপুঁটি! হাতি-ঘোড়া যেখানে তলিয়ে যায়, মশা সেখানে কী করে জল মাপবে? খুচরো চড়-থাপ্পড় খরচ হল একটা-দুটো, এবং বলতে শুরু করল রাজেশ। গোয়েন্দারা শুনতে থাকলেন ললিতাদেবীর হত্যার রুদ্ধশ্বাস নেপথ্যকথা।

—আমার বাবার কোনও অসুখ-টসুখ হয়নি স্যার। গ্রামের বাড়ির এক বন্ধুকে বলেছিলাম, যে বাড়িতে কাজ করি, সেখানে ছুটি কিছুতেই দিতে চায় না। তুই ফোন করে বলবি, বাবার অসুখ। তা হলে এক সপ্তাহের জন্য বাড়ি আসতে পারব।

—তারপর?

—স্যার, বাড়িতে আমি যাইনি। নরেন্দ্রপুরে আমাদের এক দূরসম্পর্কের মাসি থাকেন। বউবাজারে একটা বাড়িতে কাজ করেন। ওঁর বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলাম আট তারিখ। আমাকে ঘরের চাবি দিয়ে মাসি সকালে বেরিয়ে যেত কাজে। আমি বেরলে চাবিটা জানালা দিয়ে হাত গলিয়ে কাছের একটা টেবিলের উপর রেখে দিতাম। আমার ফেরার আগে মাসি চলে এলে হাত ঢুকিয়ে চাবিটা নিয়ে দরজা খুলত।

—বেশ ..

—পরের দিন, ভবানীপুরের একটা দোকান থেকে একটা ভিআইপি সুটকেস কিনলাম। তার পরের দিন Yuva দেখলাম বসুশ্রীতে। এগারো তারিখ ভোরে অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকলাম।

—এগারো তারিখ ভোরে?

—হ্যাঁ স্যার, এগারো তারিখ।

—কীভাবে ঢুকলি?

—স্যার, গেট দিয়ে ঢুকতে পারব না জানতাম। নাইটগার্ড দু’জনের একজন জেগে থাকত, একজন ঘুমোত পালা করে। গেটে তালা দিয়ে রাখত রাত বারোটার পর। ঢোকার রাস্তা ছিল না।

—তা হলে?

—বাড়িটার চারদিকে বেশ কিছু উঁচু গাছ আছে, নিশ্চয়ই দেখেছেন স্যার। পশ্চিম দিকে বেশি। আমি আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম, গাছে উঠে ওখান দিয়ে পাঁচিল টপকাব। টপকে বাড়ির ভিতর যাওয়ার সময় পাঁচিলের তারে লেগেছিল পায়ে।

—দেখা …কোথায় লেগেছিল?

ট্রাউজার হাঁটু অবধি তুলে ক্ষতচিহ্ন দেখায় রাজেশ। ফের বলতে শুরু করে।

—ওই সময়টায় লিফটম্যান থাকে না, কেয়ারটেকারের অফিসের সামনে খাটিয়ায় অচ্ছেবর ভাইয়া ঘুমিয়ে থাকে। কেউ কোত্থাও থাকে না। সোজা সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম ছাদে। অন্য কাজের লোকেরা তখন সবাই ঘুমোচ্ছে।

—তারপর?

—ছাদে উঠে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এগারো তলার রান্নাঘরের সামনে নেমে এলাম। জানতাম, মা-জি ভোরে উঠবে। পাঁচটা সাড়ে পাঁচটা নাগাদ দরজা খুলে দিয়ে পুজোয় বসবে। সাড়ে ছ’টা পর্যন্ত ঠাকুরঘরে পুজো করবে। বারান্দা থেকে কালীঘাট মন্দিরের চুড়ো দেখা যেত। পুজো শেষ হলে দশ মিনিট বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওদিকে তাকিয়ে প্রণাম করত মা-জি। দরজা খুলে গেল সাড়ে পাঁচটায়। মিনিট দশেক অপেক্ষা করে ঢুকে পড়লাম ভিতরে।

—হুঁ…

—বসার ঘরে এসে হলঘরের কোনায় যে বাথরুমটা সবসময় বন্ধ থাকত, সেটার ছিটকিনি খুলে ঢুকে পড়লাম। ভিতর থেকে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দিলাম।

—বাথরুমে?

—লুকোনোর ওটাই সবচেয়ে ভাল জায়গা ছিল স্যার। ওই বাথরুমটা বহু বছর ব্যবহার হয় না। ওর মধ্যে কেউ থাকতে পারে, কেউ ভাবতেও পারবে না, জানতাম।

—তারপর?

—ভেবেই রেখেছিলাম, খুনটা রাতে করে পরদিন ভোরে বেরিয়ে যাব। সারাদিন ওই বাথরুমেই থাকলাম।

আশিক এবং সঙ্গীরা স্তব্ধ হয়ে যান। বলে কী! এভাবেও প্ল্যান করা যায়!

—সঙ্গে একটা চটের ব্যাগ ছিল। মাসির বাড়ি থেকে একটা বড় কাঠ কাটার ছুরি এনেছিলাম। দু’প্যাকেট বিস্কুট আর কয়েকটা টিফিন কেকও এনেছিলাম। সারাদিনে ওগুলো খেলাম। বাথরুমেই ঘুমোলাম। একটুও সাড়াশব্দ করিনি সারাদিন। অপেক্ষা করে থাকলাম রাতের জন্য।

—বলতে থাক…

—রাত যখন তিনটে, বাথরুম থেকে বেরলাম। মা-জি নিজের শোবার ঘরে ঘুমোচ্ছে। বারান্দায় লোহার পাইপ রাখা ছিল কয়েকটা। একটা নিলাম। আগে মা-জি র মুখ চেপে ধরলাম। জেগে গেল। আমার জামাটা চেপে ধরল। টানাহ্যাঁচড়া হল। পাইপ দিয়ে মা-জির মাথায় মারলাম জোরে। রক্ত বেরচ্ছিল খুব। বেডশিট দিয়ে মুড়লাম মা-জিকে। টেনে টেনে নিয়ে গেলাম। ড্রয়ারে স্টোররুমের চাবি থাকত। সেটা দিয়ে স্টোররুম খুলে ঢোকালাম বডিটাকে।

—হুঁ…

—মা-জির তখনও নিশ্বাস পড়ছিল। ভয় পেয়ে গেলাম, তা হলে কি মরেনি? ছুরিটা চালালাম গলায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরতে লাগল। একটু পরে নাকে হাত দিয়ে দেখলাম, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে।

—এরপর আলমারি খুললি, টাকাপয়সা নিলি, ব্যাগে ভরলি…

—হ্যাঁ স্যার, বেরিয়ে এলাম রান্নাঘর দিয়ে। ছাদে উঠে আবার সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম। যেভাবে ঢুকেছিলাম, সেভাবেই বেরলাম। পাঁচিল টপকে। চটের ব্যাগটা আগে ছুড়ে বাইরে ফেললাম। তারপর দেওয়াল টপকে বেরিয়ে এলাম। তখন ভোর পাঁচটা সোয়া পাঁচটা হবে।

—তারপর?

—নরেন্দ্রপুরে মাসির বাড়িতে এলাম। মাসি তখন কাজে বেরিয়ে গেছে। ভিআইপি-তে টাকাপয়সা ভরে হাওড়া স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরলাম ওড়িশার। পরদিন খুব ভোরে পৌঁছলাম। বাড়িতে সুটকেসটা রেখে এসেছি। বাড়িতে বললাম, একদিনের জন্য এসেছি। ত্রিলোকিদা বিকেলে ফোন করল। বলল, পুলিশ চলে আসতে বলছে। মা-জি খুন হয়ে গেছেন। আমি গতকাল বিকেলের ট্রেন ধরে আজ কলকাতা চলে এলাম।

—স্টোররুমের চাবিটা?

—কয়েকটা বাড়ি পরে একটা ঝোপের মধ্যে ফেলে দিয়েছি। চলুন স্যার, দেখিয়ে দিচ্ছি।

—সে তো যাবই, কিন্তু তোকে তোর মা-জি এত ভালবাসতেন, মারলি কেন?

—টাকার লোভে স্যার। বারোশো টাকা মাইনে পেতাম স্যার। ওতে কিছু হয়? সিনেমায় দেখতাম বড়লোকরা কীভাবে জীবন কাটায়। কত মস্তি। ভাবতাম, সারাটা জীবন কি এই চাকরগিরি করেই কেটে যাবে? কিছুদিন পরে সব ঠান্ডা হয়ে গেলে চাকরিটা ছেড়ে দেব ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম, টাকাটা দিয়ে ব্যবসা শুরু করব কিছু।

রাতেই আশিকের নেতৃত্বে রাজেশকে নিয়ে টিম রওনা দিল ওড়িশায়। গ্রামের বাড়ি থেকে উদ্ধার হল সেই ভিআইপি সুটকেস। যার মধ্যে ভরতি টাকার বান্ডিল। সব মিলিয়ে এক লক্ষ আটান্ন হাজার। পাওয়া গেল রক্তমাখা শার্ট, যার দুটো বোতাম নেই। কলকাতায় ফিরে রাজেশের বয়ান অনুযায়ী অশোকা রোডের ফুটপাথ সংলগ্ন একটা ঝোপ থেকে পাওয়া গেল স্টোররুমের সেই চাবি। ফরেনসিক পরীক্ষায় প্রমাণিত হল, রাজেশের ওড়িশার বাড়ি থেকে পাওয়া শার্টের বোতাম আর ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া দুটো বোতাম একই পোশাকের। কী বাকি থাকে আর পারিপার্শ্বিক প্রমাণের? কী বাকি থাকে আর অভিযুক্তের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার?

শাস্তি হয়েছিল যাবজ্জীবন কারাবাসের। আশিকের তদন্ত প্রশংসা কুড়িয়েছিল আদালতের।

মার্ডার ফর গেইন। টাকার জন্য খুন। লাভের জন্য খুন। লাভ কি হয় আদৌ? হয় ‘গেইন’ আদৌ?

আইন তো যথাসময়ে এসে কড়া নাড়েই দরজায়।

পুনশ্চ: অনিল এবং সুনীল, এই নামদুটি পরিবর্তিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *