২.০২ মেলাবেন তিনি মেলাবেন

মেলাবেন তিনি মেলাবেন
[উদয় সিং হত্যা
অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়, গোয়েন্দাবিভাগের সহ নগরপাল। ২০০৪ সালে ভারত সরকারের প্রদত্ত ‘ইন্ডিয়ান পুলিশ মেডেল’-এ সম্মানিত। ২০০৯ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ‘প্রশংসা পদক’। কর্মক্ষেত্রে ধারাবাহিক প্রশংসনীয় দক্ষতার জন্য ‘রাষ্ট্রপতি পদক’ পেয়েছেন ২০১৭ সালে।]

শুধু ‘হোলি হ্যায়’ চিৎকারটাই যা বাকি!

আবির হরেক রঙের। লাল-নীল-সবুজ, বেপরোয়া উড়ছে হাওয়ায়। আলিপুর কোর্ট প্রাঙ্গণে উদ্দাম উল্লাসে ঊর্ধ্ববাহু একদঙ্গল যুবক। দুধসাদা পাজামা-পাঞ্জাবি সবার। হাতে ঠোঙা ভরতি আবিরের স্টক অফুরান। অকৃপণ ওড়াচ্ছে জয়োৎসবে। ফুর্তির উপলক্ষ? তিন যুবক, যারা নায়কোচিত ভঙ্গিতে বেরচ্ছে এজলাস থেকে।

একটু আগে রায় ঘোষণা করেছেন বিচারক। ওরা তিনজন বেকসুর খালাস পেয়েছে খুনের মামলা থেকে। বছর চারেক জেলবন্দি থাকার পর। আদালত চত্বরে ভিড় জমানো অনুরাগীরা সাদরে স্বাগত জানাচ্ছে মুক্তিপ্রাপ্ত অভিযুক্তদের। আবিরে নিমেষে রংবেরং করে দিচ্ছে একে-অন্যের সাদা পাঞ্জাবি।

অতনু দেখছিলেন স্তব্ধ হয়ে। অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়, লালবাজারের গোয়েন্দাবিভাগের হোমিসাইড শাখার তরুণ সাব-ইনস্পেকটর। জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছিল ’৯৭-এর ৬ ডিসেম্বর। রায় বেরল আজ, ২০০১-এর ৩০ অগস্ট। খুনের কিনারা তো ঘটনার দিনই হয়ে গিয়েছিল। মাথা খাটানোর বিশেষ ব্যাপার ছিল না। খুনটা যারা করেছিল, ধরতে খুব একটা কাঠখড় পোড়াতে হয়নি।

কিন্তু এটা কী হল? কী ভাবে সম্ভব? হোমিসাইড শাখার চার্জশিট চিরাচরিত ভাবে নিশ্ছিদ্র হয় বলেই গুরুত্বপূর্ণ খুনের মামলার ভার গোয়েন্দাবিভাগের উপর পড়ে। ডিপার্টমেন্ট ধরেই নেয়, হোমিসাইড কেসটা দেখছে মানে অভিযুক্তদের শাস্তি একশো শতাংশ নিশ্চিত। কোনও গল্পই থাকবে না সাক্ষ্যপ্রমাণের চক্রব্যূহ ভেদের।

এই কেসের ‘মেমো অফ এভিডেন্স’ আর চার্জশিটে মাছি গলার মতো ফাঁকও রাখেননি অতনু। গত রাতেও নিশ্চিত ছিলেন, চার অপরাধীর দোষী সাব্যস্ত হওয়া তো স্রেফ নিয়মরক্ষা। মৃত্যুদণ্ডের সম্ভাবনা নেই, তবে যাবজ্জীবন তো অবধারিত।

অথচ সব হিসেব উলটে গিয়ে বেকসুর খালাস! তাচ্ছিল্যের হাসি ছুড়ে দিচ্ছেন অভিযুক্তদের আইনজীবী। যাঁর শরীরী ভাষায় দিব্যি পড়া যাচ্ছে, ‘কী? কেমন দিলাম!’ ইচ্ছে করেই গা ঘেঁষে মুঠো মুঠো আবির ওড়াচ্ছে খালাস হওয়া তিন যুবকের চেলাচামুন্ডারা। উড়ে আসছে কান গরম করে দেওয়া বক্রোক্তি, ‘লালবাজার তো ফুটে ফুলকপি রে!’ বাকিরা সুর করে গলা মেলাচ্ছে সোৎসাহে, ‘ফুটে কী? ফুটে ফুলকপিইইই!’

ক্ষোভ-দুঃখ-অপমান একত্রে সঙ্গী হলে যা হয়, মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে ছত্রিশ বছরের অতনুর। কালকের খবরের কাগজে ফলাও করে বেরবে এই রায়, ‘পুলিশি তদন্তে ফাঁক, মুক্তি পেল উদয় সিং হত্যামামলার অভিযুক্তরা, তীব্র ভর্ৎসনা তদন্তকারী অফিসারকে’ ইত্যাদি প্রভৃতি। ডিপার্টমেন্টে মুখ দেখাবেন কী করে? পরিশ্রমী এবং অনুসন্ধিৎসু স্বভাবের জন্য ওসি হোমিসাইড বিশেষ স্নেহ করেন অতনুকে। জটিল মামলা এলে খোদ ডিসি ডিডি প্রায়ই বলে থাকেন, ‘এটা অতনু করুক!’ এ যা হল, কেরিয়ারেই তো কালো দাগ পড়ে গেল!

.

দুম! দ্রাম!

প্রথমে বিকট শব্দে গোটাকয়েক বোমা। ধোঁয়ায় ধোঁয়াক্কার চারদিক। তারপর গুলি কয়েক রাউন্ড।

ফ্ল্যাশব্যাকে ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯৭। সকাল দশটা। ওয়াটগঞ্জ থানা এলাকার রামকমল স্ট্রিটের লাগোয়া রকে বসেছিলেন উদয় সিং। রোজকার মতো আড্ডা দিচ্ছিলেন চায়ের কাপ হাতে। পাশে সর্বক্ষণের ছায়াসঙ্গী নরেশ, কল্যাণ, বোম্মাইয়া। উলটোদিকের ফুটপাথে নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করছিলেন উদয়ের ছোটভাই রঞ্জিত আর স্থানীয় যুবক নিতাই, যিনি উদয়ের ব্যবসায় দীর্ঘদিনের কর্মী।

হঠাৎই হাতে বোমা-পিস্তল নিয়ে আবির্ভাব চার যুবকের। সোজা উদয়ের দিকে ধেয়ে এসে বোমা-গুলির দুম-দ্রাম, নির্বিচারে। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল, বোমা নয়। একাধিক স্প্লিন্টার ঢুকল উদয় আর নরেশের শরীরে। রক্তাক্ত শরীর দুটো ঢলে পড়ল মাটিতে। অল্পের জন্য অক্ষত থাকলেন আড্ডার অন্য দুই সঙ্গী, কল্যাণ আর বোম্মাইয়া।

আতঙ্কের ঘোর কাটিয়ে উলটোদিকের ফুটপাথ থেকে যতক্ষণে রঞ্জিত-নিতাই ছুটে এসেছেন রাস্তার এপারে, গুলি ছুড়তে ছুড়তে তখন ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাচ্ছে চার আততায়ী। ঘটনা যেখানে ঘটছে, সে-রাস্তা দিনভর ব্যস্ত থাকে লোকজনের আনাগোনায়। তার উপর সময়টা ভাবুন, সকাল দশটা! জনতা ধাওয়া করল ঘাতক চতুষ্টয়ের পিছনে। তিনজন পালাল নাগালের বাইরে। চতুর্থ আততায়ী পিছিয়ে পড়ল কিছুটা, পিছনে রে-রে করে ছুটে আসা দঙ্গলটার সঙ্গে কমতে থাকল ব্যবধান।

উদয় আর নরেশের রক্তে ভেসে যাওয়া শরীর দুটো যখন স্থানীয়রা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়িতে তুলছেন, ততক্ষণে আশেপাশে খবর ছড়িয়ে পড়েছে উল্কাগতিতে। উদয় সিং বোমার আঘাতে গুরুতর আহত, বেঁচে থাকার সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি। সেই উদয় সিং, যার অঙ্গুলিহেলনে চালিত হয় বন্দর এলাকার একটা বড় অংশের অন্ধকার জগৎ। স্থানীয়দের কাছে যিনি হয় ‘উদয় ভাই’, নয় ‘উদয় ভাইয়া’।

সোয়া দশটা নাগাদ ফোনে খবর এল ওয়াটগঞ্জ থানায়। উদয় সিং-এর উপর গুলিবোমার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে এলাকায়, আন্দাজ করতে তিরিশ সেকেন্ডের বেশি লাগল না ওসি-র। প্রথম ফোনটা করলেন ডিসি পোর্টকে, দ্বিতীয়টা লালবাজার কন্ট্রোল রুমে। ডিসি রওনা হলেন রামকমল স্ট্রিটের উদ্দেশে। পোর্ট ডিভিশনের সমস্ত থানার ওসিদের ওয়ারলেস মারফত জরুরি নির্দেশ পাঠালেন ডিসি হেডকোয়ার্টার, ‘স্পটে যান।’ গার্ডেনরিচ-একবালপুর-মেটিয়াবুরুজ-নর্থ পোর্ট-ওয়েস্ট পোর্ট-সাউথ পোর্ট, সব থানার গাড়ি ছুটল। হাতের কাছে যা ফোর্স-অফিসার আছে, তাই নিয়ে। লালবাজার থেকেও তড়িঘড়ি ওয়াটগঞ্জে রওনা দিল RAF।

‘ধুন্ধুমার’ আজকাল মিডিয়ার খুব প্রিয় শব্দ। চ্যানেলে হোক বা খবরের কাগজে, দু’-চারজনের মধ্যে কোথাও সামান্য খুচরো খুনসুটির ঘটনা ঘটলেও অবলীলায় ব্যবহৃত হয় ‘ধুন্ধুমার’, পরিস্থিতি সে যতই হোক তেমন কিছুর যোজনখানেক দূরে।

থানা থেকে খুনের জায়গাটা খুব বেশি হলে পৌনে এক কিলোমিটার। পুলিশ যখন পৌঁছল, রামকমল স্ট্রিটে তখন আক্ষরিক অর্থেই ধুন্ধুমার। দোকানপাট যত ছিল রাস্তার দু’ধারে, ঝাঁপ পড়ছে দ্রুত। উদয় সিং-এর অনুগামীরা জড়ো হয়েছে শয়ে-শয়ে। হাতে লাঠি আর পাকানো বাঁশ। পথচলতি গাড়িঘোড়ায় এলোপাথাড়ি ভাঙচুরে ঘটছে ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে ইটবৃষ্টি চলছে লাগাতার।

এ অবস্থায় যা করতে হয়, যা করা উচিত, করল পুলিশ। বেধড়ক লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস এবং ধাওয়া করে ধরপাকড়, যতজনকে পারা যায়। প্রায় ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় যখন পরিস্থিতি কিছুটা আয়ত্তে এল, ফের শুরু হল যানচলাচল, খবর এল ক্যালকাটা হসপিটাল (বর্তমানের সিএমআরআই) থেকে। উদয় সিং মৃত। নরেশ লড়ছেন, তবে সে লড়াইয়ে হার প্রায় নিশ্চিত। ডাক্তাররা জানিয়েই দিয়েছেন একরকম, আর কয়েক ঘণ্টা বড়জোর।

.

ওয়াটগঞ্জ থানা, কেস নম্বর ২৭৫, তারিখ ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯৭। ধারা, ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২/৩০৭/৪২৭/৩৪, খুন, খুনের চেষ্টা, সম্পত্তির ক্ষতি এবং একই অপরাধের উদ্দেশ্যে একাধিকের সম্মিলিত পরিকল্পনা,

২৫ (১বি)(A)/২৭ অস্ত্র আইন, ৩ এবং ৫ বিস্ফোরক পদার্থ আইন।

দুষ্কৃতীদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের পরিণতিতে গুলি, বোমাবাজি এবং খুন। ঘটনা আজ থেকে একুশ বছর আগের। এবং একেবারেই অভূতপূর্ব নয়। দুষ্কৃতীদের এলাকা দখলের লড়াইয়ে এমন ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। পরেও। উপরন্তু এ মামলাতে প্রথাগত রহস্য নেই, কিনারাপর্বে নেই মস্তিষ্কের কসরত।

তবু এ কাহিনি বহু আলোচিত কলকাতা পুলিশের ইতিহাসে। তথাকথিত ‘ওপেন অ্যান্ড শাট’ মামলাও যে কী গভীর বিড়ম্বনায় কখনও কখনও ফেলে দিতে পারে বাস্তবের গোয়েন্দাদের, কী দুঃসহ পরীক্ষা যে নেয় ধৈর্যের-স্থৈর্যের-মনোবলের, আলোচ্য কেসের ইতিবৃত্ত তার প্রামাণ্য দলিল।

ঘটনায় ফিরি। যেমন ভাবা গিয়েছিল, উদয়ের সঙ্গী হলেন আহত নরেশও। মারা গেলেন বিকেল সোয়া চারটে নাগাদ। ময়নাতদন্তে নতুন কিছু পাওয়ার ছিল না। রুটিন কাটাছেঁড়ার পর রুটিন রিপোর্ট, শরীরের বিভিন্ন অংশে স্প্লিনটারের আঘাতে মৃত্যু।

মারমুখী জনতাকে হঠিয়ে দিয়ে যখন এলাকার দখল নিয়েছে পুলিশ, খবর এল, কাছেই মণিময় ব্যানার্জি রোডে গুরুতর জখম অবস্থায় পড়ে আছে এক যুবক। ওসি ছুটলেন।

ড্রেনের ধারে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা যুবকের শার্ট রক্তে মাখামাখি। পাশে একটা দেশি রিভলভার পড়ে আছে। তুলে দেখা গেল, সেমি-লোডেড। চেম্বারে এখনও তিন রাউন্ড গুলি। স্থানীয় মানুষ এসব ক্ষেত্রে এতটাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন, মুখ খুলতেই চান না কেউ। যাকেই জিজ্ঞেস করা হোক, কাটা রেকর্ডের মতো বাজতে থাকে, ‘আমি তো কিছু দেখিনি সেভাবে।’ স্বাভাবিকই। কে আর চায় খামোখা খুনখারাপির মামলায় জড়াতে? কিছু বললেই পুলিশ বয়ান নেবে। তাতে সইসাবুদ করতে হবে। কোর্টে ডাক পড়বে সাক্ষী দিতে। কী লাভ অত ঝামেলায় গিয়ে? এমনি এমনি কি আর বলে, ‘পুলিশে ছুঁলে…!’

কথাবার্তা বলে তবু জানা গেল যতটুকু, এই আহত যুবককে ধাওয়া করেছিল জনা কুড়ি-পঁচিশের একটা দল। হাতে রিভলভার উঁচিয়ে পালাচ্ছিল যুবক। একটা সময় আর পেরে ওঠেনি দৌড়ে। ধরে ফেলেছিল পিছু-নেওয়া জনতা। কিল-ঘুষি-লাথি কিছুক্ষণ চলেছিল যা খুশি, যেমন খুশি। কৌতূহলী স্থানীয় মানুষের ভিড় বাড়তে থাকলে ওই অবস্থায় যুবককে ফেলে রেখে উধাও হয়ে যায় ওই কুড়ি-পঁচিশ।

রক্তপাত হয়েছে প্রচুর। তবে যুবক তখনও বেঁচে। গাড়িতে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। তবে তার আগেই জানা হয়ে গেছে পরিচয়। ওসি একঝলক দেখেই চিনেছিলেন। এর নাম বাদল। বাদল মুখার্জি। বেহালার পাঠকপাড়ায় বাড়ি। খিদিরপুর এলাকায় একটা দোকান আছে। আগে একাধিকবার ধরা পড়েছে তোলাবাজি-মারদাঙ্গার অভিযোগে। উদয়ের বিরোধী গোষ্ঠীর মস্তানদের মধ্যে এই বাদল বরাবরই প্রথম সারিতে। নির্ঘাত উদয়কে যারা মারতে এসেছিল, তাদের মধ্যে ছিল। পালাতে পারেনি, মার খেয়েছে বেধড়ক। মরেই যেত আর একটু হলে। অবশ্য চোট-আঘাতের যা অবস্থা, মরে যে যাবে না, গ্যারান্টি নেই কোনও।

বাদল পালাতে পারেনি। কিন্তু যারা পেরেছে, তারা কারা? কোথায় পালাল? এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া নিয়ে চিন্তিত দেখাচ্ছিল না ওসি-কে। দিনের আলোয় মেরেছে। পালানোর সময় একজন গণপিটুনিতে হাসপাতালে। অন্যদের নাম জানা যাবে দ্রুতই। এবং জানার পর গ্রেফতার তো স্রেফ সময়েরই ব্যাপার। গ্যাং-ওয়ারের ঘটনায় যেমন হয়।

খুনিরা পালিয়ে যাবেই বা কোথায়? আর গেলেই বা কতদিন? এখন ঢের বেশি জরুরি এলাকার আইনশৃঙ্খলার স্থিতাবস্থা, ফের যাতে গোলমাল না বাধে, সেটা নিশ্চিত করা। কোথায় কোথায় পুলিশ পিকেট বসবে আগামী সাতদিন, টহলদারি গাড়ি কোথায় কোথায় নজর রাখবে বেশি, ওসি তৈরি করতে শুরু করলেন ব্লু প্রিন্ট। থানার এত কাছে গুলি-বোমা-খুন, এমনিতেই লজ্জার। ফের একটা কিছু ঘটে গেলে চাকরি নিয়েই টানাটানি হওয়ার সম্ভাবনা।

এ মামলা ডিডি নেবে, জানাই ছিল। ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের সাব-ইনস্পেকটর অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়কে ডেকে গোয়েন্দাপ্রধান জানিয়ে দিলেন, ‘কেসটা তুমি করছ। ডিটেকশন তো হয়েই গেছে ধরে নাও। অ্যারেস্টগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করার চেষ্টা করো। অতনু, আই ওয়ান্ট আ কুইক চার্জশিট, অ্যান্ড কনভিকশন অ্যাট এনি কস্ট।’

—রাইট স্যার।

অতনু মাথা নেড়ে বেরিয়ে আসেন ঘর থেকে। আপাতত প্রথম কাজ, উদয় সিং-এর ঠিকুজিকুষ্ঠি একটু ঝালিয়ে নেওয়া। অপরাধজগতের পরিচিত নাম, গুন্ডাদমন শাখায় খুঁজলেই পুরনো রেকর্ড পাওয়া যাবে নিশ্চিত।

.

উদয় সিং। তিন ভাইয়ের মধ্যে মেজো। সংগ্রাম-উদয়-রঞ্জিত, তিন ছেলেকে নিয়ে বছর পঁচিশ আগে বাবা ছোটু সিং উত্তরপ্রদেশ থেকে কলকাতায় চলে এসেছিলেন জীবিকার খোঁজে। ছোটু কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টে কাজ জুটিয়ে নিয়েছিলেন ঠিকাশ্রমিকের।

তিন ছেলেকে ভরতি করে দিয়েছিলেন স্কুলে। সংগ্রামের পড়াশুনো বেশিদূর এগোয়নি। রঞ্জিত তুলনায় বেশি মনোযোগী ছিল লেখাপড়ায়। উদয়ের অবশ্য তীব্র বিরাগ ছিল বইখাতার প্রতি। পাড়া-বেপাড়ায় ফুটবল খেলে বেড়ানো, সন্ধেবেলায় গঙ্গার পাড়ে বসে বিড়ি-সিগারেট-চোলাই আর পয়সাকড়ি জুটিয়ে এলাকার সিনেমা হলে নুন শো-য় অ্যাডাল্ট ফিলমের আঁচ পোহানো, মোটামুটি এই ছিল উদয়ের কিশোরবেলা।

বড়ছেলে সংগ্রামের বয়স যখন বছর কুড়ি-বাইশ, পরিচিত একজনকে বলেকয়ে ফ্যান্সি

মার্কেটের একটা দোকানে হেল্পারের কাজে লাগিয়ে দিলেন ছোটু সিং। বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিছু তো কাজকর্ম করুক। সে মাইনে যত কমই হোক। সংগ্রাম ক্রমশ টাকা জমিয়ে বছরকয়েকের মধ্যে ফ্যান্সি মার্কেটে একটা দোকান চালু করলেন। নিজের মতো থাকতেন। ভাইদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না বিশেষ।

উদয়ের জন্যও ছোটু সিং কাজ দেখলেন গুলমোহর ঘাটের ফুলপট্টিতে। সাপ্লাই যখন আসবে, ট্রাক থেকে দোকানে মাল নামানোর কাজ। উদয় কাজে গেল সুবোধ বালকের মতো। সন্ধেবেলা বাড়ি বয়ে এসে মালিক জানিয়ে দিয়ে গেল ছোটু সিং-কে, ‘কাল থেকে ওর আর আসার দরকার নেই। পাঠাবেন না।’

—কেন?

—আপনার ছেলে অত্যন্ত বেয়াদব। ফুলের ডালা নামানোর সময় ট্রাকের হেল্পারের সঙ্গে সামান্য কারণে তর্ক করেছে। মা-বাবা তুলে যা-তা গালাগালি দিয়েছে। হেল্পারের গায়েও হাত তুলেছে। ওকে আমি কাজে রাখব না।

ছোটু সিং বিস্তর বকাঝকা করলেন উদয়কে। যে বিন্দুমাত্র বিচলিত হল না বাবার গালমন্দে। আঠারো বছরের উদয় ততদিনে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, এসব দু’পয়সার খালাসির কাজ তার জন্য নয়। কে খাটবে এত ফাইফরমাশ? অনেক বড় মাঠ পড়ে আছে তার খেলার জন্য। খেলার নিয়মগুলো শুধু ভাল করে জেনে নিতে হবে।

‘বড় মাঠ’ বলতে কলকাতা বন্দর। ‘খেলা’ বলতে লোহার ছাঁটের নিলাম। ‘নিয়ম’ বলতে সিন্ডিকেটের প্যাঁচপয়জার। না ছিল পড়াশুনোর বালাই, না ছিল কাজকর্ম কোনও। হাতে যে অঢেল সময় থাকত, তার অনেকটাই উদয় কাটাত ডক-এলাকায়। দেখত অবাক হয়ে, লোহার ছাঁট নিলামের দিনের সপ্তাহখানেক আগে থেকে কীভাবে রাতারাতি বদলে যেত জাহাজের আসা-যাওয়া আর রুটিনমাফিক মাল খালাসের রোজকার শান্ত ছবিটা। এলাকায় টেনশনের গন্ধ পেতে ঘ্রাণশক্তি প্রখর হওয়ার প্রয়োজন পড়ত না।

গলায় চেন, হাতে বালা, শরীরে উল্কি, চোখে রোদচশমা। ষন্ডামার্কা চেহারার যুবকদের বাইক-সফর যেন হঠাৎই বেড়ে যেত এলাকায়, লক্ষ করত উদয়। কখনও আসলাম ভাইয়ের ছেলেরা এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, কখনও জিতেন্দর ভাইয়ের লোকজনকে বাইক নিয়ে দেখা যাচ্ছে যত্রতত্র। বাইক-আরোহীদের কোমরের কাছে যেটা উঁচু হয়ে আছে, সেটা কী, বুঝতে বুদ্ধি খরচ করতে হত না। মেশিন!

যত এগিয়ে আসত নিলামের দিন, রাত বাড়লেই ইতিউতি আওয়াজ পাওয়া যেত বোমাবাজির। গুলিরও। নিলামের পরদিন সব শান্ত হয়ে যেত ভোজবাজির মতো। বন্দর এলাকার প্রতিটা গলিঘুঁজি চেনা হয়ে-যাওয়া উদয় দেখত, কোনও না কোনও জায়গায় মোচ্ছব চলছে যুদ্ধজয়ের। বিদেশি মদের ফোয়ারা ছুটছে। উড়ে যাচ্ছে দেদার মুরগি-মটন। ঝাঁ-চকচকে গাড়ি এসে রাতের দিকে থামছে ঠেকের সামনে। ‘ভাই’-দের গাড়ি। কখনও সে ‘ভাই’-এর নাম আসলাম, কখনও জিতেন্দর, কখনও আনোয়ার, কখনও-বা রামাধীর। আসর জমে উঠছে ফের, সুর আর সুরায়। রাত গভীর হলে হুশ করে বেরিয়ে যাচ্ছে গাড়ি, ভ্রুমমম শব্দে স্টার্ট নিয়ে ছুটছে বাইকের সারি। কোথায় যাচ্ছে ওরা এত রাতে? কানাঘুষোয় শুনত উদয়, গন্তব্য নাকি সোনাগাছি। যেখানে রাত যত বাড়ে, তত নাকি রঙিন হয় দুনিয়া। সুন্দরীদের মেহফিল বসে।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে উদয় ভাবত, আহ, এই তো জীবন। জিন্দগি হো তো অ্যায়সা!

সিনেমায় যা দেখে থাকি আমরা সচরাচর, এরপর অন্ধকার জগতের মোহে আচ্ছন্ন এই জাতীয় ছেলেরা নজরে পড়ে যায় কোনও এক ‘ডন’-এর, কোনও এক ‘ভাই’-এর। তারপর ক্রমশ নিজের যোগ্যতায় ‘ভাই’-এর বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠা। দায়িত্ব আর ক্ষমতা, দুইয়েরই পরিধি স্বাভাবিক নিয়মে বাড়তে থাকা। এবং একটা পর্যায়ের পর উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিজেই ‘ভাই’ হয়ে ওঠার, তৈরি করে ফেলা নিজস্ব অনুগামীদের বলয়। যার ছত্রছায়ায় বড় হয়ে ওঠা, তাকেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া।

তারপর মাৎস্যন্যায়। ছোট মাছ যে ‘বড়’ হয়ে গেছে, সেটা বড় মাছ যতক্ষণে বুঝতে পারে, ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে বেশ খানিকটা। শুরু হয়ে গেছে সেয়ানে সেয়ানে টক্কর। যেখানে দয়ামায়ার জায়গা নেই, নেই নীতিনিয়মের বালাই। আছে শুধু ‘জোর যার, মুল্লুক তার’-এর আপ্তবাক্য। রামগোপাল বর্মার ‘কোম্পানি’ সিনেমার সেই গানটাই এ দুনিয়ার রিংটোন, ‘সব গন্দা হ্যায় পর ধান্দা হ্যায় ইয়ে’।

সিনেমা এক, আর বাস্তব আরেক। তবে এটা স্বীকার্য, ফিলমের প্রয়োজনে আমদানি করা নাটকীয়তার উপাদানগুলো বাদ দিলে বাস্তবের উদয়দের উত্থানের চিত্রনাট্যও মোটামুটি একই রাস্তা ধরে পথ হাঁটে। পুলিশ রেকর্ডস ঘেঁটে উদয়ের কোনও ‘গডফাদার’-এর খোঁজ অতনু পেলেন না বটে, কিন্তু একটা রেখচিত্র পাওয়া গেল আটের দশকের মাঝামাঝি থেকে বন্দর এলাকার অপরাধজগতে উদয়ের উল্কাসদৃশ উত্থানের।

গার্ডেনরিচ এলাকায় তুমুল মারদাঙ্গায় জড়িয়ে পড়ে বাইশ বছর বয়সে প্রথম হাজতদর্শন। বছরখানেকের মধ্যেই দোলের দিন ক্লাবে-ক্লাবে মারামারি আর বোমাবাজিতে নেতৃত্ব দিয়ে ফের শ্রীঘরে কিছুদিন। জামিন পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের এক শ্রমিকনেতাকে ভরদুপুরে গুলি করে খুনের চেষ্টা। চেষ্টা নয়, সরাসরি খুনই এর বছরখানেক পরে। দেড় বছর হাজতবাসের পর জামিনে মুক্তি, প্রভাব খাটিয়ে মামলাকে সময়ের হিমঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া। ক্রমে ঢুকে পড়া লোহার ছাঁটের সিন্ডিকেটে, বাহুবলে কায়েম করা দাদাগিরি, হু হু করে সংখ্যা বেড়ে যাওয়া অনুগামীর, এবং উদয় সিং থেকে ‘উদয় ভাই’ হয়ে ওঠা। হিন্দি ছবির ভাষায়, এলাকার ‘বেতাজ বাদশা’।

লম্বায় প্রায় ছ’ফুট। পাথরে কোঁদা শরীর। চওড়া কপাল, ঝাঁকড়ানো চুল। বারো মাস তিনশো পঁয়ষট্টি দিন একই পোশাক। ধবধবে সাদা শার্ট-প্যান্ট। এক কথায়, নায়কোচিত চেহারা ছিল উদয়ের। আর ছিল পোর্ট ডিভিশনের নিম্নমধ্যবিত্ত এলাকায় ‘রবিনহুড’ ইমেজ। মেয়ের বিয়ের টাকা জোগাড় হচ্ছে না, দরিদ্র পিতা শরণাপন্ন হতেন ‘উদয় বেটা’-র। সম্পন্ন বাড়িওয়ালা মস্তান লাগিয়ে উচ্ছেদের হুমকি দিচ্ছে, নিরীহ ভাড়াটিয়ার মুশকিল আসান বলতে তখন ‘উদয় ভাইয়া’। পুজোর বিচিত্রানুষ্ঠানে বোম্বের শিল্পী আনার টাকা জোগাড় হচ্ছে না, ভরসার ঠিকানা সেই ‘উদয় ভাই’। যে দু’-চারটে ফোন করলেই স্থানীয় শিল্পপতিরা টাকার থলি নিয়ে হাজির। এবং পুজোয় দেদার নাচাগানা, ব্র্যাকেটে বোম্বে-মার্কা শিল্পীদের উপস্থিতিতে। জনপ্রিয়তায় বন্দর মহল্লায় একজনই প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল উদয়ের। উদয় নিজে।

একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ের পর পুলিশ এবং আইনকে এড়াতে উদয়দের মতো লোকের প্রয়োজন পড়েই সামাজিক আব্রুর। সে আব্রু কখনও সরবরাহ করে থাকে ব্যবসাদারের পরিচিতি, কখনও-বা রাজনীতিকের মোড়ক। উদয় প্রথমটা বেছেছিলেন। বাড়ি কিনেছিলেন ১/১ রামকমল স্ট্রিটে। পাশেই আরেকটি দোতলা বাড়ির উপরটা ভাড়া নিয়ে ব্যবসায়িক সংস্থার অফিস খুলেছিলেন। নাম ‘বিকি এন্টারপ্রাইজ’। রঞ্জিতের অফিসও ওখানেই ছিল, ‘মা তারা এন্টারপ্রাইজ’। রঞ্জিত ঝুটঝামেলায় থাকা পছন্দ করতেন না। সোজা পথে ব্যবসা করতেন।

উদয়ের ব্যবসা ইমারতির। বাড়ি তৈরির মালমশলা সাপ্লাইয়ের। সকাল দশটায় রোজ অফিস খোলে, ঝাঁপ পড়ে যায় সন্ধে সাতটা নাগাদ। উদয়কে অষ্টপ্রহর ঘিরে থাকে নরেশ-কল্যাণ-বোম্মাইয়ারা। দিনভর লেগে থাকে লোকের ভিড়। সবাই জানে অলিখিত নিয়মটা, এলাকায় বাড়ি তৈরি করতে গেলে ইট-বালি-সিমেন্ট উদয়দের থেকেই নিতে হবে। যার ঘাড়ে মাথা থাকবে না নেওয়ার, তার বাড়িই উঠবে না। বাংলা হিসেব।

ফুলেফেঁপে উঠেছিলেন উদয়। লোহার ছাঁটের নিলামেও কায়েম রেখেছিলেন একাধিপত্য। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের থেকে তোলাবাজির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত তো ছিলই। কারও সাহস ছিল না পুলিশে অভিযোগ করার। পুলিশের কিছু আইনত করারও ছিল না উদয়ের ব্যাপারে, যতক্ষণ না জমা পড়ছে লিখিত অভিযোগ, যতক্ষণ না উদয় নতুন করে সরাসরি জড়াচ্ছেন মারদাঙ্গায়। উদয় বুদ্ধিমান ছিলেন। ব্যবসার আড়ালেই সব কিছু যখন নির্বিঘ্নে চলছে রক্তপাতহীন, ভালই তো! গত তিন-চার বছরে সবরকম ঝামেলার থেকে নিজেকে দূরে রেখেছিলেন।

স্ত্রী সমর্থন করতেন না উদয়ের কাজকর্ম। তিতিবিরক্ত হয়ে একটা সময় একমাত্র সন্তানকে নিয়ে উঠে গিয়েছিলেন হাজরার কাছে বাপের বাড়িতে। পরিবার আর ব্যবসা সমার্থক হয়ে গিয়েছিল ঝাড়া হাত-পা উদয়ের কাছে।

তবে ওই যে, ‘চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়’। উদয় গত সাত-আট মাস ধরেই খবর পাচ্ছিলেন, এক তরুণ তুর্কির উদয় হয়েছে এলাকায়। ধমকে-চমকে যে তোলাবাজি চালাচ্ছে সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে। একদিন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা দল বেঁধে অভিযোগ জানিয়ে গেলেন উদয়ের দরবারে, ‘ভাইয়া, একটু দেখুন। আমরা তো টিকতে পারছি না অত্যাচারে।’ উদয় নড়েচড়ে বসলেন একটু। বোম্বাইয়াকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী নাম রে ছেলেটার? খোঁজখবর নিস তো একটু।’

—নিয়েছি ভাইয়া।

—নামটা কী?

—বামা।

—বামা?

.

অতনুর প্রশ্নের উত্তরে এক মুহূর্তের জন্যও ভাবতে হয় না খুনের প্রত্যক্ষদর্শী রঞ্জিত-গোপাল-কল্যাণ-বোম্বাইয়াদের।

—স্যার, বামার ছেলেরা মেরেছে। বামা, বাদল, পটা আর টুটি, চারজনকে স্পষ্ট দেখেছি। এল, আর বোম মারতে শুরু করল ভাইয়াকে লক্ষ্য করে। গুলিও চালাল।

বামা, পটা, টুটি। এদের আসল নাম জানতে চেয়ে লাভ নেই। অতনু বোঝেন, বলতে পারবে না এরা। জেনে নিতে হবে থানার রেকর্ড থেকে, নিশ্চয়ই দু’-চারবার ধরা পড়েছে আগে। তা ছাড়া মস্তানদের তো এরকমই নাম হয়। মা-বাবার দেওয়া ভাল নামটা নিজেরাই ভুলে যায় এরা একটা সময়। নাম হয়তো গোপালচন্দ্র অমুক। পরোটা ভেজে বিক্রি করত। কোনও একটা ঝামেলায় পরোটা ভাজার তাওয়া দিয়েই মাথায় মেরে খুন করেছিল কাউকে। সেই থেকে নাম ‘পরোটা গোপাল’। কিংবা ধরুন, নাম ছিল হরেন্দ্রনাথ তমুক। বোম বাঁধতে গিয়ে বিস্ফোরণে একটা চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অনিবার্য নামকরণ, হাফচোখো হরেন। কিংবা কোনও না কোনও বিচিত্র সংযোগে কারও না কারও নাম ‘বোম বিশু’, ‘ত্যাবড়া তপন’, ‘উল্লু রাজু’। অথবা, গালকাটা গদাই, কানকাটা কানাই, বা হাতকাটা দিলীপ।

থানার নথিপত্র থেকে জানা গেল ভাল নামগুলো। প্রণব নাগ ওরফে বামা, খিদিরপুর এলাকারই হরিসভা লেনের বাসিন্দা। শংকরসুন্দর দত্ত ওরফে টুটি, বাড়ি খিদিরপুরেই। শুভাশিস মুখার্জি ওরফে পটা, স্থানীয় যুবক।

বাদল চিকিৎসাধীন এসএসকেএম-এ। পটা-টুটি-বামা, তিনজনের বাড়িতেই রেইড করা হল। জানাই ছিল, থাকবে না কেউ। পাওয়া গেল না। সোর্স লাগানো হল একাধিক। এলাকার বিভিন্ন ঠেকে সাদা পোশাকে নজরদারি শুরু করলেন গুন্ডাদমন শাখার অফিসাররা। তিনজনই স্থানীয় মস্তান। যত দাদাগিরি, এলাকাতেই। আজ নয় তো কাল, পরশু নয় তরশু, ফিরবেই মহল্লায়। যাবে কোথায়?

যা ভাবা গিয়েছিল, তাই। টুটি এবং পটা ধরা পড়ল ঘটনার দিন পনেরো পর, ২২ ডিসেম্বর। হাওয়া এখনও কতটা গরম, সেটা বুঝতে গভীর রাতে দু’জনে ঢুকেছিল গার্ডেনরিচ এলাকায়। গার্ডেনরিচ শিপবিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পিছনে এক গোপন ডেরায় মদের বোতল খুলে বসার আধঘণ্টার মধ্যে খবর চলে এসেছিল সোর্স মারফত। যে রিভলভার দিয়ে পটা গুলি চালিয়েছিল খুনের দিন, সেটা উদ্ধার হল। নিজের বাড়ির কাছেই একটা পুকুরের ধারে পুঁতে রেখেছিল। বাকি ছিল প্রণব ওরফে বামা। জালে উঠল মাঝেরহাট এলাকা থেকে, সপ্তাহখানেকের মধ্যেই। ’৯৮-এর জানুয়ারি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়া মাত্রই হেফাজতে নেওয়া হল বাদলকে। সম্পন্ন হল গ্রেফতারি-পর্ব।

খুনের কারণ? জেরায় জানা গেল, বামার নেতৃত্বে পটা-টুটি-বাদল এবং আরও বেশ কয়েকজন যুবক বছরখানেক হল নিজেদের ‘গ্যাং’ তৈরি করেছিল। যে ‘গ্যাং’-এর মূল উদ্দেশ্যই ছিল, উদয়ের একচ্ছত্র রাজ্যপাটে ভাগ বসানো। মাসছয়েক আগে পোর্টের মালপত্র সরবরাহের একটা বড় অঙ্কের টেন্ডার হয়। এসব টেন্ডারে উদয়ের অর্ডার পাওয়াটা নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল এতদিন। নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়েছিল বামা-বাহিনী। তারাও টেন্ডার ফর্ম তুলেছিল, সমানে-সমানে লড়েছিল। অর্ডার শেষ পর্যন্ত উদয়ের টিমই পেয়েছিল, কিন্তু গোকুলে যে প্রতিদ্বন্দ্বীরা বেড়ে উঠছে, সে ইঙ্গিত পেয়ে গিয়েছিলেন ‘উদয় ভাইয়া’। সে-রাতেই উদয় স্বয়ং দলবল নিয়ে বামার বাড়ি গিয়ে শাসিয়ে এসেছিলেন, ‘এই দুঃসাহস যেন আর না হয়!’

ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, আরও ঘোরতর দুঃসাহস দেখিয়েছিল পটা-টুটি-বাদলরা। পরদিন বিকেলে, উদয় তখন অফিসে অনুপস্থিত, সদলবলে হানা দিয়েছিল রামকমল স্ট্রিটে। অফিসে যারা ছিল, তাদের সামনে পিস্তল উঁচিয়ে হুমকি দিয়েছিল, ‘ভাইয়াকে বলে দিস, সে জমানা আর নেই। তোরা থাকলে আমরাও থাকব। কে কবে মাছের চারা ছাড়বে, তার ভরসায় পুকুর কাটব না, বলে দিস।’

এ হুমকির পালটা প্রত্যাঘাত কেন উদয় করেননি, শক্তির বিচারে এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও, আন্দাজ করতে পেরেছিলেন অতনু। মারপিট-খুনজখমে জড়িয়ে ফের পুলিশি ঝামেলায় পড়তে চাননি। লোক লাগিয়ে শায়েস্তা করতে পারতেন বামাদের, ইচ্ছে করলেই। করেননি, কারণ, জানতেন, শেষ পর্যন্ত নাম জড়াবেই। অন্য চাল চেলেছিলেন। নিজে থানায় গিয়ে পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ জানিয়ে এসেছিলেন পটাদের নামে। যে খবর আরও খেপিয়ে তুলেছিল বামা-পটার দলবলকে।

চাপা টেনশন একটা ছিলই। যা তুঙ্গে উঠেছিল দিনদশেক আগে। উপলক্ষ, আরেকটা টেন্ডার। দু’পক্ষই ফর্ম জমা দিয়েছিল। কিন্তু বামা-পটা খবর পেয়েছিল, উদয় পোর্ট ট্রাস্টের উপরমহলে কলকাঠি নেড়েছেন। যার ফলে বামাদের জমা দেওয়া ফর্ম বাতিল হতে চলেছে টেকনিক্যাল কারণ দেখিয়ে। ফের বামা-পটা-টুটি-বাদল সটান উদয়ের অফিসে গিয়েছিল। এবারও এমন একটা সময়ে, যখন উদয় অফিসের বাইরে। অ্যাকাউন্ট্যান্টের কপালে রিভলভার ঠেকিয়ে বামা ঠান্ডা গলায় বলেছিল, ‘আমাদের টেন্ডার যদি বাতিল হয়ে যায়, তোর ভাইয়াকেও পেতে দেব না। পরেরবার যখন আসব, চেম্বার খালি করে দিয়ে যাব, মনে রাখিস।’

উদয় শুনেছিলেন সব, খুব গুরুত্ব দেননি। ভেবেছিলেন, রক্ত গরম, তাই ছেলেগুলো একটু বেড়ে খেলছে। থানায় ফের ডায়েরি করিয়েছিলেন নিতাইকে দিয়ে। পুলিশ রেইড করেছিল বামার গ্রুপের প্রত্যেকের বাড়িতে। পায়নি কাউকেই। সেই রেইডের সাতদিনের পরই দুঃসাহসিক উদয়-হত্যা।

অক্লান্ত পরিশ্রমে তিন মাসের মধ্যেই চার্জশিট পেশ করেছিলেন অতনু। রঞ্জিত-নিতাই-কল্যাণ-বোম্মাইয়া প্রত্যক্ষদর্শী ছিল খুনের। ঘটনাস্থলের পাশেই ছিল দক্ষিণ ভারতীয় খাবারের একটা দোকান। সেই দোকানের কর্মী বাচ্চুও দেখেছিল ঘটনাটা। ঘটনাস্থলের কাছেই আগ্নেয়াস্ত্র সহ বাদলের গণপিটুনিতে আহত হওয়ার প্রমাণ তো ছিলই।

উদয়ের সঙ্গে অভিযুক্তদের পুরনো শত্রুতা এবং অফিসে এসে হুমকির উল্লেখ ছিল চার্জশিটে, মোটিভ এবং পারিপার্শ্বিক প্রমাণ হিসেবে। অনেক জটিল খুনের মামলার তদন্তের অভিজ্ঞতা ছিল অতনুর। সে তুলনায় এটা ছিল ঢের বেশি সরল, সোজাসাপটা। চার্জশিট জমা দেওয়ার সময় ভেবেছিলেন, কনভিকশন নিশ্চিত। ভুল ভেবেছিলেন।

তদন্তপ্রক্রিয়া একটা বৃত্তের মতো। যে বৃত্তের তিনটে অংশ। প্রথম, ঘটে যাওয়া অপরাধ। দ্বিতীয়, অপরাধটা কীভাবে ঘটল, কেন ঘটল, কে ঘটাল, তার অনুসন্ধান। এবং অপরাধীকে চিহ্নিত করা। লিখলাম বটে ‘অপরাধী’, আসলে তো অভিযুক্ত। যতক্ষণ না আদালতের বিচারে দোষী সাব্যস্ত হচ্ছে ধৃত, অভিযুক্তের গায়ে তকমা লাগানো যায় না অপরাধীর। এখানেই বৃত্তের তৃতীয় অংশের প্রবেশ। সাক্ষ্যপ্রমাণ একত্রিত করে পেশ করা চার্জশিট। এবং বিচারপর্বের চাপানউতোর।

আদ্যন্ত রসকষহীন এই তৃতীয় অংশটা। তদন্তপর্বে পুলিশের কাছে বয়ান দেওয়ার সময় যে যা বলেছিলেন, বিচারপর্বে তার অর্ধেকের বেশি সাধারণত মনেই থাকে না সাক্ষীর। কারণ, পুলিশকে বয়ান আর আদালতে সাক্ষ্যদানের মধ্যে সময়ের ব্যবধান থাকে অনেক। দু’-তিন বছর গড়িয়ে যায় কখনও কখনও, কখনও তার ঢের বেশি। বিচারের সময় যখন দিন ধার্য হয় কোনও সাক্ষীর সাক্ষ্যদানের, তদন্তকারীকে খেয়াল রাখতে হয়, দুই বয়ান যেন মিলে যায় হুবহু, অসংগতি যেন না থাকে। মনে করিয়ে দিতে হয়, ‘তখন আমাদের এই বলেছিলেন।’ আগাগোড়াই যোগাযোগ রাখতে হয় সাক্ষীদের সঙ্গে। সে যে যেখানেই থাকুন।

আরও ঝক্কি আছে হাজার। চার্জশিট জমা করার সময় যে সাক্ষীদের সত্যনিষ্ঠ মনে হয়, তাদেরই কেউ কেউ বিচারপর্বে উলটো গাইতে শুরু করে, প্রভাবিত হয়ে পড়ে তদন্ত আর বিচারের মধ্যবর্তী সময়ে। এমনও দেখেছি আমরা, চার্জশিট দেওয়া আর সাক্ষ্যদান শুরু হওয়ার মধ্যে মূল সাক্ষীর সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেছে প্রধান অভিযুক্তের বোনের। এখন সাক্ষী যে শ্যালকের বিরুদ্ধে বিরূপ সাক্ষ্য দেবে না, জানা কথাই।

গোদের উপর বিষফোড়া হয়ে দেখা দেয় পদ্ধতিগত বিলম্ব। যে ডাক্তার কলকাতায় পোস্টমর্টেম করেছিলেন ঘটনার পর, তিনি হয়তো মাঝের বছরগুলোয় বদলি হয়ে গেছেন প্রত্যন্ত কোনও জেলায়, আসতে পারলেন না সাক্ষ্যদানের নির্দিষ্ট দিনে। পরের দিন ধার্য হল মাসদুয়েক পরে। আর, জটিল মামলায় সাক্ষীর সংখ্যা তো থাকে ন্যূনতম পঞ্চাশ-ষাট। প্রত্যেকের সাক্ষ্য, বাদী-বিবাদী পক্ষের উকিলের জেরা… সময় লাগে। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। বস্তুত, বছরের পর বছর যায়। ধৈর্যের ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙতে ভাঙতে পুঁজি একসময় তলানিতে এসে ঠেকে।

তবু মাঠ ছাড়া যায় না। পুরো প্রক্রিয়াটায় লেগে থাকতে হয় শেষ বাঁশি বাজা পর্যন্ত। কিনারার কেরামতি অর্থহীন, যদি না দোষী সাব্যস্ত করা যায় অপরাধীকে। বিচারে যদি ছাড়া পেয়ে যায় অভিযুক্ত, দিনের শেষে হাতে পেনসিলও পড়ে থাকে না। ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়ায়, প্রি-টেস্টে স্টার মার্কস, টেস্টে সব সাবজেক্টে লেটার, কিন্তু মাধ্যমিকে গিয়ে কম্পার্টমেন্টাল।

.

৩০ অগস্ট, ২০০১, যেদিন রায় বেরবে।

আদালত চত্বরে ঢুকেই খটকা লাগে অতনুর। সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরা একদল যুবকের জটলা এজলাস কক্ষের বাইরে। চেহারায় উগ্রতা, হইহই আড্ডা দিচ্ছে অভিযুক্তদের আইনজীবীর সঙ্গে। বুঝতে অসুবিধে হয় না, এরা বামার আশ্রয়পুষ্ট খুচরো মস্তান। সে হোক, কিন্তু এত ফুর্তি কীসের, আর এত সাজগোজের ঘটাই বা কেন? শাস্তি যাদের আসন্ন, তাদের কাছের লোকদের মুখ চুন করে আদালতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এসেছেন এতদিন। আজ উলটপুরাণ?

কেন ফুর্তি, কেন সাজগোজ, রায়দান শুরু হতেই বুঝতে পারেন অতনু। হতভম্ব হয়ে যান দেখে, আটের দশকের সেই দুই কুখ্যাত পাকিস্তানি আম্পায়ার শাকুর রানা আর খিজার হায়াতকেও লজ্জা দিচ্ছে বিচারকের বক্তব্য। অভিযুক্তদের পক্ষে যিনি যুক্তিজাল সাজাচ্ছেন দৃষ্টিকটু রকমের একপেশে।

গুলিই যদি চলেছিল, কার্তুজের খোল পাওয়া গেল না স্পটে? এই দিয়ে শুরু। সওয়াল-জবাবের সময়ও এ প্রশ্ন উঠেছিল। সরকারি আইনজীবী বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, খোল পাওয়া যায়নি, ঠিকই। কিন্তু তা থেকে গুলি চলেইনি, এটা ভাবা সরলীকরণ হবে। ওইরকম জনবসতিপূর্ণ জায়গা। বোমা-গুলি চলার অন্তত আধঘণ্টা পর পুলিশ এসেছে। আগে গণ্ডগোল সামলেছে। ঘটনার দেড়-দু’ঘণ্টা পরে ভাল করে দেখতে পেরেছে ঘটনাস্থল। যেখানে কমপক্ষে দু’-তিনশো লোক আসা-যাওয়া করেছে তার আগে। খোল কার পায়ের ধাক্কায় কোথায় ছিটকে পড়েছে হয়তো। পাওয়া যায়নি। হতেই তো পারে, অসম্ভব কি?’ রায়ে বিচারক উড়িয়ে দিলেন সেই যুক্তি। লিখলেন, ঘটনায় আদৌ ব্যবহৃতই হয়নি আগ্নেয়াস্ত্র। পুরোটাই সাজিয়ে বলেছে প্রত্যক্ষদর্শীরা।

কেন সাজিয়ে বলবে? বিচারকের রায়ে যুক্তি, নিহিত স্বার্থের জন্য বলবে। উদয়ের দলের সঙ্গে ব্যবসায়িক শত্রুতা তৈরি হয়েছিল বামার দলের। উদয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের ছেলেদের ফাঁসানোর এই সোনার সুযোগ হাতছাড়া করেনি রঞ্জিত-নিতাই এবং অকুস্থলে উপস্থিত উদয়ের অনুগামীরা। এদের বয়ানের উপর কোনওভাবেই নির্ভর করা চলে না। উদয়কে মেরেছে অন্য কোনও দল, অন্য আততায়ীরা। বামার দল নয়। আর, উদয়ের যা পূর্বইতিহাস, শত্রুসংখ্যা অনেক হওয়াটাই স্বাভাবিক। খুনের মামলা চলছে এখনও উদয়ের নামে। এই লোক অনেকেরই টার্গেট হতে পারে। রঞ্জিত নিজের ভাই, আর নিতাই বহু বছরের কর্মী। প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে এদের সাক্ষ্য বিশ্বাসযোগ্য নয়।

দোসার দোকানের কর্মচারী বাচ্চু বিচারপর্বে ‘hostile witness’-এর (বিরূপ সাক্ষী) ভূমিকা নেওয়ায় ‘সাজানো গল্পের’ তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে সুবিধে হয়েছিল বিচারকের। বাচ্চু পুলিশকে বলেছিলেন, অভিযুক্তদের দেখলে চিনতে পারবেন। Test Identification Parade-এ বেমালুম অস্বীকার করেছিলেন বামা-টুটিদের চিনতে। অতনু অনেক পরে জানতে চেয়েছিলেন এই ভোলবদলের কারণ। বাচ্চু করজোড়ে জানিয়েছিলেন, ‘উপায় ছিল না স্যার। সাক্ষ্য দেওয়ার আগের দিন বামার দলের ছেলেপুলেরা বাড়িতে এসে বলে গিয়েছিল, “কোর্টে উলটোসিধে বললে বাড়ি জ্বালিয়ে দেব।”’

কিন্তু গণপিটুনিতে রিভলভার সমেত বাদলের আহত হওয়া? এসএসকেএম-এর ডাক্তারের কাছে দেওয়া বয়ান, ‘আমাকে ধাওয়া করে প্রচণ্ড মেরেছে কিছু লোক।’ নস্যাৎ করে দেওয়া হল রায়ে। বলা হল, পুরোটা পুলিশ বানিয়েছে। না হলে পুলিশ বাদলের গণপিটুনির ব্যাপারে একজনও প্রত্যক্ষদর্শীকে আদালতে হাজির করাতে পারল না কেন? বাদল যেটা বলেছে বিচারপর্বে, সেটাই বরং বিশ্বাসযোগ্য। কী? না, পুলিশ কেস সাজাতে বাদলকে তার বাড়ি থেকে তুলে এনে মারধর করে রিভলভার গুঁজে দিয়েছে। ডাক্তারের কাছে কী বয়ান দিতে হবে, সেটা শিখিয়েছে। কথা না শুনলে পুরো পরিবারকে মিথ্যে কেসে জড়িয়ে দেবে বলে শাসিয়েছে। আসলে বাদল স্পটে ছিলই না। বামা-পটা-টুটিও ছিল না।

তা হলে কারা মারল উদয় আর নরেশকে? বিচারকের জবাব তৈরিই ছিল রায়ে। এক ভদ্রলোকের সেলুন ছিল ঘটনাস্থলের ফুটবিশেক দূরে। চার্জশিটে তাঁকে সাক্ষী করেছিলেন অতনু। জেরার সময় অভিযুক্তদের আইনজীবী প্রচুর প্রশ্ন করেছিলেন নেহাতই সাদাসিধে সেলুনমালিককে। যার একটা ছিল, ‘বোমের আওয়াজ শুনেছিলেন যখন, তারপর কোনও গাড়ি যেতে দেখেছিলেন সেলুনের পাশ দিয়ে?’ কত গাড়িরই তো যাতায়াত ওই রাস্তা দিয়ে প্রতি মিনিটে। উত্তরে ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, গাড়ি তো গিয়েছিল একটা বোমের আওয়াজ শোনার পর।’

কিমাশ্চর্যম, সব বাদ দিয়ে শুধু এই সাক্ষ্যকেই হাতিয়ার করে বিচারক রায়ে লিখলেন, আসলে অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীরা গাড়ি করে এসে বোমা মেরে পালিয়েছে। মিথ্যে কেস সাজিয়ে অভিযুক্তদের ফাঁসানোর অপচেষ্টার জন্য ভর্ৎসনা প্রাপ্য তদন্তকারী অফিসারের।

সুতরাং, ‘after considering all the evidences, oral and documentary, I am of the view that prosecution has failed to prove that the accused persons have committed the murder beyond reasonable doubt.’ বামা-পটা-টুটি বেকসুর খালাস। শাস্তি শুধু বাদলের, অস্ত্র আইনে। মাত্র দু’বছরের কারাদণ্ড।

অতঃপর বেকসুর খালাস, আলিপুর কোর্টে আবির-উৎসব এবং বাক্‌রুদ্ধ অতনুর প্রতি যথেচ্ছ শ্লেষ-বিদ্রুপ-কটাক্ষ। লালবাজার ‘ফুটে ফুলকপি!’

এতটাই হতোদ্যম হয়ে পড়েছিলেন অতনু, প্রায় ডিপ্রেশনে চলে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল। সাহস জুগিয়েছিলেন নগরপাল স্বয়ং, সিদ্ধান্ত হয়েছিল রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে যাওয়ার। ফের শুরু হয়েছিল লড়াই। যে লড়াইয়ে ফের ধৈর্য বন্ধক রাখতে হয়েছিল, যে লড়াই স্থায়ী হয়েছিল প্রায় পাঁচ বছরের কাছাকাছি। শেষমেশ হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ একত্রিশ পাতার রায়ে তুলোধোনা করেছিলেন নিম্ন আদালতের রায়কে। স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, আগের রায় ছিল প্রভাবিত এবং পূর্বনির্ধারিত, ‘and we believe it will not be unfair on our part if we bring on record that appreciation of evidence done by the learned Judge was, in fact, perverse and in a preconceived manner’… বদলে গিয়েছিল রায়। অতনুর যুক্তিজাল পূর্ণ সমর্থন পেয়েছিল হাইকোর্টের বিচারকদের। যাবজ্জীবন কারাবাসে দণ্ডিত হয়েছিল চার অভিযুক্ত।

হাইকোর্টের রায় বেরিয়েছে একটু আগে। অতনু বেরিয়ে আসেন আদালত চত্বর থেকে। পৌনে পাঁচটা বাজে। বিকেল একটু একটু করে সন্ধেকে জায়গা করে দিচ্ছে ড্রেস রিহার্সালের। গাড়ি ছেড়ে দেন অতনু। কতটাই বা দূরত্ব হাইকোর্ট থেকে লালবাজারের? মাথাটা হালকা লাগছে বহুদিন পর। হাঁটা যাক আজ। বেরনোর মুখে শুনেছেন, অভিযুক্তদের আইনজীবী বলছেন সদম্ভে, সুপ্রিম কোর্টে যাবেন। সে যান। আইনের উপর ভরসা ফিরে এসেছে আজকের রায়ে। যাক না ওরা সুপ্রিম কোর্টে, যাক না!

সুপ্রিম কোর্ট সম্পূর্ণ সহমত পোষণ করেছিল হাইকোর্টের রায়ের সঙ্গে। ফের সমালোচিত হয়েছিল নিম্ন আদালতের বিচার।

বলা হয়, জাস্টিস ডিলেইড ইজ় জাস্টিস ডিনায়েড। ন্যায়বিচারে দেরির অর্থ ন্যায় থেকে বঞ্চিত হওয়াই। ভুল, এই মামলার চূড়ান্ত পরিণতিতে মনে হয়েছিল অতনুর (বর্তমানে গোয়েন্দা বিভাগেরই অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার)। দেরি হয়েছিল, অনেকটাই দেরি হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে হয়নি শেষমেশ। বহু চড়াই-উতরাইয়ের পর মিলে গিয়েছিল অপরাধ আর শাস্তির হিসেব। মনে হয়েছিল অতনুর, কেউ না কেউ বোধহয় সবার অলক্ষ্যে জীবনের পাওনাগন্ডার ব্যালান্সশিটে নজর রাখেন আগাগোড়া, দিনের শেষে সব মিলিয়ে দেবেন বলে।

মেলাবেন তিনি মেলাবেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *