২১. দাম্পত্য জীবন

সপ্তম খণ্ড
আমার সংসার-জীবন

অধ্যায় একুশ – দাম্পত্য জীবন।

১. বিবাহ

আমার বিবাহ হয় ইংরাজি ১৯২৬ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি, মোতাবেক বাংলা ১৩৩২ সালের ১৩ই ফাল্গুন। তখন আমার বয়স আটাইশ বছর সাত মাস। আমার স্ত্রীর জন্ম ১৯১৬ সালের ১লা জানুয়ারি, মোতাবেক বাংলা ১৩২২ সালের ১৮ই পৌষ। অতএব তাঁর বয়স দশ বৎসর দুই মাস। এত ছোট নাবালিকাকে বিবাহ করিতে আমি রাজি হইয়াছিলাম কয়েকটি কারণে। আমার অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেওয়ায় আমার বাপ-মা মুখে না বলিলেও মনে-মনে কষ্ট পাইয়াছিলেন, এটা আমি বুঝিয়াছিলাম দেরিতে। বাপ-মার এই অসন্তোষ দূর করিবার মতলবে শেষ পর্যন্ত বিবাহ করিতে রাজি হইয়াছিলাম। আমাদের তৎকালীন তরুণ কংগ্রেসী নেতা বিপ্লবী মধুদা’র (শ্ৰীযুক্ত সুরেন্দ্র মোহন। ঘোষের) অনুপ্রেরণায় দেশের স্বাধীনতা উদ্ধারের জন্য চিরকুমার থাকিবার সংকল্প করিয়াছিলাম। বাপ-মাকে খুশি করিবার উদ্দেশ্যে এই সংকল্প ভাঙ্গিলাম। সুতরাং বাপ-মার খেদমত করিবার জন্যই যে বিয়া, সে বিয়ার পাত্রী ছোট হোক, বড় হোক, তাতে কী আসে যায়? দ্বিতীয়ত, আমার এক বন্ধু (মৌ, আবদুল মান্নান খা আমার চাচাত ভায়রা) যখন এই বিয়ার প্রস্তাব নিয়া আসেন তখন দেখিয়া আহ্লাদিত হইলাম যে, পাত্রী আমার এক শ্রদ্ধেয় আলেম নেতার মেয়ে। মওলানা খোন্দকার আহমদ আলী আকালুবী সাহেবকে আমি ছাত্রজীবন হইতেই শ্রদ্ধা করিতাম। তার দুধে-আলতা রঙ্গের চেহারা, বিশাল কালো মিস মিসা চাপদাড়ি, বলিষ্ঠ গঠন, উন্নত নাসিকা শোভিত সুডৌল মুখমণ্ডল যে কোনও দর্শকের শ্রদ্ধা-ভক্তি ও প্রশংসা আকর্ষণ করিত। কাল আলপাকার শেরওয়ানি ও কালো ইরানি টুপিতে তাঁকে খুব মানাইত। এই পোশাকেই তাঁকে প্রথম দেখিয়াছিলাম। এই চেহারাটাই আজও আমার মনে দাগ কাটিয়া আছে। তার উপর ছিলেন তিনি কবি ও বক্তা। আসলে তিনি ছিলেন ইসলাম প্রচারক–মিশনারি। তৎকালে তার সহকর্মী সমাজ-সংস্কারকদের প্রায় সকলেই কবিতার বই লিখিতেন। যশোহরের মুনশী মেহের উল্লা, সিরাজগঞ্জের মুনশী মেহেরুল্লা ও মৌ. সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী প্রভৃতি সকলেই কবি ছিলেন। অথচ নিছক কাব্য-সাধনা তাদের আদর্শ ছিল না। অধঃপতিত মুসলিম সমাজকে জাগরণে উদ্বুদ্ধ করিবার জন্যই এরা যেমন মুখে বক্তৃতা করিয়া। বেড়াইতেন, লিখিবার বেলা তেমনি কবিতায় উপদেশ দিতেন। আমি পাঠশালার জীবন হইতেই এই শ্রেণীর যে কয়জন কবি-বক্তার ভক্ত হইয়াছিলাম তাদের মধ্যে মওলানা আকালুবী ছিলেন অন্যতম। আমার স্কুল জীবনে মওলানা আকালুবী সাহেবের শুভ-জাগরণ, সিরাজী সাহেবের অনল প্রবাহ, মুনশী মেহেরুল্লার বিধবা-গঞ্জনা ইত্যাদি বই সরকার কর্তৃক বাযেয়াফত হয়। এতে এঁদের প্রতি আমার বিদ্রোহী মন অধিকতর আকৃষ্ট হইয়া পড়ে। তারপর মওলানা সাহেবের সাত শ্যালক ও আমি একই হোস্টেলে থাকিয়া পড়াশোনা করিতাম। তিনি প্রায় প্রতি মাসেই এক-আধবার হোস্টেলে আসিতেন। আমি শ্রদ্ধা-ভরে দূর হইতে তাঁকে দেখিয়া গর্ববোধ করিতাম। এই মুদ্দতেই আমার চাচা মুনশী ছমিরুদ্দিনের সাথে মওলানা সাহেবের ঘনিষ্ঠতা হয়। মওকাটা ছিল। এক শিক্ষা সম্মিলনী উপলক্ষে উভয়েই একই ট্রেনে ঢাকা যাওয়া। আমিও চাচাজীর সঙ্গী ছিলাম। গোটা পথটাই চাচাজী ও মওলানা সাহেব আলাপে কাটাইয়াছিলেন। বাড়ি ফিরার পর চাচাজী সময় পাইলেই মওলানা সাহেবের তারিফে পঞ্চমুখ হইতেন। তাতেই আমরা জানিতে পারি যে, মওলানা সাহেব আমাদের জমাতি লোক এবং ঐ অঞ্চলের মোহাম্মদীদের সর্দার। শুধু তা-ই নয় মওলানা সাহেবের দাদা (বাপের বাবা) মৌলবী খোন্দকার যহিরুদ্দীন সাহেব আমার দাদা গাজী আশেকুল্লা সাহেবের সঙ্গে একই সময়ে জেহাদে গিয়াছিলেন এবং এক সঙ্গে বালাকোট ও অন্যান্য যুদ্ধক্ষেত্রে জেহাদ করিয়াছিলেন। ঐ অঞ্চলে তিনিও গাজী সাহেব বলিয়াই পরিচিত ছিলেন। তবে ত মওলানা সাহেব আমাদের আপনজন। ঐ একটি মাত্র খবরেই মওলানা সাহেবের প্রতি আমাদের পরিবারের সকলের বিশেষত আমার একটা টান জন্মিয়া গেল। চাচাজীর নিকট হইতে আমরা আরো জানিয়াছিলাম যে, মওলানা সাহেবরা আসলে টাঙ্গাইলের লোক, জামালপুরের নহেন। টাঙ্গাইলের অন্তর্গত আকালুর খোন্দকার বংশের লোক তারা। আকালুর খোন্দকার মৌলবী মোহাম্মদ আবদুল্লার পাঁচ পুত্রের মধ্যে মওলানা আকালুবী সাহেব অন্যতম। মওলানা সাহেবের অন্যান্য ভাইয়েরাও আলেম ও সুবক্তা। তারপর তিনি খিলাফত ও কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মওলানা আবদুল্লাহিল বাকী, মওলানা ইসলামাবাদীদের সহকর্মীরূপে তিনি ইতিপূর্বেই এ জিলার আঞ্জুমানে-ওলামায়ে-বাংলার প্রচার ও সংগঠনে অনেক দূর অগ্রসর হইয়াছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত এই সময়ে তিনি দুরারোগ্য ডায়েবিটিককার্বাঙ্কল রোগে আক্রান্ত হইয়া শয্যাশায়ী হন। তাঁর সাহিত্য সেবা, রাজনীতি, ধর্ম-প্রচার সমস্তই যুগপস্তাবে বন্ধ হইয়া যায়। আমি এর পর মওলানা সাহেবের আর কোনও খোঁজখবর পাই নাই।

বন্ধু যখন বিবাহের প্রস্তাব প্রসঙ্গে উনার নামোল্লেখ করিলেন, তখন পূর্ববর্ণিত সব কথা আমার মনে পড়িয়া গেল। যা-যা মনে ছিল না বন্ধু তা-ও স্মরণ করাইয়া দিলেন। স্বভাবতই আমি তার বর্তমান হাল-হকিকত জিজ্ঞাসা করিলাম। বন্ধু বলিলেন, মওলানা সাহেবের অবস্থা খারাপ। তিনি জীবনের আশা ত্যাগ করিয়াছেন। মেয়েদের বিবাহ শেষ করিবার জন্য তিনি ব্যস্ত হইয়াছেন। তাদের বিবাহযোগ্য হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করিবার মত সময় তাঁর নাই, এই বিশ্বাস তার হইয়া গিয়াছে। মওলানা সাহেবের প্রতি একটা সুপ্ত টান হঠাৎ পুনর্জীবিত হইয়া উঠিল। বাপ-মার সম্মতি সাপেক্ষে বন্ধুর প্রস্তাবে সম্মতি দিলাম। বন্ধু আমার সমবয়সী লোক। আলেম মানুষ। তখন দূর-সম্পর্কের আত্মীয়। বিবাহ হইলে আমার চাচাত ভায়রা ভাই হইবেন। সুতরাং তিনি তার কর্তব্যে ত্রুটি করিলেন না। অতি অল্প সময়েই আমার মুরুব্বিদের রাজি করিয়া ফেলিলেন। আমি তখন খদ্দর-ভূষিত লম্বা দাড়িওয়ালা প্রায় ছয়ফুট উঁচা ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণের জওয়ান। আর পাত্রী গোলাপের পাপড়ির মত কচি লক লকা দশ বছরের একটি শিশু। সার্থক ডাকনাম জিনত মানে বিউটি। আসল নামটি আরো অর্থবহ আকিকুন্নেসা মানে জুয়েল।

বিয়া হইয়া গেল। শ্বশুরের দিককার আত্মীয়-স্বজন ন্যায়তই বেশি খুশি হইলেন না। কিন্তু আমার শ্বশুর পঞ্চমুখে আমার প্রশংসা করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। এই সময় আমি সাহিত্যিক, গাল্পিক ও প্রাবন্ধিক হিসাবে কিছুটা পরিচিত হইয়াছি এবং তৎকালে সক্রিয়ভাবে সাংবাদিকতা করিতেছি। আমার শ্বশুর আমার লেখা ছাপা হইয়াছে এমন সংখ্যার সওগাত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা পড়িয়া শুনাইয়া-শুনাইয়া আমার অনুকূলে জনমত সৃষ্টি করিতে লাগিলেন। আমার স্ত্রীর ও আমার নিজের মধ্যে বয়স ও চেহারার এমন গরমিল ছিল যে, পরবর্তীকালে আমরা দুজন যখন কলিকাতার রাস্তায় ট্রামে ও ট্রেনে একত্রে চলাফেরা করিতাম, তখন অনেকেই আমাদেরে বাপ-মেয়ে বলিয়া ভুল করিত। আমার মেস-জীবনে আমার সিটের উপর দেওয়ালে আমার স্ত্রীর একটি জোড়া ফটো লটকাইয়া রাখিয়াছিলাম। ছবিটিতে আমি চেয়ারে বসিয়া আছি। আমার স্ত্রী আমার ডান-কাঁধে বাঁ হাত রাখিয়া চেয়ারের পিছনে দাঁড়াইয়া আছেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ও মিসেস দাশের একটি জোড়াফটোর অনুকরণে আমি এই ফটোটি তুলাইয়াছিলাম। কাজেই ফটোটি আমার খুব প্রিয় ছিল। ফটোতে আমি দাড়িওয়ালা শেরওয়ানি-পরা নব্য প্রৌঢ় লোক। আর আমার স্ত্রী কালডুরি-পাড়ের সাদা শাড়ি-পরা নিরাভরণা একটি কচি খুকি। গহনা-পত্র ও নকশি শাড়িটাড়ি পরিলে তবু হয়ত একটু বউ-বউ মনে হইত। গহনা-পত্রহীনা সাদা শাড়ি-পরা অবস্থায় তাকে ‘বউ’ বলিয়া কিছুতেই মনে হয় না। আমার রুম মেটের এক নয়া মেহমান ঐ ফটো দেখিয়া মন্তব্য করেন : ‘মৌলবীর ত শখ কম না। মেয়েরে নিয়া ফটো তুলিয়াছে। বন্ধু জিভে কামড় দিয়া আঙুলে তার পেটে গুঁতা মারিয়া চোখ ইশারায় সাবধান করিয়া দিলে তিনি চুপ করেন। মেহমানের কোনও দোষ ছিল না। কারণ যখন তিনি এই মন্তব্য করিতেছিলেন, তখন আমি চাপদাড়ি ছাঁটিয়া ফ্রেঞ্চকাট করিয়াছি, শেরওয়ানির বদলে কোট-পায়জামা পরিয়া অনেকটা যুবক হইয়াছি। ঐ ফটোর মৌলবী সাব যে আমিই, তা বুঝিবার উপায় ছিল না।

.

. বয়সের দূরত্ব লোপ

কিন্তু আমাদের এই বয়সের ও চেহারা-ছবির গরমিল আমার স্ত্রীর মনে কোনও বিরূপ ক্রিয়া করিয়াছিল বলিয়া আমি ঘুণাক্ষরেও বুঝিতে পারি নাই। আমি মুখে-মুখে যতই সন্ন্যাসীগিরি দেখাই না কেন, মনে-মনে আমি কবি ও প্রেমিক ছিলাম নিশ্চয়ই। সেই জন্যই বোধহয় বিয়ার দিনেই স্ত্রীকে দেখিয়া আকৃষ্ট হইয়াছিলাম। বাপ-মার সেবার একমাত্র উদ্দেশ্যে যে বউ ঘরে আনিলাম, বাপ-মার খেদমতে তাকে নিয়োগ না করিয়া কর্মস্থল কলিকাতায় নিয়া গেলাম। আমি নিশ্চয়ই তার রূপে মুগ্ধ হইয়াছিলাম। কিন্তু তিনি আমার প্রতি কিসে আকৃষ্ট হইয়াছিলেন? আকৃষ্ট যে হইয়াছিলেন তার প্রমাণ এই যে, আমি যেদিন তাঁর নিকট হইতে বিদায় লইয়া কলিকাতা কর্মস্থলে চলিয়া যাইতাম সেদিন তিনি গোসল ও খানাপিনা ত্যাগ করিয়া যে বিছানা নিতেন। আমার মা-ফুফু-ভাবিরা হাজার জোর করিয়াও একাধদিন না গেলে কিছু খাওয়াইতে পারিতেন না। এগার বছরের বালিকার পক্ষে ত্রিশ বছরের স্বামীর বিরহে এমন ভাত-পানি ছাড়িয়া দেওয়া মোটেই স্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু এটা তিনি করিতেন। এ বিষয়ে তার কোনও লজ্জা-শরম ছিল না; অথবা লজ্জা শরম কাকে বলে তা বুঝিবার বয়সই তার হয় নাই। এতদিন পরে বুঝিতেছি, বয়সের এই পার্থক্যটা আমি ভুলাইয়া দিতে পারিয়াছিলাম। আমাকে তুমি বলাইতে পারিয়াছিলাম। মাত্র এগার বছরের খুকির পক্ষে ত্রিশ বছরের একটা দাড়িওয়ালা জওয়ানকে ‘তুমি’ সম্বোধন করা নিশ্চয়ই খুবই কঠিন কাজ। কিন্তু এটা আমার স্ত্রী পারিয়াছিলেন। এটা যখন পারিলেন তখন বয়সের পার্থক্যটা। বোধ হয় একদম তলাইয়া গিয়াছিল। তা যদি না হইবে তবে ঐটুকু ছোট্ট খুকি আমার উপর ধমকাইয়া হুকুম জারি করিতে পারিতেন না। আমার ভুল-ত্রুটির জন্য ধমকাইতে-শাসাইতে পারিতেন না। তাছাড়া আমি বুঝিয়াছিলাম ঐটুকু খুকির মধ্যেও একটা অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, আত্মমর্যাদাবোধ ও স্বাধীনতা ছিল। বিয়ার পর বছর-খানেকের মধ্যেই যখন তাঁকে কলিকাতা নিয়া বাসা করি তখন তাঁকে সহায়তা করার কেউ ছিল না। পাশের বাসার চাকরকে দিয়া বাজার করাইতেন, আর রান্না-বান্না নিজেই করিতেন। আমার দীর্ঘ আফিস আওয়ারে বাসায় একাই থাকিতেন। প্রথমবারের মুদ্দতে তিনি কলিকাতায় ছিলেন মাত্র এক বছর। এই এক বছরেই তিনি আমার বন্ধু-বান্ধবের স্ত্রী মহলে বিশেষত সওগাত আফিসে সমাগত মহিলা মহলে খুব জনপ্রিয় হইয়া উঠেন। এই সময়ে কাজী নজরুল ইসলাম, সওগাত সম্পাদক নাসিরুদ্দিন, কবি গোলাম মোস্তফা, সুরশিল্পী আব্বাসউদ্দীন, সাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন, কবি মঈনুদ্দীন, হবিবুল্লা বাহার প্রভৃতি সবাই আমাদের বন্ধু মহল। এঁদের সবারই পরিবারের মধ্যে আমার স্ত্রীর যাতায়াত। এই মহলের মহিলারা সবাই বয়সে আমার স্ত্রীর অনেক বড়। তবু সওগাত আফিসে যে কয়বার মহিলাদের গ্রুফ ফটো তোলা হইয়াছে, তাতে আমার স্ত্রীকেই মধ্যমণি হিসাবে বসান হইয়াছে। এ সব দেখিয়া ক্রমে আমার মনেও এই প্রত্যয় জন্মিয়াছিল যে, লেখাপড়া কম জানিয়া এবং বয়সে অপরিণত হইয়াও ব্যক্তিত্ব প্রজেকশনের ক্ষমতা তার মধ্যে জন্মগতভাবেই ছিল।

আমার শ্বশুর মওলানা আকালুবী সাহেব নারী শিক্ষার খুব জোর সমর্থক ছিলেন। বহু ধনী শাগরিদ-মুরিদকে তিনি মেয়েদেরে উচ্চশিক্ষা দিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিলেন। কিন্তু নিজের মেয়েদের কাউকে তিনি উচ্চশিক্ষা দেন নাই। তৎকালে মেয়েদের উচ্চশিক্ষা খুব ব্যয়সাধ্য ছিল। মওলানা আকালুবী সাহেব গরীব মানুষ ছিলেন। কাজেই নিজের বাড়িতে বালিকাদের জন্য একটি স্কুল খুলেন। তাতে আরবি, ফারসি, বাংলা, অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোল ও সামান্য ইংরাজি পড়াইবার ব্যবস্থা ছিল। পাড়াগাঁয়ের মেয়েরাও সাধারণত কমপক্ষে বার বছরের বেশি কেউ অবিবাহিত থাকে না। এর পরেই হয় মেয়েদের বিবাহ হইয়া যায়, নয়-ত বিবাহের যোগ্য মেয়েকে বাপ-মারা পর্দায় বন্ধ করিয়া থাকেন। মওলানা সাহেবের পাঁচ মেয়ের সবারই লেখা-পড়া ঐ স্কুল পর্যন্ত। আমার স্ত্রীও ঐটুকু বিদ্বান হইয়াই আমার ঘর করিতে আসেন। পাড়াগাঁয়ের আমার বাপ-মার খেদমত করার জন্য এইটুকু বিদ্যাই যথেষ্টের চেয়ে বেশি হইল। কিন্তু আমি তাকে সাংবাদিকের সহধর্মিণী হিসাবে যখন কলিকাতা নিয়া গেলাম, তখন স্বভাবতই তার আর একটু লেখা-পড়া জানার দরকার হইল। আমার কিছু বলিতে হইল না। আমার শ্বশুর ও সম্বন্ধীই আমার স্ত্রীকে তা বুঝাইলেন। দ্বিতীয় বার দেখা হইবার সময়েই দেখিলাম, তাঁরা এঁকে কিছু-কিছু নূতন পুস্তক কিনিয়া দিয়াছেন। আমিও দিলাম। গোড়াতে আমার নিজের ও আমার স্ত্রীর সংকল্প ছিল যে তিনি প্রাইভেট ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিবেন এবং তদনুসারে কিছুদিন পড়াশোনাও চালাইলেন। কিন্তু দুই-এক বছরের মধ্যেই আপনা-আপনি তিনি লেখাপড়া ছাড়িয়া সংসারী হইয়া গেলেন এবং আমিও যেন তা বিনা প্রতিবাদে মানিয়া লইলাম।

কারণ তাঁর পনের বছর বয়স হইবার আগেই আমরা একটি পুত্র সন্তান লাভ করিলাম এবং আর দুই বছর পরে আরেকটি পুত্র সন্তান লাভ করিলাম। এটা খুবই নিষ্ঠুরতা হইয়াছিল। সতের বছর বয়সের নারী দুইটি সন্তানের মা হওয়া কোনও নারীর স্বাস্থ্যের পক্ষেই শুভ হইতে পারে না।

.

. কচি ঘাড়ে ভারী বোঝা

বিয়ার তিন বছর পরেই আমি উকালতি শুরু করিলাম। কলিকাতা ছাড়িয়া ময়মনসিংহ শহরে আসিলাম। নূতন উকিলের পক্ষে পেটে-ভাতের আয়ের বেশি কিছু করা সম্ভব ছিল না। তবু আমি দুই সন্তানের মা সতের বছরের বয়সের বালিকাকে শহরে আনিয়া আমার অভাবের সংসারের দায়িত্ব তার উপর চাপাইয়া দেই। এর আগে কলিকাতার জীবনে তাকে বিশেষ কোনও দায়িত্ব বহন করিতে হয় নাই। আমরা দুজনের জন্য একবেলা ডাল-তরকারি রাধিয়া দুই বেলা শুধু এক পোয়া চাউল সিদ্ধ করিলেই রান্না-বান্নার কাজ শেষ। কয়লার চুলাটাও তার নিজের ধরাইতে হইত না। প্রতিবেশী বন্ধু আমাদের বাজারটাও করিয়া দিতেন। তার চাকরটা আমাদের বালতির চুলাটাও ধরাইয়া দিত। কাজেই কলিকাতায় সপরিবারে বাস করা সত্ত্বেও আমি না শিখিয়াছি বাজার করিতে; আমার স্ত্রী না শিখিয়াছেন কয়লার চুলা ধরাইতে। কাজেই আমরা উভয়েই শুরু করিলাম ইংরাজিতে যাকে বলে ফ্রম দি ক্র্যাচ। আঁচড় হইতে।

কথায় বলে ‘আম ছোট হইলে কী হইবে আঁটি বড় আছে’; আমারও আয়। কম ও বাবুর্চি নাবালিকা হইলে কী হইবে, আমার বাসায় মেহমানের জোর ছিল। এই সময় প্রতিমাসে আমার বাসায় চার মণ চাউল খরচ হইত। তার। মানে প্রতিবেলা গড়ে পনের-বিশ জন লোক খানা খাইতাম। এত লোক হইবার প্রধান কারণ এই যে আমি স্থানীয় লোক। আত্মীয়-স্বজন অন্য কাজেই শহরে আসুন, আর মামলা-মোকদ্দমা করিতেই আসুন, আমাকে দিয়াই মামলা করান, আর অপর উকিলকে দিয়াই মামলা করান, আমার বাসায় চারটা ডাল ভাত না খাইয়া গেলে আমি অসন্তুষ্ট হইতে পারি, এ সম্পর্কে আত্মীয়-স্বজনরা সর্বদাই সচেতন ছিলেন। মেহমান বেশি হওয়ার দ্বিতীয় কারণ প্রজা আন্দোলনের নেতা ও প্রজা-সমিতির সেক্রেটারি হিসাবে সমিতির আফিসের লোকদের খাওয়ার ব্যবস্থাটা আমারই দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এছাড়া মফস্বল হইতে নেতৃস্থানীয় কর্মীরা আসিলে তাঁদেরে সম্মান করা ও তাদের থাকা-খাওয়ার সুবিধার দিকে নজর রাখাও আমারই কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এছাড়া আমার বৈঠকখানায় সমাগত ভদ্রলোকদের চা খাওয়ানোর রেওয়াজ ছিল। আমার রাজনৈতিক গুরু মৌলবী মুজিবর রহমান সাহেবের নিকট আমি এটা শিখিয়াছিলাম। তিনি সকলকে উপদেশ দিয়াছিলেন, যদি তোমরা নূতন কোনও মতবাদ প্রচার করিতে চাও, তবে নিজের বৈঠকখানাকে চায়ের আড্ডায় পরিণত কর। এই ধরনের চায়ের বৈঠকেই দুনিয়ার সমস্ত নূতন মতবাদ দানা বাঁধিয়াছে। মৌলবী সাহেবের এই উপদেশ আমি সাধ্যমত মানিয়া চলিতাম। ফলে বাসায় খাবার ব্যবস্থা যেমন থাকুক, চায়ের ব্যবস্থা থাকিতই। এ সবে যে খরচ খুব বেশি হইত তা নয়। কারণ চা তখন আট দশ আনা পাউন্ড। দুধ তখন টাকায় ষোল সের; চিনি পাঁচ আনা সের। ছয় পয়সা করিয়া তশতরিসহ চায়ের কাপ পাওয়া যাইত। সুতরাং ডজনে-ডজনে চায়ের কাপ কিনিতেও খুব কষ্ট হইত না। কিন্তু কষ্ট হইত আমার স্ত্রীর। একটি মাত্র চাকর লইয়া তিনি এতলোকের জন্য রান্না-বান্না ও চা তৈরি করিতেন। তা ছাড়া আমার মেহমানদারির কোনও ওয়াকত-বেওয়াকত ছিল না। মফস্বলে মিটিং করিতে গিয়া হয়ত রাত একটার সময় তিন-চারজন মেহমান লইয়া বাসায় ফিরিলাম। স্ত্রীকে জানাইলাম আমার নিজের অবশ্য ক্ষিধা নাই, না খাইলেও চলে। কিন্তু মেহমানদের ত আর ভুকা রাখা যায় না। কাজেই আর কিছু না হউক, কয়টা আলু, বেগুন বা শিম ভর্তা ও কয়টা আন্ডা ভাজা করিলেই চলিবে, আর কয় ছটাক চাউল সিদ্ধ করা, এই ত? আর কিছু করার দরকার নাই। সদ্য ঘুম-ভাঙ্গা এই বালিকা আমার এই ভণ্ডামিতে রাগ করিতে পারিতেন। তার বদলে একটু হাসিয়া পাক ঘরে ঢুকিলেন। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে মেহমানসহ আমাকে খাওয়াইয়া দিতেন। এমনি ঘটিত প্রায়ই।

আয়-ব্যয়ের কোনো খোঁজখবর করিতাম না। আমি যা রোযগার করিতাম স্ত্রীর হাতেই আনিয়া দিতাম। যা খরচ করিতাম তাও স্ত্রীর কাছ থনেই চাহিয়া নিতাম। পনের-ষোল বছরের বালিকা স্ত্রীর উপর এমন গুরুদায়িত্ব দেওয়াটা ছিল বিশ্বাস ও ভরসা উভয় দিকেই অসাধারণ। টাকা-পয়সার দায়িত্ব স্ত্রীর হাতে ছাড়িয়া দেওয়ার নজির খুবই বিরল। কাজেই আমার এমন ব্যবহার দেখিয়া-শিখার ব্যাপার নয়। তবে এটা আমি শিখিলাম কই? শিখিতে হয় নাই। অমনিতেই হইয়াছে। কিন্তু তারও ত একটা কারণ থাকার কথা? আমার মনে হয় সে কারণটা আমার স্ত্রীরই কৃতিত্ব। আর্থিক ব্যাপারে তাঁর তখনকার ব্যবহার সেটা ছিল নিতান্তই অসাধারণ। খুব হিসাবি মিতব্যয়ী স্ত্রীরাও স্বামীর টাকা-পয়সার ব্যাপারে নিজের খরচের বেলা মিতব্যয়ী হন না। কিন্তু আমার পনের-ষোল বছরের বালিকা স্ত্রীর মধ্যে আমি এর ব্যতিক্রম দেখিলাম। পুলকিত ত হইয়া ছিলামই, চমৎকৃতও হইয়াছিলাম। প্রথম ঘটনাটা এই :

স্ত্রীকে ময়মনসিংহ বাসায় আনার পর প্রথম শীতের আগমনেই স্ত্রীর জন্য আট টাকা দামে একটি গরম ফুলহাতা সুয়েটার কিনিয়াছিলাম। বাসায় ফিরিয়া গায়ে দিতেই বুঝা গেল আস্তিনটা তিন-চার ইঞ্চি খাট। বদলাইয়া আনিতে একাই দোকানে গেলাম। দুইটা অসুবিধা দেখা দিল। সুয়েটারের রং বদলাইতে হয়। আর পাঁচ টাকা দাম বেশি দিতে হয়। স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করিতে বাসায় ফিরিলাম। স্ত্রী রং বদলাইতে আপত্তি করিলেন না। কিন্তু পাঁচ টাকা বেশি খরচ করিতে আপত্তি করিলেন। তার বদলে তিনি পশমি মোটা সুতার একজোড়া বেবি হাফ মোজা কিনার হুকুম দিলেন। তাঁর নির্দেশমত আমি এক জোড়া পশমি হাফ মোজা কিনিলাম। কেন মোজা কিনিলাম বুঝিবার চেষ্টা করিলাম না। পাঁচ টাকার বদলে দশ আনার মোজা কিনিয়াই আমি খুশি হইলাম। পরদিন সন্ধ্যায় কোর্ট হইতে ফিরিয়াই দেখিলাম, কবজি-তক লম্বা আস্তিনের সুয়েটার গায় দিয়া আমার স্ত্রী আমার অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া আছেন। তার মুখে মুচকি হাসি। বেবি হাফ মোজা দিয়া তিনি সে সুয়েটারের আস্তিন লম্বা করিয়াছেন, তাঁর ভাষায় এই ‘সোজা কাজটাও তিনি আমাকে নাশতা-চা দেওয়ার আগে বুঝাইলেন না। জোড়া মিলানের কৌশল ও অদৃশ্য সিলাইর নিপুণতা বুঝাটা আমার জন্য নিতান্ত সোজা কাজ ছিল না। তাঁর সিলাই নিপুণতা আমাকে মুগ্ধ করিয়াছিল। নিশ্চয়ই। কিন্তু অব্যক্ত আনন্দে পুলকিত হইয়াছিলাম অন্য কারণে। তারই পোশাক বাবত স্বামীর টাকা খরচে অমন মিতব্যয়িতা? একটি বালিকা স্ত্রীর মধ্যে? আমি এক মুহূর্তে বুঝিলাম এই বালিকার উপর আমি সব ভার ছাড়িয়া দিতে পারি। দিলামও। এর পরও অমন অনেক ঘটনা ঘটিয়াছে। সবটাতেই আমি বুঝিয়াছি, আমি ভুল করি নাই।

.

. কুশলী নিপুণা গিন্নি

তাঁর এই আর্থিক স্বাধীনতা ও আমার একান্ত স্ত্রী-নির্ভরতা আমার জীবনের। অমূল্য সম্পদ। আমার সুখ-শান্তির আকর। সম্পূর্ণ নিশ্চিন্তে, নিরুদ্বেগে ও বেপরোয়াভাবে উকালতি, রাজনীতি, সাহিত্য ও সাংবাদিক জীবন যে আমি যাপন করিতে পারিয়াছি, তা একান্তভাবেই আমার এই বৈষয়িক নিশ্চিন্ত। সংসার পরিচালনায়, মেহমানদারিতে আমাকে কোনও দিন ভাবিতে হয় নাই। আমার স্ত্রী আমাকে ভাবিতে দেন নাই। টাকা নাই কোনও দিন বলেন নাই। আমারও তার এমনকি ছেলেদের (ততদিনে তিনি মনসুর আনাম ও মহবুব। আনাম এই দুই পুত্রের মা) কাপড়-চোপড়, জুতা-জামার ভাবনাও তিনি আমাকে ভাবিতে দেন নাই। কী কবে খাইব, কোন শেরওয়ানি-পাজামা-জুতা পরিয়া কোর্টে যাইব, তা-ও তিনিই আগে হইতে ঠিক করিয়া রাখিতেন। এটা ঘটিয়াছে অবশ্য সারাজীবনই। এটা বুঝিয়া ফেলিয়াছিলাম উকালতি জীবনের প্রথম দশ বছরেই। শুধু ব্যক্তিগতভাবে আমি নই, আমার সারা সংসার জীবনই তাঁর মুঠায়। আমার সংসারে তিনি নিজেও গলাতক ডুবিয়াছেন, তার প্রথম উপলব্ধি ঘটে আমার কৃষক-সম্পাদনার জন্য উকালতি ও ময়মনসিংহ ছাড়িয়া কলিকাতা যাওয়ার প্রাক্কালে। কলিকাতার প্রতি তার টান ছিল আগে হইতেই। কাজেই তিনি খুশিই হইলেন। কিন্তু অসুবিধাও দেখাইলেন। এই দশ বছরে তিনি সংসার কম গোছান নাই। এই ভাড়াটিয়া বাসায় তিনি গলাতক পুঁতিয়া গিয়াছেন। ইতিমধ্যে তিন ছেলের মা হইয়াছেন। বাড়িওয়ালাকে দিয়া বাড়ি কুশাদা করাইয়াছেন। ডাইনিং হল ও গেস্ট রুম করাইয়াছেন। তার উপযোগী টেবিল-চেয়ার-চৌকি-আলনা-মিটসেফ করিয়াছেন। প্রয়োজনমত লেপ-তোষক বাড়াইয়াছেন। গোসলের জন্য বাথরুম বানাইয়াছেন। বাড়ির মধ্যে ফুলের বাগান করিয়াছেন। উঠানের এক কোণে গোলাঘর করিয়াছেন। এতে তিনি চাউল-সরিষা ও কলাইর স্টক করেন। মওসুমের সময় সস্তা দামে কিনিয়া গোলাজাত করেন। বাজার চড়িলে বিক্রয় করিয়া লাভ করেন। এসব কাজে তিনি কোনও দিন আমার সাহায্য চান নাই। প্রজা-কর্মী বা মুহরী-মক্কেলদের সাহায্যে তিনি এ সব খরিদ-বিক্রি করিয়া থাকেন। নিজের খরচে হাঁস-মুরগি-কবুতরের ঘর বানাইয়াছেন, বাড়ির মধ্যে বেগুন, মরিচ, আলু, ডাটার ক্ষেত করিয়াছেন। লাউ-কুমড়া শসা-করল্লা-ঝিঙ্গার জাংলা করিয়াছেন। শাক-সবজি, তরি-তরকারি, মুরগ মুরগি তাঁর বাজার হইতে কিনিতে হয় না। বরঞ্চ চাকরকে দিয়া তিনি ঐ সব বিক্রি করিয়া থাকেন। এ সব সত্ত্বেও বাসার ভিতরে তিনি একটু ময়লা আবর্জনা হইতে দেন নাই। তিনি নিজ হাতে ঝটা-দা-কোদাল মারিয়া বাড়ির ভিতর ঝক-ঝকা রাখিতেন। দেওয়াল ঘেঁষিয়া ফুলের গাছ লাগাইয়াছেন। তার মাঝে-মাঝে লেবু-ডালিমের গাছ করিয়াছেন। এ সবই তিনি করিতেন আমার অজ্ঞাতে। কারণ বাসায় থাকিলে বৈঠকখানায় মক্কেল লইয়া বৈঠক করা, সারা দিন কোর্টে থাকা, সভা-সমিতি উপলক্ষে মফস্বলে বা কলিকাতায় কাটান, এত সব করিয়া আমি বেচারীর খোঁজখবর খুব কমই রাখিতাম। অবসর সময়ে এসবের জন্য যদি তার তারিফ করিতাম, তখন জবাব দিতেন : প্রশংসার আসল দাবিদার তার মা-আমার শাশুড়ি। কথাটা সত্য। তারই জন্য আমার স্ত্রীর পক্ষে রান্নাঘরের বাহিরে এতসব কাজ করা সম্ভব হইয়াছিল।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে আমার স্ত্রী তৃতীয় পুত্র মতলুব আনামকে প্রসব করিয়াই অসুস্থ হইয়া পড়েন। তাঁর এ নবজাত শিশুর দেখ-শোন করিবার জন্য আমার শাশুড়িকে বাসায় নিয়া আসি। স্ত্রীর অসুখ দীর্ঘস্থায়ী হয়। শাশুড়িও থাকিতে বাধ্য হন। ওদিকে বাড়িতেও তার খুব তাকিদ ছিল না। তাঁর নিজের আর কোনও সন্তানাদি ছিল না। আমার শ্বশুরের এন্তেকালের পরে তিনি সৎ-পুত্রদের সাথেই থাকিতেছেন। ছয় মাস এক নাগাড়ে আমার বাসায় থাকার পর তিনি মাঝে-মাঝে নিজ বাড়িতে যাইতেন বটে কিন্তু দু-চার দিন না যাইতেই তাকে আমরা নিয়া আসিতাম। তিনিও নাতিদেরে ছাড়া থাকিতেন পারিতেন না। তাকে ছাড়া আমাদেরও চলিত না। এইভাবে তিন চার বছরের মধ্যে তিনি নাতিদের হাতে স্থায়ী বন্দিনী ও আমার সংসারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হইয়া পড়িলেন। আমার স্ত্রীর প্রচুর অবসর জুটিল। তিনিও বই-পুস্তক, সিলাইর কল ও বাড়ি-ঘর লইয়া মাতিলেন। এমনি অবস্থায় আমি যখন সপরিবারে কলিকাতা রওয়ানা হইলাম আমার ছেলেরা নিজেদের দাবির জোরেই নানিকে টানিয়া গাড়িতে তুলিয়া নিল।

.

. কলিকাতার জীবন

মেহমানের ভিড় নাই। কাজের বাড়াবাড়ি নাই। ছোট রান্নাঘরের সমস্ত দায়িত্ব আম্মার কাছে। কলিকাতা গিয়া আমাদের উভয়ের জীবনের মোড় ফিরিল। আমরা পরম সুখে দিন কাটাইতে লাগিলাম। আমার স্ত্রীর মতে এ সময়টাই তাঁর সবচেয়ে বেশি সুখের মুদ্দত। কারণ প্রথম কয়দিন রাত খাঁটিয়া কাগজ চালু করিবার পর প্রায় সারাদিনই আমি স্ত্রীর কাছে থাকিতাম। বাসায় বসিয়া সম্পাদকীয় লিখিতাম। বিকালের দিকে আফিসে যাইতাম। দুই-এক ঘণ্টা আফিসে কাটাইয়া সন্ধ্যার একটু পরেই বাসায় ফিরিতাম। ছেলেদেরে শাশুড়ির হেফাযতে পড়ায় বসাইয়া চাকরকে রান্নার ভার দিয়া আমরা মিয়া বিবিতে গড়ের মাঠ, নিউ মার্কেটে বেড়াইতে অথবা সিনেমা দেখিতে যাইতাম। খুব কম দিনই এই প্রোগ্রামের ব্যতিক্রম হইত। স্ত্রী ছিলেন এতদিন উকিলের বিবি। ফিক্সড ইনকামের কোনও জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না। সম্পাদক হিসাবে প্রতি মাসের প্রথম দিকে আড়াই শত টাকা আনিয়া তার হাতে দিতাম। খরচের জন্য তিনি এক সঙ্গে এত টাকা এর আগে আর কখনও পান নাই। এই নূতন পরিবেশে তিনি নূতন ব্যবস্থা করিলেন। তিনি মাসের পনের দিনে একবার বাজারে যাইতে আমাকে বাধ্য করিলেন। এই দিনে চাউল, ডাইল, লবণ, শুকনা মরিচ, পিয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, গরম মসল্লার একটা বিরাট তালিকা করিয়া আমার হাতে দিতেন। একেবারে এক মাসের বাজার। প্রতিদিনের বাজার তিনি চাকরকে দিয়াই করাইতেন। মাছ, গোশত, মুরগি, তরিতরকারি ও কাঁচা মরিচ, শাক-সবজি ছাড়া সারা মাসে তিনি আর কিছুর বাজার করাইতেন না। বাজে খরচ, গাড়ি ভাড়া, রিকশা ভাড়া, সিনেমা ইত্যাদির এবং কাপড়-চোপড় কিনার খরচ দুইজন একত্রেই করিতাম। আমার একার নিজস্ব খরচ বিশেষ-কিছু ছিল না। কারণ ট্রামে চলাচলের জন্য মাসিক টিকিট ছিল। আফিসে যাতায়াত তাই দিয়া চলিত। আফিসে বসিয়া যে চা-সিগারেট খাইতাম, তার দামও মাসের শেষে এক সঙ্গেই দিতাম।

ফলে পাকা গিন্নির মতই তিনি আমার অজ্ঞাতে বেশ কিছু টাকা সঞ্চয় করিলেন। এটা টের পাইলাম যখন আমার কৃষক-এর চাকুরি গেল। আমি উদ্বিগ্ন চিত্তে বিষণ্ণ মুখে এই দুঃসংবাদ লইয়া যখন বাসায় ফিরিলাম, তখন তিনি ভরসা দিলেন : কোনও চিন্তা করিও না। কিছুদিন চালাইতে পারিব। ইতিমধ্যে একটা চেষ্টা-চরিত কর। আমি ময়মনসিংহ ফিরিয়া উকালতি করিব বলায় তিনি খুব উৎসাহ দিলেন না। বলিলেন : সেটা ত হাতের পাঁচ আছেই। তার আগে কলিকাতা থাকার সবচেষ্টা শেষ করা দরকার। তার জন্য যে কয়দিন সময় লাগে, তিনি চালাইয়া নিতে পারিবেন। বুঝিলাম, কিছু সঞ্চয় করিয়াছেন। চালাইয়া গেলেনও তিনি। কিন্তু বেশিদিন চালাইতে হইল না। দুই-তিন মাসের মধ্যেই হক সাহেবের নবযুগ-এর চাকুরি পাইলাম। বেতনও কৃষক-এর চেয়ে পঞ্চাশ টাকা বেশি। বিবি হাসিয়া বলিলেন : দেখ, সবুরে মেওয়া ফলে। সাহস করিতে হয়। সাহসই লক্ষ্মী।

কিন্তু লক্ষ্মী এক বছরও টিকিলেন না। নবযুগ-এর চাকুরি গেল। এবার ময়মনসিংহ ফিরিয়া যাওয়া ছাড়া উপায় নাই। চাকুরিটা যাওয়ার সময় আমি সপরিবারে গ্রামের বাড়িতে ছুটি উপভোগ করিতেছিলাম। চাকুরি যাওয়ার খবরটা বাড়ি বসিয়াই পাইলাম। কাউকে কিছু না বলিয়া কলিকাতা চলিয়া গেলাম। বিনা-নোটিসে আমাকে চাকুরি হইতে ডিসমিস করায় হক সাহেব আমাকে তিন মাসের বেতন দিয়া দিলেন। আমি এই টাকাটা হাতে করিয়া বিবি সাহেবাকে সমস্ত অবস্থা জানাইয়া পত্র দিলাম জিনিস-পত্র গোছাইয়া ময়মনসিংহে ফিরিয়া যাইবার জন্য। ছেলেপিলেকে বাড়িতে রাখিয়া একা আসিতে তাকে উপদেশ দিলাম। তিনি উত্তরে তার আসিবার তারিখ জানাইলেন।

.

. সংকল্পে দৃঢ়তা

নির্ধারিত দিনে তাকে আনিবার জন্য শিয়ালদহ স্টেশনে উপস্থিত হইলাম। প্ল্যাটফরম টিকিট কিনিয়া ভিতরে ঢুকিলাম। কারণ বেচারী একা আসিতেছেন, কুলি ঠিক করিতে অসুবিধায় পড়িতে পারেন। লম্বা ট্রেন। যাত্রীর ভিড়। কাজেই এক-ধারসে সব কামরা দেখিয়া-দেখিয়া অগ্রসর হইতে লাগিলাম। হঠাৎ দূর হইতে ‘আব্বা আব্বা’ বলিয়া ছেলেদের সমবেত কণ্ঠস্বর শুনিলাম। বিস্মিত হইয়া দেখিলাম, বিছানা-পত্রের হোন্ড-অলের লট বহরের মধ্যে চার ছেলেরে লইয়া বিবি সাহেবা দাঁড়াইয়া আছেন। তিন ছেলে দৌড়িয়া আমার কাছে আসিয়া সালাম করিল। মেজো-সেজো আমাকে জড়াইয়া ধরিল। কোলেরটি হাত নাড়িয়া আনন্দ জানাইতে লাগিল। বিবি সাহেবা মুচকি-মুচকি হাসিতে থাকিলেন। আমি রাগে ভিতরে-ভিতরে ফাটিয়া পড়িতেছিলাম। মেয়ে লোকটার বিবেচনা দেখ! আমার চাকুরি গিয়াছে। জিনিসপত্র গোছাইতে দুইদিনের জন্য কলিকাতায় আসিয়াছেন। অথচ নিয়া আসিয়াছেন সব ছেলে-পিলেকে। মনে হয় যেন লটবহর কিছু বাড়াইয়া আনিয়াছেন। যে কয়টা টাকা আছে, এদের যাতায়াত ও ফুট-ফরমায়েশ সারিতেই ত শেষ হইবে। কিন্তু প্ল্যাটফরমে অতলোকের মধ্যে ত স্ত্রীর উপর রাগ দেখাইতে পারি না। আচ্ছা চলো যাই আগে বাসায়। আজ তোমারই একদিন কি আমারই একদিন। ছেলেদের আর দোষ কী? ওরা কী বুঝে? কাজেই ওরা যখন কাড়াকাড়ি করিয়া আমাকে জড়াইয়া ধরিল, তখন ওদেরে আদর করিলাম। কোলের ছেলেটা ৪র্থ–মনজুর আনাম হাত বাড়াইয়া থাকায় তাকে কোলেও লইলাম।

ফিটনে চড়িয়া বাসায় ফিরিবার পথে স্ত্রী কানের কাছে মুখ আনিয়া বলিলেন : তুমি খুব রাগ করিয়াছ জানি। কিন্তু এখন কিছু বলিব না বাসায় গিয়া সব কথা বলিব। সব শুনিলে তোমার রাগ থাকিবে না।

রাগ তখনই পড়িয়া গেল। বিবির সব কথা শোনার আর দরকারই হইল না। যা বলিলেন তাই যথেষ্ট। তাতেই রাগের স্থান দখল করিল দুশ্চিন্তা। বিনা কারণে এত ব্যয়বহুল কাজ করার মেয়ে ত তিনি নহেন। তবে কি বাড়িতে কোনও অসন্তোষ বা অমঙ্গলের কারণ ঘটিয়াছিল? দুশ্চিন্তা অসহ্য হইয়া উঠিল। কী ঘটিয়াছে তা না বলিয়া আমিই উল্টা তাকে খোশামুদি করিতে লাগিলাম। কিন্তু বাসায় গিয়া ঠাণ্ডা হইয়া সব বলিব’ বলিয়া তিনি আমার দুশ্চিন্তা আরো বাড়াইয়া বোধহয় মনে-মনে কৌতুক উপভোগ করিতেছিলেন।

পাশের ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া ময়মনসিংহ জিলার অধিবাসী কংগ্রেস ও কৃষক প্রজা সমিতির আমার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী আবদুল রশিদ খাঁ সাহেবের বাসায় আমাদের নাশতার ব্যবস্থা হইয়াছিল। দুইজনের নাশতার কথা বলিয়া আমি শিয়ালদহ চলিয়া আসিয়াছিলাম। কিন্তু খাঁ সাহেব খুব সাবধানী মানুষ। তিনি একটু বেশিই করিয়াছিলেন। এক রকমে সকলের নাশতা হইয়া গেল। ছেলে পেলেরা সঙ্গে আসিয়া পড়িয়াছে দেখিয়া খাঁ সাহেব দুপুরের খাবার ব্যবস্থায়ও নিজের বাসাতেই করিলেন। কাজেই গোসল-নাশতা সারিয়া আমরা নিশ্চিন্তে আলাপ করিতে লাগিলাম। বিবি সাহেবা কিছুমাত্র ভূমিকা না করিয়া আসল কথায় আসিলেন। বলিলেন : কলিকাতা ছাড়িব না বলিয়াই ছেলেদেরে লইয়া আসিয়াছি। অনেক তর্ক করিলাম। তার সংকল্পের অসম্ভাব্যতা দেখাইলাম। সাংবাদিকতার চাকুরির দুর্লভতা এবং প্রধান সম্পাদকতা করিবার পর কোনও কাগজের নিম্নতর চাকুরি নেওয়ায় আমার অসম্মানের কথা সবই বলিলাম। তিনি জবাবে বলিলেন যে তিনি সংবাদপত্রের চাকুরির কথা বলিতেছেন না। উকালতির কথা বলিতেছেন। আমি তার সরলতায় ঠাট্টার হাসি হাসিয়া বলিলাম : উকালতি করিব বলিলেই ত হয় না। নিজের জিলাতেই সংসার খরচ চালাইবার মত রোযগার করিতে আমার তিন-চার বছর অপেক্ষা করিতে হইয়াছিল। এই বিদেশ-বিভুঁয়ে কলিকাতার মত বিশাল শহরে হাজার-হাজার উকিলের মধ্যে কে আমাকে কেস দিবে? তাছাড়া কলিকাতার বাসা খরচও অনেক বেশি। কী খাইয়া এখানে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করিব?

সমান আত্মবিশ্বাসে তিনি বলিলেন : রাখে আল্লাহ মারে কে! তুমি সে জন্য চিন্তা করিও না। যত কষ্টই হোক, কলিকাতায় আমাদের থাকিতেই হইবে। ময়মনসিংহে তোমার ফিরিয়া যাওয়া হইবে না।

এতক্ষণে বিবি সাহেবা আসল কথা বলিতেছেন মনে করিয়া আমার বুক দুরুদুরু করিয়া উঠিল। তার চোখের দিকে চাহিয়া বলিলাম: কেন?

সুরে একটু আবেগ মাখিয়া তিনি বলিলেন : কলিকাতা ছাড়িয়া নিজের জিলায় ফিরিয়া যাওয়া হইবে পশ্চাৎ গমন। সেটা হইবে তোমার পরাজয়। এই পরাজয় মানিয়া নিতে আমি তোমাকে দিব না।

এটা ভাবালুতা। কিন্তু উচ্চ ও মহৎ ভাবালুতা, আত্মসম্মানবোধের কথা সুতরাং এতে যথেষ্ট জোর আছে। আমার আত্মসম্মান ও জয়-পরাজয়ে স্ত্রীর এই অনুভূতিতে আমি গর্ববোধ করিলাম। কিন্তু উপায় কী? উপায়ান্তর নাই বলিয়া তাকে ঐ পরাজয় মানিয়া নিতে বলিলাম। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলিলেন : উপায় একটা আল্লাই করিয়া দিবেন।

এ কথার কোনও জবাব নাই। সুতরাং চুপ করিয়া হুঁক্কা টানিতে লাগিলাম। তিনি উঠিয়া অন্য কাজে চলিয়া গেলেন। ভাবটা এই যে, তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত, এতে আর আলোচনার কিছু নাই। চিন্তা করিব না বলিলেই ত হয় না। আমার মাথা জুড়িয়া চিন্তা কিলবিল করিতে লাগিল। বিবি সাবের এই জিদের পিছনে নিশ্চয়ই শক্তি আছে। সে শক্তির উৎস কী? তাঁর হাতে কি তবে কিছু টাকা আছে। আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু কতই বা থাকিতে পারে? সংসার খরচ সম্বন্ধে আমার কোনও ধারণা নাই। কোনও দিন তার খোঁজখবর করি নাই। কাগজে-কলমে ত দূরের কথা মনে-মনেও কোনও দিন হিসাব করি নাই। এখন হিসাব করিতে বসিলাম। এ যাত্রায় চার বছর কলিকাতায় আছি। সাংবাদিক ও সাহিত্যিক রোযগারের এই চার বছরে হাজার পনের টাকা আমি আয় করিয়াছি এটা আন্দাজ করা যাইতে পারে। কিন্তু কত খরচ হইয়াছে? তার ধারণার আশপাশ দিয়াও যাইতে পারিলাম না। বাজে খরচের বিভিন্ন দফা ধরিয়া-ধরিয়া হিসাব করিতে লাগিলাম। হাজার কষিয়া খরচ করিলেও দুইশ টাকার কম মাস চলে নাই। তাতে চার বছরে দশ হাজার টাকা লাগিয়াছে। চার বছরে কমসেকম আট বার দেশে যাওয়া হইয়াছে। প্রতিবারে পাঁচশ করিয়া খরচ করিয়া আসিলেও আট বারে চার হাজার চলিয়া গিয়াছে। বাকি থাকিল মাত্র হাজার টাকা। এই টাকার চার-পাঁচ মাসের বেশি চলিতে পারে না। তার উপর এই টাকা হইতে উকালতির প্রস্তুতির জন্য কিছু প্রাথমিক ব্যয় করিতে হইবে। গাউন, বই-পুস্তক ও ফার্নিচারের একটা বড় খরচ আছে। না, হাজার টাকা মূলধন লইয়া এত বড় রিস্ক নেওয়া যায় না। অথচ বিবি সাব ত কোনও যুক্তি মানিতেছেন না।

অথচ তাকে শক্ত কথা বলিতেও পারি না। বিয়ার চার বছর পরেই পনের বছরের বালিকার উপর সংসার চালাইবার ভার দিয়াছিলাম। এটা চরম নিষ্ঠুরতা হইয়াছিল, দরদি অনেক বন্ধুই আমাকে তা বলিয়াছিলেন। কিন্তু যার উপর নিষ্ঠুরতা করিলাম, তিনি কিছু বলেন নাই। কোনও দিন প্রতিবাদ করেন নাই। বরঞ্চ তিনি আমার মনে এই ধারণা সৃষ্টি ও বদ্ধমূল করিয়াছেন যে আমি যা রোযগার করি তাতে স্বচ্ছন্দে আমার সংসার চলিয়া যায়। আমার নিজের এবং ছেলেদের অথবা স্ত্রীর নিজের পোশাকপাতি, লেখাপড়ার খরচা, সিনেমা-বায়স্কোপের ব্যয়, বাড়িভাড়া, ইনশিওরেন্সের প্রিমিয়াম, দেশের জমি-জিরাতের ট্যাক্স-খাযনা, দেনার কিস্তি, অসুখ ও বিসুখে চিকিৎসা খরচা কোনটাই আদায়ের সময় তিনি বলেন নাই : টাকা নাই। যখন যেটার প্রয়োজন হইয়াছে, ঠিকমত ও সময়মত তা করিয়া গিয়াছেন। ঈদ-পরবাদিতে শুধু ছেলেদের নয়, আমাদের উভয়ের জন্য কাপড়-চোপড় কিনিয়াও বাড়িতে আমার মা, বহিন, ভাই-ভাবি-ভাতিজাদের জন্যও কাপড়-চোপড় কিনিতেন। এক একবার বাড়ি যাইবার সময় তিনি সকলের জন্যই কিছু না কিছু নিয়া নিতেন। আমার পরামর্শ বা অনুমতির অপেক্ষা রাখিতেন না। নিজের বাপের বাড়ির কারো জন্য কিছু কিনার কথা না ভাবিয়া, না বলিয়া, আমার বাপের বাড়ির লোকজনের কথা তিনি চিন্তা করেন দেখিয়া আমি মনে-মনে খুশিই হইতাম। দেশের বাড়িতে গেলে গরীব আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীকে কিছু কিছু সাহায্যও করিতেন। তাঁর এই সব কাজ অনেক সময় আমার কাছে দান খয়রাতের বিলাসিতা বলিয়া মনে হইত কিন্তু ভাল-মন্দ কিছুই বলিতাম না। এসব ব্যাপারে তার স্বাধীনতা তিনি যেন ধরিয়াই লইতেন।

কিন্তু আজকার ব্যাপার তা নয়। এ ব্যাপারে স্ত্রীর উপর নির্ভর করা বুদ্ধিমানের কাজ হইবে না। অথচ দৃঢ়তা দেখাইবার সহজ পদ্ধতি খুঁজিয়া পাইতেছি না। বিষম ভাবনায় পড়িলাম। কিছুক্ষণ পরে কামরায় ঢুকিয়া আমাকে সেই অবস্থার চিন্তায় মগ্ন দেখিয়া তিনি কাছে আসিয়া বসিলেন। হাত ধরিয়া বলিলেন : কী অত-শত ভাবিতেছ? আমার প্রস্তাবে তুমি রাজি আছ ত?

দৃঢ়তা দেখাইবার এই উপযুক্ত সময়। আমি রাজি না বলিলেই বোধহয় সব সমস্যার সমাধান হইয়া যাইত। কিন্তু তা বলিতে পারিলাম না। তার বদলে বলিলাম : সংসার চালাইবা তুমি। কষ্ট হইবে তোমার। তুমি কষ্ট করিতে রাজি থাকিলে আমার রাজি-গররাজিতে কী আসে যায়?

তিনি দুই হাতে আমার ডান হাতটা চাপিয়া ধরিলেন। দরদ দিয়া বলিলেন; না না তুমি অমন কথা বলিও না। বলো তুমি মনের খুশিতে রাজি। হইয়াছ।

এ ভারি মজার কথা! একগুয়েমি করিয়া নিজের জিদ বহাল রাখিবেন। অথচ শুধু সে জিদ মানিয়া নিলেই চলিবে না, খুশিও হইতে হইবে। খুশি নাখুশি মনের ব্যাপার। কারো ফরমায়েশ মত খুশি হওয়া যায় না। তবু যখন সহধর্মিণী-জীবনসঙ্গিনী খুশি হইতে বলিতেছেন, তখন অগত্যা বলিলাম : হাঁ, খুশিতেই রাজি হইলাম।

বলিয়া হাসিলাম। চেষ্টা করিয়া হাসিতে হইল না। স্বতই হাসি আসিল। নিজের ঐ উপায়হীনতা সত্যই হাসির ব্যাপারই ছিল। স্ত্রী তাতেই সন্তুষ্ট হইলেন।

.

. বিবিই জিতিলেন

সন্ধ্যার সময় তিনি আমাকে আমার সোদর-প্রতিম বন্ধু খান বাহাদুর সিরাজুল ইসলামের বাসায় পার্ক সার্কাস নিয়া গেলেন। খান বাহাদুর সাহেব এই সময় বাংলা সরকারের অফিসিয়েটিং জুডিশিয়াল সেক্রেটারি। আমার স্ত্রীর সাথে তার পাতা-ভাই-বহিন সম্পর্ক। ভাই-বহিনে গোপনে আলাপ হইল। তারপর খান বাহাদুর সাহেব আমাকে যা বলিলেন, আমার স্ত্রীর কথার সঙ্গে সবই মিলিয়া গেল। তার দৃঢ়মত এই যে আমার ময়মনসিংহ ফিরা চলিবে না। কলিকাতা আলীপুরে প্র্যাকটিস শুরু করিতে হইবে। তিনি আমার ভার নিলেন। আমাকে কোনও চিন্তা করিতে হইবে না। চিন্তা সত্যই করিতে হইল না। ভার তিনি সত্যই নিয়াছিলেন। এইভাবে আমার কলিকাতা থাকা হইয়া গেল। অল্প দিনেই ভাল রোযগার হইতে লাগিল। সম্পাদকতা করিয়া যে টাকা পাইতাম, তার চেয়ে অনেক বেশি টাকার মুখ দেখিতে লাগিলাম। স্ত্রী হাসি-মুখে সংসার চালাইতে লাগিলেন। আমি প্রায় রোজই একবার মনে করিতাম এই বুঝি তিনি বলিলেন : কেমন আমার কথা ঠিক হইল? তোমার কথামত ময়মনসিংহ চলিয়া গেলে কত বড় ভুল হইত।’ বহু দিন এই কথা শুনিবার জন্য অপেক্ষা করিলাম। জবাবটাও ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলাম। বলিতাম : ‘সত্যই। এর জন্য অসংখ্য প্রশংসা তোমারই প্রাপ্য। কিন্তু অনেক দিন চলিয়া গেল। তিনি ঐ ধরনের কোনও কথাই বলিলেন না। তৈরি জবাবটা দিয়া স্ত্রীকে খুশি করিবার কোনও মওকা কাজেই পাইলাম না। অগত্যা আমি নিজেই একদিন বলিলাম : ‘এ সবই তোমার বদৌলতে। তোমার উপদেশ না মানিলে মস্তবড় ভুল করিতাম।’ তিনি আমার প্রশংসাটা গায় না মাখিয়া বলিলেন : ‘ওসব কথা রাখ। প্রশংসা তোমারও নয়, আমারও নয়। সব প্রশংসা আল্লার। আল্লা এখানেই আমাদের রেযেক রাখিয়াছেন। তুমি তা বদলাইতে কিরূপে?’ এই কলিকাতায় থাকা-না থাকার উপর আমার ভবিষ্যৎ জীবনের অনেক ঘটনা নির্ভরশীল ছিল। ময়মনসিংহে চলিয়া আসিলে এর চেয়েও আর্থিক ভাল হইত কি মন্দ হইত, সেটা অবশ্য বুঝিবার বা বলিবার উপায় নাই। কিন্তু কলিকাতায় থাকার দরুন যা-যা ঘটিয়াছিল, কলিকাতায় না থাকিলে তা না ঘটিবার সম্ভাবনাই বেশি ছিল। কলিকাতার রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক জীবনের সাথে ঘনিষ্ঠতা, রেনেসাঁ সোসাইটির প্রেসিডেন্ট হওয়া, মুসলিম লীগে যোগ দেওয়া, গণ-পরিষদের মেম্বর হওয়া, সাধারণ নির্বাচনে প্রাদেশিক লীগের নমিনেশন পাওয়া, প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রচার সম্পাদক হওয়া, ইত্তেহাদ-এর সম্পাদক হওয়া ইত্যাদি ঘটনাবলিকে যদি আমার রাজনৈতিক জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ধরা হয়, তবে এটাও ধরিতে হইবে যে কলিকাতায় উপস্থিত না থাকিলে এর অনেকগুলিই না ঘটিতে পারিত। আমার কলিকাতার থাকার জন্য একমাত্র আমার স্ত্রীই দায়ী। সুতরাং নির্ভয়ে বলা চলে আমার জীবনের এইসব ঘটনার জন্য আমার স্ত্রীই দায়ী।

ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা আমাকে মুখের উপর স্ত্রৈণ বলিতেন। কথাটা হয় ত সত্য। কারণ আমার জীবনের সব ক্ষেত্রেই তার প্রভাব অল্প-বিস্তর ছিল। উপরের ঘটনাবলিতে তাঁর দায়িত্ব স্পষ্টই বুঝা যায়, তবে তার প্রভাব ওতে তত সুস্পষ্ট নয়। কিন্তু এর পর যা ঘটিল তাতে তার সুস্পষ্ট প্রভাব দেখা যাইবে।

.

. বিবির প্রভাবের ব্যাপকতা

১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের এক বছর আগে হইতেই নির্বাচনের তোড়জোড় আরম্ভ হইয়াছিল। সে তোড়জোড়ের আমি অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা। আওয়ামী লীগের কাউন্সিল মিটিং হইল ময়মনসিংহে। আমি অভ্যর্থনা সমিতির চেয়ারম্যান। আমার বাসায় নেতাদের যাতায়াত ও সমাগম। সবটাতেই আমি আছি। কিন্তু বরাবরের মত আমি আগেই ঘোষণা করিয়া রাখিয়াছি, আমি নিজে নির্বাচনে দাঁড়াইব না। হক সাহেব ভাসানী সাহেব ও শহীদ সাহেব সকলেই আমার এই সংকল্পের কথা জানিতেন। তারা আমার দাঁড়াইবার পক্ষে অনেক যুক্তি-তর্ক দিয়াছেন। অনেক আদেশ-নির্দেশ দিয়াছেন। আমি রাজি হই নাই। মওলানা ভাসানী ও হক সাহেব আমার স্ত্রীর সঙ্গে কি আলাপ-আলোচনা করিলেন আল্লাই জানেন। এরপর তিনিও আমাকে ক্যানভাস করিতে লাগিলেন। আমি মনে করিয়াছিলাম শুধু হক সাহেব ও ভাসানী সাহেবের মত মুরুব্বিদ্বয়ের অনুরোধেই বিবিসাহেব আমাকে এই কথা বলিতেছেন। আমাকে অনুরোধ করিয়াই তিনি তার কর্তব্য শেষ করিবেন।

কিন্তু ও খোদা! আমার ‘না’ বরাবরের ন্যায় মানিলেন না। বরঞ্চ তিনি অন্য পথ ধরিলেন। বলিলেন : বেশ। তবে তোমার সংকল্পই ঠিক থাক। তুমি তবে কোনও প্রকার রাজনীতিই করিতে পারিবা না।

তর্ক বাধিয়া গেল। তিনি বলিলেন : হয় আমাকে পুরাপুরি রাজনীতি করিতে হইবে অর্থাৎ আইনসভায় যাইতে হইবে। নয় ত একদম ছাড়িতে হইবে। মাঝামাঝি রাজনীতি তিনি আমাকে করিতে দিবেন না। তর্ক করিতে-করিতে তিনি উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিলেন। আবেগ-ভরা ওজস্বিনী ভাষায় তিনি বলিলেন : পঁচিশ বছর ধরিয়া রাত জাগিয়া তোমার কর্মী বন্ধুদেরে ভাত খাওয়াইয়াছি। কোনও কথা বলি নাই। কোনও আপত্তি করি নাই। জীবন-ভরা পরের জন্য খাঁটিয়া শরীর খারাপ করিয়াছ, পরের জন্য ভোট ভিক্ষা করিয়া আত্মমর্যাদা নষ্ট করিয়াছ, ভোটারদের কাছে ওয়াদা করিয়াছ তোমার নিজ মুখেই কিন্তু সে ওয়াদা পূরণের দায়িত্ব দিয়াছ অপরের কাঁধে। এটা আমি আর হইতে দিব না। হয় তুমি নিজে প্রার্থী হইবা, নয় ত আজই আওয়ামী লীগের সভাপতিত্বে রিযাইন দিবা। এই দুইটার একটা তোমাকে করিতেই হইবে। আজই করিতে হইবে।

এর ফলে সকলেই জানেন। মওলানা ভাসানী ও হক সাহেব আমার মত পরিবর্তনে মোটেই বিস্মিত হন নাই। তাঁরা বলিয়াছিলেন, এটা যে হইবে তারা তা জানিতেন। জানিতেন হয়ত ঠিকই কিন্তু তাঁরা বোধ হয় এটা জানিতেন না যে আমার স্ত্রী অমন বেঁকিয়া না বসিলে আমি কিছুতেই মত বদলাইতাম না। কারণ এটা কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক, কথাটা সত্য যে মেম্বরগিরি বা মন্ত্রিত্বে আমার কোনও লোভ ছিল না। এ মনোভাব আমার কংগ্রেস হইতেই শিক্ষা। আমার চিন্তা-ধারার উপর এটা মহাত্মা গান্ধীর প্রভাব। আমি ভয়ানক রাজনৈতিক চিন্তক ছিলাম। দেশের সমস্ত সমস্যা আমার মাথায় কিলবিল করিত ও করে। সে সব সমস্যা সমাধানেরও চিন্তা আমি করিতাম ও করিয়া থাকি। ঐসব সমস্যার সমাধান করিয়া দেশবাসীর কল্যাণ করিয়া যশ ও সম্মান অর্জনের বাসনাও আমার খুবই তীব্র। অথচ বিপ্লবে আমি বিশ্বাস করি না। আমার মতে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচনের মাধ্যমে ঐসব সংস্কার করিতে হইবে। তা করিতে গেলে আইনসভার মেম্বাররাই ঐ সব করিবেন। শুধু মেম্বর হইলেই চলে না। মন্ত্রীও হইতে হয়। এসব ব্যাপারে আমার কোনও দ্বিমত বা দ্বিধা-সন্দেহ ছিল না। কিন্তু এসব করিতে হইলে আমাকেই মেম্বর-মন্ত্রী হইতেই হইবে, এটা আমি বিশ্বাস করি না। কংগ্রেসে মহাত্মাজী ছাড়াও অনেকে ছিলেন এবং আছেন যারা মেম্বর-মন্ত্রী না হইয়াও দেশের সেবা করিতেছেন এবং দেশবাসীর শ্রদ্ধা-সম্মান যশ ও প্রভাবের অধিকারী হইয়াছেন। তাঁদের যশ-মর্যাদা মন্ত্রীদের চেয়ে কম নয়। এঁরাই আমার আদর্শ। কাজেই মেম্বর-মন্ত্রী না হওয়াটাকে আমি কোনও ত্যাগ মনে করিতাম না। কিন্তু আমার স্ত্রী এবং অনেক ভক্ত-অনুরক্ত সহকর্মী মনে করিতেন, আমি দলের সাফল্যের জন্যই এইভাবে আত্মত্যাগ করিতেছি। মেম্বর হইলেই আমি মন্ত্রীও হইব এটা আমার সহকর্মীরা ও আমার স্ত্রী বিশ্বাস করিতেন। আমি নিজেও করিতাম। আমি মন্ত্রী হইবার যোগ্য। দলের মধ্যে আমার চেয়ে যোগ্য লোক খুব বেশি নাই, এ আত্মবিশ্বাসও আমার ছিল এবং আছে। হয়ত আমার স্ত্রী এই চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হইয়াছিলেন। মন্ত্রী হওয়ার আশা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা কোনও দোষের ব্যাপার নয়। তেমনি কোনও নারীর পক্ষে উকিলের বিবি হইতে মন্ত্রীর বেগম হইবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকাও দোষের নয়। যদি আমার স্ত্রীর মনে অমন উচ্চাকাঙ্ক্ষা হইয়া থাকে, তবে সেজন্য আমি তাকে দোষ দেই না। কিন্তু তেমনি কথা তিনি আমাকে বলেন নাই। বরঞ্চ আমার মেম্বর-মন্ত্রী না হওয়ার অভিপ্রায়কে তিনি দায়িত্ব এড়াইবার মনোভাব বলিয়া নিন্দা করিয়াছিলেন। তিনি বলিয়াছিলেন : তুমি দায়িত্ব লইতে ভয় পাও। পরের কাঁধে বন্দুক রাখিয়া শিকার করিতে চাও। নিজে বন্দুক কাঁধে লইতে চাও না।

এটা ভীরুতা-কাপুরুষতার অভিযোগ। এ অভিযোগ এর আগে কেউ আমার বিরুদ্ধে করেন নাই। আমিও নিজেকে কাপুরুষ মনে করিতাম না। বরঞ্চ আমি একরূপ বেপরওয়া রেকলেস ছিলাম। কাজেই দায়িত্ব এড়াইয়া চলিবার অভিযোগ, ভীরুতার কটাক্ষ, আমাকে খেপাইয়া দিয়াছিল। তাই বোধ হয় এবার অতি সহজে ত্রিশ বৎসরের সংকল্প একদিনে বিসর্জন দিতে পারিয়াছিলাম। কাজেই দেখা যাইতেছে আমার মেম্বর-মন্ত্রী হওয়ার গোড়ায় রহিয়াছে আমার স্ত্রীর প্রভাব। দেশের রাজনৈতিক কর্মীদের চরম উচ্চাকাঙ্ক্ষা যা, আমার বেলা তা পূর্ণ হইয়াছে। আমি প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের মেম্বর, প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, এমনকি পাকিস্তানের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রীও হইয়াছি। এইদিক হইতে আমার স্ত্রীর গর্ব করিবার অধিকার আছে। এ সবের প্রশংসা একমাত্র তাঁরই প্রাপ্য। এই একই কারণে দুঃখও তাঁর সবচেয়ে বেশি। কারণ ১৯৫৩ সালে জোর-যবরদস্তি না করিলে পাকিস্তানের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী হইতাম না। এটা যেমন সত্য, তেমনি দুর্নীতির অভিযোগের আসামিও হইতাম না, এটাও সত্য। বেচারীর এই দুঃখ রাখিবার স্থান নাই। আমাকে গ্রেফতার করিয়া জেলে নেওয়ার সময় তিনি বলিয়াছিলেন : “তোমাকে আমিই জেলে পাঠাইলাম। জীবনে একথা আমি ভুলিতে পারিব না। আমি তাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করিয়াছি এই বলিয়া : তুমি আমাকে মন্ত্রী হইতেই বলিয়াছিলা; ভুল বা অন্যায় করিতে ত বল নাই।

.

. আমার স্বাস্থ্যের দিকে অতন্দ্র দৃষ্টি

আমার শরীর-স্বাস্থ্য, রোগ-চিকিৎসা সম্বন্ধে তিনি কতটা অধিকার খাটাইতেন, তার প্রমাণ পাইয়াছিলাম করাচিতে মন্ত্রী থাকাকালে। একবার আমার পায়ের চিকিৎসা করিতে গিয়া ডাক্তাররা ঠিক করিলেন আমার বা উরাতে সাফেনাস নামক রগ একটি কাটিয়া ফেলিতে হইবে। হাসপাতালে মন্ত্রীর উপযোগী ব্যবস্থাদি করিয়া ডাক্তাররা আমাকে নিতে আসেন। আমার স্ত্রী ডাক্তারদেরে জেরা করিয়া কী ধরনের অপারেশন হইবে, তা জানিয়া নেন এবং তাতে আপত্তি করেন। আমাকে তিনি বুঝাইতে চেষ্টা করেন যে ঔষধে সকল প্রকারের চেষ্টা শেষ না করিয়া অপারেশনে আমার রাজি হওয়া উচিৎ নয়। আমি জবাব দিলাম এ ব্যাপারে ডাক্তারদের মতকে চূড়ান্ত বলিয়া মানা উচিৎ। উত্তরে তিনি বলিলেন : পূর্ব-পাকিস্তানের প্রধান-প্রধান ডাক্তারদেরে না দেখাইয়া করাচির ডাক্তারদের মতকে তিনি চূড়ান্ত বলিয়া মানিয়া নিতে রাজি নন। আমি বিবি সাহেবের এই অযৌক্তিক জিদে বড়ই বেকায়দায় পড়িয়া যাই। যারা করাচিতে আমার চিকিৎসা করিতেছেন তারা সকলেই নামকরা বড় ডাক্তার। কেউ ফিজিশিয়ান, কেউ সার্জন। তাঁদের অভিমতের নির্ভুলতার সন্দেহ করিবার কোনও কারণ নাই। তিনি আমার কথার জবাবে বলিলেন: তাদের নির্ভুল মত দুদিন পরেও নির্ভুলই থাকিবে। ইতিমধ্যে দুই-একদিনের জন্য ঢাকা গিয়া ওখানকার ডাক্তারদের কনসাল্ট করিয়া আসিতে দোষ কী?’ আজ শিরাটা না কাটিলেও দু’দিন পরে কাটা যাইবে। কিন্তু একবার কাটিয়া ফেলিলে পুনর্বহাল করা যাইবে না। ডাক্তাররা যথেষ্ট শ্রদ্ধা-বিনয়ের ভাব দেখাইয়া দৃঢ়তার সঙ্গে জানাইলেন যে মন্ত্রী-হিসাবে আমার স্বাস্থ্যের জিম্মাদার তাঁরা। বেগম সাহেবের তাতে হস্তক্ষেপ করিবার কোনও অধিকার নাই। অধিকারের প্রশ্ন তোলায় বিবি সাহেব আগুন হইয়া গেলেন। ডাক্তারদেরে বলিলেন : মন্ত্রী হওয়ার দরুন যদি স্বামীর চিকিৎসার উপর আমার কোনও হাত না থাকে, এই মন্ত্রিত্বই যদি আপনাদেরে এই একক অধিকার দিয়া থাকে, তবে আমি তাঁকে এই মুহূর্তে মন্ত্রিত্বে পদত্যাগ করাইব। তবু আজ অপারেশনের জন্য আমার স্বামীকে আপনাদের হাতে ছাড়িয়া দিব না।’

আমার স্ত্রী অগ্নিমূর্তি ও এই দৃঢ়তা দেখিয়া ডাক্তাররা প্রথমে স্তম্ভিত হইলেন। তার অজ্ঞতায় কৌতুক বোধ করিলেন। ফলে নরম হইলেন। ভাবিলেন বোধ হয় অজ্ঞ মেয়েলোকের সঙ্গে তর্ক করা নিষ্ফল। ডাক্তাররা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করিয়া অপারেশনের দিন পিছাইয়া দিলেন এবং মুখে খাইবার ঔষধ দিয়া বিদায় হইলেন। ডাক্তাররা বিদায় হইলে বিবি সাহেব প্রাইভেট সেক্রেটারিকে দিয়া তৎক্ষণাৎ সেই-রাত্রের প্লেনেই ঢাকা আসিবার দু’খানা টিকিট করিয়া ফেলিলেন। এর ফলে পরদিন সকালে সাতটার সময় আমি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একজন রোগী। বিবি সাহেবের কথাই ঠিক। ঢাকা ও মির্যাপুরের সব ডাক্তাররাই একমত হইলেন যে, বিবি সাহেব অপারেশন বাধা দিয়া আমাকে বাঁচাইয়াছেন। ঐ অপারেশন মস্ত বড় ভুল হইত। জীবনের নামে বাঁ-পা হারাইতাম।

শুধু এইবার নয়। আরেকবার করাচির বড়-বড় সার্জন-ফিজিশিয়ানরা একমত হইয়া আমার গল-ব্লাডার অপারেশন করিতে চাহিয়াছিলেন। এ বারও বিবি সাহেব বাধা দেন এবং আবার এক্স-রে করাইয়া ঢাকার ডাক্তারদের দেখাইয়া প্রমাণ করেন যে, আমার গল-ব্লাডারে কোনও স্টোন হয় নাই।

এই সব ঘটনা হইতে এটাই বুঝা যাইবে যে, আমার স্ত্রী নিজেকেই সকল ব্যাপারে আমার গার্ডিয়ান নিযুক্ত করিয়াছেন এবং আমি তা সানন্দে মানিয়া লইয়াছি। সানন্দে মানিয়া লইয়াছি এই জন্য যে স্ত্রীর এই অভিভাবকত্ব কখনো আমার কাছে প্রভুত্ব বলিয়া ঠেকে নাই। বরঞ্চ কথায় ও কাজে আমার সুখ-সুবিধার জন্য শারীরিক পরিশ্রমে তিনি প্রমাণ করিতেন, আজও করেন, তিনি আমার দাসী মাত্র। কাজেই দাম্পত্য জীবনে আমি পরম সুখী এ কথা শুধু আমার একার কথা নয় আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবরাও তা বলিয়া থাকেন।

.

১০. সুখী দাম্পত্য জীবন

আমার অনেক বন্ধু-বান্ধবের ধারণা এবং সে ধারণা তাঁরা মুখে প্রকাশও করিয়া থাকেন যে, দাম্পত্য জীবনে এই নিরঙ্কুশ সুখই আমার প্রতিভা বিকাশে বিঘ্ন উৎপাদন করিয়াছে। তাঁদের দু-চারজন খুব কঠোর ভাষায় কিন্তু আন্তরিকতার সঙ্গে বলিয়াছেন : তুমি বউ-এর আঁচলে বাধা গৃহপালিত পশু “ডোমিটিকেটেড এনিম্যাল” মাত্র। আর্ট-সাহিত্যে মৌলিক কিছু দিবার দিন তোমার ফুরাইয়াছে। শুধু আমাকে একা নয় আরো অনেককেই একথা তাঁরা বলিয়াছেন। সারা দুনিয়ার বহু দৃষ্টান্ত দিয়া এঁরা দেখাইয়া থাকেন যে, চিরস্মরণীয় মনীষীরা কেউই দাম্পত্য জীবনে সুখী ছিলেন না। মনীষী বলিতে তারা নিশ্চয়ই কবি-সাহিত্যিক ও দর্শনী-বিজ্ঞানীদেরেই বুঝাইয়া থাকেন। কারণ দাম্পত্য জীবনে পরম সুখী বহু লোক রাষ্ট্রনেতা হিসাবে চরম সাফল্য লাভ করিয়াছেন। অসুখী স্বামী ইব্রাহিম লিংকনের মোকাবিলা আমরা অনেক রুযভেল্ট, চার্চিল, গান্ধীর নাম করিতে পারি। তবে কবি-সাহিত্যিকদের বেলা বন্ধুদের কথায় জোর আছে বলিয়া আমার মনে হয়। অনুভূতির তীব্রতা ছাড়া উকৃষ্ট কাব্য-সাহিত্য সৃষ্টি হইতে পারে না। মনের দিক হইতে সুখী লোকের অনুভূতি তীব্র হওয়ার অসুবিধা আছে। পাথরে পাথর ঘষিলে যেমন আগুন ক্ষরিত হয়, তেমনি বেদনার আঘাতেই মন হইতে তীব্র অনুভূতি বিচ্ছুরিত হয়। সুখের অপর নাম সন্তোষ। দাম্পত্য-সুখের অপর নাম গৃহ-প্রীতি বা ঘরমুখিতা। এই সন্তোষ ও ঘরমুখিতা মানুষের কল্পনা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও বেপরোয়া সাহস ভুতা করিয়া দেয়। এমন লোক মৌলিক শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির শক্তি হারাইয়া ফেলে। ঘরে বা পরিবারে যার মন বাঁধা পড়িল, তার চিন্তার পরিধিও স্বভাবতই ছোট হইয়া গেল। ঐ সংকীর্ণ মন ও সীমাবদ্ধ দৃষ্টি দিয়া কেউ বড়-কিছু সৃষ্টি করিতে পারে না।

এ সব কথাই ঠিক হইতে পারে। হইতে পারে কেন, বোধ হয় সত্যই ঠিক। কিন্তু যে কথাটা আমার জীবনকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করিয়াছে, তা এই যে সামাজিক জীব হিসাবে মানুষের জীবনের যেটা সবচেয়ে সুন্দর দিক সেটা মানুষের সভ্যতা। সভ্যতার প্রাথমিক ইউনিট পরিবার। পরিবারের ইউনিট দম্পতি। সুতরাং দাম্পত্য জীবনই সভ্যতার প্রাথমিক ইউনিট। ইউনিটের সঙ্গে ইউনিটির, ব্যষ্টির সঙ্গে সমষ্টির যেমন শত্রুতার সম্পর্ক থাকিতে পারে না, পরিবারের সঙ্গে তেমনি জাতির ও মানবতার শত্রুতা থাকিতে পারে না। যে বিরোধ দৃশ্যত দেখা যায়, সেটা আমাদের ভ্রান্ত নীতিরই কুফল। অন্যের সুখই আমার অসুখের হেতু, অন্য কথায় আমাকে সুখী হইতে হইলে অপরকে অসুখী করিতে হইবে, এই মনোভাবই আমাদের সমস্ত সমস্যার মূল কারণ।

দাম্পত্য জীবন লইয়া আমরা স্বামী-স্ত্রীতে অনেক আলোচনা ও তর্ক বিতর্ক করিয়াছি। সাধারণ জ্ঞানের বই-পুস্তক ছাড়া যৌনবিজ্ঞানের বইও আমি অনেক পড়িয়াছি। আমার স্ত্রীও কম পড়েন নাই। তাতে আমরা উভয়েই জ্ঞান লাভ করিয়াছি নিশ্চয়ই। কিন্তু জীবন-পুস্তক-পাঠলব্ধ জ্ঞান বই-পুস্তক পাঠ-লব্ধ জ্ঞানের চেয়ে কোনও অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমাদের চতুর্থ পুত্র মনজুর আনাম ও পঞ্চম পুত্র মহফুজ আনামের আজ্ঞা যে ছয়-সাত বছর, তা এই জ্ঞানেরই সুফল। বিদ্যা ও বয়সের শ্রেষ্ঠত্বের জোরে আমি তাকে শিখাইয়াছি অনেক। কিন্তু বয়সে ছোট ও বিদ্যায় কম হইয়াও তিনিও আমাকে অনেক শিখাইয়াছেন। সে গর্ব তিনি তাঁর লেখা ও কথায় যাহির করিতে ছাড়েন নাই। তিনি বহুবার বলিয়াছেন : আমার স্বামী আমাকে গড়িয়াছেন নিশ্চয়ই, কিন্তু আমিও তাকে গড়িয়াছি।’ কথাটা সত্য। দাম্পত্য জীবন সম্বন্ধে স্পষ্টতই তার একটা নিজস্ব মতবাদ আছে। তিনি এ সম্পর্কে আধুনিক স্ত্রী ও আধুনিক স্বামী নামে দুইখানি জনপ্রিয় বই লিখিয়াছেন। উচ্চ-শিক্ষিত ডিগ্রিধারী বান্ধবীদের সাথে তুমুল বাদ-বিতণ্ডা করিয়া অবশ্য তাঁর মতবাদ গড়িয়াছে। আমার বা তাঁর বন্ধু-বান্ধব যারাই তাঁকে চিনেন, তাঁরা সবাই জানেন, তিনি একটা অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী। আমিসহ পরিবারের এবং আত্মীয়স্বজনের সবাই আমরা সেই ব্যক্তিত্ব মানিয়া চলি।

কিন্তু মতবাদের দিক দিয়া আমিও কম একরোখা নই। তবু মতবাদ লইয়া আমাদের মধ্যে কদাচ বিরোধ হয় নাই। বন্ধু-বান্ধবরা বলেন, আমরাও জানি যে, আমরা সুখী দম্পতি। এ সুখের বয়স প্রায় অর্ধশতাব্দী। আমাদের এ সুখের গূঢ় কথা এই যে, মতবাদের দিক দিয়া আমরা আন্তরিকভাবেই টলারেন্ট। আর সব বিষয়ে আমরা সম্পূর্ণরূপে পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। তিনি রবারের মত নমনীয়। পোশাক-পাতি ও সাজ-সজ্জা সম্পর্কে তিনি বলেন যে আমার মতই তাঁর মত। তাঁর মত-মতে স্ত্রীর সাজ-সজ্জা ত স্বামীর জন্যই। কাজেই আমি যা বলি, তিনি তাই করেন। আমি যে পোশাক পছন্দ করি, তাই তিনি পরেন। প্রসিদ্ধ পীর-আলেমের পর্দানশীন মেয়ে হইয়াও তিনি বোরকা ছাড়িয়া ‘বেপর্দা’ হইতে পারিয়াছিলেন এই কারণে। তিনি আমার সকল বন্ধু-বান্ধবের সাথে মিশিলেন, বব কাটিয়া ‘মেম সাব’ হইলেন। হবিবুল্লা বাহারের কলমে আজাদ-এর পৃষ্ঠা তিনি তৎকালে ‘বব কাটা ভাবি’ রূপে মশহুর হইয়াছিলেন।

রাজনীতিক মতবাদে আমি তাঁকে প্রভাবিত করিয়াছি সত্য, কিন্তু তিনি আমাকে করিয়াছেন অনেক বেশি। ত্রিশ দশকে আমি তাঁকে কংগ্রেসি রাজনীতিতে দীক্ষা দিয়াছিলাম। জিলা স্তরে তিনি মহিলা কংগ্রেসের আফিস বিয়ারার এবং প্রাদেশিক স্তরে সক্রিয় মেম্বর হইয়াছিলেন। কিন্তু দশ বছর পরে চল্লিশের দশকে তিনিই আমাকে পাকিস্তানি মন্ত্রে দীক্ষা দিয়াছিলেন। কৃষক ও নবযু-এর সম্পাদনকালে আমি যখন ঘঘারতর ‘সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী, তিনিই তখন অতি সাবধানে ধীরে-ধীরে মুসলিম রাজনীতি’র দিকে আমার নজর ফিরান। আমার তিন ছেলে মনসুর আনাম, মহজুব আনাম ও মতলুব আনাম তখন ৮/১০/১২ বছরের কলিকাতা মাদ্রাসার নিম্ন শ্রেণীর ছাত্র। এদেরই মুসলিম লীগের ‘ন্যাশনাল গার্ডের মিছিলে শামিল দেখিয়া একদিন ধমক দিলাম। জানিতে পারিলাম, তাদের আম্মার অনুমতি নিয়াই তারা এটা করিতেছে। আস্তে আস্তে বুঝিলাম আমার গোটা পরিবারই ‘পাকিস্তানি’ অগত্যা আমিও হইলাম। এই কারণেই বলিয়াছি, রাজনীতিতে আমার স্ত্রীই আমাকে অনেক বেশি প্রভাবিত করিয়াছেন। আমি যে তাঁকে কংগ্রেসি করিয়াছিলাম সেটা ছিল স্বল্পমেয়াদি। আর তিনি যে আমাকে পাকিস্তানি, বানাইয়াছিলেন, সেটা হইয়াছে দীর্ঘমেয়াদি। বস্তুত সারা জীবন স্থায়ী। আমার রাজনৈতিক জীবনে যদি কিছু সাফল্য ঘটিয়া থাকে, তার সবটুকু কৃতিত্বই, অতএব, আমার স্ত্রীরই প্রাপ্য।

কিন্তু এক ব্যাপারে আমি তাকে মোটেই প্রভাবিত করিতে পারি নাই। সেখানেই আবশ্যক ছিল সহিষ্ণুতা। সেটা ছিল ধর্মানুষ্ঠানের ব্যাপার। আমিও ধর্মবিশ্বাসী ছিলাম ও আছি। কিন্তু তিনি বরাবর আনুষ্ঠানিক ধার্মিক। এই আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপারেই তিনি ছিলেন এবং আছেন সম্পূর্ণ স্বাধীন। যে মুদ্দতে তিনি আমার সহচর, পোশাক-পরিচ্ছদে, চাল-চলনে ‘অতি-আধুনিক হইয়াছিলেন, তখনও তিনি নামাজ-রোযা ছাড়েন নাই। আমার কথায়ও না, আধুনিকতার খাতিরেও না। কিছু বলিলে দৃঢ়তার সাথে জবাব দিতেন : দাস ফার, এন্ড নো ফাদার। ওটাই তোমার এলাকার সীমানা। এর পরের এলাকা আমার বিবেক ও আমার আল্লার।

এই অধ্যায়ের শেষ কথা হিসাবে আমার তরুণ বন্ধুদের একটিমাত্র উপদেশই দিতে পারি : ‘স্ত্রীকে বিশ্বাস কর এবং সেটা শুরু কর প্রথম দিন হইতেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *