অধ্যায় পাঁচ – মাধ্যমিক শিক্ষা–নাসিরাবাদে
১. মৃত্যুঞ্জয় স্কুল
১৯১৩ সালের জানুয়ারি মাসে আমি নাসিরাবাদ শহরে পড়িবার জন্য আসিলাম। ময়মনসিংহ শহরকে তৎকালে পাড়াগাঁয়ের লোকেরা নাসিরাবাদ বলিত। আমার মুরুব্বিরাও বলিতেন। কিন্তু শহরে আসিয়া দেখিলাম, সবাই এটাকে ময়মনসিংহ বলে, নাসিরাবাদ কেউ বলে না।
শামসুদ্দিন আগে হইতে ময়মনসিংহ শহরে থাকিতেন। সুতরাং তার সাথে একত্রে থাকিবার জন্য তাঁদের মেসেই উঠিলাম। ঐ মেসে আমাদের প্রতিবেশী মাতবর ওসমান আলী সরকার সাহেবের ছোট ভাই সাঈদ আলী সাহেবও থাকিতেন। কাজেই মুরুব্বিদের কথামত বাড়ি হইতে আগেই ঠিক করিয়াই আসিয়াছিলাম, এদের সঙ্গেই থাকিব। সাঈদ আলী সাহেব ও শামসুদ্দিন উভয়েই জিলা স্কুলের ছাত্র ছিলেন। কাজেই জিলা স্কুলেই ভর্তি হইব, ঠিক করিয়াছিলাম। কিন্তু গিয়া দেখিলাম জিলা স্কুলে সিট নাই। সাঈদ আলী সাহেব ও শামসুদ্দিন অবশ্য আমার একটা সিটের জন্য অনেক ধরাধরি করিলেন। কিন্তু কোনও ফল হইল না। এতে আমি খুবই নিরাশ হইলাম। আমার আত্মীয়-বন্ধুরা। জিলা স্কুলে পড়েন, সে জন্য জিলা স্কুলের প্রতি একটা স্বাভাবিক টান ছিল। তা ছাড়া জিলা স্কুলের প্রতি আকৃষ্ট হইবার আরেকটা সাম্প্রতিক কারণ ঘটিয়াছিল। সেই বছরই জিলা স্কুল তার পুরাতন বাড়ি। হইতে নূতন দালানে উঠিয়া আসিয়াছে। বর্তমানে জিলা স্কুল যে বাড়িতে আছে, এটাই সেই নূতন দালান। এর আগে জিলা স্কুল ছিল জজকোর্টের দক্ষিণ দিকের লম্বা বড় টিনের ঘরটায়। বর্তমানে এই ঘরটা সেটেলমেন্ট বিভাগের রেকর্ড রুমরূপে ব্যবহৃত হইতেছে, জিলা স্কুলের নূতন বাড়িতে সেই বারই প্রথম স্কুল উঠিয়া আসিয়াছে। নূতন স্কুল দালানের ভিতর-বাইর সবই তকতকা সুন্দর। চারিদিকে সব দেওয়াল নূতন। বিশেষত মাঝখানের হল ঘরটা একটা বিস্ময়ের বস্তু। মাঝখানে দাঁড়াইয়া কথা বলিলে সারা। হলটায় গম গম করিয়া আওয়াজ ওঠে। এমন সুন্দর স্কুলে পড়িতে পারিব না বলিয়া মনটা এমন খারাপ হইয়া গেল যে রাগে ঠিক করিলাম আবার আমার প্রিয় দরিরামপুরে ফিরিয়া যাইব।
শামসুদ্দিন যে মেসে থাকিত এবং সেখানে আমি উঠিয়াছিলাম তার সুপারিন্টেন্ডেন্ট ছিলেন মৌলবী আবদুল হাই। তিনি মৃত্যুঞ্জয় স্কুলের আরবি ফারসি শিক্ষক। তিনি আমাকে মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে ভর্তি হইবার উপদেশ দিলেন। মৌলবী সাহেবকে আমার ভাল লাগিয়াছিল। তার উপদেশ আমি রাখিলাম। বিশেষত ঐ মেসে যত ছাত্র ছিল তাদের অধিকাংশই ছিল মৃত্যুঞ্জয়ের ছাত্র। কাজেই মৃত্যুঞ্জয় স্কুলেই ভর্তি হইলাম।
মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে ভর্তি হইয়া জিলা স্কুলে সিট না পাওয়ার দুঃখ আমি ভুলিয়া গেলাম। কারণ মৃত্যুঞ্জয় স্কুল আমার কাছে একটা মহাসাগর মনে হইল। স্কুল ত নয়, যেন একটা মেলা। স্কুল বিল্ডিং ত নয়, যেন একটা দুর্গ। কোথাও যে এ দালানের শুরু আর কোথায় যে এটার শেষ, খুঁজিয়া বাহির করা কঠিন। প্রথম প্রথম আমার মনে হইল এ স্কুলের ছাত্রদেরও লেখাযোখা নাই। মাস্টারের সংখ্যাও অগণিত। পরে জানিয়াছিলাম স্কুলে ছাত্রসংখ্যা দেড় হাজার। শিক্ষক-সংখ্যা চৌত্রিশ জন। দেড় হাজার ছাত্রের মধ্যে মুসলমান ছাত্রের সংখ্যা তিন শর কিছু উপরে। এই হিসাবে জিলা স্কুল অতি ছোট স্কুল। তার মোট ছাত্রসংখ্যাই ছিল পৌনে তিন শ, মৃত্যুঞ্জয় স্কুলের মুসলমান ছাত্রের চেয়েও কম। তখন এই শহরে অবশ্য সিটি স্কুল ছিল ছাত্রসংখ্যার দিক দিয়া মৃত্যুঞ্জয়ের চেয়েও বড়। তার ছাত্রসংখ্যা ছিল সতের-আঠার শ। শিক্ষক ছিলেন চল্লিশের বেশি। কিন্তু মুসলমান ছাত্রের দিক দিয়া মৃত্যুঞ্জয় স্কুলই শ্রেষ্ঠ। সিটি স্কুলে মুসলমান ছাত্রের সংখ্যা ছিল এক শরও কম।
.
২. হিন্দু-মুসলমান পৃথক বেঞ্চি
এই দিক দিয়া জিলা স্কুলে ভর্তি না হওয়ার দুঃখই শুধু ভুলিলাম না, মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য গর্ব-অহংকার করিতে লাগিলাম। অল্পদিনের মধ্যেই আমি অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার শ্রীযুক্ত ভূপতি চরণ দত্ত, ইংরাজি শিক্ষক শ্রীযুক্ত যতীন্দ্র চন্দ্র সরকার, বাংলা শিক্ষক শ্রীযুক্ত বিপিন চন্দ্র রায়, গণিতের শিক্ষক শ্ৰীযুক্ত যতীন্দ্র নাথ দত্ত রায় প্রভৃতি মাস্টার মহাশয়ের প্রিয় পাত্র হইয়া উঠিলাম। ক্লাসে ভাল ছাত্র বলিয়া নাম করিলাম। ক্লাসের ফার্স্ট বয় শৈলেশ ধর, সেকেন্ড-থার্ড-ফোর্থ যথাক্রমে মনসা চক্রবর্তী, সুধীর রায়, নরেশ ঘোষ সকলের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হইয়া পড়িলাম। কিন্তু এ স্তরে পৌঁছিতে কয়েক মাস সময় লাগিয়াছিল। কারণ তৎকালে হিন্দু-প্রধান স্কুলে মুসলমান ছাত্রদের বিশেষ মর্যাদা ছিল না। আমি প্রথম দিন ক্লাসে গিয়াই বুঝিলাম, হিন্দু-মুসলমান ছাত্ররা পৃথক-পৃথক বেঞ্চিতে বসে। এটা উপরের হুকুমে হয় নাই সে খবর পাইলাম। আপনা-আপনিই এটা হইয়া গিয়াছে। সাধারণত ক্লাসে ছাত্রদের বসিবার জন্য নিয়ম-নির্দিষ্ট কোনও সিট নাই। ফার্স্ট-সেকেন্ড-থার্ড বয় পর্যন্ত ছাত্ররা শিক্ষকের বাম দিকস্থ কাতারের প্রথম দিকে বসিলেও অন্য ছাত্ররা যার যথা-ইচ্ছামত বসিয়া থাকে। এই বসার গ্রুপিং হইয়া থাকে ছাত্রদের পরস্পরের সখ্য ও বন্ধুত্বের ভিত্তিতে। খাতিরের সমপাঠীরা এক বেঞ্চে ঘেঁষাঘেঁষি করিয়া বসিয়া থাকে। এই নিয়মেই মুসলমান ছাত্ররা একসঙ্গে এক বেঞ্চিতে জমা হইয়া যাইত। সাধারণত হিন্দু ছেলেরাই ক্লাসের ভাল ছাত্র বলিয়া ভাল ছাত্রের বেঞ্চিতে শুধু হিন্দু ছাত্রই দেখা যাইত। এই স্বাভাবিক কারণে হিন্দু ও মুসলমান ছাত্ররা ক্লাসে পৃথক পৃথক আসনে বসিতে বসিতে এটা একরকমের নিয়মে পরিণত হইয়া গিয়াছিল। হিন্দুদের মধ্যে ছোঁয়াছুঁয়ির বাতিক থাকায় এই পৃথক বসাটাকে সেই অর্থে নেওয়া খুবই স্বাভাবিক ছিল। তা ছাড়া এতে হিন্দু ও মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে হয়তো একটা কমপ্লেক্স গড়িয়াও উঠিয়াছিল। মুসলমান ছাত্ররা হিন্দুদের সাথে এক বেঞ্চিতে বসিতে সাহস পাইত না; আর হিন্দুরা মুসলমানদের সাথে বসিতে ঘৃণা ও অপমান বোধ করিত। এই অবস্থায় প্রথম দিন ক্লাসে গিয়াই আমি প্রথম কাতারে টিচারের আসনের নিকটে যখন বসিলাম, তখন অনেক ছাত্রই পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিল। আমি অবশ্য আমার ডান দিকে দুই-একজন বসিতে পারে, সে মত জায়গা রাখিয়াই বসিলাম। নূতন নূতন ক্লাসে ভর্তি হইয়াই ক্লাসের প্রথম সিটটায় বসা উচিৎ মনে হইল না। আমি বরাবর ক্লাসে প্রথম সিটটাতেই বসিয়াছি। সেই অভ্যাসবশত প্রথম দিন ক্লাসে ঢুকিয়াই নিজের অজ্ঞাতসারেই প্রথম সিটটায় বসিয়া পড়িয়াছিলাম। কারণ প্রথম দিন বলিয়া প্রায় আধা ঘণ্টা আগেই ক্লাসে গিয়াছি। ক্লাসের অনেক ছাত্র বিশেষত ফার্স্ট বয় শৈলেশ ধর তখনও আসেন নাই। তবু বেঞ্চিতে বসিবার পর আমার মনে হইল ডান দিকে দুই-একজনের বসিবার মত জায়গা ছাড়িয়া দেওয়া আমার উচিৎ। তদনুসারে সরিয়া বসিলাম। আমরা এই দ্বিধা ও দুর্বলতা অন্যান্য সামনের বেঞ্চের ছাত্রদের কেউ-কেউ বোধ হয় বুঝিতে পারিল। কারণ আমি যে মুসলমান সে সম্বন্ধে ভুল করিবার কোনও উপায় ছিল না। আমার মাথায় ঈষৎ খয়েরি লাল রঙের তুর্কি টুপিটা আমার মুসলমানত্ব ঘোষণা করিতেছিল। এখানে বলা দরকার যে দরিরামপুর স্কুলে পড়িবার কালে ১৯১১ সালে ইতালির ত্রিপলি আক্রমণের প্রতিবাদে আমি তুর্কি টুপিটা পোড়াইয়া ফেলিয়াছিলাম। তুর্কি টুপির বদলে একটা ইরানি টুপি কিনিয়াছিলাম। কিন্তু তুর্কি টুপির প্রতি আমার মায়া কাটে নাই। শুধু সকলের সঙ্গে হুজুগে মাতিয়াই অত আদরের টুপি পোড়াইয়াছিলাম। তারপর অল্প দিনেই তুর্কি টুপির প্রতি আমার টান আরো বাড়িয়া যায়। কারণ ইরানি টুপির আর যত গুণই থাকুক না কেন ওটা শক্ত। ওটা ধুইয়া পরিষ্কার করা যায় না। দরকারমত পকেটে ভরাও যায় না। পক্ষান্তরে তুর্কি টুপি নরম। ধুলা বা অন্য ময়লা লাগিলে রিঠা দিয়া ঘোয়া যায়। তারপর কালেবে করিয়া সুন্দর সাইযে বহাল করা যায়। বৃষ্টি-বাদল ইত্যাদি ঠেকা-বাধায় ভাঁজ করিয়া শার্ট-কোটের পকেটে ভরিয়া টুপি বাঁচানো যায়। এসব কারণে ইতালি বয়কটের হিড়িকটা একটু কমামাত্র পরের বছরই অপেক্ষাকৃত সুন্দর একটা তুর্কি টুপি কিনিয়া ইরানি টুপিটাকে বাক্সবন্দী করিয়াছিলাম। এই টুপি পরিয়াই মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে ক্লাস করিতে শুরু করিয়াছিলাম। টুপি-পরা মুসলমান, তা-ও আবার নূতন ছাত্র। কাজেই আমাকে ক্লাসের ফার্স্ট-সেকেন্ড বয়ের বেঞ্চিতে বসিতে দেখিয়া হিন্দু ছাত্ররা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিবে, এতে আশ্চর্যের কিছু ছিল না। পরে দু-একজন মুসলমান ছাত্র আমাকে বলিয়াছিল, আমাকে ঐখানে বসিতে দেখিয়া তাদের বুক কাঁপিতেছিল। তবে আমাকে রক্ষা করিবার জন্য তারা নাকি প্রস্তুতও ছিল। সে প্রস্তুতিটা ছিল এই : যদি হিন্দু ছেলেরা শিক্ষকদের কাছে নালিশ করিত এবং তাতে যদি শিক্ষকেরা আমাকে শাস্তি দিতে চাহিতেন, তবে তারা বলিত : পাড়াগা হইতে নূতন আসিয়াছি। শহরের হাল-চাল সম্বন্ধে আমার জ্ঞান নাই। কাজেই প্রথমবারের জন্য আমাকে মাফ করিয়া দেওয়া হউক।
কিন্তু তেমন কোনও দুর্ঘটনা ঘটিল না। যদিও আমার বেঞ্চের দু-একজন ভাল ছাত্র আমাকে ঐ বেঞ্চি ত্যাগ করিতে বলিয়াছিল এবং যদিও আমি তাদের কথায় কান না দিয়া নিজের জায়গায় বসিয়া রহিলাম তথাপি কেউ শেষ পর্যন্ত শিক্ষকদের কাছে নালিশ করিল না। শুধু পাশের দুজন ছাত্র আমার গা ঘেঁষিয়া না বসিয়া একটু তফাতে বসিল এবং মাঝে মাঝে আড়চক্ষে আমার দিকে কড়া নজর ফেলিতে লাগিল।
.
৩. প্রথম বিরোধ
ভালয়-ভালয় দিনটা কাটিয়াই প্রায় গিয়াছিল। বিকালের দিকে একজন শিক্ষক আমাদের ক্লাসে আসিলেন। আমাকে তার অতি নিকটে প্রথম বেঞ্চিতে দেখিয়া তিনি মুখ ভেংগাইয়া বলিলেন : মিয়া সাহেবের কোন চিড়িয়াখানা থনে আসা হৈছে? এক লাফেই যে একেবারে গাছের আগায় বসা হৈছে?
আমি সারের কথার কোনও মানে বুঝিলাম না। কিন্তু সারা ক্লাস হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। ছাত্রদের সে হাসিতে সারও যোগ দিলেন না, আমিও যোগ দিলাম না। ক্লাসে এমন উচ্চ হাসির রোল তোলার জন্য ছাত্রদেরে তিনি কোনও ধমকও দিলেন না। তিনি একদৃষ্টে আমার দিকে চাহিয়াই রহিলেন। যেন তিনি প্রশ্নটার জবাবের অপেক্ষায় আছেন। আমি ধীরে ধীরে দাঁড়াইলাম। সারের কথার অর্থ না বুঝিলেও এইটুকু আমি বুঝিয়াছিলাম যে তিনি আমাকে বিদ্রূপ করিলেন; এটাও বুঝিলাম যে, এই স্থানে বসার জন্যই তিনি আমাকে বিদ্রূপ করিলেন। কাজেই মনে মনে আমার খুব রাগ হইয়াছিল। আমি দাঁড়াইয়া বলিলাম : এ জায়গায় বসা কি আমার অন্যায় হৈছে সার? কোনও নিষেধ আছে?
শিক্ষক মহাশয় যেন বিস্মিত হইলেন। সারা ক্লাস নিস্তব্ধ হইল। শিক্ষক মশায় একটু তোতলা ছিলেন। সেটা এইবার বুঝিলাম। তিনি দুই-একবার ঠোঁট বাজাইয়া বলিলেন : আমার কথা তুমি বুঝতে পারো নাই মিয়া সাহেব। এই বেঞ্চিতে বসায় নিষেধ নাই সত্য কিন্তু ওখানে বসতে হৈলে ভাল ছাত্র হওয়া দরকার।
আমি দাঁড়াইয়া ছিলাম। বলিলাম : আমি ছাত্র ভাল কি মন্দ, দু-চার দিন না পড়াইয়া কীভাবে বুঝলেন সার?
মাস্টার মশায় বোধ হয় আরো বেশি রাগিয়া গেলেন। তিনি বলিলেন : ‘অত কথা কইও না মিয়া সাহেব। ভাল ছাত্র হইলে একেবারে ডাইনে গিয়ে বসো। ফলেন পরিচিয়তে। এখন বইসা পড়ো ত মিয়া সাহেব।’ কিন্তু আমি বসিলাম না। বুঝিলাম মুসলমান ছাত্রকে মিয়া সাব’ বলা তাঁর রোগ। কী যেন ঘাড়ে জিদ চাপিয়া গিয়াছিল। আমি যে ক্লাসে প্রথম আসিয়াছি, সে কথা ভুলিয়া গেলাম। বলিলাম : কথায় কথায় আমারে মিয়া সাব বলেন কেন সার? আমরা মুরুব্বিদেরেই মিয়া সাব বলি। আমি ত আপনার মুরুব্বি নই; আপনার ছাত্র।
স্পষ্টই দেখিলাম, মাস্টার মশাই একেবারে সিদ্ধ করা শাকের মত মিলাইয়া গেলেন। আর দ্বিতীয় কথা না বলিয়া গজাইতে লাগিলেন। বাংলায়। তিনি দ্বিতীয় শিক্ষক। খুব ভাল পড়াইলেন। শিক্ষক হিসেবে উনাকে আমার খুব পছন্দ হইল। পরে জানিতে পারিলাম তাঁর নাম শ্রীযুক্ত অতুল চন্দ্র চক্রবর্তী। মুসলমান বন্ধুরা বলিল : অতুলবাবু মুসলিম-বিদ্বেষের জন্য খুব সুপরিচিত। আমি তার মুখের মত জবাব দিয়াছি বলিয়া অনেকে আমার তারিফও করিল। হিন্দু বন্ধুরা ঐ ধরনের কিছু বলিল না। ঐ ঘটনা সম্পর্কে ঘুণাক্ষরেও কোনও কথা আলোচনা করিল না। কিন্তু কাজে-কর্মে ব্যবহারে তারা প্রমাণ করিল, তারা আমাকে যথেষ্ট সমীহ করে। আস্তে আস্তে ক্লাসের ভাল ছাত্রদের সাথে ঘনিষ্ঠ হইলাম। প্রথম ত্রৈমাসিক পরীক্ষাতেই দ্বিতীয় স্থান দখল করিলাম। ওদের অনেকের সাথে এমন বন্ধুত্ব হইল যা মুসলমান ছেলেদের সঙ্গেও ছিল না। শুধু অতুলবাবু নন, কোনও কোনও হিন্দু সহপাঠীও মুসলমান ছাত্রদেরে ‘মিয়া সাব’ বলিয়া সম্বোধন করিত। আমি অল্প দিনেই বুঝিলাম অতুলবাবু ভাল শিক্ষক। অতুলবাবুও কয়েক দিনে বুঝিলেন, আমি ছাত্র মন্দ নই। কাজেই মোটামুটি ভাল ব্যবহারই তিনি। করিতেছিলেন। কিন্তু তিনি হঠাৎ একদিন আমার উপর চটিয়া গেলেন। পড়াশোনায় গাফলতির কোনও ব্যাপার ছিল না। আমার পোশাক দেখিয়াই তিনি চটিয়া গিয়াছিলেন। এটা তার কথায় বুঝা গেল। তিনি ক্লাসে ঢুকিয়া চেয়ারে বসিয়াই ছাত্রদেরে এক নজর দেখিয়া লইলেন। আমার উপর চক্ষু পড়িতেই তিনি মুখ বেঁকাইয়া বলিলেন : কী মিয়া সাব, আজ যে বড় চিকনাই জামাই বাবুটি সাইজা আসছ?
সত্যই আমি সেদিন একটা ডবল-কাফ ডবল-ব্রেস্টের সদ্য-ইস্ত্রি-করা শার্ট পরিয়া স্কুলে আসিয়াছিলাম। মেসের বন্ধু-বান্ধবের চাপেই আমি এই ডবল ব্রেস্টওয়ালা ইস্ত্রি-করা শার্টটা কিনিয়াছিলাম। সদ্য-ইস্ত্রি-করা লাল-সাদা ডুরির এই শার্টটা পরিয়া আমার নিজেরই কেমন লাগিতে ছিল। ক্লাসের বন্ধুরা কেউ কিছু বলিলে হয়তো আমি এর একটা কৈফিয়ত দিতাম। কিন্তু অতুলবাবুর উপর আমার আগেরই রাগ ছিল। বিশেষত তিনি বহুদিন পরে আজই আবার ‘মিয়া সাহেব’ বলিলেন। তার উপর আবার চিকনাই জামাই বাবু বলিয়া গাল দিলেন। আমার মন ও মাথায় যেন একটা ঝাঁকি লাগিল। কিন্তু মুহূর্তমাত্র। তারপর আমি দাঁড়াইয়া বলিলাম : কী কইলেন বাবুজি?
এমন কাজ কেউ করে নাই। এমন কথা কেউ আর বলে নাই। অতুলবাবু গর্জিয়া উঠিলেন : কী, তুমি আমারে বাবুজি কইলা?
আমি : আপনিও ত স্যার আমারে মিয়া সাব কইলেন।
অতুলবাবু ক্লাস থনে বাহির হইয়া গেলেন। হেডমাস্টার শ্রীযুক্ত চিন্তাহরণ মজুমদারের কাছে নালিশ হইল। আমার ডাক পড়িল। আমি গেলাম। সত্য কথা সব খুলিয়া বলিলাম। তার সুবিচারে আমি খালাস পাইলাম। অতুলবাবু তিরস্কৃত হইলেন। এই ঘটনার পর অতুলবাবু আমাকে আর কোনও দিন মিয়া সাব বলিয়া সম্বোধন করেন নাই। হিন্দু সহপাঠীদের মধ্য হইতে আস্তে আস্তে ঐ অভ্যাস দূর হইয়া গেল।
.
৪. ঢিলের জবাবে ঢিল
কিন্তু অতুলবাবুর প্রতি আমার রাগ কমিল না। অতুলবাবুও যেন আমাকে কোনও দিন ভাল চোখে দেখিতে পারেন নাই। সে জন্য দোষী ছিলাম বোধ। হয় আমিই। কারণ আমার একটা স্বভাবই ছিল এই যে আমাকে যিনি আদর করিতেন তাঁর প্রতি আমি একেবারে গলিয়া যাইতাম। একটা মিষ্টি কথা বলিলে আমি একেবারে নুইয়া পড়িতাম। কিন্তু আমাকে অবজ্ঞা করিলে, তুই তুংকার করিলে আমি আগুন হইয়া যাইতাম। এবং হুঁশ-জ্ঞান হারাইয়া। বেআদবি করিয়া ফেলিতাম। গ্রাম ছাড়িয়া শহরে আসিবার কিছুদিন আগে। আমি আমাদের জমিদারের ধানীখোলা কাঁচারির নায়েব শ্রীযুক্ত পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তী মহাশয়ের সাথে তুই’-এর জবাবে তুই’ বলিয়া এমনি এক বেআদবি করিয়াছিলাম। তাতে সারা গায়ে ও কাঁচারিতে হৈচৈ পড়িয়া গিয়াছিল। আমার ও আমার মুরুব্বিদের বিপদের আশঙ্কা হইয়াছিল। আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর নামক বইয়ে এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়াছি। তাই এখানে তার পুনরুল্লেখ করিলাম না। শুধু এটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, এই স্বভাব আমার স্কুল-কলেজজীবনেও দূর হয় নাই। বোধ হয়, আজও এই বয়সেও না।
অতুলবাবুর গম্ভীর মুখ ও কড়া চাহনিও আমাকে নরম করিতে পারিল না। বরঞ্চ অনেক মুসলমান সহপাঠী গোপনে গোপনে আমাকে খুব সাহস দিতে লাগিল। তারা বলিল যে অতুলবাবু আমাকে বানর বলিয়াছেন। তারা দেখাইয়াছিল যে একলাফে গাছের আগায় উঠার কথাটার মধ্যেই বানরের ইঙ্গিত রহিয়াছে। কাজেই অতুলবাবুর প্রতি আমার মন নরম হইল না। তিনি ক্লাসে পড়াইবার সময় আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিতেন না। কারণ তাঁর সাবজেক্ট বাংলায় আমি ভাল ছাত্র ছিলাম। কিন্তু ক্লাসের বাহিরে রাস্তাঘাটে তিনি আমার দিকে চাইতেন না। আমিও তাকে আদাব দিতাম না। অথচ আমি অন্য সব টিচারকেই, এমনকি অন্য স্কুলের টিচারগণকেও পথে-ঘাটে আদাব দিতাম। বন্ধুবান্ধবের প্রশ্নের জবাবে সগর্বে বলিতাম : ‘আমার টিচার না হোক, টিচার ত। অতুলবাবুর বেলায় বলিতাম : আমার সাথে যে যেমন ব্যবহার করিবে, সেই রকম ব্যবহার পাইবে।
এই নীতির চরম করিয়াছিলাম একদিন পোস্টকার্ড কিনিতে গিয়া। এটাও ময়মনসিংহ জীবনের প্রথম বছরের ঘটনা। একদিন ছোট বাজার পোস্ট অফিসে কার্ড কিনিতে গিয়াছি। ছোট পোস্ট অফিস। পপাস্টমাস্টার বাবু একটি জানালার ধারে বসিয়া অফিসের কাজও করেন, কার্ড-স্ট্যাম্পও বেচেন। হেড পোস্ট অফিসের মত এখানে জানালায় কোনও ফোকাম নাই। গরাদের ফাঁক দিয়াই বিকি-কিনি হইয়া থাকে। গরাদের ফাঁকগুলিও এমন চিপা যে তার ভিতর দিয়া অতি কষ্টে হাত আনা-নেওয়া করিতে হয়। অন্যান্য খরিদ্দারের মতই আমিও হাতের মুঠায় দরকার-মত পয়সা লইয়া অতি কষ্টে হাত ঢুকাইয়া মাস্টার বাবুর কাছাকাছি নিয়া মুঠা খুলিলাম এবং নিজের দরকার বলিলাম। মাস্টার বাবু পয়সা নিয়া গনিলেন এবং হিসাব ঠিক হওয়ায় হাত-বাকসের একটি খোপে পয়সা ফেলিয়া আরেকটি খোপ হইতে কার্ড বাহির করিয়া আমার প্রসারিত হাতে কার্ডগুলি দিতে উদ্যত হইলেন। সেখানে কোনও হাত না পাইয়া তিনি মাথা তুলিয়া জানালার দিকে চাহিলেন। ইতিমধ্যে ব্যাপার ঘটিয়াছে এই : মাস্টার বাবু আমার প্রসারিত ডান হাতের তলা হইতে যখন পয়সা নেন তখন আমি দেখিতে পাই যে বা হাতেই পয়সা নিলেন। আমিও অমনি আমার চিকরা ডান হাতটা ফেরত আনিয়া বা হাত ভিতরে ঢুকাইলাম। হাত ঢোকানো ও বাহির করা উভয়টাই একটু শ্রমসাধ্য, সুতরাং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। পোস্ট কার্ড তাতে লইয়া মাস্টার বাবু যখন জানালায় নজর করিলেন, তখন আমার ডান হাতটা সবেমাত্র বাহির হওয়ার কাজ শেষ করিতেছে এবং বাঁ হাতটা ঢুকিবার জন্য প্রস্তুত হইতেছে। পোস্টমাস্টার বাবু আমার হাত বদলাইবার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। আমি সরলভাবে সত্য বলিলাম। তিনি বাম হাতেই পোস্টকার্ড ধরিয়া ছিলেন। তৎক্ষণাৎ হাত বদলাইলেন। ফলে আমাকে আবার ঘুরাইয়া বাম হাতের বদলে ডান হাত ঢুকাইতে হইল। পোস্টমাস্টার বাবু প্রৌঢ় লোক। তিমি মুচকি হাসিলেন।
.
৫. প্রথম মিলাদ শরিফ
মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে আমার ছাত্রজীবন মোটামুটি ভালই কাটিতে লাগিল। অধিকাংশ শিক্ষকের প্রিয় পাত্র হইয়া উঠিলাম। বন্ধুর সংখ্যাও বাড়িল। এইভাবে আট-নয় মাস গেল।
এই সময় হিন্দু ছেলেরা ধুমধাম করিয়া সরস্বতী পূজা করিল। আমার সহপাঠীদের একজনের নাম ছিল আবদুর রহমান। তার বাড়ি ছিল নেত্রকোনা মহকুমার সেকান্দর নগর গ্রামে। আচার-ব্যবহার আদব-কায়দা ও চেহারা ছবিতে দেখিতে তাকে আমার খুব ভাল লাগে। আমি তার প্রতি মুগ্ধ হই। উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। এই আবদুর রহমান আমাকে একদিন বলে, আমাদের মিলাদ শরিফ করিতে হইবে। আমি মোহাম্মদী জমাতের লোক। মিলাদ পড়া আমাদের মধ্যে নিষেধ। কিন্তু বন্ধুকে সে কথা না বলিয়া হিন্দুদের স্কুলে মিলাদ পড়িবার অনুমতি দিবে না, এই কথা বলিলাম। জবাবে আবদুর রহমান বলিল : স্কুলের সেক্রেটারি হেডমাস্টার হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও এখানে আমরা তিন শর বেশি মুসলমান ছাত্র আছি। ইহাদের ধর্মকাজে অনুমতি না দিয়া পারিবেন না। হিন্দুদের সরস্বতী পূজার প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে মুসলমান ছাত্রদের একটা কিছু ধর্মকাজ করা নিতান্ত উচিৎ। আবদুর রহমানের এই সব যুক্তিতে আমি আকৃষ্ট হইলাম। দুই বন্ধুতে মিলিয়া আমরা স্কুলের তৎকালীন মুসলমান ছাত্রদের নেতা দশম শ্রেণীর শরফুদ্দিন আহমদ (পরবর্তীকালে খান বাহাদুর জিলা বোর্ডের চেয়ারম্যান, পাবলিক প্রসিকিউটর ও আইন পরিষদের মেম্বর) সাহেবের কাছে পরামর্শের জন্য গেলাম। তিনি আমাদের নিরাশ করিলেন। বলিলেন, স্কুলে মিলাদ পড়াইবার চেষ্টা তারা বহুদিন ধরিয়া বহুবার করিয়াছেন। লিখিত দরখাস্ত দিয়াছেন। হেডমাস্টার বাবু চিন্তাহরণ মজুমদার ও সেক্রেটারি বাবু অঘোর বন্ধু গুহের সহিত দেখা করিয়াছেন। কোনও ফল হয় নাই। স্কুলে মুসলমানদের ধর্মকাজ করিলে হিন্দু ছাত্রদের ধর্ম-প্রাণে আঘাত লাগিবে, এই যুক্তিতে কর্তৃপক্ষ তাদের সমস্ত অনুরোধ-উপরোধই অগ্রাহ্য করিয়াছেন।
শরফুদ্দিন সাহেবের নিকট হইতে নিরাশ হইয়া ফিরিলাম বটে, কিন্তু আমরা নিরুৎসাহ হইলাম না। ক্লাসের ও স্কুলের মুসলমান ছাত্রদের সাথে সলাপরামর্শ চালাইয়া গেলাম। হঠাৎ আমার মাথায় একটা ফন্দি আসিল। প্রথমে আবদুর রহমান ও পরে অন্যদের কাছে ফন্দিটা ভাঙ্গিয়া বলিলাম। বেশ কিছু সমর্থক জুটিবার পর আমরা স্কুল ছুটির পর একদিন এক সভা করিলাম। তাতে প্রস্তাব গ্রহণ করিলাম যে মূর্তিপূজা দেখা মুসলমানদের জন্য শেরিকি গোনা। অতএব স্কুলে সরস্বতী পূজা বন্ধ করিতে হইবে। অন্যথায় মুসলমান ছাত্ররা স্কুলে আগামী বকরিদে গরু কোরবানি করিবে। স্কুলে হৈচৈ পড়িয়া গেল। প্রথমে আমাদের জনপ্রিয় ইংরাজি টিচার বাবু যতীন্দ্র চন্দ্র সরকারের সাথে এবং পরে তার মধ্যস্থতায় হেডমাস্টার বাবু চিন্তাহরণ মজুমদারের সাথে। আমাদের বেশ কয়দিন দেন-দরবার হইল। অবশেষে স্কুল বিল্ডিংয়ে মিলাদ শরিফ অনুষ্ঠানের অনুমতির বদলে আমরা সরস্বতী পূজা বিরোধী দাবি প্রত্যাহার করিলাম।
মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে বিপুল আনন্দ-উল্লাস ফাটিয়া পড়িল। আমাদের নিতান্ত ন্যায়সংগত ধর্মীয় দাবি গ্রহণ করিবার জন্য সভা করিয়া স্কুল কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ দিলাম। আমারও নাম ফাটিয়া গেল। আমরা পরম উৎসাহে চাদা আদায়ে লাগিয়া গেলাম। হিন্দু-চালিত স্কুল ত দূরের কথা এমন যে সরকারি জিলা স্কুল সেখানেও স্কুল প্রাঙ্গণে মিলাদ হয় নাই। জিলা স্কুলের মিলাদ আঞ্জুমান মুসলিম হোস্টেলে হইত। অথচ আমরা হিন্দু-প্রধান মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে মিলাদ শরিফ করিতেছি। এটা এ শহরে নূতন ঘটনা। কাজেই মুসলমান ছাত্ররা পরম উৎসাহে চাদা দিল। আমরা ক্লাস সেভেনের ছাত্ররা এ কাজে উদ্যোগী হইয়াছিলাম বটে কিন্তু উপরের ক্লাসের ছাত্ররাও আমাদের কাজে পূর্ণ সহায়তা করিলেন।
মিলাদ করিবার চেষ্টা আশাতিরিক্তরূপে সফল হইতেছে দেখিয়া আমার মনে এটা প্রেরণা জাগিল। মিলাদের বিরুদ্ধে শরিয়ত-ঘটিত আপত্তি ছাড়াও আমার একটা বিশেষ আপত্তি ছিল। উর্দু-ফারসিতে ওটা পড়া হয় বলিয়া হাযেরানে-মজলিসের অধিকাংশ লোক তা বুঝেন না। সে জন্য আমি হানাফি বন্ধুদের সাথে তর্ক করিতে গিয়া বলিতাম যদি মিলাদ পড়িতেই হয় তবে বাংলাতেই তা পড়া উচিৎ; তাতে পয়গম্বর সাহেবের পুণ্য জীবন কথা হইতে জনসাধারণ শিক্ষা লাভ করিতে পারিবে। বন্ধুরা, এমনকি অনেক সময় হানাফি দুই-একজন আলেমও বলিতেন, ও-কথা বলিয়া আমি প্রকারান্তরে বাংলায় নামাজ পড়ার কথা বলিতেছি। নামাজের সাথে মিলাদের তুলনা চলে না, এটাই আমার দৃঢ় মত। কাজেই এই মিলাদ মহফিলে এ বিষয়ে একটা প্রবন্ধ পড়িব বলিয়া মনে মনে ঠিক করিলাম। অনেক রাত জাগিয়া একটি প্রবন্ধ রচনা করিলাম।
এর আগেও আমি অনেকবার স্কুলের সভায় রচনা পাঠ করিয়াছি। কিন্তু সে সবই ছিল পাড়াগাঁয়ে। এবারই জীবনের প্রথমে শহরে উচ্চশিক্ষিত বড় বড় লোকের সামনে রচনা পড়িতে হইবে। আমি শহরে মিলাদের সভা এর আগে আর দেখি নাই। কিন্তু মসজিদের জমাত দেখিয়াছি। হিন্দু ও ব্রাহ্মদের ধর্মসভা দেখিয়াছি। কাজেই কল্পনায় টিচার-প্রফেসার উকিল-মোখতার জজ ম্যাজিস্ট্রেট আলেম-ফাজেলের বিরাট সমাবেশ দেখিলাম এবং তাঁদেরে সামনে রাখিয়াই প্রবন্ধ রচনা করিলাম। খাঁটিলামও সেই পরিমাণে। পড়িয়া দেখিলাম। নিজের কাছে ভাল লাগিল। মনে জোর পাইলাম।
এত বড় সভায় কি পোশাকে দাঁড়াইব? অনেক চিন্তা করিলাম। বন্ধুবান্ধবে উপদেশ চাহিলাম। এক-এক জন এক-এক পরামর্শ দিল। শেষ পর্যন্ত নিজের বুদ্ধিই সম্বল করিলাম। কিছুদিন আগে ডার্কগ্রিন রঙের একটা টার্কিশ কোট ও কালো জমিনের উপর গ্রিন ডুরি-দেওয়া আলপাকার একটা আচকান তৈয়ার করিয়াছিলাম। আমি ঘোর কালো রঙের লোক। এই কালো চেহারায় ঔ দুইটা রঙের একটাও মানায় না। তবু ঐ রঙের দুইটা দামি কাপড় কেন বানাইয়াছিলাম, আজও আমি তা বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই। উকিলদের কালো পোশাক পরিতে হয় বলিয়া আমি আজও কালো গাউনের সাথে কালো শেরওয়ানি পরিয়া থাকি। তাতে মানাইল কি না এ বয়সে সে কথা বড় একটা ভাবি না। কিন্তু ষোল বছরের বালকের মনে নিশ্চয়ই চেহারার প্রতি এমন ঔদাসীন্য ছিল না। তবু কালো রঙের প্রতি অমন টান কোন খেয়ালে আমার হইয়াছিল, আজও তা রহস্যময় থাকিয়া গিয়াছে।
অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া আচকানটাই ঠিক করিলাম। তার উপর খয়েরি লাল তুর্কি টুপিটা ত আছেই। এই বেশে মিলাদের মজলিসে গেলাম। উদ্যোক্তাদের একজন বলিয়া আমি বেশ আগেই গেলাম। মেহমানদের অভ্যর্থনায় প্রধান অংশগ্রহণ করিলাম। কাজেই কারা-কারা সভায় আসিলেন, স্বচক্ষে দেখিলাম। অন্যান্য স্কুলের টিচার, কলেজের প্রফেসার, উকিল, মোখতার ও জজ-ম্যাজিস্ট্রেটরা আসিলেন। আমাদের স্কুলের সেক্রেটারি উকিল শ্ৰীযুক্ত অঘোর বন্ধু গুহও আসিলেন। এঁদের শুভাগমনে প্রতিবার আমার বুক নূতন করিয়া দুরুদুরু করিয়া কাঁপিয়া উঠিল। না জানি রচনা পাঠের সময় কোনো শরম পাইয়া বসি। শেষ পর্যন্ত হল ভর্তি হইয়া গেল। চার-পাঁচটা ক্লাসের কাঠের পার্টিশন সরাইয়া বিশাল লম্বা হল করা হইয়াছিল। সবটুকু জায়গা ভরিয়া গেল। ময়মনসিংহ শহরের জীবনের প্রথমে হিন্দুর স্কুলে মিলাদ হইতেছে বলিয়া শহরের গণ্যমান্য মুসলমান কেউই বাদ যান নাই।
.
৬. বাংলায় মিলাদ
যথারীতি মিলাদ পড়া হইলে সভার কাজ শুরু হইল। অমুসলমান অতিথিদের সকলে এবং মুসলমানদেরও অনেকে এতক্ষণ বারান্দা ও আঙিনায় গল্প। গোজারি করিতেছিলেন। এইবার সকলে সভায় জমিয়া বসিলেন। প্রথমে আমাদের জনপ্রিয় হেডমাস্টার শ্রীযুক্ত চিন্তাহরণ মজুমদার মহাশয় সমাগত অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাইলেন এবং তাঁর প্রিয় ছাত্ররা এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করায় তিনি তাদের উদ্যমের প্রশংসা করিলেন। উপসংহারে ছাত্রদের এই প্রথম প্রয়াসের ত্রুটি-বিচ্যুতি মাফ করিবার জন্য সকলকে অনুরোধ করিলেন। ছাত্রদের তরফ হইতে আমি দুই-চার কথা বলিব বলিয়া হেডমাস্টার বাবু আসন গ্রহণ করিলেন।
আমি দাঁড়াইলাম। আমার চেহারাও ভাল নয়। পোশাকও নিশ্চয়ই সুরুচির পরিচায়ক ছিল না। কাজেই সমবেত দ্রমণ্ডলী বোধ হয় নিরাশ হইলেন। আমি তাদের চোখে-মুখে কোনও উৎসাহ-সূচক হাসি দেখিলাম না। আমি সংক্ষেপে সমবেত অতিথিগণকে এবং বিশেষ করিয়া মুসলমান ছাত্রদের আবদার রাখার জন্য স্কুলের সেক্রেটারি ও হেডমাস্টার বাবুকে ধন্যবাদ দিয়াই পকেট হইতে প্রবন্ধটি বাহির করিলাম। এতক্ষণে শ্রোতাগণের মধ্যে উৎসাহ বা কৌতূহল একটা কিছু দেখিতে পাইলাম। দুই-তিন মিনিট পড়ার পরই সভা সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ হইল। দশ-বার মিনিটেই ‘মারহাবা’ ও ‘হিয়ার হিয়ার’ শুনিতে লাগিলাম। ওজস্বিনী ভাষা ও পড়ার ভঙ্গির জন্য এর আগেও আমি শিক্ষকদের প্রশংসা পাইয়াছিলাম। সুতরাং ঐ দুইটা ভালই হইয়াছিল। তার উপর আমি বাগদাদ-দামেস্ক হইতে দিল্লি-আগ্রা ও গ্রানাডা-কর্ডোভা যুগের মুসলমান গৌরবের কাহিনী বর্ণনা করিয়া তার তুলনায় বর্তমানের দারিদ্র্য দুরবস্থার কথাই ঐ প্রবন্ধে লিখিয়াছিলাম। ওসব কথাই অবশ্য বই-পুস্তক ও মাসিক-সাপ্তাহিক কাগজের প্রবন্ধ হইতে ধার-করা। কিন্তু ভাষা ও পঠন-ভঙ্গি ছিল আমার নিজস্ব। তাতে সাধারণ লোক ত দূরের কথা, ঐ সব বই-পুস্তকের নিয়মিত পাঠকদের পক্ষেও সে নকল ধরা সহজ ছিল না। সুতরাং শ্ৰোতৃমণ্ডলী আমার লেখা ও পড়ায় যেমন আকৃষ্ট হইলেন আমি নিজেও তেমনি নিজের খেলা পড়ায় একদম মাতিয়া উঠিলাম। বর্তমান অধঃপতনের বর্ণনা করিতে গিয়া আমি এমন কথাও বলিলাম যে আমরা শুধু নিজেদের ধর্ম-সভ্যতাই ত্যাগ করি নাই, নিজেদের জাতীয় পোশাকও বর্জন করিয়াছি। জাতীয় পোশাক বর্জনের দৃষ্টান্ত দিতে গিয়া কোট, প্যান্ট পরাকে কঠোর ব্যঙ্গ করিলাম। শ্বেতাঙ্গদের ঐ পোশাকে কালা আদমিদেরে যে কলিকাতার গড়ের মাঠের কালো পাথরের মূর্তির মত দেখায়, তেমন রসিকতাও করিলাম। উপস্থিত সভ্যমণ্ডলীর মধ্যে কয়েকজন কোট-প্যান্ট পরা অফিসার ও উকিল ছিলেন। এই রসিকতায় শ্রোতৃমণ্ডলীর মধ্যে হাসির হুল্লোড় পড়িল ও ‘হিয়ার হিয়ার’ ধ্বনি উঠিল; তাতে ঐ কয়জন ভদ্রলোক বেশ বিব্রত হইলেন। বলা দরকার ঐ রসিকতাটিও ছিল ধার করা। কারণ তখনও আমি কলিকাতা যাই নাই; গড়ের মাঠ ও তার পাথরের মূর্তিগুলিও দেখি নাই। কিন্তু সে খোঁজ রাখে কে?
এই ‘হিয়ার হিয়ার’ ও ‘মারহাবার’ মধ্যে আমি যখন আসল কথায় আসিলাম তখন হঠাৎ সমস্ত সভা গম্ভীর হইয়া উঠিল। এটা যে হইবে, তা আমি জানিতাম। সেই কারণেই বুদ্ধি করিয়া ঐ কথাটা আমি প্রবন্ধের সর্বশেষে লিখিয়াছিলাম। শ্ৰোতৃমণ্ডলীর গম্ভীর মুখের দিকে না চাহিয়া আমি প্রবন্ধ পড়িয়া যাইতে লাগিলাম। দুর্বোধ্য আরবি-ফারসি-উর্দুতে মিলাদ শরিফ পড়া উচিৎ নয়। কারণ তাতে মুসলমানদের কোনও লাভ হয় না। হযরতের জীবনী আলোচনার দ্বারা শিক্ষা লাভ করাই মৌলুদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ। বাংলা ভাষায় তা না করিয়া আমরা মৌলুদের এই মহৎ উদ্দেশ্যই ব্যর্থ করিয়া দিতেছি ইত্যাদি ইত্যাদি।
ষোল বছরের বালকের মুখ হইতে এমন জটিল বিষয়ে উপদেশ নিবার জন্য কেহ প্রস্তুত ছিলেন না। তা ছাড়া আমি হয়তো শিশুসুলভ অতি উৎসাহে আরবি-উর্দুতে মিলাদ পড়িবার প্রথার বিরুদ্ধে এমন সব কথা বলিয়া ফেলিয়াছিলাম, যার অর্থ শ্রোতারা বুঝিয়াছিলেন আমি আরবি-উর্দু ভাষা ও মিলাদ শরিফ পড়ার বিরুদ্ধেই কথা বলিতেছি। যা হোক সভায় আমার কথায় কেউ প্রতিবাদ করিলেন না। কিন্তু সভা শেষে দুইজন মুরুব্বি কেসেমের সুন্দর চেহারার লোক হলের বারান্দায় আমাকে বলিলেন : ওহে অ্যাডভোকেট অব বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ, ধর্মের বিষয়ে কথা বলিবার বয়স তোমার এখনও হয় নাই। আর কিছু না বলিয়া হাসিতে হাসিতে তাঁরা চলিয়া গেলেন। পরে জানিয়াছিলাম তিনি আমাকে এ কথাগুলি বলিয়াছিলেন, তিনি ছিলেন এ জিলার শ্রেষ্ঠ নেতা ও পাবলিক প্রসিকিউটর মৌলবী মোহাম্মদ ইসমাইল সাহেব ও তার সাথী বিখ্যাত উকিল মৌলবী আবদুল খালেক সাহেব। আমি তখন অ্যাডভোকেট শব্দটার মানে জানিতাম না। তবু ওঁরা যে আমাকে ভাল বলিলেন না, সেটা বুঝিলাম। মনটা খারাপ হইয়া গেল। রচনা পাঠ করিয়া এত প্রশংসা ও আনন্দ যে পাইয়াছিলাম, সে সবই মন হইতে ধুইয়া-মুছিয়া গেল। মেসের সুপারিনটেনডেন্ট স্কুলের হেড মৌলবী সাহেবও মুখ বেজার করিয়া রাখিলেন। সারা রাত দুর্ভাবনায় কাটাইলাম।
কিন্তু পরের দিন এর পুরস্কার পাইলাম। সেদিন জিলা স্কুলের মিলাদ। স্থান আঞ্জুমান মুসলিম হোস্টেল প্রাঙ্গণ। পরের স্কুলের অনুষ্ঠান বলিয়া একটু বিলম্বে মহফিলে পৌঁছিলাম। সভায় ঢুকিবার আগেই কয়েকজন বন্ধু হাসিতে হাসিতে আগাইয়া আসিয়া বলিল : আজ তোমারই দিন। তারপর বন্ধুরা সবিস্তারে যা বলিল তার সারমর্ম এই : মওলানা ফয়যুর রহমান বাংলায় মৌলুদ পড়িবার পক্ষে বক্তৃতা করিতেছেন। তার বক্তৃতার শুরুতেই তিনি বলিয়াছেন : গতকাল মৃত্যুঞ্জয় স্কুলের মিলাদ মহফিলে যাইতে পারেন নাই বলিয়া তিনি দুঃখিত। তিনি জানিতে পারিয়াছেন, সে মহফিলে একটি ছাত্র বাংলায় মিলাদ পড়িবার পক্ষে রচনা পাঠ করিয়াছে। তাতে কেউ-কেউ নাকি অসন্তুষ্ট হইয়াছেন। কিন্তু মওলানা সাহেবের মত এই যে ঐ ছেলে সত্য কথাই বলিয়াছে। সকলেরই বাংলায় মৌলুদ পড়া উচিৎ। বাংলা ছাড়া অন্য কোনও ভাষায় মৌলুদ পড়িলে মৌলুদের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইয়া যায়। বন্ধুরা বলিলেন, আমিও নিজ চক্ষে দেখিলাম, মওলানা সাহেব তখনও বক্তৃতা করিতেছেন। মওলানা সাহেবের প্রতি আমার শ্রদ্ধা বাড়িয়া গেল। আমি সভার এক কোণে বসিয়া পড়িলাম। তিনি প্রাঞ্জল অথচ ওজস্বিনী বাংলা ভাষায় পয়গম্বর সাহেবের জীবনের ঐতিহাসিক ঘটনাবলির শিক্ষা ও তাৎপর্য বুঝাইতেছেন। উর্দু ভাষায় সাধারণ মিলাদের কিতাবে পয়গম্বর সাহেবের পয়দায়েশ সম্বন্ধে যে সব অনৈসর্গিক আজাব কাহিনী লেখা হয়, মওলানা সাহেব তার দীর্ঘ বক্তৃতায় তার একটিও উল্লেখ করিলেন না। বরঞ্চ প্রকারান্তরে ওসবের নিন্দা করিলেন।
মওলানা ফয়যুর রহমান সাহেব আনন্দ মোহন কলেজের আরবি-ফারসির। প্রধান অধ্যাপক ছিলেন। কিন্তু সেটাই তার বড় পরিচয় নয়। তিনি সাধু সচ্চরিত্র স্পষ্টবাদী ও সুপণ্ডিত আলেম বলিয়া সুপরিচিত ছিলেন। হক পরস্তিতে তিনি খাতির-নাদার লোক ছিলেন। এমন লোকের সমর্থন পাইয়া আমার সম্মান বাড়িয়া গেল। আমি অতঃপর বুক ফুলাইয়া চলিতে লাগিলাম। অল্পদিনের মধ্যেই মওলানা সাহেবের সহিত পরিচিত হইয়া তাঁর দোওয়া নিয়াছিলাম। যদিও আনন্দ মোহন কলেজে, সুতরাং মওলানা সাহেবের খেদমতে, লেখাপড়া শিক্ষার সৌভাগ্য আমার হয় নাই, তবু মওলানা সাহেবকে শেষ পর্যন্ত উস্তাদের মতই ভক্তি করিতাম। তিনিও আমাকে নিজের ছাত্রের মতই স্নেহ করিতেন।
.
৭. ঢাকা দর্শন
এই সময় আমি অল্প দিন পর পর চাচাজীর সাথে দুইবার ঢাকা শহরে যাই। ঢাকা শহরকে তৎকালে আমি ও আমার মত অনেকেই কিসসা-কাহিনীর যাদুর শহর মনে করিতাম। পাড়াগাঁয়ে এই শহরকে বাউন্ন-বাজার-তিপান্ন গলির শহর’ বলা হইত। ঢাকার নবাবের বালাখানায় এবং শহরের রাস্তা ঘাট ও দোকান-পাটে ইসলামি জৌলুশ ফাটিয়া পড়িতেছে বলিয়া শুনিতাম। ঐ সব কথা শুনিয়া আলেফ-লায়লার বাগদাদ শহরই আমার চোখের সামনে ভাসিয়া উঠিত। কাজেই চাচাজী এই শহরে যাইতেছেন শুনিয়া আমিও তাঁর সাথে যাইব জিদ ধরিলাম। একবার উপলক্ষ ছিল ঢাকা ‘মকফাইট’ দেখা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের গোড়ার দিকে বৃটিশ সরকারের সামরিক শক্তি প্রদর্শনই এই মকফাইটের উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু ঐ বয়সে আমি অতশত বুঝিতাম না। একটা লড়াই হইবে, ‘নকল লড়াই’ আবার কী? এটাই বুঝিতাম। লড়াইয়ের নাম শুনিয়াই আমার রোমাঞ্চ হইত। মোহররমের কাড়া নাকাড়ার বাদ্যে আমার পায়ের তলায় সুড়সুড়ি হইত। লাকড়ি খেলায় কুর্দিয়া পরিবার বাসনা অতি কষ্টে দমন করিতাম। সুতরাং মকফাইট’ দেখিতে যাইবই। কারো নিষেধ মানিব না। দাদাজী অনুমতি দিলেন। চাচাজীও বাধা দিলেন না।
দ্বিতীয় বারে আমার যাওয়ার কোনও যুক্তি ছিল না। কারণ সেটা ছিল কী একটা মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্স। দেশের আলেম-ওলামা ও মাতব্বরদের দাওয়াত দেওয়া হইয়াছিল। আহসান মনজিল অর্থাৎ নবাববাড়ি হইতেই ওটা ডাকা হইয়াছিল। সমাগত ডেলিগেটদেরে আহসান। মনজিলে থাকা-খাওয়ার দাওয়াত করা হইয়াছিল। চাচাজীও দাওয়াত পাইয়াছিলেন। এবারও আমি তাঁর সঙ্গী হইলাম। আমার সঙ্গে আমার বড় ভাইও ঢাকায় যাওয়ার জিদ ধরিলেন। চাচাজী মুশকিলে পড়িলেন। ডেলিগেট ছাড়া আর কেউ আহসান মনজিলে থাকিতে পারিবেন না, আমাদের মত ছোট ছেলেদের ডেলিগেটও করা যাইবে না। কাজেই আমাদেরে লইয়া চাচাজীকে নিজের খরচে হোটেলে থাকিতে হইবে। তবু আমরা দুই ভাই চাচাজীর সঙ্গী হইলাম। খরচের ব্যাপার বলিয়া দাদাজীর অনুমতি লাগিল। বলা বাহুল্য, মকফাইট দেখার সময়েও আমরা দুই ভাই চাচাজীর সাথী হইয়াছিলাম। রমনা ময়দানে সৈন্যদের পায়তারা দেখিলাম। কামান-বন্দুকের আওয়াজ শুনিলাম। আসমানে ধোঁয়া উড়িতে দেখিলাম; আর, আর কী কী দেখিলাম সব মনে নাই। কিন্তু যাই দেখিয়া থাকি, তাতে লড়াই ছিল না। শহীদে-কারবালা, আমির হামযা ও জঙ্গনামা পড়িয়া লড়াই সম্পর্কে আমার যে ধারণা হইয়াছিল, তার কিছুই এখানে দেখিলাম না। নিরাশ হইয়াই বাড়ি ফিরিলাম।
এডুকেশন কনফারেন্সে আসিবার সময় ময়মনসিংহ হইতে আর যেসব ডেলিগেট একসঙ্গে আসিয়াছিলেন, তাঁদের মধ্যে যাকে চাচাজীর সঙ্গে খুব খাতির হইতে দেখিয়াছিলাম তিনি ছিলেন মওলানা খোন্দকার আহমদ আলী। আকালুবী। তার নাম বই-পুস্তকে ও খবরের কাগজে আগেই পড়িয়াছিলাম। এইবার নিজ চক্ষে তাঁকে সশরীরে দেখিয়া বড় আনন্দ পাইলাম। তিনি ছিলেন গৌরবর্ণের সুপুরুষ। গলার আওয়াজ বুলন্দ অথচ অতি মিষ্টি। আমি ট্রেনেই তার সঙ্গে খাতির জমাইবার বালকসুলভ চেষ্টা করিয়াছিলাম। তিনি আমাকে আদর করিয়াছিলেন। পরে ইনি আমাদের কৃষক-খাতক আন্দোলনের অন্যতম নেতা হন। আরো পরে তিনি আমার শ্বশুর হন।
ইহার অল্প কিছুদিন পরে আমার অতি প্রিয় দাদাজী ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুতে আমাদের সংসারে অভাব-অনটন দেখা দেয়। কারণ দাদাজীর ইন্তেকালের পরে-পরেই চাচাজী ও বাপজী এই সময় পৃথক হইয়া যান এবং সমস্ত সম্পত্তি আপসে বাটোয়ারা হইয়া যায়। চাচাজীর কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। মাত্র দুই মেয়ে। আর আমরা ছিলাম চার ভাই, এক বোন। সব আত্মীয়স্বজন ও আলেম-ওলামা মেহমানরা বড় ভাই বাপজীরই মেহমান হইতেন। ফলে পরিবারের বেশির ভাগ খরচের দায়িত্ব বাপজীর ঘাড়েই পড়িয়াছিল। তা ছাড়া বাপজীর উপর ছিল আমাদের চার ভাইয়ের লেখাপড়ার খরচ। ফলে অল্প দিনেই বাপজীর সংসারে অভাব দেখা দিল। কিন্তু বাপজী আমাদের গায় সে অভাব-অনটনের আঁচড়ও লাগিতে দেন নাই। নির্বিবাদে মৃত্যুঞ্জয় স্কুলের চার বছরের পড়া শেষ করিলাম। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিলাম। এটা ছিল ১৯১৭ সাল। দুই-দুইবার প্রশ্নপত্র লিক আউট হওয়ায় আমাদের তিন-তিনবার পরীক্ষা দিতে হইল। পাঁচ টাকার একটি মোহসিন স্কলারশিপসহ আমি প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করিলাম।
.
৮. নাম-নামা
ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফর্ম পূরণ করার সময় আমি অদ্ভুত ও নূতন একটা কাজ করিলাম। আমার নামের ঘরে লিখিলাম শুধু আহমদ। টিচারদের অনেকে এবং হেডমাস্টার বাবু স্বয়ং এই এক শব্দের নামে আপত্তি করিলেন। কিন্তু। আমার মত বদলাইতে পারেন নাই।
এই স্কুলের কাগজপত্রে এবং পূর্বেকার দুই স্কুলের কাগজপত্রেই আমার নাম আহমদ আলী ফরাযী। আমার পৈতৃক নামই আহমদ আলী। আমরা চার ভাই সকলেই ‘আলী। আমাদের নামে ‘আলী’ আসিল কোথা হইতে, তার জবাব দিয়াছিলেন দাদাজী। আগের কালে বাপ-মা মুরুব্বিরা আলেম ওলামাদের দ্বারা প্রভাবিত হইয়া ছেলেমেয়ের নাম রাখিতেন। মোজাহেদ আলেমদের মধ্যে এনায়েত আলী, বিলায়েত আলী, মাহমুদ আলী ও চেরাগ আলী এই চারটি নাম দাদাজীর খুব প্রিয় ছিল। ওদের নামের ‘আলী’ হইতেই তিনি আমাদের চার ভাইয়ের নামে ‘আলী’ আনিয়াছিলেন। দাদাজীরা তিন ভাই ছিলেন। সবাই উল্লা। বড় ভাই গাজী সাহেব ছিলেন আশেক উল্লা, মেজ আর উল্লা ও ছোট ভাই, আমার দাদা, আরমান উল্লা। আর উল্লা অবিবাহিত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। বাপজীরা ছিলেন তিন ভাই। বড় ভাই আমার পিতা আবদুর রহিম, দ্বিতীয় জমিরুদ্দিন ও তৃতীয় ছমিরুদ্দিন। দাদাজীর ইচ্ছা ছিল নিজের ছেলেদের নাম তার পিতা আছরদ্দিন ফরাযীর নাম। অনুসারে উদ্দিন রাখিবেন। কিন্তু তার শ্বশুর মানে বাপজীর নানা আবদুল আখন্দ সাহেব প্রথম নাতির নাম নিজের নামের আবদুল দিয়া রাখিবার আবদার করিলেন। দাদিও তার বাবার সমর্থন করিলেন। কাজেই বাপজীর নাম আবদুর রহিম হইল। কিন্তু পরবর্তী দুই ছেলের নাম দাদাজীর ইচ্ছামত উদ্দিন’ দিয়াই রাখা হইল। দ্বিতীয় পুত্র জমিরুদ্দিন অবিবাহিত মারা যান।
নাম-কাম লইয়া মানুষের জীবন। আমার কামটা এলা যেমন-তেমন, মানটার কিন্তু একটা সংগ্রামী ইতিহাস আছে। সে সংগ্রামেও জয়-পরাজয়, উত্থান-পতন, সহজ ভাষায় বাড়তি-কমতি আছে। সে সংগ্রামটা ঘটিয়াছিল আমার শৈশবে। সেদিন হইতে এটাকে এক শিশুর জীবনের ‘জঙ্গনামা’ ‘শাহনামা’ও বলা যাইতে পারে। তাই এই উপ-অধ্যায়ের নামকরণ করিলাম : ‘নাম-নামা’। সংগ্রামটি এইরূপ :
আমাদের চার সহোদরের মধ্যে বড় ভাই মোহাম্মদ মকিম আলী, মেজ ভাই মোহাম্মদ ইয়াসিন আলী, সেজ আমি আহমদ আলী ও ছোট ভাই মোহাম্মদ মোবারক আলী। চাচাজী আমাদের অপর তিনজনের সকলের নামের আগেই মোহাম্মদ লিখিতেন। শুধু আমার নামে আগে মোহাম্মদ লিখিতেন না। আমি এতে বেজার হইতাম। চাচাজী আমাকে তসল্লি দিতেন। তিনি বুঝাইতেন একই অর্থবাচক শব্দ বলিয়া আহমদের আগে মোহাম্মদ হয় না। চাচাজীর এ কথা আমি মানিতাম না। মনে মনে রাগ করিয়া আমি নিজেই পরে এই সমস্যার সমাধান করিয়াছিলাম। আমার আর তিন ভাই মোহাম্মদ লিখিতেন এবং আজও লেখেন। কিন্তু আমি শুধু আহমদ আলী লিখিতাম। ভাইদের মধ্যে আমি একাই উচ্চশিক্ষা পাইয়াছি। বড় ভাই ম্যাট্রিক পড়িয়া মাস্টারি করিতেন। মেজ ভাই হাফেজে কোরআন হইয়া মসজিদে-মকতবে পড়াইতেন। ছোট ভাই হোমিওপ্যাথি ডাক্তারি করিতেন। এই বই ছাপা হওয়ার সময় তারা কেউ আর বাঁচিয়া নাই।
নিজের নাম সম্পর্কে আমার মাথায় চিন্তা জাগে মাইনর স্কুলে। সেটা ১৯১০ কি ১৯১১ সাল। মি. স্টেপলটন ডিভিশনাল ইনসপেক্টর। তিনি আমাদের স্কুল পরিদর্শন করিতে আসেন। তিনি কোট-প্যান্ট-পরা ছয় ফুটের বেশি লম্বা সাদা সাহেব। তাকে দেখিয়া বিস্মিত হইলাম বটে কিন্তু খুশি হইলাম তার সাথে যে আলেমটি আসিলেন তাকে দেখিয়া। মাথায় পাগড়ি, মুখে দাড়ি, পরনে সাদা আচকান ও সাদা কলিদার পায়জামা। খৃষ্টান সাহেব অথচ সঙ্গে আলেম রাখেন। মনে মনে তিনি নিশ্চয়ই মুসলমান। সাহেবের উপরও খুশি হইলাম। কিন্তু সেকেন্ড পণ্ডিত খিদির উদ্দিন সাহেব আমাকে বলেন, ঐ লোকটা কোনও আলেম নয়, সে সাহেবের চাপরাশি। পণ্ডিত সাহেব ব্যাপারটা আমাকে বুঝাইবার জন্য চাপরাশির তকমা ও পেট্টি ও পাগড়ির মধ্যে একপ্রস্থ রঙিন কাপড় দেখাইয়া দিলেন।
এতে আমি স্টেপলটন সাহেবের উপর ব্যক্তিগতভাবে এবং ইংরাজ জাতির উপর সাধারণভাবে চটিয়া যাই। বেটা ইংরাজরা আমাদের বাদশাহি নিয়াও ছাড়ে নাই; আমাদের আরো অপমান করার মতলবেই আমাদের বাদশাহি পোশাক পাগড়ি-আচকান-পায়জামাকে ওরা চাপরাশির পোশাক বানাইয়াছে। ইহার প্রতিশোধ নিতেই হইবে। আমি তৎক্ষণাৎ ঠিক করিয়া ফেলিলাম, আমি বড় অফিসার হইয়া আচকান-পায়জামা-পাগড়ি পরিব এবং আমার চাপরাশিকে কোট-প্যান্ট পরাইব। চুপে-চুপে খোঁজখবর লইয়া জানিলাম, সরকারি কর্মচারী না হইলে চাপরাশি পাওয়া যায় না। সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে আবার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটই সবের উপরের অফিসার। অতএব আমি ঠিক করিলাম আমি ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট হইব। এটা আমি মানিয়া লইলাম যে ইংরাজের আমলে আমাকে খুব বড় জিলায় ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট করিবে না। কাজেই খুব ছোট জিলা লইয়াই আমাকে সন্তুষ্ট থাকিতে হইবে। আমাদের ক্লাসের পাঠ্য ভূগোল পাঠে পড়িয়াছি, বঙ্গ দেশে বগুড়া জিলাই সবচেয়ে ছোট জিলা। অতএব আমি বগুড়ার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট হইতে মনকে রাজি করিলাম। ক্লাসের একসারসাই বুকের শেষ পৃষ্ঠা (তখন পর্যন্ত আমার অভিজ্ঞতা এই যে স্কুলের লেখার কাজে খাতার শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত লাগে না) নিজের নাম দস্তখত করিয়া দেখিলাম ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটরূপে আমার নামটা মানায় কিনা। হেডমাস্টার বসন্ত বাবুর অনুকরণে খুব টানা ভাঙ্গা ইংরাজি হরফে লিখিলাম : আহমদ আলী ফরাযী, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, বগুড়া। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বানান ভুল না হয়, সে জন্য ডিকশনারি সামনে লইয়াই লিখিলাম। ইংরাজি অ্যাটলাস হইতে বগুড়া লিখার বানান জোগাড় করিয়াই বোগরা লিখিলাম। একবার লিখিয়া সন্তুষ্ট হইলাম না। স্কুলের সব মাস্টারদের হাতের লেখার অনুকরণে পৃথক পৃথক দস্তখত করিলাম। আশেপাশে কেউ নাই জানিয়া জোরে জোরে শব্দ কয়টা উচ্চারণ করিলাম।
ভাল শুনাইল না। নামটা কেমন ঢিলা-ঢিলা লাগিল। লেখাটাও দেখিতে সাহেব-সুবার দস্তখতের মত দেখাইল না। ভাবনায় পড়িলাম। শুধু নামটার জন্য ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটগিরি আটকাইয়া থাকিবে, এটা কিছুতেই সহ্য হইল না। কী করা যায়, ভাবিতে লাগিলাম। হঠাৎ মনে পড়িল অল্পদিন আগে খবরের কাগজে কী উপলক্ষে খান বাহাদুর মৌলবী আহম্মদ নামে একজন ডিপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের নাম ছাপা হইয়াছিল সেটা কয়েক বার উচ্চারণ করিয়া বুঝিলাম নামটা জোরদার। বেশ ভারী ভারী। এই ভার ও জোরটা কোন শব্দটার জন্য? খান বাহাদুর, না আহমদ? যে শব্দের জন্যই হোক, ঐ ভদ্রলোক ছিলেন ডিপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট হইলে আমি নিশ্চয়ই খান বাহাদুর হইব। তাতে আমার নাম আরো জোরদার, আরো ভারী হইবে। উচ্চারণ করিয়া দেখিলাম। হাঁ ভারী ত বটেই জোরদারও বটে। সুতরাং আমার নাম নূতন করিয়া লিখিলাম : খান বাহাদুর মৌলবী আহমদ, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বোগরা। এইবার উচ্চারণে জোর পাইলাম। নামটার মধ্যে একটা সাহেবি ভাব যেন ফুটিয়া উঠিল। বুক টান করিয়া চারদিক তাকাইলাম। মনটা তৃপ্তিতে ভরিয়া উঠিল। কিন্তু নাম হইতে আলী ও ফরাযী একদম ছাঁটিয়া ফেলায় প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হইল, কিন্তু ক্রমে সে ভাব দূর হইল। যতই উচ্চারণ করিতে লাগিলাম ততই জোরদার, মধুর ও ভারী-ভারিক্কি লাগিতে লাগিল। অতএব স্থির হইয়া গেল, খান বাহাদুর মৌলবী আহমদ নামেই আমি বগুড়ার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট হইব এবং আমার চাপরাশিকে কোট-প্যান্ট-হ্যাট পরাইয়া স্টেপলটন সাহেব ও সমস্ত ইংরাজ জাতিকে উপযুক্ত শিক্ষা দিব।
১৯১৭ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফর্ম ফিলআপ করার দিন হইতে সেটা পাঁচ-ছয় বছর আগের কথা। ইতিমধ্যে আমার ইংরাজ-বিদ্বেষ আরো বাড়িয়াছে। সেই সঙ্গে ইংরাজের চাকরির প্রতিও ঘৃণা জন্মিয়াছে। সুতরাং ইংরাজের গোলামির তকমা খান বাহাদুর খেতাব লইবার প্রশ্নই উঠিতে পারে না। খান বাহাদুর ছাড়া শুধু আহমদ নামে সেই জোর-ভার থাকে কি না, সে সম্পর্কে আমার মনে সন্দেহ জাগিল। দ্বিধায় পড়িলাম। কিন্তু এই সময় আমাদের ফারসি টিচার হেডমৌলবী মওলানা মুসা সাহেব কয়েক মাসের ছুটি নেওয়ায় তাঁর ছোট ভাই অ্যাক্টিং নিযুক্ত হন। শুনিয়া চমকিয়া উঠিলাম, তার নাম মওলানা আহমদ। আহমদ নামের গরিমাটা আমার অন্তরে ছ্যাঁৎ করিয়া উঠিল। সে আগুন নিভাইতে না নিভাইতেই আমাদের ষান্মাসিক পরীক্ষা আসিল। এই পরীক্ষায় নূতন মওলানা সাহেব ফারসি পেপারে আমাকে মোট একশ নম্বরের মধ্যে একশ পাঁচ দিলেন। হেডমাস্টার বাবু মওলানা সাহেবকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। তিনি নিরুদ্বেগে জবাব দিলেন : ছেলে সব প্রশ্নের ঠিক জবাব দেওয়ায় পুরা একশ দিয়াছি। সব প্রশ্নের জবাব দিতে পারায় খুশি হইয়া আমি পাঁচ নম্বর তাঁকে বখশিশ দিয়াছি।
মওলানা সাহেব হেডমাস্টার বাবুর মস্তক জয় করিতে পারেন নাই। কিন্তু আমার হৃদয় জয় করিতে পারিলেন। আমি নিজের নাম শুধু আহমদ লিখিতে পুনরায় উদ্বুদ্ধ হইলাম। কিন্তু অসুবিধা হইল যথেষ্ট। ইতিমধ্যে আমি কিছুটা সাহিত্যিক হইয়া উঠিয়াছি। ঐ সঙ্গে আমার নাম স্কুলের বাহিরে দিঘে-পাশে বাড়িয়া আবুল মনসুর আহমদ আলী জামী হইয়া গিয়াছে। কারণটা এই : তকালীন বিখ্যাত বক্তা মৌলবী ইসমাইল হোসেন সিরাজী সাহেবের লেখা আদব-কায়দা শিক্ষা নামে একখানা বই আমার খুব পছন্দ হইয়াছিল। এই পুস্তকে তিনি নিজের ‘সিরাজী তাখালুসের অনুকরণে সকল কবি সাহিত্যিককে নামের শেষে একটা তাখালুস ও নামের আগে একটা কুনিয়াত বসাইবার জন্য উপদেশ দিয়াছেন। এই সময় মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মৌলবী আবুল কাসেম ফজলুল হক খুব নামকরা লোক ছিলেন। সিরাজী সাহেবের উপদেশে এবং এই সব মহাপুরুষের অনুকরণে আমি আবুল মনসুর ও শামসুদ্দিন আবুল কালাম কুনিয়াত গ্রহণ করা স্থির করিলাম। এমনি একদিন কবি ছাবেদ আলী নসিরাবাদী নামক মওলানা খোন্দকার আহমদ আলী আকালুবী টাঙ্গাইলবাসী এক শাগরিদ তাঁর ‘ললনা বান্ধব’ নামে কবিতার বই ছাপিতে ময়মনসিংহ শহরে আসেন এবং ঘটনাচক্রে আমাদের মেহমান হন। ইনি শামসুদ্দিনের চেহারা সুন্দর বলিয়া তাঁকে নূরী (আলোকোজ্জ্বল) ও আমাকে খুব রসিকতা করিতে দেখিয়া জামী (রসাবতের পিয়াশাল) তাখালুস দান করেন। এই কুনিয়াত ও তাখালুসের পাখা মেলিয়া আমার বন্ধুমহলে ও মাসিক কাগজে যাহির হইলাম। আমার কয়েকটা প্রবন্ধ আল-ইসলাম নামক মাসিক কাগজে এই আবুল মনসুর আহমদ জামী নামে ছাপা হইয়া গেল।
সুতরাং ম্যাট্রিক ফরম পূরণ করিবার সময় একদিকে শুধু আহমদ নামের প্রতি নাড়ির টান ও অপর দিকে কুনিয়াত ও তাখালুসে টান আমাকে বেশ কিছু দিন টানা-হেঁচড়া করিল। শেষ পর্যন্ত মনে মনে একটা আপস করিয়া ফেলিলাম। বিদ্যালয়ের খাতায় আমি শুধু আহমদ হইয়া গেলাম। সাহিত্যের খাতায় থাকিলাম আবুল মনসুর আহমদ আলী জামী। ব্যাঙ বড় হইলে লেজ আপনি খসিয়া পড়ে। আমারও ‘আলী জামী’র লেজও কিছুদিন পরে খসিয়া পড়িল।