অধ্যায় বিশ – চতুর্থ পর্যায়
১. ‘ইত্তেহাদ’
আমার সাংবাদিক জীবনের চতুর্থ এবং শেষ পর্যায় শুরু হয় ১৯৪৭ সালের জানুয়ারিতে। বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব আমাকে সম্পাদক করিয়া একটি বাংলা দৈনিক বাহির করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। লিমিটেড কোম্পানি করিয়া আমার বিশেষ বিশ্বস্ত বন্ধু নবাবদা হাসান আলী চৌধুরীকে ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ও আমার অনুজ প্রতিম বন্ধু মি. ফারুকুল ইসলামকে সহকারী ম্যানেজিং ডাইরেক্টর করিতে শহীদ সাহেব রাজি হওয়ায় আমি সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে সম্মত হইলাম। আমি তখন কলিকাতা আলীপুরে উকালতি করি। ব্যবসাও ভাল জমিয়াছে। কাজেই সমস্ত অবস্থা বিবেচনা করিয়া শহীদ সাহেব বেতনে-ভাতায় আমাকে মোট এক হাজার টাকা মাহিয়ানা দিলেন। বিরাট ধুমধামে ইত্তেহাদ বাহির হইল। আমার গোটা সাংবাদিক জীবনের মধ্যে এইটাই আমার সবচেয়ে সুখ, আরাম ও মর্যাদার মুদ্দত ছিল। বরাবরের মত পূর্ণ সাংবাদিক স্বাধীনতা ত এখানে ছিলই, তার উপর ছিল অর্থ-চিন্তার অভাব এবং নবাবযাদা ও ফারুকুল ইসলামের সুষ্ঠু পরিচালনা।
.
২. আমার চরম সাফল্য
ইত্তেহাদ অল্পদিনেই খুব জনপ্রিয় হইয়া উঠে। ইহার প্রচারসংখ্যা অনেক। পুরাতন দৈনিকের দুই-তিন গুণ হইয়া যায়। জনপ্রিয় রাজনৈতিক মতবাদের সমর্থন, সু-সম্পাদন, সুন্দর ছাপা, কাগজ, সাইয, নিয়মিত প্রকাশ ও বিতরণ ইত্যাদি যে সব কারণে দৈনিক কাগজ জনপ্রিয় হইয়া থাকে, সে সব গুণ ইত্তেহাদ-এর ছিল। তবু ঐ সব গুণেই ইত্তেহাদ-এর জনপ্রিয়তা শেষ কথা ছিল না। আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় ইত্তেহাদ-এর জনপ্রিয়তার গূঢ় তত্ত্ব অন্যত্র নিহিত ছিল। এক কথায়, সেটা সাংবাদিক চেতনা। প্রায় পঁচিশ বছর সাংবাদিকতার সহিত সংশ্লিষ্ট থাকিয়া এবং এ সম্পর্কে বিদেশি বই-পুস্তক ও সংবাদপত্র পড়িয়া সাংবাদিকের দায়িত্ব সম্পর্কে আমার সামান্য যা কিছু জ্ঞান। লাভ হইয়াছিল, তার সবটুকু ইত্তেহাদএ প্রয়োগ করিবার চেষ্টা আমি করিয়াছিলাম। পরিচালকগণ সে সুযোগও আমাকে দিয়াছিলেন। আমার ঐ অভিজ্ঞতার ফলে আমি বুঝিয়াছিলাম :
(১) সাংবাদিকতা নিছক সংবাদ সরবরাহ নয়, সংবাদের সুষ্ঠু ব্যাখ্যাও বটে।
(২) সাংবাদিকতার সাথে রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রাজনীতিতে পার্টিগত শ্রেণীগত মতভেদ অপরিহার্য। কিন্তু এই মতভেদ সত্ত্বেও সাধু সাংবাদিকতা সম্ভব।
(৩) বিরুদ্ধ পক্ষকে অভদ্র কটুক্তি না করিয়াও তার তীব্র সমালোচনা করা যাইতে পারে ভদ্রভাষায়। বস্তুত সমালোচনার ভাষা যত বেশি ভদ্র হইবে, সমালোচনা তত তীক্ষ্ণ ও ফলবতী হইবে।
(৪) প্রত্যেক মতবাদের সুষ্ঠু, উদার, বৈজ্ঞানিক ও নিরপেক্ষ আলোচনার দ্বারা নিজের মতের পক্ষে এবং বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে জনমত তৈয়ার করা অধিকতর সহজসাধ্য।
(৫) মরহুম মৌলবী মুজিবর রহমান বলিতেন : সংবাদপত্রের কেবলমাত্র সম্পাদকীয় কলমটাই সম্পাদকের; বাকি সবটুকুই পাবলিকের। চিঠিপত্র কলমটা টাউন হল, সম্পাদকের বৈঠকখানা নয়। অতএব সংবাদ প্রকাশে নিরপেক্ষতা চাই। স্বয়ং সম্পাদকের নিন্দা-পূর্ণ পত্রও চিঠিপত্র কলমে ছাপিতে হইবে।
(৬) সাংবাদিকতা সাহিত্য, আর্ট, সায়েন্স, ইন্ডাস্ট্রি ও কমার্সের সমবায়। এর একটার অভাব হইলে সাংবাদিকতা ত্রুটিপূর্ণ এবং পরিণামে নিষ্ফল হইবে।
(৭) বিখ্যাত সাহিত্যিক থেচারে বলিয়াছেন : ছাপার মেশিনের মত সংবাদপত্র নিজেও একটা ইঞ্জিন। সকল যন্ত্রপাতির ঐক্য ও সংহতি অন্যান্য ইঞ্জিনের মত প্রেস ইঞ্জিনেরও অত্যাবশ্যক বটে, কিন্তু তার উপরেও প্রেস ইঞ্জিনে দরকার ইনটেলেকচুয়াল ইউনিটি।
এই সাতটি দফা ছিল বলিতে গেলে আমার জন্য সাংবাদিকতার ক, খ। কিন্তু আমার এইটুকু জ্ঞান লাভ করিতে-করিতে সাংবাদিকতা ঘোড়-দৌড়ে অনেক আগাইয়া গিয়াছিল। আমি পঁচিশ বছর আগে যখন সাংবাদিকতা শুরু করি, তখন সাংবাদিকতা ছিল একটা মিশন। প্রাইভেট স্কুল, হাসপাতাল চালাইবার মত একটা ব্যাপার। আর ১৯৪৭ সালে সাংবাদিকতা হইয়া উঠিয়াছিল একটি পূর্ণমাত্রার ইন্ডাস্ট্রি। এই সম্প্রসারণের ফলে সংবাদপত্র আর সম্পাদকের মন্তব্যসহ খবরের কাগজ মাত্র ছিল না। সাহিত্য শাখা, মহিলা শাখা, শিশু শাখা, সিনেমা শাখা, নগর পরিক্রমা ও খেলাধুলা ইত্যাদি বিভিন্ন ফিচার দিয়া আজকাল দৈনিক খবরের কাগজকে রীতিমত আকর্ষণীয় পঠিতব্য সাহিত্য করিয়া তোলা হইয়াছে। এই সমস্ত বিভাগ মোটামুটি অটনোমাস। সকল বিভাগের পৃথক-পৃথক সম্পাদক আছেন। কাজেই দৈনিক সংবাদপত্রের আর এখন একজন মাত্র সম্পাদক নাই, বহু-সংখ্যক সম্পাদক হইয়াছেন। ফলে কাগজের সম্পাদককে এখন আর শুধু সম্পাদক বলা চলে না। প্রধান সম্পাদক, এডিটর-ইন-চিফ অথবা চিফ এডিটার বলা হইয়া থাকে। এর ফলে আধুনিক দৈনিক খবরের কাগজের সম্পাদক কম-বেশি কনস্টিটিউশন্যাল মনার্কের মতই ফিগার-হেড মাত্র। সকর্মক দায়িত্ব তার সম্পাদকীয় লেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। দৈনিক খবরের কাগজের বিষয়-বস্তুর এই পরিব্যাপ্তি আমাদের দেশে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হইতেই শুরু হয়। কাজেই আমি যখন ইত্তেহাদএর সম্পাদকতা গ্রহণ করি, তখন আমাকেও ইহাই করিতে হইয়াছিল। এই উদ্দেশ্যে আমাকে বেশ খুঁজিয়া-পাতিয়া অজ্ঞাত মুসলিম ট্যালেন্ট বাহির করিতে হইয়াছে। একটু পরেই সে কথা বলিতেছি।
.
৩. মুসলিম সাংবাদিকতার অসুবিধা
আমি যে যুগে সাংবাদিকতা করিয়াছি, তখন মুসলমানের পক্ষে সাংবাদিকতা করা খুব দুরূহ ব্যাপার ছিল। বিশেষত বাংলার মুসলমানের সামনে জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতই সাংবাদিকতার ক্ষেত্রও অতি ক্ষুদ্র ছিল। সংবাদপত্র যতই ইন্ডাস্ট্রিতে রূপান্তরিত হইতে লাগিল, মুসলমানের পক্ষে উহা ততই কঠিন হইতে থাকিল। খুব স্বাভাবিক কারণেই মুসলমান যুবকদের হিন্দু সংবাদপত্রে কাজ পাওয়া একরূপ অসম্ভব ছিল। নিজস্ব দৈনিক কাগজ বাহির করার মত টাকাও মুসলমানের ছিল না। প্রধানত অর্থাভাবেই বহুকাল বহু মুসলিম নেতাদের এদিককার চেষ্টা ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে। আমার আমলেই মওলানা মো. আকরম খাঁ সাহেবের দৈনিক সেবক ও দৈনিক মোহাম্মদী ও মওলানা ইসলামাবাদী সাহেবের দৈনিক ছোলতান, স্যার এ কে গযনবীর দৈনিক তরক্কী, মৌ. এ কে ফজলুল হক সাহেবের দুই পর্যায়ের নবযুগ, অধ্যাপক হুমায়ুন কবিরের দৈনিক কৃষক প্রভৃতি বাংলা দৈনিক, স্যার আবদুর রহিমের মুসলিম স্ট্যান্ডার্ড মৌ. মুজিবর রহমান সাহেবের দৈনিক দি মুসলমান ও কমরেড প্রভৃতি ইংরাজি দৈনিক বাহির হইয়া বন্ধ হইয়াছে। এর ফলে একদিকে যেমন মুসলিম বাংলায় দৈনিক সংবাদপত্রের অভাব ছিল, ঠিক তেমনি সাংবাদিকেরও অভাব ছিল। আগেই বলিয়াছি, হিন্দু সংবাদপত্রে মুসলিম শিক্ষার্থীদের চান্স ছিল না। এটা আমি এত তীব্রভাবে অনুভব করিতাম যে যখনই সম্ভব ও সাধ্য হইয়াছে, তখনই ইহার প্রতিকার করিবার চেষ্টা করিয়াছি। বাছিয়া-বাছিয়া মুসলমান নিয়াছি। অধিকতর যোগ্য হিন্দু বাদ দিয়া অপেক্ষাকৃত অযোগ্য মুসলমানকে চাকুরি দিয়াছি। এতে হিন্দুর প্রতি আমার কোনও বিদ্বেষ ছিল না। শুধুমাত্র মুসলমান যুবকদের সাংবাদিকতায় উদ্বুদ্ধ করিবার জন্যই এ কাজ করিয়াছি। মুসলমানের প্রতি আমার এই পক্ষপাতিত্বের মধ্যে যে কোনও হিন্দু-বিদ্বেষ ছিল না, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই যে ইত্তেহাদ-এর সম্পাদকতা লিখার পূর্ব পর্যন্ত আমি ঘোরতর জাতীয়তাবাদী কংগ্রেসী ছিলাম। বাংলার হিন্দু ও মুসলিম মিলিয়া এক রাষ্ট্রীয় জাতি, এই মতে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলাম। তা ছাড়া আমার সম্পাদিত কৃষক ও নবযুগউভয়টাই ছিল বিঘোষিত নীতি ও মতবাদের দিক দিয়াও অসাম্প্ৰয়িক দৈনিক কাগজ। তবু ঐ দুটি কাগজের সম্পাদকীয় বিভাগে লোক নিয়োগ করিবার সময় আমি মুসলমান প্রার্থীকে প্রাধান্য দিয়াছি। ইহাতে আমার অনেক হিন্দু সাংবাদিক বন্ধু ও হিতৈষী আমার এই কাজে অসন্তোষ প্রকাশ করিয়াছেন। আমি সরলভাবে তাঁদের কাছে আমার উদ্দেশ্য বর্ণনা করিয়াছি। অনেক দূরদর্শী হিন্দু বন্ধু আমার কথা বুঝিয়াছেন। এইভাবে আমি যখনই ক্ষমতা ও সুযোগ পাইয়াছি, তখনই মুসলিম যুবদিগকে সাংবাদিকতায় উদ্বুদ্ধ করিবার চেষ্টা করিয়াছি, পরকেও এই কাজের উপদেশ একরূপ গায় পড়িয়াই দিয়াছি। দৃষ্টান্তস্বরূপ দৈনিক আজাদ-এর কথাই বলিতেছি। আজাদ-এর পরিচালকগণ তার সৃষ্টি হইতে ঢাকায় আসার পূর্ব-পর্যন্ত বার বছরকাল আজাদ-এর কপালে ছাপাইতেন মুসলিমবঙ্গ ও আসামের একমাত্র দৈনিক। এটা সুরুচির পরিচায়ক ছিল না। সে জন্য আমার মত অনেক সাংবাদিকও এতে অসন্তোষ প্রকাশ করিতেন। কিন্তু তলাইয়া বিচার করিলে বুঝা যাইবে, আজাদ-এর এই দাবি অংশত সত্য। কারণ তকালের সমস্ত বাংলা দৈনিকের মধ্যে একমাত্র আজাই আর্থিক দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। মুসলমান। পরিচালিত অন্যান্য দৈনিক টিকিয়া থাকিবে কিনা সে বিষয়ে তৎকালে স্বয়ং সাংবাদিকদেরই সন্দেহ ছিল। আজাদসম্বন্ধে সে সন্দেহ ছিল না। এই হিসাবে আজাদকে তকালের মুসলিম বাংলা ও আসামের একমাত্র ‘দৈনিক’ বলা যাইতে পারে। এই ধারণা হইতেই শুধুমাত্র চাকুরির সিকিউরিটির দিক বিবেচনা করিয়া মুসলিম সাংবাদিকরা সাধারণত অন্যান্য দৈনিকের চাকুরির চেয়ে আজাদ-এর চাকরি বেশি আকর্ষণীয় মনে করিতেন। ঠিক এই কারণেই মুসলমান সাংবাদিকদের উপর আজাদ পরিচালকের দায়িত্ব ছিল বেশি। আমি কৃষকও নবযুগ এবং পরে ইত্তেহাদ-এ শুধুমাত্র মুসলিম সাংবাদিক নিয়োগ করিবার সময় আজাদ কর্তৃপক্ষকেও এই অনুরোধ করিতাম। কিন্তু আজাদ এর পরিচালকরা আমার উপদেশে কর্ণপাত করিতেন না। তারা স্পষ্টই বলিতেন, তাঁদের নীতি অল্প বেতনে যোগ্য লোক নিয়োগ করা। হিন্দু শিক্ষিত বেকারের সুতরাং যোগ্য সাংবাদিকের সংখ্যা ছিল মুসলমানের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। ফলে স্বভাবতই অল্প বেতনে অনেক বেশি যোগ্য হিন্দু সাংবাদিক পাওয়া যাইত। আজাদ কর্তৃপক্ষ তাই করিতেন। ফলে তৎকালে আজাদ-এর স্টাফের শতকরা আশিজন ছিলেন হিন্দু। এটা আমাকে খুব পীড়া দিত। সরকারি চাকুরিতে মুসলিম অংশ দাবির উত্তরে যোগ্যতার যে জবাব হিন্দুরা দিতেন, আজাদ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষণ করিলে তাঁরা। খোলাখুলিই বলিতেন, সরকারের মত আর্থিক বুনিয়াদ যেদিন আজাদ এর হইবে, সেইদিনই তারা মুসলমানের কথা ভাবিবেন। বর্তমান অবস্থায় আজাদ টিকাইয়া রাখাই তাদের দায়িত্ব; মুসলমানদের সাংবাদিকতা শিখানোর পাঠশালা খোলা তাঁদের দায়িত্ব নয়।
.
৪. সমাজ-প্রাণতা বনাম বাস্তববাদিতা
কথাটা হয়ত ঠিক। এটাই ছিল বাস্তববাদী বুদ্ধিমান বিষয়ী লোকের কাজ। কিন্তু আমার মন তত্ত্বালে উহা গ্রহণ করে নাই। উহাদিগকে আমি তখন অপরিণামদর্শী সমাজ-প্রাণহীন স্বার্থপর লোক মনে করিতাম। এই স্বার্থপরতা জনসাধারণের মধ্যে দেখিলে তা সহ্য করা যায়। কিন্তু মুসলিম স্বার্থের কথায় যাদের মুখে খই ফুটে, তাদের মধ্যে এই বিষয়-বুদ্ধি’ এমন বেমানান যে আমি এতে শুধু অসন্তুষ্ট হইতাম না; দস্তুরমত চটিয়া যাইতাম। স্বদেশি আন্দোলনের সময় যখন বাংলার অনেক যুবক দেশের জন্য প্রাণ দিতেছিল; নেতারা বিলাতী কাপড়ের বদলে দেশি কাপড় পরিবার আবেদনে গলা ফাটাইতে ছিলেন, অসহযোগ আন্দোলনের সময় নেতারাই যখন বিলাতী লবণ বয়কট করিয়া দেশি লবণ, করকচ লবণ খাইবার আবেদন। করিতেছিলেন; তখনও দেশের জনসাধারণকে সস্তায় মিহিন পাড়ের পাকা। রং-এর যুক্তিতে বিলাতী কাপড়, এবং স্বাদ ও চেহারার যুক্তিতে বিলাতী লবণ কিনিতে দেখিয়াছি। অজ্ঞ জনসাধারণ বুঝে না বলিয়া তাদেরে ক্ষমাও করিয়াছি। কিন্তু কলিকাতার মুসলিম লীগের নেতাদিগকে যখন ওয়াছেন মোল্লা, এল মল্লিকের দোকানের বদলে ইস্টবেঙ্গল সোসাইটি হইতে এবং আমার নিজের জিলার লীগ নেতাদিগকে যখন ‘মৌলবীর দোকানে’র বদলে। ‘বঙ্গলক্ষ্মী বস্ত্রালয়’ হইতে সওদা কিনিতে দেখিতাম সস্তার যুক্তিতে, তখন আমার মেজাজ ঠিক থাকিত না। আমি যখন ঘোরতর কংগ্রেসী ছিলাম এবং খদ্দর ছাড়া কিছু পরিতাম না। তখনও খদ্দর কিনিতে বাজারে গিয়া প্রথমে পরিচিত মুসলিম দোকানে খদ্দর তালাশ করিতাম; না পাইলে খদ্দরের স্টক রাখিবার উপদেশ দিয়া আসিতাম এবং দু-চার দিন অপেক্ষা করিতাম। আমার বেশ মনে পড়ে তৎকালে কংগ্রেস-বিরোধী হিন্দু-বিদ্বেষী বহু মুসলিম বন্ধু আমাকে হিন্দুর গোলাম বলিয়া গাল দিতে-দিতে সস্তা ও ভেরাইটির অজুহাতে হিন্দু দোকানে ঢুকিয়া পড়িতেন।
এঁদেরেও হয়ত ক্ষমা করা যায়। কিন্তু মাঝে-মাঝে নয় প্রতিদিন যারা মুসলিম সমাজকে আত্মস্থ ও আত্মনির্ভরশীল হইতে উপদেশ দিতেছেন; অন্য সমাজের প্রভাব ও শোষণ-মুক্ত হইবার জন্য কর্মপন্থাও নির্দেশ করিতেছেন, তাঁরাও সস্তার যুক্তিতে মুসলমানের বদলে হিন্দু সাংবাদিকদিগকে চাকুরি দিবেন, এটা আমার বিবেচনায় ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ ছিল।
.
৫. ‘ইত্তেহাদ’-এর প্রয়াস
কাজেই যখন ইত্তেহাদএর স্টাফ নিয়োগের ক্ষমতা আমার হাতে আসিল, তখন ইহাকে আমি মুসলিম সাংবাদিক গোষ্ঠী গড়িয়া তুলিবার অপূর্ব সুযোগ মনে করিলাম। সে সুযোগের সাধ্যমত সদ্ব্যবহার করিলাম। সাংবাদিকতা-শিক্ষার্থী উচ্চ-শিক্ষিত যুবকরা দলে-দলে আসিয়া ভিড় করিল। কতকালের বুভুক্ষা লইয়া যেন তারা অপেক্ষা করিতেছিল। মুসলিম শিক্ষিত যুবকরা সাংবাদিকতা লাইনে আসিতে চায় না বলিয়া কোনও-কোনও কাগজের কর্তারা যে অভিযোগ করিতেছিলেন, মুসলিম যুবকদের বিরুদ্ধে ঐ অভিযোগ যে মিথ্যা এলাম এটা স্পষ্ট প্রমাণিত হইয়া গেল। আমি শুধু সম্পাদকীয় বিভাগে যে পঁচিশ ছাব্বিশজন লোক নিয়োগ করিলাম তার মধ্যে কুড়িজনই ছিলেন গ্র্যাজুয়েট, তাঁদের দশ-বারজন ছিলেন এমএ। সরকারি চাকুরির প্রতি মুসলমান যুবকদের টান বেশি, এই অভিযোগের উত্তরে বলিতে চাই যে, উপযুক্ত পঁচিশ-ছাব্বিশজনের মধ্যে চৌদ্দ-পনেরজনই ছিলেন সরকারি কর্মচারী। তারা সাংবাদিকতায় হাত পাকান সাপেক্ষে সরকারি চাকুরি করিয়া যাইতেছিলেন মাত্র। আমি ইত্তেহাদ-এ তাদের চাকুরি কনফার্ম করামাত্র অধিকাংশই সরকারি চাকুরিতে ইস্তাফা দিতে প্রস্তুত হইয়াই আসিয়াছিলেন। এই ব্যাপারে তাঁরা এতই দৃঢ় ছিলেন যে, মুসলমান সরকারি কর্মচারীরা ইত্তেহাদ-এর সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করিতেছেন বলিয়া কলিকাতার বিভিন্ন সংবাদপত্রে যখন আন্দোলন শুরু হয় এবং দৈনিক বসুমতী যখন তাদের নাম-ঠিকানা পর্যন্ত প্রকাশ করিয়া দেন, তখনও উহাদের অধিকাংশেই অবিচলিত থাকেন।
শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সুযোগ অন্যান্য শিল্প-মালিকদের মত সংবাদপত্রের কর্তারাও ষোল আনা গ্রহণ করিতেন। কাজেই সংবাদপত্রের স্টাফের বেতন ছিল অত্যন্ত কম। বেতনের অল্পতার জন্যই শিক্ষিত যুবকরা সহজে সাংবাদিকতার দিকে আকৃষ্ট হইত না। হিন্দু যুবকরা যে মুসলমান যুবকদের চেয়ে বেশি সংখ্যায় ঐ অল্প বেতনে চাকুরি করিতেছে, তা তারা ঐ অল্প বেতনে সন্তুষ্ট বলিয়া নয়, শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা হিন্দু সমাজে বেশি বলিয়া। কাজেই আমি ইত্তেহাদ এর স্টাফের এমন বেতনের সুপারিশ করিলাম, যা তাদের প্রয়োজনের মিনিমাম। এটা করিতে গিয়াও আমি প্রুফরিডারদের জন্য সর্বনিম্ন একশ এবং সাব-এডিটরদের জন্য সর্বনিম্ন সোওয়াশ বেতন ধার্য করিলাম। ম্যানেজারিয়াল ও কেরানির সর্বনিম্ন বেতন হইল প্রুফরিডারদের সমান। এই সমতা অনেক পুরাতন দৈনিক কাগজেই ছিল। অনেকেই পঞ্চাশ-ষাট টাকার প্রুফরিডারি ও সাব-এডিটারি করিতেছিলেন। অথবা যুদ্ধের পরিণামে মাংগা-বাজারের ফলে আফিস আদালতের পিয়ন-চাপরাশিরা পর্যন্ত এই সময় আশি টাকার বেশি পাইতেছিল।
.
৬. ‘ইত্তেহাদ’-এর জনপ্রিয়তার কারণ
অবস্থা-মাফিক সংগত পরিমাণ বেতন ধার্য হওয়ায় ইত্তেহাদ আফিসে গোড়া হইতেই প্রতিভাবান মুসলিম তরুণদের সমাবেশ হইল। এঁদের অতি অল্প সংখ্যকই অভিজ্ঞ ছিলেন, বাকি সকলে স্বভাবতই নূতন ছিলেন। ইঁহাদের ট্রেনিং দেওয়ার উদ্দেশ্যে জার্নালিযম সম্পর্কে আমি এক আলমারি বই কিনাইয়া ফেলিলাম। তার মধ্যে পিটম্যানের প্রকাশিত ম্যানস ফিল্ডের কমপ্লিট জার্নালিযম এন্ড সাব এডিটিং; চার্লস রিগবির দি স্টাফ জার্নালিস্ট; মি. এস. কারের মডার্ন জার্নালিয়ম; টি. এ. বিডের রিপোর্টার্স গাইড উই লিকাম স্টিডের দি প্রেস ইত্যাদি পুস্তক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আমি স্টাফের সহকর্মীদের ঐ সব বই-পুস্তক পড়িতে উৎসাহ দিতাম। ঠিকমত পড়িলেন কি না, তা পরখ করিতাম। ফলে দুই-তিন মাসের মধ্যে ইত্তেহাদ এর স্টাফের অধিকাংশ কর্মী শুধু হাতে-কলমে নয়, পুঁথিগত বিদ্যাতেও মোটামুটি ভাল সাংবাদিক হইয়া উঠিলেন। ফলে হেডলাইন, ডিসপ্লে, মেক আপ, গেট-আপ, টাইপ বিতরণ, প্রফ রিডিংয়ে অল্পদিনেই ইত্তেহাদ কলিকাতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও সুন্দর বাংলা দৈনিকে পরিণত হইল। মি. ওয়ালীউল্লাহ, মি. মোহাম্মদ মোদাব্বের, মি. জনাব আলী, মি. খোন্দকার ইলিয়াস, মি. কে. জি. মুস্তফা, মি. সিরাজুদ্দীন হোসেন, মি. রশীদ করীম প্রভৃতি বিখ্যাত সাংবাদিকরা সকলেই ইত্তেহাদ-এর বার্তা বিভাগের বিভিন্ন শাখার দায়িত্ব বহন করিয়াছেন। প্রথমে মিস হাযেরা খাতুন (পরবর্তীকালে মিসেস হাযেরা মাহমুদ) ও পরে মিস মরিয়ম খানম (পরে মিসেস হাশিমুদ্দীন) নামী দুইজন প্রতিভাবতী মহিলা গ্র্যাজুয়েট মহিলা শাখা সম্পাদন করায় মুসলিম মহিলাদের মধ্যে নবজীবনের সঞ্চার হইল। কবি আহসান হাবীব সাহিত্য শাখা, রুকনুযযামান খান ও মি. মোহাম্মদ নাসির আলী শিশু শাখা পরিচালনা করায় ঐ সব বিভাগ দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করিল। মি. কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস, মি. তালেবুর রহমান, মি. খোন্দকার আবদুল হামিদ, মি. যহুরুল হক, মি. কবি গোলাম কুদুস, মি. এ এম শাহাবুদ্দীন প্রভৃতি প্রতিভাবান লেখকগণের প্রথম তিনজন আগাগোড়া এবং শেষ তিনজন সাময়িকভাবে এ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর বা লিডার রাইটার ছিলেন। এতগুলি প্রতিভাশালী লেখকের লেখা হইলেও ইত্তেহাদ-এর সম্পাদকীয় প্রবন্ধগুলির মধ্যে সুরে-মতবাদে এমনকি ভাষায় একটা ঐক্য ছিল। তার কারণ এই যে আমি সকল এ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটরদেরে লইয়া সকালে আমার বাসায় কম-সে কম দুই ঘণ্টা বৈঠক করিতাম। চিফ এডিটরের বাড়িতে প্রতিদিন যাতায়াত করাটা যাতে এ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটরদের পক্ষে আর্থিক ক্ষতিকর না হয় সেই উদ্দেশ্যে আমি সকলের সম্মতিক্রমে আমার বাসায় উহাদের সকলের ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করিয়াছিলাম। এই ব্যবস্থা আমার উপরও দুর্বহ আর্থিক বোঝা ছিল না সম্পাদকের টেবিল খরচা’ বাবত আমাকে মাসে যে একশ টাকা এলাউন্স দেওয়া হইত, সে টাকা হইতে কিছু টাকা বাঁচাইয়া এই দিককার খরচা পোষাইয়া লইতে অথবা পাতলা করিতে পারিতাম। এই বৈঠকের উপকারিতা অল্পদিনেই সকলের কাছে সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল এবং কিছুদিনের মধ্যেই কলিকাতায় বড়-বড় দৈনিকের অনেকেই তাদের সম্পাদকীয় বিভাগে এই ব্যবস্থার প্রবর্তন করিলেন। এই বৈঠকে চা সিগারেট খাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ঐদিনকার সম্পাদকীয় লেখার বিষয়বস্তু লইয়া। আলোচনা চলিত। ইত্তেহাদ-এ নিয়মিতভাবে দুইটা সম্পাদকীয় ও চার পাঁচটা মন্তব্য থাকিত। সম্পাদকীয় মন্তব্যগুলির হেডিং ছিল ‘একনজর। এগুলি আমি নিজে লিখিতাম। সম্পাদকীয়গুলি সকলে ভাগ করিয়া নিতাম। সপ্তাহের সাত দিনে চৌদ্দটা সম্পাদকীয় যাইত। চৌদ্দটা সম্পাদকীয় পাঁচজনের মধ্যে ভাগ করিলে গড়ে প্রতি সপ্তাহে এক-একজনের তিনটা করিয়া প্রবন্ধ লিখিতে হইত। এটা ছিল সাধারণ নিয়ম। বিষয়-বস্তু-ভেদে এ ব্যবস্থার ব্যতিক্রম হইত। বিষয়-বস্তুর বৈশিষ্ট্য না থাকিলে ব্যক্তিগত সুবিধার খাতিরে একজনেরটা অপরজনও গছিয়া নিতে পারিতেন। কিন্তু সেটা ছিল নিতান্তই ব্যতিক্রম। সাধারণত প্রাতঃকালীন বৈঠকে বিষয়-বস্তু ও তাদের বিভিন্ন পয়েন্টসমূহ ঠিক হইয়া যাইত। যার উপর লেখার ভার পড়িত, তিনি সে সব পয়েন্টস নোট করিয়া নিতেন। তারপর তাদের সুবিধামত হয় বাসায় অথবা আফিসে বসিয়া সম্পাদকীয় লিখিয়া আমার টেবিলে রাখিয়া দিতেন। আমি নিজে বাসায় বসিয়া ‘একনজর’ ও আমার ভাগে সম্পাদকীয় লেখার ভার পড়িয়া থাকিলে তা লেখা শেষ করিয়া সন্ধ্যার দিকে অথবা সান্ধ্য-ভ্রমণ শেষ করিয়া আটটার দিকে আফিসে যাইতাম। যার উপর যেদিন লেখার দায়িত্ব পড়িত না, সেদিন তিনি আফিসে যাইতে বাধ্য ছিলেন না। আর যাদের উপর লেখার ভার পড়িত, তারাও তাদের লেখা আমার টেবিলে রাখিয়া আফিস ত্যাগ করিতে পারিতেন। কিন্তু সাধারণত তারা আফিস ত্যাগ করিতেন না। আমি তাদের লেখা ‘পাশ করিয়া না দেওয়া পর্যন্ত তাঁরা আফিসে থাকিতেন। আমি তাদের লেখা ‘পাশ করিয়া প্রেসে দিবার জন্য তাদেরই টেবিলে ফেরত পাঠাইতাম। এতে তারা তাদের ভুল-ত্রুটি বা আমার সাথে তাঁদের মতভেদ ধরিতে পারিতেন। আমার ঐসব সহকর্মী এতে অতি অল্পদিনেই এমন পাকা হইয়া গেলেন যে, অতঃপর সকাল বেলার আলোচনাই যথেষ্ট হইত। তাঁদের লেখায় আমার কলম ধরিবার কোনও প্রয়োজনই হইত না। এঁদের অনেকে আমার মতবাদ প্রকাশ-ভঙ্গির ভাষা ও যুক্তি-তর্কের ধারা এমন রফত করিয়া ফেলিলেন যে, উচ্চ-শিক্ষিত সাহিত্যিক ও বৃদ্ধা পাঠকদেরও অনেকে তাদের লেখাকে আমার লেখা বলিয়া ভুল করিতেন। আমার হাজার প্রতিবাদেও তারা মত বদলাইতেন না। মনে করিতেন ও বলিতেন, আমার সহকর্মীদের ইজজত বাড়াইবার জন্যই আমি ঐ ভদ্রতা করিতেছি।
.
৭. ‘পাঠকের মজলিস’
সাধারণভাবে সংবাদপত্র ও তাদের পাঠকদের মধ্যে এবং বিশেষভাবে ইত্তেহাদ-এর লেখক-গোষ্ঠী ও পাঠকদের মধ্যে একটা চিন্তাগত আত্মীয়তা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে আমি ইত্তেহাদএ পাঠকের মজলিস’ নামে একটা ফিচার খুলি। এই ধরনের ফিচার সংবাদপত্র-জগতে এটাই প্রথম। এটা প্রচলিত সম্পাদকের নামে চিঠিপত্র কলাম নয়। লেখার বিষয়-বস্তু, মর্যাদা ও বলার ভঙ্গি সকল দিক দিয়াই চিঠিপত্রের ও মজলিসের মধ্যে পার্থক্য ছিল। এই পার্থক্য সম্বন্ধে পাঠকগণকে সচেতন করিবার জন্য ইত্তেহাদএর চিঠিপত্র কলামও যথারীতি যথাস্থানে বজায় রাখা হইয়াছিল। পাঠকের মজলিস’ ছিল পাঠকদের ডিবেটিং ক্লাব। এতে পাঠকরা সম্পাদকের দায়িত্ব ও অধিকার লইয়া কথা বলিতে পারিতেন। এতে বুদ্ধিমান পাঠকরা অল্পদিনেই এমন অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছিলেন যে, বড়-বড় জটিল, গুরুতর, তর্কিত ও এখতেলাফী বিষয়েও সংক্ষেপে সুন্দর আলোচনা করিতেন। এইসব আলোচনার অনেকগুলি এত সুন্দর ও মূল্যবান হইত যে, আমাদের সম্পাদকীয়ের চেয়েও ভাল হইয়া যাইত। মরহুম মৌলবী মুজিবর রহমান সম্পাদকীয় কলম ছাড়া খবরের কাগজের বাকি সবটুকু অংশকে টাউন হল মনে করিবার যে উপদেশ দিতেন, সেই উপদেশ কার্যে পরিণত করিবার উদ্দেশ্যেই আমি ‘পাঠকের মজলিস’ খুলিয়াছিলাম। এই মজলিসে স্বাধীন মত প্রকাশ করিবার সম্পূর্ণ নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পাঠকদের ছিল। পাঠকরা ওতে স্বয়ং সম্পাদকের লেখার ও মতের সমালোচনা ও প্রতিবাদ করিতে পারিতেন। এতে একদিকে যেমন পাঠকদের মধ্যে লেখক ও সম্পাদক হওয়ার সুপ্ত প্রেরণা জাগ্রত হইত, অপর দিকে তেমনি সকল মত ও দলের নিকট ইত্তেহাদ-এর নিরপেক্ষতা সুস্পষ্ট হইয়া উঠিত। ফলে পাঠকরা ইত্তেহাদকে শুধু নিরপেক্ষ সুবিচারী কাগজই মনে করিতেন না, ইহাকে তাদের নিজের কাগজ মনে করিতেন। এইভাবে এক বছর পুরা হইবার বহু আগেই ইত্তেহাদ আফিস বাংলার মুসলিম তরুণ চিন্তানায়কদের পীঠস্থানে এবং ইত্তেহাদ মুসলিম-বাংলার প্রগতিবাদীদের মুখপত্রে পরিণত হইল।
.
৮. পশ্চিমবঙ্গ-সরকারের উদারতা
ইতিমধ্যে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত বাটোয়ারা হইয়া পাকিস্তানের জন্ম হইল। বাংলা ভাগ হইল। কলিকাতা পশ্চিম বাংলার ভাগে পড়িল। ঢাকা পূর্ব বাংলার রাজধানী হইল। ফলে স্বভাবতই মুসলিম-বাংলার সরকারি বেসরকারি শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মেজরিটি আস্তে-আস্তে কলিকাতা ছাড়িয়া ঢাকায় আসিতে লাগিলেন। এমতাবস্থায় কলিকাতাস্থ পাকিস্তান-সমর্থক সমস্ত সংবাদপত্রের কলিকাতা ছাড়িয়া ঢাকায় চলিয়া আসা খুবই স্বাভাবিক ও বাঞ্ছনীয় ছিল। কিন্তু বাস্তব অসুবিধাহেতু কোনো কাগজই আমরা কলিকাতা ত্যাগ করিলাম না। ভারতের বুকে বসিয়া পাকিস্তানের সংবাদপত্র চালাইয়া যাইতে লাগিলাম। পশ্চিম বাংলা ও ভারত সরকারের অসাধারণ কৃতিত্ব ও মহত্ত্ব এই যে, তারা সমস্ত মুসলিম সংবাদপত্রকে অবাধে বিনা-অসুবিধায় চলিতে দিলেন। পশ্চিম বাংলা সরকার ও ভারত সরকারের এই উদারতা, মহত্ত্ব ও সহনশীলতার কথা মুসলিম বাংলার সাংবাদিকরা চিরকাল কৃতজ্ঞতার সহিত স্মরণ রাখিবেন। এটা অতি স্পষ্ট কথা যে, দেশ ভাগ হওয়ার বহু আগে হইতেই মুসলিম সংবাদপত্রসমূহের লেখা হিন্দুদের বিরক্তি ক্রোধের উদ্রেক করিয়াছিল। দেশ ভাগ হওয়ার পর সম্পত্তি ও দায়-দেনার বাঁটোয়ারা লইয়া এই বিরক্তি ও ক্রোধে অধিকতর ইন্ধন ঢালা হইতেছিল। এক উত্তপ্ত পরিবেশে কলিকাতায় থাকিয়া সার্বিক কন্ট্রোলের ব্যবস্থার পশ্চিম বাংলার ভাগের নিউযপ্রিন্ট ব্যবহার করিয়া পশ্চিম বাংলা ও ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে ও পাকিস্তানের পক্ষে কঠোর ভাষায় গলাবাজি করিতে দেওয়া কম উদারতা ও সহনশীলতার পরিচায়ক নয়। এসব লিখিতে গবর্নমেন্ট আমাদের কোনও বাধা-নিষেধ ত দেনই নাই; বরঞ্চ বেসরকারি স্তরের কেউ আমাদের কাজে প্রতিবন্ধকতা করিবার চেষ্টা করিলে সরকার দৃঢ়হস্তে তা দমন করিয়াছেন। একটা দৃষ্টান্ত দিলেই বুঝা যাইবে। দেশ বাটোয়ারা ঘোষণা হওয়ার অব্যবহিত পরেই দেশের বিভিন্ন অংশে হিন্দু-মুসলমানে অমানুষিক হত্যাকাণ্ড শুরু হয়। কলিকাতায়ই হয় বেশি। পুনঃপুন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উভয় পক্ষেই আক্রমণকারী হইলেও পাকিস্তানোত্তর কলিকাতার দাঙ্গায় স্বভাবতই হিন্দুরাই ছিল আক্রমণকারী। কাজেই মহাত্মা গান্ধী সাম্প্রদায়িক শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে স্বয়ং কলিকাতা আসেন এবং জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ দাঙ্গা পীড়িত এলাকায় অবস্থান অনশন করিতে থাকেন। এই সময় একদিন এক উন্মত্ত হিন্দু জনতা দৈনিক আজাদ আফিস আক্রমণ করে। ফলে একদিন আজাদ বাহির হইতে পারে নাই। আমরা প্রায় পঁচিশটি দৈনিক কাগজের সম্পাদকরা অমৃতবাজার-এর চিত্তরঞ্জন এভিনিউস্থ সিটি আফিসে সভা করিয়া এই গুণ্ডামির প্রতিবাদ করি; সরকারের নিকট প্রতিকার দাবি করি; জনসাধারণের সদিচ্ছার আবেদন জানাইয়া সংবাদপত্রে বিবৃতি দেই। এই সভায় পঁচিশজন সম্পাদকের মধ্যে আমরা মাত্র তিনজন ছিলাম মুসলমান। একমাত্র স্টেটসম্যান-এর সম্পাদক মি. আয়ান স্টিফেন ছাড়া আর সবাই। ছিলেন হিন্দু। এ সম্পর্কে জনসাধারণের নিকট আবেদন করিয়া যে বিবৃতি দেওয়া হইয়াছিল, তাতে মুসলমান ছিলাম আমি একা। শ্রীযুক্ত তুষার কান্তি ঘোষ, শ্রীযুক্ত সত্যেন্দ্র নাথ মজুমদার, শ্রীযুক্ত চপলাকান্ত ভট্টাচার্য, মি. সোমনাথ লাহিড়ী ও মি. স্টিফেন প্রভৃতি সবাই ছিলেন অমুসলমান। পশ্চিম বাংলা সরকার এমন ক্ষিপ্রতার ও দৃঢ়তার সঙ্গে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করিলেন যে, পরদিনই বিনা-বাধায় আজাদ প্রকাশিত হইল।
পশ্চিম বাংলার প্রধানমন্ত্রী ডা. প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ স্বাধীনতা লাভের চার পাঁচ মাসের মধ্যেই ১৯৪৮ সালের ১৫ জানুয়ারি পদত্যাগ করায় আমরা মুসলমানরা বিশেষত মুসলিম সাংবাদিকরা বেশ সন্ত্রস্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম। কিন্তু ডা. বিধান চন্দ্র রায় অতঃপর ২০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন। ডা. রায়, ডা. ঘোষের উদার নীতি অনুসরণ করিয়া চলিলেন। মুসলমানদের মধ্যে সাহস সৃষ্টির জন্য তিনি আমার এবং কলিকাতা ও হাওড়া শহরের অন্যান্য অনেক মুসলিম নেতার সক্রিয় সহযোগিতা চাহিলেন। আমি নিজে মুসলিম-প্রধান এলাকাসমূহে সভা করিলাম। মন্ত্রিসভার উদার নীতির অনুসরণ করিয়া হিন্দু রাষ্ট্র-নেতা, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকরাও আমাদের সাথে বন্ধুত্বসূচক উদার ব্যবহার ও আমাদের যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে লাগিলেন। পাক-ভারতের সম্পর্ক সম্বন্ধে মূলনীতি নির্ধারণের আলোচনা সভাতেও সম্পাদক হিসাবে এবং সাংবাদিক ও সাহিত্যিক হিসাবে সাংবাদিক ও সাহিত্যিকদিগকে নিমন্ত্রণ করিতে থাকিলেন। এই সমস্ত ঘটনার দুইটির উল্লেখ করা দরকার মনে করি। পশ্চিম বাংলা সরকার নিয়োজিত পরিভাষা কমিটির রিপোর্ট আলোচনায় আমাকে নিমন্ত্রণ করা হইয়াছিল এবং আমার। মতামত রিপোর্টের বিরোধীও হইয়াছিল। সে কথা অন্যত্র উল্লেখ করিয়াছি। অপর ঘটনাটি এই : মহাত্মাজীর হত্যার পর পশ্চিম বাংলা সরকারের প্রচার দফতরের উদ্যোগে মন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেনের সম্পাদনায় মহাত্মাজী সম্পর্কে একটি পুস্তক প্রকাশিত হয়। এতে বাংলার বিখ্যাত চৌদ্দ-পনেরজন। সাহিত্যিক-সাংবাদিকের লেখা ছাপা হয়। আমারও একটি লেখা তাতে ছিল। আমার চিন্তায়ও মহাত্মাজীর প্রভাব ছিল অসাধারণ। কাজেই তার প্রতি আমার ভক্তি-শ্রদ্ধা একটু বিশেষ ধরনের। এমন মহাত্মার হত্যায় আমি একরূপ ক্ষিপ্ত হইয়া গিয়াছিলাম। এমন সময় পশ্চিম বাংলার সরকার মহাত্মাজীর হত্যা সম্পর্কে লেখা চাওয়ায় আমি সাগ্রহে লেখা দিলাম। লেখাটা ইত্তেহাদ-এর সম্পাদকীয়ের চেয়ে অনেক কড়া হইল। এ প্রবন্ধে কঠোর ভাষায় আমি যা লিখিয়াছিলাম, তার সারমর্ম এই : রোগের গুরুত্ব দিয়া চিকিৎসকের কৃতিত্ব বুঝা যায়। চিকিৎসকের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়াও তেমনি রোগের কঠিনতা বুঝা যায়। ছোট রোগে কেউ বড় ডাক্তার ডাকে না। ভারতীয় হিন্দুরা যে চরম দুশ্চিকিৎস্য ব্যাধিগ্রস্ত জাতি, তা প্রমাণিত হইল মহাত্মাজীর হত্যায়। যে গান্ধী আফ্রিকার গভীর অরণ্যে খালি পায়ে, খালি গায়ে ঘুরিলেও তাকে সাপে-বাঘে মারিত না, তেমন মহাপুরুষকে হত্যা করিবার মত আততায়ী পাওয়া গেল হিন্দু সমাজে। এতে প্রমাণিত হইল, এই জাতি বন্য পশুর চেয়েও হিংস্র ও নিকৃষ্ট। এই হিন্দু জাতিকে ব্যাধি-মুক্ত করিবার জন্য আল্লাহ যে চিকিৎসক পাঠাইয়াছেন তিনি যে সত্য-সত্যই মহাত্মা আজ তা নিঃসন্দেহ রূপে প্রমাণিত হইল। লেখাটা পাঠাইয়া চিন্তা করিতেছিলাম, ওটা ছাপা হইলেও হয়ত বইয়ের শেষ দিকে স্থান পাইবে। কিন্তু বই যখন আসিল, তখন দেখিলাম আমার লেখা প্রথম দিকেই সম্মানজনক স্থান পাইয়াছে। এই পুস্তক বাজারে প্রচারিত হওয়ার পর স্বয়ং প্রফুল্ল বাবুসহ অনেক পরিচিত-অপরিচিত হিন্দু ভদ্রলোক মুখে ও টেলিফোনে আমাকে কংগ্রেচুলেট করিয়া ছিলেন। পাকিস্তানে বসিয়া মুসলমানকে অমন গাল দিলে মহাত্মাজীর পিছনে-পিছনেই আমাকেও পরলোকগামী হইতে হইত। ভারতে তা হইল না দেখিয়া বুঝিলাম, হিন্দু সমাজ নীচ বটে কিন্তু সে নীচতা বুঝিবার মত উচ্চতাও তাদের আছে।
সরকার যতই উদার ও সহিষ্ণু হউন না কেন, হিন্দু জনসাধারণ অমন উত্তপ্ত পরিবেশে উদার ও সহিষ্ণু থাকিতে পারে না, আজাদ-এর উক্ত ঘটনার পর হইতে আমরা সকলেই সে বিষয়ে সচেতন হইলাম। বিশেষত আমরা মুসলিম সাংবাদিকরা এটা বুঝিলাম, আমরা আসলে পশ্চিম-বাংলা সরকারের অতিথিমাত্র। কাজেই সেই আতিথেয়তার অপব্যবহার করা আমাদের উচিৎ নয়। হিন্দুস্থানের বুকে বসিয়া আমরা পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলিয়া হিন্দু জনসাধারণকে ক্ষেপাইব, আর সেই ক্ষিপ্ত জনতার আক্রমণ হইতে আমাদিগকে রক্ষা করা হিন্দুস্থানি সরকারের ও পুলিশের পবিত্র দায়িত্ব বলিয়া দাবি করিব, এই মনোভাবকে কিছুতেই উৎসাহ দেওয়া যায় না। এমনিতেই নয়া স্বাধীন দেশের সকল সমস্যা তাদের মিটাইতে হইতেছে। দেশ ভাগ হওয়ার সাথে-সাথেই নেতাদের নিষেধ সত্ত্বেও লোকেরা লাখে-লাখে। দেশত্যাগ শুরু করিয়াছে। ফলে পাকিস্তানি সরকারের ন্যায় হিন্দুস্তানি সরকারও বাস্তুত্যাগী পুনর্বাসনের বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হইয়াছেন। এই সমস্ত সমস্যার ‘বোঝার উপর শাকের আঁটি স্বরূপ নূতন কোনও সমস্যায় হিন্দুস্তানি সরকারকে ভারাক্রান্ত করা কিছুতেই উচিৎ হইবে না।
.
৯. ‘ইত্তেহাদ’-এর অপমৃত্যু
কাজেই আমরা মুসলিম সংবাদপত্রেরা সকলেই কাল-বিলম্ব না করিয়া ঢাকায় আসিবার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগিলাম। কিন্তু পূর্ব বাংলার মন্ত্রিসভার নিকট আমরা ইত্তেহাদ ওয়ালার কোনও অভ্যর্থনা বা সহানুভূতি পাইলাম না। সহানুভূতি বা অভ্যর্থনা আমরা আশাও করি নাই। কারণ ইত্তেহাদ সোহরাওয়ার্দী-সমর্থক কাগজ হিসাবে নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভায় বিরোধীদলের সংবাদপত্র ছিল। কাজেই আমরা তাদের কোন বিশেষ অনুগ্রহ চাই নাই। শুধু সরকারের মামুলি দায়িত্ব পালনই আশা করিয়াছিলাম। কিন্তু পূর্ব বাংলার মন্ত্রিসভা আমাদের জবাব দিলেন ইত্তেহাদএর পূর্ব বাংলা প্রবেশ নিষিদ্ধ। করিয়া। প্রথমবারের নিষেধাজ্ঞা অবশ্য মাত্র পনের দিন স্থায়ী হইয়াছিল। কিন্তু এটাই সবেমাত্ৰ-আত্মপ্রতিষ্ঠ ইত্তেহাদ-এর আর্থিক মেরুদণ্ডে বিশাল আঁকি লাগাইয়াছিল। কারণ ইত্তেহাদ-এর বিপুল সাকুলেশনের, সুতরাং এই বাবত আয়ের, চৌদ্দ আনাই ছিল পূর্ব বাংলার। এই আঘাত সামলাইয়া উঠিতে-না উঠিতেই আরো দুই-দুইবার ইত্তেহাদএর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হইল। এই দুইবারই দীর্ঘদিনের জন্য এবং শেষবারের অনির্দিষ্টকালের জন্য ইত্তেহাদ-এর পূর্ব বাংলা প্রবেশ নিষিদ্ধ হইয়াছিল। এই মুদ্দতে ইত্তেহাদ-এর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর নবাবযাদা সৈয়দ হাসান আলী নিজে একাধিকবার ঢাকা আসিয়া ইত্তেহাদ-এর জন্য বাড়ি ভাড়া করিয়া ও তাতে প্রয়োজনীয় মেরামত করিয়া প্রচুর অর্থব্যয়ও করিয়াছিলেন। কিন্তু পূর্ব বাংলা সরকার তাঁর কাজে পদে-পদে বাধা সৃষ্টি করিয়া বিশেষত বিজলি সংস্থাপনের অসহযোগিতা করিয়া নবাবযাদার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করিয়া দেন।
এইভাবে ১৯৫০ সালের গোড়ার দিকে ইত্তেহাদ-এর অপমৃত্যু ঘটে। কিন্তু এটাও সত্য যে, দেশভাগ হওয়ার পরে ভারতের ভূখণ্ড হইতে পাকিস্তানি খবরের কাগজ বাহির হওয়ার কোনও যুক্তিও ছিল না।
.
১০. কলামিস্ট মাত্র
ইত্তেহাদএর মৃত্যুর পর আমারও সাংবাদিক জীবনের অবসান ঘটে। ১৯৫০ সাল হইতে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত চব্বিশ বছর ইংরাজি-বাংলা কাগজের কলামিস্ট হইয়া থাকাতেই আমার সাংবাদিকতা সীমাবদ্ধ ছিল। এটা ঘটে অবস্থাগতিকেই! পরিবার রক্ষার জন্য উকালতি ও পাকিস্তান রক্ষার জন্য রাজনীতি ধরিতে হইল। পেশায় ব্যস্ত উকিল ও রাজনীতিতে মেম্বর-মন্ত্রী হইলাম। জেল-যুলুমও খাঁটিতে হইল। এত ব্যস্ততায় সাহিত্য-সাধনা বিশেষ ব্যাহত হইল না সত্য, কিন্তু সাংবাদিকতায় কলামিস্টের বেশি কিছু হওয়া গেল না।
ঢাকার সম্পাদক-সাংবাদিকদের অধিকাংশই আমার কলিকাতার সাংবাদিক-জীবনের বয়ঃকনিষ্ঠ স্নেহাস্পদ সহকর্মী। হাজার ব্যস্ততার অজুহাতেও তাঁদের উপরোধ এড়ান গেল না। কলামিস্ট হইতে হইল। প্রথম বার বছরে ঢাকার প্রায় সব বাংলা দৈনিক-সাময়িকীর অন্তত বিশেষ সংখ্যায় গল্প-উপন্যাস-রম্যরচনা লিখিলাম অনেক। পরবর্তী বার বছরে ইংরাজি-বাংলা উভয় ভাষার কাগজেই লিখিলাম। এই মুদ্দতে একাধিক কারণে আমি সক্রিয় রাজনীতি থনে অবসর নিলাম। ফলে দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বে উদারতা ও নিরপেক্ষতা লইয়া রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক তর্কিত সমস্যা-ভিত্তিক নিবন্ধ লিখিতে-পারিলাম প্রচুর।
এইসব গল্প-উপন্যাস-রস রচনার প্রায় সবগুলিই প্রকাশকদের আগ্রহে জনপ্রিয় বই আকারে বাহির ত হইলই এমনকি ইংরাজি-বাংলা প্রবন্ধ নিবন্ধগুলির অনেকগুলিও পুস্তকাকারে প্রকাশিত হইল।
কলামিস্ট হওয়াতেই বোধ হয় এতগুলি পুস্তকের মেটিরিয়াল স্বতই তৈয়ার হইয়া গিয়াছে। সম্পাদক-সাংবাদিক থাকিলে এটা নাও হইতে পারে।