১৮. দ্বিতীয় পর্যায় ‘দৈনিক কৃষক’

অধ্যায় আঠার – দ্বিতীয় পর্যায়

১. ‘দৈনিক কৃষক’

আমার সাংবাদিক জীবনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বর মাসে। এই সময় নিখিল-বঙ্গ-কৃষক-প্রজা সমিতির উদ্যোগে কৃষক প্রজা আন্দোলনের মুখপত্ররূপে দৈনিক কৃষক প্রকাশ করা সাব্যস্ত হয়। অধ্যাপক হুমায়ুন কবিরকে ম্যানেজিং ডাইরেক্টর এবং মৌ. শামসুদ্দীন আহমদ, মৌ. সৈয়দ নওশের আলী, নবাবযাদা সৈয়দ হাসান আলী, খান বাহাদুর মোহাম্মদ জান ও ডা. আর আহমদকে ডাইরেক্টর করিয়া একটি লিমিটেড কোম্পানি। রেজিস্ট্রারি হয়। আমাকে উহার প্রধান সম্পাদক নিয়োগ করাও তাঁরাই স্থির করেন। ডালহৌসি স্কোয়ারের নিকটবর্তী ৫ নং ম্যাংগো লেনে আফিস স্থাপিত হয়। নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এত সব ঠিক করিয়া আমাকে হুকুম দেওয়া হয় সম্পাদক হও, চালাও কাগজ। সমিতির প্রস্তাব। বন্ধুদের অনুরোধ নয়, আদেশ। অমান্য করিতে পারিলাম না। পারিলাম না মানে কী? করিলাম না। নিজের মনেও বোধ হয় কুকুতানি ছিল। মাসিক দুইশ টাকা বেতন ও পঞ্চাশ টাকা সম্পাদক-এর টেবিল এলাউন্স পাওয়ার শর্তে আমি কৃষক-এর সম্পাদকতার দায়িত্ব গ্রহণ করিলাম। খাঁটিলাম খুব। অল্পদিনেই কাগজ সাংবাদিক মহলে সম্মান ও জনসাধারণের মধ্যে পপুলারিটি অর্জন। করিল। আদর্শ নিষ্ঠায় স্বাধীন মতবাদে এবং নিরপেক্ষ সমালোচনায় কৃষক বেশ নাম করিল।

কিছুদিন যাওয়ার পর আমি জানিতে পারিলাম তঙ্কালীন কংগ্রেস সভাপতি শ্রীযুক্ত সুভাষচন্দ্র বসু কৃষক-এর একজন পৃষ্ঠপোষক। আমি এতে বরঞ্চ খুশিই হইলাম। কংগ্রেসের অনেক মত ও কর্মপন্থার সাথে আমার মিল না থাকিলেও সুভাষবাবুকে আমি ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা করিতাম। কৃষক শ্রমিকদের প্রতি তাঁর দরদ, কৃষক-প্রজা আন্দোলনের প্রতি তার সমর্থন ও সাম্প্রদায়িক প্রশ্নে তার উদারতা সবই আমার জানা ছিল। কাজেই সুভাষবাবুর মত একজন মুরুব্বি পাওয়ায় কৃষক-এর আর্থিক ও বাণিজ্যিক দিকে অনেকখানি সাহায্য হইবে, ইহা আমি মনে করিলাম। কৃষক-প্রজা সমিতির আদর্শের সাথে সংগতি রাখিয়া কংগ্রেসি রাজনীতিতে ও সুভাষবাবুকে পূর্ণ সমর্থন দিলাম। মহাত্মা গান্ধীর সহিত সুভাষবাবুর বিরোধ ও ত্রিপুরী কংগ্রেসের হট্টগোল আমরা প্রকাশ্যভাবে সুভাষবাবুর পক্ষ অবলম্বন করিলাম। কলিকাতার হিন্দুদের মধ্যে কৃষক বেশ পপুলার হইল।

.

. কৃষক’-এর অর্থাভাব

গেল এমনি করিয়া বছর খানেক। হঠাৎ হুমায়ুন কবির সাহেব জানাইলেন আর চলে না। অর্থাভাব। আলোচনা করিয়া বুঝিলাম, দৈনিক চালাইবার মত যথেষ্ট মূলধন না লইয়াই এঁরা কাগজ প্রকাশে হাত দিয়াছিলেন। দৈনিক কাগজ চালান যে আগের মত মিশনারি ওয়ার্ক নয়, ইতিমধ্যে সংবাদপত্র যে একটা ইন্ডাস্ট্রি হইয়া উঠিয়াছে, এতে যে অন্যান্য শিল্পের মতই মোটা টাকা মূলধন লাগে পরিচালকরা এ খবর রাখিতেন না। দোষ তাদের নয়। কারণ তাঁরা কেউ সাংবাদিক নন, যদিও হুমায়ুন কবির সাহেব সাংবাদিকতার সাথে কিছু কিছু পরিচিত ছিলেন। কাজেই তাদের দোষ দেওয়া যায় না। পক্ষান্তরে আমারও দোষ নাই। কারণ আমার সাথে আর্থিক ব্যাপারে বা পরিচালনা সম্বন্ধে কোনও পরামর্শ করা হয় নাই। সম্পাদকের সাথে এ ব্যাপারে পরামর্শ করিবার কথাও নয়। আর করিলেই যে আমি খুব নির্ভরযোগ্য উপদেশ বা অর্থ সংগ্রহে সাহায্য করিতে পারিতাম, তা-ও নয়। ডাইরেক্টর বোর্ডের মেম্বরদের তুলনায় আমার কি দাম আছে? তাঁরা সব কলিকাতার বাসেন্দা, আমি মফস্বলের লোক। তারা সব আইনসভার মেম্বর, ভূতপূর্ব বা হবু মন্ত্রী। টাকাওয়ালা লোকদের সাথে পরিচয়ও আমার তেমন ছিল না। অতএব টাকা-পয়সার ব্যাপারে তাঁরা আমাকে কিছু না জানাইয়া অন্যায় কিছু করেন নাই।

কিন্তু কৃষক বাঁচাইয়া রাখার ইচ্ছা ও উৎকণ্ঠা পরিচালক বোর্ড ও আমার নিজের সমান। কৃষক প্রজা পার্টি হইতে নিজস্ব দৈনিক বাহির করার চেষ্টা এই প্রথম। এটা ব্যর্থ হইলে কৃষক-প্রজা-নেতৃত্ব এবং আন্দোলন একটা মার খাইবে। জনপ্রিয় কৃষক-প্রজা-নেতা প্রধানমন্ত্রী হক সাহেবের সহিত আদর্শগত বিরোধ হওয়ায় এবং তার ফলে হক মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব দিয়া পরাজিত হওয়ায় ইতিপূর্বে কৃষক-প্রজা-নেতৃত্ব একটা মার খাইয়াছে। তার পরপরই এটা হইলে আরো বিপদ। কৃষক-প্রজা নেতাদের দুশ্চিন্তা এইখানে। এই চিন্তায় আমিও শরিক।

.

. ব্যক্তিগত বিপদ

আর একটা দুশ্চিন্তা আমার ব্যক্তিগত। আমি দশ বছরের জমানো উকালতি ব্যবসাটা ছাড়িয়া সপরিবারে কলিকাতার বাসেন্দা হইয়াছি। আসিবার সময় শুধু হাতের মামলা-মোকদ্দমাগুলি নয় বই-পুস্তক, সাজ-সরঞ্জাম, টেবিল চেয়ার, মায় গাউনটা পর্যন্ত বন্ধুবান্ধবের মধ্যে বিতরণ করিয়া আসিয়াছি। অর্থাৎ যাকে বলে ‘পিছনে নৌকা তলাইয়া দিয়া সামনে অগ্রসর হওয়া’, আমি তাই করিয়াছি। সুতরাং ফিরিবার উপায় নাই। নিজের অস্তিত্বের জন্যও কৃষককে বাঁচাইয়া রাখিতে হইবে। পরিচালকদের সকলেই আমার হিতৈষী বন্ধু। তারাও আমার ব্যক্তিগত মঙ্গল-অমঙ্গল ও সুবিধা-অসুবিধায় সম্পূর্ণ সচেতন।

এইসব কারণে কৃষক-এর অর্থাভাব দূরীকরণের জন্য আমিও পরিচালকদের সাথে সক্রিয় সহযোগিতা করিতে লাগিলাম। এতদিন আমি কাগজের সম্পাদনা কার্যের উন্নতির চিন্তায় সময় ব্যয় করিতাম। এখন হইতে উহার আর্থিক দিকটাতেও জড়াইয়া পড়িলাম। কাজটা কঠিন। সম্পাদকরা লেখক-ভাবুক। শিল্পী। টাকা-পয়সার ঝামেলার মত বৈষয়িক ও ব্যবসায়িক ব্যাপার তাদের চোখে নিতান্ত অশিল্পী দোকানদারি ব্যাপার। কাজেই নিম্নশ্রেণির বিষয়। এতদিন ছিল আমার এই ধারণা। এখন বুঝিলাম অশিল্পী অসুন্দর হইলেও এই ব্যবসায়ী দিকটাই আসল। এতদিনে বুঝিলাম, মৌলবী মুজিবর রহমান সাহেবকে একাধারে সম্পাদকতা ও অর্থ সংগ্রহ করিতে কী ঝামেলা পোহাইতে হইত।

বিপদই মানুষের বড় শিক্ষক। কৃষক-এর সম্পাদকতা করিতে গিয়া আমি সংবাদপত্র, সাংবাদিকতা, সংবাদ-শিল্পী ও সংবাদ-বাণিজ্য সকল দিকে নজর দিতে বাধ্য হইয়াছিলাম। শুধু প্রধান সম্পাদকের আসনে বসিয়া থাকিলে আমার চলিত না। ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের সঙ্গে যেমন চাদা আদায়ে, বিজ্ঞাপন ক্যানভাসিং-এ ঘুরিয়া বেড়াইতে হইত, তেমনি ছাপাখানার আধ-অন্ধকার চিশিলা গরমের মধ্যে কম্পোযিটার, মেশিনম্যানের কাঁধের কাছে দাঁড়াইয়া কাজে তাকিদ দিতে হইত। এটা করিতে গিয়া একদিকে যেমন পরিচালকদের আর্থিক অভাবের কথা জানিলাম। অপর দিকে বেচারা কম্পোযিটারদের শারীরিক অসুবিধার কথাও জানিলাম। কম্পোযিটাররা অন্ধকার সংকীর্ণ ও আলো-বাতাসহীন কুঠরিতে বসিয়া দিনরাত শিসা হাতাইয়া কীভাবে শরীর, স্বাস্থ্য ও চোখ নষ্ট করিতেছে, তা দেখিয়া শিহরিয়া উঠিলাম। আমাদের অভাব মিটিলে এদের জন্যও কিছু একটা করিব অন্তত দু-চারটা ফ্যানের ব্যবস্থা করিব মনে-মনে প্রতিজ্ঞা করিলাম।

.

. অর্থাভাবের সংগত কারণ

কিন্তু টাকা কোথায়? কে দিবে টাকা কৃষককে? খবরের কাগজের টাকা মানে বিজ্ঞাপনের আয়। কাগজ বিক্রির টাকায় কাগজ-কালির দামটা উঠে মাত্র। বিজ্ঞাপনের টাকা দিয়াই স্টাফ চালাইতে হয়। লাভও থাকে। কিন্তু কৃষক বিজ্ঞাপন পাইবে কেন? বিজ্ঞাপনদাতারা বড়-বড় ধনিক-বণিক শিল্প মালিক। কৃষক কৃষক-শ্রমিক আন্দোলনের সমর্থক। জমিদারি শিল্প-বাণিজ্য সমস্ত কায়েমি স্বার্থ জাতীয়করণ করিতে চায়। এই কৃষককে বিজ্ঞাপন দিয়া তারা শত্রু পুষিবে? হিন্দুরা বিজ্ঞাপন দেয় না কৃষক মুসলমান বলিয়া, মুসলমানরা দেয় না কৃষক হিন্দু-কংগ্রেস’, ঘেঁষা বলিয়া। বিপদের উপর বিপদ। কৃষক-প্রজা দলের একমাত্র মন্ত্রী মৌ. শামসুদ্দীন আহমদ সমিতির নির্দেশে মন্ত্রিসভা হইতে পদত্যাগ করিয়াছেন। মন্ত্রিত্বের প্রভাব খাটাইয়া কিছু বিজ্ঞাপন ও অর্থ সাহায্য পাইব, সে আশায় ছাই পড়িয়াছে। সুভাষবাবুর সাহায্যে হিন্দু ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের কিছু কিছু বিজ্ঞাপন পাইব, সে গুড়ে বালি পড়ে। সুভাষবাবু মহাত্মাজীর সাথে ঝগড়া করিয়া কংগ্রেসের সভাপতিত্ব ত্যাগ করিয়াছেন। ধনিক-বণিকরা আসলে সকাজে চাদা দেয় না, তারা ভবিষ্যৎ মুনাফার আশায় টাকা খাটায়, ইনভেস্ট করে। অদূরে কংগ্রেস রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করিবে, এটা সকলের কাছেই সুস্পষ্ট। সেজন্য সরকারের বিরোধিতা সত্ত্বেও ধনিকরা তলে-তলে কংগ্রেসকে। সাহায্য করিত। সুভাষবাবু প্রেসিডেন্ট থাকিলে তার ‘ছিটাফোঁটা’ কৃষকও পাইত। সে আশাও গেল। শেষ পর্যন্ত সুভাষবাবু দেশ ত্যাগ করিলে এদিককার কোনও আশাই আর থাকিল না।

.

. খান বাহাদুর মোহাম্মদ জান

এ অবস্থায় অধ্যাপক হুমায়ুন কবির দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করিয়াও কিছু করিতে পারিলেন না। পরিচালক বোর্ডের মধ্যে একমাত্র ধনী ব্যবসায়ী খান বাহাদুর মোহাম্মদ জানের উপর ম্যানেজিং ডাইরেক্টরির ভার চাপান হয়। খান বাহাদুর সাহেব ভাল মানুষ। টাকাও তাঁর আছে। কিন্তু তিনি অবাঙ্গালী। বাংলা জানেন না। কৃষক পড়িতে পারেন না। তিনি কৃষক-শ্রমিক আন্দোলন পছন্দ করেন না। তিনি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সমর্থন করেন না বলিয়া আইনসভায় কৃষক প্রজা পার্টি ও কংগ্রেস পার্টিকে সমর্থন করে। এমন লোকের পক্ষে কৃষকের পরিচালনার এবং মাসে-মাসে দুই-তিন হাজার টাকা লস দেওয়ার উৎসাহ বেশি দিন স্থায়ী হইতে পারে না। কাজেই মাস চার-পাঁচেক পরে তিনি দায়িত্ব বহনে অস্বীকৃতি জানাইলেন।

. মি. এইচ দত্ত

এর পরে ম্যানেজিং ডাইরেক্টর হইলেন কলিকাতা কমার্শিয়াল ব্যাংকের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ও অন্যান্য অনেক কোম্পানি পরিচালক মি. হেমেন্দ্র নাথ দত্ত। মি. দত্তের বাড়ি ময়মনসিংহ। ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়াই ব্যস্ত থাকেন বটে তবে অসাম্প্রদায়িক সুস্থ রাজনীতির তিনি উৎসাহী সমর্থক। তিনি ধর্ম বিশ্বাসে ব্রাহ্ম বলিয়া সাধারণ হিন্দুর মত সংকীর্ণ নন। মুসলমানদের প্রতি তিনি খুবই উদার। এইসব কারণেই কংগ্রেসের চেয়ে কৃষক প্রজা পার্টির তিনি বেশি সমর্থক ছিলেন। এ ছাড়া অধ্যাপক হুমায়ুন কবিরের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতাও ছিল। সুভাষবাবু দেশত্যাগের আগেই মি. দত্তকে কৃষক-এর একজন শেয়ার হোল্ডার করিয়া দিয়াছিলেন। কাজেই তাকে কৃষক-এর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর করিতে কোনোই অসুবিধা হইল না। অন্যতম সুপরিচিত কৃষক নেতা ময়মনসিংহবাসী জনাব আবদুর রশিদ খাঁ এ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজিং ডাইরেক্টর রূপে সমস্ত কাজ পরিচালনা করায় এবং দত্ত সাহেব খুব কমই আফিসে আসায় এই পরিবর্তনের কথা বড় কেউ জানিতেও পারিল না। মোটামুটি স্বচ্ছন্দেই কৃষক চলিতে লাগিল। অপেক্ষাকৃত উন্নত ধরনের আফিস করার উদ্দেশ্যে মি. দত্ত কৃষক আফিস ম্যাংগো লেন হইতে ক্রীক রোডে স্থানান্তরিত করিলেন। পরিচালনা স্থান সংকুলান ও পরিবেশ সকল দিক দিয়াই ইহাতে কৃষক-এর উন্নতি হইল। আমি কম্পোযিটারদের জন্য ফ্যানের ব্যবস্থা করিলাম। বড়-বড় লাভের কাগজ সচরাচর ঐ সময় তা করে নাই। আমার কাজকে তারা বিদ্রূপ করিয়াছে।

.

. নীতিগত বিরোধ

কিন্তু এ সুখ আমাদের বেশিদিন স্থায়ী হইল না। ঐ সময় হক মন্ত্রিসভার প্রস্তাবিত মাধ্যমিক শিক্ষা বিল লইয়া খুবই বাদ-বিতণ্ডা চলিতেছিল। এই বিলের বিধান অনুসারে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার কর্তৃত্ব কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতছাড়া হইয়া যাইবে বলিয়া হিন্দু শিক্ষিত সমাজের প্রায় সকলেই ইহার বিরুদ্ধতা করিতেছিলেন। হিন্দু সংবাদপত্রেরাও সমস্বরে ইহার প্রতিবাদ করিতেছিলেন। কংগ্রেস পার্টি ও আইন সভার ভিতরে বাহিরে এই বিলের বিরুদ্ধে জনমত গড়িতেছিল। এমন সময় কৃষক-এর সম্পাদকীয়তে এই বিলের সমর্থন করা হইল। মি. দত্ত এই সর্বপ্রথম সম্পাদকের দায়িত্বে হস্তক্ষেপ করিলেন। আফিসে আসিয়া আমার রুমে বসিয়া আমার লেখার প্রতিবাদ করিলেন। তিনি বলিলেন যে সম্পাদকীয় ব্যাপারে নাক ঢুকাইবার তার মোটেই ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু এই ব্যাপারে না করিয়া পারিলেন না। কারণ আমি একটা সাম্প্রদায়িক বিল সমর্থন করিয়া কষক-এর মূলনীতি লঙ্ঘন করিতেছি। আমি যুক্তিতর্ক ও তথ্যাদি দিয়া বুঝাইবার চেষ্টা করিলাম যে প্রস্তাবিত বিলটা সাম্প্রদায়িক নয়, হিন্দুদের বিরুদ্ধতাটাই সাম্প্রদায়িক। তিনি আমার যুক্তি মানিলেন না। আমিও তারটা মানিলাম না। ঐ ব্যাপারে পরপর আরো কয়টা সম্পাদকীয় লিখিলাম। তিনি বোর্ডের মিটিং ডাকিয়া আমার বিরুদ্ধে নালিশ করিলেন। বোর্ডের মেম্বাররা। স্বভাবতই আমারই সমর্থন করিলেন। মি. দত্ত পদত্যাগের হুমকি দিলেন। কৃষক-এর জীবনে আবার ক্রাইসিস।

অবস্থা শেষ পর্যন্ত এই দাঁড়াইল যে আমি এডিটর থাকিলে মি. দত্ত ম্যানেজিং ডাইরেক্টর থাকিবেন না। তিনি ম্যানেজিং ডাইরেক্টর না থাকিলে কৃষক চলিবে না। কাজেই কৃষক বাঁচাইয়া রাখিতে হইলে আমারই পদত্যাগ করিতে হয়। কিন্তু পরিচালক বোর্ডের মেম্বাররা তা মনে করিলেন না। তাঁরা দেখিলেন আমার অবর্তমানে কৃষকচলিবে না। তার মানে এই নয় যে আমার মত যোগ্য সম্পাদক আর নাই; আমাকে ছাড়া কাগজ চলিবে না। তারা দেখিলেন যে ইস্যুতে বিরোধ তাতে মি. দত্তকে মানিয়া নিলে কৃষক বাঁচিয়া থাকিলেও মুসলমানের কাগজ থাকিবে না। কিন্তু আমি অন্য দিক দেখিলাম। কৃষক বন্ধ হইলে শতাধিক মুসলিম যুবক বেকার হইবে। কৃষক-এর সম্পাদকীয় বিভাগের কম-বেশি পঁয়ত্রিশ জনের সকলেই মুসলমান। ম্যানেজিং বিভাগের চৌদ্দ-পনের জনের দুইজন বাদে সবই মুসলমান। কম্পোযিং বিভাগের পঞ্চাশজনের মধ্যে সকলেই মুসলমান। ইহাদের সকলকেই আমি নিযুক্ত করিয়াছি। কৃষক বন্ধ হইলে একযোগে এতগুলি লোকের চাকরি যাইবে। এঁরা সকলে আমারই দিকে তাকাইয়া আছেন। তাঁরা আমাকে আন্তরিক ভালও বাসিয়া থাকেন। কারণ সারা কলিকাতার সংবাদপত্র জগতে আমিই সর্বপ্রথম কম্পোষ সেকশনে ‘ফ্যান’ দিবার ব্যবস্থা করিয়াছিলাম। ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে বলিয়াছিলাম, যত দিন কম্পোযিটরদেরে ফ্যান দেওয়া না হইবে, ততদিন সম্পাদকের রুমে ফ্যানের দরকার নাই। আমার এই কাজে কলিকাতার কম্পোযিটার শ্রেণীর মধ্যে আমার খুব নাম ছিল। কাজেই একযোগে এতগুলি লোকের বেকারির সম্ভাবনায় আমি কাতর হইলাম। আমার নিজের চাকরির জন্য এতগুলি লোককে বেকার করা আমার বিবেকে কিছুতেই বরদাশত হইল না।

.

. ‘কৃষক’ ত্যাগ

পক্ষান্তরে আমি যদি সম্পাদকতা ছাড়িয়া দেই তবে দত্ত সাহেব কৃষক চালাইবেন। স্টাফের কাউকে তিনি ছাড়াইবেন না। কারণ কাগজের পলিসির সাথে তাদের কোনও সম্পর্ক নাই। দত্ত সাহেব স্পষ্টভাবেই প্রতিশ্রুতি দিলেন। কাজেই আমি পদত্যাগ করিতেই রাজি হইলাম। দত্ত সাহেব ডিরেক্টর বোর্ডের জরুরি সভা ডাকিলেন। সেখানে আমার বক্তব্য পেশ করিয়া পদত্যাগ করিলাম। আমাকে ধন্যবাদ দিয়া পদত্যাগপত্র গৃহীত হইল।

অতঃপর কৃষক চলিতে থাকিল। কিন্তু দুই-এক দিনের মধ্যেই সব ডাইরেক্টর পদত্যাগ করিলেন। কৃষক কার্যত দত্ত সাহেবের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হইয়া গেল। কৃষক-প্রজা সমিতির দুয়েকজন প্রভাবশালী সদস্য এবং আমার কোনও কোনও সাংবাদিক বন্ধু আমাকে বলিলেন : আমি ভুল করিয়াছি। দত্ত সাহেবের হাতে কৃষক তুলিয়া না দিয়া উহা বন্ধ করিয়াই বাহির হওয়া উচিৎ ছিল। কারণ মুসলমানদের প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্র এইভাবে পুঁজিবাদী হিন্দুর হাতে তুলিয়া দিয়া আমি মুসলমান সমাজের শত্রুতাই সাধন করিয়াছি। মুসলমানের শ্রম ও ঘর্মে অস্ত্র তৈয়ার করিয়া তাতে শাণ দিয়া আমি মুসলমানের গলা কাটিবার জন্য হিন্দুর হাতে তুলিয়া দিয়া আসিয়াছি। ব্যাপারটা অত সাংঘাতিক এ বিষয়ে আমি ঐ সব বন্ধুর সাথে একমত হইতে পারি নাই।

.

. সাংবাদিকতায় নূতন জ্ঞান

কারণ প্রায় তিন বছর কাল কৃষক–এর সম্পাদকতা করিয়া আমি দুইটা নূতন জ্ঞান লাভ করিয়াছিলাম। (১) সংবাদপত্র পরিচালন একটা ইন্ডাস্ট্রি; এতে প্রচুর মূলধন লাগে; কাজেই ধনী ছাড়া কেউ নূতন কাগজ বাহির করিয়া সফল হইবে না। মুদির দোকান চালাইতে চালাইতে বড় সওদাগর ও শিল্পপতি হওয়ার দিন যেমন আর নাই, সাপ্তাহিক চালাইতে চালাইতে দৈনিক করার দিনও তেমনি আর নাই। (২) ধনতন্ত্রী সমাজের অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রিতে যেমন সংবাদপত্র-শিল্পও তেমনি, যার টাকা তিনিই মালিক। কাজেই শিল্পের ইঞ্জিনিয়ার যেমন শিল্পের নিয়ন্তা নন, সম্পাদকও তেমনি খবরের কাগজের নিয়ন্তা নন। খবরের কাগজে মালিক-এর মত চলিবে, না সম্পাদকের মত চলিবে, এই তর্ক আমার কৃষক-সম্পাদকতার আমলেই উঠিয়াছিল। আমাদের সকল সাংবাদিকের ‘দাদা’ শ্ৰীযুক্ত মৃণালকান্তি বোস ও আমার প্রায়ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডা. ধীরেন্দ্রনাথ সেনের সঙ্গে অমৃতবাজার পত্রিকার কর্তৃপক্ষের বিরোধ বাধে সম্পাদকীয় পলিসি লইয়া। মৃণালবাবু শ্রমিক আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। ধীরেনবাবু বামপন্থী কংগ্রেসী ছিলেন। কাজেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বড়-বড় ইস্যু সম্বন্ধে অমৃতবাজার-এর মালিকদের সাথে এঁরা একমত ছিলেন না। কাগজে তারা নিজেদের মতামত চালাইতেন। অমৃতবাজার কর্তৃপক্ষ এদের দুইজনকেই কর্মচ্যুত করেন। ব্যক্তিগতভাবে এঁরা দুইজনই সাংবাদিকদের কাছে খুব শ্রদ্ধেয় ও জনপ্রিয় ছিলেন। কাজেই বিভিন্ন কাগজে অমৃতবাজারকর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠিল। জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনে এর কথা উঠিল। ঐ এসোসিয়েশনের অনেক মালিক মেম্বর ছিলেন বলিয়া ওয়ার্কিং জার্নালিস্টরা নিজেদের প্রতিষ্ঠান খাড়া করিলেন এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ আন্দোলন করিতে। কাজেই শিক্ষিত সমাজে, বিশেষত সাংবাদিকদের সামনে একটি মাত্র ইস্যু দেখা দিল : খবরের কাগজে কার মত চলিবে : মালিকের? না সম্পাদকের? সব সাংবাদিক ও অধিকাংশ খবরের কাগজে একই মত দেওয়া হইতে লাগিল : সম্পাদকের মত চলিবে। একমাত্র আমি কৃষক-এর সম্পাদকীয় লিখিলাম : মালিকের মত চলিবে।

.

১০. সম্পাদক বনাম মালিক

কলিকাতার সাংবাদিক মহল স্তম্ভিত হইল। মালিকরাও বোধ হয় অতটা আশা করেন নাই। মালিকের পক্ষের কথা বলে একজন ওয়ার্কিং জার্নালিস্ট তাও আবার বামপন্থী কাগজে? অনেক বন্ধু আমার নিন্দা করিলেন। ওয়ার্কিং জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন আমার কথায় প্রতিবাদ করিলেন। আমি কিন্তু অটল। নিজের কথার সমর্থনে পরপর আরো কয়েকটা সম্পাদকীয় লিখিলাম। আমি বলিয়াছিলাম সাংবাদিকতা উকালতির মতই একটা প্রফেশন। এটা মিশনারির মত আদর্শ সেবা নয়। উকিল যেমন দোষী-নির্দোষ-নির্বিশেষে সকলের কেস নেন, সাংবাদিকও তেমনি কংগ্রেস, মুসলিগ লীগ, হিন্দু সভা নির্বিশেষে সকলের কেস নিবেন। অর্থাৎ যিনি তার ফিস দিবেন তাঁরই পক্ষে সাংবাদিক কলম ধরিবেন। এটা তার ব্যবসায়িক কাজ। এটাকে তার ব্যক্তিগত মতামত বলিয়া কোনও বুদ্ধিমানই ধরিয়া লইবে না। সাংবাদিক এইভাবে পরের জন্য টাকার বিনিময়ে কলম চালাইতে গিয়া এতটুকু মাত্র দেখিবেন যে ঐ সাংবাদিক কর্তব্যের বাহিরে তার স্বাধীনতা যাতে ব্যাহত বা সংকুচিত না হয়। আপনি যদি কংগ্রেসী হন, তবে কংগ্রেস-বিরোধী কাগজে আপনি চাকুরি নিবেন না। যদি নেন, তবে কংগ্রেস-বিরোধী কথাই আপনাকে লিখিতে হইবে। আপনি কংগ্রেস-বিরোধীর টাকায় খানা খাইয়া তাঁরই কাগজে কংগ্রেসী প্রচার করিবেন, এটা আইন বা নীতির কোনও দিক দিয়াই সমর্থনযোগ্য নয়। যদিও কংগ্রেস-বিরোধী কথা বলিলে কাগজ না চলে, তবে সেটা দেখা যার টাকা তারই কর্তব্য, সাংবাদিকের নয়। সাংবাদিক সে ক্ষেত্রে মালিককে সদুপদেশ দিতে পারেন মাত্র। মালিক যদি সে উপদেশ না রাখেন। তবে সাংবাদিককে কাগজের মালিকের কথাই লিখিতে হইবে। আমি কৃষক ছাড়িবার সময় মুসলিম স্টাফকে এই উপদেশ দিয়াই আসিয়াছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *