চতুর্থ খণ্ড
সাহিত্যিক জীবন (মামুলি)
অধ্যায় বার – প্রচলিত পথে অগ্রসর
১. কৈফিয়ত
আমার সাহিত্যিক জীবনীকে দুই খণ্ডে ভাগ করিতে বাধ্য হইলাম। কারণ এ দিককার জীবনটাই আমার দুই ভাগে বিভক্ত। দুই ভিন্ন খাতে তা প্রবাহিত। সুলত দুই ভিন্ন দিকে। অদূরবর্তী ভিন্ন গন্তব্যের দিকে। পথ ও গন্তব্যের এ ভিন্নতার কারণ রাজনৈতিক। রাজনৈতিক কারণে দেশ ভাগ হইয়াছে। দেশ ভাগ হইলেও সাহিত্য ভাগ হয় নাই যারা বলেন, সে দলের আমি নই। আমার জন্য এটা নূতন কথা নয়। কারণ আমার বিচারে সাহিত্য মানেই জীবনভিত্তিক সাহিত্য। জীবন মানেই জন-জীবন। সে সাহিত্যের ভাষা মানেই গণ-ভাষা। আমার ক্ষেত্রে এ চিন্তাটা উৎপ্রেরণা, সহজাত। দেশভাগ যখন কল্পনাতীত ছিল, সেই ১৯২২ সালে আমি ‘গোলামী সাহিত্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে তৎকালীন সাহিত্যিক দিকপালদেরে ধান ক্ষেত ভাঙ্গিয়া গোলাপ বাগান রচনা না করিতে অনুরোধ করিয়াছিলাম। শ্রেণীর জন্য সাহিত্য রচনা না করিয়া জনগণের জন্য সাহিত্য রচনা করিবার দাবি করিয়াছিলাম। পরবর্তীকালে এ কথাটাকেই ‘আইভরি টাওয়ার হইতে মাটির বুকে নামিয়া আসার কাজ বলিয়াছিলাম। এসব লেখার কথা পরে যথাস্থানে বলিব। এখানে শুধু এইটুকু বলিয়া রাখিতেছি যে সাহিত্যের বস্তু জনগণ। জনগণ মানেই একটি জনপদের, একটা ভূখণ্ডের, একটা দেশের, একটা রাষ্ট্রের জনগণ। আমাদের বেলা আগে এটা ছিল গোটা বেঙ্গল। বাটোয়ারার পর এটা প্রথমে পূর্ব বাংলা, পরে পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমানে বাংলাদেশ হইয়াছে। দেশভাগ হওয়ার ফলে কোন কোন ব্যাপারে কী কী পরিবর্তন ঘটিয়াছে, তার ফলে সাহিত্যিকদের কর্তব্যের কী কী মোড় পরিবর্তন হইয়াছে, সেসব কথা পরে যথাস্থানে বলিতেছি। এখানে বলিতেছি শুধু সেইটুকু, দেশভাগ না হইলে একই দেশের সাহিত্যিক হিসাবে আমাদের যা কর্তব্য ও করণীয় ছিল। শুধু সেই পথে সেই উদ্দেশ্যে সাহিত্য-সাধনার দায়িত্বটাই ছিল আমাদের সাহিত্যিকদের প্রচলিত মামুলি কর্তব্য ও করণীয়। দেশ ভাগ হওয়ার আগে পর্যন্ত সব সাহিত্য-সেবকের মতই আমিও সেই গতানুগতিক পথেই চলিতেছিলাম। সেইটুকুই ছিল আমার এলাকা ও কর্তব্য এই কারণে এই মুদ্দতের সাহিত্য-সাধনাকে আমি মামুলি গতানুগতিক বা সাধারণ সাধনা বলিয়াছি। এই মুদ্দতের আমার সাহিত্যিক জীবনকেও কাজেই মামুলি সাহিত্যিক জীবনী’ আখ্যা দিয়াছি। ঠিক এই কারণেই বিভাগোত্তর সাহিত্য-সাধনাকে নূতন, অভিনব, অসাধারণ, সুতরাং গরমামুলি বলিয়াছি। এই কারণেই দুই মুদ্দতের সাহিত্য-সাধনাকে, সুতরাং সাহিত্যিক জীবনীকে, স্বতন্ত্রভাবে দুই ভিন্ন খণ্ডে লিপিবদ্ধ করিতে বাধ্য হইয়াছি। দুই মুদ্দতের সাহিত্য ও সাহিত্যিকের দায়িত্বের চরিত্রটা অতিশয় সুস্পষ্ট। তবু এখানে সংক্ষেপে তার উল্লেখ করিতেছি। ১৯৪৭ সালে বেঙ্গল বাটোয়ারা হওয়ার আগ পর্যন্তও আমরা বাঙ্গালীরা সবাই এক দেশের নাগরিক ছিলাম। কলিকাতা আমাদের প্রশাসনিক, সুতরাং ব্যবসায়িক, কৃষ্টিক, সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্রভূমি ছিল। ইংরাজ আমলের প্রায় দুইশ বছর পূর্ব বাংলা কলিকাতার হিন্টারল্যান্ড ছিল এবং সেই হিসাবে দেশের মেজরিটি বাসেন্দার দেহ, মন ও মস্তিষ্ক কলিকাতার জীবনেও বাংলা সাহিত্যে অবহেলিত ছিল। ইংরাজ শাসনের অবসানে অবশ্য সে অবস্থা আর থাকিত না। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের অবশ্যম্ভাবী চাপে ও প্রভাবে সারা বাংলার, সুতরাং মেজরিটি জনগণের সার্বিক রূপ কলিকাতার সাহিত্যে প্রতিফলিত হইতই। অবিভক্ত বাংলা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হইলে ত কথাই নাই, অখণ্ড রাষ্ট্ররূপে ভারতীয় ইউনিয়নের বা ফেডারেল পাকিস্তানের অঙ্গরাজ্য হইলেও গণতান্ত্রিক অন্তর্নিহিত শক্তিতেই রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতই শিল্প-সাহিত্য ক্ষেত্রেও এটা ঘটিত।
স্মরণীয় ব্যাপার এই যে, ইংরাজ আমলের দুইশ বছরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যে বিপুল ও সার্বিক উন্নতি সাধিত হইয়াছিল, ঐতিহাসিক কারণে তার মোল আনা উদ্যোগ ও কৃতিত্ব ছিল হিন্দুদের। মুসলমানদের তাতে কোনও অংশদারিত্ব ছিল না। ফলে খুব স্বাভাবিক কারণেই এই উন্নত বাংলা সাহিত্যের গোটা চেহারাটাই ছিল হিন্দুদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির রূপায়ণ। শরিক হিসাবে বাঙ্গালী মুসলমানেরা সেখানে শুধু অনুপস্থিতই ছিল না, ঐ সাহিত্যের তারা বাঙ্গালী বলিয়া স্বীকৃতই ছিল না। এসব কথাই দুই খণ্ডের যথা-যথাস্থানে আলোচিত হইয়াছে।
কিন্তু এখানে উল্লেখযোগ্য এই যে, বাংলা-সাহিত্যের এই চেহারার জন্য হিন্দুরাই এমন দোষী ছিলেন না। মুসলমানদের এই সাহিত্যিক অবমূল্যায়নের জন্য তারা নিজেরাও কম দায়ী ছিলেন না। বিশ শতকের গোড়া হইতেই দেশে গণতান্ত্রিক জাগরণের ফলে দেশের জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে মুসলমানদের পুনরুজ্জীবনের যে লক্ষণ সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল, সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তা প্রতিফলিত হইতে শুরু করিয়াছিল। রাজনৈতিক কারণে দেশভাগ না হইলে গোটা বাংলার ভাষিক ও সাহিত্যিক জীবনে বাঙ্গালী মুসলমানদের গণতান্ত্রিক দাবি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সংঘাত-সংগ্রামের আকারেই দেখা দিত। বস্তুত সে প্রসেস শুরু হইয়াই গিয়াছিল। গোড়ার দিকে কিছু কাল তাতে মতবিরোধ, বিতর্ক, অপ্রিয়তা, ভুল বুঝাবুঝি, এমনকি সাম্প্রদায়িক সংঘাত, দুর্নিবার অবশ্যম্ভাবী হইলেও শেষ পর্যন্ত একটা সমঝোতা অবশ্যই হইত। স্পষ্টতই এবং দৃশ্যতই এটা কঠিন ছিল। রাজনৈতিক বিবর্তনের মত সাহিত্যিক পরিবর্তন অত সহজ হইত না। রাজনীতিতে ফজলুল হকের জন্ম হওয়া যত সহজ, সাহিত্য-ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ পয়দা হওয়া তেমন সহজ নয়। বাঙ্গালী মুসলমানদের মুখের ভাষাকে হিন্দুরা বিশুদ্ধ বাংলাভাষা বলিয়া স্বীকার করিত না। মুসলমানদের ধর্ম-কৃষ্টি-সম্পর্কিত আরবি-ফারসি-জাত শব্দাবলিকে হিন্দু লেখকরা এবং সরকারি শিক্ষা-বিভাগ বাংলা শব্দ হিসাবে গ্রহণ করিতে ত রাজি ছিলেনই না, তাদের দৈনন্দিন ব্যবহৃত অন্য শব্দগুলিও হিন্দুরা সাহিত্যে স্থান। দিতে আপত্তি করিতেন। হিন্দুদেরও সরকারি শিক্ষা বিভাগের এই অস্বীকৃতির ভয়ে স্বয়ং মুসলমান লেখকরাও গোড়াতে সেসব শব্দ বর্জন করিয়া চলিতেন। এসব শব্দের ও বাক্যের সাহিত্যিক স্বীকৃতি পাইবার জন্য যে ধরনের অসাধারণ প্রতিভাধর লেখকের দরকার, নজরুল ইসলামের আগে অমন প্রতিভাবান মনীষী মুসলমানদের মধ্যে আবির্ভূত হন নাই। স্বয়ং নজরুল ইসলামের প্রতিভাও হিন্দুরা সোজাসুজি স্বীকার করেন নাই। মুসলিম ভারত, সওগাত, নওরোজ ইত্যাদি মুসলমান-পরিচালিত কাগজে লিখিয়া ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের রেকর্ডে গান গাহিয়া নজরুল ইসলাম জনপ্রিয়তা অর্জন করিবার পরেই হিন্দু লেখক-সম্পাদকরা নজরুল ইসলামকে মর্যাদা দিয়াছিলেন। এ মর্যাদা দানের মধ্যেও জাতীয় উদারতা ছিল না, ছিল সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা। কারণ সে স্বীকৃতিও ছিল মুসলমান কবি হিসাবেই, জাতীয় কবি হিসাবে নয়।
তবু দেশভাগ না হইলে এই প্রসেস চলিতে থাকিত এবং কালক্রমে গণতন্ত্রের নিজস্ব জোরেই তার গতিবেগ ও জোর বাড়িত। সব রকমের ভেস্টেড ইন্টারেস্টের স্বাভাবিক বিরোধের মতই সাহিত্য হিন্দু ভেস্টেড ইন্টারেস্টের প্রতিরোধও স্বভাবতই বাড়িত। কারণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভেস্টেড ইন্টারেস্টের চেয়ে কালচারের ভেস্টেড ইন্টারেস্ট কম শক্তিশালী নয়, বরঞ্চ বেশি। বাংলার মুসলিম সাহিত্যিক জাগরণের মোকাবিলা হিন্দু প্রতিরোধের এই অনমনীয়তা লক্ষ্য করিয়াই আমি ১৯৪৩ সালে এক সাহিত্য সভায় হিন্দু লেখকদের সম্বোধন করিয়া বলিয়াছিলাম : রাজনৈতিক পাকিস্তান হইবে কিনা জানি না, কিন্তু আপনারা বাংলার মেজরিটি মুসলমানের মুখের ভাষাকে বাংলা সাহিত্যে যেমন উপেক্ষা করিয়া চলিয়াছেন, তাতে বাংলায় সাহিত্যিক পাকিস্তান হইতে বাধ্য।
কিন্তু সে সংঘাতের পথে আমাদের যাইতে হয় নাই। তার আগেই দেশভাগ হইয়া গিয়াছে। দৃশ্যত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে দেশভাগ হইয়াছে। মনে হইবে। কিন্তু একটু গভীরে তলাইয়া দেখিলেই বুঝা যাইবে যে এ বিভাগের আসল কারণ ছিল কৃষ্টিক। বিশ শতকে এটা প্রমাণিত ও স্বীকৃত হইয়াছে যে, রাজনৈতিক পরাধীনতা মানব-মনের যে ক্ষতি করে, কৃষ্টিক পরাধীনতা ক্ষতি করে তার চেয়ে অনেক বেশি। কাজেই সাহিত্যে দুইশ বছরের হিন্দু প্রাধান্যের অবসান ঘটাইয়া বাংলার গণতন্ত্রের জোরে মুসলিম-প্রাধান্য প্রবর্তন করিলে সেটা হইত হিন্দুর উপর অবিচার। তার বদলে দেশভাগ হইয়া বাংলার হাজার বছরের দুইটা সমান্তরাল কালচারের স্বকীয়তা রক্ষা বৃদ্ধি ও উন্নয়নের নিশ্চিত ব্যবস্থা হইয়াছে। ভালই হইয়াছে। পূর্ব বাংলায়, পূর্ব পাকিস্তানে এবং বর্তমানের বাংলাদেশে মুসলিম-প্রধান বাঙ্গালী কৃষ্টি ও সাহিত্যের নয়া বাগিচা, নূতন প্রাসাদ, নবীনদুর্গ গড়ার সুযোগ হইয়াছে। অথচ এটা করিতে গিয়া হিন্দু-কৃষ্টি সাহিত্যের কলিকাতা-কেন্দ্রিক বাগিচা বা দুর্গ ভাঙ্গার কোনও দরকার থাকে নাই। মুসলমানের হাতে সেটা ভাঙ্গা অশোভন ও হিন্দুর মনে পীড়াদায়ক হইত। আধুনিকতা ও গণতান্ত্রিক দাবিতে ও প্রয়োজনে তার যদি সংস্কার অথবা কোনও অংশ ভাঙ্গার দরকার হয়, তবে সেটা হিন্দুরা নিজেরাই নিজ হাতে করিবে, এটাই ভাল। বিশ শতকের চতুর্থ-পঞ্চম দশকে হক মন্ত্রিসভা কলিকাতা ভার্সিটি জমিদারি-মহাজানি প্রথাসমূহের মত হিন্দু কৃষ্টি ভাঙ্গিবার যেসব চেষ্টা করিয়াছিলেন, হিন্দুরা ঐক্যবদ্ধভাবে তাতে বাধা দিয়াছিলেন। কিন্তু দেশ বিভাগের পর তারা নিজেরাই সেসব দুর্গ ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছেন। অখণ্ড বাংলার অস্থায়ী ও সাময়িক মুসলিম-প্রাধান্যের মুহূর্তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উপলক্ষে মুসলিম দাঙ্গাকারীরা হিন্দুদের মূর্তি-মন্দির ভাঙ্গিয়া ফেলিত। ঐ উপলক্ষে আমার এক শ্রদ্ধেয় কংগ্রেসি হিন্দু বন্ধু আমাকে বলিয়াছিলেন : “তোমরা মুসলমানরা আমাদের সমাজ-সংস্কারে বাধা দিতেছ। আমরা হিন্দুরা নিজেরাই সেসব মূর্তি ভাঙ্গিয়া ফেলিব স্থির করিয়াছিলাম, তোমরা মুসলমানরা সেগুলি ভাঙ্গিতেছ বলিয়া আমরা একটার জায়গায় আরো দশটা বানাইতেছি।’ কথাটার অনেকখানি সত্য। এর অন্তর্নিহিত সত্যটা লক্ষণীয়।
দেশভাগের এটাই তাৎপর্য। এই কারণেই অখণ্ড বাংলায় আমরা মুসলমানরা যে কলিকাতা-কেন্দ্রিক সাহিত্য-সাধনা করিতেছিলাম, দেশ ভাগের পরের ঢাকা-কেন্দ্রিক সাহিত্য তার থনে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক নবজীবনের সাধনা। এই কারণেই আমার সাহিত্যিক জীবনকে দুই আলাদা খণ্ডে বিচার বিবেচনা করিয়াছি। ঢাকার সাহিত্য-সাধনা কলিকাতার সাহিত্য-সাধনার বিকাশ, উন্নতি ও পরিণাম নয়। নয়া জাতির জন্মে অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবেই আমাদের এটা নবজীবন, নয়া জিন্দিগি।
.
২. শৈশবের খোরাক পুঁথি
আমাদের নিজেদের বাড়িতে এবং দুই মামুর বাড়িতে পুঁথি পড়ার খুব চর্চা ছিল। চাচাজী মুনশী ছমিরুদ্দিন ফরাযী, দুই মামু হোসেন আলী ফরাযী ও ওছমান আলী ফকির নামযাদা পুঁথি-পড়ুয়া ছিলেন। তিনজনের গলাই খুব মিঠা ছিল। ওছমান আলী ফকির সাহেবের গলা খুব দায় ও বুলন্দ ছিল। বিবাহ মজলিসে, ছোট-বড় যিয়াফতে, এমনকি ওয়াযের মজলিসের শেষে, নিয়মিতভাবে পুঁথি পড়া হইত। সাধারণত গুরুগম্ভীর বা ধর্ম-ভাবের সভায় কাছাছুল আম্বিয়া, আমির হামযা, শাহনামা, শহীদে-কারবালা, জঙ্গনামা, ফতুহশোমইত্যাদি কেতাব পড়া হইত। এ ছাড়া বিবাহ-মজলিসে, ছোটখাটো মেহমানিতে আলেফ-লায়লা, হাতেম-তাই, লায়লি-মজনু, শিরি-ফরহাদ, বাহার-দানেশ, চাহার-দরবেশ, সূর্য-উজাল, জইগুন ও সোনাভানের কিচ্ছা, তুতিনামা ইত্যাদি হরেক রকমের পুঁথি পড়া হইত। চাচাজী মুনশী মানুষ ছিলেন বলিয়া তিনি বাছাই করা মজলিসে বাছাই করা পুঁথি পড়িতেন। কিন্তু মামুদের বেলা সে রকম কোনও বিধিনিষেধ ছিল না। সকল রকম মজলিসেই তাঁদেরে ডাকা হইত। যাইতেনও তাঁরা। পড়িতেনও হরেক রকমের পুঁথি। পার্শ্ববর্তী হিন্দুপাড়ায় যেমন মাঝে-মাঝে রাতভর কীর্তন হইত, আমাদের গ্রামের মুসলমান পাড়ার অনেক বাড়িতে তেমনি সারারাত পুঁথি পড়া হইত। এমন অনেক দিন গিয়াছে, যখন হিন্দুবাড়ির কীর্তনের লাইন : ‘কালা ত আইল না, কালা ত আইল না’ শুনিতে-শুনিতে ঘুমাইয়া পড়িয়াছি এবং ফযরে যখন ঘুম ভাঙ্গিয়াছে তখনও শুনিয়াছি ভাঙ্গা গলায় গাওয়া হইতেছে : কালা ত আইল না। ঠিক সেইরূপ, এমন অনেক রাত গিয়াছে, যেদিন ‘ওছি মামুর সুর করা দরা গলার ‘এতেক কহিল যদি আলী পালোয়ান, গোস্বায় জ্বলিয়া গেল বীর হনুমান’ শুনিতে-শুনিতে ঘুমাইয়া পড়িয়াছি আবার ফযরে ‘গোস্বায় জ্বলিয়া গেল বীর হনুমান’ শুনিয়াই ঘুম ভাঙ্গিয়াছে।
.
৩. পুঁথির নিশা
এই পুঁথি পড়ায় আমি এত প্রভাবিত হইয়াছিলাম যে সাত-আট বছর বয়সে আমিও একজন মজলিসি পুঁথি-পড়ুয়া হইয়া গেলাম। চাচাজী ও মামুরা পুঁথি পড়িতে পড়িতে ক্লান্ত হইলে আমাকে বদলি দিতেন। এইভাবে অল্পদিনেই স্বাধীন পড়ুয়া হইয়া গেলাম। ছেলেবেলা সকলেরই স্মরণশক্তি খুব প্রখর থাকে। আমারও ছিল। অনেক পুঁথির পৃষ্ঠাকে-পৃষ্ঠা আমার মুখস্থ হইয়া গিয়াছিল। স্কুলে যাইবার কালে পথেঘাটে এবং খেলা করিতে গিয়া মাঠে উচ্চসুরে এইসব আবৃত্তি করিতাম। ক্ষেতে কাজ করিবার সময় চাষিরা এবং গরু রাখিবার সময় রাখালরা যেমন গলা ছাড়িয়া ভাটিয়ালি-ভাওয়াইয়া গান গাইত, আমিও তেমনি তাদের সাথে পাল্লা দিয়া গলা ছাড়িয়া পুঁথি পড়িতাম। পুঁথি পড়ায় আমি এমন অভ্যস্ত হইয়া গেলাম যে, এক পুঁথি পড়িতে-পড়িতে অন্য পুঁথির অনুরূপ দু-চার ছতর ঢুকিয়াইয়া দিতাম। শ্রোতারা টেরও পাইত না। এই অভ্যাস শেষ পর্যন্ত এমন হইল যে, পুঁথি পড়িতে-পড়িতে আমি এক্সটেমপোর স্বরচিত দু-চার লাইন ঢুকাইয়া দিতাম। আস্তে আস্তে এ কথা জানাজানি হইয়া গেল। এক কথা একশ কথা হইয়া প্রচারিত হইল। আমার সাহস ও উৎসাহ বাড়িয়া গেল। আমি পুঁথি রচনায় হাত দিলাম। সে সব লেখা অবশ্য আমি ছাড়া আর কেউ পড়ে নাই। কিন্তু নিজেই ঐসব পড়িয়া নিজেকে বাহবা দিতাম।
.
৪. গদ্য সাহিত্যের সাথে পরিচয়
ধানীখোলা পাঠশালায় আমার পড়া শেষ হওয়ায় আমি পুঁথি ছাড়া অন্য রকম বই-পুস্তক পড়িবার সুযোগ নাই। তার মধ্যে যশোহরের মুনশী মেহের উল্লার মেহেরুল ইসলাম, সিরাজগঞ্জের মুনশী মেহেরুল্লার নসিহত নামা ও ময়মনসিংহের মওলানা খোন্দকার আহমল আলী আকালুবীর শুভ জাগরণ কবিতার বই, দারোগার দপ্তর নামে ডিটেকটিভ গল্পের মাসিক এবং প্রবাসী নামক মাসিক পত্র এবং বঙ্গবাসী, মিহির ও সুধাকরনামক সাপ্তাহিক কাগজের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সম্ভবত ১৯০৭-০৮ সালে ময়মনসিংহ শহরে মুসলিম শিক্ষা সম্মিলনী নামে খুব বড় একটি সভা হয়। চাচাজী ও এ অঞ্চলের অনেক মাতব্বর ও আলেম-ফাযেল ঐ সভায় যোগদান করেন। চাচাজী ঐ সম্মিলনী হইতে অনেক কাগজ-পত্র ও বই-পুস্তক নিয়া আসেন। তাতে বাংলা ইংরাজি দুইই ছিল। ইংরাজি পড়িতে পারি নাই। কিন্তু বাংলাগুলি রাক্ষসের ক্ষুধা লইয়া পড়িয়াছিলাম। তার সব কথা মনে নাই। শুধু মনে আছে, মি. শার্প নামে এক ইংরাজ সাহেব মুসলমানদের শিক্ষার কথা বলিয়াছিলেন। আর মনে আছে, করটিয়ার খান পন্নি ও জঙ্গলবাড়ি-হায়বতনগরের দেওয়ান সাহেবদের কয়েকজনের নাম ছাপার হরফে দেখিয়াছিলাম। তাঁদের মধ্যে ওয়াজেদ খান পন্নি ও দেওয়ান মান্নান দাদ খাঁর নাম মনে ছিল। আর সব ভুলিয়া গিয়াছিলাম। এর পর সম্ভবত ১৯০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে বৈলর বাজারে এক বিরাট সভা হয়। তাতে আমি ভলান্টিয়ার ছিলাম এবং কিছু বই-পুস্তক কিনিয়া ফেলিয়াছিলাম। সিরাজগঞ্জের মুনশী মেহেরুল্লা সাহেব এই সম্মিলনীর প্রধান বক্তা ছিলেন। তার বই-পুস্তক এই সভাতেই বিক্রয় হইয়াছিল।
.
৫. শৈশবে সম্পাদকতা
পাঠশালার ছাত্র হইয়াও আমি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র পড়িতাম, এমনকি, ডিটেকটিভ গল্পের বইও পড়িতাম, এ কথা আজকালকার তরুণ পাঠকদের বিশ্বাস হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আমাদের ছেলেবেলা এটা কোনও অসাধারণ ব্যাপার ছিল না। আমার সহপাঠীদের অনেকেই তা করিত। তরুণ পাঠকরা শুনিয়া হয়ত আরো বিস্মিত হইবেন যে, আমার অন্যতম সহপাঠী শামসুদ্দীন (বর্তমান প্রবীণ সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন) ও আমি নিম্ন প্রাইমারি পাঠশালার শেষ বছর দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়িবার সময় মঞ্জুষা নামে একটি সংবাদ-সাহিত্য-পত্র বাহির করিয়াছিলাম। এটি স্বভাবতই হইল হাতের লেখা। সম্পাদক-লেখকও হইলাম আমরা দুইজনই। সম্পাদক মানে সত্যই সম্পাদক। কিন্তু লেখক মানে রাইটার’ নয় কপিস্ট। ছাপার বদলে যা করিতে আমরা বাধ্য ছিলাম। প্রথমে ইচ্ছা ছিল সাপ্তাহিক মঞ্জুষাকরা। সম্পাদনা মানে নিজেদের মৌলিক রচনা নয়, সাপ্তাহিক বিভিন্ন সংবাদপত্র হইতে পছন্দমত নকল করা। এ কাজও কঠিন ও শ্রমসাধ্য বিবেচিত হওয়ায় সাপ্তাহিকের বদলে মাসিক মঞ্জুষা বাহির হইল। শেষ পর্যন্ত সারা বছরে দুই-তিন সংখ্যার বেশি বাহির হইতে পারিল না। তবু চেষ্টা ত করিয়াছিলাম।
আসলে তৎকালে বাংলা ও অঙ্ক শিক্ষার মানই অনেক উন্নত ছিল। ইংরাজি শিক্ষার বোঝা ছিল না। দ্বিতীয় শ্রেণীর শেষ কয়মাস স্পেলিং বুক নামে একটি ছোট্ট বই ছিল মাত্র। আরবি-ফারসি ও বাড়িতেই পড়ার নিয়ম ছিল। সে জন্য বাংলা বই-পুস্তক যা কিছু সামনে পড়িত, তা পড়িতে চেষ্টা করিতাম, পারিতামও। যেসব শব্দ বুঝিতাম না, চাচাজীকে জিজ্ঞাস করিতাম। তিনি না পারিলে মাস্টার সাবকে জিগাইয়া বুঝিয়া নিতাম। তা-ও না হইলে কাল্পনিক অর্থ করিয়া সন্তুষ্ট হইতাম। কাল্পনিক অর্থগুলিই অনেক সময় বেশি রোমাঞ্চকর হইত।
এরপর দাদাজীর নামে মিহির ও সুধাকর নামে একটি সাপ্তাহিক কাগজ আসিতে শুরু করে। আমাদের প্রতিবেশী এবং সম্পর্কে চাচা ওসমান আলী সরকার (পরে খান সাহেব ওসমান আলী) এই সময় বঙ্গবাসীর গ্রাহক ও আমার মামু হুসেন আলী ফরাযী হিতবাদীর গ্রাহক হন। আমি এই তিনখানা সাপ্তাহিকই নিয়মিতভাবে পড়িতাম। পাঠশালার পড়া শেষ করিয়া দরিরামপুর মাইনর স্কুলে যাওয়ার পর গদ্য সাহিত্য পড়িবার সুযোগ আরো বেশি বাড়ে। পূর্বোক্ত ওসমান আলী সাহেব সাপ্তাহিক বঙ্গবাসীছাড়া দারোগার দপ্তর নামক একটি মাসিক পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। ওসমান আলী সাহেবের ছোট ভাই সাদত আলী আমার সাথে দরিরামপুর স্কুলে পড়িতেন। তিনি বড় ভাই-এর দারোগার দপ্তর গোপনে আনিয়া আমাকে পড়িতে দিতেন। দরিরামপুর স্কুলে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার কৈলাস বাবু আমাকে প্রবাসীর গ্রাহক করিয়া দেন। এইভাবে আমি পুঁথিপাঠ হইতে গদ্য বই-পুস্তক পড়িতে শিখি। চাচাজী এই সময় একটি বিষাদ-সিন্ধু কিনেন। তিনি বৈঠকখানায় বসিয়া লোকজনকে এই ‘গদ্যে শহীদে কারবালা পড়িয়া শুনাইতেন।
এই সব বইয়ের মধ্যে দারোগার দপ্তর পড়িয়া আমি খুবই মুগ্ধ হই। কয়েক সংখ্যা দারোগার দপ্তর পড়িয়াই আমি নিজে পরপর কয়েকটি ডিটেকটিভ গল্প লিখিয়া ফেলি। সাদত ও শামসুদ্দীন উভয়েই আমার গল্পের তারিফ করে। কাজেই ছাপাইবার জন্য ঐসব গল্প দারোগার দপ্তর অফিসে পাঠাই। স্বভাবতই একটাও ছাপা হয় নাই। কাজেই বাংলা সাহিত্যের পাঠকরা আমার ঐ ডিটেকটিভ গল্প পাঠ হইতে একদম বঞ্চিত না হন, সেজন্য এসব গল্পের একটির সারমর্ম এখানে উল্লেখ করিতেছি : খুনি নিহত লোকটাকে অন্ধকারে ছুরি মারিয়া খুন করে। তদন্তকারী দারোগা কিছুতেই খুনের আশকারা করিতে পারেন না। অবশেষে খুনি আরো লোক খুন করিবে বলিয়া দারোগা বাবুকে চ্যালেঞ্জ করিয়া পত্র দেয়। সেই পত্রে প্রথমে সে নিজের নামই লিখিয়াছিল। পরে চিন্তাভাবনা করিয়া সাবধানতা হিসাবে নিজের নাম কাটিয়া সে স্থলে লেখে ‘তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী। নামটি সে কাটিয়াছিল বটে, কিন্তু একটু নজর দিয়া পড়িলেই তার পাঠোদ্ধার করা সম্ভব ছিল। দারোগা বাবু কাটা নামটি পড়িতে সমর্থ হন এবং খুনিকে গ্রেফতার করেন। এইভাবে খুনের ঐ ‘গভীর রহস্য উদঘাটিত হয়।
.
৬. কৈলাস বাবুর প্রভাব
কৈলাস বাবু ছিলেন কবি, সাহিত্যিক ও গায়ক। তার কয়েকখানা কবিতার বই ছাপা হইয়াছে। দরিরামপুরে আমাদের শিক্ষকতা করিবার সময় তিনি ছাত্রদের অভিনয়োপযোগী নারী চরিত্রহীন নাটক লিখিতেন। তাতে যে সব গান থাকিত তার সবই তাঁর নিজের রচিত। এই সব নাটক তিনি আমাদের দিয়া অভিনয় করাইতেন। নাটকের বিষয়বস্তু ছাত্রদের প্রতি উপদেশ। যথা : সত্যের পুরস্কার’, ‘মিথ্যাবাদীর শাস্তি’, ‘কুসংসর্গের পরিণাম’। এসব নাটকের মূল চরিত্র ভাল ছাত্রের পার্ট তিনি আমাকে দিয়াই করাইতেন। তিনি আমাকে রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠে উদ্বুদ্ধ করেন। তাঁরই চেষ্টায় আমি রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী প্রাইম পাই। মোট কথা, তারই প্রেরণায় আমার। মনে কবি-সাহিত্যিক হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা জাগে।
.
৭. আতিকুল্লাহ
বন্ধুবর আতিকুল্লাহর গুণের কথা ইতিপূর্বেই বলিয়াছি। তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের ফলে কী মজার ব্যাপার ঘটিয়াছিল, তাই এখানে বলিতেছি। আতিকুল্লাহর সঙ্গে আমার পরিচয় একটু ঘনিষ্ঠ হওয়ার পরই তিনি একদিন আমাকে তাঁর বাসায় নিয়া যান। এরপরও অনেক দিন আমি তার বাসায় গিয়াছি। কিন্তু আমি প্রথম দিনের কথাই এখানে বলিতেছি। আতিকুল্লাহ নিকটবর্তী এক বাড়িতে যায়গীর থাকিতেন। আমাকে সেখানে নিয়া যখন তাঁর থাকার ঘরটা দেখাইলেন, আমি অবাক হইয়া গেলাম। ঘরের সামনে দাঁড়াইতেই প্রথমে নজর পড়িল ঘরের দরজার কাঠে কপাট জুড়িয়া একটা কাগজ সাঁটা আছে। তাতে সবুজ ও লাল কালিতে সুন্দর বড়-বড় হরফে লেখা আছে : ‘আতিকিয়া। লাইব্রেরি। আরো কাছে গিয়া দেখিলাম, অপেক্ষাকৃত ছোট হরফে লেখা আছে : ‘এইখানে পাওয়া যায়। তারও নিচে আরো ছোট-ছোট হরফে দুই সারিতে শতাধিক পুস্তকের নাম ও দাম লেখা আছে। পুস্তকের নামের সারিদ্বয়ের নিচে একটু বড় হরফে লেখা আছে : ‘এতদ্ভিন্ন অর্ডার পাইলে যে কোনও পুস্তক কলিকাতার দরে সরবরাহ করা হয়।’
আতিকুল্লাহ দরজার তালা খুলিয়া ঘরে ঢুকিলেন কিন্তু পিছনে-পিছনে আমি ঢুকিলাম না দেখিয়া তিনি ফিরিলেন। আমাকে তার বিজ্ঞাপন পড়িতে দেখিয়া হাসিতে হাসিতে আমার হাত ধরিয়া টানিয়া ভিতরে নিলেন। আমিও হাসিয়া ঘরে ঢুকিতে-ঢুকিতে বলিলাম : ‘এইসব বই আপনার এখানে পাওয়া যায়?
কিন্তু ঘরে ঢুকিয়া আমার বিস্ময়ের অবধি থাকিল না। আমার প্রশ্নের কথা ভুলিয়া আতিকুল্লাহর ঘরের সৌন্দর্য দেখিতে থাকিলাম। ছোট্ট ঘর। চাটাইর বেড়া। কিন্তু চাটাইর বেড়াতে খবরের কাগজ লাগানো হইয়াছে। আর সেই খবরের কাগজের উপর সুন্দর-সুন্দর ছবি তরে-তরে সারি-সারিতে লাগানো হইয়াছে। ছবিগুলির কোনোটা লতা-পাতা, কোনোটা টবের উপর আস্ত একটা গোলাপ গাছ। তাতে অনেকগুলি ছোট-বড় ফুল ফুটিয়াছে। কোনোটা মাত্র কলি। কোনও ছবি একটা নদীর বাক। দুই ধারে গাছপালা। নদীর বাঁকে লাল সুরুজ ডুবিতেছে। পাখিরা উড়িয়া বাসায় যাইতেছে। এই ধরনের ছবিগুলোর ফাঁকে ফাঁকে আরবি ও বাংলা হরফে সুন্দর রূপে সাজান তুগরা। মোট কথা, চারপাশের এই সুন্দর ছবিগুলি আতিকুল্লাহর ঘরটিকে একটি ছোটখাটো বাগিচা বানাইয়াছে। তার মধ্যে বিছানাটিও পরিপাটি। সাদা বিছানার চাদরটি টান-টান করিয়া পাতা। বালিশের সাদা ওয়াড়ে লতা-পাতা ফুল আঁকা। আতিকুল্লাহ বাহিরে পোশাক-পাতিতে মোটেই বাবু নন। বরঞ্চ তাকে অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন বলা যায়। তাঁরই শোবার ঘর ও বিছানা এত সুন্দর। এত পরিষ্কার। জানিলাম ঐ সব তাঁর নিজের হাতের আঁকা। নিজেই ময়দার আটা দিয়া লাগাইয়াছেন। বালিশের ফুলও তিনি নিজেই তুলিয়াছেন। অনেকক্ষণ দেখিবার পর আমার বিস্ময় কাটিলে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম : আপনার লাইব্রেরিটা কোথায়?
আতিকুল্লাহ কিছুমাত্র বিব্রত না হইয়া বিছানার পাশে একটি তক্তার উপর রাখা একটি ছোট্ট টিনের বাক্স খুলিলেন। বাক্সের কিছু কাপড়-চোপড় সরাইয়া একখানা-একখানা করিয়া চার-পাঁচখানা পুস্তক ও কেতাব বাহির করিলেন। পুস্তক মানে ছোট সাইযের বই। কেতাব মানে পুঁথি সাইযের বই। পুস্তক মানে বাম দিকে হইতে শুরু করা বই; আর কেতাব মানে ডান দিক হইতে শুরু করা বই। সুতরাং দেখামাত্র চিনিলাম কোনোটা পুস্তক আর কোনোটা কেতাব।
এগুলি উল্টাইয়া-পাল্টাইয়া আমি বন্ধুকে বলিলাম : আর বই কই?
কিছুমাত্র লজ্জিত না হইয়া আতিকুল্লাহ জবাব দিলেন : “আর সব বই কলিকাতায় আছে। চিঠি লিখিলেই চলিয়া আসিবে। বড়জোর সাত দিন। আর পোস্টাফিস যখন আপনার বাড়ির কাছে, তখন আপনার আরো কম দিন লাগিবে।’
.
৮. হাজী আহমদ আলী
আমার মুখে নৈরাশ্যের ভাব দেখিয়া আতিকুল্লাহ বাক্সের অজতলা হইতে একটি ছোট বই বাহির করিয়া আমার হাতে দিলেন। আমি দেখিলাম উহা ‘সকল রকম বই পুস্তকের তালিকা।’ পুস্তক বিক্রেতার নাম হাজী আহমদ আলী। আহমদীয়া লাইব্রেরি। …নম্বর মেছুয়া বাজার স্ট্রীট কলিকাতা। পাতা উল্টাইয়া দেখিলাম, পিপড়ার মত ছোট হরফে কত যে পুস্তকের নাম লেখা হইয়াছে, তার লেখাযুখা নাই। আমার পাতা উল্টানো শেষ হইলে আতিকুল্লাহ বলিলেন : এই হাজী সাহেব কলিকাতার সবচেয়ে বড় ধনী, ইমানদার মুসলমান। আহমদীয়া লাইব্রেরি কলিকাতার শ্রেষ্ঠ পুস্তকের দোকান।
আতিকুল্লাহর অত ক্যানভাসের দরকার ছিল না। আমি প্রথম দৃষ্টিতেই হাজী সাহেবের প্রেমে পড়িয়াছিলাম। তিনি আমার মিতা। হাজী বাদ দিলে তার আর আমার নাম এক। তারপর হাজী আগে না লিখিয়া আমাদের দেশের মত নামের পরে লিখিলে তিনি হন আহমদ আলী হাজী। আর আমি হইলাম আহমদ আলী ফরাযী। এমন খাপে-খাপে মিলিয়া যাওয়া মিতা আর কয়টা আছে? অতএব ইনি যে কলিকাতার শ্রেষ্ঠ ধনী, আর তার লাইব্রেরিই যে। সবচেয়ে বড়, সে বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ রহিল না।
অতঃপর আতিকুল্লাহ আমার হাত হইতে তালিকা পুস্তকটি নিয়া পড়িয়া শুনাইলেন, হাজী সাহেবের লাইব্রেরি হইতে পুস্তক কিনিলে শতকরা পঁচিশ টাকা কমিশন পাওয়া যায়। তিনি আমাকে ঐ কমিশনের মর্ম ও তাহা পাওয়ার। সহজ উপায় বাতলাইলেন। তাঁর দরজায় লটকানো বিজ্ঞাপন পড়িয়া লোকেরা তাঁর কাছে বইয়ের অর্ডার দেয়। তিনি সেই অর্ডারি পুস্তকের জন্য হাজী সাহেবের নিকট পোস্টকার্ড লিখেন। হাজী সাহেব ডাকে সেইসব পুস্তক পাঠাইয়া দেন। এই প্রসঙ্গে আতিকুল্লাহ আমাকে ডাক, পোস্টাফিস, পার্সেল ইত্যাদি কথার অর্থ ও কার্যপ্রণালি প্রাঞ্জল করিয়া বুঝাইয়া দেন। এত সহজে পঁচিশ টাকা কমিশন রোযগারের আমার খুব লোভ হইল। হয়ত মিতাজী আমাকে কমিশন আরো বাড়াইয়াও দিতে পারেন। মনে মনে ঐ কমিশনে ব্যবসা করা স্থির করিয়া ফেলিলাম। কিন্তু আতিকুল্লাহর কাছে প্রকাশ করিলাম। শুধু তালিকা পুস্তকটি চাহিলাম। ওটি দেওয়ার অসুবিধা বুঝাইয়া তিনি শীঘ্রই আরেকটি আনাইয়া দেওয়ার ওয়াদা করিলেন। আমি দৃঢ়সংকল্প লইয়াই সেদিন বিদায় হইলাম।
.
৯. আহমদীয়া লাইব্রেরি
মাসেক-পনের দিনের মধ্যেই আতিকুল্লাহ আমাকে একটি নূতন তালিকা বই দিলেন। এটি আরো সুন্দর আরো বড়, পুস্তকের সংখ্যা আরো বেশি। ইতিমধ্যে আতিকুল্লাহর শিষ্যত্বে আমি আরো বেশি পাকিয়াছি। নিজহাতে লাল-সবুজ কালি বানাই। সুন্দর লেখা। আতিকুল্লাহর হুবহু অনুকরণে আমি আমাদের বৈঠকখানার বেড়ায় পুস্তকের তালিকা লটকাইলাম। তালিকার উপরে বড়-বড় হরফে হেডিং বসাইলাম। আহমদীয়া লাইব্রেরি। আতিকুল্লাহর অনুকরণে লাল-সবুজ-কালির লেখা। দেখিতে বেশ সুন্দর। চাচাজী এটাকে পাগলামি মনে করিয়া গোড়াতে ধমক দিয়াছিলেন। আমি কাঁদিয়া দাদাজীর কাছে নালিশ করি। দাদাজী চাচাজীকে পাল্টা ধমক দেন। চাচাজী আমাকে আর কিছু বলেন না। পাড়ার লোক আসিয়া আমার লাইব্রেরির সামনে ভিড় করিত। যারা পড়িতে জানিত তারা জোরে-জোরে পুস্তকের নাম পড়িত, আর যারা পড়িতে জানিত না তারাও আমার লেখার তারিফ করিত। কিন্তু কেউই আমার কাছে বইয়ের অর্ডার দিত না।
কিন্তু তাতে আমি নিরুৎসাহ হইলাম না। আমি হাজী সাহেবের নিকট পঁচিশ টাকা কমিশনের প্রস্তাব করিয়া পোস্টকার্ড লিখিলাম। হাজী সাহেব আমার প্রস্তাবে রাজি হইয়া খুব তাড়াতাড়িই পত্রের জবাব দিলেন। তাতে আমার কী কী পুস্তক কত কপি চাই অতি সত্বর জানাইতে লিখিলেন। আমার আর কোনও সন্দেহ থাকিল না যে, আমার নাম দেখিয়াই হাজী সাহেব অত সহজে আমার প্রস্তাব গ্রহণ করিয়াছেন এবং অতি সত্বর বইয়ের লিস্টি চাহিয়াছেন। আমি কি আর দেরি করি? হাজী সাহেবের তালিকা পুস্তকের প্রায় অর্ধেক বইয়ের নাম লিখিয়া ফুলস্কেপ কাগজের এক শিট ভরিয়া ফেলিলাম এবং সেটা ইনভেলাপ ভরিয়া পোস্ট মাস্টারের পরামর্শে অতিরিক্ত টিকিট লাগাইয়া পাঠাইয়া দিলাম। পুস্তকের বদলে আরেকটি চিঠি পাইলাম। তাতে হাজী সাহেব জানাইয়াছেন যে, অর্ডারি পুস্তকের মোট দাম হাজার টাকার উপরে হইবে; অত টাকার পুস্তক বিনা-অগ্রিমে পাঠানোর নিয়ম নাই। অতএব পত্র পাওয়ামাত্র যেন আমি শতকরা পঁচিশ টাকা অগ্রিম হিসাবে অন্তত আড়াই শ টাকা মনি-অর্ডারযোগে হাজী সাহেবের নিকট পাঠাইয়া দেই। ঐ টাকা পাইয়াই হাজী সাহেব আমার নামে সমস্ত বই পাঠাইয়া দিবেন। অবশ্য অগ্রিম পাওয়া বাদ দিয়াই তিনি পুস্তক ভি পি করিবেন।
এই পত্র পাইয়া আমার মাথা ঘুরিয়া গেল। কোথায় হাজী সাহেব নিজে দিবেন আমাকে শতকরা পঁচিশ টাকা কমিশন। তা না করিয়া তিনি এখন আমারই নিকট শতকরা পঁচিশ টাকা অগ্রিম চাহিয়া বসিয়াছেন? নিশ্চয়ই কোথাও বুঝিবার কোনও ত্রুটি হইয়াছে। কিন্তু কোথায়? হাজী সাহেব যে লিখিয়াছেন ভি পি করিবেন, সে কথারই বা অর্থ কী? বড় ভাবনায় পড়িলাম। যিনি এ বিষয়ে আমাকে পরামর্শ দিতে পারিতেন, সেই আতিকুল্লাহর কাছে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ। কারণ ব্যাপারটা তার কাছে গোপন রাখিয়াছি। তার কাছে শিক্ষা পাইয়া, তারই নিকট হইতে তালিকা আনিয়া তাঁরই ব্যবসাটা নিজের হাতে লইয়া আসিতেছি, এটা জানিলে আতিকুল্লাহ ভাই মনে কষ্ট পাইবেন বলিয়াই ব্যাপারটা তাকে জানিতে দেই নাই। এখন তার কাছে যাওয়াটা বড়ই লজ্জার ব্যাপার হইবে। কাজেই নিজেই বুদ্ধি করিয়া হাজী সাহেবের চিঠির জবাব দিলাম। এইরূপ লিখিলাম : ‘আমি আপনার মিতা, এ কথা ভুলিবেন না। বিনা অগ্রিমে বই পাঠাইয়া দেন। বই বিক্রয় করিয়াই টাকা পাঠাইয়া দিব। আল্লাহর ওয়াস্তে মিতাকে বিশ্বাস করুন। হাজী সাহেবের জবাব পাইলাম। তিনি লিখিয়াছেন : কোনও বয়স্ক ও বিশ্বাসী লোক যামিন না হইলে তিনি অত টাকার বই বিনা-অগ্রিমে বাকি দিতে পারেন না বলিয়া তিনি খুবই দুঃখিত।
.
১০. বৃদ্ধ মিতাজির দোওয়া
চিঠিটা পাইয়া আমি চমকিয়া উঠিলাম। বয়স্ক লোকের যামিনের কথা হাজী সাহেব লিখিলেন কেন? তবে কি তিনি ধরিয়া ফেলিয়াছেন যে আমি নয় বছর বয়সের ক্লাস থ্রির ছাত্র? বড় ভাবনায় পড়িলাম। এখন করা যায় কী? এতদূর অগ্রসর হইয়া পিছাইয়া পড়া বড়ই লজ্জা ও অপমানের বিষয় হইবে। অনেক চিন্তা-ভাবনা করিয়া বুঝিলাম, মিতা হওয়ার কথাটা হাজী সাহেব বিবেচনা করিয়াছেন। তাই আমাকে বাকি দিতে না পারিয়া তিনি দুঃখিত হইয়াছেন। তা হইলে বাকি দিবার ইচ্ছা হাজী সাহেবের আছে। শুধু আমাকে নাবালক সন্দেহ করিয়াই হাজী সাহেব দ্বিধায় পড়িয়াছেন কিন্তু আমি যে সত্যই নাবালক সেটা হাজী সাহেবের সন্দেহমাত্র। এই সন্দেহ দূর হইলেই তিনি আমাকে বাকি দিবেন। অতএব আমি লিখিলাম : মিতাজি, আপনি আমার বয়স সম্বন্ধে ভুল বুঝিয়াছেন। আমি নাবালক ছাত্র নই। আমি পঁয়ষট্টি বছর বয়সের বৃদ্ধ। আমি আহমদীয়া লাইব্রেরির মালিক। এটা খুব বড় পুরাতন পুস্তকের দোকান।
দাদাজীর আনুমানিক বয়সটাই নিজের বয়সরূপে চালাইয়া দিলাম। কম্পিত বুকে চিঠিটা পোস্ট করিলাম। জবাবের আশায় প্রবল আগ্রহে কানখাড়া রাখিলাম। দুই-একদিন পর-পর পোস্টাফিসে খবর লইতে লাগিলাম। শেষ পর্যন্ত জবাব আসিল। কিন্তু এবারের চিঠি বরাবরের মত পোস্টকার্ডে না। তার বদলে নীল রঙের ইনভেলাপ। কম্পিত হস্তে চিঠিটা খুলিলাম। চিঠিটা নীল রঙের। বরাবর কার্ডের লেখা থাকে এক হাতের, দস্তখতটা অন্য হাতের। দস্তখতের নিচে রবার স্ট্যাম্প মারা। ইতিমধ্যে আতিকুল্লাহর নিকট আমি রবার স্ট্যাম্প দেখিয়াছি। কিন্তু এবারের নীল রঙের পত্রটা আগাগোড়া এক হাতের লেখা। তাতে কোনও রবার স্ট্যাম্প নাই। আমি একদমে চিঠিটা পড়িয়া ফেলিলাম। চিঠিতে আমাকে সম্বোধন করা হইয়াছে। এইভাবে : ‘আমার প্রাণের ক্ষুদে মিতাজি’। তারপর আমার শতকোটি আন্তরিক দোওয়া-স্নেহ জানিবা,’ বলিয়া শুরু করিয়া বিশেষ স্নেহপূর্ব মোলায়েম ভাষায় লিখিয়াছিলেন, তার সব কথা মনে নাই। কিন্তু তার সারমর্ম ছিল এইরূপ : এত অল্প বয়সে পুস্তক বিক্রয় বা অন্য কোনও ব্যবসায়ের দিকে খেয়াল না দিয়া আমি যেন মন দিয়া লেখাপড়া করি। হাজী সাহেবের দৃঢ় আশা ও বিশ্বাস, আমি যদি মন দিয়া পড়াশোনা করি, তবে আমি ভবিষ্যতে পুস্তকের দোকানদারি না করিয়া পুস্তকের লেখক হইতে পারিব। তিনি এই মর্মে আল্লার দরগায় সর্বদাই মোনাজাত করিতেছেন। পত্রের নিচে তিনি লিখিয়াছেন : দোওয়াগো তোমার বৃদ্ধ মিতা। তার নিচেই বরাবরের মত দস্তখত।
হাজী সাহেব নিশ্চয়ই বহুদিন আগেই বেহেশতবাসী হইয়াছেন। আজ প্রায় তার সমান বয়সের বৃদ্ধ হইয়া এখন মনে পড়িতেছে, বৃদ্ধ মিতার ঐ আশীর্বাদ-পত্রখানা আমার সযত্নে রক্ষা করা উচিৎ ছিল। কিন্তু সযত্নে রক্ষা করার বদলে আমি কী করিয়াছিলাম? অতি সাবধানে ও সঙ্গোপনে আমি চিঠিটা পুনঃপুন পড়িলাম। যতই পড়িলাম, ততই মনে হইল, হাজী সাহেবের ঐ চিঠিটা চিৎকার করিয়া আমাকে জনসমক্ষে তিরস্কার করিতেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস হইল, চিঠিটা আমার মস্ত বড় একটা কুকর্মের জাজ্বল্যমান সাক্ষী। এই মুহূর্তে ঐ সাক্ষী একদম গায়েব না করিলে যেন আমার আর রক্ষা নাই। কাজেই বিনা দ্বিধায় আমি চিঠিটা টুকরা-টুকরা করিয়া টুকরাগুলি আবার টুকরা করিয়া, আবার টুকরা করিয়া, অতি সাবধানে বাড়ির পুকুরে ডুবাইয়া দিলাম। যতক্ষণ সবগুলি টুকরা ভিজিয়া লুথা ও সাদা হইয়া পানিতে না ডুবিল, ততক্ষণ আমি ঐ স্থান ত্যাগ করিলাম না।
এইভাবে বাহিরের সাক্ষী নিশ্চিহ্ন করিলাম বটে, কিন্তু আমার ভিতরের সাক্ষী ত বাঁচিয়া থাকিল! বহুদিন পর্যন্ত হাজী সাহেবের চিঠিটা সময় পাইলেই আমার চোখের সামনে ভাসিয়া উঠিত। ঐ চিঠির প্রত্যেক লাইন, প্রত্যেক শব্দ, এমনকি প্রতিটি হরফ, বিকট অট্টহাসিতে আমাকে তিরস্কার করিত। আজ মনে হইতেছে, আমি ভুল বুঝিয়াছিলাম : ওটা তিরস্কার ছিল না, ছিল আশীর্বাদ।
.
১১. উচ্চতর পরিবেশ
১৯১৩ সালে ময়মনসিংহ পড়িতে আসিয়া আমার সাহিত্যচর্চার নিশা আরো বাড়িয়া যায়। বাসায় শামসুদ্দীন ও সাঈদ আলী সাহেবের সাহচর্য এবং স্কুলের শিক্ষকের উপদেশ দুইটাই সাহিত্য-সাধনার অনুকূল ও উপযোগী ছিল। শামসুদ্দীন ও সাঈদ আলী সাহেব নিজেরা বই-পুস্তক কিনিতেন। মাসিক কাগজ লইতেন। সাঈদ আলী সাহেব সম্পর্কে আমার চাচা, বয়সেও কিছু বড়, পড়িতেনও উপরের ক্লাসে। কাজেই সাহিত্য আলোচনা ও রসালাপ তার সাথে হইত না। সেটা সীমাবদ্ধ থাকিত আমার ও শামসুদ্দীনের মধ্যে। তবে সাঈদ আলী সাহেব তার কিনা বই-পুস্তক আমাদেরে পড়িতে দিতেন। আমাদের কিনা পুস্তকও পড়িতে নিতেন। এই সময় আমরা পরস্পরের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া কিনিতাম যাতে তিনজন একই বই কিনিয়া না ফেলি। আমি আগে হইতেই প্রবাসীর গ্রাহক ছিলাম বলিয়া শামসুদ্দীন সুরেশ সমাজপতির সাহিত্য ও সাঈদ আলী সাহেব প্রমথ চৌধুরীর (বীরবলের) সবুজ পত্র-এর গ্রাহক হইলেন। আমি প্রবাসীর ও শামসুদ্দীন সাহিত্য-এরও গ্রাহক হওয়ায় আমাদের সাহিত্যিক মতও যার-তার কাগজের দ্বারা প্রভাবিত হইয়াছিল। কবি হিসাবে আমি রবীন্দ্রনাথের ভক্ত হইলাম। শামসুদ্দীন অক্ষয় বড়ালও ডি এল রায়ের সমর্থক হইল। ফলে এই সময় রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইয পাওয়ায় আমি যতটা খুশি হইলাম, শামসুদ্দীন তা হইল না। নিজেরা বই-পুস্তক কিনায়। আমাদের অনেক বন্ধু জুটিল। অবশ্য বন্ধুদের মধ্যে হিন্দুই ছিল বেশি। তাদের সাথে আমাদের বই-পুস্তক আদান-প্রদান হইত। তার ফলে শহরে যাওয়ার এক বছরের মধ্যে আমি বঙ্কিমচন্দ্রের বিষবৃক্ষ, দুর্গেশ নন্দিনী ও রাজসিংহ, রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি, নৌকাডুবি ও গোরা, কালীপ্রসন্ন ঘোষের প্রভাত চিন্তা, নিশীথ চিন্তা, চন্দ্র শেখর করের উদভ্রান্ত প্রেম, কায়কোবাদের অশ্রুমালা ও মহাশোন, মাইকেলের মেঘনাদবধ নবীনচন্দ্রের পলাশীর যুদ্ধ, হেমচন্দ্রের বৃত্রসংহার ইত্যাদি কাব্য-উপন্যাস পড়িয়া ফেলিলাম। এ ছাড়া অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়ের সিরাজদ্দৌলা ও মীর কাসিম ইত্যাদি ইতিহাস গ্রন্থও আমি কিনিয়াছিলাম। মাইকেলের মুসলমান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে আমরা কেউ ডা. আবুল হোসেনের যমজভগ্নি কাব্যও কিনিয়াছিলাম। এসব পুস্তক ছাড়া আমি মাস্টার মশায়দের মুখে নাম শুনিয়া স্কটের আইভানহো, টেলিসম্যান, মেরি কোরেলির সরোয-অব-স্যাটান, জর্জ ইলিয়টের অ্যাডাম বিডিইত্যাদি ইংরাজি নভেল স্কুল লাইব্রেরি হইতে আনিয়া পড়িবার চেষ্টা করিয়াছিলাম। বন্ধু-বান্ধবদেরে দেখাইয়াও ছিলাম যে ঐসব বই আমি বুঝিতে পারি।
.
১২. বঙ্কিমচন্দ্রের প্রভাব
লোকমুখে শুনিয়া এবং মুসলমান সাপ্তাহিক খবরের কাগজ পড়িয়া আমি বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি খুব বিরূপ ছিলাম। তাকে আমরা মুসলিম-বিদ্বেষী বলিয়াই জানিতাম। দুর্গেশ নন্দিনী ও রাজসিংহ পড়িয়া সে বিষয়ে আমার আর কোনও সন্দেহ থাকিল না। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায় খুবই আকৃষ্ট হইয়া পড়িলাম। অবশ্য তৎকালের অন্যান্য লেখক যথা কালীপ্রসন্ন ঘোষ ও চন্দ্রশেখর কর প্রভৃতির ভাষাও খুব ভাল লাগিত। এমনকি বিদ্যাসাগরের সীতার বনবাস-এর ভাষাও আমার কাছে খুব মধুর লাগিত। এটা আমাদের পাঠ্য বহি ছিল। কিন্তু এঁদের মধ্যে সবচেয়ে মজাদার লাগিল আমার কাছে বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা। বিশেষত দুর্গেশ নন্দিনীর ভাষায় আমি মুগ্ধ হইয়াছিলাম তাঁর বাণী-বন্দনা আমার মুখস্থ ছিল। এটা উদ্ধৃত করিবার সময় আমি ধবল’ কথাটা যোগ করিয়া বলিতাম : হে বাগদেবী, হে কমলাসনে, অমলধবল-কমল-দল-নিন্দিত-চরণ-ভকত-জন বসলে ইত্যাদি ইত্যাদি। বন্ধুবান্ধব ও শিক্ষকদের কেউ কেউ ঐ ‘ধবল’ শব্দ দুর্গেশ নন্দিনীতে নাই বলিয়া আমার ভুল ধরিতেন। কিন্তু আমি সেদিকে কান দিতাম না। এইভাবে সমাসবহুল শব্দরচনা আমার ও শামসুদ্দীনের তখন একটা নিশা হইয়া গিয়াছিল। আমরা স্কুলের রচনায় এমনকি, পরীক্ষার খাতায়ও সমাসবহুল শব্দ প্রয়োগ করিতাম। প্রতিযোগিতায় আমরা এমনি মাতিয়াছিলাম যে, শামসুদ্দীনের চৌষট্টি হরফের শব্দের জবাবে আমি একশ আট হরফের শব্দ রচনা করিয়াছিলাম। পঞ্চাশ-ষাট হরফের শব্দ ত আমাদের ডাল-ভাত হইয়া গিয়াছিল। এইভাবে আমরা স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্রকে হারাইয়া দিয়াছিলাম। কারণ তাঁর সব চেয়ে বড় শব্দেও পঁচিশটার বেশি হরফ নাই।
আমাদের বাংলার শিক্ষক বাবু বিপিন চন্দ্র রায় আমার সাহিত্য-প্রীতির জন্য আমাকে খুবই স্নেহ করিতেন। তিনি আমাকে সব সময়ে উৎসাহ ও উপদেশ দিতেন। রচনার মুনশীয়ানার জন্য তিনি তাঁর সহকর্মী ও বন্ধুদের নিকটও আমার তারিফ করিতেন। আমার সমাস-বহুলতার প্রশংসা করিয়াও তিনি আমাকে মাত্রাধিক্য বর্জন করিতে পরামর্শ দিতেন। আমি তাঁর অন্য সব উপদেশ পালন করিলেও এ ব্যাপারে তা অমান্য করিতাম।
.
১৩. কাব্য-সাধনা
কবিতা না লিখিয়া শুধু গদ্য রচনা করিলে সাহিত্যিক হওয়া যায় না, এই ছিল। তকালের জনমত। বস্তুত সাহিত্যিকের জীবন আরম্ভই হয় পদ্য রচনা হইতে। আমার বেলাও তাই হইয়াছিল। গোপনে-গোপনে কবিতা লিখিয়া বিভিন্ন কাগজে পাঠাইতে লাগিলাম। কোনও দিন ছাপা হয় নাই। ছাপা না হওয়ার দরুন নিজের কবি-প্রতিভার প্রতি শ্রদ্ধা হারাইতাম না। সম্পাদকদের পক্ষপাতিত্ব ও নির্বুদ্ধিতাকেই সেজন্য দায়ী করিতাম।
গ্রামে থাকিতে প্রথমে অবশ্য পুঁথির অনুকরণে মিত্রাক্ষর ছন্দে পয়ার, ত্রিপদী, একাবলি ইত্যাদি মাত্রায় কবিতা লিখিতাম। ময়মনসিংহ শহরে আসিবার পর মাইকেল, নবীনচন্দ্র, হেমচন্দ্র ও কায়কোবাদের বই পড়িবার পর অমিত্রাক্ষর ছন্দে কবিতা লিখিতে শুরু করি। অমিত্রাক্ষর ছন্দে কবিতা লিখিবার নিয়ম প্রচলন করায় মাইকেল ও তার অনুসারী কবিদের প্রতি মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানাইলাম। কারণ পয়ার, ত্রিপদীর চেয়ে মিলহীন কবিতা লেখা অনেক সোজা বলিয়াই ছিল তৎকালে আমার বিশ্বাস। পদান্ত মিল সম্বন্ধেও আমার এবং তৎকালীন সমস্ত বন্ধু-বান্ধবের ধারণা স্পষ্ট ছিল না। ‘খালে’ ‘বিলে’ মিল দিতে তখন আমরা লজ্জা পাইতাম না। ময়মনসিংহ শহরে আসিবার পরই সর্বপ্রথম এ বিষয়ে আমার চোখ খোলে। অতুল চন্দ্র। চক্রবর্তী নামক আমাদের বাংলার শিক্ষক একদিন অধম মিলের কবিতাকে বিদ্রূপ করিয়া এই কবিতা আবৃত্তি করেন : কাঁঠালের ঠোঙ্গা নিয়া নাচে নন্দলাল, ফস্ করে নিয়া গেল এক বেটা চিল্। কাঁঠালের’ জায়গায় মিঠাই’ বসাইয়া অনেককেই এই কবিতা পরবর্তীকালে আবৃত্তি করিতে শুনিয়াছি। কিন্তু আমি জীবনের প্রথমে অতুল বাবুর মুখে ইহা এইভাবেই শুনি। অতুল। বাবুর উচ্চারণ ও আবৃত্তি এতই বিদ্রুপাত্মক হইয়াছিল যে, অধম পদান্ত মিলের হাস্যকরতা না বুঝিবার কোনও উপায় ছিল না।
ফলে অতঃপর পদান্ত মিল সংগ্রহে খুবই সাবধান হইলাম। তার ফলে পদান্ত মিল দেওয়া খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার হইয়া গেল। শব্দের তালাশে অভিধানে অভিযান চালাইতে হইল। স্কুল-পাঠ্য ছোটখাটো অভিধানে পোষাইল না। এই সময়ে সমাস-বহুল বৃহত্তম শব্দরচনার উদ্দেশ্যেও অষ্টপ্রহর অভিধান খুঁজিতে হইত। এই দুই কারণে আমি তঙ্কালীন বৃহত্তম দুইটা বাংলা অভিধান ‘প্রকৃতিবোধ’ ও ‘প্রকৃতিবাদ কিনিলাম। শব্দকোষ বা এই নামের একটি অভিধান কিনিল শামসুদ্দীন। এই সব অভিধান ঘাটিয়া এমন সব অজানা নূতন শব্দ আবিষ্কার করিতাম ও গদ্য রচনায় ব্যবহার করিয়া বসিতাম, যার অর্থ অনেক সময় নিজেই বলিতে পারিতাম না। কিন্তু পদান্ত মিল সম্বন্ধে ক্রমে এতটা সচেতন হইয়া গেলাম যে, অর্থহীন শব্দ প্রয়োগের দ্বারা হইলেও পদান্ত মিল সুন্দর করিতে হইবে, ইহাই হইয়া উঠিল আমার মতবাদ। অতুল বাবুর বক্তৃতা শুনিবার এবং এ সম্পর্কে শামসুদ্দীন ও অন্যান্য কবি-বন্ধুর সহিত আলাপ করিবার পর আমার বাল্যের ভুলিয়া-যাওয়া স্মৃতিকথা মনে পড়িল। ছেলেবেলা চাচাজীর মুখে আমাদের বাড়ির মাদ্রাসার মৌলবীদের মুখে এবং বিশেষ করিয়া মৌলবী এরফান আলী নামে আমার এক ফুফাত ভাইয়ের মুখে আমি বহু ফারসি কবিতা শুনিয়াছিলাম। আমি অর্থ না বুঝিয়া তার অনেকগুলি নিজেও আবৃত্তি করিতাম। এতদিনে গুন-গুন করিয়া মনে-মনে আবৃত্তি করিয়া দেখিলাম, ওগুলির পদান্ত মিল অতি সুন্দর। বাংলা কবিতায়, ‘চিল’ ও ‘বিল’, ‘খাল’ ও ‘লাল’ এইরূপ দুই হরফের মিল হইলেই চমৎকার পদান্ত মিল হইল। কিন্তু ফারসিতে বহু কবিতার শেষের চার হরফে পর্যন্ত মিল আছে। কোনও কোনও কবিতার দুইটা লাইনের প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত আগাগোড়াই মিল। তখন লাইনগুলিরও কোন-কোনটা মনে পড়িয়াছিল। কিন্তু এই বুড়া বয়সে এই বই লেখার সময়ে হাজার মাথা কুটিয়াও একটা লাইন বা তার অংশ মনে করিতে পারলাম না। হাতের কাছে ফারসি বইও দু-চারটা নাই যা হইতে দৃষ্টান্ত দেখাইতে পারি। তবু ব্যাপারটা এবং মিলের ধরনটা দেখাইবার জন্য অর্থ নির্বিশেষে কয়েকটি অক্ষর-সমষ্টির উল্লেখ করিতেছি। যথা : ‘গেরেফ তানের’ সঙ্গে ‘সেরেফ খান’, ‘আকরিব’-এর সঙ্গে ফান ফরিব’। পরওয়ারদিগারের সঙ্গে ‘সরওয়ারনিগার’-এর পদান্ত মিল হইলে চমৎকার হইবে। এতে পাঁচ-ছয় অক্ষর হইতে আট-নয় অক্ষর পর্যন্ত মিল হইয়া যাইবে।
পয়ারের দুই পদের আগাগোড়া মিলের লাইন মোটেই মনে পড়িতেছে না। তবে সেটার কল্পিত রূপ এই :
খাতায়ে বুযুর্গান গেরেফতান খাতাস্ত;
আতায়ে হুযুর খান সেরেফ জান আতাস্ত!
শুধু মিল দেখাইবার জন্য এই ‘কবিতা’। কাজেই দুসরা ছতরের অর্থ বুঝিবার চেষ্টা করিবেন না। এই ধরনের পয়ার রচনায় যে কী পরিমাণ মুনশীয়ানা ও শব্দ-জ্ঞান-প্রয়োজন, তা ভাবিয়া বিস্মিত হইতাম। কিন্তু উহার অনুকরণে হাজার চেষ্টা করিয়াও সফল হইতাম না। অথচ অন্তত পাঁচ-ছয় অক্ষরে পদান্ত মিল না দিয়া কবিতা রচনায় মনও উঠিত না।
.
১৪. মাইকেলের প্রভাব
এমন বিপদের দিনে মাইকেল মধুসূদন আসিলেন আমার বিপত্তারক হিসাবে। প্রথমে তার একাকিনী শোকাকুলা অশোক কাননে’, পড়িলাম পাঠ্যবইয়ে। তারপর আস্ত মেঘনাদবধ কাব্যটাই পড়িয়া ফেলিলাম। তারপর এক-দুই করিয়া পলাশীর যুদ্ধ, বৃত্রসংহার ও মহাশ্মশান কাব্য পড়িলাম। নবীনচন্দ্র ও কায়কোবাদের কবিতা মাইকেলের কবিতার চেয়ে সহজ লাগিল। মাইকেলের কবিতা তুলনায় অনেক কঠিন। কঠিন বলিয়াই উহাকে শ্রেষ্ঠতর কাব্য মনে হইল। কারণ কবিতায় যত বেশি কঠিন শব্দ থাকিবে, কবিতা পড়িতে পাঠককে যত বেশি অভিধান দেখিতে হইবে, যত দুর্বোধ হইবে, কবিতা তত উৎকৃষ্ট হইবে, ইহাই ছিল আমার ধারণা। আমি অমিত্রাক্ষর ছন্দে যথাসম্ভব দুর্বোধ্য কবিতা রচনা করিতে লাগিলাম। তাতে যথেষ্ট নাম হইল। মাসিক কাগজের সম্পাদকরা আমার কবিতা না ছাপিলেও বিবাহ-মজলিসে আমার আদর ছিল। বিভিন্ন স্থান হইতে চেনা-অচেনা অনেক লোক প্রীতি উপহার’ লেখাইতে আমার কাছে আসিত। আগ্রহের সঙ্গে তাদের ফরমায়েশ পালন করিতাম। রাত জাগিয়া নিজের কাগজ-কলম খরচ করিয়া কবিতা লিখিতাম। অত খাটুনির ফল কবিতাটা ছাপার ভুলের জন্য নষ্ট না হয়, সেজন্য প্রেসে গিয়া প্রুফ দেখিয়া দিতাম।
বিবাহের ‘প্রীতি উপহার’ লিখিতে গিয়া এবং প্রেম-ভালবাসার কবিতা লিখিতে গিয়া বুঝিলাম অমিত্রাক্ষর ছন্দে তা চলে না। প্রেম-ভালবাসার মর্ম অবশ্য তখনও বুঝিতাম না। কিন্তু তাতে প্রেমের কবিতা লিখিতে কোনও অসুবিধা হইত না। কোকিল-পাপিয়া না দেখিয়াই ওদেরে সম্বোধন করিয়া যেমন অনেক কবিতা লিখিলাম, কোনও সুন্দরী না দেখিয়াও তেমনি তাকে সম্বোধন করিয়াও অনেক কবিতা লিখিলাম। বলা বাহুল্য, এসবই বড়-বড় কবিদের অনুকরণমাত্র।
.
১৫. পুস্তক বাইন্ডিং
কবিতা লেখার সঙ্গে নাটক-নভেল পড়াও সমান জোরে চলিতে লাগিল। শামসুদ্দীন, সাঈদ সাহেব ও আমি পুস্তক খরিদে প্রচুর অর্থ ব্যয় করিতাম। তাতে আমাদের তিনজনেরই নিজস্ব লাইব্রেরি গড়িয়া উঠে। শামসুদ্দীনের ও আমার লাইব্রেরি পুস্তক-সংখ্যা সাঈদ মিঞাকে অনেক ছাড়াইয়া যায়। এর একটা গুপ্ত কারণও ছিল। পয়সা দিয়া কিনা ছাড়াও আমি ও শামসুদ্দীন অন্য উপায়ে পুস্তক সংগ্রহ করিতাম। অন্যের নিকট হইতে ধার করিয়া আনা কোনও পুস্তক খুব পছন্দ হইলেই আমরা কয়েক হাত ঘুরাইয়া বইটি শেষ পর্যন্ত গায়েব করিয়া ফেলিতাম। কয়েক দিন গুপ্ত থাকিয়া অন্য চেহারায় সেই বই আসিয়া আমার অথবা শামসুদ্দীনের লাইব্রেরিতে স্থান পাইত। শামসুদ্দীন ও আমার মধ্যে এ কাজের ‘কোড ল্যাংগুয়েজ ছিল বাইন্ডিং করা। অর্থাৎ ঐ বইটির মলাট ছিঁড়িয়া ফেলিয়া নূতন করিয়া বইয়ের আকারভেদে চামড়ার ফুল বাধাই, হাফ বাধাই ও টিশ বাধাই করাইয়া ফেলিতাম এবং প্রয়োজনবোধে সোনালি-রুপালি হরফে নিজেদের নাম লেখাইয়া ফেলিতাম। এ কাজে আমরা দুইজন এমন সিদ্ধহস্ত হইয়াছিলাম যে, আমাদের বন্ধু বান্ধবদের কেউ কোনও ভাল বই হারাইলেই আমি ও শামসুদ্দীন পরস্পরকে সন্দেহ করিতাম। চোখ ঠারাঠারি করিয়া জিজ্ঞাসা করিতাম : ‘কিহে বাইন্ডিং করিয়া ফেলিয়াছ নাকি?’ এইরূপ বাইন্ডিং করানোর কাজে যে আমরা শুধু পুরাতন ছেঁড়াছুটা বইই বাঁধাই করাইতাম তা নয়, অনেক নূতন বইয়েরও ভাল বাঁধাই খুলিয়া ফেলিম এবং সম্পূর্ণ নূতন ধরনে নূতন বাঁধাই করিতাম। এ কাজে আমাদের বিশ্বস্ত দফতরি ছিল। কিন্তু সব ব্যাপারে শুধু দফতরির উপর নির্ভর করিয়া নিশ্চিন্ত থাকিতাম না। দফতরির হাতে দিবার আগেই বাঁধাই ভোলা হইতে শুরু করিয়া বইয়ের ভিতরে নাম লেখা নিশ্চিহ্ন করা পর্যন্ত সব কাজ নিজ হাতে করিতাম। প্রয়োজন হইলে দুই-এক পাতা বা পাতার অংশ ছিঁড়িয়া ফেলিতাম। এ কাজে আমাদের লোভ ও দক্ষতা এমন। বাড়িয়া গিয়াছিল যে, স্কুল-কলেজের লাইব্রেরি-কমন রুমে বা পাবলিক পাঠাগারে কোনও বই আমাদের একজনের পছন্দ হইলে অপর জনকে বলিতাম : বইখানা বাইন্ডিং করার যোগ্য হে’। অতঃপর দুই বন্ধুতে ঐ বইখানা বাইন্ডিং করার সুবিধা-অসুবিধা, বিপদ-আপদ চারদিক চিন্তা করিতাম। অবস্থা গতিকে বাইন্ডিং করার লোভ অনেক ক্ষেত্রেই ত্যাগ করিতে হইয়াছে। এ সব ক্ষেত্রে ইসু-করা পুস্তক একাধিকবার রিইসু করাইয়া দীর্ঘদিন একজনের কাছে রাখিয়াছি। নিয়মে না কুলাইলে দুজনের নাম বদলা-বদলি করিয়াছি। তবু বইখানা নিজেদের হাতছাড়া করি নাই। বেশ কিছুদিন এইভাবে রাখিয়াও যখন বাইন্ডিং করার কোনও নিরাপদ পন্থা বাহির করিতে পারি নাই, তখন বাধ্য হইয়া বই ফেরৎ দিয়াছি। প্রিয়জনকে দাফন করিতে গোরস্তানে লইয়া যাইবার সময় মানুষ যেমন শোকে মুহ্যমান থাকে, আমরা দুইজন তেমনি মুহ্যমান অবস্থায় বইখানা ফেরৎ দিতে গিয়াছি।
.
১৬. চোরের উপর বাটপারি
এইভাবে আমরা দুইজন নিজ-নিজ ব্যক্তিগত লাইব্রেরি এত বড় করিয়া ফেলিয়াছিলাম যে, তৎকালে আমাদের সহপাঠী, পরিচিত বা বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে কারো এত পুস্তক-সম্পদ ছিল না। বলা আবশ্যক, আমাদের লাইব্রেরির আয়-ব্যয়, জমা-খরচ ও হ্রাস-বৃদ্ধিও ছিল। অর্থাৎ আমাদের পুস্তকও হারাইয়া যাইত। সে সব পুস্তকও ‘বাইন্ডিং’ হইয়া যাইত কিনা বলা কঠিন। কারণ যাঁরা। আমাদের বই গায়েব করিতেন, তাঁরা আর যাই করুন, বাইন্ডিং করার ফন্দি তাঁদের মস্তিষ্কে ঢোকার কথা নয়। এটা ছিল আমার-শামসুদ্দীনের নিজস্ব আবিষ্কার। আমাদের বন্ধু-বান্ধবরা ছিল সবাই সাধারণ শ্রেণীর মামুলি পাঠক। আমাদের দুইজনের মত ‘প্রতিভাশালী’ কেউ ছিল না। ঐসব মামুলি পুস্তকের কিড়ারা-ফন্দি আবিষ্কারে আমাদের ধারে-কাছে আসিতেই পারে না। কাজেই তাদের চুরি ছিল মামুলি চুরি। ফলে কালে-ভদ্রে আমাদের হারান পুস্তক দু একটা ধরাও পড়িয়াছে। কিন্তু আমাদের চুরি ছিল আর্টিস্টিক। ধরা পড়িবার কোনও সম্ভাবনা ছিল না।
কিন্তু আমাদের কিছু বই সত্য-সত্যই বাইন্ডিং হইয়াছিল। কারণ এটা। আমরা নিজেরাই করিতাম। অর্থাৎ আমরা দুই বন্ধু বাইন্ডিং কাজে এমন মত্ত হইয়া উঠিয়াছিলাম যে, এক বন্ধু আরেক বন্ধুর উপর হাত সাফাই করিতে দ্বিধা করিতাম না। তবে দুর্নিবার প্রলোভন না হইলে এ কাজ করিতাম না। করিলে এত সাবধানে করিতাম যাতে কিছুতেই ধরা না পড়ি। ধরা পড়িলে আত্মহত্যা করিয়াও লজ্জা নিবারণ করা যাইবে না। কারণ আমার ধারণা, আমিই শুধু শামসুদ্দীনের বই বাইন্ডিং’ করিয়া ঘুমন্ত বন্ধুর পিঠে ছুরি মারিতেছি। কাজেই সময়ে সাবধান হইলাম। হোস্টেলে পুস্তকের স্টক বুকশেলফ হইতে পোর্টমেন্টে তুলিলাম। বাড়িতে বৈঠকখানার আলমারি অন্দর বাড়িতে নিয়া গেলাম। তাতে তালা-চাবি লাগাইলাম। তার পর একদিন নিতান্ত দৈবাৎ জানিতে পারিলাম আমার একখানা ভাল বই শামসুদ্দীন বাইন্ডিং’ করিয়া ফেলিয়াছে। নিজের চক্ষুকে বিশ্বাস করিতে পারিলাম না। কিন্তু অল্পক্ষণেই সে ভাব কাটিয়া গেল। বুকের উপর হইতে একটা পাপের বোঝা নামিয়া গেল। শুধু আমিই শামসুদ্দীনের বই বাইন্ডিং’ করিয়া ঘুমন্ত সরল বিশ্বাসী বন্ধুর ডাকাতি করিতেছি বলিয়া আমি মনে-মনে শামসুদ্দীনের নিকট অপরাধী ছিলাম। প্রতি কাজে প্রতি কথায় আমার বুকে সেটা কাঁটার মত বিধিত। আজ সেটা হইতে রক্ষা পাইলাম। নিজের প্রিয় জিনিস চুরি হইলেও যে তাতে আনন্দ পাওয়া যায়, এই অভিজ্ঞতা লাভ করিলাম আমি ঐদিন।
আমি কিছু বলিলাম না। কিন্তু অতঃপর আমার কথাবার্তায় ও চাল-চলনে শামসুদ্দীনের মনে সন্দেহ সৃষ্টি হইল। শেষ পর্যন্ত সে কথাটা নিজেই স্বীকার করিল। আমি তার সব কথা শুনিয়া বুঝিলাম সেও নিজেকেই একা অপরাধী মনে করে। আমি যে তার অনেক ভাল বই বাইন্ডিং’ করিয়া ফেলিয়াছি সে ঘুণাক্ষরেও তেমন সন্দেহ করে নাই।
অতঃপর দুই বন্ধুর কনফেশনের পালা। কে কার কতখানা বই বাইন্ডিং করিয়াছি, তার খতিয়ান করা হইল। দেখা গেল : কেহ কারে নাহি পারে, সমানে সমান। দুই জনের খতিয়ান প্রায় কাছাকাছি।
দুই বন্ধু খুব জোরে হ্যান্ডশেক করিলাম। বলিলাম : কুচপরওয়া নাই। তোমার বই আমার বই, আমার বই তোমার বই। আমাদেরটা জয়েন্ট লাইব্রেরি।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের দুইজনের লাইব্রেরির একটাও টিকে নাই চুরিতে যে লাইব্রেরি গড়িয়া উঠিয়াছিল, ডাকাতিতে তা শেষ হইল। এ ডাকাতি শুরু হইল, চাকরি ও ব্যবসা উপলক্ষে আমরা বাড়ি ছাড়িবার পর হইতে। কারণ আমাদের বইগুলি লোকেরা নিল বলিয়া-কহিয়া। যিনি নিলেন তিনি আর ফেরৎ দিবার নামটি করিলেন না। আমরা টাকা-কড়ি খরচ করিয়াই বই কিনিতাম। যেগুলি বাইন্ডিং’ করিতাম, তাতেও বেশ পয়সা খরচ হইত। তারপর আমাদের নাম বহন করিয়াই আমাদের লাইব্রেরিতে থাকিত। কিন্তু আমাদের যে সব বন্ধু ও আত্মীয়েরা আমাদের পুস্তক নিয়াছেন, তাঁরা
বাইন্ডিং’-এ টাকা খরচ করেন নাই বলিয়া তাদের বাড়িতে বসিয়াই আমাদের পুস্তকগুলি আমাদেরেই বুড়া আঙুল দেখাইতেছে।