১৩. সাহিত্য-সাধনা

অধ্যায় তের – সাহিত্য-সাধনা

১. কবি হওয়ার অপচেষ্টা

ছাপার হরফে নিজের নাম দেখার ইচ্ছা বোধ হয় সব মানুষেরই ছেলেবেলার উচ্চাকাঙ্ক্ষা। বিশেষত কবি-সাহিত্যিক হওয়া যাদের শখ তাদের ত নিশ্চয়ই। আমারও এই শখ ছিল খুব তীব্র। কবি হিসাবে নাম প্রকাশ করিবার আশায় বিভিন্ন মাসিক কাগজে নিজ নামে অনেক কবিতা পাঠাইয়াছি। নিজ নামে ছাপা না হওয়ায় ধারণা হইয়াছে, হিন্দু সম্পাদকরা মুসলমান কবিদের কবিতা ছাপাইবেন না। মুসলমানকে ওরা দু’চোখে দেখিতে পারেন না। কাজেই অবশেষে হিন্দু নামে কবিতা পাঠাইতে লাগিলাম। সে ফন্দিও ব্যর্থ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত বড় বড় নাম করা কবিদের নামে কবিতা পাঠাইতাম। আমার যতদূর মনে পড়ে একবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম দিয়াও একটা কবিতা পাঠাইয়াছিলাম।

ছাপার হরফে নিজের নাম মাসিক পত্রিকায় দেখিবার আশাতেই এসব ফন্দি-ফিকির করিয়াছিলাম, বলা বোধহয় ঠিক হইবে না। কারণ ঐসব কবিতা যদি ছাপা হইতও, তবু তাতে আমার নাম থাকিত না। তবে কিসের আশায় এত শ্রম, এত কাগজ ও এক টিকিট ব্যয়? নিজের নাম নয়, নিজের কবিতা ছাপার হরফে দেখিবার জন্য। নিজের সৃষ্টির প্রতি মানুষের এমনি একটা টান বোধ হয় স্বাভাবিক ও সহজাত। সন্তান ও আর কেউ যদি বাপ মাকে নাও চিনে, তবু বোধ হয় বাপ-মারা নিজের সন্তানকে সুস্থ ও যশস্বী দেখিয়া এমনি একটা পুলকের রোমাঞ্চ অনুভব করিয়া থাকেন।

.

. গদ্যে প্রথম সাফল্য

যা হোক শেষ পর্যন্ত কবিতা লেখার দিকে ঝোঁক কমাইতে বাধ্য হইলাম। প্রবন্ধ ও গল্প লিখিতে চেষ্টা করিলাম। একটা লাগিয়া গেল। বোধ হয় ১৯১২ ১৩ সালের কোনও এক সময়ে নেতৃস্থানীয় সাহিত্যিক-আলেমরা ‘আঞ্জুমনে ওলামায়ে বাঙ্গালা’ নামে একটি সমিতি গঠন করেন এবং তার মুখপত্র রূপে আল-এসলাম নামে একটি মাসিকপত্র বাহির করেন। ১৯১৩ সালে এটা আমি প্রথম দেখি। মুসলমানদের নিজস্ব মাসিকপত্র বাহির হওয়ায় আমি উৎসাহিত হইয়া উঠিলাম। অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া এই কাগজে কবিতা না পাঠাইয়া একটি প্রবন্ধ পাঠান স্থির করিলাম। কারণ, ভয় হইল যদি একবার এই কাগজের সম্পাদক আমার লেখা না-পছন্দ করিয়া বসেন, তবে পরে হাজার ভাল লেখাও তিনি ছাপিবেন না। হয়ত বা নাম দেখিয়াই লেখাটা ফেলিয়া দিবেন, পড়িয়াও দেখিবেন না। অতএব প্রবন্ধই পাঠাইতে হইবে। অনেক খাঁটিয়া-খুটিয়া একটি প্রবন্ধ পাঠাইলাম। প্রথম গুলিতেই শিকার পড়িল। প্রবন্ধ ছাপা হইয়া গেল। শুধু ছাপা হইল না। পরবর্তী লেখাটার জন্য সম্পাদক সাহেব তাকিদ-পত্র লিখিলেন। সেদিন আমার আনন্দ দেখে কে? বন্ধু-বান্ধবের কাছে, এমনকি মুরুব্বিদের কাছে, আমার কদর কত! কলিকাতায় প্রকাশিত মাসিক কাগজে নিজের নামসহ প্রবন্ধ ছাপা হইয়াছে। সারা গায় রোমাঞ্চ হইল। তা দুই-এক দিনে কাটিল না। নিজের প্রবন্ধটা অন্তত কুড়িবার এবং ছাপার হরফে নিজের নামটা অন্তত হাজার বার পড়িলাম। যতই দেখিতে লাগিলাম, ততই ভাল লাগিতে লাগিল।

.

. অনুবাদ

অথচ প্রবন্ধটা কোনও মৌলিক নিজস্ব লেখা নয়। ওয়াশিংটন আর্ভিং-এর টেলস-অব আল-হামরা গ্রন্থের অংশবিশেষের অনুবাদমাত্র। কিন্তু সেটাও কম কৃতিত্বের বিষয় ছিল না। কারণ ঐ পুস্তকে বিষয়বস্তু ছিল স্পেনে মুসলিম স্থপতির বিশদ বর্ণনা। গ্রানাডা, কর্ডোভা, সেভিল ইত্যাদি স্পেনীয় প্রাচীন নগরীগুলিতে মুসলিম স্থপতির যেসব বিস্ময়কর নিদর্শন আছে, ঐ বইয়ে তার নিখুঁত ও বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া হইয়াছে। স্থপতি বিদ্যার বহু টেকনিক্যাল ইংরাজি শব্দ ঐ পুস্তকে দেদার ব্যবহার করা হইয়াছে। ঐ সব ইংরাজি শব্দের বাংলা শব্দ খুঁজিয়া পাওয়া কত কঠিন কাজ! কারণ অভিধান দেখিয়া শুধু ইংরাজি শব্দের বাংলা অর্থ বাহির করিলেই চলিবে না। আমাদের দেশেও মুসলিম স্থপতিতেও ঐসব শব্দের টেকনিক্যাল প্রতিশব্দ আছে। কাজেই এটা এমনিতেই দুরূহ ব্যাপার। আমার মত পনের-ষোল বছর বয়সের ক্লাস সেভেন-এইটের ছাত্রের পক্ষে এটা ছিল আরো কঠিন। তবু স্পষ্টতই আমার অনুবাদ ভাল হইয়াছিল। প্রমাণ, সম্পাদক সাহেব পরবর্তী প্রবন্ধের জন্য তাকিদ করিয়া পাঠাইয়াছেন। বাল্যের দুর্বলতা ও অহমিকাহেতু ঐ প্রবন্ধের কোথাও উহাকে অনুবাদ বলিয়া স্বীকার করা হয় নাই। ঐ বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থকারের নামও কোথাও উল্লেখ করা হয় না। স্পষ্টই বুঝা যায়, উহাকে মৌলিক প্রবন্ধ বলিয়া চালাইয়া দেওয়াই আমার অভিসন্ধি ছিল। নব্য সাহিত্যিক হিসাবে আমি যে ঐ কাজ করিয়া কত বড় রিস্ক নিয়াছিলাম, তা বুঝিবার মত বুদ্ধি ও বয়স তখনও আমার হয় নাই। আমি তখন জানিতাম না যে, নিজের মৌলিক প্রবন্ধরূপে না পাঠাইয়া ওয়াশিংটন আর্ভিং-এর অনুবাদরূপে চালাইলে তা সম্পাদক সাহেবের অধিক শ্রদ্ধা পাইত সুতরাং প্রবন্ধ ছাপা হওয়া এবং আমার নাম ছাপার হরফে বাহির হওয়া একরূপ নিশ্চিত ছিল। তা না করিয়া আমার মত অখ্যাতনামা নবীন লেখক তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রের মৌলিক প্রবন্ধরূপে পাঠাইয়া আমি উহার ছাপা হওয়ার চান্সকে শতকরা নিরানব্বই ভাগ কমাইয়া দিয়াছিলাম। তাতেও যে উহা সম্পাদক সাহেবের কাঠোর পরীক্ষায় পাশ করিয়াছিল এইটাই ঐ প্রবন্ধের, তার ভাষার, সুতরাং আমার কৃতিত্বের বিষয়।

.

. আল-এসলাম

কিন্তু তবু আল-এসলাম-এ প্রথমে কবিতা পাঠানোর মত রিস্ক এটা ছিল না। সেটা আমি পরে বুঝিয়াছিলাম। আল-এসলাম-এ প্রথম লেখা পাঠাইবার সময় কবিতার বদলে প্রবন্ধ পাঠাইবার বুদ্ধি কে দিয়াছিল, তা মনে নাই। যতদূর মনে পড়ে বুদ্ধি কেউ দেয় নাই। কারণ কারো বুদ্ধি চাই নাই। অবিবাহিত মেয়ের গর্ভপাত হওয়ার মতই নব্য-লেখকদের এ ধরনের ব্যাপার চরম গোপনীয় বিষয়। নিছক আল্লার মেহেরবানিতে নিজের মগজের ঢেউ’-এর জোরেই এ কাজ করিয়াছিলাম। এটা না করিয়া কবিতা পাঠাইলে কী হইত, সেটা বুঝিলাম কিছুদিন পরে। আঞ্জুমনে ওলামার অন্যতম নেতা, আল-এসলাম-এর ভারপ্রাপ্ত সহ-সম্পাদক ও মুদ্রাকর মৌ. মোযাফফর উদ্দিন আহমদ ময়মনসিংহ বেড়াইতে আসেন এবং আমার মত নগণ্য অচেনা লোককে খুঁজিয়া বাহির করেন। সুপারের খাতিরে তিনি হোস্টেলে সরকারি মেহমান। তিনি সকলের সামনে আমার তারিফ করেন। এবং কথায় কথায় বলেন : এই ছেলের যে বিশেষ গুণটায় আমরা এর সম্বন্ধে আশান্বিত হইয়াছি, সেটা এই যে, সাধারণ নব্য-লেখকদের মত সে কবি হওয়ার চেষ্টা করে নাই। নব্য-কবিদের জ্বালায় শান্তিতে সম্পাদকতা করা অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছে। কবিতার যে বস্তা আফিসে জমা হইয়াছে, তাই ঝটাইয়া ফেলিবার আমার লোকের অভাব। তার উপর কবিরা আফিসে গিয়া পর্যন্ত আমাকে ধাওয়া করে। আমার গা কাঁটা দিয়া উঠিল। গায়েবের মালিক আল্লাহকে মনে-মনে ধন্যবাদ দিলাম।

আল-এসলাম-এ গ্রানাডা-কর্ডোভার স্থপতি সম্বন্ধে কয়েকটা প্রবন্ধ বাহির হওয়ার পর ওদিককার প্রচেষ্টা বন্ধ হয়। এর পরে আমি ছোট-গল্প লেখায় মন দেই। এই সময় শরত্যাবুর পল্লী সমাজ পাঠ করি এবং ঐ একটি বই পড়িয়াই শরত্যাবুর ভক্ত হইয়া পড়ি। অতঃপর শরত্যাবুর বিভিন্ন বই পড়িয়া তার স্টাইল-এ এতই প্রভাবিত হই যে, পরবর্তীকালে শরবাবুর প্রভাব হইতে চেষ্টা করিয়াও মুক্তি লাভ করিতে পারি নাই।

.

. পিওর আর্টের বিতর্ক

১৯১৫ হইতে ১৯২০ সাল পর্যন্ত এই পাঁচ বছরে আমি বাংলা ও ইংরাজি সাহিত্যের কাব্য-উপন্যাসের বহুলাংশ পাঠ করিয়া ফেলি। বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল, রমেশ দত্ত, নবীনচন্দ্র ও হেমচন্দ্রের বসুমতী-প্রকাশিত গ্রন্থাবলি এই সময় হইতেই প্রকাশিত হয়। সে জন্য এঁদের সব বই পড়া তখন খুবই সহজসাধ্য ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, ডা. নরেশ সেন, নারায়ণ ভট্টাচার্য প্রভৃতির সামাজিক নভেল এবং দীনেন্দ্র কুমার রায় ও পাঁচকড়ি দে প্রভৃতির ডিটেকটিভ নভেল পৃথকভাবে হয় নিজের কিনিতে, নয় ত বন্ধু-বান্ধবকে দিয়া কিনাইতে হইত, অথবা স্কুল-কলেজ, লাইব্রেরি ও পাঠাগার হইতে সংগ্রহ করিতে হইত। প্রাইভেট পাঠাগারের মধ্যে এই সময় ঢাকাস্থিত সারস্বত সমাজের লাইব্রেরিটি উল্লেখযোগ্য। এতে অনেক বই পাওয়া যাইত। বাবু পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য নামক এক ভদ্রলোক এই সময় ঐ লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান ছিলেন। তিনি আমাকে পঠিতব্য পুস্তক নির্বাচনে অনেক সাহায্য করিয়াছেন। কলেজ লাইব্রেরি হইতে এই সময় হল কেইন, মেরি কোরেলি, স্কট, জর্জ ইলিয়ট, টমাস হার্ডি, গেলওয়ার্দি, টলস্টয়, ভিক্টর হিউগো, টুর্গেনিভ ও ডস্টয়ভস্কির নামকরা সব পুস্তক পড়িয়া ফেলি।

এই সময় বাংলা মাসিক পত্রিকাগুলিতে ‘আর্ট ফর আর্টস সেক’ এই প্রশ্ন। লইয়া বাদ-বিতণ্ডার ঝড় বইতে ছিল। নামকরা পণ্ডিত লোকদের প্রায় সবাই এই বিতর্কে যোগ দিয়াছিলেন। এই সব প্রবন্ধ আমি প্রবল আগ্রহ লইয়া পড়িলাম। কিন্তু সে বিতণ্ডায় আমি কোনও আলো পাইলাম না।

মাঝখান হইতে এইসব তর্ক-বিতর্কে আমার নিজস্ব একটা মতবাদ গড়িয়া উঠিল। আমার মত নগণ্য তরুণ যুবকের মনোভাবকে মতবাদ বলা ঠিক হয় না। তবু নিজের কথাটা বলিবার আগ্রহ আমার দুর্নিবার হইয়া উঠে। কথাটা ঠিক পজিটিভ কোনও মতবাদ নয়। একটা নিগেটিভ অ্যাটিচুড মাত্র। শরৎবাবুর বই পড়িবার জন্য আমার মধ্যে একেবারে রাক্ষসী ক্ষুধা ছিল। তাঁর বই আমাকে একেবারে সম্মোহিত করিয়া রাখিত। তবু শরৎবাবুর পল্লী সমাজ বাদে আর সমস্ত বইয়ের বিরুদ্ধে আমার একটা গোপন বিদ্রোহ ছিল। এ যেন মদখোরের মদ-নিন্দা। মদখোরেরা বন্ধুদের মজলিসে বসিয়া মদ খাওয়ার নিন্দায় সককে ছাড়াইয়া যায়। কিন্তু মদের বোতল দেখিলেই সব কথা ভুলিয়া যায় এবং গোগ্রাসে বোতলকে-বোতল গিলিয়া ফেলে। আমার বিবেচনায় শরৎবাবুর এই গুণটাই ছিল দোষ। রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাস সম্বন্ধেও আমার এই একই রকম অ্যাটিচুড ছিল। একমাত্র গোরা সম্বন্ধেই আমার ধারণা ছিল অন্যরূপ। এটাকে আমি রবিবাবুর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ বলিতাম। কেন বলিতাম, সে কথা কাউকে বুঝাইতে পারিতাম না। ঠিক তেমনি টলস্টয়, টুর্গেনিভ ও ডস্টয়ভস্কির পুস্তকগুলিকে আমি আদর্শ উপন্যাস বলিতাম। কিন্তু সেগুলি কেন আদর্শ নভেল, তা বুঝাইতে পারিতাম না। ইংরাজি নভেলিস্টদের মধ্যে একমাত্র হল কেইনকেই আমি শ্রেষ্ঠ বলিতাম। ফরাসি নভেলিস্টদের মধ্যে আমি ভিক্টর হিউগোকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নভেলিস্ট বলিতাম। তাঁর লা মিজারেবলস ও লাফিং ম্যানকে আমি মহাকাব্যের অনুকরণে মহা-উপন্যাস বলিতাম।

কিন্তু একমাত্র রাশিয়ান নভেলগুলিকেই আমি আদর্শ নভেল বলতাম। কিসের জন্য, কী কারণে, ওগুলি আদর্শ নভেল বন্ধু-বান্ধবের এই প্রশ্নের কোনও জবাব দিতে পারিতাম না। কিন্তু নিজে-নিজে চিন্তা করতাম। এই চিন্তার ফল ১৯২২ সালে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত আমার ‘গোলামী সাহিত্য’ নামক প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধটা বর্তমানে আমার সামনে নাই। অনেক তালাশ করিয়াও যোগাড় করিতে পারিলাম না। তাই কোন যুক্তিতে কী বলিয়াছিলাম, তা বলিতে পারিব না। কিন্তু ওতে আমার প্রতিপাদ্য ছিল যা সে কথাটা আমার মনে আছে। আমি ঐ প্রবন্ধে বলিতে চাহিয়াছিলাম যে বাংলা সাহিত্যের দিকপাল শিল্পীরা যে সাহিত্য সৃষ্টি করিতেছেন, সেটা বাঙ্গালীর সত্যিকার জীবনালেখ্য নয়; এটা গোলাম বাংলার সাহিত্য। কাজেই গোলামী সাহিত্য। এঁদের সৃষ্ট আর্ট শুধু আর্টেরই জন্য, জীবনের জন্য নয়। আমার মতে আর্ট আর্টের জন্য নয়, আর্ট মানুষের জীবনের জন্য। যে আর্ট মানুষের উপকারে আসিল না, সেটা সুন্দর নয়, অসুন্দর। আমি তাতে বলিয়াছিলাম আমাদের শিল্পীরা ধানক্ষেত কাটিয়া সেখানে ফুলের বাগিচা করিতেছেন। এই প্রবন্ধে আমি রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রকে কঠোর ভাষায় নিন্দা করিয়াছিলাম। তাতে সাহিত্যিক মহলে বেয়াদবির জন্য আমার যথেষ্ট নিন্দা হইয়াছিল। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক ভোলার কবি মোজাম্মেল হক সাহেব আমাকে বলিয়াছিলেন যে, আমার ঐ প্রবন্ধ ছাপার জন্য কলিকাতার সাহিত্যিকরা তাকে তিরস্কার করিতেছেন। এত প্রতিবাদ ও নিন্দার মধ্যে আমি একটা সান্ত্বনা পাইয়াছিলাম বরিশাল হইতে প্রকাশিত বরিশাল হিতৈষীনামক একটি সাপ্তাহিক কাগজে দীর্ঘ সম্পাদকীয় প্রবন্ধে আমার ঐ প্রবন্ধের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা এবং আমার সমালোচকদের নিন্দা করা হইয়াছিল।

আমি শরত্যাবুর যতই বিরোধী হই না কেন, তার প্রভাবমুক্ত হইতে পারিলাম না। তাঁর অনুকরণে অনেকগুলি গল্প লিখিয়া ফেলিলাম। ঐ সব গল্পই সওগাত-এ ছাপা হইয়াছে। ঐগুলি লেখার সময় আমি মাত্র আইএ পড়ি, অথবা সবেমাত্র আইএ পাশ করিয়াছি। সওগাত-এর সম্পাদক নাসিরউদ্দীন সাহেব শুধু মাসের পর মাস আমার গল্পই ছাপিতেন না, আমাকে উৎসাহ দিয়া পত্রও লিখিতেন। সেই হইতে নাসিরউদ্দীন সাহেব ও তার সওগাত-এর সাথে আমার ব্যক্তিগত ও সাহিত্যিক জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত হইয়া যায়। এ সম্পর্কের মধুরতা এই বৃদ্ধ বয়সেও অটুট রহিয়াছে।

.

৬. সাহিত্যিকদের সাথে প্রথম পরিচয়

আমি ১৯২২ সালের মাঝামাঝি বোধহয় জুলাই মাসে খিলাফত কমিটির সভায় যোগ দিতে প্রথম কলিকাতা যাই। কিছুদিন আগে শামসুদ্দীন কলিকাতা গিয়াছেন। তিনি মুসলিম জগত নামক সাপ্তাহিক কাগজের সম্পাদকতা করেন। তিনি ছাত্রজীবনের দুই বছরও কলিকাতায় কাটাইয়াছেন। সুতরাং কলিকাতার ব্যাপারে তিনি আমার বিবেচনায় একজন এক্সপার্ট। আর আমি আনাড়ি, একদম বাঙ্গাল। কাজেই আগে হইতে তাঁকে চিঠি লিখিয়া জানাইলাম। তিনি শিয়ালদহ স্টেশন হইতে আমাকে নিয়া গেলেন। আমি তার মেহমান হইলাম। যাকারিয়া স্ট্রিট ও চিৎপুরের মোড়ের একটি বাড়িতে খিলাফত আফিস। সেখানেও শামসুদ্দীনই আমাকে পৌঁছাইয়া দিলেন। কলিকাতা এত ভাল লাগিল যে খিলাফত কমিটির সভার কাজ শেষ হইবার পরও কলিকাতা ছাড়িতে মন চাহিল না। স্বরাজ ও খিলাফত দুই আন্দোলনেই তখন মন্দা পড়িয়া গিয়াছে। কাজেই নিজের গ্রামে বা জিলায় চাঞ্চল্যকর কিছু। করিবারও নাই। শহরের জাতীয় বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করিয়া যা কিছু পাই, তাতে পকেট খরচা ও খাওয়াই চলে না। কাজেই কলিকাতায় কোনও কাজের যোগাড় করা যায় কি না দুই বন্ধুতে সে চিন্তা করিতে লাগিলাম।

একদিন শামসুদ্দীন বলিলেন, কলেজ স্ট্রিটে সাহিত্য-সমিতির সভা আছে। আমাকে যাইতে হইবে। তিনি অন্য মেম্বরদেরে কথা দিয়া আসিয়াছিলেন। আল-এসলাম, সওগাত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় গল্প-প্রবন্ধ লিখিয়া আমি তখন সাহিত্যিক সমাজে কতকটা পরিচিত হইয়াছি। কাজেই শামসুদ্দীন বলিলেন সবাই আমাকে দেখিতে চান। ইতিমধ্যে পথে-ঘাটে সমিতির সম্পাদক কবি মোজাম্মেল হক (ভোলা) ও সহকারী সম্পাদক মোযাফফর আহমদ সাহেবের সঙ্গে পরিচয় হইয়াছিল। শামসুদ্দীন তাঁদেরও দোহাই দিলেন। সবচেয়ে আকর্ষণীয় কথা বলিলেন, কাজী নজরুল ইসলাম আজকার সভায় উপস্থিত থাকিবেন। দু-এক দিনের মধ্যে তিনি ধূমকেতুনামে সাপ্তাহিক বাহির করিবেন।

যথাসময়ে সভায় গেলাম। অনেক নাম-শোনা চোখে-না-দেখা কবি সাহিত্যিকের দেখা পাইলাম। শামসুদ্দীন সভার মধ্যে আমাকে ফরমালী পরিচিত করিতে গিয়া আমার প্রতিভার, লেখার ও রসিকতার অনেক তারিফ। করিয়া শেষে বলিলেন : কিন্তু এ ব্যাপারে আপনাদিগকে সাবধান করিয়া দিতেছি। আমার এই বন্ধু যে সব কথা বলিবেন, তার বার আনা বাদ দিয়া মাত্র চার আনা বিশ্বাস করিবেন। আমার প্রতি এই আক্রমণ সকলে উচ্চ হাসিতে উপভোগ করিলেন। আমিও অগত্যা সে হাসিতে যোগ দিলাম। সকলের শেষে আমার জবাবের পালা। তারিফের উত্তরে ততোধিক তারিফ। করিয়া বিনয়ের উত্তরে সর্বাধিক বিনয় দেখাইয়া উপসংহারে বলিলাম : বন্ধুবর শামসুদ্দীন আমার কথার বার আনা বাদ দিয়া মাত্র চার আনা বিশ্বাস করিবার উপদেশ দিয়াছেন। সরলভাবে আমি স্বীকার করিতেছি যে, তাতেও আমার দুই আনা নেট মুনাফা থাকিবে।

হাসির হুল্লোড় পড়িয়া গেল। সবার সমবেত উচ্চ-হাসি তলাইয়া দিয়া ছাদফাটা হাসি হাসিলেন যিনি তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি আসন ছাড়িয়া রসিক বটে, এমনটি আর দেখি নাই বলিতে-বলিতে আমাকে হাবিলদারের সমস্ত শক্তি দিয়া জড়াইয়া ধরিলেন। অন্তরে-অন্তরে আমাদের পরিচয় হইয়া গেল।

সাংবাদিক জগতে প্রবেশ করার জন্য কিছু-কিছু প্রাথমিক কোদাল-কাম করিয়া সেবারের মত ফিরিয়া আসিলাম। পরে আরো কয়বার গিয়া পাকাভাবে গেলাম ১৯২৩-এর মার্চ-এপ্রিলে। সেবারও আবুল কালাম শামসুদ্দীনেরই মেহমান হইলাম। মেহমানদারির বদলা তাঁর সম্পাদিত মুসলিম জগত-এ কিছু-কিছু লেখা দেওয়া আমার কর্তব্য এবং সুযোগ মনে করিলাম। এইভাবে আমি ‘ছহি বড় তৈয়ব নামা’ নামে একখানা স্যাটায়ার কাব্য এবং সভ্যতায় দ্বৈতশাসন’ নামে একটি বড় প্রবন্ধ লিখিলাম। ছহি বড় তৈয়ব নামা’ মশহুর পুঁথি ‘ছহি বড় সোনাভানের অনুকরণে একটি রাজনৈতিক প্যারডি-স্যাটায়ার। আমার রাজনৈতিক সহকর্মী খেলাফত নেতা শ্রদ্ধেয় মৌলবী তৈয়ব উদ্দিন আহমদ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের স্বরাজ দলের একজন আইন সদস্য। তিনি অন্যতম মন্ত্রী স্যার আবদুল করিম গযনবীর খাতির এড়াইতে না পারিয়া সরকার পক্ষে একটি ভোট দিয়া দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেন। তার এই কাজের নিন্দায় আমি এই স্যাটায়ারটি লিখি। স্যাটায়ার লেখায় এই আমার প্রথম উদ্যম। মুসলিম জগত-এ এটি বাহির হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কলিকাতার সাহিত্যিক মহলে বিশেষত মুসলিম সাহিত্যিক মহলে আমার সুনাম হয়। আমি খুবই উৎসাহবোধ করি। সভ্যতায় দ্বৈতশাসন’ রাজনৈতিক দার্শনিক দীর্ঘ প্রবন্ধ। ইহা কয়েক মাস কাল ধরিয়া মুসলিম জগত-এ ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়। এই সময়ে ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনে যে কিছু আংশিক স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হইয়াছিল, কংগ্রেস-খিলাফত নেতারা উহাকে ‘ডায়ার্কি বা দ্বৈতশাসন’ বলিতেন। কাজেই আমরা তখন দ্বৈতশাসনকে খুব খারাপ জিনিস মনে করিতাম। আমি এই প্রবন্ধে প্রমাণ করিবার চেষ্টা করিয়াছিলাম, ইংরাজের-দেওয়া শাসন-ব্যবস্থাটাই শুধু দ্বৈতশাসন নয়, ইংরাজি সুতরাং গোটা ইউরোপীয় সভ্যতাটাই আসলে দ্বৈতশাসন। কাজেই ইংরাজ সাম্রাজ্যবাদীরা যে আমাদের ঘাড়ে রাজনৈতিক দ্বৈতশাসন চাপাইবার চেষ্টা করিতেছেন, এটা কোনও ‘বিচ্ছিন্ন আকস্মিক ব্যাপার নয়। তাদের সভ্যতার এটা অংশ মাত্র। ছহি বড় তৈয়ব নামা’ বা ‘সভ্যতায় দ্বৈতশাসন’ কোনটারই কপি বর্তমানে আমার কাছে নাই। কাজেই এত বড় বিষয়ে আমার মত সাধারণ যুবক কী লিখিয়াছিলাম, আজ তা বলিতে বা বুঝিতে পারিতেছি না। যতদূর স্মরণ পড়ে, ঐ প্রসঙ্গে আমি বলিবার চেষ্টা করিয়াছিলাম যে পাশ্চাত্য সভ্যতা দু’মুখা সভ্যতা। এ সভ্যতা মুখে-মনে এক কথা বলে না। যা শিখায় তা করায় না। আমার আরো মনে পড়ে যে তৎকালে মহাত্মা গান্ধীর ইয়ং ইন্ডিয়া এবং রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধাবলি পড়িয়া আমি খুবই প্রভাবিত হইয়াছিলাম। তাদেরই ভাবকে নিজের ভাব মনে করিয়া ছোটমুখে বড় বড় কথা বলিয়াছিলাম। নিজে ঐ সব কথা বলিতে পারিয়া আমি এতটা গর্ব বোধ করিয়াছিলাম যে, গোটা প্রবন্ধের কাটিংগুলি একত্রে গাঁথিয়া আমার দর্শনের অধ্যাপক (তকালে ভাইস চ্যান্সেলার) ডা. ল্যাংলির কাছে ঢাকা পাঠাইয়াছিলাম এবং সঙ্গীয় পত্রে তাঁকে সসম্মানে অনুরোধ করিয়াছিলাম, তিনি যেন কাউকে দিয়া উহার অনুবাদ করাইয়া পড়িয়া দেখেন। ল্যাংলি সাহেব ধর্মপ্রাণ খৃষ্টান ছিলেন। কয়েক মাস পরে তিনি একখানা স্নেহপূর্ণ সংক্ষিপ্ত পত্রে জানাইয়াছিলেন, যে আমার প্রবন্ধটা তার ভাল লাগিয়াছে। লেখক হিসাবে আমার সাফল্যের জন্য তিনি দোওয়া করিতেছেন।

.

. প্রথম বইয়ের কপিরাইট

আমি ১৯২২ সালের মাঝামাঝি খুব সম্ভব জুলাই মাসে প্রথম কলিকাতায় যাই। ঐ বছর মাঝে-মাঝে এবং ১৯২৩ সাল হইতে একটানা প্রায় আট বছর কলিকাতা থাকি এবং সংবাদপত্রের সেবা করি। আমার সাংবাদিক জীবন অন্য খণ্ডে বর্ণনা করিব। এখানে শুধু সাহিত্যিক জীবনের কথাটুকুই বলিতেছি। ১৯২৪-২৫ সালে আমি যখন সাপ্তাহিক মোহাম্মদীতে সহকারী সম্পাদকের কাজ করিতাম, তখন আমার বেতন ছিল মাত্র পঞ্চাশ টাকা। এই টাকায় তৎকালে সচ্ছলে আমার চলিয়া যাইত। কিন্তু কিছু সঞ্চয় করিতে পারিতাম না। এই সময় কতকটা উপরি আয়ের আশায় কতকটা গ্রন্থকার হইবার শখে, ছেলেদের উপযোগী করিয়া কাছাছুল আম্বিয়ার কতকগুলি গল্প লইয়া একটি বই লিখিলাম। তার নাম রাখিলাম মুসলমানী উপকথা। বই লেখা সমাপ্ত করিয়া উহা প্রকাশের জন্য প্রকাশক ও ছাপাখানার সঙ্গে দেন-দরবার করিতেছি, এমন সময় বাড়ি হইতে বাপজী জানাইলেন, শত খানেক টাকার জন্য তিনি একটা কাজে ঠেকিয়াছেন। ঐ পরিমাণ টাকা যোগাড় করা আমার দ্বারা সম্ভব হইলে তাঁর খুবই উপকার হয়। ছেলের কাছে বাপের টাকার চাওয়ার এর চেয়ে মোলায়েম ভাষা আর হইতে পারে না। কিন্তু আমি বুঝিলাম নেহাত নিরুপায় না হইলে বাপজী আমার নিকট টাকা চাহিতেন না। কিন্তু একশ টাকা যোগাড় করা তৎকালে আমাদের মত পঞ্চাশ টাকার সাংবাদিকের পক্ষে কল্পনাতীত ব্যাপার ছিল। কাজেই ঠিক করিলাম, আমার জীবনের প্রথম বই মুসলমানী উপকথার কপিরাইট বিক্রয় করিব। কপিরাইট যদি বিক্রয় করিতেই হয়, তবে যার নিমক খাই, তার কাছেই প্রথম যাচাই করা দরকার। কারণ তাদেরও ‘মোহাম্মদী বুক এজেন্সী’ নামক প্রকাশকের ব্যবসা ছিল। কাজেই আমার তকালীন মনিব মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ও তার জ্যেষ্ঠ পুত্র মৌলবী খায়রুল আনাম খার নিকট প্রস্তাব দিলাম। তারা ছয়শত টাকার বেশি দিতে চাহিলেন না। অন্যত্র বেশি দাম পাইলে সেখানে কপিরাইট বিক্রয় করিতে তাদের আপত্তি নাই বলিয়া দিলেন। এই সঙ্গে মাওলানা সাহেব বইটির নামের মধ্য হইতে ‘উপ’ কথাটা বাদ দিয়া শুধু মুসলমানী কথা নাম রাখিবার উপদেশ দিলেন। এ উপদেশ আমার পছন্দ হইল। ডা. দীনেশ চন্দ্র সেনের রামায়ণী কথার অনুকরণে আমার বইয়ের নাম রাখিলাম মুসলমানী কথা।

বেশি দামের সন্ধানে ঘুরিতে-ঘুরিতে অবশেষে এগারশ টাকা কপিরাইট বিক্রয় করিতে সমর্থ হইলাম। খরিদ্দার বিখ্যাত প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতা ভট্টাচাৰ্য্য এন্ড সন্স। যথাসময়ে পাণ্ডুলিপি তাদের হাতে দিয়া এক শ টাকা অগ্রিম লইলাম। বাকি হাজার টাকা পুস্তক ছাপা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাইব, কথা স্থির হইল। ছাপা হওয়ার সময় প্রথম প্রফটা আমি দেখিয়া দিতে ওয়াদা করিয়াছিলাম। তাই বোধ হয় অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী ভট্টাচার্য্য। মহাশয় বাকি টাকা দেওয়ার ঐরূপ শর্ত করিয়াছিলেন। আমার তাতে মোটেই আপত্তি ছিল না। কারণ প্রথমত বাড়িতে পাঠাইবার মত টাকা আমি পাইয়াছি; এখন আমার আর টাকার প্রয়োজন নাই। দ্বিতীয়ত নিজের প্রথম বইটায় ছাপার ভুল না থাকে, সে বিষয়ে আমার আগ্রহ প্রকাশকের আগ্রহের চেয়ে কম ছিল না।

ইতিমধ্যে ভট্টাচাৰ্য্য এন্ড সন্স রঙ্গিন কালিতে বড় বড় হরফে বর্ডারসহ বই ছাপিবার জন্য ব্লকাদি করিয়া ফেলিলেন। একটা সম্পূর্ণ নূতন ধরনের চমৎকার শিশুপাঠ্য পুস্তক বাহির হইতেছে বলিয়া বিজ্ঞাপন বাহির হইল। সঙ্গে সঙ্গে আমার নামও প্রকাশ হইল। ভট্টাচার্য্য এন্ড সন্সের এই সময়ে শিশু সাথী নামে একটি সুন্দর শিশু মাসিক ছিল। এই শিশু মাসিকে কারুনের ধন’ নামক মুসা ও কারুনের গল্পটি ছাপা হইয়া গেল। কলিকাতার সাহিত্যিক সমাজে গল্পটির যথেষ্ট সমাদর হইল। আমার আনন্দ আর ধরে না। ঐ বইয়ে আমার কোনও স্বত্ব নাই। ওটা লাখ লাখ কপি বিক্রয় হইলেও তাতে আমার এক পয়সা লাভ হইবে না। এসব কোনও কথাই আমার আনন্দে বিঘ্ন ঘটাইতে পারিল না।

.

. আরবি-ফারসি বনাম বাংলা শব্দ

কয়েক দিন পরই ভট্টাচাৰ্য্য এন্ড সন্সের মালিক আমাকে নিবার জন্য লোক ও গাড়ি পাঠাইলেন। আমি তাদের কর্নওয়ালিস স্ট্রিটস্থ দোকানে গেলাম। কুশল মন্দ জিজ্ঞাসা ও চা’র অর্ডার ইত্যাদি প্রাথমিক ভদ্রতার পরই আমার বইয়ের কথা তুলিলেন। বই খুব জনপ্রিয় হইবে, গল্প ও ভাষা খুবই চমৎকার, ইত্যাদি কয়েক কথার পরেই তিনি বলিলেন : “কিন্তু বই-এ অনেক আরবি-ফারসি শব্দ আছে। এইগুলির ফুটনোট দিতে হইবে।’ ভট্টাচাৰ্য মহাশয়ের কথা আমার পছন্দ হইল না। কিন্তু ভদ্রলোকের সঙ্গে তর্ক করা যায় না, কারণ হাজার টাকা এখনো বাকি। কাজেই খুব সাবধানে অতি মোলায়েম ভাষায় যুক্তি ও দৃষ্টান্ত দিয়া বলিলাম যে অমন সুন্দর রঙ্গিন কালির ছাপ শিশুপাঠ্য বইয়ে ফুটনোট একেবারে বেমানান হইবে। বইয়ের সৌন্দর্য একদম নষ্ট হইয়া যাইবে।

ভদ্রলোক আমার যুক্তি মানিয়া লইলেন। কিন্তু ফুটনোটের বদলে ‘পরিশিষ্টে’ শব্দার্থ দিতে বলিলেন। পরিশিষ্টের বিরুদ্ধে খানিকক্ষণ এটা-ওটা যুক্তি দিয়া শেষ পর্যন্ত আসল যুক্তিটা বাহির করিলাম। বলিলাম : আমার বইয়ে কোনও আরবি-ফারসি শব্দ নাই। সবই বাংলা শব্দ। কাজেই পরিশিষ্টে শব্দার্থ দেওয়ার দরকার নাই।

ভদ্রলোককে বুঝাইবার জন্য বলিলাম যে ঐসব শব্দের উৎপত্তি আরবি ফারসি ভাষা হইতে হইয়াছে বটে, কিন্তু যুগ-যুগান্তর ধরিয়া বাংলার জনসাধারণ ঐ সব শব্দ তাদের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করায় ও-সবই বাংলা হইয়া গিয়াছে। বলিলাম : যেসব শব্দ তিন বছরের নিরক্ষর বাঙ্গালী শিশু বুঝিতে ও বলিতে পারে, মূল যা-ই হোক, যেসব শব্দই বাংলা। দৃষ্টান্ত দিলাম ‘জংগল’ ও ‘জানালা দিয়া। দুইটাই ওলন্দাজ শব্দ। কিন্তু আমাদের দেশের মাটিতে উহারা এমন মিশিয়া গিয়াছে যে ও-গুলির বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজিয়া বাহির করার কল্পনাও কেউ করে না।

ভদ্রলোক আমার কথায় বিরক্ত হইয়া বলিলেন : আমাকে ভাষা-বিজ্ঞান শিখাইবার চেষ্টা করিবেন না। আমি ব্যবসায়ী মানুষ। আমার বই বিক্রয় দিয়া কথা। ঐ সব শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ না দিলে হিন্দুরা বুঝিতে পারিবে না। মুসলমানরা ঐসব শব্দ ব্যবহার করিলেও হিন্দুরা করে না।

আমি যখন ভদ্রলোককে বলিলাম যে হিন্দুরা ও-সব শব্দ সাধারণত ব্যবহার না করিলেও তারা সকলেই বুঝিতে পারে, তখন ভদ্রলোক ধৈর্য হারাইয়া বলেন যে তবু ওগুলি আরবি-ফারসি শব্দ, বাংলা শব্দ নয়।

আমিও রাগ করিয়া প্রশ্ন করিলাম :

শতকরা ছাপ্পান্ন জন বাঙ্গালীর মুখের ভাষাকে আপনি বাংলা স্বীকার করেন? দেশের দুর্ভাগ্য!

আমি তখন পুরা কংগ্রেসি। মাথা হইতে পা পর্যন্ত মোটা খদ্দর। তিনি নূতন করিয়া আমার পোশাকের দিকে চাহিয়া বলিলেন : দেখুন, আমি ব্যবসায়ী। আপনার সাথে আমি দেশের ভাগ্য লইয়া তর্ক করিতে চাই না। আমার শুধু জানা দরকার আপনি ঐ সব শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ দিবেন কি দিবেন না?

ভদ্রলোকের সুরে অশুভ ইঙ্গিত ফুটিয়া উঠিল। আমি অপেক্ষাকৃত নরম হইয়া বলিলাম : আমাকে ব্যাপারটা বুঝিতে দেন। আপনি কী বলিতে চান, পরিশিষ্টে ‘পানি’ অর্থ ‘জল’, ‘আল্লাহ’ অর্থ ‘ঈশ্বর’, ‘রোযা’ অর্থ উপবাস’, এইভাবে ওয়ার্ড বুকের মত শব্দার্থ লিখিয়া দিতে হইবে?

আমি অনেকটা নরম হইয়াছি মনে করিয়া ভদ্রলোক খুশি হইলেন। বিনীতভাবে বলিলেন : আজ্ঞে হাঁ, ঠিক ধরিয়াছেন।

আমি : তা হইলে আমাকে স্বীকার করিতে হইবে যে পানি, আল্লাহ, নামাজ, রোযা এসব শব্দ বাংলা নয়? জল, ঈশ্বর, উপাসনা ও উপবাসই বাংলা শব্দ?

ভদ্রলোক একটু ভাবিয়া বলিলেন : না, তা কেন? বাংলা শব্দেরও কি বাংলা প্রতিশব্দ থাকে না? ঈশ্বর অর্থ ভগবান, জল অর্থ বারি, এসব কথা কি আমরা বলি না?

আমি বলিলাম : ঠিক আছে। আপনার কথাই মানিয়া লইলাম। ঐ সব শব্দের প্রতিশব্দ আমি লিখিয়া দিব। কিন্তু এক শর্তে।

ভদ্রলোক খুশিতে হাসিতে যাইতেছিলেন। অকস্মাৎ মুখের হাসির বদলে চোখে কৌতূহল দেখা দিল। বলিলেন : কী শর্ত?

আমি: আপনি বহু হিন্দু গ্রন্থকারের বইয়ের প্রকাশক। তাঁদেরে ডাকিয়া রাজি করুন : তাঁদের বইয়ের পরিশিষ্টের শব্দার্থে ঈশ্বর অর্থ আল্লাহ, জল অর্থ পানি, উপবাস অর্থ রোযা; ইত্যাদি যোগ করিবেন। এতে রাজি আছেন আপনি?

.

. প্রথম স্যাক্রিফাইস

ভদ্রলোক রাগে ফাটিয়া পড়িলেন। এর পর যা কথাবার্তা হইল তার খুব স্বাভাবিক পরিণতি হইল আমার জন্য খুব খারাপ। ভদ্রলোক স্পষ্ট বলিয়া দিলেন, আমার সাথে তার চুক্তি বাতিল। তিনি কপিরাইট কিনিলেন না। ব্লক তৈয়ার করিতে তাঁর যে হাজার খানেক টাকা খরচ হইয়া গিয়াছে, তা তিনি আমার কাছে দাবি করিলেন না। আমার অগ্রিম নেওয়া একশত টাকা ফেরৎ দিয়া যে-কোনও দিন আমি পাণ্ডুলিপি ফেরৎ নিতে পারি বলিয়া ভদ্রলোক চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া পড়িলেন। অগত্যা আমিও উঠিলাম। আদাব’ বলিয়া বাহির হইলাম। প্রায় চৌকাঠ পার হইয়াছি এমন সময় ভদ্রলোক ডাকিয়া বলিলেন : মনসুর সাহেব, আপনি রাগিয়া গিয়াছেন। আবার ভাবিয়া দেখুন। পরিশিষ্ট দিতে রাজি হইলে এখনও আপনার বই নিতে পারি।

কিন্তু এ কথার যে জবাব আমি দিতে চাহিলাম, তা পারিলাম না। তার বদলে কে যেন আমার মুখ দিয়া বাহির করিয়া দিল : ‘ভট্টাচাৰ্য্য মশায়, আপনি রাগিয়া গিয়াছেন। আবার ভাবিয়া দেখুন। পরিশিষ্ট ছাড়া বই ছাপিতে রাজি হইলে এখনও আপনাকে বই দিতে পারি।’

ব্যবহারের প্রতিবিম্বরূপে ব্যবহার করা, আর কথার প্রতিধ্বনি রূপে কথা কওয়ার সেই পুরাতন বদভ্যাস! আমি কিছুতেই এই অভ্যাসের হাত হইতে রেহাই পাইলাম না।

গিয়াছিলাম মোটরে। ফিরিতে হইবে ট্রামে। ফুটপাথ ধরিয়া ট্রামস্টপে যাইতে, ট্রামের জন্য অপেক্ষা করিতে এবং ট্রামে চড়িয়া শিয়ালদহে মোহাম্মদী আফিসে আসিতে শুধু একটা কথাই আমার মাথায় কিলবিল করিতে থাকিল : এটা কী করিলাম? এক হাজার টাকা হারাইলাম একটা জিদের বশে? হাজার টাকা ত গেল, আবার আগাম-নেওয়া টাকাটাও ত ফেরৎ দিতে হইবে। এগারশ টাকার সব গেল? মনে হইল, বাদশাহী তখৃত হারাইয়া পথের ফকির হইলাম। বস্তুত, তৎকালে আমার জন্য এগারশ টাকাই ছিল বিপুল সম্পদ। মাসে চল্লিশ হাজার টাকার আইন ব্যবসায় ছাড়িয়া দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেওয়ায় একদা ঐ মহাপুরুষের উদ্দেশ্যে মাথা নত করিয়া আমিও অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়াছিলাম। আজ মনে হইল আমার এই এগারশ টাকা ত্যাগ দেশবন্ধুর ত্যাগের চেয়েও বড়। কারণ দেশবন্ধু ঐ ত্যাগের পরেও সুখে-সম্মানে বাঁচিয়া আছেন। কিন্তু আমার এই ত্যাগে সুখ-সম্মান ত দূরের কথা, একশ টাকা ফেরৎ না দিলে ত আমাকে চরম অপমান হইতে হইবে। কী দরকার ছিল জিদ করিবার? দিলেই ত হইত একটা পরিশিষ্ট লিখিয়া। বইটায় ত আমার কোনও স্বত্বাধিকার থাকিত না। কাজেই তার ভুলত্রুটির জন্য আমাকে কেউ দোষও দিত না, তবে কি ভুল করিলাম?

কিন্তু মুহূর্তেই জবাব পাইলাম। আমার সারা অস্তিত্ব এক সঙ্গে হুংকার দিয়া উঠিল : না না, ভুল করি নাই। আমার আত্মসম্মানবোধ ঝাঁকি মারিয়া মাথা তুলিয়া বুক টান করিয়া বলিল : ঠিক করিয়াছি। বাংলার মেজরিটি মুসলমানের মুখের ভাষাকে বাংলা ভাষা বলিয়া স্বীকার করিল না বাংলার মাইনরিটি হিন্দুরা? এ অবস্থা চলিতে থাকিলে মুসলমানের ত ভাল হইবেই না, সারাদেশের, সুতরাং হিন্দুরও ভাল হইবে না। কাজেই এটা বন্ধ করিতেই হইবে। হিন্দুদের বর্তমান মতিগতিতে কাজটা খুবই কঠিন। কাজেই স্যাক্রিফাইস দরকার। আমার মত গরীবের পক্ষে এগারশ টাকা স্যাক্রিফাইস খুব বড় ত্যাগ বটে, কিন্তু উদ্দেশ্যের তুলনায় এ ত্যাগ খুবই সামান্য। হয়ত এর চেয়েও বড় ত্যাগ করিতে হইবে। মনে সান্ত্বনা পাইলাম। আফিসে ফিরিয়া খায়রুল আনাম খাঁ সাহেবকে সব বলিলাম। তিনি দয়া করিয়া পূর্ব প্রস্তাব মত ছয়শ টাকায় আমার বই কিনিতে রাজি হইলেন। এক শ টাকা অগ্রিম দিলেন। পাণ্ডুলিপি ফেরৎ আনিলাম।

যথাসময়ে মোহাম্মদী বুক এজেন্সী আমার মুসলমানী কথা প্রকাশ করিলেন। অতঃপর যা ঘটিল, তাতে মুসলমানের মুখের ভাষার জন্য আমার মত গরীবের স্বার্থ ত্যাগের অহংকার ষোল আনা অটুট থাকিল। কারণ আমার ত্যাগের পরিমাণ আরেকটু বাড়িল। কিন্তু ঐ ত্যাগও যথেষ্ট নয়, আর ত্যাগের দরকার হইতে পারে বলিয়া আমি সেদিন যে আশঙ্কা করিয়াছিলাম, বারটি বছর না যাইতেই সে আশঙ্কা আমারই ঘাড়ের উপর দিয়া কার্যে পরিণত হইল।

.

১০. দ্বিতীয় স্যাক্রিফাইস

আমি তখন ময়মনসিংহ জজকোর্টে উকালতি করি। নূতন উকিল। পসার খুব জমে নাই। সাহিত্যিক নেশায় এবং উপরি আয়ের জন্য নয়া পড়া নামক চার খণ্ডের একখানা শিশুপাঠ্য বই লিখি। চার খণ্ড বই মকতবের চার ক্লাসের জন্য টেক্সট বুক কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত হয়। এই চারখানা বই হইতে আমি যথেষ্ট টাকা-কড়ি পাইতে থাকি। তিন বছর মুদ্দত পার হয়-হয় অবস্থায় বাংলার প্রাইমারি এডুকেশন অ্যাক্ট পাশ হয়। এই নূতন আইনে প্রাইমারি স্কুল ও মকতব এক করিবার বিধান হয়। আমার নয়া পড়াঅনুমোদিত পুস্তকগুলির মধ্যে ‘এ’ ক্লাসের বই ছিল। সুতরাং নূতন বিধানেও আমার বই পাঠ্য-পুস্তক থাকিয়া যাইবে, এ কথা প্রকাশকসহ সকলেই বলিলেন। নয়া পড়ার চাহিদা বাড়িয়া যাইবে। আমার আয়ও বাড়িবে, এই আশায় আমি গোলাপি স্বপ্ন দেখিতে থাকিলাম।

।এমন সময় টেক্সট বুক কমিটির তরফ হইতে এক পত্রে আমাকে জানান। হইল যে আমার নয়া পড়া নূতন আইনে পাঠ্য-পুস্তকরূপে অনুমোদিত হইয়াছে, তবে উহাতে যে সব আরবি-ফারসি শব্দ আছে, সেসব শব্দের জায়গায় বাংলা প্রতিশব্দ বসাইতে হইবে।

বার বছর আগেকার ঘটনা মনে পড়িল। তখন ছিলেন ভট্টাচাৰ্য্য এন্ড সন্স, এবার স্বয়ং টেক্সট বুক কমিটি মানে, খোদ সরকার। কিন্তু আমিও আজ বার বছর আগের অসহায় লোকটি নই। ইতিমধ্যে দেশে বিরাট পরিবর্তন হইয়াছে। কৃষক প্রজা পার্টির নেতা হক সাহেব প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী হইয়াছেন। তাঁর আমি একজন প্রিয় শিষ্য। তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করার ব্যাপারে আমার যথেষ্ট হাত আছে। হক সাহেব আমার কোনও কথাই ফেলেন না।

অতএব টেক্সট বুক কমিটিকে আমার সেই পুরাতন মত জানাইলাম, যা ভট্টাটাৰ্য্যকে জানাইয়াছিলাম। টেক্সট বুক কমিটি কিন্তু ভট্টাচাৰ্য্যকে ছাড়াইয়া গেলেন। তারা অন্যান্য যুক্তির সঙ্গে এটাও জানাইলেন : “আল্লা’, ‘খোদা’, ‘পানি ইত্যাদি শব্দ প্রাইমারি পাঠ্য-পুস্তকে থাকিলে হিন্দু ছাত্রদের ধর্মভাবে আঘাত লাগিবে। আমার মাথায় আগুন চড়িয়া গেল। আমি জানাইলাম, একশ বছরের বেশি বাংলার মুসলমান ছাত্ররা পাঠ্য-পুস্তকে ‘ঈশ্বর’, ‘ভগবান’, ‘জল’ পড়াতেও যদি তাদের ধর্মভাবে আঘাত লাগিয়া না থাকে, তবে এখন হইতে ‘আল্লা’, ‘খোদা পড়িয়া হিন্দুদেরও ধর্মভাবে আঘাত লাগা উচিৎ নয়।

আমার যুক্তি ভট্টাচাৰ্য্য যেমন মানেন নাই, টেক্টট বুক কমিটিও মানিলেন না। আমাকে জানাইয়া দিলেন, অত্র অবস্থায় আমার বই বাতিল করিয়া দিতে তারা বাধ্য হইলেন বলিয়া দুঃখিত।

আমি রাগ করিলাম না। মনে মনে হাসিলাম। বেচারা টেক্সট বুক কমিটি জানেন না : কার বই তাঁরা বাতিল করিলেন। তাঁরা জানেন না, প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী হক সাহেবকে দিয়া আমি শুধু তাদের এই বাতিল অর্ডারই বাতিল করিতে পারি না। তাদের চাকুরি পর্যন্ত নট’ করিয়া দিতে পারি। অবশ্য আমি বেচারাদের চাকরি সত্য-সত্যিই নট’ করিব না। তবে সে মর্মে ধমক দিয়া তাঁদের ভবিষ্যতের জন্য হুঁশিয়ার করিয়া দিতে এবং তাঁদের বাতিলি অর্ডার বাতিল করাইতে আমি কলিকাতা গেলাম। হক সাহেব যথারীতি হৈ চৈ করিলেন : টেক্সট বুক কমিটি ভাঙিয়া পড়িবেন, কর্মচারীদের ডিসমিস করিবেন। বলিয়া হুংকার দিলেন। তাঁদের কৈফিয়ত তলব করিলেন। আমি আশ্বস্ত হইয়া এবং কারো চাকুরি নষ্ট না করিতে হক সাহেবকে পুনঃপুন অনুরোধ করিয়া ময়মনসিংহ ফিরিয়া আসিলাম। বহুদিন অপেক্ষা করিবার পর আবার কলিকাতা গেলাম। এইবার হক সাহেব আমাকে জানাইলেন যে হিন্দু বদমায়েশ অফিসারদের জ্বালায় তিনি কিছু করিতে পারিলেন না। বিলম্বও হইয়া গিয়াছে যথেষ্ট। এখন পাঠ্যবই বদলাইলে ছাত্রদের অসুবিধা হইবে। আমারও আর্থিক লাভ বিশেষ হইবে না। তবে আগামী বৎসর যাতে আমার বই অবশ্যপাঠ্য হয়, সে ব্যবস্থা তিনি নিশ্চয় করিবেন। আমি এতদিন ব্যাপারটার আর্থিক দিক মোটেই ভাবিতেছিলাম না। হক সাহেবের আশ্বাসের পর সে বিষয়েও আমি সচেতন হইলাম। কিন্তু তাঁর প্রতিশ্রুত আগামী বছর আর আসিল না। বাঙ্গালী মুসলমানের মুখের ভাষা বাংলা সাহিত্যে স্বীকৃতি পাইবার প্রয়াসে ইহাকে আমার আরেকটা স্যাক্রিফাইস বলিয়া অবশেষে নিজের মনকে সান্ত্বনা দিলাম।

১৯২৬ হইতে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত চার বছর কাল আমি সওগাত-এর সম্পাদকের দফতর লেখায় সাহায্য করি। ঐ সাথেই আমার আয়নার গল্পগুলিও সওগাত-এ বাহির হয়। এই সময় সওগাত আফিস তৎকালীন প্রগতিবাদী সমস্ত মুসলিম সাহিত্যিকদের আড্ডা ছিল। ঐ আড্ডাতে আমরা সওগাত ক্লাব’ বলিতাম। নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, ইয়াকুব আলী চৌধুরী, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, হবিবুল্লাহ বাহার, কবি মঈনুদ্দীন, কবি ফজলুর রহমান, কবি বেনীর আহমদ, কবি মহিউদ্দিন প্রভৃতি সমস্ত সাহিত্যিকদেরই সওগাত আফিসের আড্ডায় যাতায়াত ছিল। কাজী আবদুল ওয়াদুদ ও অধ্যাপক আবুল হুসেন সাহেবরা তৎকালে ঢাকায় শিখা সম্প্রদায় বলিয়া পরিচিত প্রগতিবাদী মুসলিম সাহিত্য সংঘ চালাইতেন। এঁদের সঙ্গে চিন্তার দিক দিয়া আমাদের বহুলাংশে মিল ছিল বলিয়া ব্যক্তিগত সহযোগিতা ও যাতায়াত ছিল।

.

১১. সাহিত্য-সমিতির সেক্রেটারি

এই মুদ্দতটাতে আমি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সেক্রেটারি ছিলাম। বয়স, যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তার দিক দিয়া আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় ইয়াকুব আলী চৌধুরী সাহেবকেই আমি সেক্রেটারি করিতে চাহিয়াছিলাম। কিন্তু তার স্বাস্থ্য খারাপ ও দৃষ্টিশক্তি দুর্বল ছিল বলিয়া তিনি আমাকে সেক্রেটারি হইবার জন্য জিদ করেন এবং নিজে আমার সহকারী সেক্রেটারি হইতে সম্মত হন। ফলে বার্ষিক সভায় প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট মি. এস ওয়াজেদ আলী সাহেব প্রেসিডেন্ট, আমি সেক্রেটারি, ইয়াকুব আলী চৌধুরী ও আয়নুল হক খাঁ সাহেবদ্বয় সহ সেক্রেটারি ও মৌ. মুজিবর রহমান সাহেব কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হইলেন। আমরা নির্বাচিত সম্পাদকমণ্ডলী ছাড়া মৌ. ওমেদ আলী নামে এক ভদ্রলোক ড. শহীদুল্লাহ-মমাজাম্মেল হক সাহেবের আমল হইতে বরাবর সমিতির আফিস সেক্রেটারি ছিলেন। সাহিত্য সমিতির প্রতি এই ভদ্রলোকের এমন একটা পিতৃস্নেহ ছিল যে, সামান্য বেতনে তিনি বহুদিন এই সমিতির সেবায় কঠোর পরিশ্রম করিয়াছেন। আমাদের প্রেসিডেন্ট সাহেব ক্যাম্বুিজের গ্র্যাজুয়েট ব্যারিস্টার ছিলেন। নামের শেষে তিনি বরাবর ‘বি. এ. ক্যানটাব’ লিখিতেন ও লিখাইতেন। বন্ধুবর ওমেদ আলী এ বিষয়ে খুব সচেতন ছিলেন। সমিতির প্রচারে বাহিরে গিয়া অথবা আফিসে বসিয়া নূতন লোকের প্রশ্নের উত্তরে কেউ আমরা যখন বলিতাম আমাদের প্রেসিডেন্ট মি. এস ওয়াজেদ আলী, ওমেদ আলী সাহেব ব্রাকেটে বলিয়া দিতেন ‘বি. এ. ক্যানটাব’। স্যার আবদুর রহিম, মৌ. ফজলুল হক, মৌ, আবদুল করিম প্রভৃতি বড়-বড় নেতাদের বাড়িতে আলোচনায় এমনকি সমিতির সভায়ও যদি কেউ কোনও কারণে মি. এস ওয়াজেদ আলী উচ্চারণ করিতেন, অমনি ওমেদ আলী সাহেব সভার যে-কোনও কোণ হইতে বলিয়া উঠিতেন, বি. এ. ক্যানটাব। আমরা ওমেদ আলী সাহেবের এই ব্যবহারে হাসিতাম। আমরা মনে করিতাম, ওয়াজেদ আলী সাহেবের ‘ক্যানটাব’প্রীতিকে তিনি এইভাবে বিদ্রূপ করিতেছেন। কিন্তু ওমেদ আলী সাহেব ছিলেন সিরিয়াস। তিনি আমাদের হাসিতে মনে মনে দুঃখিত হইতেন।

যা হোক ওমেদ আলী সাহেব ছিলেন সমিতির একটা অ্যাসেট। তার মহানুভবতায় আমি এতদিন নির্বিঘ্নে সমিতির সেক্রেটারিগিরি করিতে পারিয়াছিলাম।

সাহিত্য সমিতির সেক্রেটারিগিরি করিতে গিয়া আমার যে দুইটি চমৎকার অভিজ্ঞতা হইয়াছিল আমার সাহিত্যিক জীবনের সঙ্গে তার কোনও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক না থাকিলেও এখানে তার উল্লেখ করার লোভ সম্বরণ করিতে পারিলাম না।

.

১২. চাঁদা আদায়

প্রথমটি নবাব মশাররফ হোসেন সাহেবের সঙ্গে। তিনি একবার বার্ষিক সভায় সমিতির তহবিলে পাঁচ শত টাকা সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। তখন তিনি বাংলা সরকারের একজন মন্ত্রী। এই প্রতিশ্রুত চাদা আদায়ের জন্য আমরা সম্পাদকমণ্ডলী তার হাজরা রোডের বাড়িতে হানা দিলাম। হাজরা রোড ট্রাম লাইন হইতে অনেক দূরে। কাজেই কিছুদিন হাঁটাহাঁটি করিবার পর প্রথমে ইয়াকুব আলী চৌধুরী, পরে আয়নুল হক খ এবং শেষ পর্যন্ত ওমেদ আলী সাহেবও নিরাশ হইয়া খসিয়া পড়িলেন। আমি সেক্রেটারি পাওনাদারের তাকিদ আমার উপরই ছিল প্রত্যক্ষভাবে। সুতরাং পাঁচ শ টাকা আমি অত সহজে ছাড়িতে পারিলাম না। ঘুরা-ফেরা করিতেই থাকিলাম। একদিন আমি চটিয়া গিয়া বলিয়া ফেলিলাম : ‘নবাব সাহেব, আমাকে আর কত ঘুরাইবেন? টাকা দিবেন কি না আজ স্পষ্ট কথা বলিতে হইবে।’ নবাব সাহেব আমার কথা বলার ভঙ্গিতে বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলিয়া বলিলেন : ‘বড় যে পাওনাদারের মত মেজে কথা বলিতেছেন। আপনার কথা শুনিয়া মনে হয় আমি যেন আপনার খাতক। আমি সমান জোরে বলিলাম : ‘আলবত আপনি আমার খাতক; আলবত আমি আপনার পাওনাদার।’ নবাব সাহেব চোখ লাল করিলেন। ঘর-ভরা বড়-বড় সাহেব আইসিএস অফিসার। তারা আমার দুঃসাহসে ও আসন্ন বিপদে বিস্মিত ও চিন্তিত হইলেন। কিন্তু আমি বিন্দুমাত্র না ঘাবড়াইয়া মাথা উঁচা করিয়া বলিলাম : আপনি যেদিন প্রকাশ্য সভায় দাঁড়াইয়া সমিতির তহবিলে পাঁচ শত টাকা চাঁদা দিবেন ঘোষণা করিয়াছিলেন, সেইদিন হইতে সমিতি আপনার পাওনাদার। আপনি সমিতির খাতক। আপনি যদি ওয়াদা খেলাফ করিতে চান, তবে বলিয়া দেন সে কথা। আমি সমিতির সভা ডাকিয়া সে কথা বলি। সমিতি আপনাকে মাফও করিয়া দিতে পারে।

নবাব সাহেব আমার দিকে আর না চাহিয়া প্রাইভেট সেক্রেটারিকে একটা পাঁচ শ টাকার চেক লিখিয়া আনিতে বলিলেন। চেক আসিলে তিনি তাতে সই করিয়া আমার দিকে ঠেলিয়া দিলেন। আমিও একটা রসিদ লিখিয়া একটানে ছিঁড়িয়া তাঁর দিকে ঠেলিয়া দিলাম। খুব নুইয়া একটা ‘আদব আরয’ করিয়া বিদায় হইলাম। দুইদিন পরে আমার মনিব মৌ. মুজিবর রহমানের কাছে। নবাব সাহেব বলিয়াছিলেন : ‘আপনার ঐ আবুল মনসুরটা একটা মস্তবড় বেয়াড়া লোক। সে আমাকে সেদিন অফিসারদের সামনে কি বেকায়দায়ই না ফেলিয়াছিল।’ সমস্ত ঘটনা শুনিয়া মৌলবী সাহেব হাসিয়া বলিয়াছিলেন : ‘ছেলেটা অমন বেয়াড়াই বটে।’

.

১৩. চাঁদা দান

দ্বিতীয় ঘটনাটা হক সাহেবের সঙ্গে। বাড়িওয়ালা কর্পোরেশনের বকেয়া ট্যাক্স না দেওয়ায় সেবার আমাদের সমিতি অফিস, লাইব্রেরির বই-পুস্তক, আলমারি ও টেবিল-চেয়ার ক্রোক হইয়াছিল। তিন দিন সময় নিয়াছিলাম। সে তিন দিনের শেষ দিন। সেদিন টাকা শোধ না করিলে পরদিন সকালে নিলাম হইবে। মোট দেনা সাড়ে তিনশ টাকা। সম্পাদকমণ্ডলী আড়াই দিন ঘুরিয়া নবাব, জমিদার, ব্যারিস্টার, উকিল, মার্চেন্ট প্রভৃতি বিরাট ধনী লোকের নিকট হইতে মাত্র পঞ্চাশ টাকার মত চাঁদা তুলিতে পারিয়াছি। তৃতীয় দিনের বেলা তিনটা পর্যন্ত বিনা গোসল-খাওয়ায় তিন-চার-বন্ধু নিতান্ত নিরাশ হইয়া ক্ষুধা ক্লান্ত দেহে বাসায় ফিরিতেছি। পথে মৌলবী ফজলুল হকের বাসা। বাসার সামনে গিয়া হঠাৎ একজন বলিয়া ফেলিলেন : হক সাহেবের কাছে একবার গেলে হয় না? কিন্তু আমরা কথাটায় আমল দিলাম না। আমরা সবাই হক সাহেবের ভক্ত বটে, কিন্তু তাঁর ওটা চরম দারিদ্র্যের সময়। কাবুলী মহাজনের তাগাদায় তিনি রাস্তায় বাহির হইতে পারেন না। তার ভাঙ্গা ফোর্ড মোটরের হেডলাইট, সাইড লাইট কিছুই না থাকায় দুই দিকে দুইটা হ্যারিকেন বাঁধিয়া রাত্রে রাস্তায় বাহির হন। হাইকোর্টে প্রায় যানই না। শুধু মফস্বলে প্র্যাকটিস করেন। তার বাসার অদূরেই একটা মেসে আমরা থাকি। কাজেই এসবই আমাদের জানা কথা। হক সাহেবকে ঋণমুক্ত করিবার জন্য পাবলিকের কাছে অর্থ সাহায্য চাহিয়া কিছুদিন আগে ইয়াকুব আলী চৌধুরী সাহেবের নেতৃত্বে আমরা আবেদনপত্র ছাপিয়া বিলি করিয়াছি। এমন বিপন্ন হক সাহেবের কাছে চাঁদা চাইতে যাওয়া কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়ামাত্র। কিন্তু ঐ বন্ধু জিদ করিলেন : হক সাহেব সমিতির অন্যতম ভাইস প্রেসিডেন্ট। চাঁদা চাই আর না চাই, সমিতির বর্তমান বিপদটা তাকে জানান আমাদের কর্তব্য।

এ যুক্তির জবাব ছিল না। কাজেই আমরা হক সাহেবের বৈঠকখানায় ঢুকিলাম। দেখিলাম তিনি একজন মাত্র মওক্কেল লইয়া বসিয়া আছেন। আমরা সবিস্তারে সব কথা তাঁকে বলিলাম। তিনি মাথা চুলকাইলেন এবং মওক্কেলটির দিকে চাহিয়া বলিলেন : বেশ আমি যাইব। বায়নার টাকা ফেলেন। লুঙ্গি-পরা সাদাসিধা বুড়া মানুষ। জলপাইগুড়ির এক কেসে হক সাহেবকে জলপাইগুড়ি নিতে আসিয়াছেন। হক সাহেবের আদেশে তিনি টেবিলের উপর পাঁচশ টাকা রাখিয়া বলিলেন : এটা বায়না। টিকিট আমি কিনিব। বাকিটা জলপাইগুড়িতে দিব।

হক সাহেব আমাদের দিকে চাহিয়া বলিলেন : তোমাদের দরকার কত?

আমাদের দরকার তিনশ। কিন্তু মোটে পাঁচশ টাকার মধ্যে তিনশ টাকা চাহিতে আমাদের জিভ আড়ষ্ট হইয়া আসিল। আমাদের সংকোচ দেখিয়া হক সাহেব নিজেই হিসাব করিয়া দুইশ টাকা নিজের ড্রয়ার টানিয়া বাকি তিনশ আমাদের দিকে ঠেলিয়া দিলেন। স্তম্ভিত আমরা কম্পিত হস্তে টাকা তুলিয়া নির্বাক সালাম দিয়া বাহির হইয়া আসিলাম।

.

১৪. সাহিত্য-জীবনের মুদ্দত ভাগ

প্রকাশিত পুস্তকগুলির রচনাকালের দিক হইতে আমার সাহিত্যিক জীবনকে চারটি মুদ্দতে ভাগ করা যায়। প্রথম মুদ্দত কলিকাতা-জীবন ১৯২২ হইতে ১৯২৯। দ্বিতীয় মুদ্দত, ময়মনসিংহ-জীবন ১৯৩০ হইতে ১৯৩৮। ১৯৩৮ হইতে ১৯৫০ পর্যন্ত আবার কলিকাতা-জীবন আমার সাহিত্যিক জীবনের তৃতীয় মুদ্দত। ১৯৫০ সাল হইতে আজ পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহের জীবন। আমার চতুর্থ মুদ্দত। পূর্বেকার মুদ্দতে ছাত্রজীবনে আমি যেসব প্রবন্ধ আল এসলাম-এ এবং যেসব গল্প সওগাত-এ লিখিয়াছিলাম, তা পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় নাই বলিয়া এই চার মুদ্দতে সেটা পড়ে না।

১৯২২ হইতে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত এই আট বছরে আমি যেসব গল্প লিখিয়াছিলাম এবং সওগাত-এ প্রকাশিত হইয়াছিল তার প্রায় সবগুলি আয়নায় ছাপা হইয়াছে। কাছাছুল আম্বিয়ার কিচ্ছাগুলি শিশুদের জন্য লিখিত মুসলমানী কথাও এই মুদ্দতেই লেখা। সেটিও পুস্তকাকারে বাহির হইয়াছিল এই মুদ্দতেই আয়না প্রকাশের আগেই। এই মুদ্দতের লেখা আমার গোলামী সাহিত্য ও সভ্যতায় দ্বৈতশাসন ইত্যাদি বিতণ্ডামূলক প্রবন্ধগুলি তৎকালে খুবই আলোড়ন সৃষ্টি করিয়াছিল বটে, তবে সেগুলি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় নাই। এই মুদ্দতে সওগাত-এ যেসব প্রবন্ধাদি ছাপা হইয়াছিল, সেগুলিরও সংগ্রহ পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় নাই।

১৯২৯ সালের শেষ দিকে সাংবাদিকতা ও কলিকাতা ছাড়িয়া উকালতি করিতে আমি ময়মনসিংহ শহরে আসি এবং ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত এখানে থাকি। এই সময়ে সওগাত আমি সাহিত্য ও যুগ-ধর্ম’, ‘মুসলমান সমাজে আনন্দ ইত্যাদি যেসব সাহিত্যিক-সামাজিক প্রবন্ধ লিখিয়াছিলাম সেগুলিও পুস্তকাকারে ছাপা হয় নাই। কিন্তু এই মুদ্দতে আমার জীবন ক্ষুধা নামক বিশাল আকারের নভেলটি সওগাত-এ ক্রমশ প্রকাশিত হইতে শুরু হয়। প্রতিমাসে বাহির হইয়াও চার বছরে শেষ হয়। আমার আয়নাও পুস্তকাকারে এই মুদ্দতেই প্রথম প্রকাশিত হয়।

১৯৩৮ সালে সাংবাদিকতা করিতে আবার কলিকাতা যাই। সেখানে একটানা ১৯৫০ সাল পর্যন্ত বার বছর বাস করি। এই সময়কার লেখা আমার গল্পগুলি ফুড কনফারেন্স-এ এবং দুই-একটা আসমানী পর্দা ও গালিভারের সফরনামাতেও ছাপা হইয়াছে। আমার সত্য-মিথ্যা নভেলও এই মুদ্দতেই লেখা হয়। যদিও এসব পুস্তক আরো পরে ঢাকা আসার বাদে ছাপা হইয়াছে। ছোটদের কাছাছুল আম্বিয়াও এ সময়ে লেখা, কিন্তু পরে ছাপা হইয়াছে।

১৯৫০ সাল হইতে বর্তমান সময় পর্যন্ত মুদ্দতে আমার জীবন ক্ষুধা, সত্য মিথ্যা, আবে হায়াত ইত্যাদি নভেল, আসমানী পর্দা, গালিভারের সফরনামা ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ ও পাক-বাংলার কালচার (বর্তমান বাংলাদেশের কালচার) ও পরিবার পরিকল্পনা নামক সন্দর্ভ পুস্তক, আল-কোরআনের নসিহত নামে সিলেকশন অনুবাদ গ্রন্থও এই মুদ্দতেই বাহির হইয়াছে। এই মুদ্দতেই আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, শেরে বাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু ও এন্ড অব এ বিট্রেয়াল (ইংরাজি) ইত্যাদি রাজনৈতিক গ্রন্থসমূহ প্রকাশিত হইয়াছে।

ময়মনসিংহ উকালতি জীবনে (১৯২৯-১৯৩৮) আমার সাহিত্য-সাধনার বিষয়বস্তুর মধ্যে অভিনবত্ব আসিয়াছিল দুই দিক হইতে : একটি স্বভাবের টানে; অপরটি অভাবের টানে। নিতান্ত দৈবাৎ। প্রথমটি আমার পাঠ্য-পুস্তক লেখা। এটি ঘটে এই ভাবে। কলিকাতার সদাব্যস্ত সাংবাদিক জীবন হইতে এই প্রথম আসিয়াছি মফস্বল শহর ময়মনসিংহের উকালতি জীবনে। নূতন উকিল। কাজ কম। অবসর প্রচুর। আনন্দ মোহন কলেজের আরবি-ফারসির দ্বিতীয় অধ্যাপক মৌ. আসাদুজ্জমান সাহেব এই শহরেরই ফিরোয় লাইব্রেরি’র মালিক। তিনি আমাকে ধরিলেন শিশু পাঠ্য-পুস্তক লিখিতে। তার অনুরোধে নয়া পড়া নামে চার খণ্ডের একটি পাঠ্য-পুস্তক লিখিলাম। মকতবের ১ম, ২য় ও ৪র্থ শ্রেণীর জন্য পুস্তক চারটি কমপালসারি পাঠ্য-পুস্তক নির্বাচিত হইল। চার বছর পাঠ্য থাকিল। প্রচুর বিক্রি হইল। আমার বেশ অর্থাগম হইল। নূতন উকিলের প্র্যাকটিসের স্বল্পতাহেতু অর্থাভাব এতে পোষাইয়া গেল। এ সম্বন্ধে অন্যত্র বিস্তারিত আলোচনা হইয়াছে। অতএব এখানে এ বিষয়ে আর কিছু লিখিলাম না।

.

১৫. অভিনব বিষয়বস্তু

দ্বিতীয়টা, আমার জীবনে প্রথম যৌনবিজ্ঞানের পুস্তক রচনা। এটি ঘটে এইভাবে। আমার ছাত্রজীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম পরে খান বাহাদুর এই সময়ে ময়মনসিংহে মুনসেফ। নবাবযাদা সৈয়দ হাসান আলী এই সময়ে এই শহরে তাঁর নিজস্ব প্রাসাদ হাসান মনজিলে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করিয়াছেন। আমার সাথে রাজনীতি করিবার উদ্যোগ গ্রহণ করিতেছেন। আমরা খুবই ঘনিষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছি। সিরাজুল ইসলাম সাহেব ও নবাব্যাদা ঘন-ঘন আমার বাসায় যাতায়াত করেন। আমার স্ত্রী এই সময়ে (১৯৩৫ সালে) তৃতীয় পুত্র মতলুব আনামকে প্রসব করিয়াই টাইফয়েড জ্বরে ঘোরতর অসুস্থ হইয়া পড়িয়াছেন। তাঁর খোঁজখবর করিতে তারা আরো বেশি ঘন-ঘন আসিতে বাধ্য হন। কারণ আমি এ সময়ে কোর্টে খুবই কম যাইতে পারিতাম। এমনি দিনে তারা দুইজনই এক সঙ্গে এ জিলার এডিশনাল এসপি মি. আবুল হাসানাত মোহাম্মদ ইসমাইলের সাথে আমার পরিচয় করাইয়া দেন। তাদের প্রস্তাব : আবুল হাসানাত সাহেব উদীয়মান সাহিত্যিক। তিনি একটি পুস্তক রচনা করিয়াছেন। আমাকে পুস্তকখানা সংশোধন করিয়া দিতে হইবে। এসপি সাহেব আমাকে যথেষ্ট পারিশ্রমিক দিবেন। আমার বর্তমান অসুবিধা ও অভাবের মধ্যে এতে আমার খুবই উপকার হইবে।

আমি রাজি হইলাম। আবুল হাসানাত সাহেব তার লেখা যে পাণ্ডুলিপিটি আমাকে দিলেন, সেটি একটি যৌন পুস্তক। কলিকাতার আন্ডার ওয়ার্ল্ড বাজারে এই ধরনের পুস্তকের গোপন বিক্রির কথা আমি কিছু-কিছু জানিতাম। এই ধরনের অশ্লীল পুস্তক রচনাকে আমি পাপ ও অপরাধ মনে করিতাম। কাজেই এসপি সাহেবের এ কাজে সহায়তা করিতে আমি অস্বীকার করিলাম। এসপি সাহেব তখন আমাকে বুঝাইলেন, অশ্লীল যৌন রচনা তার উদ্দেশ্য নয়। তিনি পশ্চিমী সভ্য জগতে প্রচলিত বিজ্ঞানের সাহিত্যই রচনা করিতে চান। এই ধরনের কোনও পুস্তক আমি পড়ি নাই, জানিতে পারিয়া তিনি অবাক হইলেন এবং কিছু কিছু পুস্তক আমাকে দিতে লাগিলেন। এইভাবে তিনি আমাকে হ্যাভলক এলিস, ফোরেল এবং মেরিস্টোপস প্রভৃতির বেশ কিছু বই পড়িতে দিলেন। ফলে এই ধরনের পুস্তক রচনায় এসপি সাহেবকে সহায়তা করিতে রাজি হইলাম। জনাব সিরাজুল ইসলাম ও নবাব্যাদার মধ্যস্থতায় আমার পক্ষে সুবিধাজনক আর্থিক চুক্তি হইয়া গেল। এসপি সাহেব আমার স্ত্রীর চিকিৎসা খরচা বাবত বেশ কিছু টাকা অগ্রিম দিলেন। ঔষধের দামের সব বিল তাঁর কাছে পাঠাইবার জন্য ঔষধের দোকানদারকে বলিয়া দিলেন। আমি কোর্টে যাওয়া প্রায় একদম বন্ধ করিয়া দিয়া রুগ্‌ণ স্ত্রীর শুশ্রূষায় ও যৌন বিজ্ঞানের বিশাল বিশাল পুস্তক পড়ায় লাগিলাম। আমার স্ত্রীর অসুখ সারিতে চার মাস লাগিয়াছিল। সম্পূর্ণ সুস্থ হইতে আরো দুই মাস লাগিয়াছিল। প্রথম চার মাস আমি শুধু পড়িলাম ও নোট করিলাম। পরের দুই মাস আমি অবিরাম লিখিয়া গেলাম। চার মাসে আমি মোট ১৪৩ খানা যৌন বিজ্ঞানের বই পড়া শেষ করিয়াছিলাম। এর মধ্যে চল্লিশখানার বেশি বড়-বড় বই। আর শত খানেকের বেশি চটি বই। এর প্রায় সবাই এসপি সাহেব এ জিলার চার-পাঁচটি বড়-বড় জমিদার বাড়ির লাইব্রেরি হইতে যোগাড় করিয়াছিলেন। এঁদের মধ্যে ময়মনসিংহের ও সুশুঙ্গের মহারাজা, মুক্তাগাছা ও গৌরীপুরের রাজা, শেরপুর ও আঠারবাড়ির জমিদারদের লাইব্রেরিই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রাজা-জমিদাররা এইসব পুস্তক লাইব্রেরি হইতে বাহিরে যাইতে কখনও দিতেন না। কিন্তু একজন এসপির অসাধ্য তৎকালে কিছুই ছিল না।

এসব পুস্তক ছাড়া দুই-একখানা সর্বাধুনিক যৌন-বিজ্ঞানের বইও তিনি নিজে বিদেশ হইতে খরিদ করিলেন। এইসব বইয়ে দীর্ঘ চার মাস কাল আমি এমন ডুবিয়াছিলাম যে, এই চার মাস কেমন করিয়া কাটিয়া গেল, আমি যেন তার টেরই পাইলাম না। এই সব বই পড়িয়া আমি সম্পূর্ণ নূতন জ্ঞান লাভ করিলাম। সাধারণভাবে জীবন-দর্শন বিশেষভাবে যৌন-জীবন সম্পর্কে আমার ধ্যান-ধারণা বহু পরিবর্তন হইল। অতিশয়োক্তি না করিয়াও বলা যায়, আমি যেন জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিকে একদম অন্ধকার হইতে আলোর রাজ্যে চলিয়া আসিলাম।

ফলে যে কাজ শুরু করিয়াছিলাম অনিচ্ছা ও অভক্তি লইয়া নিতান্ত আর্থিক টানে বাধ্য হইয়া, সেই কাজই শেষ করিলাম স্বেচ্ছায়, সশ্রদ্ধভাবে এবং বিপুল জ্ঞান ও আনন্দ-উৎসাহের মধ্য দিয়া। মানসিক এই পরিবর্তনে দেহে ও হাতে এমন শক্তি ও উদ্যম আসিল যে দেড়শ বইয়ের সারমর্ম পাঁচশ পৃষ্ঠার একটি বইয়ে জমাট বাঁধাইলাম বিনা আয়াসে দুই মাস সময়ে। লেখাটাও এমন প্রাণবন্ত, জোরালো, যুক্তিপূর্ণ ও শালীন ভাষায় রচিত হইল যে, যিনি এই বইয়ের জন্য ছয় মাসে আমাকে ছয় হাজারের বেশি টাকা দিলেন, তিনি পুস্তকের ভূমিকার একাংশ পড়িয়াই আর পড়িলেন না। সোজা ছাপার ব্যবস্থা করিলেন। মধ্যস্থ বন্ধুদ্বয় সিরাজুল ইসলাম ও নবাবদা পড়িতে বা শুনিতেও চাহিলেন না। বলিলেন : আমরা জানিতাম মনসুর সাব যা লিখিবেন, তাই শ্রেষ্ঠ হইবে। পড়িয়া দেখিতে হইবে কেন?

বড়াই-অহংকার না করিয়াও বলা যায় যে চল্লিশ বছর আগে, তকালীন সমাজ-চিন্তার স্তরে ও জনমতের সেই পরিবেশে যৌন-বিজ্ঞানের প্রথম বাংলা গ্রন্থটি সত্যই ভাল হইয়াছিল। তার প্রমাণ এই যে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের মত চিরকুমার ব্রহ্মচারী-বিজ্ঞানী-দর্শনী এই পুস্তকটিকে ‘যৌন-সংহিতা’ বলিয়া অভিনন্দিত করিয়াছিলেন। তাছাড়া ডা. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, ডা. গিরিন্দ্র চন্দ্র দে প্রভৃতি বিশেষ-বিশেষ দৃঢ় মতবাদী পণ্ডিত ব্যক্তিগণও এই পুস্তকের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিয়াছেন। কলিকাতার সকল মত, শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের দৈনিক, সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ও মাসিকাদি সাহিত্য-পত্র যেভাবে এই তথাকথিত অশ্লীল বিষয়ে লেখা পুস্তকের প্রশংসা করিয়াছেন ও এর প্রকাশককে অভিনন্দন জানাইয়াছেন, তাতে বলা যায়, বইটি সকল দিক দিয়াই সুলিখিত হইয়াছিল।

বইটি ছাপিতে দেওয়া হইয়াছিল কলিকাতা মোহাম্মদী প্রেসে। মোহাম্মদী প্রেসের সব প্রবীণ ও প্রধান কম্পোযিটররাই দীর্ঘদিনের পরিচিতির ফলে আমার হাতের লেখা চিনিতেন। প্রেসে যাওয়া-মাত্র তারা ধরিয়া নিলেন ওটা আমার বই। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় ও উপরওয়ালাদের কাছে খবর দেওয়ার সময় তারা ওটাকে ‘মনসুর সাহেবের বই’ বলিয়াই উল্লেখ করিতেন। এ সব কথা আমাকে বলিলেন আবুল হাসানাত সাহেব নিজেই। তিনি এ সব খবর আমাকে দিলেন আমাকে তাঁর বইয়ের একটা প্রুফ দেখিতে অনুরোধ করিয়া। তিনি নিজেই ছুটি লইয়া কলিকাতা থাকিয়া আসিয়াছেন। কিন্তু প্রফ দেখায় তিনি তখনও উস্তাদ নন। খুব ভাল প্রুফরিডার তিনি রাখিয়াছেন সত্য, কিন্তু তাদের দিয়া বিশ্বাস পাইতেছেন না। আমি ত কৃষক-প্রজা সমিতির কাজে ঘন-ঘন কলিকাতা গিয়াই থাকি; এ কাজে কিছুদিন বেশি করিয়া থাকিয়া-থাকিয়া এক-একটা ফাইনাল প্রুফ দেখিয়া দিলে খুব ভাল হয়। সেজন্য তিনি আমাকে যথেষ্ট ক্ষতিপূরণ দিবেন। ততদিনে ১৯৩৫ সাল পার হইয়া ‘৩৬ সালে পড়িয়াছে। আসন্ন নির্বাচনে কৃষক প্রজা পার্টি কনটেস্ট করিবে। এই উপলক্ষে সত্যই আমাকে ঘন-ঘন কলিকাতা যাতায়াত করিতে হইতেছিল। তাছাড়া নিজের লেখা ছাপার সময়ে প্রুফ দেখার আগ্রহ আমার বরাবরের। নিজের লেখাটা, তা যার নামেই প্রকাশ হউক না কেন, ভুল ছাপান হইলে আমার মনে অসহনীয় কষ্ট হইত। কাজেই আমি রাজি হইলাম। সপ্তাহ-পনের দিনে কলিকাতা যাতায়াত করা, সেখানে থাকা-খাওয়া আমার ব্যবসায়িক লোকসান ইত্যাদি সাকুল্য বিষয় বিবেচনা করিয়া তিনি আমাকে এবারেও যথেষ্ট টাকা দিলেন। আমাকে প্রুফরিডার পাইয়া প্রেসও কাজে জোর দিল। ত্রিশ-বত্রিশ ফর্মার বই দুই মাসে ছাপা হইয়া গেল। ছাপা শেষ হইয়া আসিতে থাকায় আবুল হাসানাত সাহেব আমাকে আরেক বিপদে ফেলিলেন। তিনি আমাকে তার বইয়ের কো-অথার রূপে নাম দিতে চাপিয়া ধরিলেন। আমার মধ্যস্থ বন্ধুদ্বয়ও সে অনুরোধে যোগ দিলেন। কিন্তু এবার আমি দৃঢ়তার সাথে অস্বীকার করিলাম। দুই কারণে। এক, আমি তখনও পাক্কা কংগ্রেসি। অধিকাংশ কৃষক-প্রজা নেতা-কর্মীও তাই। জিলার পুলিশ সুপারের সাথে বইয়ের কো-অথার রূপে নাম ছাপা হইলে সহকর্মী ও কংগ্রেসি সার্কেলে আমার বদনামের সীমা থাকিবে না, এ ভয়ে আতঙ্কিত হইলাম। দুই, আমি নিজে ততদিনে যৌন-বিজ্ঞানকে একটি সুষ্ঠু-শালীন বিজ্ঞান বলিয়া মানিয়া লইয়াছি বটে, কিন্তু আমাদের দেশের পাবলিক তখনও ওটাকে অশ্লীল কুকর্ম বলিয়াই জানিত। সরকারি অফিসাররা বিশেষত একজন পুলিশ অফিসার অনায়াসে জনমত অগ্রাহ্য করিয়া চলিতে পারেন। কিন্তু একজন রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর পক্ষে ওটা সম্ভব নয়। আমাদের মধ্যস্থ বন্ধুদ্বয়কে। উভয় আপত্তিই জানাইলাম বটে, কিন্তু আবুল হাসানাত সাহেবকে শুধু দ্বিতীয় আপত্তির কথাই জানাইলাম। আবুল হাসানাত সাহেব অগত্যা আমাকে কো অথার করার অভিপ্রায় ত্যাগ করিলেন। কিন্তু নিজে একটি সংক্ষিপ্ত ‘গ্রন্থকারের নিবেদন’ লিখিয়া তাতে বলিলেন, ‘সুসাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ’ এই গ্রন্থ রচনায় আমাকে বিশেষ সহায়তা করিয়াছেন।

আমি নিজে যতই গোপন করিতে চেষ্টা করি না কেন, মুসলিম সাংবাদিক ও রাজনৈতিকদের কাছে ধরা পড়িয়া গেলাম। প্রধানত মোহাম্মদী আফিস হইতে এটা প্রকাশ হইয়া পড়িল। আবুল হাসানাত সাহেব চারিত্রিক সবলতার দরুন নিজেই তার বন্ধুমহলে এটা প্রকাশ করিয়া দিলেন। মোহাম্মদী আফিস হইতে এই সময় দৈনিক আজাদ বাহির হয়। প্রজা সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সেক্রেটারি মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ সাহেব এই সময় মুসলিম লীগে যোগ দেন। ফলে মোহাম্মদী তথা আজাদ আফিস মুসলিম লীগ নেতা-কর্মীদের আড্ডায় পরিণত হয়। সেখান হইতে প্রায় সকল মুসলিম রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা যৌন-বিজ্ঞানের রচনায়। গোপন তথ্য জানিয়া ফেলিলেন। হিন্দু সাংবাদিক বন্ধুরা এবং কংগ্রেসি সহকর্মীরা এটা জানিলেন আনন্দবাজার পত্রিকার মারফতে। কলিকাতার সব ইংরাজি, বাংলা দৈনিক পত্রিকায় সদ্য-প্রকাশিত ‘যৌন-বিজ্ঞানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা বাহির হয়। আনন্দবাজার পত্রিকার সমালোচক এক ডিগ্রি আগাইয়া যান। বিরাট আকারের সমালোচনা। তাতে অন্যান্য কথার সঙ্গে এ কথাও বলেন : “এই গ্রন্থের ভাষা পড়িয়া আমরা বুঝিলাম গ্রন্থকারকে আমরা চিনি। তিনি ছদ্মনামে এই বই লিখিয়াছেন। এই সময় আমার শ্রদ্ধেয় বন্ধু মি. সত্যেন্দ্র নাথ মজুমদার আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক। আমরা হিন্দু মুসলিম সাংবাদিকরা প্রায় সবাই তাকে সত্যেনদা বলিয়া ডাকিতাম। এই সময় আমি সাংবাদিকতা ছাড়িয়া দেওয়া সত্ত্বেও কলিকাতা সফরের সময় প্রায়ই আনন্দবাজার পত্রিকা আফিসে গিয়া সত্যেনদা’র সম্পাদকীয় রুমে আড্ডা দিতাম। যৌন-বিজ্ঞান বাহির হইবার পর একদিন আমি এমনি ধরনের আনন্দবাজার পত্রিকার আফিসে সত্যেনদার রুমে হাজির হইলে সত্যেনদা সমাগত বন্ধুদের (যাদের অনেকেই আমার পূর্বপরিচিত) উদ্দেশ্য করিয়া বলিলেন : বহুল প্রশংসিত যৌন-বিজ্ঞানের আসল গ্রন্থকারের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করাইয়া দিতেছি। সমবেত বন্ধুদের বিস্ময়-কৌতূহলের জবাবরূপেই যেন তিনি আমার রচনার বৈশিষ্ট্য, শব্দপ্রয়োগে নিজস্বতা, ভাষার সাবলীল তেজস্বিতা, স্টাইলের অনুকরণীয়তা ইত্যাদি তাঁরই নিজস্ব ভাষার গুণাবলি উদারভাবে আমার উপর আরোপ করিয়া আমার প্রাপ্যাধিক প্রশংসা করিলেন। এ ব্যাপারে সত্যেনদা সত্যই অতুলনীয়ভাবেই উদার ও মুক্ত-রসনা ছিলেন।

আবুল হাসানাত সাহেব তাঁর ‘যৌন-বিজ্ঞান’-কে পরবর্তীকালে আকারে অনেক বিশাল ও বিষয়-সম্ভারে আরো অনেক সমৃদ্ধিশালী করিয়াছেন। এসব কৃতিত্বপূর্ণ কাজে আমার কিছুমাত্র অবদান বা সহযোগিতা নাই। এ সবই তাঁর নিজস্ব কীর্তি। তিনি আগে হইতেই স্বাধীন চিন্তক ও শক্তিশালী লেখক ছিলেন। যৌন-বিজ্ঞানকে উন্নততর মানের গ্রন্থে পরিণত করা ছাড়াও এ সম্পর্কে আরো অনেক বই-পুস্তক লিখিয়া তিনি যশস্বী হইয়াছেন।

হয়ত গোড়ায় আমার প্রদর্শিত পন্থায় তিনি কিছুটা উপকৃত হইয়াছেন। কিন্তু আমি নিজে উপকৃত হইয়াছি অনেক বেশি। তার দেওয়া উল্লিখিত বিপুল সংখ্যক বই পড়িয়া আমার জীবন-দর্শনে প্রভূত প্রসারতার উন্মেষ হইয়াছে সে কথা আগেই বলিয়াছি। তাছাড়াও আবুল হাসানাত সাহেবের প্রদর্শিত পথে আরো অগ্রসর হইয়া কিছুদিনের মধ্যেই ফ্রয়েড ও ইয়ুংয়ের বই-পুস্তকের ও মনোবিকলনের সঙ্গে পরিচিত হই। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে মনোবিকাশের ফলে ফ্রয়েডিয়ান মতবাদের শুধু ভক্ত পাঠকই হই নাই, তার মতবাদের তীব্র সমালোচকও হইয়াছি।

সক্রিয় রাজনীতি ও উকালতি হইতে অবসর গ্রহণের পর বৃদ্ধ বয়সে নিজেই পরিবার পরিকল্পনা নামে যৌন-বিজ্ঞানের একখানা বইও লিখিয়া ফেলিয়াছি। তাতে আমি খাদ্যাভাব মোচনের প্রচলিত উদ্দেশ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের চেয়ে দম্পতি ও পরিবারের সুখ-শান্তির জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণকে উচ্চতর ও মহত্তর জীবন-বিধি রূপে প্রমাণ করিবার চেষ্টা করিয়াছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *