১৯. তৃতীয় পর্যায় ‘নবযুগ’

অধ্যায় উনিশ – তৃতীয় পর্যায়

১. ‘নবযুগ’

১৯৪১ সালের অক্টোবর মাসে হক সাহেব নবযুগ বাহির করেন। আমি ইহার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করি। কিন্তু উহাতে সম্পাদকরূপে আমার নাম দিতে রাজি হই নাই। ইহার একাধিক কারণ ছিল। প্রথমত, যদিও আমি সাংবাদিকতাকে প্রফেশন হিসাবে গ্রহণ করিয়া ব্যক্তিগত মতামত নিরপেক্ষভাবে যে কোনও মতের কাগজে চাকুরি নিতে সাংবাদিক বন্ধুদের উপদেশ দিতাম। কিন্তু আমি নিজে তা করিতে রাজি ছিলাম না। কারণ আমার নিজের একটা রাজনীতিক জীবন ছিল। সেটা নষ্ট করিতে আমি প্রস্তুত ছিলাম না। দ্বিতীয়ত, যে উদ্দেশ্য প্রচারের জন্য হক সাহেব নবযুগ বাহির করিলেন, সে উদ্দেশ্যের সহিত আমার পূর্ণ সহানুভূতি থাকিলেও হক সাহেবের মতের স্থিরতায় আমার আস্থা ছিল না। মুসলিম লীগ নেতৃত্বের সাথে বিশেষত জিন্নাহ সাহেবের সহিত হক সাহেবের বিরোধের মূল কথা আমি জানিতাম। মুসলিম বাংলার স্বার্থ জিন্নাহ নেতৃত্বের হাতে নিরাপদ নয় বলিয়াই হক সাহেব জিন্নাহ সাহেবের সাথে কলহ করিতেছেন, হক সাহেবের এ কথা আমি বিশ্বাস করিতাম। নবযুগ বাহির হইবার মাসাধিক কাল আগে হইতেই হক সাহেব তার উদ্দেশ্যের কথা আমাকে বলেন এবং আমার সহযোগিতা দাবি করেন। আমার কলমের উপর হক সাহেবের আস্থা ছিল। তিনি মুসলিম লীগে থাকিয়া মুসলিম লীগ প্রধানমন্ত্রী হিসাবেই নবযুগ বাহির করিতেছেন। অথচ শেষ পর্যন্ত মুসলিম লীগ হইতে তিনি বাহির হইয়া আসিবেন। এসব ব্যাপারে তাঁর ধারণা ছিল সুস্পষ্ট। এ অবস্থায় নবযুগ-এর সম্পাদকীয় নীতি পরিচালনার দায়িত্ব তিনি আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে দিয়া বিশ্বাস পাইতেছেন না, হক সাহেবের এসব কথাও আমি বিশ্বাস করিয়াছিলাম। দাম্ভিকতা ও অহংকার না করিয়াও আমি বলিতে পারি, আমার মত উকিল-সম্পাদক ছাড়া আর কারো পক্ষে এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে হক সাহেবের পছন্দ-মত কাগজ চালানো সম্ভব ছিল না। এ অবস্থায় আমি সর্ব শক্তি দিয়া হক সাহেবের সমর্থন করিতে প্রস্তুত ছিলাম। এর উপর আমার বিশেষ অন্তরঙ্গ শ্রদ্ধেয় বন্ধু সৈয়দ বদরুদ্দোজা আমাকে বুঝাইলেন যে মুসলিম বাংলার স্বার্থে হক নেতৃত্বের পিছনে দাঁড়াইতে তাঁর মত বহু মুসলিম লীগার প্রস্তুত। আসল কারণ তারাও বিশ্বাস করেন যে হক সাহেব জিন্নাহ সাহেবের নিকট পরাজিত হইলে অথবা হক সাহেবের রাজনৈতিক অপমৃত্যু ঘটিলে মুসলিম বাংলার ভবিষ্যৎ নাই। সুতরাং হক সাহেবের নবযুগ-এ যোগ দেওয়া সম্বন্ধে আমার মনে কোনও দ্বিধা থাকিল না। এলাউন্সসহ মাসে তিনশ টাকা বেতনের অফার দিয়া আর্থিক দিক দিয়া আমার আপত্তিও খণ্ডন করা হইয়াছিল। এসব সত্ত্বেও আমি সন্দেহ করিতাম এবং আমার অনেক বন্ধুও আমার সাথে একমত হইতেন যে, হক সাহেব যে কবে আবার লীগের সাথে রফা করিয়া ঘুরিয়া দাঁড়াইবেন, তার কোনও নিশ্চয়তা নাই। তৃতীয়ত, আমি জানিতাম নবযুগ বেশি দিন টিকিবে না। কারণ আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এই যে, রাজনৈতিক নেতাদের স্থাপিত কাগজ স্থায়ী হয় না। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, মি. জে এম সেন গুপ্ত, শ্রীযুক্ত শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী, পণ্ডিত জওয়াহরলাল নেহরু প্রভৃতি বড়-বড় নেতা নিজস্ব দৈনিক কাগজ বাহির করিয়াছেন। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ধুমধামের মধ্যে কাগজ চলিয়াছে কিছুদিন। তারপর সব ঠাণ্ডা। হক সাহেবের কাগজও এর ব্যতিক্রম হইবে না। সুতরাং ব্যাপারটা যখন শেষ পর্যন্ত একটা অনিশ্চিত এক্সপেরিমেন্ট তখন সম্পাদকরূপে নিজের নামটা দিয়া বদনাম কিনি কেন? বদনামের কথা আমি এই জন্য বলিলাম যে হক সাহেবের বিরুদ্ধে গত তিন চার বছর যত-কিছু লিখিয়াছি ও সভা-সমিতিতে যে সব কথা বলিয়াছি, নবযুগ-এ সে সবেরই উল্টা উতার গাইতে হইবে। তাছাড়া উকালতি সাসপেন্ড করারও রিস্ক ছিল।

.

. বেনামী সম্পাদক

কাজেই হক সাহেবকে পাল্টা প্রস্তাব দিয়াছিলাম। সম্পাদকরূপে তাঁর নিজের নাম দিতে হইবে। যুক্তি দিলাম, প্রথম পর্যায়ে বিশ বছর আগের নবযুগ-এর সম্পাদকরূপে তাঁরই নাম ছিল। তার পছন্দ হইল। তিনি নিমরাজি হইলেন। কিন্তু সপ্তাহখানেক পরে তিনি জানাইলেন যে সরকারি আইন ও স্বরাষ্ট্র বিভাগ আপত্তি করিয়াছে। লাট সাহেবও বারণ করিয়াছেন। অতঃপর বন্ধুবর সৈয়দ আজিজুল হক (নান্না মিঞা), জনাব ওয়াহিদুযযামান (ঠাণ্ডা মিঞা) ও স্নেহাস্পদ মাহমুদ নূরুল হুদা প্রভৃতির সঙ্গে পরামর্শ করিয়া হক সাহেবের সম্মতিক্রমে কাজী নজরুল ইসলামের নাম ঠিক করিলাম। কাজী সাহেব এ সময় দায়-দেনায় খুবই বিপন্ন ছিলেন। পাওনাদাররা ডিক্রিজারী করিয়া তাকে অপমান করিবার চেষ্টা করিতেছে। পক্ষান্তরে তার পাবলিশাররা ও গ্রামোফোন কোম্পানিরা তাকে ঠকাইতেছে। এ সময়ে কাজী সাহেবকে আর্থিক সাহায্য করাও হইবে। আমার সাড়ে তিনশ টাকা বেতন অফার করিলাম। কিছু করিতে হইবে না, মাঝে-মাঝে বিকাল বেলা আফিসে আড্ডা। এবং সপ্তাহে এক-আধটা কবিতা দিলেই যথেষ্ট। কাজী সাহেব রাজি হইলেন। ধুমধামের সাথে নবযুগবাহির হইল। চলিলও ভাল। কাজী সাহেব সত্য-সত্যই সন্ধ্যার দিকে আফিসে আড্ডা দিতে লাগিলেন। মুসলিম ছাত্র তরুণরা হক সাহেবের নয়া নীতিতে কতকটা, নজরুল ইসলামের আকর্ষণে কতকটা, নবযুগ আফিসে ভিড় করিতে লাগিল। আচ্ছা খুব জমিয়া উঠিল। নজরুল ইসলামও উৎসাহিত হইয়া উঠিলেন। তিনি জোরদার কবিতাই শুধু নয়, দুই-একটা সম্পাদকীয়ও লিখিয়া ফেলিলেন। এমনই একটার মধ্যে জিন্নাহ সাহেবকে কাফের’ ও পাকিস্তানকে ফাঁকিস্তান’ বলাতে মুসলিম লীগ মহলে আগুন লাগিল। নবযুগ বাহির হওয়ায় আজাদ স্বভাবতই আতঙ্কগ্রস্ত হইয়াই ছিল। এই সুযোগে নবযুগও নজরুল ইসলামকে কঠোর ভাষায় গাল দিয়া এক সম্পাদকীয় লিখিলেন। নজরুল ইসলামের নাম সম্পাদক হিসাবে প্রকাশিত হওয়ায় আমি কবি ও কাদা’ নামে একটি দস্তখতী সম্পাদকীয় লিখি। লেখাটা সত্যই মর্মস্পর্শী ও যুক্তিপূর্ণ হইয়াছিল। ছাত্র-তরুণরা ও সাহিত্যিক-সাংবাদিক মহলে উহা উচ্চ প্রশংসা লাভ করল। অনেকে আফিসে আসিয়া, অনেকে টেলিফোনে আমাকে কংগ্রেচুলেট করিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, নজরুল ইসলাম আমাকে ধন্যবাদ দিতে আসিয়া, আমার হাত ধরিয়া আনন্দে কাঁদিয়া ফেলিলেন। আমি নজরুল ইসলামের তর্কিত প্রবন্ধটা ছাপা হওয়ার দরুন নিজেই দুঃখিত ছিলাম। আমার অবর্তমানে লেখাটা ছাপা হইয়া যাওয়ায় নিজের উপরও যেমন রাগ ছিল, নজরুল ইসলামের উপরও গোস্বা ছিল। কিন্তু নজরুল ইসলামের শিশুসুলভ সরলতায় আমি এই দিন সব ভুলিয়া গেলাম।

কিন্তু নজরুল ইসলামের লেখায় কাজ হইল। হক সাহেব ও জিন্নাহ সাহেবের মধ্যে যে আপোস একরূপ চূড়ান্ত হইয়া গিয়াছিল, কাজী সাহেবের ঐ লেখাকে কেন্দ্র করিয়া সে আপোস ভণ্ডুল হইয়া গেল। নবযুগ বাহির হইবার দুই-আড়াই মাস মধ্যে ১৯৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে মুসলিম লীগ ত্যাগ করিয়া হক সাহেব ‘প্রোগ্রেসিভ কোয়ালিশন পার্টি গঠন করিলেন এবং কংগ্রেস, হিন্দু সভা, কৃষক প্রজা সব পার্টিকে লইয়া নয়া মন্ত্রিসভা গঠন করিলেন।

প্রস্তুতই ছিলাম। কলম ঘুরাইয়া ধরিলাম। আগের কথা ত পুরান কথা, গত আড়াই মাস ধরিয়া যা কিছু লিখিয়াছি সে সব কথাও উল্টাইয়া বলিতে শুরু করিলাম। এবার সত্য-সত্যই প্রফেশনাল সাংবাদিকতা শুরু করিলাম। অর্থাৎ নিজের মতামত, আদর্শ ও বিবেক-বুদ্ধি চুঙ্গায় ভরিয়া রাখিয়া নূতন নূতন যুক্তিতে প্রোগ্রেসিভ কোয়ালিশনকে জনপ্রিয় ও সফল করিতে উকিলের মতই আরগুমেন্ট করিতে লাগিলাম। এ কাজে এমন সফল হইয়াছিলাম যে, এই কোয়ালিশনের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ও নেতা জনাব সৈয়দ নওশের আলী সাহেব একদিন নবযুগআফিসে আমার রুমে আসিয়া বলিলেন : কংগ্রেচুলেশন মনসুর সাহেব। আমি নীতিগতভাবেই খবরের কাগজ পড়ি না; কিনিয়া পয়সা অপব্যয় ত করিই না : খবরের কাগজের আফিসেও যাই না। বিনা পয়সায় যায়। বলিয়া নবযুগআমার বাড়িতে ঢুকিতে পারে। আপনার লেখা আমার ভাল লাগে বলিয়া দুই-একদিন নবযুগআমি পড়িয়া থাকি। আপনি প্রোগ্রেসিভ কোয়ালিশন। সম্পর্কে ক্রমান্বয়ে যে পাঁচ-সাতটা এডিটরিয়েল লিখিয়াছেন, আপনি শুনিয়া আশ্চর্য হইবেন যে সবগুলি আমি এক নিশ্বাসে পড়িয়া ফেলিয়াছি।

আমি গালটি প্রশস্ত করিয়া বলিলাম : তবে ত কংগ্রেচুলেশন দিতে হয় আপনাকেই। কী হইয়াছে?

সৈয়দ সাহেবও হাসিয়া বলিলেন : হইবে আর কী? বুকের বোঝা নামিয়াছে। প্রোগ্রেসিভ কোয়ালিশন করিয়া আমার চোখের ঘুম গিয়াছিল। ভাল করিলাম কি মন্দ করিলাম বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিলাম না। আপনার সম্পাদকীয় কয়টা পড়িয়া এতদিনে বুঝিলাম, এমন ভাল কাজ জীবনে আর একটাও করি নাই। আমাদের এই কাজের সমর্থনে যে এত-এত যুক্তি আছে, আপনার লেখা পড়িবার আগে তা জানিতাম না।

সৈয়দ সাহেবের কথার জবাবে আমি মুখে কিছু বলিলাম না বটে কিন্তু মনে-মনে বলিলাম: আপনার ও আমার অবস্থা একই। লিখিবার আগে আমিও জানিতাম না যে আপনাদের পক্ষে অত কথা বলিবার আছে।

বস্তুত প্রোগ্রেসিভ কোয়ালিশনের সমর্থনে পরপর কয়েকদিন এডিটরিয়েল লিখিয়া আমি নিজেই নিজের যুক্তির ফাঁদে পড়িলাম। যদিও প্রোগ্রেসিভ কোয়ালিশন গঠনে আমার কোনও কনট্রিবিউশন ছিল না, সুতরাং উহাকে সফল করিবার কোনও দায়িত্ব আমার ছিল না। ক্রমেই আমার মনে হইতে লাগিল চেষ্টা করিলে ইহাকে সফল করা যাইতে পারে এবং সে চেষ্টা করাও উচিৎ। এমন সময় হক সাহেব এক বিবৃতিতে বলিলেন : ডা. শ্যামাপ্রসাদ মুসলিম বাংলার স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছেন, আর হক সাহেব স্বয়ং নিয়াছেন হিন্দু বাংলার স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব। হক সাহেব তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে যতগুলি ঐতিহাসিক ঘোষণা করিয়াছেন, তার মধ্যে এইটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঘোষণা। কারণ হিন্দু সভার নেতা ডা. শ্যামাপ্রসাদকে এই সময় বাংলার, এমনকি গোটা ভারতের, মুসলমানরা নিজেদের সবচেয়ে বড় শত্রু মনে করিত। সেই ডা. শ্যামাপ্রসাদকেই মুসলিম স্বার্থ রক্ষার ভার দেওয়া হইয়াছে শুনিয়া মুসলমানরা সোজাসুজি বুঝিল বাঘের হাতেই ছাগল রাখানি দেওয়া হইয়াছে।

.

. আমার রাজনীতিক সাংবাদিকতা

কিন্তু আমি হক সাহেবের ঐ ঘোষণার মধ্যে প্রোগ্রেসিভ কোয়ালিশনের সাফল্যের চাবিকাঠি দেখিতে পাইলাম। বাহ্যত অসম্ভব এবং হাস্যকর এ ঘোষণা স্পষ্টতই একটা রাজনৈতিক স্টান্ট। সাংবাদিকের দায়িত্ব এটা নয়। ‘রাজনীতি’ ও ‘সাংবাদিকতা সম্পূর্ণ আলাদা কাজ। সাংবাদিকতা উকিলের মত ‘প্রফেশনাল’ মাত্র, এসব কথা মাত্র কয়েকদিন আগে প্রচার করিয়াছি; ওটা তখনও আমার দৃঢ় মত। তবু আমি হক সাহেবের নবযুগ-এ চাকুরি নিয়া তাঁর রাজনীতিতে জড়াইয়া পড়িলাম। সেটা পারিলাম দুই কারণে। প্রথমত, রাজনীতি ও সাংবাদিকতার স্বাতন্ত্রটা আমার সাম্প্রতিক মত। অভিজ্ঞতালব্ধ উপলব্ধি মাত্র। মুরুব্বিদের কাছে-শেখা জ্ঞান হইতে এই মত সম্পূর্ণ আলাদা। মওলানা ইসলামাবাদী, মওলানা আকরম খাঁ ও মৌলবী মুজিবর রহমান প্রভৃতি শিক্ষাগুরুদের কাছে পাওয়া জ্ঞানের এটা সম্পূর্ণ বিপরীত। সাংবাদিকতা মিশনারির দায়িত্ব, চাকুরিয়ার কাজ নয়, এটাই শিখিয়াছিলাম এদের খেদমতে। পরে মুরুব্বিদের এই মতের ত্রুটি বুঝিয়াছিলাম। কিন্তু অভ্যাস বদলাইতে পারি নাই। শৈশবে-পাওয়া মুরুব্বিদের-দেওয়া জ্ঞান সত্যই মানুষের স্বভাবে অন্তর্ভুক্ত হইয়া যায়। দ্বিতীয়ত, হক সাহেবের তখনকার রাজনৈতিক সাফল্য-অসাফল্যের সাথে নবযুগএরা মরা-বাঁচা অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত ছিল। নবযুগ-এর বাঁচিয়া থাকা শুধু আমার একার নয়, নবযুগএর শতাধিক চাকুরিয়ার জীবিকা নির্ভর করিতেছে। দু-চারজন বাদে এঁরা সবাই মুসলমান। নবযুগ না থাকিলে এঁদের বিপদ হইবে। কৃষক-এর সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা হইতে এটা আমি বুঝিয়াছিলাম।

কাজেই অন্তত নবযুগ-এর জন্যও হক সাহেবের এই নয়া রাজনীতিকে সফল করিতেই হইবে, এই প্রয়োজনের বিচারেই আমি সম্পাদকীয় লিখিয়া চলিলাম। তারই একটাতে বলিলাম: এই মুহূর্তে হক সাহেবের পশ্চিম বাংলা ও ডা. শ্যামাপ্রসাদের পূর্ব বাংলা সফরে বাহির হওয়া উচিৎ। এই সম্পাদকীয়ের সমর্থনে আমি হক সাহেব ও ডা. শ্যামাপ্রসাদকে মৌখিক পরামর্শ দিলাম এবং আমার নিজ জিলায় ডা. শ্যামাপ্রসাদকে নিমন্ত্রণ জানাইলাম। তাকে আমি ভরসা দিলাম, আমি নিজে গিয়া সভার আয়োজন করিব এবং লক্ষ লোকের সমাবেশ করাইব। ঐ সভায় ডা. শ্যামাপ্রসাদ যদি মুসলিম স্বার্থ রক্ষার ওয়াদা করিয়া আসেন, তবে প্রোগ্রেসিভ কোয়ালিশনের গতি ও জয় দুর্বার হইয়া উঠিবে। আমার এই প্রস্তাবে হক সাহেব ও ডা. শ্যামাপ্রসাদ উভয়েই রাজি হইলেন। মি. সন্তোষ কুমার বসু, অধ্যাপক প্রমথ ব্যানার্জী প্রভৃতি অন্য মন্ত্রীরাও পরম উৎসাহেই আমার প্রস্তাব সমর্থন করিলেন।

কিন্তু কার্যত তা হইল না। বরঞ্চ হক সাহেব পূর্ব বাংলা এবং শ্যামাপ্রসাদ পশ্চিম-বাংলা সফরে বাহির হইলেন। বোধ হয় তারা আগে যার যার ঘর সামলানোকেই অধিকতর আসন্ন জরুরি কাজ মনে করিলেন। আমি বুঝিলাম, এই ভুলের দরুনই কোয়ালিশনের সাফল্যের সম্ভাবনা দূর হইল। যদি শেষ পর্যন্ত এই চেষ্টা ব্যর্থই হয়, তবু এ ব্যর্থতায়ও যাতে হক সাহেবের চূড়ান্ত রাজনৈতিক মৃত্যু না ঘটে, সেদিকে নজর রাখিয়া আমি কলম চালাইলাম। প্রোগ্রেসিভ কোয়ালিশন না বাচুক, হক সাহেবকে বাঁচাইতে হইবে।

.

. আমার ব্যক্তিগত সংকট

এই ধরনের লেখা স্বভাবতই হিন্দু মন্ত্রীদের পছন্দ হইল না। যতদূর মনে পড়ে এই সময়ে বিভিন্ন বিভাগের চাকুরির ব্যাপারে বিশেষত এ. আর. পি. বিভাগের চাকুরিতে মুসলমানদের দাবি-দাওয়া পদদলিত হইতেছে বলিয়া মুসলমানদের মধ্যে যে অসন্তোষ দেখা যাইতেছিল, হক সাহেব এবং তার মন্ত্রিসভার কারো কারো সাথে পরামর্শ করিয়াই আমি এ ব্যাপারেও ভারত সরকারের সমালোচনা করিতে লাগিলাম। এতে হিন্দু মন্ত্রীরা আমার উপর চটিলেন। কেউ-কেউ আমার সাথে তর্ক করিলেন। আমি নানা যুক্তি-তর্ক দিয়া বুঝাইবার চেষ্টা করিলাম, প্রোগ্রেসিভ কোয়ালিশনের জনপ্রিয়তা রক্ষার খাতিরেই আমি ঐ সব লেখা লিখিতেছি।

হক সাহেব পরে আমাকে জানাইলেন, তাঁর হিন্দু মন্ত্রীরা আমার যুক্তিতে মোটেই কনভিন্সড হন নাই। তারা আমার উপর খুবই অসন্তুষ্ট। কেউ-কেউ আমাকে সরাইবার কথা বলিতেছেন। সঙ্গে সঙ্গে হক সাহেব অবশ্য আমাকে আশ্বাস দিলেন, আমার চিন্তার কোনও কারণ নাই। আমি যেভাবে সম্পাদকীয় লিখিতেছি, তাতে তাঁর নিজের এবং মুসলমান মন্ত্রীদের পূর্ণ সমর্থন আছে। অন্যতম মন্ত্রী খান বাহাদুর হাশেম আলী ও বন্ধুবর শামসুদ্দীন আহমদও আমার নীতিতে পূর্ণ সমর্থন জানাইলেন। উভয়েই আমাকে নিশ্চিন্ত থাকিতে বলিলেন।

আমি নিশ্চিন্ত হইবার চেষ্টা করিলাম। নিশ্চিন্ত হওয়া আমার দরকারও ছিল। কারণ ইতিমধ্যে এই সনের আগস্ট মাসেই আমার চতুর্থ পুত্র মনজুর আনামের জন্ম হইয়াছে। আমার সংসার-খরচা বাড়িয়াছে।

.

. নজরুলের ধর্মে মতি

ইতিমধ্যে নজরুল ইসলাম সাহেবের মধ্যে একটু-একটু মস্তিষ্ক বিকৃতি দেখা দিল। আগেই শুনিয়াছিলাম, তিনি বরদাবাবু নামক জনৈক হিন্দু যোগীর নিকট তান্ত্রিক যোগ সাধনা শুরু করিয়াছেন। জিজ্ঞাসা করিলে কাজী সাহেব মিষ্ট হাসি হাসিতেন। কিন্তু তাঁর স্বাভাবিক প্রাণচঞ্চল ছাদ-ফাটানো হাসি তিনি আর হাসিতেন না। তার বদলে উঁচু স্তরের এমন সব আধ্যাত্মিক কথা বলিতেন, যা সংবাদপত্র আফিসে মোটেই মানায় না। একদিন আফিসে। আসিয়া তিনি আমাকে বলিলেন : একটা জায়নামাজ ও অযুর জন্য একটা বদনা কিনাইয়া দিন। তাই করা হইল। আফিসে দুতালার পিছন দিকে একটি ছোট কামরাকে নামাজের ঘর করা হইল। কাজী সাহেব সপ্তাহে দু চার দিন যা আসিতেন এবং দুই-তিন ঘণ্টা যা থাকিতেন তার সবটুকুই তিনি অযু ও নামাজে কাটাইতেন। অযু করিতে লাগিত কমছে-কম আধ ঘণ্টা। আর নামাজে ঘণ্টা দুই। এ নামাজের কোনও ওয়াকত-বেওয়াকত ছিল না। কেরাত-রুকু-সেজদা ছিল না। জায়নামাজে বসিয়া হাত উঠাইয়া মোনাজাত করিতেন এবং তার পরেই মাটিতে মাথা লাগাইতেন, সিজদার মত কোমর উঁচা করিয়া নয়, কোমর উরুর সাথে ও পেট জমির সাথে মিশাইয়া। এইভাবে ঘণ্টার-পর ঘণ্টা এক সিজদায় কাটাইয়া দিতেন। আমি যতদূর দেখিয়াছি, তাতে তিনি সিজদা শেষ করিয়া একবারই মাথা উঠাইতেন।

আমাদের দুশ্চিন্তার মধ্যেও এইটুকু সান্ত্বনা ছিল যে অন্তত তান্ত্রিক সাধনা ছাড়িয়া তিনি মুসলমানি এবাদত ধরিয়াছেন। এইভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর তিনি একদিন আমাকে বলিলেন : তাঁকে সেই দিনই পাঁচ শত নামাজশিক্ষা কিনিয়া দিতে হইবে। কারণ তাঁর পাঁচ শত হিন্দু মহিলা শিষ্য হইয়াছেন; তাঁদের সকলকে কাজী সাহেব নামাজ শিখাইবেন। তখন শেখ আবদুর রহিম সাহেবের নামাজ শিক্ষা’র দাম পাঁচ আনা। পাঁচশ কপি কিনিতে লাগে প্রায় দেড়শ টাকা। ম্যানেজার, একাউন্টেন্ট ও ক্যাশিয়ার গোপনে আমার সাথে। পরামর্শ করিলেন। সর্বসম্মতিক্রমে ঠিক হইল, দশটা টাকা দিয়া একজনকে বাজারে পাঠাইয়া দেওয়া হউক। দশ টাকায় যা পাওয়া যায় আনিয়া বলা হউক, মার্কেটে আর কপি নাই। তাই করা হইল। ত্রিশ কপি নামাজ শিক্ষা আনিয়া কাজী সাহেবকে দেওয়া হইল। ঐ কৈফিয়তটাও দেওয়া হইল। আশ্চর্য এই যে কাজী সাহেব ঐ ত্রিশ কপি পাইয়াই খুশি হইলেন এবং বিনা প্রতিবাদে চলিয়া গেলেন। আর কপি কোনও দিন চাইলেন না। আরো কপি কিনিবার ভয়ে কাজী সাহেবের হিন্দু শিষ্যদের নামাজ শিক্ষার অগ্রগতি সম্বন্ধেও আমরা কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করিলাম না। কিন্তু কাজী সাহেবের দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও আমার সহকর্মী মি. কালীপদ গুহ ও মি. অমলেন্দু দাসগুপ্ত এটাকে মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ বলিয়া স্বীকার করিলেন না। এই দুই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার আগের পরিচয় ছিল না। আমার দীর্ঘদিনের সাংবাদিক জীবনে বা কংগ্রেসী রাজনীতিতে এঁদেরে কোনও দিন দেখি নাই। তবু কাজী সাহেবের পীড়াপীড়িতে আমরা এই দুইজনকেই সহকারী সম্পাদক করিয়া নিয়াছিলাম। কাজী সাহেব এবং বোধহয় ম্যানেজমেন্টের কেউ-কেউ আমাকে বলিয়াছিলেন যে উহারা যুগান্তর’-’অনুশীলন দলের বিপ্লবী লোক বলিয়াই কংগ্রেসী রাজনীতিতে ওঁদের সাক্ষাৎ পাই নাই। শুনিয়া শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হইল। ওঁদেরে সহকারী সম্পাদক নেওয়া হইল কারণ ওঁদের দুইজনেই শক্তিশালী লেখক ছিলেন। বিশেষত, অমলেন্দু বাবুর কলমে খুবই জোর ছিল। তবে সাংবাদিকতায় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার অভাবেই বোধ হয়, তাঁদের লেখাগুলি বাস্তবের চেয়ে অবাস্তব, জার্নালিস্টেকের চেয়ে লিটারির, অবজেকটিভের চেয়ে সাবজেকটিভই হইত বেশি। সেজন্য তাঁদের সব লেখা ছাপা যাইত না। সেজন্য তারা বোধ হয় মনে-মনে আমার প্রতি। অসন্তুষ্ট হইয়াছিলেন এবং কাজী সাহেবের কাছে বোধ হয় এক-আধবার নালিশও করিয়াছিলেন। কাজী সাহেব সম্পাদনার ব্যাপারে মোটেই হাত দিতেন না। তাঁর সময়ই ছিল না। কাজেই তাঁরা মনে-মনে আমার উপর বিক্ষুব্ধ ছিলেন, এটা বলা যায়। কিন্তু আমি তাদের উপর অসন্তুষ্ট হইলাম। কাজী সাহেবের অসুখকে তারা অগ্রাহ্য করিতেন বলিয়া। শুধু অগ্রাহ্য করা নয়, এটাকে তারা আধ্যাত্মিক জীবনের অগ্রগতি বলিয়া ব্যাখ্যা করিতেন। আমি ও-সব কথাকে প্রথমে হাসিয়া এবং পরে দৃঢ়তার সাথে উড়াইয়া দিতাম বলিয়া আমার সামনে তারাও ও-বিষয়ে কথা আর বলিতেন না। ফলে লাভ এই হইল যে, কাজী সাহেব আমার রুমে তার নির্দিষ্ট আসনে না বসিয়া প্রায়ই সহ-সম্পাদকের জন্য নির্দিষ্ট রুমে অমলবাবুদের সাথেই বেশি সময় কাটাইতেন। তিনিই আইনত নবযুগএর প্রধান-সম্পাদক। তাঁর আসনও প্রধান-সম্পাদকের উপযোগী করিয়া সাজানো। গদি-আঁটা-চেয়ার, সেক্রেটারিয়েট টেবিল। টেবিলে বিশালকার ব্লটিং প্যাড হইতে শুরু করিয়া প্রকাণ্ড কাঁচের দোয়াতদান, দুরঙ্গা দুইটা কালি-ভরা দোয়াত-কলমসহ পেন হোল্ডার, পেপার-কাটার সবই সাজান থাকিত। কিন্তু এ সব ফেলিয়া তিনি অমলবাবুদের রুমে কাঠের চেয়ারে বসিয়া চুপি-চাপি আলাপ করিতেন। নজরুল ইসলাম বাংলার তরুণদের বিশেষত মুসলিম তরুণদের জন্য বিরাট আকর্ষণ। প্রধানত তাঁকে দেখিবার জন্যই মুসলিম ছাত্ররা দলে-দলে নবযুগ আফিসে আসিত। অন্য কোনও কারণই ছিল না তাদের। মুসলিম ছাত্রসমাজের প্রায় গোটাটাই এই সময় পাকিস্তান আন্দোলনের সুতরাং মুসলিম লীগের, সমর্থক এবং হক সাহেবের নবযুগ-এর সমর্থক। গোড়াতে নজরুল ইসলামকে ঘিরিয়া মুসলিম ছাত্র-তরুণদের সমাগমে নবযুগ আফিস সরগরম থাকিত। এইরূপ মস্তিষ্ক বিকৃতি দেখা দেওয়ার পর হইতে তিনি যেন ছাত্রদের এই ভিড় না-পছন্দ করিতে লাগিলেন। আমি তাঁকে তাঁর সিটে থাকার পরামর্শ দিয়া আমলবাবু ও বরদাবাবুর যোগটোগের সমালোচনা করায় তিনি গম্ভীরভাবে বলিয়াছিলেন : বরদাবাবু সিদ্ধ পুরুষ, তিনি বার বছর আগে-মরা বুলবুলকে একদিন সশরীরের তাঁর সামনে উপস্থিত করিয়াছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে কেউ কোনও কথা বলিলে তিনি মনে কষ্ট পান। আমার সমালোচনার এটা দৃঢ় প্রতিবাদ। এরপর আমি আর কোনও কথা বলি নাই।

.

. নজরুলের আধ্যাত্মিকতা

তিনি দরজা বন্ধ করিয়া গোপনে আমার সাথে অনেক আধ্যাত্মিক আলোচনা করিতেন। আলোচনা করিতেন মানে তিনি বলিয়া যাইতেন, আমি শুনিয়া যাইতাম। এ সব কথার মধ্যে দুর্বোধ্যতা, এমনকি অনেক সময় কাণ্ডজ্ঞানহীনতা থাকিলেও তাতে পাগলামি ছিল না। বরঞ্চ অনেক কথা আমার ভাল লাগিত। এমন ধরনের একটি কথা এখানে উল্লেখ করার লোভ সম্বরণ করিতে পারিলাম না। একদিন তিনি আফিসে আসিয়া নিজের আসনে বসিলেন। মিনিট খানেক কী ভাবিলেন। পরে নিজের আসন ছাড়িয়া আমার টেবিলের সামনের ভিজিটার্স সিটে বসিলেন। তারপর আমার দিকে গলা বাড়াইয়া গোপন কথা বলিবার ভঙ্গিতে বলিলেন, তার সারমর্ম এই : তিনি এবং তাঁর স্ত্রীর মধ্যে একটা দুর্ভেদ্য চীনা দেওয়াল উঠিয়াছে। তারা উভয়ে উভয়ের সহিত মিলিত হইবার জন্য আঁকুপাঁকু করিতেছেন। তারা উভয়েই পরস্পরের প্রেমের রজু টানিয়া একজন আরেকজনকে নিজের কাছে নিতে চাহিতেছেন। উভয়ের মধ্যে এই টাগ-অব-ওয়ার চলিতেছে দীর্ঘদিন ধরিয়া। কিন্তু এ চেষ্টা ব্যর্থ হইয়াছে। কারণ এটা অবৈজ্ঞানিক। কীরূপে, তা বুঝাইবার জন্য তিনি আমার টেবিলের উপর হইতে একটা বড় ডিকশনারি লইয়া তা উপুড় করিয়া টেবিলের উপর বসাইলেন। কলমদানের উপর হইতে এক টুকরা মোটা সুতা লইয়া তার দুই মাথায় দুইটা পেপার-ওয়েট সুকৌশলে বাঁধিলেন। এবং খাড়া করা বইটার উপর তা ঝুলাইয়া দিলেন। তারপর তিনি বলিলেন : লক্ষ্য করুন, দুইটা পেপার-ওয়েট সমান ওজনের। তাই একটার ভারে অপরটা উঠিয়া আসিতেছে না। উভয়ের ওজন সমান না হইয়া যদি একটা অপরটার দশ গুণ ভারী হইত, তবে ভারীটার টানে পাতলাটা উঠিয়া আসিত। কারণ গত কয়েক বছর ধরিয়া আমি নিজের ওজন স্ত্রীর ওজনের দশ গুণ বাড়াইবার চেষ্টা করিয়াছি। অনেক বাড়াইয়াছি। কিন্তু যথেষ্ট বাড়াইতে পারি নাই। তাই আমি ওজন বাড়াইবার চেষ্টা ত্যাগ করিয়া দেওয়ালের চূড়ায় উঠিয়া সেখান হইতে তাকে টানিয়া তুলিবার চেষ্টা করিতেছি। সেটা কেন দরকার এবং কেমন করিয়া সম্ভব, তাই এখন বুঝাইতেছি।

এইখানে আমাকে তিনি প্র্যাকটিক্যাল ডিমনস্ট্রেশন করিয়া দেখাইয়া দিলেন যে নিচে হইতে টানিয়া অপর পারের পেপার-ওয়েটটা এ পাশে আনা যত কষ্টসাধ্য, বইটার উপর হইতে টানিয়া তোলা তেমন কঠিন নয়, অনেক সহজ। এটা যখন আমি অতি সহজেই স্বীকার করিলাম, তখন তিনি আমাকে বলিলেন : “অতএব আমি স্থির করিলাম আমি এই চীনা দেওয়ালের উপর উঠিব। সেখান হইতেই স্ত্রীকে টানিয়া তুলিব। গত এক বছর এই চেষ্টা করিয়াও পারি নাই। এখন আমাকে অগত্যা দেওয়ালের অপর পারে নামিয়া পড়িতে হইবে। উপর হইতে রশি ধরিয়া টানিয়া তোলার চেয়ে ওপারে মিয়া ওকে কাঁধে তুলিয়া নিয়া আসা অনেক সহজ হইবে।’ আমি ব্যাপারটা বুঝিবার জন্যই জেরা করিলাম। তিনি শেষ পর্যন্ত বলিলেন : ‘আপনি ঠিকই বুঝিয়াছেন আমাকেও আমার স্ত্রীর রোগে পীড়িত হইতে হইবে।’

.

. নজরুলের রোগ লক্ষণ

কাজী সাহেবের স্ত্রী বহুদিন ধরিয়া দুরারোগ্য পক্ষাঘাত রোগে ভুগিতেছেন। তার রোগের রোগী হওয়া মানে কাজী সাহেবেরও পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়া। কথাটা মনে হইতেই গা কাঁটা দিয়া উঠিল। এই অশুভ চিন্তার জন্য মনে-মনে তওবা করিলাম। কাজী সাহেব আমার বিচলিত ভাব দেখিয়া সান্ত্বনা দিলেন : ‘চিন্তার কোনও কারণ নাই। ব্যাপারটাকে যত সাংঘাতিক মনে করিতেছেন, তত সাংঘাতিক এটা নয়। আমি আমার স্ত্রীর মত অসুস্থ হইয়া আবার ভাল হইব এবং তখন স্ত্রীও আমার সাথে-সাথে আরোগ্য লাভ করিবে। আধ্যাত্মিক সাধনার বলে এমন ইচ্ছাধীন রোগাক্রান্তি এবং রোগমুক্তি সম্ভব এটা বৈজ্ঞানিক কথা। এটাকে বলে সাইকো-থিরাপি। আমার মন মানিল না, কারণ আমি ও-সম্বন্ধে কোনও বই-পুস্তক পড়ি নাই। কেমন যেন অশুভ অশুভ মনে হইতে লাগিল। যিনি শুনিলেন তিনিই এটাকে মস্তিষ্ক বিকারের লক্ষণ বলিলেন।

এরপর কাজী সাহেব আফিসে আসা একদম বন্ধ করিয়া দিলেন। শুধু বেতন নিবার নির্ধারিত তারিখে রশিদ সই করিয়া টাকা নিতে আসিতেন। তাও খবর দিয়া আনিতে হইত। কয়েক মাস পরে তা-ও বন্ধ করিলেন। লোক পাঠাইয়া বেতনের টাকা নিতে লাগিলেন। নজরুল ইসলাম সাহেবই ছিলেন নবযুগ আফিসে ছাত্র-তরুণদের বড় আকর্ষণ। তিনি আর আফিসে আসেন না কথাটা জানাজানি হইয়া যাওয়ায় আস্তে-আস্তে তাদেরও যাতায়াত কমিয়া গেল।

ইতিমধ্যে হক সাহেব একদিন কথা প্রসঙ্গে নবযুগ-এর আর্থিক দুরবস্থার কথা আমাকে জানাইলেন। তিনি বলিলেন : মন্ত্রী হওয়ার আগে সকলেই তাঁদের বেতনের মোটা অংশ পত্রিকা ফান্ডে দিবার ওয়াদা করিয়াছিলেন। কিন্তু কোনও মন্ত্রীই তার ওয়াদা পূরণ করেন নাই।’ কিছুদিন ধরিয়া আমিও এই আশঙ্কাই করিতেছিলাম। কারণ পরিচালকদের অর্থাভাবের হাওয়া বেতন-ভোগীদের গায়েই সবার আগে লাগিয়া থাকে। আমার চোখে-মুখে বোধহয় দুশ্চিন্তা ফুটিয়া উঠিয়াছিল। হক সাহেব আমাকে আশ্বাস দিলেন, বিপদটা খুব আসন্ন নয়। আমি হক সাহেবের। আশ্বাসে খুব ভরসা পাইলাম না বটে, কিন্তু খুব চিন্তাযুক্তও হইলাম না। কারণ আমার কাছে এটা খুব অচিন্তিত-আকস্মিক ব্যাপার ছিল না। এমন কিছু একটা ঘটিবে, আগে হইতেই তা আমি জানিতাম। তবে অত তাড়াতাড়ি হইবে তা জানিতাম না। তাছাড়া চাকরি পাওয়া-যাওয়া, সাধারণ আর্থিক দুরবস্থা ও বিপদ-আপদের সাথে এই কুড়ি-বাইশ বছরেই এত বেশি পরিচিত হইয়া গিয়াছি যে অদূর-ভবিষ্যতে বিপদের। সম্ভাবনাতেও চঞ্চল হইয়া উঠিলাম না।

.

. মি. দত্তের আবির্ভাব

ইহার কিছুদিন পরে মি. হেমেন্দ্র নাথ দত্ত আমার রুমে প্রবেশ করিয়া হাসিমুখে বলিলেন : নমস্কার মনসুর সাব, কৃষক-এ আমাদের ছাড়াছাড়ি হইয়াছিল। ভগবানের ইচ্ছায় নবযুগ্এ আবার একত্র হইলাম।

বিনা-খবরে মি. দত্ত আমার ঘরে প্রবেশ করায় আমি বিস্মিত হইলাম না। কারণ মাত্র কয়েকদিন আগে বন্ধুবর অধ্যাপক হুমায়ুন কবিরের মুখে। শুনিয়াছিলাম, মি. দত্ত একটা বড় রকমের চাউলের কন্ট্রাক্ট পাইতেছেন। এবং হক সাহেব ঐ কন্ট্রাক্টের বদলা নবযুগ তহবিলে চাঁদা দাবি করিতেছেন। মি. দত্ত এককালীন চাঁদা না দিয়া নবযুগ-এর পরিচালন-ভার নিতে রাজি আছেন বলিয়া কিছু-কিছু কানাঘুষা শুনিতেছিলাম। কাজেই বিন্দুমাত্র-বিস্ময়ের ভাব না দেখাইয়া আমি প্রতি-নমস্কার দিলাম এবং হাত ইশারায় সামনের একটা চেয়ার দেখাইয়া মি. দত্তকে বসিতে বলিলাম। সাধ্যমত আত্মসম্বরণ করিয়া হাসি মুখের জবাবে হাসিমুখেই বলিলাম: কী রকম?

জবাবে মি. দত্ত যা বলিলেন তার সারমর্ম এই যে, হক সাহেব তাকে নবযুগ পরিচালনের ভার দিয়াছেন। তিনি সাধ্যমত নবযুগএর উন্নতির চেষ্টা করিবেন। টাকা-পয়সার জন্য আমাকে আর কোনও চিন্তা করিতে হইবে না। নবযুগকে বাংলার শ্রেষ্ঠ দৈনিক করিতে আমার যত-কিছু স্কিম আছে, এখন হইতে তার সবগুলি আমি প্রয়োগ করিতে পারি।

মি. দত্ত প্রফুল্ল বদনে পরম উৎসাহের সঙ্গেই তাঁর কথাগুলি বলিয়াছিলেন। হয়ত আশা করিয়াছিলেন, আমিও উৎসাহ প্রকাশ করিব। কিন্তু আমি বিন্দুমাত্র উৎসাহ দেখাইলাম না। এক বছর আগে কৃষক উপলক্ষ করিয়া যে সব ঘটনা ঘটিয়াছিল, তার সবগুলি আমার স্মৃতিপথে উদিত হইল। আমি বোধহয় তৎক্ষণাৎ ঠিক করিয়া ফেলিয়াছিলাম নবযুগ-এ কাজ করা আর আমার পক্ষে সম্ভব হইবে না। তাই আমি কৃত্রিম ভদ্রতা দেখাইয়া নিতান্ত জোর-করা হাসি মুখে বলিলাম : এ খোশ-খবরটা আপনি নিজে বহন না করিয়া যদি হক সাহেবের মারফত পাঠাইতেন, তবে ব্যাপারটা সুন্দর হইত।

মি. দত্ত আমার নিকট হইতে এমন রূঢ় কথা শুনিবার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। কিনা জানি না। কিন্তু তিনি অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী লোক। আমার কথার মধ্যেকার অপমানটা গায় না মাখিয়া মুখের হাসি বজায় রাখিয়া বলিলেন : ‘ও-সব টেকনিক্যাল ফরমালিটি যথাসময়ে হইয়া যাইবে। তার জন্য আমাদের বসিয়া থাকা উচিৎ নয়। আমাদের মধ্যে যে বন্ধুত্ব ও অন্তরের সম্বন্ধ তাতে টেকনিক্যাল কথার স্থান নাই।’ নবযুগকে উন্নত করার কাজে তার ও আমার পূর্ণ সহযোগিতা দরকার, এই জন্যই তিনি ফর্মালিটির অপেক্ষায় বসিয়া না। থাকিয়া প্রথম সুযোগেই আমার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছেন। এ ব্যাপারে আমার সমস্ত দ্বিধা-সন্দেহের অবসান ঘটাইবার জন্যই বোধহয় তিনি কবে, কী শর্তে নবযুগ-এর ভার নিয়াছেন, কার-কার সামনে কথা হইয়াছে, কে-কী বলিয়াছেন, সব কথা বলিয়া ফেলিলেন।

আমি বোধহয় মাত্রাতিরিক্ত চটিয়া গিয়াছিলাম। তাঁর কথা মনোযোগ দিয়া শুনিবার আগ্রহ আমার ছিল না। তবু শুধু ভদ্রতার খাতিরে বাধা দিলাম না। তার কথা শেষ হইলে বলিলাম : ‘এ সব কথা আমাকে বলিয়া লাভও নাই, দরকারও নাই। হক সাহেবের মারফতই এসব কথা জানাইবেন। হক সাহেব আপনাকে নবযুগ-এর পরিচালক বানাইয়াছেন, তিনি নিজেই আমাকে একথা জানাইবেন। তার পর আপনার পরিচালনায় নবযুগ্এ আমি চাকরি করিব কিনা, সে কথাও আমি হক সাহেবকেই জানাইব। আপনি মেহেরবানি করিয়া এখন যান। আমার কাজ আছে।

বলিয়া একটা প্যাড টানিয়া লেখা শুরু করিবার উদ্যোগ করিলাম, যদিও তখনি লেখার তাড়া ছিল না।

.

. লজ্জাকর দুর্ঘটনা

মি. দত্ত স্বভাবতই অপমান বোধ করিলেন। তিনি ধৈর্য হারাইলেন। এতক্ষণের ভদ্রতা ও শিষ্টাচারের পোশাক তাঁর একদম খসিয়া পড়িল। তিনি গলায় অতিরিক্ত জোর দিয়া বলিলেন : ‘আমাকে এভাবে এখান হইতে যাইতে বলার কোনও অধিকার আপনার নাই। আপনি জানেন, আজ হইতে এ। আফিসের মালিক আমি। আমি বাহির হইয়া যাইব না। যদি আমাদের দুইজনের কারো বাহির হইয়া যাইতে হয়, তবে সে ব্যক্তি আমি নই, আপনি।’

আমি বিদ্রুপের হাসি হাসিয়া বলিলাম: ‘আপনি এ আফিসের কর্তা হইলে আমি এখানে থাকিব না। তা আমি মানি। কিন্তু ঠিক এ মুহূর্তে আমিই এখানে কর্তা। সুতরাং আপনিই দয়া করিয়া বাহির হইয়া যান।’

মি. দত্ত চেয়ার ছাড়িতেছেন না দেখিয়া আমিই চেয়ার ছাড়িয়া দাঁড়াইলাম। মি. দত্ত আমার এই দাঁড়ানোর খুব খারাপ অর্থ করিলেন। আমাকে উঠিতে দেখিয়াই তিনি চট করিয়া চেয়ার ছাড়িয়া উঠিলেন এবং বলিলেন : আমাকে আক্রমণ করিতে উদ্যত হইয়াছেন? এ অপমানের আমি বিচার করাইব। অবশ্যই করাইব।

মি. দত্তের গলা ও সর্বাঙ্গ কপিতেছিল। তিনি অতি ব্যস্ততার সহিত দরজার দিকে ছুটিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত হুমড়ি খাইয়া চৌকাঠের উপর পড়িয়া গেলেন এবং মূৰ্ছা গেলেন। আমার রুমের সামনেই প্রকাণ্ড হলঘর। এই হলঘরটাই। আমাদের আফিস ঘর। ম্যানেজার, একাউন্টেন্ট ও তাদের গোটা স্টাফই এই হলে বসেন। আফিস পাঁচটায় ছুটি হইয়া গেলেও ম্যানেজার ও একাউন্টেন্ট দুই একজন সহকারী লইয়া কাজ করিতেছেন। মি. দত্ত তার এক ছেলেকে সঙ্গে লইয়া আসিয়াছিলেন। তিনি পিতাকে আমার রুমে ঢুকাইয়া ম্যানেজারের সাথে বসিয়া গল্প করিতেছিলেন। দত্ত সাহেবকে পড়িয়া যাইতে দেখিয়া এঁরা সকলেই ছুটিয়া আসিলেন। চোখে-মুখে পানি ছিটাইয়া যথাসম্ভব প্রাথমিক তদবিরাদি করিয়া তাঁকে ধরাধরি করিয়া গাড়িতে তোলা হইল। দত্ত সাহেবের নিজের মোটর রাস্তায় দাঁড়ান ছিল। সেই গাড়িতেই তাঁকে হাসপাতালে পাঠান হইল। পরে টেলিফোনে জানিতে পারিলাম, পথেই তার সংজ্ঞা ফিরিয়া আসায় হাসপাতালে নেওয়ার দরকার হয় নাই। তিনি এখন ভাল আছেন।

ব্যাপারটা নিতান্তই আকস্মিক। আমার জন্য বড়ই লজ্জাকর। লোকে কী মনে করিবে? আমার মত ছয়ফুট লম্বা একটা জওয়ান মানুষের কামরায় চৌকাঠে দত্ত সাহেবের মত বৃদ্ধ ও শীর্ণ মানুষ বিনা কারণে হুমড়ি খাইয়া নিশ্চয়ই পড়েন নাই। দত্ত সাহেবকে নিয়া যাওয়ার পর-পরই আমাদের স্টাফের প্রায় সকলে আমার কামরায় ভিড় করিয়া আমার কথা শুনিলেন এবং সকল কথা শুনিয়া আমাকে কংগ্রেচুলেট করিলেন। কিন্তু আমি নিজে খুব উৎসাহ পাইলাম না। এই ঘটনার পরে এখানে আমার চাকুরি নাই, এ কথাটা হয়ত আমার মনের তলে লুকাইয়া আমাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করিতে ছিল। কিন্তু আমার মনে যা পীড়া দিতেছিল তা ছিল আমার ব্যবহার। আমার ক্রমেই বেশি করিয়া মনে হইতে লাগিল, সব দোষ আমার, দত্ত সাহেবের কোনও দোষ নাই। মনটা খারাপ হইল। সকলকে বিদায় দিয়া লেখায় ডুবিবার চেষ্টা করিলাম।

পরদিনই হক সাহেব ডাকিয়া পাঠাইলেন। যা অনুমান করিয়াছিলাম তাই। দত্ত সাহেব আগেই হাজির। আমি গেলে হক সাহেব আমাদের দুইজনকে লইয়া তাঁর শোবার ঘরে গেলেন। কাউকে কিছু বলিতে না দিয়া তিনিই শুরু করিলেন। ওয়াদা-করা চাঁদা না দেওয়ার অপরাধে সমস্ত মন্ত্রীদের বিশুদ্ধ বরিশালী ভাষায় গাল দিয়া, আর্থিক দুরবস্থার বর্ণনা করিয়া তিনি। আমাকে বুঝাইলেন, তিনিই বাধ্য হইয়া অনিচ্ছুক দত্ত সাহেবকে এ ব্যাপারে টানিয়া আনিয়াছেন। দত্ত সাহেব রাজি না হইলে তিনি অগত্যা নবযুগবন্ধই করিয়া দিতেন। এমতাবস্থায় আমাকে ও দত্ত সাহেবকে এক যোগে মিলিয়া মিশিয়া কাজ করিতেই হইবে। গতকালের ব্যাপারটা উভয়কেই ভুলিয়া যাইতে হইবে। ওতে দত্ত সাহেবেরও দোষ আছে। দত্ত সাহেব অন্তত নান্না মিয়াকে সঙ্গে না লইয়া আফিসে যাইয়া কাজ ভাল করেন নাই। আমারও দোষ আছে। দত্ত সাহেবকে অপমান করিয়া বাহির করিয়া দেওয়া ঠিক হয় নাই। হক সাহেবই কথা শুরু করিয়াছিলেন। তিনিই শেষ করিলেন। আমাদের কোনও কথা বলিতে দিলেন না। নবযুগ চালাইতে হইলে আমাদের উভয়কে মিলিতে হইবে, এই কথার পুনরাবৃত্তি করিয়া আমাদিগকে মুসাফিহা করাইয়া বিদায় দিলেন।

.

১০. আগুনে ইন্ধন

আমরা ভুলিতে চেষ্টা করিলে কী হইবে? পাড়ার লোক আমাদের ভুলিতে দিল না। ভোটরঙ্গ ও অবতার নামে এই সময়ে কলিকাতায় খুব জনপ্রিয় দুইটি ব্যঙ্গ-সাপ্তাহিক ছিল। আমাদের ঘটনা লইয়া ওদের একটিতে হেমেন্দ্র বধ কাব্য ও আরেকটিতে হেমেন্দ্র-মনসুর সংবাদ নামে অমিত্রাক্ষর ছন্দে দুইটি কাব্য-নাটিকা প্রকাশিত হইল। তার ফলে কয়েক সপ্তাহ ধরিয়া কলিকাতার রাস্তাঘাটে, ট্রামে-বাসে, স্কোয়ারে-ময়দানে, আমরা দুইজন আলোচনার বিষয় থাকিলাম। লেখা দুইটি ছিল মোটামুটি শক্তিশালী লেখকের হাতের। সুতরাং প্যারডি খুব উপভোগ্য হইয়াছিল। ভাষায় যথেষ্ট মুনশীয়ানা ছিল। এই মুনশীয়ানা করিতে গিয়া লেখককে স্বভাবতই কল্পনার আশ্রয় নিতে হইয়াছিল। তবু তাকে সত্য-অর্ধসত্য মিলিয়া মোটামুটি লেখা দুইটিতে সত্যের রূপ দিতে পারিয়াছিল। ওতে আমাকেও যথেষ্ট বিদ্রূপ করা হইয়াছিল। কিন্তু সাহিত্যিক রণযোদ্ধা হিসাবে আমি সে সব বিদ্রুপের কশাঘাতকে শিল্প হিসাবে গ্রহণ করিলাম। কিন্তু রস-কষহীন নিরেট ব্যবসায়ী ভাল মানুষ দত্ত সাহেব ঐ স্যাটায়ারের রস গ্রহণ করিতে স্বভাবতই অসমর্থ হইলেন। বরঞ্চ তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করিলেন, ও-দুইটা ব্যঙ্গ-রচনা আমার সাহায্যে লেখা হইয়াছে। প্রমাণস্বরূপ তিনি দেখাইলেন যে, রচনা দুইটিতে আমাকে নরম হাতে এবং দত্ত সাহেবকে নির্দয়ভাবে আক্রমণ করা হইয়াছে। ফলে আমরা উভয়কে যথাসম্ভব এড়াইয়া চলিতে লাগিলাম। দত্ত সাহেব এর পরে দুপুরের দিকেই নবযুগ”এ আসিতেন। বিকাল বা সন্ধ্যায় কখনও আসিতেন না।

এই সময়ে আমি কঠিন আমাশয়ে আক্রান্ত হই। ডাক্তার স্থান পরিবর্তনের উপদেশ দেওয়ায় আমি হক সাহেবের নিকট হইতে এক মাসের ছুটি নিয়া সপরিবারে গ্রামের বাড়িতে চলিয়া যাই। বার্তা সম্পাদক কবি বেনীর আহমদকে মাসখানেক কোনও মতে চালাইয়া যাইবার ভার দিয়া যাই।

.

১১. ‘নবযুগে’ চাকুরি খতম

ছুটির পনের দিন যাইতে না যাইতেই নজরুল ইসলাম সাহেবের এক টেলিগ্রাম পাইলাম : আপনার সার্ভিসের আর দরকার নাই।’ অর্থাৎ আমার চাকুরি খতম। এমনটি একদিন ঘটিবেই, তা জানিতাম। কিন্তু কাজী সাহেব আমাকে টেলিগ্রাম করেন কেন? হয় হক সাহেব নয় ত মি. দত্তই আমার চাকুরি খতম করিবেন। কাজী সাহেব কেন? আমার সন্দেহ হইল। আমি আগেই জানিতাম, অন্যতম মন্ত্রী এবং কাগজে-পত্রে নবযুগ–এর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর খান বাহাদুর হাশেম আলী ঐদিন ময়মনসিংহ শহরে আছেন। আমি তার সাথে দেখা করিলাম। তিনি ব্যাপার শুনিয়া আকাশ হইতে পড়িলেন। এটা কিছুতেই বরদাশত করা হইবে না বলিয়া তিনি অবিলম্বে কলিকাতা যাইতে আমাকে পরামর্শ দিলেন। তিনি নির্দিষ্ট ট্যুর প্রোগ্রাম শেষ করিয়াই দু-চার দিনের মধ্যেই কলিকাতা ফিরিবেন বলিলেন।

মন বলিল কোনও লাভ হইবে না। তবু কলিকাতা গেলাম। কারণ দেনা-পাওনা মিটাইয়া এবং জিনিস-পত্র গোছাইয়া আসিতে একবার কলিকাতা ত যাইতেই হইবে। সে জন্য বাড়িতে কাউকে কিছু না বলিয়া শহরে দু-এক বন্ধুকে আমার জন্য একটি বাড়ি ঠিক করিতে অনুরোধ করিয়া কলিকাতা গেলাম। হক সাহেবের সাথে দেখা করিয়া টেলিগ্রামটা দেখাইলাম। তিনি শুধু বিস্ময় প্রকাশ করিলেন না : ‘কোন বদমায়েশ এই বদমায়েশি করিল’ বলিয়া দু-চারটা হুঙ্কারও দিলেন। কিন্তু নান্না মিয়া, মি. সৈয়দ বদরুদ্দোজা, নূরুল হুদা ও বেনযীর আহমদের নিকট আসল কথা জানিতে পারিলাম। তারা যা বলিলেন তার সারমর্ম এই : আমি ছুটিতে যাওয়ার পর হইতেই মি. দত্ত হিন্দু মন্ত্রীদিগকে দিয়া আমাকে সরাইবার জন্য হক সাহেবের উপর চাপ দেওয়া শুরু করেন। হক সাহেব শেষ পর্যন্ত রাজি হন। কিন্তু নিজে ডিসমিস করিতে রাজি হন না। দত্ত সাহেব নিজেও ডিসমিসের পত্র দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না। কাজেই অনেক বুদ্ধি-পরামর্শ করিয়া তিনি কাজী সাহেবকে ধরেন। কাজী সাহেবের সঙ্গে মি. দত্ত একা অনেক আলাপ করিতেন। সে আলাপে নূরুল হুদা ও বেনযীর আহমদকে কাজী সাহেবের কাছে থাকিতে দেওয়া হয় নাই। তবে তারা শুনিয়াছেন কাজী সাহেবের সমস্ত দেনা শোধ করিবার ওয়াদা করিয়া মি. দত্ত কাজী সাহেবকে চিঠির বদলে টেলিগ্রাম করিতে রাজি করিয়াছেন। কাজী সাহেবের এই কাজের নিন্দা সকলেই করিলেন। আমিও মনে আঘাত পাইলাম। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে কাজী সাহেবের তল্কালীন মানসিক অবস্থার কথা মনে পড়ায় তাঁর প্রতি নরম হইয়া গেলাম।

ফলে নবযুগ-এ ফিরিয়া যাওয়ার আশা ও চেষ্টা ত্যাগ করিলাম। তাঁর বদলে মাথায় একটা দুষ্ট-বুদ্ধি গজাইল। মাত্র কয়েকদিন আগে বোম্বাই হাইকোর্টের একটা রুলিং খবরের কাগজে বাহির হইয়াছিল। তাতে বলা হইয়াছে নিয়োগ-পত্রে নির্দিষ্ট কিছু শর্ত লেখা না থাকিলে সাংবাদিককে বরখাস্ত করিতে তিন মাসের নোটিস লাগিবে। আমি হক সাহেবকে সে কথা বলিলাম। তিনি খুশি হইয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিলেন। বলিলেন যে মি. দত্তের সঙ্গে আমার বনিবে না, তা তিনি জানিতেন। অথচ আমাকে ছাড়িতেও তাঁর মনে কষ্ট হইতেছিল। এখন আমি স্বেচ্ছায় সরিয়া যাইতে রাজি হওয়ায় তাঁর বুকের উপর হইতে একটা পাথর নামিয়া গেল। তিনি নিশ্চয় মি. দত্তকে দিয়া তিন মাসের বেতন দেওয়াইয়া দিবেন। বোধ হয় পরদিনই তিনি আমাকে জানাইলেন, মি. দত্ত টাকা দিতে রাজি হইয়াছেন। কিন্তু আমার দাবি-মত নয়শ টাকা নয়। কারণ আমার বেতন আড়াইশ। ওরই তিন মাস হইবে। এলাউন্সের পঞ্চাশ টাকা নোটিসের সঙ্গে আসিবে না। বুঝিলাম এটা লইয়া দরকষাকষি করিয়া সময় নষ্ট করা উচিৎ নয়। সাড়ে সাতশ টাকা লইয়া সকল দাবি-দাওয়া ত্যাগের রশিদ লিখিয়া দিলাম। এই ভাবে আমার সাংবাদিক জীবনের তৃতীয় পর্যায় শেষ হইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *