২০. উপক্রমণিকা
ইতিপূর্বে আমরা যে আলোচনা করেছি তার থেকে কয়েকটি পরিসংহার টানা যেতে পারে। প্রধানত ঐতিহাসিক ও নৈতিক এই দুভাগে তা বিভক্ত হবে। ঐতিহাসিকভাবে আমরা দেখেছি যে, সুসভ্য সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে যৌন নৈতিকতার দুটি উৎস আছে–একদিকে পিতৃত্বের মতো স্বভাবিকতাকে আস্বাদনের ইচ্ছা, অন্যদিকে সন্তান-উৎপাদন ব্যতিরেকে যৌনতাকে অপ্রাসঙ্গিক মনে করার নান্দনিক চিন্তাধারা। প্রাক-খ্রিস্টিয় সময়ের নৈতিকতায় এবং দূর প্রাচ্যের সমকালীন চিন্তাধারায় প্রথম উৎসটি ক্রিয়াশীল থেকেছে। ভারত ও পারস্যের ক্ষেত্রে নান্দনিক চিন্তাই অধিকতর ক্রিয়াশীল কিন্তু অপেক্ষাকৃত অনুন্নত জাতিগোষ্ঠী পিতৃত্বের প্রতি এতখানি আকৃষ্ট ছিল না, যেহেতু সন্তান উৎপাদনে পুরুষের ভূমিকা সম্পর্কে তাদের কোনো সম্যক ধারণা ছিল না। তাদের মধ্যে নিহিত ছিল পৌরুষ উপযোগী হিংসা যা নারীজাতির প্রতি আরোপ করেছিল কিছু বাধানিষেধ। তথাপি সামগ্রিক বিচারে প্রাচীন পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার নারীরা অধিকতর অবাধ জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিল।
একথা সহজেই অনুমেয় যে, পরিবর্তনের সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা পরম্পরার অনিবার্য ফলশ্রুতিতে নারীদের স্বাধীনতার প্রতি আরোপতি হয়েছে শৃঙ্খল এবং পিতারা সন্তানদের জন্ম দিয়ে গর্বিত পিতৃত্বের স্বাদ করেছে আস্বাদন। এই অবস্থায় যৌননৈতিকতা আবদ্ধ থেকেছে শুধুমাত্র রমণিদের ক্ষেত্রে। কোনো এক বিবাহিত নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা ছাড়া পুরুষকে অবাধ স্বেচ্ছাচারী করা হয়েছে।
খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তনের ফলে নারী ও পুরুষ উভয়কেই একই রকম নৈতিকার বন্ধন আবদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়। প্রাচীন যৌননৈতিকতার একমাত্র জৈবিক উদ্দেশ্য ছিল শিশুকে তাদের শৈশবের বছরগুলিতে পিতা ও মাতা উভয়ের নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার ছত্রছায়ায় রাখা, কোনো এক জনের নয়। খৃষ্টীয় তত্ত্বে এই উদ্দেশ্য অনেকাংশে বিঘ্নিত হয়, কিন্তু ব্যবহারিক উপস্থাপনায় তার সাযুজ্য ক্রিয়াশীল রইলো।
বর্তমানে যুগে আমরা দেখেছি যে, খ্রিস্টিয় ও প্রাক খ্রিস্টিয় যৌননৈতিকতা রূপান্তরের মাধ্যমে পরিবর্তিত হচ্ছে।
ধার্মিক বিশ্বস্ততার অবমূল্যায়নে এবং কুসংস্কারের অপসৃয়মাণতায় খ্রিস্টিয় প্রভাব ক্রমেই কমে আসছে। এই শতাব্দীতে জাত মানব-মানবীরা যদিও তাদের অবচেতনার সুপ্তির মধ্যে সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি অনুরাগী কিন্তু সচেতনভাবে গর্ভপাতকে অস্বীকার করতে চায় না; এমনকি প্রাক-ক্রিস্টিয় অনুবর্তনে এই রূপান্তর বিদ্যমান। প্রথমত গর্ভনিরোধকের ব্যবহারে ফলে যেকোনো যৌনমিলনের অনিবার্যভাবে গর্ভদানের সম্ভাবনাকে প্রকট করে না এবং অবিবাহিতা নারীজাতিকে সন্তান উৎপাদনে বাধ্য করে না, এমনকি বিবাহিতা রমণিকেও তাদের স্বামী দ্বারা উৎপাদিত সন্তানেই সন্তুষ্ট রাখা যেতে পারে, যদিও এর সঙ্গে চারিত্রিক শুদ্ধতা রক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই।
এই পদ্ধতি এখনও সম্পূর্ণ হয় নি। কেননা এখনও মানুষ গর্ভনিরোধকের ওপর সম্পূর্ণ মাত্রায় আস্থাশীল নয়। ভবিষ্যতে বহির্বৈবাহিক যৌনসঙ্গমের ব্যাপকতা সত্ত্বেও রমণিরা তাদের সতীত্ব রক্ষার্থে সমর্থ হবে। ফলে নারীরা তাদরে স্বামীদের সহজেই প্রবঞ্চিত করতে পারবে। এবং এই প্রবঞ্চনার সঠিক কারণ অনুসন্ধানে স্বামীরা প্রায়শই ব্যর্থ হবে। যখন কোনো একটি নারী একাধিক পুরুষের প্রতি অনুরক্ত হবে তখন তার গর্ভে উৎপাদিত সন্তানের পিতৃত্ব নিয়ে দেখা দেবে এক অনভিপ্রেত সংঘাত। নতুনতর দৃষ্টিভঙ্গিতে হয়তো আগামীদিনের স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের প্রতি পোষণ করবে সুপ্ত ঈর্ষা।
আগামীদিনের সমাজ ব্যবস্থায় রমণি জাতির আনুগত্যের রূপরেখাঁটি পূর্বের মতো জটিল আকার ধারণ করবে না এবং যৌননৈতিকতার ক্ষেত্রে যে যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটে যাবে তার ফল হবে সুদূরপ্রসারী। রাষ্ট্র যতই শিশুর শিক্ষা ও প্রতিপালনকে সামাজিক দায়বদ্ধতার ঘেরাটোপে বন্দি করবে ততই সন্তানের প্রতি পিতামাতাকে স্ব আরোপিত কর্তব্যবোধের দিগন্ত সংকুচিত হবে। বিশেষ করে চাকরিজীবী সম্প্রদায় এর দ্বারা বহুলাংশে প্রভাবিত হবে এবং বর্তমানে জনগোষ্ঠী সংখ্যাগুলো হলো ঐ সম্প্রদায়ভুক্ত। ধীরে ধীরে সমাজের বাকি গোষ্ঠীভুক্ত হবে এর অন্তর্গত। জান্তব ও মানব পরিবারে পিতার প্রধান কাজ হলো পরিবারকে সম্ভাব্য বিপদ থেকে রক্ষা করা এবং তার সুষ্ঠু প্রতিপালন, কিন্তু সুসভ্য সমাজ ব্যবস্থায় নিরাপত্তার দায়িত্ব দেয় আইনরক্ষকেরা এবং বিশেষ করে সমাজের দুর্বলতর শ্রেণিদের ক্ষেত্রে প্রতিপালনের বিষয়টি রাষ্ট্র নিজেই সমাধা করে। তাহলে পিতার আর কোনো সদর্থক ভূমিকা থাকছে না। সেক্ষেত্রে নারীর বেলায় দুটি সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে।
প্রথম রমণি তার স্বাভাবিক কার্যধারা বজায় রাখবে এবং কোনো সামাজিক সংগঠন তার শিশুকে প্রতিপালন করবে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে রমণি তার সন্তান প্রতিপালনের জন্য সমাজ অথবা সংসার কর্তৃক বেতনপ্রাপ্তা হবে। যদি শেষের ঘটনাটি ঘটে তাহলে প্রথাগত নৈতিকতার পুনরুজ্জীবন ঘটতে পারে এই কারণে যে, দুশ্চরিত্রা নারীকে বেতনলাভে বঞ্চিত করা হবে। সেক্ষেত্রে সে সামাজিক সংগঠনের সাহায্য নিতে বাধ্য। তাই অর্থনৈতিক শক্তিগুলির যথাযোগ্য সদ্ব্যবহারে ভবিষ্যৎ জাতক-জাতিকার জীবনে পিতার গুরুত্ব বহুলাংশে এবং মাতার গুরুত্ব কিয়দংশে হ্রাসপ্রাপ্ত হবে। এক্ষেত্রে ঐতিহ্যানুসারী নৈতিকতার প্রথাসম্মত কারণগুলি অবলুপ্ত হবে এবং নব্য নৈতিকতার স্বপক্ষে নতুন উদ্দেশ্যের জন্ম হবে।
সত্যি সত্যি যদি পরিবার প্রথা ভেঙে যায় তাহলে আমার মতে আনন্দের ঘটনা হবে না। কেননা, শিশু প্রতিপালনের মধ্যে মাতাপিতার যে স্নেহবিজড়িত কর্তব্যবোধ থাকে তা কোনো সামাজিক সংগঠনে অপ্রাপ্তব্য হবে। এদের কাজ হবে অতিমাত্রায় পেশাদারী ও হৃদয়হীন। বিভিন্ন বাতাবরণে জন্ম হওয়া শিশুদের স্বতন্ত্রীকরণে ব্যর্থ হয়ে এরা এক অদ্ভুত সাম্য ও সাযুজ্যের জন্ম দেবে। যদি না ইতিমধ্যে এক। আন্তজাতিক সরকারের প্রতিষ্ঠালাভে সক্ষম হয় তাহলে বিভিন্ন দেশভূক্ত শিশুদের মনে উগ্র স্বজাত্যবোধের যে ভয়াবহতা দেখা দেবে তার থেকে জন্ম হবে ভবিষ্যৎ জীবনের চরমতার বৈরিতার।
এমনকি জনসংখ্যার ক্ষেত্রেও সর্বদেশিয় সরকারের প্রয়োজন আছে, কেননা, এর অবর্তমানে জাতীয়বাদী শক্তিগুলি কাঙ্ক্ষিত সংখ্যার চেয়ে বেশি মাত্রায় সন্তান উৎপাদনের প্রতি আকৃষ্ট হবে এবং চিকিৎসাশাস্ত্র ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতির ফলশ্রুতিতে অনভিপ্রেত সংখ্যাধিক্যের বিয়োজনে যুদ্ধই হবে একমাত্র পন্থা।
সমাজশাস্ত্রী প্রশ্নাবলি সাধারণত কঠিন ও জটিল হলে ব্যক্তিগত চিন্তাগুলি সরল ও শোভন হয়ে থাকে। যৌনতার সঙ্গে সংযুক্ত সবকিছুই পাপের দ্যোতক– এই বিশ্বাস শৈশবের প্রথম দিন থেকে পরবর্তী জীবনের প্রতিটি প্রহরকে অব্যক্ত যন্ত্রণায় বিদ্ধ করবে।
যৌন অনুরাগকে কারারুদ্ধ করে প্রথাগত নৈতিকতা জীবনের আরও অনেকগুলি সুকুমার প্রবৃত্তির মৃত্যু ঘটিয়েছে; যেমন সংখ্যাপূর্ণ আচনণ মানুষকে করে তুলেছে নির্মম, হৃদয়হীন, স্বঃপ্রযুক্ত ও আবেগহীন। যেকোনো যৌন সম্পর্কিত সত্যের সার্বিক ও সর্বশেষ উপস্থাপনায় কুসংস্কারহীনতার ছাপ থাকা দরকার এবং স্বপক্ষে স্বীকৃত কারণের উপস্থিতি থাকতে হবে।
পেশা, বাণিজ্য, ক্রীড়া, বৈজ্ঞানিক অথবা মানবজীবনের অন্য যেকোনো কার্যধারার মতো যৌনতাও স্থির লক্ষ্য ছাড়া বাঁচতে পারে না। কিন্তু অশিক্ষিত মানুষ দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীন পৃথিবীর অকারণ নিষেধাজ্ঞার নৈতিকতায় তার স্ফুরণ অসম্ভব। যৌনতার ক্ষেত্রে অর্থনীতি ও রাজনীতির মতো ভীতি বিহ্বলতা আজও প্রধান দখল করেছে অথচ তাকে বিনষ্ট করেছে আধুনিক আবিস্কারগুলি। কিন্তু সেই আবিস্কারলব্ধ গুণগুলিকে আমরা মনস্তাত্ত্বিক অনুকরণের বিফলতায় সর্বাংশে প্রযুক্ত করতে পারছি না।
একথা সত্য যে, পুরোনো পদ্ধতি থেকে নতুন পদ্ধতিতে উত্তরণের মধ্যবর্তী এই সময়ে কিছু অসঙ্গতি দেখা দেবে। যারা নতুন আবিস্কারের কথা ঘোষণা করবেন তাদেরকে সক্রেটিসের মতো নিন্দনীয় করা হবে এই কথা বলে যে, তারা তরুণ প্রজন্মকে বিপদমুখি করেছে। অবশ্য এর অন্তরাল কিছু সত্যতা আছে, যদিও তাদের দ্বারা প্রবর্তিত নব্য চিন্তাধারাকে সর্বাংশে গ্রহণ করলে ভবিষ্যৎ জীবন হবে ফেলে আসা জীবনের তুলনায় অনেক বেশি আরামপ্রদ। মধ্যপ্রাচ্যের ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে যাদের বিন্দুমাত্র ধারণা আছে তারা জানেন যে, প্রত্যহ ঈশ্বর চিন্তায় অন্তত পাঁচ মিনিট অতিবাহিত করা উচিত, না হলে আমরা জীবন ধারণের পক্ষে অপরিহার্য নৈতিক নিয়ম-নীতিকে ঠিকমতো মানতে পারবো না।
বিশুদ্ধবাদীদের নব্য নৈতিকতার সঙ্গে সুপ্রাচীন পবিত্রতার মূল পার্থক্য এই যে, আমরা বিশ্বাস করি চেতনাকে আরোপিত করা যায় না, ধারাবাহিক পৌনঃপুনিকতার মাধ্যমে তার বিকাশ ঘটে। যেকোনো আধুনিক মানব-মানবীর জীবনে এই সত্যের সুপ্রশস্ত গ্রহণযোগ্যতা দেখা যায়। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত এটিকে সর্বাংশে গ্রহণ না করা হবে ততক্ষণ এর সম্পূর্ণ বিকাশ ঘটবে না।
যদি শিশুর মননে সহজাত প্রবৃত্তিকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয় তাহলে ভবিষ্যতে কোনোদিন সুশিক্ষার মাধ্যমে প্রবৃত্তির জন্ম দিতে পারবে না। আমি যে নৈতিকতার স্বপক্ষে যুক্তির অবতারণা করতে চাইছি তা কোনো মতেই এমন নৈতিক হবে না, যা যৌবনপ্রাপ্ত নরনারীকে অথবা কিশোর-কিশোরীকে বলবে–তোমার প্রক্ষোভ অনুযায়ী যা খুশি করো। জীবনের প্রতিটি ঘটনার মধ্যে সীমানা নির্ধারণ করা দরকার কেননা যে সমস্ত ঘটনা তাৎক্ষণিকভাবে সুখদায়ক এবং প্রতিমুহূর্তে আকর্ষক তার মধ্যে ধারাবাহিক অবদান নাও থাকতে পারে। আমি তাই স্বনিয়ন্ত্রণকে সর্বশেষ উপায় হিসেবে মানতে পারি না। আমি মনে করি যে, আমাদের সমাজ ও সংস্কার যেন এই বোধকে সর্বোচ্চ সীমায় উপনীত করার পরিবর্তে সর্বনিম্ন অবস্থানে নির্দিষ্ট রাখে।
স্ব-নিয়ন্ত্রণ হলো চলমান গতিতে রুদ্ধ করার মতো চালিকাশক্তি। যখন আপনি অন্যায় পথে পা দিয়েছেন তখন এ হলো আলোর দিশারী, আবার ন্যায়ের পথযাত্রীর ক্ষেত্রে এর প্রভাব অত্যন্ত ক্ষতিকারক। এই চেতনার বারংবার প্রয়োগ সুপ্রযুক্ত কার্যধারার পক্ষে অপরিহার্য শক্তির অপচয় ঘটে। আভ্যন্তরীণ ঘর্ষণের ফলে তা বহুলাংশে নষ্ট হয় যে, যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর অপরিহার্যতাকে স্বীকার করে বলতে হয় যে, এ ঘটনা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।
শৈশবের প্রথম প্রহরে আরোপিত প্রবৃত্তির পরিশীলনে স্বনিয়ন্ত্রণের মাত্রা নির্ভর করে। শৈশবে বিদ্যমান প্রবৃত্তি ভবিষ্যৎ জীবনে সুখদায়ক অথবা ক্ষতিকর হতে পারে, যেমনভাবে একটি লোকোমোটিভ ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে বাস্পের সদ্ব্যবহার তাকে ঈপ্সিত লক্ষ্যের দিকে ধাবিত করে এবং এর কু-প্রযুক্তিতে সেই ইঙ্গিত ভয়ংকর দুর্ঘটনায় পতিত হয়। শিক্ষার কাজ হলো প্রবৃত্তিকে সৎ, শোভন ও সুন্দর দিকে চালিত করা। যদি প্রথম জীবনে এই কাজ সুচারুভাবে সমাধা করা হয় তাহলে ভবিষ্যতের মানব মানবী সুকঠিন আত্মনিয়ন্ত্রণের ব্যতিরেকে জীবনযাপণ করতে পারে; যদিও কয়েকটি বিরলতম ক্ষেত্রে এই নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। পক্ষান্তরে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা যদি প্রবৃত্তির অবদমনে প্রবৃত্ত হয় তাহলে ভবিষ্যৎ জীবনে এমন দুর্বিষহতার জন্ম হবে, যার থেকে নিষ্ক্রমণের একমাত্র পথ হলো আত্মনিয়ন্ত্রণের ধারাবাহিক উপস্থাপনা।
যৌন প্রক্ষোভের মধ্যেও এর উপস্থিতি আছে, বিশেষ করে এই প্রক্ষোভ অত্যন্ত শক্তিশালী এবং প্রথাগত নৈতিকতা দ্বারা তাড়িত হয়ে অতিমাত্রায় অসংযমী হওয়াতে এই চেতনার অন্তরাল তীব্র যৌনেচ্ছা বিদ্যমান। নীতিবাগীশদের বিশ্বাস এই ইচ্ছার যথাযোগ্য অবদমন না হলে তা ভয়ংকর নৈরাজ্যবাদের জন্ম দেবে।
কোনো কোনো মানুষের মধ্যে প্রাচীন নিষেধাজ্ঞার বোধ বিদ্যমান; যদিও তারা আত্মনিয়ন্ত্রণে সর্বাংশে সফল হন না। যাকে আমরা বিবেক বলে থাকি তা হলো তর্কাতীতভাবে আবেগমন্দ্রিত এবং প্রথম যৌবনে আহরিত অচেতন গ্রহণযোগ্যতা দ্বারা সৃষ্টি। সমাজ যাকে নিষিদ্ধ করেছে তা ত্রুটিযুক্ত এই চিন্তা ধারার মতে যৌদ্ধিক আচ্ছন্নতার প্রকাশ নেই। এর থেকে জন্ম হয়েছে স্ববিরোধী ব্যক্তিসত্তার প্রবৃত্তি এবং কারণ হাতে হাত মিলিয়ে চলতে পারছে না যদিও প্রবৃত্তি হয়েছে সর্বগ্রাসী এবং কারণ হয়েছে নীরব। বর্তমান যুগে প্রথাভাঙার সঙ্গীত হচ্ছে ধ্বনিত। মানুষ আজ আশৈশবজনিত নৈতিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ছুঁড়ে দিচ্ছে। কিন্তু তার বিশ্বাস ও কার্যধারার মধ্যে সাযুজ্য ঘটছে না।
আবার এমন কিছু মানুষ আছে যারা বিবেকের দংশনে শৈশবে দেখা চেতনার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাইছে কিন্তু অবচেতনে আজও রয়েছে সেই বিশ্বাসের নীরব পদচারণ। ভীতিবিহ্বলতার মতো কোনো কঠিন আবেগের আতিশয্যে সেই মানুষ অকস্মাৎ তার মতবাদ পরিবর্তিত করতে পারে। দুরারোগ্য ব্যাধির আক্রমণ অথবা ভূমিকম্প তার মনে জন্ম দেবে এমন এক অনুশোচনাবোধের, যার থেকে তার বৌদ্ধিক দিকগুলি হারিয়ে যাবে চিরতরে, সে আবার কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাসে পতিত হবে।
প্রাচীন পন্থার পরিবর্তে নব্যপদ্ধতি তখনও পর্যন্ত সুখদায়ক হবে না যখন পর্যন্ত তাকে সামগ্রিক ব্যক্তিত্বের অভিধায় অভিষিক্ত না করা হবে। এর সর্বস্তরে অবস্থার করবে বিবেক-অলংকৃত চেতনা। কিন্তু যে মানুষ শৈশব থেকে প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থায় বড় হয়েছে তার পক্ষে এই নতুন নীতিকথাকে করা সহজে সম্ভব নয়।
যৌন নৈতিকতাকে আরমা কয়েকটি সাধারণ তত্ত্বের পরিচায়ক হিসেবে গণ্য করতে পারি। প্রথমত মানব-মানবীর মধ্যে এমন তীক্ষ্ণ আকাঙ্ক্ষিত প্রণয় বিদ্যমান থাকা দরকার যা উভয়ের সমগ্র ব্যক্তিসত্তাকে এমনভাবে আলোকিত করবে যার থেকে জন্ম হবে যে বিস্ফোরণের সেটা উভয়কেই অহংকারী ও সর্বব্যাপী করে তুলবে।
এর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শিশুর প্রতি যথেষ্ট যত্নের উপস্থাপনা যা হবে একাধারে শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক। এই দুটি মূলতত্ত্বের স্বপক্ষে আমি কয়েকটি রূপান্তরের কথা বলবো। যদি না আজকের মানব-মানবীরা স্মৃতি তাড়িত ভয়ের মুহূর্তে কাটাতে তাহলে বিবাহ নামক স্বর্গীয় বন্ধন দ্বারা আবদ্ধ হয়ে তারা লাভ করতো অনেক বেশি আনন্দ। কিন্তু প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতার অভাবে তারা কাঙ্ক্ষিত সুখলাভ করতে পারে না, যেহেতু হিংসা নীতিবাগীশদের সম্মতি পেয়েছে, তাই তা মানুষের অন্তরীণ করেছে রুদ্ধ কারায়। যে দাম্পত্যজীবন বিশ্বাসহীনতার বিষাক্ত দহনে দগ্ধ হয় তা কাঙ্ক্ষিত ও বরণীয়।
ভয়, নিষেধাজ্ঞা ও পারস্পরিক স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করা জীবন কখনোই সুখি ও সমৃদ্ধ হতে পারে না।
এর জন্যে প্রয়োজন শারীরিক বিশ্বস্ততা ও মানসিক প্রশান্তি। চিরন্তন স্নেহের . পরিস্ফুটনে আনুগত্যের দাম অমাপ্য।
বর্তমানে এমন দেখা গেছে যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঘটে যাওয়া বিবাদ বিসম্বাদ ক্ষণে ক্ষণে ঘটমান সমালোচনা, তর্কবিতর্ক শিশুর মননে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। যদিও একথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, বিবাহ বিচ্ছেদের মতো ঘটনা সন্তানের জীবনে চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে যায়। কিন্তু যে সম্পর্ক পরিণত হয় বিক্ষোভ তাড়িত উত্তেজনায় তার থেকে মুক্তিলাভই কাম্য।
যেকোনো স্বচ্ছ মনোভাবাপন্ন যুক্তিবাদী প্রাপ্ত বয়স্ক ও কিশোরদের মনের মধ্যে এমন নতুন চিন্তাধারার বহিঃপ্রকাশ ঘটাবেন যা বারবার ব্যবহারে দীর্ণ ও জরাপ্রাপ্ত সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের সর্বজনগ্রাহ্য বিকল্প হিসেবে গণ্য হবে। আমরা যে স্বাধীনতার আকাক্ষী তার অনুপ্রবেশ ঘটাতে হবে। শৈশবের প্রথম প্রহর থেকে না হলে আমরা সমগ্র সত্তার স্বাধীনতা অর্জনে অসমর্থ হব। যদিও না শিশুকালে এই মুক্তির বার্তা সূচিত হয় তাহলে ভবিষ্যৎ জীবনের প্রতিটি প্রহর অতিবাহিত হবে প্রাচীন পাপবোধ সম্পর্কে অহেতুক ভয়ের মধ্যে।
মনোবিশারদেরা যে বিষয়টির ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে চেয়েছেন তা হলো মানবজীবনের শৈশব লাঞ্ছিত ভীতির বিশ্লেষণ। এমনটি দেখা গেছে, যেসব শিশু নীতিকথার বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে তাদের শিশুকাল অতিবাহিত করে, তাদের অধিকাংশই পরবর্তীকালে পরিবর্তিত হয় ব্যক্তিত্বশূন্য মানব সত্তায় এবং তারা সকলেই সাধারণভাবে বিবাহ ও যৌনতা সম্পর্কে স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় রাখতে পারে না। কিন্তু এই ঘটনার সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো এই যে, আমরা এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত না হয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও একই রকম কুশিক্ষায় গড়ে তোলার চেষ্টা করি।
আমি অবাধ মুক্তির স্বপক্ষে সাওয়াল করতে আসি নি, আমি চেয়েছি সুপ্রাচীন ঐতিহ্যকে সমকালীন করতে। স্ব-নিয়ন্ত্রণ হবে এমন একটি সত্তা যা মানুষের স্বীয় স্বাধীনতাকে অবাধ ও অনধিকৃত রাখবে এবং তাকে সুষ্ঠুভাবে গড়ে তোলার সহায়ক হবে। এর প্রধান উপকরণ হলো এমন শিল্প শিক্ষা যা পারস্পরিক ব্যক্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র্যবোধকে শ্রদ্ধা করতে শেখাবে। কিন্তু পবিত্রতার নামে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি এর বিপরীতক্রমে ক্রিয়াশীল থাকে। তাই নিয়ন্ত্রিত নৈতিকতার আলোকিত দিকগুলির উপস্থাপনাই হবে আমাদের প্রতিপাদ্য বিষয়।
আদর্শ বিবাহ হলো এমন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা বা সুদৃঢ় অন্তরঙ্গতা এবং শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক যোগসূত্রতায় মানব-মানবীর দ্বৈত সত্তাকে দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতায় পরিশীলিত করবে। এই প্রেম হলো অভিপ্রেত ও দুর্লভ, এর অন্তরালে আছে এক স্বকীয় নৈতিকতা ও ঐচ্ছিক আত্মনিবেদন, যার অবর্তমানে প্রেম তার স্বাভাবিক গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে পরিণত হয় আবেগশূন্য অনুভূতিতে।