০২. বৈবাহিক সমাজ সমূহ
বিবাহের পদ্ধতির মধ্যে সদাসর্বদা তিনটি বিষয়ের মিশ্রণ থাকে, সাধারণভাবে যেগুলো নামকরণ করা যায় সহজাত, অর্থনৈতিক ও ধার্মিক। আমি বলতে চাই না যে, এই তিনটি ধর্মকে তীক্ষ্ণভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব, কেননা সেগুলো একই সঙ্গে প্রযুক্ত। রবিবার যে দোকান বন্ধ থাকে তার অন্তরালে আছে ধার্মিক উৎস কিন্তু এখন সেটি পরিণত হয়েছে অর্থনৈতিক কারণে। এবং যৌনতা সম্পর্কিত আইন ও প্রচলিত নীতির মধ্যে এই সংমিশ্রণ পরিলক্ষিত হবে। যে ব্যবহারযোগ্য নিয়মনীতির ধার্মিক উৎস আছে সেটি সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী হয়। কেননা ধার্মিক নীতি অমূল্যায়িত হলেও তার উপযোগিতা বজায় থাকে।
ধার্মিক ও সহজাত বিষয়ের মধ্যে প্রভেদ নিরূপণ করা শক্ত কাজ। যে ধর্ম মানুষের কার্যপ্রকৃতির ওপর দৃঢ় কর্তৃত্ব বজায় রাখে, সাধারণত তার মূলে থাকে সহজাত প্রবৃত্তি। এই দুইটি ঐতিহ্যের গুরুত্ব অনুসারে পৃথক করা যেতে পারে এবং এই সত্যটি স্মরণ রাখতে হবে যে, কয়েকটি গ্রহণযোগ্য কার্যধারা বিশেষ ধরনের ফলশ্রুতির জন্ম দেয়। উদাহরণস্বরূপ আমরা বলতে পারি, ভালোবাসা ও হিংসা উভয়েই হলো সহজাত আবেগ। কিন্তু ধর্ম হিংসাকে গ্রহণযোগ্য আবেগরূপে স্বীকার করে না, কিন্তু ভালোবাসাকে মনে করে পরম কাক্ষিত।
যৌন সম্পর্কে সহজাত প্রবৃত্তি অনুমান অপেক্ষা কম। এই বইয়ের মধ্যে আমি নৃতত্ত্ববিদ্যা নিয়ে আলোচনা করতে চাই নি। আমি আধুনিক যুগের সমস্যা বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছি। একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, আমাদের কাজের জন্যে বিজ্ঞান হলো অত্যন্ত গ্রহণীয়। এর মাধ্যমে আমরা দেখাতে চাইব কিভাবে সহজাত প্রবৃত্তিগুলির মধ্যে সুদূরপ্রসারী সুনিশ্চিত মনোমালিন্য ঘটিয়ে বিজ্ঞান তাকে দীর্ঘকাল ধরে নিয়ন্ত্রণ করেছে। শুধুমাত্র বর্বর শক্তির মধ্যে নয়, অপেক্ষাকৃত উন্নততর গোষ্ঠীর মধ্যে একটা নিয়ম প্রচলিত আছে–পুরোহিতরা কুমারী মেয়েদের সতিচ্ছেদ করে থাকে, এবং কখনো কখনো তা করা হয় সর্বজন সমক্ষে। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী পুরুষরা মনে করে এই কর্তব্যটি হলো স্বামীর নিজস্ব অধিকার। অধিকাংশ খ্রিস্টান এখনো অবধি ধার্মিক সতিচ্ছেদের পদ্ধতিতে সহজাত বলে মনে করে। অতিথির সেবার জন্যে নিজের স্ত্রীকে উৎসর্গ করার মধ্যে যে আতিথেয়তার প্রকাশ ঘটে তার অন্তরালে আধুনিক ইউরোপীয় মানুষ সহজাত প্রবৃত্তির সন্ধান পেয়েছে এবং এই পদ্ধতিটি সর্বত্র পরিব্যাপিত আছে।
বহুস্বামীকতা হলো আরেকটি পদ্ধতি যাকে সুশিক্ষিত শ্বেতাঙ্গ মানুষ মানবতা বিরোধী বলে মনে করে। এই সকল যুক্তি দ্বারা আমরা প্রমাণ করতে পারি যে, এদের অন্তরাল অর্থনৈতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রভাব পড়েছে। আসল কথা হলো, যেখানে মানব সত্তা সংযুক্ত আছে সেখানে প্রাকৃতিক ধারা থেকে সহজাত প্রবৃত্তিকে কৃত্রিম অসারতায় বিচ্ছিন্ন করা হয়। বর্বর অথবা সভ্য গোষ্ঠীর মধ্যে এ ব্যাপারে কোন মতপার্থক্য নেই।
যৌনতা সম্পর্কে মানুষের চেতনা যেমন দৃঢ়, ঠিক তেমন কঠিন হলো কোন বিষয়ের আলোচনায় সহজাত শব্দটির যথাযোগ্য উপস্থাপনা। মানুষের সমস্ত যৌনকেন্দ্রিক ব্যবহারের মধ্যে একমাত্র যে মনস্তাত্ত্বিক চেতনাটিকে সহজাত বলা যেতে পারে সেটি হচ্ছে শৈশবে স্তন্যপান। আমি জানি না বর্বর জাতির মধ্যে এ সম্পর্কে কি মতবাদ প্রচলিত আছে। কিন্তু সুসভ্য মানুষকে যৌনকার্যের জন্য শিক্ষাগ্রহন করতে হয়। বিবাহের কয়েক বছর পরে বিবাহিত দম্পতি চিকিৎসকের কাছে সন্তান উৎপাদন বিষয়ে পরামর্শ চাইছে, এ ঘটনা বিরল নয়। পরীক্ষা দ্বারা অনেক সময় প্রমানিত হয় যে, দম্পতিরা এখনও জানে না কিভাবে শারীরিক সঙ্গম সাধন করতে হয়। অতএব যথাযোগ্যভাবে বিচার করলে যৌনতাকে আমরা সহজাত বলতে পারি না। যদিও এর প্রতি আছে একটি প্রাকৃতিক আকর্ষণ; এবং এর অবর্তমানে অতৃপ্তির অনুপ্রবেশ ঘটে। এ প্রসঙ্গে আমরা অন্যান্য জন্তুর মধ্যে প্রযুক্ত সংক্ষিপ্ত স্বভাব-সঞ্জাত বিষয়ের কথা বলতে পারি, যেখানে সহজাত প্রকৃতিকে সরিয়ে দিয়েছে অন্য প্রকৃতি।
মানব সত্তা প্রাথমিকভাবে অতৃপ্তি সহকারে অনিয়ন্ত্রণ ও অসম্পূর্ণতার প্রতি ছুটে চলে কিন্তু ধীরে ধীরে আকস্মিকতা দ্বারা তারা এমন অবস্থায় পৌঁছায় যা তাদের দেয়। তৃপ্তি। তখন সে পদ্ধতিটি বারবার প্রযুক্ত হয়। সমাপিত কার্যধারাকে সহজাত বলা উচিত নয়। সহজাতবোধ নিহিত আছে, যে প্রকৃতি ঐ ধারাকে অনুধাবন করতে সাহায্য করে তার মধ্যে। প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যে বিশেষ বিজ্ঞপ্তি দেয় পূর্ব নির্ধারিত নয়। যদিও নিয়ম অনুসারে জৈবিক দিক থেকে সবচেয়ে সুবিধাজনক ভঙ্গিমা সম্পূর্ণ তৃপ্তি দিতে পারে। অবশ্য সেটিকে অনুধাবন করতে হবে আকস্মিকতার মধ্যে।
আধুনিক সমাজের সমস্ত সুসভ্য জাতির ভিত্তি হলো পিতৃতান্ত্রিক পরিবার। নারীত্বের গুণাবলি সম্পর্কে যাবতীয় ধারণা পিতৃতান্ত্রিক পরিবারকে বাস্তবমুখি করার জন্য উদ্ভূত হয়েছে। মনে প্রশ্নে জাগে, পিতৃত্ব সম্পর্কে এই আবেগের অন্তরাল আছে কোন প্রাকৃতিক উন্মাদনা? সাধারণ মানুষ হয়ত মনে করতে পারেন যে, এই প্রশ্নে অত্যন্ত সোজা। শিশুর প্রতি মায়ের আবেগ-অনুভূতিকে অনুধাবন করা একেবারেই শক্ত নয়, কেননা এখানে আছে ঘনিষ্ঠ শারীরিক বন্ধন, যেটি বজায় থাকে আলিঙ্গন অবধি।
কিন্তু পিতার সঙ্গে শিশুর সম্পর্ক হলো অপ্রত্যক্ষ অনুভূত ও সশ্রদ্ধ। একে নিয়ন্ত্রণ করে স্ত্রীকে সম্মান করার বিশ্বাস এবং এটি যে স্থানে বিচরণ করে তা এত বেশি বুদ্ধিনীতি সম্পন্ন, যাকে সহজাত বলা চলে না। অথবা আমরা এক কথায় বলতে পারি, পিতৃত্ব সম্পর্কে আমাদের আবেগের কেন্দ্র হলো কোনো মানুষের নিজের শিশু। এটি কিন্তু কোনো বিষয়ে প্রকৃত ঘটনা হতে পারে না।
মেলানেশিয়ানরা জানে না যে, মানুষের পিতা থাকে, যদিও তাদের মধ্যে পিতার ভালোবাসা আছে সেই পিতৃস্নেহের মতো যারা পিতৃত্ব সম্পর্কে সচেতন। ট্রোবিয়েড দ্বীপপুঞ্জবাসীর পিতৃত্ব সম্পর্কিত মনস্তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন ম্যালিনস্ক। এ বিষয়ে তার কয়েকটি গ্রন্থ আছে। তার মধ্যে তিনটি পুস্তক সবিশেষ উল্লেখযোগ্য– বর্বর সমাজে যৌনতা ও বিকৃতি (sex and repression in savage society), আদিম মনস্তত্ত্বে পিতা (The father in primitive psychology) ও উত্তর-পশ্চিম মেলানেশিয়ার বর্বরদের যৌন জীবন (The sexuallives of savages in North West Melanesia)। যে জটিল আবেগকে আমরা পিতৃত্ব বলি তাকে উপলব্ধি করতে হলে এই তিনটি পুস্তক হলো অপরিহার্য। যেসব কারণে মানুষ একটি শিশুর প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে তার মধ্যে আছে দুটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। মানুষ শিশুকে ভালোবাসে কেননা সে বিশ্বাস করে যে, ঐ শিশুটি হলো তার, অথবা সে হয়তো শিশুর প্রতি অনুরক্ত–এই ভেবে যে, ও হলো তার স্ত্রীর সন্তান। যেখানে পিতার স্থান অজ্ঞাত সেখানে দ্বিতীয় কারণটি কাজ করে।
ট্রোবিয়েন্ড দ্বীপবাসীরা যে তাদের পিতৃত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ সে কথা সন্দেহাতীতভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন ম্যালিনসকি। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, এ দেশের পুরুষরা এক বছর অথবা তারও বেশি সময় সমুদ্র-ভ্রমণে কাটিয়ে দেশে ফিরে তার স্ত্রীর কোলে নবজাতক শিশু দেখে উৎফুল্ল হয় এবং তার স্ত্রীর সতীত্ব সম্পর্কে ইউরোপীয় মন্তব্যকে উপলদ্ধি করতে পারে না। এখানে আরেকটি বিষয় আরও বেশি গ্রহণযোগ্য। তিনি দেখেছেন যে পুরুষের অধিকারে উচ্চ বংশজাত পুরুষের দল থাকে, সেই পুরুষ সমস্ত পুরুষজাতির মধ্যে সবিশেষ সম্মানিতরূপে বিবেচিত হয়। এবং সে অনুধাবন করতে পারে না যে, এই ঘটনা বংশগরিমার অবনতি ঘটাতে পারে। ওখানে এই বিশ্বাস প্রচলিত যে, অলৌকিক শক্তি দ্বারা শিশুরা জন্মায় এবং ঐ শক্তি তাদের মায়েদের মধ্যে প্রবেশ করে। ঐ দ্বীপপুঞ্জের মানুষ এই সত্যকে স্বীকার করে নিয়েছে যে, কুমারীরা গর্ভবতি হতে পারে না। যদিও একথা মেনে নেওয়া হয়েছে যে, বিবাহ অলৌকিক রক্ত বিরুদ্ধে শারীরিক প্রাচীর গড়ে তোলে। বিবাহের পূর্বে পুরুষ-নারীরা বন্ধনহীন ভালোবাসার জীবনযাপন করে। কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে কুমারী মেয়েরা প্রায়ই গর্ভবতী হয়ে পড়ে। একথা যথেষ্ট হবে যে, কুমারী মেয়েদের গর্ভবতী হওয়ার ঘটনা গ্রহণযোগ্য নয় যদিও খ্রিস্টীয় দর্শন অনুসারে ওরা বিশ্বাস করে, কোনো কুমারীরা এমন কোনো কাজ করেনি যা তাদের এই পরিণতি এনে দিয়েছে।
ক্রমে ক্রমে একটি নারী বৈচিত্র্যের মধ্যে ক্লান্ত হয়ে পড়ে ও বিয়ে করে। সে তখন তার স্বামীরা গ্রামে বাস করতে যায় কিন্তু তাকে ও তার সন্তানদের ফেলে আসা গ্রামের সম্পত্তি হিসেবে ধরা হয়। তার সন্তানদের সঙ্গে স্বামীদের যেকোনো রক্তের সম্পর্ক আছে, সেটা স্বীকার করা হয় না। বংশ নিরূপণ করা হয় মায়ের দিক থেকে। সর্বত্র শিশুর ওপর কর্তৃত্ব থাকে পিতার। কিন্তু ট্রোবিয়েন্ড দ্বীপপুঞ্জবাসীর মধ্যে সেই কর্তৃত্ব স্থাপিত আছে মামার ওপর। এর ফলে চমকপ্রদ জটিলতার সৃষ্টি হয়। ভাইবোনদের মধ্যে গড়ে ওঠে অদ্ভুত মানসিকতা। তার ফলে প্রাপ্ত বয়স্ক হবার পরেও ভাইবোনেরা কখনও যৌন সম্পর্কে নিভৃতেও আলোচনা করে না। পক্ষান্তরে যেহেতু মামার ওপরে শিশুদের কর্তৃত্ব স্থাপিত থাকে, সেহেতু তারা বাবাদের দেখতেই পায় না।
অবশ্য যখন তারা মায়েদের কাছ থেকে দূরে থাকে কিংবা বাড়ি ছেড়ে চলে যায় তখন মামা তাদের দেখাশোনা করে। এই পদ্ধতিতে শিশুকে নিয়ন্ত্রণবিহীন দেহের প্রতিভূ করে তোলা হয়। যেটা অন্যত্র অজানা। বাবা তাদের সঙ্গে খেলা করে, কিন্তু তাদের শাসন করার অধিকার তার থাকে না। যে অধিকার আছে মামার ওপর সেও উপস্থিত হতে পারে না।
আরেকটি অদ্ভুত বিশ্বাস আছে, যদিও সন্তানদের সঙ্গে মায়ের স্বামীর মধ্যে কোনো রক্তের সম্পর্কে স্বীকার করা হয় না, তা সত্ত্বেও মনে করা হয় যে, শারীরিক দিক দিয়ে শিশুরা তাদের মায়েদের স্বামীর অনুরূপ। কিন্তু মায়েদের সঙ্গে তাদের অথবা ভাইবোনদের সঙ্গে তাদের বিশেষ মিল নেই।
প্রকৃতপক্ষে ভাইবোনের মধ্যে আকৃতিগত সাদৃশ্য অন্বেষণ করা হলো নিন্দনীয় কাজ। একইভাবে মায়ের সঙ্গে শিশুর সাদৃশ্যকে নিন্দা করা হয়। এমন কি অত্যন্ত পরিস্কার সাদৃশ্যকে শক্তভাবে অগ্রাহ্য করা হয়।
ম্যালিনসকি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, পিতার সঙ্গে সন্তানদের শারীরিক সাদৃশ্য আছে, মাতার সঙ্গে নেই–এই ধারণার মধ্যে পিতৃস্নেহ আলোড়িত হয়।
তিনি আবিস্কার করেছেন, সুসভ্য জাতির মধ্যে পিতাপুত্রের মধ্যে যে সম্পর্ক তার চেয়েও অনেক বেশি আনন্দ চঞ্চল স্নেহময় হলো এখানকার সম্পর্ক এবং যেমনটি আশা করা যায়। তিনি কিন্তু ইডিপাস কমপ্লেক্সের কোনো চিহ্ন দেখতে পান নি।
সর্বশ্রেষ্ঠ যুক্তিকেন্দ্রিক প্রয়াস সত্ত্বেও ম্যালিনসকি দ্বীপপুঞ্জবাসী বন্ধুদের মধ্যে পিতৃত্বের প্রকাশ দেখতে চান নি। এই ব্যাপারটিকে তারা মনে করে মিশনারীদের দ্বারা উদ্ভাবিত নিষিদ্ধ গল্প। খ্রিস্টধর্ম হলো পিতৃকেন্দ্রিক ধর্ম। এবং যে সমস্ত মানুষ পিতৃত্বকে স্বীকার করে না, তারা আবেগ কিংবা বুদ্ধির দ্বারা তাড়িত হয়ে এই ধর্মের সারবত্তা আনুধাবনে অপরাগ!
পিতাই ঈশ্বর এই উচ্চারণের বদলে তারা বলে মাতুলই ঈশ্বর। কিন্তু সেই উচ্চারণের মধ্যেও অর্থগত সুপ্রযুক্ততা বজায় থাকে না। কেননা পিতৃত্ব অধিকার ও স্নেহকে সংবাহিত করে, অথচ মেলানেশিয়াতে মামার হাতে ন্যস্ত হয় কর্তৃত্ব এবং পিতার ওপর থাকে ভালোবাসার দায়িত্ব।
সমগ্র মানবজাতি যে ঈশ্বরের সন্তান এই মতবাদটিও ট্রোবিয়েনড দ্বীপপুঞ্জবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা তারা নিজেদের কোনো পুরুষের সন্তান হিসেবে ভাবতে পারে না। তার ফলে মিশনারীদের অনেক অসুবিধার মুখোমুখি হতে চলেছে। ধর্ম প্রচারের সময় তারা শারীরবিদ্যা সম্পর্কে তথ্যাবলির আলোচনা করেছেন। অনেকে ম্যালিনসকির কাছে স্বীকার করেছেন যে, ঐ প্রাথমিক বক্তব্য বিফল হওয়ায় তারা ঈশ্বরের ভাবাদর্শকে সম্যকভাবে প্রচার করতে পারেন নি।
ম্যালিনসকি বিশ্বাস করেন এবং আমার মনে হয় তার এ বিশ্বাস যথাযথ হয় যদি কোনো পুরুষ গর্ভাবস্থাকালীন তার স্ত্রীর সঙ্গে বাস করে এবং শিশুর জন্মের সময় উপস্থিত থাকে তাহলে সে জন্মের সঙ্গে সঙ্গে শিশুকে সহজাত প্রবৃত্তিবলে ভালোবাসবে। এটি হলো পিতৃত্ব-সঞ্জাত আবেগের মূল ভিত্তি।
তিনি মন্তব্য করেছেন মানবীয় পিতৃত্ব প্রথম অবস্থায় জৈবিক ভীতি ব্যতিরেকে প্রতিভাত হয়। একে প্রাকৃতির পরিবেশ এবং জৈবিক চাহিদার মধ্যে দৃঢ় সংবদ্ধ বলা যেতে পারে। যদিও তিনি মনে করেন যে, যদি কোনো পুরুষ গর্ভাবস্থায় তার স্ত্রীর কাছে অনুপস্থিত থাকে তাহলে সে প্রথমে শিশুর প্রতি সহজাত স্নেহ বোধ করবে না। যদিও তার সমাজের নিয়মনীতি এবং গোষ্ঠীকেন্দ্রিক নৈতিকতা তাকে মা ও ছেলের সঙ্গে একত্রে বসবাস করাবে, ধীরে ধীরে এমন স্নেহ উদ্ভাবিত হয় যেন সে সর্বক্ষণ মায়ের সঙ্গে অতিবাহিত করেছে।
সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ মানবিক সম্পর্কের মধ্যে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য কার্যধারার মধ্যে এমন সহজাত প্রবৃত্তি আছে যাকে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। সামাজিক নৈতিকতা তাকে কার্যক্ষম করতে পারবে না। বর্বরদের মধ্যে এই ঘটনা ঘটে। সামাজিক অনুশাসন ঘোষণা করে যে, শৈশবকালে মায়ের স্বামী দেখাশোনা করবে ও সুরক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। কিন্তু এই অনুশাসনকে সুপ্রযুক্ত করা সহজসাধ্য হলেও অসাধ্য। এর মধ্যে সহজাতবোধের অভাব আছে।
মেলানেশিয়ানদের মধ্যে পিতারা যে সহজাতবোধ দ্বারা সন্তানদের প্রতিপালিত করে সে সম্পর্কে ম্যালিনসকির নিজস্ব মন্তব্য আছে। আমি মনে করি, এই ধারণা তার বইয়ের পাতাতে আবদ্ধ নেই। এ হলো আরো সাধারণ। আমার বিশ্বাস, নারী ও পুরুষের মনে পালিত শিশুর প্রতি স্নেহ থাকবেই। এমন কি যদি নিয়মনীতি অথবা অর্থকে শিশু সংরক্ষণের সর্বপ্রথম ঘটনা বলে অভিহিত করা হয় তাহলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাবে ঐ মূল্যবোধ থেকে স্নেহের জন্ম হয়েছে।
যখন শিশুটি হয় প্রেয়সি রমণিয় শিশু, তখন সন্দেহ নেই, এই বোধের অনুভূতি হয় অনেক তীব্র। সেই কারণে বর্বর জাতির পুরুষরা স্ত্রীদের সন্তানদের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা পোষণ করে। সুসভ্য পুরুষ সন্তানদের যে স্নেহ দেয় তার মধ্যে এই বিষয়টি ক্রিয়াশীল। ম্যালিনসকি ঘোষণা করেছেন, আমার মনে হয় তার সিদ্ধান্তকে সন্দেহের সামনে দাঁড় করাতে পারে এমন মতবাদ অপর্যাপ্ত, যে সমস্ত মানব জাতি ট্রোবিয়েড দ্বীপপুঞ্জবাসীর মতো অবস্থা পার করেছে। যদিও এমন একদিন ছিল যখন কোথাও না কোথাও পিতৃত্ব ছিল স্বীকৃত। পশুদের পরিবারে পিতার স্থান আছে, তারাও হয়ত এই ভিত্তি থেকে উদ্ভূত। শুধু যে মানবসত্তার মধ্যে কৃতিত্বের অনুভূতি আছে তাই নয়–পিতৃত্ব সংক্রান্ত আবেগ অনুভূতির জন্ম হয়েছে আমাদের সুপরিচিত অবস্থা থেকে।