১৯. মানবিক মূল্যবোধে যৌনতার অবস্থান
যে লেখক যৌন বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা করে তার মনের মধ্যে সর্বদা এই ভয় থাকে যে, সে তার লেখনি দ্বারা এবং সমালোচক দ্বারা সমালোচিত হবে। তারা মনে করে এই বিষয়টিকে সর্বসাধারণে মধ্যে প্রকাশ করা উচিত নয়। এমনকি তথাকথিত তার্কিক বুদ্ধিজীবীরাও তার এই প্রয়াসকে কালিমালিপ্ত করতে পারে এই অভিমত পোষন করে যে, তার লেখনি দ্বারা সমাজের বৃহৎ অংশের কোনো উপকার সাধিত হবে না। একমাত্র যারা প্রাচীনপন্থি নৈতিকতার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে আগ্রহী তারাই কেলমাত্র এই লেখককে সাধুবাদ জানাবে।
আমরা সেইসব মানুষকে যৌনবিষাদের পথিক হিসেবে মনে করতে পারি যারা কোনো চঞ্চলা বারবধূর ভ্রুকুটিতে উত্তেজিত হয়, এই আদিম ব্যবসাকে আইনের আশ্রয়ে আনতে চায়, অবাধ ও সুন্দর বহিবৈবাহিক সম্পর্কে জয়গান করে, মিনিস্কার্ট পরা এবং রঞ্জনীতে লালিমাদীপ্ত ওষ্ঠের অধিকারিণী রমণিদের অনুরাগী হয়, আর সমুদ্রের সৈকতে বিশ্রামরতা রৌদ্রস্নাতা অসংযমী নারীদের সংক্ষিপ্ত স্নান-পোশাকের অন্তরালে জেগে থাকা ত্রিভঙ্গ শরীরের সুষমা দর্শনে মেলে ধরে তাদের গোয়েন্দা চোখ। এইভাবে তারা যৌন স্বাধীনতার স্বপক্ষে যুক্তি আনয়নকারী লেখকদের চেয়ে আরও বেশি মাত্রায় কষ্টভোগ করে। নির্মম নৈতিকতা হলো কামুক প্রক্ষোভের বিপরীতধর্মী উপাখ্যান এবং যে মানুষ নিজেকে এর মধ্যে সমর্পিত করে সাধারণত তার মন কুচিন্তায় ভরপুর হয়। এই চিন্তার অন্তরাল শুধু যে যৌনতার প্রচ্ছন্ন মহিমা থাকে তা নয় কিন্তু নৈতিকতার কুয়াশায় আবৃত বলে সেই মানুষ জীবন ও যৌনতা সম্পর্কে কোনো স্বচ্ছ, সুন্দর, সার্বিক মনোভঙ্গির পরিচয় দিতে পারে না। এ বিষয়ে চার্চের সঙ্গে আমার কোনো দ্বিমত নেই যে, যৌন বিষয়ের তাড়না পাপের উদ্রেক করে। কিন্তু আমি চার্চের সঙ্গে একমত হয়ে বলতে পারি না যে, একে উপক্ষো করার মধ্যেই সার্থকতার বীজ নিহিত আছে। একথা সহজেই বলা যেতে পারে যৌনতা সম্পর্কে সেইন্ট এনটনীর মধ্যেও এক ধরনের বিষাদময়তা কাজ করতো। এ সম্পর্কে আমি আরও সমকালীন উদাহরণ দিতে পারি। কিন্তু ভদ্রতাবোধে তা থেকে বিরত থাকলাম।
ক্ষুধা ও তৃষ্ণা মতো যৌনতাও মানবজীবনের এক প্রাকৃতিক চাহিদা। যদি আমরা খাদ্য-পানীয় গ্রহণে উন্মুখ নিন্দা না করি তাহলে কেন যৌনজীবনের অভিলাসী মানুষের অকারণে নিন্দা করবো? সুজনশিল্প আমাদের এই শিক্ষা দিচ্ছে যে, মানুষ তার বেঁচে থাকার স্বাভাবিক উপাদানগুলিকে লালন করবে। আবার নীতিবাগীশরা যৌন অনুভুতি থেকে মানুষকে বিমুক্ত রাখার অপচেষ্টায় স্ব-আরোপিত মতবাদের প্রবর্তন করেছে। সতের শতকের এক নীতিবাগীশ সমালোচনা এই মন্তব্য করেছেন
Would you enjoy gay nights and pleasant dinners?
Then must you board with saints and bed with sinners.
এর থেকে মনে করা যেতে পারে যে, অতি ভক্ষণকে নীতিবাগীশরা নরকের পথ হিসেবে ধরে নিয়েছিল। ক্যাথলিক চার্চের ধারণা অনুসারে অতি-ভক্ষণ হলো সেই সাতটি ভয়ঙ্কর পাপের একটি যা দান্তে বর্ণিত নরকের অন্ধকারের অভিসারী। কিন্তু যার থেকে স্বাস্থ্যের উদ্দীপনা হতে পারে তার সবকিছুই কি আমরা গ্রহন করতে পারি না? তাহলে কেন ঔদারিকদের এভাবে অভিযুক্ত করা হবে?
খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে দেখা যায় মানুষ এবার তার আহার গ্রহণের পর পরবর্তী আহারের মধ্যে অন্যান্য বিষয়ের চিন্তা করে। কিন্তু যারা নান্দনিক দর্শনকে জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে, ন্যূনতম খাদ্যগ্রহণ ছাড়া জীবনের আর কোনো চাহিদাকে মেটায় নি, তারাও মাঝে মধ্যে লোভনীয় নৈশকালীন আহার এবং দৈত্যকর্তৃক প্রদর্শিত, রসালো ফলের আকাঙ্ক্ষায় বিসাদগ্রস্ত হয়। এবং যে সমস্ত অভিযাত্রীরা সুমেরু অঞ্চলে অভিযান করে তারাও তিমি মাছের লিভার খেতে খেতে সেই স্বপ্নে বিভোর হয় কখন তারা স্বদেশে ফিরে সুস্বাদু খাবারের স্বাদ পাবে।
এর থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, যৌনতাকে একটি অবদমিত ইচ্ছা হিসেবে চিহ্নিত না করা হয় থাহলে একে খাদ্যের মতোই জীবনধারণের সহযোগী হিসেবে চিন্তা করা উচিত। যে খাদ্য আমরা সাধারণভাবে ভক্ষণ করে থাকি, যা থেবিড় অরণ্যের সন্ন্যাসীদের খাদ্য নয়। খাদ্য ও পানীয়ের মতো যৌনতা এক স্বাভাবিক মানবিক চাহিদা। যদি এর অবর্তমানে মানুষ বাঁচতে পারে কিন্তু খাদ্য বা পানীয়ের বেলায় এমন কথা প্রযোজ্য নয়। কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গীতে বিচার করলে এই সত্যকে স্বীকার করতে হবে যে, খাদ্য ও পানীয়ের আকাক্ষার মতো যৌনতাও একটি স্বাভাবিক চাহিদা, যা অপ্রযুক্তিতে অসম্ভব বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় এবং প্রশ্ন মনে সাময়িকভাবে হ্রাস প্রাপ্ত হয়ে থাকে। যখন এর চাহিদা প্রবল হয় তখন রুদ্ধ হয় চেতনার সবকটি বাতায়ন। সমগ্র ব্যক্তিসত্তা কেন্দ্রিভূত হয় মুহূর্তের উত্তেজনার সফল রূপায়ণে। তখন আমরা এমন সব প্রবৃত্তি দ্বারা তাড়িত হই যা পরবর্তীকালে পরিচায়ক হিসেবে মনে হতে পারে। খাদ্য ও পানীয়ের মতো নিষেধাজ্ঞা এই ইচ্ছাকে শতগুণে বাড়িয়ে দেয়। আমি এমন অনেক শিশুর কথা জানি যারা প্রাতঃরাশের টেবিলে আপেল খেতে চায় না কিন্তু বাগান থেকে চুরি করা আপেল খেতে আগ্রহী। যদিও প্রাতঃরাশের আপেলগুলি চুরি করা আপেলের তুলনায় অনেক বেশি রসালো ও সুস্বাদু।
কুড়ি বছর আগে একজন আমেরিকান মাদকদ্রব্যের প্রতি যত মাত্রায় আসক্ত ছিল এখন সেই আসক্তির পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। একইভাবে খ্রিস্টীয় শিক্ষণ ও প্রশাসন যৌনবিষয়ক কৌতূহলের পরিধিকে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমান প্রজন্ম ধীরে ধীরে প্রথাগত দিকগুলিকে অস্বীকার করে এমন এক যৌন স্বাধীন সম্পর্কের অনুসন্ধানী হচ্ছে যা তাদের পূর্বপুরুষদের মনোভঙ্গি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। অবশ্য এই পৃথকীকরণের ধনাত্মক ও ধনাত্মক দুটি দিকই আছে। স্বাধীনতাই একমাত্র যৌন আচ্ছন্নতার বিরুদ্ধে ক্রিয়াশীল হতে পারে। এই স্বাধীনতাকে প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গীভূত করতে হবে এবং যৌন সম্পর্কিত বিশেষ সুষ্ঠ মনোভাবের পরিচয় রাখতে হবে।
আমি আবার তাদের সঙ্গে একথা বলতে চাই যে, নিষেধাজ্ঞার পরিমাণ যত বাড়বে ততই যৌন-যন্ত্রণার সীমানা বেড়ে যাবে। বিশেষ করে আমেরিকার ক্ষেত্রে এই উক্তির সারবত্তা প্রমাণিত হয়েছে। কঠিন নীতিবাগীশরা মিথ্যা চিন্তা ধারার প্রতি তাৎক্ষণিক আত্মনিবেদনের মাধ্যমে এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে। ঔদরিক, স্বেচাছাচারী এমন ব্যক্তি যারা স্ব-সৃষ্ট পৃথিবীর মধ্যে থাকতে ভালোবাসে এবং সম্পৃক্তি অথবা বিমোচনের মাধ্যমে নিজেদের চেতনাকে বিশ্লিষ্ট করে। যে মানুষ মননে ও শরীরে সুখি সে কখনই তার চিন্তা ধারাকে তার নিজের মধ্যে আবৃত্ত রাখবে না, পক্ষান্তরে সে পৃথিবীব্যাপী অম্বেষণার মাধ্যমে খুঁজে নেবে তার কাঙ্ক্ষিত কৌতূহলের উৎসকে। নিমজ্জন হলো সুখি মানুষের সাধারণ শর্ত যার মধ্যে প্রাকৃতিক প্রক্ষোভের অনুসরণ ধ্বনিত হতে পারে। খামখেয়ালীপূর্ণ মানুষের কাছে যৌন পরিতৃপ্তি হলো এমন একটি তাড়না যা দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত মানুষের সামনে খাদ্যের সম্ভার দ্বারা উদ্ভূত। সুখিসমৃদ্ধ মানব মানবীর অন্তরাল স্বাভাবিক প্রক্ষোভে ক্রিয়াশীলতা বজায় থাকে না, এর অন্তরাল কাজ করে সুখি জীবনের পক্ষে অপরিহার্য চেতনাসমূহের সুচারু বিকাশ।
আমি একথা বলতে চাইছি না যে, যৌনবিষয়ে নৈতিকতা অথবা নিষেধাজ্ঞা একেবারে থাকবে না কিন্তু খাদ্যের ক্ষেত্রে যেমন তিনটি নিষেধাজ্ঞা আছে, যৌনতার ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটি থাকা উচিত। এই তিনটি হলো- আইন দ্বারা, প্রথা দ্বারা এবং স্বাস্থ্যের জন্যে। খাদ্য চুরি করাকে আমরা অন্যায় বলে মনে করি, পঙক্তিভোজনে অতিরিক্ত খাওয়াকে বিসাদৃশ বলে মনে করা হয়, এবং যে আহার আমাদের অসুস্থ করে তোলে তাকে বর্জন করা হয়ে থাকে। যৌনতার ক্ষেত্রেও একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা বজায় থাকা প্রয়োজন যদিও তা হবে অনেক বেশ জটিল এবং তাতে আরও অধিকতর মাত্রায় আরোপ করতে হবে স্ব-প্রশমনের উপায়। যেহেতু একজন মানুষ অন্যায়ভাকে অন্যের জিনিসে ভাগ বসাতে পারে না, তাই চুরি করে খাদ্য গ্রহণ করাকে নিন্দিত করা হয়েছে। একইভাবে ধর্ষণকে আইন দ্বারা নিষিদ্ধ করতে হবে। স্বাস্থ্যের আলোচনায় যৌন-রোগের সম্ভাবনার কথা মাথায় রাখা প্রয়োজন। ইতি পূর্বে আমরা বীরাঙ্গনা শীর্ষক অধ্যায়ে আলোচনা করেছি, পেশাদারী গণিকাবৃত্তির হ্রাসকরণ উপযুক্ত ঔষুধের ব্যবহার দ্বারাই এর প্রতিকার করা সম্ভব। তরুণ-তরুণীদের মধ্যে গড়ে উঠা যৌন স্বাধীনতার ব্যাপক প্রসারতার মাধ্যমেই পেশাদারী বেশ্যাবৃত্তির অবশেষ হতে পারে।
সুসংযত যৌন-তত্ত্ব যৌনতাকে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক ক্ষুধা কিংবা বিপদের সম্ভাব্য উৎস হিসেবে মনে করে না। এই দুটি দিক ছাড়াও যৌনতার সঙ্গে সংযুক্ত আছে মানব জীবনের কয়েকটি পরমকাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য। এর মধ্যে প্রধান হলো–কাব্যিক ভালোবাসাতে বিবাহোত্তর সুখিজীবন এবং শিল্প কলা। কাব্যিক ভালোবাসা এবং বিবাহ সম্পর্কে আমরা আগেই আলোচনা করেছি। অনেকে মনে করেন শিল্প হলো যৌনতার সঙ্গে সম্পর্কহীন। কিন্তু বর্তমানে এই মতবাদে বিশ্বাসীদের সংখ্যা ক্রমশই কমে আসছে। একথা মানতেই হবে যে, যেকোনো নান্দনিক সৃষ্টি মনস্তাত্ত্বিকভাবে সংযুক্ত আছে ভালোবাসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ কিংবা অপ্রত্যক্ষভাবে। যখন যৌন প্রক্ষোভ থেকে শৈল্পিক ব্যঞ্জনার সূচনা হয় তখন তার মধ্যে নিহিত থাকে কয়েকটি সম্ভাবনা। শৈল্পিক প্রতিভার বিকাশ দ্বারা এটি সম্ভব নয়। কিন্তু প্রতিভা সকলের মধ্যে সমভাবে বিরাজমান থাকে না, তাই একথা মনে করা যেতে পারে যে, স্বীয় প্রতিভার পরিপন্থি পারিপার্শিকতাই এক্ষেত্রে শৈল্পিক চেতনার বিবর্তনে অধিকতর শক্তিশালী ভূমিকা নিয়েছে। এর সঙ্গে কিছু পরিমাণ স্বাধীনতা থাকা প্রয়োজন। অথচ এই স্বাধীনতা শিল্পীকে পুরস্কৃত করার সোপান হবে না। এই স্বাধীনতা তাকে কোনো একটি নির্দিষ্ট শিল্পকর্মে আবৃত থাকতে নিয়োজিত করবে না। যখন জুলীয়াস টু মাইকেল এঞ্জেলকে কারারুদ্ধ করেছিলেন তখন তিনি ঐ শিল্পীর স্বাধীনতা হরণ করেন নি, যেহেতু তিনি ঐ শিল্পীকে এক বিশিষ্ট ব্যক্তিরূপে চিহ্নিত করেছিল। তাই তিনি চাইতেন না যে, কোনো সাধারণ মানুষ ঐ শিল্পীর প্রতি সামান্যতম অপরাধ করুক। যখন এক শিল্পী কোনো ধনী পৃষ্ঠপোষকের অথবা নাগরিক শুভানুধ্যায়ী দ্বারা পরিচালিত হয়ে তাদের মনোজ্ঞ নন্দন শিল্পে প্রবৃত্ত হয় তখন তার শৈল্পিক স্বাধীনতার মৃত্যু ঘটে। আবার যখন সে বিবাহ দ্বারা আহৃত সামাজিক ও অর্থনৈতিক মৃত্যু ঘটে যায়। যে সমস্ত সমাজ ঐতিহ্য অনুসারে পুণ্য সঞ্চারে আগ্রহী সেখানে মহৎ শিল্পকর্মের মৃত্যু ঘটে থাকে।
বর্তমান যুগে আমেরিকা তার শৈল্পিক চাহিদা মেটাতে ইউরোপ থেকে আমদানি করতে বাধ্য হচ্ছে যেখানে এখনো পর্যন্ত স্বাধীনতা বিদ্যমান। কিন্তু ইউরোপের আমেরিকীকরণের ফলে অদুর ভবিষ্যতে নিগ্রোদের থেকে শিল্পীর জন্ম হবে। শিল্পের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল হবে আপার কঙ্গো অথবা তিব্বতের উত্তরাঞ্চল। কিন্তু এর সর্বশেষ পরিণতির আর বেশি দেরি নেই। আমেরিকা যেভাবে বিদেশি শিল্পীদের অর্থ দ্বারা পুরস্কৃত করছে তাতে তাদের সৃজনশীলতা ক্রমে ক্রমে শূণ্য বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
আগে আমরা মনে করতাম যে, শিল্পের উৎস হলো জীবনের আনন্দ। এবং জীবনের আনন্দ অনেকখানি নির্ভর করে স্বতঃস্ফূর্ত যৌন অভিজ্ঞতার ওপর। যেখানে যৌনতাকে অবদমিত করা হয় সেখানে সৃজনশীল কোনো শিল্প সৃষ্টি হতে পারে না, যা হয় তাকে আমরা শ্রমিকের কাজ বলতে পারি। আমেরিকাতে প্রতি দিনে-রাতে ঘটে যাওয়া যৌনতার ঘটনা পৃথিবীর যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। নীতিবাগীশ শিক্ষাগুরুদের মতবাদের আর একটি ত্রুটিপূর্ণ অভীক্ষা হলো, তারা যৌন ঘটনার মধ্যে যৌনতার পরিমাণকে কম করতে চায় কিন্তু কোনো সুসভ্য মানুষ অথবা বন্য মানুষ শুধুমাত্র যৌনক্ষুধার নিবৃত্তি চায় না। যে চেতনা তাকে যৌন আকাঙ্ক্ষা তৃপ্তির পথে চালিত করে তা শুধু যৌনতা নয়, তার মধ্যে আছে ভালোবাসা, প্রণয় ও পারস্পরিক নৈকট্যবোধ। এগুলি ব্যতিরেকে দৈহিক ক্ষুধার জাগরণ হলে মানবিক আকুতিগুলি নির্বাসিত হয়ে যায় এবং পরিতৃপ্তি লাভ করা সম্ভব হয় না। একজন শিল্পী যে যৌন-স্বাধীনতা আকাঙ্ক্ষা করে তা হলো ভালোবাসার স্বাধীনতা, এমন নয় যে, সে কোনো অপরিচিতা রমণিকে সম্ভোগ করার যেনতেন সুযোগ পাবে, আর ভালোবাসার স্বাধীনতা প্রতি সকলের সমান অধিকার থাকা প্রয়োজন। আশাকরি আমার নীতিনিষ্ঠা বন্ধুরা এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করবেন না।
যদি সারা পৃথিবীব্যাপী আমেরিকীকরণের পরেও শিল্পকে বেঁচে থাকতে হয় তাহলে আমেরিকার নীতিবাগিশদের আর একটু কম ন্যায়নিষ্ঠ হতে হবে আর অনৈতিক বাদীদের আরও কম উদ্ধত। উভয় গোষ্ঠীকে এই মতবাদে বিশ্বাসী হতে হবে যে, যৌনতার মধ্যে উচ্চতর মূল্যবোধে লুকিয়ে আছে এবং আমাদের অভিব্যক্তি ব্যাস্ক-অ্যাকাউন্টের চেয়ে কম কাম্য নয়। একজন পর্যটকের কাছে আমেরিকার সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হরো আনন্দের অপ্রাচুর্য। এখানে আনন্দ নিহিত আছে ক্ষুব্ধ হৃদয়ের অন্তরালে, এর থেকে স্বতোৎসারিত হচ্ছে আবেগসঙ্কুল স্মৃতি, কিন্তু এই আবেগ কোনো চিরস্থায়ী সম্পদের জন্ম দিতে পারছে না।
যে সমস্ত মানুষের পিতামহরা বাল্যকালের সুর-মূর্ঘনাতে ক্ষুব্ধ হতেন তারাই এখন তাদের জীবন ও যৌবনের উজ্জ্বল মুহূর্তগুলিকে নিয়ন্ত্রিত করছে যন্ত্রলেখন ও দুরভাষের ক্লান্তিকর ব্যবহার। সন্ধ্যায় পানশালার অন্ধকার আরো চিৎকারের মধ্যে তারা নতুন করে অর্থ উপার্জনের উপায় খুঁজতে ব্যস্ত থেকে সুখরূপী দৈত্যের কাছে নিজেদের হৃদয় ও আত্মাকে উৎসর্গ করেই চলেছে। তাদের স্বপ্নখিত চেতনার মধ্যে এই আর্থিক আকাক্ষার নীরব পদচারণা ধ্বনিত হচ্ছে যারা তাদের আত্মাকে বিক্রি করেছে ক্রীতদাসের কাছে।
এমন কথা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, জীবনের যা কিছু শ্ৰেয় তার সঙ্গে যৌনতার সম্পর্কে আছে। এমনকি এই অনুভুতির সঙ্গে তাত্ত্বিক অথবা ব্যবহারিক বিজ্ঞানের ফলপ্রসু যোগাযোগ নেই, নেই কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক সাযুজ্যের ইতিহাস। আমার কাছে যে তিনটি প্রাথমিক আবেগ উল্লেখযোগ্য, তা হলো– ক্ষমতা, যৌনতা ও সন্তান উৎপাদন–এই তিনটি সত্তার উদগৈরণে প্রাপ্তবয়স্ক মানসিকতা তার ঐচ্ছিক অভিব্যক্তিকে জটিল প্রক্ষোভের দ্বারা উদ্বুদ্ধ করে। এমনকি স্ব-নিয়ন্ত্রণ ছাড়া মানব জীবনের অন্যান্য ইচ্ছার সঙ্গে এই তিনটি বোধ প্রচ্ছন্ন আছে। এই তিনটি মধ্যে ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা সবচেয়ে আগে উৎসারিত হয় এবং সর্বশেষ অন্তর্হিত হয়। যেহেতু একজন শিশুর ক্ষমতা খুবই কম, তাই আরো অধিক আগ্রাসন দ্বারা একে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত করার চেষ্টা করা হয়। বস্তুতপক্ষে তার সমগ্র কামের অধিকাংশই এর প্রভাবে আচ্ছাদিত। তার আর একটি প্রভাবশালী চেতনা হলো অহংকার–যা জন্ম দেয় প্রশংসিত হবার দুর্বল আকাঙ্ক্ষাকে এবং ভয় দেখায় নিন্দিত অথবা পরিত্যাজ্য হওয়াকে। এই অহংকারই তাকে সামাজিক জীব হিসেবে গড়ে তোলে এক গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনযাপনের উপযোগী করে যদিও তত্ত্বগতভাবে এদের মধ্যে সাদৃশ্য অপরিলক্ষিত, তবু অহংকার বোধের সঙ্গে যৌনতার প্রত্যক্ষ সংযোগ আছে। কিন্তু ক্ষমতার সঙ্গে যৌনতার সম্পর্কে অত্যন্ত ক্ষীণ। ক্ষমতার প্রতি আকর্ষণ ও অহংকারের প্রতি আকাক্ষা–এই দুটি বোধ থেকে একটি শিশু শারীরিক ও মানসিকভাবে পরিপূর্ণ হয়ে উঠার চেষ্টা করে। উৎসুক্য ও জ্ঞান অন্বেষণাকে ক্ষমতা লিপ্সার শাখা বলা যেতে পারে। এই কারণে জীববিদ্যা ও প্রাণীবিজ্ঞানের গঠন ব্যতিরেকে বিজ্ঞানকে যৌনতার অনুভূতির সঙ্গে সম্পর্কহীন হিসেবে গণ্য করা উচিত। যেহেতু মহামান্য সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডরিক এখন আর জীবিত নন, তাই এই চিন্তাধারাকে অসংবদ্ধ মনে হতে পারে। তিনি যদি আজ জীবিত থাকতেন তাহলে এক বিখ্যাত অঙ্কবিশারদ ও এক বিশিষ্ট গীতিকারের অঙ্গচ্ছেদের মাধ্যম তাদের আরম্ভ কাজের ওপরে ঐ ঘটনার প্রভাব বিশ্লেষণ করতে চাইতেন। এখানে প্রথম ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রভাব হতো পূর্ণ ও দ্বিতীয়র ক্ষেত্রে সামান্য। যেহেতু মানব ধর্মের অন্যতম চেতনার উদ্রেক হলো জ্ঞানের অম্বেষণা তাই মানব জীবনের বৃহৎ অংশের প্রক্ষোভের সঙ্গে যৌনতার কোনো সম্পর্ক নেই।
ক্ষমতাকে যদি আমরা তার বৃহত্তম অর্থে ব্যবহার করি তাহলে দেখতে পাবো যে, এটি হলো অধিকাংশ রাজনৈতিক কার্যধারার প্রধান উৎস। এর দ্বারা আমি একথা বোঝাতে চাইছি না যে, এখন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদের মনে দেশের সার্বিক উন্নয়নের কোনো চিন্তা নিহিত থাকে না। এর দ্বারা আমি এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছি যে, একজন রাজনীতিবিদ হলেন এমন এক ব্যক্তি যার চেতনার মধ্যে বিক্ষুব্ধ পিতৃত্বের চিহ্ন রয়ে গেছে। কিন্তু তার মধ্যে ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা না থাকলে তিনি কখনোই। রাজনৈতিকভাবে সফল হবার ভ্রমসঙ্কুল পথের পথিক হতে পারবেন না। আমি এমন অনেক রাজনৈতিক নেতাকে চিনি যারা দেশ শাসনের অভীপ্সার সঙ্গে ব্যক্তিগত উচ্চাশার পরিতৃপ্তিকে নিখুঁত সাযুজ্যে জারিত করে সফলতার শিখরে উঠে গেছেন।
একবার এক বিশিষ্ট আমেরিকার রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কন তার সিনেটরদের সামনে ভাষণ দিতে গিয়ে এই মন্তব্য করেছিলেন–আমি হলাম ইউনাটেড স্টেটসের প্রেসিডেন্ট, এক অনন্ত ক্ষমতার অধিকারী। এই ঘোষণার মাধ্যমে তিনি স্বীয় ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ জনিত আনন্দ লাভ করেন। সুপ্রযুক্ত বা কুপ্রযুক্ত রাজনীতির ক্ষেত্রে যে দুটি চেতনা সর্বাংশে ক্রিয়াশীল থাকে তার একটি হলো অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য এবং অন্যটি ক্ষমতার ইচ্ছা। এর মধ্যে ফ্রয়েডীয় মনোভাবের কোনো প্রতিফলন নেই।
তাহলে এ কথা স্বীকার করতে বাধা নেই যে, শিল্পীদের বাদ দিলে পৃথিবীর অন্যান্য ব্যক্তিরা তাদের গুরুত্বপূর্ণ কার্যপ্রণালীর মধ্যে যৌনতার প্রতিচ্ছায়া দেখতে পান না। এর থেকে এই সত্য প্রতিভাত হয় যে, একজন মানুষের আবেগ তাড়িত ঐচ্ছিক অনুভূতির উপস্থাপনাতে যৌনতার অপচ্ছায়া যেন দিগন্ত বিস্তৃত না হয়। পৃথিবীকে জানার ইচ্ছা এবং সেই পৃথিবীকে পরিবর্তন করার আকাঙ্ক্ষা–এ দুটি হলো মানবসভ্যতার অন্যতম দুটি চালিকাশক্তি, যাদের অবর্তমানে সভ্যতার ক্রমোন্নতি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এমনকি সার্বিক সুখের মধ্যেও এই আকাক্ষা সতত ক্রিয়াশীল থাকে।
যখন কোবডেন জন ব্রাইটকে মুক্ত বাণিজ্যের প্রতিভূরূপে চিহ্নিত করতে চাইলেন তখন তিনি ব্রাইটের স্ত্রী-বিয়োগ জনিত ব্যথার ওপরে জোর দিয়েছিলেন এই চিন্তা করে যে, ব্রাইট যেন অন্যদের দুঃখ-দুর্দশাকে সম্যকভাবে উপলব্ধি অর্থাৎ নিজস্ব দু:খানুভূতি না থাকলে একজন মানুষ অন্যের দুঃখকষ্ঠগুলিকে সাম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পারবে না। তাই চিরন্তন দু:খের মধ্যেই অন্তর্নিহিত আছে অশেষ সুখের অন্বেষণা। যথেষ্ট শক্তিশালী মানুষের কাছে দু:খ হলো এক সৃষ্টিশীল অনুপ্রেরণা। যদি আমরা সর্বাংশে সুখি হতাম তাহলে আমাদের জীবনকে আরও সুখি করার স্বপ্নে বিভোর থাকতাম। কিন্তু সফল ফলশ্রুতি আছে বলে দু:খগুলো বিলাসের অঙ্গীকার গ্রাহ্য হতে পারে না। কেননা শতকরা নিরানব্বইটি ক্ষেত্রে এই যন্ত্রণার ফল সুদূর প্রসারী; যার থেকে আরো হতাশা উদ্রেক হয়। শতকরা একটিমাত্র ক্ষেত্রে এই অনুভূতি থেকে অব্যক্ত আনন্দের জন্ম হয়। তাই দু:খ-বেদনাকে দীর্ঘায়িত করার কোনো সফল যুক্তি নেই।