০৬. নারীজাতির স্বাধীনতা
যৌননৈতিকতা সম্পর্কে ঐতিহ্যশালী শর্তাবলি বর্তমান যুগে যে অবস্থায় রূপান্তরিত হয়েছে তার অন্তরালে আছে দুটি কারণ। প্রথমটি হলো গর্ভবিরোধী ঔষধের আবিস্কার এবং দ্বিতীয়টি হলো নারীসত্তার জাগরণ। প্রথমোক্ত কারণটি সম্পর্কে আমি পরে আলোচনা করব, এই অধ্যায়ে শেষাক্ত কারণটি বিশ্লেষিত হবে।
গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম অঙ্গ হিসেবে নারীজাতির নবমূল্যায়ণ শুরু হলো। এটির সূচনা হয় ফরাসি বিপ্লবে। আগেই বলেছি, ঐ বিপ্লব উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইনকে পরিবর্তিত করে কন্যাদের প্রতি গ্রহণযোগ্য করে তোলে।
মেরি উলসস্টোনক্রাফটের Vindication of the Rights of Women (1792) হলো এই ভাবধারার প্রতিফলক। যার উৎস ফরাসি বিপ্লব। তার সময় থেকে আজ অবধি ক্রমবর্ধমানভাবে যে মতবাদটি প্রকাশিত হয়েছে তা হলো পুরুষদের সমান অধিকার অর্জনের জন্য নারীজাতির প্রয়াস। জন স্টুয়ার্ট মিলের নারীজাতির পরাধীনতা কে তথ্যসমৃদ্ধ যুক্তিনির্ভর গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এই গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে তাঁর সময়কার মানুষদের সুপ্রযুক্ত চিন্তা। আমার পিতা-মাতা তাঁর চিন্তাধারাকে মেনে চলতেন এবং ষাটের দশকের প্রথম দিকে আমার মা নারীজাতির যোগদানের অধিকারের স্বপক্ষে বক্তৃতা দিতেন। তাঁর স্ত্রীচেতনা এত বেশি ছিল যে, তিনি প্রথম মহিলা চিকিৎসক ডাক্তার গ্যারেট অ্যান্ডারসন কর্তৃক আমাকে এই পৃথিবীতে আনয়ন করেন। সেই সময়ে গ্যারেটকে স্বীকৃত চিকিৎসক হিসেবে মানা হতো না। তিনি ছিলেন সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত ধাত্রী মাত্র।
সে যুগের নারী মুক্তির আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল অভিজাত ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে। তার ফলে তার মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ রাজনৈতিক শক্তি ছিল না। প্রতি বছর পার্লামেন্টে নারীজাতির অধিকার সংক্রান্ত বিলটি উত্থাপিত হত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেটি উত্থাপন করতেন মিস্টার ফেইথফুল বেগ, এবং সেটিকে সমর্থন করতেন মিস্টার স্ট্রেজ ওয়র পিগ। কিন্তু আইনে পরিণত হবার কোনো সম্ভাবনা তার মধ্যে ছিল না। যে যুগের মধ্যে তৃতীয় নারী মুক্তির আন্দোলনকারীরা নিজস্ব সীমানার মধ্যে একটি বিরাট সফলতা অর্জন করেন। ১৮৮২ সালে বিবাহিতা মহিলাদের সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনটি গৃহিত হয়। এই আইনটি গৃহীত হবার আগে নিয়ম ছিল যে, বিবাহিতা মহিলা যে পরিমাণ সম্পত্তি লাভ করবে তা তার স্বামীর সার্বভৌম কর্তৃত্বে থাকবে। যদিও দায়িত্ব থাকবে নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে। যাতে স্বামী সেই তহবিল খরচ করতে না পারেন।
রাজনৈতিক দৃষ্টিসম্পন্ন নারী মুক্তি আন্দোলনের পরবর্তী ইতিহাস হলো অতিমাত্রায় সাম্প্রতিক এবং বিপুল পরিমাণে জ্ঞাত, তাই স্মৃতি বিভ্রমের কারণ নেই। যদিও বলা যায় যে, বর্তমানকালে অধিকাংশ সুসভ্য দেশে রমণিরা যেভাবে তাদের রাজনৈতিক সমতা অর্জন করেছে তার সঙ্গে তুলনীয় কোনো ঘটনার উদাহরণ পাওয়া যাবে না। এ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিজনিত অধিক পরিবর্তনের কথা মনে রাখতে হবে। ক্রীতদাস প্রথা উচ্ছেদের সঙ্গে এর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে যদিও ইউরোপের দেশগুলিতে ক্রীতদাস প্রথা ছিল না। এর সঙ্গে নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত ঘনিষ্ঠ অন্তরঙ্গতার কথা ভেবে দেখতে হবে।
আমার মনে হয়, এই আকস্মিক পরিবর্তনের কারণ হলো দুটি: একদিকে গণতান্ত্রিক তথ্যের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে যা নারীদের দাবি সংক্রান্ত প্রশ্নের অধিক উত্তরদানে অসমর্থ হয়েছে। এবং অন্য দিকে বিপুল সংখ্যক রমণি গৃহের বাইরে জীবিকা অর্জনের জন্যে নিয়োজিত হয়েছে। এবং তারা দৈনন্দিন জীবনের আরামের জন্য পিতা অথবা স্বামীর করুণার ওপর আর নির্ভরশীল নয়।
এই অবস্থা চরমে উপনীত হয় যুদ্ধকালীন সময়ে। যখন পুরুষ কর্তৃক সমধিক কাজের দায়িত্ব পড়ল নারীদের ওপর। যুদ্ধের পূর্বে নারীদের ভোটাধিকারের বিরোধিতা করে বলা হত যে, ভোট প্রদানের অধিকার পেলে তারা গৃহবিমুখ হবে। কিন্তু যুদ্ধের সময় এই মনোভাবের মৃত্যু ঘটে। এবং যেহেতু নারীরা রক্তাক্ত হাতে অংশগ্রহণ করছে, সেই কারণে তাদের ভোটদানের অধিকার দেওয়ার আবেদন গৃহীত হলো।
আদর্শবাদী উদ্যোক্তাদের অভিমত ছিল যে, মহিলারা রাজনীতির মধ্যে নৈতিকতার প্রশ্ন তুলবে। এই ঘটনাটি হতাশা সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু আদর্শবাদীদের মৃত্যু চিহ্নিত ছিল তাদের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ধ্বংসকারী চেতনায়।
নারীজাতির অধিকারের প্রশ্নের সঙ্গে এমন কোনো সত্য সংযুক্ত ছিল না যার ফলে আমরা ভাবতে পারি যে, নৈতিকতার দিক থেকে অথবা অন্য যেকোনোভাবে তারা পুরুষ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। তারা সম্পূর্ণভাবে মানবসত্তা হিসেবে তাদের অধিকারকে অর্জন করতে চেয়েছিল অথবা গণতন্ত্রের স্বপক্ষে সাধারণ যুক্তি থেকে তাদের এই ধারণার উদ্ভব হয়। কিন্তু সর্বদা দেখা যায় যে, নির্যাতিত জাতি অথবা দেশ যখন তার অধিকার দাবি করে তখন কোনো না কোনো উপায়ে সেই দাবিকে অস্বীকার করার চেষ্টা করা হয়। মহিলাদের অধিকারের দাবিকে এই বলে দমিয়ে রাখা হলো যে, তাদের হৃদয়ে বিচিত্র নৈতিকতার অনুপ্রবেশ ঘটে এবং এই নৈতিকতা সামাজিক নিয়মনীতি সম্পর্কে বিচিত্র মনোভাবের সৃষ্টি করবে।
নারীজাতির রাজনৈতিক অধিকারের সঙ্গে আমাদের আলোচ্য বিষয়ের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। বিবাহ ও নৈতিকতার সঙ্গে বিবেচিত হবে সামাজিক অধিকারের গুরুত্বপূর্ন বিষয়টি। প্রাচীন যুগে এবং আধুনিক যুগের পূর্বে দেশের নারীজাতির পবিত্রতাকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হত। আত্মস্থ সংযমের জন্যে কোনো চেষ্টা করা হয়নি। কিন্তু পাপ কাজের সব রকম সুযোগ সুবিধে কেড়ে নেওয়া হলো। পশ্চিমা দেশে এই পদ্ধতিটি কখনও সম্পূর্ণভাবে প্রযুক্ত হয় নি কিন্তু সম্মানিয়া মহিলারা শিশুকাল থেকে এই শিক্ষা লাভ করত যে, বিবাহ ব্যতিত যৌন সঙ্গম হলে আতঙ্কঘন ঘটনা।
এই শিক্ষা পদ্ধতি ক্রমে ক্রমে ক্রুটিহীন হতে থাকে, সঙ্গে সঙ্গে বাইরের বাধানিষেধগুলি অপসারিত হয়ে যায়।
যারা বাইরের বাধা নিষেধগুলি অপসারিত করার জন্যে আত্মনিবেশ করে তারা চিন্তা করত যে, ভেতরের নিয়মনীতির প্রাচীরই যথেষ্ট শক্তিশালী। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, সে যুগে মনে করা হত যে, সামাজিক ব্যাপারে তরুণীর সহচরীর কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা সঠিক রূপে প্রতিপালিত সুন্দরি রমণি কখনই যুবক পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হবে না সুতরাং তাকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দেওয়া যেতে পারে। আমার যৌবনকালে আমি দেখেছি যে, উঁচু বংশের নারীরা মনে করত যৌন সহবাস অন্যায়; বিবাহের পরে তারা এটিকে কর্তব্যের অঙ্গ বলে ধরে নিত। এই মনোভাব থাকার ফলে জননীরা তাদের কন্যাদের যথেষ্ট স্বাধীনতা দিতেন। কেননা সেই বাস্তবযুগে এটা ছিল গ্রহণযোগ্য স্বেচ্ছাচারিতা।
আকাঙ্ক্ষিত ফল লব্ধ হয় নি, পরিণতি কিছুটা পরিবর্তন ডেকে আনে। এই রূপান্তরের প্রভাব সমানভাবে পড়েছিল বিবাহিতা স্ত্রী এবং অবিবাহিতা নারীদের ওপর। ভিক্টোরিয়ান যুগের মহিলারা এবং যুগের অধিকাংশ মহিলা বাস করে মানসিক রুদ্ধ কারায়। এই কারাগারের অস্তিত্ব তাদের চেতনায় অপরিহার্যরূপে ধরা পড়ে না। কেননা এটি গঠিত হয়েছে অবচেতন অনুভূতি থেকে। সংস্কার বোধের ধ্বংসের সাথে সাথে, যা ঘটিয়েছে এ যুগের তরুণ সমাজ, উথিত হতে থাকে সহজাত প্রবৃত্তির চেতনাময় অনুভূতি, যা দীর্ঘদিন সমাহিত ছিল সংস্কারের পর্বত গহবরে। যৌন নৈতিকতার ওপরে এই বিষয়টির বৈপ্লবিক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে, শুধুমাত্র একটি দেশ অথবা একটি জাতির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ না থেকে সেই প্রভাব প্রসারিত হয়েছে সর্বযুগের সর্বকালের সমস্ত সুসভ্য দেশে।
নারী-পুরুষের সম অধিকারের প্রশ্নটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচিত হয়নি, এর মধ্যে যৌন নৈতিকতার প্রশ্নটি জড়িত ছিল। মেরি উলসস্টোনক্রাফটের ধারণাকে আধুনিক বলা যায় কিন্তু এ বিষয়ে তাঁকে অনুসরণ করেননি পরবর্তীকালের নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রবক্তারা। বিপরীত পক্ষে তারা ছিলেন অতিমাত্রায় নৈতিকতাবাদী, তারা চেয়েছিলেন এ যাবত নারী কর্তৃক প্রতিপালিত নিয়মনীতিগুলিকে পুরুষের কাঁধে চাপিয়ে দিতে।
১৯১৪ সালের পর থেকে কিশোরী রমণিরা তথ্যগত জ্ঞান ছাড়াই নতুন পথে চলতে শুরু করে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, মহাযুদ্ধের আবেগপ্রবণ উত্তেজনা এই নতুন বিষয়টি সূচিত করেছে। কিন্তু এর প্রভাব পড়েছে দীর্ঘ সময় ধরে। পূর্বে পবিত্রতা সম্পর্কে নারীজাতির যে ধারণা ছিল তার সঙ্গে নরকের সন্তান এবং গর্ভবতি হবার আশঙ্কা ছিল ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। প্রথমটিকে অপসারিত করলো কুসংস্কারজনিত গোড়ামীর মৃত্যু এবং দ্বিতীয়টিকে বিনষ্ট করল গর্ভনিরোধক ঔষধপত্র।
কিছুদিন ধরে ঐতিহ্য সম্পন্ন নৈতিকতাবাদ বজায় রাইল নিয়মনীতি ও মানসিক জাড্যতার মধ্যে। কিন্তু যুদ্ধের শিহরণ সমস্ত প্রাচীরকে ধূলিসাৎ করে দেয়। ত্রিশ বছর আগের নারীমুক্তি আন্দোলনকারীদের মতো বর্তমান কালের নারীবাদীরা পুরুষদের পাপ হ্রাস করার সম্পর্কে উদ্বিগ্ন নয়। তারা দাবি করে পুরুষ যা করবে তাদেরকে ও সেই কাজে অংশগ্রহণ করার অধিকার দেওয়া হোক। তাদের পূর্বপুরুষেরা নৈতিক ক্রীতদাস প্রথায় সমতা চেয়েছিল যেখানে তারা দায়ী নৈতিক স্বাধীনতায় সমতা আনায়।
এই আন্দোলনটি এখনো প্রাথমিক পর্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে এবং এটি যে কিভাবে গঠিত হবে সে সম্পর্কে কিছু বলা যায় না। এই মতবাদের প্রবক্তারা এবং প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারীরা বয়সে বেশ তরুণ। সমাজ স্বীকৃত মানুষদের কাছে তাদের বক্তব্য বিষয় এখনো যথেষ্ট গুরুত্ব লাভ করে নি। পুলিশ, আইন, চার্চ এবং তাদের পিতামাতারা বিরোধিতা করছে, যখনই তাদের কাছে অধিকার অর্জনের বিষয়টি যাচ্ছে তখন তারা আপ্রাণ চেষ্টা করছে যাতে এটি ফলপ্রসূ না হয়। কিন্তু সাধারণভাবে তরুণীরা তথ্য গোপন রাখার মতো কোমলতা অর্জন করতে পেরেছে এবং যারা শুধু বেদনার সৃষ্টি করবে তাদের কাছ থেকে ওরা দূরে থাকতে চায়। জর্জ লিন্ডসের মতো লেখকদের অভিমত হলো যে, প্রাচীনের চিন্তাধারা নতুন প্রজন্মকে অকারণে শৃঙ্খলাবদ্ধ করেছে। যদিও এই শৃঙ্খল সম্পর্কে আজকের প্রজন্ম যথেষ্ট অবহিত নয়।
অবশ্য এই জাতীয় অবস্থা হলো অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। এর সঙ্গে জড়িত আছে দুটি প্রশ্ন হয় প্রবীণরা এই সত্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে তরুণ সমাজকে তাদের নবলব্ধ স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করবে অথবা তরুণরা নিজেরাই সম্মানজনক ও গুরুত্বপূর্ণ পদগুলি দখল করে কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করবে নব নৈতিকতাবাদের প্রতিষ্ঠায়। ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, কয়েকটি দেশে আমরা এ দুটি বিষয়ের একটিকে কার্যকরি দেখি এবং অন্য দেশে অপরটি কাজ করে।
ইতালিতে যেখানে সব বিষয়ের মতো অপবিত্রতার কর্তৃপক্ষ হলো দেশের সরকার সেখানে পুণ্যবোধের উন্মোচনের জন্যে চেষ্টা চলেছে। রাশিয়াতে সম্পূর্ণ বিরোধী অবস্থা দেখা যায়, কেননা সেখানকার সরকার নতুন নৈতিকতাবাদের স্বপক্ষে কাজ করে চলেছে।
জার্মানির প্রোটেস্টান্ট অঞ্চলে স্বাধীনতাকে জয়যুক্ত করার সম্ভাবনা প্রবল, কিন্তু ক্যাথলিক অঞ্চলে এই বিষয়টি যথেষ্ট সন্দেহপূর্ণ। ফরাসি দেশটি সম্ভবত দীর্ঘদিন সঞ্জাত ফরাসি নিয়মনীতি কর্তৃক উদ্ভাবিত আবেদনের দ্বারা শিহরিত হবে। নৈতিকতার প্রশ্নটি সেখানে সহনশীলতার সুষ্ঠ বেদিমূলে স্থাপিত নয়। ইংল্যান্ড অথবা আমেরিকাতে কি ঘটতে পারে সে সম্পর্কে আমি কোনো ভবিষ্যৎ বাণী করতে চাই না।
এখন আমরা নারী-পুরুষের সম অধিকারের দাবির অন্তরালে যে তার্কিক বিষয়গুলি আছে সে সম্পর্কে আলোচনা করব। স্মরণাতীকাল থেকে পুরুষেরা বেআইনি যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হবার অনুমতি পেয়েছে, যদিও তথ্যগতভাবে একে স্বীকার করা হয়নি। বিবাহের সময় একজন পুরুষ তার কৌমার্য রক্ষা করবে, এ ব্যাপারটা আশা করা যায় না। এমনকি বিবাহের পরেও চবিত্রহীণতার দোষটিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত করা হয় না যদি সেই ঘটনাগুলি ঐ পুরুষের স্ত্রী ও প্রতিবেশিদের দ্বারা জ্ঞাত না হয়।
এই পদ্ধতির সম্ভাব্যতা নির্ভর করে গণিকাবৃত্তির ওপর। অবশ্য এই পদ্ধতিকে রক্ষা করার মতো তথ্য আধুনিকতার নেই। এই কেউ কি এই মতকে মেনে নেবেন যে, এ ব্যাপারে নারী-পুরুষের সমান অধিকার থাকা উচিত। রমণিদের তৃপ্তি দেবার জন্যে পুরুষগণিকা সৃষ্টি করতে হবে; যেমনভাবে তাদের স্বামীরা এই ব্যাপারের মধ্যে লিপ্ত আছে।
অবশ্য আধুনিক যুগের আরেকটি সমস্যা হলো বেশি বয়সে বিবাহ। বর্তমান কালের পুরুষদের অতি ক্ষুদ্র শতাংশ বিশ্বাস করে যে, নিজের সামথ্য মতো গৃহ এবং নিজের সমপর্যায়ভুক্ত নারীকে অধিকার করার আগে কৌমার্য ব্রত পালন করা উচিত। যদি অবিবাহিত পুরুষরা একক জীবন যাপনে তৃপ্ত না হয় তাহলে অবিবাহিত নারীরা সম অধিকারের প্রশ্নে অতৃপ্তি দাবি করতে পারে। নৈতিকতাবাদীদের কাছে এই বিষয়টি যে অতীব দুঃখজনক তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রতিটি ঐতিহ্যশালী। নৈতিকতাবাদী চিন্তা করেন এই বিষয়ের দ্বৈত সত্তা। অর্থাৎ যার চিন্তাধারায় প্রতিভাত হয় যে, যৌন পবিত্রতার বিষয়টি পুরুষ অপেক্ষা নারীর ক্ষেত্রে বিশেষ প্রযোজ্য। তিনি হয়তো এই ব্যবস্থাকে মেনে নিতে পারতেন না।
তর্কের খাতিরে বলা যায় যে, তার তাত্ত্বিক নীতিবাদ পুরুষ অধিকার হরণের দাবি করবে। অবশ্য পুরুষদের প্রতি এর প্রয়োগ যে কতখানি কার্যকরি হবে সে বিষয়টিও ভেবে দেখতে হবে না, কেননা পুরুষরা সংগোপনে পাপ কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে। ঐতিহ্য সম্পন্ন নৈতিকতাবাদী তাই স্বইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বীকার করতে বাধ্য হবে যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে অসমতা থাকা প্রয়োজন। শুধু তাই নয়, নিজের শ্রেণিভুক্ত কোনো রমণির সঙ্গে সহবাস করা অপেক্ষা গণিকালয়ে যাওয়ার প্রশ্নটি শ্রেয়। যদিও প্রথমোক্ত ক্ষেত্রে সেই তরুণ পুরুষের সম্পর্ক হয়ত শুধুমাত্র শরীরকেন্দ্রিক না হয়ে স্নেহসম্পন্ন ও সার্বিকভাবে সুখ সঞ্চারিত হতে পারে।
অবশেষে নৈতিকতাবাদীরা এমন কোনো নীতিশিক্ষার পরিণতি সম্পর্কে সওয়াল করতে পারেন না যার বাস্তবতা বিষয়ে তাদের মনে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তাঁরা মনে করেন যে, যতদিন পর্যন্ত তারা গণিকাবৃত্তির স্বপক্ষে যুক্তি না দেখাবেন ততদিন তাদেরকে গণিকাবৃত্তির অনিবার্য কারণের উৎস স্বরূপ বিবেচিত করা হবে না। এই কারণে আমাদের যুগে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, ব্যবসায়িক নৈতিকতাবদীরা সাধারণত বুদ্ধিবৃত্তির নিচে অবস্থানকারী মানুষ।
উপরোক্ত বিষয়গুলি বিবেচনা করে আমরা ঘোষণা করতে পারি যে, যতদিন পর্যন্ত মানুষ অর্থনৈতিক কারণে বিবাহকে অসম্ভব মনে করবে এবং যতদিন অধিকাংশ নারী বিবাহ ব্যবস্থায় লিপ্ত না হবে ততদিন অবধি নারী-পুরুষের সঙ্গমের বিষয়টি রমণিসুলভ পবিত্রতার ঐতিহ্যসম্পন্ন মানবের অবনতিরূপে সূচিত হবে। যদি পুরুষজাতিকে প্রাক বৈবাহিক শারীরিক সহবাসের অনুমতি দেওয়া হয় (প্রকৃতপক্ষে তারা সেই অনুমতি ইতিমধ্যেই অর্জন করেছে) নারীজাতিকেও তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। যে সমস্ত দেশে নারীজাতি সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে শুধুমাত্র গাণিতিক অপরিহার্যতার দিকটি বিবেচিত করে রমণিদের বিরাট অংশকে অবিবাহিতা রেখে সর্বপ্রকার যৌন অভিজ্ঞতা হতে বঞ্চিত করাটা হলো অমানবিক কাজ।
এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, নারীমুক্তির আন্দোলনের প্রথম বক্তারা এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ অবজ্ঞাত ছিলেন। কিন্তু তাদের আধুনিক শিষ্যেরা এই বিষয়টির গুরুত্ব সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে। এবং যিনি এই মনোভঙ্গির বিরোধিতা করছেন সেই পুরুষ অথবা নারীকে তারা স্ত্রীজাতির অধিকার অর্জনের বিরুদ্ধবাদী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
নতুন নৈতিকতা বনাম প্রাচীন নৈতিকতার প্রশ্নে স্পষ্ট তর্কের উদ্ভব হয়েছে। যদি কুমারী কন্যার শারীরিক পবিত্রতা এবং স্ত্রীদের আনুগত্যের বিষয়গুলি আর বিবেচিত না হয় তাহলে পরিবারের কাঠামো রক্ষার জন্যে নতুন বিষয়ের অবতারণা করা উচিত। অথবা পরিবারের ভাঙ্গনের জন্য সুপ্রযুক্তি প্রয়োগে ব্রতি হওয়া উচিত। একথা বলা যেতে পারে যে, সন্তান উৎপাদনের প্রয়োজন শুধুমাত্র বিবাহ সম্পর্কে নয়। এবং সকল প্রকার বহিবৈবাহিক যৌন সম্পর্ক গর্ভনিরোধক ঔষধের দ্বারা বন্ধ্যা করতে হবে। সেক্ষেত্রে স্বামীরা হয়তো প্রেমিকদের স্বীকার করার মতো মানসিকতা অর্জন করবে, যেমনভাবে প্রাচ্যদেশের স্ত্রীরা সতীনদের স্বীকার করে নিতো।
এই পদ্ধতির একটি অসুবিধা আছে। এর ফলে গর্ভনিরোধক বড়ির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা এসে যাবে এবং স্ত্রীদের আনুগত্যকে বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন বলে মানতে হবে। সময়ের প্লাবনে এ দুটি অসুবিধা হ্রাস পেতে পারে। নতুন নৈতিকতাবোধের আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো সামাজিক স্বীকৃতি হিসেবে পিতৃত্বের গুরুত্ব হ্রস। পিতার ওপর ন্যাস্ত দায়িত্বগুলি এখন রাষ্ট্রগ্রহণ করেছে। অবশ্য যে ক্ষেত্রে পিতা তার পিতৃত্ব সম্পর্কে নিঃসন্দেহ এবং সে সন্তানকে অতিমাত্রায় ভালোবাসে, তখন সে হয়তো স্বেচ্ছাকৃতভাবে পিতার কর্তব্য পালন করবে অর্থাৎ জননী ও সন্তানকে আর্থিক সাহায্য দেবে। কিন্তু আইন দ্বারা তাকে এ কাজ করাতে বাধ্য করা সম্ভব হবে না।
অবশ্য রাষ্ট্রের হাতে উপযুক্ত ক্ষমতা না থাকলে এ যুগের সকল শিশুর অবস্থা হতো পিতৃপরিচয়হীন জারজ সন্তানের মতো। ভবিষ্যতে এই দায়িত্বের পরিমাণ অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে।
পক্ষান্তরে আমরা যদি প্রাচীন নৈতিকতাবোধকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চাই তাহলে কয়েকটি অপরিহার্য বিষয়ের কথা ভাবতে হবে। এর মধ্যে দুটি একটির কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু অভিজ্ঞতা দ্বারা জানতে পেরেছি যে, মাত্র এই কটা বিষয়ই কার্যক্ষম হয়। প্রথম অপরিহার্যতা হলো নারীজাতির শিক্ষা সম্বন্ধীয়। তাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে তারা গোড়া কুসংস্কারী ও উদাসীন হয়। যে সমস্ত বিদ্যালয়ের ওপর চার্চের কর্তৃত্ব আছে সেখানে এই ব্যবস্থা চালু হয়ে গেছে।
পরবর্তী অপরিহার্যতা হলো যৌন সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহকারী সকল প্রকার পুস্তকের ওপর কঠিন নিয়মরীতি আরোপ করা। ইংল্যান্ড ও আমেরিকাতে এই বিধিনিষেধ আরোপিত হয়েছে। আইনের পরিবর্তন না করে, পুলিশের ক্রমবর্ধমান প্রয়াসে যৌন-পুস্তকের ওপর কঠিন নিরাপত্তা স্থাপিত হয়েছে।
কিন্তু এ সমস্ত ব্যবস্থা এখনও অতিমাত্রায় অপ্রতুল। অল্পবয়সি মেয়েরা যাতে পুরুষদের নিঃসঙ্গ সান্নিধ্যে আসবার কোনো সুযোগ না পায় তার সব রকম ব্যবস্থা করতে হবে। বাড়ির বাইরের কাজ করে জীবিকা অর্জন করা থেকে মেয়েদের বিরত করতে হবে। মা অথবা কাকিমাদের সঙ্গে না নিয়ে তারা বাইরে বেড়াতে যেতে পারে না। পরিচারিকা ছাড়া নাচের আসরে যাবার অনুশোচ্য প্রথাকে দৃঢ়ভাবে উৎপাটিত করতে হবে।
পঞ্চাশ বছরের কমে কোনো অবিবাহিতা রমণিকে মোটর গাড়ির অধিকারিণী করা যাবে না। সম্ভবত সমস্ত অবিবাহিতা নারীকে পুলিশ ডাক্তারের নির্দেশ অনুযায়ী মাসিক পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। যাদের কুমারীত্ব সম্পর্কে কোনোরকম সন্দেহ দেখা দেবে, তাদের জন্যে বিশেষ শারীরিক অনুসন্ধানের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।
অতি অবশ্যই গর্ভনিরোধ ঔষধকে নির্মূল করতে হবে। গর্ভ-সংক্রান্ত ব্যাপারে চিরন্তন নিন্দাসূচক সংলাপের মধ্যে অবিবাহিতা নারীকে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হবে না। যদি একশো বছর ধরে এই নিয়মনীতিগুলি যত্ন সহকারে প্রযুক্ত হয়, তাহলে অনৈতিকতার উথিত জোয়ারের শক্তিকে শান্ত করা যেতে পারে। আমার মনে হয়, সব রকম ক্ষতির হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করার জন্যে সমস্ত পুলিশ ও চিকিৎসককে সতর্ক করা উচিত। হয়তো এই প্রথাকে আরও এক ধাপ অগ্রগামী করা যায়। কেননা, এ প্রসঙ্গে পুরুষ চিত্তের সহজাত দুর্বলতার প্রতি দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। আমার মনে হয় নৈতিকতাবাদীরা হয়তো এই মত সমর্থন করবেন যে, ধর্মপ্রচারক ব্যতিরেকে সমগ্র পুরুষজাতিকেই হীনবীর্য করা উচিত।
যেকোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হোক না কেন, কিছু কিছু ক্ষতি ও নিন্দা আসতে পারে। যদি আমরা নতুন নৈতিকতাকে তার পথে চলবার অনুমতি দিই, তাহলে সে সীমানার বাইরে অগ্রসর হয়ে প্রশংসার অযোগ্য বিপদ ডেকে আনবে। অপরদিকে যদি আমরা প্রাচীন যুগে প্রযুক্ত বিধিনিষেধগুলি আধুনিক পৃথিবীতে প্রবর্তনের চেষ্টা করি তাহলে আমরা নিষেধের অসম্ভব দৃঢ়তার মধ্যে পতিত হব। যার বিরুদ্ধে মানব সত্তা অচিরেই বিদ্রোহ ঘোষণা করবে।
একটা ব্যাপার সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, যত বিপদ বা ক্ষতি আসুক না কেন পৃথিবীকে পশ্চাদগামী করার থেকে অগ্রগামী করার বাসনার মধ্যে তৃপ্তি অন্বেষণ করতে হবে।
এই কারণে অমাদের প্রয়োজন নিখুঁত নতুন নৈতিকতাবোধ। এর দ্বারা আমি বোঝাতে চাইছি যে, যে সমস্ত নিষেধ ও কর্তব্যকে আমরা স্বীকৃতি দেব, তাদের সঙ্গে অতীতের স্বীকৃত নিষেধ ও কর্তব্যের বৈসাদৃশ্য বিদ্যমান। যতদিন অবধি নতুন নৈতিকতাবাদীরা মৃত পদ্ধতির সম্পর্কে ওকালতি করার বিচিত্র মনোভাব পরিত্যাগে সমর্থ না হবেন তারা নবলব্ধ স্বাধীনতাকে নীতি তত্ত্বের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করার প্রচেষ্টার ফলপ্রসূ হবেন না। অথবা যার দ্বারা স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, সেই কর্তব্যবোধগুলিকে সুচিহ্নিত করতে পারবেন না।
আমি মনে করি না যে, নতুন ব্যবস্থা সমাজের বুকে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করবে। কিন্তু আমার বক্তব্য হলো–এর গতিপ্রকৃতি হবে প্রাচীন যুগে প্রযুক্ত সামাজিক ব্যবস্থার চেয়ে অন্য রকম। প্রকৃতপক্ষে যৌন নৈতিকতা সংক্রান্ত সমগ্র সমস্যাটিকে সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে হবে।