০৫. বিচিত্র ভালোবাসা
বর্বর সমাজের ওপর খ্রিস্টানদের বিজয়ের পর নর-নারীর সম্পর্কের মধ্যে নিষ্ঠুরতার অনুপ্রবেশ ঘটে। প্রাচীন পৃথিবীতে এই অনুভবটি বহু শতাব্দী ধরে ছিল। অজ্ঞাত। প্রাচীন পৃথিবী পাপিষ্ঠ ছিল কিন্তু নিষ্ঠুর ছিল না। অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগে ধর্মও বর্বরতার সমন্বয়ে জীবনের যৌন সংক্রান্ত দিকটি অবমূল্যায়িত হতে থাকে। বিবাহের ক্ষেত্রে স্ত্রীর কোনো অধিকার ছিল না। বিবাহ ব্যতিরেকে সবই ছিল পাপপূর্ণ। তাই অসভ্য পুরুষজাতির প্রাকৃতিক জান্তব্যতাকে খর্ব করার জন্যে কোনো প্রচেষ্টা করা হয় নি। মধ্য যুগের দুর্নীতিপরায়ণতা যথেষ্ট প্রসারিত হয়। বিশপরা প্রকাশ্যে তাদের কন্যাদের সঙ্গে পাপকার্যেও লিপ্ত হতেন এবং আর্চ বিশপরা প্রিয় পুরুষ পাত্রদের বেআইনি কাজ অনুমোদন করতে। পুরোহিত শ্রেণির পবিত্রতা সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান বিশ্বাসের জন্ম হয় অথচ প্রকৃতপক্ষে অবস্থাটা ছিল অন্যরকম। পোপ গ্রেগরী ৭-এর প্রচেষ্টায় পুরোহিতরা উপপত্নী রাখা থেকে বিরত হন কিন্তু আবিলারডের সময় আমরা দেখেছি কলঙ্কজনকভাবে তিনি জেলোসিকে বিবাহ করেন।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধে পুরোহিতদের শারীরিক পবিত্রতা রক্ষার ব্যবস্থা দৃঢ়ভাবে প্রযুক্ত হলো। এরপরের পুরোহিতরা রমণিদের সঙ্গে বেআইনি সম্পর্ক বজায় রাখে কিন্তু তারা এই সম্পর্কের প্রতি কোনোরকম সম্মান অথবা সৌন্দর্য আরোপ করা থেকে বিরত হয়। কেননা তারা নিজেরা জানত যে, এই সম্পর্ক নৈতিকতাহীন ও অপবিত্র। চার্চের প্রচেষ্টায় যৌন সম্পর্কের পবিত্র দিকটি উন্মোচিত করার চেষ্টা করা হয় এবং ভালোবাসার ধারণাকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করা হলো। এ ব্যপারে হীনম্মন্যতার ভূমিকা উল্লেখ্যযোগ্য।
পুরোহিতরা তাদের শপথ ভেঙ্গেছে ও ধারাবাহিক পাপকার্যে পতিত হয়েছে। তারপর তারা পবিত্রতাপূর্ণ জীবনে সহজে ফিরে আসতে পারে না।
এ সম্পর্কে আমরা কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঘটনার কথা উল্লেখ করতে পারি। যেমন পোপ জন এয়োবিংশতাঁকে অন্যান্য অনেক অপরাধের সঙ্গে চারিত্রিক ত্রুটির জন্যে অভিযুক্ত করা হয়। ক্যানটারবেরির মঠাধ্যক্ষ সেইন্ট আগস্টিনের ওপর ১১৭১ সালে অনুসন্ধান চালিয়ে জানা গেল যে, একটি মাত্র গ্রামে তার ১৭ জন বেআইনি সন্তান আছে। অথবা স্পেনের সেইন্ট পিলার নাম করা যায়। ১১৩০ সালে প্রমাণিত হয় যে, তিনি ৭০ জন রমণিকে রক্ষিতা হিসেবে রেখেছেন। লীগের বিশপ হেনরী তৃতীয় সম্পর্কে ১২৭৩ সালে একটি তথ্য প্রকাশিত হয়। তাঁর ৬৫ জন বেআইনি সন্তান ছিল। কিন্তু পুরোহিতদের সম্পর্কে যে দীর্ঘ বিবরণ পাওয়া গেছে এবং ধর্মগ্রস্থ প্রণেতাদের ধারাবাহিক লেখনি থেকে যে তথ্য আবিস্কৃত হয়েছে তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, পুরোহিতরা রক্ষিত রাখার চেয়েও অনেক বেশি পাপকার্যে লিপ্ত ছিলেন।
দেখা গেছে যে, পুরোহিতরা যখন প্রকৃত স্ত্রীকে আনতেন তখন সেই বেআইনি ও নিজের পক্ষে ক্ষতিকারক সম্পর্কের কথা তারা প্রকাশ করতেন না। এই অতিরিক্ত নারী সম্ভোগ এবং আকর্ষণজনিত চরম অপমানবতার ব্যাপারটি তাঁদের ক্ষেত্রে ছিল সাধারণ ঘটনা। মধ্যযুগে লেখকদের রচনা থেকে আমরা গণিকালয়ের সমগোত্রীয় একাধিক পাপকেন্দ্রের বিবরণ পাই। যেখানে নিয়মিতভাবে শিশুহত্যা হতো এবং পুরোহিতরা অসৎ জীবন কাটাতেন।
এই ঘটনা থেকে প্রতিভাত হয় যে, পুরোহিতদের সম্পর্কে সুকঠিন বিধিনিষেধ নিয়মনীতি প্রবর্তন করা উচিত যাতে তারা তাদের মা-বোনেদের সঙ্গে একত্রে বসবাস করতে না পারেন। বিচিত্র ভালোবাসা, খ্রিস্টান ধর্মের মহান সেবাপরায়তা যাকে পৃথিবী থেকে প্রায় বিলুপ্ত করে দিয়েছিল সেটি আবার ফিরে আসে এবং পুনর্গঠনের পূর্বে আত্মশুদ্ধির জন্যে স্বীকারোক্তি করার প্রবণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়।
মধ্যযুগব্যাপী চার্চের গ্রিক-রোমান ঐতিহ্য ও অভিজাততন্ত্রের টিউটোনিক, ঐতিহ্যের মধ্যে বিচিত্র পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সভ্যতার পুনর্গঠনে উভয়ের অবদান ছিল কিন্তু সেই আত্মত্যাগের মধ্যে বৈসাদৃশ্য দেখা গেছে। ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের রাজকীয় ঐশ্বর্য থেকে চার্চ বহন করেছে দর্শন শিক্ষা, আইন পাঠ এবং খ্রিস্টান সমাজের মধ্যে একীকরণের ভূমিকা। সাধারণ আইন থেকে জন্ম নিয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ সরকার, নারীজাতির প্রতি বীরত্বপূর্ণ ব্যবহার, কাব্যগাঁথা ও উপন্যাস। আমরা যে অবদান সম্পর্কে বিশেষভাবে উৎসাহিত, তা হলো বিচিত্র ভালোবাসা।
যদি বলা হয় মধ্যযুগের আগে বিচিত্র ভালোবাসা ছিল সম্পূর্ণ অজানা তাহলে মিথ্যে বলা হয়। তবে একথা ঠিক যে মধ্যযুগে এই অনুভূতিকে বাসানার স্বীকৃত আবেগ হিসেবে স্থাপিত করা হলো। বিচিত্র ভালোবাসা মূল মন্ত্র হলো এটি প্রিয়তম বস্তুকে সহজে স্পর্শ করে না। তাকে অমূল্য মনে করে। তাই প্রিয়তমের হৃদয় হরণের জন্যে নানা প্রচেষ্টা দেখা যায় কবিতায়, গানে, শক্তিতে অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে রমণির মন লাভের চেষ্টা করা হয়। নারীন মূল্য সম্পর্কে এই চিন্তা এসেছে তাকে অর্জন করার অসুবিধা থেকে সৃষ্ট মনস্তাত্ত্বিক কারণে।
আমার মনে হয়, যখন একটি পুরুষ অতি সহজে একজন রমণিকে অধিকার করতে পারে, তখন সেই নারীর প্রতি তার মনোভাব বিচিত্র ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয় না। মধ্যযুগ থেকে দেখা যাবে যে, প্রথমে বিচিত্র ভালোবাসার অনুভূতি শুধুমাত্র সেই রমণিবৃন্দের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল যাদের সাথে প্রেমিকের আইনগ্রাহ্য অথবা আইন বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। এটি সুউচ্চ সম্মানীয়া নারীদের সঙ্গে যুক্ত ছিল, যারা নৈতিকতা ও ঐতিহ্যের দুর্লঙ্ প্রাচীন দ্বারা তাদের প্রেমিকদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এইভাবে চার্চ পুরুষকে যৌন সম্পর্কে অশুভ চিন্তার হাত থেকে উদ্ধার করে। কেননা একটি নারীকে অধিকার না করলে তবেই কাব্যিক অনুভূতির প্রকাশ ঘটে ফলে প্রেম হয় অপার্থিব, অবশ্য যদি এর কোনো সৌন্দর্য থাকে।
বর্তমান যুগের কোনো মানুষের পক্ষে মধ্যযুগের প্রেমিক-কবির মনস্তত্বকে কল্পনার চোখে অবলোকন করা দুরুহ কাজ। ঘনিষ্ঠতার আকুল আকাঙ্ক্ষা ছাড়াও তারা শ্রদ্ধাপূর্ণ ভালোবাসার স্বপক্ষে সওয়াল করে গেছে। আধুনিক যুগের পাঠক অবাক হয়ে ভাবে যে, তারা কিভাবে সাহিত্যিক মূল্যবোধের বাইরে ভালোবাসাকে শ্রদ্ধা করত। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, সাহিত্যগত প্রকাশভঙ্গিকে আক্রান্ত করেছিল প্রথাগত ঐতিহ্য।
কিন্তু ভাইটা নুয়োভা (Vita Nouva) তে দান্তে বর্ণিত বিয়াচিত্রের প্রতি ভালোবাসার ঐতিহ্যের আত্মপ্রকাশ ঘটেনি। কিন্তু আমি বলবো সেই আবেগের মধ্যে আধুনিক যুগের মানুষদের কাছে অজানা কামনার্ত বাসনার প্রকাশ ঘটেছে। মধ্যযুগের পবিত্র শক্তি পার্থিব জীবনকে নশ্বর বলে মনে করত। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিকে তারা ভাবত দুর্নীতি ও আদিম পাপের ফল। শরীর ও তার চাহিদাকে তারা ঘৃণা করত। পরিপূর্ণ আনন্দ বলতে বোঝাতো, যৌনকেন্দ্রিক আকর্ষণ থেকে আহত সম্পূর্ণ অবচিীন স্বর্গীয় সুখতন্দ্রা।
দান্তের বর্ণনায় আমরা কিন্তু প্রেম সম্পর্কে এই মনোভাবের প্রতিফলন দেখতে পাইনি। কোনো পুরুষ যদি একজন নারীকে যথাযথভাবে ভলোবাসে এবং সম্মান করে তাহলে সে তার সঙ্গে যৌন সঙ্গমের কথা চিন্তা করতে পারবে না। কেননা সে জানে সমস্ত যৌন সহবাস কিছু না কিছু পরিমাণে অপবিত্র।
সেক্ষেত্রে তার ভালোবাসা পরিণত হবে কাব্যিক কাল্পনিক অবস্থায়, ও স্বভাবতই সেটি প্রতীক চিহ্নে ভরে যাবে। সংস্কৃতির ওপর এর প্রভাব ছিল শ্রদ্ধাযোগ্য। যার ফলে সম্রাট ফ্রেডিরিকের দ্বিতীয় রাজসভায় সূচিত হলো প্রেমের কবিতায় জয়যাত্রা এবং নবজাগরণ অবধি তার ধারাবাহিক উন্নতি চলতে থাকে।
মধ্যযুগের শেষভাগের ভালোবাসা সংক্রান্ত মনোভঙ্গির সর্বশ্রেষ্ঠ বিবরণ পাওয়া যায় গ্রন্থে–মধ্যযুগের ক্ষয়প্রাপ্ততা The Waring of Middle ages by Hurizinga। তিনি বলেছেন, দ্বাদশ শতাব্দীতে অতৃপ্ত কামনার বিফলতা হিসেবে ভালোবাসার কাব্যিক বাসনা জন্ম নেয়, যার কেন্দ্র ছিল ঈশ্বরের আশীর্বাদ। এর দ্বারা সভ্যতার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম চিহ্নিত হলো। পুরাণকথার মধ্যে যন্ত্রণাময় ভালোবাসার সঙ্গীত শোনা যায় কিন্তু আনন্দ অম্বেষণের তীব্র ইচ্ছা অথবা তার দুঃখজনক হতাশার যে করুণ ছবি আঁকা হলো, তেমনি আর কখনো হয়নি। পাইরামাস এবং থিপসে, সেফালাস অথবা প্রোকরিসের ভাগ্য সমাপ্তি ঘটেছে বিপদঘন পরিণতিতে। তার ফললব্ধ আনন্দে হৃদয় বিদীর্ণকারী ত্যাগস্বীকার দেখা যায়।
অন্যদিকে অভিজাত কবিতায় বাসনা তার অপরিহার্যতা নিয়ে উপস্থিত হলো এবং সৃষ্টি করল ভালোবাসা সংক্রান্ত নিরাশ ভঙ্গি। বাসনামণ্ডিত প্রেমের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন না করে, নতুন কাব্যিক আদর্শ সকল প্রকার নৈতিক ইচ্ছাবোধকে আলিঙ্গন করতে সমর্থ হলো।
প্রেমকে অভিষিক্ত করা হলো নৈতিক ও সাংস্কৃতিব আনন্দের আদর্শ ক্ষেত্র হিসেবে। কেননা মানুষের ভালোবাসার মহান প্রেমিক নিষ্পাপ ও পুণ্যবান হয়ে উঠে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ থেকে আত্মিক উপাদান ক্রমশ প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। দান্তে এবং তাঁর বন্ধুমণ্ডলীর কামনা বোধ শেষ হলো প্রেমকে পবিত্র মহান অনুরাগ চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে। এখানে চরম উৎকর্ষতা পরিলক্ষিত হয়। ইতালীয়ান কবিতা ধীরে ধীরে তার উদগ্র বাসনা আগুনকে বিসর্জন দিতে সক্ষম হলো। পেত্রার্ককে দ্বিধা বিভক্ত করা হলো আর্থিক উদ্ভূত ভালোবাসা ও অভিজাত প্রকৃতির সামাজিক সৌন্দর্যের মধ্যে। অনতিবিলম্বে আরোপিত ভালোবাসায় কৃত্রিম পদ্ধতির মৃত্যু ঘটে। যখন নবজাগরণ যুগের স্বর্গীয় ভালোবাসার জন্ম হয় এবং ইতিমধ্যে যা ছিল সুপ্ত, সেই রাজকীয় আবেগ থেকে আত্মিক সম্বন্ধভুক্ত কামনাময় কবিতার আন্দোলনের সূত্রপাত হয়।
ফ্রান্স ও বুরগানডিতে ইতালির মতো ধারাবাহিকতা বজায় থাকে নি। কেননা ফ্রান্সের আভিজাতপূর্ণ মনেভঙ্গির মধ্যে ভালোবাসা ছিল গোলাপের গন্ধের মতো। যা সাহসে ভরা প্রেমেকে শ্রদ্ধা করত কিন্তু তার অতৃপ্ত সমাপ্তি সম্পর্কে আক্ষেপ করত না। প্রকৃতপক্ষে এ হচ্ছে চার্চের শিক্ষার বিরুদ্ধে প্রেমের সুপ্রযুক্ত পৌত্তলিত অনুমোদন।
সমাজের উচ্চ বংশের মধ্যে এবং নৈতিক আদর্শ যে বোধ কারণ উদ্ভূত ছিল তাকে ইতিহাসের বিশিষ্ট ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। আদর্শ সভ্যতার অন্য কোনো ক্ষেত্রে মানুষ এত বেশি সংশ্লিষ্ট ছিল না, যতদিন সে যুক্ত ছিল ভালোবাসার সম্পর্কে। যেমন ভাবে ছাত্রসম্পর্কিত বিদ্যা চেষ্টা করেছে মধ্যযুগের সমস্ত শক্তিকে একত্রিত করে এক কেন্দ্রের মধ্যে আবর্তিত দার্শনিক চিন্তা বৃত্ত সৃষ্টি করা, তেমনভাবে অভিজাত ভালোবাসার তথ্য অপেক্ষাকৃত কম প্রসারিত প্রাঙ্গণে, সহজ জীবনের সকল পরিণতিকে স্পর্শ করতে চেয়েছে। ফরাসিদের মতবাদ এই পদ্ধতিকে বিনষ্ট করেনি, শুধুমাত্র প্রকাশভঙ্গিতে রূপান্তরিত করে, অন্তর্নিহিত সংজ্ঞায় ঐশ্বর্য বাড়িয়েছে।
ঐ যুগের শুধুমাত্র অস্বাভাবিক কর্কশতার যুগ বলা যায় না। কেননা ভালোবাসার স্বপক্ষে ফরাসিরা যে সওয়াল করেছে, যাকে পুরোহিতদের মত অনুসারে পবিত্র বলা যাবে না। কিন্তু তা হলো পরিশুদ্ধ বীরত্বব্যঞ্জক ও কোমল।
অবশ্য এই মনোভাব সীমাবদ্ধ ছিল শুধু মাত্র অভিজাত শ্রেণির মধ্যে। তারা অবসর থেকে চিন্তা করতেন, অপার্থিব ত্রাস থেকে কিছু পরিমাণ আবেগ সঞ্চয় করতেন। তখনো জীবনের নানা স্থানে চার্চের প্রবল প্রতাপ পরিলক্ষিত হতো না এবং রাজকীয় ভালোবাসার ধারাকে অবহেলা করার মতো সাহস চার্চের ছিল না। আমাদের গণতান্ত্রিক যুগে আমরা প্রায়ই এই সত্য ভুলে যাই যে, পূর্বে পৃথিবীতে অভিজাততন্ত্রের প্রতিপত্তি ছিল। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে, যদি বীরত্বপূর্ণ ভালোবাসার মধুর রোমাঞ্চ দ্বারা পরিবেশ সৃষ্টি না হতো তাহলে নবজাগরণের পক্ষে ভালোবাসার পুনরুত্থানের কার্যটি সহজসাধ্য হতো না।
পৌত্তলিকতার প্রতি সহজাত আকর্ষণের প্রভাবে নবজাগরণের যুগে ভালোবাসা তার স্বর্গীয় অপার্থিবতা হারিয়ে ফেলে। যদিও সেটি তখনো ছিল কাব্যময়। মধ্যযুগের চিন্তাভাবনা সম্পর্কে নবজাগরণের প্রতিফলন ঘটেছে ডনকুইকসেট এবং তার ডালসিনিয়ার মধ্যে। অবশ্য মধ্যযুগের মধ্যে প্রভাববিহীন অবস্থাকে অবশিষ্ট রাখা হয়। সিডনির অ্যাসস্টোফেল ও স্টেলা এবং সেক্সপীয়রের সন্টে মিস্টার ডবলিউ এইচ-এর মধ্যে এবং মিস্টার ডবলিউ এইচকে লেখা সেক্সপীয়রের সনেটের মধ্যে ঐ ভাবনার প্রতিফলন পড়েছে। সবদিক থেকে বিচার করলে নবজাগরণ যুগের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত প্রেমের কবিতাকে আনন্দ সঞ্চারি ও কৃত্রিমতাবিহীন বলে অভিহিত করা যায়।
শয্যায় ছেনালীপনা ভালো না লাগে, যখন শরীরে তোমার উত্তাপ না জাগে। কলেছেন এলিজাবেথ যুগের এক কবি। এই উক্তির মধ্যে প্রকাশ্য আবেগ ও পার্থিব অনুভূতির স্পন্দন পাওয়া যাবে। মধ্যযুগের অপার্থিব প্রেমের কাছ থেকে নবজাগরণ শিক্ষা পেয়েছিল যে, কিভাবে ভালোবাসার মাধ্যম হিসেবে কবিতাকে কাজে লাগানো যায়। সিমবিলাইনে Cymbeine ক্লোটেনকে হাস্যপ্রদ করা হয়েছে কেননা সে নিজে প্রেমের কবিতা লিখতে পারত না এবং এক লাইনের জন্যে এক পেনি দেওয়া হবে এইভাবে একজনকে ভাড়া করতো। সে হায়, কি জ্বালা, মরণ প্রভৃতি শব্দগুলিকে কবিতায় পরিণত করতো।
এখানে একটা বিষয় আমাদের অবাক করে দেয় তা হলো মধ্যযুগের আগেও ভালোবাসার কবিতা লেখা হয়েছে কিন্তু তাকে প্রেমের প্রত্যক্ষ অংশীদার করা হয়নি। এক চীনা কবিতায় জনৈক মহিলার মর্মবেদনা প্রকাশিত হয়েছে, সে তার প্রেমাস্পদের অনুপস্থিতিতে বিলাপ করছে। ভারতীয় কাব্যে রহস্যময়তার প্রকাশ দেখা যায়। যেখানে আত্মা হলো নারী, যে ঈশ্বর স্বরূপ পুরুষের উপস্থিতির জন্যে কাতর। কিন্তু সে যুগে নারীরা এতই সহজলভ্যা ছিল যে, সঙ্গীত অথবা কবিতায় আশ্রয় নেওয়ার কোনো প্রয়োজনই পড়ত না।
শিল্পগত দিক থেকে বিচার করলে বলা উচিত যে, নারীরা সহজপ্রাপ্য হলে তাদের শৈল্পিক উৎকর্ষ কমে যায়। এবং হৃদয়ের পরম আকাঙ্ক্ষিত বস্তুটি লাভ না করলে জন্ম নেয় না মহান কবিতা। নবজাগরণ যুগে থেকে এই ধারাটি মোটামুটিভাবে প্রবর্তিত হয়েছে। ক্ষতিকারক দিকগুলিকে আংশিকভাবে অন্তঃস্থ এবং আংশিকভাবে বহিঃস্থ বলা যায়। শেষোক্ত বিষয়টি এসেছে প্রথাগত নৈতিক শিক্ষা থেকে।
বিচিত্র ভালোবাসা তার চরম শিখরে আরোহণ করে রোমান্টিক আন্দোলনের যুগে। শেলীকে এই ধারার প্রধান প্রবর্তক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। শেলী যখন অপূর্ব আবেগ ও কাল্পনিক চিন্তাযুক্ত ভালোবাসায় নিমজ্জিত হন তখন তিনি মনের ভাবকে প্রকাশ করার জন্যে কবিতার আশ্রয় নিলেন। তার মতে আবেগ থেকে সর্বসুন্দর শ্রীমণ্ডিত ভাবনার আত্মপ্রকাশ ঘটতে পারে এবং প্রেম সম্পর্কে নিয়ন্ত্রিত থাকার কোনো কারণ নেই। যাহোক তারা বিচার বুদ্ধি মন্দ মনস্তত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।
বাসনার পথে একাধিক বাধা তাকে কবিতা লিখতে উজ্জীবিত করে। যদি মহতি দুর্ভাগ্যবতি মহিলা, এমিলিয়া ভিভিয়ানিকে তিনি গ্রহন করতে পারতেন তাহলে এলিপসেডিয়ন রচনা করার কোনো প্রয়োজন হতো না। যদি জানতেন আয়ারের ইউলিয়ামসের মতো রূপসী গুণবতি জীবন সঙ্গিনী না থাকত তাহলে তিনি কখনো দি রিকারেকসান রচনা করতেন না। যে সমস্ত সামাজিক বাধা তাঁকে প্রতারিত করে তার মধ্যে সুপ্ত ছিল তাঁর শ্রেষ্ঠতম সৃজনি সত্তার অপরিহার্য উন্মাদনা।
শেলী কর্তৃক বিবৃত বিচিত্র ভালোবাসার অনুভূতির মধ্যে অস্থির মানসিকতার প্রকাশ দেখা যায়। সেখানে চিরন্তন বাধাবিপত্তিগুলি আছে কিন্তু তার কার্যক্ষমতা অনেকাংশে কমে গেছে। যদি বাধাগুলি সুসংবদ্ধ হতো অথবা তারা প্রযুক্ত না হতো তাহলে বিচিত্র ভালোবাসার উন্মেষ ঘটত না। যেমনভাবে চীনা সমাজে চরম অবস্থার কথা ধরা যায়। সেই অবস্থায় একজন পুরুষ তার স্ত্রী ব্যতিত অন্য কোনো সম্মানিয়া মহিলার সংস্পর্শে আসতে পারতো না এবং যখন সে মনে করত যে, তার স্ত্রীর কাছ থেকে সে সবটুকু তৃপ্তি পাচ্ছে না, তখন গনিকালয়ে যেত। তার স্ত্রীকে নির্বাচিত করা হতো এবং সম্ভবত বিবাহের আগের দিন অবধি মেয়েটি সম্পূর্ণ থাকত অচেনা।
এর পরিণতিতে সেই পুরুষদের সমগ্র যৌন সম্পর্কের মধ্যে ভালোবাসার বিচিত্র বহিঃপ্রকাশ পরিলক্ষিত হতো না। সেই পুরুষ হৃদয় অনুভূতির এমন কোনো পর্যায়ে উপনীত হতে পারত না, যার ফলে সে প্রেমের কবিতায় জন্ম দেবে। সম্পূর্ণ স্বাধীন অবস্থায় কোনো মানুষ প্রেমের কবিতা রচনা করতে পারে কিন্তু প্রবল প্রতিযোগিতামূলক যুদ্ধে জয়লাভের জন্যে পরিহার্য কাল্পনিক শক্তির প্রকাশভঙ্গির সার্বিক প্রয়োজন আছে। অর্থাৎ ভালোবাসার কবিতা নির্ভর করে চিরন্তন ও স্বাধীনতার মধ্যে অবস্থিত নির্দিষ্ট কোমল পরিণতির ওপরে। যেকোনো দিকে ঐ সমতা বিঘ্নিত হলে কবিতার উৎকৃষ্টতম বহিঃপ্রকাশ দেখা যাবে না।
যদিও প্রেমের কবিতাই ভালোবাসার একমাত্র উদ্দেশ্য নয় এবং শৈল্পিক প্রকাশ ছাড়াও বিচিত্র ভালোবাসার অন্যান্য দিক আছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি যে, জীবন থেকে সংগৃহিত যাবতীয় সুখানুভূতির মধ্যে বিচিত্র ভালোবাসাই হলো শ্রেষ্ঠতম উৎস। যে নারী-পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে কামনা-কল্পনা-কোমলতা ভরা ভালোবাসা আছে, তারা সৃষ্টি করে অনন্ত মূল্যসম্পন্ন বোধের। যাকে অস্বীকার করলে মানব সত্তার সর্বাধিক দুর্ভাগ্যকে আমন্ত্রণ করা হবে। আমার মনে যেকোনো সমাজ ব্যবস্থায় উচিত, এই সামাজিক আনন্দের উৎসকে সম্মান করা। যদিও এটি হলো জীবনের এক কণা মাত্র, তার প্রধান উদ্দেশ্য নয়।
অপেক্ষাকৃত আধুনিকালে ফরাসি বিদ্রোহের সময়ে এই চিন্তা বজায় ছিল যে, বিবাহকে বিচিত্র ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গণ্য করতে হবে। যে সমস্ত দেশের অধিবাসীরা ইংরেজি ভাষাতে কথা বলে তারা এই ব্যবস্থাকে বিনা প্রতিবাদে গৃহীত সত্য বলে স্বীকার করেছিল এবং এটিকে বৈপ্লবিক মনোভঙ্গি হিসেবে মানতে বাধ্য হয়নি।
একশো বছর আগের উপন্যাস ও নাটক সাধারণভাবে তরুণতর প্রজাতি কর্তৃক স্থাপিত বিবাহের নতুন ভিত্তির সঙ্গে পিতামাতা কর্তৃক নির্বাচিত ঐতিহ্যমণ্ডিত বিবাহ মতবাদের সংঘাতের কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছে। এর প্রকাশভঙ্গি ক্ষতিকারক অথবা আশাব্যঞ্জক কিনা, সে সম্পর্কে যথেষ্ট মতবিরোধ আছে।
মিমেস ম্যালাপ্রপের বিচার সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন। তিনি মনে করতেন যে, ভালোবাসা ও পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা মাতৃতন্ত্র তাকে বিনষ্ট করে। তাই কিছু পরিমাণ বিতর্কের মনোভাব থাকা উচিত। একটা ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় যে, নারী পুরুষ যখন পরস্পর সম্পর্কে পূর্ববর্তী যৌন অভিজ্ঞতা ব্যতিত বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় বিচিত্র ভালোবাসার প্রভাবে, তখন প্রত্যেকে কল্পনা করে যে, অন্যের মধ্যে নিহিত আছে নৈতিক ত্রুটিহীনতা অপেক্ষা শ্রেয় সত্তা এবং ধারণা করে যে, বিবাহ হলো আশীর্বাদের দীর্ঘ স্বপ্নের পথ। বিশেষ করে এই ঘটনাটি মহিলাদের ক্ষেত্রে ঘটে যদি সে অজ্ঞাত ও পবিত্রতার মধ্যে যৌবনপ্রাপ্তা হয়। তখন তার পক্ষে যৌনযুদ্ধ ও আবেগময় ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য নিরুপণ করার কাজটা দুরুহ হয়ে যায়।
আমেরিকাতে বিবাহ সম্পর্কে বিচিত্র ভালোবাসার স্বীকৃতি যেখানে সর্বাধিক গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হয়, এবং যেখানে আইন ও প্রথা সমবেতভাবে কুমারীদের স্বপ্নের ওপর নির্ভরশীল, সেখানে বিবাহ বিচ্ছেদকে সুখ প্রদানকারী বিবাহের চরম বিফলতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পরস্পরের সান্নিধ্যলব্ধ আনন্দ অপেক্ষা আরো গম্ভীর হলো বিবাহের উদ্দেশ্য। এই প্রথার মাধ্যমে সন্তানদের আগমন ঘটে এবং এটি সমাজের ঘনিষ্ঠতম অংশে অনুপ্রবেশ করেছে। স্বামী ও স্ত্রীর ব্যক্তিগত আবেগের বাইরে সেই অস্তিত্ব প্রসারিত হয়েছে সুদূরে।
এটি সম্ভবত সুখি চিহ্ন, আমার মনে হয়, এটি থেকে যে বিবাহের ধারণা আসবে, তার উৎস বিচিত্র ভালোবাসা। কিন্তু একটা বিষয়ে অবহিত হবে যে, এ ধরনের ভালোবাসা থাকলে বিবাহ বন্ধনকে সুখি করা যায় এবং তার সামাজিক দায়িত্ব পালন করা যায়। সেই ভালোবাসা বিচিত্র নয়। তা হলো ঘনিষ্ঠতা অপেক্ষা অন্তরঙ্গ, স্নেহ সঞ্চারী ও বাস্তববাদী।
রোমান্টিক ভালোবাসার ক্ষেত্রে প্রিয়বস্তুকে সঠিকভাবে দেখা যায় না। তাকে দেখা যায় বর্ণনার তন্ময়তার মধ্যে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কয়েক ধরনের মহিলা বিবাহের পরেও এই রহস্য তন্ময়তার জগতেও বাস করে। কিন্তু এক্ষেত্রে তার সমগোত্রীয় স্বামী লাভ করার ব্যাপারটা অত্যন্ত অন্তরঙ্গতাকে অস্বীকার করে ফিনিকস পাখির মতো নিজের একান্ত অনুগত ভাবনা ও অনুভূতির জগতে বাস করে। এর মধ্যে কিছু পরিমাণে শারীরিক গোপনীয়তার প্রশ্ন জড়িত আছে। অবশ্য এই জাতীয় অনুভূতি বিবাহকে তার সর্বোত্তম সম্ভাবনাবলি থেকে বিরত করে যা নির্ভর করে কল্পনা দ্বারা অপ্রাপ্তব্য স্নেহার্দ্র অন্তরঙ্গতার মধ্যে।
সর্বোপরি, বিবাহ সম্পর্কে বিচিত্র ভালোবাসার অপরিহার্যতাকে যথেষ্ট শক্তি সঞ্চারী বলে মনে হয়। এবং সেইন্ট পলের ধারণা অনুসারে বিপরীত বক্তব্য রাখা যায় যে, এটি এই সত্যকে অস্বীকার করে সন্তান উৎপাদক বিবাহ ব্যবস্থাকে গুরুত্বপূর্ণ করেছে। কিন্তু সন্তানদের জন্য, সে কারণে কোনো যৌন সংক্রান্ত মতবাদের প্রয়োজন নেই। স্ত্রী ও স্বামী পরস্পর সম্পর্কে বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেবে। এ যাবত যে ধারণাকে তারা সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব হিসেবে মেনে এসেছে তার প্রতি মনোনিবেশ করবে না।