০৩. পিতৃতান্ত্রিক পদ্ধতি
যে মুহূর্তে পিতৃত্বের শারীরবৃত্তিয় ভিত্তিকে স্বীকার করে নেওয়া হলো, সঙ্গে সঙ্গে পিতৃত্ব অনুভবের মধ্যে সম্পূর্ণ নতুন উপাদান প্রবেশ করে, সে অনুভূতি প্রায় সর্বত্র পিতৃতান্ত্রিক সমাজ সৃষ্টিতে সাহায্য করল। যখনই পিতা বুঝতে পারল যে, বাইবেল অনুসারে শিশু হচ্ছে তার বীজ, সঙ্গে সঙ্গে শিশুর প্রতি তার মনোভাব দুটি বিষয়ের সংযুক্তি ঘটে–অধিকারের প্রতি ভালোবাসা এবং মৃত্যুকে জয় করার অসীম আকাঙ্খ।
উত্তরাধিকারীদের কার্যধারা এক অর্থে মানুষের নিজস্ব সৃষ্টি এবং তাদের জীবন হলো তার জীবনের ধারাবাহিকতা। আশা আকাঙ্খ মৃত্যুর কবরে অন্বেষণ করবে না সমাপ্তি, সে অনন্তকাল ধরে প্রবাহিত হবে ভাবীকালের মধ্যে। এখানে আমরা আব্রাহামের অতৃপ্তি কথা চিন্তা করতে পারি। যখন তাঁকে জানানো হয় যে, তার বীজ কেমন ভূখন্ড দখল করবে, তখন তিনি তৃপ্ত হন।
মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পারিবারিক উদ্দেশ্যকে নারীজাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ। রাখা হয়। এবং যেহেতু নারীজাতি যুদ্ধের কাজে নিয়োজিত নয় তাই এই পারিবারিক উচ্চাশার মধ্যে পুরুষের কল্পনাশক্তির মতো সুদূর প্রকাশ নেই।
আমরা বলতে পারি পিতৃত্বের আবিস্কার মানব সমাজকে আরো বেশি প্রতিযোগিতামূলক, শক্তিশালী, গতিশীল ও ব্যস্ত করেছে। মাতৃতান্ত্রিক অবস্থায় সে ছিল অনেক বেশি নম্র। এই কল্পনা প্রসূত প্রভাব ছাড়াও স্ত্রীদের সতীত্ব সম্পর্কে অসম্পূর্ণ নতুন এক গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ উদ্ভাবিত হল।
আধুনিক ব্যক্তিরা যেমন ধারণা করে তেমনভাবে কিন্তু সম্পূর্ণ সহজাত ঈর্ষাবোধের অনুপ্রবেশ ঘটেনি। পিতৃকেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ঈর্ষাবোধের সর্বোচ্চ এসেছে ভাবীকাল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবার আশঙ্কায়। এই সত্যের স্বপক্ষে আমরা বলতে পারি যে, পুরুষ যখন তার স্ত্রী সম্পর্কে ক্লান্ত হয়ে যায় তখন কামার্ত বাসনায় তার রক্ষিতার প্রতি অনুগত হয়। যদি তার রক্ষিতার দেহ পাবার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বীর আবির্ভাব ঘটে তাহলে সে হয় ঈর্ষিত। স্ত্রীর ক্ষেত্রে এমনটি ঘটে না।
সন্তান হলো মানুষের আত্মজ ইচ্ছাশক্তির ধারাবাহিকতা এবং বৈধ সন্তানদের প্রতি তার ভালোবাসা সেই প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তির রূপমাত্র। পক্ষান্তরে, জারজ সন্তানের ক্ষেত্রে সন্দেহসম্পন্ন পিতা সন্তানের প্রতি যে ভালবাসা দেখায়, তার মধ্যে শারীরিক বন্ধনের বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। এইভাবে পিতৃত্ব নিরূপণ করাকে নারীজাতির সতীত্ব রক্ষার একমাত্র উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হলো। এই শারীরিক ও মানবিক আবেদনটি ভিক্টোরিয়ান যুগে সর্বোচ্চ সীমায় উপনীত হয়।
নারী জাতির আনুগত্যের কথা চিন্তা করে অতি সুসভ্য সমাজ নতুন দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছে। সেখানে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সাহচৰ্য্যবোধ থাকে না। তাদের সম্পর্কটা হয়ে দাঁড়ায় এক পক্ষের অনুগ্রহশীলতা এবং অন্য পক্ষের কর্তব্যবোধ। পুরুষ তার যাবতীয় জটিল ভাবনা ও বাসনাকে নিজের মধ্যে গোপন রাখে। কেননা স্ত্রী তাকে প্রতারিত করতে পারে। প্রায় সমস্ত সুসভ্য জাতির মধ্যে নারীদের করা হয়ে থাকে সমকালীন পৃথিবী ও তার ঘটনাবলির সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তাদেরকে কৃত্রিমভাবে নির্বোধ করে রাখা হয় এবং তার ফলে তারা হয় অনাকর্ষণীয়া।
প্লেটোর সংলাপগুলি থেকে আমরা অনুধাবন করতে পারি যে, তিনি এবং তাঁর বন্ধুগণ একমাত্র পুরুষকে সত্যিকারের ভালোবাসার পাত্র হিসেবে মনে করতেন। এই কথা স্মরণ রাখলে আমরা আর আশ্চর্য হবে না, যখন জানবো পুরুষ তার সমস্ত প্রিয় বিষয়ের আলোচনা করবে সম্মানীয়া এথেন্স কন্যার সঙ্গে। কিছুকাল আগে অবধি চীনদেশেও একই রকম মনোভাব বজায় ছিল। এবং পার্শিয়ান কবিতার সুমহান যুগে পারস্য দেশে ছিল একই রচনার অনুসরণ। এই চিন্তা ছিল অন্যান্য যুগে-কালে দেশে। স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে ভালোবাসার মধুর সম্পর্ক ভেঙ্গে দিয়েছে সন্তানের বৈধত্ব সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হবার বাসনা। শুধুমাত্র ভালোবাসাই নয়, সভ্যতার প্রতি নারীজাতি কর্তৃক প্রদত্ত যাবতীয় উপহারকে স্তব্ধ করে দিয়েছে এই আশঙ্কা।
স্বাভাবিক কারণেই অর্থনৈতিক অবস্থা এই মনোভাবের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ পুরুষ তার মামার কাছ থেকে গ্রহণ করে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ সে গ্রহণ করে বাবার কাছ থেকে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পিতা-পুত্রের মধ্যে যে সম্পর্ক তা মাতৃতান্ত্রিক সমাজের পুরুষদের মধ্যে যেকোনো সম্পর্কের চেয়ে ঘনিষ্ঠ। কেননা আমরা দেখেছি, পিতার প্রতি যে সমস্ত কর্তব্য প্রযুক্ত হয়, মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় তাকে ভাগ করে দেয়া হয় পিতা ও মাতুলের মধ্যে। পিতার কাছ থেকে আসে স্নেহ, ভালোবাসা। মামার কাছ থেকে আসে ক্ষমতা ও সম্পত্তি। এই থেকে বোঝা যায়, আদিম অবস্থায় পরিবার ছিল অনিয়ন্ত্রিত। পিতৃতান্ত্রিক পরিবার তাকে ঘনিষ্ঠভাবে গ্রন্থিত করেছে।
একথা মনে হয় যে, শুধুমাত্র পিতৃতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রবর্তনের ফলে পুরুষজাতি তাদের স্ত্রীদের কুমারীত্ব আকাক্ষা করে। যেখানে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রচলিত আছে সেখানকার কিশোরী মেয়েরা যুবকদের সঙ্গে বন্ধনহীন জীবনে অভ্যস্ত। কিন্তু বিবাহ ব্যতিরেকে সহবাসের যেকোনো ঘটনাকে লজ্জাজনক হিসেবে দেখা হয়।
নিজেদের অস্তিত্বকে আবিস্কার করার পর পিতারা তাকে সর্বতোভাবে শোষণ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করল। সভ্যতার ইতিহাস হলো পিতৃ অধিকারের ক্রমানতির কালপঞ্জি। ঐতিহাসিক কালপঞ্জি শুরু হওয়ার প্রাক মুহূর্তে যে অধিকার অধিকাংশ সুসভ্য দেশে সর্বোচ্চ শিখরে উপনীত হয়েছিল প্রাচীন যুদ্ধ উন্মাদনা, যাকে বহন করেছে চীন ও জাপানের আধুনিক গৃহবিবাদ, তার মধ্যে প্রাথমিক সভ্যতার বিশ্বজনীন বৈশিষ্ট্যের ছাপ আছে। সন্তানদের ওপর পিতার সার্বভৌম অধিকার অনেক ক্ষেত্রে বজায় থেকেছে। যেমন ছিল রোমে, ছিল জীবনে ও মৃত্যুতে। সভ্যতার ইতিহাসে মেয়েরা কখনো তাদের পিতার অমতে বিবাহ করতে পারেনি এবং অনেক শতাব্দী ধরে পুত্রদের ওপরও এই নিয়ম প্রযুক্ত ছিল। সাধারণত পিতা স্থির করত কাকে তারা বিবাহ করবে। জীবনের কোনো অবস্থাতেই একজন রমণি তার অস্তিত্বের পৃথক সত্তাকে আবিস্কার করতে সক্ষম হত না। প্রথমে সে থাকত পিতার ইচ্ছাধীনা এবং পরে সে হত স্বামীর অনুগতা। এই সময় এক বৃদ্ধা গার্হস্থ্য ব্যাপারে তার একক অধিকার বজায় রাখতো।
পুত্ররা এবং তাদের স্ত্রীরা তার সঙ্গে একই ছায়ার তলায় বসবাস করত। পুত্রবধূরা থাকতো তার কর্তৃত্বের মধ্যে। বর্তমান কালেও চীনদেশে শাশুড়ির অত্যাচারে তরুণি বধূর আত্মহত্যার ঘটনা দেখা যায়, সেদিন তা ঘটতো ইউরোপ ও এশিয়ার সুসভ্য অঞ্চল জুড়ে।
যীশুখ্রীস্ট যখন ঘোষণা করেন যে, তিনি পিতাপুত্রের ও শাশুড়ি-পুত্রবধূর মধ্যে মিলন ঘটাতে চান তখন তিনি ঐ জাতীয় গৃহস্থের কথা চিন্তা করেন এখনও যার অস্তিত্ব আছে দূর প্রাচ্যে। প্রথম অবস্থায় পিতা স্বীয় অধিক শক্তি দ্বারা যে ক্ষমতা অর্জন করেছিল, ধন তাকে দিল সুদূর বন্ধন। অনুমান করা হলো যে, ঈশ্বর হলেন রাষ্ট্রের সমর্থক। সুপ্রাচীন দেবার্চনার মধ্যে এই মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে। খ্রিস্টধর্মের মতাদর্শে পিতৃত্বের আভিজাত্যকে মেনে নেওয়া হল।
রাজতান্ত্রিক ও অভিজাততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় অথবা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ব্যবস্থায় পিতৃত্বের শক্তিকে স্বীকার করা হলো। প্রাথমিক যুগে অর্থনৈতিক বিষয়গুলি এই ধারাকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করে। জেনেসিসে আমরা দেখতে পাই, পুরুষ অসংখ্যবার সন্তানকে কামনা করে এবং যখন তারা তাকে অধিকার করে তখন তৃপ্তির সীমা থাকে না। গৃহপালিত পশুর বৃদ্ধির মতো সন্তান বৃদ্ধির দ্বারা পুরুষ সুবিধাজনক পরিস্থিতির উদ্ভাবন করার চেষ্টা করে। এই কারণেই সে যুগে ঈশ্বর পুরুষকে আদেশ দিয়েছিলেন–বৃদ্ধি করতে, শুধু উৎপাদন করতে।
কিন্তু সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক অবস্থাবলির পরিবর্তন ঘটল। ধার্মিক মনোবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো স্বীয় স্বার্থ সম্পর্কিত নিপুণ আলোচনা। রোম তার সম্পদ অধিকার করার পর বিত্তবানেরা বৃহৎ পরিবারের প্রতি পরাজুখ হয়ে পড়ে। রোমান শ্রেষ্ঠত্বের শেষ শতাব্দীগুলিতে সুপ্রাচীন বিশ্বাসের ধারাবাহিক মৃত্যু ঘটতে থাকে। যাকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হবেন নৈতিকতাবাদীরা। বিবাহ বিচ্ছেদ হলো সহজ ও সরল। উচ্চ শ্রেণির মহিলারা প্রায় পুরুষদের সমান অধিকার অর্জন করল এবং সহজবোধ্যতা ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে।
এই ক্রমউন্নতির সঙ্গে বর্তমান যুগের উন্নতির অনেক সাদৃশ্য আছে। কিন্তু সেটি সীমাবদ্ধ ছিল উচ্চ শ্রেণির মধ্যে। তার ফলে অপেক্ষাকৃত গরিব লোকেরা নিদারুণ আঘাত পায়। কেননা তারা ঐ ব্যবস্থা দ্বারা উপকৃত হতে পারছে না। অভিজাত সভ্যতা ধীরে ধীরে সমগ্র জনসমষ্টির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শতাংশে পরিণত হয়েছিল। অবশ্য এখানে কিছু ব্যতিক্রম আছে। এই ব্যবস্থার মধ্যে এমন কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ছিল যা একে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখে। অবশেষে প্রবাহিত হলো কুসংস্কারের প্লাবন।
খ্রিস্টান মানসিকতা এবং বর্বর অভিযান গ্রিক-রোমান মতাদর্শের মৃত্যু ঘটায়। ধীরে ধীরে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা শক্তিশালী হতে থাকে, তার শক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে অভিজাত রোমকদের তুলনা করা যায়, কিন্তু সেই চিন্তাধারা নতুন মূল্যায়নের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারল না। যৌনতা সম্পর্কে খ্রিস্টান মতবাদ এবং আত্মা ও মোক্ষ সম্পর্কে খ্রিস্টান মতবাদ থেকে উদ্ভূত ব্যক্তি স্বাতন্ত্রকে সহ্য করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
প্রাচীন যুগের সভ্যতার মতো অথবা দূর প্রাচ্যের সভ্যতার মতো খ্রিস্টান জনমানস জৈবিক উন্মাদনায় উজ্জীবিত হতে পারল না। খ্রিস্টান দেশগুলির সুপ্রাচীন ধারণাটি ভাবীকালের পুনর্জীবনের মধ্যে ক্রমশ হ্রাসপ্রাপ্ত হতে থাকে। মানুষ ধীরে ধীরে সম্ভাব্য অনিশ্চয়তার দিকে অগ্রসর হয়।
যদিও বর্তমান সমাজ এখনো পিতৃতান্ত্রিক এবং এখনো তাতে পারিবারিক অস্তিত্ব বজায় আছে। তা সত্ত্বেও প্রাচীন যুগের তুলনায় এ সভ্যতা পিতৃত্বের প্রতি কম গুরুত্ব প্রদান করে। পারিবারিক শক্তির ক্ষমতা আগের চেয়ে বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। জেনেসিস যুগের মানুষদের তুলনায় আজকের পুরুষদের আশা আকাঙ্খ হলো একবারে ভিন্ন। আজকের পুরুষ রাষ্ট্রের মধ্যে স্ত্রীর বৈশিষ্ট্য বজায় রাখার চেষ্টা করে, সে সন্তান সন্ততিদের মিছিল দেখতে অভ্যস্ত নয়। এই পরিবর্তনের অন্তরালে একটি কারণ ক্রিয়াশীল। যে কারণে ঐতিহ্যসম্পন্ন নৈতিকতা ও আদর্শবোধ তাদের বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে।
এই মানসিকতার উন্মেষে বিবাহ ও পরিবার সম্পর্কে ধর্মের অনুশাসনের কি ভূমিকা আছে, এখন তা আলোচনা করতে চলেছি।