তিনতলার ব্যালকনির একেবারে শেষ টেবিলটা খালি পেয়ে গিয়েছিল অসীম। সরু এক ফালি প্যাসেজের মত জায়গায় পর পর টেবিল পাতায় যে ফ্যানটির দরকার হয়েছে তার অবস্থান ওই টেবিলের শেষে। ফলে ঝড়ের মত হাওয়ায় দীপার চুল উডিয়ে দিচ্ছিল বারে বার। নাজেহাল হয়ে সে বলল, আমি এদিকে মুখ করে বসব।
ওরা চেয়ার বদল করল। টেবিলে টেবিলে ছেলেমেয়েদের কথা বলার শব্দ এক হয়ে সামুদ্রিক গর্জনের মত শোনাচ্ছে। বাঁ দিকে তাকাতেই পুরো দোতলার মেঝে জুড়ে থাকা টেবিলগুলো এবং মানুষের মাথা দেখা যাচ্ছে। দীপা দেখল। অনেকেই চোখ তুলে তাদের দিকে, তার দিকে তাকিয়ে আছে। খাবারের অর্ডার দিয়ে অসীম একটু ঝুঁকে এল। এখন হাওয়ার ঝাপটা সরাসরি লাগছে তার মুখে, দীপার পেছন থেকে ওটা আসায় সে দু হাতে কানের পাশের চুল চেপে রইল। একটু অসুবিধে হলেও আরাম লাগছে এভাবে বসতে। অসীম জিজ্ঞাসা করল, তারপর?
তুমি আমাকে তোমার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্যে ব্যস্ত হচ্ছি কেন?
দেখাতে।
মানে?
আমার বধু কিরকম স্ব ভাবের, তার চেহারা কি রকম—
বি সিবিষয়াস অসীম।
আমি তো সিরিয়াস হয়েই আছি।
দেখিয়ে কি লাভ হবে?
অসীম সোজা হল, কি ব্যাপার বল তো দ্য গ্লোরিযাব। মৃত্যু তোমাকে বদলে দিয়ে গোল নাকি? এবার তোমাকে বুঝতে পারছি না।
তবে! দ্যাখো। এখনই বুঝতে পারছ না।
বুঝতে চাই।
দীপা চট করে সিদ্ধান্ত নিল। সে বলল, অসীম তোমাকে আমার খুব ভাল বন্ধু বলে মনে হয়। তুমি কখনও মুখে বলনি সরাসরি, তুমি আমাকে চাও?
অসীম কোন কথা না বলে মাথা দোলালো, সে চায়।
কী ভাবে?
আশ্চর্য। সেভাবে পুরুষ নারীকে চায়। স্ত্রী হিসেরে।
কবে?
আর বছর তিন চার অপেক্ষা করতে হবে। আমাদের পড়াশুনা শেষ হলেই।
শেষ হবার পর যদি আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল না হয়?
বোকার মত কথা বল না। এদেশে বেকারের সংখ্যা যতই বাড়ক দুজনে একসঙ্গে ভেসে বেড়াবো না। তুমি কল্পনা করতে পারো আমি পড়াশুনা শেষ না করে খেয়ে মরছি!
দীপা হাসল, বালাই ষাট! তা কি ভাবতে পারি।
তোমাব ব্যাপারটা কি বলে তো?
অসীমের প্রশ্নের জবাব দেবার আগেই বেয়ারা মোগলাই পরোটা নিয়ে এল। নুন মরিচ ছড়িয়ে তার একটা ছোট টুকরো মুখে ফেলে দীপা জবাব দেয়, খুব খিদে পেয়েছে। আগে খেয়ে নিই, তারপর বলছি। এই যে, আমি তোমার সঙ্গে বসে খোলা রেস্টুরেন্টে মোগলাই পরোটা খাচ্ছি তা চা-বাগান দূরের কথা জলপাইগুড়ি শহরেও ভাবতে পারতাম না।
তুমি যখন ওখানে নেই ভাবার কি দরকার?
দীপা জবাব দিলে না। চুপচাপ খাওয্যা শেষ করল। জল খেল। তারপর বলল, অসীম, তুমি জানো, আমি আই এ এসে বসব।
বসলেই যে তুমি সুযোগ পারে তার কি স্থিরতা আছে? এখন পর্যন্ত কটা মেয়ে আই এ এসে সুযোগ পেয়েছে।
পেয়েছে। তুমি খবরের কাগজ পড়োনি?
হ্যাঁ। একজন। নামটা ভুলে গিয়েছি।
রমা মজুমদার।
কিন্তু তুমি নিজে কি করে নিশ্চিত হলে যে পারে।
আমি আর হারতে বাজি নই।
আর মানে?
আমি জীবনের শুরুতে ভাগ্যের কাছে বড় রকম হেরে গিয়েছিলাম অসীম। সেই হারের পর আমার মাস্টারমশাই-এর কথাই একমাত্র আদর্শ, আমাকে ভাগ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে জিততে হবে, কক্ষনো পেছন ফিরে তাকার না।
আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না!
তোমাকে কিভাবে বলি?
সহজ ভাবে। যেভাবে মানুষ কথা বলে।
দীপা চোখ তুলে তাকাল, আমার মা মারা গিয়েছিলেন আমি জন্মানো মাত্র। মানুষ হয়েছি মাসী এবং মেসোেমশাই-এর কাছে। তাঁদেরই মা বাবা বলতাম। এতদিন। আমার নিজের বাবাকে আমি কখনও চোখে দেখিনি।
হুঁ। তুমি কি এর জন্যে দুঃখিত?
একদম না।
তাহলে আমারও কিছু এসে যায় না।
দীপা কিছুক্ষণ অসীমের দিকে তাকাল। অসীম চোখ সরাল না। দীপা খুব নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের বাড়িতে কোন বিধবা মহিলা আছেন?
অসীম বুকে এল, হাওয়ান্য শুনতে পেলাম না, জোরে বল।
দীপা প্রশ্নটা আবার উচ্চারণ করল! অসীম মাথা নাড়ল, আছেন! পিসিমা!
তিনি কি মাছ মাংস ডিম খান? রঙির শাড়ি পরেন?
মাথা খারাপ!
কার?
মানে, এদেশেব বিধবাদেবী ওসব বললে তারা পাগল হয়ে যাবে।
তাই!
আমি তোমার রহস্য বুঝতে পারছি না। এমন সব প্রশ্ন করছো কেন?
তোমার পিসিমা যদি পাগল না হয়ে যান?
দ্যাখো, ছেলেবেলা থেকেই আমি তাঁকে ওইভাবে দেখতে অভ্যস্ত, অন্য কোন ছবি আমি ভাবিনি। অসীম বলল।
ভাবোনি কেন?
স্রেফ অভ্যোস।
ধর, তিনি যদি ওইসব নিয়ম যা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল তা আর না। মানেন? তুমি কি মানতে পারবে?
পিসিমার ব্যাপারেব সঙ্গে তুমি আমি কিভাবে জড়িত হচ্ছি?
আমার প্রশ্নের জবাব দাও আগে, বলছি।
অসীম চোখ বন্ধ করল, করে হেসে ফেলল, সত্যি কথা হল, মানতে পারছি না বললে নিজের কাছে নিজে ছোট হয়ে যাব আবার উল্টোটা ভাবতে স্বস্তি পাচ্ছি না।
দীপা খুব খুশি হল। অসীম এভাবে সত্যি কথা বলবে সে আশা করেনি। সে ঠিক করে। নিল, অকপট হওয়াই এক্ষেত্রে উচিত কাজ হবে। এইসময় কফি এল। বেয়ারা ব্যবহৃত প্লেটগুলো তুলে নিয়ে গেল। কফির গরম কাপ টেনে নিয়ে দীপা বলল, চা-বাগানের বাড়িতে আমরা কখনও কফি খাইনি।
অসীম বলল, কফি বাগানের লোকেরাত চা খেতে উৎসাহী নয়, হয়তো।
দীপা হাসল, একটু মাথা ঝাঁকাল, তারপর বলল, জানো অসীম, আমি যখন ছোট, সেই এগার বারো বছর বয়েসে, যাঁদের আমি মা বাবা ঠাকুমা বলতাম তাঁরা আমার ভালোর জন্যে খুব বড়লোকের একমাত্র ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। খুব সহজ গলায় কথাগুলো উচ্চারণ করল সে।
অসীম কফিতে চুমুক দিতে গিয়ে যেন ছাঁকা খেল। চট করে সোজা হয়ে বসল সে। তার দুই চোখ, মুখে বিস্মযা ঠিকরে বেরুচ্ছে। কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না অসীম। যেন তার নিঃশ্বাসও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দীপা দেখল টেবিলে রাখা হাত কাঁপছে। সে আবার কথা শুরু করল, বিয়ে হয়েছিল। চা-বাগান থেকে আমায় নিয়ে আসা হল জলপাইগুড়ি শহরে। দুটো দিন একটা রাত কাটল কালরাত্রি আর নিযামকানুন মেনে। ওই বয়সের আমার বোধ-বুদ্ধির কথা নিশ্চয়ই অনুমান করছ। তারপর এল ফুলশয্যা; যার সঙ্গে আমার বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তবে শরীরে অল্পবয়সেই মৃত্যু বাসা বেঁধেছিল। তাকে দিয়ে কোনমতে একটি সন্তান উৎপাদন করে নিতে পারলেই বংশরক্ষা হয়। এমন চিন্তা ছিল—!
হঠাৎ কানে হাত দিয়ে চাপা গলায় চিৎকার করে উঠল। অসীম, আঃ, আর আমার শুনতে ভাল লাগছে না, প্লিও!
না। শুনতে তোমাকে হবেই। দীপা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল, একটা বীভৎস বাতের স্মৃতি আমাক জন্যে রেখে ছেলেটি সকালবেলায্য হাসপাতালে গেল! না, তার শরীরে এমন শক্তি ছিল না। যা দিয়ে সে তার বাবার ইচ্ছে পূৰ্ণ করে। এখনও চোখ বন্ধ করলে একটি ক্লাব পুরুষেবা গোঙানি শুনতে পাই, সমস্ত শরীর ঘিনঘিন করে ওঠে। আমি কুমারী অবস্থায় পালিয়ে এসেছিলাম চা-বাগানে আর আমার স্বামী মারা গিয়েছিল। সেই দিনই, হাসপাতালে। আমি বিধবা গুলাম বিয়ের বাহাত্তর ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই। প্ৰথম দিকে বিধবার যা যা কবণীমা তাই আমাকে করতে বাধ্য করা হয়েছিল। সে এক ভয়াঙ্কবা জীবন!
কাবা বাধা করেছিল?
আমাক হিতাকাঙক্ষীরা। দীপা হাসল, মজার কথা হল, শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করেছিলাম। আমি কিন্তু এই সমাজ আমাকে বিধবা বলে যাবে আমৃত্যু। শ্বশুরবাড়ির কেউ আজ বেঁচে নেই, আমার কারো কাছে কোন দায় নেই–। এহ অবধি বলে থেমে গেল আচমকা দীপা।
থামলে যে?
দায় নেই কথাটা সত্যি নব্য অসীম; অন্তত একজন মহিলার কাছে আমি দায়গ্ৰস্ত। যাঁকে আমি ঠাকুমা বলি, যার পাশে শুয়ে শৈশব, বালাকাল এবং কৈশোর কাটিয়েছি।
অসীম কি বললে প্রথম বুঝতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত সে বলতে পারল, দীপাবলী, তুমি চমৎকার একটা গল্প শোনালে!
গল্প? হতভম্ব দীপা।
নয়তো কি? তোমার মত স্মার্ট, পরিষ্কার মনের মেয়ের জীবনে এমন ঘটনা ঘটতেই পারে না। যদি ঘটতো তাহলে তুমি এখানে পৌঁছতেই পারতে না। আসল কথা হল, এসব বলে তুমি আমায় পরীক্ষা করছ! তাই তো?
দীপা অপলক তাকল, যদি করি?
তাহলে জেনো আমি বিশ্বাস করছি না।
দীপা বলল, অসীম, কাউণ্টারে গিয়ে এসবের বিল দেওয়া যায় না?
অবাক হল অসীম, কেন। যাবে না? কিন্তু একথা বলছি কেন?
আমি উঠব। আমার শরীর ভাল লাগছে না।
কি হল তোমার?
বললাম তো, শরীর ভাল লাগছে না।
হঠাৎ।
হঠাৎই।
আমি কি কিছু খারাপ বললাম?
না। তুমি যা স্বাভাবিক তাই বলেছ। চল। দীপা উঠে দাঁড়াল। সে কফি স্পর্শ করেনি। অসীম আর একবার বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে হাল ছাডল। প্যাসেজ পেরিয়ে দীপা সোজা চলে গেল কাউণ্টারে। তার পেছনে জোরে পা ফেলে অসীম বলল, তুমি দিচ্ছি। কেন? প্লিজ।
দীপা মাথা নাড়িল, না, আজ আমাকে দিতে দাও।
দাম মিটিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নামার সময় অসীমের দিকে তাকিয়ে দীপা বলল, জানো, আমি একটা বিরাট ঋণের বোঝা রয়ে চলেছি। এখন পর্যন্ত যা খরচ করছি তা ওই ঋণ থেকেই নেওয়া। এসবই আমাকে শোধ করতে হবে।
কিসের ঋণ? তুমি কার কাছ থেকে টাকা ধার করেছ?
টাকা তো বটেই। আরও অনেক, অনেক ঋণ?
কি হেযালি করছ বল তো, আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।
জবাব না দিয়ে নিচে নেমে এল দীপা, তারপর ঘুরে দাঁড়াল, অসীম, এবার আমি যাই। বন্ধু হিসেরে তুমি খুব ভাল, খুব।
বেশ। চলে যেতে চাইলে তুমি যাবে। কিন্তু আমার ভুলটা বলে যাও।
তোমার কোনো ভুল নেই।
না। তুমি আমায একটা গল্প বললে। আমি জানি নিজেকে তুমি অনেক বেশী মূল্যবান বলে মনে কর। আই. এ. এস দেবে, জীবনের অনেক সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠবে, আমার মত একটি সাধারণ ছেলের ভালবাসায় আটকে থাকতে তুমি চাও না। কিন্তু এই ভাবনাটা মুখ ফুটে বলনি কেন এতদিন ৮ কেন আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে একটা মিথ্যে গল্প সাজাতে হল?
অসীমের গলার স্বর এতটা উঁচুতে উঠেছিল যে পাশ দিয়ে যাওয়া কয়েকজন দাঁড়িযে পড়ল। দীপা কি করবে বুঝতে পারছিল না। অসীমকে খুব ক্ষিপ্ত দেখাচ্ছে। যে কেউ বুঝবে খুব গোলমাল হয়েছে। সে শুধু বলতে পারল, তুমি ভালভাবে কথা বল অসীম! আমি কোন গল্প শোনাইনি।
আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না।
হঠাৎ।
খামোকা তোমাকে বলতে যাব কেন? আচ্ছা! তুমি আমার সঙ্গে হোস্টেলে চল। প্ৰমাণ পেয়ে যাবে সেখানে।
কিসের প্রমাণ? অসীম নড়ছিল না। দীপা দেখল ভিড় বাড়ছে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা আর উচিত হবে না। সে কথা না বলে হাঁটতে শুরু করল। এইসময় পেছন থেকে হাসি ভেসে এল। যারা কৌতূহলী ছিল তারা হাসছে এখন। রাগ অপমান আচমকা অসহায় করে তুলল দীপাকে। ট্রামে ওঠার কথা খেয়ালে এল না। এবং তখন অসীম ওর পাশে চলে এল, এভাবে চলে যাচ্ছ যে!
তুমি আমাকে ছেড়ে দাও অসীম, প্লিজ লিভ মি। আমি একা থাকতে চাই।
কেন?
তুমি হাসিগুলো শোননি? এভাবে আমাকে অপমান নাই বা করলে।
অদ্ভুত! আমি তোমাকে অপমান করলাম? অসীমের গলা ভাঙল, তুমি আমাকে এড়িয়ে যেতে চাইছ না?
এখন চাইছি। কারণ আমি বিধবা এটা তুমি মানতে পারছ না।
অসীম খুব অসহায় হয়ে পড়ল। দীপার চেহারায় বিবাহিতা মেয়ের কোন চিহ্ন নেই। বিবাহিতা মেয়েদের শরীরে যে পরিবর্তন আসে তা নিয়ে বন্ধুবান্ধবরা নানান গল্প করে থাকে। কলেজে যে কোন বিবাহিতা মেয়ের সঙ্গে কুমারী মেয়ের প্রভেদ সাদা চোখে বোঝা যায়। সে বলল, হ্যাঁ, আমি মানতে পারছি না। তোমার আচরণ কথাবার্তায় সেটা কখনও বোঝা যায়নি বলেই আচমকা শুনে মানা যে কোন মানুষেবা পক্ষেই অসম্ভব।
বাঃ, আমি তোমাকে বানিয়ে গল্প বলব?
অসীম জবাব দিল না। ওরা হাঁটছিল। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাব পাব অসীম জিজ্ঞাসা করল, হোস্টেলে গেলে তুমি আমাকে কি দেখাবে?
হোস্টেলের খাতায্য আমার বাবার উপাধি মুখাৰ্জী দেখতে পারে।
সেটা অসম্ভব নয়। তিনি তোমার নিজের বাবা ছিলেন না।
হকচকিয়ে গেল দীপা। কখনও ব্যাপারটা তার মাথায় আসেনি।
অসীম হাসল, তুমি বরং অন্য কোন জোরদার কিছু প্ৰমাণ হিসেরে দাও যা আমি বিশ্বাস করতে পাবি। ধর, বিয়ের কার্ড, ওই সময় তোলা ছবিটবি—।
দীপা মাথা নাড়ল, যে ব্যাপারটা ভুলে যেতে চেয়েছি প্ৰাণপণে তার স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে বেড়াব এমন ভাবছ কি করে? আর এর পর, বিশ্বাস কর অসীম, প্ৰমাণ দিয়ে সম্পর্ক জিইয়ে রাখার কোন ইচ্ছে আমার নেই। দেখা হলে কথা বলব, বন্ধু না হোক পরিচিতের সঙ্গেও তো লোকে কথা বলে। চলি।
দীপা পা চালালো। ওর কেবলই মনে হচ্ছিল অসীম তার পেছনে আসছে। দূবত্ব বাড়াবাব জন্যে সে জোরে পা চালালো না সে কোন ভাবে অসীমকে দোষী করতে পারছে না। একটা ভাল লাগা তৈরীি হয়েছিল। অসীম সেটাকে ইতিমধ্যে ভালবাসায় নিয়ে গিয়েছিল, প্ৰায় নিঃশব্দে সে ব্যাপার্বটাকে মেনে নিতে বলেছিল। ওরা কখনও মুখ ফুটে উচ্চারণ করেনি ভালবাসি কিন্তু সেটা ব্যবহাবে অপ্ৰকট তো ছিল না। এই অবস্থায় অসীমের ধারণা তো খুব স্বাভাবিক ভাবে তৈরী হতে পারে সে আর পাঁচটা মেয়ের মত স্বাভাবিক, অবিবাহিতা।
কিন্তু এই ভাল হল। বিদ্যাসাগর মশাই-এর কথা ছেড়ে দেওয়া যাক, স্বয়ং দেবেন্দ্ৰনাথ ঠাকুর চাননি তাঁর পরবারের বিধবা বউ-এর পুনর্বিবাহ হোক। সেই মানসিকতা আজও অসীম এবং অসীমদের মত প্ৰগতিবানরা যদি বয়ে বেড়ায় তাহলে কিছু করার নেই। গত আশি বছরে করে কে কোথায় বিধবা বিবাহ করেছিল বলে আজ দেশে সেটাই স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দাঁড়াবে এমন আশা করা বোকামি। বরং একটা গভীর খাদের একদম কিনারা থেকে সে ফিরে আসতে পারল বলে অসীমকে ধন্যবাদ দেবে সে। নিজের সঙ্গে এইসব কথা বলতে বলতে সে হেদুয়ায় চলে এল। এখন বিছানা টানছে তাকে। নিজের বিছানায় উপুড় হয়ে অনেকক্ষণ শুয়ে থাকতে পারলে আর কিছু চায় না। না, সে পেছন ফিরে তাকবে না, কিছুতেই না।
হোস্টেলের গেটের কাছে পৌঁছে সে থমকে দাঁড়াল। উল্টো ফুটপাথ থেকে কেউ তাকে চেঁচিয়ে ডাকছে। দীপা অনেক কষ্টে মুখ ফেরাল। তার কষ্ট হচ্ছে কেন, কেন শরীর এমন ভারী হয়ে যাচ্ছে, এই চিন্তায় ফেরার অবকাশ পেল না। সে দেখতে পেল সুভাষচন্দ্ৰ তাকে হাত উচিয়ে দাঁড়াতে বলছেন।
সুভাষচন্দ্র ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? ওঁর পাশে একজন মাঝবয়েসী মহিলা। ইদানীং খোঁজ খবর করা সুভাষচন্দ্র একদম ছেড়েই দিয়েছেন। ট্রাম বাস দেখে রাস্তা পেরিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি, অনেকক্ষণ এসেছি; কোথায় গিয়েছিলি, শুনলাম কে খুন হয়েছে বলে নাকি আজ কলেজ বন্ধ ছিল।
হ্যাঁ। একটু দরকারে বেরিয়েছিলাম।
হুটহাট কলকাতা শহরে বেরুনো ঠিক নয়। লোকে বাঙালি ভাববে।
বাঙাল?
হ্যাঁ, পাকিস্তান থেকে আসা রিফ্যুজি। এদেশের মেয়েরা অমন হুটহাট বের হয় না।
প্ৰচণ্ড রাগ হয়ে গেল দীপার। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই সুভাষচন্দ্র গলা নামিয়ে নিচু স্বরে বললেন, তোর হোস্টেলের গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে আত্মাবাম খাঁচাছাড়া হয়ে গিয়েছিল। পুলিশে পুলিশে থিক থিক করছে। দারোযান বলল যে মেয়েটা খুন হয়েছে সে নাকি তোর ঘরেই থাকত। দেখিস পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা।
ভাবনাটা এক লহমায় ঘুরে গেল। পুলিশ হোস্টেলে এসেছে। তদন্ত করতে? কিন্তু বাইরে কোন গাড়ি দেখতে পাচ্ছে না তো। ওরা নিশ্চয়ই জেরা করবে তাকে। করলে ক্ষতি কি! গ্লোরিয়ার সম্পর্কে সে যা জানে বলে দেবে। সুভাষচন্দ্র বললেন, তোর সঙ্গে খুব জরুরী কিছু কথা ছিল। কোথায় বসে বলা যায় বল তো?
গেস্টরুমে আসুন।
দূর! পুলিশের সামনে কৃথা বলব কি করে? বলতে বলতে সুভাষচন্দ্ৰ মুখ তুললেন, কিছু চাই ভাই? অনেকক্ষণ থেকে দেখছি দাঁড়িয়ে আছ?
দীপা মুখ ফেরাতেই অসীমকে দেখতে পেল; অসীম সেখানে দাঁড়িয়েই হাসল, হ্যাঁ, দীপাবলীর সঙ্গে একটু কথা আছে!
সুভাষচন্দ্ৰ দীপাকে জিজ্ঞাসা করলেন, চিনিস নাকি?
হ্যাঁ। কলেজে পড়ে।
নে, কি কথা বলবে বলছে সেরে নে, তারপর আমরা বলব।
দীপা কিছু বলার আগেই অসীম মাথা নাড়ল, না, না, আমার সময় লাগবে। আপনারাই বরং শেষ করে নিন।
সুভাষচন্দ্ৰ গম্ভীর হয়ে গেলেন, দিস ইজ নট গুড। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলা তোর বাবাও, মানে অমরনাথ মুখুজ্যেও পছন্দ করত না।
দীপা ঘুরে দাঁড়াল, অসীম, আর কি কোন জরুরি কথা থাকতে পারে?
অসীম নিদ্বিধায় মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।
দীপা কি করবে। বুঝে উঠল না। সেইসময় দারোয়ান গেট থেকে বেরিয়ে এল। দীপাকে দেখতে পেয়ে সে তড়বড় করে বলে উঠল, আরে দিদি, পুলিশ আপনাকে খুঁজতেছিল।
দীপা সুভাষচন্দ্ৰকে বলল, তোমরা গেস্ট রুমে এসে বসো। আমি আসছি।
সে সোজা গেট পেরিয়ে ঢুকে পড়ল। থিক থিক করা পুলিশ নজরে এল না। সুপারের ঘরে দুজন পুলিশ অফিসার বসে আছেন। তাকে দেখতে পেয়ে সুপার বললেন, এই যে, তুমি এসে গিয়েছ! ঐরা তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চান। এর নাম দীপাবলী বন্দ্যোপাধ্যায়।
দীপা তৃতীয় চেয়ারটিতে বসতেই একজন অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি আর
গ্লোরিয়া একই ঘরে থাকতেন?
হ্যাঁ। দীপা মাথা নাড়ল।
ও কোন বর্ধমানে গিয়েছিল জানেন?
না। আমি জানতাম ও শান্তিনিকেতনে গিয়েছে।
হুম! মেয়ে হিসেরে ও কেমন ছিল?
ভাল।
কি রকম ভাল। বাঙালিদের মত স্বভাব ছিল না নিশ্চয়ই।
বাঙালিদের স্বভাব বলতে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?
প্রশ্নটা শোনামাত্র দুই অফিসার নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করে নিলেন। এবার দ্বিতীয় জন প্রশ্ন করলেন, গ্লোরিয়াকে কেন খুন করা হল এ ব্যাপারে কোন সূত্র দিতে পারেন?
আমি জানি না।
ও মদ সিগারেট খেত? পুরুষবন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতো।
মদ খেতে না। সিগারেট খেতে দেখেছি। ওর দেশের কিছু ছেলের সঙ্গে নিশ্চয়ই ওর বন্ধুত্ব ছিল। তাদের কারো সঙ্গে ওর সম্পর্ক কিছুদিন আগে ভেঙে গিয়েছিল।
কি রকম সম্পর্ক?
মনে হয় তাকে গ্লোরিয়া ভালবাসতো।
গুড। কি নাম তাব?
আমি জানি না।
কেন?
ও আমাকে বলেনি, আর কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রশ্ন করতে চাইনি।
হুম। মেয়ে হিসেরে সে কেমন ছিল?
ভাল। প্রথম প্রথম ভাষা এবং অভ্যোসগুলো আলাদা বলে কিছুটা অসুবিধে হত আমার। কিন্তু পরে মনে হয়েছে ও খুব সোজা ধরনের মেয়ে।
কোন দুষ্টচক্রের সঙ্গে তার সংযোগ ছিল বলে মনে হয়?
না। থাকলেও আমি জানি না।
গ্লোরিয়াকে আপনি এখানে এসে প্ৰথম দাখেন?
হ্যাঁ। আমি জলপাইগুড়ির মেয়ে, আর ও জাম্বিয়ার মেয়ে।
ঠিক আছে। যদি প্রয়োজন হয় আপনাকে আবার বিরক্ত করব। এবার যেতে পারেন।
মাথা নেড়ে ঘর থেকে বেরিয়েই দাঁড়িয়ে পড়ল দীপা। একজন অফিসার বলছেন, খুব শক্ত মেয়ে তো, এই বয়সে এমন উত্তর আশা করা যায় না।
সুপার বললেন, হ্যাঁ, মেয়েটি একটু অন্যরকম।
অন্য রকম মানে? অফিসারের গলায় কৌতূহল।
খুব সিরিয়াস টাইপের কোন কোন মেয়ে থাকে, ওই ধরনের।
দীপা আর দাঁড়াল না।
গেস্টরুমে এসে দেখল। সুভাষচন্দ্ৰ আর সেই মহিলা পাশাপাশি বসে আছেন। সে
পৌঁছানো মাত্র সুভাষচন্দ্ৰ বললেন, খুব বদ ছোকরা। কম্যুনিস্ট নাকি?
কার কথা বলছেন?
আরে যে তোর সঙ্গে কথা বলার জন্যে দাঁড়িয়েছিল। কথা শুনে তো মনে হয় না। ওদেশের। মুখে মুখে তর্ক করছিল। খুব বিরক্ত দেখাচ্ছিল তাঁকে।
কোথায় গেল অসীম?
অসীম? ওর নাম অসীম! ঘুরে আসতে বলেছি। এখানে হুটহাট ছেলেরা চলে এলে দেখা করতে দেয়? মেয়েদের হোস্টেলে নিয়মকানুন নেই?
এখন ভিজিটিং আওয়ার্স চলছে। কি ব্যাপার বলুন। দীপা বসল।
মুহুর্তেই পাল্টে গেলেন সুভাষচন্দ্র, তুই তো আর এই বুড়ো মামার খোঁজখবর নিস না। মাসের কুড়ি দিনই অসুস্থ থাকি। হাই ব্লাডপ্রেসার তার ওপর আমাশা লেগে আছে। অমরনাথ মুখুজোর চলে যাওয়ার সময় বিছানায় পড়েছিলাম। খুব বড় ধাক্কা পেয়েছিলাম খবরটা শুনে। তোর সঙ্গে যে এসে দেখা করব এমন মনের জোর ছিল না। কি অকালেই না চলে গেল লোকটা।
দীপা জবাব দিল না। সে মহিলাকে দেখল। রোগা ছোটখাটো চেহারা। এক দৃষ্টিতে তিনি দীপকে দেখে যাচ্ছেন। সুভাষচন্দ্র মাথা নাড়লেন শোকার্ত ভঙ্গীতে, তবে অঞ্জলির সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। চিঠিপত্র দেয। এখনও ওদের কোয়াটার্স ছাড়তে হয়নি। তবে ঘরবাড়ি তুলে ফেলেছে। কারো জন্যে তো কিছু আটকে থাকে না। এই পৃথিবীতে, মাঝখান থেকে তুই একদম একা হয়ে গেলি। তোবা দুজনেই ঠিক, আমি আর কাকে সমথন করব।
আপনি বলছিলেন খুব জরুরি কথা আছে।
হ্যাঁ, সেজন্যেই তো এলাম। কিন্তু এই পুলিশের ঝামেলা চুকেছে।
হ্যাঁ।
বাঃ, চিন্তা হচ্ছিল খুব। এক ঘরে ছিলি, মেমসাহেব তার ওপর নিগ্রো, স্বাভাবি চবিত্র তো এদের খুব একটা ভাল হয় বলে শুনিনি।
মামা, আমার শরীর ভাল নয়। আপনি কি বলতে এসেছেন বলুন।
সুভাষচন্দ্ৰ মহিলার দিকে তাকালেন। মহিলা বললেন, হ্যাঁ, ওকে অনেকক্ষণ আটকে রেখেছি। আমরা। তারপর দীপার দিকে তাকালেন, তোমার নাম খুব মিষ্টি।
আমি কিন্তু আপনাকে চিনতে পারছি না। মামা এখনও পবিচষ] করিয়ে দেননি। কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বলল দীপা।
সুভাষচন্দ্র একটু আডষ্ট হলেন, মানে পরিচয় করিয়ে দেবার সুযোগ পাইনি এখনও। ইনি হচ্ছেন তোমার মা, একে প্ৰণাম কর।
হকচকিয়ে গেল দীপা। বিস্ময়ে সে কথা বলতে পারল না।
সুভাষচন্দ্র মাথা নাড়লেন, শুনে নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছে। কিন্তু এটাই সতিা! অঞ্জলি তোমার সম্পর্কে মাসী হয়। তাকে তুমি মা বলতে। আসলে তোমাব। গৰ্ভধাবিণী গত হওয়ার পর তোমার জন্মদাতা বিবাগ হয়ে যান। পিবে যখন সংসারী হল তখন একেই বিবাহ করেন। তার মানে, ইনি যেহেতু তোমার জন্মদাতার স্ত্রী তাই একেই মা বলে ডাকা উচিত। নাও, প্ৰণাম করো।