1 of 2

২২. একতারা বাজিয়ে গান

হিত্তি গেনু, হুত্তি গেনু, গেনু জলপাইগুড়ি/ জলও নাই, গুড়িও নাই পাইতে সুড়সুড়ি/ নিজের চোখুত দেখি আসিনু শহরটার ঢক/ নামের বাহার অফুলা শাক, মানষিলায় ঠক।

বিষণ্ণ চেহারার একটি মানুষ একতারা বাজিয়ে গান গাইছিল কিং সাহেবের খাটে বসে। সামনের। বালির চরে পন্থীরাজ ট্যাক্সিগুলো জিরোচ্ছে। এ পাশে করলা আর তিস্তার মিলনমুখে কিছু দোকান, চা সিঙ্গাডার আর ঘাটবাবুদের। এখন ভরদুপুর। কলেজ থেকে জনা চারেক মেয়ে আচমকা ছুটি হওয়ায় তিস্তা দেখতে এসেছিল চুপিসারে। আর এসেই ওরা ওই গানটা শুনল।

জলপাইগুড়ি জেলার মানুষের বাংলা কলকাতার থেকে আলাদা। তা কোন জেলাব ভাষাই বা ঠিকঠাক মিলে যায় কলকাতার সঙ্গে? এতদিন চালু ছিল কামরূপী। আর বঙ্গলা—বরেন্দ্রী মিশ্রিত এক ধরনের বাবু বাংলা। কামরুপী বলেন রাজবংশী এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ। দেশ বিভাগের পর এই বারো বছরে ব্যাপারটা ওলট পালট হয়ে যাওয়ার মুখে। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষেরা বিশেষ করে বগুড়া, রাজশাহী, পাবনা আর মৈমনসিংহ থেকে আগত শরণার্থীরা জলপাইগুড়ি শহরের প্রান্তে পত্তন করলেন উদ্বাস্তু কলোনির। মাসকলাইবাড়ি বা পাণ্ডাপাড়ায়, সেই কলোনি সীমাবদ্ধ থাকল না, সস্তা চাষের জমি এবং বসতজমি পাওয়ায় তাঁরা ছড়িয়ে পড়লেন ড়ুয়ার্সের গ্রামে গ্রামে, অরণ্যে। এবার কামরুপী এবং বঙ্গালী-বারেন্দ্রীর সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের ওইসব জেলার ভাষা যা কিনা প্ৰত্যেকেরই প্ৰায় আলাদা চেহারা, মিলে মিশে একটা বাংলা ভাষা চালু করতে চাইছে যার ক্রিয়া পদে পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্ব, শব্দভাণ্ডারে কামরূপী ভাষার প্রচুর অস্তিত্ব এবং পরিবেশনে কলকাতার বাবু বাংলার ছায়া স্পষ্ট। মাত্ৰ বারো বছরেই এই কাণ্ড। জলপাইগুড়ি আনন্দচন্দ্ৰ কলেজের অধ্যাপক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বলতেন, আমরা একটা চমৎকার ভাষা পেলাম কারণ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষরা বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছেন। যদি ওঁরা সবাই একই জেলা থেকে এখানে আসতেন তাহলে এ জেলার ভাষার অর্ধেকটাই হয়ে যেত। রাজসাহী বা মৈমনসিংহের।

অথচ চা-বাগানে দীপারা যে বাংলা বলত তাতে পূর্ববাংলার ভাষা যেমন ছিল না তেমনি কামরূপী ভাষার প্রভাবও পড়েনি। যেহেতু মুষ্টিমেয় কয়েকটি পরবারের বাস ছিল সেখানে এবং বহিরাগত মানুষও গল্প-উপন্যাসের চরিত্রের ভাষায় কথা বলতেন তাই দীপাদের বিপাকে পড়তে হয়নি। বরং মদেশিয়া অনেক শব্দ কথার মধ্যে ঢুকছিল। ঠাকুমা প্রায়ই সতর্ক করতেন শব্দ-উচ্চারণে গোলমাল হলে। অমরনাথ তো বাঙাল শব্দ শুনলেই রোগে যেতেন। অন্তত পরবারের মানুষের মুখে। হোস্টেলে এসে দীপা নিজের অজান্তে নতুন বাংলা বলতে লাগল সঙ্গিনীদের সংস্পর্শে। এখনও তাদের কলেজে শরণার্থী ছেলেমেয়েরা ভর্তি হয়নি, স্বাধীনতার আগে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে একধরনের বিনীতভাব ছিল, নতুন পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতেন তাঁরা, বেপরোয়াভাবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ছিল না। যেসব তরুণ পূর্ববাংলায় স্কুল শেষ করে এখানকার কলেজে দেশ বিভাগের পর ভর্তি হয়েছিল তাদেরও সম্ভবত নতুন পরিবেশে ভাষার জন্যে একধরনের সঙ্কোচ হত। এখন দীপাদের ক্লাসে যে কটি মেয়ে রয়েছে তাদের কেউ শরণার্থী নয়। অথাৎ এখনও সেই প্রজন্মের কলেজে পড়া শুরু হয়নি।

মানুষটি রাজবংশী। তাঁর ভাষা কামরূপী। দুই একটি শব্দ কানে প্ৰথমে অবোধ্য ঠেকলেও কয়েকবার উচ্চারিত হবার পর সহজ হল। দীপার সঙ্গিনীদের ওর গান শোনার চেয়ে কিং সাহেবের ঘাট দেখার দিকেই কৌতূহল বেশী। কিন্তু দীপাকে লোকটা টানছিল। গান শেষ হলে কাঁঠালগাছের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা চোখ মেলে মেয়েদের দেখল। তারপর মুখ ঘুরিয়ে নিল। মানুষটির বয়স হয়েছে কারণ দাড়িতে রুপোর ঝিলিক। দীপা তার এক নতুন বান্ধবাঁ সরমাকে বলল, লোকটার সঙ্গে কথা বলব। আমার সঙ্গে যাবি?

সরমা সহজ মেয়ে। জলপাইগুড়ি শহরের সবরকম সংস্কার নিয়ে মানুষ। প্রিয় গায়কের দিকে তাকিয়ে সে ইতস্তত করল। দীপা বলল, নতুন স্যার বলছিলেন না যে দরবেশ বাউল ফকিরদের গানে সাধারণ মানুষের কথা ফুটে ওঠে। আমার ওঁর গান শুনে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করছে কেন উনি জলপাইগুড়ির মানুষদের ঠিক বললেন।

কিছু যদি মনে করে? সরমা বলল।

কি মনে করবে? আমাদের চেয়ে অনেক বড়। প্ৰায় বাবার মত।

লোকটা কিন্তু ফকির না।

কি করে বুঝলি।

ফকিরদের এরকম পোশাক থাকে।

নতুন স্যার বলেছেন দেশজ গান থেকে অনেক প্রবাদ পাওয়া যায়। কয়েকটা পেয়ে গেলে কেমন হয় বলতো? চল না!

আনন্দচন্দ্র কলেজে সম্প্রতি যোগ দেওয়া এক অধ্যাপক বেশ আলোড়ন তুলেছেন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। তিনি শুধু যত্ন করেই পড়ান না, সাহিত্যের নানান খবর গল্প করে বলেন। ছেলেরা সম্ভবত নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের পর আর একজনকে বন্ধুর মত পেয়েছে। তাঁর নামে কাজ হল। সরমা এগোল। অন্য দুজন দূর থেকে দেখতে লাগল।

মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দীপা জিজ্ঞাসা করল, এই গানটা আপনি বানিয়েছেন?

মানুষটি মৃদু মাথা নাড়ল। তার দাড়ি বাতাসে উড়ছিল, সেই ক্ষমতা কি দীনদয়াল আমাকে দিয়েছেন? আমি কুড়িয়ে কুড়িয়ে জমা করি বুকের মধ্যে। যখন ইচ্ছে হয় তখন গাই মা। এই গান কি তোমাদের ভাল লেগেছে?

হ্যাঁ। আপনি জলপাইগুড়ির মানুষদের ঠিক বললেন কেন?

মানুষ যদি ঠকায় তাহলে তাকে ঠক বলতেই হয়।

আপনি গানের সময় ওই ভাষায় গাইলেন, কথা বলছেন শুদ্ধ বাংলায়।

তোমরা তো বাবুদের বাড়ির মেয়ে। তাই তোমাদের বুঝতে সুবিধে হবে বলে বলছি। আর আমার ঘর ছিল নদীয়া জেলায়। ভাসতে ভাসতে অনেককাল এখানে ঠেকে আছি।

আপনি এরকম গান অনেক জানেন?

না মা। আমার পুঁজি অল্প। তবে এর প্রেমে পড়ে আছি। যা পাই তাই নিই। বাদ বিচার করি না। ত্রিস্‌সায় না জানে ঘাট কি আঘাট/ নিমদে না জানে ভাঙ্গা ঘাট/ পিরীত না বুঝে জাত কি অজাত। সুর করে নিচু গলায় গাইল লোকটা।

দীপা চটপট হাতের খাতা খুলল, আর একবার বলবেন?

কেন? লিখে রাখব। না মা, আমি লিখে রেখেছি মনে আর তুমি লিখবে খাতায়? সেটা কি মানানসই হল? মনে রাখতে পারলে রাখো। যদি থাকে মনত, হয়না ক্যানে দেশের কোনত, পিরীতি যদি মাচায় থাকে, দূর হলেই কি ভুলে তাকে?

আপনার মত স্মরণশক্তি নেই যে আমার।

কি করে বুঝলে? লোকে সুখের কথা ভুলে যায়, দুঃখের কথা ভুলতে পারে না। তুমি বাচ্চা মেয়ে। বুঝবে না এখন। কখনও যদি দুঃখের মত দুঃখ পাও দেখবে চেষ্টা করলেও ভুলতে পারবে না।

দীপার মুখ থমথমে হয়ে গেল। এ কথাটা কতখানি সত্যি তা সে জানে। সব কিছু ভোলা যায়। কিন্তু সেই ফুলশয্যার রাত্রের নরকটাকে কিছুতেই ভুলতে পারে না সে।

কিন্তু আপনি এখনও স্পষ্ট বললেন না কেন শহরের লোক ঠক?

লোকটা হাসল। তানপুরায় শব্দ করে মুখে বলল, ফুটানির রামা/ উপর ধুতি তলে জামা।

সরমা আর দীপা একসঙ্গে হেসে উঠল। দীপা সরমাকে বলল, এটা আমি কখনও ভুলব না। আপনি এরকম আর কয়েকটা বলুন না।

শহরের লোক বড় অহঙ্কারী। নিজের গুণ পাঁচমুখে বলে। এরা সব রাজার ঘরের বান্দী। কিন্তু, ছান ফ্যালাইতে দেখা যায় খোলা মাথায় চান্দি। লোকটা এবার হাসল, আচ্ছা! লিখে নাও তিনটে উপদেশ। আমার কথা না, এই জেলার মানুষেধ। পূর্ব-পুরুষদের মুখ থেকে শুনে শুনে মনে রেখেছে। কিন্তু মনেই রেখেছে কাজে তো করা যায় না। করতে চাইলেও না। লেখ। লোকটা চোখ বন্ধ করল। কিন্তু দীপা খাতা খুলল না। সরমা তাকে খোঁচা দিল। দিয়ে নিজের খাতা খুলল। লোকটি চোখ বন্ধ করে বলল, সুদিনের বাপ ভাই, নিদান কালে কহয় নাই। সুজনেরও ড়ুবে নাও হাতিরও পিছলে পাও। নয়া নয়া বথুয়া শাক নুন তেলে খায়, বুড়া হইলে বথুয়া শাক গড়াগড়ি যায়। ব্যাস। হয়ে গেল। এবার আমি চলি। কোন ভূমিকা না করেই লোকটা খেয়াঘাটের দিকে পা বাড়াল। ওরা দেখতে পেল খেয়াঘাটের সামনে পৌঁছানো মাত্র মাঝিরা লোকটিকে সাদরে নৌকোয় তুলে নিল। এক নৌকো মানুষ কিং সাহেবের ঘাট ছেড়ে রওনা হল বার্নিশ ঘাটের দিকে। হঠাৎ দীপার বুক টনটন করতে লাগল। ওর খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। চা-বাগানে যেতে। এই পথ দিয়ে এক অপরাহুে সে এক অসুস্থ শরীরে চা-বাগানে গিয়েছিল। এখন তো সব চেনা। শনিবারে চলে গিয়ে সোমবার সকালে ফিরে আসা যায়। হাতখরচের পয়সা বাঁচিয়ে গাড়িভাড়া দেওয়া যায়। তবু অনেকদিন যাওয়া হয়নি। সেই পুজোর ছুটির আগে যাওয়ার কথাও নয়।

কোর্টের পাশ দিয়ে নেতাজী পুলের দিকে আসছিল ওরা। হঠাৎ কেউ একজন চিৎকার করতে লাগল, আশা মা, আশালতা মা। একটু দাঁড়াও।

দীপা প্রথমে খেয়ালই করেনি। ওর বন্ধুদের কারো ওই নাম নয়। কিন্তু কোর্টের প্রাঙ্গণ থেকে হস্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসা লোকটিকে দেখতে পেল সারমা। পেয়ে বলল, এই আমাদের থামতে বলছে। ওরা দাঁড়াল। হরদেব ঘোষাল ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে আসছে। দীপা তাকে চিনতে পারল। পেয়েই শক্ত হয়ে গেল।

হরদেব ততক্ষণে সামনে এসে পড়েছেন, এই যে আশা মা, দূর থেকে একঝলক দেখেই চিনতে পেরেছি। এদিকে কোথায় এসেছিলে? কোর্টে?

আপনি ভুল করছেন। আমার নাম দীপাবলী।

তা তো জানি। কিন্তু আমাদের পক্ষে বউমা তোমার নাম রেখেছিলেন। আশালতা। ভারি মিষ্টি নাম। তা তোমার বাবার খবর কি?

দীপা কি বলবে বুঝতে পারছিল না। বন্ধুরা, কলেজ এবং হোস্টেলের কেউ জানে না তার বিয়ে হয়েছিল। জানাবার সুযোগই হয়নি। সে বিধবা একথা বলার প্রয়োজনই বোধ করেনি। বন্ধুদের সে চেনে। সে বিবাহিতা এই খবর ওরা মেনে নিতে পারবে। কিন্তু যদি জানে বিধবা তাহলেই প্রতিক্রিয়া হবে। হিন্দু-বিধবা মেয়ে মাছ-মাংস খাচ্ছে, রঙিন শাড়ি পরছে, ছেলেদের সঙ্গে কথাবার্তা বলত, এটা হজম করা ওদের পক্ষে মুশকিল হয়ে পড়বে। সে বুঝতে পারছিল হরদেবের সঙ্গে তর্ক করলে সেই তথ্যটা এরা জেনে ফেলবে। অতএর মুখ ফিরিয়ে দীপা বলল, ভাল আছেন।

তা তো থাকবেনই। আমি তোমাকে কোর্টের দিকে দেখে ভাবলাম তুমি বুঝি উইল রেজিষ্টি করতে এসেছি। আচ্ছা মা, তুমিই বল, ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খেতে হয়?

আপনি কি বলছেন আমি বুঝতে পারছি না। কিসের উইল?

তুমি জানো না কি করে একথা বিশ্বাস করি বল?

দেখুন, আমাদের হোস্টেলের নিয়ম রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোন ছেলের সঙ্গে কথা বলা চলবে না। জানতে পারলে হোস্টেল থেকে বের করে দেবে। আপনি বরং আমাদের হোস্টেলের গেস্টরুমে এসে আমার সঙ্গে কথা বলবেন। করে আসবেন বলুন? দীপা এ ছাড়া কিছুই বলতে পারল না।

কবে আবার? আজই আসতে পারি। ঠিক আছে, তুমি এগোও, আমি আসছি। ঠিক কথা, রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলা ঠিক নয়। হরদেব হাসল।

দ্রুত পা চালাল দীপা। বন্ধুরা কয়েক পা এগিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হরদেবের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব তৈরী হবার পর সরমা জিজ্ঞাসা করল, কে রে?

আমার বাবার পরিচিত।

ওসব কি বলছিল?

কিসব? দীপা নিজেই যেটা বোঝেনি সেটা সরমারা কতখানি বুঝছে জানতে চাইল।

ওই উইল টুইল। লোকটা যেন কেমন!

আর এক বন্ধু বলল, আমরা জানতামই না তোমার নাম আশালতা!

ধ্যাত। যত বাজে কথা।

ওমা, ওই লোকটা তোমাকে আশা আশালতা বলে ড়াকছিল। নাম না হলে কেউ মিছিমিছি। ডাকে। বলল না, আমাদের পক্ষে বউমা তোমার নাম রেখেছিল।

চতুর্থ জন বলল, আমাদের পক্ষে মানে? এসব তো বিয়ের ব্যাপারে বলে।

সরমা বলল, আমার মায়ের নাম আগে ছিল গোলাপ বিয়ের পাব ঠাকুমা রাখেন সুধা। বিয়ের পর হরদম নাম পাল্টে যেত। তোমার কি বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছিল?

মুখ গম্ভীর করে হাঁটছিল দীপা। এই সময় সত্যি কথাটা বলে দেবে ওদের? কাল সকালের মধ্যে খবরটা ছড়িয়ে যাবে চারপাশে। কিন্তু মিথ্যে কথা বললে সেটা যদি ফাঁস হয়ে যায়? এতদিন কেউ জিজ্ঞাসা করেনি বলে সে আগ বাড়িয়ে কিছু বলেনি। সেটা ছিল একরকম। এখন গলা ফুলিয়ে মিথ্যে বললে তো ধরা পড়লে আরও লজ্জা। সে মাথা নেড়ে বলল, হয়েছিল।

তারপর?

ছেলেটা অসুস্থ ছিল, মরে গিয়েছে। এটা সত্যি তবু কোথাও তো রাখা ঢাকা থাকল। দীপার কথা শেষ হওয়ামাত্র সরমা বলল, বাঁচা গেছে।

 

হরদেব কিন্তু এল না। দুদিন অপেক্ষা করে দীপা চা-বাগানে চিঠি দিল ঘটনার বর্ণনা দিয়ে। অমরনাথের কাছে জানতে চাইল ব্যাপারটা কি? অমরনাথ। এতদিন ঘটনার তিপ্রকৃতি বিশদভাবে অঞ্জলিকে বলেননি। মনোরমার কিছু জানা নেই। মেয়ের চিঠি পেয়ে অমরনাথ বুঝলেন আর চেপে রাখা যাবে না। কিন্তু এখন বলতে গেলে ওরা জানতে চাইবে ঘটনাটা কেন বলেনি আগে। অবশ্য অঞ্জলি প্রতুলবাবুর দেওয়া টাকাটার কথা জানে। অর্ধেক বলা আছে যাকে তাকেই তিনি বাকি ঘটনাটা রেখে ঢেকে বললেন।

অঞ্জলি স্বামীর দিকে তাকালেন, এসব কথা তুমি আগে বলনি কেন?

আমি অপেক্ষা করছিলাম। আসলে না আঁচালে তো বিশ্বাস নেই।

তার সঙ্গে আমাকে না বলার কি আছে! আমি তোমাকে ঠিক বুঝতে পারছি না। সত্যি ব্যাপারটা খুলে বল। অঞ্জলি সন্দিগ্ধ গলায় বলল।

যা বললাম। তাই সত্যি! আসলে আমার মনে হচ্ছিল এই যে সম্পত্তির জন্যে যাওয়া আসা করছি, এসব শুনলে তুমি আমাকে খুব লোভী ভাববে। একথা ঠিক, মেয়ে বিধবা হবার পর আমরা সম্পর্ক রাখিনি কিছুদিন। ওরা যেভাবে লুকিয়ে বিয়ে দিয়ে মেয়ের সর্বনাশ করেছে তাতে মুখদর্শন করাত পাপ। তোমার মেয়েরও তাই ধারণা। কিন্তু সব পাপের তো একটা প্ৰায়শ্চিত্ত করার নিয়ম আছে। প্রতুলবাবু যদি সম্পত্তি তার বউমাকে দিতে চান তাহলে চাইতে পারেন। নেওয়া না নেওয়া আমাদের ইচ্ছে। কিন্তু চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার কোন মানে হয়? দীপা ওই সম্পত্তির ন্যায্য উত্তরাধিকারী। তাকে সম্পত্তি পাইয়ে দিয়ে আমি কি কোন অন্যায় করছি?

তোমার মেয়ে যদি না নেয়?

না নিলে কাউকে দান করে দেবে। তাহলে অন্তত বারোভূতে লুটেপুটে খাবে না?

কত টাকার সম্পত্তি?

লক্ষ লক্ষ টাকা!

অঞ্জলি উত্তরটা শুনে চুপ মেরে গেল। অমরনাথ বললেন, আমার কি! মেয়ে যদি ভোগ করতে চায় করবে না। চাইলে ছেড়ে দেবে। আমি তো আর ভাগ বসাতে যাচ্ছি না। কিন্তু এই হরদেব লোকটা এসব বলতে গেল কেন? উইলের কথা তো আমি তাকে বলিনি।

লোকটা কেমন?

খুব খারাপ। প্রতুলবাবুর সেই টাকা থেকে কমিশন নিয়েছে। আনার ওপর নজর ছিল।

আনা! প্রতুলবাবুর সেই ঝি যে দীপাকে সাহায্য করেছিল?

হ্যাঁ। সেই তো এখন সমস্ত কিছু দেখাশোনা করছে। প্রতুলবাবুর পাশে সে একা আছে। আনা যা চাইবে তাই হবে।

আনা কি চায়?

সম্পত্তির ভাগ। আমাকে বলল একটা উইল করে নিয়ে যেতে। করলাম। তা পরীক্ষা না করিয়ে সই করাবেন না। তিনি প্রতুলবাবুকে দিয়ে।

সরাসরি প্রতুলবাবুর সঙ্গে কথা বলছি না কেন?

তিনি তোমার মেয়েকে দেখতে চান।

ঠিক আছে, এবার যখন তুমি জলপাইগুড়িতে যাবে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেও। আমি দীপাকে বুঝিয়ে বলব। আর হ্যাঁ, ওই আনার কাছে তোমার এক যাওয়ার দরকার নেই।

অমরনাথ স্ত্রীর দিকে তাকালেন, জঙ্গলের অন্ধকারে শহরের বিদুষী সুন্দরীকে সাইকেলের পেছনে বসিয়ে এনেছি চরিত্র মুঠোয় করে ধরে, তাতেও তোমার বিশ্বাস হল না?

অঞ্জলি মাথা নাড়ল, পুরুষমানুষের আবার চরিত্ৰ! বাজে বকো না তো। খুঁটি বাঁধা বকনা। খুঁটি উঠে গেলে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

কিন্তু এ যাত্রায় অমরনাথ স্ত্রীকে নিয়ে এলেন না। হরদেবের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হবে। সেইসময় স্ত্রীলোক সঙ্গে থাকলে বিপত্তি হবে। দীপার ছুটির সময় হয়ে এসেছে। বড়দি যদি অনুমতি দেন তাহলে তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছে অঞ্জলি।

কিং সাহেবের ঘাটে নেমে কোর্টের দিকে পা না বাড়িয়ে অন্য রাস্তা ধরলেন তিনি। তিস্তার গায়ে বাঁধ বাঁধা হচ্ছে। ভয়ঙ্করীকে সরকার এবাবে বেধে ফেলবে। ওপাশে নদীর ওপর ব্রিজ হয়ে গেলে ড়ুয়ার্স এক দৌড়ে কাছে এসে যাবে। ট্রেন চলবে বাস চলবে। আর ওই নৌকো আর পাখীরাজ টাক্সিগুলো উধাও হয়ে যাবে। কাজকর্ম দেখে মনে হচ্ছে। আর বেশী দিন নেই। নির্জনে পথ চলে অমরনাথ চলে এলেন হাকিমপাড়ায়।

প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে ঢুকে সদরে না গিয়ে বাগানের পথ ধরে পেছনে এসে গলা খুললেন তিনি, কেউ আছেন?

সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়িঙ্গে গোছের এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এল, অ! আপনি।

এই লোকটিকে বাগানে কাজ করতে দেখেছিলেন অমরনাথ একসময়। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার। আর সব কোথায়?

আর সব মানে? বাবু তাঁর বিছানায় শুয়ে আছেন।

অমরনাথ সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন, আনাকে দেখছি না!

তিনি ঘুমোচ্ছেন। রাত জেগেছেন তো!

রাত জেগেছে? অমরনাথ চিন্তিত হলেন,  কেন? খুব বাড়াবাড়ি হয়েছিল?

না। বাবুর বন্ধু হরদেববাবু এসেছিলেন। তিনি তো গেলেন তিনটের পর!

ধক করে বুকে লাগল কথাটা। হরদেব তাহলে এই বাড়িতে আসার অনুমতি পেয়েছে! শুধু আসা নয় একেবারে রাত তিনটে পর্যন্ত এমন জাগা জগতে হল যে এই সকাল নটাতেও তিনি ঘুমাচ্ছেন–অমরনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, বাবুর ঘুম ভাঙ্গেনি?

তা ভাঙ্গবে না কেন? পেচ্ছাপ পায়খানা করিয়ে চা খাইয়ে দিলাম। আমি! আনা কিছু বললে না বলতে তো চিতায় ওঠার আগে পারবো না। আমাকে একবার বাজারে যেতে হবে তাও রোগী ছেড়ে যেতে পারছি না।

কতক্ষণ লাগবে?

আধঘণ্টা। যাব। আর আসব।

ঠিক আছে, আমি তোমার বাবুর পাশে বসছি।

লোকটা তাঁকে প্রতুলবাবুর ঘরে নিয়ে এল। প্রতুলবাবু আজ বালিশ উঁচু করে মাথা রেখেছেন। চাদরের পাশ দিয়ে পা বেরিয়ে গিয়েছিল। অমরনাথ সেটা ঢেকে দিতেই প্রতুলবাবুর নজর পড়ল, ও, আপনি। আশা কোথায়? আশালতা? তাকে বড় দেখতে ইচ্ছে করে। যাওয়ার আগে মাথায় হাত বোলাবে না?

বেদম রাগ হয়ে গেল অমরনাথের। অত কাণ্ডের পরেও তিনি আশা করছেন দীপা এসে মাথায় হাত বুলিযে দেবে। ঘুণাক্ষরেও যদি জানতে পারে প্রতুলবাবু নগ্ন হয়ে একটা চাদর চাপা দিয়ে স্ব-ইচ্ছায় পড়ে থাকেন তাহলে মরে না গেলে এই ঘরে ঢুকবে না।

ছেলেমেয়োবা বড় হয়ে গেলে কিছুটা স্বাধীন তো হয়েই যায়।

স্বাধীন? স্বাধীন আবার কি? আমি টাকা না দিলে পড়তে পারত? সক, গলায় অহঙ্কাবেবাঁ ছাপ বন্ড স্পষ্ট। অমরনাথ হজম করার চেষ্টা করলেন। কথা ঘোরাবার জন্যে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ডাক্তার রোজ আসছে?

পয়সার স্বাদ পেয়েছে, না এসে পারে  প্রতুলবাবু কথাগুলো বলামাত্র অমরনাথের মনে হল মানুষটা যেন আগের দিনের চেয়ে বেশী সুস্থ। এত চটপটে কথা আগের দিন বলেনি।

আমি মরছি ভেবে সবকটা শকুন উড়ে এসে বসছিল। আনা তাদের তাড়িযেছে। তার জন্যেই আমার চিস্তা! মেয়েছেলে তো।

জেনে শুনেও না জানার ভান করলেন অমরনাথ। বৃদ্ধ মালী বেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আনা কোথায়?

পাশের ঘরে। ঘুমোচ্ছে। ঘুমোক মেয়েছেলে যত ঘুমোবে তত শরীর ভরাট হবে।

প্রতুলবাবু, আনা কি কিছু বলেছে আপনাকে?

কি ব্যাপারে?

সম্পত্তি, মানে বিষযা আশয়—উইল টুইল।

না! তার কোন লোভ নেই। মুখ ফুটে কিছু চাইল না। আজ পর্যন্ত। কথা বলতে বলতে হঠাৎ নেতিযে পড়লেন প্রতুলবাবু। যেটাকে আপাতচোখে সুস্থতা বলে মনে হচ্ছিল সেটি অন্তহিঁত হল। চোখ বন্ধ করে কাঁপতে লাগলেন। কিছুক্ষণ বসে রইলেন অমরনাথ। আনা উইল সই করায়নি। সম্পত্তির জন্যে যে মেয়ের জিভ লোভে লকলক করছে তাকে প্রতুলবাবু সন্ন্যাসিনী সাজাবেন। এখন তাঁর চোখ বন্ধ। আচমকা অনর্গল কথা বলে অত্যন্ত পরিশ্রান্ত।

প্রতুলবাবু বুঝতেই পারলেন না। অমরনাথ উঠে দাঁড়িয়েছেন। লোকটি তাঁকেও শকুনের দলে ফেলেছে বোঝার পর থেকেই খুব খারাপ লাগছিল। মনে হল চুপচাপ এ বাড়ি থেকে চলে গিয়ে দীপাকে সব কথা খুলে বলে হালকা হবেন। প্ৰায় নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে এপাশ ওপাশ তাকালেন তিনি। লোকটা অবশ্য তাঁকে বিশ্বাস করে বাজার করতে গিয়েছে। কি করা যায়! পাশের ঘরের দরজা ভেজানো। আনাকে ঘুম থেকে তুলে ব্যাপারটা বলে যাবেন? মন স্থির করে দরজা ঠেলতেই সেটা খুলে গেল। বড় ঘর। মাঝখানে চওড়া পালঙ্ক। পালঙ্কের ওপর রাজেন্দ্ৰাণীর মত শুয়ে আছে আনা। চোখ বন্ধ। একটা হাত কপালের ওপর আলগোছে রাখা। বুকের কাপড় সরে যাওয়ায় চোখ ঘুরিয়ে নিলেন অমরনাথ। তিনি দরজা থেকে ডাকলেন, আনা, আনা।

দুবার ডাকতেই হাত সরাল আনা। তার ঘুম ভেঙ্গেছে। এক মুহুর্ত তাকিয়ে থাকার পর ঠোঁটে হাসি খেলল অথচ বুকের আঁচলের কথা খেয়াল করল না।

এই মুহুর্তে সে মোটেই প্রৌঢ়া নয়, গৃহপরিচারিকার ভূমিকা অন্তহিঁত। অমরনাথ গলায় শব্দ করলেন, এসেছিলাম। একটু দরকার ছিল।

ঝট করে উঠে বসে কাপড় সামলে নিল আনা, এখানেই বসুন, আমি আসছি। দরজা থেকে সরে দাঁড়াতেই আনা পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। অমরনাথ ঘরে ঢুকলেন। একটা আঁশটে গন্ধ যেন ঘরে ঝুলছে। জানলাগুলো বন্ধ। তিনি এগিয়ে গিয়ে জানলা খুললেন। রোদ এবং হাওয়া ঢুকলে পালঙ্কের দিকে তাকালেন। এমন দামী পালঙ্কে তিনি কখনও শোননি। ঘরে আরও দুটো চেয়ার আছে। তার একটিতে সতর্ক ভঙ্গীতে বসলেন তিনি। এটি তাহলে আনার ঘর। প্রতুলবাবুর ঘরের পাশেই সে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গতরাত্রে হরদেব কি এই ঘরে ছিল? হরদেবের যে বয়স, শরীর যে পরিমাণ শুকিয়েছে তাতে রাত তিনটে পর্যন্ত জেগে আনার সঙ্গে–। ছিছিছি। লোকটাকে দেখেই অবশ্য নোংরা মনে হয়। কিন্তু সে দিনরাত আনাকে যা-ইচ্ছে-তাই গালমন্দ করত। আবার আনাও ওর প্রসঙ্গ উঠলে গাল না দিয়ে ছড়িত না। অমরনাথের মনে হল দুই শয়তানের মিলন হয়েছে। এবং তার ফলে তাঁর মত ভালমানুষের পক্ষে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরী হবে। এই অবস্থায় মাথা গরম করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

আনা ঘরে ঢুকল পোশাক পরিবর্তন করে। তার মুখ চোখ পরিষ্কার। সামনে দাঁড়িয়ে বলল, কখন এসেছেন? বেলা যে এত হল টেরই পাইনি।

শরীর খারাপ বুঝি?

না। কাল রাত তিনটে পর্যন্ত জগতে হয়েছিল।

প্ৰতুলবাবু দেখলাম আগের থেকে ভাল।

তা ভাল।

উইলটার কোন খবর আছে?

হ্যাঁ। ওটা যেমনটি চেয়েছিলাম তেমনই লিখিয়েছেন।

তাহলে প্রতুলবাবুকে দিয়ে—।

করিয়েছি।

অমরনাথ চমকে উঠলেন। প্রতুলবাবু উইলে সই করেছেন? কই, তিনি তো একথা একবারও বলেননি। আনা হাসল, দুদিন আগে থেকে নানান কাগজপত্রে এমনি এমনি সই করতাম। উনি এত বিরক্ত হতেন যে শেষে দেখতেনও না কি সই করছেন।

অমরনাথ উঠে দাঁড়ালেন, তাহলে—!

কাল সব ফাঁস হয়ে গিয়েছে।

মানে?

আপনি যে উকিলকে দিয়ে ওটা লিখিয়েছেন সে কোর্টে গল্প করেছে। মুখে মুখে খবর পৌঁছেছে হরদেব ঘোষালের কানে। তারপরেই সে ছুটে এসেছিল আমার কাছে। তাকে চেপে রাখব। এমন সাধ্য নেই আমার।

তারপর?

হরদেব অবশ্য ভাল কথা বলেছে। আপনার মেয়ে তো ঘেন্নায় এর নাম মুখেও আনে না। স্বীকারই করে না বিয়ে হয়েছিল। সম্পত্তি সে ছুঁয়েও দেখবে না। তাহলে তার নামে বড় অংশ লিখিয়ে লাভ কি? সইসবুদ যখন আমিই করছি তখন পুরোটাই আমার নামে লিখিয়ে নেওয়া ভাল। হরদেব যদ্দিন বেঁচে থাকবে দেখাশোনা করবে, আমি মাসোহারা দেব। লোকটা অবশ্য শেয়াল, তবে শেয়ালের বুদ্ধিকে কাজে লাগালে সিংহের হাত থেকে বাঁচা যায়। তাছাড়া ওর নজর ছিল আমার ওপর অনেক দিনের। পায়নি বলেই শত্ৰুতা করছিল। এরকম লোককে বশ মানাতে পারলে কোন চিন্তা থাকে না। কথা শেষ করে আনা এগিয়ে গেল আলমারির দিকে। সেটি খুলে অমরনাথের দেওয়া উইলটি বের করে বলল, এটা রেখে কোন লাভ নেই।

অমরনাথ দেখলেন আনা ওটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলছে। তিনি, হতভম্ব হয়ে গেলেন। নারীর এ কি রূপ। টুকরোগুলো একটা কাগজে মুড়ে আনা বলল, ব্যস। হয়ে গেল। আর কোন চিহ্ন রইল না।

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। হরদেবকে শকুন বলা হয়েছিল!

সত্যি কথা। দেখুন, আমি মেয়েছেলে। পাশের ঘরের লোকটার পা নাড়ার ক্ষমতা নেই তবু তিনি বেঁচে আছেন বলেই মাথার ওপর একটা পুরুষ আছে। পুরুষ ছাড়া মেয়েছেলে মানে আঢাকা খাবার ছাদে রাখা। উনি আপনাকে আমার দায়িত্ব নিতে বলেছিলেন। আপনি বা কাড়েননি। পঁচিশ ভাগ দিয়েই হাত মুছে নিতে চান। কোন পচিশ ভাগ। এই বাড়ির এক সিকি জমি? তা দিয়ে কি করব আমি?

তা কেন? আমি কি আপনাকে ঠকাতাম?

শুধু কথায় চিড়ে ভেজে মুখুজ্জে মশাই?

শুনেছি আপনার আত্মীয়স্বজন আছে দেশে–।

অতীত, অতীত। আমি তো অতীত হইনি। এখনও ভগবান শরীরটা রেখেছেন। শরীরে সাধ আহ্বাদ আছে। যৌবনের শুরুতে ওই পাশের ঘরের উনি যে জ্বালা তৈরী করে দিয়েছিলেন তা যে করে মিটবে কে জানে! আনা হাসল, তা বলে আপনার সঙ্গে আমার কোন শত্ৰুতা নেই। আপনি কুটুম মানুষ, যখন খুশী তখন আসবেন। এতদিন ছাদ ছিল মাথাব ওপর এখন ছাতি বেছে নিলাম। সুবিধে হল এই ছাতির বাঁট আমার হাতেই ধরা থাকবে।

তাহলে সব সম্পত্তি নিজের নামে করে নেওয়া হল?

উপায় কি? আনা হাসল।

অমরনাথ উঠে দাঁড়ালেন। কেমন যেন অসহায় লাগছে নিজেকে। হঠাৎ তিনি প্রশ্নটা করলেন, তা এর জন্যে এত জল ঘোলা হল কেন? আমাকে না ডেকে প্রথম দিকেই তো নিজের নামে করে নেওয়া যেত।

বললাম যে, মেয়েমানুষের মন। আপনার মেয়েকে পুরো ঠেকাতে ইচ্ছে ছিল না। জানলে তিনিও সই করতেন না। এখনও আশালতা করে যাচ্ছেন। কিন্তু যেই বুঝতে পারলাম। আপনার মেয়ে নখ দিয়েও এ বাড়ির বিষয় ছোবে না। তখন আর মনে হল না। ঠকাচ্ছি। পাঁচভূতের পেটে না গিয়ে আমিই ভোগ করি। আনা ঘুরে দাঁড়াল, কি খাবেন বলুন, চা না সরবৎ?

কিছু না। যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালেন অমরনাথ।

আর একটা কথা। আনা মৃদুস্বরে বলল। অমরনাথ থেমে গেলেন।

হরদেব আর আপনার মধ্যে পছন্দ করতে গেলে আমার মন প্রথম জনকে কখনই মেনে নিতে পারে না। তাই অপেক্ষা করছিলাম। তাই রাজী করেছিলাম ভাগ করে নিতে। এখন বুঝে গেছি গাছের পাখির থেকে হাতের পাখি ঢের ভাল।

অমরনাথ হন হন করে বেরিয়ে এলেন। নিজেকে খুব ক্ষুদ্র লাগছিল তাঁর। এবং সেই সঙ্গে কিঞ্চিৎ অসহায়। কোন নারী, সে দাসী অথবা মহারাণীই হোক তাঁকে কামনা করে হতাশ হয়ে এমন কাণ্ড করবে তা কখনও চিন্তায় ছিল না। যা হোক, খুব বড় ফাঁড়া কেটে গেল মনে করতে গিয়ে আর এক ধরনের হতাশ বোধ তাঁকে আচ্ছন্ন করছিল। এত বড় সম্পত্তি একেবারে হাতছাড়া হয়ে গেল?

গেটের কাছে পৌঁছেই শক্ত হলেন অমরনাথ। চুপিসানো মুখে হাসতে হাসতে হরদেব ঘোষাল আসছে। দুটো হাত মাথার ওপরে ঠেকিয়ে হরদেব বলল, নমস্কার অমরনাথবাবু, ধন্য আপনি। অমন আদর্শবতী কন্যার পিতা সবাই হতে পারে না।

মানে? অমরনাথ ফিস ফিস করলেন।

এক কথায় বলে দিল প্রতুলের সম্পত্তি সে ছুঁয়েও দেখবে না।

আপনার সঙ্গে করে কথা হল? গতকাল। মাঝখানে একবার হোস্টেলে যেতে বলেছিল। আমি যাইনি। কি দরকার! আপনিও নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু আনু যখন বলল আমাকে তার প্রয়োজন তখন দেখা করতে গেলাম। সব বললাম।

বললেন?

হ্যাঁ। আমি মিথ্যাচার করতে পারব না। তবে ওই ব্যাঙ্কের টাকার কথা বলিনি। তা সে বলল প্রতুল। যদি লিখেও দেয়। তবুও নেবে না। আমার কাজ হয়ে গেল। কাল রাত্রে দুজনে বসে সব ঠিক করে নিয়েছি। আজ প্রতুল সই করযে, আমি সাক্ষী হব। তারপরেই সমস্ত সম্পত্তি আনুর নামে কোর্টে আইনসম্মত করিয়ে নেব। এটা ঠিক, আনু যা করেছে সব তো তারই পাওনা  হরদেব হাসলেন।

আনু?

আনা। প্রতুল তো আদর করে আনু ডাকত। বুনো বেড়াল।

আর তখনই দূরে বাড়ির ভেতর থেকে উচ্চস্বরে কান্না ভেসে এল। হরদেব চমকে উঠল, আনুর গলা! কি হল? প্রতুল টেসে গেল? সর্বনাশ। উইল তো এখনও সই কাবানো হয়নি। পড়ি কি মারি করে হরদেব ছুটল বাড়ির দিকে। অমরনাথ আর যেতে পারলেন না। বুক থেকে না উঠলে এমন কান্না মানুষ কাঁদতে পারে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *