1 of 2

৩০. এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা

এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা এতকালের চেনাজানা মানুষ এবং তাদের আচরণে যে অভ্যাস তৈরি হয়েছিল তার সঙ্গে কোন সাযুজ্য নেই গ্লোরিয়ার আচরণে। এতকাল দীপার মনে হত বাঙালি মেয়ে হিসেরে এত অল্প বয়সে সে এমন অনেক কাজ করেছে যা সাধারণ নিয়মের মধ্যে পড়ে না। স্বাধীনতার দশ বারো বছর পরেও মেয়েরা শুধু মেনে নিয়ে বেঁচে থাকতেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। অনেক ব্যাপারে জিভে কেন শব্দটি উঠে এলেও তারা সেটাকে গিলে ফেলতে পারলে বেঁচে যায়। মাঝে মাঝে এই ধারণাও তীব্র হয়েছে যে মেয়েদের বড় শত্ৰু হল মেয়েরাই। নলিনী কিংবা আনা জানত কি জন্যে তাকে ওই বয়সে বউ করে আনছেন প্রতুলবাবু। তারা এও জানত অতুলচন্দ্রের স্বাস্থ্য কি রকম সুস্থ। তবু তারা প্ৰতিবাদ করেননি। নিজের স্বার্থে আনা তার উপকার করেছে, মেয়ে হিসেরে আর একটি মেয়েকে সম্মান জানাতে নব্য। মনোরমা তার ওপর বৈধব্যের নিয়মাবলী চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সে প্রতিবাদ করেছিল পারে কিন্তু প্ৰাথমিক অবস্থায় মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। সে বিধবার মত জীবন যাপন করুক তা অন্তত অমরনাথ মুখ ফুটে। কখনও বলেননি। অঞ্জলিও মনোরমাকে বোঝাতে এগিয়ে যাননি। সে নিজে পটু একটু করে যখন ওইসব নিয়মের পাঁচিল ভেঙে স্বাভাবিক হয়েছিল তখন চা-বাগানের বিভিন্ন কোয়ার্টার্সের বয়স্করা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলতেন এই নিয়ে। রমলা সেন ব্যতিক্রম। তিনি ঔদ্ধত্য এবং স্বাধীনতা একসঙ্গে ব্যবহার করছেন। এখন মনে হয় তাঁর অনেক কাজের পেছনে কোন যুক্তি নেই। যেভাবে মাঝরাত্রে জঙ্গলের রাস্তায় তিনি অমরনাথের সাইকেলে চেপে অচেনা বাড়িতে এসে রাত কাটিয়েছিলেন সেটা কোন অবস্থাতেই সমর্থনযোগ্য নয়। একটা রাত গাড়ির মধ্যে কাটালে তাঁর যে ক্ষতি হত সেই একই ক্ষতি অচেনা লোকের সাইকেলে উঠলেও হতে পারত। কলকাতায় এসে বাসাবাড়িতে ওঠার পর যে মেয়েটির সঙ্গে তার আলাপ হয়েছিল। সে কিছুটা স্বাধীনতার সুযোগ চুরি করে নিয়েছিল। সিনেমা এবং লুকিয়ে-চুবিয়ে ছেলেদের সঙ্গে মেশার মধ্যে সেই স্বাধীনতার আনন্দ উপভোগ করে তৃপ্তি প্ৰায় সে। কিন্তু তার বাইরে এই কলকাতার মেয়েরা এখনও পদপ্ৰিথায় বিশ্বাস করে। রিকশায় উঠেই মধ্যবয়সী মহিলারাত পদ ফেলে দেন সামনে। মিজাপুর স্ট্রিটে উল্টোদিকের বাড়িতে এক মহিলা সারা দুপুর খড়খডি ফাঁক করে রাস্তা দেখতেন, জানলা খুলে দেবার সাহস তার ছিল না মাঝে মাঝে মনে হয় সাহস নয়, সংস্কারে জড়ানো মন প্রতিটি পায়ে আটকে যায়। এই যে অভিভাবকরা ছাতা মাথায় করে কলেজে ছাত্রী পৌঁছে দিচ্ছেন, ছেলে হলে দিতেন না। হয় তাঁরা মেয়েটিকে সাবালিকা ভাবেন না অথবা সাবালিকা ভাবেন বলেই ভয় করেন। যেন পৃথিবীর সমস্ত পুরুষ তাঁর মেয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে একা পেলেই এবং সেই ননীর পুতুল তাদের হাতে নিজেকে তুলে দেবে। অথবা এমনও হতে পারে ঐরা নিজেদের মেয়েকেই সন্দেহ করেন যেন ফাঁক পেলেই মেয়েটি কোন গৰ্হিত কর্ম করতে ছটফট করবে।

হ্যাঁ, ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে কিন্তু এখনও তার চোখে পড়েনি। বাসে ট্রামে তার বয়সী। মেয়ে একা ঘোরে না। সে শুনেছে ঘটিদের বাড়িতে নাকি এ ব্যাপারে আরও কড়াকড়ি। সেখানে দাদার বন্ধুদের দিকেও চোখ তুলে তাকানো নিষেধ। মা মাসি না থাকলে সিনেমায় যাওয়ার কথা কেউ ভাবতে পরে না। এখন অবশ্য বারোতে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয় না। কিন্তু এদেশের নব্ববুইভাগ মেয়ে কুড়িতে পড়তে না পড়তেই কোনরকমে শ্বশুরবাড়িতে চলে যায়।

প্রথম রাতে গ্লোরিয়ার সঙ্গে কথা বলতে বেশ অসুবিধেয় পড়েছিল দীপা। ইংরেজি বলার একদম অভ্যোস নেই, তার লিখতে আটকায় না। তার ওপর গ্লোরিয়ার কথা বলার ধরন একদম অন্যরকম, একটু জড়ানো আর উচ্চারণও আলাদা। কর্তার পর ক্রিয়া এবং তার কাল নিয়ে মোটেই মাথা ঘামায় না সে। মাঝে মাঝে কতা ব্যবহার না করে দু-তিনটি শব্দে মনের কথা বোঝায়। বিছানাপত্ৰ সাজিয়ে জুতো খুলে বিছানায় বাবু হয়ে বসতেই ওর কাছে আর দুটি মেয়ে এসেছিল। তিনজনই লিভিংস্টোন নামে একটা শহরে থাকত। নিজেদের মধ্যে চিৎকার চেঁচামেচি হাসােহাঁসি করল ঘণ্টাখানেক। গ্লোরিয়া তার সঙ্গে ওদের আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। যে মেয়েটির নাম লুসাকা সে বলল, ইওর নেম বিউতিফুল।ারিয়া তাকে দীপাবলী শব্দটির অর্থ বুঝিয়ে দিয়েছিল। দীপা জানতে চাইল লুসাকা শব্দটির মানে কি? মেয়েটা হেসে গড়িয়ে পড়ল। তারপর হাত নাড়তে নাড়তে বলল, আমি জানি না। আসলে জাম্বিয়াতে একটা শহর আছে যার নাম লুসাকা। আমার মা সেই শহরের মেয়ে। তাই আমার নাম রেখেছিল লুসাকা।

এই সময় গ্লোরিয়া একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করল। করে প্রথমে দীপার দিকে সেটা এগিয়ে ধরল। দীপা মাথা নাড়ল, আমি সিগারেট খাই না।

গুড গার্ল। আমার মনে হয় ইন্ডিয়ান মেয়েরাই সিগারেট খায় না। গ্লোরিয়া বন্ধুদের মধ্যে সিগারেট বিতরণ করে নিজেরটা ধরাল, কেন বলতো?

কোন বিশেষ কারণ নেই। ব্যাপারটা চালু হয়নি তাই।

এইসময় লুসাকা বলল, কিন্তু আমি দিল্লী স্টেশনে একটা মেয়ে ভিখিরিকে সিগারেট খেতে দেখেছি। হ্যান্ডমেড সিগারেট।

গ্লোরিয়া অবাক হল, তাই? তুমি শিয়োর যে মেয়েটা ভারতীয়?

নিশ্চয়ই। দিল্লীর স্টেশনে কি বিদেশী মেয়ে ভিখিরি ভিক্ষা করবে?

দীপা বলল, এটা হতে পারে। এদেশের একদম নীচুতলার বিত্তহীন মেয়েদের মধ্যে সিগারেট বিড়ি খাওয়ার রেওয়াজ আছে।

তৃতীয় মেয়েটি যার নাম খুব খটমটে, হেসে বলল, দিল্লীতে একটা একজিবিশনে আমি তিনশ বছর আগের এক রেসপেক্টবল ইন্ডিয়ান লেডির ছবি দেখেছি। যিনি স্মোক করছিলেন পাইপের সাহায্যে। লম্বা পাকানো পাইপ।

গ্লোরিয়া দীপাকে জিজ্ঞাসা করল, তাহলে তোমার ব্যাখ্যায় গোলমাল থাকছে। বাড়িতে ফুলের যদি চোখের সামনে সিগারেট খায়, প্যাকেট টেবিলে ফেলে রাখে, কলেজে ছেলেরা যদি একসঙ্গে আড্ডা মারতে মারতে সিগারেট ধরায় মেয়েরা কি হাত গুটিয়ে থাকবে? ফিফটি পার্সেন্টের হয়তো সিগারেটের টেস্ট খারাপ লাগে বলে খায় না। কিন্তু বাকিরা? সিগারেট খেলে মেজাজ ভাল হয় না?

দীপা তখন বোঝাতে বসল। এদেশে বড়দের সামনে ছোটরা সিগারেট ধরায় না। কারণ তারা মনে করে নেশার জিনিস বড়দের সামনে খাওয়া অভদ্রতা।

নেশার জিনিস? কথার মাঝখানে বাধা দিল গ্লোরিয়া। সিগারেট খেলে কি নেশা হয়? মাথা ঘোরে? পা টিলে? কথা জড়িয়ে যায়?

যায় না। কিন্তু এদেশের ছেলেরা কোন যুক্তি ছাড়াই বড়দের সামনে খায় না। আর মেয়েরা তো ভাবতেই পারে না খাবার কথা। যেসব মেয়ে খায় তাদের হয় নিচু শ্রেণীর বলে উপেক্ষা করা হয় না বন্দচরিত্রের বলে এড়িয়ে যায়।

লুসাকা চেঁচিয়ে উঠল, গুড গড! তাহলে কি আমাদের সিগারেট খেতে দেখে তুমি খুব খারাপ ভাবছ?

দীপা ওর কথা বলার ধরনে হেসে ফেলল, আমার কিছুই মনে হচ্ছে না। তবে এই হোস্টেলের কি নিয়ম আমি জানি না রাস্তায্য যদি সিগারেট খাও তাহলে লোকে ফিরে ফিরে তাকরে। অবশ্য বিদেশী বলে তোমরা কিছুটা ছাড় পেতে পার।

গ্লোরিয়া বলল, এটা খুব ফালতু ব্যাপার। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি খুব বাস্তব মেয়ে। তুমি কেন সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা কর না। আমাদের দেশে এখনও পড়াশুনার চল বেশী হয়নি। বেশীরভাগ মানুষই দাবিদ্র্যসীমার নিচে। কিন্তু তারাত অযৌক্তিক কিছু আঁকড়ে বসে থাকে না।

দীপা বলল, তোমাদের দশ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। শুধু শুনেছি আফ্রিকার মানুষ বা মানুষের মাংস খেত।

তিনটে মেয়ে একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল। খটমটে নামের মেয়েটি একটুরেগে গিয়ে বলল, তোমার কি আমাদের দেখে ক্যানিবাল বলে মনে হচ্ছে?

দীপা লজ্জা পেল, আমি বলেছি। এমন ঘটনা শুনেছি।

গ্লোরিয়া বলল, খুব মিথ্যে শোননি। একসময় জঙ্গলে এই ধরনের কিছু আদিবাসী ছিল। এখন সেটা ভাবাই যায় না। তাছাডা আফ্রিকা একটা বিশাল মহাদেশ। মরোকো আলজেরিয়া থেকে সাউথ আফ্রিকার কেপ প্ৰভিন্স পর্যন্ত গাদা গাদা দেশ। আচার ব্যবহারে জীবনযাত্রায় প্রচুর পার্থক্য। তাই আফ্রিকার মানুষকে তুমি একই চেহারায় ফেলতে পার না।

রাত্রে দীপা ওদের সঙ্গে খেতে নামল। সে লক্ষ্য করল অন্য বাঙালি মেয়েরা তার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছে। তিনটে জাম্বিয়ান মেয়ের সঙ্গে তার কি করে ভাব হল এমন প্রশ্ন সবার মনে। একজন মন্তব্য করল, উরিকবাস, কি কালো, অন্ধকারে খালি গায়ে হেঁটে গেলে বোঝাই যাবে না কেউ যাচ্ছে।

আর একজন মন্তব্য করল, কালো মেমসাহেবের সঙ্গে একজন ভিড়ে গেছে। বাকবাঃ, আমি মরে গেলেও ওদের সঙ্গে একঘরে থাকতে পারব না।

খাওয়ার টেবিলে বসে লুসাকা ঝুঁকে পড়ে দীপাকে জিজ্ঞাসা করল, ওরা কি আমাদের সম্পর্কে কিছু বলছে?

দীপা অস্বস্তিতে পড়ল। দূরের মেয়েগ্রেগুলোর দিকে তাকাল সে। তারপর গলা তুলে জিজ্ঞাসা করল, শোন, এরা জিজ্ঞাসা করছে তোমরা কি এদের নিয়ে কিছু আলোচনা করছ? কি জবাব দের বলে দাও।

দুটো মেয়ে একই সঙ্গে মাথা নামিয়ে খেতে লাগল। দীপা মাথা নাড়ল, না। ওরা কোন জবাব দিল না।

ভাত ডাল তরকারি। আর মাছ খেতে তিনজনের খুব অসুবিধে হচ্ছিল। হাতে করে খেতে পারবে না বলে চামচ চেয়ে নিল তিনজনেই। কিন্তু খাওয়ার শেষে অর্ধেক খাবারই পড়ে রইল। গ্লোরিয়া বলল, প্ৰথমবার তো, দিন তিনেকের মধ্যেই এই খাবার অভ্যোস করে ফেলব।

লুসাকা বলল, আমার গলা পেট জ্বলছে। প্রচুর মশলা। আমাদের সুপারের সঙ্গে কথা বলা উচিত। ওরা তো আমাদের সেদ্ধ খাবার দিতে পারে।

খটমটে নামের মেয়েটি বলল, না না এখনই নয়। গ্লোরিয়া ঠিকই বলেছে, আগে চেষ্টা করা যাক এই খাবার অভ্যেসে আসে কি না। না পারলে দেখা যাবে। যখন রোমে এসেছ তখন রোমানদের মত বিহেভ কর।

দীপা হেসে ফেলল। লুসাকা জিজ্ঞাসা করল, তুমি হাসছ কেন?

দীপা জবাব দিল, তাহলে তোমাদের শাড়ি পরতে হয়। আর প্রকাশ্যে সিগারেট খাওয়াও চলবে না।

গ্লোরিয়া হেসে বলল, আমি যেদিন শাড়ি পরব সেদিন সিগারেট খাব না, প্ৰমিস। শুধু তোমাকে কপি করে যাব সেইদিন।

শুভরাত্রি জানিয়ে মেয়েরা চলে গেল নিজেদের ঘরে। নিজের টেবিলে বসে দীপা ভােবল বাবাকে প্ৰথম দিনের ঘটনা জানিয়ে চিঠি লিখবে। হঠাৎ তার চোখে পড়ল গ্লোরিয়ার ওপরে। একটানে ওপরের জামা খুলে বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে ফ্যানের রেগুলেটার বাড়িয়ে দিল গ্লোরিয়া। হকচকিয়ে গেল দীপা আজ পর্যন্ত কোন মেয়েকে নগ্ন শরীরে শুধু ব্ৰা পরা অবস্থায় দেখেনি সে। ওই অবস্থায় কিছু গোছগাছ করছে গ্লোরিয়া। দীপা চোখ বন্ধ করল। গ্লোরিয়া বলছিল, আমরা ভাবতাম। ক্যালকাটাতে বেশ ঠাণ্ডা পড়ে। একগাদা গরম জামাকাপড় মিছিমিছি বয়ে আনলাম।

দীপা চোখ বন্ধ করল। এটা কি স্বাভাবিক আচরণ? সে কি ওইভাবে দাঁড়াতে পারত? নিজের কাছে উত্তরটা স্পষ্ট কিন্তু তবু তো গ্লোরিয়াকে খারাপ মনে হচ্ছে না। কোনরকম আড়ষ্টতা নেই, সঙ্কোচ নেই। আচ্ছা, নিজের মনে যদি কোন পাপবোধ না থাকলে তাহলে সেই কাজটা কি অন্যায় নয়?

প্রায় সেমিজের মত অথচ কাঁধে সরু স্ট্র্যাপের একটা জামা যার প্রান্ত হাঁটু পর্যন্ত পৌঁছেছে, শরীরে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল গ্লোরিয়া। বিছানায় মাথা রেখে বলল, তুমি মর্নিং ওয়াক করো?

দীপা মাথা নাড়ল, না।

কিন্তু করা উচিত। শরীর ভাল থাকে, মন আরও ভাল হয়ে যায়। তাছাড়া খুব ভোরে পৃথিবীর বেশীরভাগ মানুষের মন প্যাঁচালো হয় না। যেসব জায়গায় প্রচুর বদনাম আছে যেখানে দিনের বেলায় কোন মেয়ে নিশ্চিন্তে হাঁটতে পারে না। সেখানে সকাল হবার সময়টায় যদি হাঁটো তাহলে ঝামেলা হবে না। কারণ বদমায়েসী করার জন্য মানুষের মন তখনও তৈরি হয় না। আমার ভোরে ওঠার অভ্যোস আছে। তোমাকে ডাকব?

ডেকো। দীপা বড় আলো নিবিয়ে টেবিল ল্যাম্প জ্বালল।

গ্লোরিয়া জিজ্ঞাসা করল, কি লিখছ তুমি?

চিঠি।

বয়ফ্রেন্ডকে?

দীপা হাসল, আমার বাবাকে।

বাবা? শব্দটি মৃদু স্বরে উচ্চারণ করল গ্লোরিয়া, তোমার বাবাকে খুব ভালবাসো তুমি? প্রশ্ন কানে যেতে দীপা মুখ ফিরিয়ে দেখল। টেবিল ল্যাম্পের আলো ঘরের ওদিকে যাচ্ছে না। প্ৰায়ান্ধকারে মিশে আছে গ্লোরিয়া বিছানায়। চট করে জবাব দিতে পারল না দীপা। সে কি অমরনাথকে ভালবাসে? ভালবাসা কাকে বলে? সে যেদিন স্কুল ফাইন্যাল পাস করেছিল সেদিন চা-বাগানের স্কুলের মাঠে অমরনাথ অনেক ছেলেমেয়ে মাস্টার মশাইদের সামনে তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠেছিলেন। কেন! যে অমরনাথ প্ৰায় ঘাড় থেকে নামানোর জন্যে বালিকা অবস্থায় তার বিয়ে দিয়েছিলেন তিনি কেন কাঁদবেন? তার রুচি এবং মনের গড়ন বুঝেও প্রতুলবাবুর হাত থেকে তার জন্যেই টাকা নিতে যে লোকটা দ্বিধা করেনি, ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর যার সঙ্গে সে কথা বন্ধ করে দিয়েছিল, নিজের অসুস্থ অবস্থাতেও সেই একই লোক কেন ব্যাঙ্ককে নির্দেশ দেবে কলকাতার হোস্টেলের ঠিকানায় টাকা পাঠাতে? অমরনাথের জন্যে মন কেমন করে উঠল। একেই কি ভালবাসা বলে? না। অবশ্যই নয়। চোখের সামনে কোন মানুষ দুর্ঘটনায় মারা গেলে মনে ব্যথা জমে, সেখানে ভালবাসা কোথায়? সত্যি, ভালবাসা করে কয়! দীপা মাথা নাড়ল, আমি জানি না। আমি এও জানি না ভালবাসা কাকে বলে?

গ্লোরিয়া মাথা তুলল, অদ্ভুত! তুমি বলতৃে চাইছ। এই বয়স পর্যন্ত কোন ছেলেকে তুমি ভালবাসনি? তোমার কোন বয়ফ্রেন্ড নেই?

দীপা মাথা নাড়ল, না।

অসম্ভব! তোমার মত সুন্দর দেখতে মেয়ে সম্পর্কে ছেলেরা উদাসীন থাকতে পারেই না। দীপাবলী, তুমি আমার কাছে সত্যি বলছি না।

গ্লোরিয়া, আমাদের দেশে বিয়ের আগে কোন ছেলেমেয়ের বন্ধুত্ব এখনও প্রকাশ্যে স্বীকৃতি পায় না। কোন অভিভাবক এটা করতে অনুমতি দেন না। আমি বললাম বন্ধুত্ব, আর তার বেশী এগিয়ে যেতে চাইলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হয়।

গ্লোরিয়া উঠে বসল, আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না। ভালবাসতে হলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে? কী রকম সংখ্যায় এমন ঘটনা ঘটে?

দশ হাজারে একজন মেয়ে সাহসী হলেও হতে পারে।

কিন্তু কেন?

আমাদের এখানে মেয়েরা বিয়ে করে না, তাদের বিয়ে দেওয়া হয়।

তার মানে তোমরা মন থেকে শরীরে পৌঁছাও না, একটা অজানা অচেনা লোকের সঙ্গে প্রথমেই শরীরের সম্পর্ক তৈরি করে মনে পৌঁছাতে চাও। তা সম্ভব?

এও আমি জানি না। সারা জীবন পাশাপাশি থেকেও হয়তো হুকুম মেনে চলাটাই এদেশের বিবাহিতা মেয়েরা দাম্পত্য জীবনযাপন করা বলে মনে করে।

গ্লোরিয়া ধীরে ধীরে শুয়ে পড়ল। দীপা আবার ঘুরে বসল। কলম খুলে সে লেখা শুরু করল, শ্ৰীচরণেষু বাবা, তোমার শরীর এখনও ভাল হয়নি বলে মামা বললেন। তুমি নিশ্চয়ই যত্নে আছ কিন্তু চিন্তাভাবনা করলে শুধু যত্নে শরীর সারবে না। আমার মনে হয় তুমি আমার জন্যেও চিন্তা করো। আমি বলি কি, আমি এখন অনেক বড় হয়েছি, আমার জন্যে দুশ্চিন্তা করার কোন কারণ নেই।

আমি স্কটিশচার্চ কলেজে ভর্তি হয়েছি তা তুমি জানো। আমার হোস্টেলের নাম ঠিকানা পেছনে দিলাম। মামাই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আজ এখানে আমার প্রথম রাত। আমার রুমমেট হিসেরে আছে আফ্রিকা মহাদেশের জাম্বিয়া বলে একটি দেশের মেয়ে। আমরা যাকে নিগ্রো বলি এ তাই। কিন্তু এত পরিষ্কার কথা এবং আচরণ যে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি। ওর গায়ের রঙ গাঢ় তামাটে, কথা বলে ইংরেজিতে। আমরা যেভাবে ইংরেজি বলতে এদেশে শুনেছি তা থেকে একটু আলাদা। একদম অজানা দেশে কোন মানুষের সঙ্গে এক ঘরে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা আমার এই প্ৰথম, তুমি জানো। কিন্তু অন্য মেয়েরা একে এড়িয়ে চললেও আমার শুধু কৌতূহল হচ্ছে। ক্লাস শুরু হবে। আগামী কাল। তুমি ভেবো না, আমি মন দিয়ে পড়াশুনা করব। মাকে আমার প্রণাম ভাইদের মেহ আর তোমাকে আমার—। দীপা কলম তুলল। ভক্তিপূৰ্ণ প্ৰণাম শব্দদুটি অভ্যেসে এসে যাচ্ছিল। সে গ্লোরিয়ার দিকে তাকাল। গ্লোরিয়া এখন চুপচাপ। হয় তো ঘুমিয়ে পড়েছে। ও জিজ্ঞাসা করেছিল বাবাকে ভালবাসে কি না। ভক্তিপূর্ণ প্ৰণামে কি ভালবাসা থাকে? দীপা ঠোঁট কামড়াল।

গত বছর থেকে আফ্রিকার কিছু দেশের সঙ্গে ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক আদান প্ৰদান প্ৰকল্পমতি ছেলেমেয়েরা এখানে পড়তে আসছে। সংখ্যায়। তারা খুব অল্প এবং তাদের মেলামেশার চৌহদ্দিটা খুবই সীমিত। গ্লোরিয়া তাদের ব্যতিক্রম। দীপা লক্ষ্য করছিল ওর মধ্যে কেমন একটা একরোখা ভঙ্গী আছে? কেন নয়? এই প্রশ্নটা শুধু মুখে বলে ক্ষান্ত হয় না, শরীরের ভঙ্গীতেও ফুটে ওঠে। প্রথম দিন ভোর চারটের সময় ঘুম ভাঙিয়েছিল বসে দীপার। একমাত্র পরীক্ষার আগে ছাড়া ওই সময়ে চোখ মেলাব অভ্যোস নেই। কিন্তু মেনে নিয়েছিল সে। শাড়ি পাল্টে চুল আচড়ে বেরুবার জন্যে তৈরী হতেই দেখতে পেল গ্লোরিয়া কেডস শর্টস আর জামা পরে তৈরী। সে আতকে উঠেছিল, এন্মা! গ্লোরিয়া অবাক হয়ে একান্ত বাঙালি শব্দটি শুনে জিজ্ঞাসা করেছিল, ওটার মানে কি?

তুমি কি ওই হাফ প্যান্ট পরে বাইরে বেরুবে?

হাফ প্যান্ট? এটা তো শর্টস। জগিং কিংবা দৌড়বার সময় সারা পৃথিবীর মেয়েরা পারে থাকে। তোমার নেই?

নাঃ। কিন্তু সবাই তোমার পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকবে।

থাকুক। মাই লেগস আর নট ব্যাড।

সত্যি এত ভাল পা দীপা কখনও দেখেনি। অবশ্য এদেশে বাঙালি মেয়েদের পা বারে। বছরের পর দেখা সম্ভবও নয়। সে নিজের পা বাথরুমেব বাইরে কোনদিন দেখেছে কি? আর বাথরুমের ভেতরেও পা দেখার কথা কখনও খেয়ালে থাকে? কিন্তু গ্লোরিয়ার পায়ের গড়ন এত চমৎকার, একটুও মেদ দেই, দীর্ঘ পা দুটি যেখানে যেমন হওয়া উচিত, মা কালীর পা থেকেও সুন্দর। দীপা ভেবেছিল বলে, তুমি ঠিক করেছিলে রোমে থাকতে হলে রোমানদের মত আচরণ করা উচিত। অতএর ওই বস্তুটি খুলে পায়ের পাতা ঢাকা প্যান্ট পরে বের হও কিন্তু সে কিছু বলেনি। এখন এই সময়ে রাস্তায় নিশ্চয়ই মানুষ নেই। গ্লোরিয়া যদি এতে স্বস্তি পায় পাক না।

মুশকিল হয়েছিল হোস্টেলের মেইন গেট নিয়ে। সেটি তালা মারা। সাধারণত আলো ফুটলে দারোয়ান চাবি বের করে। গ্লোরিয়া তালা দেখে জিজ্ঞাসা করল, গেটকিপার কোথায়? তাকে ডাকতে হবে।

দীপা একটা ঝামেলার গন্ধ পেল। সাড়ে চারটের সময় বেচারার ঘুম ভাঙালে সুপারের কাছে অভিযোগ পৌঁছাতে পারে। সে ডাকাডাকি করতে নিষেধ করল। গ্লোরিয়া জিজ্ঞাসা করল, কেন? আমরা কি গেট টপকে বাইরে যাব? মর্নিং ওয়াক করার রাইট আমাদের থাকবে না কেন?

দারোয়ানের দরজায় ধাক্কা দিয়ে সে ঘুম ভাঙিয়েছিল লোকটার। এমন অদ্ভুত পোশাকের মহিলার দর্শন পেয়ে লোকটা হতভম্ব। গ্লোরিয়া যা বলছে তা তার মাথায় ঢুকছে না। দীপা একটু পিছিয়ে ছিল। এবার এগিয়ে গিয়ে বুঝিয়ে বলল ব্যাপারটা।

লোকটা বলল, রাত নটার পর সুপারের পারমিশান ছাড়া দরজা খোলা নিষেধ?

দীপা বলল, ঠিক। কিন্তু এখন আর রাত কোথায়? দিন তো ফুটল বলে ৭ আর এই মেমসাহেবের সকালবেলায় না হাঁটলে শরীর খারাপ হয়।

কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে লোকটা দরজার তালা খুলেছিল। দীপা লক্ষ্য করেছিল তারা বাইরে বেরিয়ে আসামাত্র সে আবার তালা দিয়ে ভেতরে চলে গেল। এখনও অন্ধকার ফিকে হয়ে মাখামাখি কলকাতার শরীরে। গ্লোরিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছিল না দীপা। একেই সে অনেক লম্বা তারপর ক্ষিপ্ৰ পায়ে চটপট এগিয়ে যাচ্ছিল হাঁটার ভঙ্গিতেই। হেদুয়ার মুখে পৌঁছেই সে চিৎকার করে উঠল, আঃ দারুণ! ওর ভেতরে দৌড়ানো যাবে।

দীপা দেখল ওই সময়েও কিছু বৃদ্ধ প্ৰাতৰ্ভমণ করতে এসে হতভম্ব ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে পড়েছেন গ্লোরিয়াকে দেখে। গ্লোরিয়া তখন কোমরে হাত রেখে একই জায়গায় সোজা হয়ে লাফাচ্ছে। কুড়িবার লাফিয়ে গ্লোরিয়া থামল, চল দৌড়াই।

দীপা হাত নাড়ল, না। বাবা এই শাড়ি পুরে দৌড়তে পারব না।

তুমি কালকে শর্টস পরবে। আমার কাছে একটা নতুন আছে।

দীপা মনে মনে বলল, পাগল।

ওরা হেদুয়ার ভেতর ঢুকে পড়ল। পেছন পেছন বৃদ্ধরও আসছেন। তাঁদের সংখ্যা এখন বেড়েছে।

গ্লোরিয়া বলল, তুমি জোরে হাটো, আমি দৌড়াই। বলেই সে দৌড়তে লাগল। এখন অন্ধকার যাব যাব করছে। গ্লোরিয়ার শরীরটা একটা কালো চিতার মত ক্ষিপ্ৰ ভঙ্গীতে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে হেদুয়ায় বেড়াতে আসা কিছু মানুষ থমকে এবিব ছোেটা দেখতে আরম্ভ করল।

এক হাঁটতে আরম্ভ করতেই দীপার বেশ ভাল লাগল। অল্প হাওয়া বইছে। আকাশটা পরিষ্কার হচ্ছে। অনেক অনেক আগে চা-বাগানের এমন ভোরে সে বিছানা ছেড়ে উঠে শিউলি ফুল কুড়োতে ছুটে যেত। তখন কি আকাশ আরও উজ্জ্বল, আরও নীল থাকত! বয়সের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিও কি ঔজ্জ্বল্য হারায়। হঠাৎ পেছন থেকে গ্লোরিয়ার গলা ভেসে এল, হ্যারি আপ গার্ল, এক রাউণ্ড কমপ্লিট। পাশ কাটিয়ে সে ছুটে গেল। আবার। একটু একটু করে শরীরে ঝরঝরে ভাব এল দীপার। মন ভাল।

দুবার পাক খেয়ে দীপার পাশে এসে দাঁড়াল গ্লোরিয়া। এর মধ্যে বেশ ঘেমে গেছে সে। হেদুয়ায় সাঁতার কাটতে ক্লাব মেম্বাররা চলে এসেছে। সেদিকে তাকিয়ে গ্লোরিয়া বলল,–কস্ট্র্যম আনলে একটু সাঁতার কাটা যেত।

দীপা বলল, রক্ষে কর। তোমার এই পোশাক দেখার জন্যেই পেছনে দর্শক জমে গিয়েছে। গ্লোরিয়া পেছনে ফিরে লোকগুলোকে দেখল। তারপর হাসল, এদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কারণ এদের দাঁত নেই নখ নেই শুধু চোখ আছে। আমাকে কেউ যদি চোখ দিয়ে রেপ করে খুশি হয় আমি শুধু তাকে করুণা করতে পারি, তার বেশী কিছু না। পুরুষ মানুষ যে কত খারাপ হতে পারে তা আমার চেয়ে বেশী কেউ জানে না দীপাবলী।

 

কলেজে মায়ার সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেল দীপার। এত অকপট কথাবার্তা, খামোেকা লজ্জা না টেনে আনা, ছেলেদের সঙ্গে প্রকাশ্যে তুই তোকারি করে নিজের মতামত জানিয়ে দেওয়া-ও যেন পঞ্চাশ দশকের বাঙালি মেয়ে নয়। মায়া বলছিল, আমাদের দেশের মেয়ের এককালে স্বাধীনতা সংগ্ৰাম করেছে। মাতঙ্গিনী হাজরা, প্রীতিলতা ওয়াদার, এমন কত মহিলা। কিন্তু এখন চারপাশে তাকালে কেউ কি সেকথা বিশ্বাস করবে?

দীপা জবাব দিয়েছিল, যেসব ছেলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আড্ডা মারে, মেয়েদের সিটি দেয়, যেসব লোক ব্যাগ হাতে করে অফিসে কেরানিগিরি করতে যায় অথবা যে বাঙালিরা টাকা রোজগারের ধাক্কায় ছুটে বেড়াচ্ছে তাদের দেখে কেউ কি বলবে। একজন সুভাষচন্দ্র এদের মধ্যে থেকেই উঠে এসেছিলেন?

ওয়েল সেইড। মায়া ওর হাত চেপে ধরেছিল, আমি একচোখা হয়ে গিয়েছিলাম। আচ্ছা দীপা, তোমার এদেশের রাজনীতি সম্পর্কে কি ধারণা।

কোন ধারণা নেই।

তুমি কম্যুনিজম নিয়ে পড়াশুনা করেছ। কখনও?

না। সেই সুযোগ পাইনি

পড়তে চাও?

আপত্তি নেই।

আমি তোমাকে পড়তে দেব। আমি বিশ্বাস করি ভারতবর্ষের মানুষের স্বাধীনতা উনিশ শো সাতচল্লিশের পনেরোই আগস্ট হয়নি। একমাত্র কম্যুনিজমের আদর্শ এদেশে প্রতিষ্ঠা হলেই মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা আসবে।

কম্যুনিস্টরা দেশকে স্বাধীন করবে?

মানুষকে। তুমি আমাদের ইউনিয়ন অফিসে এসো না।

না মায়া, আমি রাজনীতিতে জড়াতে চাই না।

কিন্তু রাজনীতি ছাড়া কোন আধুনিক মানুষ বাঁচতে পারে না। ধব, তুমি কোন সৃষ্টি করতে চলেছ এবং তার জন্যে তোমার একটা অনুকুল পরিবেশ পাওয়া দরকার। স্বাথাম্বেষী কোন দল ক্ষমতায় থেকে সেই পরিবেশ তৈরী হতে দিচ্ছে না। তোমার সক্রিয় সমর্থনে কম্যুনিজম সেই পরিবেশ এনে দিতে পারে। অথাৎ মানুষ তার অধিকার অর্জন করতে পারে কম্যুনিজমের মাধ্যমেই।

এ নিয়ে তর্ক করা যায়। আমি কম্যুনিজমরিরোধী নই। তবে এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করেছিল মহাত্মা গান্ধীকে। কারণ কম্যুনিজমে বিশ্বাসীরা এদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে তেমন অংশ নেয়নি। কংগ্রেস খারাপ ভাবলে মানুষ তখন তার ডাকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসত না। মানুষ ভেবেছিল তাদের মুক্তি আসবে কংগ্রেসের মাধ্যমেই। রাজনীতি বড় গোলমেলে জিনিস, আমার এনিয়ে ভাবতে ভাল লাগে না। বরং মেয়ে হয়ে জন্মেছি বলেই আমার অনেক কিছু নিয়ে ভাবার আছে।

যেমন? মায়া উৎসুক হল।

আমরা এমন কিছু সংস্কার বা ধারণা নিয়ে যুগ যুগ ধরে জীবনযাপন করছি। যার পেছনে কোন যুক্তি নেই। আমি মফস্বলের মেয়ে সেখানকার পরিবেশে অনেক কিছু করা এখনও সম্ভব নয়। কিন্তু কলকাতার মত বড় শহরে সেটা কেন মানা হবে? এখানে তো কেউ কাউকে চেনে না, তাহলে লোকলজ্জা বাধা হয়ে দাঁড়াবে কেন?

তুমি কি ব্যাপারে কথা বলছি দীপাবলী?

মেয়েদের জীবনযাত্ৰা নিয়ে। কয়েকজন অভিভাবক প্ৰিন্সিপ্যালের কাছে অভিযোগ করলেন তাঁদের মেয়েদের বিরক্ত করা হয়েছে। প্ৰিন্সিপ্যাল সেই মেয়েদের ডেকে জানতে চাইলেন না কেন? তোমরা আবার সেইসব মেয়ের খোঁজ করতে এলে ইউনিয়ন থেকে। আর সব কিছুর ফল হল কয়েকজনের বিয়ে হয়ে গেল।

বিয়ে যেমন হল তেমনি কয়েকজন অভিভাবক ছাড়াই কলেজে আসার স্বাধীনতা পেল! পেল না? ইউনিয়ন থেকে আমরা কি করতে পারতাম?

কিছু না। অবহেলা করতে পারতে। কলেজে ছেলেমেয়েরা যে বেলোপ্লাপনা করতে আসে না, একটা ছেলের সঙ্গে দুটো কথা বললে যে চরিত্র নষ্ট হয়ে যায় না। এই বোধ অভিভাবকদের মনে সঞ্চারিত হবার আগে মেয়েদের মনে সেটা ঢোকানো উচিত। জানো, আমার রুমমেট গ্লোরিযা জাম্বিয়ার মেয়ে–

গ্লোরিয়াকে আমি চিনি। কলেজ স্পোর্টসে নাম দিয়েছে।

আমাদের জীবনের এইসব গল্প আর সমস্যা শুনে ও হতভম্ব হয়ে যায়। ব্যাপারটা যেন ওর মাথায় ঢুকতেই চায় না। কেউ এসে যদি আমাদের বলে সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। তাহলে তাকে যা মনে হবে ওরও যেন এইসব কথা শুনে তাই মনে হচ্ছে। অথচ জাম্বিয়া মোটেই উন্নত দেশ নয়। বিলেত ফ্রান্স নয়। ওদের দেশেও গরীব মানুষের সংখ্যা খুব বেশী। কিন্তু মোটা দাগের কতগুলো ব্যাপার ওরা ঝেড়ে ফেলেছে অনেক দিন।

মায়া চুপচাপ দীপার কথা শুনছিল এবার সে ঘড়ি দেখল, তুমি এখন কি করছ।

হোস্টেলে ফিরে যাব, কিছু তো করার নেই।

তাহলে আমার সঙ্গে চল। আটটার মধ্যে ফিরে আসবে।

রাজনীতির মধ্যে আমাকে টানবে না।

আর না না। আমি তোমাকে বুঝে গিয়েছি।

দীপা হেসে ফেলল। সে নিজেকেই এখনও বুঝতে পারল না। আর মায়া তাকে এত অল্প দেখে বুঝে গেল। কিন্তু মুখে কিছু বলল না।

হেদুয়ার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় উল্টো ফুট থেকে ডাক ভেসে এল, এই মায়া।

দীপা দেখল দুজন দাঁড়িয়ে আছে। একজনের পবনে পাজামা পাঞ্জাবি, গালে দাড়ি, কাঁধে কাপড়েব ব্যাগ। মায়া ওকে ইশারা করে রাস্তা পাব হল।

কি ব্যাপার? তুমি এখানে?

দাড়িওযাল ছেলেটি বলল, সুজয়েব কাছে এসেছিলাম। চা খাবে?

না। এর নাম দীপাবলী, আমাদের কলেজে এসেছে জলপাইগুড়ি থেকে, ওকে নিয়ে একবার বাড়িতে যাব। দীপা, আলাপ করিয়ে দিচ্ছি, শমিত, মণি কলেজে পড়ে। দাকণ নাটক করে। আমাদের একটা গ্রুপ আছে, মানে গুপটা নতুন ফর্ম করেছি, সুজয়ের লেখা নাটক শমিত পরিচালনা করছে।

সুজয় ছেলেটি ছিমছাম, বলল, একটু ভুল হল, আমি একটি বিদেশী নাটকের ভাবানুবাদ করেছিলাম, শমিত মেঝে ঘষে তার চেহারা পাল্টে দিয়েছে।

শমিত একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ দীপার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, একদিন আসুন না, আমাদের গ্রুপে। বুড়ো হাবড়া কেউ নেই, ভাল লাগবে।

দীপা হাসল শুধু। এরই মধ্যে পথচারিরা ঘুরে ঘুরে তাদের দেখে যাচ্ছে। মায়া ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাঁটা শুরু করল। দীপা জিজ্ঞাসা করল, তুমি ছেলেদের সঙ্গে নাটক করা নাকি?

হ্যাঁ। নাটক আমার সেকেন্ড লাভ। ফার্স্ট লাভ অবশ্যই রাজনীতি।

বাড়িতে কিছু বলে না?

কে বলবে? মা আর আমি, মা আমার বন্ধু।

আত্মীয়স্বজন?

আই ডোন্ট কেয়ার।

তুমি কি নাটক করে টাকা পাও?

দূর। আমরা যে থিয়েটার করছি তাতে ঘর থেকে পয়সা ঢালতে হয়। একি আর বোর্ডের নাটক! কিন্তু আমরা ভাল নাটক করতে চাই। শিল্পের জন্যে জীবন। এদেশের মানুষের রুচি নষ্ট হয়ে গিয়েছে একগাদা বাজে নাটক দেখে দেখে। আমরা এমন নাটক করতে চাই যাতে সততা থাকবে, যা দেখার পর মানুষ ভাববে। এই যে শমিতকে দেখলে, ওর প্রাণশক্তি খুব বেশী। ওর কাছে থাকলে একটা আলাদা উৎসাহ আপনা। আপনি তৈরী হয়ে যায়।

তার মানে তোমরা রাজনৈতিক নাটক করা?

না হে। মানুষের নাটক। মানুষের কথা।

একটা পুরনো বাড়িতে ওরা ঢুকল। বাড়িটির শরীর থেকে প্লাস্টার খসে খসে পড়ছে। বোঝাই যায় অনেকগুলো পরবার এখানে বাস করছে। মায়া হেসে বলল, দেড়শ বছরের বাড়ি, এরও বোধ হয়। আমাকে সহ্য হচ্ছে না, গা থেকে চুনবালি খসিয়ে ফেলছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *