না দেখলে ভাবতেই পারতেন না অমরনাথ একটি মানুষের চেহারা কয়েক বছরে এত পাল্টে যেতে পারে? প্রতুল বন্দোপাধ্যায় অবশ্যই অসুস্থ। কিন্তু তাঁর গলার স্বরও রুগ্ণ হয়ে গিয়েছে। গাল বসে গিয়েছে, চুলেও সাদা ছাপ পড়েছে।
হরদের ঘোষাল দরজা থেকে ফিরে এলেন, না আমার আর এখানে বসে থাকা ঠিক হবে না। তোমরা দুই বেয়াই অনেকদিন বাদে একসঙ্গে বসেছি। তোমরা মনেব কথা বল। আমি থাকলে নিশ্চয়ই অসুবিধে হবে। আমে দুধে মিশে যাক, আমি আঁটি কেটে পড়ি।
প্রতুলবাবু বললেন, বড্ড বাজে কথা বল। বযস হয়েছে অথচ—! হাত তুললেন তিনি বসো। বসো ওখানে।
হরদের যেন এমনটাই চাইছিলেন, হুকুম হওয়া মাত্র চট করে বসে পড়লেন, বাড়িটার কি অবস্থা! আহা, খাঁ খাঁ করছে।
অমরনাথ চুপচাপ বসেছিলেন। সকালের বাস ধরে তিনি এখানে পৌঁছেছেন সকাল দশটা নাগাদ। তাও প্ৰায় পনেরো মিনিট হয়ে গেল। হরদের ঘোষাল আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন বাইরের গেটে। তাঁর মারফত যোগাযোগ হয়েছে। যে বাড়িতে আর কখনও পা দেবেন না বলে তিনি স্থিব করেছিলেন সেই বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই একটা অস্বস্তি শুরু হয়ে গিয়েছিল। এখানে আসার ব্যাপারে তিনি কারো সঙ্গে কথা বলেননি। আসলে দীপার। পাসের খবর পাওয়ার পর থেকে কদিন যা শুক হয়েছে তাতে অঞ্জলির কাছেও ব্যাপারটা তোলা সম্ভব হয়নি। তিনি এসেছেন কৌতূহল নিয়ে। একটা মানুষের সবই যে খারাপ তা হতে পারে না। প্রতুলবাবু যদি নিজের ভুল বুঝতে পারেন তাহলে আখেরে দীপারই লাভ।
হরদেববাবু তাঁকে নিয়ে অফিসঘরে বসে খবর পাঠিয়েছিলেন নিজের নাম বলে। তারপর কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলেছিলেন, আপনি আসছেন সেটা কাল বলে গিয়েছি। এখন আপনার নাম বলে পাঠালাম না তার কারণ খবরটা তো আগে দাসীরাণী শুনবেন। অত্যন্ত ধড়িবাজ মেয়েছেলে। ঠিক বুঝতে পারবে। আর তারপরেই পাঁচ কাষতে শুরু করবে।
অমরনাথ কিছু বললেন না। সেই দাসীটির নাম আনা। এতদিন মনে মনে তাঁদের সমস্ত পরবার এই আনার কাছে কৃতজ্ঞ ছিল। ছিলই বা কেন, যা সে করেছে, যে স্বার্থেই করে থাক, মেয়েটা তো বেঁচে গিয়েছে। তিনি যদি সেই ঘটনার পরেও আজ এ বাড়িতে আসতে পারেন তাহলে আনাকে নিয়ে কোন বিরূপ মন্তব্য করার অধিকার তাঁর নেই।
প্রতুলবাবু এসেছিলেন মিনিট পনেরো বাদে। হাতে লাঠি। অফিসঘরে ঢুকে দুটো হাত কপালে ঠেকিয়ে বলেছিলেন, নমস্কার। আপনার মেয়ের খবর পেয়েছি। এত বড় একটা কৃতিত্বের অধিকারী আমাদের বাড়ির বউ হবে তা আমি কল্পনাও করিনি।
হরদের ঘোষাল বলেছিলেন, তোমাদের বাড়ির বউ মানে? সে অমরনাথবাবুর মেয়ে।
কিন্তু পরীক্ষার ফর্ম ভর্তি করার সময় কি নাম লিখেছিল? মানে কোন উপাধি? বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেনি? যতক্ষণ ওই বিয়ের বাঁধনে থাকবে ততক্ষণ বন্দোপাধ্যায় লিখতেই হবে। কি অমরনাথবাবু, ঠিক বলছি কিনা?
অমরনাথ নীরবে মাথা নেড়ে জানিয়েছিলেন কথাটা সত্যি। আর তারপরেই হরদের দরজার কাছে চলে গিয়ে ভান করেছিলেন চলে যাওয়ার।
প্রতুলবাবু মাটির দিকে তাকিয়ে ছিলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, অমরনাথবাবু, আমার বিরুদ্ধে আপনাদের নিশ্চয়ই অনেক অভিযোগ আছে। থাকাটাই স্বাভাবিক। না, আগে আপনাদের কথা শুনি। তারপরে আমার কথা বলব।
অমরনাথ বললেন, আমাদের কোন কথা নেই তো।
কোন অভিযোগ নেই?
না। আমরা আমাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছি।
পাপ?
হ্যাঁ। একটি বালিকাকে বড়লোকের বাড়িতে কোন খোঁজখবর না নিয়ে বিয়ে দিয়েছি নিতান্তই লোভে পড়ে। নিজের মেয়ে হলেও অনেক সময় সেই লোভ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। লোভ তো পাপাই। অমরনাথ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললেন।
আপনার কোন অভিযোগ নেই?
অমরনাথ প্রতুলবাবুর মুখের ওপর দৃষ্টি রাখলেন, আপনি কেন মেয়েটার এই সর্বনাশ করলেন? আপনি জানতেন যে ওই ছেলের আয়ু বেশী দিন নেই। তবু তাকে দিয়েই বংশরক্ষার অবাস্তব পরিকল্পনা করেছিলেন। আপনি। হরদেববাবুর কাছে শুনেছি আপনি তাকে ওষুধ ব্যবহার করতে দিয়েছেন। হয়তো সেটা খেয়েই তার মৃত্যু এগিয়ে এসেছিল। শুধু তাই নয়, আপনি সেই রাত্ৰে–
ওটা বানানো গল্প। আর যাই হোক আমি উন্মাদ নই। ওটা আনা বানিয়ে বলেছিল। যাতে বউমা আমার সম্পর্কে বেশী ভয় পায়। প্রথম প্রতিবাদ করলেন প্রতুলবাবু।
কিন্তু আপনি আমার বাড়িতে রাত কাটাতে চাননি পাছে ছেলের ব্যাপারটা ধরা পড়ে যায়। আমি মুর্থ আমি লোভী, কিন্তু মেয়েটা তো কোন দোষ করেনি!
প্রতুলবাবু বললেন, সত্যি কথা। এখন বলুন, এ জন্যে আমি কি প্ৰায়শ্চিত্ত করব?
মানে? অমরনাথের কপালে ভাঁজ পড়ল।
আমি যা করেছি। তার জন্যে আপনার মেয়ে বিধবা হয়েছে। এখন ও ব্যাপারে তো কিছু করার নেই। আমরা শুধু পারি ওর ভবিষ্যৎ যাতে সমস্যামুক্ত হয় তার ব্যবস্থা করতে।
হরদের ঘোষাল এতক্ষণ চুপ করে বসেছিলেন। এবার বললেন, আরে সবচেয়ে ভাল হয় সসম্মানে ঘরের বউকে ঘরে ফিরিয়ে এনে সুখে ঘর কর।
সুখে ঘর করা আর এ জীবনে হবে না হরদেব। যৌবনের প্রাবল্যে সব কিছু নস্যাৎ করেছিলাম। এখন তার মাশুল দিতে হচ্ছে। এ বাড়িতে বউমা ভাল থাকবে না। তাকে ভাল থাকতে দেওয়া হবে না।
একথা ভাবছ কেন? তোমার বাড়িতে একটা ছোট্ট মেয়ে এসেছিল। সে আজ কত বড় হয়ে গেছে। ফার্স্ট ডিভিসনে স্কুল ফাইন্যাল পাস করেছে। এ বাড়িতে এসে সে নিজের সুখ নিজে তৈরি করে নিতে পারে। তুমি হয়তো অনর্থক ভয় পাচ্ছি। হরদের খুব আন্তবিকভাবে কথাগুলো বললেন। নিঃশব্দে হাত নাড়লেন প্রতুলবাবু। তারপর হেসে বললেন, ঈষা, সন্দেহ, হিংসা মানুষকে যত ছোট করে দেয় অধিকার পাওয়ার পর সেটা হাতছাড়া না কবার চেষ্টান্য মানুষ অনেক নিচে নামে। আমি আমার নিজের জালে জড়িয়েছি।
অমরনাথ বললেন, আপনার শরীরে কি হয়েছে?
নানা রকম। সুগাব, ব্লাডপ্ৰেসাব, বুকের ব্যামো কি নেই? মাথাটা এখনও ঠিক আছে এই রক্ষে। তিন মাস কোন ব্যবসার কাজকর্ম করিনি। আর হবেও না। যা আছে তাতে মৃত্যু পর্যন্ত এইভাবেই থাকতে পারব প্রতুলবাবুর হাতের দশটা আঙুল পরস্পরকে আঁকড়ে ধবল।
তোমার পর? হরদের সরাসবি জানতে চাইলেন।
হ্যাঁ। একটা কিছু ব্যবস্থা করে যাওয়া উচিত। নইলে পাঁচ ভূতে লুটেপুটে খাবে।
পাঁচ ভূত না ওই এক পেত্নীই যথেষ্ট। হরদের বললেন, সত্যি কথা বল তো, আর অমরনাথবাবু সব কথা জানেন, ও কি তোমার সঙ্গে এক বিছানায় শোয়?
এসব কথা আলোচনা করতে ভাল লাগে না হরদেব। অমরনাথবাবু, বউমা অত ভাল পাস করল, এ জেলায্য ছেলেদের মধ্যেও যে দ্বিতীয় হয়েছে, ওর উচ্চ শিক্ষার কি ব্যবস্থা করলেন? চা-বাগানে তো আর কলেজ নেই। প্রতুলবাবু ফিরে তাকালেন।
সমস্যা এখানেই। আমার অবস্থা তো জানেনই। দু-দুটো ছেলে আছে, তাদের মানুষ করতে হবে। মাইনে যা পাই তাতে এখনও কোনমতে চলে যায়। ওকে পড়াতে গেলে হয় জলপাইগুড়ি নয় কলকাতায় পাঠাতে হয়। কলকাতার কথা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। শুনছি ও নাকি সবকার থেকে কিছু ভাতা পারে। স্কলারশিপ। তার কি পরিমাণ তাও জানি না! হয়তো কলেজের বেতন লাগবে না। কিন্তু থাকা-খাওয়ার জন্যেও তো অনেক খরচ।
এই খরচটা যদি আমি করি? আপনি কলকাতার বড় কলেজে ওকে ভর্তি করুন। যা নম্বর পেয়েছে সব কলেজই ওকে ডেকে নেবে। সেখানকার ভাল হোস্টেলে রেখে দিন। পড়াক। যদ্দূর পড়তে চায় পড়তে দিন। তারপর একদিন হয়তো নিজের পথ খুঁজে পারে। আর সেইটেই হবে। আমাদের প্রায়শ্চিত্ত।
অমরনাথ মাথা নাড়লেন, তা সম্ভব নয়।
কেন? প্রতুলবাবু অবাক হলেন।
আমার মেয়েকে আমি চিনি।
মেয়েটি আপনার শালিকার।
জন্ম সূত্রে। কিন্তু আমার দুই ছেলের থেকে সে কম নয়। দীপা যদি জানতে পারে আপনার টাকায় সে পড়াশুনা করছে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রোহ করবে। করছর আমার মা ওকে জোর করে বিধবা সাজিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু এখন সে ওসব মানতে চাইছে না। রঙিন শাড়ি পরছে, যে-কোন দিন মাছমাংস খাওয়া শুরু করবে।
এটা ঠিক নয়। হরদের ঘোষাল বলে উঠলেন, আপনার প্রতিরোধ করুন।
এতদিন করেছি। কতদিন পারব জানি না। সে আপনাদের ঘেন্না করে।
খুব স্বাভাবিক। প্রতুলবাবু চোখ বন্ধ করলেন। ঘরে নিস্তব্ধতা নেমে এল। একটু বাদে হরদের ঘোষাল বললেন, আমি বলি কি, তুমি একটা উইল কর। যদ্দিন জীবিত থাকবে তদ্দিন তুমি এসব সম্পত্তি ভোগ করবে। তোমার অবর্তমানে তোমার বউমা সব পারে।
প্রতুলবাবু বললেন, তুমি শুনলে না, বউমা আমাকে ঘেন্না করে। শুনুন অমরনাথবাবু, টাকাটা যদি আমি আপনার নামে পাঠাই। মানে, আমি যে পাঠাচ্ছি তা যদি বউমা টের না পায় তাহলে তো আর কোন ঝামেলা হবে না।
তা হবে না।
প্রতুলবাবু হাসলেন, তাহলে এই তঞ্চকতটুকু আমরা করি?
কিন্তু একটা সমস্যা হবে।
বলুন।
দীপা আমার আর্থিক পরিস্থিতির কথা জানে। কলকাতায় পড়তে পাঠাতে যে টাকা দরকার তা যে আমি দিতে পারব না একথাও তার অজানা নয়। সে তাই নিজে শিলিগুড়িতে পড়তে চেয়েছে। সেখানে আমাদের পরিচিতা এক অধ্যাপিকার বাড়িতে থেকে সে পড়তে চায়। এই অবস্থায় কলকাতায় পড়তে পাঠালে সে সন্দেহ করবে। মেয়ে তো খুব বুদ্ধিমতী। অমরনাথ সব কথা খুলে বললেন।
আপনি আমার এখানে এসেছেন সে জানে?
আজ্ঞে না।
ভাল। না, শিলিগুড়িতে পড়তে পাঠানোর দরকার নেই। পাঁচ ভূতের শহর, কোন ঐতিহ্য নেই। আপনি জলপাইগুড়ির কলেজেই ভর্তি করুন। হোস্টেলে রাখুন। আজ বাড়ি ফিরে বলবেন এস সি রায় মশাই ওর সব খরচ বহন করবেন।
এস সি রায়?
দুর মশাই। এস সি রায় হলেন ফাদার অফ টাউন।
তা জানি। কিন্তু—।
কিন্তু টিন্তু না। আমরা যখন দু হাতে পকেট ভরছি তখন রায়সাহেব ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে এই শহরে নানান জনহিতকর কাজ করে গিয়েছেন। শুধু স্পোর্টস নয়, কত গরীব মেধাবী ছাত্রকে পড়ার সুযোগ দিয়েছেন, চাকরির ব্যবস্থা করেছেন তার ঠিক নেই। আপনি ওঁর নাম ব্যবহার করবেন।
যদি কোনদিন দীপা রায়সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যায়?
ঘটনাটা আমি ওঁকে বলে রাখব।
প্রস্তাব মনঃপূত হল অমরনাথের। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি প্রতি মাসে ওর নামে মানি অর্ডার করবেন?
না। আমি ব্যাঙ্কে আপনার নামে পঞ্চাশ হাজার টাকা রাখব। প্ৰতি মাসে দুশো টাকা সুদ ওরা বউমার কাছে পাঠিয়ে দেবে।
দুশো টাকা মাসে? এত কি হবে? অমরনাথ চমকে উঠলেন।
অত লাগবে না বলছেন?
না, না। একশো টাকাতেই সব হয়ে যাবে ওর।
বেশ। তাই হবে। টাকাটা থাকবে ওর নামে। কিন্তু অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে ওর সই চাই। সেটা আপনি কোনভাবে করিয়ে নেবেন।
হরদের ঘোষাল বললেন, আপনার মেয়ে কি আইনের চোখে সাবালিকা হয়েছে?
অমরনাথ মাথা নাড়লেন, না। হরদের হাসলেন, তাহলে মেয়ের সঙ্গে নিজের নামটাও অ্যাকাউন্ট খোলার সময় দেবেন অমরনাথবাবু। নাবালিকার নামে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা যায় না। অভিভাবক চাই।
কথাবার্তা পাকা হয়ে গেল। প্রতুলবাবু বললেন, গ্লানি কিছুটা কমল মশাই। আপনি পাঁচটা টাকা দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলে নম্বরটা আমাকে জানিয়ে দেবেন। চিঠি লিখলে ইংরেজিতে লিখবেন। তাতে অন্য কেউ মাথা গলাবে না।
হরদের ঘোষাল জিজ্ঞাসা করলেন, সম্পত্তির বিলিব্যবস্থা কি করছ?
দেখি! প্ৰতুলবাবু আবার চোখ বন্ধ করলেন।
তুমি যদি ফটু করে চিতায় ওঠে তাহলে আইনত সম্পত্তি কে পাবে জানো?
যার কথা বলছি সে পেলে তো খুশিই হতাম। না অমরনাথবাবু, আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আপনি ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলবেন, আমাকে জানাবেন, তাতে অনেক সময় লাগবে –আমি আর অপেক্ষা করতে চাইছি না। আজই একটা পঞ্চাশ হাজার টাকার চেক আপনাকে দিচ্ছি, আপনি এ বাড়ি থেকে বেরিয়োeব্যাঙ্কে গিয়ে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে জমা দিয়ে দিন। ব্যাপারটা আজই চুকে যাক।
কিন্তু অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে দীপার সই লাগবে যে।
তা অবশ্য। আবার চিন্তিত হলেন প্রতুলবাবু, ঠিক আছে ব্যাঙ্ক থেকে আজ কাগজপত্ৰ নিয়ে যান, কাল মেয়েকে দিয়ে সই করিয়ে জমা দেবেন। একটু বসুন, আমি আসছি। লাঠিতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন প্রতুলবাবু! সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়ালেন হরদের ঘোষাল, হ্যান্ড শোক করুন মশাই।
না বুঝেই করমর্দন করলেন অমরনাথ। হরদের বললেন, এক কথায় পঞ্চাশ হাজার। এই তো সরে শুরু। আমার যা আন্দাজ তাতে প্রতুল অন্তত দশ-বিশ লক্ষ টাকার সম্পত্তি বানিয়েছে। হবে, সব হবে। জল যখন আপনার দিকে গড়াতে শুরু করেছে এক সময় টাকার বন্যায় ভেসে যাবেন মশাই। আমার কমিশন শতকরা দশ টাকা। এটুকু দয়া করে খেযালে রাখবেন তাহলেই চলবে।
কমিশন?
ওই দালালি যাকে বলে। ব্যবসার প্রথম নিয়ম হল একটা ভাল দালাল যোগাড় কর যে তোমার জন্যে ব্যবসা আনবে যার বিনিময়ে তুমি তাকে সন্তুষ্ট রাখবে। এ তো এক ধরনের ব্যবসা। পঞ্চাশের পাঁচ আমার রইল। না না তাড়াহুডো কিছু নেই। ধীরে-সুস্থেই দেবেন। তদিনে আমি দেখি আরও কয়েক লাখ বের করতে পারি কিনা।
প্রতুলবাবু যদি জানতে পারেন?
দুর মশাই, টাকা পয়সা হল যতক্ষণ পকেটে থাকে ততক্ষণ আমার। পকেট বদল হলেই আমি কে? প্রতুলের খেয়েদেয়ে কাজ নেই যে খোঁজখবর করতে যাবে।
এই সময় প্রতুলবাবু ফিরে এলেন। পাঞ্জাবির পকেট থেকে চেকবই বের করে অনেক সময় নিয়ে লিখে নিজের নাম সই করলেন। হরদের বললেন, আর একটা সই করে দাও প্রতুল, তোমার হাত কাঁপছে। প্রতুলবাবু মাথা নাড়লেন। তারপর দ্বিতীয় সইটি করলেন। চেকের পাতা ছিঁড়ে অমরনাথের দিকে এগিয়ে ধরে বললেন, গ্রহণ করুন– ।
অমরনাথ চেক নিলেন, পে টু দীপাবলী বন্দ্যোপাধ্যায় অ্যান্ড অমরনাথ মুখোপাধ্যায়। পঞ্চাশ হাজার টাকা। এ জীবনে এত টাকা একসঙ্গে দ্যাখেননি অমরনাথ। তাঁর সমস্ত শরীরে কাঁপুনি এল। জিভ শুকিয়ে গেল। পাঁচ এবং তার পাশের চারটে শূন্য বিশাল হয়ে গেল আচমকা। অমরনাথের কপালে ঘাম জমল। তাঁর দশ বছরের মাইনে। এটা যদি হারিয়ে যায়? অবশ্য এককোণে অ্যাকাউন্ট পেয়ি কথা দুটো লিখে দিয়েছেন প্রতুলবাবু। যে কেউ চট করে ব্যাঙ্কে গিয়ে ভাঙ্গাতে পারবে না। তিনি সন্তর্পণে চেকটা পকেটে পুরলেন।
প্রতুলবাবু বললেন, এ বাড়িতে এসে কিছু না খেয়ে চলে যাবেন এটা আমার ভাল লাগল না। সরবত আসছে। সেটা খেয়ে যান।
হরদের বললেন, সরবত? আমাকে তো তিনি কখনও সরবত খাওয়ান না।
কুটুম এসেছেন বাড়িতে হরদেব। তাই না?
তাহলে তো খবর পৌঁছেছে।
দরজায় ছায়া পড়ল। একটু শব্দ। তারপর অল্প বয়সী একটি কাজের মেয়ে ট্রে নিয়ে ঢুকাল। দুজনের হাতে সরবতের গ্লাস তুলে দিয়ে মেয়েটি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। প্রতুলবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, কি রে, কিছু বলবি?
হুঁ। উনি কি দুপুরে ভাত খাবেন? মেয়েটি মুখ নামিয়েই জিজ্ঞাসা করল।
না না। আমাকে এখনই বেরুতে হবে। অমরনাথের কথা শেষ হওয়ামাত্র মেয়েটি বেরিয়ে গেল। হরদের জিজ্ঞাসা করলেন, এটি আবার করে আমদানি হল?
দিন তিনেক। কাউকেও তো মাসখানেকের বেশী রাখে না।
হরদের হাসলেন, কেন জায়গা দখল হবার ভয়ে?
আঃ, হরদেব। বড্ড বাজে কথা বল তুমি। নিন, খেয়ে নিন। অমরনাথবাবু। এখন তো আর তেমন বাধা রইল না। জলপাইগুড়িতে যখন মেয়ে থাকবে তখন শহরে আসতেই হবে আপনাকে। মাঝে মাঝে দর্শন দিলে ভাল লাগবে। প্রতুলবাবু বললেন।
পঞ্চাশ হাজার টাকার চেক বুকে নিয়ে হাকিমপাড়ার রাস্তায় যখন অমরনাথ হাটছিলেন তখন হরদের ঘোষাল তাঁর পাশে ছিলেন। হরদের বলছিলেন, দোষগুণ মিশিয়েই তো মানুষ। প্রতুলের যদি ওই ব্যাপারটা না থাকত তাহলে এতদিনে মিনিস্টার হয়ে যেত।
কোন ব্যাপার?
ওই মেয়েছেলে সংক্রান্ত আকর্ষণ আর সন্দেহ। সেই সঙ্গে মানুষকে অবজ্ঞা করা। হরদের হাসলেন, নইলে আমরা জলপাইগুড়িতে আর একজন আলামোহন দাস পেয়ে যেতাম।
অমরনাথ কথা বললেন না। আলামোহন বা চিত্তরঞ্জন, তাঁর কিছু এসে যায় না। কিন্তু ওই ব্যাপারটা বলে যে তিনটে কারণ দেখালেন তা একটি সাধারণ মানুষেরও থ বলে সে খুব নীচ হয়ে যায়। প্রতুলবাবু অবশ্য বললেন তিনি কিছুটা গ্লানিমুক্ত হলেন পঞ্চাশ হাজার টাকার চেক দিয়ে। হয়তো যতটা নীচ ছিলেন ততটা আর রইলেন না। চেকটার কথা মাথায় আসতেই তাঁর খেয়াল হল হরদের এখনও পাশাপাশি হেঁটে চলেছেন। এখন তাঁরা কুলনাপুলের কাছে এসে গেছেন। এখান থেকে সোজা রাস্তা ধরে টাউন ক্লাবের মাঠ বাঁ দিকে রেখে কাছারির ঘাটে গিয়ে নৌকো ধরা যায়। তাঁকে দাঁড়াতে দেখে হরদের জিজ্ঞাসা করলেন, কি হল? যাবেন না?
কোথায়? অমরনাথের মনে হল লোকটাকে বিদায় করতে পারলে বাঁচেন।
ব্যাঙ্কে। সেখানে গিয়ে ফর্মটর্ম নিতে হবে। ফর্মে একজনের সুপারিশের প্রয়োজন হয়। ও নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমাদের পাড়ার একটা ছোকরা সেখানে কাজ করে। বললে সে সই করে দেবে। ব্যাঙ্ক থেকে আমাকে আবার শ্মশান কালী মন্দিরে যেতে হবে।
কালী মন্দির?
হ্যাঁ মশাই। মানত ছিল। যেদিন থেকে প্রতুলেব সাম্রাজ্যের ইট খসাতে মা সাহায্য করবেন সেদিনই সোয়া পাঁচ আনার পুজো দেব। ওই যাঃ, তাড়াহুড়োতে পয়সা না নিয়েই বেরিয়ে এসেছি। সোয়া পাঁচ আনাটা দিন তো। আপনারাই মঙ্গল হবে। হাত বাড়ালেন হরদেব। কেউ যখন মানত করে তখন পুজোর পয়সাটা আলাদা তুলে রাখে বলেই জানতেন অমরনাথ। কিন্তু আপাতত সোয়া পাঁচ আনা দিয়ে মুক্তি পেতে চাইলেন তিনি। পয়সাগুলো পকেটে পুবে ব্যস্ত হলেন হরদেব, চলুন চলুন বেলা বাড়ছে।
বাসুদেব বাসে বসে যখন আঙরাভাসা নদী পেরিয়ে এলেন অমরনাথ তখন দুপুর গড়িয়ে গিয়েছে। তাঁর সঙ্গে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলার ফর্ম, তাতে হরদেবের পরিচিত ছেলেটির সই কাবানো হয়েছে, কলেজে ভর্তি হবার ফর্ম এবং একটি পঞ্চাশ হাজার টাকার চেক। আচ্ছন্নের মত বসে ছিলেন তিনি। কাজটা কি রকম হল সেটা আর মাথায় আসছিল না। হরদের শ্মশান কালীর মন্দিরে যাওয়ার আগে পই পাই করে বলে দিয়েছেন আগামীকালই যেন তিনি এসে অ্যাকাউন্ট খুলে চেকটা জমা দেন। বেলা এগারোটা নাগাদ হরদের ব্যাঙ্কে থাকবেন। সেই সময় তিনি অমরনাথের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকার চেক নিয়ে নেবেন। তাঁর কমিশন। একথাও বলেছেন, পুরো সম্পত্তি আদায় করে আপনাকে দের মশাই। ওই জাঁহাবাজ মেয়েছেলেটাকে রাস্তায় বসাবো।
হরদেবকে আর পছন্দ হচ্ছে না। তিনি না থাকলেও এই টাকাটা প্রতুলবাবু তাঁদের দিতেন বলে অমরনাথের ধারণা। মাঝখান থেকে শকুনের মত উড়ে এসে জুড়ে বসেছে হরদেব। লোকটাকে কিভাবে কাটানো যায় তাও ঠাওর করতে পারছেন। পুরো সম্পত্তি যদি দশ-বিশ লাখেব হয়, হরদের যদি পুরোটাই এনে দিতে পারেন—। বড় নিঃশ্বাস ফেললেন অমরনাথ। তিনি কি লোভী হয়ে যাচ্ছেন!
বাস থেকে নেমে এপাশ ওপাশে তাকাতেই গাড়িটাকে দেখতে পেলেন অমরনাথ। তাঁর কোয়ার্টার্সের সামনে গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িতে চেপে তাঁর কাছে আসার কোন পরিচিত মানুষ নেই। সিঁড়ি পেরিয়ে মাঠে নামলেন তিনি। বারান্দায় উঠেই তিনি শুনতে পেলেন, অনেক আগেই আমার আসা উচিত ছিল। কিন্তু বয়স হচ্ছে তো! শরীরে একটা না একটা রোগ লেগেই থাকে। তা অমরনাথবাবুকে বলে আমি এসেছিলাম। দীপাবলীর ব্যাপারে কোন চিন্তা তোমাদের করতে হবে না। এত ভাল রেজাল্ট করেছে যে মেয়ে—।
এই সময় অঞ্জলি বলল, ওই তো উনি এসে গিয়েছেন।
অমরনাথ তখন দরজায়। বসার ঘরে রমলা সেনকে ঘিরে অঞ্জলি আর দীপা বসে আছে। মনোরমা সেখানে নেই। ছেলে দুটোর স্কুল থেকে ফেরার সময় হয়নি।
রমলা সেন দুই হাত জোড় করে বললেন, নমস্কার মশাই। মেয়ের গর্বে নিশ্চয়ই খুব গর্বিত। আরে, কি চেহারা হয়েছে আপনার? এত তাড়াতাড়ি চুলটুল পেকে গেল কেন? কি ভাই অঞ্জলি, যত্ন আত্তি করছ না কেন?
কি করব! অঞ্জলি হাসার চেষ্টা করল, দিনরাত শুধু ভবিষ্যতের চিন্তা করে। আর ওই দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর থেকেই শরীর ভাঙ্গছে।
অমরনাথ চেয়ারে বসলেন, তোমার কলেজে ভর্তি হবার ফর্ম এনেছি।
রমলা সেন মাথা নাড়লেন, ওমা, আমরা তো এর মধ্যে ঠিক করে ফেলেছি দীপাবলী শিলিগুড়ি কলেজে পড়বে। আমার কাছে থাকবে। কলেজে বাড়িতে আমিই থাকব, কোন চিন্তা নেই। আপনাদের।
হতভম্ব হয়ে গেলেন অমরনাথ। হয়তো আজ সকালে এই প্ৰস্তাব শুনলে তিনি খুব খুশি হতেন। কিন্তু দীপা কারো বাড়িতে থেকে কলেজে পড়ছে জানার পর প্রতুলবাবু কি—! তিনি গম্ভীর হয়ে বললেন, এত বড় ব্যাপারে তো এক কথায় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। আমি ভেবে দেখি।
রমলা সেনের মুখ গম্ভীর হল। অঞ্জলি বলল, এতে ভেবে দ্যাখ্যার কি আছে। উনি দীপাকে মেয়ের মত ভালবাসেন। এতদিন ধরে চিঠিতে উৎসাহ দিয়েছেন। ওঁর কাছে থাকলে মেয়ে আরও ঠিক থাকবে।
রমলা বললেন, না, না। আমার কাছে না থাকলে দীপাবলী যে ঠিক থাকবে না এটা বললে ওকে অসম্মান করা হবে।
অমরনাথ বললেন, আমি যখন বলছি ভাবতে হবে তখন নিশ্চয়ই তার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। আপনারা গল্প করুন। আমার মান-খাওয়া কিছু হয়নি। অমরনাথ মাথা নেড়ে চেয়ার ছেড়ে ভেতরে চলে এলেন। তাঁর সামনে এখন মনোরমা। তিনি ভেতরে, ঘরের খাটের ওপর বসেছিলেন। ছেলেকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়েছেন, বউমার কোনদিন আকেল হবে না। চাপা গলায় বললেন মনোরমা, তুই যে এক কথায় রাজী হয়ে যাসনি এটা ভগবানের আশীর্বাদ। ওর কাছে থাকলে তো দীপা ম্লেচ্ছপনা শিখবে।
অমরনাথ জবাব না দিয়ে আলমারির কাছে চলে গেলেন। যথারীতি পাল্লা খোলা। শুধু লকারে তালা বন্ধ করে চাবিটা পাশেই রাখা আছে। অমরনাথ লকার খুলে চেক এবং ব্যাঙ্কের ফর্ম রেখে দিলেন। তার পরেই কি ভেবে ব্যাঙ্কের ফর্ম বের করে নিয়ে কলেজেব ফর্মের সঙ্গে রাখলেন। এই সময় অঞ্জলি ঘরে এল। তাকে দেখে মনোরমা ভেতরে চলে গেলেন। অঞ্জলি সেদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে?
অমরনাথ জবাব দিলেন না। অঞ্জলি বলল, তুমি ওভাবে চলে এলে কেন?
অমরনাথ বললেন, খুব খিদে পেয়েছে। স্নানও করতে হবে।
তাহলে লকার খুলে কি করছ।
জরুরী কিছু রাখছি। অমরনাথ জামা খুলতে খুলতে বললেন, তোমার সঙ্গে কথা আছে। প্রাইভেট। তুমি রান্নাঘরে খাবার দিয়েই চলে এস না।
উনি বাইরের ঘরে বসে কথা বলছেন।
আশ্চর্য। প্রথম যেদিন এসেছিলেন সেদিন মুখ গোমড়া করে ছিলে। অমরনাথ বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বললেন, খাবার দাও।
বাইরের ঘরে বসে রমলা সেন বললেন, আমি তোমাকে কোন সাজেশন দের না। সায়েন্স নেবে কিনা তুমিই ঠিক করবে। তবে যাই নাও মনে রেখো। ভবিষ্যতে ওই পড়াটা যেন কাজে লাগে।
আমি ইংরেজি নিয়ে পড়তে চাই।
সেটা তো ইন্টার মিডিয়েটে সম্ভব না। গ্র্যাজুয়েশনের সময় তুমি অনার্স নিতে পার। চট করে ভেবে ফেলো না কি করবে। সময় আছে।
আমি কলেজে পড়াতে চাই বড় হলে।
পড়বার মত যোগ্য হলে বল। বড় তো হয়েই গিয়েছ। কিন্তু কেন পড়াতে চাও? এখন পর্যন্ত এই প্রফেসনেই মেয়েরা নিরাপদ বলে? ছেলেরা যেসব চাকরি করছে তা করতে চাইবে না কেন? আমাদের সমযে সুযোগ ছিল না তেমন, স্বাধীন ভারতবর্ষে মেয়েরা শুধু মাস্টারি করার জন্যে পড়াশুনা করবে। এই ব্যাপারটা আমি মানতে পারি না। অনেক দেরি হয়ে গেল। তোমার বাবা এখন নিশ্চয়ই মানখাওয়া করবেন। অঞ্জলিকে ডাকো, তাকে বলে যাই। রমলা সেন ঘড়ি দেখলেন।
তাহলে আপনাকে জানাবো কি করে?
কি ব্যাপারে?
শিলিগুড়িতে গেলে—।
ও হো। সোজা চলে যাবে। ওতে আবার জানানোবা কি আছে। হয় বাড়ি নয় কলেজে থাকব। বইগুলো তুলে রেখে দাও। ববীন্দ্রনাথের সব কবিতা ওতে আছে। পড়ে মনে রাখবে। সমস্ত জীবন। পাশেই ছোট ছোট কবিতার বই-এর স্তুপের ওপর হাত রাখলেন রমলা সেন। মাথা নেড়ে ভেতরে এল দীপা। অমরনাথ তখনও বাথরুমে। রান্নাঘরে এসে সে বলল, উনি চলে যাচ্ছেন। তোমাকে ডাকছেন।
অঞ্জলি ভাতের হাঁড়িতে হাত দিয়েছিল। একটু অপ্ৰস্তৃত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, বুধুয়াকে পদখেছিস? দীপা মাথা নাড়ল, না। রান্নাঘরের দরজা টেনে বন্ধ করে দ্রুত চলে এল অঞ্জলি। যতটা শোভনভাবে বিদায় দেওয়া সম্ভব ততটাই শোভনতা বজায় রাখল সে। অস্টিন গাড়িটা বেরিয়ে যাওয়ামাত্র দীপা জিজ্ঞাসা করল, বাবার কি হয়েছে মা? কেমন গম্ভীরভাবে কথা বলছিল।
অঞ্জলি ঠোঁট ওল্টালো। তারপর মনে পড়ে যাওয়ায় রান্নাঘরে ছুটল।
রাত তখন একটা। অঞ্জলি গালে হাত দিয়ে বসেছিল। খাওয়াদাওয়া চুকে গেলে এগারোটা নাগাদ অমরনাথ কথা শুরু করেছিল। প্রায়-বিকেলে রান্নাঘরে কথা বলার সুযোগ হয়নি। অমরনাথ খেতে বসামাত্ৰ মনোরমা এসে দাঁড়িয়েছিলেন।
অঞ্জলি শেষ পর্যন্ত বলল, টাকাটা তুমি নিলে?
টাকা নয় চেক। না ভাঙালে কোন মূল্য নেই। অমরনাথ বললেন।
পঞ্চাশ হাজার? সে আডচোখে চেকটাকে দেখল। লকার থেকে বের করে নিয়ে এসেছেন অমরনাথ অঞ্জলিকে দেখাতে। অঞ্জলি বলল, আমার মাথা ঘুরছে গো। পঞ্চাশ হাজার টাকা এক সঙ্গে দিয়ে দিল?
বলছি তো টাকা নয়, চেক। না ভাঙালে কিসু দেয়নি। এখনও যদি ইচ্ছে করে ব্যাঙ্ককে নির্দেশ দিতে পারে টাকা দেওয়া বন্ধ করতে।
ও মা! তা করবে কেন?
মানুষের খেয়াল বলে কথা। তবে মনে হল লোকটা একদম পাল্টে গেছে।
বউ-এর খোঁজ নেয় না?
জিজ্ঞাসা করিনি। হরদেববাবু বললেন পাগলের শেষ স্টেজে পৌঁছে গেছে। যে-কোন দিন মরে যাবে। টাকা দিয়েই বোধ হয় দায়িত্ব খালাস করেছেন।
আর সেই বিটা? তাকে দেখলে?
না। সে বাইরে আসেনি। তবে প্রতুলবাবু সত্যি খুব অসুস্থ। কথাবার্তাও আগের মত বলতে পারছিলেন না। তুমি চিন্তা করতে পারছি ওঁর বিশ লক্ষ টাকার সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী তোমার মেয়ে।
বিশ লক্ষ?
হরদেববাবু তাই বললেন। আরও বেশীও হতে পারে।
ও মাগো!
কিন্তু শোন, দীপা যদি জলপাইগুড়ির কলেজে না ভর্তি হয় তাহলে ওই পঞ্চাশ হাজারেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। প্রতুলবাবু যেই বুঝবেন ওঁর পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে আমরা দীপার জন্যে খরচ করছি না, নিজেরাই ভোগ করছি। সঙ্গে সঙ্গে হাত মুঠো করে ফেলবেন। আর একটা পয়সাও দেবেন না।
কিন্তু ওঁর টাকা আমরা নেব কেন?
কেন নেব না। যে অন্যায় তিনি করেছেন, আমাদের মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলে ছুঁড়ে ফেলেছেন তার দাম তাঁকে দিতে হবে না?
টাকা দিয়ে সেই দাম শোধ করা যায়?
যায় না। কিন্তু কিছু একটা তো দিতে হবে। এই টাকা দীপার। ভবিষ্যৎকে নিরাপদ করবে। ও অন্তত না খেয়ে মারবে না।
তা সেটা তো পঞ্চাশ হাজারেও হয়ে যায়। এই না হলে স্ত্রীবুদ্ধি! হাজার হোক দীপা তো ও-বাড়ির বউ। ওর সম্পত্তি ঝি-এ, ছেলেরা ভোগ করুক এটা তুমি চাও?
ও। কিন্তু মেয়েকে তো জানি। যেই জানবে তুমি প্রতুলবাবুর টাকায় ওকে পড়াচ্ছ সঙ্গে সঙ্গে বেঁকে বসবে। হয়তো পড়াশুনাই ছেড়ে দেবে।
হুম। ওই রমলা সেনই ওর বারোটা বাজিযেছে। তা সে-ব্যবস্থাও হয়েছে। টাকা যাবে এস সি রায়ের নামে। এস সি রায় গো! যাঁর অনেক চা-বাগান আছে, খুব দানধ্যান করেন। জেলার মেধাবী ছেলেমেয়েকে পড়ার খরচ দেন। প্রতুলবাবু ওঁর সঙ্গে কথা বলে নেবেন। টাকা দীপার কাছে যাবে ঔব নামে কিন্তু পাঠাবে ব্যাঙ্ক।
তাহলে ওকে শিলিগুড়িতে পাঠাচ্ছ না?
না। শোন আমরা দীপাকে ভালবাসি। ওর ভাল চাইছি। কিন্তু আজ আমি তেমন কিছু করতে পারি না যাতে আমার দুই ছেলের ক্ষতি হয়। তা ছাড়া, এ তো পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা, নেব্বই না বা কেন? যাক, এসব কথা যেন আর কেউ জানতে না পারে। ও পড়াশুনা শেষ করুক। তদ্দিন অবশ্য মূল টাকায় আমরাত হাত দের না। অমরনাথ বিছানা থেকে নেমে চেকটা আবার লকারে তুলে রাখলেন।
সকালে দীপাকে ডাকলেন অমরনাথ, শোন, রমলা দেবী ভাল মানুষ। তোমাকে স্নেহ করেন। কিন্তু তাঁর কাছে তোমাকে রাখলে তিনি টাকা পয়সা নেবেন না। সেটা ভেবেছ?
দীপা বলল, আমি টিউশ্যুনি করব।
অমরনাথ মাথা নাড়লেন, না। পড়াশুনার সময় তোমাকে রোজগার করতে হবে না। জলপাইগুড়িতে একটা ফান্ড আছে। মেধাবী ছেলেমেয়ের পড়াশুনার খরচ সেই ফাণ্ড থেকেই দেওয়া হয়। তুমি এই ফর্মে সব কিছু লিখে সই করে দাও। আর সেই সঙ্গে এই ব্যাঙ্কের ফর্মেও। ওরা ব্যাঙ্ক থেকেই টাকাটা দেবে। এটা কারও দান নয়, নিজের যোগ্যতা দিয়ে যা উপার্জন করছ, সেটা সব সময় গর্বের, কথাটা মনে রেখ। নাও, সই কর।