খুব দ্রুত থানার পাশ দিয়ে হাঁটছিলেন অমরনাথ।
চোখের সামনে এখনও প্রতুলবাবু। কিংবা বলা যেতে পারে একটি মৃত নগ্ন শরীর, বিছানায় শুয়ে শুয়ে যার সবঙ্গে ক্ষত দাগ দগ করছে, জীয়নকালে যিনি ছিলেন দুর্দান্ত ব্যবসাদার প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়, এখন অসহায় অবস্থায় খাটের ওপর পড়ে আছেন। মাথার পাশে বসে আনা যে কাঁদছিল, তাতে বানানো ব্যাপার কিছু ছিল না। আনার কান্না এত স্বাভাবিক যে অমরনাথও ভাবাবেগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। হরদেব ঘোষাল ঘরে ঢুকে একপলক দৃশ্যটি দেখলেন। তারপরে ছুটে গেলেন খাটের পাশে, কবজি টেনে পালস দেখার চেষ্টা করলেন, চোখের পাতা ধরে টানাটানির পর উদোমশরীর থেকে খসে পড়া চাদরটিকে সস্থানে ফিরিয়ে দিলেন। দিয়ে বললেন, যাই, ডাক্তার ডেকে আনি।
কান্না থামিয়ে আনা ফ্যালফ্যাল করে তাকাল, ডাক্তার?
নিশ্চয়ই। প্ৰাণ আছে কি নেই বোঝার যোগ্যতা একমাত্র ডাক্তারের আছে। থাকলে তিনি চিকিৎসা করবেন, গেলে একটা সাটিফিকেট দেবেন। ততক্ষণ গলা সাধা বন্ধ বাখো। এভাবে ফন্ট করে মরে গেলে তোমার কোন লাভ হবে না। ঘুরে দাঁড়িয়ে হরদেব অমরনাথকে দেখলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুখে যেন দুশ্চিন্তা খেলে গেল, অমরনাথবাবু, মনে হচ্ছে খুব দুর্বলভাবে নাড়ি চলছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে ডান দিকের মোড়ের মাথায় সন্তোষ ডাক্তার থাকেন। তাঁকে ডেকে আনবেন একবার?
অমরনাথ ব্যস্ত হয়ে বললেন, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।
প্ৰায় ঝড়ের মত দৌড়ে গেলেন অমরনাথ। সন্তোষ ডাক্তার সব শুনে বললেন, প্ৰাণ যদি থেকেও থাকে তাহলে কিছু করার নেই। আপনি এগোন, আমি যাচ্ছি।
ব্যানার্জিবাড়িতে ফেরার পথে হঠাৎ মনে হল হরদেব তাঁকে ইচ্ছে করে ওই সময় সরিয়ে দিল না তো! আত্মীয়স্বজনরা আসার আগে কিছু হাতিয়ে নিতে পারে। মৃতদেহ খুব বেশী দেখেননি। অমরনাথ এ জীবনে, কিন্তু প্রতুলবাবুর শরীরের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মনে হয়েছিল তাঁর প্রাণ নেই। বাড়ির সেই বুড়ে চাকব অথবা নিজে ডাক্তারের কাছে না গিয়ে কেন তাঁকে পাঠালেন হরদেব?
সদর দরজা দিয়ে না। ঢুকে বাগানের পথে পা রাখলেন অমরনাথ। বুড়ে চাকরিটা চুপচাপ বসেছিল। একবার চোখ তুলে মুখ নামিয়ে নিল। খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল লোকটাকে। অমরনাথ প্ৰায় নিঃশব্দে পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। প্রতুলবাবুর ঘরের দিকে পৌঁছানো মাত্র হরদেবের গলা কালে এল, তাড়াতাড়ি কর। প্রত্যেক পাতায় ছাপ দাও। যেসব জায়গায পেন্সিলের টিক আছে তার ওপরে। উইলে সই না করলে কি আছে, টিপসই দিয়েছে তো! যে মানবে না। সে কারুক কেস।
অমরনাথ দরজায় দাঁড়ালেন। ভূত দেখার মত চমকে উঠল আনা। এবং হরদেব কিছু বলার আগেই সে দুই হাতে উইলটাকে মুচড়ে ফেলল।
হরদেব খুব দুঃখিত ভাবে বললেন, প্রতুল যা করতে চেয়েছিল তা সুস্থ অবস্থায় করে যেতে পারেনি। বিছানায় পড়ে রইল কত বছর। আমায় বলেছিল। দি টুপ করে সে মরে যায় তাহলে অন্তত এই উইলে ওর টিপছাপ তুলে রাখি। দুর্জনের তো অভাব নেই। ওর শেষ ইচ্ছা পূৰ্ণ করছি এখন। হে হেঁ করে একটু হেসে আরও যোগ করলেন, কিন্তু কার জন্যে করব? স্ত্রীবুদ্ধির নমুনা দেখলেন? আপনাকে দেখে ও এমন ঘাবড়ে গেল যেন চুরি করছে। উইলটার কি অবস্থা করল দেখুন! আরো অমরনাথবাবু যখন পৌঁছে গিয়েছেন তখন সাক্ষী হিসেরে ওঁর সই নিতে হবে না? দাও উইলটা। হরদেব হাত বাড়ালেন।
সত্যি চোরের মত দাঁড়িয়ে ছিল আনা। এবার হরদেব হাত বাড়ানো মাত্র সে সচল হল। কোন কথা না বলে মুচড়ে ফেলা উইলটাকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। হরদেব চিৎকার করলেন, আরে? কি হল? সব ছাপ দেওয়া হয়ে গিয়েছে। আনা? ও আনু।
আর এইসময় ডাক্তারবাবুর গলা পাওয়া গেল সদর দরজায়। তাঁকে দরজা খুলে দিয়ে আর দাঁড়ালেন না অমরনাথ। আর সেই সময় পেছন থেকে আনা তাঁকে ডাকল, শুনুন।
থমকে দাঁড়িয়ে মুখ ফেরালেন অমরনাথ। আনার হাতে তখনও গোল করে পাকানো উইল ধরা, একটা অনুরোধ রাখবেন?
অমরনাথ জবাব দিলেন না। আনা বলল, আমাকে যত খারাপ ভাবেন তাতে আমার
কিছু এসে যায় না। ওঁর শেষ ইচ্ছে ছিল আশালতাকে দেখা। হল না। আপনি ওকে একবার নিয়ে আসবেন?
কি দরকার? অমরনাথ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
বললাম তো ওঁর ইচ্ছা পূৰ্ণ করতে।
যেভাবে হরদেব শেষ ইচ্ছা পূৰ্ণ করছিলেন।
বাড়িতে মড়া পড়ে আছে। এই অবস্থায় তর্ক করবেন?
অমরনাথ আর দাঁড়াননি। হনাহনিয়ে বেরিয়ে এসে করলা নদী পেরিয়ে থানার রাস্তা ধরেছিলেন। লোভ মানুষকে কত নীচে নামাতে পারে তার সবচেয়ে নগ্ন উদাহরণ দেখে উদ্রাস্ত হয়ে পড়ছিলেন বারংবার। কোন দিকে নজর ছিল না। তাঁর। হঠাৎ কানো গেল বাবা শব্দটি। দ্বিতীয়বারে মনে হল গলাটি তাঁর চেনা। মুখ ফিরিয়ে তিন চারটি মেয়েকে দেখলেন। তিনটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে চুপটি করে, একটি এগিয়ে আসছে। এবার দীপা স্পষ্ট হল। অমরনাথ যেন হুঁস ফিরে এলেন।
সামনে দাঁড়িয়ে দীপা জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে তোমার? তিনবার ডাকলাম, শুনতেই পাচ্ছ না।
তুই এখানে? অমরনাথ স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করছিলেন।
বাঃ আমরা কলেজে যাচ্ছি। তুমি কখন এসেছ জলপাইগুড়িতে?
আজ সকালে। অমরনাথ সত্যি কথাই বললেন।
তাহলে আমার কাছে যাওনি কেন? দীপা জিজ্ঞাসা করল। অমরনাথ ঘুরে দাঁড়ানো মেয়েদের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, দীপু, তুমি তোমার বন্ধুদের বলে কলেজে চলে যেতে। তোমাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে।
কোথায়? দীপা অবাক হচ্ছিল।
বলছি। আগে ওদের ছেড়ে দাও। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রয়েছে।
দীপা মেয়েদের কাছে গিয়ে কিছু বলল। তারা অমরনাথকে দেখতে দেখতে পোস্ট অফিসের দিকে হাঁটতে লাগল। ফিরে এসে দীপা জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে। বাবা? অমরনাথ এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে জানতে চাইলেন, এই সময় কলেজে না গিয়ে অন্য কোথায় যাওয়ার জন্যে কি হোস্টেল থেকে অনুমতি নিতে হয়?
না। দীপা মাথা নাড়ল।
সে কি! তাহলে তো তোমরা যেখানে ইচ্ছে যেতে পাব!
আমরা কলেজে পড়ছি বাবা। স্কুলে নয়। খারাপ জায়গায় যাবই বা কেন? দীপা হেসে ফেলেই গম্ভীর হবার চেষ্টা করল, কিন্তু তোমার কি হয়েছে বল তো? কিছু লুকিয়ে যাচ্ছ!
এই সময় একটা খালি রিকশা সামনে দেখে অমরনাথ সেটাকে দাঁড় করালেন, ওঠে। দীপা আদেশ মান্য করল। অমরনাথ পাশে বসে রিকশাওয়ালাকে হাত তুলে ইশারা করলেন রাস্তা দেখিয়ে। এবং তখনই তাঁর মনে হল মেয়ে অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। একজন ভদ্রমহিলার পাশেই বসে আছেন এমন অনুভূতি হচ্ছিল।
থানার পাশ দিয়ে রিকশা ঝুলনা পুলের গায়ে এসে থামল। অমরনাথ বুঝলেন তিনি ভুল রাস্তায় রিকশাওয়ালাকে আসতে বলেছেন। করলা নদীর ওপর ঝুলনা পুলে রিকশা উঠবেই না। সেই সুভাষ বোসের স্ট্যাচু অথবা দীনবাজার ঘুরে আসতে হবে। তাতে সময় লগত বেশী। এইটুকু রাস্তা পেরিয়ে ঝুলনা পুলে আসতে রিকশার কোন প্রয়োজন ছিল না। পয়সা দিয়ে মেয়েকে বললেন, চল।
কুলনা পুলে উঠে। দীপা জিজ্ঞাসা করল, আমরা কোথায় যাচ্ছি বাবা?
ব্যানার্জী বাড়িতে।
না।
দীপা, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ একভাবে মাপতে যেও না।
আমি ওই বাড়িতে যাব না।
আমি তোমাকে কখনও যেতে বলিনি। কিন্তু আজ বলছি।
কেন? ওদের সঙ্গে তো আমার কোন সম্পর্ক নেই।
ইচ্ছে না করলেও কোন কোন কাজ করতেই হয়। সম্পর্ক তুমি স্বীকার না করলেও আমাদের মানতে হয়। তোমাকে এখন ব্যানার্জী লিখতে হচ্ছে। আর সম্পর্ক যে-মানুষগুলোকে কেন্দ্র করে ও বাড়িতে তৈরী হয়েছিল তারা কেউ আর আজ বেঁচে নেই। প্রতুলবাবু আজ সকালে পরলোকগমন করেছেন।
সেই ভয়ঙ্কর রাগী মানুষটির মুখ মনে পড়ল দীপার। মুখেব সব কিছু আর তেমন স্পষ্ট নয়। কিন্তু আদলটি মুছছে না। এখনও। মেয়েকে চিন্তিত দেখে অমরনাথ বললেন, আমরা আর কদিন! সবাইকেই যেতে হবে। প্রতুলবাবুও গেলেন। মৃতের প্রতি শ্ৰদ্ধা জানানো যে-কোন জীবিত মানুষের কর্তব্য। চল।
না। শক্ত হয়ে দাঁড়াল দীপা। নিচে করলাব কালো জল স্থির। দুই এক জন লোক যারা ঝুলনা পল দিয়ে যাতাযাত করছে তারা কৌতূহলী হয়ে এদের দিকে তাকিয়ে যাচ্ছিল। অমরনাথ বলে ফেললেন, বেয{দপি করে না দীপা।
দীপা জবাব দিল না। নদীর দিকে এতকাল। এবং তখনই তার দুচোখ ঝাপসা হয়ে গেল। অমরনাথ সেটা দেখতে পেলেন না। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, আমি তোমাকে আদেশ করছি তাই তুমি যাবে।
চোখ মোছার চেষ্টা করল না দীপা। অমরনাথকে সে অনুসরণ করল। বাতাস বইছে। তার ছোঁয়ায় চোখের জল গালে শুকিয়ে যাচ্ছে। সমস্ত শরীর জুড়ে কাঁপুনি, ইচ্ছের বিরুদ্ধে অমরনাথ তাকে দিয়ে যে কাজ কাবাচ্ছেন তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বাসনা ক্রমশ তাকে শক্ত করল। দীপা মনে মনে প্ৰতিজ্ঞা করল, এই শেষ। যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোন কিছুর সঙ্গে সমঝোতা করবে না। অমরনাথ কিংবা অঞ্জলি যদি অন্যায় ভাবে কিছু তার ওপর চাপিয়ে দবার চেষ্টা করেন তাহলে সেটা ঝেড়ে ফেলতে দ্বিধা করবে না। এই শেষ, শেষবার।
এর মধ্যে বেশ কিছু লোকজন এসে গিয়েছে। পাড়াপ্রতিবেশীরা আছেনই, আত্মীয়স্বজনরাত আসতে শুরু করেছেন। মেয়েকে নিয়ে অমরনাথ ঘরের এককোণে দাঁড়িয়েছিলেন। আনা ইতিমধ্যে প্রতুলবাবুকে পাঞ্জাবি পরিয়ে বুক অবধি চাদরে ঢেকে রেখেছে। হরদেব ঘোষাল অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে সব তদারকি করছিল। আনা বসে আছে প্রতুলবাবুর পায়ের কাছে। যাঁরা এসেছেন তাঁরা নিচু গলায় কথা বলছিলেন। জেলার কংগ্রেস-কতারা মালা ফুল নিয়ে পৌঁছে গেলেন। দেখতে দেখতে প্রতুলবাবু এতকালের একাকিতু কাটিয়ে তাঁর কর্মময় জীবনের প্রাপ্য সম্মান অর্জন করতে চললেন। জলপাইগুড়ি শহরের একজন প্রথিতযশা মানুষ চলে গিয়েছেন এবং তাঁকে বিদায় জানাবার ব্যাপারটা যাতে সম্মানের সঙ্গে হয় তার আয়োজন চলছিল। এই সময় হরদেব প্রতুলবাবুর দাদাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলেন। বয়স বেড়েছে। হাতে লাঠি। অমরনাথ দেখলেন ভদ্রলোক খুব একটা বদলাননি। এই মানুষটি যদি হরিদাসবাবুর বাড়িতে তাঁকে ডাকিয়ে নিয়ে গিয়ে দীপার বিয়ের প্রস্তাব না দিতেন তাহলে মেয়েটাকে বিধবা হতে হত না। অমরনাথ অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করলেন।
প্রতুলবাবুর দাদা দরজায় দাঁড়িয়ে প্রথমে মৃতদেহের দিকে তাকালেন, তারপর তাঁর চোখ ঘরের মানুষগুলোর ওপর ঘুরতে লাগল। অমরনাথ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়েছিলেন। প্রতুলবাবুর দাদা কয়েক পা এগিয়ে এসে বললেন, হরদেববাবু, প্রতুল আমার নিজের ভাই নয়। কিন্তু রক্তের সম্পর্ক রয়েছে। সে মারা না গেলে আমি এই বাড়িতে পা দিতাম না। আজ এসেছি। ওই রক্তের সম্পর্কের জন্যে। আসতে বাধ্য হয়েছি।
হরদেব নিচু স্বরে বললেন, অত্যন্ত সত্যি কথা।
খাটের ওপর কে বসে আছেন?
আনা।
আনা! মানে প্রতুলের– ওঁকে কথা শেষ করতে দিলেন না হরদেব, হ্যাঁ।
ওকে নেমে আসতে বলুন। ব্যাপারটা অসম্মানজনক।
হরদেব মিনমিন করে বললেন, উনিই এতদিন সব সেবাযত্ন একা করে এসেছেন।
ভালকথা। কিন্তু সেবিকা সেবিকাই। সে কখনও আত্মীয়ের মর্যাদা পেতে পারে না।
হরদেব ছুটে গেলেন আনার কাছে। কথাগুলো সে-ও শুনেছিল। কিন্তু তার কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। হরদেব আনার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললেন, ঝামেলা না করে নেমে আসাই ভাল। পাঁচজন চেয়ে দেখছে।
আনা তবু নড়ল না। তার মুখ নিচু। অধৈৰ্য হরদেব ডাকলেন, আনা!
আনা উত্তর দিল না। প্রতুলবাবুর দাদা গলা তুললেন, আশ্চর্য! এ তো দেখছি কান কাটা মেয়েছেলে! অমরনাথবাবু, আপনি একটু শুনবেন?
অমরনাথ চমকে উঠলেন। হঠাৎ যে তাঁর নাম উচ্চারণ করবেন। ভদ্রলোক তিনি ভাবতে পারেননি। সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে বললেন, আমাকে কিছু বলছেন?
হ্যাঁ। প্রতুলবাবুর দাদা দরজায় দাঁড়িয়েই কথা বলছিলেন, যতদূর মনে হচ্ছে আপনি এখানে কন্যাকে নিয়ে এসেছেন। তাই তো?
আজ্ঞে হ্যাঁ। অমরনাথ ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলেন না।
প্রতুলবাবুর দাদা যেন খুব স্বস্তি পেলেন। অমরনাথরা যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন সেখানে এগিয় এসে বললেন, এসো মা, দূরে দাঁড়িয়ে থেকো না, তুমি এই বাড়ির বউ। প্রতুলের স্ত্রী পুত্র নেই, তুমিই তার পরবারের একমাত্র জীবিত মানুষ। ওর এই সময়ে তুমি তোমার কর্তব্য পালন কর।
অমরনাথ কিছু বলার আগেই দীপা পরিষ্কার গলায় জিজ্ঞাসা করল, কিভাবে?
প্ৰতুলবাবুর দাদা বললেন, অত দূরে দাঁড়িয়ে থেকো না। মৃতের পাশে তার নিকট আত্মীয়রা থাকবে। সেটাই স্বাভাবিক।
দীপা ঠোঁট কামড়াল। ঘরের সমস্ত মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে।
অমরনাথ মেয়ের অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, আসলে এ বাড়িতে ওর আসা-যাওয়া নেই তাই সংকোচ–।
প্রতুলবাবুর দাদা কথাটা থামিয়ে দিলেন, সংকোচের কোন কারণ নেই। আসা-যাওয়া বন্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। এখন সেই প্রসঙ্গ তোলার কোন যুক্তি নেই। হিন্দু বিধবা পুনর্বিবাহ না করা পর্যন্ত বৈবাহিক সম্পর্ক বাতিল হয় না। আর ওর না হয় আসা-যাওয়া ছিল না। কিন্তু আপনি তো নিয়মিত এসেছেন।
আমি! অমরনাথ। হতভম্ব।
সব খবর কানে এসেছে আমার। এতদিন বলার দরকার মনে করিনি। তাছাড়া এখানে এসে আপনি অন্যায় কিছু করেননি। এসো মা।
দীপা মাথা নাড়ল, না। উনিই ওখানে বসার যোগ্য মানুষ।
মানে? প্রতুলবাবুর দাদা চমকে উঠলেন, এর পরিচয় তুমি জানো?
হ্যাঁ। উনি আমাকে রক্ষা করেছিলেন।
আমি বুঝতে পারছি না।
বোঝার কি খুব দরকার আছে? ওই মহিলা যখন জীবন দিয়ে সেবা করে গেছেন বছরের পর বছর তখন আপনারা কেউ বাধা দেননি। সাহায্য করতেও আসেননি। আজ কেন গায়ে পড়ে নিজের মতামত চাপিয়ে দিচ্ছেন।
প্ৰতুলবাবুর দাদা অবাক হয়ে তাকালেন। তারপর ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। অমরনাথ দেখলেন হরদেব খুব খুশি হয়েছে। শোকসংবাদ পেয়ে যারা এসেছে তারা গুঞ্জন শুরু করল। আনা ওই একই অবস্থায় বসে আছে। তার দিকে তাকিয়ে বিস্ময় বাডছিল অমরনাথের। ওই মহিলা প্রতুলবাবুর মৃত্যুব পারে হরদেবের নির্দেশ যখন মান্য করছিল তখন অন্য চেহারা ছিল। কোনটে সত্যি আর অভিনয় বোঝা অসম্ভব।
এই সময় একটি যুবক এসে অমরনাথের সামনে দাঁড়াল, আপনাদের বাবা ডাকছেন।
চেহারা দেখে অমরনাথ অনুমান করলেন ছেলেটি প্রতুলবাবুর দাদাবাঁ ছেলে। তিনি দীপাকে বললেন, আয় মা।
এই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে দীপা যেন বেঁচে গেল। যে মানুষটি খাটের ওপর শুয়ে আছে তার সঙ্গে কিদয়েব সময় দেখা প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোন মিল নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওদিকে তাকালে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল!
অমরনাথের সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে দীপা দেখল শ্মশানযাত্রীবা প্ৰস্তৃত। ভিড় আরও বাড়ছে। শুধু হাকিমপাড়া নয়, জলপাইগুড়িবা অনেক মানুষ এসেছেন। এখানে। বাগানের মধ্যে একা দাঁড়িয়েছিলেন প্রতুলবাবুর দাদা। সামনে যেতেই তিনি বললেন, অমরনাথবাবু, আমি আমার বেয়াই-এর বাড়িতে গিয়ে আগ বাড়িয়ে আপনাকে বিয়ের সম্বন্ধটা দিয়েছিলাম। এই কারণে আমি পরে অনুতপ্ত হয়েছি। এখন বললে বেঙ্গ বিশ্বাস করবে না। প্রতুলেব অসুস্থতার পরো ব্যাপারটা আমার জানা ছিল না। তারপর অনেক বছর কেটে গেছে। আপনার মেয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে। তার আচরণ নিয়ে যখন নানান কথা আমার কানে এসেছে তখন ভেবেছিলাম মেয়েটা সেই আঘাত ভুলতে পেরেছে। কিন্তু তাই বলে আজ সবার সামনে আপনার মেয়ে আমাকে অপমান করব সাহস পায় কোথেকে? সেদিনের অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করতে চেয়েছিলাম আজ; এই বাড়িব, প্রতুলের সম্পত্তির অধিকার তাকে দিতে চেয়েছি। সর্বসমক্ষে কিন্তু তার বদলে—! ছি ছি ছি।
অমরনাথ বললেন, আপনি ভুল বুঝছেন। ও আপনাকে ভাল করে চেনেই না! খামোক অপমান করতে যাবে কেন?
অপমান নয়? আপনি এ কি বলছেন? ওই নষ্ট মেয়েটাকে সমর্থন করল, আমাকে বলল গায়ে পড়ে চাপিয়ে দিচ্ছি, এসব শুনতে পাননি?
দীপা শুনছিল এতক্ষণ। এবার অমরনাথকে বলল, বাবা, আমরা কি যাব?
যাবে মানে? প্রতুলবাবুর দাদা আঁতকে উঠলেন, এখন শ্মশানযাত্রা শুরু হয়নি। আর তুমি যেতে চাইছ? না, বাড়ির বউকে শ্মশানে যেতে বলছি না। কিন্তু এখানে এসেছ ঘোমটা না দিয়ে তার ওপর এখন বেরিয়ে গেলে আমাদের সম্মান থাকবে?
দীপা ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট বলল, দেখুন, আমি এখানে নিজের ইচ্ছায় আসিনি। বাবা জোর করেছিলেন বলেই আসতে হল।
তুমি কি নির্বোধ?
মানে?
এসব কথা বলার অর্থ কি জানো?
যা সত্যি তাই আমি বলছি।
অমরনাথবাবু, আপনার মেয়েকে বুঝিয়ে বলুন। এসব কথা উচ্চারণ করার অর্থ এই পরবারের সমস্ত সম্পত্তি থেকে সরে দাঁড়ানো।
দীপা হাসল, এখানেও আপনি ভুল করেছেন।
ভুল?
যে সর্বনাশ একদিন আপনারা আমার করেছিলেন আজ তার প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যে ব্যাকুল হয়েছেন। খুব ভাল। কিন্তু এ বাড়ির একটা টুকরোকেও নিজের করে ভাবাব কোন প্ৰবৃত্তি আমার নেই। বাবা, বল।
দাঁড়াও। ছোট মুখে অনেক বড় কথা বললে।
বড় কথা কিনা জানি না, এটা আমার বিশ্বাসের কথা।
যারা দিনের আলোয় উপদেশ দেয় আর রাতের অন্ধকারে চুরি করে এই ব্যযসে তুমি তাদের দলে পৌঁছে যেতে পেরেছ দেখে অবাক হচ্ছি!
কি বলছেন আপনি?
তুমি কি ভাবছ আমি জানি না যে তোমার বাবা ওই মেয়েছেলেটার সঙ্গে এক হয়ে তোমাকে সম্পত্তির ভাগ দেবার চেষ্টা করছে?
সে কি?
অথচ সেটা তুমি নিজেই এক অধিকার করতে পারতে। আমি ব্যাপারটার কোন অর্থ বুঝতে পাবিনি এতকাল। আজ যখন ওই মেয়েছেলেটাকে তুমি সমর্থন করলে তখন অর্থটা হৃদয়ঙ্গম হল।
আপনি আমার বাবার নামে মিথো বদনাম দিচ্ছেন।
অমরনাথ কিন্তু কিন্তু করে বললেন, প্রতুলবাবু চেয়েছিলেন বলে–।
মিথ্যে বদনাম! কি অমরনাথবাবু ব্যাপারটা কি মিথ্যে?
তুমি আমাকে এসব কথা কখনও বলনি বাবা? দীপার গলার স্বর কেপৌ উঠল। তার প্রশ্ন শুনে অমরনাথ মাথা নিচু করলেন।
প্রতুলবাবুর দাদা বললেন, যাচ্চলে।! ঠিক আছে, বিষয়সম্পত্তির ব্যাপারটা না হয় তোমার বাবা তোমাকে বলেননি। কিন্তু চা-বাগান থেকে জলপাইগুড়ি শহরে এসে হোস্টেলে বাস করে এই যে পড়াশুনা করছ—।
এই সময় শ্মশানযাত্রীরা হরিধ্বনি দিতে দিতে প্রতুলবাবুর দেহ খাটে চাপিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। একটি মাত্র কঠের কান্না শোনা যাচ্ছিল। সেদিকে তাকিয়ে প্রতুলবাবুর দাদা বললেন, থাক। আর কিছু বলার নেই।
দীপা বাধা দিল, দাঁড়ান। আমার পড়াশুনার ব্যাপারে কি বলছিলেন?
যেতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন ভদ্রলোক, এতক্ষণ তুমি অনেক বড় কথা বললে মা। তোমার অপমানিত হবার কারণ যথেষ্ট আছে। তবে দুরকম আচরণ করা ঠিক নয়। তুমি এ বাড়ির সম্পত্তি, এ বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক যদি অস্বীকার কর তাহলে প্রতুলের দেওয়া টাকায় পড়াশুনা করা ঘোরতর অন্যায়।
প্রতুলবাবুর দাদা আর দাঁড়ালেন না। শব মিছিলের সঙ্গী হতে ছেলেকে নিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগলেন। তখন চারধার হরিধ্বনিতে উচ্চকিত। মিছিল একটু একটু করে বেরিয়ে গেল বড় রাস্তায়। বলহরি-হরিবোল শব্দদুটো আর দীপার কাছে পৌঁছাচ্ছিল না। সে পাথরের মত দাঁড়িয়েছিল। প্রতুলবাবুর দাদা কথাগুলো বলার পর থেকেই তার সমস্ত অনুভূতি লোপ পেয়ে গিয়েছিল।
অমরনাথ অত্যন্ত অসহায় বোধ করছিলেন। মেয়ের কাছে লুকিয়ে রাখা খবরগুলো প্রতুলবাবুর দাদা যে এভাবে বলে যাবেন তা তাঁর ধারণার বাইরে ছিল। ঠিক কুরেছিলেন, মেয়ে গ্র্যাজুয়েট হবার পর এক সময় নিজেই খুলে বলবেন। এমন হবে জানলে তিনি নিশ্চয়ই জোর করে দীপাকে নিয়ে আসতেন না। এখন মাথা তুলতেও তাঁর সংকোচ হচ্ছিল। কিন্তু প্রতুলবাবু, হরদেব ঘোষাল আর তিনি ছাড়া একমাত্র আনা আর অঞ্জলি ব্যাপারটা জানে। আনা জানে কিনা সে-ব্যাপারেও তিনি নিঃসন্দেহ নন। ব্যাপারটা গোপন রাখতে তিনি প্রতুলবাবুকে সেইসময় অনুরোধ করেছিলেন। তাহলে এই ভদ্রলোক খবরটা পেলেন কি করে? তিনি যে মাঝে মধ্যে এ বাড়িতে আসা-যাওয়া করেছেন তাও ভদ্রলোকের অজানা নয়। অমরনাথের মনে হল আর কিছু করার নেই। তিনি মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে ভরসা পাচ্ছিলেন না।
এই সময় সেই বুড়ে কর্মচারিটি এগিয়ে এসে দীপার সামনে দাঁড়াল। খুব বিনীত গলায় বলল, আপনাকে ডাকছে
দীপা তাকাল। কিন্তু কোন প্রশ্ন করুল না। লোকটি আবার বলল, আনাদি আপনাকে একবার আসতে বললে।
এবার দীপা সচল হল। অমরনাথ দেখলেন তাঁকে কোন কথা না বলে দীপা ধীরে ধীরে লোকটির সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। কিছু প্ৰতিবেশী মহিলা তখনও দাঁড়িয়েছিলেন বাড়ির সামনে। তাঁরা সকৌতূহলে তাকিয়ে আছেন দীপার দিকে। অমরনাথ এগোতে পারলেন না। দীপা ধীরে ধীরে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলে তিনি পায়চারি করতে লাগলেন বাগানে।
শূন্য বাড়ি। প্রতুলবাবুর শরীর বের করে নিয়ে যাওয়ায়র সঙ্গে সঙ্গে যাব ফোঁড় হয়েছিল তারাত বেরিয়ে এসেছিল। বৃদ্ধ একটি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দীপাকে ইশারা করল, ভিতরে। দীপা ঘরে ঢুকল। লোকটি চলে গেল।
আনা বসেছিল তক্তাপষেবা ওপর। তার হাতের মুঠোয় আঁচল এবং সেটি মুখে চাপা। পিঠ ফুলে ফুলে উঠছে। দীপা কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখল। তারপর কথা বলল, কিছু বলবেন?
আনা মুখ তুলল। তার কান্না সোচ্চার হওয়ামাত্র সে সামলাবার চেষ্টা করল। তারপর জড়ানো গলায় জিজ্ঞাসা করল, আমার কি হবে?
দীপার বোধগম্য হল না, সে প্রশ্ন করল, কি ব্যাপারে?
তোমরা কি আমাকে তাড়িয়ে দেবে? কান্না গলার দখল ছাড়ছিল না।
তো তাডাবার কেউ নই।
তুমিই সব। বল, তুমি কি আমাকে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলবে?
আবার বলছি আমি কেউ নই। কিন্তু আপনার চলে যাওয়ার কথা হচ্ছে কেন?
দি সবার সামনে আমাকে জানিয়ে দেওয়া হল আমি ওরা দাসী।
আপনি কি নিজেকে তার চেয়ে বেশী ভাবেন?
হ্যাঁ। শুধু দাসী হলে এতগুলো বছর আমি মানুষটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইতাম না। খুব খারাপ, বন্দ লোক ছিল, তবু—। কান্নাটা বন্ধ করতে আনা মুখে আঁচল চাপা দিল।
আমি যাই?
না। আনা হঠাৎই উঠে দাঁড়িয়ে করুণ স্বরে বলল, তুমি যেও না, তুমি না থাকলে ওরা আমাকে এ বাড়ি থেকে দূর করে দেবে।
কেউ আপনাকে সেটা করতে পারবে না। আচ্ছা, ওঁর স্ত্রী কোথায়?
সে কি! তুমি জানো না?
না।
তিনি নেই। পাগলাগারদেই মারা গিয়েছেন।
পগলা গারদ।
হ্যাঁ। শোন আশালতা–।
আপনি আমাকে ওই নামে ডাকরেন না।
ও। তুমি একটু বসো। তোমাকে আমি সব কথা বলব।
আমার কোন কথা শোনার একটুও ইচ্ছা নেই।
না। শুনতে হবে। একদিন আমি তোমার উপকার করেছিলাম, সেই অধিকারে তোমাকে বলছি, একটু বসো। কথা বলতে বলতে আনা দরজার কাছে পৌঁছে সেটাকে ভেজিয়ে দিল। আনাকে হঠাৎ উন্মাদিনীর মত দেখাচ্ছিল। তার আঁচল মাটিতে লুটোচ্ছে, চুল আলুথালু। দীপা হতাশভঙ্গীতে খাটে এসে বসল। আনার মুখ দেখে মনে হল এতে পে একটু সন্তুষ্ট হয়েছে।
হঠাৎই দীপার সামনে মেঝেতে বসে পড়ল আনা। দীপা প্ৰতিবাদ করতে গিয়েও থেমে গেল। আনা বলল, উনি তো মানুষ ভালছিলেন না। সারা জীবন টাকা আর মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করেছেন। ঘরের বউ-এর ক্ষমতা ছিল না। তাঁকে সুখী করে। কোন কোন পুরুষমানুষের চাহিদা বাক্ষসের মত, একমাত্র রাক্ষসী না হলে সেটা মেটাতে পারে না। সেই কাজটা করেছিলাম। আমি। তাঁকে ঘরে ফিরিয়েছিলাম। গিন্নিই আমাকে লেলিয়ে দিয়েছিল। ছেলের অসুখের পর তার মাথা সব সময় ঠিক কাজ করত না। যাক এসব কথা। গিন্নি চলে গেছেন পাগলাগারদে থাকার সময়। খবরটা তোমার বাবা জানতেন। কর্তাকে জানানো হয়নি। কতা যখন প্ৰথম বিছানায় পড়লেন তখন থেকেই তাঁর বিবেক দংশন আরম্ভ হল। তোমার প্রতি যে অন্যায় করেছেন তার প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইলেন।
আনা নিঃশ্বাস নিতে একটু চুপ করতেই দীপা জিজ্ঞাসা করল, উনি কি আমার পড়াশুনার জন্যে টাকা দিয়েছেন?
হ্যাঁ। জোর করেই। তোমার বাবা নিতে চাইছিলেন না। ওই হরদেব শকুনটা জোর করে নেওয়ালেন। নিশ্চয়ই সে ভাগ নিতে ছাড়েনি। তবে, শুনেছি, টাকাটা ব্যাঙ্কে আছে, তা থেকে সুদ যায় তোমার কাছে।
কত টাকা?
ঠিক জানি না। কতা আমাকেও বিশ্বাস করে পুরোটা বলেননি।
তারপর?
উনি চাইতেন তুমি এ বাড়িতে এসে থাকে। ওঁর শরীর আরও খারাপ হতে লািগল। এই সম্পত্তি তোমাকে দিতে চেয়েছিলেন। আমি বলতাম, আমার কি হবে? তিনি বলতেন, তোকেও কিছু দেব। শেষ দিকে যখন বুঝে গেলেন তুমি আসবে না। তখন আর সম্পত্তির ব্যাপারে কিছু বলতেন না। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলে একটা উইল তৈরী করলাম। আমি খুব চেষ্টা করেছিলাম ওঁকে দিয়ে সই করাতে। কিন্তু তখন ওঁর হাত উঠত না। এই সময় হরদেব শেয়াল আমাকে কুমতলব দিল। আমি একা মেয়েমানুষ। শরীর এখনও শুকিয়ে যায়নি। পুরুষমানুষের কুনজর চিতায় না ওঠা পর্যন্ত মরে না। ভাবলাম, এতদিন বাঘের হাতে ছিলাম। এখন না হয় শেয়ালের হাতে থাকি। প্রশ্ৰয পেয়ে হরদেব মাথায় উঠল। সে তোমাকে ঠকাতে বলল। নতুন উইল হল। সব সম্পত্তি বিষয়-আশয় আমার নামে। তদারকি করবে। হরদেব। দিনরাত বলতে সই কবাতে। যিনি করবেন তাঁর তখন আঙ্গুল সরে না। বলল, টিপসই করাতে। করব করার করে যখন ইস হল তখন তিনি নেই। ওই মরা মানুষটার আঙ্গুলে কালি মাখিয়ে ছাপ লাগাতে চেয়েছিল শেয়ালটা। আর তখন ভগবান আমাকে সম্বিত ফিরিয়ে দিলেন। সব ছিডে ফেলেছি। কিন্তু কে জানত ওঁর আত্মীয় এসে পাঁচজনের সামনে আমাকে খাট থেকে টেনে নামাতে চাইবে! তুমি বলছি সম্পত্তি চাই না, আমাকে কুকুর বেড়ালের মত তাডাবে আর পাঁচভূতে সব দখল করবে। করুক। কিন্তু তুমি বল, আমার অপরাধ কোথায়?
দীপা কোন জবাব দিল না। সে অবাক হয়ে আনাব মুখেব দিকে তাকিয়েছিল। যা শুনছে তা কি সত্যি? হরদেব ঘোষাল তাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে যে কথাগুলো বলেছিলেন তা মনে পড়ল। চা-বাগানে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন ব্যাপারটা। কিন্তু অমরনাথ এখনও সেই প্রসঙ্গ তোলেননি। আনা যা বলছে তাতে কি মিথ্যে আছে? দুটো যোগ করলে–তো—! এমন কি প্রতুলবাবুর দাদাও একই কথা বলে গেলেন। কেঁপে উঠল দীপা। সে কি করবে বুঝতে পারছিল না। আমন্ত্ৰনাথ তাকে মিথ্যে কথা বলেছেন? জলপাইগুড়ির বিখ্যাত চা-বাগানোবা মালিক পায়পরবার থেকে তাকে তার মেধাবী জন্যে বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে না?
অনা দীপার হাত ধরল, শোন, তুমি আমাকে বক্ষা কর।
কি ভাবে? দুর্বল গলায় বলল দীপা।
ওদের বল আমি এ বাড়ি ছেড়ে যেতে পারব না।
আপনার কেউ নেই?
আছে। একটা ছেলে। আমাদের দেশে। হাওডায়। সেখানে আমার যাওয়ার মুখ নেই। কিতার টাকাব্য সে বড় হচ্ছে।
ওর বাবা নেই?
না। সে কতবাবুর ছেলে। এখন হরদেব শেয়াল ছাড়া একথা কেউ জানে না। আমি বলতেও চাই না। এই পরিচয় দেবার তো উপায় নেই। আইন মানবে না। আনা আরও ঘনিষ্ঠ হল, তুমি হোস্টেলে থেকে না। এই বাড়িতে চলে এস। তোমার মধ্যে একধরনের তেজ আছে। কেউ কাছে ঘেষতে সাহস পারে না।
আপনি আমাকে বাঁচাতে এ বাড়ি থেকে একদিন চলে যেতে সাহায্য করেছিলেন। আজ কেন—। দীপা মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল।
সত্যি কথা বলব? তোমাকে বাঁচাবার চেয়েও সেদিন আমার মনে হয়েছিল তুমি চলে গেলে কতাবাবুকে আমি নিজের মত করে পাব। কেঁদে উঠল আনা।
সেই মহিলার দিকে কয়েক সেকেন্ড অপলক তাকিয়ে ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে এল দীপা। দরজার বাইরে সেই বৃদ্ধ চাকরীটি অসহায় চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। দীপা কোন দিকে লক্ষ্য না করে হাঁটছিল। মৃত্যুশোক নয়, একটি নির্মম সত্যের শোষণ তার জীবনকে নীরক্ত করে দিয়েছে কয়েক মিনিটে।
অমরনাথ মেয়েকে দেখে চমকে উঠলেন। দ্রুত পা চালিয়ে কাছে এসে তিনি উদ্বেগে প্রশ্ন করলেন, কি হয়েছে দীপু?
দীপা অমরনাথের দিকে তাকাল। সেই দৃষ্টির সামনে তিনি কেঁপে উঠলেন। দীপা নিচু গলায় বলল, তুমি কেন এত লোভী হলে! ছিঃ!।