কলেজ এবং হোস্টেলের বাইরে দীপা প্রতি রবিবার বিকেলে মায়ার বাড়িতে যায়। এই সময় মায়া প্ৰায়ই বাড়িতে থাকে না। কিন্তু মায়ার মায়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক এখন এত কাছের হয়ে গিয়েছে যে সময় কাটাতে অসুবিধে হয় না। কলকাতা শহর, উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের মানুষের গল্প ভদ্রমহিলা অনর্গল বলে যান। ওঁর সঞ্চয়ে প্রচুর পুরনো বই রয়েছে। দীপকে সেগুলো তিনি মাঝেমাঝেই পড়তে দেন। স্কটিশচার্চ কলেজের লাইব্রেরিতে নিয়মিত বই আনতে যায়। কিছুদিন একটা ঘোরের মধ্যে কেটেছিল দীপার। কিন্তু হঠাৎই একদিন মনে হল সে পাঠ্যপুস্তক সংক্রান্ত পরিধির বাইরে বড় বেশি মন দিচ্ছে। আর এই সময় সে বিবেকানন্দের লেখা এবং তাঁর জীবনী পড়ে ফেলল। একটা মানুষ অত অল্প দিনের মধ্যে এত কাণ্ড করে ফেললেন? কখনই মনে হল না। ওঁর জীবনটা বড় কম সময়ের। কথাটা এক রবিবারে মায়ার মাকে বলল দীপা। সেদিন মায়া ছিল। মায়ার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল শমিত। লম্বা, খুবই লম্বা, দোহারা চেহারা। মাথা ভর্তি চুল, চোখ বড় আর গলার স্বর ভরাট। মণি কলেজ থেকে বি.এ. পাস করেছে। সদ্য। ফর্সা করে বলে বসল, তাজব! আপনি বিবেকানন্দ পড়েছেন?
তাজ্জব কেন? এই ভাবে কথা বলার মধ্যে একটা তাচ্ছিল্য পেল দীপা।
উত্তর না দিয়ে শমিত জিজ্ঞাসা করল, মায়া, তুমি পড়েছ?
মায়া মাথা নাড়ল, না। বাবা! ধৰ্মটর্ম আমার পোষায় না।
সঙ্গে সঙ্গে ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠল। শমিত, মাসিমা, আপনার মেয়ে তো মায়া? না, না, হতেই পারে না, হসপিটালে ওলট-পালট হয়ে গিয়েছে।
মায়া খুব রেগে গেল, এতে হাসির কি হল? দ্যাখো শমিত, তুমি নাটক ভাল বোঝ মানে এই নয় সব বিষয়ে পণ্ডিত হয়ে গিয়েছ!
চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়ল, উঁহু! আমি শিশির ভাদুড়ি নই। যে নাটক বুঝে গিয়েছি। বোঝার চেষ্টা করছি এইমাত্র। কিন্তু কথা হল যেটা তুমি জানো না বিবেকানন্দের সঙ্গে ধর্মকে যারা জড়ায় তাদের ভাবনা খুবই দুর্বল।
মায়ার মা চুপচাপ কথাগুলো শুনছিলেন, এবার বললেন, শমিত ঠিকই বলেছে।
বাঃ, রামকৃষ্ণদেবের শিষ্য, রামকৃষ্ণমঠের প্রতিষ্ঠাতা বিবেকানন্দের সঙ্গে ধর্মের কোন সংশ্ৰব নেই? মায়া প্ৰতিবাদ করে উঠল।
মায়ার মা বললেন, শোন। বিবেকানন্দ একজন তেজস্বী মানুষ। তাঁর ভাবনায় কোন সংকীর্ণতা ছিল না। তিনি ঠাকুরের শিষ্য ছিলেন বটে। কিন্তু নিজস্ব ভাবনার রূপ দিয়েছেন।
শমিত বলল, মাসিমা, আমি একটু বলি। পৌত্তলিকতায় বিশ্বাস করতেন না। ব্ৰাহ্মসমাজে যাওয়া আসা ছিল, শুনেছি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে গিয়ে দেবেন ঠাকুরকে গান শুনিয়েছেন। এরকম একটা মানুষকে রামকৃষ্ণ বেছে নিলেন কেন? সবাই যখন তাঁর কাছে ছুটে যাচ্ছে শিষ্য হবার জন্যে, কেশনচন্দ্র সেন পর্যন্ত, তখন রামকৃষ্ণ ডাকছেন বিবেকানন্দকে। তার মানে এই ভদ্রলোক স্রোতের বাইরে ছিলেন। মানুষ রামকৃষ্ণকে বিবেকানন্দের পছন্দ হল। তিনি শিষ্যত্ব নিলেন। বোধ হয় কোথাও একটা নাড়া বাঁধার প্রয়োজন পড়ে মানুষের। তা বিবেকানন্দ দক্ষিণেশ্বরে থেকে যেতে পারতেন। থাকেননি। সমস্ত ভারতবর্ষ, ভারতবর্ষের বাইরে ঘুরে বেড়িয়ে বলেছেন নিজেকে জাগাতে হবে।
আত্মকে আবিষ্কার করতে হবে। মাটির দেবতা নয় মানুষকে সেবা করতে হবে। মেয়েলিপনা একদম পছন্দ করতেন না। আমার ধন্দ লাগে, উনি যখন মারা গেলেন তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স একচল্লিশ। অথচ ওঁদের মধ্যে কোন সেতু ছিল না। অথচ দুজনের মন ছিল সংস্কারমুক্ত, দুজনেই কয়েক শতাব্দী বেশি আধুনিক ভাবনা নিয়ে জন্মেছিলেন। চারপাশের আরহাওয়াতে ওই দুইজন ছিলেন বেমানান। এক টানে আমাদের এগিয়ে দিয়ে গেছেন। কিন্তু কেউ কারো ছায়া মাড়ননি। এই সময়ে বিবেকানন্দকে পড়লে মনে হয় আজ যারা কমুনিজমের বুলি আওড়ায় তিনি তাদের থেকে অনেক খাঁটি কম্যুনিষ্ট। মানুষ নিয়ে যে লোকটি কাজ করে গেলেন তাঁর পক্ষে একই সঙ্গে রাজনৈতিক নেতা হওয়ার কোন অসুবিধে ছিল না। বুঝলে খুকি?
দীপা চুপচাপ শুনছিল। এবার বলল, বিবেকানন্দ কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেননি।
শমিত বলল, কিন্তু তিনি স্বাধীনতার সমর্থনে কথা বলেছেন। আগে স্বাধীনতার জন্যে যোগ্য হতে হবে তারপর বাইরে স্বাধীনতা আদায় করতে হবে। এবং সেটা কোন বাইরের শক্তির হাত ধরে নয়। এক জাপানি ভদ্রলোক বোমা বাঁধা শেখাতে এসেছিলেন বলে খুব খেপে গিয়েছিলেন। ব্রিটিশরা বিবেকানন্দকে ভাল চোখে দেখত না। উনি মারা যাওয়ার আগে এদেশে সশস্ত্র বিপ্লবের সূত্রপাত হয়নি।
মায়ার মা বললেন, তুমি এই বিবেকানন্দকে নিয়ে নাটক লিখছি না কেন?
মাথায় আছে মাসিমা। খুব ইচ্ছে করে। এই দীপা, তুমি নাটক করবে?
দীপা হাসল, না। আমি পারব না।
পারবে না। মানে? চলে এস, পরীক্ষা হয়ে যাক।
তা নয়। আমার অন্য উদ্দেশ্য আছে। সেইটেই করতে চাই মন দিয়ে।
কি উদ্দেশ্য?
একান্ত ব্যক্তিগত।
শমিত চোখ বড় বড় করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল, গুড। যেদিন উদ্দেশ্য সফল হবে সেদিন জানিও, আমি তোমার সঙ্গে দেখা করব। মাসিমা, এ মেয়ে কিন্তু গোত্রছাডিা! এবার শমিত ছাড়া সবাই হেসে উঠল।
দীপা বলল, কথাটা কি ঠিক হল? আমি তো গোত্রের মধ্যেই রয়েছি। ওটা মায়া সম্পর্কে বলা উচিত। একসঙ্গে কতগুলো কাজ করছে। কাউকে বোকার মত ভয় পাচ্ছে না। ও যা করতে পারছে বাংলাদেশের কাটি মেয়ে তা পারে?
কথাগুলো বললেও বুকের মধ্যে শমিতের শব্দটা বিধে গিয়েছিল, গোত্রছাড়া। সে কি সত্যি গোত্ৰছাড়া? মনে যতই দ্বিধা না থাক, হিন্দুঘরের বিধবা, মাছ মাংস খায়, রঙিন শাড়ি পরে, গতরাত্রে গ্লোরিয়ার বারংবার অনুরোধে সিগারেটে দুটো টান দিয়ে অনেকক্ষণ কেসেছে নিজের বিছানায় বসে, তার বয়সী কোন বাঙালি মেয়ের এমন অবস্থা? গোত্রছাড়া নয় তো কি?
রাধার সঙ্গে কথা বলতে খুব স্বস্তি পায় দীপা। মেয়েটার কোন ভান নেই, সাজানো অহঙ্কার নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় ও এই কলেজে। সব দিক দিয়ে বেমানান। এক শাড়ি দুদিন পরে আসে এবং দুটোর বেশী শাড়ি এখন পর্যন্ত দেখতে পায়নি। সেন্ট পাউডার শাড়ি সিনেমা অথবা ছেলেদের নিয়ে গল্প করে না। সন্ধ্যা নামের বাগবাজারের একটা মেয়ে তো তাকে বলেই বসলে, ওই রিফ্যুজি মেয়েটার সঙ্গে কি এত কথা বল?
জীবনের কথা। হেসে উত্তর দিয়েছিল দীপা।
তার মানে? হ্যাঁ হয়ে গিয়েছিল সন্ধ্যা।
ধর, তোমার মা-বাবা-দাদা আজ বিকেলে বললেন, কাল থেকে তুমি এ বাড়ির একটা ঘরে শুধু থাকতে পারবে। কিন্তু নিজের খাওয়া, জামাকাপড়, কলেজ পড়ার খরচ তোমাকেই রোজগার করতে হবে, কোন সাহায্য পারে না বাড়ির কাছ থেকে, তুমি কি করবে?
যাঃ, কেউ বলে নাকি?
যদি বলে। তোমার তো আঠারো বছর বয়স হয়ে গিয়েছে। মানুষ হিসেরে তুমি যথেষ্ট সাবালক। আমাদের বয়সে এখন অনেকেই দুই তিন ছেলেমেয়ের মা হয়ে যায়। অতএর তাঁরা যদি তোমাকে নিজের পথ দেখে নিতে বলেন তুমি কি করবে?
দূর! তোমার মাথা খারাপ!
আমি বলছি, যদি বলেন তাহলে—
মামা যদি জায়গা না দেন?
ওরে বাবা! তাহলে না খেয়ে মরতে হবে। শিউরে উঠল সন্ধ্যা।
কিন্তু যারা মরতে চায় না, যারা লড়াই করে, তাদের কাছেই জীবনের গল্প শোনা যায়।
ও তাই বল! ঠোঁট ওল্টালো সন্ধ্যা, তুমি ওই রিফ্যুজি মেয়েটার সঙ্গে আমার তুলনা করছ! আমি আর ও সমান হলাম।
প্রচণ্ড রাগ হয়ে গিয়েছিল দীপার। সে বলল, শোন, তুমি আর কখনও আমাকে ডেকে কথা বলবে না। তোমার সঙ্গে কথা বলার কোন প্রবৃত্তি নেই। আমার।
ছুটির পরে অসীমের সঙ্গে দেখা হল দীপার। গেটের সামনে দাঁড়িয়েছিল গম্ভীর মুখে। বলল, তুমি পরশু চলে যাচ্ছ?
হেসে ফেলল দীপা, কি ব্যাপার বলতো? তুমি কি দিন গুনছ?
না, মানে, আমার ভাল লাগছে না।
কেন? দীপা অন্যদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল।
কি ছেলেমানুষী করছ? কোন একটা প্ৰতিক্রিয়া হচ্ছে অথচ কেন হচ্ছে জানি না। এমন বয়স থেকে আমরা অনেকদিন আগে চলে এসেছি। বেশ শক্ত গলায় কথা বলল দীপা। অসীম অবাক হয়ে তাকল, তোমার কি হয়েছে?
আমার মন মেজাজ ভাল নেই।
কেন?
দ্যাখো, ছেলেরা নয়, মেয়েরাই মেয়েদের এক নম্বর শত্ৰু। কোন মেয়ে আর একটা মেয়ের প্রশংসা প্ৰাণ খুলে করতে পারে না। যাদের অহঙ্কার করার কোন কারণ নেই তারাই আকাশে নাক তুলে থাকে। সময় বিশেষে ননীর পুতুল, ন্যাকামি অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন হতে পারে, আবার পরীক্ষণেই ফণা বের করতে এদের জুড়ি নেই।
আজ কিছু হয়েছে? অসীম শক্ত গলায় জানতে চাইল।
একটি মেয়ে যে সাজগোজ আর শরীর নিয়ে ব্যস্ত থাকে, বাপ দাদার মেহকে ন্যায্য অধিকার মনে করে নিশ্চিত সে সমালোচনা করছে একটা লড়িয়ে মেয়েকে যাকে সাহায্য করার কেউ নেই, পায়ব তলার মাটি খুঁজতে যে হিমসিম খাচ্ছে। নিজের যোগ্যতা নেই এক ফোঁটা। সে করছে অন্যের সমালোচনা।
তুমি এত উত্তেজিত হচ্ছে কেন?
হব না? এক শো বছরেও আমাদের বেশির ভাগ মেয়েদের কোন পরিবর্তন হল না? শরৎচন্দ্রের সেই মুখরা নিন্দুক স্বভাবের নারী চরিত্র দিব্যি খোলস পাল্টে বেঁচে রয়েছে? কে বলবে এদেশে রবীন্দ্ৰনাথ বিবেকানন্দ জন্মেছিলেন?
হঠাৎ এদের কথা?
কদিন আগে মায়ার বাড়িতে বিবেকানন্দ নিয়ে কথা হচ্ছিল। ওঁর বই পড়ছিলাম। আমেরিকায় গিয়ে বিবেকানন্দ সেই দেশের মেয়েদের মুক্ত জীবন দেখে অভিভূত হন। প্রকাশ্যেই বলেন, শত সহস্রাবার জন্মেও আমি আপনাদের কাছে আমার গভীর কৃতজ্ঞতার ঋণ শোধ করতে পারব না। এই সম্মান পাওয়ার কোন আকাঙক্ষাই আমাদের দেশের মেয়েদের মধ্যে নেই।
পথ শেষ হয়ে আসছিল। হোস্টেলের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অসীম বলল, এত তাড়াতাড়ি না ফিরে চল না কফিহাউসে গিয়ে বসি।
না। বাবা। ওটা মাছের বাজার। আমার ভাল লাগেনি।
দীপা–।
বল। আমি, আমি,-না থাক, কাল কলেজে দেখা হবে। অসীম মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল। দীপা দাঁড়িয়ে রইল যতদূর অসীমকে দেখা যায় সে দেখল। অসীম কিন্তু একবোবও পিছু ফিরে তাকাল না। নিজেকে সংযত করতে চাইল দীপা। উপলক্ষ যেন আসল বস্তুকে অতিক্রম করে না যায়। হঠাৎ সে এক বিপরীত ভাবনার আরর্তে পড়ল। কোনটে আসল আর কোনটে উপলক্ষ তা গালমাল হয়ে যায়। আজ যা আসল বস্তু কাল তা উপলক্ষ হয়ে যেতে পারে। রামকৃষ্ণদেবের আশীর্বাদ এবং তাঁর কাছে দীক্ষা নেওয়াকেই সেই সময়ের অনেক মানুষ মোক্ষাপ্ৰাপ্তি বলে মনে করতেন। সেটাই তাঁদের কাছে আসল বস্তু ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালের জীবন বলে দিচ্ছে বিবেকানন্দের সেটা ছিল একটা উপলক্ষ। যার মাধ্যমে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে তিনি মানুষের কাছে পৌঁছাতে চেয়েছিলেন। অথাৎ মানুষই তাঁর কাছে ছিল আসল বস্তু। অসীম চলে গিয়েছে কিন্তু ওই মানুষটি আজ তাকে বড় টানতে লাগল। প্রায় পঞ্চান্ন বছর আগে যে মানুষটি মারা গিয়েছেন তিনি আধুনিকতা শব্দটিব সঠিক প্ৰতিনিধি। আর রবীন্দ্রনাথ? দীপা মাথা নাড়ল। সব গোলমাল হয়ে যায়। একজন বাঙালির হৃদয় যদি রবীন্দ্ৰনাথ হয় তবে তার মস্তিষ্ক বিবেকানন্দ হওয়া উচিত।
দীপা আশা করেছিল জলপাইগুড়িতে যাওয়ার আগে সুভাষচন্দ্র তার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। কিন্তু এলেন না। দীপাকে কখনই তিনি বাড়িতে যাওয়ার কথা বলেননি। ফলে মন থেকে কোন তাগিদ বোধ করেনি সে।
গ্লোরিয়ারা ছুটিতে কলকাতায় থাকছে না। ওরা চলে গেল দিল্লিতে। সেখানে সমস্ত দেশে ছড়িয়ে থাকা জাম্বিয়ার ছেলেমেয়ে এক সয়ে ছুটি কাটায়। ঘন ঘন দেশে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সেই একটা রাত মেয়েটা অঝোরে কেঁদেছিল। কিন্তু তারপর একদম স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। ওর জীবনের অত বড় একটা ঘটনা এক রাতের কান্নায় শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সত্যি কি যায়? দেশ কাল সমাজে ভেদে একজন মেয়ে আর কতটা আলাদা হতে পারে? অবশ্য ওর আচরণ দেখে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। যা বাস্তব তার বিরুদ্ধে নিজের জীবনকে টেনে রাখার মত বোকামি সে অন্তত করছে না।
হোস্টেলের দারোয়ান ট্যাক্সি ডেকে আনল। বিছানাপত্র রয়ে গেল, নিজের জামাকাপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে সুপারের সঙ্গে দেখা করে এসে ট্যাক্সিতে উঠে বসতেই কেমন অস্বস্তি হল। এতটা পথ, প্ৰায় চব্বিশ ঘণ্টার, তাকে একা যেতে হবে। সে যখন দ্বিতীয়বার কলকাতায় এসেছিল তখন একটা জেদ কাজ করছিল। এবার খুব একলা লাগছে। হোস্টেলের অন্য মেয়েদের গার্জেনরা এসে গতকাল থেকেই তাদের নিয়ে যেতে শুরু করেছেন। তাকে নিতে কেউ আসেনি। শুনে সুপার খুব অবাক হয়েছিলেন।
ট্যাক্সি চলতে শুরু করতেই দীপা দেখতে পেল অসীম ফুটপাত থেকে নেমে এসে হাত তুলে তাকে থামতে বলছে। সে ড্রাইভারকে বলতেই ট্যাক্সি থামল। দরজা খুলে উঠে বসল। অসীম, উঃ, আর একটু হলে মিস করতাম। চলিয়ে ভাই।
তুমি কোথায় যাচ্ছ? দীপা অবাক।
তোমাকে সি-অফ করতে। কাঁধের কাপড়ের ব্যাগটা পাশে নামিয়ে রাখল। অসীম। দীপা বলল, আমি কিন্তু একদম আশা করিনি।
অসীম হাসল, কিছু বলল না।
দীপা, ঠাট্টা করল, তুমি যে আমার সঙ্গে এক ট্যাক্সিতে যাচ্ছ, কেউ দেখতে পেলে?
অসীম হাত নাড়ল, যাঃ বাবা! তুমিও সন্ধ্যাদের মত কথা বলছ!
সন্ধ্যার সঙ্গে তোমার কথা হয়েছে নাকি?
আমার নয়, দীপকের। দীপক ওর সঙ্গে ভাব করতে চেয়েছিল। দীপককে চেন তো? ফ্যবসা লম্বা দের আনন্দের মত হাঁটে। ফোর্থ ইয়ার সায়েন্স। দীপক বলে ওকে নাকি সন্ধ্যা দেখলেই চোখ ঘুরিয়ে হাসে। তাই সাহস পেয়ে রাস্তায় কথা বলেছিল। সন্ধ্যা আর একটা মেয়ে ছিল। একটা প্রশ্নের জবাব না দিয়ে প্ৰায় দৌড়েই চলে গিয়েছিল।
তারপর? মজা পেল দীপা।
পরদিন কলেজে দূর থেকে দেখা হতেই যেই সন্ধ্যা হাসল অমনি দীপক এগিয়ে গিয়ে কডা গলায় বলল, হাসতে লজ্জা করে না? রাস্তায় কথা বললে পালিয়ে যাও। তার উত্তরে সন্ধ্যা বলেছে, কি করব। রাস্তায্য কথা বললে যদি কেউ দেখে ফেলে? আর আমাকে কলেজে আসতে দেবে না। কলেজের মধ্যে কথা বললে বাড়ির লোক জানবে না।
কি অবস্থা! দীপা মাথা নাড়ল।
শিয়ালদা স্টেশনে নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেসে বেশ ভিড় হয়। কিন্তু মেয়েদের একটা আনরিজাৰ্ভড কামরায় বসতে পাওয়া যায়। সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছিল দীপা কিন্তু অসীম বাধা দিল, দূর! মেয়েদের কম্পার্টমেন্টে অসহায় মেয়েরা ওঠে।
জেনারেল কম্পার্টমেন্টে জায়গা পাব না।
চল না দেখি। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে জায়গা পেয়ে গেল অসীম। এক বৃদ্ধকে চারজন তুলে দিতে এসে বেঞ্চি দখল করে বসেছিল। অসীম তাদের কথা দিল বৃদ্ধকে যত্ন করে সকরিকলি মনিহারি ঘাট পার করে দেবে। যেহেতু জানলার পাশে বসলে বৃদ্ধের হাওয়ায় ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে তাই ওরা ওদিকটাও পেয়ে গেল দীপার। পাশে অসীম বসার পর বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন কাঁপা গলায়, তোমরা কোথায় যাচ্ছ বাবা?
জলপাইগুড়ি। অসীম জবাব দিল।
কোন পাড়া?
এবার দীপার দিকে তাকাল অসীম। দীপা হেসে ফেলল, আমি চা-বাগানে থাকি। আপনি জলপাইগুড়িতে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ। কালীঘাট দেখতে এসেছিলাম। হাকিমপাড়ায় ব্যানার্জীদের পাশেই আমার বাড়ি। ব্যানার্জীরা তো মরে হেজে গিয়েছে। নিজের মনেই শেষ কথাগুলো বললেন বৃদ্ধ আর শক্ত হয়ে গেল দীপা। ভদ্রলোক নিশ্চয়ই প্রতুল ব্যানার্জীর কথা বলছেন। সবাই ওই বাড়িটাকেই ব্যানার্জী বাড়ি বলত। ওঁর পক্ষে দীপাকে চিনতে পারা সম্ভব নয়। এইসময় অসীম চাপা গলায় বলল, আর একটু হলে ধরা পড়ে যাচ্ছিলাম। আমি তো কোন পাড়ার নাম জানি না। এই সময় হুইসল। বাজতেই প্লাটফর্মে ব্যস্ততা শুরু হল। দীপা বলল, যাও, নেমে যাও।
কোথায়? বড় চোখে তাকাল অসীম।
আশ্চর্য। ট্রেন ছেড়ে দেবে না?
পরে নামলেও তো চলবে।
দক্ষিণেশ্বরে। আবার বাস ধরে ফিরতে হবে।
অসীম কিছু বলল না। কিন্তু সে দক্ষিণেশ্বরেও নামিল না। এবার সত্যি সত্যি ঘাবড়ে গেল দীপা। অসীম চাপা গলায় বলল, তোমাকে পৌঁছে দের বলে বেরিয়েছি।
তুমি কি পাগল।
যা ভাব।
টিকিট কেটেছ?
সেই জন্যে তো হোস্টেলে তোমার কাছে পৌঁছাতে দেরি হয়ে গেল।
বাড়িতে বলে বেরিয়েছ?
অবশ্যই।
হঠাৎ একটা ভাল লাগায় আক্রান্ত হল দীপা। এমনটা কেউ করতে পারে ধারণায় ছিল না তার। অসীম আগে থেকেই এতটা ভেবে রেখেছে? কিন্তু জলপাইগুড়িতে পৌঁছেই ফিরে আসতে হবে যে ওকে। চা-বাগানের বাড়িতে নিয়ে গেলে যে কুরুক্ষেত্র বাধরে সেটা সে চায় না। একের পর এক স্টেশন চলে যাচ্ছে আর ভাল লাগাটা তীব্রতর হচ্ছে। চারপাশে একটাও চেনামুখ নেই, কাউকে জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। নানা রকম গল্প করে চলেছে। ওরা। সূৰ্য্যাস্তের মুহুর্তে ট্রেন গঙ্গার ধারে গিয়ে থামল। যাত্রীরা ছুটছে স্টিমারের জায়গা দখল করতে। কুলিদের চিৎকার শুরু হয়েছে। অসীম বৃদ্ধিকে সযত্নে নামিয়ে ধীরে ধীরে চলল।
স্টিমারে উঠে বৃদ্ধ বললেন, তোমরা ভাই বোন দুটি খুব ভাল।
অসীম মাথা নাড়ল, না, না, আমরা ভাইবোন নাই।
মানে? বৃদ্ধ হাঁ হয়ে গেলেন। দীপার সিঁথির দিকে তাকালেন।
আমরা বন্ধু। একসঙ্গে পড়ি।
বন্ধু অনাত্মীয়?
কি হল? এরপর আর আমার সাহায্য নেবেন না?
না শব্দ ছিটকে এল বৃদ্ধের শরীর থেকে।
ঠিক আছে। চল দীপা। অসীম অমানবদনে হাঁটতে লাগল ভিড় সামলে। এই ব্যাপারটা আরও চমৎকৃত করল দীপাকে। এত স্পষ্ট কথা অসীম বলতে পারল? এই কয়েকমাসে সে কি ওকে চিনতে পারেনি?
সন্ধে নামছে নদীর ওপর। হাওয়া দিচ্ছে খুব। ভোঁ বাজিয়ে স্টিমার ছাড়ল। লোয়ার ডেকে গিজগিজ করতে মানুষ। যেহেতু ওদের টিকিট প্রথম শ্রেণীর নয়। তাই আপার ডেকে না গিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিল। গঙ্গার ঢেউ এ স্টিমারের আলো নকশা আঁকছে। দীপার খুব ভাল লাগছিল। এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে। চুপচাপ।
নদী পেরিয়ে ঘাটে স্টিমার লাগতেই আবার বালির চরে দৌড়বীপ শুরু হল। অনেক দূরে দাঁড়ানো ট্রেনে জায়গা দখল করা, একটা গোটা রাত না ঘুমিয়ে গল্প করে যাওয়া, দীপা যা কখনও করবে বলে স্বপ্নেও ভাবেনি। আর এইসব কথারা এতদিন কোথায় ছিল? না, খুব স্বাভাবিক কথাবার্তা, রসিকতা, নানান বিষয়ের গল্প। আর কখনই হৃদয় সংক্রান্ত সংলাপ নয়। যেন দুজনেই জানত পৃথিবীর সব বিষয় নিয়ে কথা বলা যায় শুধু ওইটুকু ছাড়া। রাত যখন গড়াতে থাকে, কামরায় যখন ঘুম জাঁকিয়ে বসেছে তখন চুপচাপ খোলা জানলা দিয়ে অন্ধকার দেখে যেতে যে কি ভাল লাগে তা জানা ছিল না দীপার।
সকাল হয়ে গেল শিলিগুড়িতে পৌঁছাতে। স্টেশনের বাইরে এসে দীপা অসীমের মুখের দিকে তাকাল। অসীম জিজ্ঞাসা করল, এখান থেকে কতদূর?
অনেক। জলপাইগুড়ি শহর হয়ে গেলে দুবার বাস পাল্টাতে হবে। নৌকেও। আর সেবক দিয়ে গেলে এখান থেকে এক বাসেই যাওয়া যায়।
তই তো গেলে হয়।
রিকশায় চেপে ওরা বাসস্ট্যান্ডে এল। আলিপুরদুয়ারের বাস ছাড়ছে। দীপা অসীমকে বলল, আমার খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু কি ভাবে তোমাকে নিয়ে যাই।
আমি তো তোমাদের বাড়িতে যাব বলে আসিনি।
জানি। কিন্তু শুধু আমাকে পৌঁছে দিয়ে তুমি আবার ফিরে যাবে এটা ভাবতেই ভাল লাগছে না। এতটা পথ, একা একা!
তোমার বাস হর্ন দিচ্ছে।
আচমকা দীপা প্রশ্ন করল, তুমি তো আমাকে ভাল করে জানোই না। সত্যি কথা বলতো, তুমি কেন এলে?
তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ থাকব বলে।
দীপা আর কিছু না বলে বাসে উঠল। ভিড় হয়ে গেছে এরই মধ্যে কিন্তু জানলার পাশে জায়গা পেতে অসুবিধে হল না। কন্টাক্টর অনেক বকাঝকা করে দুটো দেহাতি লোককে সরিয়ে জায়গা করে দিল। এদেশে মেয়ে হিসেরে শুধু এইটুকু সুবিধে পাওয়া যায়। কদিন আগেও দীপার মনে হয়েছিল এটা এক ধরনের করুণা। সে এমন করুণার দান গ্ৰহণ করবে: না। কিন্তু এখন সেই ভাবনা কাজ করল না। সে দেখল। অসীম শিষ্টুটা দূরে দাঁড়িয়ে তার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। চোখাচে্যুখি হতেই এগিয়ে এল। অসীম। গলা তুলে বলল, এখানকার হাসপাতাল পাড়ায় আমার মেশোমশাই ডাক্তাব। ডক্টর রামানন্দ মুখার্জি। তুমি চিন্তা করো না, আমি ওঁর কাছে তিন চারদিন থেকে ফিরে যাব।
এইসময় বাস ছাড়ল। অসীমকে আর দেখা গেল না। কিন্তু এবার উদ্বেগ অস্বস্তির ওপর স্বস্তির হাল্কা প্ৰলেপ লাগল। সে জানলায় মাথা রাখল। শিলিগুড়ি শহর ছাড়িয়ে গাড়ি ছুটিছে সেবকের দিকে। আকাশে পুজো পুজো রঙ, রোদের চেহারা পাল্টাচ্ছে। হঠাৎ সে আড়ষ্ট হয়ে গেল। না, এ হতে পারেন। সে জেনেশুনে কি করে একটা ভুল করতে চলেছে! অসীমের সঙ্গে তার সম্পর্ক প্ৰায় তৈরি হতে চলল। কিন্তু কোন প্ৰস্তুতি ছাড়াই? সে কি নিজেকে কখনও জিজ্ঞাসা করেছে যে অসীমকে প্রয়োজন আছে কিনা? অসীমের জন্যে কোন টান তো কখনও তেমন করে অনুভব করেনি। নিজের চারপাশে একটা বাঁধ দিয়ে চমৎকার ছিল সে। কলকাতা থেকে এমনভাবে সঙ্গে এসে অসীম সেই বাঁধ ভেঙে দিচ্ছে। এটা কখনও ঠিক নয়। প্ৰথম কথা অসীমের জানা উচিত তার অতীতে কি কি ঘটে গিয়েছে। সেই জানার পরে ওর প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে সেটাও অজানা। দ্বিতীয়ত অসীমের ব্যক্তিজীবন সে জানে না। সাময়িক ভাল লাগা থেকে সে আর একটা ছেলেখেলায় জড়াতে চায় না। কিন্তু গত দিন এবং রাতের যে ভাললাগা, সেটা কি মিথ্যে! এখনও তার রেশ মন জুড়ে। তাহলে? দুই বিপরীত মেরু থেকে টান অনুভব করতে লাগল দীপা। গাড়ি কখন সেবক ব্রিজ, বাগরাকোট ছাড়িয়ে মালবাজারে পৌঁছে গিয়েছে খেয়ালই করেনি। হঠাৎ সে সোজা হয়ে বসল। না, তার পথ একটাই। যে করেই হোক মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে। সত্যসাধন মাস্টার তাকে যা বলে গিয়েছিলেন তা কখনই মিথ্যে হতে দেবে না সে। ব্যক্তিগত আবেগ, ভাললাগা, হৃদয়ের আর্তি, এসব ভুলে যেতে হবে তাকে। তাকে পৌঁছাতে হবে সেই জায়গায় যেখানে গেলে লোকে বলবে কৃতী মানুষ।
সূর্য যখন মধ্যগগন অতিক্রমণ করেছে, চা-বাগানের ওপর পোড়া রোদ ধকধক করছে তখন নাকে পরিচিত গন্ধ এল। দীপা তৃপ্তি নিয়ে চেনা গাছ, চায়ের বাগান, দূরের ফ্যাক্টরি আর উলঙ্গ মদেশিয়া শিশুদের কৌতূহলী দৃষ্টি দেখে উঠে দাঁড়াল। কন্টাক্টর ঘন্টি বাজিয়ে চিৎকার করল, বাগান?
দীপা মাথা নেড়ে ব্যাগ হাতে ব্যালেন্স সামলে দরজার দিকে এগোতে লাগল। ঠিক মাঠের শেষে সিঁড়ির সামনে থেমে গেল বাস। নিচে নেমে দীপা দেখল কোয়ার্টার্সগুলোর বাইরের দরজাগুলো বন্ধ। সামনের। মাঠেও কেউ নেই। এই ভরদুপুরে কারো সেই প্রয়োজন পড়েনি। বাস চলে যাওয়ার পর শূন্য আসাম রোড আবার দেওদার শিরীষের ছায়ায় মাখামাখি হয়ে গেল। দীপার মনে হল অনেককাল বাদে নিজের মাটির কাছে ফিরে এল। সে ব্যাগ নিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে দেখতে পেল শ্যামলদা সাইকেল চেপে ফ্যাক্টরিতে ডিউটি করতে যাচ্ছে। মাথায় চুল অনেক পড়ে গিয়েছে, একটু মোটা দেখাচ্ছে। দািব শ্যামলদা যে তাকে চিনতে পারেনি তা কাছে আসার পর বোঝা গেল, আরে তুই। আমি ভাবলাম কোন ভদ্রমহিলা। কলেজ ছুটি হয়ে গেল?
হ্যাঁ। দীপা হাসার চেষ্টা করল।
তুই কি একা এলি কলকাতা থেকে? বিস্ময় যেন যাচ্ছিল না।
হ্যাঁ।
ও! চলি রে! শ্যামলদা সাইকেলের প্যাডেল ঘোরাল।
মাঠ পেরিয়ে বারান্দায় উঠল দীপা। দরজা বন্ধ। তিন চারবার কড়া নাডাব পাব ভেতর থেকে গলার আওয়াজ ভেসে এল, কে? এই ভরদুপুরে যে কে আসে! গলাটা অঞ্জলির। খিল খোলার আওয়াজেই বোঝা গেল যে সে খুব বিরক্ত। দরজা খুলে সামনে দীপাকে দেখে তার চোখ ছোট হয়ে গেল, কপালে ভাঁজ পড়ল। তারপর কিছু না বলে আচমকা ঘুরে বড় বড় পা ফেলে ভেতরে চলে গেল।
দীপা হতভম্ব। আর যাই হোক এমনভাবে অঞ্জলি তাকে গ্রহণ করবে। সে কল্পনাও করেনি। ব্যাগ নিয়ে ভেতরে ঢুকাল দীপা। বাইরের ঘরে কেউ নেই। ভেতরের ঘরে ঢুকেই সে দেওয়ালের দিক-ঘেষা খাটে অমরনাথকে শুয়ে থাকতে দেখল। অঞ্জলি এখানে নেই। অমরনাথ একা। চোখ বন্ধ।
ব্যাগটাকে নামিয়ে রেখে সে খাটের পাশে চলে এল। মনে হল অমরনাথ ঘুমোচ্ছেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল দীপা। এবং তারপরে পায়ের আওয়াজ কানে এল। মনোরমা উঠোনের দিকের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন। চোখাচোখি হতেই ইশারায় উঠে আসতে বললেন। বাবার দিকে আর একবার তাকিয়ে দীপা নিঃশব্দে ঠাকুমাকে অনুসরণ করল। মনোরমা নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন না। তাকে। কারণটা দীপা জানে। বাইরের কাপড়, বাসি কাপড় ইত্যাদি ভাবনা এখন মনোরমার মনে কাজ করছে। বারান্দার একটা মোড়া দেখিয়ে মনোরমা বললেন, বোস।
দীপা বলল না, ঠিক আছে।
তুই একা এলি? মনোরমা জানতে চাইলেন।
আবার কে আসবে সঙ্গে?
আমি ভাবলাম তোর মামা নিয়ে আসবে তোকে।
তাঁর কাজকর্ম থাকতে পারে। তাছাড়া আমি তো আর বাচ্চা নাই। দীপা হাসল, আমার চিঠি পাওনি তোমরা?
পেয়েছি।
কি হয়েছে? এমন করে কথা বলছি কেন? দীপা সন্দেহ বোঝাল।
এবার হঠাৎ মনোরম আঁচলে মুখ চেপে কেঁদে উঠলেন। শব্দটা ঢাকার চেষ্টা সত্ত্বেও সেটা একবার ছিটকে বেরুল। সেটা শুনতে পেয়েই সম্ভবত অঞ্জলি রান্নাঘরের বারান্দায় বেরিয়ে এল, আপনি আবার কাঁদছেন মা? আমি না। আপনাকে কাঁদতে নিষেধ করেছি।