1 of 2

১২. রমলার চিঠি

স্নেহের দীপাবলী, তোমার চিঠি পেয়েছি। তোমাকে আমি ইংরেজিতে চিঠি লিখতে বলেছিলাম। অথচ সেটা পেয়ে আমি বাংলায় কেন লিখছি তাই ভেবে নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছ। সেইটে আগে বুঝিয়ে বলি! আমাদের সময় আমরা ইংরেজিটা বাংলার চেয়ে ভাল শিখতাম। কোন কিছু বানিয়ে লিখতে বললে বাংলার বদলে ইংরেজিতে লিখলে সুবিধে হত। নেসফিল্ডের গ্রামারবই সেই ছোট্টবেলায় এমন গিলিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে ইংরেজি বাক্য ভুল লিখতেই পাবতাম না! এতে উপকার হয়েছে দুটো। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত বিখ্যাত বই ইংরেজি ভাষায় পাওয়া যায়। পিতৃভাষায় দক্ষতা থাকায় সেগুলোতে ড়ুবে যেতে অসুবিধে হয় না। দ্বিতীয়ত জিভের আড়ষ্টতা চলে গেলে কথা বলতে সুবিধা হয়। মনে রেখ বাংলার বাইরেই কেউ বাংলাভাষাটা বোঝে না। বড় জায়গায় পৌঁছাতে হলে নিজেকে আন্তর্জাতিক করতেই হবে। শুনেছি রাশিয়ান বা ফরাসীরা ইংরেজি বলে না। পৃথিবীর ইতিহাসে যদি কখনও রাশিয়ান বা ফরাসীদের মত জায়গা দখল করতে পারি। তখন না হয় শুধু বাংলা ব্যবহার করব। তোমার ইংরেজি বিদ্যে কতটুকু তা জানার জন্যেই ইংরেজিতে চিঠি লিখতে বলেছিলাম। খুব ভাল লাগল, কারণ একটি বানান ভুল পাইনি, ছোট ছোট বাক্যে মনের কথা লিখতে পেরেছ। আমি বিশ্বাস করছি। কেউ তোমাকে ওই চিঠি লিখতে সাহায্য করেনি। চা-বাগানে থেকে অমন স্কুলে পড়েও যে তুমি ওই চিঠি লিখতে পেরেছ তার জন্যে তোমার মাস্টারমশাইকে আমার শ্রদ্ধা জানালাম।

এখন কেমন আছ? পরীক্ষা তো দরজায়। যদি জলপাইগুড়ির বদলে শিলিগুড়িতে তোমাদের সিট পড়ত তাহলে আমার এখানে থেকে পরীক্ষা দিতে পারতে। দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাও। তোমাকে সাফল্য পেতেই হবে। মনে রেখ আমি যখন পাশ করেছিলাম, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম তখন মেয়েদের হাতে গোনা যেত। এখনও ছবিটা বড় বেশী পাল্টায়নি। আমাকে ঘোড়ামুখো মেয়ে বলা হত। আমাদের সমাজ আমার এই ঔদ্ধত মেনে নেয়নি। বয়েই গেছে আমার। তুমিও যা ন্যায় মনে করবে তাই সত্য বলে ভাববে। সেই সত্যের জন্যে কিছুর সঙ্গে আপোষ করো না।

মাথা ঠাণ্ডা রেখে পরীক্ষা দেবে। যে প্রশ্নটিকে কঠিন মনে হবে তার উত্তর আগে লিখবো। কারণ তখন তোমার মাথা তাজা থাকবে এবং তুমি কিছু একটা ভেবে বের করতে পারবে। সহজ উত্তরগুলো লিখে ফেলার পর কঠিনটা নিয়ে আর ভাবার অবকাশ পারে না। যেন তেন করে। সারতে হবে তখন, নম্বরও কমে যাবে। কঠিনটাকে সরিয়ে রেখে সহজটাকে ধরা মানে পালিয়ে যাওয়া। সহজ যা তা তো পরেও সহজ থাকে। তাই না?

এ চিঠির উত্তর আমি এখন চাই না। সব পরীক্ষা শেষ হলে একটা লম্বা চিঠি লিখে আমাকে জানিও। তোমার এগিয়ে যাওয়ার পথে আমার শুভেচ্ছা সব সময় থাকবে। ইতি, রমলা সেন।

চিঠিটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল দীপা। রমলা সেনের চিঠি এলেই মন ভাল হয়ে যায়। বয়স্ক মানুষটা কেমন বন্ধুর মত কথা বলেন। গত দুবছর ধরে প্রতি মাসে দুটি করে চিঠি লেখে দীপা, জবাব পায়। চিঠিটা অমরনাথ সকালে জলখাবার খেতে আসবার সময় ফ্যাক্টরি থেকে এনেছিলেন। বাগানের সবার চিঠি ফ্যাক্টরিতে জমা হয়। জলখাবার খেয়ে আবার কাজে যাওয়ার সময় তিনি পড়ার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ালেন। আগে যেটা বসার ঘর ছিল সেটা বাড়িয়ে পাটিশন দিয়ে দীপার পড়ার ঘর করে দেওয়া হয়েছে অনেকদিন। পায়ের আওয়াজ থেমে যেতে দীপা মুখ ফিরিয়ে তাকাল।

অমরনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, কার চিঠি? রমলা সেনের?

দীপা মাথা নাড়ল। অমরনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, কি লিখেছেন?

দীপা বলল, পড়বে? আমার কি করা উচিত তাই লিখেছেন!

অমরনাথ কথা না বলে হেসে নিচে নেমে গেলেন। দীপা দেখল বেড়ার গায়ে হেলান দেওয়া সাইকেল টেনে নিয়ে তিনি ফ্যাক্টরির দিকে রওনা হলেন। দীপা জানলা দিয়ে মাঠের দিকে তাকাল। সকালের রোদে মাঠ, চাঁপা ফুলের গাছ মাখামাখি। আসাম রোড দিয়ে বাস ছুটে যাচ্ছে। পাখি ডাকছে গাছে গাছে। পৃথিবীটা কি শান্ত! দীপা চিঠিটাকে আর একবার দেখল। ভোর চারটের সময় পড়তে বসেছে। আজকাল পাঁচটার পরেই সকাল হয়ে যায়। সারাদিনে পনের ঘণ্টা না পড়লে খুব খারাপ লাগে। টেস্ট পেপারটা নিয়ে আবার অঙ্ক কাষতে বসতেই বারান্দায় শব্দ হল। সাধারণত বারান্দার দিকের দরজাটা বন্ধ রাখে পড়াব সময়। দীপা দেখল। খবরের কাগজ পড়ে আছে। সে উঠে আজকের কাগজটা তুলে নিল। জহরলাল নেহেরু কি বলেছেন, বিধানচন্দ্র রায় কি করেছেন, কমু্যনিস্টরা কোথায় আন্দোলন করেছে, এইসব। প্ৰথম পাতাটা পড়তে মোটেই ভাল লাগে না। দ্বিতীয় পাতা খুলতে সুচিত্রা-উত্তমের ছবি দেখতে পেল সে। গত কালীপূজোয় মাঠে সিনেমা দেখানো হয়েছিল। অগ্নিপরীক্ষা। গানে মোর ইন্দ্ৰধনু। মনের ভেতর গুনগুনিয়ে বেজে যায় সর্বক্ষণ। তখন সুচিত্রা উত্তমকে দেখেছিল সে। যেতে চায়নি প্ৰথমে। অঞ্জলি জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তখন অনেক রাত। মাথায় চাদর জড়িয়ে সবার পেছনে মায়ের সঙ্গে ত্রিপলের ওপর বসে দেখেছিল। সুচিত্রা সেনের ছবি দেখলেই মালবাবুর বাড়ির সেই ছেলেটার কথা মনে পড়ে। সেই কতবছর আগে শিউলিফুল তুলছিল সে ভোরবেলায়। ছেলেটি সামনে। এসে বলেছিল তোমাকে দেখতে ঠিক সুচিত্রা সেনের মত। খুব রাগ হয়ে গিয়েছিল সেদিন। আজ হাসি পেল। ছেলেটাকে তারপর আর কখনও দ্যাখেনি সে।

খবরের কাগজ বাইরের ঘরের টেবিলে রেখে দিয়ে সে ভেতরে এল। এখন সবাই রান্নাঘরে। বারান্দা দিয়ে উঠোনে নামার সময় মনোরমার গলা ভেসে এল, সুজিটা খেয়ে যা। দীপা মুখ ভেংচালো, রোজ রোজ সৃজি ভাল্লাগে না!

আর কি করব বলে দে। লুচি বেগুন ভাজা ভাল লাগে না, পরোটায় অরুচি হয়ে গিয়েছে, দুধ-রুটি দিলে বলবি রুগীর খাবার। আমার হয়েছে জ্বালা। মনোরমার গলায় অসন্তোষ। দীপা এগিয়ে গিয়ে দরজা থেকে বাটি তুলে নিল, একটা চামচ দাও। মনোরমা নিজে কখনও চামচ ব্যবহার করেন না। কিন্তু তিনি এগিয়ে দিলেন। উঠোনে দাঁড়িয়ে সরে সুমন্ত সুজি মুখে পুরেছে দীপা অমনি ছোট ভাই বলে উঠল, এই দিদি, আমাকে দিবি?

দীপা মাথা নেড়ে হ্যা বলতে না বলতেই রান্নাঘর থেকে অঞ্জলি ধমকে উঠল, এ্যাই, কি হ্যাংলারে তুই! একটু আগে ডিমসিদ্ধ খেলি এখন সুজি চাইছিস! দিদি কি ডিম খায় যে তোকে সুজি দেবে? একদম দিবি না। ওকে দীপা!

মনোরমা সুজিতে বড় বেশী মিষ্টি দেন। কিন্তু সেকথা বললে বেগে যান। আজ তেজপাতা এবং এলাচ থাকা সত্ত্বেও সুজিটাকে বিস্বাদ লাগল দীপার। ছোট ভাই ততক্ষণে সরে গিয়েছে সামনে থেকে। আর একটু হেঁটে বাড়ির পাশের লিচু গাছের তলায় এল সে। তারপর এক চামচ সুজি খুঁড়ে দিল মাটিতে। আমনি দুটো পাতিকাক লাফিয়ে পড়ল সেখানে। দুই ঠোকরে সেটা সাবাড়ি করে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকাতে লাগল দীপার দিকে। একটু একটু করে কাকদুটোকে সুজি খাওয়াতে লাগল সে।

তার মায়ের রান্নাঘরে বসে খাওয়ার পাট চুকেছে সেই বড় অসুখ থেকে সেরে ওঠার পর থেকেই। মনোরমার রান্নাঘরে এখন তার জন্য রান্না হয়। আলোচালের ভাত, ডাল, তরকারি, ভাজা। চাটনিটা অবশ্যই। আগে মনোরমা একরেলা রান্না করতেন। এখন রাত্রে রুটি করেন। ওঁর শরীর খারাপ হলে অঞ্জলি এখানে এসে রান্না করে দিয়ে যায়। এই নিয়ে অমরনাথের সঙ্গে মনোরমার প্রচণ্ড তর্ক হয়েছিল। মায়ের মুখের ওপর সচরাচর কথা বলেন না অমরনাথ। সেবার বিদ্রোহী হয়েছিলেন। ওইটুকুনি মেয়ে মাছ-মাংস ডিম পেঁয়াজ খাবে না এটা মানতে পারেননি। এই বয়সে শরীরে প্রোটিন দরকার। কিন্তু মনোরমা এসবে কান দিতে চাননি। হিন্দু মেয়ে বিধবা হলে বয়স কোন ব্যাপারই নয়। বিধবার যা যা করণীয় তাই তাকে করতে হবে। তা যদি না মানো তাহলে মন্ত্র পড়িয়ে বিয়ে দিয়েছিলে কেন? প্ৰায় ছয়মাস কোন বাক্যালাপ ছিল না মা-ছেলের মধ্যে। খুব কষ্ট হত দীপার। প্রথম প্রথম বাড়িতে মাছ-মাংস আসা বন্ধ হয়েছিল। দীপা খাবে না অথচ তাঁরা খাবেন, অমরনাথ ভাবতে পারতেন না। ফলে ছোট দুটো প্রায়ই অর্ধভুক্ত থাকত। মাছ ছাড়া ওদের চলে না। এইসময় একজন খুব অসুখে পড়ল। ডাক্তারবাবু হুকুম করলেন সিঙ্গি মাছের ঝোল খাওয়াতে। ফলে আবার মাছ এল বাড়িতে। সেইসময় একদিন একা পেয়ে অমরনাথ তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, হ্যারে, ঠাকুমার সঙ্গে নিরামিষ খেতে তোর খুব কষ্ট হয়, না? দুর্বল লাগে? বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে সে সত্যি কথা বলতে পারেনি, না তো! ঠাকুমা তো খুব ভাল রান্না করে। তারপর থেকেই আবার অমরনাথের সঙ্গে মনোরমার সম্পর্ক সহজ হয়ে গেল।

সুজিটা খেলি না কেন?

দীপা চমকে ফিরে দেখল। অঞ্জলি তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।

এমনি।

অঞ্জলি ওর কাঁধে হাত রাখল,  খেতে ভাল হয়নি?

খারাপ হয়নি। কথাটা বলেই অঞ্জলির দিকে তাকাল সে। মা এখন কিরকম ভারী ভারী হয়ে গিয়েছে। আগের মত হই চই করে না। চেঁচামেচিও কমে গেছে। অঞ্জলি যেমন এসেছিল তেমন চলে গেল চুপচাপ। শাড়ির আঁচলে কপাল মুছল দীপা। শীত চলে যেতে না যেতেই ঘাম হচ্ছে। সাদা আঁচলটা অবশ্য ভিজল না। এখন সে নিয়মিত কাপড় পরে। কালো সরু পাড় সাদা শাড়ি, সাদা জামা। মনোরমা বলেছেন বিধবাদের রঙিন শাড়ি পরতে নেই। মন চঞ্চল হয় এমন কোন কাজ করতে নেই। ঈশ্বরের দেওয়া এই শরীরটাকে পবিত্র রাখতে হবে মৃত্যু পর্যন্ত। আর এই কাজ সহজতর হবে। যদি উপযুক্ত কোন গুরুর কাছে দীক্ষা নেওয়া যায়। সব মেনে নিলেও এই একটা ব্যাপারে বেঁকে বসেছিল দীপা। দীক্ষা মানে নিয়মিত পুজো করে যাওয়া। যেটা সে কিছুতেই পারবে না। অমরনাথ মেয়ের সমর্থনে কথা বলেছিলেন বলেই বোধ হয় মনোরমা। এ নিয়ে জোর করেননি। সুবিধে হল ক্লাশ নাইনে উঠলেই স্কুলে মেয়েদের শাড়ি পরতে হয়। স্কুলের ইউনিফর্ম হল কালা সরু পেড়ে সাদা শাড়ি আর সাদা জামা। অতএর স্কুলে গিয়ে কোন অসুবিধে হয় না। দীপার। চার পাঁচজন মেয়ে যখন ওই একই পোশাকে বাড়ি ফেরে তখন কয়েকবার দেখেছেন অমরনাথ, কষ্টটা কমে গিয়েছিল।

এসব কথা রমলা সেনকে একসময় লিখেছিল দীপা। ভদ্রমহিলা চমৎকার চিঠি লিখেছিলেন। অপ্ৰাপ্তবয়স্ক এবং পরনির্ভর মেয়েদের পক্ষে নিজের মত প্ৰকাশ করা অনুচিত কাজ নয়। কিন্তু যতক্ষণ তুমি নিজের দায়িত্ব নিতে না পারছ ততক্ষণ গুরুজনদের মতামত মান্য করতেই হবে। তোমার বাবা-মায়ের মতামত যদি ঠাকুমা না শোনেন তাহলে তাঁর অবাধ্য হলে বাড়িতে শুধু অশান্তিই চলবে। মনে রেখ তুমি বিধবা নাও। একটি রোগগ্ৰস্ত তরুণের সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়েছিল। তার সঙ্গে মানসিক বা শারীরিক সম্পর্ক হবার আগেই সে চলে গিয়েছে। সংস্কৃতে ধব মানে স্বামী। যে তরুণ তোমার ধব হতে পারেনি সে চলে গেলে তুমি কেন বিধবা হবে? তা সত্ত্বেও তোমাকে এই পরিস্থিতি মেনে নিতে হবে কিছু দিনের জন্যে। নিরামিষ খেয়ে ভালভাবে বেঁচে আছেন এমন মানুষেব সংখ্যা পৃথিবীতে কম নেই। আর পোশাক? ওটা তো বাইরের ব্যাপার। পোশাক কখনও মানুষেব ভেতরটাকে তৈরী করে না। তোমার সামনে একটা পুরো জীবন পড়ে আছে। সাময়িক এই ব্যবস্থাটা মেনে নাও। এতে তো তোমার কোন ক্ষতি হচ্ছে না।

চিঠিটা অমরনাথকে দেখিয়েছিল দীপা। পড়ে তিনি হেসেছিলেন নিজের মনে। তারপরে বলেছিলেন, এই মহিলার সঙ্গে সারা জীবন যোগাযোগ রাখবে। উনি ঠিক কথাই লিখেছেন। এসব আমারই বলা উচিত ছিল অথচ কিভাবে বলব বুঝতে পাবিনি। তবে এই চিঠি তোমার ঠাকুমাকে দেখিও না।

উঠোন থেকে ফিরে এল দীপা পড়ারঘরে। টেস্ট পেপার নিয়ে বসতে গিয়ে জানলায় নজর গেল। বিশু আর খোকন সাইকেলে চেপে আসাম রোড দিয়ে যাচ্ছে। এক নিমেষেই ওরা চোখের আড়ালে চলে গেল। কতকাল আর ওদের সঙ্গে গল্প করা হয়নি। এ ব্যাপারে আর কেউ তাকে নিষেধ করেনি। কিন্তু নিজের থেকেই আর যেতে চায় না সে। মজার ব্যাপার হল ওরাত তাকে ডাকতে আসে না। স্কুল থেকে ফেরার সময় মাঝে মাঝে দেখা হয়। ওরা এমন ভাব করে চলে যায় যেন কোনদিন আলাপ ছিল না। কোন বাড়িতে যায় না সে। তার কোন বন্ধু নেই। হঠাৎ বুক কাঁপিয়ে কান্না এল দীপার। টেস্ট পেপারে মুখ চেপে সে চুপচাপ কেঁদে গেল কিছুক্ষণ। তারপর এক ঝটিকায় উঠে বসে আঁচলে মুখ পুছে পড়তে বসল।

গত কয়েক বছরে জায়গাটার চেহারা খুব দ্রুত বদলেছে। চৌমাথাকে কেন্দ্র করে এক নতুন জনপদ গড়ে উঠেছে। কাঠের ব্যবসায়ীরা ছিলেন। কিন্তু এখন তাঁদের সংখ্যা বেড়েছে। বেশ কয়েকটা সরকারি অফিস চালু হওয়ায় তাদের কর্মচারিরাত বাসা নিয়েছে। সেইসঙ্গে বাজার এলাকায় ব্যাঙ্ক, ফবেস্ট অফিস, পি ডব্লু ডি-র অফিস বসে যাওয়ায় জায়গাটার রমরমা বেড়েছে। সেলুন, রেস্টরেন্ট, ছোট হোটেল থেকে শুরু করে দু-দুটো লন্দ্রি চালু হয়ে গেছে চৌমাথায়। আর সেই কারণে একমাত্র স্কুলটিতে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা বেড়েছে। গত বছর থেকে এই স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা ফাইনাল পরীক্ষায় বসছে। চারজন ছেলে গিয়েছিল, দুজন থার্ড ডিভিসনে পাস করেছে, দুজন পারেনি। এবার সংখ্যাটি বেড়েছে, মোট ছাত্রছাত্রী বারোজন। স্কুলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট বিখ্যাত টিম্বর মার্চেন্ট অনিল চ্যাটার্জীর মেয়েও এই দলে আছে। সত্যসাধনবাবুর ইচ্ছে ছিল না তাকে ফাইন্যাল পরীক্ষায় বসতে দিতে। টেস্টে সে তিনটি বিষয়ে পাস করতে পারেনি। তার বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগও ছিল। সে ছাত্রীর মত আচরণ করে না। কিন্তু প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস হেডমাস্টারমশাই-এর ছিল না। সত্যসাধনবাবুর এখন একমাত্র বাসনা এই যে দীপাকে তিনি ফার্স্ট ডিভিসনে পাস করাবেনই। এই স্কুল থেকে যদি কেউ ফার্স্ট ডিভিসন পায় তাহলে কে ফেল করল তা নিয়ে লোকে আলোচনা করবে না।

স্কুল থেকে এবারও সত্যসাধনবাবু পরীক্ষার সময় জলপাইগুড়িতে যাবেন। প্ৰায় প্ৰত্যেক ছাত্রছাত্রীব সেখানে থাকবে ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে কিন্তু দীপার ব্যাপারে অমরনাথ মনঃস্থির করতে পারেননি। এমন কোন নিকট আত্মীয় সেখানে নেই যার বাড়িতে দীপাকে নিয়ে ওঠা যায়। সত্যসাধন প্ৰস্তাব দিয়েছিলেন তাঁর বোন-ভগ্নিপতি জলপাইগুড়ির শিল্পসমিতি পাড়ায় থাকেন, তাদের ওখানেই তিনি দীপার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। অমরনাথ কোন উত্তর দেননি। অথচ যাওয়ার সময় হয়ে এল। বিকেলবেলায় সত্যসাধনমাস্টার চা-বাগানের দিকে আসছিলেন হনহন করে। আসাম রোড দিয়ে একটা জিপ পাশ কাটিয়ে যেতে গিয়ে ব্ৰেক কষল। সত্যসাধন ঘুরে দাঁড়াতেই অনিলবাবুকে দেখতে পেলেন। ড্রাইভারের পাশে বসে অনিল চ্যাটার্জী নমস্কার করলেন, ভাল আছেন তো? এরকম দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছেন কোথায়?

সত্যসাধন বিনীত গলায় বললেন, এই একটু অমরনাথবাবুর কোয়ার্টার্সে।

ও। ওঁর মেয়ে নাকি খুব ভাল ছাত্রী। বিধবা মেয়েকে পড়িয়ে ভদ্রলোকের কি লাভ হচ্ছে বুঝি না। যে জন্যে দাঁড়ালাম, জলপাইগুড়িতে তো যাচ্ছেন, দেখবেন আমার মেয়েটা যেন ভাল ভাবে পরীক্ষা দেয়। মোটামুটি থার্ড ডিভিসন পেলেই হবে। মানে ডিভিসনের কোন দরকার নেই আমার। পাস করলেই একটা খুব ভাল পাত্র পাওয়া যাবে। ছেলেটির ইচ্ছে মেয়েকে অন্তত স্কুল ফাইন্যাল পাস হতে হবে, বুঝুন। অনিলবাবু হাসলেন।

মন দিয়া পরীক্ষা দিতে কন–!

আরে মশাই মন দিলেই যদি পাস করা যায় তো আমিও করতাম। পরীক্ষার সময় যদি গার্ডরা ওকে একটু সাহায্য করে এটা দেখবেন। আমিও থাকব সে-সময়। কোন অসুবিধে হলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবেন, আমি ব্যবস্থা করব। চলি। জিপটা আবোব গতি নিয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন সত্যসাধনমাস্টার। বাবা হয়ে মানুষটা কি মেয়েকে অসৎ উপায়ে পাস করাতে চান? সময় কি ভাবে পাল্টে যাচ্ছে! সত্যসাধনমাস্টারের মনে হল অশিক্ষিত কিছু মানুষ ব্যবসায়ের দৌলতে হাতে কাঁচা পয়সা পাচ্ছে বলেই মানুষের মেরুদণ্ডটি দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আজ থেকে তিরিশ বছর আগেও কেউ একথা বলতে পারত না। ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর ব্যাপারটা যেন দ্রুত বেড়ে চলেছে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না পেলে কোন জাতির মেরুদণ্ড গঠিত হতে পারে না। অর্থ যদি কয়েকটি অশিক্ষিত মানুষের হাতে সীমাবদ্ধ হয় তাহলে তো তারা তার বলে বলীয়ান হয়ে বেপরোয়া হবেই। আবার হাঁটতে শুরু করলেন সত্যসাধনমাস্টার। এবং তখনই তাঁর খেয়াল হল কথাগুলো ঠিক এইরকমভাবে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন তো? আজকাল এর কথা ওর মুখে, অথবা কখনও কখনও নিজের মনের কথা পছন্দসই মানুষের মুখে বসিয়ে দিচ্ছেন তিনি আজকাল। এটা ঠিক নয়। ছাত্রছাত্রীরা বিভ্রান্ত হবে।

বারান্দায় মোড়া পেতে অঞ্জলি বসেছিল। সত্যসাধনকে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল, আসুন মাস্টারমশাই, আপনার ছাত্রী এখনও পড়ার ঘরে।

সে কি! কি মুশকিল কথা। এই বিকাল বেলায় সে পড়তেছে, এটা ঠিক না।

কি বলব বলুন। এত করে বলি, কিন্তু কিছুতেই শুনবে না। এত পড়লে কি মাথা ঠিক থাকবে? আপনি তো জানেন ও মাছ-মাংস খায় না। শরীরে শক্তি পারে কি করে তা বুঝি না। আপনি একটু বুঝিয়ে বলুন। অঞ্জলি একপাশে সরে দাঁড়াল। সত্যসাধন বারান্দায় উঠে এসে পড়ারঘরের বন্ধ দরজাটা খুললেন। দীপা বই থেকে মুখ তুলে তাকিয়েছিল। সত্যসাধনবাবু বললেন, দিস ইজ ভেরি ব্যাড। কাম হিয়ার।

দীপা উঠল। লজ্জিত মুখে সে বাইরে এসে দাঁড়াল। হঠাৎ সত্যসাধনবাবু তার মাথার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তোমার উচ্চতা কত?

দীপা একটু অবাক হল, জানি না তো!

মাইপা দ্যাখ। এখনই।

মাপা হল। দীপা দেওয়ালে ঠেস দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। একটা স্কেল দিয়ে মাথার সমান্তরাল দেওয়ালে দাগ দেওয়া হল। অঞ্জলির লম্বা ফিতে দিয়ে মাটি থেকে সেই দাগ পর্যন্ত মাপা হল। পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি। সত্যসাধনবাবু মাথা নাড়লেন, ইস্পসিবল। দ্বিতীয়বার মাপ। এবারেও একই অঙ্ক পাওয়া গেল। সত্যসাধনবাবু বললেন, অবাক কাণ্ড! তুমি কখন এত লম্বা হইলা? আমি কত জানো? পাঁচ ফুট ছয়। অনলি তিন ইঞ্চি বেশী লম্বা। সত্যি অবাক কাণ্ড।

দীপা বলল, আপনি আমার চেয়ে এক জীবন বেশী লম্বা।

আঁ? তুমি এখনও কবিতার বই পড়তেছ? তোমারে নিষেধ করি নাই বিফোব ফাইনাল নো কবিতার বই! কি কাণ্ড।

আমি ছমাস আগে পড়েছিলাম।

কার কবিতা?

আপনি একটা পত্রিকা দিয়েছিলেন। তাতে ছিল।

বেশ। কিন্তু খুকী, এইরকম সুন্দর বিকালে তুই বই নিয়া বইস্যা থাকরা না। ঘাসে পা রাখবা। আকাশের নিচে একটু ঘুইর‍্যা বেড়াইবা। বুঝলা?

অঞ্জলি বলল, উনি আসছেন মাস্টারমশাই।

দেখা গেল অমরনাথ মাঠ পেরিয়ে সাইকেল নিয়ে চলে এসেছেন কোয়ার্টার্সের সামনে। মাস্টারমশাইকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন সাইকেল থেকে নেমে, কখন এলেন?

এই তো। অমরনাথবাবু, আপনে কি জানেন। আপনার দীপার উচ্চতা কত?

অমরনাথ অবাক হলেন সামান্য সময়ের জন্য। তারপর সপ্রতিভ গলায় জবাব দিলেন, উনত্রিশ হাজার তিনশ ফুট।

দীপা চিৎকার করে উঠল, এম্মা!

অমরনাথ বললেন, হিমালয়ের থেকে একটু বেশী। তাই না দীপা?

সত্যসাধন সশব্দে হেসে উঠলেন। দীপা লজ্জা পেয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। মনোরমা আসছিলেন, ওকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, কে হাসছে রে ওরকম ষাঁড়ের মত?

দীপা আঙ্গুল তুলল, দাঁড়াও, মাস্টারমশাই-এর সামনে বলব।

অ্যাঁ! ও বাবা। মাস্টারমশাই? তা এত হাসির কি হল?

জানি না। গিয়ে জিজ্ঞাসা কর।

মনোরমা একটু বিরক্ত হয়েই বাইরে এলেন। অঞ্জলি মাথার ঘোমটা টানল। তখন অমরনাথ বলছিলেন, সমস্যা অনেক মাস্টারমশাই। আপনার আত্মীয়ের বাড়িতে ওকে একা রেখে আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারব না। কি রকম পরীক্ষা দিচ্ছে—, বুঝতেই পারছেন?

তা ঠিক। কিন্তু দীপারে একটা ভাল জায়গায় রাখা দরকার। ওয়েসিস কিংবা রুবি বোর্ডিং-এ ঘর পাওয়া মুশকিল।

সেটা শুনলাম। কাল নবনীর বন্ধু এসেছিল জলপাইগুড়ি থেকে। সে বলল পবীক্ষার্থীরা নাকি ওই দুটো হোটেলে অ্যাডভান্স টাকা জমা দিয়ে প্রায় দখল করে নিয়েছে। মুশকিল হল হোটেলেও দীপাকে নিয়ে ওঠা যাবে না।

আমার আত্মীয়র বাড়িতে আপনাদের প্রব্লেম হইতে পারে। কিন্তু হোটেলে না থাকার কি কারণ তা বোঝলাম না।

মনোরমা এবার মুখ খুললেন, এটা তো খুব সহজ কথা মাস্টারমশাই। মেয়েটা বিধবা। হোটেলে পাঁচভূতেব ব্যাপার, মাছ-মাংসের ছোঁয়াছুয়ির বালাই নেই, ওখানে ও খাবে কি? ওর জন্যে তো আলাদা বাসনপত্রে কেউ রান্না করে দেবে না!

সত্যসাধনমাস্টারের থতমত ভঙ্গীটি লক্ষ করল অঞ্জলি। ভদ্রলোক বোধ হয় আজ পর্যন্ত জানতেন না যে মনোরমা দীপাকে চিবাচরিত বৈধব্যজীবনের খানিকটা মানতে বাধ্য করেছেন। তাঁকে গম্ভীর হয়ে যেতে দেখল অঞ্জলি। শেষপর্যন্ত তিনি বললেন, ঠিক আছে, আপনারা যা ভাল মনে করেন। তাই করুন। অন্তত দীপা যেন আনডিস্টার্বড পরীক্ষা দিতে পারে। সেইটা দেখবেন।

অমরনাথ বললেন, জলপাইগুড়িতে একটা বাড়ি কদিনের জন্যে ভাড়া নিতে চেয়েছিলাম আমি। নবনীর বন্ধু বলল অন্তত মাসখানেকের নিচে কেউ বাড়ি ভাড়া দেয় না। গায়ে লাগছে খুব। তবু ওকে বলেছি তাই ব্যবস্থা করতে।

যদি ব্যবস্থা না হয়? সত্যসাধনমাস্টার মুখ তুললেন, কিছু মনে কইরেন না, আপনি কিন্তু দায়িত্ব পালন করতেছেন না। আজ বাদ কাল তার পরীক্ষা আর এখনও কোন ব্যবস্থা হয় নাই! নো, ইটস নট ডান। সে আমার প্রিয় ছাত্রী তাই এত কথা কইলাম। আসি, নমস্কার। সত্যসাধন ফিরে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালেন। অঞ্জলি তাঁকে ডাকল, মাস্টারমশাই, আপনার বোন তো ওখানে আছেন, উনি কোন ব্যবস্থা করতে পারেন না?

দায়িত্ব যদি দ্যান তাহলে–।

ও তো আপনারই মেয়ে। আপনি না থাকলে আজ পরীক্ষা দেওয়া কি সম্ভব হত ওর পক্ষে? আপনি চলে যাবেন না। ওঁর সঙ্গে কথা বলুন। আমি চা আনছি।

সত্যসাধনমাস্টারের মুখ প্ৰসন্ন হল এখন। অমরনাথ বললেন, দীপা কোথায়? ওকে ডেকে দাও, ওর চিঠি আছে।

শিলিগুড়ি থেকে? অঞ্জলির প্রশ্নের মধ্যে ঈষৎ বক্রতা ছিল।

অমরনাথ বললেন, খুলে দেখিনি।

অঞ্জলি ভেতরে চলে গেলে মনোরমা বললেন, এটা ভাল করিস না অমর। মেয়ের যথেষ্ট বয়স হয়েছে। কে না কে চিঠি দিচ্ছে আর তুই তা বয়ে এনে ওকে দিচ্ছিস। বদমায়েস ছেলে ছোকরাত তো লিখতে পারে!

সেরকম কেউ লিখলে দীপা নিশ্চয়ই আমাকে বলবে।

বাঃ কি বুদ্ধি! শুনলেন মাস্টারমশাই? ওই বয়সে মতিভ্ৰম হতে আর কতক্ষণ সময় লাগে! মেয়ে তখন বাপকে বলবে। আমার মতিভ্ৰম হয়েছে?

সত্যসাধনমাস্টার বললেন, মা। একটা কথা কই। অমরনাথবাবু ঠিক কাজই করতেছেন। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।

এইসময় দীপা এসে দাঁড়াল। অমরনাথ তাকে খামটা এগিয়ে দিলেন। সে সবার সামনেই খামের মুখ খুলে দুটো কাগজ বের করল। প্রথমটা পড়ে নিয়ে দ্বিতীয়টা বাবার দিকে এগিয়ে দিল, এই চিঠিটা তোমাকে লিখেছেন উনি।

অমরনাথ চিঠিটা পড়লেন। তাঁর মুখে হাসি ফুটল। একবার সন্ধ্যার আকাশের দিকে তাকিয়ে সামান্য ভাবলেন তারপর বললেন, মাস্টারমশাই, একেই বলে যোগাযোগ। আপনি তো রমলা সেনের নাম শুনেছেন। দীপাকে খুব ভালবাসেন মহিলা!

শুনছি। তবে ওঁর সাজেশন ঠিক না। আগে ইজি অ্যানসার লিখলে ব্রেন ট্যাক্সড হয় না। কি লিখছেন তিনি?

অমরনাথ বললেন, জলপাইগুড়ির কোন হোটেলে পড়াশুনার আবহাওয়া কেমন থাকবে তা নিয়ে ওঁর সন্দেহ আছে। ওঁর পরিচিত এক ভদ্রলোকের অফিসের গেস্ট হাউস আছে বাবুপাড়ায়। আমরা সেখানে থাকতে পারি ইচ্ছে হলে। গেস্ট হাউসে দুটো ঘর আছে, নিজেরাত রাঁধতে পারি। আবার চৌকিদারকে বললে সে করে দিতে পারে। সময় বেশী হাতে নেই বলে তিনি তাঁর বন্ধুকে বলে দিয়েছেন চৌকিদারকে জানিয়ে দিতে। আমাদের যদি অন্য কোথাও ব্যবস্থা হয়ে থাকে তাহলে একবার চৌকিদারকে খবরটা দিলেই হবে। নইলে সরাসরি ওখানে উঠতে পারি। অমরনাথ থামতেই মনোরমা জিজ্ঞাসা করলেন, বন্ধু মানে? কিরকম বন্ধু?

অমরনাথ চট করে গম্ভীর হয়ে গেলেন, সেটা লেখেননি উনি।

অত বড় মেয়েছেলের আবার বন্ধু হয় কি করে! গেস্ট হাউস মানে কি?

অতিথিদের থাকার জায়গা।

ও বাবা। সেটা নিশ্চয়ই কোন মেয়ে বন্ধু রাখবে না। আমার ভাল ঠেকছে না। যতই ভাল চিঠি মেয়েকে লিখুক, যে মেয়েছেলে এত বছর বয়স পর্যন্ত বিয়ে করেনি তাকে আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। তার আবার বন্ধুও আছে।

হঠাৎ দীপা প্ৰতিবাদ করল, মেয়েছেলে মেয়েছেলে বলো না তো!

মনোরমা আকাশ থেকে পড়লেন, মানে?

মেয়েছেলে আবার কি কথা! মহিলা বলবে।

কেন? মেয়েছেলে বললে জাত যায় নাকি? জন্মভর লোকে আমাদের মেয়েছেলে বলে এল, কই আমার তো কখনও গায়ে লাগেনি। তোরা যেন ফোসকা পড়ল!

অমরনাথ বললেন, দ্যাখ, উনি ভদ্রতা করেছেন। আমাদের যখন থাকার জায়গা ঠিক হয়নি তখন ওই ভদ্রতার খাতিরে একবার সেখানে গিয়ে দ্যাখা দরকার। নইলে আগরওয়ালারা নতুন ধর্মশালা করেছেন সেখানেই উঠব।

সত্যসাধনমাস্টার জিজ্ঞাসা করলেন, গোস্ট হাউসের চার্জ কত?

ওটা নাকি ভাড়া দেওয়ার জন্যে নয়। তাই লিখেছেন উনি।

 

অঞ্জলির যাওয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু সে গেলে ছেলে দুটো সঙ্গে যাবে। তাদের সামলানো মনোরমার পক্ষে সম্ভব নয়। অতএর মনোরমাই সঙ্গে যাবেন। দুখানা ঘর যদি পাওয়া যায় তাহলে একটিতে নাতনি ঠাকুমা থাকবে অন্যটিতে অমরনাথ। কিন্তু যাওয়ার আগের দিন মনোরমা বেঁকে বসলেন। তিনি যেতে পারবেন না। ভোররাত্রে স্বপ্ন দেখেছেন তিস্তায় নৌকো ড়ুবি হচ্ছে এবং সেই নৌকোতে তিনি দীপার সঙ্গে বসে আছেন। অঞ্জলি বোঝাতে চাইল, স্বপ্নেবি সঙ্গে জীবনের মিল এক লক্ষে একবার হয়। কিনা সন্দেহ। মনোরমা বললেন, না বউমা। একটা নৌকোড়ুবি আমার জীবনটাকে ছারখার করে দিয়েছিল। স্বপ্নটা যখন দেখেছি তখন আর পা বাড়াচ্ছি না। তোমাকে কি বলব, আমি আর দীপা পাশাপাশি বসে জল দেখছি হঠাৎ মুখ তুলে দেখি তিনি। দু হাত দূরে নৌকোয় বসে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। সঙ্গে সঙ্গে ড়ুবে গেল নৌকো।

অঞ্জলির সমস্ত শরীরে কাঁটা ফুটল। মৃত মানুষেরা মাঝে মাঝে ভোরবেলায় স্বপ্ন দেখিয়ে হুঁশিয়ার করে দিয়ে যায় এমন গল্প সে অনেক শুনেছে। অমরনাথ চিন্তিত হলেন। নিজে কখনও উনুনের পাশে যাননি। তিনি। খাবার আনতে হলে হোটেলে যেতে হবে। সেটা মনোরমা জানলে কুকক্ষেত্র বাধরে। জলপাইগুড়িতে অবশ্য নৌকো এড়িয়েও যাওয়া যায়। তাতে প্রচুর সময় লাগে। বানান্ধহাট থেকে ট্রেনে চেপে শিলিগুড়ি, সেখান থেকে আবার ট্রেন পাল্টে জলপাইগুড়ি। পুরো একদিনের পথ। পরীক্ষার দুদিন আগে মেয়েটাকে এতখানি পবিশ্রম কবানো উচিত হবে কিনা বুঝতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত অঞ্জলি জানাল সে-ই যাবে। বাদব দুটোকে এমন শাসনে সেখানে রাখবে যে ওরা দিদিকে বিরক্ত করােব সাহস পারে না। মনোরমার মুখে হাসি ফুটল।

মনোরম আজ মাঠে নেমে এসেছিলেন। বুধুয়া বাসের মাথায় মালপত্র তুলে দেওয়ার পর আসনে বসে অঞ্জলি তাকে শেষবার বলল বাড়ি ছেড়ে কোথাও না যেতে। তারপরই তার নজরে পড়ল বড়বাবুর বাবা তেজেন্দ্র নিজেদের কোয়ার্টার্স ছেড়ে লুঙ্গি পরে গেঞ্জি গায়ে বেরিয়ে এসেছেন। ওর হাসি পেল। দীপা জিজ্ঞাসা করল, হাসছ কেন?

অঞ্জলি মাথা নাড়ল, এমনি।

দীপার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। লেডিস সিট খালি থাকার দৌলতে তারা বসতে পেরেছে। কিন্তু অমরনাথ মাথার ওপরে রডে হাত রেখে চলন্ত বাসে দাঁড়িয়ে আছেন। বাবাকে দাঁড় করিয়ে রেখে তারা বসে আছে এমন কাণ্ড কখনও ঘটেনি। সে মায়ের দিকে তাকাল। ব্যাপারটা অঞ্জলির মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া ঘটায়নি। সে খুব খুশী মুখে চা বাগান পিছিয়ে যেতে দেখছে। এই সময় ছোট ভাইটা জিজ্ঞাসা করল, অ্যাই দিদি, এই নদীটার নাম কিরে?

দীপা গম্ভীর মুখে জবাব দিল, আঙরাভাসা।

নৌকোয় বসেছিল অঞ্জলি কাঠ হয়ে। বালিতে পা দিয়ে বলল, বাঁচলাম বাবা।

দীপা জিজ্ঞাসা করল, কেন?

তোর ঠাকুমা স্বপ্ন দেখেছিল না?

ঠাকুমার আসার ইচ্ছে ছিল না বলে বানিয়ে বলেছে।

সে কি! কি করে বুঝলি?

বাঃ। আমি তো ঠাকুমার পাশেই শুয়েছিলাম। খারাপ স্বপ্ন দেখলেই ঠাকুমা ঠেলে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয়। কাল তো ভাঙায়নি। কথা বলতে বলতে লোকটার ওপর নজর পড়ল তার। পজিশ্বরাজ ট্যাক্সির সামনে দাঁড়িয়ে হকিছে, পাঁচ সিকে পাঁচ সিকে  জিনিসপত্র ততক্ষণে অন্য একটা ট্যাক্সিতে তুলে দিয়েছিলেন অমরনাথ। দীপা ছুটে গেল তাঁর কাছে, বাবা, আমাকে একটা আধুলি দেবে?

আধুলি? কি করবি?

দাও না। পরে বলব।

অমরনাথ পকেট থেকে খুচরো পয়সার দঙ্গল থেকে একটা আধুলি বের করে দিতেই দীপা ছুটে গেল লোকটার কাছে। ততক্ষণে সেই ট্যাক্সিতেও যাত্রী বোঝাই হয়ে গিয়েছে। ড্রাইভার স্টার্ট দিতে যাচ্ছিল। দীপা পাশে দাঁড়িয়ে বলল, এটা নিন।

নিন মানে? আট আনায় তো যাওয়া যায় না ভাই। আর জায়গাও নেই।

না। আমি যাব না। আপনি আমার কাছে আট আনা পান।

আমি? তোমার কাছে? অবিশ্বাসে লোকটা যাত্রীদের দিকে তাকাল। তাঁরাও এখন কৌতূহলী হয়েছেন। দীপা আঁচলটা টেনে ধরল। হ্যাঁ। অনেকদিন আগে আপনি আমাকে আট আনায় জলপাইগুড়ি থেকে এই ঘাটে এনেছিলেন।

খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে থেকে লোকটা নেমে এল গাড়ি থেকে, তোমার হাতে একটা ভারী স্যুটকেস ছিল? বিকেল হয়ে গিয়েছিল। তোমার সঙ্গে কেউ ছিল না, তাই তো?

দীপা মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

লোকটা হতভম্ব হয়ে গেল। তারপর বিড়বিড় করে বলল, কিন্তু সেদিন তোমার মাথায় সিঁদুর ছিল, হাতে শাঁখা ছিল। নতুন বউ মনে হচ্ছিল। এই গল্প আমি অনেকের কাছে করেছি। কিন্তু—।

এখন আর আমি বউটউ নই। আপনি আমার খুব উপকার করেছিলেন। এটা নিলে আমার ভাল লাগবে। দীপার কথা শেষ হওয়ামাত্র অমরনাথ তার পাশে এসে দাঁড়ালেন। ড্রাইভার তাঁকে দেখল, আপনার–?

মেয়ে।

ও। শোন, তুমি খুব ভাল। আমি কিছুই জানি না তোমার। কিন্তু এত বছর পরে তো আর ওই আধুলি নিতে পারব না। সেদিন যদি তোমার কাছে বাস ভাড়া ছাড়া বেশী পয়সা থাকত অবশ্যই নিতাম। আমরা কশাই লোক। কাউকে একটা পয়সাও ছাড়ি না। কিন্তু সেদিন আধুলিটা কম নিয়েছিলাম বলে আজও মনে মনে সুখ পাই। তুমি যদি সেটা আজ শোধ করে দাও। তাহলে আর সুখ থাকবে না।

তা হলে আপনার কাছে আমি ঋণী থাকব?

না। সেদিন কি তোমাকে বলেছিলাম। পরে দিয়ে দিও? বলিনি। তাহলে আর ঋণ বলছ কেন? মনে করো তোমার জন্যে আট আনাই ভাড়া ছিল। আচ্ছা, যেদিন তুমি আবার শাঁখা সিঁদুর পরে স্যুটকেস নিয়ে একা এই ঘাটে এসে আমার পঙ্খিরাজে উঠবে সেদিন সুদ সমেত শোধ করে দিও। কথা শেষ করেই লোকটা গাড়িতে উঠে বসল। তারপর বেশ রাগী মুখে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বালির ওপর ছুটে চলল কিং সাহেবের ঘাটের দিকে। প্রচণ্ড শব্দের সঙ্গে যে ধুলো উড়লো তাতে মুহুর্তেই গাড়িটা ঢাকা পড়ে গেল। অমরনাথ মেয়ের কাঁধে হাত রাখলেন, চল।

দুটো রিকশা করতে হল। ছেলেদের নিয়ে অমরনাথ সামনের রিকশায় বসেছিলেন। পেছনে বিষণ্ণ মুখে মায়ের পাশে দীপা। কোর্টকাছারি ছাড়িয়ে ডানদিকে সুভাষ বোসের মূর্তিটাকে রেখে রিকশা করলা নদীর ওপর কাঠের ব্রিজে উঠতেই ওপাশ থেকে একজন চিৎকার করে উঠল, ও মশাই, দাঁড়ান দাঁড়ান। আপনার নাম অমরনাথ, না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *