কলকাতার পুরনো হোটেল
মুখুজ্জেমশায় সেকালের ঝানু গোয়েন্দা পুলিশ। প্রায় দেড়শো বছর আগেকার কথা। তখন তো কলকাতার বাইরে হোটেল কিংবা থাকবার জায়গা বিশেষ ছিল না। লোকজনের যাওয়া-আসাও এত ছিল না। তাহলেও যাঁরা সরকারি চাকরি করতেন তাঁদের তো ঘুরে বেড়াতেই হত। থাকবার খাওয়ার ব্যবস্থা নিজেদেরই যথাসম্ভব করে নিতে হত, আরও কিছু বছর আগে কয়েক মাইল পরে-পরে চটি পাওয়া যেত, চটিতে থাকবার অনেক অসুবিধা ছিল। কোথাও কোথাও চটিদারের সঙ্গে ডাকাতদের ব্যবস্থা ছিল। সে-রকম চটিতে টাকা-পয়সা প্রাণ কিছুই নিরাপদে থাকত না। ধরা যাক, মুখুজ্জেমশায় সরকারি কাজে বর্ধমান জেলায় গিয়েছেন ডাকাত ধরতে। বেশির ভাগ সময় যাঁরা মুখুজ্জেমশায়ের মতো কাজ করতেন তাঁদের সঙ্গে কখনও-কখনও একজন লোক থাকত। সে রান্নাবান্নার সময় সব গুছিয়ে দিত, ফাই-ফরমাশ খাটত এবং ডাকাত ধরবার সময় সাহায্য করত। ইচ্ছা করলে অনেক সময় মুদির দোকানে এক রাত্রি দু-রাত্রি থাকা যেত। চাল ডাল নুন তেল কাঠ মুদির কাছ থেকে কিনতে হত। মুদিরা রান্নার বাসনও ভাড়া দিত। যেসব জায়গায় বড় বড় জমিদার ছিলেন সেখানে অতিথিশালা থাকত। সেখানেও আশ্রয় পাওয়া যেত, রান্না-করা খাবারও অন্দরমহল থেকে আসত, কখনও-কখনও দেবতার ভোগ। ব্রাহ্মণ অতিথি হলে একটু বাড়তি খাতির পাওয়া যেত।
ভারতবর্ষের অনেক জায়গায় ইংরেজদের শাসন তখন ভালভাবে গেড়ে বসেছে। ইংরেজদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। যুদ্ধবিগ্রহের জন্য লোক দরকার, শাসনের কাজের জন্যও অনেক লোক দরকার। তাছাড়া অনেক ইংরেজ তখন এদেশে বসতি আরম্ভ করেছিলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। এত লোকের থাকবার ব্যবস্থা কী-রকম ছিল? কলকাতায় কয়েকটি ভাল হোটেল ছিল। কলকাতার সবচেয়ে পুরনো হোটেল কী বলা মুশকিল, তবে অনেকদিন আগে কলকাতার দক্ষিণে ফলতা গ্রামে একটি ইংরেজি ধরনের হোটেল ছিল। এখানে হোটেল করবার অর্থ স্পষ্ট। তখন ইয়োরোপ থেকে অনেক জাহাজ ফলতায় এসে থামত। জাহাজের যাত্রীরা অনেক সময় ফলতায় রাত্রিটা কাটিয়ে যেতেন। বিশপ হিবার নামে একজন নামকরা পাদ্রি লর্ড আমহার্স্টের সময় এ-দেশে বেড়াতে এসেছিলেন। তিনি এ-হোটেলে থাকেননি। তাহলে এই হোটেলের ভাল বর্ণনা পাওয়া যেত। তিনি শুধু বলেছেন, এটি ইংরেজি ধরনের হোটেল। এছাড়া বিশেষ কিছু জানা তাঁর সম্ভব হয়নি। এই হোটেল কতদিন টিকেছিল তাও জানবার উপায় নেই।
বোধহয়, কলকাতার সবচেয়ে পুরনো হোটেল যা কয়েক বছর আগে পর্যন্ত টিকে ছিল তার নাম স্পেনসেস হোটেল। স্পেনসেস হোটেল রাজভবনের খুব কাছে। রাজভবনের উত্তর দেউড়ি থেকে সোজা বড় রাস্তা আগেকার ট্যাঙ্ক স্কোয়ার, পরের ডালহৌসি স্কোয়ার এবং বর্তমান বি বা দী বাগ পর্যন্ত চলে গিয়েছে। রাজভবনের দরজা থেকে চার-পাঁচ মিনিট হাঁটলেই রাস্তার বাঁ দিকে হোটেলের বড় বাড়ি। এখন দরজা বন্ধ, রাস্তার দিকে খানিকটা জায়গা টিন দিয়ে ঘেরা রয়েছে। এখানকার খাবারদাবার বেশ পুরনো, ইংরেজদের খাবারদাবারের মতো। শেষের দিকে দেখলে মনে হত, হোটেলটার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তারপর একদিন কর্মচারীদের ধর্মঘটের ফলে দরজা বন্ধ হয়ে গেল, আর খোলেনি। বিলেত থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে আসবার পরে মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই হোটেলে এসে উঠেছিলেন এবং কিছুদিন থেকেওছিলেন। আর একজনের কথা বলা যায়, তাঁকে অবশ্য খুব বেশি লোক জানতেন না। তিনি হব্সসাহেব। এক সময় সেনাবিভাগে চাকরি করতেন, পরে অবসর নিয়ে ডালহৌসি স্কোয়ারে একটি বাদ্যযন্ত্রের দোকান করেছিলেন। পুরনো কলকাতার উপর হব্সসাহেবের কয়েকটি বই আছে। বইগুলি সুখপাঠ্য। হব্সসাহেব বছর-পনেরো আগে মারা গিয়েছেন। তাঁকে অনেকে দেখেছেন, সন্ধ্যাবেলায় চৌরঙ্গি-পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে চৌরঙ্গির দিকে তাকিয়ে আছেন, লোকের আসা-যাওয়া দেখছেন।
আর একটি পুরনো হোটেল উইলসনসাহেবের হোটেল। এই শতাব্দীতে তার নাম বদলে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল হয়েছে। আর একটি হোটেল ছিল তার নাম ভুলে গিয়েছি, পুরনো কাগজপত্র থেকে উদ্ধার করা সম্ভব নয়। সিপাহিযুদ্ধের সময় এই হোটেলটির কথা পুরনো ইলাসট্রেটেড লণ্ডন নিউজ-এ দেখা যেত। হোটেলটি ধর্মতলা স্ট্রিটে (এখনকার লেনিন সরণি) রাস্তার দিকে ছিল। পুরনো কাগজের বর্ণনা পড়ে আমার অনুমান, এখন যেখানে ওয়াছেল মোল্লার দোকান তার খুব কাছে হতে পারে। হোটেলটি বেশি দিন চলেনি। বোধহয় এই শতাব্দীর প্রথম দিকেই তার অস্তিত্ব ছিল না। শনি-রবিবার একটু শান্তিতে কাটাতে হলে আগেকার ইংরেজরা চন্দননগরে যেতেন। সেখানে অন্তত দুটি চলনসই কিম্বা ভাল হোটেল ছিল। চন্দননগর তো অনেকদিন পর্যন্ত ফরাসি রাজ্যে ছিল। ফরাসিদের রাজনৈতিক ক্ষমতা লর্ড ক্লাইভ আসবার পরেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু চন্দননগরে গেলে মনে হত ইংরেজ-শাসনের বাইরে অন্য পরিবেশ। সেদিন পর্যন্ত চন্দননগরের উপর ফরাসিদের প্রভাব একেবারে লোপ পেয়ে যায়নি।
এইসব হোটেলে থাকা বড়লোক ছাড়া কারুর পক্ষে সম্ভব হত না। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে বড় হোটেলের থাকা-খাওয়ার খরচ ছিল দিনে দশ-বারো টাকা। তখনকার দিনে অবশ্য দশ টাকা অনেক টাকা। যেসব অল্পবয়সী ইংরেজ চাকরি নিয়ে এদেশে আসত তাদের নিজেদের মাইনে থেকে এ-টাকা দেওয়া সম্ভব ছিল না। তাদের অবশ্য টাকা পাওয়ার অনেক উপায় ছিল। জাহাজ ঘাটে দাঁড়ালে যারা ভিড় করে আসত তাদের মধ্যে অনেকের উদ্দেশ্য ছিল নতুন লোকদের কাছে চাকরি যোগাড় করে নেওয়া। আর আসতেন সরকাররা। তাঁরা ইংরেজদের টাকা ধার দিয়ে, বাড়ির আসবাবপত্রের ব্যবস্থা করে দিয়ে গুছিয়ে বসাতেন। বাড়তি টাকা তাঁরাই সুদে ধার দিতেন। তাঁদের টাকা বিশেষ মারা গিয়েছে বলে শুনিনি।
সাধারণ সৈন্যরা অবশ্য ফোর্ট উইলিয়মের ভিতরে ব্যারাকে থাকত। পরে ব্যারাকপুরে যখন ইংরেজদের ছাউনি হল তখনও অনেক সৈন্য সেখানে থাকত। কিন্তু যারা কেরানি হয়ে আসত, পরে অবশ্য দু-একজন গভর্নর-জেনারেল পর্যন্ত হয়েছেন, তাদের অনেক অসুবিধা ছিল। ট্যাঙ্ক স্কোয়ারের পূব দিকে কয়েকটি গলি ছিল, এখনও আছে। সেসব জায়গায় পানাহারের ব্যবস্থা ছিল। গলিগুলোর বিশেষ সুনাম ছিল না। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ইচ্ছা ছিল না যে তাদের অধীনে যারা কাজ করে তারা এইসব জায়গায় থাকে। যখন রাইটার্স বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে তখন সরকারের ইচ্ছা ছিল এইখানে কোম্পানির লোকজনরা বাস করবে, অফিসের কাজে ব্যবহার করা হবে না, কিন্তু থাকার জায়গার বদলে ঐটি কেরানিপাড়া হয়ে দাঁড়াল। একবার কেবল কিছুদিনের জন্য কোম্পানির লোকদের ওখানে থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল। যাই হোক, যে-উদ্দেশ্যে বাড়ি করা হয়েছিল সে-উদ্দেশ্য কিছুদিনের জন্য হলেও পূর্ণ হয়েছিল।
পরবর্তী কালে আরও বড় হোটেল হয়েছে, যেমন, গ্র্যাণ্ড হোটেল। চৌরঙ্গি-ধর্মতলার মোড়ে ছিল ব্রিস্টল হোটেল। এটি প্রধানত রেস্তোরাঁ, কেবল দু-একটি থাকবার ঘর ছিল। এই সব হোটেলে না থেকেও রেস্তোরাঁয় খাওয়া যেত। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার আগে পর্যন্ত কোথাও লাঞ্চ খেতে দেড় টাকার বেশি খরচ পড়ত না। যত ইচ্ছা খাওয়া যেত। কোনো-কোনো রেস্তোরাঁয় কুড়ি-পঁচিশ পদের বেশি খাবার দিত। এত বেশি পদ একসঙ্গে খাওয়া সম্ভব নয়। খরচ কিন্তু সেই দেড় টাকা। ১৯৩৯-৪০ সালে দেড় টাকা কি খুব বেশি টাকা হল? এত রকম খাবারের কথা ভাবলে সে-কথা বলতে ইচ্ছে করে না।
একটি অবিশ্বাস্য কথা বলি। যুদ্ধের সময় যখন কলকাতায় অনেক বিদেশী সৈন্যর ভিড় হয়েছিল তখন চৌরঙ্গির একটি বিখ্যাত রেস্তোরাঁ বিকালের কফি দিত। শুধু কফি নয়, তার সঙ্গে আবার এক প্লেট ছোট ‘সসেজ’। সবসুদ্ধ দাম চার আনা। ভাবতে পারো?