ছত্রপতির বংশধর
ছত্রপতি শিবাজি খুব বিচক্ষণ রাজা ছিলেন। কিন্তু তাঁর দুই ছেলে তাঁর এই গুণ পাননি। শিবাজি বেশিদিন বাঁচেননি। কোন্ সালে তাঁর জন্ম, তাও ঠিক করে বলা চলে না। ১৬২৭ হতে পারে, আবার কারও মতে ১৬৩০ সাল। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স প্রায় ষাট, কিংবা ষাটের একটু বেশি হয়েছিল। আওরঙ্গজেব আরও আঠারো বছর বেঁচে ছিলেন। শিবাজির বড় ছেলে শম্ভাজি সাহসী যোদ্ধা ছিলেন, কিন্তু তাঁর আর কোনো গুণ ছিল না। অনেকে বলত, তাঁর একজন বন্ধুর কুপরামর্শে তিনি অধঃপাতে যাচ্ছিলেন। বন্ধুটির উপাধি ছিল ‘কবিকুলেশ’ অর্থাৎ কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তখনকার লোকরা একটু বদল করে বলত ‘কবিকলুষ’, অর্থাৎ ‘পাপের কবি’। ন’বছর রাজত্ব করার পর শম্ভাজি আওরঙ্গজেবের একজন সেনাপতির হাতে ধরা পড়লেন। আওরঙ্গজেব তখন দাক্ষিণাত্যে। তাঁকে এবং তাঁর বন্ধুকে আওরঙ্গজেবের কাছে ধরে নিয়ে যাওয়া হল, এবং সম্রাটের সামনে তাঁদের মেরে ফেলা হল। এরপর শিবাজির ছোট ছেলে রাজারাম রাজ্যশাসনের ভার নিলেন। রাজারাম ঠিক রাজা নন, রাজার প্রতিনিধি। শম্ভাজির ছেলে শাহু মোগল-শিবির থেকে যদি ফিরে আসেন, তিনিই রাজা হবেন।
আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্য থেকে আর দিল্লি ফিরে যেতে পারেননি। আহ্মেদনগরের কাছে তাঁর মৃত্যু হয়। তখন ১৭০৭ সাল। ইতিমধ্যে মারাঠা অশ্বারোহীরা মোগল সাম্রাজ্যে ঢুকে খুব উৎপাত আরম্ভ করেছিল। মোগল সেনাপতি জুলফিকার খাঁ শাহুকে মুক্ত করে দিলে ফল খারাপ হবে না। মারাঠারা দুই দলে ভাগ হয়ে যাবে। নতুন সম্রাট আওরঙ্গজেবের বড় ছেলে মুয়াজ্জেম তখন প্রথমবাহাদুর শাহ নামে সিংহাসনে বসেছেন। মুক্তি পাবার সময় শাহু অঙ্গীকার করেছিলেন যে, তিনি মোগলের বশম্বদ হয়ে থাকবেন। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর মাস-তিনেক পরে তিনি নিজের রাজ্যে ফিরে এলেন। রাজারামেরও দিন শেষ হয়ে এসেছিল। জালনা দুর্গ থেকে মোগল সৈন্যের তাড়া খেয়ে পালিয়ে তিনি সিংহগড়ে এসে পৌঁছলেন। সেখানে মাসখানেক অসুস্থ থাকার পরে তাঁর মৃত্যু হয়।
জুলফিকার খাঁ যা ভেবেছিলেন তাই হল। রাজারামের বিধ্বা স্ত্রী তারাবাঈ রাজ্যের উপর দাবি ছাড়লেন না। শম্ভাজির দুষ্কৃতির ফলে সিংহাসনের উপর শাহুর দাবি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু প্রথম পেশোয়া বালাজি বিশ্বনাথ শাহুর পক্ষে ছিলেন। প্রধানত তাঁর সাহায্যে শাহু ক্ষমতাশালী হয়ে উঠলেন। তারাবাঈ নিজের জায়গা রাখতে পারলেন না। তিনি সাতারার দুর্গে প্রায় বন্দিনীর মতো থাকতে লাগলেন। শাহুর ছেলে ছিল না। তিনি দত্তক নেবার চেষ্টা করতে লাগলেন। তারাবাঈ বলে পাঠালেন যে, তাঁর নিজের বংশেরই তো একজন আছে, সেই হবে সিংহাসনের প্রকৃত উত্তরাধিকারী। তারও নাম রাজারাম। তারাবাঈ বললেন, তাকে খুব অল্প বয়স থেকে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। সে এতদিন এক গন্ধানি পরিবারে মানুষ হয়েছে। গন্ধানিদের পেশা হচ্ছে নাচ-গান করা। তরুণ রাজারামকে সাতারায় আনা হল। সাতারা দুর্গের নীচে তাঁর প্রাসাদ। তারাবাঈ তো স্বামীর নাম ধরে তাঁকে ডাকতে পারেন না, কাজেই তাঁর নাম একটু বদলে তাঁকে বলা হত রামরাজা। কিন্তু তাঁকে দিয়ে তারাবাঈয়ের ইচ্ছাপূরণ হল না। পেশোয়ার সঙ্গে লড়াই করবার শক্তি বা ইচ্ছা কোনোটাই তাঁর ছিল না।
তারাবাঈ এতে ভীষণ রেগে গেলেন। রামরাজা ও তাঁর স্ত্রীকে চম্পাষষ্ঠী ব্রত উপলক্ষে দুর্গে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে এলেন তিনি। খাওয়া-দাওয়া ভালই হল, কিন্তু রামরাজা দুর্গ থেকে বিদায় নিতে গিয়ে দেখলেন যে, তারাবাঈয়ের হুকুমে দুর্গের সব দরজা বন্ধ। বের হবার উপায় নেই। কেউ-কেউ বলেছেন, রামরাজার উচিত ছিল রক্ষীদের আক্রমণ করা। তারা নিশ্চয়ই শিবাজির বংশধরকে বাধা দিতে সাহস পেত না। দরজা খুলে দিত। এ-কথা হয়তো ঠিক। কিন্তু রামরাজা সে-ধরনের মানুষ ছিলেন না। তার বদলে তিনি তারাবাঈকে জিজ্ঞেস করতে গেলেন যে, তাঁর এ-রকম ব্যবহারের কারণ কী? তারাবাঈ দেখা করলেন না।
রামরাজার আর নিজের প্রাসাদে ফিরে যাওয়া হল না। তিনি সস্ত্রীক সাতারায় থাকতে লাগলেন। ধীরে-ধীরে এই পরিবেশের সঙ্গেই মানিয়ে নিতেও শিখলেন। তারাবাঈয়ের মৃত্যুর পরে রামরাজার অবস্থার উন্নতি হল, কিন্তু তাঁকে মুক্তি দেবার কথা কারও মনে হল না। সাতারায় বন্দী অবস্থায় থাকার সময় রামরাজা ও তাঁর বংশধররা শুনতেন যে, তাঁর সৈন্যরা সর্বত্র জয়ী হচ্ছে। তাঁর অশ্বারোহীরা পাঞ্জাব অতিক্রম করে গিয়েছে, মারাঠারাই উত্তর ভারতবর্ষের অধীশ্বর। পেশোয়া বছরে একবার এসে তাঁর কাছ থেকে রাজ্যশাসন ও যুদ্ধবিগ্রহের অনুমতি নিয়ে যেতেন। দুর্গের মধ্যে বসে শিবাজির বংশধর রাজ্যশাসনের খেলা খেলতেন।
রামরাজা ২৭-২৮ বছর এইরকম রাজা রাজা খেলা খেললেন। তাঁর ছেলে ছিল না বলে তিনি দত্তক নিয়েছিলেন। নাম রেখেছিলেন দ্বিতীয় শাহু। তাঁর রাজত্বকাল ছিল ১৭৭৭ থেকে ১৮১০ পর্যন্ত, অর্থাৎ ইংরেজরা যখন দক্ষিণ ভারতে খুব প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠেছিল। ১৮১০ সাল পর্যন্ত তিনি বেঁচে ছিলেন। দ্বিতীয় মারাঠা যুদ্ধে পেশোয়া তখন ইংরেজদের কাছে হেরে গিয়েছেন। ১৮০২ সালে বেসিনের সন্ধির ফলে পেশোয়ার ক্ষমতা অনেক কমে যায়। তাহলেও পেশোয়া প্রকৃতপক্ষে সাতারার রাজার প্রভু। সামান্য ব্যাপারেও রাজাকে পেশোয়ার কৃপার উপর নির্ভর করতে হত। তাঁর প্রার্থনা পূর্ণ হয় পেশোয়ার মর্জির উপরে। দু-একটি উদাহরণ দিচ্ছি। রাজার কর্মচারীদের পেশোয়া নিয়োগ করতেন। তাঁদের উপর রাজার ক্ষমতা সবসময় খাটত না। এমনও হয়েছে যে রাজা তাঁদের অপরাধের জন্য শাস্তি দিলে পেশোয়া সে-শাস্তি মকুব করে দিয়েছেন। একবার রাজার ইচ্ছা হল দুজন নর্তকীকে মাইনে দিয়ে রাখবেন। প্রত্যেকের মাইনে মাসিক চল্লিশ টাকা। পেশোয়া সম্মতি দিয়েছিলেন। আর একবার রাজপ্রাসাদে জল আনবার ব্যবস্থা হচ্ছিল। খরচ বেশি পড়বে বলে পেশোয়া এই ব্যবস্থা নাকচ করে দেন।
১৮১০ সাল থেকে সাতারার রাজা হলেন প্রতাপসিং। ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ বাধলে পেশোয়া দ্বিতীয় বাজীরাও ১৮১৭ সালে পুনে থেকে পালিয়ে গেলেন। পালাবার সময় সাতারা দুর্গ থেকে রাজা প্রতাপসিং ও তাঁর পরিবারের কাউকে-কাউকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। তার কারণ স্পষ্ট। ইংরেজরা যদি এই সুযোগে প্রতাপসিংকে মারাঠাদের রাজা বলে ঘোষণা করেন, তাহলে পেশোয়া অসুবিধেয় পড়ে যাবেন। এইভাবে কয়েক মাস ধরে ইংরেজ সৈন্যের কাছে হঠে গিয়ে পালাতে পালাতে ১৮১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পেশোয়ার সর্বনাশ হয়ে গেল। অষ্ঠির যুদ্ধে তাঁর সেনাপতি বাপু গোকলা, যাঁর উপর তাঁর সব আশা-ভরসা ছিল, মারা গেলেন। প্রতাপসিংকে ফেলে বাজীরাও পালিয়ে গেলেন। তাঁর ফেলে-যাওয়া এক কোটি টাকাও ইংরেজদের হাতে এল। এলফিনস্টোনের কাছে সাতারার রাজাকে রেখে জেনারেল স্মিথ পেশোয়াকে আবার তাড়া করে বেড়াতে লাগলেন। প্রতাপসিংয়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর এলফিনস্টোন লিখলেন, প্রতাপসিংয়ের আচরণ স্বাধীন রাজার মতো। এলফিনস্টোনকে দেখে আসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন না, নিচু হয়ে অভিবাদনও করলেন না। তাঁর ব্যবহার খুব ভদ্র, কথাবার্তা মার্জিত। তিনি দেখতে সুপুরুষ নন, বরং তাঁর ভাই তাঁর চাইতে দেখতে ভাল। তবে দুজনের চেহারার মিল আছে। তাঁদের মাকে দেখে এলফিনস্টোনের মনে হল, তিনি খুব বুদ্ধিমতী। একসময় সুরূপা ছিলেন বোঝা যায়। পেশোয়ার হাত থেকে মুক্তি পেয়ে প্রতাপসিং খুব আনন্দিত হয়েছেন বোঝা গেল। এপ্রিলের ১০ তারিখে সাতারায় প্রতাপসিংয়ের অভিষেক হল।
প্রতাপসিংয়ের সঙ্গে প্রথম দিকে ইংরেজদের সদ্ভাব ছিল। এল্ফিনস্টোন তাঁর গুণমুগ্ধ ছিলেন। বন্ধুর কাছে লেখা একটি চিঠিতে তিনি তাঁকে সবচেয়ে সভ্য মহারাষ্ট্রীয় বলে বর্ণনা করেছেন। ভেলভেটে মোড়া টেবিলের একদিকে বসে সাতারার রাজা নিজের হাতে চিঠি লিখছেন এবং অন্যান্য কাজ করছেন। এলফিনস্টোনের মনে হয়েছিল, এই দৃশ্য দেখলে শিবাজি কী ভাবতেন! এলফিনস্টোন বলেছেন, প্রতাপসিং যে-ভাবে রাজ্যশাসন করছেন তা যে-কোনো ইউরোপীয়ের পক্ষেই গর্বের বিষয় হত। বিখ্যাত ঐতিহাসিক জেম্স কানিংহাম গ্রান্ট ডাফ প্রায় তিন বছর সাতারার রাজার অভিভাবকের কাজ করেছেন। তিনি এই কাজ থেকে অবসর নেবার পর এলেন ক্যাপ্টেন ব্রিগ্স। তিনিও পরে ঐতিহাসিক হয়েছিলেন। প্রতাপসিং মহাবলেশ্বরে যাবার জন্য একটি পথ নির্মাণ করে দিয়েছিলেন এবং ইউরোপীয়দের জন্য সেখানে একটি গ্রীষ্মবাস। তার বদলে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি প্রতাপগড়ের বিখ্যাত শিবাজির ভবানী-মূর্তি রাজাকে ফেরত দিয়েছিলেন। তাঁর লেখাপড়ায় উৎসাহ ছিল, কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গেও তাঁর যোগ ছিল।
কিন্তু কোম্পানির সঙ্গে সদ্ভাব স্থায়ী হল না। কেউ-কেউ বলতে লাগলেন, তিনি কোম্পানির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। একবার খবর এসেছিল, প্রতাপসিং ও বিঠুরের নির্বাসিত পেশোয়া বাজীরাও ইংরেজের হাত থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টা করছেন। তখন কিন্তু এই কথা কেউ বিশ্বাস করেননি। কিন্তু যে-কারণেই হোক, অবশেষে প্রতাপসিংয়ের রাজত্ব গেল। ১৮৩৯ সালে তাঁকে সরিয়ে দিয়ে তাঁর ভাই শাহজিকে রাজা করা হল।
প্রতাপসিংয়ের রাজ্য যখন কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, তখন তিনি প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিলেন। কাগজপত্রসমেত ইংল্যাণ্ডে দূত পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু কোনো ফল হয়নি। দূতদের একজন দরকারি কাগজপত্র আর অনেক টাকা নিয়ে অন্তর্ধান করেছিলেন। প্রতাপসিংয়ের সঙ্গে কোম্পানি ভাল ব্যবহার করেনি। যে ইংরেজ কর্মচারী তাঁকে কাশী নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি সমস্ত পথ তাঁর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিলেন। প্রতাপসিং কিন্তু শেষ পর্যন্ত আশা ছাড়েননি। জর্জ টমসন নামে একজন ইংরেজ সাংবাদিককে বিলেতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে জর্জ টমসনকে অনেকে জানত। কিন্তু তাতে কিছু কাজ হল না। বারাণসীতে অবহেলার মধ্যে শিবাজির বংশধরের মৃত্যু হল। প্রতাপসিংয়ের ভাই শাহজির মৃত্যুর পর সম্পূর্ণ সাতারা ইংরেজদের হাতে এসে যায়। শিবাজির রাজত্বের আর কোনো চিহ্ন রইল না।