মোগল-দরবারে ইংরেজ ডাক্তার
৪ জুলাই, ১৭১৫ সাল। দিল্লি শহরের বাইরে হুমায়ুনের সমাধির কাছে বাদশাহ ফররুখশিয়ারের একজন কর্মচারী ২০০০ সৈন্য ও দুটি হাতি নিয়ে সকাল থেকে অপেক্ষা করছিলেন। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি কলকাতা থেকে বাদশাহর কাছে দরবার করবার জন্য একটি ছোট দল পাঠিয়েছিলেন। সেই দলের সেদিন দিল্লি পৌঁছবার কথা। ইংরেজদের ইচ্ছা ছিল, তাদের যেন ভাল করে অভ্যর্থনা করা হয়, এবং ধুমধাম করে শহরের ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তারা যেন ধুলোপায়ে বাদশাহর সঙ্গে দেখা করতে পারে। বাদশাহর সঙ্গে দেখা করে তারা যে যার থাকবার জায়গায় চলে যাবে।
ইংরেজদের তো বাজনা-টাজনা বাজিয়ে, শোভাযাত্রা করে দিল্লির লালকেল্লায় নিয়ে যাওয়া হল। পৌঁছতে বেলা প্রায় দুপুর। দরবারে ইংরেজরা বাদশাহর কাছে কলকাতার গভর্নরের চিঠি পেশ করলেন, ১০০১ মোহর নজরানা দিলেন। তার সঙ্গে আরও অনেক উপঢৌকন। ভালয় ভালয় ইংরেজরা কাজ আরম্ভ করলেন বটে, কিন্তু গোড়ায় গলদ ছিল, তাই শেষ রক্ষা হতে দেরি হল। সে-কথা বুঝতে হলে আগেকার কিছু ঘটনা জানা দরকার।
বাদশাহ আওরঙ্গজেব ১৭০৭ সালে মারা গেলেন। ইংরেজরা তখন অনেকটা গুছিয়ে বসেছে। সম্পত্তি রক্ষা করতে গেলেই দুর্গ গড়তে হয়। দুর্গ রাখতে হলে অনেক টাকা খরচ। সে-টাকা কোথা থেকে আসবে? তখন নতুন ব্যবসা। লাভও করব, এত খরচও করব, তা সম্ভব নয়। একটা বাড়তি উপায়ের ব্যবস্থা করা দরকার। বাড়তি টাকা আসতে পারে, যদি দুর্গের কাছে অনেকটা জমি পাওয়া যায়। তার জন্য দিল্লির বাদশাহর অনুমতি দরকার। সুবে বাংলায় একজন শাসনকর্তা অবশ্যই ছিলেন, মুর্শিদকুলি খাঁ। তাঁকে ইংরেজদের বন্ধু বলে চলে না। পরস্পরকে তাঁরা সন্দেহের চোখে দেখতেন।
আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর তিন বছরের মধ্যে ইংরেজরা এ নিয়ে কথা শুরু করে; কিন্তু কাজ তখনও কিছু এগোয়নি। বাহাদুর শাহর পরে তাঁর বড় ছেলে জাহান্দার শাহ্ সম্রাট হয়েছিলেন। জাহান্দার শাহ্ কিন্তু ঠিক বাদশাহ হবার উপযুক্ত লোক ছিলেন না। এক বছরেই তাঁর রাজত্ব শেষ হয়ে গেল। তারপর জাহান্দার শাহর ভাই আজিম-উস্-সানের ছেলে ফররুখশিয়ার সম্রাট হলেন। তিনিও কোনো কোনো বিষয়ে একটু অদ্ভুত ছিলেন। তিনি ও তাঁর বাবা, দুজনেই ইংরেজদের পছন্দ করতেন। ফররুখশিয়ার বিলিতি খেলনা ভালবাসতেন। বড় হয়েও ফররুখশিয়ার খেলনার লোভ ছাড়তে পারেননি। ইংরেজদের মনে হয়েছিল, অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে সম্রাটকে কিছু বিলিতি খেলনা উপহার দিলে কাজের সুবিধা হতে পারে। ফররুখশিয়ারের রাজত্বের প্রথম দিক থেকে দিল্লিতে লোক পাঠাবার তোড়জোড় হচ্ছিল। মুর্শিদকুলি খাঁ এ ব্যাপার পছন্দ করছিলেন না। ইংরেজরা দিল্লি থেকে বাদশাহর হুকুম আনালেন যে, মুর্শিদকুলি খাঁ যেন কোনোভাবে তাঁদের বাধা না দেন।
ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ থেকে দিল্লিতে কাদের পাঠানো হবে, তাই নিয়ে কিছু আলোচনা চলছিল। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল, যাঁরা কাউন্সিলের সদস্য, তাঁদের না-পাঠানোই ভাল। কে জানে, বাদশাহ কিংবা তাঁর ওমরাহরা তাঁদের সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করবেন। শেষ পর্যন্ত যাঁদের পাঠানো হল, তাঁদের নাম জন্ সারমন, এডওয়ার্ড স্টিফেনসন, হিউ বারকার ও ডাক্তার উইলিয়াম হ্যামিলটন। এঁদের মধ্যে জন্ সারমন এই দলের নেতৃত্ব করেন। কিন্তু দেখা গেল, ডাক্তার হ্যামিলটনকে দিয়েই কোম্পানির কাজ হয়েছে।
দরখাস্ত পেশ করতে হলে রীতি হচ্ছে উপযুক্ত মানের উপহার দিতে হয়। কোম্পানি অনেক ভেবে বাদশাহকে যে উপহার দেবেন ঠিক করেছিলেন, তার দাম এক লাখ দু’ হাজার টাকার কিছু বেশি। দরবারের ওমরাহদের জন্য যেসব জিনিসপত্র সঙ্গে নেওয়া হল, তার দামও এক লাখ আট হাজার টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তা ছাড়া সারমন ও সঙ্গীদের খরচের জন্য প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা ধরা হয়েছিল। এই দলের সঙ্গে কিছু কাপড়চোপড় পাঠানো হল, যা বিক্রি করে কিছু টাকা পাওয়া যেতে পারে। পথ-খরচার টাকার অভাব হবে না।
ইংরেজরা বাদশাহর দরবারের আদব-কায়দা ভাল করে জানতেন না। সেখানে সত্যিকারের কিছু ক্ষমতা ছিল যাঁদের, তাঁরা দুই ভাই, আবদাল্লা আর হুসেন। সমস্ত দরখাস্ত পেশ করতে হত উজির আবদাল্লা খানের কাছে। তাঁর বদলে ইংরেজরা যাঁর কাছে দরখাস্ত পেশ করেছিলেন, তাঁর বিশেষ কোনো ক্ষমতা ছিল না। ইতিমধ্যে আর-এক বিপদ উপস্থিত হল। বাদশাহ ফররুখশিয়ারের স্বাস্থ্য কোনোদিনই ভাল ছিল না। এই সময়েই তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাদশাহর বিয়ের দিন ঠিক হয়েছিল, কিন্তু অসুখের জন্য সে-তারিখ পিছিয়ে যেতে লাগল। দরবারের হাকিমরা কিছুই করতে পারলেন না। শেষে ওমরাহদের একজন বললেন, ইংরেজদের সঙ্গে তো একজন ডাক্তার আছে, তাকে দিয়েই বাদশাহর চিকিৎসা করানো যাক। এ-ব্যবস্থাও সবার ভাল লাগেনি। ইংরেজদের চিকিৎসায় বাদশাহর অসুখ সত্যি যদি সেরে যায়, তাহলে হাকিমরা তো মুখ দেখাতে পারবে না। একজন আবার বললেন যে, আগে একজন বড় কর্মচারীকে ওষুধ খাইয়ে দেখা যাক কী হয়। যাঁর নাম করা হল, তিনি বাদশাহর খান-ই-সামান। তিনি কিছুতেই ওষুধ খেতে রাজি হলেন না। যার অসুখ করেনি, তাকে ওষুধ খাইয়েই বা কী বোঝা যাবে? অবশেষে ডাক্তার হ্যামিলটনকে ডাকা হল। তাঁর চিকিৎসায় বাদশাহ ধীরে ধীরে ভাল হয়ে উঠলেন, কিন্তু ঠিক সেরে উঠতে মাস-দুই লাগল। তখন আবার বিয়ের ধুম লেগে গেল। ইংরেজরা আর বাদশাহর নাগাল পান না।
ইংরেজরা প্রথমে বুঝতে পারেননি যে, বাদশাহর কাছে দরখাস্ত পাঠাতে হলে ঠিক লোকের হাতে দিতে হয়। সেই লোক বাদশাহর উজির। দরখাস্ত প্রথম পাঠানো হয়েছিল ১৭১৫ সালের আগস্ট মাসে। ইংরেজরা যা প্রার্থনা করেছিলেন, তা মোটামুটি এই: পূর্বে ইংরেজদের যেসব সুবিধা দেওয়া হয়েছিল সেগুলি যেন বজায় থাকে। অর্থাৎ বাংলা বিহার ও ওড়িশায় তাঁরা যেন অবাধে বাণিজ্য করতে পারেন। তার জন্য নামমাত্র কর দিলেই চলবে। তিনটি গ্রাম—সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও কলকাতা তাঁরা খাজনা দিয়ে ভোগ করতে পারবেন। এ দুটি পুরনো ব্যাপার। এই সুবিধা ইংরেজদের দেওয়াই হয়েছিল, কিন্তু বাদশাহর কাছ থেকে ফরমান পেলে ব্যাপারটা আরও পোক্ত হয়। ইংরেজরা নতুন করে চাইলেন, যেন এই তিনটি গ্রামের মতো কলকাতার কাছে আরও ৩৮টি গ্রাম তাঁদের এইরকম শর্তে দেওয়া হয়। তা ছাড়া চাওয়া হল পাটনার ফ্যাক্টরির জন্য ১৩ একর জমি।
আরও প্রস্তাব ছিল। কলকাতার নাম বদলে ফররুখ-বন্দর রাখা হবে, আর ৩৮টি গ্রাম ইংরেজদের দিলে তাঁরা তার সঙ্গে সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও কলকাতাকে যোগ করে গোটা এলাকাকে ফররুখাবাদ নাম দেবেন। বোধহয় মনে করা হয়েছিল, এইসব প্রস্তাবে বাদশাহ খুশি হবেন। কিন্তু কলকাতার নাম বদলে ফররুখ-বন্দর করা কিংবা ফররুখাবাদ নামে একটি আলাদা পরগনা করার প্রস্তাবে বাদশাহ রাজি হলেন না। ভাবলেন, এতে পরে অনেক অসুবিধা হতে পারে। ইংরেজরা আশা করেছিলেন যে, বাদশাহ দরখাস্ত হাতে পেলেই ফরমান জারি করে দেবেন। তা কিন্তু হল না।
পরের বছর জানুয়ারি মাসের শেষে ইংরেজরা আর-একটি দরখাস্ত করলেন। দ্বিতীয় দরখাস্তে দুটি নতুন প্রার্থনা ছিল। একটি হচ্ছে ইংরেজদের যেন বোম্বাইতে একটি টাঁকশাল করতে দেওয়া হয়। আর একটিতে বলা হয়েছিল যে, কলকাতায় দুর্বৃওরা এসে খুব উপদ্রব করে, তাদের যেন দমন করবার ব্যবস্থা হয়। প্রায় তিন মাস অপেক্ষা করার পর মার্চ মাসে ইংরেজদের দ্বিতীয় দরখাস্ত ফেরত দেওয়া হল। বলা হল, ওটা উজিরের হাত দিয়ে আসা উচিত, নাহলে কিছু করা যাবে না। পরের বছর ইংরেজরা উজিরের হাত দিয়ে তৃতীয় দরখাস্ত পাঠালেন। এবার তাড়াতাড়ি কাজ হতে লাগল। বাদশাহকে বলা হয়েছিল যে, ইংরেজরা বিরক্ত হয়ে সুরাটের ব্যবসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে পারেন। ইংরেজদের সুরাটের ব্যবসায় বাদশাহের বেশ লাভ হত। অবশেষে ১৭১৭ সালে বাদশাহ ফরমান জারি করলেন। সেই ফরমানে বাদশাহের মোহরের ছাপ পড়ল। তারপর উজিরের মোহর পড়ল। কিন্তু মে মাসের আগে ইংরেজরা দিল্লি ছাড়তে পারলেন না। ইতিমধ্যেই দু পক্ষের কিছু উপহার দেওয়া-নেওয়া হয়েছিল। ফররুখশিয়ার খুব ভালবাসতেন ঘোড়া। তিনি সারমনকে অন্য জিনিসের সঙ্গে একটি ঘোড়া উপহার দিলেন। শেষ মুহূর্তে আবার একটি বিপদ ঘটতে পারত। বাদশাহকে কেউ কেউ বুঝিয়েছিলেন যে, ডাক্তার তো ফিরে যাবেন, সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বাদশাহর আবার অসুখ হলে কী হবে? ডাক্তার হ্যামিলটনকে রেখে দেওয়া হোক। ডাক্তার হ্যামিলটন এই বলে ছাড়া পান যে, তিনি বিলেত গিয়ে স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে দেখা করবেন। তারপর বাদশাহর জন্য ভাল ওষুধ যোগাড় করে পাঠাবেন। এর পর বাদশাহ আর আপত্তি করলেন না।
ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিকে যে ফরমান দেওয়া হয়েছে, এ খবর আগেই কলকাতায় পাঠানো হয়েছিল। কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ও চারজন সদস্য কলকাতা থেকে কিছু দূরে ত্রিবেণীতে এসে সারমন ও তাঁর সঙ্গীদের অভ্যর্থনা করলেন। সারমন যে-সব প্রার্থনা করেছিলেন, তার সব বাদশাহ মঞ্জুর করেননি। কিন্তু অনেকগুলি করেছিলেন। ইংরেজরা আগেকার মতো বাংলা, বিহার ও ওড়িশায় ব্যবসা করতে পারবে। তার জন্য তিন হাজার টাকা ছাড়া আর কিছু দিতে হবে না। কলকাতার চারদিকে তাদের অনেকটা জায়গা দেওয়া হল। হায়দরাবাদেও আগেকার মতন ব্যবসা চলবে। যা কর তারা দিত, শুধু তাই দিতে হবে। সুরাটে সবরকম কর ও মাশুলের বদলে বছরে তারা ১০ হাজার টাকা দেবে। বোম্বাইতে টাঁকশালে যে টাকা ছাপা হবে, তা সাম্রাজ্যের সব জায়গায় চলবে।
একশো বছর আগে জাহাঙ্গিরের আমল থেকে ইংরেজরা ব্যবসা করবার অনুমতি ও নানারকম সুবিধা খুঁজছিল। কিন্তু বাদশারা যা-ই বলুন না কেন, তখন যাঁরা প্রদেশের সুবেদার ছিলেন, তাঁদের উপরে অনেকটা নির্ভর করত। সুবেদারের হাত শক্ত থাকলে তাঁরা বিদেশীদের অনেকভাবে বাধা দিতে পারতেন। দিল্লি অনেক দূরের পথ। তা ছাড়া দিল্লির বাদশাহের সিংহাসন এত টলমল করত যে সুবেদারকে চটিয়ে ইংরেজদের কোনো লাভ হত না। পলাশির যুদ্ধে জিতে ইংরেজদের অনেক সুবিধা হল বটে, কিন্তু ইংরেজদের সঙ্গে বাংলার নবাবের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে বিরোধ আরও কয়েক বছর ধরে লেগেই রইল। তার অনেক আগেই ফররুখশিয়ারের মৃত্যু হয়েছে। পরে যাঁরা বাদশা হলেন, তাঁদের শাসন তো নামেমাত্র শাসন। তাঁদের মর্জিমতন কাজ-কারবার করার কোনো দরকারই ইংরেজদের ছিল না।